Bangla - ভূতের গল্প

অসীমের ঘড়ি

Spread the love

ঋত্বিক দে


অসীম দে শ্যামবাজারের পুরোনো গলির ভেতরে ছোট্ট কিন্তু নামী জুয়েলার্স দোকানের মালিক। বয়স পঁয়ত্রিশের কোঠায়, কিন্তু চোখেমুখে তার বয়সের চেয়ে অনেক বেশি ক্লান্তির ছাপ। ব্যবসাটা তার নিজের তৈরি, বাবার থেকে পাওয়া নয়, তাই দোকানের প্রতিটি শোকেস, প্রতিটি রুপোর গহনা, প্রতিটি কাচের তাকের পেছনে লুকোনো আছে অসীমের বহু বছরের ঘাম আর অভিজ্ঞতা। সে বিশ্বাস করে প্রতিটি রত্নের নিজস্ব ইতিহাস থাকে, প্রতিটি অলঙ্কার এক-একটি অদৃশ্য গল্প বহন করে। তাই যখনই কোথাও কোনো নিলামের কথা শোনে, তার ভেতরে এক অদ্ভুত কৌতূহল জন্ম নেয়।

সেই কৌতূহলই তাকে নিয়ে গেল বৌবাজারের এক পুরোনো নিলামঘরে। ভাঙাচোরা ভবনের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে অসীম অনুভব করছিল, যেন প্রতিটি ইট-চুন তার কানে ফিসফিস করে কোনো অচেনা ইতিহাস বলছে। ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল ধুলো ধূসরিত টেবিলের উপর সাজানো নানা রকম প্রাচীন দ্রব্য—চিত্রকলা, পিতলের প্রদীপ, কাঠের বাক্স, আর কোণের কাচের কেবিনেটে রাখা কয়েকটি হাতঘড়ি আর পকেট ঘড়ি। অসীমের চোখ সেই কেবিনেটেই আটকে গেল।

কেবিনেট খুলে যখন আড়তের কর্মচারী একে একে ঘড়িগুলো দেখাচ্ছিল, হঠাৎ একটি পকেট ঘড়ি অসীমের দৃষ্টি টেনে নিল। রুপোলি ধাতুতে তৈরি, যদিও বেশ মলিন, তবুও তার গায়ে এক অদ্ভুত শীতল আভা। ঘড়ির কাচে সূক্ষ্ম আঁচড়, আর পিছনের ঢাকনায় খোদাই করা আছে দুটি ইংরেজি অক্ষর—“A.M.”। অসীম যখন সেটি হাতে নিল, বুকের ভেতর দিয়ে কেমন ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। মনে হল ধাতব শরীরের ভেতরে যেন এখনও রক্তের জমাট উষ্ণতা লেগে আছে।

“এটা কার?” অসীম জিজ্ঞেস করল।

কর্মচারী কাঁধ ঝাঁকালো। “পুরোনো কালেকশন, সাহেব। অনেক বছর ধরে গুদামে পড়েছিল। নাকি কোনো দেউলিয়া বাবুর জিনিসপত্র। কে জানে!”

অসীম অদ্ভুত আকর্ষণে ঘড়িটিকে কিনে নিল। দাম খুব একটা বেশি পড়ল না, কিন্তু ঘড়ির ভেতরে যেন কোনো অদৃশ্য দৃষ্টি লুকিয়ে ছিল, যা তাকে বারবার বলছিল—এটা তোমাকেই নিতে হবে।

সেদিন রাতেই দোকানের পেছনের ঘরে বসে অসীম ঘড়িটা পরীক্ষা করছিল। ভেতরের মেশিন অদ্ভুতভাবে অক্ষত, শুধু কাঁটা সামান্য কেঁপে কেঁপে চলছে। সে ঘড়িটা ঠিক করে তুলতে চাইছিল, যেন আবার সচল হয়। রাত তখন প্রায় এগারোটা পেরিয়েছে। একসময় অসীম কাগজপত্র সরিয়ে রাখতে গিয়ে হঠাৎ ঘড়ির টিকটিক শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। সে চমকে ঘড়িটার দিকে তাকালো। কাঁটা দাঁড়িয়ে আছে—বারোটার ঘরে।

ঘড়ি থেমে গেল, কিন্তু ঘরে থামল না শব্দ। আচমকা কোথা থেকে এক দীর্ঘশ্বাসমাখা করুণ আর্তনাদ ভেসে এলো। সেই শব্দ এতই অপ্রত্যাশিত যে অসীমের শরীর কেঁপে উঠল। শব্দটা যেন দোকানের চারদিক ঘুরে তার কানে এসে বিঁধছিল, আবার মনে হচ্ছিল যেন ঘড়ির ভেতর থেকেই উঠছে। সে দ্রুত কাচ খুলে কাঁটা নাড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু ঘড়ি অচল। তবু আর্তনাদ চলল আরও কিছুক্ষণ, তারপর হঠাৎ সব থেমে গেল।

অসীম ঘড়িটা রেখে দিল, কিন্তু তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠল। জানালার বাইরে শ্যামবাজারের রাত তখন নিস্তব্ধ, কেবল দূরের কোনো ট্রামের ঘণ্টার শব্দ ভেসে আসছিল। কিন্তু সেই নির্জনতায় তার মনে হল—কেউ যেন তাকিয়ে আছে।

পরের দিন সে দোকানে আসতে দেরি করল। সারারাত ঘুম হয়নি। মাথায় ঘুরছিল সেই শব্দ, সেই কাঁটা। কিন্তু সকালে ঘড়িটা পরীক্ষা করে দেখল, আবার টিকটিক করছে, যেন কিছুই হয়নি। “সম্ভবত ক্লান্তির কারণে হ্যালুসিনেশন হয়েছে,” নিজেকে বোঝাল অসীম। তবু অদ্ভুত ভয় গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারল না।

কয়েকদিন কেটে গেল। দিনে ঘড়ি নির্দোষ, একেবারে সাধারণ পকেট ঘড়ির মতো চলছে। কিন্তু প্রতি রাত বারোটায় সে থেমে যায়, আর একই সঙ্গে শোনা যায় সেই ভয়ার্ত আর্তনাদ। অসীম প্রথমে কাউকে বলেনি, পরে দোকানের কর্মচারী বিপ্লবকে এক রাতে ডাকল। “তুই দেখিস, আমার মাথা ঠিক আছে কিনা।”

দুজন মিলে পেছনের ঘরে বসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। সময় এগোচ্ছে, কাঁটা ধীরে ধীরে বারোটার দিকে যাচ্ছে। অসীমের বুকের ধড়ফড় বাড়ছিল। ঘড়ি হঠাৎ থেমে যেতেই ঘরে এক শীতল স্রোত বইল, আর ভেসে এল সেই অচেনা আর্তনাদ। বিপ্লব চমকে উঠে চিৎকার করল, “দাদা, এ যে সত্যি!” তার চোখ ভয়ে কোটর থেকে বেরিয়ে আসার মতো।

অসীম তখন ঠাণ্ডা গলায় বলল, “এটা শুধু ঘড়ি নয়। এর ভেতরে কিছু আছে। কোনো ইতিহাস। কোনো রক্ত।”

বিপ্লব আতঙ্কে বলল, “এই জিনিস দোকানে রাখবেন না। ফেলে দিন।”

কিন্তু অসীমের চোখে তখন ভয় নয়, এক অদ্ভুত মোহ। যেন ঘড়িটাই তাকে ডেকে নিচ্ছে আরও গভীরে, রক্তাক্ত কোনো অন্ধকারের দিকে।

ঘড়ির সেই রাতের অভিজ্ঞতার পর অসীমের ভেতরে ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে জন্ম নিল এক অদ্ভুত কৌতূহল। সে বুঝল—এই ঘড়ি নিছক সময় দেখায় না, এর ভেতরে লুকিয়ে আছে এক অচেনা মৃত্যুর ছাপ। বিপ্লব পরদিনই এসে বলল, “দাদা, আমি কালকের পর আর দোকানের পেছনে থাকব না। ওই আওয়াজ শুনে বুক এখনও কাঁপছে।”

অসীম চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে উত্তর দিল, “তুই ভয় পেয়েছিস, আমি পেয়েছি মায়া। ও আওয়াজে শুধু আতঙ্ক নেই, কান্না আছে। কারো অসমাপ্ত কষ্ট লুকিয়ে আছে।”

বিপ্লব মাথা নেড়ে বলল, “তাহলে পুলিশে দিন, পণ্ডিত ডাকুন, কিছু একটা করুন। আমাদের দোকান তো ভূতের আস্তানা হতে পারে না।”

কিন্তু অসীমের মাথায় তখন অন্য হিসেব। সেই “A.M.” খোদাই। কার? কীসের? সে নোটবই বের করে সম্ভাব্য নাম লিখতে লাগল—অমল মুখার্জি, অশোক মিত্র, অর্ণব মজুমদার… কারো মৃত্যু ঘড়ির ভেতর এত গভীর দাগ রেখে যেতে পারে?

রাত নামতেই আবার পরীক্ষা করার ইচ্ছে জাগল। দোকান গুটিয়ে সে ঘড়িটা ব্যাগে রাখল। এ বার বাড়ি নিয়ে যাবে। শ্যামবাজার থেকে দমদমে তার বাসা। ভিড়ভাট্টার বাজার পেরিয়ে বাসায় ফিরল। স্ত্রী নেই, মা-বাবা নেই, সে একাই থাকে। তাই ভয় বা লজ্জা ছাড়াই ঘড়িটাকে নিজের টেবিলের ওপর রেখে বসল।

বারোটার ঘর ঘনিয়ে আসছে। চারদিক নিস্তব্ধ, জানালার বাইরে কেবল কুকুরের ডাক। ঘড়ির টিকটিক ধীরে ধীরে কমে আসছে। অসীমের চোখে উত্তেজনার ঝিলিক। আর ঠিক বারোটায় কাঁটা থেমে যেতেই আবার ভেসে এল সেই আর্তনাদ। এ বার শব্দটা আরও স্পষ্ট—একজন পুরুষের গলা, যন্ত্রণায় ভাঙা, যেন বলতে চাইছে কিছু, কিন্তু বেরোয় না।

অসীম বুক চেপে রাখল। কানে যত্ন করে শোনার চেষ্টা করল। টেবিলে কলম আর খাতা রাখা—সে দ্রুত লিখতে শুরু করল, ভাঙা শব্দগুলো ধরতে চাইছে। যেন গলার ভেতর থেকে উঠে আসছে, “বাঁচাও… রক্ত… ঘড়ি…”

হঠাৎ জানালার কাচে ঠক্‌ঠক্‌ আওয়াজ। অসীম চমকে তাকাল। বাইরে অন্ধকার, তবু কাচে জ্বলজ্বল করছে দুটো ফ্যাকাশে চোখ। যেন কেউ তাকিয়ে আছে। গলা শুকিয়ে গেল অসীমের। সে এগিয়ে গিয়ে জানালা খুলতেই বাইরে কিছু নেই—কেবল অচেনা ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকে ঘর কাঁপিয়ে দিল।

সারা রাত ঘুম হল না। সকাল হলে অসীম সিদ্ধান্ত নিল—ঘড়ির ইতিহাস খুঁজে বের করতেই হবে। না হলে এই কান্না তাকে তাড়া করবে।

সে বৌবাজারের নিলামঘরে গেল আবার। আগের কর্মচারীকে খুঁজে পেল না। আরেকজন বলল, “ওই ঘড়িটার কাগজপত্র আলাদা বাক্সে ছিল। কিন্তু নাম লেখা নেই, কেবল ঠিকানা ছিল। শ্যামবাজারের এক পুরোনো বাড়ি।”

ঠিকানা হাতে নিয়ে অসীম দাঁড়িয়ে রইল। গলির নাম পড়তে গিয়ে মনে হল কোথাও শুনেছে আগে—অরুণ মিত্র লেন। হঠাৎ মনে পড়ল—“A.M.”!

রক্ত হিম হয়ে গেল তার। যদি অরুণ মিত্রই সেই অক্ষরের মালিক হন? যদি তার মৃত্যুর সঙ্গে এই ঘড়ি বাঁধা থাকে?

অসীম পরদিন ঠিক করল সেই বাড়িতে যাবে।

কিন্তু সেদিন রাতের আগে আরেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। ঘড়ি বারোটায় থেমে গেলে এবার শুধু আর্তনাদ নয়—একটা চাপা চিৎকারের সঙ্গে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল তীব্র রক্তের গন্ধ। অসীমের টেবিলে হঠাৎ লালচে ছোপ দেখা দিল, ঠিক ঘড়ির নিচে। সে কাগজ দিয়ে মুছল, কিন্তু দাগ উঠল না। ঘড়িটা যেন ফিসফিস করে উঠল, তার কানে শোনা গেল—“আমাকে ফিরিয়ে দাও…”

অসীমের মনে হচ্ছিল ঘড়িটা যেন তাকে পথ দেখাচ্ছে। প্রতিদিন রাত বারোটায় কান্না, চিৎকার, আর সেই অদ্ভুত রক্তের গন্ধ তার ভেতরে ভয় নয়, বরং এক অদম্য কৌতূহল তৈরি করছিল। “A.M.”—অরুণ মিত্র লেন, সেই সূত্রকে আঁকড়ে ধরেই এক দুপুরে সে রওনা দিল।

গলিটা ছিল পুরোনো উত্তর কলকাতার এক কোণে। স্যাঁতস্যাঁতে ইটের দেওয়াল, মাথার উপর দিয়ে জটপাকানো বৈদ্যুতিক তার, আর নির্জন দুপুরে ঝিম ধরা কাকের ডাক। গলির শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা ভাঙাচোরা বাড়িটার গায়ে নামফলক প্রায় মুছে গেছে, কিন্তু অসীম চোখ কুঁচকে পড়তে পারল—মিত্র ভিলা”

বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতর কেমন ঠাণ্ডা কাঁপুনি উঠল। জানালার কপাট বন্ধ, অথচ ভেতর থেকে যেন কারো ছায়া সরে গেল। অসীম দরজা ঠেলে ঢুকতেই কাঠের কড়িকাঠ ভেঙে উঠল শব্দ করে। ভিতরে পায়ের তলায় ধুলো উড়ল, আর বাতাসে এক অচেনা গন্ধ—জীর্ণ কাপড় আর শুকনো রক্তের মতো।

ভিতরে একটা বৃদ্ধ লোক ঝাঁটা দিচ্ছিল। হাড় জিরজিরে শরীর, মুখে কুঁচকানো চামড়া। অসীম এগিয়ে গিয়ে বলল, “কাকা, এই বাড়িতে আগে কে থাকতেন জানেন?”

বৃদ্ধ একবার তাকাল, তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “কেন, আপনি কে?”

অসীম পকেট থেকে ঘড়িটা বার করল। ঘড়িটা দেখাতেই বৃদ্ধের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার মতো হল। হাতে কাঁপুনি ধরল। “এটা… এটা আবার কই পেলেন?”

অসীম গম্ভীর গলায় বলল, “নিলামে কিনেছি। এর ইতিহাস জানতে চাই।”

বৃদ্ধ ধীরে ধীরে বসে পড়ল চৌকিতে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এটা অরুণ মিত্র সাহেবের ঘড়ি। ওঁর নামেই এই লেন। একসময় ভীষণ ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ এক রাতে তাঁর নির্মম খুন হয়। সেই খুনের তদন্ত আজও শেষ হয়নি। শোনা যায়, ওঁকে যখন মারা হয় তখন এই ঘড়িটাই তাঁর হাতে আঁকড়ে ছিল। তারপর থেকে ঘড়িটা অশুভ বলে সবাই এড়িয়ে চলত।”

অসীমের বুক ধড়াস করে উঠল। “খুন? কে করেছিল?”

বৃদ্ধ মাথা নেড়ে বলল, “কেউ জানে না। পুলিশ সন্দেহ করেছিল ব্যবসার শত্রুকে। কেউ বলেছিল বাড়ির লোকের ষড়যন্ত্র। কিন্তু সত্যিটা অন্ধকারেই রয়ে গেল। সেই রাতের পর থেকে এই বাড়িতে আর কেউ থাকতে চায়নি। মাঝে মাঝে রাতের বেলা কাঁদার আওয়াজ পাওয়া যেত।”

অসীমের চোখে ঘড়িটার কাঁটা কেঁপে উঠল যেন। তার মনে হল, অরুণ মিত্র এখনও কিছু বলতে চাইছেন, তাই প্রতি রাতেই সেই আর্তনাদ শোনা যায়।

বৃদ্ধ হঠাৎ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আপনি ওই ঘড়ি রাখবেন না। ফিরিয়ে দিন। যতদিন এটা আপনার কাছে থাকবে, ততদিন মৃত্যু আপনার পেছনে ঘুরবে।”

অসীম হেসে বলল, “কাকা, ভয় নয়—সত্যিটাই আমি চাই। অরুণ মিত্রর মৃত্যুর রহস্য আমি জানব। হয়তো এটাই আমার নিয়তি।”

বৃদ্ধ মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। চোখে যেন আতঙ্ক জমে আছে। তিনি আর কিছু বললেন না, শুধু ধীরে ধীরে ফিসফিস করে উঠলেন—“বারোটার শব্দ থেকে সাবধান হোন বাবু। ওখানেই মৃত্যু দাঁড়িয়ে থাকে…”

অসীম বাড়ি ফিরে এসে ঘড়িটাকে টেবিলে রাখল। সে বুঝতে পারল, রহস্যের শুরু হয়েছে মাত্র। কিন্তু তার ভেতরে এখন দৃঢ় সংকল্প—এই অদ্ভুত পকেট ঘড়ির ভিতরেই লুকিয়ে আছে অরুণ মিত্রর রক্তাক্ত অতীত।

সেদিন রাত বারোটায় আবার কাঁটা থেমে গেল। কিন্তু এবার শুধু কান্না নয়, অসীম শুনতে পেল এক অচেনা নাম বারবার ভেসে আসছে—সুবীর… সুবীর…”

বারোটার সেই রাত যেন অসীমের জীবনে নতুন অন্ধকারের দরজা খুলে দিল। আগের রাতগুলিতে সে শুধু কান্না আর যন্ত্রণার চিৎকার শুনত, কিন্তু এবার ঘড়ির থেমে যাওয়া কাঁটা থেকে যে গলার শব্দ বেরোল, তা স্পষ্ট করে উচ্চারণ করল এক নাম—সুবীর… সুবীর…”

অসীম খাতায় দ্রুত নামটা লিখে রাখল। তারপর অনেকক্ষণ বসে থেকে ভেবেও বুঝতে পারল না কে এই সুবীর। অরুণ মিত্রের বন্ধু? শত্রু? নাকি খুনির নাম? ঘড়িটা এবার তাকে সরাসরি কোনো সূত্র দিচ্ছে—এই বিশ্বাসে সে আরও গভীর হয়ে পড়ল রহস্যে।

পরের দিন সকালে সে বৌবাজারের এক বৃদ্ধ সংবাদপত্র ব্যবসায়ীর কাছে গেল। বৃদ্ধের দোকান ভরা পুরোনো কাগজে, ফাইলের মতো বাঁধাই করা নানা বছরের খবর। অসীম বলল, “কাকা, ১৯৮০ থেকে ৯০ এর মধ্যে অরুণ মিত্র নামের ব্যবসায়ীর খুনের খবর আছে?”

বৃদ্ধ চোখ কুঁচকে তাকাল। তারপর কাগজ ঘেঁটে বের করল এক হলদেটে পৃষ্ঠা। শিরোনাম—ব্যবসায়ী অরুণ মিত্র খুন, রহস্যে ঘেরা কলকাতা” খবরটা পড়ে অসীমের বুক ধড়াস করে উঠল। অরুণ মিত্রকে নিজের শোবার ঘরে খুন করা হয়। শরীরে ছুরির আঘাত, চারপাশে রক্তের দাগ, আর হাতে আঁকড়ে রাখা পকেট ঘড়ি। পুলিশ সন্দেহ করেছিল খুনটা খুব ঘনিষ্ঠ কারও কাজ, কারণ দরজার তালা ভাঙা ছিল না।

সবচেয়ে চমকপ্রদ লাইন ছিল শেষের দিকে—
“পুলিশ প্রাথমিকভাবে জেরা করেছিল মৃতের ব্যবসায়িক সহযোগী সুবীর ঘোষকে। তবে প্রমাণের অভাবে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।”

অসীম চোখ বড় বড় করে খবরটা পড়তে লাগল। ঘড়ির রাতের আর্তনাদ যে নাম বারবার ডাকছিল, সেই নামই কাগজে জ্বলজ্বল করছে।

সন্ধ্যার দিকে সে আবার মিত্র ভিলায় গেল। বৃদ্ধ দারোয়ান তখন দরজার পাশে বসে বিড়ি খাচ্ছিল। অসীম কাগজটা তার সামনে ধরল। “কাকা, এই সুবীর ঘোষ কে ছিলেন?”

বৃদ্ধ ভয়ে কেঁপে উঠল। বিড়ি হাত থেকে পড়ে গেল। ফিসফিস করে বলল, “ওঁকেই তো সবাই সন্দেহ করত বাবু। সুবীর ঘোষ ছিল অরুণবাবুর ছায়াসঙ্গী, ব্যবসার খুঁটিনাটি সামলাত। কিন্তু পরে ওর সঙ্গেই নাকি টাকার দ্বন্দ্ব বাধে। সেই রাতের পর ও আর এই এলাকায় মুখ দেখায়নি।”

অসীম জিজ্ঞেস করল, “এখন সে কোথায় থাকে জানেন?”

বৃদ্ধ ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বলল, “কেউ জানে না। শুনেছি দক্ষিণে কোথাও ঘর বানিয়েছে। কিন্তু আপনার ওসব জানা কেন? ওই লোকের নাম উচ্চারণ করলেই সর্বনাশ ডেকে আনে।”

অসীম কিন্তু থামল না। সে ঠিক করল সুবীর ঘোষকে খুঁজে বের করবে। অরুণ মিত্রর আত্মা নিশ্চয়ই সেই নাম ডেকে তাকে পথ দেখাচ্ছে।

সেদিন রাতেও বারোটায় ঘড়ি থেমে গেল। অসীম টেবিলের পাশে বসে কলম হাতে অপেক্ষা করছিল। আর্তনাদ এবার যেন আরও কাছে থেকে ভেসে এলো। স্পষ্ট কণ্ঠস্বর—“সুবীর… বিশ্বাসঘাতক… রক্ত…”

অসীমের বুক কেঁপে উঠল। কলমের নিব কাগজে চিরে গেল। জানালার কাচে আবার একবার ঠকঠক আওয়াজ। এবার সে দৌড়ে গিয়ে বাইরে তাকাল। অন্ধকার গলির মধ্যে, দূরে, একটা অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে। স্থির, ফ্যাকাশে। যেন দুটো চোখ সরাসরি তাকিয়ে আছে তার দিকে।

অসীম চেঁচিয়ে উঠল, “কে ওখানে?”

কোনো উত্তর নেই। কিন্তু পরমুহূর্তে ঘড়ির কাচ ফেটে গেল ভেতর থেকে। টেবিলে ছড়িয়ে পড়ল লালচে তরল। অসীম হাত বাড়াতেই গরম ছোপ তার আঙুলে লেগে গেল—যেন সত্যিকারের রক্ত।

সে বুঝল, খেলার সময় শেষ। অরুণ মিত্রর আত্মা শুধু নাম ফিসফিস করছে না, সে প্রতিশোধ চাইছে। আর এই প্রতিশোধের কেন্দ্রবিন্দু একটাই মানুষ—সুবীর ঘোষ।

সারারাত টেবিলের উপর ছড়িয়ে থাকা সেই লালচে তরল মুছতে মুছতে অসীমের হাত কাঁপছিল। বারবার মনে হচ্ছিল—এ তো কোনো কল্পনা নয়, সত্যিই ঘড়ির ভেতর থেকে রক্ত বেরিয়েছে। সকালে আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে দাগ মিলিয়ে গেল বটে, কিন্তু ভেতরে জমে রইল সেই গন্ধ, যেটা কেবল সে-ই টের পাচ্ছিল।

সে ঠিক করল—এখন সুবীর ঘোষকে খুঁজে বের করতেই হবে। না হলে ঘড়ির অভিশাপ থেকে মুক্তি নেই।

প্রথমে সে খোঁজ করল পুরোনো ব্যবসায়ী মহলে। দু-একজন বয়স্ক গহনার ব্যবসায়ী এখনও বেঁচে আছেন, যারা অরুণ মিত্রকে চিনতেন। শ্যামবাজারের এক পুরোনো দোকানে গিয়ে এক বৃদ্ধ মালিককে অসীম প্রশ্ন করল, “কাকা, সুবীর ঘোষের নাম শুনেছেন?”

বৃদ্ধ একটু থেমে বললেন, “হ্যাঁ, শুনেছি তো। অরুণবাবুর ডান হাত ছিল। কিন্তু খুনের পর ওর নাম ওঠে। তারপর থেকে ও পুরোপুরি উধাও হয়ে যায়। কেউ বলে বেনারসে গেছে, কেউ বলে দক্ষিণ কলকাতায় লুকিয়ে আছে।”

অসীম জিজ্ঞেস করল, “দক্ষিণ কলকাতার কোথায়?”

বৃদ্ধ ভুরু কুঁচকে অনেক ভেবে বললেন, “বেহালার দিকে নাকি এক ভাঙাচোরা বাড়িতে থাকত কিছুদিন। তার পর কী হয়েছে জানি না।”

এই সূত্র আঁকড়ে ধরেই অসীম পরের দিন বেহালার গলি-ঘুপচি ঘুরল। পুরোনো চায়ের দোকানে বসা লোকজনকে ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, যদিও ছবিটা পাওয়া গেল সেই পুরোনো সংবাদপত্র থেকে। অনেকেই চেনেনি, তবে এক ভিখিরি বৃদ্ধ বলল, “হ্যাঁ বাবু, ওর মতো একজন লোক থাকত একসময়। একা একা, কারও সঙ্গে মিশত না। সবাই ডরাত। রাতের বেলা নাকি কাঁদত, চিৎকার করত।”

অসীমের বুক ধড়ফড় করতে লাগল। মনে হল সে ক্রমশ কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে। কিন্তু যতই এগোচ্ছে, ততই ঘড়ির আচরণ ভয়ংকর হয়ে উঠছে।

সেই রাত বারোটায় ঘড়ি থেমে যেতেই এবার শুধু কান্না নয়, সরাসরি কথার মতো শোনা গেল—সুবীরকে খুঁজে বের করো… আমার রক্ত ফিরিয়ে দাও…”

অসীম যেন সম্মোহিত হয়ে উত্তর দিল, “আমি খুঁজে বের করব, আমি প্রতিশোধ নেব।”

ঘড়ির কাচের ভেতর যেন ক্ষণিকের জন্য একটি মুখ ভেসে উঠল—অরুণ মিত্রর বিকৃত, রক্তাক্ত মুখ। অসীম চমকে চেয়েও দৃষ্টি সরাতে পারল না। মুখটা যেন তাকে হাসি-ভরা কণ্ঠে আশীর্বাদ করল, আবার শীতল চাহনিতে হুঁশিয়ারিও দিল।

পরের দিন থেকে অসীমের চারপাশে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে শুরু করল। দোকানের শোকেসে রাখা হীরের আংটিতে ফাটল ধরল, গ্রাহকের হাতে গহনা পরাতে গিয়ে সে টের পেল ধাতব শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, বিপ্লব দোকানে কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়ে গেল। জ্ঞান ফেরার পর সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “দাদা, আমি দেখেছি—আপনার পিছনে রক্তমাখা একজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল।”

অসীম কিছু বলল না। শুধু ঘড়িটাকে আঁকড়ে ধরল আরও শক্ত করে। এখন আর ভয় নেই। এখন শুধু একটাই লক্ষ্য—সুবীর ঘোষকে খুঁজে বের করা।

সে জানত, রহস্যের শিকড় এখন বেহালার ভাঙাচোরা বাড়ির দিকেই ইশারা করছে। আর অরুণ মিত্রর আত্মা প্রতিদিন রাতে তাকে তাড়া করে আসছে, যেন সময় ফুরিয়ে আসছে।

অসীমের ভেতরে যেন এক ধরণের নেশা তৈরি হয়েছে। ঘড়ি আর অরুণ মিত্রর আত্মা তাকে প্রতিদিন নতুন সূত্র দিচ্ছে, আর সে অন্ধকারের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে আরও গভীরভাবে। দোকানের কাজ, গ্রাহক, এমনকি নিজের শরীরের ক্লান্তি—সব ভুলে গেছে সে। কেবল একটাই নাম তার কানে গমগম করছে—সুবীর ঘোষ।

বেহালার ভাঙাচোরা বাড়ির গলিতে সে আবার গেল। দুপুরবেলা গলিটার ধুলো আর গরমে যেন শ্বাসরোধ হয়ে আসছিল। হঠাৎ এক মদের দোকানের সামনে বসা এক মাতালকে সে সংবাদপত্রের পুরোনো ছবিটা দেখাল। লোকটা প্রথমে ঝাপসা চোখে তাকাল, তারপর থরথর করে কেঁপে উঠল।

“ওই লোক? ও এখানে থাকত একসময়। সবাই ওকে ভয় করত। রাতের বেলা জানলার ফাঁক দিয়ে রক্তমাখা কাপড় শুকোতে দেখেছি। একদিন হঠাৎ উধাও হয়ে গেল।”

অসীমের বুকের ভেতর চাপা আগুন জ্বলে উঠল। সে আরও খুঁটিয়ে জানতে চাইলে মাতাল বলল, “কিছু লোক বলে ও নাকি টালিগঞ্জের দিকে গেছে। এক পরিত্যক্ত সিনেমা হল আছে, সেখানে লুকিয়ে থাকে।”

অসীম চমকে উঠল। অরুণ মিত্রর মতো ধনী ব্যবসায়ীর সহযোগী আজ এক ভগ্নদশা আশ্রয়ে লুকিয়ে আছে? তবুও মনে হল সত্যি হতে পারে।

রাতে ঘড়ি যখন বারোটায় থেমে গেল, এবার অরুণ মিত্রর গলা সরাসরি নির্দেশ দিল—সিনেমা হল… টালিগঞ্জ… অন্ধকারের ভেতর খুঁজে নাও…”

ঘড়ির কাচে হঠাৎ যেন সিনেমার পর্দার মতো ছবি ফুটে উঠল—অর্ধেক ভাঙা সাইনবোর্ড, তার ওপরে লেখা অস্পষ্ট ইংরেজি অক্ষর, আর ভেতরে অন্ধকার গহ্বর। অসীম কাগজে তাড়াতাড়ি ছবিটা এঁকে রাখল।

পরদিন বিকেলেই সে টালিগঞ্জে রওনা দিল। অটো থেকে নেমে গলিপথে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সামনে ভেসে উঠল সেই একই সাইনবোর্ড। অস্পষ্ট অক্ষরে লেখা—“Minerva Talkies”। একসময় জনপ্রিয় সিনেমা হল ছিল, এখন কেবল ভাঙাচোরা দেওয়াল আর মাকড়সার জাল।

অসীমের বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল। ভেতরে ঢুকতে গিয়েই সে টের পেল বাতাসের ভেতর অদ্ভুত এক গন্ধ—পুরোনো মলিন কাপড় আর ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে আছে তীব্র লৌহের গন্ধ, যেন শুকনো রক্তের।

হলের ভেতর অন্ধকার, কিন্তু ভাঙা প্রজেক্টরের পাশে এক ঝাপসা আলো জ্বলছিল। অসীম ধীরে ধীরে এগোতেই দেখতে পেল—একটা মানুষ কুঁজো হয়ে বসে আছে, মাটির দিকে তাকিয়ে। লম্বা দাড়ি, ছেঁড়া জামা, কঙ্কালসার শরীর।

অসীম নিঃশ্বাস আটকে বলল, “আপনি কি… সুবীর ঘোষ?”

লোকটা ধীরে মাথা তুলল। চোখ দুটো রক্তাভ, ঠোঁট কাঁপছে। গলার আওয়াজ কর্কশ, ভাঙা—“কে তুমি? কে পাঠিয়েছে তোমায়?”

অসীমের হাতে তখন শক্ত করে ধরা ঘড়ি। হঠাৎ ঘড়ির কাঁটা নিজে থেকেই নড়ল, আর সেই ভগ্ন কণ্ঠের ওপরে ভেসে উঠল আরেকটা আওয়াজ—অরুণ মিত্রর আত্মা—বিশ্বাসঘাতক… আমার রক্ত… সময় ফুরিয়ে আসছে…”

সুবীরের চোখ হঠাৎ আতঙ্কে বড় হয়ে গেল। সে কাঁপতে কাঁপতে চেঁচিয়ে উঠল, “না… না… আমি খুনি নই! ও রাতটা… ও রাতটা অভিশাপ!”

অসীম এগিয়ে গেল এক পা। তার চোখে তখন আর ভয় নেই, কেবল প্রতিশোধের দাবিতে জ্বলে ওঠা এক অদ্ভুত দীপ্তি।

অন্ধকার ভাঙা সিনেমা হলের ভেতরে অসীমের কণ্ঠে উচ্চারিত প্রশ্ন যেন ছুরি হয়ে ঢুকে গেল সুবীর ঘোষের কানে। বৃদ্ধ লোকটা কাঁপতে কাঁপতে দেয়ালে হেলান দিল। তার চোখদুটো লালচে, দাড়িতে গোঁজামিল, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে।

“তুমি কে?”—সুবীর কর্কশ গলায় বলল।

অসীম ধীরে ধীরে ঘড়িটা সামনে ধরল। “আমি জুয়েলার্স। এই ঘড়িটা কিনেছি। কিন্তু প্রতিরাতে বারোটায় ঘড়ি থেমে যায়, আর শোনা যায় অরুণ মিত্রর আর্তনাদ। সে শুধু একটা নাম ডাকে—তোমার নাম।

সুবীর হঠাৎ কেঁদে ফেলল। তার বুক কাঁপছে, হাতদুটো থরথর করছে। “আমার নাম এখনও কি আমাকে ছাড়ে না? এত বছর পরও?”

অসীম এগিয়ে গেল। “তুমি যদি নির্দোষ হও, তবে সব বলো। যদি দোষী হও, তবে মনে রেখো, তার আত্মা ন্যায় চাইছে।”

সুবীর মাটির দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আমি খুনি নই… কিন্তু আমি বিশ্বাসঘাতক। সেই রাতটা আমার জীবনের কালো দাগ।”

সে কাশতে কাশতে বলতে শুরু করল। “অরুণবাবু আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো বিশ্বাস করতেন। ব্যবসার সব খুঁটিনাটি আমার হাতে ছিল। কিন্তু আমি… আমি লোভে পড়েছিলাম। বিদেশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বড় চুক্তি করার জন্য কিছু গোপন নথি আমি চুরি করেছিলাম। ভেবেছিলাম ও বুঝবে না। কিন্তু অরুণবাবু সব জেনে ফেললেন। সেই রাতে তিনি আমাকে ডেকে বললেন, ‘সুবীর, তোমাকে আমি ক্ষমা করব, যদি সত্যি বলে দাও।’ আমি তখন হাঁটু গেড়ে ক্ষমা চাইতে যাচ্ছিলাম। ঠিক তখন… জানালার ওপাশ থেকে কেউ ঢুকে পড়ল। মুখ ঢাকা, হাতে ছুরি। অরুণবাবু বুঝে ওঠার আগেই তার বুকে একের পর এক আঘাত করল।”

সুবীর থেমে গেল। তার চোখে ভয়ের ছাপ।

অসীম চমকে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে খুনি তুমি নও?”

সুবীর মাথা নাড়ল। “না। আমি শুধু দাঁড়িয়ে ছিলাম। পাথরের মতো। সাহায্য করতে পারিনি। ভয়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। অরুণবাবুর শেষ দৃষ্টি আমার দিকে ছিল—সন্দেহভরা, রক্তাক্ত, ভাঙা বিশ্বাসের দৃষ্টি। তিনি ঘড়িটা আঁকড়ে ধরেছিলেন। তারপর… সব শেষ।”

সুবীর কাঁদতে কাঁদতে বলল, “পুলিশ আমাকে সন্দেহ করেছিল, কিন্তু প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দেয়। তারপর থেকে আমি লুকিয়ে আছি। প্রতিদিন রাতে সেই চোখ আমার স্বপ্নে ভেসে ওঠে। আমি জানি, আমি খুনি না হলেও আমি পাপী। আমি তাকে বাঁচাতে পারিনি। বিশ্বাসঘাতক হয়েছি।”

অসীমের শরীরে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। ঘড়ির ভেতর তখন টিকটিক শব্দ থেমে গিয়ে হঠাৎ এক শ্বাসরুদ্ধ শব্দ শোনা গেল। অসীমের মনে হল অরুণ মিত্র নিজেই যেন ফিসফিস করে বলছে—মিথ্যে… সব মিথ্যে… ও-আমার রক্তে ভিজেছে…”

অসীম চমকে তাকাল। সুবীর ঘামতে ঘামতে চিৎকার করল, “না! আমি খুনি নই! আমি দেখেছি, কিন্তু আমি করিনি!”

হলের ছাদের অন্ধকারে হঠাৎ কাকের মতো ডানা ঝাপটানোর শব্দ। ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে লাগল। ঘড়ির কাচের ভেতর রক্ত জমে অক্ষরে অক্ষরে ফুটে উঠল—সুবীর”

অসীমের হাত শক্ত হয়ে গেল। তার চোখে তখন অদ্ভুত এক ঝিলিক। হয়তো সত্যিই সুবীর ঘোষের মুখোশের আড়ালে আরও ভয়ঙ্কর কিছু লুকিয়ে আছে।

টালিগঞ্জের সেই ভাঙা সিনেমা হলের ভেতর বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছিল। অন্ধকার দেয়ালে প্রতিধ্বনির মতো বারবার ভেসে আসছিল সুবীর ঘোষের কণ্ঠ—“আমি খুনি নই… আমি শুধু দাঁড়িয়ে ছিলাম… আমি পাপী, কিন্তু খুনি নই…”

অসীম চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, হাতে শক্ত করে ধরা সেই পকেট ঘড়ি। ঘড়ির কাচের ভেতর তখনো রক্তলাল অক্ষরে ফুটে আছে সুবীর”। শব্দহীন নিস্তব্ধতা ভেদ করে হঠাৎ ঘড়ি থেকে এক কর্কশ ফিসফিস আওয়াজ উঠল—মিথ্যে… সে-আমার রক্তে ভিজেছে…”

সুবীর আতঙ্কে দেয়ালের কোণে সরে গেল। তার চোখ ফাঁকা, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ওর চোখ আমাকে আজও তাড়া করে… বিশ্বাসঘাতক হয়েছি… কিন্তু খুন আমি করিনি।”

অসীম দ্বিধায় পড়ল। কার সত্যি মানবে সে? এই কুঁকড়ে যাওয়া বৃদ্ধের কান্না, নাকি ঘড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসা অরুণ মিত্রর আত্মার ভয়াল কণ্ঠ?

ঠিক তখনই সিনেমা হলের মেঝেতে একটা জোরে শব্দ হলো—যেন ভারী কিছু পড়ে গেল। অসীম চমকে তাকাল। পুরোনো প্রজেক্টরের পাশের ভাঙা কাঠের বাক্স থেকে গড়িয়ে বেরোল একগাদা পুরোনো কাগজ। অসীম এগিয়ে গিয়ে তুলে নিল। কাগজগুলো রক্তমাখা, অর্ধেক ছেঁড়া। চোখ কুঁচকে সে পড়তে লাগল—চুক্তিপত্র, টাকার লেনদেনের হিসাব, আর কিছু ব্যবসায়িক নথি। সব কাগজেই অরুণ মিত্রর সই, আর পাশে সুবীর ঘোষেরও সই।

কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল শেষ পাতায় শুকনো রক্তের দাগ। তার উপর অস্পষ্ট লেখনী—সুবীর, তুই-ই…” বাকিটা কেটে গেছে।

অসীম কাগজটা তুলে ধরতেই ঘড়ির কাঁটা আবার নড়ে উঠল। থেমে গেল বারোটার জায়গায়, যদিও তখন বিকেল। সাথে সাথে সিনেমা হল কেঁপে উঠল। ঠাণ্ডা বাতাসে ফিসফিস আওয়াজ—প্রমাণ… সে-ই…”

সুবীর ভয়ে ছটফট করতে লাগল। “না! না! আমি খুনি নই! আমি বাঁচাতে পারিনি, কিন্তু আমি মারিনি। আমি শপথ করছি।”

অসীম অনুভব করছিল তার ভেতরে ভয় আর কৌতূহলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে প্রতিশোধের এক উন্মত্ত টান। যেন অরুণ মিত্রর আত্মা তার শরীর দিয়ে প্রতিশোধ নিতে চাইছে।

হঠাৎ লাইটহীন সিনেমা হলের ভেতর অন্ধকার আরও ঘন হয়ে এল। কোথা থেকে যেন টপটপ করে তরল পড়ার শব্দ। অসীম নিচে তাকাল—তার হাতের ঘড়ি থেকে রক্ত ঝরছে, আর সেই রক্ত মেঝেতে ছড়িয়ে একটাই শব্দ আঁকছে—খুনি”

অসীম কাঁপা গলায় সুবীরকে বলল, “সত্যিটা বলো… না হলে এই ঘড়ি তোমার রক্ত চাইবে।”

সুবীর হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “সত্যিটা আমি জানি না গো! ওকে কে খুন করল আমি দেখিনি, শুধু ছায়া দেখেছিলাম। কিন্তু ওই রাত থেকে অরুণবাবুর চোখ… সেই দৃষ্টি… আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে।”

অসীম বুঝতে পারল—এখন সত্য-মিথ্যার সীমারেখা মুছে গেছে। একদিকে সুবীরের কান্না, অন্যদিকে ঘড়ির ভয়াল বিচার। সে জানত, একবার যদি ভুল সিদ্ধান্ত নেয়, তবে হয়তো এই অভিশাপ তার নিজের জীবনও কেড়ে নেবে।

তবু ভেতরে এক অদ্ভুত আকর্ষণ কাজ করছিল—যেন প্রতিশোধের ভার সে-ই শেষ পর্যন্ত বহন করবে।

সিনেমা হলের অন্ধকারে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। অসীমের হাতে ধরা ঘড়ি থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ছিল মেঝেতে, আর সেই রক্ত নিজে নিজেই অক্ষরে রূপ নিচ্ছিল—খুনি”

সুবীর কোণে ঠেস দিয়ে বসেছিল, কাঁপতে কাঁপতে বারবার বলছিল, “আমি খুনি নই… আমি শপথ করছি… আমি শুধু দাঁড়িয়ে ছিলাম…” তার গলা ভাঙা, চোখ লালচে, শরীর কাঁপছে।

অসীমের চোখে তখন দ্বিধা নেই। ঘড়ির ভয়াল ফিসফিস তাকে যেন বশ করেছে। “মিথ্যে বলছ তুমি, সুবীর… তোমার হাতেই রক্ত লেগেছিল।”

ঠিক তখনই, সিনেমা হলের ছাদের ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে চারপাশে ঘূর্ণি তুলল। অন্ধকারের ভেতরে যেন ছায়ার মতো এক অবয়ব নড়ল। অসীমের মনে হল, ঠিক প্রজেক্টরের পর্দার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন অরুণ মিত্রর রক্তাক্ত মুখ। চোখে জ্বলে উঠছে প্রতিশোধের আগুন।

অসীম চমকে উঠল। কিন্তু ভয় নয়, বরং এক ধরণের উন্মত্ততা তাকে গ্রাস করল। সে এগিয়ে গিয়ে সুবীরের কলার চেপে ধরল। “সত্য বলো! না হলে এই ঘড়ি তোমার প্রাণ নিয়ে নেবে।”

সুবীর হাঁপাতে লাগল। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। “আমি… আমি বিশ্বাসঘাতক, খুনি নই। কিন্তু আমি বাঁচাতে যাইনি, সাহায্য করিনি। সেই দোষে আমি প্রতিদিন মরছি।”

অসীম তখন কাগজে শুকনো রক্তের দাগের সেই অক্ষরগুলো মনে করল—সুবীর, তুই-ই…”। মনে হল ঘড়ির অভিশাপ আর সুবীরের ভয়ের মধ্যে সীমারেখা মুছে যাচ্ছে।

হঠাৎ ঘড়ির কাঁটা আবার নড়ল। এবার সোজা পিছনে ঘুরে গেল, যেন সময় উল্টে চলেছে। সিনেমা হলের দেয়ালে পর্দার মতো দৃশ্য ফুটে উঠল—অসীম দেখল সেই রাতের ছবি। অরুণ মিত্রর শোবার ঘর, হাতে ঘড়ি, মুখে আতঙ্ক। ছায়ার মতো একজন ঢুকে এসে বারবার ছুরি মারছে।

কিন্তু ছায়ার মুখ দেখা গেল না—শুধু রক্তে ভিজে যাওয়া হাত। আর সেই রক্ত মুছে অস্পষ্টভাবে প্রকাশ পেল আঙুলে একটা আংটি। হীরের আংটি, বিশেষ নকশা।

অসীম চমকে উঠল। সে নকশাটা চেনে—কারণ কয়েক মাস আগে এক ধনী গ্রাহকের হাতে একই রকম আংটি সে নিজে বানিয়ে দিয়েছিল।

তার মনে হলো, সত্যিটা হয়তো সম্পূর্ণ ভিন্ন। সুবীর হয়তো বিশ্বাসঘাতক, কিন্তু আসল খুনি অন্য কেউ। হয়তো অরুণ মিত্রের ব্যবসার প্রতিদ্বন্দ্বী।

কিন্তু ঘড়ির ভেতর থেকে আবার ভয়াল ফিসফিস ভেসে এলো—ও-ই… ও-ই…”

অসীম হঠাৎ নিজের বুকের ভেতর চাপা যন্ত্রণা টের পেল। যেন ঘড়ি তার হৃদয়ে প্রবেশ করছে। হাত শক্ত হয়ে আসছে, চোখের সামনে সব ঘুরপাক খাচ্ছে।

সুবীর ভয়ে চিৎকার করে উঠল, “না, আমাকে মারো না! আমি খুনি নই!”

অসীম দাঁড়িয়ে রইল দ্বিধার কিনারায়—ঘড়ির অভিশাপে নতিস্বীকার করবে, নাকি নিজের চোখে দেখা দৃশ্যের সত্য খুঁজবে?

ঠিক তখনই সিনেমা হলের বাইরে থেকে কুকুরের দল হাউমাউ করে ডাকতে লাগল। বাতাসের ভেতর যেন মৃত্যুর আগমন টের পাওয়া গেল।

ভাঙাচোরা সিনেমা হলের অন্ধকারে অসীম দাঁড়িয়ে ছিল এক বিভীষিকাময় দ্বিধার সামনে। হাতে ধরা ঘড়ি থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, তার প্রতিটি ফোঁটা যেন মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি। সুবীর ঘোষ কোণে ঠেস দিয়ে কাঁদছে—“আমি খুনি নই! আমি শুধু পাপী… বিশ্বাসঘাতক… কিন্তু আমি খুন করিনি!”

কিন্তু ঘড়ির কাঁটা থেমে গিয়ে ফিসফিস করে উঠল—ও-ই… ও-ই…”

অসীমের বুক ধড়ফড় করতে লাগল। হঠাৎ ঘড়ির কাচে আবার ভেসে উঠল দৃশ্য—অরুণ মিত্রর শোবার ঘর। ছুরি চালানো ছায়ার হাত এবার আর লুকোনো রইল না। আঙুলে জ্বলজ্বল করছে হীরের নকশা করা আংটি। অসীমের চোখ বিস্ফারিত। কারণ সেই আংটির নকশা সে ভালো করেই চেনে—এটা তার নিজের তৈরি, আর কয়েক মাস আগে সেই আংটি সে বিক্রি করেছিল নামী ব্যবসায়ী প্রমোদ সেনকে।

অসীম কেঁপে উঠল। সত্যিটা স্পষ্ট হয়ে গেল। খুন করেছে সুবীর নয়, অরুণ মিত্রর ব্যবসার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রমোদ সেন। কিন্তু অরুণ মিত্রর মৃত্যুর সময় পাশে দাঁড়িয়ে থেকেও কিছু না করার অপরাধে সুবীর অভিশপ্ত হয়ে বেঁচে আছে।

ঘড়ির ভিতর থেকে তখন অরুণ মিত্রর ভয়াল কণ্ঠ ভেসে এল—ও-আমার রক্তে ভিজেছে… সুবীর, তুই বিশ্বাসঘাতক…”

সুবীর কাঁদতে কাঁদতে অসীমের পায়ে লুটিয়ে পড়ল। “আমায় ক্ষমা করো! আমি খুনি নই, কিন্তু আমি মানুষও নই। আমি বাঁচাতে যাইনি। আমি মরার থেকেও ভয়ঙ্কর শাস্তি পাচ্ছি এত বছর ধরে।”

অসীমের চোখে তখন আর ভয় নেই। সে ঘড়ি উঁচু করে বলল, “অরুণ মিত্র, সত্যিকারের খুনি সুবীর নয়। আমি খুঁজে বের করব প্রমোদ সেনকে। তোমার রক্তের প্রতিশোধ আমি নেব।”

হঠাৎ ঘড়ি থেকে এক দমকা আলো ছড়িয়ে পড়ল। সিনেমা হল কেঁপে উঠল। অরুণ মিত্রর আত্মার ছায়া পর্দায় দেখা দিল, চোখে অদ্ভুত শান্তি আর করুণ দৃষ্টি। সুবীরের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই আমায় বাঁচাতে পারিসনি… কিন্তু প্রতিশোধ নিক অসীম… সময় ওর হাতে তুলে দিলাম।”

অসীমের শরীর কেঁপে উঠল। তার হাতে ঘড়ির কাঁটা হঠাৎ ঘুরে গিয়ে থেমে গেল একেবারে শূন্যে। তারপর নিস্তব্ধতা। সিনেমা হল আবার অন্ধকার হয়ে গেল।

সুবীর মাটিতে অচেতন হয়ে পড়ে রইল। অসীম ধীরে ধীরে বাইরে বেরোল। রাতের আকাশে চাঁদ ঢাকা, চারদিকে নিস্তব্ধতা। হাতে শক্ত করে ধরা পকেট ঘড়ি আরেকবার টিকটিক শুরু করল—কিন্তু এবার বারোটায় নয়, কাঁটা এগোচ্ছে অবিরাম।

সে বুঝল, অভিশাপের দায়িত্ব এখন তার উপর নেমে এসেছে। ঘড়ি এখন তার নিয়তি। অরুণ মিত্রর আত্মা মুক্তি পাবে কেবল তখনই, যখন সত্যিকারের খুনির রক্তে ঘড়ি আবার ভিজবে।

অসীম ফিসফিস করে বলল, “প্রমোদ সেন… আমি আসছি।”

আর ঘড়ির টিকটিক শব্দ তখন রাতের অন্ধকার ছেদ করে যেন মৃত্যুর নতুন সময় গুনতে শুরু করল।

***

WhatsApp-Image-2025-08-27-at-4.16.23-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *