অনিন্দ্য দে
১
গ্রামের রাত সবসময়ই শান্ত, বিশেষ করে শীতের শেষে ফাগুনের সন্ধ্যায় যখন চারপাশে পেঁচা ডাকে আর দূরে কোথাও শেয়ালের ডাক ভেসে আসে। সেদিনও তেমনই এক রাত। আকাশে চাঁদ নেই, শুধু অন্ধকারের চাদর মাটিকে ঢেকে রেখেছে। দূরে দূরে ক্ষেতজমির মাঝে জোনাকিরা আলো জ্বালাচ্ছিল ক্ষুদ্র প্রদীপের মতো। গ্রামের লোকেরা তখন গভীর নিদ্রায়, কেবল কয়েকজন কৃষক কাজের ফাঁকে রাত জেগে বসেছিল মচানঘরে। হঠাৎই নিস্তব্ধতার বুক চিরে ভেসে এল এক অদ্ভুত শব্দ—শাঁখের আওয়াজ। শাঁখ বাজানোর সেই সুর গ্রাম্য পূজার সময় সবাই শুনেছে, কিন্তু আজকের সেই সুর ভিন্ন ছিল—অত্যন্ত দীর্ঘ, করুণ আর বেদনায় ভরা। কৃষকরা প্রথমে ভেবেছিল হয়তো কোনো বাড়িতে পূজা চলছে, কিন্তু চারপাশে কোনো প্রদীপ, কোনো ধূপের গন্ধ, কোনো আলোই নেই। শুধু কালো রাত আর নিঃশব্দ প্রকৃতির মধ্যে সেই ভৌতিক শাঁখ বাজতে থাকল। ভয় আর কৌতূহলে তারা একে অপরের দিকে তাকাল, তারপর ধীরে ধীরে মচান থেকে নেমে পুকুরপাড়ের দিকে হাঁটতে লাগল, অথচ প্রতিটি পদক্ষেপেই বুক ধড়ফড় করছিল।
পুকুরের ধারে গিয়ে তারা দেখল চারপাশ একেবারে নিস্তব্ধ। কুয়াশার চাদরে ঢাকা জলে মৃদু ঢেউ খেলে যাচ্ছে। শাঁখের শব্দ যেন জল থেকে উঠে আসছে, কিন্তু সেখানে কোনো মানুষ নেই। অন্ধকারে তারা কারও ছায়া খুঁজতে চেষ্টা করল, কিন্তু দেখতে পেল শুধু জলে প্রতিফলিত কাঁপা কাঁপা চাঁদহীন আকাশ। হঠাৎ মনে হল বাতাসই থেমে গেছে, গাছের পাতার শব্দ মিলিয়ে গেছে। চারপাশ যেন শূন্যতার এক অদ্ভুত আবেশে ভরে উঠল। তখনই আবার বাজল সেই শাঁখ, এবার আরও জোরে, যেন বুকের ভেতরকার যন্ত্রণা ছিঁড়ে বেরোচ্ছে। এক কৃষক ঘাবড়ে গিয়ে বলল—“এটা তো মানুষের বাজানো নয় রে, এ যে আত্মার শব্দ।” আরেকজন কাঁপা গলায় বলল—“এ বেহুলার শাঁখ, শোনা যায় সে তার লখিন্দরের জন্য এখনও কাঁদে।” কথাটা মুখ থেকে বের হতেই অন্যদের শরীর কেঁপে উঠল। কারণ সবাই জানে এই গ্রামে পুরোনো বিশ্বাস আছে—বেহুলা একসময় এই পুকুরপাড়েই পূজা দিয়েছিল, যখন তার স্বামী লখিন্দর সাপের ছোবলে মারা যায়। তারপর থেকে মাঝে মাঝে গভীর রাতে শোনা যেত শাঁখের রহস্যময় শব্দ, কিন্তু এতটা স্পষ্ট আর বেদনাময় সুর তারা আগে শোনেনি।
খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল পুরো গ্রামে। ভোরের আলো ফুটতেই কৃষকেরা একে একে গিয়ে সবাইকে বলল রাতে কী ঘটেছিল। মহিলারা শিউরে উঠল, শিশুরা কান্নাকাটি করতে লাগল, আর বৃদ্ধরা মাথা নেড়ে বলল—“এ তো সেই পুরোনো অশান্ত আত্মা।” সকলে আবার মনে করতে লাগল বেহুলা আর লখিন্দরের কাহিনি—কীভাবে লখিন্দর সাপের কামড়ে মারা যায়, আর বেহুলা তাকে নিয়ে ভেলায় ভাসতে ভাসতে দেবতার কাছে প্রার্থনা করে। গ্রামের বুড়োরা বলতে লাগল, হয়তো সে মুক্তি পায়নি, তার শাঁখ বাজানো এখনো চলছে। ফলে সন্ধ্যা নামলেই গ্রামের রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়, কেউ আর পুকুরের ধারে যায় না। কুসংস্কারের আঁচে ভয় ঢুকে যায় প্রতিটি ঘরে, প্রতিটি হৃদয়ে। অথচ ভেতরে ভেতরে সবারই কৌতূহল—আসলে সেই শাঁখ কার বাজানো? বেহুলার আত্মা নাকি কোনো অজানা রহস্য? কিন্তু কেউ সাহস করে প্রশ্ন তুলতে চায় না। সবাই শুধু ভাবে—শাঁখের সেই করুণ সুর মানেই বেহুলার কান্না, মানেই মৃত্যুর পরেও তার অভিশপ্ত বেদনা এখনো এই গ্রামে বেঁচে আছে।
২
দিনের আলোয় গ্রাম যেন স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসে। ভোরবেলার হাটে গরুর গাড়ি আসে, শিশুরা মাঠে ছুটে বেড়ায়, মেয়েরা পুকুরঘাটে গিয়ে কলসি ডুবিয়ে জল তোলে। কৃষকেরা ক্ষেতমুখো হয়, আর চায়ের দোকানে বসে লোকেরা আড্ডা মারে। কিন্তু এ সবকিছুই যেন কেবল দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়তে না পড়তেই যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নামতে শুরু করে গ্রামে। সাঁঝের আকাশে প্রথম তারা জ্বলার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ঘরে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। যে পুকুরটি সকালবেলায় হাসি আর কোলাহলে ভরে থাকত, সেই পুকুরই সন্ধ্যা নামার পর মৃতপ্রায় নীরবতায় ডুবে যায়। শিশুদের বাইরে খেলতে যেতে দেওয়া হয় না; মায়েরা কড়া গলায় বলে দেয়—“অন্ধকারে পুকুরের ধার ঘেঁষবি না।” ছোটরা জানে না কেন এত নিষেধ, তবু বড়দের মুখে আতঙ্কের ছাপ দেখে তাদেরও বুক কেঁপে ওঠে। মহিলারা সন্ধ্যা নামলেই মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা করতে বসে। কারও হাতে রুদ্রাক্ষ, কারও হাতে তুলসীর পাতা, সবাই একসুরে প্রার্থনা করে—বেহুলার আত্মা যেন শান্তি পায়। যেন সেই শাঁখ আর না বাজে, আর রাতের আঁধার ছিন্নভিন্ন করে না গ্রামবাসীর ঘুম।
অন্যদিকে, গ্রামের পুরুষরাও ভেতরে ভেতরে ভয়ে কাঁপলেও বাইরে সাহস দেখাতে চায়। তারা চায়ের দোকানে বসে নানা গল্প করে। কেউ বলে—“এ সব কুসংস্কার, শাঁখের শব্দ হয়তো বাতাসে ভেসে আসছে।” আবার কেউ বলে—“না না, আমি তো নিজে শুনেছি, মনে হচ্ছিল বুক চিরে যাচ্ছে।” এমন কথাবার্তায় দোকান ভরে যায়, কিন্তু সূর্য ডুবে যেতেই সবাই দ্রুত বাড়ির পথে পা বাড়ায়। গ্রামজুড়ে এমন এক অদ্ভুত বিভীষিকার আবহ তৈরি হয়, যা কেবল রাতে ঘনীভূত হয়ে ওঠে। অল্পবয়সী ছেলেরা মাঝে মাঝে সাহস দেখিয়ে বলে—“চলো না, আজ রাতে পুকুরপাড়ে গিয়ে দেখি কী হয়!” কিন্তু শেষমেশ কেউ সাহস করে না, অন্ধকার নামলেই তাদের বুক ধড়ফড় শুরু হয়ে যায়। বিশেষ করে যারা প্রথম রাতের সেই শাঁখ শোনার সাক্ষী, তাদের চোখের ভয় আরও গভীর। তারা জানে, যে শব্দ তারা শুনেছে, তা নিছক বাতাসের খেলা হতে পারে না। সেই সুরে এমন বেদনা ছিল যা মানুষের বাজানো শাঁখে কখনোই থাকে না।
এভাবেই ধীরে ধীরে বেহুলার কাহিনি আবার নতুন করে জীবন্ত হয়ে ওঠে গ্রামে। বৃদ্ধরা শিশুদের কাছে বসে পুরোনো গল্প শোনায়—কীভাবে লখিন্দর সাপের ছোবলে মারা গেল, কীভাবে বেহুলা তাকে ভেলায় ভাসিয়ে আকাশ-পাতাল খুঁজে বেড়াল, কীভাবে শেষমেশ দেবতাদের কৃপায় সে তার স্বামীকে ফেরাল। কিন্তু সবাই একসঙ্গে এ কথাও বলে—“সে কি সত্যিই শান্তি পেয়েছিল?” গ্রামের ছোটরা অবাক হয়ে ভাবে—মৃত্যুর পরও কি মানুষ কাঁদতে থাকে? আর বয়স্করা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে—“হয়তো পেয়েছিল, কিন্তু এই পুকুরপাড়ে তার অশান্ত আত্মা থেকে গেছে।” দিন যত গড়াতে থাকে, শাঁখের সেই গল্প ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের গ্রামেও। কেউ কেউ কৌতূহলবশত আসতে চায়, আবার অনেকে ভয়ে কাছে ঘেঁষতে সাহস পায় না। রাতের আঁধার নামলেই যেন অদৃশ্য এক আবরণে ঢেকে যায় গোটা গ্রাম। মোমবাতির আলোয় ভরা ঘরে বসে মানুষ একে অপরকে জড়িয়ে ধরে, আর বাইরের পুকুরের জলে অদ্ভুত কাঁপন তুলতে থাকে সেই অজানা আতঙ্ক—যেন যে কোনো মুহূর্তে আবার বাজবে বেহুলার শাঁখ।
৩
হরিপদ মাস্টার ছিলেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে, কিন্তু তার চোখেমুখে এখনো তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ঝলক। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ আর যুক্তির প্রতি অটল বিশ্বাস তাকে গ্রামের অন্যদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল। তিনি শহরে কলেজে পড়াশোনা করেছেন, তারপর ইচ্ছা করেই গ্রামে ফিরে এসে শিশুদের পড়াতে শুরু করেন। গ্রামবাসীর কাছে তিনি ছিলেন একদিকে শিক্ষক, অন্যদিকে একরকম পথপ্রদর্শকও। তবে এই পথপ্রদর্শকতা তিনি সবসময় বিজ্ঞান আর যুক্তির আলোকে করতেন। তাই যখন শাঁখ বাজানোর ঘটনা নিয়ে গ্রামে ভয় ছড়িয়ে পড়ল, তিনি একেবারেই তা মানতে পারলেন না। তিনি বললেন—“এ সবই কুসংস্কার। ভূত বলে কিছু হয় না। নিশ্চয় কেউ ইচ্ছে করেই রাতে শাঁখ বাজাচ্ছে। হয়তো ভয় দেখিয়ে কিছু লুকোচ্ছে।” তাঁর যুক্তিগুলো স্পষ্ট ও দৃঢ় ছিল। তিনি বোঝাতে লাগলেন—“দেখো, রাতের অন্ধকারে মানুষ যা দেখে বা শোনে তা সবসময় সত্যি হয় না। ভয় আমাদের কল্পনাকে বাড়িয়ে তোলে।” কিন্তু গ্রামের মানুষ তাঁর কথা শুনলেও মনের মধ্যে ভয় কাটাতে পারল না। বরং তারা ফিসফিস করে বলতে লাগল—“মাস্টারমশাই তো বই পড়েছেন, তাই এসব মানেন না। কিন্তু আমরা তো নিজের কানে শুনেছি। এতগুলো মানুষ কি মিথ্যে বলবে?”
হরিপদ মাস্টার বারবার তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলেন। স্কুলে পড়ানোর সময়ও তিনি উদাহরণ টেনে বললেন—“আলো না থাকলে আমাদের চোখ বিভ্রম তৈরি করে। অনেক সময় অন্ধকারে আমরা এমন কিছু দেখি যা বাস্তবে নেই। আবার শব্দও বাতাসে ছড়িয়ে বিকৃত হয়। শাঁখের মতো শব্দ দূর থেকে ভেসে এলে অন্যরকম শোনাতে পারে।” তাঁর ছাত্ররা তখন চুপচাপ শুনে, কিন্তু গ্রামে ফিরে গিয়ে আবার বয়স্কদের কাছে শুনতে পায় বেহুলার করুণ কাহিনি। ফলে যুক্তি আর বিশ্বাসের এই টানাপোড়েনে সবাই দোটানায় পড়ে যায়। বিশেষ করে যারা প্রথম রাতের সেই শাঁখ শুনেছিল, তারা তো একেবারেই অটল—তাদের মতে, সেই শব্দ মানবকণ্ঠে তৈরি নয়। গ্রামের মহিলারা মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা করতে থাকল, আর শিশুরা রাতে ভয়ে বিছানা ছাড়তে সাহস পায় না। এই পরিস্থিতিতে হরিপদ মাস্টার প্রায় একাই থেকে গেলেন যুক্তির পক্ষে দাঁড়িয়ে। তাঁর মনে হল, এভাবে চলতে থাকলে ভয় গ্রামকে গ্রাস করবে, মানুষ কাজকর্ম বন্ধ করে দেবে। তাই তিনি স্থির করলেন সত্য খুঁজে বের করতেই হবে।
তবে ভেতরে ভেতরে তিনিও কিছুটা অস্বস্তি টের পাচ্ছিলেন। কারণ তিনিও এক রাত শাঁখের সেই শব্দ শুনেছিলেন। হ্যাঁ, তিনি মানতে চাননি, কিন্তু যখন স্কুল থেকে ফেরার পথে সন্ধ্যা নামতে না নামতেই পুকুরপাড় দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন দূর থেকে সেই শাঁখ বাজতে শুনেছিলেন। তার বুক কেঁপে উঠেছিল, শরীর ঠাণ্ডা হয়ে এসেছিল, কিন্তু তিনি দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়েছিলেন। পরে নিজেকে বোঝালেন—“এ তো কারও বাজানো শাঁখ, হয়তো কোনো ছেলে দুষ্টুমি করছে।” কিন্তু সন্দেহের কাঁটা মনের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। আর এটাই তাঁকে আরও বেশি যুক্তিবাদী করে তুলল। তিনি ঠিক করলেন, এক রাতে তিনি নিজেই প্রমাণ করবেন গ্রামে ভূত নেই, শাঁখ বাজানোও মানুষের কাজ। এ সিদ্ধান্ত তিনি কারও কাছে বলেননি, তবে ভেতরে ভেতরে একটা পরিকল্পনা গড়ে উঠছিল। তাঁর চোখে-মুখে তখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল কৌতূহল আর একধরনের একগুঁয়ে দৃঢ়তা। গ্রামে সবাই যখন ভয়কে সত্যি বলে মানতে শুরু করেছে, তখন তিনি একাই লড়াই শুরু করলেন অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে। আর ঠিক এই লড়াই-ই ধীরে ধীরে তাঁকে টেনে নিয়ে গেল বেহুলার রহস্যের গভীরে, যেখানে যুক্তি আর কুসংস্কারের সীমারেখা ঝাপসা হয়ে যেতে শুরু করল।
৪
মনোরমা পিসি গ্রামের প্রাচীনতম নারীদের একজন। বয়স আশির কাছাকাছি হলেও তার স্মৃতি আর কণ্ঠস্বর আজও তীক্ষ্ণ। সাদা চুল খোঁপায় বাঁধা, চোখে মোটা চশমা, আর ঠোঁটের কোণে অচল ভাঁজের মতো হাসি—তাকে দেখলে সবার মধ্যে একধরনের শ্রদ্ধা জাগত। ছোটবেলা থেকে তিনি গ্রামের সবকিছুই দেখে আসছেন। তাই যখন তিনি কোনো কথা বলেন, তা গ্রামবাসীরা নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করে। সেই রাতে, সবাই যখন পুকুরপাড়ের ভৌতিক শাঁখ নিয়ে ফিসফাস করছে, তখন মনোরমা পিসি হঠাৎই ঘোষণা করলেন—“আমি দেখেছি, আমি নিজে দেখেছি ওকে।” সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। তিনি গলা পরিষ্কার করে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন। তার কণ্ঠে কোনো কাঁপুনি ছিল না, বরং এক অদ্ভুত দৃঢ়তা, যা উপস্থিত সবাইকে আরও অস্বস্তিতে ফেলল। তিনি বললেন—“কাল রাতে যখন আমি ঘুমোতে পারছিলাম না, তখন জানলার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাই। তখন দেখি পুকুরপাড়ে এক সাদা শাড়ি পরা মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। ভিজে চুল কাঁধে ছড়িয়ে পড়েছে, যেন সদ্য জলে উঠেছে। তার হাতে শাঁখ, আর মুখে এমন যন্ত্রণা, এমন কান্না—যেন বুক ফেটে যাচ্ছে। চোখে অশ্রু, ঠোঁট কাঁপছে, তবু নিরলসভাবে শাঁখ বাজাচ্ছে।”
এই বর্ণনা শোনার পর গ্রামের মানুষের বুক কেঁপে উঠল। একে তো এতদিন তারা শুধু শাঁখের শব্দ শুনছিল, কোনো ছায়ামূর্তি দেখেনি। তাই একটা ক্ষীণ আশা ছিল—হয়তো সবই ভুল বোঝাবুঝি, হয়তো সত্যিই কারও দুষ্টুমি। কিন্তু মনোরমা পিসির মুখ থেকে এমন স্পষ্ট ও বিস্তারিত বিবরণ শুনে সেই আশার আলোও নিভে গেল। কারণ তিনি কখনো মিথ্যা বলেন না, বরং গ্রামে বিচার-বিবাদের সময়ে তার সাক্ষ্যই সবাই মানে। তাই তার এই বর্ণনা মানুষের মনে অচিরেই গভীর ছাপ ফেলল। মহিলারা চোখে হাত দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগল, পুরুষরা চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইল। শিশুদের মুখে আতঙ্ক জমে গেল। সবাই একবাক্যে বিশ্বাস করল—এ আর মানুষের কাজ নয়, এ বেহুলার আত্মাই ফিরে এসেছে। কেউ বলল—“দেখেছো? আমাদের পূর্বপুরুষদের কাহিনি সত্যি ছিল।” কেউ আবার ফিসফিস করে বলল—“যদি সে সত্যিই শান্তি না পেয়ে থাকে, তবে আমাদের সর্বনাশ আসন্ন।” সেই মুহূর্ত থেকে গ্রামবাসীর মনে ভয় আরও বহুগুণ বেড়ে গেল। রাত নামলেই পুকুরের দিক থেকে কুকুর হাউ হাউ করে ডাকতে শুরু করত, মানুষ সেটাকেও বেহুলার উপস্থিতির ইঙ্গিত বলে মনে করত।
কিন্তু এই ভয় শুধু মানুষের মনকেই গ্রাস করল না, গ্রামের দৈনন্দিন জীবনের ওপরও প্রভাব ফেলতে শুরু করল। মহিলারা আর পুকুরে নামতে সাহস করল না, জলের জন্য তারা কষ্ট করে দূরের কুয়ো থেকে জল আনতে লাগল। কৃষকেরা সন্ধ্যার আগেই কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে আসত, মাঠে আর গরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত না। রাতে কেউ অসুস্থ হলে ডাক্তার আনতে লোক পাওয়া যেত না, কারণ অন্ধকারে বাইরে বেরোবার সাহস কারও ছিল না। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাও শোনা শুরু করল বেহুলার কাহিনি নতুন করে, আর তারা ভয়ে ক্লাসে মন বসাতে পারল না। হরিপদ মাস্টার চেষ্টা করলেন সবাইকে বোঝাতে—“মনোরমা পিসি হয়তো কুয়াশার ছায়াকে ভুল করে মহিলা ভেবেছেন।” কিন্তু মানুষ তার যুক্তি মানল না। বরং গ্রামের কেউ কেউ বলতে লাগল—“মাস্টারমশাইকে শাস্তি পেতে হবে, তিনি যদি দেবী আত্মাকে অস্বীকার করেন তবে আমাদের সর্বনাশ হবে।” একসময় গ্রামের মানুষ এতটাই ভীত আর হতাশ হয়ে পড়ল যে, তারা সত্যিই বিশ্বাস করতে শুরু করল—বেহুলার অশান্ত আত্মা তাদের শাস্তি দেবে। আর এই বিশ্বাস, এই আতঙ্ক ধীরে ধীরে গ্রামটিকে এক অদ্ভুত ভয়ের অন্ধকারে ডুবিয়ে দিতে লাগল।
৫
রঞ্জন গ্রামের এক তরুণ কৃষক, বয়সে মাত্র বাইশ-তেইশ। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা, কাঁধ চওড়া, হাত শক্তপোক্ত—ছোট থেকেই খেতে কাজ করে শরীরটা গড়ে উঠেছে পাথরের মতো দৃঢ়। রঞ্জনকে গ্রামে সবাই চিনত তার সাহস আর দাপুটে স্বভাবের জন্য। ছোটবেলায় গাছ থেকে পড়ে আহত হলেও কান্না করেনি, বরং দাঁতে দাঁত চেপে সইয়ে নিয়েছিল। সে পড়াশোনায় তেমন ভালো না হলেও আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। তাই যখন শাঁখ বাজানোর ঘটনা নিয়ে পুরো গ্রাম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছিল, তখন রঞ্জনই একমাত্র খোলাখুলি বলল—“এ সব বাজে কথা। ভূত বলে কিছু নেই।” চায়ের দোকানে, মাঠের আড্ডায়, এমনকি হরিপদ মাস্টারের সঙ্গে আলোচনায়ও সে জোর দিয়ে বলত—“যদি ভূত সত্যি থাকত, তবে আমি আগে দেখতাম। আমি এই গ্রামে জন্মেছি, বড় হয়েছি। এতদিন তো কিছু দেখিনি।” কিন্তু মনোরমা পিসির সাক্ষ্যের পর পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নেয়। সবার মুখ গম্ভীর হয়ে যায়, কেউ আর রঞ্জনের সঙ্গে তর্ক করতে চায় না। তখনই রঞ্জন সিদ্ধান্ত নিল—কথা দিয়ে নয়, কাজে প্রমাণ করতে হবে। তাই এক দুপুরে সে সবার সামনে ঘোষণা করল—“আজ রাতে আমি যাব পুকুরপাড়ে। আমি দেখব, আর প্রমাণ করব—এ সব কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়।” তার কণ্ঠে দৃঢ়তা ছিল, কিন্তু ভেতরে কোথাও একটা কাঁপনও কাজ করছিল, যা সে নিজেও টের পায়নি।
রঞ্জনের বন্ধুরা আতঙ্কিত হয়ে উঠল। তারা চেষ্টা করল তাকে থামাতে। তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু গোপাল বলল—“রঞ্জন, পাগলামি করিস না। যদি সত্যিই কিছু থাকে?” রঞ্জন হেসে উত্তর দিল—“তাহলে দেখা যাবে, ভয় পেলে তো চলবে না।” অন্যরা বলল—“মনোরমা পিসি মিথ্যে বলবে না, তুই জানিস। উনি যা দেখেছেন, সেটা সত্যিই হয়েছে।” কিন্তু রঞ্জন হাল ছাড়ল না। তার মনে হয়েছিল, ভয় মানুষকে বন্দি করে রাখে। আর যদি সে প্রমাণ করতে পারে ভূত বলে কিছু নেই, তবে পুরো গ্রাম ভয় থেকে মুক্তি পাবে। সে বলল—“তোরা চাইলে আমার সঙ্গে চল, না চাইলে আমি একাই যাব।” কিন্তু কেউ রাজি হলো না। রাত যত ঘনিয়ে আসছিল, ততই বন্ধুদের বুক কাঁপছিল। তারা শেষমেশ তাকে বোঝাতে পারল না, শুধু অনুরোধ করল—“কমপক্ষে ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করিস, এখন যাস না।” কিন্তু রঞ্জন অটল। সে মনে মনে শপথ করল—ভয় নামের এই শিকল সে ছিঁড়ে ফেলবেই।
সেদিন রাত। আকাশে মেঘ জমেছে, চাঁদ মাঝে মাঝে বেরিয়ে আবার আড়ালে চলে যাচ্ছে। বাতাসে এক অদ্ভুত ঠাণ্ডা ভাব, চারপাশে পোকামাকড়ের শব্দও যেন থেমে গেছে। গ্রামজুড়ে নীরবতা নেমে এসেছে, সবাই দরজা-জানালা বন্ধ করে মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে আছে। আর সেই নীরবতার মধ্যেই রঞ্জন একা পুকুরের দিকে হাঁটা দিল। হাতে কেবল একটি লণ্ঠন, কোমরে দা গুঁজে নিয়েছিল সাহসের প্রতীক হিসেবে। পথের ধারে কুকুর হাউ হাউ করে ডাকছিল, যেন তাকে সতর্ক করছে। বন্ধুরা দূর থেকে তার পিছু নিল, কিন্তু সাহস করে বেশি কাছে গেল না। রঞ্জনের পদক্ষেপ ভারী, কিন্তু বুকের ভেতর ধুকপুকানি ক্রমশ বাড়ছিল। পুকুরপাড়ের কাছে পৌঁছতেই চারপাশে হঠাৎ যেন হাওয়া বইতে লাগল, লণ্ঠনের আলো দুলে উঠল। আর ঠিক তখনই, অন্ধকারের বুক চিরে ভেসে এল সেই পরিচিত শাঁখের শব্দ—গভীর, দীর্ঘ আর বেদনায় ভরা। রঞ্জনের পা থমকে গেল। তার শরীরে শিহরণ বয়ে গেল বটে, কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে সে সামনে এগোল। দূরে পুকুরের ধারে যেন কারও ছায়া নড়ল। বন্ধুরা দূর থেকে চিৎকার করে উঠল—“ফিরে আয় রঞ্জন!” কিন্তু রঞ্জন থামল না। সে জানত, এই রাতই তার পরীক্ষা, আর এই রাতই প্রমাণ করবে—ভয় কি মানুষের সৃষ্টি, নাকি সত্যিই এখানে কোনো অশরীরী আত্মা রয়েছে।
৬
রঞ্জন সাহস নিয়ে যখন পুকুরের ধারে পৌঁছাল, তখন চারদিক যেন হঠাৎ এক অদৃশ্য শক্তিতে থেমে গেল। বাতাস আর বইছে না, পাতার মর্মর ধ্বনি থেমে গেছে, এমনকি ব্যাঙের ডাক, ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজও স্তব্ধ। সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে শোনা গেল একটানা গভীর আর করুণ শাঁখের শব্দ, যা বুকের ভেতর ঢুকে কাঁপন ধরাচ্ছে। রঞ্জন হাতের লণ্ঠন শক্ত করে ধরল, কিন্তু আলো টলমল করতে লাগল, যেন ভয়ও তাকে গ্রাস করেছে। তার বুকের ভেতর ধুকপুকানি বাড়তে লাগল, কপাল ঘেমে ভিজে গেল। সে নিজের মনে বলল—“এটা মানুষের কাজ, আমি ভয় পাব না।” কিন্তু যতই নিজের সাহস জাগাতে চাইছিল, ততই শরীর জমে আসছিল। হঠাৎই চোখে পড়ল—পুকুরের জলে কিছু একটা নড়ছে। প্রথমে ভেবেছিল জেলেপাড়ার কোনো ছেলে হয়তো সাঁতার কাটছে, কিন্তু ধীরে ধীরে তা রূপ নিল এক দীর্ঘকায় সাদা ছায়ায়। জল থেকে উঠে আসছে, ভিজে চুল কাঁধে লেপ্টে আছে, মুখের অবয়ব অস্পষ্ট, কিন্তু চোখদুটি যেন জ্বলছে। রঞ্জনের বুকের ভেতর যেন বজ্রপাত হলো, হাত থেকে লণ্ঠন প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। সেই ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে পুকুরঘাটের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল, হাতে শাঁখ ধরে তার দিকে তাকিয়ে। শাঁখের শব্দ এবার আরও বেদনায়, আরও করুণ সুরে বাজতে লাগল, যেন প্রতিটি ঢেউয়ে অশ্রু ঝরছে।
রঞ্জনের হাঁটু কাঁপতে শুরু করল, সে নিজেকে শক্ত রাখতে চাইল, কিন্তু চোখের সামনে দৃশ্যটা এতটাই ভয়ঙ্কর যে যুক্তি আর সাহস দুটোই ম্লান হয়ে গেল। সে বুঝতে পারছিল না এটা তার বিভ্রম, নাকি সত্যিই বেহুলার আত্মা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ এক ঝলক আলোয় সে দেখল—মুখটা এক নারী, চোখদুটি ভরা অশ্রু, ঠোঁট কাঁপছে যন্ত্রণায়। মুহূর্তেই রঞ্জনের দম বন্ধ হয়ে এলো। ভয়ে সে পিছিয়ে গেল কয়েক পা, কিন্তু মাটিতে পা জড়িয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। সে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই শাঁখের শব্দ যেন কানে ঢুকে মাথার ভেতর বাজতে লাগল। মনে হলো, শব্দটা তার বুক ফাটিয়ে বাইরে আসছে। বন্ধুরা দূরে দাঁড়িয়ে কেবল ভয়ার্ত চিৎকার করছে, কিন্তু কাছে আসার সাহস কারও নেই। সেই সময় ছায়ামূর্তি এক ঝলকে যেন জলের মধ্যে মিলিয়ে গেল। তবে তার চোখদুটি শেষ মুহূর্তে রঞ্জনের দিকে এমনভাবে তাকাল যে মনে হলো অশ্রু আর অভিশাপ একসঙ্গে ছুঁড়ে দিল। রঞ্জন তখন প্রাণপণে উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে পালাতে লাগল। তার বুক ধড়ফড় করছে, নিঃশ্বাস আটকে আসছে, কিন্তু সে থামল না—যেন পুরো গ্রাম পেরিয়ে না গেলে ছায়ামূর্তি আবার পিছন থেকে ধরা দেবে।
যখন সে অবশেষে দৌড়ে নিজের আঙিনায় ফিরল, তখন গ্রামের লোকজন চারপাশে ভিড় জমাল। সবার চোখে ভয়ের সঙ্গে এক অদ্ভুত কৌতূহল—“কি দেখলি রঞ্জন? কাকে দেখলি?” রঞ্জন হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়ল, শরীর ঘেমে ভিজে গেছে, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। কিন্তু কোনো স্পষ্ট কথা সে বলতে পারল না। বারবার শুধু ফিসফিস করে বলল—“আমি দেখেছি… সাদা শাড়ি… চোখে জল… শাঁখ…”। বাকিটুকু তার গলায় আটকে গেল। গ্রামবাসী একে অপরের দিকে তাকাল, আরেকবার আতঙ্ক আরও গাঢ় হয়ে উঠল। কেউ কেউ চিৎকার করে বলল—“এটাই প্রমাণ! বেহুলা সত্যিই ফিরেছে!” হরিপদ মাস্টার চেষ্টা করলেন বোঝাতে—“রঞ্জন ভয় পেয়েছে, তাই ঠিকমতো কিছু বলতে পারছে না।” কিন্তু গ্রামবাসীর চোখে তখন আর যুক্তির কোনো দাম নেই। তারা বিশ্বাস করে ফেলল, বেহুলার আত্মা এবার সত্যিই জেগে উঠেছে। আর রঞ্জনের সেই ভয়ার্ত মুখ, কাঁপা শরীর, অস্পষ্ট সাক্ষ্য—সব মিলিয়ে গ্রামের ভয় যেন হাজারগুণ বেড়ে গেল। সেই রাতের পর থেকে কেউ আর অন্ধকার নামলে ঘরের বাইরে পা রাখল না, আর পুকুরপাড় হয়ে উঠল এক শ্মশান-নিঃশব্দ স্থান, যেখানে শুধু কল্পনার আতঙ্ক আর বেহুলার অশ্রুসিক্ত শাঁখের সুর ভেসে বেড়ায়।
৭
রঞ্জনের আতঙ্কিত প্রত্যাবর্তনের পর গ্রামে যেন ঝড় বয়ে গেল। দিনদুপুরেও লোকজনের মুখে সেই রাতের গল্প ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর রাত নামলেই দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয় সবাই। এমন সময়ে গ্রামের প্রবীণ পুরোহিত শশী দাদুকে ডেকে আনা হলো। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, কপালে চন্দন-চিহ্ন, লম্বা সাদা দাড়ি ও কুঞ্চিত ভ্রুতে বয়সের ছাপ স্পষ্ট হলেও তাঁর চোখে ছিল এক গভীর শান্তি। সবাই জানত, শশী দাদু শুধু ধর্মীয় কাজেই সিদ্ধহস্ত নন, তিনি লোককাহিনি আর তন্ত্র-মন্ত্রেরও পণ্ডিত। গ্রামের মাটির মন্দিরে তিনি প্রতিদিন পূজা দেন, গ্রামবাসীর নানা সমস্যায় পরামর্শ দেন। তাই সবাই ভরসা করে তাঁর কাছে এল। এক সন্ধ্যায়, যখন আঙিনায় প্রদীপ জ্বলা শুরু হয়েছে, গ্রামবাসীরা মশাল হাতে ভিড় করল শশী দাদুর উঠোনে। অনেকে কাঁদছে, অনেকে ভয়ে কাঁপছে। শশী দাদু গম্ভীর চোখে সবাইকে শুনলেন, তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন—“তোমরা যা দেখছ, তা কোনো কল্পনা নয়। এই গ্রাম বহু বছর ধরে বেহুলার কাহিনির সাক্ষী। লখিন্দরের মৃত্যু আর বেহুলার কান্না এই পুকুরের ধারে মিশে আছে। তার আত্মা মুক্তি পায়নি, তাই সে আজও শাঁখ বাজায়, কান্না করে। এটাই তার অস্থিরতা।” শশী দাদুর কণ্ঠস্বর শান্ত হলেও তার প্রতিটি শব্দ যেন গ্রামবাসীর বুক কাঁপিয়ে দিচ্ছিল।
লোকজন স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। শশী দাদু এবার আরও স্পষ্ট করে বললেন—“মৃত আত্মা যদি মুক্তি না পায়, তবে সে অশান্ত থাকে। বেহুলা যে কষ্ট নিয়ে এই গ্রাম ছেড়েছিল, সেই কষ্ট আজও অটুট। শাঁখ তার অশ্রু, শাঁখ তার যন্ত্রণা। তোমরা দেখেছ—রঞ্জনও চোখে দেখেছে। কিন্তু ভয়ের কিছু নেই। আত্মা কখনো কাউকে বিনা কারণে ক্ষতি করে না। তবে যদি তাকে মুক্তি না দেওয়া যায়, তবে তার দুঃখ গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে। খেত নষ্ট হবে, ঘরে অশান্তি আসবে, মানুষ অসুখে পড়বে।” গ্রামবাসীর ভেতরে ভয় আরও বেড়ে গেল। অনেকে একে অপরকে জড়িয়ে ধরল, কেউ কেউ হাত জোড় করে প্রণাম করল। গ্রামের মহিলারা চোখ মুছতে মুছতে বলল—“তাহলে দাদু, আমাদের কী করতে হবে?” শশী দাদু দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন—“তার আত্মাকে শান্তি দিতে হবে। পূজা করতে হবে, শ্রাদ্ধ করতে হবে। না হলে এই অস্থিরতা থামবে না।” তাঁর কণ্ঠে এমন দৃঢ়তা ছিল যে কারও মনে আর সন্দেহ রইল না।
সেদিন রাতেই গ্রামবাসীরা সিদ্ধান্ত নিল—এক বড় পূজার আয়োজন করা হবে। পুকুরপাড় পরিষ্কার করে সেখানে মণ্ডপ বাঁধা হবে, পুরোহিতদের দিয়ে বিশেষ মন্ত্রপাঠ হবে, বেহুলার নামে দান করা হবে। মহিলারা সলতে পাকাতে লাগল, যুবকেরা বাঁশ কাটতে বেরোল, কৃষকেরা ধান, চাল, ফলমূল সংগ্রহ করল। গ্রামজুড়ে যেন এক নতুন আলোড়ন শুরু হলো। কেউ ভয়ে নয়, এবার সবাই উৎসর্গ আর মুক্তির আশায় একত্র হলো। কিন্তু এর মাঝেই হরিপদ মাস্টারের ভ্রু কুঁচকে গেল। তিনি বললেন—“দাদু, ভূত বলে কিছু নেই। এগুলো কেবল মানুষের ভয়। পূজা করলে মানুষের মন শান্ত হবে, কিন্তু এসব অলৌকিক ব্যাপার সত্যি নয়।” শশী দাদু শান্তভাবে তার দিকে তাকালেন, মৃদু হাসলেন। “হরিপদ, যুক্তি সবসময় সত্যি বলে না। কিছু কিছু বিষয় আছে যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু থাকে। বিশ্বাস মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। ভয় আর বিশ্বাসের মাঝেই মানুষের অস্তিত্ব।” মাস্টার কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেলেন। গ্রামবাসীরা তখন মশালের আলোয় শশী দাদুর চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল, আর তাঁদের চোখে একসঙ্গে ভয় ও আশা মিলেমিশে জ্বলজ্বল করছিল। তারা বিশ্বাস করল, শশী দাদুর এই পূজাই হবে বেহুলার আত্মাকে মুক্ত করার একমাত্র উপায়।
৮
শশী দাদুর কথায় গ্রামবাসী যখন পূজার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে, তখন হরিপদ মাস্টারের মনে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব তৈরি হলো। তিনি ছোটবেলা থেকেই যুক্তি আর বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করেছেন, কুসংস্কারকে কখনো পাত্তা দেননি। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো তাকে ভিতরে ভিতরে নাড়া দিতে শুরু করেছিল। রঞ্জনের আতঙ্ক, মনোরমা পিসির বিবরণ, এমনকি নিজের ছাত্রদের চোখে দেখা ভয়ের ছাপ—সব মিলিয়ে তিনি দ্বিধায় পড়লেন। তবুও মনের গভীরে তিনি দৃঢ়ভাবে ঠিক করলেন, এই রহস্যের জট খুলতেই হবে। ভূত বলে কিছু নেই, সবই মানুষের বানানো। আর যদি সত্যিই কিছু ঘটে থাকে, তবে তার বৈজ্ঞানিক কারণ অবশ্যই আছে। এই চিন্তা থেকেই তিনি গ্রামের কয়েকজন সাহসী যুবককে ডাকলেন। রঞ্জন বাদে আরও তিনজন—নিতাই, গোপাল আর কিরণ—এগিয়ে এল। তারা সবাই মাঠে-ঘাটে খাটতে খাটতে দমে না যাওয়া তরুণ, তবে শাঁখের শব্দে তাদেরও বুক ধড়ফড় করে ওঠে। হরিপদ মাস্টার তাঁদের সামনে একটা ছোট টেপ-রেকর্ডার আর লণ্ঠন রেখে বললেন, “আজ রাতে আমরা পুকুরপাড়ে থাকব। এই যন্ত্রে শব্দ রেকর্ড করব। যদি সত্যিই কেউ শাঁখ বাজায়, তবে তা প্রমাণ হয়ে যাবে। ভয় পেও না, আমি আছি।” তাঁর গলায় আত্মবিশ্বাস থাকলেও চোখের ভেতরে এক অদ্ভুত কৌতূহলও লুকানো ছিল।
সেদিন গভীর রাতে, যখন পুরো গ্রাম ঘুমিয়ে পড়েছে, তারা চারজন মিলে চুপিচুপি পুকুরপাড়ে গিয়ে বসল। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ। টেপ-রেকর্ডার চালু করা হলো, লাল আলো জ্বলল। সবাই নিঃশ্বাস চেপে অপেক্ষা করতে লাগল। প্রথম এক ঘণ্টা কিছুই হলো না। হরিপদ মাস্টার মনে মনে হাসলেন—“দেখেছ, সব বাজে কথা।” কিন্তু হঠাৎ করে বাতাস থেমে গেল, যেন প্রকৃতি নিজেই স্তব্ধ হয়ে পড়ল। ঠিক তখনই ভেসে এল সেই পরিচিত শাঁখের শব্দ—গভীর, দীর্ঘ, বুক কাঁপানো সুরে বাজছে। চারজন একসঙ্গে চমকে উঠল। যন্ত্রের দিকে তাকাতেই দেখা গেল, টেপ-রেকর্ডারের লাল আলো নিভে গেল। হরিপদ মাস্টার তড়িঘড়ি করে বোতাম টিপলেন, কিন্তু যন্ত্র একেবারেই কাজ করল না। যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি সেটাকে অকার্যকর করে দিল। “এটা কীভাবে সম্ভব!”—তিনি বিড়বিড় করে উঠলেন। নিতাই ভয়ে ফিসফিস করে বলল, “দেখেছেন দাদা? এটা অশরীরীর কাজ।” কিন্তু মাস্টার থামতে রাজি নন। তিনি বললেন, “শান্ত হও, হয়তো যন্ত্রে সমস্যা হয়েছে।” কথাটা শেষ হতেই কিরণ হঠাৎ চিৎকার করে উঠল। সে অনুভব করেছিল, কেউ তার কাঁধে বরফের মতো ঠাণ্ডা হাত রাখল। চারপাশে কেউ নেই, তবুও সেই স্পর্শ যেন হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিল। গোপালও আতঙ্কে ফ্যাকাশে মুখে বলল, “আমার কানে যেন কেউ ফিসফিস করে বলল।” অথচ আশেপাশে ছিল নিস্তব্ধতা আর ঘন কুয়াশা।
হরিপদ মাস্টার এই সব দেখে আর নিজের যুক্তিকে শক্ত রাখতে পারলেন না। এক মুহূর্তের জন্য তাঁর বুকের ভেতরেও ভয় কাজ করল। তিনি সাহস করে বললেন, “চল, আর দেরি নয়।” সবাই মিলে দৌড়ে পুকুরপাড় ছেড়ে গ্রামের দিকে ছুটল। ফেরার পথে কারও কারও মনে হলো, তাদের পেছনে কারও পায়ের শব্দ ভেসে আসছে। যেন কেউ ধীরে ধীরে পিছু নিচ্ছে। ঘামে ভিজে, হাঁপাতে হাঁপাতে তারা অবশেষে গ্রামে ফিরল। সেদিন রাতে আর কারও ঘুম হলো না। ভোর হতেই মাস্টার চেষ্টা করলেন যন্ত্রটা চালু করতে। আশ্চর্যজনকভাবে টেপ-রেকর্ডার একেবারে ঠিকঠাক চলছে। কিন্তু যখন ক্যাসেট শুনলেন, সেখানে কেবল একটানা স্ট্যাটিক শব্দ, যেন কোনো অদৃশ্য স্রোত পুরো রেকর্ডিং মুছে দিয়েছে। কোনো শাঁখের শব্দ নেই, কোনো ফিসফিস নেই। শুধু এক ভৌতিক শূন্যতা। মাস্টার চুপ করে বসে রইলেন, কিছু বলতে পারলেন না। যুবকেরা তো আগেই ভয়ে কাঁপছে, এবার তাদের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হলো—“এটা মানুষের কাজ নয়, এটা অশরীরীর শক্তি।” হরিপদ মাস্টার প্রথমবার নিজের ভিতরে টলমল করে উঠলেন। তিনি চাইলেও আর স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারলেন না। এক অজানা রহস্য যেন তাঁকেও গ্রাস করতে শুরু করেছে।
৯
মনোরমা পিসি ছিলেন গ্রামের এক প্রাচীন আত্মা, বয়সের ভারে শরীর নুয়ে গেলেও মন তাঁর ছিল কিশোরীর মতোই সজাগ। তিনি ছোট থেকেই বেহুলার কাহিনি শুনেছেন, কখনো চোখের সামনে স্বপ্নে দেখেছেনও তার রূপ। কিন্তু সেদিন রাতে যা ঘটল, তা তাঁকে শিহরিত করে তুলল। ভোরের আগে ঘুম ভাঙল তাঁর, মনে হলো বুকের ভেতর কেউ নীরবে টোকা মারছে। হঠাৎই স্বপ্নের ভেতর তিনি দেখলেন—পুকুরের ধারে সাদা শাড়ি পরা এক কিশোরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার লম্বা ভেজা চুল ঝরে পড়ছে কাঁধে, চোখ দুটো জলে ভিজে কষ্টের ভারে ঝলমল করছে। সে কাঁপা কণ্ঠে বলল, “আমি বেহুলা… আমার লখিন্দরকে হারিয়ে আমি মুক্তি পাইনি। প্রতিরাতেই তাই শাঁখ বাজাই, কারণ এই শাঁখ আমার কান্না, আমার অভিমান, আমার ব্যথার প্রতীক।” মনোরমা পিসি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন, শব্দ বেরোলো না তাঁর ঠোঁট থেকে। বেহুলা আবার বলল, “আমার আত্মা আটকে আছে এই গ্রামে। লখিন্দরকে সাপের কামড়ে হারানোর পর আমি দেবীর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, আমার প্রেম যেন অমর হয়। কিন্তু প্রেম অমর হলেও আমার আত্মা অমর দুঃখে বন্দি হয়ে আছে। কেউ আমার কান্না শুনলেও কেউ আমাকে মুক্তি দেয় না। তুমি তো আমাকে দেখতে পাচ্ছ, তাই বলছি—আমাকে মুক্তি দাও।” স্বপ্নের সেই দৃশ্য এতটাই জীবন্ত ছিল যে মনোরমা পিসির গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল।
তিনি হঠাৎ ঘুম ভেঙে চিৎকার করে উঠলেন। চারপাশে তখনও অন্ধকার, ভোর হয়নি। তাঁর বুক ধড়ফড় করছে, চোখের কোণে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছিল, যেন সত্যিই কারও আর্তনাদ শুনলেন তিনি। ভোর হতে না হতেই তিনি উঠোনে এসে বসে পড়লেন, আর গ্রামবাসীদের ডাক পাঠালেন। গ্রামের মহিলারা, যুবকেরা, এমনকি হরিপদ মাস্টারও এসে দাঁড়ালেন। সবাই অবাক হয়ে দেখল—মনোরমা পিসির মুখে এক অদ্ভুত আভা, যেন তিনি আর পাঁচজনের মতো নেই, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাঁকে ছুঁয়ে গেছে। তিনি কাঁপা কণ্ঠে বললেন, “আমি আজ রাতে বেহুলাকে দেখেছি। সে আমার স্বপ্নে এসে বলেছে, তার আত্মা মুক্তি পায়নি। প্রতিরাতের শাঁখ বাজানোই তার কান্না, তার যন্ত্রণা। সে শান্তি চায়, সে মুক্তি চায়।” এ কথা শোনামাত্রই জনতার মধ্যে হাহাকার উঠল। কেউ চোখ মুছল, কেউ চমকে উঠল, আবার কেউ শিউরে কেঁপে উঠল। শশী দাদু গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বললেন, “আমি আগেই বলেছিলাম, তার আত্মা অশান্ত। এখন তার নিজের মুখ থেকেই তুমি শুনেছ। এই সত্যি আর অস্বীকার করার উপায় নেই।”
হরিপদ মাস্টার এবারও দ্বিধায় পড়লেন। তিনি যুক্তি দিয়ে বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে চাইলেন, কিন্তু মনোরমা পিসির চোখেমুখের দৃঢ়তা দেখে কিছু বলতে পারলেন না। মনে হচ্ছিল, যেন সত্যিই কোনো অদৃশ্য শক্তি তাঁকে ঘিরে রয়েছে। যুবকেরা একসঙ্গে বলল, “যদি বেহুলা মুক্তি চায়, তবে আমাদের তার জন্য কিছু করতে হবে।” মহিলারা কেঁদে উঠল, শিশুরা মায়ের আঁচল আঁকড়ে ধরল। চারিদিকের পরিবেশ আরও ভারী হয়ে উঠল, বাতাসও যেন নিঃশব্দ হয়ে থেমে গেল। তখন শশী দাদু ঘোষণা করলেন, “আমাদের পূজা করতে হবে, অস্থির আত্মাকে মুক্ত করতে হবে। বেহুলা মুক্তি না পেলে এই গ্রামও শান্তি পাবে না।” তাঁর কণ্ঠে ছিল এক অদম্য দৃঢ়তা, আর সেই মুহূর্তে গ্রামের সবাই সিদ্ধান্ত নিল—এইবার আর দেরি নয়, বেহুলার শান্তির জন্য পূজা-যজ্ঞের আয়োজন হবেই। মনোরমা পিসি তখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে অশ্রুভরা চোখে ফিসফিস করে বলছিলেন, “বেহুলা, তুমি দুঃখ পেয়ো না… আমরা তোমাকে মুক্তি দেব।” গ্রামবাসীর ভেতরে ভয় আর বিশ্বাস মিলেমিশে এক অদ্ভুত আবহ তৈরি করল, আর সেদিন থেকে “বেহুলার শাঁখ” আর শুধু ভয়ের প্রতীক রইল না, হয়ে উঠল এক আত্মার মুক্তির আবেদন।
১০
গ্রামজুড়ে যেন এক অদ্ভুত প্রতীক্ষার আবহ। দিনের আলো ম্লান হয়ে যখন অন্ধকার নেমে এলো, তখন গ্রামের প্রতিটি মানুষ পুকুরপাড়ে ভিড় জমালো। চারিদিকে শোভা পেল শত শত প্রদীপ, জোনাকির আলোয় যেন এক অন্যরকম রূপকথার দৃশ্য তৈরি হলো। পুরুষেরা কলাগাছ কেটে এনে বাঁশে বেঁধে সাজালো মণ্ডপ, মহিলারা ফুল তুললো, শিশুরা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল। মণ্ডপের মাঝখানে বসে পড়লেন শশী দাদু, সাদা ধুতি ও উজ্জ্বল কপালে সিঁদুরের টিপে যেন তাঁকেই মনে হচ্ছিল দেবতার দূত। তাঁর সামনে রাখা হলো গঙ্গাজল, ধূপ, ফুল আর পূজার সামগ্রী। ভক্তি আর ভয় মিশে সবাই নিঃশব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যখন মন্ত্রপাঠ শুরু হলো, সেই ধ্বনি গুমরে উঠল আকাশে। পুকুরের জল কেঁপে উঠল, বাতাস যেন ভারী হয়ে এলো। গ্রামের প্রতিটি চোখে প্রতিটি কানে এক অজানা প্রত্যাশা—আজকের রাতেই মুক্তি মিলবে কি না বেহুলার? মনোরমা পিসি পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে কাঁপা হাতে প্রদীপ ধরে ছিলেন, তাঁর চোখ থেকে অশ্রু ঝরছিল, যেন তিনি বেহুলার প্রতিনিধি হয়ে আজকের যজ্ঞে উপস্থিত হয়েছেন।
ধূপের ধোঁয়া উড়তে উড়তে আকাশে ছড়িয়ে পড়ল, আর শশী দাদুর কণ্ঠ আরও জোরালো হলো। ঠিক তখনই, হঠাৎ শাঁখের সেই পরিচিত শব্দ ভেসে এলো। সবাই শিউরে উঠল। এতদিন যা শুনলে বুকের ভেতর আতঙ্ক জমে যেত, আজ সেই শব্দে এক ভিন্ন সুর ছিল। না, এবার কান্নার মতো ভাঙা স্বর নয়—বরং দীর্ঘায়িত প্রশান্তি, যেন ক্লান্ত আত্মা বিশ্রাম চাইছে। মুহূর্তেই গ্রামবাসীরা বুঝল, আজ কিছু আলাদা ঘটছে। শাঁখের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে পুকুরের জলে প্রতিফলিত হলো প্রদীপের আলো, আর সেই জল যেন ঝলমল করে উঠল। মনে হলো, এক অদৃশ্য শক্তি ধীরে ধীরে উপরে উঠছে, আলোর স্রোতের সঙ্গে মিলিয়ে যাচ্ছে আকাশে। কয়েকজন মহিলা কেঁদে উঠল, কেউ কেউ হাত জোড় করে প্রণাম করল, আবার কেউ হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল মাটিতে। হরিপদ মাস্টার, যিনি এতদিন সবকিছুকে কুসংস্কার ভেবেছিলেন, তিনিও হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর চোখে ভাসছিল বিস্ময় আর এক অদ্ভুত শ্রদ্ধা। তিনি বুঝতে পারলেন, সবকিছু বিজ্ঞানে মাপা যায় না, মানুষের অনুভূতি, আত্মা আর ইতিহাসের গভীরে এমন কিছু রহস্য আছে, যা যুক্তির বাইরে। শাঁখের সুর তখনও বাজছে, কিন্তু প্রত্যেক মুহূর্তে তার ধ্বনি ক্রমশ শান্ত হয়ে আসছিল, যেন এক মধুর বিদায়।
ধীরে ধীরে শব্দ মিলিয়ে গেল। পুকুরের জল শান্ত হলো, বাতাস হালকা হয়ে এলো, আর গ্রাম যেন এক অদ্ভুত নীরবতায় ঢেকে গেল। কিন্তু সেই নীরবতা আর ভয়ের ছিল না, বরং শান্তি ও পরিতৃপ্তির। সবাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলল, যেন তাদের হৃদয়ের ভার নেমে গেছে। শশী দাদু ধীরে ধীরে চোখ মেলে বললেন, “বেহুলা মুক্তি পেয়েছে।” গ্রামবাসীরা তখনই বুঝে গেল, আর কোনো অশান্ত আত্মা নেই, আর কোনো ভয়ের ছায়া নেই। তবে রাতের শেষ দিকে কেউ কেউ বলল, “তবু পূর্ণিমার রাতে পুকুরপাড়ে দাঁড়ালে যেন এখনো সেই শাঁখের প্রতিধ্বনি শোনা যায়, তবে তা ভয়ের নয়—শুধু এক অমর প্রেমের স্মৃতি।” সেদিন থেকে গ্রামের মানুষ আর পুকুরপাড়কে ভয় পায়নি, বরং সেটাকে পবিত্র স্থান বলে মানতে শুরু করল। শিশুরা সেখানে খেলতে গেল, মহিলারা জল তুলতে গিয়ে আর কাঁপল না। হরিপদ মাস্টারও ক্লাসে বাচ্চাদের বললেন, “সবকিছুর ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিতে পারে না। মানুষের বিশ্বাস, ইতিহাস আর আত্মার শান্তির মধ্যে অনেক অজানা রহস্য লুকিয়ে আছে।” আর মনোরমা পিসি প্রতিদিন সন্ধ্যায় পুকুরপাড়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে বসতেন, ফিসফিস করে বলতেন, “বেহুলা, তুমি শান্তি পেয়েছ, আমাদের গ্রামও শান্তি পেল।” গ্রামের রাত আর নিস্তব্ধ থাকত না, ভেসে আসত স্নিগ্ধ প্রশান্তির এক আবেশ, যেন মুক্ত আত্মার আশীর্বাদ ছড়িয়ে থাকত চারদিকে।
সমাপ্ত