ঋতব্রত চক্রবর্তী
পর্ব ১ : স্বপ্নের শুরু
রাতের নিষ্প্রভতা যেন লালচে ছাই হয়ে উঠে বসে আছে স্বপ্নের ভেতরে—একটা শ্মশান, পাঁচটি নিবিড় প্রদীপ, নিরাবেগ নদীর ধারে কাঁসার থালায় রাখা কালচে ধূলি, আর কোথাও থেকে ভেসে আসা অসম্পূর্ণ শব্দ: “হ্রীং… ক্রৌঁ… শৌঃ… ন—” তারপরই ফাঁকা, এমন এক ফাঁকা যা নিঃশব্দ নয়; অদৃশ্য কণ্ঠের ভাঙন-ধ্বনি সেখানে ঘণ্টার মতো পাক খেতে থাকে, মাটির নিচে চোরা জলের শব্দের মতো সরে যায়, আবার ফিরে আসে। সেই স্বপ্ন থেকে পাঁচজন পাঁচ জায়গায়, পাঁচটি শরীর ভিন্ন ভিন্ন ঘামে, একই আতঙ্কে জেগে উঠল—যেন কোনো অদেখা আঙুল তাদের বুকের ওপর অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে লিখে রেখে গেল একটি মাত্র বৃত্ত, যার ভিতরে অর্ধেক মন্ত্র থমকে আছে।
কলকাতায় তনয় মিত্র প্রথমে বুঝতেই পারেনি—ঘড়ির কাঁটা থেমে আছে কিনা, না কি তার মাথার ভেতর সময় থেমে গেছে। মেডিক্যাল কলেজের ইন্টার্নশিপের রাতের ডিউটি সবে শেষ করে ঘুমোতে গিয়েছিল। জানলা আধখোলা, বর্ষার পরের গন্ধে ভিজে আছে পর্দা। স্বপ্নে সে দেখেছিল ছাই ছড়িয়ে আছে, কোনো সাদা কাপড়ের ভাঁজে নীল দাগ, সেই দাগের ওপর দিয়ে একটি ছায়া হাঁটছে, আর কণ্ঠ বলছে, “ন—।” তনয়ের মনে হয়েছিল, একটা অক্ষর আটকে গেছে কারও গলায়। জেগে ওঠার পর সে গলা ছুঁয়ে দেখল—কিছুই তো নয়, কিন্তু বুকের মাঝ বরাবর হালকা আঁচড়ের মতো কিছু একটা। আয়নার সামনে টি-শার্ট তুলে ধরতেই দেখতে পেল গোল হয়ে হালকা লালচে চিহ্ন, মাছির কামড় নয়, অ্যালার্জি নয়, যেন এক আঙুল চক দিয়ে বৃত্ত এঁকে চলে গেছে। “ওয়েকিং ড্রিম,” সে নিজেকে বোঝাল, “স্লিপ ডেপ্রাইভেশন। কিছুই না।” কিন্তু জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে যে ধোঁয়াটে গন্ধ আসছিল—চন্দন না কি জ্বলন্ত শালপাতার—তাকে যুক্তিবিদ্যা দিয়ে ব্যাখ্যা করা গেল না।
বেনারসে কবির তিওয়ারি ঠাণ্ডা ঘামের মধ্যে উঠে বসে দেখল তার ছোট ঘরে কুশাসনের ছোট ফালি আলো পড়েছে। তার ঘরের সিন্দুকে রয়েছে ঠাকুরদার কালো মলাটের পুঁথি—তাম্রপাতার দিকে ঝুঁকে থাকা শ্লোকের ভাঁজ। সে ছোটবেলা থেকে শ্মশানঘাটের শব্দ শুনে অভ্যস্ত—ভোরে শঙ্খ, সন্ধ্যায় ঘণ্টা, মাঝরাতে কুকুর। কিন্তু আজকের স্বপ্ন আলাদা। সে দেখেছিল পাঁচটি প্রদীপকে, প্রত্যেকের শিখা ডানদিকে বাঁকিয়ে আছে, বাতাস নেই তবু ঝিলমিক—আর সেই কণ্ঠ: “হ্রীং… ক্রৌঁ… শৌঃ…” তারপরই একটি অক্ষর মুখে এসে আটকে গেছে। কবির জানে, উচ্চারণের ভুল শাস্ত্রে ক্ষমার অযোগ্য; অথচ সে নিজেই জেগে উঠে মনে মনে সেই মন্ত্রটুকু জোড়ার চেষ্টা করছিল। নিজের অজান্তে জপতে শুরু করলে সে থমকে গেল, ঠোঁট বন্ধ করল, জানলার দিকে তাকিয়ে দেখল—ঘাটের উপর কুয়াশার পাতলা চাদর, দূরে সাদা ধোঁয়া। পাশে থাকা রেডিওটা হঠাৎ খট করে শব্দ করল, যেন কেউ ভলিউম বাড়িয়ে আবার কমাল। কবিরের বুক ধড়ফড় করতে লাগল। পুঁথির কথা মনে পড়তেই সে সিন্দুক খুলে দেখল—পাতাগুলোর মধ্যে কোথা থেকে এসে পড়েছে কালচে ছাইয়ের গুঁড়ো।
শিলঙে ইশিতা দত্ত ঘুম ভেঙে শুনল পাহাড়ি বৃষ্টির টুপটাপ। রিসার্চের কাজে সে খাসি লোরির সুর রেকর্ড করছে; ঘুমোবার আগে পুরনো একটা প্লেলিস্টে পাহাড়ি বাঁশির সুর শুনেছিল। স্বপ্নে সে দেখেছিল বাঁশির বদলে শ্মশানের নিস্তব্ধতা, আর একটি সুর যা সুর নয়—অর্ধেক মন্ত্রের মতো কোনো শ্রুতিপথ। তার মনে হয়েছিল, নয়নদীপের আলোতেই সে হাঁটছে, অথচ তার পায়ের নিচের জমি স্পঞ্জের মতো ডেবে যাচ্ছে। জেগে উঠে সে মোবাইলের ভয়েস-রেকর্ডারে প্লে চাপল—শুনতে পেল একটি ক্ষীণ শব্দ, যেন রাতের মধ্যে কোনো এক জায়গায় ক্ষুদ্র ঘণ্টা কেঁপে উঠেছে। সে কি স্বপ্নেও রেকর্ডার অন রেখেছিল? না কি কেবলি ভ্রম? জানলার বাইরে কুয়াশা কেটে গিয়ে যখন তিরতিরে রোদ উঠল, তখনও ইশিতার বুকের মধ্যে সেই কণ্ঠটা তরঙ্গ তুলছিল—“ন—”। সে খাতা খুলে নোট নিতে লাগল: অসম্পূর্ণ ধ্বনি—একই ফ্রিকোয়েন্সিতে বারবার ফিরে আসছে; সুরের পরিসর স্থির, বাক্য নেই, কেবল শব্দের পাথরখণ্ড।
মুর্শিদাবাদে সায়ন্তন ঘোষ—উচ্চমাধ্যমিকের ইতিহাসের শিক্ষক—রাতে পড়ার টেবিলে বসে জমিদারির দলিল আর স্থাপত্যের নকশা দেখছিল। স্বপ্নে সে নিজেকে দেখল কাশিমবাজারের এক ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে। দরজার চৌকাঠে পাঁচটি ছোট গর্ত, গর্তে তেল, তেলে কাঁপা শিখা, আর দেয়ালে খোদাই—বেআব্রু নয়, কিন্তু স্পষ্ট—একটি বৃত্তের ভিতরে পাঁচটি বিন্দু। মধ্যবর্তী বিন্দুটি বাদামি হয়ে কুঁচকে আছে, যেন কেউ নখ দিয়ে খুঁটে তুলেছে। সেই সময়ই সে শুনল মন্ত্রের ধ্বনি, এবং মধ্যবর্তিতায় ভাঙা একটি অক্ষর। জেগে ওঠার পরে সায়ন্তন খাতায় দ্রুত এঁকে নিল যে বৃত্তটি সে দেখেছিল। আঙুল দিয়ে আঁকা কাঁচা সার্কেল, পাঁচ বিন্দু, আর মাঝখানে—একটি শূন্যস্থান। সে নিজের হাতের তালুতে চেপে ধরল কলমের নিব; ক্ষীন ব্যথা; কিন্তু তালুর মাঝখানে খুবই হালকা, জলের দাগের মতো একটি বৃত্ত ফুটে থাকল। সে বাথরুমে গিয়ে হাত ধুয়ে ফেলল, তবু দাগ গেল না। “সন্দীপনদাকে বলব,” ভাবল সে, “ও তো প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে কাজ করে। হয়তো কোনো প্রতীক।” কিন্তু ফোন হাতে নিয়ে থেমে গেল—কী বলবে? যে সে স্বপ্নে এক শূন্য বৃত্ত দেখেছে?
চট্টগ্রামের নাদিয়া রহমান পুরো ভোরটুকু ভুল দিকের সময়ের মতো পার করে দিল। হাসপাতালে ডাবল শিফটে থাকা মেয়েটি জানে, অতিরিক্ত কাজের চাপে মস্তিষ্ক কেমন মায়ার জাল ফেলে। তবু আজকের স্বপ্ন তাকে অন্যভাবে ছুঁল। সে দেখেছিল—সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ থেমে গিয়ে এক শুষ্ক বাতাস উঠে আসছে, এবং সমুদ্রতটে নয়নদীপগুলি আঙুলের মতো বাঁকিয়ে আছে ডানদিকে। “হ্রীং… ক্রৌঁ…” এমন ধ্বনি সে কখনও শোনেনি কাছ থেকে, অথচ মনে হলো শৈশবের কোনো অন্দরঘরে, কাবার্ডের ভেতর, সেই শব্দ আটকে ছিল। জেগে উঠে সে বুকে হাত রাখতেই আঙুলের ডগায় লাগল জ্বালাপোড়া। আয়নায় দেখে মনে হলো—গলার কাছটায় খুবই পাতলা এক বৃত্ত, যেন সিন্দুরের ধোঁয়া লেগে আছে। নাদিয়া চোখ টিপে টার্চ জ্বেলে তাকাল; যতই দেখল ততই নিশ্চিত হলো, এটা স্কিন র্যাশ নয়। “হ্যালুসিনোজেনিক ড্রিম,” সে নিজেকে বোঝাল। কিন্তু হাসপাতালের করিডরে হাঁটতে হাঁটতে সে শুনল—নেবুলাইজারের মৃদু ছোঁয়ার মধ্যে, মনিটরের বিপ-বিপের ফাঁকে—কারা যেন খুব নিচু গলায় কোনো ছন্দ ভাঙা শব্দ বলছে। অন কল রুমে ঢুকে সে ফোনের ভয়েস নোট খুলল। কোনো নির্বোধ, কোনো অবচেতন চাপ—সে রাতেই হয়তো রেকর্ড করেছে। কানে হেডফোন দিয়ে শুনল—একটি মাত্র ধ্বনি: “ন—”। সে এতটাই চমকে গেল যে ফোন হাত থেকে পড়ে গিয়ে বিছানায় গড়িয়ে গেল।
এই পাঁচজনের কেউ জানত না, তারা একই সময়ে জেগে উঠেছে। তারা জানত না, একই ঘ্রাণ তাদের ঘর জুড়ে পাক খাচ্ছে—চন্দন না শালপাতা, বলা মুশকিল। তারা জানত না, পাঁচটি ভিন্ন ঘরের পাঁচটি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একই ভঙ্গিতে নিজ নিজ বুকে হাত বুলিয়ে দেখছে বৃত্তচিহ্ন। কিন্তু শহরের আকাশ আলাদা আলাদা আলোতে ভরলেও, তাদের ভেতরের আঁধার যেন একই রঙে জমাট বাঁধছিল।
তনয় হাসপাতালের ক্যাফেটেরিয়ায় কফি হাতে নিয়ে আউটডোরের রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎ সে অনুভব করল পকেটে রাখা ফোন কাঁপছে। আননোন নম্বর: দেশের কোড আলাদা। সে ধরতেই ওপার থেকে অচেনা এক মেয়ের গলা—বাংলা কিন্তু স্বরভঙ্গে অন্য ছায়া—বলল, “হ্যালো, আমি ইশিতা। কোনো একটা… দেখুন, আপনি চিনবেন না আমাকে। কিন্তু… গতকাল রাত আপনি কি কোনো অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছেন?” তনয় ভুরু কুঁচকে বলল, “কে আপনি? এই নম্বর পেলেন কীভাবে?” ইশিতা হেঁচকি টেনে নীরব হল, তারপর বলল, “রিকার্ডারে একটা শব্দ পেয়েছি—খুব অদ্ভুত। গুগলে ধোঁয়াশা একটা সূত্র পেলাম, সেখানে আপনার নাম—তনয় মিত্র—একটা কনফারেন্স পেপারে এসেছে, Acoustic Signatures of Hypnopompic Hallucinations। তাই… ভাবলাম—” তনয় অবিশ্বাসের হাসি হাসল, “আপনি ড্রিম অ্যাকোস্টিক্স আর মেডিক্যাল সাইকোলজি গুলিয়ে ফেলছেন। আর, আমি তো কেবল ইন্টার্ন—” তার কথা কেটে দিয়ে ইশিতা বলল, “আপনার বুকের ওপর কি কোনো বৃত্তচিহ্ন আছে?” ফোনটা কানের সঙ্গে চেপে ধরা তনয়ের মেরুদণ্ড দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “কে আপনি?” ইশিতা ফিসফিস করল, “আমি শুধু… একই চিহ্ন আমারও আছে। আর আমি একা নই। আমি মনে হয় আরও তিনজনকে খুঁজে পেয়েছি—বিভিন্ন পোস্ট, ব্লগ, লোকাল নিউজ থেকে টুকরো টুকরো করে। কারও গলায়, কারও তালুতে, কারও বুকে। কেউ লিখেছে রাতের বেলা কোনো ‘অর্ধমন্ত্র’ শুনেছে। আমি… জানি না এটা প্যারানইয়া, না কি—”
“কোথায় আছেন আপনি?” তনয়ের গলা অকারণে দৃঢ় হয়ে উঠল। ইশিতা বলল, “শিলঙ। কিন্তু… মনে হচ্ছে, কোথাও দেখা করা দরকার। একটি মানচিত্র বারবার মনে পড়ছে—দেখুন, শুনতে অদ্ভুত লাগবে, কিন্তু আমি যেটা আঁকলাম, সেটায় পাঁচটি বিন্দু আছে, আর মাঝখানে—” তনয় বলে উঠল, “শূন্য। ঠিক?” লাইনটা এক মুহূর্তে নিস্তব্ধ হয়ে গেল, তারপর ইশিতার নিঃশ্বাস শোনা গেল, “হ্যাঁ।”
সেই সময়ই বেনারসে কবির নদীর ঘাটে নেমে দেখল, এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসী চৌকির ওপর বসে চোখ বুজে আছেন। কবির হাতের তালুতে যে বৃত্তচিহ্নটা দপদপ করছে, সেটার ওপর সে রুমাল চাপা দিল। বৃদ্ধ চোখ খুলে তাকাতেই কবির কেমন যেন চমকে উঠল। ওই চোখে সে যেন নিজের স্বপ্নের আলো দেখতে পেল। বৃদ্ধ বললেন, “শব্দটা কোথায় আটকে যায়, জানো? জিভের ডগায় নয়, বুকের মাঝখানে।” কবির হাঁ করে তাকিয়ে রইল। “আপনি—আপনি আমাকে চেনেন?” বৃদ্ধ হাসলেন, “চিনতে হয় না। শব্দ শুনলেই চেনা যায়।” কবির কাঁপা গলায় বলল, “মন্ত্রটা অসম্পূর্ণ কেন?” বৃদ্ধ দূরে সাদা ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “যে বলছে, তার মুক্তি হয়নি। আর যার কানে যাচ্ছে, তার নিয়তি বাঁধা।” কথাটা বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন, লাঠি ঠুকতে ঠুকতে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেলেন। কবির পিছন থেকে বলল, “কিন্তু এরপর?” কোনো উত্তর এল না। নদীর উপর দিয়ে ভেসে আসা ধোঁয়ায় তার গলায় কোথা থেকে যেন মধুর কাঁটার মতো একটা ব্যথা উঠল।
মুর্শিদাবাদে সায়ন্তন তার আঁকা বৃত্ত নিয়ে মেসেঞ্জারের চ্যাটবক্সে কয়েকটি ছবির সঙ্গে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ল: “ঐতিহাসিক প্রতীক?” মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এক অচেনা প্রোফাইল থেকে রিপ্লাই এল, “আপনিও দেখেছেন নাকি?” সায়ন্তন লিখল, “স্বপ্নে। তারপর… হাতের তালুতে।” ওপার থেকে আসা উত্তরে ছিল একটি ছবি—একজন মেয়ের গলার কাছে হালকা বৃত্তচিহ্ন। নাম দেওয়া: Nadia R. সঙ্গে ছোট্ট মেসেজ: “আমি চট্টগ্রাম। আমাদের কি দেখা করা উচিত?” সায়ন্তন কিবোর্ডের ওপর আঙুল রেখে ভাবল—এতটা সুপরিকল্পিত প্রতারণা হতে পারে? তবু বুকের মধ্যে যে শব্দটা দাঁত-নখ বের করে কসরত করছে—“ন—”—তাকে উপেক্ষা করা যাচ্ছে না।
চট্টগ্রামের করিডরে নাদিয়া ডিউটি শেষ করে জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। বর্ষার মেঘ সরে গিয়ে সমুদ্রের ওপর রোদ ফোটে উঠেছে। সে ফোনে নোট খুলল: পাঁচজন, পাঁচ চিহ্ন, এক অসম্পূর্ণ মন্ত্র। দেখা করা দরকার। ঝুঁকি? হ্যাঁ। কিন্তু—যদি একই দরজা সবাই শুনে থাকি? সে নিজের কাঁধের ওপর স্টেথোস্কোপটা জড়িয়ে নিল, যেন সামনে যে পথ, তাতে চিকিৎসকের যুক্তিবোধ তাকে রক্ষা করবে। তারপর মেসেজ টাইপ করল: “শিলঙে আসা যাবে? ওখান থেকেই পাহাড় নেমে সমুদ্রের দিকে এক ধরণের হাওয়া নামে—সুরের মতো। হয়তো সেখানেই শব্দটা সম্পূর্ণ হবে।”
সন্ধ্যা নামার আগে, পাঁচটি আকাশের নীচে পাঁচজন মানুষ একে অপরের কাছে অচেনা থকে একটু কম অচেনা হয়ে উঠল। তাদের ফোনে, খাতায়, হাতে, কণ্ঠে একটি করে বৃত্ত জ্বলে উঠল অদৃশ্য কালিতে। তারা কিছু ঠিক করল না এখনও; কেবল প্রত্যেকে নিজের ভেতরের দরজা খুলে রাখল সামান্য। আর শূন্যের যে কেন্দ্রে একটি অক্ষর আটকে ছিল, সেটি সেই মুহূর্তে টলটল করে উঠল—“ন—”—এবং থেমে গেল, যেন কারও ধৈর্য মেপে নিচ্ছে।
রাত্রে তারা যে যার বিছানায় শুতে গেলে, একই বাতাস আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকে পড়ল—চন্দন-শালপাতার সীমানাহীন গন্ধ, দূরের ঘণ্টার একটি কাঁপা ঝঙ্কার, আর নীচু স্বরে আঙুল ডুবিয়ে লেখা একটি কথামাত্র: শুরু।
পর্ব ২ : অস্থির দিনগুলি
তনয় মিত্র নিজের যুক্তিবাদী মনকে যতই ঠান্ডা করতে চাইল, শরীরের ভেতরের আতঙ্ক থামল না। হাসপাতালের করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে লক্ষ্য করছিল—রোগীদের চোখ যেন অদ্ভুত ভাবে তার ওপর স্থির হয়ে আছে। যেন তারা সবাই একই প্রশ্ন করতে চাইছে: “তুমি কি সেই শব্দ শুনেছ?” সে কয়েকবার মাথা ঝাঁকিয়ে দূরে চলে যেতে চেষ্টা করল, কিন্তু মনে হচ্ছিল প্রতিটি ছায়া তার বুকের ওপর আঁকা বৃত্তটার দিকে তাকিয়ে আছে। কফি মেশিনের সামনে দাঁড়াতেই নিজের কানে আবার শুনল—“হ্রীং… ক্রৌঁ… শৌঃ…” তারপর হঠাৎ করেই কণ্ঠ থেমে গিয়ে ফাঁকা নিস্তব্ধতা। কফির গরম কাপটি হাতে নিয়েও তনয়ের আঙুল কেঁপে উঠল, ফোঁটা ফোঁটা কফি মেঝেতে পড়তে লাগল।
বেনারসে কবির তিওয়ারি দিনভর ঘাটের আশেপাশে অস্থির হয়ে হাঁটছিল। ছাই ভরা বাতাস যেন বুকের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল। বিকেলে সে যখন সিন্দুক খুলল, দেখল ঠাকুরদার পুঁথির পাতার মধ্যে আবারো ছাই জমেছে। এবারও সে ছাই সরাতে চাইল, কিন্তু আঙুলে তীব্র জ্বালাপোড়া শুরু হল। সেই সময় পুঁথির শেষ পাতায় সে হঠাৎ অর্ধেক আঁকিবুঁকি দেখতে পেল—যেন মন্ত্রের প্রথম কয়েকটি অক্ষর কারও তাড়াহুড়োয় কেটে দেওয়া। কবির হতবাক হয়ে বসে রইল। মাথার ভেতরে গুঞ্জন বাজছিল, আর সে বুঝতে পারছিল এই গুঞ্জন তার নিজের মাথার ভেতরের নয়, বাইরে থেকেও নয়—কোথাও মাঝখানে।
শিলঙে ইশিতা দত্ত গবেষণার কাজে বাইরে গেলেও সারাক্ষণ কানে ভেসে আসছিল সেই একই স্বপ্নের শব্দ। সে মাইক্রোফোন খুলে পাহাড়ি ঝর্ণার শব্দ রেকর্ড করছিল, কিন্তু হেডফোনে পরে যখন শুনল, মনে হল ঝর্ণার সঙ্গে মিশে গেছে সেই অসম্পূর্ণ মন্ত্র। রেকর্ডার বারবার বন্ধ করলেও শব্দ হারাল না। পাহাড়ি মেয়েদের লোকগান শুনতে শুনতে ইশিতা হঠাৎ লক্ষ্য করল—এক বৃদ্ধা গায়িকা গান থামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলছে, “তুমি-ও শুনেছ, তাই তো?” ইশিতা আঁতকে উঠল। বৃদ্ধার চোখে স্পষ্ট ভয় ছিল, কিন্তু ঠোঁটের কোণে এক চাপা হাসি, যেন সে জানে অনেক কিছু যা বলা যায় না।
মুর্শিদাবাদে সায়ন্তন ঘোষ ক্লাসে দাঁড়িয়ে ‘পঞ্চদশ শতকের তান্ত্রিক প্রতীক’ নিয়ে পড়াচ্ছিল, অথচ নিজের খাতার ভাঁজে আঁকা বৃত্তটা থেকে চোখ সরাতে পারছিল না। ছাত্রদের কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেই সে হকচকিয়ে যাচ্ছিল। শেষে বিরতিতে এক ছাত্র তার দিকে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল, “স্যার, আপনার হাতের দাগটা কেমন করে হলো?” সায়ন্তন বুঝতে পারল—সে রুমাল দিয়ে ঢাকতে চাইলেও, বৃত্তচিহ্ন আরও গাঢ় হয়ে উঠছে। চোখ সরিয়ে নিতেই ক্লাসরুমের কোণে সে কানে শুনতে পেল কেউ মন্ত্রের প্রথম অংশ জপছে। কিন্তু চারপাশে কেউ নেই।
চট্টগ্রামে নাদিয়া রহমানের দিনটাও কাটল অসহ্যভাবে। রোগীর বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে ইনজেকশন দিতে গিয়েই তার হাতে হঠাৎ টান লাগল। সুই এক মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠল। রোগী ব্যথায় চিৎকার করতেই নাদিয়া নিজের ভেতর ভয়ানক অপরাধবোধে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। সে বুঝতে পারছিল—তার শরীরের নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে অন্য কারও হাতে চলে যাচ্ছে। রাতে হাসপাতালের রুমে বসে নিজের গলার বৃত্তটাকে আঙুলে ঘষতে ঘষতে সে হঠাৎ ফোনে একটি মেসেজ পেল—“আমাদের দেখা করতেই হবে। এই মন্ত্র থামবে না।” প্রেরকের নাম: ইশিতা দত্ত।
সন্ধ্যায় একই আকাশের নিচে পাঁচজন মানুষ নিজেদের ভেতরের ছায়ার সঙ্গে লড়াই করছিল। তারা কেউ কারও নাম জানত না, তবু প্রত্যেকেই একইরকম অস্থিরতা অনুভব করছিল—শরীর যেন অন্য কারও দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, মনের ভেতরে এক অনিবার্য শব্দ প্রতিধ্বনিত, আর স্বপ্নের সেই অসম্পূর্ণ মন্ত্র প্রতিটি মুহূর্তে আরও জোরে বাজছে।
রাত নামতেই তনয়ের ফোনে অচেনা একটি নোটিফিকেশন ভেসে উঠল—Circle of Five: Incomplete Chant. সে ভেবেছিল হয়তো ফোন হ্যাক হয়েছে। কিন্তু অ্যাপ্লিকেশন ওপেন করতেই দেখল—পাঁচটি বিন্দু জ্বলছে, চারটির পাশে নাম লেখা, একটি ফাঁকা। তনয় অবাক হয়ে স্ক্রিনে তাকাল। ঠিক সেই মুহূর্তে তার বুকের ওপরের বৃত্তচিহ্ন যেন আলোকিত হয়ে উঠল—এবং সে অনুভব করল, কারা যেন তাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে, এক অদ্ভুত পথে, যেখানে তার আর ফেরার উপায় নেই।
পর্ব ৩ : ছেদবিন্দু
কলকাতা থেকে শিলঙ যাওয়ার বাস যাত্রা তনয়ের জীবনে প্রথম। ডাক্তারি পড়াশোনার ফাঁকে সে কোনোদিন এত দূরে পাহাড়ে আসেনি। বুকের ওপরের বৃত্তচিহ্ন এতোদিনে কিছুটা ফিকে হলেও একদম মিলিয়ে যায়নি, বরং রাত বাড়লেই আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। ট্রেনের স্লিপারে শুয়ে সে বুঝতে পারছিল—এক অদৃশ্য টান তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। অ্যাপ্লিকেশনটা ফোন থেকে মুছে ফেলতে চেয়েও পারেনি, কারণ ফোন অন করলে আবারও জ্বলে উঠত সেই একই লোগো: Circle of Five.
শিলঙের মেঘমাখা সকাল। নীচু কুয়াশার ভেতর দিয়ে গাছপালার শিকড় যেন মাটির বাইরে এসে বাতাসে নড়ছে। পাহাড়ি শহরের এক ক্যাফেতে প্রথমবার তনয় মুখোমুখি হল ইশিতা দত্তর সঙ্গে। ইশিতা বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল, চোখের তলায় কালো দাগ। কফির কাপ হাতে নিয়ে সে হেসে বলল, “আপনিও কি ঘুমাতে পারছেন না?” তনয় অস্বস্তি নিয়ে গলা খাঁকারি দিল, “শুধু ঘুম নয়… এই শব্দগুলো আমার মাথা ভরিয়ে ফেলেছে। অপারেশন থিয়েটারেও শুনছি।” ইশিতা মাথা নাড়ল, “আমি রেকর্ড করেছি। আপনি শুনতে চান?”
ইশিতা মোবাইলটা টেবিলের ওপর রাখল। প্লে চাপতেই শোনা গেল পাহাড়ি ঝর্ণার শব্দ, তার ভেতর থেকে হঠাৎ যেন মন্ত্রের ধ্বনি ভেসে উঠল। তনয় চেয়ারের হাতল শক্ত করে ধরল। “ঠিক এইটুকু পর্যন্তই আসে। তারপর থেমে যায়। ওই শেষ অক্ষরটা আটকে থাকে।” ইশিতার গলা কেঁপে যাচ্ছিল।
ক্যাফের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল আরও দু’জন—কবির তিওয়ারি আর সায়ন্তন ঘোষ। দু’জনেই একে অপরকে আগে দেখেনি, কিন্তু ক্যাফের ভেতরে পা রাখতেই তারা এক অদ্ভুত নিশ্চয়তা পেল—ঠিক জায়গাতেই এসেছে। কবিরের চোখে ধোঁয়ার মতো ছাই লেগে ছিল, যেন সে এখনও ঘাট থেকে এসেছে। সায়ন্তনের হাতে পুরোনো খাতার ভাঁজ, তার পাতায় আঁকা সেই বৃত্ত।
“আমি কবির,” সে সংক্ষেপে বলল, চেয়ারে বসে। “বেনারস থেকে এসেছি। তোমাদের সবার মতো আমারও একই স্বপ্ন।”
সায়ন্তন গম্ভীর স্বরে যোগ করল, “স্বপ্ন নয়। এটা অভিন্ন অভিজ্ঞতা। আমি ক্লাসে পড়াতে পড়াতে শুনেছি সেই ধ্বনি। ছাত্রদের সামনে— অথচ কেউ টের পায়নি।”
টেবিলের চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এল। ঠিক তখনই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল পঞ্চম জন—নাদিয়া রহমান। তার চোখে ঘুমহীনতার ছাপ, কাঁধে হাসপাতালের স্টেথোস্কোপ এখনও ঝুলছে। এক মুহূর্তের জন্য সবাই তার দিকে তাকাল। নাদিয়া আস্তে বলে উঠল, “তাহলে এটা কেবল আমারই নয়।”
ক্যাফের ভেতরে বসে থাকা অন্য ক্রেতারা স্বাভাবিক কথাবার্তায় মশগুল ছিল, কিন্তু পাঁচজনের টেবিল যেন অদৃশ্য কোনো পর্দায় ঢাকা। বাইরের হইচই এখানে এসে থেমে যাচ্ছিল।
ইশিতা ব্যাগ থেকে খাতা বের করে খুলল। পাতায় আঁকা মানচিত্রের মতো একটি বৃত্ত—পাঁচটি বিন্দু আর মাঝখানে শূন্য। “আমি স্বপ্নে দেখেছি এটা,” সে বলল, “এবং এর প্রত্যেকটি বিন্দু আমাদের মধ্যে একজনকে বোঝাচ্ছে।”
কবির তার খাতার ভাঁজে পাওয়া আঁকিবুঁকি বের করল। একই প্রতীক। সায়ন্তনের হাতের তালুর দাগও একই বৃত্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তনয়ের বুকের দাগ আর নাদিয়ার গলার চিহ্ন দেখা যেতেই কেউ আর সন্দেহ করল না।
তারা প্রত্যেকে বুঝতে পারছিল—এখন আর ফেরার উপায় নেই।
কবির নিচু গলায় বলল, “এই প্রতীক শাস্ত্রে মণ্ডল নামে পরিচিত। সাধনার জন্য তৈরি করা হতো। কিন্তু এখানে যে অসম্পূর্ণ মন্ত্র আটকে আছে, তা শুধু সাধনা নয়… এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কারও মুক্তি।”
তনয় ঝুঁকে এল, “মানে?”
কবির দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “যে সাধক এটা শুরু করেছিল, সে মরেও শেষ করতে পারেনি। তাই আমাদের মাধ্যমে সে কাজটা শেষ করতে চাইছে।”
কথাগুলো শোনামাত্র নাদিয়া টেবিলের ওপর হাত রাখল। “তাহলে আমরা শুধু স্বপ্নের ফাঁদে পড়িনি। আমরা নির্বাচিত হয়েছি।”
টেবিলের চারপাশে ছায়া যেন একটু ঘন হয়ে এল। বাতাসের ভেতরে অদৃশ্য ধ্বনি ঝিরঝির করে কেঁপে উঠল। ইশিতার মোবাইল নিজে থেকেই রেকর্ডিং শুরু করল। সবাই নীরবে শুনল—শব্দটা এবার আরও স্পষ্ট:
“হ্রীং… ক্রৌঁ… শৌঃ… ন…”
কিন্তু এর পর?
সবাই নিঃশ্বাস আটকে থাকল। কেউ কথা বলল না। বাইরের পাহাড়ি কুয়াশা জানলার কাঁচে জমে এসে যেন ভেতরে উঁকি দিচ্ছিল।
সেই মুহূর্তে হঠাৎ ক্যাফের আলো একবার ঝিম মেরে উঠল। ওয়েটার চমকে পেছন ফিরে তাকাল, তারপর আবার আলো স্বাভাবিক হল। কিন্তু পাঁচজনই জানত—এটা কেবল বৈদ্যুতিক সমস্যা নয়।
তারা প্রত্যেকে একে অপরের দিকে তাকিয়ে বুঝে গেল—এবার তাদের একসাথে খুঁজে বের করতে হবে সেই অসম্পূর্ণ সাধনার সত্য।
এবং এর জন্য শুরু করতে হবে প্রাচীন পুঁথির সন্ধান।
পর্ব ৪ : প্রাচীন পুঁথি
শিলঙের সেই ক্যাফে থেকে বেরোনোর পর পাহাড়ি বাতাস যেন আরও শীতল হয়ে উঠল। মেঘ নেমে এসে রাস্তা ঢেকে দিয়েছে, যেন শহরটাকে বাইরে থেকে লুকিয়ে রাখতে চাইছে। পাঁচজন প্রথমবার একসঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল—অপরিচিত হলেও, যেন বহুদিনের সঙ্গী।
ইশিতা ব্যাগ থেকে বের করল একটি কপি। পাহাড়ি লোকগান নিয়ে গবেষণার সময় সে পুরোনো আর্কাইভে ঢুঁ মেরেছিল। সেখানেই পেয়েছিল এক অদ্ভুত রেফারেন্স: “অর্ধচন্দ্র মণ্ডল ও পঞ্চমন্ত্র”—১৬ শতকের এক বিরল তান্ত্রিক গ্রন্থের উল্লেখ। বইটির নাম অগ্নিকুণ্ড তন্ত্র। কিন্তু সে গ্রন্থ আজ আর সম্পূর্ণ নেই।
“এই গ্রন্থেই প্রথম ওই শব্দটার উল্লেখ পাই,” ইশিতা বলল। “কিন্তু শুধু টুকরো টুকরো উদ্ধৃতি আছে। মূল পুঁথি নাকি হারিয়ে গেছে। হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন রাখা হয়েছিল।”
সায়ন্তন সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানাল। “আমি এই রেফারেন্সটা একবার পেয়েছিলাম মুর্শিদাবাদের লাইব্রেরিতে। জমিদারি আমলের সংগ্রহে। পুঁথির নাম ছিল অগ্নিকুণ্ড তন্ত্র। সেখানে পাঁচটি মন্ত্রের কথা লেখা আছে। কিন্তু শেষ মন্ত্রটা অসম্পূর্ণ।”
কবির হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। “হ্যাঁ, আমার ঠাকুরদার সিন্দুকের পুঁথিটাই বোধহয় তার টুকরো। আমি ভেবেছিলাম পুরোনো শ্লোক, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, ওই অসম্পূর্ণ ধ্বনিই এই পুঁথির অংশ।”
তনয় বিস্মিত গলায় বলল, “মানে আমরা সবাই আলাদা আলাদা ভাবে একই জিনিস খুঁজে পেয়েছি?”
নাদিয়া চুপচাপ তাদের কথা শুনছিল। তার চোখে স্থির ভয় জমাট বেঁধেছিল। “কিন্তু কেন আমাদের? পাঁচজন আলাদা শহরে, আলাদা জীবন… অথচ একই চিহ্ন, একই স্বপ্ন? এটা কি নিছক কাকতাল?”
কবির ধীরে ধীরে বলল, “কাকতাল নয়। এটা নির্বাচন। পঞ্চমন্ত্র সম্পূর্ণ করতে পাঁচজন সাধক দরকার। আমাদের শরীরই বেছে নেওয়া হয়েছে।”
কথাগুলো বাতাসে ভারি হয়ে ঝুলে রইল। চারপাশের নীরবতার ভেতর থেকে হঠাৎ কুকুরের হুক্কাহুয়া ডাক ভেসে এল, যা এই শহরে সচরাচর শোনা যায় না।
ইশিতা কাঁপা হাতে ফোন বের করল। “আমাদের একসঙ্গে যেতে হবে বেনারসে। কবিরের সিন্দুকের পুঁথিটাই প্রথম সূত্র। সেখান থেকেই হয়তো পাওয়া যাবে অসম্পূর্ণ অংশের চিহ্ন।”
পরের দিন তারা রওনা দিল। পাহাড় থেকে সমতলে নামতে নামতে প্রত্যেকের শরীর ভারী হয়ে উঠছিল, যেন অদৃশ্য কোনো বাঁধন তাদের মাটির সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে। ট্রেনে বসে সায়ন্তন তাদের নিজের আঁকা প্রতীক দেখাল। “এটা শুধু মণ্ডল নয়। প্রতিটি বিন্দু একটি দিক বোঝায়—উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম, আর মাঝখান। মাঝের বিন্দুই ফাঁকা। মন্ত্রও সেখানেই আটকে আছে।”
কবির গভীর গলায় বলল, “আমার ঠাকুরদা বলতেন, অসম্পূর্ণ মন্ত্র জপ করলে সাধক বেঁচে থাকে না। তাই হয়তো শেষ অংশ মুছে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু ওই সাধকের আত্মা মুক্তি পায়নি। সে-ই এখন আমাদের দিয়ে কাজটা করাতে চাইছে।”
নাদিয়া তাকিয়ে রইল জানলার বাইরে। অন্ধকারের ভেতর ট্রেনের লাইট ঝলসে উঠছিল। সে ফিসফিস করে বলল, “তাহলে… যদি আমরা এটা সম্পূর্ণ করি?”
ইশিতা নিঃশ্বাস ফেলে উত্তর দিল, “তাহলে এক ভিন্ন জগতের দরজা খুলে যাবে। এবং তার মূল্য আমাদের মধ্যেই কেউ দিতে হবে।”
সবাই চুপ করে গেল। ট্রেনের চাকায় চাকায় ছন্দ বাজতে লাগল, সেই ছন্দের ভেতর মিশে যাচ্ছিল ভাঙা মন্ত্রের গুঞ্জন—
“হ্রীং… ক্রৌঁ… শৌঃ… ন—”
বেনারসে পৌঁছতেই গঙ্গার বাতাসে ছাইয়ের গন্ধ নাকে এসে লাগল। কবির তাদের নিয়ে গেল তার পুরোনো বাড়িতে। অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে সিন্দুক খুলতেই দেখা গেল, পাতলা চামড়ায় বাঁধা সেই পুঁথি। পাতার ওপর লেখা মন্ত্রগুলো ছাইয়ে ঢেকে গেছে। কিন্তু মাঝের কয়েকটি অক্ষর এখনও জ্বলজ্বল করছে, যেন কেউ আগুনে খোদাই করেছে—
“পঞ্চমন্ত্রে মুক্তির দ্বার, কিন্তু উৎসর্গে পথ সম্পূর্ণ।”
সবাই একই সঙ্গে তাকাল একে অপরের দিকে। প্রশ্নটা আর মুখে উচ্চারণ করার দরকার হলো না—কে উৎসর্গ হবে?
পর্ব ৫ : অভিশপ্ত সাধক
বেনারসের পুরোনো বাড়ির নিঃশ্বাস নেওয়া দেয়ালের ভেতরে যেন ঘন হয়ে জমে ছিল সময়ের গন্ধ। সিন্দুকের ভাঁজে রাখা অগ্নিকুণ্ড তন্ত্র খুলতেই পাঁচজনের গা ছমছম করে উঠল। পাতার কালি জায়গায় জায়গায় মুছে গেছে, ছাইয়ের আস্তরণে ঢেকে আছে অক্ষর, তবু কিছু শব্দ এখনও স্পষ্ট—“অর্ধচন্দ্র মণ্ডল… পঞ্চমন্ত্র… উৎসর্গ।”
কবির কাঁপা হাতে পাতাগুলো উল্টে দিল। “এটা আমার ঠাকুরদা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রক্ষা করেছিল। বলত—এই বই শ্মশানের ধোঁয়া থেকে জন্মেছে।”
ইশিতা পাতার উপর আঙুল বুলিয়ে দেখল। হঠাৎ এক কোণ থেকে ধুলো উড়ে উঠে এল, যেন পাতাই শ্বাস ফেলছে। সায়ন্তন চশমা মুছে নিয়ে অক্ষর পড়তে লাগল। “এখানে লেখা আছে—‘তপস্যার সমাপ্তি হইবে না যতক্ষণ না পঞ্চম আত্মা মিলে মন্ত্র পূর্ণ করে। সাধক দেহ ত্যাগ করিবে, কিন্তু আত্মা রইবে আবদ্ধ।’”
নাদিয়ার গলা শুকিয়ে এল। “মানে… কোনো সাধক অসম্পূর্ণ সাধনায় মারা গিয়েছিল?”
কবির মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। ইতিহাসে এর উল্লেখ খুব সামান্য আছে। ১৫৭০ সালের দিকে বেনারসে একজন তান্ত্রিক ছিলেন—রুদ্রানন্দী। বলা হয় তিনি ‘অগ্নিকুণ্ড তন্ত্র’ সম্পূর্ণ করার জন্য পাঁচজন শিষ্য নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ মন্ত্রের আগে, রাত্রির মাঝপথে তাঁর দেহ ভস্ম হয়ে যায়। আর শিষ্যরা পাগল হয়ে মারা যায়।”
তনয় ঠান্ডা স্বরে বলল, “তাহলে রুদ্রানন্দীর আত্মাই এখন আমাদের দিয়ে সেই সাধনাটা শেষ করাতে চাইছে।”
ঘরে এক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা নেমে এল। বাইরে গঙ্গার ঘাট থেকে ভেসে এল ঢাক আর শঙ্খের শব্দ, যেন কোনো দূর অর্ঘ্য ছিন্ন হয়ে এখানে এসে লাগছে।
সায়ন্তন আবার পুঁথির পাতায় চোখ বোলাল। “এখানে লেখা আছে, অসম্পূর্ণ সাধক মুক্তি পাবে কেবল তখনই যদি পাঁচজন মিলে আবার সেই মন্ত্র জপ করে। কিন্তু… সঙ্গে আরও একটি শর্ত আছে।”
“কী শর্ত?” নাদিয়ার গলা কেঁপে উঠল।
সায়ন্তন ধীরে ধীরে পড়ল, “‘মুক্তির দ্বার খোলার জন্য রক্তবন্ধন আবশ্যক। পঞ্চজন মিলে একজনকে উৎসর্গ করিতে হইবে।’”
ঘরটা যেন জমে গেল। বাতাস ভারী হয়ে উঠল।
তনয় চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটাহাঁটি শুরু করল। “এটা একধরনের মনস্তাত্ত্বিক খেলা। আমাদের অবচেতন ভয়ের ফসল।”
কবির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বলল, “না। তুমি ডাক্তারি দিয়ে বোঝাতে চাইছ। কিন্তু আমি ছোটবেলা থেকে শ্মশানের বাতাসে বড় হয়েছি। অসম্পূর্ণ মন্ত্রের ধ্বনি আমি চিনি। এটা আমাদের ভেতরে আটকে গেছে। কোনো না কোনো দিন এর মূল্য দিতে হবেই।”
ইশিতা চাপা গলায় বলল, “তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে—কাকে বেছে নেওয়া হবে?”
কথাটা বলতেই সবার গা শিউরে উঠল।
নাদিয়া চুপ করে বাইরে তাকিয়ে রইল। গঙ্গার কালো জলে চাঁদের আলো প্রতিফলিত হচ্ছিল। হঠাৎ মনে হলো, জলের ভেতর থেকে কারা যেন চোখ মেলে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ বাইরে থেকে আসা বাতাসে পুঁথির পাতা উল্টে গেল। সেখানে একটি আঁকা ছবি—অর্ধচন্দ্রাকৃত মণ্ডল, তার ভেতরে পাঁচটি বিন্দু, আর মাঝখানে আগুনের শিখার মতো এক দাগ। ছবির নীচে লেখা: “যদি পঞ্চমন্ত্র অসম্পূর্ণ থাকে, সাধকের আত্মা পাঁচজনকে নিয়ন্ত্রণ করবে।”
ঠিক তখনই পাঁচজন একসঙ্গে শুনতে পেল বুকের ভেতর গম্ভীর এক কণ্ঠ—
“হ্রীং… ক্রৌঁ… শৌঃ… ন—…”
কণ্ঠ এবার থামল না। বরং শেষ অক্ষর যেন জিভে জড়িয়ে ধরা পড়ল—
“না—মঃ।”
শব্দটি বেরুতেই ঘরের বাতি নিভে গেল। চারদিক অন্ধকারে ঢেকে গেল। শুধু জানলার বাইরে গঙ্গার ঢেউ আলো ছিটিয়ে দিচ্ছিল।
অন্ধকারের ভেতর সেই কণ্ঠ আবার শোনা গেল—
“আমাকে মুক্ত করো… নয়তো তোমরা মুক্তি পাবে না।”
পর্ব ৬ : রক্তবন্ধন
অন্ধকার ঘরটিতে পাঁচজনের নিঃশ্বাস যেন কুয়াশার মতো জমে উঠেছিল। সিন্দুকের পুঁথি অর্ধেক খোলা, পাতার উপর আলো জ্বলজ্বল করছে, অথচ ঘরের বাতি নিভে আছে। যেন পুঁথিটাই আলোর উৎস।
কবির ঠোঁট শুকিয়ে এল। “শুনলে তো? শেষ অক্ষরটা এবার সম্পূর্ণ হলো।”
ইশিতা চুপচাপ বসে ছিল। তার কণ্ঠ প্রায় ফিসফিস করে বেরোল—“‘নামঃ’… মানে পূর্ণ সমর্পণ। উৎসর্গ ছাড়া মুক্তি নেই।”
তনয় জোরে মাথা নাড়ল। “না, এটা হ্যালুসিনেশন। আমাদের সবার মাথায় একই ভয়ের ছাপ পড়েছে। মস্তিষ্কে রেজোন্যান্স হচ্ছে।”
কবির তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। “তুমি ডাক্তার, বিজ্ঞান মানো। কিন্তু এই দাগটা তোমার বুক থেকে কি মুছতে পারছ? আমরা কেউ পারিনি।”
সায়ন্তন খাতায় দ্রুত লিখতে শুরু করল। “রক্তবন্ধন… এর মানে কেবল প্রতীকী উৎসর্গ নাও হতে পারে। হয়তো রক্ত দিয়ে মণ্ডল পূর্ণ করতে হবে। তন্ত্রে বহুবার দেখা যায়, রক্ত মন্ত্রের শক্তি বহন করে।”
নাদিয়া শিউরে উঠল। “তাহলে আমাদের মধ্যে একজনকে হত্যা করতে হবে?”
ঘরে আবারো নিস্তব্ধতা নেমে এল। বাইরে গঙ্গার ঢেউ ভাঙার শব্দ যেন আরও কাছে চলে আসছিল।
ঠিক তখনই পুঁথির পাতায় হঠাৎ লালচে দাগ ফুটে উঠল। কেউ ছুঁয়েওনি, তবু অক্ষরের চারপাশে রক্তের মতো তরল জমে উঠছে। নাদিয়া আতঙ্কে পিছিয়ে গেল। “এটা কীভাবে সম্ভব?”
কবির দাঁড়িয়ে পড়ল। “এটা সতর্কবার্তা। আমরা যদি মন্ত্র শেষ না করি, তবে রুদ্রানন্দীর আত্মা আমাদের দেহকেই ব্যবহার করবে। আর যদি শেষ করি—আমাদের মধ্যে একজনকে উৎসর্গ করতে হবে।”
তনয় চেঁচিয়ে উঠল, “কেউ কাউকে মেরে ফেলবে না! আমরা অন্য পথ খুঁজব।”
ইশিতা চোখ নামিয়ে বলল, “কিন্তু অন্য পথ কি আছে?”
সায়ন্তন ধীরে বলল, “শাস্ত্র বলছে, রক্তবন্ধন আবশ্যক। প্রশ্ন হচ্ছে—উৎসর্গটা কাকে করতে হবে? হয়তো শারীরিক মৃত্যু নয়, হয়তো কারও জীবনশক্তি সমর্পণ করলেই হবে।”
নাদিয়ার ঠোঁট ফেটে গেল, রক্ত বেরোল। সবাই চমকে তাকাল। তার গলার বৃত্তচিহ্নটা আরও লাল হয়ে উঠছিল। সে কষ্ট করে বলল, “আমার মনে হয়… ও ইতিমধ্যেই আমাকে বেছে নিয়েছে।”
তনয় দ্রুত এগিয়ে গিয়ে তার ক্ষত মুছে দিল। “না, তুমি বলবে না এমন কথা। এটা কেবল কাকতাল।”
কিন্তু ইশিতা লক্ষ্য করছিল—নাদিয়ার চোখে এক অদ্ভুত স্থিরতা। যেন সে মেনে নিয়েছে নিজের নিয়তি।
হঠাৎ ঘরের বাইরে শঙ্খধ্বনি বেজে উঠল। রাত তখন গভীর, অথচ এমন শঙ্খধ্বনি সাধারণত সকালে হয়। তারা সবাই দৌড়ে জানলার কাছে গেল। গঙ্গার ঘাটে পাঁচজন সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে, তাদের হাতে প্রদীপ। প্রত্যেকেই একই সঙ্গে মন্ত্র উচ্চারণ করছে—
“হ্রীং… ক্রৌঁ… শৌঃ… নামঃ…”
তাদের কণ্ঠে কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু ঘাটের আলোতে স্পষ্ট দেখা গেল—প্রত্যেক সন্ন্যাসীর কপালে কালচে ফাঁকা দাগ, যেন তারা শূন্য চোখে জপ করছে।
কবির ফিসফিস করে বলল, “এরা বেঁচে নেই… এরা ওর দাস।”
পাঁচজন একে অপরের দিকে তাকাল। তারা বুঝে গেল—সময় ফুরিয়ে আসছে। যদি তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত না নেয়, রুদ্রানন্দীর আত্মা জোর করে তা করে নেবে।
ঘরে ফিরে এসে পুঁথির পাতা আবার খুলতেই লেখা ভেসে উঠল—
“পঞ্চজন মিলে রক্তবন্ধন না করলে, মণ্ডল অপূর্ণ থেকে যাবে। তখন আত্মা নিজেই উৎসর্গ বেছে নেবে।”
তনয় ঘামতে ঘামতে বলল, “মানে, যদি আমরা না ঠিক করি… আমাদের মধ্যে একজন নিজে থেকেই মারা যাবে?”
নাদিয়া ধীরে চোখ বন্ধ করল। “হ্যাঁ। আর সেটা হয়তো খুব শিগগিরই।”
পর্ব ৭ : শ্মশানের রাত্রি
গঙ্গার ধারে রাত্রিটা যেন কেঁপে উঠছিল নিজের অদৃশ্য ছন্দে। শহরের আলো পেছনে ফেলে কবির তাদের নিয়ে গেল মানিকর্ণিকার ঘাটের কাছের এক পুরনো শ্মশানমন্দিরে। বেনারসের ঘাটে এমন অগণিত মন্দির আছে, কিন্তু এই মন্দিরের গায়ে অদ্ভুত নকশা খোদাই—পাঁচটি বৃত্ত, আর তাদের মাঝখানে ছাইমাখা শূন্যচিহ্ন।
ইশিতা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বলল, “এটাই তো আমাদের স্বপ্নের প্রতীক।”
সায়ন্তন মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। “এই মণ্ডলেই রক্তবন্ধন সম্পূর্ণ করতে হবে।”
মন্দিরের ভেতরে ঢুকে সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। বাতাসে শুধু ধূপের ধোঁয়া নয়, পোড়া কাঠের গন্ধ মিশে ছিল। একপাশে ভাঙা প্রদীপ, অন্যপাশে ছাই জমে আছে। যেন বহু বছর কেউ এখানে আসেনি।
তনয় হাতের টর্চ জ্বালাতেই মন্দিরের দেয়ালে শ্লোক ভেসে উঠল। অক্ষরগুলো আধো-আধো, কিন্তু পড়া গেল—
“পঞ্চমন্ত্রে দ্বারোদ্ঘাটন, রক্তে হবে মণ্ডল পূর্ণ।”
নাদিয়া চুপচাপ মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল। তার গলার দাগটা আবারও উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল, যেন জ্বলন্ত আগুনের ছাপ। সে ফিসফিস করে বলল, “আমাকে দিয়েই শুরু করতে চায়।”
তনয় তার হাত ধরে ফেলল। “না, তুমি মরবে না। আমরা অন্য পথ বের করব।”
কিন্তু কবির কণ্ঠ দৃঢ়। “অন্য পথ নেই। এখানে যতক্ষণ না রক্ত পড়বে, ততক্ষণ মন্ত্র অসম্পূর্ণ থাকবে। আমরা যদি না করি, ও নিজেই কাউকে বেছে নেবে।”
হঠাৎ বাইরে শ্মশানের অগ্নিশিখা দপদপ করে উঠল। বাতাসের ঝাপটায় পুরু ধোঁয়া ঢুকে পড়ল ভেতরে। ধোঁয়ার মধ্যে তারা সবাই শুনল সেই ভাঙা মন্ত্র এবার স্পষ্ট হয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে—
“হ্রীং… ক্রৌঁ… শৌঃ… নামঃ…”
কণ্ঠটা যেন আর শুধু কানে নয়, হাড়ের ভেতর গেঁথে যাচ্ছে।
ইশিতা ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে রেকর্ড করতে গেল, কিন্তু স্ক্রিন হঠাৎ অচল হয়ে গেল। তাতে শুধু একটাই প্রতীক দেখা গেল—পাঁচটি বিন্দু, আর মাঝখানে রক্তলাল আগুনের দাগ।
সায়ন্তন খাতার পাতা মেঝেতে ছড়িয়ে দিল। “এখানে মণ্ডল আঁকতে হবে। পাঁচজন মিলে দাঁড়াতে হবে পাঁচ বিন্দুর জায়গায়।”
তারা কাঁপা হাতে মণ্ডল আঁকল ছাই দিয়ে। পাঁচ বিন্দুতে পাঁচজন দাঁড়াতেই চারপাশের বাতাস কেঁপে উঠল। যেন অদৃশ্য হাত মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দিল।
নাদিয়ার গলা হঠাৎ চেপে এল, সে হাঁপাতে লাগল। তার বুক থেকে রক্তের ফোঁটা ঝরে পড়ল মণ্ডলের কেন্দ্রে। লাল দাগ ছড়িয়ে পড়তেই মণ্ডল আলোকিত হয়ে উঠল।
তনয় চেঁচিয়ে উঠল, “না! এটা বন্ধ করো!”
কবির তাকে ধরে রাখল। “এটাই রক্তবন্ধন। এ ছাড়া মুক্তি নেই।”
ইশিতার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল, কিন্তু সে কণ্ঠ চেপে পড়ল, “যা হবার, হতে দাও।”
মণ্ডলের মাঝখানে লাল আলো জমাট বাঁধছিল। আলো থেকে ধীরে ধীরে এক আকৃতি ফুটে উঠল—অগ্নিদীপ্ত চোখ, ছাইমাখা দেহ, আর জটাজুটে ঢাকা এক সাধকের ছায়া।
সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল—
“আমার সাধনা অসম্পূর্ণ। তোমাদের রক্তে পথ খুলেছে। এখন দ্বার উন্মুক্ত করো।”
সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল।
কিন্তু সায়ন্তন হঠাৎ কণ্ঠ উঁচু করে বলল, “না! আমরা কাউকে উৎসর্গ করব না। যদি মুক্তি পেতে হয়, তুমি নিজেই তোমার অসম্পূর্ণ সাধনার দায় নাও।”
অগ্নিদীপ্ত চোখে সেই ছায়া সায়ন্তনের দিকে তাকাল। মুহূর্তে বাতাস ভারী হয়ে উঠল। সায়ন্তনের শরীর কাঁপতে শুরু করল, বুকের দাগটা রক্তলাল হয়ে উঠল।
তখনই নাদিয়া চিৎকার করে বলল, “না! যদি কাউকে নিতে হয়—আমাকে নাও!”
মণ্ডলের মাঝখানের আলো দপদপ করে উঠল। আগুনের ছায়া থেমে গেল এক মুহূর্ত।
আর বাকিরা বুঝল—আজকের রাতেই সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে, কে বেঁচে থাকবে, আর কে উৎসর্গ হবে।
পর্ব ৮ : দ্বারোদ্ঘাটন
মণ্ডলের মাঝখানে আলো ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছিল। ধোঁয়ার ভেতর থেকে ফুটে ওঠা রুদ্রানন্দীর ছায়া যেন প্রতিটি নিশ্বাসে আগুন গিলছিল। গঙ্গার ঘাটের বাতাস থেমে গেছে, দূরের অগ্নিশিখাগুলো নিস্তেজ, কেবল এই ভগ্ন মন্দিরের ভেতরে আলো তীব্রতর হয়ে উঠছিল।
নাদিয়া হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। বুক থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে মণ্ডলের কেন্দ্রে। সে ফিসফিস করে বলল, “আমাকে নিয়েই যদি তোমার মুক্তি হয়, তবে নাও।”
তনয় ছুটে গিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরল। “চুপ করো! তোমাকে কিছু হতে দেব না।” তার কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত দৃঢ়তা, কিন্তু চোখে ভয়ের ছায়া।
রুদ্রানন্দীর কণ্ঠ ভেসে এল—
“উৎসর্গ ছাড়া দ্বার খুলবে না।
মন্ত্র অসম্পূর্ণ থাকলে আমি মুক্ত হব না।
আর তোমরাও মুক্তি পাবে না।”
ইশিতা চোখ মুছে দাঁড়িয়ে গেল। তার হাতে এখনও মোবাইল, কিন্তু স্ক্রিনে কেবলই লাল বৃত্ত ঘুরছে। “আমরা পাঁচজন যদি একই সঙ্গে জপ করি? অসম্পূর্ণ মন্ত্র সম্পূর্ণ করলে কি দরজা খুলবে?”
সায়ন্তন বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে চিৎকার করে উঠল, “হ্যাঁ, এখানে তাই লেখা! পঞ্চজন একত্রে জপ করলে দ্বার খুলবে—কিন্তু রক্ত ছাড়াই হয়তো অসম্ভব। তবু চেষ্টা করা যাক।”
পাঁচজন হাত মিলিয়ে দাঁড়াল মণ্ডলের বিন্দুগুলোতে। ধোঁয়া আরও ঘন হয়ে উঠল। তারা একসঙ্গে উচ্চারণ শুরু করল—
“হ্রীং… ক্রৌঁ… শৌঃ… নামঃ…”
কণ্ঠ এক হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মণ্ডলের মাঝখানে হঠাৎ এক ভয়ংকর আলো জ্বলে উঠল। চারপাশের দেয়াল যেন কেঁপে উঠল, মাটিতে আঁকা প্রতীকগুলো লাল হয়ে জ্বলতে লাগল।
তারপরই ঘটল অচিন্তনীয় ব্যাপার। মন্দিরের ভেতরে যেন আরেকটা আকাশ খুলে গেল—ধোঁয়ার আড়াল সরে গিয়ে দেখা গেল অচেনা প্রান্তর, যেখানে মাটি নেই, গাছ নেই, কেবল ছাইয়ের সমুদ্র আর কালো শিখা ওঠানামা করছে। সেই শিখার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক দরজা—অর্ধেক খোলা। দরজার ওপারে অন্ধকার, কিন্তু অন্ধকারের ভেতর থেকে ভেসে আসছে গর্জন, যেন হাজারো কণ্ঠ একসঙ্গে ডাকছে।
কবির দমবন্ধ হয়ে বলল, “এটাই অন্য জগতের দ্বার।”
তনয় নাদিয়াকে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। তার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছে, কিন্তু চোখ স্থির। সে আস্তে বলল, “দরজাটা ওর জন্য নয়। এটা আমাদের জন্য খোলা হয়েছে।”
রুদ্রানন্দীর ছায়া এবার আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। আগুনের মতো চোখ, গলার ভেতরে তীব্র গর্জন। “আমার সাধনা অসম্পূর্ণ ছিল। এখন তোমরা তা সম্পূর্ণ করেছ। দরজা খুলে গেছে। এখন বলো—কে উৎসর্গ হবে?”
মন্দিরে আবার নিস্তব্ধতা। বাইরে বাতাস নেই, নদীর শব্দ নেই, কেবল হৃদস্পন্দনের মতো ধ্বনি বাজছে।
ইশিতা দাঁত চেপে বলল, “আমরা পাঁচজন মিলে যদি মন্ত্র জপ করি, তবে দ্বার খোলা থাকবে। কাউকে উৎসর্গ করা লাগবে না।”
কিন্তু ছায়া গর্জে উঠল, “তন্ত্রের নিয়ম ভাঙা যায় না। তোমাদের রক্ত চাই। একজনের।”
নাদিয়া ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল কেন্দ্রে। তার চোখে অদ্ভুত প্রশান্তি। “হয়তো আমি-ই সেই নির্বাচিত। আমার দেহ থাকুক উৎসর্গ, যদি তাতে অন্যরা বাঁচে।”
তনয় তাকে আটকাতে গেল, কিন্তু কবির কাঁধে হাত রাখল। “ও নিজেকে সমর্পণ করছে। এটাই হয়তো শাস্ত্রের পথ।”
হঠাৎ দরজা দপদপ করে আরও খুলে গেল। ভিতর থেকে কালো বাতাস ছুটে এসে সবাইকে কাঁপিয়ে দিল। সেই বাতাসে ভেসে আসছিল অচেনা গন্ধ—চন্দন, ছাই আর রক্তের মিশ্রণ।
পাঁচজন নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল। দ্বার অর্ধেক খুলে গেছে। এখন যদি নাদিয়া এগোয়, তবে সম্পূর্ণ খুলে যাবে। আর যদি না যায়—তাহলে কে জানে, কী হবে?
পর্ব ৯ : আত্মার লেনদেন
শ্মশানমন্দিরের ভেতর তখন কেবল আগুনের গন্ধ, ছাইয়ের ঝড় আর দরজার ভেতর থেকে ভেসে আসা গর্জন। পাঁচজন একে অপরের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারল—এখন আর পিছু হটার উপায় নেই।
রুদ্রানন্দীর ছায়া ধীরে ধীরে মণ্ডলের আলো থেকে বেরিয়ে এল। অগ্নিদীপ্ত চোখ ঘুরে ঘুরে পড়ল সবার ওপর। “তোমাদের মাধ্যমে আমি মুক্ত হব। কিন্তু তার বিনিময়ে একজনকে উৎসর্গ হতে হবে। বলো, কে প্রস্তুত?”
নাদিয়া ধীরে মাথা তুলল। “আমাকে নাও। আমার শরীরই তো চিহ্নে ভরে গেছে।”
তনয় গর্জে উঠল, “না! তুমি মরবে না। যদি কেউ উৎসর্গ হয়, আমি হব।”
ইশিতা হকচকিয়ে গেল। “তুমি? কিন্তু তুমি ছাড়া আমরা চিকিৎসার সাহায্য পাবো না।”
তনয় কঠিন গলায় বলল, “আমি ডাক্তার হয়েছি প্রাণ বাঁচানোর জন্য। কিন্তু যদি একজনের মৃত্যু দিয়ে চারজন বাঁচে, সেটাও তো বাঁচানো।”
কবির দাঁত চেপে বলল, “না, এভাবে ভাবা যায় না। আমরা সবাই সমানভাবে বাঁধা। যে-ই যাক, তার সঙ্গে আমাদেরও মৃত্যু আসতে পারে।”
সায়ন্তন হাত তুলে সবাইকে থামাল। তার চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি। “আমাদের মধ্যে একজনকে বেছে নিতেই হবে। কিন্তু কে বলল সেটা রক্তের মৃত্যু? হয়তো উৎসর্গ মানে আত্মার লেনদেন—নিজের জীবনের বদলে অন্য কিছু দেওয়া।”
রুদ্রানন্দী গম্ভীর কণ্ঠে হেসে উঠল। “বুদ্ধিমান! হ্যাঁ, রক্তের মৃত্যু এক পথ। কিন্তু আত্মা দিয়ে লেনদেন করা যায়। যে স্বেচ্ছায় নিজের আত্মা সমর্পণ করবে, সে চিরকাল আমার সঙ্গে থাকবে।”
ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। পাঁচজনের বুকের দাগ লাল হয়ে জ্বলল। সবাই বুঝল—এটা এখন বিশ্বাসের খেলা।
ইশিতা হঠাৎ কণ্ঠ উঁচু করল, “আমি রাজি। আমার রিসার্চ, আমার জীবন, সবকিছু ত্যাগ করতে পারি। শুধু তোমাদের চারজনকে বাঁচিয়ে দাও।”
কবির তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। “তুমি জানো না এর মানে কী। আত্মা দিলে আর ফিরে আসা যায় না।”
ইশিতা মৃদু হাসল। “আমাদের সবার তো ভবিষ্যৎ নেই, যদি না কেউ নিজেকে দেয়। আমি অন্তত জানব, আমার মৃত্যুর পরও চারজন বেঁচে আছে।”
তনয় কাঁপা গলায় বলল, “থামো! এটা আত্মহত্যার মতো। কেউ কারও জন্য আত্মা দেবে না।”
রুদ্রানন্দীর ছায়া হাত উঁচু করল। হঠাৎ মণ্ডলের মাঝখানে আগুনের শিখা ফেটে উঠল। ধোঁয়ার ভেতর ভেসে এল অসংখ্য কণ্ঠ—“উৎসর্গ… উৎসর্গ…”
সায়ন্তন মাটিতে বসে পড়ল। “সময় নেই। যদি আমরা সিদ্ধান্ত না নিই, ও নিজেই বেছে নেবে।”
ঠিক তখনই নাদিয়া বুকের ওপর হাত চাপড়ে উঠে দাঁড়াল। “আমাকে নাও।” তার কণ্ঠে আর ভয় ছিল না, ছিল কেবল দৃঢ়তা। “আমার গলার চিহ্নই প্রথম জ্বলেছিল। শুরু হয়েছিল আমার থেকে। শেষও হোক আমার থেকে।”
তনয় কেঁপে উঠল, তাকে জড়িয়ে ধরল। “না, তোমাকে ছাড়ব না।”
নাদিয়ার চোখে জল চিকচিক করছিল। “তুমি ডাক্তার। তুমি মানুষের জীবন বাঁচাতে শপথ নিয়েছ। আমার উৎসর্গ তোমাদের চারজনকে বাঁচাবে। এটাই তোমার শপথ পূর্ণ করবে।”
মণ্ডলের আগুন আরও উঁচু হলো। দরজা কেঁপে উঠল, প্রান্ত থেকে কালো বাতাস ঢুকতে লাগল। রুদ্রানন্দী হাত প্রসারিত করল, যেন গ্রহণ করতে চাইছে।
কবির দাঁত চেপে বলল, “না! এটা অন্যায়! আমরা সবাই মিলে কোনো উপায় বের করব।”
কিন্তু সেই মুহূর্তে নাদিয়া দুই হাত মণ্ডলের কেন্দ্রে ছুঁয়ে দিল। আলো ফেটে বেরোল চারদিকে। তার দেহ হঠাৎ কেঁপে উঠল, বুক থেকে শেষ নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল এক অদ্ভুত শান্তির সঙ্গে।
তার চোখ বন্ধ হওয়ার আগেই সে আস্তে বলল—
“এটাই আমার নিয়তি।”
দরজার ওপাশে ভয়ঙ্কর শব্দ উঠল। কালো অন্ধকার সরে গিয়ে দেখা গেল জ্বলন্ত পথ, যা কোথাও অচেনা জগতে নিয়ে যাচ্ছে।
আর রুদ্রানন্দীর ছায়া গর্জন করে বলল—
“পথ খুলেছে।”
পর্ব ১০ : চূড়ান্ত মন্ত্র
মণ্ডলের মাঝখানে নাদিয়ার দেহ নিস্তব্ধ। তার ঠোঁটে শেষ কথা যেন জমাট বেঁধে আছে—“এটাই আমার নিয়তি।” চারদিকে আলো ছড়িয়ে পড়েছে, অথচ সেই আলো শীতল নয়, আগুনের মতো ঝলসাচ্ছে।
রুদ্রানন্দীর ছায়া আগুন থেকে উঠে এল। তার চোখে মুক্তির লোভ, কণ্ঠে গর্জন—
“উৎসর্গ সম্পূর্ণ হয়েছে। মন্ত্র পূর্ণ হয়েছে। এখন দ্বার খুলেছে। আমাকে মুক্ত করো।”
দরজা এখন সম্পূর্ণ খোলা। ভেতর থেকে ভেসে আসছে ভয়ঙ্কর বাতাস, গর্জন আর হাহাকার। মনে হচ্ছে, অচেনা অগণিত আত্মা বন্দি হয়ে আছে ও-পারে।
কবির দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় বলল, “এটা মুক্তি নয়। এটা অভিশাপ। এই দরজা খুললে আমরা সবাই ধ্বংস হব।”
ইশিতা চোখ মুছে তাকাল। “কিন্তু নাদিয়া তো তার জীবন দিল এই পথ খুলতে। আমরা কি ফিরিয়ে দেব?”
সায়ন্তন খাতার দিকে তাকাল, যেখানে শেষ পাতায় জ্বলজ্বল করছে অক্ষর—
“দ্বার খোলা মানেই মুক্তি নয়; দ্বার বন্ধ করাই সত্য সাধনা।”
সে চিৎকার করে বলল, “শোনো! রুদ্রানন্দীর আত্মা আমাদের ভুল পথে টানছে। ও চায় আমরা বিশ্বাস করি, এটাই মুক্তি। আসল পরীক্ষা হলো দরজা বন্ধ করা। নাদিয়ার আত্মা হয়তো সেই কারণেই উৎসর্গ হয়েছিল।”
তনয় বুক থেকে হাত সরিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা নাদিয়ার শরীরের দিকে তাকাল। তার চোখে ভিজে উঠল জল। “যদি সত্যি তাই হয়… তবে নাদিয়ার আত্মাকে শান্তি দিতে আমাদের দরজা বন্ধ করতে হবে।”
রুদ্রানন্দী গর্জে উঠল, “না! আমি শতাব্দী ধরে অপেক্ষা করেছি। দরজা একবার খোলার পর আবার বন্ধ করলে আমি চিরকাল বন্দি থাকব। তোমরা সাহস করবে?”
চারজন একে অপরের দিকে তাকাল। ভয়, অস্থিরতা আর বেদনার ভেতরেও তাদের চোখে একই দৃঢ়তা জ্বলল।
কবির দাঁত চেপে বলল, “আমরা মন্ত্র ফের উচ্চারণ করব—কিন্তু এবার বন্ধ করার জন্য।”
তারা সবাই মিলে দাঁড়াল মণ্ডলের বিন্দুগুলোয়। হাত একে অপরের হাতে জড়াল। আগুনের ঝড়ের মধ্যে তারা একসঙ্গে উচ্চারণ করল—
“হ্রীং… ক্রৌঁ… শৌঃ… নামঃ… শান্তিঃ… শান্তিঃ… শান্তিঃ।”
অক্ষরের ধ্বনি মন্দির কাঁপিয়ে দিল। দরজার ভেতর থেকে হাহাকার আরও তীব্র হয়ে উঠল, হাজারো হাত যেন ধাক্কা মারছে ওপার থেকে। রুদ্রানন্দীর ছায়া চিৎকার করে উঠল—
“না! এটা করো না! তোমরা বুঝছ না, এভাবে তোমরাও পুড়ে ছাই হয়ে যাবে!”
কিন্তু চারজন থামল না। তাদের কণ্ঠ এক হয়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। দরজার আলো দপদপ করে নিভতে শুরু করল। কালো বাতাস টেনে নিতে চাইছিল, কিন্তু তাদের হাত শক্তভাবে বাঁধা রইল একে অপরের সঙ্গে।
অবশেষে এক গর্জনের সঙ্গে দরজা ভেঙে পড়ল। আগুন নিভে গেল। মন্দির নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
রুদ্রানন্দীর ছায়া ছিন্ন হয়ে ছাই হয়ে মাটিতে ঝরে পড়ল। তার শেষ কণ্ঠে ভেসে এল—
“অসম্পূর্ণ… অপূর্ণ… অভিশাপ…”
নীরবতা নেমে এল চারদিকে। কেবল গঙ্গার জলে ঠান্ডা ঢেউ ভাঙার শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
চারজন মাটিতে বসে পড়ল, ক্লান্ত, ভাঙাচোরা, কিন্তু বেঁচে আছে। তাদের বুকের দাগ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল।
তনয় নাদিয়ার নিস্তব্ধ দেহের দিকে তাকাল। চোখে অশ্রু ভরে উঠল। “ও-ই আমাদের রক্ষা করল। তার আত্মাই দ্বার বন্ধ করল।”
ইশিতা নিঃশব্দে তার কপালে হাত রাখল। “ও কখনও হারাবে না। ও-ই আমাদের বন্ধনের কেন্দ্র।”
সায়ন্তন খাতার শেষ পাতায় লিখে ফেলল—
“পঞ্চমন্ত্র অসম্পূর্ণই থাকল। কিন্তু অসম্পূর্ণতাতেই মুক্তি।”
কবির ধীরে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকাল। গঙ্গার ওপারে ভোরের আলো ফুটে উঠছিল। অগ্নিশিখার বদলে এবার শান্ত ঢেউ।
চারজন একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে মন্দির থেকে বেরিয়ে এল। পিছনে পড়ে রইল ভাঙা মণ্ডল, নিভে যাওয়া দরজা, আর নাদিয়ার আত্মত্যাগের ছায়া।
শহর তখন আবারও স্বাভাবিক হয়ে উঠছিল। মানুষ জানত না, আজকের রাতে কী ভয়াবহ খেলা থেমে গেছে।
আর চারজন জানত—তাদের জীবন আর কখনও আগের মতো হবে না।
সমাপ্ত




