সুকান্ত আইচ
পর্ব ১
পাড়ার নাম মধুবন কলোনি। কলকাতার এদিকেই, গঙ্গার ধার ঘেঁষা এক অদ্ভুত গলি। এই গলির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ—একজন টিউশন মাস্টার। নাম—বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী। বয়স পঞ্চান্ন, কিন্তু চেহারায় বোধহয় এখনও তিরিশের মতো এনার্জি। পরনে খাটো পাঞ্জাবি, চোখে মোটা পাওয়ারের চশমা, আর মাথার উপরে তেল দেওয়া টাকের চারপাশে জেগে থাকা ঝাঁকড়া চুল।
বিষ্ণুপদবাবু একসময় কলেজে খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন, পরে কাজ ছেড়ে দিয়ে “প্রাইভেট টিউশনের দুনিয়া”য় নামেন। আর তারপর থেকেই তার জীবন অন্যদিকে ঘুরে গেল। আশপাশের পাড়ায় নাকি তিনি এমন সব বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন যে পড়ুয়ারা ভিড় জমিয়ে ফেলল। বিজ্ঞাপনে লেখা—
“যে যা পড়তে চাও, এসো আমার কাছে। আমি সব শেখাই। অংক, ইংরেজি, ইতিহাস, ভূগোল, কম্পিউটার, এমনকি হারমোনিয়ামও।“
প্রথমে মানুষ হাসাহাসি করেছিল। “সবকিছু শেখানো কি আর সম্ভব?” কেউ বলেছিল, “এ তো জ্যাক অফ অল ট্রেডস, মাস্টার অফ নান!” কিন্তু বিষ্ণুপদবাবু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করলেন না। উল্টে নতুন পোস্টার ঝুলিয়ে দিলেন—
“আমি শিখলে তোমার রেজাল্ট উন্নতি হবেই। না হলে ফ্রি টিউশন!”
ফ্রি শব্দটা পড়েই পাড়ার অর্ধেক ছেলেমেয়ে ভিড় জমাল। ফলত এক সপ্তাহের মধ্যে তার ভাড়া করা গ্যারেজঘরটা ক্লাসরুমে পরিণত হলো। বাঁধানো কাঠের বেঞ্চ, একটা পুরনো ব্ল্যাকবোর্ড, আর কোণে টেবিলের উপর একটা ছোট হারমোনিয়াম।
প্রথম দিনেই যাদের দেখা গেল সেই ক্লাসে—
- সোনালী নামের এক কিশোরী, অংকের জন্য এসেছে।
 - জয়, যার ইতিহাস পাশ করার ভয়।
 - কৌশিক, গিটার বাজাতে শিখতে এসেছে।
 - মীরা, স্কুল প্রজেক্টের জন্য ভূগোল পড়তে চায়।
 - আর আছে আরও দশবারো জন, যাদের কেউ সঠিক জানে না আসলে তারা কী শিখতে এসেছে।
 
বিষ্ণুপদবাবু ক্লাস শুরু করলেন মহাগম্ভীর ভঙ্গিতে। বললেন—
“দেখো, জ্ঞান হলো সমুদ্র। আমি সেই সমুদ্রের মাঝি। তোমরা যে দিকেই নৌকা চালাও, আমি পথ দেখাব।”
ছাত্রছাত্রীরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে নিল। জয় ফিসফিস করে বলল, “এই লোকটা কি পড়াবে নাকি উপন্যাস লিখবে?”
তারপর মাস্টারমশাই বোর্ডে লিখলেন—
“দ্বিঘাত সমীকরণ“
এর পাশে সঙ্গে সঙ্গেই লিখলেন—
“পলাশীর যুদ্ধ – ১৭৫৭“
আর একটু জায়গা ফাঁকা রেখে লিখলেন—
“সা রে গা মা“
ক্লাসরুমে তখন চূড়ান্ত চুপচাপ। সবাই বোঝার চেষ্টা করছে ব্যাপারটা আসলে কী। সোনালী হাত তুলল, “স্যার, আমি অংক শিখতে এসেছি। কিন্তু এই পলাশীর যুদ্ধটা কেন?”
মাস্টারমশাই ধমক দিয়ে বললেন, “অংক শেখার জন্য ইতিহাস জানতে হয়, না হলে জীবন সমীকরণ মেলে না!”
কৌশিক গিটার কেস খুলে দপদপ শব্দ করতেই মাস্টার গম্ভীরভাবে বললেন, “তুমি বাজাও, আমি বোর্ডে তার সুর মিলিয়ে সমীকরণ পড়াব।”
এভাবে প্রথম ক্লাসটা এগোতে থাকল। ছাত্ররা বিভ্রান্ত, কেউ হেসে কুটি কুটি। মীরা পরে বাড়ি গিয়ে মাকে বলে, “মা, আজ টিউশনে গেছিলাম। মাস্টারমশাই সমীকরণ লিখলেন, তারপর বললেন পলাশীর যুদ্ধে মীর জাফর কেমন করে ‘x’ এর মান ০ করে দিল!”
গল্পটা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ল যে পরের দিনই ক্লাসে নতুন কিছু ছাত্র হাজির। কেউ শুধু কৌতূহল থেকে, কেউ আবার সত্যিই শিখতে চায়। কিন্তু পাড়ার গলি তখন গমগম করছে—
“ওই যে নতুন মাস্টার—সবকিছু একসাথে শেখায়!”
সন্ধ্যার পর দেখা গেল, ক্লাস শেষ হতেই মাস্টারমশাই হারমোনিয়াম টেনে বের করলেন। বললেন, “এবার সবাই মিলে গান শিখব। অংকের উত্তর না মিললেও গান গাইলে মন মিলবে!”
ছাত্ররা হাঁ করে তাকিয়ে রইল। কেউ মজা পেল, কেউ হালকা বিরক্ত। কিন্তু একথা ঠিক—বিষ্ণুপদ চক্রবর্তীর টিউশন ক্লাস যে সাধারণ নয়, তা সবাই বুঝে গেছে।
এভাবেই শুরু হলো “টিউশনের টর্নেডো”—একটা পাগলামি, হাসির, আর অদ্ভুত অভিজ্ঞতার গল্প।
পর্ব ২
পরের সপ্তাহ থেকে মধুবন কলোনির গলির দৃশ্যটাই পালটে গেল। বিষ্ণুপদবাবুর ক্লাসরুমের সামনে প্রতিদিন ভিড় জমতে শুরু করল। শুরুতে যেখানে দশ-বারো জন এসেছিল, এবার সেই সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়াল প্রায় চল্লিশে। ভাড়া করা গ্যারেজঘরটা ভরে গেল ছাত্রছাত্রী আর তাদের বায়না-ঝগড়ায়।
সকালে যখন তিনি লাল চেক শার্ট পরে বেরোতেন, পাড়ার লোকজন চোখ কচলাতো—“দ্যাখ দ্যাখ, ওই লোকটাই না? সবকিছু একসাথে শেখায়!” আর নতুন ভর্তি হওয়ার ছাত্ররা পেছন থেকে হাঁক দিত—“স্যার, আমার নামটা লিখে নিন। আমি কিন্তু শুধু ইংরেজি প্র্যাকটিস করতে চাই।” আরেকজন বলত—“স্যার, আমি আঁকতে শিখব, ফি একি হবে তো?”
বিষ্ণুপদবাবু খুব শান্ত গলায় জবাব দিতেন, “সবই সম্ভব, জ্ঞানের কোনো ভেদাভেদ নেই।” কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি যে কেমন এক অদ্ভুত আনন্দ পাচ্ছিলেন, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হয়নি।
প্রথমেই শুরু হলো জায়গার সমস্যা। একদিকে বেঞ্চে চারজন গাদাগাদি করে বসছে, অন্যদিকে গিটার হাতে কৌশিক দাঁড়িয়ে আছে। সোনালী গলার কাছে গাণিতিক খাতা, আর জয় তার বিশাল ইতিহাসের বই নিয়ে ঠেলাঠেলি করছে। হঠাৎই মীরা চিৎকার করে উঠল—“স্যার, এই ভিড়ে আমার খাতা ছিঁড়ে গেল।”
বিষ্ণুপদবাবু সবাইকে শান্ত করে বললেন, “এভাবে হবে না। আমরা আলাদা আলাদা ভাগ করব। একদিকে যারা অংক শিখবে, তারা ডান পাশে বসবে। যারা ইতিহাস, তারা বাঁ দিকে। সংগীতের জন্য মাঝখানে হারমোনিয়ামের কাছে। আর বাকিরা, যাদের আলাদা দাবি আছে, তারা জানলার ধারে।”
ফলত গ্যারেজঘরটা দেখতে লাগল যেন কোনো মেলা চলছে। কেউ কলম চালাচ্ছে, কেউ গিটার টোকাচ্ছে, কেউ আবার মুচকি হেসে আঁকিবুকি কাটছে।
ক্লাস শুরু হতেই মাস্টারমশাই বোর্ডে সমীকরণ লিখতে শুরু করলেন। হঠাৎ মাঝখানেই থেমে বললেন—“এই যে, ইতিহাস বিভাগ, তোমরা শোনো। প্লাস টু সিলেবাসে যে অধ্যায়টা পড়বে, সেটা কিন্তু যুদ্ধের সঙ্গে রাজনীতি বোঝার বিষয়। আর অংকেও যুদ্ধ হয়, সংখ্যার যুদ্ধ।”
সবাই হেসে উঠল। জয় বলে ফেলল, “স্যার, তাহলে তো অংকের খাতাও যুদ্ধক্ষেত্র!”
তারপর কৌশিক গিটার বাজাতে বাজাতে সুর তুলল। মাস্টার থেমে গেলেন না, উল্টে বললেন, “এই সুরেই আমি দ্বিঘাত সমীকরণের মান মনে রাখব। সবাই গাইবে—‘ax² + bx + c = 0’। সা রে গা মা।”
ক্লাসরুম একেবারে হইচইয়ে ভরে গেল। কারও বোঝা গেল না আসলে তারা অংক করছে নাকি গান শিখছে। মীরা ভুরু কুঁচকে বলল, “স্যার, আমি তো ভূগোল পড়তে চাইছিলাম।”
বিষ্ণুপদবাবু চোখ টিপে বললেন, “আচ্ছা, পৃথিবী গোল, তার মানে অংকের বৃত্ত। গানেও তো তাল—তিন তালে চার খণ্ড, সেটা ভূগোলের মতোই ঘোরে। সবকিছু যুক্ত আছে।”
ছাত্রছাত্রীরা তখন কেবল হাসি সামলাচ্ছে। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা অভিভাবকেরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে বলছে, “ক্লাসটা না সার্কাস হচ্ছে?”
একদিন এক অভিভাবক, সোনালীর বাবা, এসে ভদ্রভাবে বললেন, “চক্রবর্তী মশাই, অংকটা একটু আলাদা করে শেখাতে পারবেন? গান বাজনার মধ্যে মেয়ে মন বসাতে পারছে না।”
বিষ্ণুপদবাবু চেয়ার ঠেসে বসে উত্তর দিলেন, “অংক আলাদা নয়, গান আলাদা নয়। সব একসূত্রে গাঁথা। আপনার মেয়ের মন বসবে, তবে সময় দিন।”
পরের দিন থেকেই ছাত্ররা আরও কৌতূহলী হয়ে উঠল। কেউ ক্লাসে আসছে শুধুই মজা করার জন্য, কেউ আবার সত্যিই ভেবেছে এই পাগলাটে মাস্টারের ভেতরে কোনো গোপন জ্ঞান আছে।
তৃতীয় সপ্তাহে জয় হঠাৎ ক্লাসে ঢুকে গলা ফাটিয়ে বলল, “স্যার, কাল ইতিহাস পরীক্ষায় লিখেছি—‘পলাশীর যুদ্ধে মীর জাফর অংকের ‘b² – 4ac’ কে শূন্য করে দিয়েছিল, তাই ফলাফল নিশ্চিত হয়েছিল।’”
বিষ্ণুপদবাবু হাততালি দিয়ে বললেন, “বাহ বাহ! এটাই তো চাই!”
ছাত্ররা খিলখিলিয়ে হাসতে লাগল। কেউ বইয়ে কিছু লিখছে, কেউ আবার খাতার প্রান্তে কার্টুন এঁকে রেখেছে—বোর্ডে অংকের পাশে গিটার ঝুলছে, আর তার নিচে মীর জাফরের মুখ!
এভাবেই বিষ্ণুপদবাবুর ক্লাস হয়ে উঠল পাড়ার প্রধান বিনোদন। মধুবন কলোনির গলি তখন প্রতিদিন ভরে যায় হাসি-ঠাট্টা আর অদ্ভুত সব গল্পে। কেউ বলত, “এই টিউশনে পড়লে পাশ করবে না, কিন্তু হাসির ডিগ্রি পাবে।” আর কেউ আবার গম্ভীরভাবে বলত, “হাসি যদি শেখার অংশ হয়, তবে এর থেকে ভালো মাস্টার আর কোথাও নেই।”
পর্ব ৩
সেই সপ্তাহে ঘটল আসল বিপত্তি। বিষ্ণুপদবাবুর ক্লাসে ছাত্র সংখ্যা তখন চল্লিশ পেরিয়ে প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। ভিড়ে ঘরটায় নিশ্বাস নেওয়ার জায়গা নেই। জানলার ধারে দাঁড়িয়ে কেউ গিটার বাজাচ্ছে, সামনের বেঞ্চে বসে কেউ গলা ফাটিয়ে গাইছে “সা রে গা মা”, আবার কেউ খাতার প্রান্তে সমীকরণ মেলাচ্ছে। সবমিলিয়ে গ্যারেজঘরটা যেন একটা মিনি কুম্ভমেলা।
সেইদিন মাস্টারমশাই খুব উৎসাহ নিয়ে ঘোষণা দিলেন, “আজ আমরা ইন্টিগ্রেশন শিখব। তবে শুধু অংক নয়, ইতিহাস আর সঙ্গীতের সঙ্গেও একসাথে।” সবাই হাঁ করে তাকাল। জয় ফিসফিস করে বলল, “আজ আবার কী হবে কে জানে!”
বিষ্ণুপদবাবু বোর্ডে বড় করে লিখলেন:
∫x2dxint x^2 dx∫x2dx
এর পাশে আবার লিখলেন—“১৮৫৭ – সিপাহী বিদ্রোহ”। আর ঠিক নিচেই লিখলেন—“রাগ ভৈরবী”।
সোনালী বিরক্ত হয়ে বলল, “স্যার, আমরা কি অংক শিখব না ইতিহাস গাইব?”
মাস্টার গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন, “ইন্টিগ্রেশন মানে মিলন। ইতিহাসও মিলন—ব্রিটিশ আর ভারতীয় সেনার সংঘর্ষের মিলন। আবার গানও মিলন—তালের সঙ্গে সুরের। বুঝেছ? সবই এক।”
ক্লাস তখন থমথমে চুপ। হঠাৎ কৌশিক গিটার থেকে টুংটাং বাজিয়ে দিল একটা সুর। মাস্টার খুশি হয়ে হাততালি দিয়ে বললেন, “বাহ, এটাই তো চাই! এখন সবাই মিলে বল—x³/3।”
গিটার বাজল, সবাই গাইতে শুরু করল—“x³/3, x³/3।”
জানলার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জন নতুন ছাত্রী হেসে গড়াগড়ি। তাদের একজন বলল, “আমরা শুনেছিলাম এখানে গান শেখায়, তাই এসেছিলাম। কিন্তু এ কী! গানের মধ্যে অংক ঢুকছে কেন?”
ঠিক তখনই মীরা খাতায় লিখে ফেলল—“১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ সমীকরণের মতো বেড়ে গিয়েছিল, শেষে ভাগ হয়ে তিন ভাগ হয়েছিল—বাংলা, উত্তরপ্রদেশ আর পাঞ্জাব।”
বিষ্ণুপদবাবু আনন্দে বলে উঠলেন, “বাহ বাহ! এটাই সৃজনশীলতা।”
ক্লাসের বাইরে তখন কয়েকজন অভিভাবক দাঁড়িয়ে আড়ি পাতছে। একজন চাপা গলায় বললেন, “শুনেছ? অংকের ক্লাসে বিদ্রোহ হচ্ছে।” আরেকজন ভুরু কুঁচকে জবাব দিলেন, “আমার ছেলেটা এখানে এসে যে পাশ করবে না, সে তো নিশ্চিত। তবে একদিন কমেডি অভিনেতা হয়ে উঠবে।”
সেইদিন আরও এক কাণ্ড ঘটল। জয়, যে ইতিহাসে দুর্বল, সে খাতায় লিখল—
“ইন্টিগ্রেশন অফ প্লাসি ব্যাটেল = ব্রিটিশ + মীর জাফর।”
খাতা দেখে বিষ্ণুপদবাবু এমন উচ্ছ্বসিত হলেন যে ক্লাসেই তাকে দাঁড় করিয়ে হাততালি দিলেন। সবাই হেসে লুটোপুটি, আর জয় লজ্জায় মাথা চুলকোতে লাগল।
ঠিক সেই সময় বিদ্যুৎ চলে গেল। ঘর অন্ধকার। কেউ চিৎকার করছে, কেউ আবার মোমবাতি খুঁজছে। বিষ্ণুপদবাবু সুযোগ বুঝে হারমোনিয়াম টেনে এনে বললেন, “এবার সবাই মিলে বিদ্রোহের গান গাই। গান গাইতে গাইতে আলো আসবেই।”
ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অর্ধেক মজা পেয়ে গান ধরল—“মীর জাফর করেছিল বেইমানি, তার সমীকরণ বর্গমূলহীন।”
আলো ফিরে আসতেই বোর্ডে দেখা গেল এক অদ্ভুত দৃশ্য—অর্ধেক লেখা অংক, পাশে ইতিহাসের তারিখ, আর নিচে কারও হাতের খসখস করা লিরিক্স। যেন পুরো বোর্ডটাই কমেডি চিত্রনাট্য।
সেদিনের পর থেকে মধুবন কলোনির পাড়ায় নতুন আলোচনা শুরু হল। চায়ের দোকানে, বাসস্ট্যান্ডে সবাই বলছে, “চক্রবর্তী মশাইয়ের টিউশনে কী হচ্ছে জানো? অংক গাইছে, ইতিহাস বাজাচ্ছে!”
পাড়ার লোকজনের কেউ কেউ গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল—“এতে পড়াশোনা হবে না।”
কিন্তু বেশিরভাগই খিলখিল করে হেসে বলল—“পড়াশোনা না হোক, মজা হচ্ছে তো!”
ক্লাস শেষ হওয়ার পর ছাত্রছাত্রীরা বাইরে বেরিয়ে হাসতে হাসতে বলল, “এটা টিউশন নয়, এটা স্ট্যান্ড-আপ কমেডি। স্যার আমাদের হাসিয়ে মারবেন।”
কিন্তু মাস্টারমশাই তখন গম্ভীরভাবে খাতা গোছাচ্ছেন। তাঁর মুখে এক চিলতে হাসি। মনে মনে ভাবছেন—
“এরা এখনও বুঝতে পারছে না, আমি আসলে দেশের সবচেয়ে ইনোভেটিভ টিচার।”
পর্ব ৪
সেদিন ক্লাস শেষ হওয়ার পর গ্যারেজঘরে সবাই বেরিয়ে গেলেও বিষ্ণুপদবাবু বসে রইলেন একা। হারমোনিয়ামের ঢাক বন্ধ, ব্ল্যাকবোর্ডে আধাআধি মুছে যাওয়া সমীকরণ আর তার নিচে কুচকুচে চক দিয়ে লেখা—“পলাশীর যুদ্ধ = x³/3”। তিনি চেয়ার ঠেসে বসে আঙুলে কপাল চুলকাতে চুলকাতে এক অদ্ভুত আত্মতৃপ্তির হাসি দিলেন। মনে মনে বললেন, “এই পৃথিবী এখনও বুঝতে পারছে না আমি কী করছি। কিন্তু একদিন তারা বুঝবে—আমি স্রেফ টিউশন মাস্টার নই, আমি শিক্ষাবিপ্লবের পথিকৃৎ।”
সেই রাতেই তিনি একটা ডায়েরি খুললেন। ডায়েরির প্রথম পাতায় লিখলেন বড় বড় হরফে—
“আমার মিশন: এক ক্লাস, এক মাস্টার, সব বিষয়।”
পরের পাতায় লিখলেন নিজের স্বপ্ন:
- ছাত্ররা একসাথে অংক শিখবে, আবার গানের তালে তালে ইতিহাস মুখস্থ করবে।
 - ভূগোল শিখতে গিয়ে তারা নাচবে “পৃথিবী ঘোরে গোল গোল।”
 - ইংরেজির ব্যাকরণ তারা শিখবে কবিতা পড়ে, “Subject + Verb = হাসি।”
 
ডায়েরি লিখতে লিখতে তিনি এমন এক জগতে ঢুকে গেলেন, যেখানে তিনি বিশ্বখ্যাত শিক্ষক। টেলিভিশনের ক্যামেরা তাঁর সামনে, সাংবাদিকরা প্রশ্ন করছে—“চক্রবর্তী মশাই, আপনার টিউশন পদ্ধতি নিয়ে সারা দুনিয়ায় হইচই। কীভাবে এত বৈচিত্র্য একসাথে শেখান?” আর তিনি খুব শান্ত গলায় উত্তর দিচ্ছেন—“শিক্ষা মানেই আনন্দ, ভয় নয়। আমি সেই আনন্দ শেখাই।”
ঠিক তখন বাইরে থেকে আওয়াজ এল, কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে। তিনি চমকে উঠলেন, বুঝলেন বাস্তব আর কল্পনা একসাথে চলে আসছে।
পরের দিন থেকেই তিনি নতুন নিয়ম চালু করলেন। ক্লাসে ঢোকার আগে সবাইকে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে হবে—
“আমরা পড়ব, গাইব, নাচব, একসাথে পাশ করব!”
ছাত্রছাত্রীরা প্রথমে অদ্ভুত চোখে তাকালেও পরে হাসতে হাসতে মেনে নিল।
এবার থেকে বিষ্ণুপদবাবুর ক্লাস আরেক ধাপ এগোল। অংক বোঝাতে গিয়ে তিনি বোর্ডে লিখলেন—“2x + 3 = 9”। তারপরই গেয়ে উঠলেন—“দুইয়ে মিলে তিনে গাইলাম, বাকি রইল নয়।” ছাত্রছাত্রীরা হাততালি দিয়ে উঠল। জয় বলে উঠল, “স্যার, যদি পরীক্ষা হলে গাইতে হয় তখন কী হবে?”
মাস্টার গম্ভীরভাবে বললেন, “তাহলে পরীক্ষকও সঙ্গে গাইবে। শিক্ষা মানে তো ছড়িয়ে দেওয়া।”
এমন সময় ক্লাসে এসে হাজির হলেন এক সাংবাদিক। স্থানীয় পত্রিকার রিপোর্টার, নাম গোপাল। তিনি গোপনে খবর পেয়েছেন এই “অলরাউন্ডার টিউশন” নিয়ে। খাতায় টুকে টুকে নোট নিচ্ছিলেন। হঠাৎ কৌশিক গিটার বাজাতে শুরু করতেই গোপাল হাঁ করে তাকিয়ে গেলেন। আর যখন সোনালী অংকের উত্তরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গাইতে শুরু করল, তখন তিনি হাসতে হাসতে পেট ধরলেন।
পরের দিনই পাড়ার খবরের কাগজে বেরোল শিরোনাম—
“মধুবনের গ্যারেজে বিশ্বশিক্ষাবিপ্লব—একই ক্লাসে অংক, গান আর ইতিহাস।”
খবর বেরোতেই পাড়ায় চাঞ্চল্য। কেউ মাস্টারমশাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, কেউ আবার বলছে—“এ তো পড়াশোনাকে ঠাট্টা বানাচ্ছে।” কিন্তু বিষ্ণুপদবাবুর মুখে একটাই হাসি। তিনি পাড়ার দোকানে দাঁড়িয়ে মিষ্টি কিনতে কিনতে বলে ফেললেন, “একদিন আমার নাম হার্ভার্ডে পড়ানো হবে।”
সেদিন রাতে আবার তিনি ডায়েরিতে লিখলেন—
“স্বপ্ন: আমি হব ভারতের সবচেয়ে ইনোভেটিভ শিক্ষক। আমার ক্লাসে পাশ–ফেল থাকবে না, থাকবে শুধু হাসি।”
কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা তখনও এই স্বপ্ন জানে না। তাদের কাছে বিষয়টা এখনও কেবল হাসি-ঠাট্টা আর মজা। কেউ কেউ অবশ্য বুঝতে শুরু করেছে—এই মাস্টারমশাই সত্যিই অন্যরকম।
মীরার মা একদিন গোপনে মেয়েকে বললেন, “দেখিস, এই লোকটা হয়তো একদিন টিভিতে যাবে।”
মীরা খিলখিলিয়ে হেসে জবাব দিল, “মা, তার আগে হয়তো আমাদের স্কুলে ফেইল করবে!”
তবুও ক্লাস চলতে থাকল, আর বিষ্ণুপদবাবুর স্বপ্নও দিনে দিনে ফুলতে থাকল যেন হাওয়ায় ভরা বেলুনের মতো।
পর্ব ৫
পাড়ার চায়ের দোকান মধুবন কলোনির সংসদ। যে কোনো খবর আগে পৌঁছায় এখানেই। বিষ্ণুপদবাবুর টিউশনের গল্পও প্রথম ছড়াল এই দোকান থেকে। টানা তিনদিন ধরে আলোচনা হলো—
“কী রে, শুনলি? চক্রবর্তী মশাই নাকি অংক পড়াতে গিয়ে গান গাইছেন?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার ছেলেটা বলল বোর্ডে সমীকরণ লিখেই নাকি রাগ ভৈরবী ধরলেন।”
“আরে, এটা শিক্ষা না, সার্কাস।”
দোকানের এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিলেন নাপিত হরিদাস। তিনি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মন্তব্য করলেন, “আমি বলি, খারাপ কী আছে? আমার দোকানে তো গ্রাহক আসে চুল কাটতে, তার সাথে যদি কীর্তন গেয়ে দিই তবে মন্দ লাগবে?” সবাই হেসে উঠল।
অভিভাবকেরা কিন্তু ততটা খুশি নন। একদিন একসাথে পাঁচ-ছ’জন অভিভাবক মিলে মাস্টারমশাইয়ের গ্যারেজঘরে হাজির হলেন। ভেতরে তখন গিটার টুংটাং বাজছে, বোর্ডে লেখা—“cos²θ + sin²θ = ১ / স্বাধীনতার সমীকরণ”।
সোনালীর বাবা এগিয়ে গিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “চক্রবর্তী মশাই, একবার কথা হবে?”
বিষ্ণুপদবাবু হাত থামালেন, মুখে গম্ভীর ভঙ্গি এনে বললেন, “অবশ্যই, শিক্ষার দরজা সবার জন্য খোলা।”
তখনই শুরু হলো অভিভাবকদের আক্রমণ—
“স্যার, আমাদের ছেলে-মেয়েরা পরীক্ষায় পাশ করবে তো?”
“ইতিহাসের খাতায় যদি সমীকরণ লিখে আসে, শিক্ষকরা তো নম্বর কেটে দেবে।”
“অংকের বদলে গান গাইতে গেলে স্কুলে শাস্তি পেতে হবে।”
বিষ্ণুপদবাবু শান্ত গলায় বললেন, “দেখুন, এরা হাসছে, শিখছে, মজা করছে। শিক্ষা মানে যদি শুধু মুখস্থ করা হয়, তবে সেটা শুকনো। আমি শেখাচ্ছি জীবনের আনন্দ।”
অভিভাবকদের মধ্যে তর্ক বেঁধে গেল। কেউ সমর্থন করল, কেউ বিরোধিতা। জয়-এর মা বললেন, “আমার ছেলেটা অন্তত ক্লাসে যেতে চায়, আগে তো ভয় পেত।” মীরার বাবা পাল্টা বললেন, “কিন্তু পরীক্ষার নম্বরই আসল, গান গেয়ে পাশ হবে না।”
এই বিতর্কের মাঝেই বাইরে পাড়ার ছেলেরা দাঁড়িয়ে হাসাহাসি করছে। তারা গলা মিলিয়ে স্লোগান দিচ্ছে—“আমরা পড়ব, গাইব, নাচব, একসাথে পাশ করব!”
পরিস্থিতি সামলাতে মাস্টারমশাই সেদিন ঘোষণা করলেন, “আগামী রবিবার একটা খোলা ক্লাস হবে। আপনারা সবাই আসবেন। দেখবেন, আমার টিউশন কেবল হাসির নয়, জ্ঞানেরও।”
রবিবার বিকেল। গ্যারেজঘরের সামনে গমগম করছে। অভিভাবক, প্রতিবেশী, এমনকি দোকানদাররা পর্যন্ত হাজির। ভেতরে বসে ছাত্রছাত্রীরা—কারও হাতে গিটার, কারও হাতে অংকের খাতা।
মাস্টারমশাই উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, “আজ আপনাদের দেখাব কীভাবে শিক্ষা একসাথে হয়।” তারপর বোর্ডে লিখলেন—“ভূগোল + ইতিহাস + অংক = গান”।
তিনি নির্দেশ দিলেন—“সোনালী, তুই সমীকরণ পড়।”
সোনালী বলল, “(x + y)² = x² + 2xy + y²।”
সঙ্গে সঙ্গে জয় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল, “এটা যেমন ব্রিটিশ + মীর জাফর = প্লাসি।”
আর কৌশিক গিটারে টুংটাং বাজিয়ে গান ধরল—“x² + y² = স্বাধীনতা।”
দর্শকরা হাঁ করে তাকিয়ে রইল। কেউ হাসছে, কেউ অবাক। শেষে মাস্টারমশাই চোখ বন্ধ করে হারমোনিয়ামে সুর তুললেন, “শিক্ষা মানে মিলন, মিলন মানেই আনন্দ।” ছাত্ররা হাততালি দিয়ে গাইতে লাগল।
বাইরে দাঁড়ানো অভিভাবকরা তখন একে অপরের দিকে তাকিয়ে দ্বিধায়। কেউ বলছে, “এটা আসলেই নতুন কিছু।” কেউ আবার গম্ভীর মুখে বলছে, “এতে পাশ হবে না।”
কিন্তু একথা সত্যি—সেদিনের পর থেকে মধুবন কলোনিতে বিষ্ণুপদবাবুর নাম আরও ছড়িয়ে গেল। কেউ তাঁকে পাগল বলল, কেউ প্রতিভাবান। আর তাঁর নিজের মনে শুধু একটাই বিশ্বাস জাগল—
“আমি ভারতবর্ষের সবচেয়ে ইনোভেটিভ শিক্ষক হতে চলেছি।”
পর্ব ৬
রবিবারের সেই খোলা ক্লাসের পর ছাত্রছাত্রীদের মাথায় নতুন বুদ্ধি ঢুকল। তারা বুঝে গেল মাস্টারমশাই যতই সিরিয়াস হতে চান, ক্লাসটা আসলে মজার জায়গা। কেউ যদি একটু নাচে, গায়, বা উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে—মাস্টারমশাই তাকে থামান না, উল্টে বোঝানোর চেষ্টা করেন সবকিছুর সঙ্গে “শিক্ষা” জোড়া আছে। আর এখানেই শুরু হলো আসল কাণ্ড।
পরের সপ্তাহে জয় একটা বিশাল নোটিশ তৈরি করে ক্লাসে টাঙিয়ে দিল—
“মধুবন অল–রাউন্ডার ট্যালেন্ট শো – প্রতি বুধবার, টিউশন চলাকালীন।”
নিচে লেখা—
- অংক = কবিতা আবৃত্তি
 - ইতিহাস = নাটক
 - ভূগোল = নাচ
 - ইংরেজি = জোকস বলা
 - গান = সবার বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণ
 
সোনালী প্রথমে আপত্তি করল, “এতে যদি মাস্টারমশাই রেগে যান?”
জয় হেসে বলল, “রেগে যাবেন? তিনি তো বলবেন এটাই ‘নতুন শিক্ষাব্যবস্থা’। দেখিস।”
ক্লাস শুরু হলো যথারীতি। মাস্টারমশাই বোর্ডে লিখলেন—“Simple Interest = PRT/100।” তখনই কৌশিক গিটার টুংটাং বাজাতে শুরু করল। জয় দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করল—
“Principal হলো পুঁজি, Rate হলো সুদ,
Time বাড়লেই জীবন হয় খুদ।”
সারা ক্লাস হেসে উঠল।
বিষ্ণুপদবাবু এক মুহূর্ত ভুরু কুঁচকালেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, “আহা! দারুণ। অংক যদি কবিতায় শেখা যায়, তবে ভুলবে না।” তিনি নিজেই হাততালি দিলেন।
এরপর ভূগোলের পালা। মীরা উঠে দাঁড়িয়ে নাচতে লাগল। নাচতে নাচতে বলল, “পৃথিবী ঘোরে, দিন রাত বদলায়।” পাশে থাকা দু’জন ছাত্রী হাততালি দিয়ে তাকে ঘুরিয়ে দিল। মাস্টারমশাই গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “এটা হলো ঘূর্ণন ও আবর্তন—ড্যান্সের মাধ্যমে বোঝানো।”
ইতিহাস অংশে আরও মজার কাণ্ড হলো। জয় আর কৌশিক মঞ্চস্থ করল ছোট্ট নাটক—“পলাশীর যুদ্ধ।” জয় মীর জাফরের চরিত্রে, গিটার হাতে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করল, “আমি সমীকরণ শূন্য করে দেব।” কৌশিক বলল, “না, স্বাধীনতার x-value আমি বাঁচাব।” দর্শকরা—মানে বাকি ছাত্রছাত্রীরা—হেসে গড়িয়ে পড়ল।
ইংরেজির পালায় সোনালী দাঁড়িয়ে জোকস বলল—
“Teacher: Define Past Tense.
Student: Sir, Past Tense মানে, যখন গতবারের পরীক্ষার নম্বর দেখে আমার বাবা আমাকে পেটাল।”
ক্লাসে তখন তুমুল হইচই।
এই পুরো শো দেখে বিষ্ণুপদবাবু গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। কেউ ভেবেছিল তিনি রেগে যাবেন, কিন্তু না। তিনি ঘোষণা করলেন, “আজ থেকে প্রতি বুধবার হবে আমাদের ট্যালেন্ট শো। শিক্ষা মানেই আনন্দ। এটাই আমার ডায়েরির স্বপ্ন।”
ছাত্রছাত্রীরা তখন লাফিয়ে উঠল। কেউ চিৎকার করে বলল, “স্যার জিন্দাবাদ!” কেউ আবার গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিল, “আমরা পড়ব, নাচব, গাইব, একসাথে পাশ করব।”
বাইরে তখন কয়েকজন অভিভাবক দাঁড়িয়ে পুরো দৃশ্য দেখছিলেন। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হতবাক। একজন বিড়বিড় করে বললেন, “এ তো ক্লাস নয়, সার্কাস।” আরেকজন বললেন, “কিন্তু বাচ্চাগুলো তো খুশি।”
সেদিন থেকে টিউশনের নামই বদলে গেল। পাড়ার ছেলেরা বলল—“চক্রবর্তী সার্কাস স্কুল।”
অবশ্য ছাত্রছাত্রীরা মজা করে এটাকে ডাকতে লাগল—“টিউশনের টর্নেডো।”
আর বিষ্ণুপদবাবু? তিনি দিব্যি খুশি হয়ে ডায়েরিতে লিখলেন—
“আমার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। আমি ভারতের ইতিহাসে প্রথম সার্কাস–স্টাইল শিক্ষক।”
পর্ব ৭
মধুবন কলোনির ভেতরে তখন রোজ নতুন এক কাণ্ড। বুধবারের ট্যালেন্ট শো নিয়ে এত হইচই হলো যে খবর ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। প্রথমে স্থানীয় পাড়ার কাগজেই দু’কলম লিখেছিল—“অদ্ভুত টিউশন! পড়াশোনার সঙ্গে গান, নাচ, নাটক।” কিন্তু আসল হুল্লোড় শুরু হলো যখন এক টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার হাজির হলো ক্লাসে।
সেদিন বুধবার, ট্যালেন্ট শোর দিন। ছাত্ররা একেবারে তৈরি হয়ে এসেছে—কারও হাতে বাঁশি, কারও হাতে গিটার, কেউ কবিতা মুখস্থ করেছে, আবার কেউ নাচের ড্রেস পরে এসেছে। ক্লাসরুম যেন মঞ্চে পরিণত হয়েছে। বাইরে ভিড় জমে গেছে অভিভাবক, কৌতূহলী মানুষ, দোকানদার সবাই মিলে।
রিপোর্টার মাইক্রোফোন হাতে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় ঘোষণা করলেন, “আজ আমরা হাজির মধুবন কলোনিতে, যেখানে পড়াশোনা আর বিনোদনের অদ্ভুত মেলবন্ধন ঘটছে। বলা যায়, এটা দেশের সবচেয়ে ‘এন্টারটেইনিং টিউশন।’”
ক্যামেরা অন হতেই মাস্টারমশাই উঠে দাঁড়ালেন। পরনে সাদা পাঞ্জাবি, কপালে চন্দনের টিপ। তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “শিক্ষার সংজ্ঞা পাল্টাতে আমি এসেছি। বই খাতার বাইরে শিক্ষা হলো আনন্দ, মিলন, সৃজনশীলতা।”
তারপর শো শুরু হলো। সোনালী সমীকরণ আবৃত্তি করল, জয় নাটকীয় ভঙ্গিতে মীর জাফরের ডায়লগ বলল, কৌশিক গিটার টুংটাং করে তাল দিল, মীরা ভূগোল বোঝাতে নাচল। ক্যামেরার সামনে সব যেন সাজানো কমেডি। দর্শকরা হাততালি দিয়ে মেতে উঠল।
রিপোর্টার মাস্টারমশাইকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি তো সব একসাথে শেখাচ্ছেন—অংক, ইতিহাস, গান, নাচ। এটা কি কার্যকরী?”
বিষ্ণুপদবাবু বুক ফুলিয়ে উত্তর দিলেন, “কার্যকরী কেন নয়? দেখুন, এই বাচ্চারা ভয় পায় না, ক্লাসে হাসে। হাসি মানেই শিক্ষা মনে বসছে।”
এই সাক্ষাৎকার সম্প্রচারিত হতেই পাড়ায় সাড়া পড়ে গেল। টিভিতে দেখা যাচ্ছে চক্রবর্তী মশাইকে—হাততালি দেওয়া ছাত্রছাত্রীদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছেন, “আমি ভারতের সবচেয়ে ইনোভেটিভ শিক্ষক।”
পরদিন সকালেই চায়ের দোকানে আলোচনা শুরু।
“দ্যাখেছিস কাল টিভিতে? আমাদের পাড়ার মাস্টারমশাইকে দেখাচ্ছিল!”
“হ্যাঁ, আমি তো ভাবছিলাম বিদেশের কোনো প্রোগ্রাম।”
“বিদেশ কেন? এ তো আমাদের পাড়ার গ্যারেজঘর!”
অভিভাবকদের মধ্যে কেউ কেউ গর্বিত মুখে বললেন, “আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন টিভিতে আসছে।” আবার কেউ ভুরু কুঁচকে বললেন, “এতে পাশ করবে কি? নাকি নাচগানের সার্টিফিকেট পাবে?”
এই সবের মাঝেই মাস্টারমশাই নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন। তিনি ডায়েরিতে লিখলেন—
“শীঘ্রই আমি ‘অল–ইন–ওয়ান এডুকেশন একাডেমি’ খুলব। এখানে পড়াশোনা হবে উৎসবের মতো।”
এদিকে ছাত্রছাত্রীরাও উতলা হয়ে উঠল। জয় একদিন বলল, “স্যার, আমরা যদি আগামী মাসে একটা বার্ষিক অনুষ্ঠান করি? আমাদের পরিবার, প্রতিবেশী সবাই আসবে। আমরা মঞ্চে দেখাব অংক + গান + ইতিহাস।”
মাস্টারমশাই চোখ চকচক করে বললেন, “অসাধারণ! এটাই হবে আমার এডুকেশনের মহোৎসব।”
পাড়ায় খবর ছড়াল—মধুবন কলোনিতে হচ্ছে এক অভিনব অনুষ্ঠান। নাম দেওয়া হলো—“টিউশনের টর্নেডো ফেস্টিভ্যাল।”
কেউ ভাবছিল, এ একদিনেই চক্রবর্তী মশাইয়ের “বিশ্বসেরা শিক্ষক হওয়ার” স্বপ্ন পূর্ণ হতে চলেছে। আবার কেউ ফিসফিস করে বলল, “এই সার্কাসে যদি পোলাপান ফেইল করে, তখন কিন্তু খবরের কাগজে লেখা হবে—‘টর্নেডো সব উড়িয়ে নিল।’”
কিন্তু মাস্টারমশাই এসব কিছু পাত্তা দিলেন না। তিনি খালি ভাবলেন, “টিভি আসছে, কাগজ আসছে, এবার বিদেশও আসবে।”
পর্ব ৮
টিভিতে একবার মুখ দেখানোর পর থেকেই বিষ্ণুপদবাবুর মধ্যে যেন অন্য এক চক্রবর্তী জন্ম নিল। আগে যেখানে তিনি গ্যারেজঘরে হালকা গলায় গান গাইতেন বা বোর্ডে অদ্ভুত সমীকরণ লিখে মজা করতেন, এখন তিনি কথা বলছেন এমন ভঙ্গিতে যেন নোবেল পুরস্কারটা আগামী সপ্তাহেই তাঁর হাতে আসছে।
প্রথম পরিবর্তন হলো তাঁর পোশাকে। আগের সস্তা চেক শার্টের বদলে তিনি প্রতিদিন ঝকঝকে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে আসতে লাগলেন, কপালে চন্দনের টিপ, হাতে ঝকমকে ঘড়ি। ছাত্ররা একে অপরকে ইশারা করে বলত, “স্যার এখন সেলিব্রিটি।” জয় তো একদিন মজা করে খাতায় লিখল—“Celebrity Equation = চক্রবর্তী² + টিভি – সাধারণ শিক্ষক।”
দ্বিতীয় পরিবর্তন হলো ক্লাসে তাঁর বক্তৃতার ধরণ। আগে তিনি বোর্ডে অংক লিখে পাশেই গান ধরতেন। এখন ক্লাস শুরু হতেই দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেন—
“তোমরা জানো, আমি এখন আন্তর্জাতিক স্তরে আলোচিত। শিক্ষা আর বিনোদনের এই মডেল একদিন হার্ভার্ডে পড়ানো হবে। তোমরা আমার প্রথম ব্যাচ—গর্বিত হও।”
ছাত্রছাত্রীরা খিলখিলিয়ে হেসে উঠত, কিন্তু গম্ভীর হওয়ার ভান করত। কৌশিক একদিন গিটার টোকাতে টোকাতে ফিসফিস করে বলল, “আমরা তো হার্ভার্ডের বেসুরো গায়ক।”
এই অহংকারের ফাঁকে ছাত্ররা সুযোগ খুঁজে পেল আরও মজা করার। একদিন জয় ও মীরা মিলে “মীর জাফরের ভূতের সাক্ষাৎকার” নামে নাটক শুরু করে দিল। জয় চাদর জড়িয়ে ভুত সেজে ঢুকল, গম্ভীর গলায় বলল, “আমি সেই মীর জাফর, আজ বলব কিভাবে আমি x এর মান ০ করে দিলাম।”
মীরা ভুড়ি কাঁপিয়ে হেসে বলল, “স্যার, ইন্টারভিউ নিন না! বিদেশে গেলে এই ভিডিও বিক্রি হবে।”
ক্লাস তখন হাসিতে গর্জে উঠল।
বিষ্ণুপদবাবু একটু ভুরু কুঁচকে বললেও শেষে হাততালি দিলেন। তারপর বক্তৃতা দিলেন—
“এই যে নাটক, এটিই হলো ইতিহাসের জীবন্ত রূপ। আমি চাই প্রতিটি বিষয় নাটকে রূপান্তরিত হোক। এমনকি অংকও।”
কিন্তু অভিভাবকেরা এখন আরও চিন্তিত হয়ে উঠল। সোনালীর বাবা স্কুল থেকে রিপোর্ট কার্ড হাতে পেয়ে বললেন, “মেয়ে পরীক্ষায় লিখেছে—‘Simple Interest = গান শিখতে শিখতে সময় কেটে যাওয়া।’ নম্বর পেল শূন্য।”
জয়ের মা ফুঁপিয়ে বললেন, “আমার ছেলেটা ইতিহাসের কাগজে লিখেছে—‘১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ একধরনের integration।’ শিক্ষকরা মন্তব্য করেছে: ‘পাগলামি।’”
অভিভাবকেরা আবার মিলে মাস্টারমশাইয়ের কাছে গেলেন। এবার তাঁরা একেবারে রাগে ফেটে পড়লেন।
“চক্রবর্তী মশাই, আমাদের ছেলেমেয়েরা যদি এমন উত্তর লিখে ফেলতে থাকে, স্কুলে ফেল করবে।”
“আপনি তাদের মজা করতে শিখাচ্ছেন, পড়াশোনা নয়।”
কিন্তু বিষ্ণুপদবাবু শান্ত গলায় বললেন, “এখন যদি ফেল করে, ভবিষ্যতে জীবন জিতবে। কারণ তারা হাসতে শিখছে, সৃজনশীল হতে শিখছে। পাশ তো সবাই করে, কিন্তু আনন্দ নিয়ে শেখে কয়জন?”
অভিভাবকেরা হতাশ মুখে বেরিয়ে গেলেন। আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছাত্ররা ভেতরে ঢুকে মাস্টারকে ঘিরে ধরল। জয় বলল, “স্যার, আমরা যদি একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলি? নাম দেব ‘টিউশনের টর্নেডো’। এখানে আমরা আপনার সব ক্লাস আপলোড করব।”
বিষ্ণুপদবাবু উজ্জ্বল মুখে বললেন, “অসাধারণ! তখন তো সারা বিশ্ব দেখবে আমার শিক্ষা। আমি ভাইরাল হব।”
কৌশিক গিটার বাজিয়ে সঙ্গে সঙ্গে গান ধরল—
“চক্রবর্তী স্যার, ভাইরাল স্টার,
হার্ভার্ড ডাকছে, খুব দূরে আর নয়।”
সবাই হেসে গড়াগড়ি। কিন্তু মাস্টারমশাই একে সিরিয়াসলি নিয়ে ডায়েরিতে লিখলেন—
“আমার পরবর্তী ধাপ: ইউটিউব ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি।”
এদিকে স্কুল থেকে বারবার সতর্কবার্তা আসতে থাকল—ছাত্রদের অদ্ভুত উত্তর দেখে শিক্ষকরা অবাক। কিন্তু ছাত্ররা কিছুতেই টিউশনে যাওয়া বন্ধ করল না। কারণ, স্কুলে যেখানেই বিরক্তিকর চাপ, বিষ্ণুপদবাবুর ক্লাস মানেই উৎসব, হাসি আর কাণ্ডকারখানা।
এভাবেই মাস্টারমশাইয়ের অহংকার ও ছাত্রদের মজার পরিকল্পনা মিলিয়ে ক্লাস হয়ে উঠল একেবারে সার্কাস—যেখানে শিক্ষা আর কমেডির সীমারেখা মিলেমিশে একাকার।
পর্ব ৯
শীতকাল এসে পড়েছে। পাড়ার বাতাসে কাশফুলের গন্ধ, স্কুলে পরীক্ষার গন্ধ—আর মধুবন কলোনিতে বিষ্ণুপদবাবুর টিউশনের গন্ধ মানেই হাসাহাসি। কিন্তু এবার হাসির মাঝেই ঝড় জমতে শুরু করল। সামনে বোর্ড পরীক্ষা। কেউ অংক নিয়ে হাঁসফাঁস করছে, কেউ ইতিহাসে ঘাম ঝরাচ্ছে। এরই মাঝে ঠিক হলো স্থানীয় ক্লাবে বার্ষিক সঙ্গীত প্রতিযোগিতা আর স্কুল থেকে ঘোষণা এলো—ইতিহাস প্রোজেক্ট জমা দিতে হবে ওই একই সপ্তাহে।
ছাত্রছাত্রীরা দিশেহারা। তারা ভেবেছিল ক্লাসে মজা করে সব পার হয়ে যাবে, কিন্তু এবার তিনটে আলাদা ফ্রন্ট খুলে গেছে—অংকের বোর্ড পরীক্ষা, ইতিহাস প্রোজেক্ট, আর গানের প্রতিযোগিতা। আর মাস্টারমশাই কী বললেন জানো? তিনি বুক ফুলিয়ে ঘোষণা করলেন—
“চিন্তা নেই। এই তিনটেকে আমি একসাথে মিশিয়ে দেব। তোমরা এক ঢিলে তিন পাখি মারবে।”
ছাত্ররা হাঁ করে তাকাল। সোনালী বলল, “স্যার, একসাথে তিনটা মানে?”
বিষ্ণুপদবাবু বোর্ডে লিখলেন—
“Equation of Success = Board Exam + Project + Music Contest।”
তারপর বললেন, “অংকের সমাধান গানের সুরে হবে, ইতিহাসের প্রোজেক্ট হবে নাটকের মতো, আর প্রতিযোগিতায় আমরা গাইব পড়াশোনার গান।”
এরপর শুরু হলো এক অভিনব রিহার্সাল। জয় আর মীরা মিলে ইতিহাস প্রোজেক্ট বানাল—“১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের Integration।” জয় মীর জাফর সেজে ঢুকছে, মীরা নাটকীয় ভঙ্গিতে বলছে, “এই সমীকরণ ভেঙে দে।” খাতায় তারা সমীকরণ লিখে মঞ্চে নাচতেও লাগল।
অংকের পড়া নিয়েও অদ্ভুত কাণ্ড হলো। সোনালী একদিন চিৎকার করে উঠল—
“স্যার, Simple Interest মনে রাখতে গিয়ে আমি গেয়ে উঠেছি—P × R × T / 100 = গান।”
মাস্টার উজ্জ্বল চোখে বললেন, “বাহ! এটাই হলো বোর্ড পরীক্ষার জন্য তোমার সেরা প্রস্তুতি।”
কিন্তু সবচেয়ে বড় গোল বাঁধল সঙ্গীত প্রতিযোগিতায়। কৌশিক প্রস্তাব দিল, “আমরা প্রতিযোগিতায় গান গাইব—‘ax² + bx + c = 0’। এর চেয়ে সৃজনশীল গান আর কী হতে পারে!”
সবাই হাততালি দিয়ে সমর্থন করল।
প্রতিযোগিতার দিনে ক্লাব ঘর ভরা দর্শক। প্রথমে অন্য স্কুলের ছেলেমেয়েরা রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি গাইতে লাগল। সবাই গম্ভীর হয়ে শুনছে। এরপর মধুবন কলোনির টর্নেডো টিম মঞ্চে উঠল। সোনালী তাল দিয়ে শুরু করল—
“ax² + bx + c = শূন্য… শূন্য… শূন্য…”
জয় নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, “এটা যেমন প্লাসির যুদ্ধ, তেমনি সমীকরণের যুদ্ধে মীর জাফর।”
কৌশিক গিটার বাজিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সুর তুলল।
মঞ্চ তখন হাসির ঝড়। দর্শকরা প্রথমে হাঁ করে তাকিয়ে রইল, তারপর হেসে গড়িয়ে পড়ল। কেউ চিৎকার করল, “এটা গান না কমেডি?” কিন্তু হাততালি পড়ল অঝোরে।
ওদিকে স্কুলে ইতিহাস প্রোজেক্ট জমা দেওয়ার সময় হলো। মীরা ও জয় জমা দিল বিশাল একটা খাতা, নাম লিখল—“ইন্টিগ্রেশন অফ রেভলিউশন”। ভেতরে সমীকরণ আর নাটকের স্ক্রিপ্ট। ইতিহাসের শিক্ষক কপালে হাত দিয়ে বসে বললেন, “এ কী!” তবু অদ্ভুতভাবে হাসি চাপতে পারলেন না।
এদিকে বোর্ড পরীক্ষায় গণ্ডগোল পাকল আরও বেশি। সোনালী প্রশ্নপত্রে উত্তর লিখল—
“Compound Interest মানে, জীবনের আনন্দে মিশে যাওয়া।”
জয় লিখল—
“১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ ছিল integration-এর উদাহরণ।”
আর কৌশিক লিখল—
“Equation is music, music is life।”
ফল কী হলো বুঝতেই পারছ। নম্বর কম, শিক্ষক বিরক্ত, কিন্তু ছাত্রদের মাথায় দুঃখ নেই। কারণ ক্লাবের প্রতিযোগিতায় তারা “বিশেষ পুরস্কার” পেল—“সৃজনশীল উপস্থাপনা।”
অভিভাবকেরা এখন সত্যিই আতঙ্কিত। তারা বলছে, “এভাবে চললে ছেলে-মেয়েরা ফেল করবে।” আর মাস্টারমশাই তখনও আত্মবিশ্বাসে ভরপুর—
“ফেল নয়, ইতিহাস গড়বে। আজ নাচগান, কাল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।”
কিন্তু সবার ভেতরে ভেতরে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল—
“এই টর্নেডো শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামবে?”
পর্ব ১০
মধুবন কলোনির বাতাসে তখন চাপা উত্তেজনা। বোর্ড পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে, আর সেই খবর ছড়াতেই পাড়া সরগরম। সোনালী, জয়, মীরা—প্রায় সবাই কম নম্বর পেয়েছে। কেউ পাস করেছে কষ্টেসৃষ্টে, কেউ আবার ফেল করে মুখ গোমড়া করে বসে আছে। অভিভাবকেরা ক্ষেপে আগুন, কেউ সোজা মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির সামনে গিয়ে চিৎকার করে উঠল—
“চক্রবর্তী মশাই! আপনি আমাদের ছেলে-মেয়েদের জীবনটা শেষ করে দিলেন।”
“অংকের বদলে গান শিখিয়েছে, ইতিহাসের বদলে নাটক করিয়েছে—এটাই ফল!”
পাড়ার মধ্যে কানাঘুষো শুরু হলো। কেউ বলল, “মাস্টারমশাই সব শেষ করে দিলেন।” কেউ বলল, “না না, উনি আসলে বিনোদন দিচ্ছিলেন।”
এমন পরিস্থিতিতে মাস্টারমশাই একেবারেই হাল ছাড়লেন না। উল্টে সবাইকে ডাকলেন গ্যারেজঘরে, ঘোষণা করলেন—
“আজ হবে আমাদের সমাপনী অনুষ্ঠান। বোর্ডের রেজাল্ট দিয়ে শিক্ষা মাপা যায় না। আমি প্রমাণ করব, আমরা হেরেও জিতেছি।”
সন্ধ্যায় ক্লাসরুম ভর্তি ভিড়। ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক, প্রতিবেশী, এমনকি খবরের কাগজের সাংবাদিকও এসে বসেছে। মাস্টারমশাই উঠে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
“হয়তো নম্বর কম এসেছে, হয়তো পাশ হয়নি। কিন্তু এই টিউশনে তোমরা পেয়েছ এক জিনিস—আনন্দ। পড়া মানে ভয় নয়, পড়া মানে হাসি। আর হাসি মানে জীবন।”
তারপর শুরু হলো আসল শো। জয় আর মীরা আবার নাটক করল—“মীর জাফর ও সমীকরণের বিশ্বাসঘাতকতা।” সোনালী গাইল—“ax² + bx + c = শূন্য”—দর্শকরা হাততালি দিয়ে উঠল। কৌশিক গিটার বাজিয়ে ঘোষণা করল, “এই গান বোর্ডে ফেল করালেও পাড়ার মনে জয় আনল।”
প্রথমে অভিভাবকেরা চুপচাপ বসে ছিলেন। কিন্তু আস্তে আস্তে তাঁরাও হাসতে শুরু করলেন। সাংবাদিক খাতায় লিখে রাখল—“মধুবন কলোনির গ্যারেজঘরে হাসির ঝড়।”
অনুষ্ঠানের শেষে সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিল—
“আমরা পড়ব, নাচব, গাইব—একসাথে হাসব!”
অভিভাবকেরা হয়তো এখনও চিন্তিত, কিন্তু একথা মানতে হলো—তাদের ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনায় দুর্বল হলেও আনন্দে ভরপুর। পাড়ার লোকজন মজা করে নাম দিল—“এন্টারটেইনমেন্ট মাস্টার।”
মাস্টারমশাই গর্বে চোখ মুছে বললেন,
“যদি পাশ না-ও করে, অন্তত হাসতে শিখল। হাসিই হলো আসল শিক্ষা।”
আর সেদিন থেকে মধুবন কলোনির গলি জুড়ে একটা কথা শোনা গেল—
“বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী? উনি শিক্ষক নন, উনি টর্নেডো। যার ঘূর্ণিতে সবাই হাসে, সবাই বাঁচে।”
শেষ পর্যন্ত বোর্ডের রেজাল্টে ফেল হোক বা পাস, মাস্টারমশাইয়ের টিউশন চিরকাল মনে থাকবে একটাই নামে—
“টিউশনের টর্নেডো।”
				
	

	


