দেবব্রত সরকার
নিঃসঙ্গ শ্মশানের অন্ধকারে সায়ন ধীরে ধীরে তার আসন গ্রহণ করে। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা শ্মশানশিল্পের অবচেতন ছায়া তার মনকে আরও উদ্বেগজনক করে তোলে। দূরে দূরে পঁচা পাতার ঘন স্তূপে কাকেরা কাঁকড়ির মতো ডাকছে, যেন শ্মশান নিজেই তার নিঃশ্বাসে সচেতন। বাতাস শীতল, ঠোঁট কামড়ে যায়, এবং হাওয়ার সঙ্গে মাটির ঘ্রাণ মিশে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ সৃষ্টি করছে। সায়নের চোখ বারবার অন্ধকারে মেলে—প্রায় মনে হচ্ছে, অদৃশ্য কোনো চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে মনে মনে গুরুজীর নির্দেশ অনুসরণ করে, নিজের নিশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু শ্মশানের অন্ধকার যেন তার প্রত্যেকটি পদক্ষেপকে ওজন দিচ্ছে। আগুনের ক্ষীণ আলো তার সামনে নাচতে নাচতে অদৃশ্য রূপে অঙ্কন করছে যেন অতীতের সমস্ত মৃত আত্মারা তাকে ঘিরে ধরেছে। তার মন অস্বস্তিতে, আবার উত্তেজনায় কেঁপে উঠছে; প্রতিটি কাঁপুনির সাথে মনে হচ্ছে কোনো অদৃশ্য শক্তি তার চারপাশে ঘূর্ণায়মান।
শ্মশানের মধ্যে গভীরভাবে এক অদ্ভুত নিরবতা বিরাজ করছে, যা অচেনা আতঙ্ককে আরও শক্তিশালী করছে। সায়নের চোখ অন্ধকারের মধ্যে ছায়া খুঁজছে, কিন্তু ছায়াগুলো যেন নিয়মিত নয়; কখনও বড়, কখনও ছোট, কখনও স্থির, কখনও হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায়। তার মনে অজান্তেই ভয় জন্ম নেয়—কিন্তু একই সঙ্গে রহস্যের প্রতি আকর্ষণও তীব্র। সে অনুভব করছে, শ্মশান শুধু মৃতদের স্থান নয়, বরং অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের মধ্যবর্তী এক দ্বার। কাকের কাঁকড়ির ডাক, দূরে মাটির মধ্যে পড়ে থাকা কঙ্কালের শব্দ, আগুনের ক্ষীণ আলো—সবই যেন তাকে এক অন্য জগতে নিয়ে যাচ্ছে। সে চোখ বন্ধ করে তার শরীরকে শান্ত করার চেষ্টা করছে, কিন্তু প্রতিটি ক্ষণ যেন আরও গভীর করে দিচ্ছে রহস্যের জট। হাওয়া যেন অদৃশ্য অঙ্গুর দিয়ে তার কানে ফিসফিস করছে, আর মনে হচ্ছে, সে শুধু একজন সাধক নয়, বরং এই শ্মশানের ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সায়নের মন আরও স্থির হয়ে আসে, কিন্তু শরীরের অভ্যন্তরীণ ভয় তাকে ছেড়ে যায় না। সে ধীরে ধীরে নিজের শ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করছে, চোখে অন্ধকারের রঙে মিশে যাওয়া আগুনের নাচের খেলাকে মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। হঠাৎ, দূরের অন্ধকার থেকে কোনো অচেনা শব্দ আসে—মাটির সঙ্গে কোনো কঠিন বস্তুর সংস্পর্শ, যেন কেউ চুপচাপ হেঁটে আসছে। সায়ন ভয়ে না, বরং রহস্যের উত্তেজনায় চঞ্চল হয়। তার মনে হয়, এই শ্মশানের অন্ধকার শুধু মৃতদের নয়, বরং জীবিতদের অন্তর্দৃষ্টি পরীক্ষার জন্যও তৈরি। সে বুঝতে পারে, প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি নিশ্বাস, প্রতিটি মুহূর্ত এখানে একটি ধ্যান ও সাধনার পরীক্ষা। আগুনের লালশোভা, কাকের ডাক, হাওয়ার ফিসফিস—সবই যেন তাকে বলে দিচ্ছে, “তুমি প্রস্তুত নও, তবে এগোতে হবে।” এবং সে সেই পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়ায়, হৃদয় ব্যথায় ও উত্তেজনায় একসঙ্গে কেঁপে উঠছে, প্রস্তুত হয় তার প্রথম রাতের সাধনার জন্য।
***
শ্মশানের অন্ধকারে সায়ন যখন প্রথমবারের মতো নিজের নিঃশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে, তখন আশপাশের পরিবেশ হঠাৎ জীবন্ত হয়ে ওঠে। আগুনের ক্ষীণ আলোর নাচের সঙ্গে সঙ্গে হালকা ফিসফিসানি বাতাসে ভেসে আসে, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি তার কানে ফিসফিস করছে। দূরের শ্মশানপাথরের ওপর পড়ে থাকা শুকনো পাতা হঠাৎ শব্দ করে, আর সেই শব্দ তার হৃদয়কে দ্রুত ছুঁয়ে যায়। পায়ের আওয়াজ শোনায় যেন কেউ ধীরে ধীরে তার চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে। আগুনের ক্ষুদ্র ছিটকানি হঠাৎ বেশি আলো ছড়ায়, এবং প্রতিটি অন্ধকার কোণ যেন তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। সায়ন চেষ্টার সঙ্গে স্থির থাকে, চোখ মেলে অন্ধকারকে পর্যবেক্ষণ করে, কিন্তু ভয় তার মনের মধ্যে ক্রমেই বাড়তে থাকে। মনে হয়, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ছায়া তার ভয়কে আরও গভীর করছে। সে গুরুজীর কথা মনে আনে—“ভয়কে জয় করো, তাহলেই পথ খুলবে।” এই কথা তার ভেতরের ধ্বনির মতো, যা আতঙ্কের ঢেউকে সামলানোর জন্য তাকে কিছুটা সাহস দিচ্ছে।
শরীরের প্রতিটি অঙ্গ ভয়কে অনুভব করছে, কিন্তু সায়নের মন এখনও দৃঢ়। তার চোখ বারবার অন্ধকারে কোনো অদৃশ্য রূপ খুঁজে পেতে চায়। হঠাৎ, শ্মশানের এক প্রান্ত থেকে হালকা ছায়া অচেনাভাবে নাচতে নাচতে আসে, যেন সে নিজেই জীবিত। এই ছায়া কখনো বড়, কখনো ছোট, কখনো স্থির, কখনো দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে, ভয় শুধু বাহ্যিক নয়—এটা তার নিজের মনের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে। প্রতিটি ফিসফিসানি শব্দ যেন তার গভীর ভয়কে আরও তীব্র করছে। আগুনের নাচে অদৃশ্য কঙ্কালের মতো রেখা দেখা যায়, যা তার মনকে সতর্ক করছে। হাওয়া এমনভাবে হুলস্থুল করছে যেন মৃতরা নিজস্ব ভাষায় তাকে পরীক্ষা করছে। তার মনে প্রশ্ন জাগে—এই ভয় কি সত্যিই বাস্তব, নাকি শুধুই তার অভ্যন্তরীণ অবচেতন মন তার সঙ্গে খেলা করছে? এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই সে আরও গভীরভাবে নিজের নিঃশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে, তার হৃদয় ভয় আর উত্তেজনার মধ্যে কেঁপে উঠছে।
ধীরে ধীরে রাত গভীর হয়, কিন্তু ভয়ের ছায়া সায়নের দিকে অবিরাম ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি অদৃশ্য স্পর্শ তার মনকে আরও শক্তিশালী করে, যদিও শরীর এখনও অস্থির। সায়ন অনুভব করে, এই ভয় শুধুমাত্র একটি পরীক্ষা; এটি তার স্থির মন ও সাধনার ধৈর্যকে যাচাই করছে। হঠাৎ দূরের অন্ধকার থেকে কোনো হালকা আঘাতের শব্দ আসে, যেন কেউ ধীরে ধীরে তার কাছে আসছে। সায়ন আতঙ্কিত নয়, বরং রহস্যের উত্তেজনায় আরও সজাগ হয়ে ওঠে। প্রতিটি পদক্ষেপ তার ভয়কে পরীক্ষা করছে, আর সে নিজের মধ্যে সেই ভয়কে জয় করার জন্য প্রয়াস চালাচ্ছে। আগুনের ক্ষীণ আলো, কাকের কাঁকড়ির ডাক, ফিসফিসানি বাতাস—সবই তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে গুরুজীর শিক্ষা। ভয়কে জয় করতে হবে, তাহলেই পথ খোলা হবে। ধীরে ধীরে সে উপলব্ধি করে, যে ভয়কে সে অনুভব করছে, সেটি তার শক্তি এবং সাধনার এক অবিচ্ছিন্ন অংশ, যা তাকে শ্মশানের রহস্যের গভীরে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত করছে। রাত গভীর, এবং সায়নের মন, শরীর ও আত্মা একসাথে সেই ভয়ের পরীক্ষা পার করে এগোচ্ছে, যেন শ্মশানের অন্ধকার তাকে আরও অভিজ্ঞ ও শক্তিশালী করে তুলছে।
***
ধূপের ঘ্রাণে ভরা শ্মশানের অন্ধকারে হঠাৎ এক অদ্ভুত রঙের আলো এসে পড়ে। আগুনের ক্ষীণ নাচের আলো ও ধোঁয়ার ঘনত্ব এক অদ্ভুত মায়াময় পরিবেশ সৃষ্টি করে। সায়ন তার আসনে বসে ধ্যান করছেন, হঠাৎ অন্ধকারের ভেতর থেকে হালকা সাদা ছায়া নড়াচড়া করে। প্রথমে সে ভয় পায়, মনে হয়, অদৃশ্য কোনো শক্তি তার দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু চোখের কোণ দিয়ে যা দেখা গেল, তা তার সমস্ত ধারণাকে ছাড়িয়ে যায়। ধোঁয়ার ভেতর থেকে আবির্ভূত হয় এক রহস্যময়ী নারী—সাদা শাড়ি, খোলা চুল, আর চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি, যা অন্ধকারের সব কিছুই আলোকিত করছে। তার উপস্থিতি এতটাই অদ্ভুত যে সায়নের হৃদয় কিছুটা কাঁপলেও মনে হয় ভয়ের সঙ্গে মিশে গেছে এক অজানা আকর্ষণ। সে মনে মনে ভাবছে, ভূত বা অদৃশ্য শক্তি কি সত্যিই এখানে উপস্থিত? কিন্তু নারীর ভঙ্গি ও হাঁটার ধরণ এক গভীর মানবিক সৌন্দর্য প্রকাশ করছে, যা ভয়কে হ্রাস করে। ধোঁয়া তার চারপাশে নাচতে নাচতে যেন নারীর রূপকে আরও রহস্যময় করে তুলছে।
নারীর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসার সাথে সাথে সায়নের মন আরও কৌতূহল ও ভয়ের মিশ্র অনুভূতিতে উত্তেজিত হয়। প্রতিটি ধাপে ধোঁয়া সরিয়ে নতুন আকারের আলো ফেটে পড়ে, যা নারীর সাদা শাড়ির নরম উজ্জ্বলতাকে আরও স্পষ্ট করে। তার চোখের দীপ্তি এমনভাবে সায়নের দিকে তাকাচ্ছে যে মনে হয়, সে তার ভয় ও সাহস একসাথে দেখছে। ধীরে ধীরে সে নিজের ভয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করে, তবে হৃদয় এখনো দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে। হঠাৎ, নারী মৃদু হাসি দিয়ে বলে, “ভয় পেও না, আমি তোমার সাধনার সঙ্গিনী।” এই শব্দগুলি তার কানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই সায়নের ভয় কিছুটা কমতে থাকে, কিন্তু কৌতূহল আরও বাড়ে। সে অনুভব করে, নারীর উপস্থিতি শুধু শরীরিক নয়; এটি এক অদৃশ্য শক্তির প্রতিফলন, যা তার সাধনার প্রতি দৃষ্টি ও মনোযোগকে আরও তীব্র করছে। ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে নারীর নরম পদক্ষেপের শব্দ শোনা যায়, যা যেন শ্মশানের অন্ধকারে নতুন জীবন ঢোকাচ্ছে।
সায়ন ধীরে ধীরে সচেতন হয় যে, এই প্রথম দর্শন শুধু একটি মিলন নয়, বরং তার সাধনার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। নারীর উপস্থিতি তার ভয়কে পরীক্ষা করছে, একই সঙ্গে তার মনকে এক নতুন দিক দেখাচ্ছে। ধূপের ঘ্রাণ, আগুনের ক্ষীণ আলো, কাকের দূরের ডাক—সবই মিলেমিশে একটি মায়াময় আবহ তৈরি করছে। সায়ন অনুভব করে, নারী কেবল তার সঙ্গে শারীরিকভাবে নয়, মানসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে যুক্ত। তার চোখের দীপ্তি তার মনে এক অদ্ভুত জিজ্ঞাসা জাগায়—এই নারী কি প্রকৃত, নাকি এক অদৃশ্য শক্তির অবতার? কিন্তু তার মৃদু হাসি এবং কোমল ধ্বনি তাকে আশ্বস্ত করে। সায়ন ধীরে ধীরে স্থির হয়ে, নিজের নিঃশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে, মনে মনে প্রস্তুত হয়, কারণ সে বুঝতে পারছে, এই প্রথম দর্শন তার সাধনার পথে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। রাতের অন্ধকার, ধূপের ঘন কুয়াশা এবং অদ্ভুত শব্দের মধ্যে, সে এবং তার নতুন সঙ্গিনী এক অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায়, যা তাকে ভয়ের সীমা পেরিয়ে এক রহস্যময় সাধনার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
***
সায়ন দিন দিন নারীর উপস্থিতিতে আরও বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে শুরু করে, কিন্তু একই সঙ্গে তার মনে ক্রমেই দ্বিধা জন্ম নিচ্ছে। নারী কখনো মাতৃসুলভ স্নেহ দেখায়, যেমন কোনো সন্তানের প্রতি মায়া দেখায়, আবার কখনো হঠাৎ এক অদ্ভুত রহস্যময় ভঙ্গিতে সে উপস্থিত হয়। তার চোখে দীপ্তি থাকে, যা একদিকে শান্তি ও আশ্বাস দেয়, অন্যদিকে একটি অজানা ভয় ও প্রশ্ন জাগায়। সে সায়নের হাতে শক্তির মন্ত্র শেখাতে চাইছে, আর ধাপে ধাপে তাকে তার নিজস্ব শক্তি আবিষ্কার করার পথে পরিচালিত করছে। প্রতিটি মন্ত্রের উচ্চারণে, প্রতিটি ধ্যানের সময়, সায়ন অনুভব করছে এক অদৃশ্য শক্তির প্রবাহ, যা তাকে শক্তিশালী করছে। কিন্তু হঠাৎ, নারী এমন কিছু কথা বলে, যা তার মনে সংশয় ও অস্থিরতা জন্ম দেয়। কখনো সে বলে, “সবই তোমার নিজের মধ্যে আছে,” আবার হঠাৎ অন্য সময় বলে, “তুমি ভুল পথে যাচ্ছো, সতর্ক থাকো।” এই দ্বন্দ্বপূর্ণ আচরণ সায়নের মনকে বিভ্রান্ত করছে—তার প্রশ্ন জাগে, এই নারী কি সত্যিই দেবী, নাকি এক রহস্যময় ছায়া, যা তার ভয় এবং আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন?
সায়ন প্রতিটি কথায় এবং ভঙ্গিতে মনোযোগী হয়, তার মানসিক শক্তি ও ধৈর্য পরীক্ষা করা হচ্ছে। নারীর আচরণে যে অনিশ্চয়তা, তা যেন তার নিজের আত্মার ভেতরের দ্বন্দ্বকে প্রতিফলিত করছে। সে অনুভব করে, মায়াময়ী হাসি বা হঠাৎ কঠোর দৃষ্টিতে নারীর উপস্থিতি তার মনকে প্রভাবিত করছে, যেন সে তার ভয়, আশা, আকাঙ্ক্ষা সবকিছু একসাথে যাচাই করছে। ধূপের ঘ্রাণ, আগুনের নরম আলো এবং শ্মশানের অন্ধকার—সব মিলেমিশে এমন একটি আবহ তৈরি করছে, যা তার অনুভূতি এবং চিন্তাকে আরও জটিল করে তুলছে। নারীর সঙ্গিনীর মতো উপস্থিতি তাকে শক্তি দিচ্ছে, আবার একই সঙ্গে তার মনকে এক গভীর সন্দেহে ফেলে দিচ্ছে। সায়ন প্রতিটি মন্ত্র ও ধ্যানের সময় নিজের অভ্যন্তরীণ শক্তি অনুভব করছে, কিন্তু প্রশ্ন জাগছে—এ শক্তি কি সত্যিই নারীর কারণে হচ্ছে, নাকি তার নিজের আত্মার আবিষ্কার?
দিনের পর দিন, সায়ন তার নিজের মধ্যে একটি অদ্ভুত দ্বন্দ্ব অনুভব করছে। নারীর উপস্থিতি একদিকে তাকে নিরাপত্তা ও আধ্যাত্মিক দিশা দিচ্ছে, অন্যদিকে তার মনের ভেতর একটি প্রশ্ন রেখে যাচ্ছে—দেবী নাকি ছায়া? সে নারীকে লক্ষ্য করে, প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি, প্রতিটি হাসি, প্রতিটি শব্দ তার মনকে পরীক্ষা করছে। কখনো মনে হয়, নারী যেন তার অন্তর্দৃষ্টি খুলে দেখাচ্ছে, আবার কখনো মনে হয়, সে শুধুই তার ভয় ও কল্পনার প্রতিচ্ছবি। এই দ্বন্দ্ব সায়নের সাধনার পথকে আরও গভীর ও জটিল করে তুলছে। হঠাৎ রাতে, শ্মশানের অন্ধকারের মধ্যে বসে সে বুঝতে পারে, তার যাত্রা শুধুমাত্র শক্তি অর্জনের নয়—এটি তার নিজের আত্মার গভীর অন্বেষণ। নারীর এই রহস্যময় উপস্থিতি, তার দ্বন্দ্বপূর্ণ আচরণ এবং মন্ত্র শেখানোর প্রক্রিয়া—সব মিলেমিশে সায়নকে এমন এক অবস্থায় নিয়ে এসেছে, যেখানে সে শুধু শারীরিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন করছে না, বরং নিজের ভয়, আকাঙ্ক্ষা, এবং আত্মার অন্ধকারও পর্যবেক্ষণ করছে। রাতের অন্ধকার, ধূপের ঘন কুয়াশা, এবং অদৃশ্য শক্তির উপস্থিতি—সব মিলিয়ে সায়ন এই দ্বন্দ্বপূর্ণ রহস্যময়ী নারীর সত্য খুঁজতে তার সাধনার পথে আরও গভীরভাবে প্রবেশ করছে।
***
শ্মশানের গভীর অন্ধকারে সায়ন যখন ধ্যান ও মন্ত্রপাঠে মগ্ন, হঠাৎ চারপাশে অদৃশ্য উপস্থিতির আভাস পায়। আগুনের ক্ষীণ আলো কেবল অল্প অল্প ছায়া সৃষ্টি করছে, আর ধূপের ধোঁয়া তার দৃষ্টিকে ঝাপসা করছে। হঠাৎ, তার চারপাশে অদৃশ্য আত্মাদের উপস্থিতি অনুভূত হয়। বাতাসে হালকা ফিসফিসানি শব্দ ছড়িয়ে পড়ে, যেন অজানা কণ্ঠগুলি তার কানে অশুভ বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে—“তুমি ব্যর্থ হবে… তুমি মরবে।” সায়নের হৃদয় দ্রুত স্পন্দিত হয়, মনে ভয় জাগে। সেই মুহূর্তে নারী, যে তার জন্য রাহু-সত্যের মতো সঙ্গিনী, হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায়। সায়ন নিজেকে একা পায়, শ্মশানের অন্ধকারে, যেখানে প্রতিটি ছায়া যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তার শরীর কাঁপছে, মন আতঙ্কে ভরে উঠছে, কিন্তু একপাশে সাহসের জোয়ারও ধীরে ধীরে উঠছে। সে উপলব্ধি করে, এটি তার সত্যিকারের পরীক্ষা—না শুধু শক্তির, বরং তার সাহস এবং স্থিতিশীল মনোর পরীক্ষাও।
অদৃশ্য আত্মাদের কণ্ঠস্বর ক্রমেই তীব্র হয়ে ওঠে, কখনো কাঁপানো ফিসফিসানি, কখনো দূরের কঙ্কালের মতো হাহাকার। সায়ন অনুভব করে, এই শব্দগুলো শুধুই বাহ্যিক নয়; এটি তার অন্তরের ভয় ও অনিশ্চয়তার প্রতিফলন। প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি নিশ্বাসে তার ভয় বাড়ছে, কিন্তু একই সঙ্গে সাহসও জাগছে। সে মনে মনে মনোয়ন করছে গুরুজীর শিক্ষা—“ভয়কে জয় করো।” সেই এক কথাই তার মনে বারবার বাজছে, ভয়কে সামলানোর জন্য শক্তি দিচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যে সে নিজের চারপাশের ছায়াগুলোকে দেখছে, প্রতিটি অদৃশ্য আকার যেন তার ভয়কে পরীক্ষা করছে। প্রতিটি ফিসফিসানি শব্দ তাকে বারবার থামাতে চায়, কিন্তু তার মন ধীরে ধীরে স্থির হয়। সে বুঝতে পারে, আত্মাদের ডাক শুধুই ভয় সৃষ্টি করছে, কিন্তু নিজের অভ্যন্তরীণ শক্তি চিনতে পারলে এই ভয়কে জয় করা সম্ভব।
হঠাৎ, শ্মশানের স্থিরতায় একটি অদ্ভুত আবহ জন্মায়। বাতাস থেমে যায়, আগুনের ক্ষীণ আলো অন্ধকারকে অল্প একটু আলোকিত করছে। সায়ন ধীরে ধীরে শ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে, মনকে কেন্দ্রীভূত করে, এবং নিজের ভয়কে অভ্যন্তরীণ শক্তিতে রূপান্তর করতে শুরু করে। সে অনুভব করে, আত্মাদের কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যাচ্ছে, আর অন্ধকার তার সঙ্গে যুদ্ধ করছে না, বরং তার শক্তি স্বীকার করছে। তার মন স্থির, চোখে দৃঢ়তা, হৃদয়ে সাহস। শ্মশানের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সে অনুভব করে, এই একাকীত্বই তাকে শিখিয়েছে—ভয় ছাড়াই শক্তির খোঁজ, নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করা, এবং আত্মার গভীরে প্রবেশ করা। হঠাৎ অদৃশ্য নারীর উপস্থিতির স্মৃতি তার মনে জাগে, কিন্তু সে এখন ভয়ের কাছে নিপীড়িত নয়। অন্ধকারের মধ্যেই সে বুঝতে পারে, আত্মাদের ডাক ছিল শুধুই পরীক্ষা, এবং সে নিজেই তার ভয়কে জয় করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী। শ্মশানের একাকীত্ব, আত্মাদের ফিসফিসানি, আগুনের ক্ষীণ আলো— সবাই মিলেমিশে সায়নকে এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে গেছে, যেখানে সে ভয়কে জয় করেছে এবং সত্যিকার সাহসিকতার স্বাদ পেয়েছে।
***
শ্মশানের অন্ধকার ও ধোঁয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে সায়ন হঠাৎ অতীতের স্মৃতির আবির্ভাব অনুভব করে। সে নিজের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ মনে করতে শুরু করে, বিশেষ করে গুরুজীর কথা। গুরুজীর মৃদু, কিন্তু গভীর কণ্ঠ আজও তার কানে বাজছে—“তুমি যদি মৃত্যু-ছায়ার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারো, তবে দেবীর আসল রূপ পাবেই।” এই কথা তার মনে গভীর প্রভাব ফেলে। মৃত্যুর ছায়া, যা তার ভয়ের প্রতীক, এবার কেবল এক ভয়ঙ্কর অস্তিত্ব নয়; বরং এক পরীক্ষা, এক পাঠ, যা তাকে শক্তিশালী করবে। সায়ন বুঝতে পারে, ভয় ও মৃত্যুর ছায়া আসলে তার ধ্যান ও সাধনার পথে এক বাধা, যা তাকে তার অন্তর্নিহিত শক্তি অন্বেষণের জন্য প্রস্তুত করছে। ধোঁয়া ও অন্ধকারের মধ্যে সে ধীরে ধীরে নিজের নিঃশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে, মনে মনে গুরুজীর শিক্ষাকে পুনরায় মৃদু উচ্চারণ করে, যেন প্রতিটি শব্দ তাকে ধ্যানের আসনে স্থির থাকতে সাহায্য করছে। সে উপলব্ধি করে, শ্মশানের অন্ধকার শুধুই বাহ্যিক নয়—এটি তার মনের গভীর অন্ধকারকে প্রতিফলিত করছে, যা জয় করতে পারলেই সত্যিকারের আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন সম্ভব।
স্মৃতির শক্তি তার মনকে আবার উদ্দীপ্ত করতে থাকে। সায়ন ধ্যানের আসনে বসে, চোখ বন্ধ করে, শুধু নিজের নিঃশ্বাস ও হৃদয়ের স্পন্দনে মনোনিবেশ করে। সে মনে মনে অনুভব করছে, গুরুজীর কথার মর্মার্থ কেবল পরীক্ষা নয়, বরং পথপ্রদর্শন। মৃত্যু-ছায়ার মুখোমুখি হওয়া মানে শুধু বাহ্যিক আতঙ্কের মোকাবিলা নয়, বরং নিজের ভয়, অনিশ্চয়তা এবং দুশ্চিন্তাকে পরাস্ত করা। প্রতিটি ফিসফিসানি শব্দ, প্রতিটি অন্ধকার ছায়া এখন তাকে ভয় দেখাচ্ছে না; বরং তা তার ধ্যান ও একাগ্রতার জন্য এক ধরনের কসরত। সে বুঝতে পারে, যে শক্তি দেবীর আসল রূপকে প্রকাশ করবে, তা তার নিজের ভেতরেই লুকিয়ে আছে—সাধনা, সাহস, এবং ধৈর্যের মাধ্যমে তা উদ্ভূত হবে। এই উপলব্ধি তাকে শ্মশানের অন্ধকারের মধ্যেও স্থির রাখে, এবং সে ধীরে ধীরে নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছাড়ে না, বরং গভীর মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি অশুভ ছায়া ও শব্দকে অতিক্রম করে।
গুরুজীর স্মরণে সায়নের অভ্যন্তরীণ শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। ধোঁয়ার ঘনত্ব ও শ্মশানের অন্ধকারে সে এক নতুন স্পন্দন অনুভব করে—প্রতিটি হৃদস্পন্দন যেন এক নতুন জ্ঞান ও শক্তি প্রদান করছে। মৃত্যুর ছায়ার ভয়, যা আগে তাকে স্থির করতে পারত না, এখন তার ধ্যান ও সাধনার সহচর হয়ে ওঠে। সে জানে, এই ভয়ই তাকে সতর্ক করছে, শক্তি জাগিয়ে দিচ্ছে, এবং দেবীর আসল রূপ দেখার পথে প্রস্তুত করছে। ধীরে ধীরে সে নিজের শরীর ও মনকে স্থির করে, গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে ধ্যানের আসনে সম্পূর্ণ মনোযোগ নিবদ্ধ করে। গুরুজীর স্মৃতির প্রভাব তাকে সাহস, ধৈর্য, এবং শক্তি প্রদান করে, যা তাকে শ্মশানের অন্ধকার ও অদৃশ্য শক্তির মধ্যে একাগ্র থাকতে সাহায্য করে। এই অধ্যায়ে, সায়নের মনে শক্তি ও আত্মবিশ্বাসের পুনরুদ্ধার ঘটে, যা পরবর্তী দিনে —আত্মাদের ডাক, মৃত্যুর ছায়া, এবং দেবীর আসল রূপের সন্ধানে তাকে আরও দৃঢ় ও প্রস্তুত করে।
***
রাত্রি হঠাৎ গভীর অন্ধকারে ডুবে যায়, এবং আকাশের মেঘ কেটে যায় না যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি আকাশকে নিজের বন্দি করে রেখেছে। বজ্রপাত শুরুর সাথে সাথে শ্মশানের পরিবেশ ক্রমেই অজানা আতঙ্কে পরিপূর্ণ হয়। গর্জন করা বজ্রবিদ্যুৎ অন্ধকারে হঠাৎ আলোর ঝলক দিচ্ছে, প্রতিটি আলো যেমন অল্প সময়ের জন্য সবকিছু উন্মোচন করছে, তেমনি নতুন ভয়ও সৃষ্টি করছে। হঠাৎ শ্মশানে নতুন মৃতদেহ আনা হয়, যা আগুনে দাহের প্রস্তুতিতে রাখা হয়েছে। দাহের আগুন উঁচু শিখায় নাচতে থাকে, প্রতিটি শিখা যেন শ্মশানের ভেতরের অদৃশ্য শক্তিকে আলো করছে। বাতাসে ধোঁয়া, আগুনের গরম, এবং রক্তের গন্ধ এক অদ্ভুত আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। সায়ন তার আসনে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে, চোখে বিস্ময় এবং হৃদয়ে ভয়—সে বুঝতে পারছে, শ্মশান এবার শুধুই সাধনার স্থান নয়, বরং মৃত্যুর রঙ্গমঞ্চে রূপান্তরিত হয়েছে।
অগ্নিস্পর্শে ঝলমল করা চিতার মাঝখানে হঠাৎ সেই রহস্যময়ী নারী পুনরায় আবির্ভূত হয়। এবার তার উপস্থিতি এক নতুন আতঙ্ক সৃষ্টি করছে—সাদা শাড়ি আগের মতো কোমল নয়, বরং দাহের আলোয় লালচে প্রতিফলিত হচ্ছে। তার চোখ এক হঠাৎ লাল দীপ্তিতে জ্বলছে, যা অন্ধকারের মধ্যে যেমন হঠাৎ ঝলক দেয়, তেমনি সায়নের মনকে স্থির রাখতে পারছে না। মুখে অদ্ভুত হাসি, যা হেসে না, বরং ভয়ঙ্কর এক আগ্রাসন প্রকাশ করছে। ধোঁয়া, আগুন, বজ্রপাত—সবই যেন তার উপস্থিতিকে আরও রহস্যময় করে তুলছে। সায়ন একদিকে নারীর আগের কোমলতা মনে করছে, আবার এই মুহূর্তে তার ভয়ঙ্কর রূপে আতঙ্কিত হচ্ছে। সে অনুভব করছে, এই নারী কেবল তার সঙ্গিনী নয়—এবার সে তার পরীক্ষার অংশ, যা তার ধ্যান, সাহস এবং আত্মা সবকিছু একসঙ্গে পরীক্ষা করছে।
দাউদাউ জ্বলতে থাকা চিতার আলো ও অন্ধকারের মিশ্রণে সায়নের মন এবং শরীর কেঁপে ওঠে। বজ্রপাতের প্রতিটি আঘাত যেন তার হৃদয়কে ছেদ করছে, আর প্রতিটি শ্মশানের শব্দ তার ভয়কে তীব্র করছে। নারীর লালচে চোখ এবং অদ্ভুত হাসি তাকে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়—ভয় আর কৌতূহল, প্রীতি আর আতঙ্ক একসঙ্গে। সে মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করে, চোখ বন্ধ করে গভীর নিঃশ্বাস নেয়, তবে নারীর উপস্থিতি তার মনকে শিথিল করতে দেয় না। এই রক্তময় রাত, বজ্রপাত, আগুনের দাহ, এবং অদ্ভুত নারীর রূপ—সবই মিলেমিশে তাকে এক নতুন ধাপের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সায়ন উপলব্ধি করে, সত্যিকারের শক্তি ও সাহস এখন পরীক্ষা হতে চলেছে; এই রাত তার ভয়, সাহস, এবং আধ্যাত্মিক ক্ষমতার সর্বোচ্চ সীমা যাচাই করছে। সে স্থির হয়ে দাঁড়ায়, চোখে দৃঢ়তা, হৃদয়ে অদম্য সাহস নিয়ে—কারণ এই রক্তময় রাতই তাকে দেবীর আসল রূপের পথে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
***
শ্মশানের অন্ধকারে আগুনের নরম আলোর নাচের মধ্য দিয়ে নারীর উপস্থিতি ক্রমেই স্বচ্ছ ও প্রকট হয়ে ওঠে। সে ধীরে ধীরে নিজের মুখোশ সরায়, এবং তার আসল রূপ—মৃত্যু-ছায়া, কিন্তু দেবীর এক প্রতিরূপ—সায়নের চোখের সামনে উন্মোচিত হয়। তার দেহের গতি, চোখের দীপ্তি, এমনকি শাড়ির নরম ছায়া পর্যন্ত ভয় ও রহস্যের মিশ্রণ প্রকাশ করছে। আগুনের আলো তার রূপকে এমনভাবে আলোকিত করছে যে, প্রতি মুহূর্তে তার ভয়ঙ্কর এবং ঈশ্বরীয় দিক একসাথে দৃশ্যমান হচ্ছে। সে ধীরে ধীরে সায়নের দিকে এগোচ্ছে, প্রতিটি পদক্ষেপ যেন তার শক্তি ও ক্ষমতার প্রতীক। তার কণ্ঠে এক গভীর ধ্বনি বাজে, যা আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতিফলন: “যে আমাকে ভয় পাবে, সে বিনাশ হবে। যে আমাকে আপন করে নেবে, সে শক্তি পাবে।” সায়নের হৃদয় দ্রুত স্পন্দিত হয়, মনে ভয় ও উত্তেজনার সমন্বয় ঘটতে থাকে। এই মুহূর্তে সে বুঝতে পারে, মৃত্যুর ছায়া ও দেবীর এই একরূপী উপস্থিতি তার জীবনের সব পরীক্ষার চূড়ান্ত অংশ।
সায়নের মন, ভয়, এবং সাহস একসাথে দ্বন্দ্ব করছে। তার চোখ নারীর চোখের সাথে মিলেছে, এবং সে দেখতে পাচ্ছে, নারী শুধুই ভয় সৃষ্টি করছে না—সে তার অন্তর্নিহিত শক্তি পরীক্ষা করছে। ধোঁয়া, আগুন, বজ্রপাত—সবই মিলেমিশে একটি রহস্যময় আবহ তৈরি করছে, যা সায়নের ধ্যান ও সাহসকে চূড়ান্তভাবে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করছে। তার মনে প্রশ্ন জাগে—কীভাবে ভয়কে জয় করা যায়, এবং কীভাবে মৃত্যুর ছায়াকে নিজের শক্তি হিসেবে গ্রহণ করা যায়। সায়ন বুঝতে পারে, নারীর বার্তা শুধুই আভ্যন্তরীণ নয়; এটি তার বাস্তবিক পরীক্ষাও। যে মুহূর্তে সে ভয়কে স্বীকার করবে, সেই মুহূর্তেই তার শক্তি প্রসারিত হবে। সে ধীরে ধীরে নিজের নিঃশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে, মনে মনে গুরুজীর কথা স্মরণ করে—“ভয়কে জয় করো, তাহলেই দেবীর আসল রূপ দেখবে।” নারীর উপস্থিতি তার সামনে ক্রমেই দৃঢ় হয়ে ওঠে, যেন প্রতিটি মুহূর্তে সে সায়নের অন্তর্দৃষ্টি ও মনোবলকে যাচাই করছে।
চূড়ান্ত মুহূর্ত এসে পৌঁছায়, যখন সায়ন পুরোপুরি নারীর উপস্থিতির সামনে দাঁড়ায়। তার ভয়, দ্বিধা, এবং সন্দেহ—সবই এক সাথে স্থির হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে, এই সিদ্ধান্তই তার সাধনার, সাহসের, এবং আধ্যাত্মিক যাত্রার চূড়ান্ত পরীক্ষা। তার চোখে দৃঢ়তা, হৃদয়ে অদম্য সাহস; সে ভয়কে সরাসরি গ্রহণ করে, নারীকে নিজের অন্তরে গ্রহণ করে। মৃত্যু-ছায়ার রূপ যতই ভয়ঙ্কর হোক, সায়ন তার ভয়ের সীমা পেরিয়ে যায়, এবং সেই মুহূর্তেই তার নিজের শক্তি উদ্ভূত হয়। আগুনের লালশিখা, ধোঁয়ার ঘন কুয়াশা, শ্মশানের অন্ধকার—সবই মিলেমিশে একটি নতুন আধ্যাত্মিক শক্তির জন্ম দেয়। সায়ন উপলব্ধি করে, সত্যের উন্মোচন শুধু নারী বা মৃত্যুর ছায়ার পরিচয় নয়, বরং নিজের অন্তর্দৃষ্টি, সাহস, এবং শক্তির পরিপূর্ণ স্বীকৃতি। এই অধ্যায়ের শেষে, শ্মশানের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সে নতুন রূপে শক্তিশালী হয়, এবং দেবীর আসল রূপের রহস্য তার অন্তরে প্রবেশ করে।
***
শ্মশানের অন্ধকার ও আগুনের নরম আলোয়ের মধ্যেই সায়ন স্থির হয়ে বসে, চোখ বন্ধ করে। ধোঁয়া, বজ্রপাতের শব্দ, এবং অদৃশ্য আত্মাদের ফিসফিসানি—সবকিছু তার মনকে পরীক্ষা করছে। সে নিজের নিঃশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে, ধীরে ধীরে হৃদয়কে শান্ত রাখে, এবং গুরুজীর শিক্ষা মনে করে—“ভয়কে জয় করো।” সায়ন গভীর মনোনিবেশের সঙ্গে মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করে। প্রতিটি শব্দ যেন তার অন্তরের শক্তিকে জাগিয়ে তোলে। প্রথমে শব্দগুলো ভয় ও সন্দেহের মতো রুখে দাঁড়ায়, কিন্তু ধীরে ধীরে সায়নের একাগ্রতা ও স্থির মন ভয়কে প্রভাবিত করতে শুরু করে। অন্ধকারের প্রতিটি ছায়া, আগুনের প্রতিটি শিখা, এবং বাতাসের প্রতিটি ফিসফিসানি—সবই তার নিঃশ্বাস ও মন্ত্রের সঙ্গে মিলেমিশে অদৃশ্য শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে আনে। সে অনুভব করে, ভয় আর নেই; প্রতিটি ভয়ের প্রতিফলন ধীরে ধীরে নিঃশেষ হচ্ছে।
মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে, নারীর উপস্থিতিও পরিবর্তিত হয়। আগের ভীতিকর রূপ, লালচে চোখ ও অদ্ভুত হাসি—সব মিলেমিশে নরম এবং শান্ত দীপ্তিতে রূপান্তরিত হয়। আগুনের আলোতে তার সাদা শাড়ির কোমল ছায়া যেন মায়াময় আভা ছড়াচ্ছে, যা শ্মশানের অন্ধকারকে উজ্জ্বল করে তুলছে। সায়ন চোখ খুলে বিস্ময় ও আনন্দের সঙ্গে দেখে, যে নারী আর ভীতিকর নয়, বরং এক শান্ত, শক্তিশালী এবং আধ্যাত্মিক দীপ্তি ছড়াচ্ছেন। তার উপস্থিতি এখন কেবল আশ্বাস, প্রেম এবং শক্তির প্রতীক। ধোঁয়া আর অদৃশ্য শক্তির আওয়াজ এখন কোনো হুমকি নয়; এটি কেবল আধ্যাত্মিক শক্তির সঙ্গীত, যা সায়নের চারপাশে প্রশান্তি তৈরি করছে। এই মুহূর্তে, সায়ন উপলব্ধি করে, তার ভয়কে জয় করা মানে কেবল আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন নয়—এটি তার অন্তরের স্থিরতা, সাহস, এবং বিশ্বাসের চূড়ান্ত প্রকাশ।
শেষ মুহূর্তে, নারী ধীরে ধীরে সায়নের কপালে হাত রাখেন এবং মৃদু হাসি দিয়ে আশীর্বাদ দেন। সেই স্পর্শে সায়নের হৃদয় পূর্ণ শক্তি, শান্তি এবং আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধি অনুভব করে। আগুনের নরম আলো, ধোঁয়ার ঘন কুয়াশা, এবং শ্মশানের অন্ধকার—সব মিলেমিশে এই মুহূর্তকে এক পবিত্র, মায়াময়, এবং শক্তিশালী আভা প্রদান করছে। সায়ন অনুভব করে, যে শক্তি তিনি আজ অর্জন করেছেন তা কেবল বাহ্যিক নয়, বরং তার নিজস্ব মন, আত্মা, এবং সাহসের অন্তর্দৃষ্টি থেকে উদ্ভূত। নারীর উপস্থিতি, তার আশীর্বাদ, এবং নিজের জয়—সব মিলেমিশে তাকে নতুন এক পর্যায়ের আধ্যাত্মিক শক্তি দেয়। শ্মশানের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সায়ন বুঝতে পারে, ভয়কে জয় করলেই সত্যিকারের শক্তি অর্জন করা সম্ভব, এবং সেই শক্তি তাকে দেবীর আসল রূপের সঙ্গে সংযুক্ত করে।
***
শ্মশানের অন্ধকার রাত ক্রমেই হালকা হয়ে আসে, পূর্ব আকাশে সূর্যের প্রথম কিরণ উঁকি দিতে শুরু করে। আগুনের ক্ষীণ আলো, ধোঁয়া, এবং অদৃশ্য আত্মাদের ফিসফিসানি—সব মিলেমিশে ধীরে ধীরে নীরব হয়ে আসে। ধীরে ধীরে শ্মশান যেন এক নতুন আভা লাভ করে, যেখানে অন্ধকারের ভয় আর রহস্য নেই, বরং শান্তি ও আধ্যাত্মিক উজ্জ্বলতা বিরাজ করছে। সায়ন দাঁড়িয়ে সূর্যোদয়ের দিকে তাকায়, চোখে দৃঢ়তা, হৃদয়ে প্রশান্তি, এবং মনে গভীর উপলব্ধি। তার জীবনের সমস্ত ভয়, সন্দেহ, এবং দ্বিধা—সবই ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে গেছে। শ্মশানের অন্ধকারের মধ্য দিয়ে যা শুরু হয়েছিল, সেই ভয়ঙ্কর রাত এবং মৃত্যুর ছায়া এখন একটি শিক্ষণীয় স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে। সে উপলব্ধি করে, সত্যিকারের শক্তি ও সাহস শুধু ভয়কে জয় করার মধ্যেই নিহিত নয়, বরং জীবনের সমস্ত দিক—ভয়, শক্তি, আনন্দ এবং দুঃখ—কে গ্রহণের মধ্যেও নিহিত। সূর্যের আলো ধীরে ধীরে শ্মশানের প্রতিটি কোণ উজ্জ্বল করছে, আর সায়নের মনে এক অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করছে, যেন প্রতিটি ছায়া এখন তার সঙ্গে মিলিত হয়ে এক অমোঘ সঙ্গী হয়ে গেছে।
ধীরে ধীরে সায়ন অনুভব করে, দেবী ও মৃত্যুর ছায়া—দুইয়েরই উপস্থিতি একই রূপে তার জীবনকে নির্দেশ করছে। অতীতের সমস্ত পরীক্ষার স্মৃতি তার মনে ভেসে ওঠে—ভয়, দ্বন্দ্ব, এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের মুহূর্ত। নারীর উপস্থিতি, তার শান্ত দীপ্তি, এবং কপালে আশীর্বাদ—সবই তাকে শিখিয়েছে, যে ভয়কে জয় করা মানে শুধু শক্তি অর্জন নয়; বরং এটি আত্মার গভীর উপলব্ধি। শ্মশানের অন্ধকার, আগুনের দাহ, বজ্রপাত—সবই মিলেমিশে তাকে দেখিয়েছে, যে যাত্রা কখনো একক নয়। মৃত্যু-ছায়া এবং দেবী একই রূপে তার পথপ্রদর্শক, এবং তাকে শিখিয়েছে, যে সঙ্গিনী শুধু শারীরিক উপস্থিতি নয়; বরং শক্তি, সাহস, এবং অন্তর্দৃষ্টির এক অদৃশ্য সঙ্গীও হতে পারে। সে বুঝতে পারে, এই সঙ্গিনী তার নিজের ভেতরের আত্মা, যা প্রতিটি ভয়কে জয় করে শক্তি এবং শান্তি অর্জনে সহায়তা করেছে।
সূর্যোদয়ের আলোতে, শ্মশান এক নতুন জীবনকে আলোকিত করছে। ধোঁয়া ম্লান হয়ে গেছে, আগুনের শিখা নরম আলোতে হ্রাস পেয়েছে, এবং বাতাসে এক শান্তি বিরাজ করছে। সায়ন বুঝতে পারে, এই শ্মশানেই তিনি তার প্রকৃত সঙ্গিনী খুঁজে পেয়েছেন—মৃত্যু-ছায়া, দেবী, ভয় এবং শক্তি—সব মিলেমিশে তার আধ্যাত্মিক সঙ্গিনী হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এখন সে জানে, যে পথ চলা শুরু হয়েছে, তা আর একাকী নয়; প্রতিটি ধাপেই তার সঙ্গে রয়েছে সেই শক্তি ও আধ্যাত্মিক উপস্থিতি। সূর্যোদয়ের সাথে মিলেমিশে তার হৃদয় ও আত্মা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, এবং শ্মশানের নীরবতা এক মায়াময় শান্তিতে ভরে যায়। এই অধ্যায়ের শেষে, সায়ন স্থির, দৃঢ়, এবং প্রস্তুত—কারণ সে শিখেছে, সত্যিকারের শক্তি, সাহস, এবং সঙ্গিনী সবকিছুই তার অন্তরে নিহিত, এবং শ্মশানের রহস্যময় পরিবেশ তাকে সেই শক্তির সাথে সংযুক্ত করেছে।
****




