Bangla - প্রেমের গল্প

চাঁদের আলোয় প্রতিশ্রুতি

Spread the love

চৈতালী বৰ্মন


চাঁদের আলোয় ডুবে থাকা সেই গ্রামটির চারপাশে এক অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছিল। দিনের কোলাহল ফুরিয়ে গেলে গ্রামের আকাশ যেন হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে যায়, কেবল দূরের পুকুরের ব্যাঙের ডাক আর মাঝেমধ্যে শেয়ালের হাঁক সেই নীরবতাকে খানিকটা ভেঙে দেয়। অরিন্দমের জীবনের প্রতিটি দিন কাটত একই ছন্দে—ভোরের আলোয় খেতের কাজে বেরিয়ে যাওয়া, দুপুরের রোদে ঘেমে-নেয়ে খড়ের গাদায় বসে বিশ্রাম নেওয়া আর সন্ধ্যার দিকে ফেরার পথে মাঠের আল দিয়ে একবার চোখ ফেরানো। সে জানত, সেই দিকেই হয়তো দেখা মিলবে মিতালীর। কৃষকের ছেলে হয়েও তার ভেতরে এক গভীর কোমলতা ছিল, যা মাটির গন্ধে জন্মেছিল, অথচ গ্রামের চোখে সে ছিল এক সাধারণ শ্রমিক, যার স্বপ্ন দেখা প্রায় নিষিদ্ধ। এদিকে মিতালী ছিল গ্রামের ধনী জমিদার পরিবারের মেয়ে—যার প্রতিটি পদক্ষেপ নজরে রাখা হতো, যার হাসি–কান্নাও পরিবারের সম্মানের সঙ্গে বাঁধা ছিল। সন্ধ্যা নামলেই সে বারান্দার কার্নিশ ধরে দাঁড়িয়ে থাকত, আর দূরে মাঠের ভেতর ঝুঁকে কাজ করতে থাকা অরিন্দমের ছায়া দেখত। সেই মুহূর্তগুলোয় তাদের চোখ হঠাৎ মিলত, দুজনেই যেন কাঁপা কণ্ঠে এক অদৃশ্য স্বীকারোক্তি করত—তাদের ভালোবাসা শুরু হয়ে গেছে, অথচ এই গ্রামে সেই ভালোবাসা কখনো জায়গা পাবে না।

অরিন্দমের দিন যত কঠিন হতো, ততই মিতালীর উপস্থিতি তার কাছে স্বস্তির মতো লাগত। খেতে চাষ করতে করতে সে বারবার উপরের দিকে তাকাত, যদি কখনো দূর থেকে মিতালীর মুখটি দেখা যায়। আর মিতালীও, পরিবারের শাসন আর সমাজের বাঁধনের ভেতরে থেকেও তার দৃষ্টি ফেরাত অরিন্দমের দিকে। সমাজের চোখরাঙানি ছিল তাদের চারপাশে সর্বদা—মিতালীর বান্ধবীরা যখন ফিসফিস করে বলত, “ও কৃষক ছেলেটার দিকে তাকিয়ো না”, বা গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা যখন তাচ্ছিল্যের সুরে বলত, “ধনী ঘরের মেয়ে চাষার সঙ্গে মেশে!”—তখনও তাদের চোখাচোখির মুহূর্তে অন্য সব কণ্ঠ নিঃশেষ হয়ে যেত। কিন্তু এই গোপন সান্নিধ্যের মাঝেও এক ভয় কাজ করত—যদি কেউ দেখে ফেলে? যদি কোনোদিন তাদের সম্পর্ক প্রকাশ হয়ে যায়? অরিন্দম মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, সে কখনো মিতালীকে কষ্ট দেবে না, যদিও সে জানত এই সমাজের কাছে তাদের প্রেম হবে অপরাধ। কিন্তু ভালোবাসা কি সমাজের নিয়মে বাঁধা যায়? অরিন্দম জানত, তার হৃদয় ইতিমধ্যেই বন্দি হয়ে গেছে মিতালীর চোখে।

সেই রাতে আকাশ ছিল অসাধারণ পরিষ্কার। তারার ঝিকিমিকি, চাঁদের উজ্জ্বল আলো, আর গ্রামের নির্জনতা যেন এক অপার্থিব আবহ তৈরি করেছিল। খড়ের গাদার ওপর বসে অরিন্দম ভাবছিল, কতটা অদ্ভুত এই টান! যেখানে কথা নেই, স্পর্শ নেই, শুধু এক দূরত্ব থেকে নজরবন্দি হওয়া—তবু হৃদয় যেন ভরে উঠছে। মিতালীও বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে তাকিয়ে ছিল মাঠের দিকে, যেখানে তার প্রিয় মানুষ ক্লান্ত শরীর নিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। দুজনের মাঝখানে দূরত্ব যতটা, হৃদয়ের কাছাকাছি তারা ততটাই। সমাজের চোখে হয়তো তারা অপরাধী, কিন্তু সেই আকাশ, সেই চাঁদ, সেই নীরব গ্রামের বাতাস ছিল তাদের সাক্ষী। সেই নিস্তব্ধতার মাঝেই যেন ভেসে উঠল অদৃশ্য এক সঙ্কেত—এই প্রেম সহজ হবে না, কণ্টকাকীর্ণ পথ তাদের পেরোতে হবে, আর হয়তো একদিন এই নীরব আকাশই হয়ে উঠবে তাদের প্রতিশ্রুতির সাক্ষী।

গোধূলির সেই সময়টাতে গ্রামটা অন্য রূপ নেয়। সূর্য ধীরে ধীরে দিগন্তের ওপারে ডুবতে থাকে, আকাশে কমলা আর লাল রঙের মিশ্রণ যেন আঁকা হয়ে ওঠে এক স্বপ্নীল ছবি। নদীর ধারে বাতাস তখনও ভেজা, শীতল, আর চারপাশে শোনা যায় গরু-ছাগল ফেরার ঘণ্টার শব্দ। মিতালী সেদিন হঠাৎই ঘর থেকে বেরিয়েছিল—কারও চোখ এড়িয়ে, নিজের ভেতরের অস্থিরতা সামলাতে। নদীর ধারের সেই সরু পথটা তার কাছে মুক্তির মতো লাগত, যেখানে শাসন, বাঁধন বা লোকের কড়া দৃষ্টি পৌঁছায় না। হাঁটতে হাঁটতে সে হঠাৎ থমকে গেল—অরিন্দমকে দেখল সামনে দাঁড়িয়ে। অরিন্দম সেই মুহূর্তে বাঁশের ঝাড়ের পাশে জলের দিকে তাকিয়ে ছিল, হাতে মাটির কলস, ঘরে জল নেওয়ার জন্য এসেছিল। তাদের চোখ মিলল, আর সময় যেন থেমে গেল। দুজনের শ্বাসকষ্ট বেড়ে উঠল, যেন এতদিন ধরে জমে থাকা অজানা টান হঠাৎ এক ভয়ংকর সত্যি হয়ে উঠেছে।

প্রথমে কেউ কিছু বলতে পারল না। নীরবতার ভেতর কেবল নদীর কলকল শব্দ বেজে চলল। অরিন্দমের বুকের ভেতর ধকধকানি যেন ভেঙে ফেলছিল তার শরীর, আর মিতালীর চোখে ভেসে উঠছিল এক অদ্ভুত মিশ্রণ—ভয়, লজ্জা আর অনাবিষ্কৃত আনন্দ। অবশেষে অরিন্দম মাটির কলস রেখে এগিয়ে এসে ধীর কণ্ঠে বলল, “তুমি এখানে?” মিতালী হেসে উত্তর দিল, “নদীর ধারে এলে মনে শান্তি লাগে।” তার গলায় স্নিগ্ধতা ছিল, কিন্তু সেই সুরে ছিলও অস্বস্তির কম্পন। তারা প্রথমবার এতটা কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, চারপাশে কেউ নেই, শুধু ঝিরঝিরে বাতাস তাদের কথোপকথনকে ঢেকে রাখছে। অরিন্দম বলল, “তুমি জানো, আমাদের এই কথা বলা যদি কেউ দেখে, তাহলে কী হতে পারে?” মিতালী হঠাৎ তার চোখের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল, “জানি… কিন্তু তোমার সঙ্গে কথা বলার টান আমি আটকাতে পারি না।” সেই মুহূর্তে যেন দুই হৃদয়ের গোপন ব্যথা হঠাৎ বেরিয়ে এলো, তারা বুঝল, একে অপর ছাড়া তাদের আর কোনো আশ্রয় নেই।

গোধূলির আলো তখন প্রায় নিভে আসছে, আকাশে চাঁদের আভাস ফুটতে শুরু করেছে। অরিন্দম ও মিতালী নদীর ধারে হাঁটতে হাঁটতে কিছুক্ষণ কথা বলল—ছোট ছোট বিষয়, অথচ তাদের কাছে তা ছিল মহামূল্যবান। তারা বলল শৈশবের স্মৃতি, গ্রামের জীবন, স্বপ্নের কথা। মিতালী বলল সে কতবার দূর থেকে অরিন্দমকে দেখেছে মাঠে কাজ করতে, আর অরিন্দম স্বীকার করল সে প্রতিদিন কাজের ক্লান্তি ভুলত কেবল মিতালীর এক ঝলক দেখার আশায়। গ্রামের বাতাসে যেন তখন এক নতুন গন্ধ জন্ম নিল—গোপন প্রেমের গন্ধ। সেই পথে হয়তো আরও অনেক যুগল কখনো গোপনে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আবার সমাজের ভয়ে হারিয়েও গেছে। কিন্তু এই দুজনের জন্য সময় যেন এক নতুন অধ্যায় খুলে দিল। গোধূলির আঁধার থেকে জন্ম নিল এক অদৃশ্য বন্ধন, যা শব্দে প্রকাশ করা যায় না, কেবল নদীর জল, বাতাস আর চাঁদের আলোই তার সাক্ষী হয়ে রইল।

পূর্ণিমার রাত সেই গ্রামকে যেন অন্য এক জগতে নিয়ে যায়। সাদা আলোয় ভেসে ওঠে কাঁচা রাস্তা, ধানক্ষেত, আর নদীর চকচকে ঢেউ। সেদিনও রাতটা এমনই ছিল—অপার্থিব, নিস্তব্ধ, অথচ গভীর আবেগে ভরা। গ্রামের মাঝখানে শতবর্ষ পুরোনো এক বটগাছ দাঁড়িয়ে ছিল, যার ছায়ায় অগণিত গল্প লুকিয়ে আছে। লোকজন বলে সেখানে ভূতের আড্ডা, তাই কেউ রাতের বেলায় সে গাছের কাছে যায় না। কিন্তু সেই ভয়ই অরিন্দম আর মিতালীর আশীর্বাদ হয়ে উঠেছিল, কারণ এই ভুতুড়ে নামের আড়ালে তাদের প্রথম গোপন দেখা হওয়ার নিরাপদ জায়গা তৈরি হয়েছিল। অরিন্দম আগেই পৌঁছে গিয়ে বটগাছের গোড়ায় দাঁড়িয়েছিল, তার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ শোনা যাচ্ছিল যেন। সে জানত, আজকের এই রাত কোনো সাধারণ রাত নয়—আজ প্রথমবার তারা শুধু চোখের দেখা নয়, কথার প্রতিশ্রুতিতেও বাঁধা পড়বে। দূর থেকে মিতালীর পায়ের নুপুরের ক্ষীণ ঝনঝন শব্দ ভেসে আসতেই তার দম বন্ধ হয়ে এল, আর মুহূর্তের মধ্যে চারপাশের জগত যেন অদৃশ্য হয়ে গেল।

মিতালী এসে দাঁড়াল অরিন্দমের সামনে, চাঁদের আলোয় তার মুখ যেন দীপ্তিমান হয়ে উঠেছিল। সে সাদা শাড়ি পরে এসেছিল, আর বাতাসে উড়ছিল তার খোলা চুল। তারা দুজনেই কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল, যেন এতদিনের অদৃশ্য আকাঙ্ক্ষা সেই দৃষ্টির ভেতরেই উন্মোচিত হচ্ছে। প্রথমে কথা খুঁজে পাওয়া গেল না, কেবল নদীর কলকল আর রাতের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকই তাদের নীরবতার ভাষা হয়ে উঠল। অবশেষে অরিন্দম ফিসফিস করে বলল, “তুমি জানো, এই মুহূর্তটা আমি কতদিন ধরে ভেবেছি?” মিতালী চোখ নামিয়ে ধীরে উত্তর দিল, “আমি-ও। আমার মনে হয়, চাঁদের আলো যদি সত্যি কিছু দেখে, তবে সেটা আজ আমাদের দেখা।” তারা ধীরে ধীরে বসে পড়ল বটগাছের নিচে, হাতের কাছে হাত এল, আর স্পর্শে শরীর কেঁপে উঠল। সেই মুহূর্তে মিতালী বলল, “আমি জানি আমাদের পথ কঠিন হবে, সবাই আমাদের আলাদা করতে চাইবে। কিন্তু আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আমি তোমাকে ছাড়ব না।” অরিন্দমের চোখে জল এসে গেল, সে কণ্ঠ রুদ্ধ করে বলল, “তুমি যদি থাকো, আমি সব সহ্য করব। আমি-ও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি—জীবনের শেষ পর্যন্ত আমি শুধু তোমার।”

চাঁদের আলো যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল, নদীর স্রোত যেন থেমে গেল, প্রকৃতি যেন তাদের শপথ শুনে আশীর্বাদ দিচ্ছে। তারা দুজনেই জানত, ভবিষ্যত তাদের জন্য সহজ নয়—সমাজ, পরিবার, দারিদ্র্য, সবকিছু মিলিয়ে পথ হবে অগ্নিপরীক্ষার মতো। তবু সেই রাতে তারা ভয়কে দূরে সরিয়ে দিল, কারণ তাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে এমন এক ভালোবাসা, যা আর কোনো শক্তি মুছে ফেলতে পারবে না। সময়ের ধারা হয়তো তাদের আলাদা করে দেবে, কিন্তু এই রাত, এই বটগাছ, এই চাঁদ আর নদী চিরকাল তাদের প্রতিশ্রুতির সাক্ষী হয়ে থাকবে। বিদায় নেওয়ার আগে তারা শেষবার একে অপরের চোখে চোখ রেখে প্রতিজ্ঞা করল—“যত বাধাই আসুক, আমরা একসাথে থাকব।” আর দূরে বাজল রাতের কুকুরের ডাক, বাতাসে দুলল বটপাতার ফিসফিসানি, যেন প্রকৃতিও সেই গোপন প্রেমকথাকে চিরন্তন করে তুলল।

দিন যত এগোতে লাগল, পূর্ণিমার সেই রাতের জাদু যেন ধীরে ধীরে ধরা পড়তে শুরু করল গ্রামের কটাক্ষভরা চোখে। গ্রাম এমনই এক জায়গা, যেখানে পুকুরের ঢেউ থেকেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে খবর, আর ফিসফিসানি মুহূর্তে রূপ নেয় গুজবে। একদিন সকালে দু’একজন রাখাল ছেলে নদীর ধারে মিতালী আর অরিন্দমকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফেলে। তাদের চোখে যা ছিল নির্ভেজাল ভালোবাসা, সেই দৃশ্য গ্রামবাসীর চোখে হয়ে উঠল পাপ আর কেলেঙ্কারির বিষয়। দুপুরের মধ্যেই চায়ের দোকান, ধানের গোলা আর খেজুরগাছের ছায়ায় সেই গল্প ছড়িয়ে পড়ল। কেউ কটাক্ষ করে বলল, “চাষার ছেলে হতেই তো সাহসী, জমিদারের মেয়েকে হাত করতে চাইছে।” আরেকজন বলল, “ও মেয়েটারও দোষ কম নয়, ঘরের মান রাখছে না।” ধনী–গরিব বিভাজন, যেটা এতদিন নীরবে ছিল, হঠাৎ যেন ভয়াবহ আকারে প্রকাশ পেল। সবার মনে হলো, এই অসম প্রেম যদি মেনে নেওয়া হয়, তবে গ্রামের পুরোনো নিয়ম ভেঙে যাবে, বংশের গরিমা মাটিতে পড়বে।

মিতালীর পরিবারও শিগগিরই গুজবের খবর পেয়ে যায়। তার বাবা—যিনি গ্রামের অন্যতম প্রভাবশালী জমিদার—বিষয়টি শুনে প্রচণ্ড রেগে ওঠেন। তিনি মিতালীকে ডেকে প্রশ্ন করেন, কিন্তু মিতালী নীরব থাকে। নীরবতা অনেক সময় অস্বীকারের থেকেও বেশি প্রমাণ হয়ে ওঠে, আর তাতেই সন্দেহ দৃঢ় হয়। বাড়ির ভেতরে শুরু হয় কড়া নজরদারি—মিতালীর চলাফেরা সীমিত হয়ে যায়, বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার সময়ও কমিয়ে দেওয়া হয়। তার চোখের বিষণ্নতা ধরা পড়ে দাসী কিংবা দূরের আত্মীয়দের চোখে, কিন্তু কেউ মুখ খোলে না, কারণ জমিদারের রোষের সামনে সবাই নিস্তব্ধ। অন্যদিকে, অরিন্দমের জীবনও ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। এক সন্ধ্যায় সে যখন বাড়ি ফিরছিল, গ্রামের দুই প্রবীণ তাকে থামিয়ে হুঁশিয়ারি দিল, “ওসব ভাবনা বাদ দে। বড়লোকের ঘরের মেয়ের দিকে তাকানো তোর মতো ছেলের কাজ নয়। সমাজ তোরে মেনে নেবে না।” তাদের চোখে ছিল তাচ্ছিল্য আর ভয় দেখানোর চেষ্টা, কিন্তু অরিন্দম সেই মুহূর্তে ভেতরে ভেতরে অদ্ভুত শক্তি অনুভব করল। সে জানত, তাদের সতর্কবার্তার আড়ালে লুকিয়ে আছে সমাজের অমানবিক শৃঙ্খল।

তবুও সেই হুঁশিয়ারি সহজে উড়িয়ে দেওয়া গেল না। রাতের অন্ধকারে অরিন্দমের বুক কেঁপে উঠল, কারণ সে বুঝল, শুধু ভালোবাসাই যথেষ্ট নয়, সমাজের বাঁধন কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। মিতালীও বুঝতে পারছিল, তার পরিবার শুধু কথায় থেমে থাকবে না, প্রয়োজনে তার জীবনকে শৃঙ্খলের মধ্যে বেঁধে ফেলবে। তবু দুজনের মনে একই ভাবনা গড়ে উঠল—যে প্রেম একবার জন্ম নিয়েছে, তা কি এত সহজে শেষ হয়ে যেতে পারে? গ্রামের গলিপথে, নদীর ঘাটে, কিংবা ধানক্ষেতের বাতাসে তাদের নাম নিয়ে কানাঘুষো চলতে লাগল, অথচ অরিন্দম আর মিতালী মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, সমাজ যতোই চোখরাঙানি দেখাক, তাদের ভালোবাসা ভাঙবে না। চাঁদের আলোতে দেওয়া প্রতিশ্রুতির মতোই তাদের হৃদয়ে জন্ম নিল নতুন এক সাহস—যদিও তা ছিল অজানা বিপদের দিকে এগিয়ে যাওয়া।

গ্রামের চাপা গুঞ্জন, পরিবারের সন্দেহ, সমাজের চোখরাঙানি—সবকিছুর মধ্যেও মিতালী যেন হঠাৎ অন্য এক রূপ ধারণ করল। এতদিন সে ছিল শান্ত, নিরীহ, পরিবারের নির্দেশ মেনে চলা এক মেয়ে। কিন্তু অরিন্দমের প্রতি তার ভালোবাসা যতটা সত্যি, ততটাই শক্তিশালী হয়ে উঠল সেই বিদ্রোহী স্পৃহা, যা তাকে বাধা ভাঙতে প্রলুব্ধ করল। এক রাতে, বাড়ির কড়া নজরদারি এড়িয়ে, সে সাহস করে বেরিয়ে এল অরিন্দমের সঙ্গে দেখা করতে। চাঁদের আলোয় নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে সে অরিন্দমের হাত শক্ত করে ধরে বলল, “আমি কাউকে ভয় করি না। আমি তোমাকে ছাড়ব না, অরিন্দম। সমাজ, পরিবার, লোকের চোখ—কিছুই আমাকে তোমার থেকে আলাদা করতে পারবে না।” সেই কথাগুলো যেন রাতের নিস্তব্ধতায় প্রতিধ্বনিত হলো। অরিন্দম বিস্ময়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, কারণ এত দৃঢ় উচ্চারণ সে আগে কখনো মিতালীর মুখে শোনেনি। তার হৃদয় গর্বে ভরে উঠল, কিন্তু একইসঙ্গে ভয়ও জেগে উঠল—এই অগ্নিমূর্তি সমাজ সহজে মেনে নেবে না।

তাদের ভালোবাসা সেই মুহূর্ত থেকে আরও গভীর হলো। তারা শুধু প্রেমিক-প্রেমিকা রইল না, বরং একে অপরের জীবনের যোদ্ধা হয়ে উঠল। রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা, নদীর ঘাটে দীর্ঘশ্বাস মেশানো কথা, কিংবা মাঠের আলপথে চোরাগোপ্তা হাসি—সবকিছুই তাদের কাছে হয়ে উঠল মহামূল্যবান। মিতালী প্রায়ই বলত, “আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। যদি আমার বিয়ে জোর করে অন্য কোথাও দেয়, আমি পালিয়ে আসব।” তার কণ্ঠে যে দৃঢ়তা ছিল, তাতে অরিন্দম একইসঙ্গে খুশি আর অস্থির হয়ে উঠত। সে জানত, এই ধরনের প্রতিজ্ঞা শোনার পর আর পিছু হটার উপায় নেই। অরিন্দম একদিন তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি আমার জীবনের সাহস। কিন্তু ভয় হয়, তোমার এই সাহসের জন্য বড় বিপদ আসতে পারে।” মিতালী হেসে বলেছিল, “বিপদ এলে দুজন মিলে লড়ব।” তাদের এই পারস্পরিক শক্তি বিনিময় যেন ধীরে ধীরে প্রেমকে রূপান্তর করছিল সংগ্রামে, যেখানে শুধু হৃদয়ের টান নয়, বরং টিকে থাকার যুদ্ধও যুক্ত হলো।

কিন্তু এই সাহস, এই বিদ্রোহী মনোভাবই আসলে বিপদের ইঙ্গিত বহন করছিল। গ্রামের কানে গোপন কথা যতই পৌঁছাতে থাকল, ততই লোকজনের কটাক্ষ আর আক্রোশ বাড়তে লাগল। একদল প্রবীণ বলল, “মেয়েটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে কলঙ্ক লাগবে সবার কপালে।” মিতালীর পরিবারও বুঝতে পারছিল, শুধু নজরদারি নয়, শীঘ্রই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অথচ মিতালী আর অরিন্দমের মনে তখন শুধুই প্রতিশ্রুতির আলো, তারা ভবিষ্যতের বিপদের আঁচ পেলেও তা পাত্তা দিতে চাইছিল না। তাদের কাছে প্রেমই ছিল একমাত্র সত্যি, আর বাকি সবকিছু ছিল কেবল প্রতিবন্ধকতা। সেই রাতে, যখন তারা চাঁদের আলোয় আবার প্রতিজ্ঞা করল—“যা-ই হোক, আমরা একসাথে থাকব”—তখন প্রকৃতির ফিসফিসানি যেন সতর্ক করছিল, এই বিদ্রোহ সহজে ক্ষমা করা হবে না। তবু তারা শুনল না, কারণ ভালোবাসা মানুষকে যেমন অটল করে তোলে, তেমনি অন্ধও করে দেয়। আর এই অন্ধ সাহসই তাদের ভাগ্যকে ঠেলে দিল অজানা এক ঝড়ের দিকে।

গ্রামের চাপা গুঞ্জন, পরিবারের নিষেধাজ্ঞা আর সমাজের চোখরাঙানি—সবকিছুর মাঝেও এক রাতে তারা আবার বেরিয়ে এল, যেন প্রেমের ডাকে কোনো শিকলই তাদের আটকে রাখতে পারে না। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ তখন ভেসে আছে, তার সাদা আলো নদীর ঢেউয়ে রূপালি রেখা এঁকে দিয়েছে। মিতালী সাদা ওড়না মাথায় দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এল নদীর ঘাটের দিকে, আর অরিন্দম তখন আগেই দাঁড়িয়ে ছিল পাথরের ধাপে। চারপাশে নিস্তব্ধতা, শুধু দূরে রাতের পাখির ডাক আর নদীর কলকল শব্দ। সেই নির্জনতায় দুজনের চোখে যে আলো জ্বলছিল, তা কোনো সমাজের ভয় বা পরিবারের নিয়ন্ত্রণ মুছে দিতে পারছিল না। তারা একে অপরকে দেখে মুহূর্তের জন্য সব ভেতরের কষ্ট ভুলে গেল, মনে হলো—এই পৃথিবীতে যদি সত্যি কিছু থাকে, তবে সেটাই তাদের ভালোবাসা।

অরিন্দম ধীরে ধীরে হাত বাড়াল, মিতালী তাতে হাত রাখল। দুজনের আঙুল যেন একে অপরকে আঁকড়ে ধরে অঙ্গীকারের ভাষা খুঁজে পেল। মিতালী ফিসফিস করে বলল, “আজ থেকে এই চাঁদ আমাদের সাক্ষী। যদি কোনোদিন তুমি বা আমি দুর্বল হয়ে পড়ি, এই চাঁদ মনে করিয়ে দেবে—আমরা একে অপরের।” অরিন্দমের চোখে জল ভরে উঠল, সে কণ্ঠ রুদ্ধ করে বলল, “আমি শপথ করছি, মিতালী, এই জীবন যতদিন আছে, আমি শুধু তোমার। সমাজ যতোই বাঁধা দিক, পৃথিবী যতোই আমাদের আলাদা করতে চায়, একদিন আমি তোমাকে নিয়ে আমার ঘরে ফিরব।” তাদের কণ্ঠে যে দৃঢ়তা ছিল, তা নিস্তব্ধ রাতকেও কাঁপিয়ে দিল। যেন প্রকৃতিও শোনার জন্য থেমে গেছে—বাতাস থমকে দাঁড়িয়েছে, নদীর স্রোত ধীরে ধীরে বইছে, আর বটগাছের পাতা মৃদু শব্দে প্রতিধ্বনি করছে তাদের প্রতিশ্রুতির।

সেই মুহূর্তে তারা আর প্রেমিক-প্রেমিকা নয়, তারা হয়ে উঠল দুই যোদ্ধা, যারা ভালোবাসার নামে সমাজের বাঁধনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। মিতালী তার কাঁধে মাথা রেখে নিঃশব্দে বলল, “যদি মৃত্যু আসে, তাও আমি চাই তোমার হাত ধরে যেতে।” অরিন্দম কেঁপে উঠল, তবু দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিল, “যদি মৃত্যু আসে, আমি আগে তাকে মোকাবিলা করব। তোমাকে আমি শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আগলে রাখব।” চাঁদের আলোয় তাদের ছায়া নদীর জলে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল, যেন আকাশ আর পৃথিবীও তাদের এক হওয়ার ভবিষ্যৎ আঁকছে। কিন্তু সেই রাতের শান্তি আর প্রতিশ্রুতির ভেতরে লুকিয়ে ছিল অদৃশ্য ঝড়ের পূর্বাভাস, যা তারা দুজনেই বুঝতে পারল না। তবু তাদের কাছে সেই মুহূর্তটাই হয়ে উঠল চিরন্তন, কারণ তারা জানত—সমস্ত বাধা, ভয় আর মৃত্যুর ওপরে দাঁড়িয়ে আজকের এই প্রতিশ্রুতি তাদের প্রেমকে অমর করে রাখল।

প্রেমের শপথ নেওয়ার সেই রাত যেন প্রকৃতির বুকেও চিরকালীন হয়ে রইল, কিন্তু ভোরের আলো ফুটতেই অন্ধকারের ছায়া নেমে এলো তাদের জীবনে। গ্রামের অজানা কোন সূত্রে খবর ছড়িয়ে পড়ল—মিতালী আর অরিন্দম চাঁদের আলোয় নদীর ধারে দেখা করেছে। যারা গোপনে তাদের ভালোবাসার মুহূর্ত দেখেছিল, তাদের ঠোঁটে চাপা হাসি, আর যারা শুনেছিল, তাদের চোখে কটাক্ষ। বিকেলের মধ্যেই গুজব দাবানলের মতো ছড়িয়ে গেল পুরো গ্রামে। জমিদারের মেয়ে প্রেম করছে এক গরিব চাষার ছেলের সঙ্গে—এই কথাটা গ্রামের পুরনো সামাজিক কাঠামোর জন্য ছিল যেন এক ভয়ঙ্কর অপরাধ। রাতের সেই পবিত্র প্রতিশ্রুতি তাই সকালের আলোয় হয়ে উঠল কলঙ্কের প্রতীক। গ্রামের মসজিদ, মন্দির, চায়ের দোকান, এমনকি ধানক্ষেতের বাঁশঝোপেও একটাই আলোচনা—“এবার শাস্তি হবে, সমাজকে রক্ষা করতে হবে।”

পরদিন ভোরেই জমিদারের বাড়িতে ঝড় বয়ে গেল। মিতালীকে আর এক মুহূর্তও বাইরে বেরোতে দেওয়া হলো না। তার ঘরের জানালা বন্ধ করে দেওয়া হলো, দাসীদের কঠোর নির্দেশ দেওয়া হলো—মেয়েটির উপর নজর রাখতে হবে, বাইরে কোনো খবর যেন না যায়। মিতালী ঘরের কোণে বসে শুধু কাঁদতে লাগল। আগের রাতের প্রতিশ্রুতি তার বুকের ভেতর শক্ত হয়ে গেঁথে ছিল, কিন্তু পরিবারের চোখে সেই প্রতিশ্রুতি অপরাধের চেয়েও ভয়ঙ্কর। জমিদার বাবা মিতালীকে ডেকে বললেন, “তোর সাহস হয়েছে এমন কলঙ্ক আনতে? গরিবের ছেলের দিকে তাকানোর যোগ্যতা তোর হয়নি। আজ থেকে তোর পৃথিবী এই ঘরেই সীমাবদ্ধ।” সেই কঠিন কণ্ঠে কোনো মমতা ছিল না, শুধু রাগ আর সামাজিক ভয়ের প্রতিফলন। মিতালী নীরব থেকে শুধু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—যতো শৃঙ্খলই আসুক, সে অরিন্দমকে ভুলবে না।

অন্যদিকে, অরিন্দমকে গ্রামবাসী একা পেয়ে হঠাৎ ঘিরে ফেলল। কয়েকজন যুবক আর প্রবীণ মিলে তাকে মাঠের মাঝখানে টেনে নিয়ে গেল। কারো হাতে লাঠি, কারো হাতে বাঁশ। তারা অরিন্দমকে আক্রমণ করতে লাগল—“তুই সাহস পাস জমিদারের মেয়ে নিয়ে স্বপ্ন দেখার? তোর মতো লোকের জায়গা সমাজে নেই।” আঘাতে অরিন্দমের শরীর কাঁপতে লাগল, কিন্তু তার ঠোঁট থেকে একটি শব্দও বেরোল না। তার মনে শুধু মিতালীর মুখ ভেসে উঠছিল, আর সেই চাঁদের আলোয় দেওয়া প্রতিশ্রুতি তাকে টিকিয়ে রাখছিল। তার ভেতরে ভয় ছিল, ব্যথা ছিল, কিন্তু ভালোবাসা যেন তাকে অবিচল শক্তি দিচ্ছিল। মারধরের পর যখন সে মাটিতে পড়ে রইল, তখনও সে চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল—“আমি হাল ছাড়ব না।” নদীর ওপরে ভেসে আসা বাতাসে যেন সেই আর্তনাদ মিলিয়ে গেল। আর চাঁদ, যে গতরাতে তাদের প্রতিশ্রুতির সাক্ষী ছিল, আজ যেন দুঃখে মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়ে ফেলল। নদীর স্রোত ভারী হয়ে বয়ে চলল, যেন প্রকৃতি নিজেও কাঁদছিল এই নিষ্ঠুরতার সাক্ষী হয়ে।

মিতালী দিনকে দিন বন্দি হয়ে পড়ছিল ঘরের চার দেওয়ালের ভেতর। জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকালে তার মনে হতো, আকাশটা যেন তার জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ সেই আকাশেই আছে অরিন্দমের নিশ্বাস, সেই আকাশের নিচেই আছে তাদের ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি। পরিবার যতই তাকে আটকে রাখতে চাইছিল, ততই তার মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠছিল। অন্যদিকে, অরিন্দম আহত শরীর নিয়ে মাঠে কাজ করতে গেলেও মন টেকাতে পারছিল না। গ্রামবাসীর দৃষ্টি, কটাক্ষ, হুমকি—সবকিছুর মাঝেও সে শুধু ভাবছিল, কীভাবে মিতালীকে মুক্ত করা যায়। অবশেষে এক সন্ধ্যায়, অন্ধকার নামার আগে, গ্রামের সীমানায় একটি পুরনো অশ্বত্থ গাছের তলায় তারা দেখা করল। অনেক কষ্টে চিঠির মতো ইশারায় তারা এই সাক্ষাৎ ঘটাতে পেরেছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে মিতালী ফিসফিস করে বলল, “এভাবে আর চলবে না, অরিন্দম। আমাদের পালাতে হবে। এই গ্রাম, এই সমাজ, এই পরিবার—কেউ আমাদের ভালোবাসা মেনে নেবে না। যদি থাকি, তবে শুধু যন্ত্রণা আর অপমান পাব।” অরিন্দম তার হাত চেপে ধরে বলল, “আমি প্রস্তুত। তুমি যদি বলো, আজ রাতেই আমরা বেরিয়ে পড়ব।”

সেই রাতে চাঁদ আবার আকাশে উঠল, নদীর জল রূপালি হয়ে ঝিকমিক করছিল। গোপনে বাড়ি থেকে বেরোনোর জন্য মিতালী বুক ধড়ফড় করতে করতে অপেক্ষা করছিল। ঘরের সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ল, তখন সে ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো। হাতে ছিল শুধু একটি ছোট ব্যাগ, যেখানে মায়ের দেওয়া শাড়ি আর কিছু গহনা রাখা। ওদিকে, অরিন্দম আগে থেকেই নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখে একদিকে ভয়, অন্যদিকে আশা। মিতালীকে দেখে সে এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গেল সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, ব্যথা। দুজনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে শুধু হাসল—সে হাসি ছিল মুক্তির, ছিল নতুন জীবনের স্বপ্নের। মিতালী ধীরে ধীরে বলল, “আজ যদি আমরা পালাতে পারি, তবে সত্যি আমাদের প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হবে।” অরিন্দম মাথা নেড়ে বলল, “আজ আমরা আমাদের আকাশ খুঁজে নেব।” তারা নদীর ঘাট থেকে নৌকায় চেপে দূরে কোথাও পালানোর পরিকল্পনা করেছিল। তাদের মনে হচ্ছিল, আর কিছুক্ষণ পরেই তারা এই অন্ধকার গ্রাম আর শত্রুতার বাঁধন ছেড়ে মুক্ত পৃথিবীতে পা রাখবে।

কিন্তু ভাগ্য যেন অন্য কোনো খেলায় মেতে উঠেছিল। তাদের পিছু পিছু গ্রামের কয়েকজন যুবক আর কিছু প্রৌঢ় লোক চলে আসছিল। কেউ একজন টের পেয়ে পরিবারকে জানিয়েছিল, আর তারা দল বেঁধে লাঠি হাতে বেরিয়ে পড়েছিল “কলঙ্ক রক্ষা” করতে। নদীর ঘাটে পৌঁছেই তারা দুজনকে দেখে ফেলল। হঠাৎ চারদিক থেকে চিৎকার উঠল—“ধরো! পালাতে দিচ্ছি না।” মুহূর্তের মধ্যে শান্ত রাত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। মিতালী আঁতকে অরিন্দমের হাত শক্ত করে ধরল। অরিন্দম তাকে বুকের কাছে টেনে নিল, তার চোখে আগুন জ্বলছিল—সে জানত, লড়াই ছাড়া মুক্তি নেই। কিন্তু চারপাশ থেকে ঘিরে ধরা গ্রামবাসীর হাতে লাঠি, বাঁশ, আর ক্রোধ। সেই উত্তেজনা, সেই তীব্র রাগে ভরা চোখ দেখে মনে হচ্ছিল, দুজন মানুষ যেন এখন পুরো গ্রামের শত্রু। নদীর ঢেউ থেমে গিয়ে যেন সেই দৃশ্যের সাক্ষী হতে চাইছিল, আর আকাশের চাঁদ মেঘের আড়াল থেকে তাকিয়ে ছিল নিঃশব্দে। অরিন্দম–মিতালীর মুক্তির স্বপ্ন কি ভেঙে যাবে এখানেই? নাকি তাদের প্রেম শেষ মুহূর্তে কোনো অলৌকিক পথ খুঁজে পাবে? উত্তর তখনও অজানা, কিন্তু সেই রাতের হাহাকার আগামীর ঝড়ের ইঙ্গিত দিচ্ছিল স্পষ্টভাবে।

রাত তখন গভীর, আকাশে পূর্ণিমার আলো মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলছে। নদীর ঘাটের ওপর বিরাজ করছিল অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, কিন্তু সেই নিস্তব্ধতার ভেতরেই লুকিয়ে ছিল আসন্ন ঝড়ের পদচিহ্ন। অরিন্দম আর মিতালী নৌকায় ওঠার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, তাদের চোখে তখনো স্বপ্নের ঝলক—একটা নতুন জীবনের ডাক। কিন্তু হঠাৎ দূরে লাঠির শব্দ, মানুষের চিৎকার, আর দৌড়ের পদধ্বনি ভেসে এলো বাতাসে। মুহূর্তের মধ্যে বোঝা গেল, গ্রামবাসীরা তাদের পরিকল্পনা টের পেয়েছে। “ধরো! পালিয়ে যাচ্ছে ওরা!”—এই আর্তনাদ ছিঁড়ে দিল রাতের নীরবতা। মিতালী ভয়ে আঁকড়ে ধরল অরিন্দমের হাত, আর অরিন্দম এক মুহূর্তের জন্য চারপাশে তাকিয়ে বুঝল—এখন হয় পালাতে হবে, নয়তো হার মানতে হবে। কিন্তু নদীর ঘাট ইতিমধ্যেই ঘিরে ফেলেছে কয়েকজন যুবক, হাতে বাঁশ ও লাঠি। সেই মুহূর্তে মনে হলো, নদীও যেন হঠাৎ উত্তাল হয়ে উঠেছে, ঢেউ আছড়ে পড়ছে ঘাটের ধাপে, যেন প্রকৃতিও বুঝতে পারছে আসন্ন বিপদের গন্ধ।

চারপাশে হাহাকার আর বিশৃঙ্খলার মধ্যে শুরু হলো এক ভয়াবহ ধাওয়া। অরিন্দম মিতালীর হাত ধরে ছুটতে লাগল, কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপে তাদের পিছু ধাওয়া করছিল গ্রামবাসীর দল। কারো হাতে মশাল, কারো মুখে অভিশাপ—“কলঙ্ক ধুয়ে ফেলতে হবে!” অন্ধকারে ছুটতে ছুটতে মিতালীর শাড়ি একবার ঝোপে আটকে গেল, অরিন্দম দ্রুত টেনে মুক্ত করল, কিন্তু ততক্ষণে তাদের চারপাশের বৃত্ত আরও ছোট হয়ে আসছিল। নদীর জল তখন রূপালি আলোয় ভেসে উঠছিল, কিন্তু সেই আলোয় কোনো নিরাপত্তা ছিল না, ছিল কেবল আতঙ্কের প্রতিচ্ছবি। কেউ একজন মশাল উঁচিয়ে ছুড়ে মারল, তার আগুনের ঝলকানি মুহূর্তের জন্য আলোকিত করল দুই তরুণ প্রাণের ভীত কিন্তু দৃঢ় মুখ। তাদের নিঃশ্বাস তখন দম বন্ধ করে দিচ্ছিল, তবুও তারা দৌড় থামাল না। সেই দৌড় যেন ছিল অস্তিত্ব রক্ষার, সেই দৌড় যেন ছিল অসমাপ্ত স্বপ্নের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়া।

তারপর হঠাৎ করেই সব কিছু অদ্ভুত হয়ে গেল। কে কোথায় দাঁড়িয়েছিল, কে কী বলেছিল—পরদিন কেউ আর স্পষ্ট করে মনে করতে পারেনি। কেউ বলে, অরিন্দম–মিতালী শেষ পর্যন্ত নৌকায় উঠে নদীর বুকে ভেসে গেল, আর সমাজের শিকল ভেঙে মুক্ত হলো অজানা দিগন্তে। আবার কেউ বলে, ক্রোধে উন্মত্ত গ্রামবাসীর হাতে তারা ধরা পড়ে গিয়েছিল, আর সেই রাতেই নদীর জলে ঢেকে দেওয়া হলো তাদের কণ্ঠস্বর। কিছু বৃদ্ধলোক ফিসফিস করে বলল—“চাঁদ নিজেই সাক্ষী, সে জানে সত্যিটা।” কিন্তু নদী আর চাঁদ নীরব রইল, যেন তারা নিজেরাই মিতালী আর অরিন্দমকে রক্ষা করার জন্য রহস্য আড়াল করে দিল। ভোরের আলো উঠতেই ঘাটে পড়ে ছিল শুধু কিছু ভাঙা লাঠি, ছেঁড়া ওড়নার টুকরো, আর নদীর ঢেউয়ের রহস্যময় গুঞ্জন। গ্রামের মানুষজন সেই ঘটনার নানা ব্যাখ্যা দিলেও আসল সত্য কেউই জানল না। হয়তো তারা সত্যিই মুক্তি পেয়েছিল, হয়তো নদীই তাদের চিরদিনের মতো নিজের বুকে টেনে নিয়েছিল। যেভাবেই হোক, সেই রাতের যাত্রা অসমাপ্ত থেকে গেল—কিন্তু তাদের প্রেমের কাহিনি হয়ে উঠল গ্রামজুড়ে অমর কাহিনির মতো, যেখানে শেষ নেই, শুধু অনন্ত প্রশ্নচিহ্ন।

বছরের পর বছর কেটে গেছে সেই ভৌতিক রাতের পর। গ্রাম বদলেছে, মানুষ বদলেছে, নতুন প্রজন্ম জন্ম নিয়েছে, কিন্তু নদীর ঘাট আজও বহন করছে এক অদ্ভুত ভারী নীরবতা। দিনের বেলায় সেখানে কোলাহল থাকে, শিশুরা খেলে, কৃষকরা নৌকা বেঁধে রাখে, জেলেরা মাছ ধরে। কিন্তু রাত নামলেই নদীর ধারে অন্য এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে পূর্ণিমার রাতে। আকাশের রূপালি আলো নদীর বুকজুড়ে ছড়িয়ে পড়তেই চারদিকে অদ্ভুত এক শিহরণ ছড়িয়ে যায়। গ্রামের মানুষ যতই হাসি–ঠাট্টা করে বলুক যে এসব গল্প শুধু কুসংস্কার, তবু অন্তরে অন্তরে তারা ভয় পায়। কারণ পূর্ণিমার রাতে বারবার কেউ না কেউ শোনে নদীর ধারে ফিসফিসানি। সেই ফিসফিসানিতে থাকে দুটি কণ্ঠস্বর—একটি কোমল, অন্যটি দৃঢ়, যেন দুই আত্মা একে অপরকে খুঁজে ফেরে। গ্রামবাসীরা অনেক সময় দূর থেকে দেখে চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে আছে দুটি ছায়া, পাশাপাশি, একে অপরের হাত ধরে। আর সেই দৃশ্য দেখে মানুষের মনে হয়, অরিন্দম আর মিতালী এখনো হারিয়ে যায়নি; তারা শুধু দেহের বাঁধন ছেড়ে অনন্ত প্রেমে মিলিত হয়েছে।

কথিত আছে, যে রাতে নদীর ধারে এই ছায়াগুলো দেখা যায়, সে রাতে গ্রামজুড়ে অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে। হঠাৎ করে কুকুরের দল ঘেউ ঘেউ করে ওঠে, পাখিরা ভয়ে উড়ে যায়, আর বাতাসে ভেসে আসে এক অচেনা গন্ধ—কখনো শিউলি ফুলের, কখনো শুকনো ধূপের ধোঁয়ার মতো। গ্রামের বৃদ্ধারা বলেন, চাঁদের আলোতে তারা বারবার অরিন্দম আর মিতালীর প্রতিচ্ছবি দেখেছেন। মিতালীর সাদা শাড়ি বাতাসে দুলে ওঠে, আর অরিন্দমের দৃঢ় দৃষ্টি যেন আজও রক্ষা করছে তাকে। যুবক–যুবতীরাও গোপনে নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের ভালোবাসার গল্প শুনতে। কেউ কেউ বলে, যারা সত্যিকারের প্রেমে বাঁধা, তারা যদি পূর্ণিমার রাতে নদীর ধারে প্রতিজ্ঞা করে, তবে তাদের ভালোবাসা কখনো ভাঙে না। কারণ অরিন্দম–মিতালী সেই প্রতিশ্রুতির সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, মৃত্যুর পরও। কেউ কেউ আবার বিশ্বাস করে, যে রাতে এই ছায়াগুলো দেখা যায়, সেদিন গ্রামে কোনো অশুভ ঘটনা ঘটে না। যেন তাদের আত্মা আজও পাহারা দিচ্ছে গ্রামটিকে।

এভাবেই ধীরে ধীরে অরিন্দম–মিতালীর অসমাপ্ত কাহিনি পরিণত হলো এক কিংবদন্তিতে। সময় বদলালেও, প্রযুক্তি–সভ্যতা যতই এগিয়ে যাক, গ্রামের মানুষ এখনো পূর্ণিমার রাতকে আলাদা চোখে দেখে। তারা মনে করে, সেই রাতে চাঁদ শুধু নদীর ওপর আলো ছড়িয়ে দেয় না, সে আলো জ্বালায় মানুষের হৃদয়ে অমর প্রেমের দীপশিখা। কেউ যদি প্রশ্ন তোলে—“প্রেম কি মৃত্যুতে শেষ হয়?”—তাহলে গ্রামের মানুষ উত্তর দেয়, “না, প্রেম অনন্ত।” আর প্রমাণ হিসেবে তারা আঙুল তুলে দেখায় নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থাকা দুই ছায়াকে। হয়তো ওরা সত্যিই আছে, হয়তো নেই; কিন্তু বিশ্বাসই হয়ে উঠেছে সত্য। আর সেই সত্যই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়েছে গল্প হয়ে, গান হয়ে, লোকগাথা হয়ে। আজও যখন শিশুরা দাদী–নানীর কাছে শোনে চাঁদের আলোয় দুই প্রেমিক–প্রেমিকার গল্প, তাদের চোখে ভেসে ওঠে এক জোড়া ছায়া—যারা মৃত্যুকে অতিক্রম করে প্রতিশ্রুতিকে সত্যি করে তুলেছে। এভাবেই “চাঁদের আলোয় প্রতিশ্রুতি” হয়ে ওঠে প্রেমের এমন এক উত্তর, যা কোনো দিন শেষ হয় না, আর চাঁদ আজও তার নীরব সাক্ষী হয়ে থাকে।

1000058098.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *