সুজন কর্মকার
১
কলকাতার এক শীতল বিকেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অডিটোরিয়ামে জমে উঠেছিল এক বিশেষ বক্তৃতা। উপস্থিত দর্শকদের ভিড় ভরিয়ে দিয়েছিল সাদা দেয়ালঘেরা হলে, যেখানে একদিকে ছাত্রছাত্রীরা তাদের খাতায় দ্রুত নোট নিচ্ছিল, অন্যদিকে কিছু অধ্যাপক কপালে ভাঁজ ফেলে মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। মঞ্চে দাঁড়িয়ে ছিলেন ড. অরিত্র মুখার্জী—একজন প্রখ্যাত পদার্থবিদ, যিনি গবেষণায় যেমন কড়া, তেমনি মতামতে দৃঢ়। লম্বাটে চেহারা, নাকের উপর সোনালি ফ্রেমের চশমা, আর হাতে একটি সাদা চক—এমন ভঙ্গিমায় তিনি যেন একাই এক অদম্য শক্তি। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল স্বচ্ছ, কঠিন অথচ প্রলুব্ধকর। তিনি বোর্ডে জটিল সমীকরণ লিখে বলছিলেন, “এই মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটছে, তার পেছনে আছে গণনা, সূত্র, এবং ব্যাখ্যাযোগ্য পদার্থবিদ্যা। অলৌকিক বলে কিছু নেই, তন্ত্র-মন্ত্র আসলে কেবল ভয় আর অজ্ঞতার ফাঁদ।” তিনি মুহূর্তে একরাশ উদাহরণ টেনে আনলেন—মধ্যযুগের গ্রহের গতিপথ বোঝার ভুল, সূর্যের গ্রহণ নিয়ে ভীতির গল্প, কিংবা রোগ নিরাময়ে অযৌক্তিক প্রার্থনা। তাঁর যুক্তি ছিল অটল—“অলৌকিকতায় আস্থা রাখলে আমরা বিজ্ঞানের অগ্রগতি থামিয়ে দেব।” ছাত্রছাত্রীদের ভিড় হাততালি দিয়ে সায় জানাল, করতালির শব্দে অডিটোরিয়াম কেঁপে উঠল। কিন্তু সামনের সারিতে বসা কয়েকজন প্রবীণ মানুষ—চোখেমুখে জীবনের অভিজ্ঞতার ছাপ—কোনো হাততালি দিল না। তাদের মুখে এক অদ্ভুত বিরক্তি, কেউ ফিসফিস করে উঠল, “এ ছেলেটা বড় বেশি জানে, অথচ কিছুই বোঝে না।” তাদের নিঃশব্দ বিদ্রোহ যেন অডিটোরিয়ামের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই ডুবে গেল করতালির ঢেউয়ে।
সেই মুহূর্তেই দর্শকসারির পেছনে বসে ছিলেন অনন্যা সেন, বয়সে তরুণী কিন্তু স্বভাবে দৃঢ়চেতা এক সাংবাদিক। কলম হাতে তিনি প্রতিটি শব্দ লিখে নিচ্ছিলেন, যেন এগুলোই কালকের শিরোনাম। তিনি সংবাদপত্রে কাজ করতেন, আর তাঁর বিশেষত্ব ছিল বিতর্কিত বিষয় খুঁজে বের করে সমাজের সামনে তুলে ধরা। অরিত্রর কথাবার্তা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল, আবার কৌতূহলও বাড়িয়েছিল। অনন্যার মনে হচ্ছিল—একদিকে এমন এক মানুষ যিনি অটল যুক্তিতে বিশ্বাসী, অন্যদিকে তার বক্তব্যে আঘাত পাওয়া বহু মানুষের অচেনা আবেগ। এই দ্বন্দ্ব থেকেই জন্ম নেয় খবর, জন্ম নেয় গল্প। তাঁর চোখে ধরা পড়ছিল ছাত্রদের উচ্ছ্বাস, কিন্তু একইসঙ্গে প্রবীণদের অস্বস্তিও। তিনি বুঝতে পারছিলেন, এই বক্তৃতা এখানেই শেষ নয়, এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে আরও দূরে। অনন্যা খাতায় নোট লিখতে লিখতে ভাবলেন—“যদি কেউ এই বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে, তবে খবরের পর খবর তৈরি হবে।” তাঁর সাংবাদিকতা শুধু কলমের নয়, মানুষের ভেতরের কণ্ঠস্বর শোনারও। অডিটোরিয়াম থেকে বেরিয়ে আসার সময় তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন, এই যুক্তি-অলৌকিকতার দ্বন্দ্বের পেছনের সত্য উদঘাটন করতেই হবে।
অন্যদিকে, বক্তৃতা শেষে যখন ভিড় কমে এল, অরিত্র একাকী বসে নিজের খাতা গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। ছাত্ররা এসে তার কাছে ধন্যবাদ জানাচ্ছিল—“স্যার, আপনি আমাদের চোখ খুলে দিলেন।” কিন্তু অরিত্রর চোখে ছিল এক অদৃশ্য অহংকার, যেন তিনি নিজেকে এক যোদ্ধা ভাবছেন, যিনি অন্ধকারের বিরুদ্ধে মশাল হাতে লড়ছেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, তিনি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু বাইরে যে ঠান্ডা বাতাস বইছিল, সেখানে যেন একটা চাপা অশান্তি লুকিয়ে ছিল। হলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রবীণ মানুষগুলো ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছিল, কারও চোখে ক্ষোভ, কারও চোখে অবজ্ঞা। একজন দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, “শুধু গণনা আর সূত্র দিয়ে সব বোঝা যায় না, বোকা ছেলেটা টের পাবে।” অরিত্র এসব শোনেননি, কিংবা শুনলেও পাত্তা দিতেন না। তাঁর কাছে বিজ্ঞানই শেষ কথা, অন্য সবকিছু ভ্রান্ত। ঠিক তখনই অডিটোরিয়ামের দরজার ফাঁক দিয়ে অনন্যার দৃষ্টি তাঁর ওপর পড়ল। সাংবাদিকের অন্তর্দৃষ্টি তাঁকে বলছিল—এই মানুষটির জীবনে খুব শিগগিরই এমন এক দ্বন্দ্ব আসছে, যা তাঁর সব যুক্তি কাঁপিয়ে দেবে। অনন্যার কলম থামল না; তিনি জানতেন, আজকের এই বক্তৃতা কেবল এক শুরুর ইঙ্গিত। ভবিষ্যতের গল্প আরও ভয়ঙ্কর, আরও আকর্ষণীয়।
২
বক্তৃতার কয়েকদিন পরেই কলকাতার পত্রিকা আর টিভি চ্যানেলগুলোতে হইচই পড়ে গেল। অরিত্র মুখার্জীর যুক্তি, তার তীব্র বক্তব্য—“তন্ত্র-মন্ত্র মানে ভণ্ডামি”—শিরোনামে ছাপা হলো বড় বড় হরফে। কেউ সমর্থন করল, কেউ আবার তীব্র সমালোচনায় মুখর হলো। ঠিক এই সময়েই শহরের আড়ালে, পুরোনো এক আশ্রম থেকে খবর ছড়িয়ে পড়ল—প্রখ্যাত তান্ত্রিক রুদ্রনাথ, যিনি বহু বছর ধরে অদৃশ্যের মতো ছিলেন, হঠাৎ প্রকাশ্যে এলেন। বয়স পঞ্চাশের কোঠায় হলেও তাঁর চোখের তেজ যেন সময়কে অগ্রাহ্য করে। অদ্ভুত শান্ত অথচ ভয় জাগানো কণ্ঠে তিনি ঘোষণা করলেন—“যদি বিজ্ঞান সত্যিই এত শক্তিশালী হয়, তবে এই যুবক পণ্ডিত আমার সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়াক। অরণ্যের গভীরে, যেখানে মানুষ আর অলৌকিক শক্তির সীমারেখা মিলেমিশে যায়, সেখানেই হোক আমাদের পরীক্ষা।” এই ঘোষণা বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়ল, টেলিভিশনের স্ক্রলে ভেসে উঠল, পত্রিকার পৃষ্ঠায় আলোচনার কেন্দ্র হলো। মানুষ বিস্ময়ে ফিসফিস করতে লাগল—“তান্ত্রিক বনাম বিজ্ঞানী, এ তো এক অন্যরকম দ্বন্দ্ব।” সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত হলো—একদল বলল, “অরিত্র সঠিক, সব কুসংস্কার,” আরেকদল বলল, “বিজ্ঞান কিছুই পারে না, এবার তন্ত্রই জয়ী হবে।”
অরিত্র প্রথমে এই চ্যালেঞ্জকে কেবল এক ধরনের নাটক ভেবে উপেক্ষা করলেন। তিনি বললেন, “এ সব ভণ্ডামি, মিডিয়ার মনোযোগ পাওয়ার কৌশল।” ছাত্ররা তাঁকে ঘিরে প্রশ্ন করতে লাগল—“স্যার, আপনি কি রুদ্রনাথের মুখোমুখি হবেন?” তিনি হেসে বললেন, “অবশ্যই না, আমি বিজ্ঞানী, নাটুকেপনা করতে আসিনি।” কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম হলো। মিডিয়া তাঁর দরজায় এসে হাজির হলো, ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন তাক করল তাঁর দিকে। “ডক্টর মুখার্জী, আপনি কি ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছেন?” “তান্ত্রিকের চ্যালেঞ্জ এড়িয়ে গেলে কি আপনার যুক্তি দুর্বল হয়ে যাবে না?”—এমন প্রশ্নে চারদিক ভরে উঠল। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল ব্যঙ্গচিত্র, কেউ লিখল, “অরিত্র সাহেব শুধু বক্তৃতার নায়ক, আসল মাঠে নেই।” তাঁর ছাত্রদের মধ্যেও কৌতূহল বেড়ে গেল। তরুণরা উসকে দিল—“স্যার, বিজ্ঞানের শক্তি প্রমাণ করার এটাই তো সুযোগ।” পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছাল যেখানে তাঁর নীরবতা মানেই পরাজয়। অরিত্রর যুক্তিনিষ্ঠ অহংকার চ্যালেঞ্জ মেনে নিতে বাধ্য করল তাঁকে। তিনি মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেও বললেন, “ঠিক আছে, আমি যাব। তবে শর্ত একটাই—সব কিছু বৈজ্ঞানিকভাবে নথিভুক্ত হবে।” এই ঘোষণা আবারও মিডিয়ায় বিস্ফোরণ ঘটাল, যেন শহরের প্রতিটি মানুষ এখন এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বের অপেক্ষায়।
অনন্যা সেন, যিনি প্রথম থেকেই অরিত্রর বক্তৃতা কাভার করেছিলেন, এই ঘটনার মূল সাক্ষী হয়ে উঠলেন। তাঁর ভেতরে সাংবাদিকতার তাড়না আরও বেড়ে গেল। তিনি জানতেন, রুদ্রনাথকে কেউ সহজে কাছে পায় না; তাঁর চারপাশে রহস্যের জাল। কিন্তু এইবার রুদ্রনাথ নিজেই প্রকাশ্যে ডাক দিয়েছেন, আর অরিত্র তাতে সাড়া দিয়েছেন। অনন্যা তার নোটবুকে লিখলেন—“এটি কেবল দুটি মতের সংঘর্ষ নয়, এটি এক যুগের সঙ্গে আরেক যুগের লড়াই।” তিনি আরও বুঝতে পারছিলেন, এর ভেতরে শুধুই বিজ্ঞান বা তন্ত্র নেই; আছে মানুষের বিশ্বাস আর ভয়, কুসংস্কার আর যুক্তি, পুরোনো প্রথা আর আধুনিক জ্ঞানের টানাপোড়েন। শহরে যখন উত্তেজনা তুঙ্গে, তখন এক রাতে অনন্যার হাতে এসে পৌঁছাল এক অচেনা খাম। ভেতরে ছিল পুরু খয়েরি কাগজে লেখা কিছু অদ্ভুত চিহ্ন, নিচে মাত্র দুটি শব্দ—“অরণ্যের দ্বার।” অনন্যার বুক কেঁপে উঠল, তিনি বুঝলেন—এই লড়াই কেবল বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা বা মিডিয়ার খেলায় থেমে যাবে না, এর গভীরে আছে অচেনা এক অন্ধকার। অন্যদিকে অরিত্র, সমস্ত সংশয় সরিয়ে রেখে, দৃঢ় সংকল্পে নিজের গবেষণা দলকে বললেন, “আমরা যাব। বিজ্ঞান প্রমাণ করবে, ভয় আর মিথ্যের কোনো জায়গা নেই।” এভাবেই শুরু হলো সেই পথচলা, যা এক ভয়ঙ্কর সংঘর্ষের দিকে শহর ও মানুষকে ঠেলে নিয়ে যাবে।
৩
অবশেষে সেই রাত এল, যেদিন অরিত্র মুখার্জী তাঁর যুক্তির হাতিয়ার নিয়ে সরাসরি মুখোমুখি দাঁড়াবেন তন্ত্রের রহস্যময় শক্তির সামনে। কলকাতার বাইরে, সভ্যতার আলো থেকে বহু দূরে, ছিল এক ঘন অরণ্য—যেখানে রাত নামলেই শ্বাসরুদ্ধ অন্ধকার আর অদ্ভুত শব্দে ভরে ওঠে চারপাশ। চাঁদের আলো ছিল ফিকে, আকাশে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছিল, আর বাতাসে ভেসে আসছিল পচা কাঠ আর শুকনো পাতার গন্ধ। অরিত্রর সঙ্গে ছিলেন তাঁর দুই গবেষক—তরুণ অর্ক ও প্রীতি, হাতে ল্যাপটপ, ক্যামেরা, এবং নানা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। তাদের সঙ্গে সাংবাদিক অনন্যাও এসেছিলেন, ক্যামেরা আর কলম নিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত ধরে রাখার জন্য। তারা যখন অরণ্যের গভীরে পৌঁছাল, সামনে দেখা গেল এক প্রাচীন শ্মশান। ভাঙাচোরা শিবমন্দির, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পুরোনো চিতা, আর বাতাসে অজানা ছাইয়ের গন্ধ—মনে হচ্ছিল, সময় যেন এখানে থমকে আছে। শ্মশানের ভেতরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই চারদিকে কুকুরের হাহাকার ভেসে এল, বাতাস হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে গেল। অরিত্র তখনও দৃঢ়, তিনি ব্যঙ্গ করে বললেন, “এই ভয় দেখানো নাটক আমার কাছে কাজ করবে না। বিজ্ঞান প্রতিটি জিনিসের ব্যাখ্যা দিতে পারে।” তাঁর চোখে ছিল তাচ্ছিল্য, যেন তিনি আগেই ফল জানেন।
ঠিক সেই সময় হঠাৎ শ্মশানের অন্ধকারে একটা লাল আভা দেখা গেল। মৃদু আগুনের মতো আলো ধীরে ধীরে ঘনীভূত হয়ে এক মানুষের অবয়ব তৈরি করল। অরিত্র আর অন্যরা তাকিয়ে রইল, আর দেখল রুদ্রনাথকে—গা জুড়ে গেরুয়া বস্ত্র, গলায় রুদ্রাক্ষমালা, কপালে ভস্মের আস্তরণ, আর চোখে অদ্ভুত দীপ্তি। তাঁর চুল কাঁধ ছুঁয়ে নামছিল, মুখে দাড়ি-গোঁফ মেশানো, কিন্তু সেই মুখমণ্ডল ছিল প্রশান্ত অথচ ভয় জাগানো। মনে হচ্ছিল, তিনি শুধু একজন মানুষ নন, যেন অরণ্যের অন্ধকারই তাঁর শরীরে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তিনি ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন, তাঁর চোখ সরাসরি অরিত্রর চোখে গিয়ে ঠেকল। মুহূর্তে শ্মশানের সমস্ত শব্দ থেমে গেল—কুকুর, ঝিঁঝিঁপোকা, বাতাস—সব নিস্তব্ধ। রুদ্রনাথের ঠোঁটে ভেসে উঠল শান্ত হাসি, যেন তিনি জানেন, সামনে দাঁড়ানো মানুষটি কিছুই বুঝতে পারছে না। অরিত্র তাঁকে দেখে বললেন, “তোমার এই আলোর খেলা, মন্ত্র পড়ার ভান—সবই কৌশল। আমি প্রমাণ করব, এর কোনও সত্যতা নেই।” রুদ্রনাথ বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। তিনি মৃদু গলায় উত্তর দিলেন, “প্রমাণ করতে এলে স্বাগতম, কিন্তু মনে রেখো, সত্যকে ছোট করলে সে তোমাকে গিলে খাবে।” তাঁর কথায় এমন এক নিশ্চিন্ত ভরসা ছিল, যা শুনে অর্ক আর প্রীতি অজান্তেই কেঁপে উঠল।
অনন্যা পুরো দৃশ্যটি পর্যবেক্ষণ করছিলেন, তাঁর হাতে ক্যামেরা কাঁপছিল, কিন্তু তাঁর চোখ একবারও রুদ্রনাথ থেকে সরছিল না। তাঁর সাংবাদিকসুলভ কৌতূহল তাকে টেনে নিচ্ছিল—এই মানুষ সত্যিই কে? ভণ্ড নাকি সত্যিকারের শক্তিধর? অরিত্র তখন ল্যাপটপ খুলে যন্ত্র বসাচ্ছিলেন, তড়িঘড়ি করে তরঙ্গ মাপার চেষ্টা করছিলেন। তিনি দৃঢ় গলায় বললেন, “আমি ভয়ের কাছে হার মানি না। যদি কিছু ঘটে, তবে সেটা আমি সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করব।” রুদ্রনাথ আস্তে করে চোখ বন্ধ করে মন্ত্র পড়া শুরু করলেন। চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠল, শ্মশানের শিখাগুলো যেন হঠাৎ লাফিয়ে উঠল, এবং মাটিতে অজানা ছায়া নড়েচড়ে উঠল। ছাত্ররা আতঙ্কে একে অপরের হাত ধরল, কিন্তু অরিত্র দাঁড়িয়ে রইলেন অটলভাবে, যদিও তাঁর কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছে। তখন রুদ্রনাথ আবারও চোখ খুললেন, শান্ত কণ্ঠে বললেন—“এটি কেবল শুরু। বিজ্ঞান আর তন্ত্রের সংঘর্ষ এখনও শুরুই হয়নি। প্রস্তুত হও, কারণ এবার তোমার বিশ্বাসের সীমা ভেঙে পড়বে।” তাঁর এই বাক্য যেন অরণ্যের নিস্তব্ধতায় প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এলো। অনন্যা বুঝতে পারলেন—আজকের রাত তাদের সকলের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে। আর অরিত্রর চোখে সেই প্রথমবারের মতো এক মুহূর্তের অনিশ্চয়তা ফুটে উঠল।
৪
শ্মশানের নিস্তব্ধতা ভেঙে হঠাৎই যেন এক অদ্ভুত আবহ তৈরি হলো। রুদ্রনাথ স্থির হয়ে দাঁড়ালেন, তাঁর চোখ দুটি অদ্ভুত দীপ্তিতে জ্বলজ্বল করছিল। কণ্ঠে মৃদু মন্ত্রোচ্চারণ শুরু হতেই পরিবেশে পরিবর্তন আসতে লাগল। হাওয়া চলা হঠাৎ থেমে গেল, যেন কেউ অরণ্যের প্রতিটি গাছকে থামিয়ে দিয়েছে। চারপাশে ঝিঁঝিঁপোকার ডাক নিস্তব্ধ হয়ে এল, বাতাসে অদৃশ্য ভার ছড়িয়ে পড়ল। ঠিক সেই মুহূর্তে, শ্মশানের ভাঙা মন্দিরের সামনে রাখা এক প্রদীপ নিজে থেকেই জ্বলে উঠল—কোনো সলতে বা তেল না থাকলেও। আলোটা ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে অন্ধকার গিলে নিতে শুরু করল। অরিত্র ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি টেনে বললেন, “এই হলো তোমার জাদু? আগুন জ্বালানো আর বাতাস থামানো? এগুলো সব প্রাকৃতিক ঘটনার ফল। বাতাসের চাপ আর বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গই এই প্রদীপ জ্বালিয়েছে।” তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর যন্ত্র চালু করলেন—একটি বায়ুচাপ মাপক যন্ত্র, আরেকটি তাপমাত্রা সেন্সর। স্ক্রিনে ওঠা ডেটা তিনি ছাত্রদের দেখালেন, যেন প্রমাণ করছেন—সবকিছু বিজ্ঞানের আওতায়। তাঁর কণ্ঠে দৃঢ়তা, কিন্তু চোখে একটু অস্বস্তিও ধরা পড়ল।
অর্ক আর প্রীতি কৌতূহল ভরা চোখে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারা দেখল, ডেটা আসলেই এক ধরনের স্বাভাবিক পরিবেশ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। “দেখছো তো?”—অরিত্র বললেন—“এই যে তাপমাত্রা হঠাৎ বেড়ে ওঠা, আর বায়ুচাপ কমে যাওয়া—এটাই বাতাস থামার কারণ। বিজ্ঞানের বাইরে কিছু নেই।” রুদ্রনাথ তখনও শান্ত, মাটিতে বসে মন্ত্র জপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি খেলছিল, যেন তিনি অপেক্ষা করছেন পরবর্তী ঘটনার জন্য। অনন্যা তাঁর ক্যামেরা চালু করে সব রেকর্ড করছিলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, প্রদীপের আলো আর অরিত্রর যন্ত্রের স্ক্রিনে ওঠা ডেটা একসঙ্গে ওঠানামা করছে, যেন দুই বিপরীত শক্তি একই জায়গায় লড়াই করছে। কিছুক্ষণ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু হঠাৎই অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটল—অরিত্রর যন্ত্রের স্ক্রিন কাঁপতে লাগল, সংখ্যাগুলো ঝাপসা হয়ে গেল। ল্যাপটপ থেকে বেরোতে লাগল ধোঁয়া, তারগুলো কাঁপতে শুরু করল। প্রীতি আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল, “স্যার! যন্ত্রগুলো কাজ করছে না।” অরিত্র হতবাক হয়ে বোতাম টিপলেন, কিন্তু যন্ত্র একে একে বিকল হয়ে পড়তে লাগল, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাদের নিঃশেষ করে দিচ্ছে।
রুদ্রনাথ তখন ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। চারপাশে হালকা ঝড়ের মতো বাতাস উঠল, অথচ মুহূর্ত আগেই অরিত্র প্রমাণ করেছিলেন বাতাস থেমে গেছে। শ্মশানের ভাঙা দেয়ালে ছায়াগুলো হঠাৎ লম্বা হয়ে নড়তে শুরু করল, যেন তারা জীবন্ত। অনন্যা ভয়ে হলেও চোখ ফেরাতে পারলেন না। তাঁর সাংবাদিকসুলভ দৃষ্টি বুঝতে পারছিল—এটা কেবল কুসংস্কার নয়, এখানে কিছু ঘটছে, যা ব্যাখ্যার সীমার বাইরে। তিনি হঠাৎ খেয়াল করলেন, প্রদীপের আলো সরাসরি অরিত্রর ল্যাপটপের স্ক্রিনে প্রতিফলিত হচ্ছে, আর দুই বিপরীত শক্তি—বিজ্ঞান আর তন্ত্র—মুখোমুখি সংঘর্ষে নেমে এসেছে। আলো আর ডেটা যেন একে অপরকে ঠেলে দিতে চাইছে। অরিত্র গলা উঁচু করে বললেন, “এটা কেবল ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্টারফেরেন্স!” কিন্তু তাঁর গলার আত্মবিশ্বাস কমে আসছিল। রুদ্রনাথ শান্ত ভঙ্গিতে বললেন, “বিজ্ঞান আর তন্ত্র একই স্রোতে বয়ে চলে। তুমি শুধু একদিক দেখতে পাচ্ছ। তুমি যদি জোর করে তাদের সংঘর্ষ ঘটাও, তবে তার পরিণতি ভয়ঙ্কর।” অরিত্র রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “আমি ভয় পাই না। আমি দেখাবো সব কেবল ভ্রম।” তাঁর কথা শেষ হতেই সমস্ত যন্ত্র একসঙ্গে বিস্ফোরণের মতো শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল। চারপাশে আবারও নেমে এল গভীর নিস্তব্ধতা, শুধু প্রদীপের শিখা একা জ্বলছিল—আর অনন্যার কাঁপা হাতের ক্যামেরা প্রতিটি মুহূর্ত ধরে রাখছিল, যা ইতিহাস হয়ে থাকবে।
৫
শ্মশানের সেই রাতের ঘটনার পর, অরিত্রর দল ক্লান্ত ও অস্থির হয়ে শহরে ফিরে এলেও তাঁর ভেতরে ক্রোধ ও জেদ আরও বেড়ে উঠেছিল। যন্ত্র বিকল হওয়া, ডেটা বিকৃত হয়ে যাওয়া—এসব তাঁর বৈজ্ঞানিক অহংকারে আঘাত করেছিল। অর্ক ও প্রীতি ভয় পেয়ে তাঁকে বারবার বলছিল—“স্যার, আমাদের থামা উচিত। ওটা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।” কিন্তু অরিত্র সেই সবকে উড়িয়ে দিলেন। তিনি বললেন, “যন্ত্র কেন নষ্ট হলো, সেটা আমি বুঝব। বিজ্ঞানেরই কোনো ব্যাখ্যা আছে, আমি প্রমাণ করব।” ঠিক তখনই অনন্যা তাঁর কাছে এলেন। সাংবাদিক হিসেবে তিনি জানতেন, ঘটনাগুলো প্রচার হলে সমাজে আলোড়ন উঠবে, কিন্তু একইসঙ্গে তাঁর অন্তরে শঙ্কা জাগছিল। তিনি নরম গলায় বললেন, “আপনি কি বুঝতে পারছেন না, এখানে শুধু যন্ত্র নয়, আরও কিছু কাজ করছে?” অরিত্র হেসে উঠলেন, “মিস সেন, আপনিও সাংবাদিক হয়ে কুসংস্কার ছড়াচ্ছেন নাকি? আমি জানি, মানুষের মস্তিষ্ক ভয়কে বড় করে দেখে, আর তাতেই অলৌকিকের ধারণা জন্ম নেয়।” এই কথার মাঝেই আশ্রম থেকে একজন সন্ন্যাসী তাদের ডাক দিলেন—বাবা অচ্যুতানন্দ, যিনি বহু বছর ধরে ওই অঞ্চলে সাধনা করছিলেন এবং মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা করত শান্ত জ্ঞানী হিসেবে।
অচ্যুতানন্দের আশ্রমটি ছিল অরণ্যের প্রান্তে, সরল মাটির কুটির, চারপাশে তুলসী আর বেলগাছ। তাঁর চেহারায় বয়সের ছাপ, কপালে শান্ত ভস্ম, চোখে অনন্ত অভিজ্ঞতার দীপ্তি। তিনি অরিত্রর দিকে তাকিয়ে গভীর কণ্ঠে বললেন, “বাবা, তুমি ভুল পথে যাচ্ছ। তোমার যুক্তি শক্তিশালী, কিন্তু সব সত্য যুক্তির কাছে ধরা দেয় না। তন্ত্র মানে শুধু ভণ্ডামি নয়, এটি শক্তির এক রূপ, যা মহাবিশ্বের অন্তরে লুকানো। বিজ্ঞান আর তন্ত্রকে যদি একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করাও, তবে তারা পরস্পরকে নষ্ট করবে, আর তার ধ্বংস হবে ভয়ঙ্কর।” আশ্রমের চারপাশে হাওয়া বইছিল, বেলপাতার শব্দ যেন তাঁর কথার সাক্ষ্য দিচ্ছিল। অনন্যা গম্ভীর হয়ে শুনছিলেন, আর অর্ক-প্রীতি ভয়ে থম মেরে গিয়েছিল। কিন্তু অরিত্র দাঁড়িয়ে হেসে ফেললেন। তাঁর হাসিতে ব্যঙ্গ ভরা—“বাবা, আপনার অভিজ্ঞতাকে আমি শ্রদ্ধা করি, কিন্তু এসব ভৌতিক গল্প দিয়ে মানুষকে ভয় দেখানো হয়। তন্ত্র মানে কেবল ভেলকি, আর বিজ্ঞানই একমাত্র সত্য। আমি প্রমাণ করব।”
অচ্যুতানন্দ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তাঁর চোখে যেন দূরের ভবিষ্যৎ প্রতিফলিত হলো। তিনি মৃদু স্বরে বললেন, “তুমি যখন নিজের অহংকারে অন্ধ, তখন আমি আর কিছু বলতে পারব না। তবে মনে রেখো, শক্তি কখনও মিথ্যা নয়, সে শুধু রূপ পাল্টায়। তুমি যদি সেই শক্তিকে অসম্মান করো, তবে তার প্রতিঘাত তোমার জন্যই ভয়ঙ্কর হবে।” তিনি আবার চোখ বন্ধ করে জপে বসে গেলেন, যেন আর কিছু বলার নেই। অনন্যা অরিত্রকে বোঝাতে চাইলেন—“শুনুন, অন্তত সতর্ক হোন। এ সতর্কবার্তাগুলো হেলাফেলা করা উচিত নয়।” কিন্তু অরিত্র হাত নেড়ে বললেন, “আমি ভয় পাই না। ভয়ই হলো মানুষের শত্রু।” তাঁর গলায় দৃঢ়তা থাকলেও চোখের গভীরে এক মুহূর্তের দ্বিধা খেলে গেল, যা তিনি সযত্নে লুকিয়ে রাখলেন। আশ্রম থেকে ফেরার পথে চারদিকে নিস্তব্ধ অরণ্য, গাছের ফাঁক দিয়ে ঝিরঝিরে হাওয়া, আর দূরে ভেসে আসা শকুনের ডাক—সব মিলিয়ে এক অশুভ আবহ তৈরি করছিল। অনন্যার মনে হচ্ছিল, অচ্যুতানন্দ যা বললেন, তা সত্যি হয়ে উঠতে বেশি দেরি নেই। অরিত্র অবশ্য কিছুই পাত্তা দিলেন না; তাঁর চোখে কেবল একটাই লক্ষ্য—তন্ত্রকে ভুয়া প্রমাণ করা, যেভাবেই হোক। তিনি জানতেন না, তাঁর এই জেদই শিগগিরই তাঁদের সবাইকে এক ভয়ঙ্কর অচেনা পথে নিয়ে যাবে।
৬
অরিত্র মুখার্জীর মাথায় তখন একটাই সংকল্প—রুদ্রনাথের শক্তিকে তিনি যন্ত্রের কক্ষে বন্দি করবেন, এবং বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করবেন যে সেটি আসলে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, মানুষের ভেলকি ছাড়া আর কিছু নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে তিনি কয়েকদিন ধরেই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বিশাল টেবিলজুড়ে সাজানো হলো স্পেকট্রোমিটার, কোয়ান্টাম সেন্সর, ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড ডিটেক্টর, এমনকি নিউরো-সিগন্যাল রেকর্ডার পর্যন্ত। তাঁর ছাত্ররা তাকিয়ে দেখছিল—এ যেন এক আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে অস্ত্র হলো বিজ্ঞান আর লক্ষ্য হলো সত্যের উন্মোচন। অনন্যা তাঁর সব প্রস্তুতি ক্যামেরায় ধারণ করছিলেন, কিন্তু মনে মনে ক্রমেই অস্থির হচ্ছিলেন। তিনি বারবার বলছিলেন, “আপনি নিশ্চিত তো, এটা বিপজ্জনক হবে না?” অরিত্র কটমট করে তাকিয়ে উত্তর দিলেন, “বিজ্ঞান কোনোদিন ভয় পায় না। যদি ভয় পেত, তবে মানুষ কখনো আকাশে উড়ত না, সমুদ্র পাড়ি দিত না।” তাঁর চোখে তখন এমন দীপ্তি জ্বলছিল, যা একইসঙ্গে দৃঢ়তারও প্রতীক আর অহংকারেরও প্রকাশ। বাইরে থেকে জানলার ফাঁক দিয়ে আসা হালকা হাওয়া যেন আশঙ্কার বার্তা বয়ে আনছিল, অথচ অরিত্রর ভেতরে শুধু উত্তেজনার ঢেউ।
নির্দিষ্ট দিনে রুদ্রনাথকে ডাকা হলো ল্যাবে। তিনি আসলেন শান্ত ভঙ্গিতে, লাল বসনে মোড়া শরীর, গলায় রুদ্রাক্ষমালা, চোখে যেন গাঢ় রহস্যের দীপ্তি। ছাত্ররা ভয়ে সরে গেল, কিন্তু অরিত্র দৃঢ়ভাবে তাঁকে যন্ত্রের মাঝখানে দাঁড় করালেন। “আপনি যা করেন, এখানে করুন। আমার যন্ত্র প্রমাণ করবে যে এসবই প্রকৃতির নিয়মের ভিন্ন রূপ,” তিনি বললেন। রুদ্রনাথ কেবল একটি শান্ত হাসি দিলেন, যেন সবকিছু আগেই জানেন। তারপর তিনি মৃদু গলায় মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন। প্রথমে শব্দ ছিল নরম, বাতাসে ঢেউ খেলে যাচ্ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে মন্ত্র যেন ল্যাবের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল, বাতাস ভারী হয়ে উঠল। হঠাৎ স্পেকট্রোমিটারের আলো ঝিকমিক করে জ্বলে উঠল, কোয়ান্টাম সেন্সরে অস্পষ্ট তরঙ্গ ধরা পড়ল। যন্ত্রগুলো অস্বাভাবিক সিগন্যাল দেখাচ্ছিল, স্ক্রিনে অচেনা গ্রাফ ভেসে উঠছিল, যার কোনো সূত্র অরিত্রর জানা তত্ত্বে মেলে না। রুদ্রনাথের চারপাশে বাতাস ঘন হয়ে উঠল, লাল আভা যেন ভেসে উঠল তাঁর শরীর ঘিরে। অনন্যার ক্যামেরা কেঁপে উঠল, লেন্সে ধরা পড়ল অদ্ভুত বিকৃতি, যেন দৃশ্যপটই বাঁকিয়ে যাচ্ছে। ছাত্ররা ভয়ে চিৎকার করল, কিন্তু অরিত্রর চোখ স্থির—তিনি এই অজানা শক্তির ভেতরে সত্য খুঁজছিলেন।
তখনই ঘটল সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা। ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ডিটেক্টরের স্কেলে সংখ্যা বেড়ে গেল অস্বাভাবিকভাবে, রুমের বাতাসে স্পার্ক ছড়িয়ে পড়ল। নিউরো-সিগন্যাল রেকর্ডার হঠাৎ এমন তরঙ্গ ধরে ফেলল, যা মানুষের মস্তিষ্কে কখনো ধরা পড়েনি। অরিত্র হতভম্ব হয়ে গেলেন, তিনি নিজেও ব্যাখ্যা করতে পারছিলেন না। “অসম্ভব… এটা কেমন শক্তি?” তাঁর ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এলো ফিসফিসানি। তখন রুদ্রনাথ চোখ খুললেন, তাঁর দৃষ্টিতে এক অদ্ভুত স্থিরতা—না ক্রোধ, না দয়া, বরং নিঃশব্দ এক সতর্কবার্তা। মন্ত্র থেমে যেতেই যন্ত্রগুলোর অনেকগুলো ফেটে গেল, স্পার্ক ছড়িয়ে পুরো ল্যাব অন্ধকারে ডুবে গেল। শুধু ধোঁয়া আর ভাঙা তারের গন্ধে ভরে উঠল চারপাশ। অনন্যা দৌড়ে এগিয়ে এসে বললেন, “আপনি কি বুঝলেন এখন? বিজ্ঞানেরও সীমা আছে।” অরিত্র তখনও অবিশ্বাসে ডুবে ছিলেন। তাঁর হাত কাঁপছিল, ঠোঁট শুকিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু চোখে জ্বলছিল অন্যরকম এক আলো—ভয়ের সঙ্গে মিশে থাকা কৌতূহল। তিনি মনে মনে বললেন, “এ শক্তি যা-ই হোক, আমি এর রহস্য ভেদ করব।” কিন্তু তাঁর অন্তরের গভীরে এক অজানা আতঙ্ক জন্ম নিতে শুরু করেছিল, যাকে তিনি এখনো স্বীকার করতে প্রস্তুত নন।
৭
রুদ্রনাথের মন্ত্রোচ্চারণের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন ধরা পড়তে লাগল। প্রথমে তারা ভেবেছিল যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার কারণে এমনটা হচ্ছে, কিন্তু দিন কয়েক কাটতে না কাটতেই ভয়ের প্রকৃত রূপ উন্মোচিত হলো। ফিজিক্স বিভাগের ল্যাবে হঠাৎই বাতি টিমটিম করে উঠছিল, মাঝে মাঝে পুরো অন্ধকার নেমে আসছিল কয়েক সেকেন্ডের জন্য, অথচ বৈদ্যুতিক সংযোগে কোনো ত্রুটি পাওয়া যাচ্ছিল না। লাইব্রেরিতে এক ছাত্র বই পড়তে গিয়ে শুনতে পেল, পেছনে কেউ মন্ত্রের মতো কিছু বলছে, কিন্তু ফিরে তাকিয়ে দেখল সেখানে কেউ নেই। আরেক ছাত্রী হঠাৎ দেখল তার হাতের কবজিতে লালচে দাগ ফুটে উঠেছে, যেন অদৃশ্য কারও আঙুলের ছাপ। তাদের অনেকেই প্রথমে এই ঘটনাকে কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দিলেও, পরপর ঘটতে থাকা অস্বাভাবিকতাগুলো ধীরে ধীরে তাদের মনে আতঙ্ক তৈরি করল। ফিসফিস শব্দ, অকারণ শীতল বাতাসের প্রবাহ, আর হঠাৎ করে ধাতব যন্ত্রের কাঁপুনি—সব মিলিয়ে এক অজানা সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়তে লাগল ক্যাম্পাসে। অরিত্র এই সবকিছুকে ব্যাখ্যা করার জন্য দিনরাত মাথা খাটাচ্ছিলেন, কিন্তু কোনো সূত্র খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তাঁর ছাত্ররা যাদের ওপর ভরসা করতেন, তারাই এখন ভয়ে ল্যাবে আসতে চাইছিল না।
অনন্যা সেন, যিনি প্রথম থেকেই সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিলেন, অনুভব করছিলেন যে ঘটনার মূল উৎস লুকিয়ে আছে সেই পরীক্ষার রাতে। তিনি বুঝলেন—অরিত্র ও রুদ্রনাথের সংঘর্ষে এমন এক শক্তি জাগ্রত হয়েছে, যা শুধু যন্ত্রে ধরা পড়ার মতো নয়, বরং মানুষের শরীর ও মনেও ছাপ ফেলছে। তাঁর সাংবাদিক মন তাঁকে সত্যটা প্রকাশ করতে উৎসাহ দিচ্ছিল, কিন্তু একইসঙ্গে তাঁর মানবিক দিক তাঁকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছিল। তিনি দেখলেন, কয়েকজন ছাত্র অকারণেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে, চিকিৎসকেরা বলছেন এগুলো মানসিক চাপের ফল, কিন্তু অনন্যা নিশ্চিত ছিলেন যে এর পেছনে অদৃশ্য কোনো প্রভাব কাজ করছে। রাতে তিনি একা নিজের রেকর্ডিং দেখছিলেন—সেই সময় যখন রুদ্রনাথ ল্যাবে মন্ত্র পড়ছিলেন। হঠাৎ তিনি লক্ষ্য করলেন, ফ্রেমের এক কোণে এমন এক ছায়া নড়ছে, যা বাস্তবে উপস্থিত ছিল না। তিনি থমকে গেলেন, ভিডিও বারবার রিপ্লে করে দেখলেন—ছায়াটি ক্রমশ মানুষের আকার নিচ্ছে, মুখ অস্পষ্ট, কিন্তু চোখ দুটি যেন শূন্যে তাকিয়ে রয়েছে। অনন্যার গায়ে কাঁটা দিল। তিনি তৎক্ষণাৎ অরিত্রকে ফোন করলেন, বললেন, “আপনি বুঝতে পারছেন তো? বিজ্ঞান আর তন্ত্রের মধ্যে যে সংঘর্ষ ঘটেছে, সেটাই এক ভয়ঙ্কর শক্তিকে মুক্ত করে দিয়েছে। আর সেটা এখন ছড়িয়ে পড়ছে।” কিন্তু অরিত্র তাঁর কথাকে একরকম উপেক্ষা করে উত্তর দিলেন, “এটা স্রেফ মানসিক বিভ্রম। আমি বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করব যে এগুলো কোনো অতিপ্রাকৃত ব্যাপার নয়।”
কিন্তু সত্যিটা আর লুকিয়ে থাকল না। দিন কয়েক পর, ল্যাবের ভেতরে এক ছাত্র হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়ে গেল। যখন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো, ডাক্তাররা তাঁর শরীরে অদ্ভুত নীলচে দাগ খুঁজে পেলেন, যেন বিদ্যুতের শক লেগেছে। অথচ সে ছেলেটি কোনো যন্ত্রের কাছেই ছিল না। এদিকে হোস্টেলে থাকা ছাত্রীদের অভিযোগ, রাতে তারা ঘুমোতে গেলে দরজার বাইরে কিসের যেন শব্দ শোনা যায়—মাঝে মাঝে কণ্ঠস্বর, আবার কখনও ধুপের গন্ধ ভেসে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তে লাগল, ক্লাস ফাঁকা হতে শুরু করল। যারা প্রথমে অরিত্রর বক্তৃতায় হাততালি দিয়েছিল, তারাই এখন ভয়ে তাঁকে দায়ী করতে লাগল। অনন্যা তাঁকে সতর্ক করলেন, “আপনি কি বুঝতে পারছেন না? আপনার একগুঁয়েমির কারণে আমরা সবাই এক অনিয়ন্ত্রিত শক্তির শিকার হচ্ছি।” অরিত্র কোনো উত্তর দিলেন না, শুধু জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর চোখে ভয়ের সঙ্গে এক অদ্ভুত মোহ জড়িয়ে ছিল—যেন তিনি আতঙ্কের মধ্যেও সত্যকে ছুঁতে চাইছেন। অনন্যা তখন উপলব্ধি করলেন—এ লড়াই শুধু বিজ্ঞানের সঙ্গে তন্ত্রের নয়, বরং অজানার সঙ্গে মানুষের সীমাবদ্ধতারও। আর সেই অজানা শক্তি ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে, যা হয়তো একদিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
৮
অরণ্যের গভীরতম প্রান্তে, যেখানে প্রাচীন শ্মশানঘাট ও ভগ্ন মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ পড়ে আছে, সেখানেই আয়োজন হলো অরিত্র ও রুদ্রনাথের চূড়ান্ত মুখোমুখি লড়াইয়ের। আকাশ কালো মেঘে ঢাকা, চাঁদের আলো লুকিয়ে গেছে ঘন ধোঁয়ার আড়ালে। বাতাসে এক অদ্ভুত গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল—ধূপ, ছাই আর ভেজা মাটির মিশ্রণ। ছাত্রছাত্রী ও কৌতূহলী গ্রামবাসীরা দূর থেকে দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের চোখে আতঙ্ক আর বিস্ময়ের ছাপ। অরিত্র দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করলেন—“আজ প্রমাণ হবে, বিজ্ঞানই সত্য, বাকিটা কুসংস্কার।” তাঁর হাতে জ্বলজ্বল করছিল লেজার সেন্সর, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক স্ক্যানার, আর কোয়ান্টাম ওয়েভ ডিটেক্টর। অন্যদিকে রুদ্রনাথ শান্ত মুখে দাঁড়িয়ে, চোখ বন্ধ করে গভীর তন্ত্রমন্ত্র উচ্চারণ শুরু করলেন। তাঁর কণ্ঠের প্রতিটি ধ্বনি যেন চারপাশের অন্ধকারে তরঙ্গ তৈরি করে ছড়িয়ে পড়ছিল। হঠাৎ করেই বাতাস থমকে গেল, গাছের পাতা আর দুলল না, যেন প্রকৃতি নিঃশ্বাস আটকে রেখেছে। এই নিরবতায় অরিত্র যন্ত্র চালু করলেন, আর মুহূর্তের মধ্যেই আকাশ বিদীর্ণ হয়ে এক প্রচণ্ড বজ্রপাত আছড়ে পড়ল দূরে। যেন বিজ্ঞান ও তন্ত্র একে অপরের উপস্থিতি বুঝে প্রথম আঘাতের জন্য প্রস্তুত।
সংঘর্ষ শুরু হতেই অরণ্যের পরিবেশ অস্বাভাবিক হয়ে উঠল। অরিত্রর যন্ত্র থেকে ছিটকে বেরোতে লাগল অদৃশ্য তরঙ্গ, যা মাটির বুকে ধাতব স্ফুলিঙ্গ তৈরি করছিল। অন্যদিকে রুদ্রনাথের মন্ত্রোচ্চারণে জেগে উঠল অগ্নিশিখা—হঠাৎ করে মাটির ফাঁক থেকে শিখার ফুলকি উঠল, বাতাসে ভেসে বেড়াতে লাগল লালচে আভা। এই দুই শক্তির সংঘর্ষে চারদিকে প্রবল ঝড় বয়ে গেল। গাছগুলো কেঁপে উঠছিল, মৃত পাতাগুলো যেন তীরের মতো উড়ে আসছিল। বজ্রপাত এত ঘনঘন হচ্ছিল যে রাতের অন্ধকার ভেদ হয়ে বারবার আলোকিত হয়ে উঠছিল শ্মশানের ভাঙাচোরা স্তম্ভ। ছাত্রছাত্রীরা ভয়ে কাঁপছিল, কেউ কেউ চিৎকার করে বলছিল, “চল পালাই! এটা মানুষের লড়াই নয়।” অনেকেই আতঙ্কে দৌড়ে পালাতে শুরু করল। কিন্তু অনন্যা দাঁড়িয়ে রইলেন, তাঁর হাতে ক্যামেরা, চোখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা—তিনি জানতেন এই সংঘর্ষ শুধু ইতিহাসে নয়, মানবজাতির চিন্তায়ও এক মোড় ঘুরিয়ে দেবে। যন্ত্রের প্রতিটি স্পন্দন আর মন্ত্রের প্রতিটি ধ্বনি যেন মিলেমিশে এমন এক শক্তির জন্ম দিচ্ছিল, যা আগে কেউ দেখেনি। আকাশের কালো মেঘ বিদীর্ণ হয়ে রক্তিম আলো ছড়িয়ে দিচ্ছিল, যেন প্রকৃতি নিজেই এই দ্বন্দ্বের সাক্ষী।
সংঘর্ষ যত বাড়ছিল, বাস্তবতা আর মায়ার সীমারেখা তত ভেঙে যাচ্ছিল। অরিত্রর যন্ত্র হঠাৎ অস্বাভাবিক তরঙ্গ রেজিস্টার করতে শুরু করল—এক অজানা শক্তি গ্রাফে ওঠানামা করছিল, যা পদার্থবিজ্ঞানের কোনো সূত্রে ফেলা যায় না। রুদ্রনাথের কণ্ঠ ক্রমশ গম্ভীর হয়ে উঠল, তাঁর চোখ থেকে যেন দীপ্ত জ্যোতি বের হচ্ছিল, আর প্রতিটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে বাতাস কেটে বেরোচ্ছিল অগ্নির মতো উত্তপ্ত তরঙ্গ। মুহূর্তে চারপাশের তাপমাত্রা বেড়ে গেল, শীতল রাতেও মানুষের গায়ে ঘাম ঝরতে লাগল। হঠাৎই দুই শক্তির মুখোমুখি সংঘর্ষ হলো—অরিত্রর কোয়ান্টাম ডিভাইস থেকে ছিটকে পড়া আলোকরশ্মি আর রুদ্রনাথের মন্ত্রোচ্চারণে জেগে ওঠা অগ্নিশিখা একই বিন্দুতে আঘাত করল। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে মাটি কেঁপে উঠল, আকাশে উড়ে গেল ধুলো, ধোঁয়া আর ছাই। ছাত্ররা আতঙ্কে প্রাণ নিয়ে দৌড়ে পালাতে লাগল, কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়ল। অনন্যা হাতে ক্যামেরা শক্ত করে ধরে ছিলেন, কিন্তু চোখের সামনে দেখা এই ভয়ংকর বাস্তবতাকে তিনি ক্যামেরার লেন্সে বন্দি করতে পারছিলেন না—এটা ছিল মানুষের বোঝার সীমার বাইরে এক অদৃশ্য যুদ্ধ। শ্মশানের মাটিতে আগুনের রেখা তৈরি হলো, যেন কেউ লাল শিখা দিয়ে এক অশুভ বৃত্ত এঁকে দিয়েছে। অরণ্যের নীরবতা ভেঙে চিৎকার, বজ্রগর্জন আর যন্ত্রের ভোঁ-ভোঁ শব্দ মিশে তৈরি করল এক দমবন্ধ করা পরিবেশ। বিজ্ঞান আর তন্ত্রের এই দ্বন্দ্বে মনে হচ্ছিল, যে কোনো মুহূর্তে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
৯
অরণ্যের কালো আকাশ বিদীর্ণ করে চলা বজ্রপাত, কাঁপতে থাকা মাটির কম্পন, শ্মশানের ভাঙা স্তম্ভে প্রতিধ্বনিত মন্ত্র ও যন্ত্রের গর্জন—সব মিলিয়ে পৃথিবী যেন এক মহাপ্রলয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। ছাত্ররা কেউ ছুটে পালাচ্ছে, কেউ ভয়ে গাছের আড়ালে আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু অনন্যা দাঁড়িয়ে আছেন মাঝখানে, তাঁর চোখ দুটো ভেজা মাটির মতোই গাঢ় আর স্পষ্ট। এই ভীষণ সংঘর্ষের ভেতর তিনি হঠাৎ অনুভব করলেন—এটা কেবল লড়াই নয়, বরং দুটি শক্তির সংঘর্ষ যা একই মূল থেকে প্রবাহিত। বিজ্ঞান চেষ্টা করছে সত্যকে পরিমাপ করতে, আর তন্ত্র চেষ্টা করছে সেই সত্যকে অনুভব করতে। অনন্যার মনে হলো, দুজনেই একই নদীর দুই ধার, যারা মিলিত হলে সমুদ্র গড়ে ওঠে। তাঁর হৃদয় থেকে এক তীব্র কণ্ঠ বেরিয়ে এলো—“থামুন! তোমরা একই জিনিসের দুই রূপ, একে অপরকে ধ্বংস করলে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে।” তাঁর চিৎকার বজ্রপাতের শব্দ ভেদ করে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল, ছাত্ররা স্তব্ধ হয়ে তাকাল, যেন প্রকৃতি নিজেও এই আহ্বান শুনল। রুদ্রনাথের কণ্ঠ মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠল, মন্ত্রের ধ্বনি থমকালো। অরিত্রর চোখে এক ঝলক দ্বিধার ছায়া দেখা দিল, কিন্তু তাঁর যন্ত্র তখনও গর্জে উঠছে, অদৃশ্য তরঙ্গ মাটিকে ছিঁড়ে ফেলছে। অনন্যা দৌড়ে গিয়ে তাঁদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়লেন, তাঁর শরীর কাঁপছিল, কিন্তু কণ্ঠ দৃঢ় ছিল—“এটা যুদ্ধ নয়, এটা মিলনের মুহূর্ত।”
কিন্তু প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে সংঘর্ষ থামানো যায় না সহজে। ঠিক সেই সময় অরিত্রর কোয়ান্টাম যন্ত্র হঠাৎ বিকট শব্দ করে কাঁপতে শুরু করল। যন্ত্রের মনিটরে উজ্জ্বল সাদা আলো ফুটে উঠল, তারপর মুহূর্তেই তা বিস্ফোরিত হলো এক দমবন্ধ করা শব্দে। আগুন আর ধোঁয়ার মেঘ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, ছাত্ররা ভয়ে চিৎকার করে দৌড় দিল দূরে। বিস্ফোরণের অভিঘাতে শ্মশানের ভাঙা স্তম্ভগুলো ভেঙে পড়ে গেল, মাটি থেকে ধুলোর ঝড় উঠল। অরিত্র নিজেই যন্ত্রের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে গেলেন, তাঁর চশমা ভেঙে মাটিতে ছড়িয়ে পড়ল। অপরদিকে রুদ্রনাথের ঠোঁটে তখনও শেষ মন্ত্র বেজে উঠছিল, কিন্তু বিস্ফোরণের অভিঘাত তাঁর কণ্ঠ ভেঙে দিল, শব্দের তরঙ্গ যেন গলা থেকে বের হতে না পেরে নিঃশেষ হয়ে গেল। তাঁর শরীরও হঠাৎ শক্তিহীন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। এই দুই বিপরীত শক্তির পতনে মুহূর্তের জন্য অরণ্য নিস্তব্ধ হয়ে গেল—না মন্ত্র, না যন্ত্র, কেবল আগুনের গন্ধ আর ছাইয়ের কুয়াশা ভেসে বেড়াতে লাগল চারপাশে। ছাত্ররা ভয়ে পিছন থেকে তাকিয়ে দেখছিল, কেউ সাহস পাচ্ছিল না কাছে আসতে। কিন্তু অনন্যা, চোখে অশ্রু নিয়ে, ধুলো আর ধোঁয়ার মাঝ দিয়ে দৌড়ে গেলেন মাটিতে পড়ে থাকা দুই মানুষটির দিকে। তাঁর মনে হচ্ছিল—যেন এই মুহূর্তেই সত্য উদ্ভাসিত হচ্ছে, বিজ্ঞান আর তন্ত্রের দ্বন্দ্ব ভেঙে পড়ছে, কিন্তু একসঙ্গে তাদের মিলনের পথও খুলে যাচ্ছে।
অরিত্র আর রুদ্রনাথ দুজনেই অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলেন। তাঁদের মুখে যন্ত্রণার ছাপ, কিন্তু অদ্ভুতভাবে দুজনের শ্বাসের ছন্দ একসঙ্গে উঠানামা করছিল—যেন তারা একই স্রোতের সঙ্গে যুক্ত। অনন্যা হাঁটু গেড়ে বসে কাঁপতে থাকা হাতে অরিত্রর কাঁধে হাত রাখলেন, তারপর রুদ্রনাথের কপালে স্পর্শ করলেন। তাঁর মনে হলো, বিস্ফোরণ আর মন্ত্রভঙ্গের এই মুহূর্তে প্রকৃতি নিজেই ইঙ্গিত দিচ্ছে—এরা প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং একই সূত্রে গাঁথা। হঠাৎ বাতাসে এক অদ্ভুত প্রশান্তি নেমে এলো। বজ্রপাত থেমে গেল, আকাশ থেকে মেঘ সরে গিয়ে চাঁদের আলো ভাঙা মন্দিরের গায়ে পড়ল। আগুনের রেখাগুলো ধীরে ধীরে নিভে গেল, কেবল সাদা ধোঁয়ার আস্তরণ বাকি রইল। ছাত্ররা সাবধানে এগিয়ে এলো, কেউ ফিসফিস করে বলল—“ওরা কি বেঁচে আছে?” অনন্যা দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিলেন—“হ্যাঁ, এরা বেঁচে আছে। কারণ সত্য মরে না, সত্য শুধু রূপ বদলায়।” তাঁর কথায় উপস্থিত সবার মধ্যে এক আশ্চর্য নীরবতা ছড়িয়ে পড়ল। কেউ আর কথা বলল না, কেবল সবাই তাকিয়ে রইল অরিত্র ও রুদ্রনাথের দিকে—দুজন মানুষ, যারা একে অপরকে ধ্বংস করতে গিয়ে নিজেরাই ভেঙে পড়েছেন, অথচ তাঁদের পতনই হয়তো নতুন সত্যের উদ্ভাস ঘটাবে।
১০
সকালের প্রথম সূর্যের আলো যখন শ্মশানের ভাঙা প্রাচীর ছুঁয়ে গেল, তখন চারপাশের দৃশ্য যেন অচেনা হয়ে উঠল। আগের রাতের বজ্রপাত, বিস্ফোরণ আর মন্ত্রযুদ্ধের দাগ মাটির গায়ে দগদগে ক্ষতের মতো স্পষ্ট। ছাত্ররা যারা পালিয়ে বেঁচেছিল, তারা ধীরে ধীরে ফিরে এসে দেখে—শ্মশানের চারপাশে মাটি অদ্ভুতভাবে ফেটে গেছে, যেন ভেতর থেকে কোনো অজানা শক্তি বেরিয়ে এসেছে। ফাটলের ভিতর দিয়ে ধোঁয়া উঠছে, আর কোথাও কোথাও অদ্ভুত নীলাভ আলো জ্বলজ্বল করছে। বাতাসে ছাইয়ের গন্ধ থাকলেও তার সঙ্গে মিশে আছে অজানা ধাতব গন্ধ, যা কারও আগে কখনও টের পাওয়া হয়নি। ভোরের আকাশে পাখির ডাক নেই, চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু ফাটল থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে বেরিয়ে আসা অদ্ভুত শব্দ—মৃদু কম্পন আর চাপা গুঞ্জন। অনন্যা হাঁটতে হাঁটতে মাটিতে শুয়ে থাকা অরিত্রকে খুঁজে পান। তাঁর শরীর ক্ষতবিক্ষত, কিন্তু শ্বাস আছে, দুর্বল হলেও জীবনের চিহ্ন স্পষ্ট। তিনি কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়েন, চোখে জল চলে আসে—গত রাতের উন্মত্ত দ্বন্দ্ব অরিত্রকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু চারদিকে তাকিয়ে তিনি আতঙ্কে বুঝলেন, প্রকৃত বিপদ কেবল অরিত্রর দেহে নয়, বরং শ্মশানের এই মাটি আর তার ভেতরে লুকোনো শক্তির ভাঙা বাঁধে। আর সেই মুহূর্তেই তিনি খেয়াল করলেন—রুদ্রনাথ কোথাও নেই। তাঁর লাল বস্ত্রের ছিঁড়ে যাওয়া টুকরো কিছু দূরে ছড়িয়ে আছে, কিন্তু মানুষটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
ছাত্ররা দলে দলে এসে জড়ো হলো, কেউ অরিত্রকে তুলতে চাইছে, কেউ মাটির ফাটলের দিকে আতঙ্কে তাকিয়ে আছে। এক ছাত্র ফিসফিস করে বলল—“এটা কি ভূমিকম্প? না কি সত্যিই কিছু বেরিয়ে এসেছে ভেতর থেকে?” অনন্যা কাউকে উত্তর দিলেন না। তিনি তাঁর ব্যাগ থেকে নোটবুক বের করে তাতে কাঁপা হাতে লিখতে শুরু করলেন—“বিজ্ঞান ও তন্ত্র কোনোটি মিথ্যা নয়। তারা উভয়েই সত্য, কিন্তু ভয়ঙ্কর সত্য তখনই জন্ম নেয়, যখন আমরা তাদের একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করাই। গত রাতের সংঘর্ষে যে শক্তি মুক্তি পেয়েছে, তা মানুষের হাতের বাইরে। অরিত্র চেয়েছিলেন প্রমাণ করতে, তন্ত্র শুধু ভণ্ডামি। রুদ্রনাথ চেয়েছিলেন দেখাতে, বিজ্ঞান কেবল সীমাবদ্ধ। কিন্তু আসলে তাঁরা নিজেরাই অজান্তে এমন এক দরজা খুলে ফেলেছেন, যেখান থেকে শক্তি বেরোলে তার নিয়ন্ত্রণ কারও হাতে থাকে না।” তাঁর কলম থেমে গেল এক মুহূর্তের জন্য, চোখের সামনে অরিত্রর ক্ষতবিক্ষত মুখ আর রুদ্রনাথের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া ছবির মতো ভেসে উঠল। মনে হলো, এই নোটবুকই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবে, এক অমোচনীয় সতর্কবার্তা হিসেবে।
শেষ দৃশ্যে সূর্যের আলো যখন পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়ল, তখন ছাত্ররা সবাই আতঙ্কে পিছু হটল। শ্মশানের মাঝখানে পড়ে থাকা ভাঙা যন্ত্রটির ভেতর থেকে এক মৃদু আলো জ্বলতে শুরু করল। আলোটা নিছক বৈদ্যুতিক নয়, আবার নিছক আগুনও নয়—এটা ছিল স্পন্দিত, যেন শ্বাস নিচ্ছে, যেন জীবন্ত। ভাঙা সার্কিট থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গ বেরোচ্ছে, আর সেই সঙ্গে চারপাশে মৃদু গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ছে। অনন্যা দূর থেকে তাকিয়ে অনুভব করলেন, যে অজানা শক্তি মুক্তি পেয়েছে, তা এখনও সক্রিয়, এখনও জেগে আছে। ছাত্ররা কেউ এগোতে সাহস পেল না, শুধু দূর থেকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে রইল। অরিত্রর নিস্তেজ দেহ, রুদ্রনাথের অনুপস্থিতি, ভাঙা মাটি আর জীবন্ত আলো—সব মিলিয়ে ভোরের শ্মশান যেন মৃত্যুর থেকেও ভয়ঙ্কর এক অমীমাংসিত রহস্য হয়ে উঠল। অনন্যার মনে তখন শুধু একটাই বাক্য প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল—“আমরা সত্যের পথে হাঁটতে চেয়েছিলাম, কিন্তু হয়তো সত্য আমাদের চেয়ে অনেক বড়, অনেক ভয়ঙ্কর।” তিনি চোখ বন্ধ করলেন, নোটবুক বুকে চেপে ধরলেন, আর দূরে ফেটে যাওয়া মাটি থেকে আসা গুঞ্জন যেন ইঙ্গিত দিল—এ গল্প এখানেই শেষ নয়, এর আসল অধ্যায় এখনও শুরু হয়নি।
শেষ




