আরিফ রহমান
পর্ব ১: কাবুলের ধ্বংসস্তূপে জন্ম
বাতাসে ধুলো আর বারুদের গন্ধ মিশে ছিল। কাবুল শহরের ভাঙাচোরা ইট, অর্ধেক গুঁড়িয়ে যাওয়া মসজিদ আর অগ্নিদগ্ধ গলিপথ যেন যুদ্ধের পরও যুদ্ধের গল্প শুনিয়ে যাচ্ছিল। একসময় যেসব পথে শিশুরা হেসে খেলত, সেসব গলিতে এখন কেবল বুটের শব্দ আর ভয়ে কাঁপতে থাকা মানুষের নিশ্বাস। যুদ্ধ এখানে কোনো সংবাদপত্রের শিরোনাম নয়—এখানে যুদ্ধ ছিল দৈনন্দিন জীবন।
সে ভাঙাচোরা গলির এক অন্ধকার কোণে, জন্ম নিল এক শিশু। জন্মের সময় তার চারপাশে কোনো আনন্দ ছিল না, বরং চারদিকে বেজে উঠেছিল কামানের গর্জন। মায়ের রক্তাক্ত শরীর, আতঙ্কিত চোখ—সেই ছিল শিশুটির প্রথম পৃথিবী দেখা। নাম রাখা হলো ইমরান। তার জন্ম যেন ভাগ্যের এক নির্মম ইঙ্গিত—যে শহর রক্তে ডুবে আছে, সেই শহরের সন্তানও হয়তো একদিন রক্তের উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে চলবে।
ইমরানের বাবা এক সাধারণ দর্জি ছিলেন। যুদ্ধের ভয়ংকর সময়ে তিনি চেষ্টা করেছিলেন পরিবারটিকে রক্ষা করার, কিন্তু তার সেলাই মেশিন বাঁচাতে পারেনি ক্ষুধা আর গোলাগুলির আঘাত। এক রাতে, যখন মার্কেটের ধ্বংসস্তূপ থেকে ভাত আর আটা নিয়ে ফিরছিলেন, তখন এক বোমা বিস্ফোরণে তিনি আর ফিরে এলেন না। ইমরান তখন মাত্র পাঁচ বছরের। সেই রাত থেকেই তার শৈশব ভেঙে পড়ল। মায়ের কোল একমাত্র আশ্রয় হয়ে রইল, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে আশ্রয়ও প্রায়ই ভেঙে যায়।
বছরের পর বছর চলল লড়াই, আর ইমরানের চোখে ভরল ক্ষুধা, শোক আর আগুন। স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। কাবুলের স্কুলগুলো একে একে ভেঙে পড়ছিল বিস্ফোরণে, আর শিক্ষকরা হয় মারা যাচ্ছিলেন, নয়তো পালিয়ে যাচ্ছিলেন। ইমরান জানল, এই পৃথিবীতে অক্ষর শেখার থেকে অস্ত্র ধরাটা সহজতর। আশেপাশের বড় ছেলেরা কালাশনিকভ হাতে রাস্তার মোড়ে দাঁড়াত, তারা খাবার পেতো, টাকা পেতো, আর মানুষ তাদের ভয় করত। একদিন সেই ছেলেদের একজন ইমরানকে বলল,
— “তুমি ক্ষুধায় মরছ কেন? আমাদের সাথে এসো, আমরা তোমাকে খাওয়াবো, বন্দুক দেবো, আর আল্লাহর জন্য লড়াই শিখিয়ে দেবো।”
শিশু ইমরান তখনও বুঝতে পারেনি ধর্মের নামে লড়াই কাকে বলে। কিন্তু ক্ষুধার যন্ত্রণা আর নিঃসঙ্গতার ভয় তাকে ঠেলে দিল সেই পথে। মা প্রথমে আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন। তার চোখে ছিল অজস্র কান্না, তিনি বলেছিলেন—
— “ইমরান, বন্দুকের পথ শুধু মৃত্যু আনে। তোমার বাবার মতোই একদিন তুমি হারিয়ে যাবে।”
কিন্তু ক্ষুধা আর রক্তাক্ত পরিবেশের চাপে মায়ের কথার ওজন কমে গিয়েছিল। এক ভোরে, যখন মায়ের চোখ ঝাপসা, তখন ইমরান পালিয়ে গেল শহরের বাইরে এক গোপন ক্যাম্পে। সেখানে তাকে স্বাগত জানাল একদল মানুষ, যারা নিজেদের বলত মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু তাদের চোখের গভীরে লুকিয়ে ছিল অন্ধকার।
ক্যাম্পে শুরু হলো তার নতুন জীবন। প্রতিদিন ভোরে অস্ত্র হাতে দৌড়ানো, গুলি ছোড়ার প্রশিক্ষণ, আর ধর্মের নামে উগ্র বক্তৃতা। তারা বলত—
— “তুমি শহীদ হবে, তোমার রক্তে এই মাটি পবিত্র হবে। পশ্চিমাদের শত্রুতার জবাব দিতে হবে।”
ইমরানের কিশোর মনের মধ্যে ঘৃণার বীজ বপন করা হচ্ছিল। যে শিশুটি একসময় খেলনার জন্য কাঁদত, সে এখন হাতে গ্রেনেড নিয়ে খেলা শিখল। যে কণ্ঠ একসময় মায়ের ল lullaby শুনত, সেই কণ্ঠে ভরে উঠল জিহাদের স্লোগান।
তবুও রাতের অন্ধকারে যখন ঘুম আসত না, তখন তার মনে পড়ত মায়ের চোখে জমে থাকা কান্না। ক্যাম্পের অন্যান্য ছেলেদের মতোই সেও কখনও চুপচাপ কাঁদত কম্বলের নিচে। কিন্তু ভোর হলেই আবার কঠোর প্রশিক্ষণ তাকে ভেতর থেকে বদলে দিতে শুরু করত।
ইমরান কেবল একা নয়। কাবুলের মতো শহরে এমন শত শত ছেলে জন্ম নিচ্ছিল প্রতিদিন—যাদের শৈশব কেড়ে নিয়েছিল যুদ্ধ, আর যাদের হাতে বন্দুক তুলে দিচ্ছিল এক অদৃশ্য সাম্রাজ্য। তারা ছড়িয়ে পড়ছিল, সীমান্ত পেরিয়ে, মরুভূমি পেরিয়ে, নতুন নতুন শহরে। কারো নাম ছিল ইউসুফ, কারো নাম ওমর, কারো নাম আখতার। তারা সবাই ছিল ছায়ার সন্তান, জন্ম থেকেই যাদের ভাগ্যে লেখা ছিল রক্ত।
বছর পেরিয়ে ইমরান হলো যুবক। তার চোখে তখন আর ভয় ছিল না, বরং ছিল এক অদ্ভুত দহন। সে জানত, শহরের ভাঙা দেয়ালের বাইরে এক বিশাল দুনিয়া আছে। সেই দুনিয়ায় উঁচু টাওয়ার, উজ্জ্বল আলো, বড় বড় বাজার। আর তাদের নেতারা প্রতিদিন বলত—
— “ওই দুনিয়াই শত্রু। তারা তোমাদের শৈশব কেড়েছে। তাদের রক্ত দিয়ে প্রতিশোধ নিতে হবে।”
ইমরান ভাবত, প্রতিশোধই হয়তো তার জীবনের একমাত্র মানে। যে শিশু ক্ষুধায় কেঁদেছিল, সেই যুবক এখন শিখেছে কীভাবে ভয় দেখাতে হয়। তার হাতের বন্দুকই তার পরিচয়।
কিন্তু এই গল্প শুধু ইমরানের নয়। আফগানিস্তানের পাহাড় থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমি পর্যন্ত এমন হাজারো ইমরানের জন্ম হচ্ছিল। প্রতিটি জন্ম যেন পৃথিবীর বুকে নতুন এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। আর এই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ একদিন ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।
কাবুলের ধ্বংসস্তূপে জন্ম নেওয়া এক শিশুর গল্পই তাই হয়ে উঠবে ছায়ার সাম্রাজ্যের সূচনা—যেখানে শৈশব নেই, কেবল আছে রক্তের উত্তরাধিকার।
পর্ব ২: নিউ ইয়র্কের আতঙ্কের ছায়া
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহর—বিশ্বের এক ব্যস্ততম মহানগরী। আকাশচুম্বী ভবনগুলো যেন মেঘ ছুঁতে চায়, আর রাস্তাগুলোতে প্রতিদিন ছুটে চলে লাখো মানুষ। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত এই শহর জেগে থাকে, যেন ঘুম এখানে অপরাধ। নানা জাতি, নানা ভাষা, নানা সংস্কৃতির ভিড় মিশে যায় এক স্রোতে। পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষের কাছে নিউ ইয়র্ক মানে স্বপ্ন, স্বাধীনতা আর সুযোগের আরেক নাম। কিন্তু স্বপ্নের শহরও মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্নের আঁধারে ঢেকে যায়।
ইমরান, যে কাবুলের ধ্বংসস্তূপে জন্ম নিয়েছিল, এখন আর শিশু নয়। কয়েক বছরের প্রশিক্ষণে সে হয়ে উঠেছে এক কঠোর, শীতল যুবক। সংগঠনের নেতারা তাকে পাঠিয়েছে পাকিস্তানের সীমান্ত থেকে মধ্যপ্রাচ্যের গোপন শিবিরে। সেখানেই তাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল বিশেষ এক অভিযানের জন্য। প্রশিক্ষকরা বলেছিল—
— “তুমি এখন ছায়ার সৈনিক। তোমার নাম হয়তো দুনিয়া জানবে না, কিন্তু তোমার কাজ চিরকাল মনে রাখবে। শত্রুর হৃদয়ে ভয় ঢুকিয়ে দিতে হবে।”
সে শত্রু আর কেউ নয়, আমেরিকা—যে দেশকে তাদের নেতা অভিশাপ দিতেন প্রতিটি ভাষণে। ইমরান প্রথমবারের মতো শুনল নিউ ইয়র্কের নাম, শুনল ওখানকার টাওয়ার, ব্রিজ আর সাবওয়ের কথা। তখন থেকেই তার মনে আঁকা হলো এক অদ্ভুত মানচিত্র।
অভিযানের প্রস্তুতি দীর্ঘ ছিল। ভুয়া পরিচয় তৈরি করা হলো, পাসপোর্ট আর ভিসা জোগাড় হলো ভিন্ন চ্যানেলে। সংগঠনের নেটওয়ার্ক এতটাই বিস্তৃত ছিল যে সীমান্ত পার হওয়া আর তেমন কঠিন মনে হলো না। একদিন ভোরে, বিমানে চেপে ইমরান পা রাখল আমেরিকার মাটিতে। তার ভেতরে একদিকে ছিল বিস্ময়, অন্যদিকে দমন করা ঘৃণা।
নিউ ইয়র্কে পৌঁছে প্রথম যে জিনিসটি তাকে আঘাত করল, তা হলো শহরের আলো। রাতে গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে সে দেখল রঙিন আলোতে মোড়া আকাশচুম্বী ভবন। এই শহরে যেন ক্ষুধা নেই, যুদ্ধ নেই, ধ্বংস নেই। কিন্তু সংগঠনের কথাগুলো তার মনে বাজতে থাকল—
— “এই আলোই তোমাদের শৈশব কেড়েছে। এই সমৃদ্ধিই তোমাদের রক্তের দায়ী।”
সে কয়েকদিন শহরটা পর্যবেক্ষণ করল। প্রতিদিন সকালে হাজার হাজার মানুষ সাবওয়ে দিয়ে কাজে যাচ্ছে, স্কুলে যাচ্ছে বাচ্চারা, পর্যটকেরা ছবি তুলছে টাইমস স্কোয়ারে। মানুষগুলো নির্ভার, মুক্ত। অথচ ইমরানের চোখে তারা শত্রু, কারণ তাকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের ঘৃণা করতে।
সে একদিন দাঁড়াল হাডসন নদীর ধারে। নদীর ওপারে দেখা যাচ্ছিল স্ট্যাচু অফ লিবার্টি। বুকের মধ্যে যেন কিছু একটার ধাক্কা খেল। কাবুলে তার মা বলেছিলেন স্বাধীনতার কথা, বলেছিলেন,
— “স্বাধীন মানে কারো ক্ষতি না করে নিজের জীবন বাঁচানো।”
কিন্তু সংগঠন তাকে শেখাল ভিন্ন সংজ্ঞা—স্বাধীনতা মানে প্রতিশোধ নেওয়ার অধিকার।
কয়েক সপ্তাহ ধরে ইমরান পরিকল্পনা করল তার কাজ। নিউ ইয়র্কের অগণিত মানুষের মধ্যে মিশে যাওয়া সহজ ছিল। সে সস্তা একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিল কুইন্সে। পাশের বাসিন্দারা তাকে দেখত এক সাধারণ অভিবাসী হিসেবে, যে হয়তো ট্যাক্সি চালায় বা কোনো দোকানে কাজ করে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে ছিল ছায়ার সৈনিক, যার ব্যাগের ভেতরে লুকিয়ে আছে মানচিত্র আর কাগজপত্র।
কাজের জন্য সে পরিচিত হলো আরেকজনের সাথে—ইউসুফ। ইউসুফ আসলে মধ্যপ্রাচ্যেরই আরেক যুবক, সংগঠনের আরেকটি সেল থেকে পাঠানো। তারা দু’জন মিলে প্রতিদিন ছোট ছোট পরিকল্পনা করত। সাবওয়ের কোন স্টেশন সবচেয়ে ভিড় হয়, কোন রাস্তায় পুলিশ টহল কম, কোথায় বিস্ফোরণ ঘটালে আতঙ্ক ছড়াবে—সব খুঁটিনাটি খেয়াল করত।
এক রাতে, ইউসুফ ইমরানকে জিজ্ঞেস করল,
— “তুমি কি কখনও ভয় পাও? এত বড় শহরে এত মানুষের সামনে যদি ধরা পড়ো?”
ইমরান ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল,
— “ভয় জন্মের সময়ই মরে গেছে। যখন বাবার শরীর খুঁজে পাইনি ধ্বংসস্তূপের নিচে, তখনই বুঝেছিলাম ভয় মানে কিছু নেই। কেবল প্রতিশোধ আছে।”
তবুও ইমরানের মনের গভীরে দ্বন্দ্ব চলছিল। দিনে সে শহরের উজ্জ্বল দুনিয়া দেখত—একটি রেস্টুরেন্টে হাসতে হাসতে খাচ্ছে পরিবার, রাস্তায় দাঁড়িয়ে বেহালা বাজাচ্ছে এক বৃদ্ধ, আরেক প্রান্তে শিশুরা খেলার মাঠে দৌড়াচ্ছে। এই দৃশ্যগুলো তাকে মনে করিয়ে দিত, হয়তো এই মানুষগুলোর কোনো দোষ নেই। কিন্তু রাত হলেই সংগঠনের শপথ তার মাথার ভেতর আগুন জ্বালিয়ে দিত।
অবশেষে দিনটি এল। ইউসুফ আর ইমরান দু’জনেই প্রস্তুত। পরিকল্পনা ছিল সাবওয়ের ভিড়পূর্ণ একটি লাইনে বিস্ফোরণ ঘটানো। একসাথে শত শত মানুষ মরবে, শহর আতঙ্কে থরথর করে উঠবে, আর দুনিয়া জানবে ছায়ার সাম্রাজ্যের নাম। তাদের হাতে দেওয়া হলো বিস্ফোরক ভর্তি ব্যাগ।
সকালবেলা, হাজার হাজার মানুষের সাথে ভিড় করে তারা নামল স্টেশনে। ইমরানের বুক ধকধক করছে। সে ব্যাগ শক্ত করে ধরে আছে, যেন সেই ব্যাগেই তার জীবনের শেষ সিদ্ধান্ত লুকিয়ে আছে। সামনে ছোট্ট একটি ছেলে বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়েছে, স্কুলের ব্যাগ ঝোলানো। সেই দৃশ্য দেখে হঠাৎ তার মনে পড়ল নিজের শৈশবের কথা—যে শৈশব সে কখনও পায়নি।
হঠাৎ যেন তার ভেতর থেকে একটি কণ্ঠ উঠল,
— “এই শিশুটি তো তোমার মতোই। তুমি যদি তাকে মেরে ফেলো, তাহলে পার্থক্য কী থাকবে তাদের সাথে, যারা তোমার বাবাকে হত্যা করেছিল?”
ইমরান থমকে গেল। ইউসুফ তার দিকে তাকাল, ইশারা করল—“এখনই সময়।” কিন্তু ইমরানের হাত কাঁপছে। ব্যাগের চেইন খুলতে পারছে না। তার মনে হলো, যদি এই মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটে, তবে শুধু এই শহর নয়, তার মায়ের স্মৃতিও চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাবে।
ঠিক তখনই, এক পুলিশ অফিসার সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকাল। ইউসুফ আতঙ্কে এগিয়ে গেল ট্রেনের দিকে। ইমরান দাঁড়িয়েই রইল। এক মুহূর্তে সব বদলে গেল—পুলিশ ছুটে এল, যাত্রীদের মধ্যে হইচই শুরু হলো, ইউসুফের হাতে ধরা ব্যাগ ফেটে গেল আগুনে। বিস্ফোরণ ঘটল, কিন্তু পুরোটা নয়। আংশিক বিস্ফোরণে কয়েকজন আহত হলো, স্টেশনে ধোঁয়া ছড়িয়ে গেল, আর ইউসুফ দগ্ধ শরীর নিয়ে মাটিতে পড়ে গেল।
ইমরান স্থির দাঁড়িয়ে রইল। চারদিকে আতঙ্ক, চিৎকার, পুলিশি সাইরেন। তার হাতে তখনও ব্যাগটি অক্ষত। তার চোখে ভাসছিল মায়ের মুখ। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করল, কিন্তু তার ভেতরের ঝড় থামল না।
সেই মুহূর্তে ইমরান বুঝল—সে কি আসলেই প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল, নাকি সে কেবল এক ছায়ার খেলনা ছিল?
পর্ব ৩: প্যারিসের অন্ধকার রাত
প্যারিস—ভালোবাসার শহর, আলো আর শিল্পের শহর। সেন নদীর ধারে ঝলমলে ক্যাফে, আইফেল টাওয়ারের আলো, ল্যুভরে জমে থাকা ইতিহাস—সব মিলিয়ে শহরটা যেন স্বপ্নের ক্যানভাস। পর্যটকেরা দিনে যেমন ভিড় জমায়, রাতে তেমনি শহরটিকে জাগিয়ে রাখে হাসি, গান আর ওয়াইনের গ্লাস। কিন্তু এই উজ্জ্বল আলোর নিচে অনেক সময় অদৃশ্য ছায়া নড়ে ওঠে, যা কোনো উৎসব নয়, বরং মৃত্যুর দূত।
ইমরান নিউ ইয়র্কের ঘটনার পর মার্কিন পুলিশের হাতে বন্দি হয়েছিল। তবে সংগঠনের নেটওয়ার্ক এতটা গভীর ছিল যে তাকে চুপিসারে মুক্ত করার পথ খুঁজে নেওয়া হলো। আন্তর্জাতিক আইনজালের ফাঁক-ফোকর আর ঘুষের টাকার খেলায় একদিন সে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল কারাগার থেকে। পশ্চিমা মিডিয়া তখন উত্তপ্ত—“এক জঙ্গি কীভাবে পালাল?”—কিন্তু প্রকৃত উত্তর কেউ জানল না।
কয়েক মাস পর, ইমরানকে দেখা গেল ইউরোপের আরেক কোণে—প্যারিসে। এবার তার সাথে ছিল আরও দুইজন—হামিদ আর খালেদ। দু’জনেই সিরিয়ার মরুভূমির ক্যাম্প থেকে আসা প্রশিক্ষিত যোদ্ধা। সংগঠনের নতুন পরিকল্পনা ছিল ইউরোপের কেন্দ্রস্থলেই আতঙ্ক ছড়ানো। আমেরিকা দূরের লক্ষ্য, কিন্তু ইউরোপ—এখানে আঘাত করলে বার্তা আরও দ্রুত পৌঁছে যাবে।
তাদের লক্ষ্য ছিল শহরের প্রাণকেন্দ্র। একটি কনসার্ট হলে সেদিন রাতেই হাজার হাজার মানুষ গাইবে, নাচবে, সঙ্গীতে মাতবে। সংগঠন চেয়েছিল, সেই আনন্দকে মুহূর্তে রক্তে ডুবিয়ে দিতে।
রাতটা ছিল নভেম্বরের ঠান্ডা। আইফেল টাওয়ারের আলো ঝিকমিক করছে, চারদিকে উৎসবের আমেজ। ইমরানরা তিনজন আলাদা আলাদা পথে কনসার্ট হলের দিকে এগোল। প্রত্যেকের হাতে ছোট ছোট অস্ত্র আর বিস্ফোরক। তাদের চোখে ছিল শুধু শপথ—“আজ রাতে ইউরোপ কাঁপবে।”
কনসার্ট হলের দরজা দিয়ে ঢুকতে গিয়ে ইমরানের বুকের ভেতর হঠাৎ আবার সেই অদ্ভুত কাঁপুনি জাগল। নিউ ইয়র্কের সাবওয়ে স্টেশনে দাঁড়ানো ছোট্ট ছেলেটির চোখ এখনও তাকে তাড়া করে। সে ভেতরে ঢোকার আগে এক মুহূর্তের জন্য থমকাল। কিন্তু খালেদ ফিসফিস করে বলল,
— “ভাই, পিছিয়ে যেও না। এটা আল্লাহর কাজ।”
ইমরান নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। তারা তিনজন মিশে গেল মানুষের ভিড়ে। মঞ্চে তখন এক ফরাসি ব্যান্ড বাজাচ্ছে জোরালো গান, হাজার হাজার মানুষ হাততালি দিচ্ছে, নাচছে। হল ভরে গেছে আলো আর শব্দে। অথচ তিনটি ছায়া ভিড়ের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর তাদের ব্যাগে লুকানো আছে মৃত্যুর সংকেত।
হঠাৎই শুরু হলো আতঙ্কের খেলা। প্রথমে খালেদ ট্রিগার টিপল। ভিড়ের একপ্রান্তে বিস্ফোরণ ঘটল। মুহূর্তেই চিৎকার, দৌড়ঝাঁপ, ধোঁয়া আর রক্তে ভরে গেল হল। মানুষ বুঝতেই পারল না, গান শেষ হলো না, কিন্তু জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে। হামিদ গুলি চালাতে শুরু করল, অন্ধকারে ভয়ংকর প্রতিধ্বনি।
ইমরানও অস্ত্র বের করল। কিন্তু ট্রিগার টিপতে গিয়ে তার চোখে ভেসে উঠল দর্শকদের আতঙ্কিত মুখ। এক মেয়ে বাবার হাত ধরে কান্না করছে, এক যুবক তার প্রেয়সীকে আড়াল করছে নিজের শরীর দিয়ে। ইমরান থমকে গেল। হাতে অস্ত্র, কিন্তু হৃদয়ে দ্বন্দ্ব।
খালেদ চিৎকার করল,
— “কি করছো? গুলি চালাও!”
কিন্তু ইমরান তাকাল মঞ্চের দিকে। ব্যান্ডের একজন সঙ্গীতশিল্পী আতঙ্কে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তার চোখে মৃত্যুভয় নয়—বরং অসহায়তা। সেই দৃষ্টিতে ইমরান যেন আবার নিজের মাকে দেখল—ধ্বংসস্তূপের নিচে কাঁদা মায়ের চোখ।
তার হাত কাঁপতে লাগল। গুলি চলল না। ঠিক তখনই পুলিশ এসে গেল চারদিক ঘিরে। খালেদ শেষ মুহূর্তে বিস্ফোরক ফাটিয়ে দিল নিজের শরীরে, হামিদও গুলিতে মারা গেল। কিন্তু ইমরান—সে অস্ত্র নামিয়ে দিল।
পুলিশ তাকে মাটিতে ফেলে দিল, হাতকড়া পরাল। সাংবাদিকদের ক্যামেরার আলো ঝলসে উঠল, বিশ্ব জানল, “প্যারিসে ভয়াবহ হামলা, শতাধিক নিহত।” খবরের মধ্যে ইমরানের মুখও ধরা পড়ল—এক তরুণ, যে হয়তো গুলি চালাতে পারত, কিন্তু শেষমুহূর্তে থেমে গেল।
জিজ্ঞাসাবাদে ফরাসি গোয়েন্দারা তাকে প্রশ্ন করল,
— “তুমি কেন গুলি চালাওনি?”
ইমরান নিঃশব্দে বলল,
— “কারণ আমি তাদের চোখে আমার শৈশবকে দেখেছিলাম।”
প্যারিসের সেই রাত রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল। বিশ্ব আবার কেঁপে উঠল। কিন্তু একইসাথে প্রশ্ন উঠল—এক জঙ্গি কেন নিজের পরিকল্পনা ভাঙল? কারও কাছে সে ছিল কাপুরুষ, কারও কাছে হয়তো অনুশোচনায় জর্জরিত একজন মানুষ।
কিন্তু সংগঠন? তারা ইমরানকে বিশ্বাসঘাতক বলে ঘোষণা করল। প্যারিসের খবর পৌঁছানোর সাথে সাথেই মরুভূমির সেই নেতারা বলল—“সে শহীদ নয়, সে ভীরু।” আর সেই মুহূর্তে ইমরান বুঝল—সে আর সংগঠনের সৈনিক নয়, বরং তাদের লক্ষ্যবস্তু।
কারাগারের অন্ধকার সেলে বসে ইমরান জানল, ছায়ার সাম্রাজ্য শুধু বাইরের পৃথিবী নয়, তার ভেতরেও গভীরভাবে ছড়িয়ে গেছে। সে কি মুক্ত হতে পারবে? নাকি এই অন্ধকারই একদিন পুরো পৃথিবীকে গ্রাস করবে?
পর্ব ৪: ঢাকার সীমানায় লুকিয়ে থাকা ছায়া
ঢাকা শহর—অগণিত মানুষের ভিড়, যানজটের হর্ন, রাস্তার ধারে ভাজাভুজির গন্ধ, আর গলির ভেতর ভিড় করে থাকা জীবনের উচ্ছ্বাস। দিনে এই শহর থাকে ক্লান্তির বোঝায় ভারী, আর রাতে আলোয় ভরে ওঠে নতুন প্রাণে। কিন্তু এই কোলাহলের ভেতরেও কখনও কখনও এমন কিছু ছায়া ঘুরে বেড়ায়, যাদের চোখে আলো নেই, আছে কেবল অন্ধকার।
প্যারিস হামলার পর ইমরানকে ফরাসি গোয়েন্দারা বন্দি করেছিল। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম দিনরাত তার ছবি ছাপাচ্ছিল। সংগঠন তাকে বিশ্বাসঘাতক ঘোষণা করল। অথচ এক রাতে রহস্যজনকভাবে সে অদৃশ্য হয়ে গেল সেলের ভেতর থেকে। কারা তাকে বের করে নিল—ফরাসি গোয়েন্দারা তা জানল না। অনেকেই বলল, হয়তো কোনো ভেতরের হাত মিলেছিল, হয়তো আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের লম্বা ছায়া।
কয়েক মাস পর, দক্ষিণ এশিয়ার এক ছোট ফ্ল্যাটে, ঢাকা শহরের গোপন এক গলিতে, আবার দেখা গেল ইমরানকে। এবার তার চারপাশে এক নতুন দল। নাম প্রকাশ না করা এক সংগঠন, যারা দাবি করত—“আমরাই খাঁটি বিশ্বাসী, আমরা আল্লাহর সৈনিক।”
এই সংগঠনের কার্যক্রম লুকিয়ে থাকত শহরের ভেতরে। ছাত্রাবাস, মাদ্রাসা, এমনকি শহরের কিছু সাধারণ ব্যবসার আড়ালেও তাদের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে ছিল। ইমরানকে রাখা হয়েছিল নিরাপদ আশ্রয়ে, কারণ সংগঠন এখনও তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে না। প্যারিসে তার দ্বিধা তাদের মনে সন্দেহ জাগিয়েছিল।
ঢাকার কোলাহল ইমরানকে প্রথমে অচেনা মনে হলো। কাবুলের ধ্বংসস্তূপ, নিউ ইয়র্কের আকাশচুম্বী দালান, প্যারিসের শিল্পের শহরের পর এই ভিড়ভাট্টা আর ধুলোবালির ঢাকা যেন সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে দারিদ্র্য আর ঐশ্বর্য পাশাপাশি হাঁটে। রিকশাচালকরা ঘামে ভিজে রাস্তা পেরিয়ে যায়, আবার কয়েক মাইল দূরে ঝলমলে রেস্টুরেন্টে বিদেশি খাবারের আসর বসে।
এই বৈপরীত্যের ভেতরেই কাজ করত সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক। তারা জানত, হতাশ তরুণ, যারা দারিদ্র্যের শৃঙ্খলে বন্দি, তাদের ভেতর সহজেই ঘৃণার বীজ বপন করা যায়। ধর্মের মোড়কে সেই ঘৃণাকে পবিত্র যুদ্ধের রূপ দেওয়া যায়।
এক সন্ধ্যায় সংগঠনের নেতা, একজন কঠোর দাড়িওয়ালা লোক, ইমরানকে বলল—
— “তোমার নাম আমরা জানি। তোমার অতীত আমরা জানি। তুমি হয়তো প্যারিসে দ্বিধা করেছিলে, কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, তুমি এখনও কাজে লাগতে পারো। ঢাকায় আমাদের বড় পরিকল্পনা আছে।”
ইমরান চুপচাপ বসে রইল। তার চোখে তখনও নিউ ইয়র্কের সাবওয়ে স্টেশনের সেই শিশুর মুখ ভাসছিল। কিন্তু সে জানত, যদি আবার দ্বিধা করে, তবে এবার তার বেঁচে থাকার সুযোগ থাকবে না।
পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে ইমরান দেখল ঢাকার আন্ডারগ্রাউন্ড জগতকে। সংগঠন নতুন ছেলেদের সংগ্রহ করত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কেউ পড়াশোনায় ব্যর্থ, কেউ পরিবারে অবহেলিত, কেউবা শুধু রোমাঞ্চ খুঁজত। তাদের দেখানো হতো ভিডিও—যুদ্ধক্ষেত্রের, নিরীহ মানুষের হত্যার, আর বিদেশি সেনাদের আক্রমণের ছবি। বলা হতো—“দেখো, তারা মুসলিমদের উপর কী অত্যাচার করছে। তোমাদের রক্তের দায়িত্ব এখন তোমাদেরই নিতে হবে।”
ইমরান লক্ষ্য করল, এই তরুণদের চোখে ক্ষোভ জমছে, কিন্তু সেই ক্ষোভের দিকনির্দেশনা নেই। সংগঠন সেই ক্ষোভকে বন্দুক ধরিয়ে দিচ্ছে।
এক রাতে গোপন বৈঠকে পরিকল্পনা হলো—ঢাকায় বড় ধরনের আক্রমণ। লক্ষ্য একটি অভিজাত রেস্টুরেন্ট, যেখানে বিদেশিরা প্রায়ই খেতে আসে। তাদের হত্যা করলে বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক ছড়াবে, আর সংগঠনের নাম আবার আলোচনায় আসবে।
নেতা বলল,
— “এই কাজ হবে আমাদের শহীদির দীক্ষা। বিশ্ব দেখবে, আমরাও আছি।”
ইমরানের বুক ধকধক করতে লাগল। এই পরিকল্পনা তাকে মনে করিয়ে দিল প্যারিসের সেই রাত। আবারো নিরীহ মানুষের মৃত্যু, আবারো রক্ত। কিন্তু এবার সে জানে, যদি থামে, তবে আর কোনো পথ খোলা থাকবে না।
ঘটনার আগের রাতে, এক নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত তরুণ ছেলেটি তার কাছে এসে বলল,
— “ভাই, আমি ভয় পাচ্ছি। আমি তো কখনো বন্দুক ধরিনি। আল্লাহ কি আমাকে ক্ষমা করবেন?”
ইমরান ছেলেটির চোখে তাকাল। সেই চোখে সে নিজের ছেলেবেলার প্রতিবিম্ব দেখল—ক্ষুধার্ত, ভীত, দিশেহারা। সে বলল না কিছু, শুধু কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ফিসফিস করল—
— “ভয় মানে এখনও তুমি মানুষ আছো।”
পরদিন সন্ধ্যা। শহরের এক প্রান্তে আলো ঝলমল করছে, বিদেশি কূটনীতিকরা বসেছেন সেই অভিজাত রেস্টুরেন্টে। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ইমরান আর তার দল। তাদের হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, ব্যাগভর্তি গ্রেনেড। শুধু এক ইশারায় পুরো শহর কেঁপে উঠবে।
ইমরান ব্যাগের চেইন খুলল। কিন্তু তার হাত আবার থেমে গেল। ভেতরে যেন যুদ্ধ শুরু হলো—একদিকে সংগঠনের শপথ, অন্যদিকে নিজের ভাঙা শৈশব আর সেই ছোট্ট ছেলেটির চোখ।
ঠিক তখনই পুলিশি সাইরেন বেজে উঠল। সংবাদ পৌঁছে গিয়েছিল আগে থেকেই। গোয়েন্দারা ঘিরে ফেলল এলাকা। গুলির লড়াই শুরু হলো। ইমরানের সঙ্গীরা একে একে পড়ে গেল। আতঙ্কে শহর স্তব্ধ হয়ে গেল।
কিন্তু ইমরান—সে আবারো গুলি চালাল না। বরং ব্যাগটা রাস্তার পাশে ছুড়ে দিয়ে হাত দুটো উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেল। পুলিশ তাকে মাটিতে ফেলে দিল। চারদিক ভরে গেল চিৎকার আর গুলির শব্দে।
ঢাকার রাস্তায় সেই রাতে মৃত্যু নামল, কিন্তু পরিকল্পিত গণহত্যা ঠেকানো গেল। আর ইমরান আবার ধরা পড়ল—এইবার দক্ষিণ এশিয়ার গোয়েন্দাদের হাতে।
সে জানত, এবার সংগঠন তাকে ছাড়বে না। সে জানত, তার নিজের ভেতরের ছায়ার সাথে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেল—একজন ইমরানকে কি সত্যিই ভেঙে ফেলা সম্ভব, যখন তার জন্মই হয়েছে ধ্বংসস্তূপে? নাকি তার ভেতরের দ্বন্দ্বই একদিন পুরো বিশ্বকে নতুন পথে নিয়ে যাবে?
পর্ব ৫: সিরিয়ার মরুভূমির কালো পতাকা
সিরিয়ার মরুভূমি—অন্তহীন বালির সমুদ্র, যেখানে দিনের বেলা সূর্য ঝলসে দেয় শরীর, আর রাতে হাড়কাঁপানো ঠান্ডা ছেয়ে বসে। একসময় এই ভূমি ছিল বাণিজ্যের পথ, সভ্যতার অংশ, প্রাচীন সাম্রাজ্যের সাক্ষী। কিন্তু ২১শ শতকের শুরুতে সিরিয়ার নাম উচ্চারিত মানেই মানুষের মনে ভেসে উঠতে থাকে ধ্বংসস্তূপ, শরণার্থী আর কালো পতাকার ছায়া।
ইমরানকে ঢাকার আক্রমণের পর ধরা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক গোয়েন্দারা বুঝতে পারছিল, এই মানুষটির ভেতরে দ্বন্দ্ব আছে। দু’বার সে মৃত্যুর পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে, কিন্তু একইসাথে সে আবারো সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের ভেতরে ফিরে গেছে। কারাগারে বসে জেরা করতে গিয়ে তদন্তকারীরা এক অদ্ভুত জিনিস খুঁজে পেল—সে কোনো উত্তর দিচ্ছে না, কিন্তু তার চোখে ভয়ও নেই। যেন সে এখনো ঠিক করেনি কোন দিক নেবে।
তবে বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ থেমে নেই। সিরিয়ার মরুভূমি তখন সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে বড় ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজধানী শহরগুলো থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার দূরত্বে, অগণিত কালো পতাকা উড়ছে ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরের উপরে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তরুণরা আসছে এই পতাকার নিচে। কেউ আসছে ধর্মের নামে, কেউ ক্ষোভে, কেউ রোমাঞ্চ খুঁজে।
সেই ঘাঁটিতে খবর পৌঁছল—“ইমরান বেঁচে আছে।” সংগঠনের নেতারা প্রথমে তাকে বিশ্বাসঘাতক বললেও পরে ভেবেছিল, তার মধ্যে এখনও মূল্য আছে। সে একাধিক বড় অপারেশনের অংশ ছিল, এবং মিডিয়ায় তার ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল। তাকে যদি আবার ফিরিয়ে আনা যায়, তবে প্রোপাগান্ডার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
অতএব, রহস্যজনকভাবে ইমরানকে কারাগার থেকে পাচার করে নিয়ে যাওয়া হলো সিরিয়ার মরুভূমিতে। কনভয় ভরা কালো জীপ, বালির ঝড়ের মধ্যে দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে তাকে পৌঁছে দেওয়া হলো এক বিশাল ক্যাম্পে। ক্যাম্পের চারদিকে কালো পতাকা উড়ছে, যেগুলোতে আরবি অক্ষরে লেখা: “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।”
এখানে ইমরান দেখল এক ভিন্ন জগত। শত শত যুবক অস্ত্র হাতে দৌড়াচ্ছে, রকেট লঞ্চার নিয়ে ছবি তুলছে, ভিডিও বানাচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে এই ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হবে, যাতে পৃথিবীর অন্য প্রান্তের তরুণরাও আকৃষ্ট হয়। মরুভূমির মাঝখানে তৈরি হয়েছে এক অদ্ভুত সাম্রাজ্য—যেখানে শিক্ষা নেই, চিকিৎসা নেই, কিন্তু আছে শৃঙ্খলা, ভয় আর আগ্রাসন।
নেতারা ইমরানকে স্বাগত জানালেন, কিন্তু শীতল চোখে। একজন কঠোর কণ্ঠের কমান্ডার বলল,
— “তুমি প্যারিসে দ্বিধা করেছিলে। ঢাকায় গুলি চালাওনি। কিন্তু আমরা তোমাকে শেষ সুযোগ দিচ্ছি। যদি এবার প্রমাণ করতে পারো, তবে তুমি আবারো আমাদের ভাই।”
ইমরান মাথা নত করল। ভেতরে ভেতরে তার মনে চলছিল এক ভয়ংকর লড়াই। তার কানে বাজতে থাকল প্যারিস কনসার্ট হলের চিৎকার, ঢাকার সেই তরুণ ছেলেটির ভীত দৃষ্টি, আর মায়ের কান্নাভেজা মুখ। কিন্তু তার চারপাশে যে বাস্তবতা, সেখানে এসব ভাবার সুযোগ নেই। এখানে কোনো দ্বিধা মানেই মৃত্যু।
প্রশিক্ষণ শুরু হলো আবার। মরুভূমির বালিতে ইমরানকে আবার বন্দুক ধরতে হলো, আবারো শিখতে হলো বিস্ফোরক বানানো। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সবাইকে বসানো হতো কালো পতাকার নিচে, আর উগ্র ভাষণে বলা হতো—“আমরা এক নতুন খিলাফত গড়ছি। পৃথিবী আমাদের শত্রুতে ভরা, আর তোমরা তার জবাব।”
তবে ইমরান লক্ষ্য করল, এই ক্যাম্পে শুধু যুদ্ধ নয়, রাজনীতির খেলাও চলছে। এক নেতা আরেক নেতার উপর সন্দেহ করছে, কারো সাথে আন্তর্জাতিক দালালের যোগ আছে, কারো সাথে অস্ত্র ব্যবসায়ীর। অনেকেই সন্ত্রাসের নামে শুধু ক্ষমতার স্বাদ নিচ্ছে।
এক রাতে, আগুনের পাশে বসে ইমরান কথা বলল হামজা নামের এক তরুণের সাথে। হামজা এসেছিল লন্ডন থেকে, বাবা-মায়ের সংসার ছেড়ে। সে বলল,
— “ভাই, আমি ওখানে কিছুই পাইনি। পড়াশোনা করেছি, চাকরি পাইনি। বন্ধুদের চোখে আমি সবসময় অন্য। এখানে এসে অন্তত মনে হচ্ছে আমি কিছু বড় কাজের অংশ।”
ইমরান শান্তভাবে উত্তর দিল,
— “কোন বড় কাজ? শিশু হত্যা, নিরীহ মানুষ মেরে ফেলা? তুমি কি সত্যিই মনে কর, এতে তোমার জীবন অর্থপূর্ণ হবে?”
হামজা চমকে তাকাল। ক্যাম্পে এই ধরনের কথা বলা মানে মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু ইমরানের চোখে কিছু ছিল, যা তাকে ভাবতে বাধ্য করল।
এদিকে নেতারা পরিকল্পনা করছিল নতুন আক্রমণ। এবার লক্ষ্য ইউরোপ নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যেরই এক শহর—দামেস্ক। পরিকল্পনা অনুযায়ী, একসাথে তিনটি আত্মঘাতী হামলা ঘটানো হবে। ইমরানকে বেছে নেওয়া হলো তাদের একজন হিসেবে।
আত্মঘাতী ভেস্ট তাকে পরিয়ে দেওয়া হলো। নেতা বলল,
— “এটাই তোমার শহীদির দীক্ষা। তুমি যদি এবার পিছিয়ে যাও, তবে আমাদের ভাই নও।”
ভোরের আলোয় মরুভূমির বাতাস হিমেল ছিল। গাড়িতে বসে শহরের দিকে এগোতে গিয়ে ইমরানের মনে আবারো লড়াই শুরু হলো। তার হাতে ছিল ভেস্টের ট্রিগার, কিন্তু চোখে ভেসে উঠল হামজার প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি, মায়ের অশ্রু, আর নিরীহ মানুষের আতঙ্ক।
গাড়ি পৌঁছে গেল শহরের প্রান্তে। দূরে বাজার, স্কুল, মানুষ। ইমরান ট্রিগার ধরল, কিন্তু তার হাত আবার কেঁপে উঠল। সে বুঝল, যদি এখন চাপ দেয়, তবে তার শৈশবের মতো শত শত শৈশব মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যাবে।
সে হঠাৎ ট্রিগার ছুঁড়ে ফেলে দিল গাড়ির বাইরে। সঙ্গীরা চমকে গেল, চিৎকার করল। কিন্তু ঠিক তখনই দূরে গর্জে উঠল বিমান। আন্তর্জাতিক জোটের ড্রোন হামলা নামল মরুভূমির ক্যাম্পে। বিস্ফোরণে ধুলোর ঝড় উঠল, চারদিকে আগুন। ইমরান গাড়ি থেকে ঝাঁপ দিয়ে পালাল, চারপাশে ধ্বংস আর মৃতদেহ।
সেই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে ইমরান বুঝল—কালো পতাকার নিচে কোনো মুক্তি নেই, কেবল মৃত্যু। কিন্তু সে জানে না, তার পথ এখন কোথায়। সংগঠন তাকে আর কখনো ক্ষমা করবে না, আর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও তাকে শত্রু হিসেবে দেখবে।
মরুভূমির মাঝখানে একা দাঁড়িয়ে ইমরান মনে মনে ফিসফিস করল,
— “আমি কি সত্যিই ছায়ার সৈনিক? নাকি আমি কেবল সেই শিশু, যে ধ্বংসস্তূপ থেকে আজও মুক্তি খুঁজছে?”
পর্ব ৬: লন্ডনের রক্তাক্ত ভোর
লন্ডন শহর—বিগ বেনের ঘণ্টাধ্বনি, টেমস নদীর ধারে আলোকিত সেতু, রেড বাসের ধাক্কাধাক্কি, আর বৃষ্টিভেজা রাস্তায় ছাতা হাতে ছুটে চলা মানুষ। ইউরোপের এই শহর যেন ইতিহাস আর আধুনিকতার এক অদ্ভুত মিশ্রণ। সকালে অফিসগামী মানুষের ভিড়, বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজারো শিক্ষার্থীর ব্যস্ততা, আবার রাত নামলে পাব-রেস্তোরাঁয় হাসি আর গান। লন্ডনকে প্রায়ই বলা হয় “গ্লোবাল ভিলেজ”—কারণ এখানে পৃথিবীর সব জাতি, সব সংস্কৃতি মিলেমিশে থাকে। কিন্তু এমনই শহরে ভোর কখনও কখনও রক্তের দাগে ইতিহাস লিখে দেয়।
সিরিয়ার মরুভূমিতে কালো পতাকার ছায়া থেকে ইমরান পালিয়েছিল ড্রোন হামলার ধ্বংসযজ্ঞে। বালির মরুভূমি পেরিয়ে, ভাঙাচোরা কনভয় থেকে নিজেকে গোপন করে, সে এক সময় পৌঁছাল তুরস্কের সীমান্তে। শরণার্থী স্রোতের ভিড়ে মিশে গেল তার মুখ। হাজার হাজার মানুষ তখন ইউরোপের দিকে ছুটছিল—কারও হাতে শিশু, কারও কাঁধে ব্যাগ, কারও চোখে শুধু বাঁচার আকুতি। ইমরান সেই ভিড়েই হারিয়ে গেল।
অবশেষে এক শীতল সকালে, সে দাঁড়াল লন্ডনের আকাশের নিচে। শহরের ভিড় তাকে প্রথমে অদ্ভুত মনে হলো—এখানে যুদ্ধ নেই, বিস্ফোরণের ধোঁয়া নেই। কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থার খোঁজখবর থেকে মুক্ত থাকা এত সহজ ছিল না। ফরাসি, আমেরিকান, মধ্যপ্রাচ্যের গোয়েন্দারা সবাই জানত—ইমরান এখনও জীবিত। সে যেন এক চলমান রহস্য, যাকে ধরতে পারলে অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।
তবে সংগঠনও বসে ছিল না। লন্ডনের অভিবাসী সম্প্রদায়ের ভেতরেও তাদের নেটওয়ার্ক ছিল। রাতের পর রাত, গোপন ফ্ল্যাটে বসে পরিকল্পনা চলছিল। লক্ষ্য—লন্ডনের হৃদয়ে এক আঘাত। যাতে আবারো বিশ্ব কেঁপে ওঠে।
এক রাতে ইমরানকে খুঁজে পেল রাশেদ নামের এক তরুণ। রাশেদ জন্মেছে লন্ডনেই, কিন্তু তার বাবা-মা এসেছিলেন দক্ষিণ এশিয়া থেকে। পড়াশোনা শেষ করে সে কাজ পায়নি, সমাজে নিজেকে অচেনা মনে করত। সংগঠন তাকে টেনে নিয়েছে অন্ধকারে। সে বলল,
— “ভাই, আমাদের সাথে থাকো। লন্ডনের বুকে বড় আঘাত হানতে হবে। আমরা যদি না করি, তবে কারা করবে?”
ইমরান চুপ করে শুনল। তার চোখে ভেসে উঠল দামেস্কের বাজার, যেখানে সে ট্রিগার টিপতে পারেনি। ভেসে উঠল ঢাকার সেই কিশোর, নিউ ইয়র্কের সাবওয়ের শিশুটি, প্যারিসের কনসার্ট হল। প্রতিবারই সে দাঁড়িয়ে গেছে মৃত্যুর সামনে, কিন্তু গুলি চালায়নি। অথচ সংগঠন বারবার তাকে ফিরিয়ে আনছে, যেন তাকে দিয়ে ইতিহাস লিখতে চায়।
লন্ডনের পরিকল্পনা ছিল ভয়ংকর। টেমস নদীর ধারে ভিড় করা পর্যটক, লন্ডন ব্রিজের গাড়ির সারি—সেখানেই আঘাত হানতে হবে। ছোট একটি ভ্যান ভাড়া করে, সেটি বিস্ফোরকে ভরে চালিয়ে দিতে হবে সেতুর উপর। সেই সঙ্গে সশস্ত্র কয়েকজন নেমে গুলি চালাবে চারদিকে। আতঙ্ক, রক্ত, মৃত্যু—পুরো ইউরোপ আবার কেঁপে উঠবে।
পরদিন ভোর। লন্ডন ব্রিজে তখন ব্যস্ততা। অফিসগামী মানুষের ভিড়, স্কুলের বাচ্চাদের বাস, পর্যটকের ভিড়। ঠিক তখনই ছুটে এলো একটি সাদা ভ্যান। চালকের আসনে বসেছিল রাশেদ, পাশে ইমরান। পেছনে ছিল আরও দুই তরুণ। ভ্যানের নিচে লুকানো ছিল বিস্ফোরক, মাত্র এক বোতামের আঙুলের দূরত্বে।
রাশেদের চোখে উন্মাদনা। সে বলল,
— “এটাই আমাদের শহীদির সময়। প্রস্তুত হও, ভাই।”
ইমরান ব্যাগের ভেতরে হাত রাখল। সেখানে ছিল ট্রিগার। তার আঙুল কাঁপছিল। ভ্যান গর্জন তুলে সেতুর উপর উঠল। মানুষের ভিড় ছুটোছুটি শুরু করল। রাশেদ চিৎকার করল—
— “এখনই, ইমরান! এখনই চাপ দাও!”
কিন্তু ইমরান আবারো থেমে গেল। তার চোখে ভেসে উঠল মায়ের মুখ, যেদিন ধ্বংসস্তূপে বসে তিনি বলেছিলেন—“বন্দুকের পথ শুধু মৃত্যু আনে।” তার বুক ধকধক করছিল। আঙুলে যেন পাথর চেপে বসেছে।
এক মুহূর্তে সব বদলে গেল। ভ্যানের সামনে পুলিশি গাড়ি এসে ধাক্কা দিল। সাইরেন বাজতে লাগল চারদিক। রাশেদ বন্দুক বের করে গুলি চালাল, গুলির শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো টেমস নদীর ওপারে। মানুষ চিৎকার করে ছুটতে লাগল। দু’জন তরুণ ভ্যান থেকে নেমে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
কিন্তু ইমরান—সে হঠাৎ ব্যাগের ভেতর থেকে ট্রিগার বের করে রাস্তায় ছুড়ে ফেলল। বিস্ফোরণ ঘটল না। পুলিশ তাকে মাটিতে ফেলে দিল, হাতকড়া পরাল। রাশেদ পালানোর চেষ্টা করল, কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যে গুলিতে লুটিয়ে পড়ল।
সেতুর উপর তখন রক্ত, আতঙ্ক, পুলিশি আলো। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম চিৎকার করে বলছিল—“লন্ডনে আবারো সন্ত্রাসী হামলার চেষ্টা।” কিন্তু সেই খবরে একটি অদ্ভুত লাইন যোগ হলো—“একজন হামলাকারী নিজেই বিস্ফোরণ থামিয়ে দিল।”
গোয়েন্দারা আবারো দ্বিধায় পড়ল। ইমরান কি সত্যিই সন্ত্রাসী, নাকি সে এমন এক মানুষ, যে নিজের জন্মের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে চায়?
কারাগারের অন্ধকার সেলে বসে ইমরান ভোরের আলো দেখছিল ছোট জানালা দিয়ে। লন্ডনের রক্তাক্ত ভোর তার জীবনে আরেকটি অধ্যায় লিখল। সংগঠন এবার তাকে বিশ্বাসঘাতক বলবে নিশ্চিত। পশ্চিমা বিশ্ব তাকে খুনি বলবে। অথচ তার ভেতরে সে জানে—সে কেবল এক শিশু, যার জন্ম হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে, আর যে আজও খুঁজছে নিজের মুক্তি।
কিন্তু পৃথিবী কি তাকে সেই মুক্তি দেবে? নাকি তাকে ব্যবহার করবে, বিচার করবে, আরেক অন্ধকার খেলায় ঠেলে দেবে?
পর্ব ৭: মস্কোর আন্ডারগ্রাউন্ড ষড়যন্ত্র
মস্কো শহর—বরফে মোড়া চত্বর, রেড স্কোয়ারের লাল দেয়াল, ক্রেমলিনের ঘড়ি, আর ভদকার গন্ধে ভেজা রাত। শীত এখানে কেবল ঋতু নয়, এক অভ্যাস। রাশিয়ার রাজধানী, যা ইতিহাস জুড়ে যুদ্ধ, বিপ্লব আর রক্তপাতের সাক্ষী। অথচ আধুনিক মস্কো রাতের আলোয় সাজানো এক মহানগরী, যেখানে ফ্যাশন শো থেকে শুরু করে গোপন রাজনৈতিক বৈঠক সবকিছুই ঘটে। কিন্তু শহরের নিচে—অদৃশ্য গলিতে, মেট্রোর অন্ধকার টানেলে—চলত আরেক জগত। ষড়যন্ত্র, কালোবাজার আর ছায়ার খেলা।
লন্ডনে হামলার ব্যর্থতার পর ইমরান আবার বন্দি হয়েছিল। কিন্তু তার গল্প এতটাই জটিল হয়ে গেছে যে, পশ্চিমা গোয়েন্দারা তাকে পুরোপুরি মৃত্যুদণ্ড দিতে পারছিল না। প্রতিবারই সে হামলার অংশ হয়েছে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে কিছু একটা করে বিস্ফোরণ আটকেছে। কারও কাছে সে ছিল সন্ত্রাসী, কারও কাছে রহস্য। ফলে তাকে নিয়ে শুরু হলো আন্তর্জাতিক রাজনীতির খেলা।
রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবি হঠাৎ আগ্রহ দেখাল। তাদের দাবি ছিল, “এই মানুষটি কেবল সন্ত্রাসী নয়, এর ভেতরে আরও কিছু আছে। হয়তো আমরা এর ভেতর থেকে তথ্য বের করতে পারব।” গোপন এক চুক্তির মাধ্যমে ইমরানকে হস্তান্তর করা হলো রাশিয়ার হাতে।
মস্কোতে পৌঁছানোর পর ইমরানকে নিয়ে যাওয়া হলো এক অজানা কারাগারে। ঠান্ডা দেয়াল, ধাতব দরজা, অন্ধকার সেল। প্রতিদিন জেরা চলত—“তুমি কার সাথে কাজ করো? সংগঠনের ভেতরের শাখাগুলো কোথায়? কারা অর্থ দেয়?” কিন্তু ইমরান নীরব থাকত। শুধু বলত,
— “আমি আর কিছু জানি না। আমি শুধু নিজের ভেতরের যুদ্ধ লড়ছি।”
রাশিয়ান কর্মকর্তারা প্রথমে ভাবল, এটা নাটক। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা বুঝতে পারল, এই মানুষটি সত্যিই ভিন্ন। তার ভেতরে কোনো স্পষ্ট আনুগত্য নেই। যেন সে এখনো বুঝে উঠতে পারেনি, কোন দিক তার।
এদিকে মস্কোর আন্ডারগ্রাউন্ডে নতুন ষড়যন্ত্র ফুঁসে উঠছিল। মধ্য এশিয়া থেকে আসা অস্ত্র ব্যবসায়ী, চেচনিয়া থেকে আসা ভাড়াটে যোদ্ধা, আর কিছু আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক মিলে পরিকল্পনা করছিল এক বড় হামলা। লক্ষ্য—মস্কোর মেট্রো। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ যাতায়াত করে সেই টানেলে। একবার বিস্ফোরণ ঘটলে পুরো শহর থেমে যাবে।
গোয়েন্দারা খবর পেল, এই ষড়যন্ত্রের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের পুরনো নেটওয়ার্কও জড়িত। আশ্চর্যের বিষয়, সেই নেটওয়ার্কের নামের সাথে ইমরানের অতীত মিলে যাচ্ছে। ফলে এফএসবি-র এক কর্মকর্তা সিদ্ধান্ত নিলেন—ইমরানকে ব্যবহার করা হবে। হয়তো সে নিজে অংশ নেবে, হয়তো ফাঁস করবে। কিন্তু যেভাবেই হোক, তাকে দিয়ে ষড়যন্ত্র থামাতে হবে।
ইমরানকে গোপনে বের করে আনা হলো কারাগার থেকে। এক অফিসার বলল,
— “তুমি অনেকবার মৃত্যু থামিয়েছ, কিন্তু একইসাথে অনেক মৃত্যুর অংশও হয়েছ। এবার তোমার সামনে দুটি পথ—অথবা আমাদের হয়ে কাজ করো, অথবা মরো।”
ইমরান কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল,
— “আমি আর কারো সৈনিক নই। আমি শুধু চাই এই ছায়ার খেলা শেষ হোক।”
তাকে পাঠানো হলো আন্ডারগ্রাউন্ডে, যেখানে ষড়যন্ত্রের মূল চালক ছিল আজমত নামে এক চেচেন। লম্বা দাড়ি, শীতল চোখ, তার চারপাশে তরুণ যোদ্ধাদের ভিড়। আজমত বিশ্বাস করত, “মস্কো কাঁপালে দুনিয়া কাঁপবে।”
ইমরানকে দেখে আজমত বলল,
— “তুমি তো আমাদের নায়ক ছিলে এক সময়। তোমার নাম শুনে অনেকেই এসেছে। কিন্তু তুমি বারবার দ্বিধা করেছ। এবার প্রমাণ করতে হবে তুমি আসলেই কার।”
পরিকল্পনা স্পষ্ট হলো। তিনটি আলাদা দল তিনটি মেট্রো স্টেশনে বিস্ফোরণ ঘটাবে। সময়—ভোরের ভিড়। প্রতিটি দলে একজন আত্মঘাতী থাকবে। ইমরানকে দেওয়া হলো ভেস্ট। আজমত হেসে বলল,
— “এবার আর কোনো পালানোর পথ নেই।”
রাত গভীর হলো। মস্কোর রাস্তায় তুষার পড়ছিল। ইমরান ভেস্ট পরে বসেছিল এক গোপন কক্ষে। তার চোখে ভেসে উঠছিল আগের সব দৃশ্য। প্যারিসের রক্তাক্ত কনসার্ট, ঢাকার আতঙ্ক, দামেস্কের ধ্বংসস্তূপ, লন্ডনের সেতুর উপর আলো। প্রতিবারই সে থেমেছে। কিন্তু এবার?
সে জানত, যদি এবারও থেমে যায়, তবে আজমতের হাতে সে সেখানেই মারা যাবে। কিন্তু যদি বিস্ফোরণ ঘটায়, তবে শত শত নিরীহ মানুষ মরে যাবে।
ভোর হলো। ভিড় জমল মস্কোর মেট্রোতে। ট্রেন ঢুকছে, মানুষ নামছে, কেউ বই পড়ছে, কেউ ফোনে কথা বলছে। ইমরান সেই ভিড়ের মাঝখানে দাঁড়াল। ভেস্ট তার শরীরের সাথে লেগে আছে। আঙুল ট্রিগারের উপর।
হঠাৎ সে এক বৃদ্ধাকে দেখল, হাতে ফুলের তোড়া। হয়তো নাতনির জন্মদিনে যাচ্ছে। তার পাশেই এক কিশোর, স্কুল ব্যাগ কাঁধে। এই দৃশ্য ইমরানের বুক কাঁপিয়ে দিল।
তার মনে হলো, যদি এখন সে ট্রিগার টিপে, তবে শুধু এই মানুষগুলো নয়, তার ভেতরের মানবতাটুকুও চিরতরে মরে যাবে।
সে ট্রিগার নামিয়ে ফেলল। কিন্তু সেই মুহূর্তেই আরেক আত্মঘাতী দৌড়ে এল স্টেশনের ভেতরে। আজমতের নির্দেশে সে ট্রিগার চাপল। ভয়ংকর বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল মেট্রোর টানেল। আগুন, ধোঁয়া, চিৎকার—চারদিকে মৃত্যু।
ইমরান বিস্ফোরণের ধাক্কায় ছিটকে পড়ল। তার কানে বাজছিল মানুষের আর্তনাদ। পুলিশ ছুটে এলো, এফএসবি সদস্যরা স্টেশন ঘিরে ফেলল। আজমতের লোকেরা পালিয়ে গেল।
মাটিতে শুয়ে ইমরান চোখ বন্ধ করল। তার কানে ভেসে আসছিল মানুষের চিৎকার, পুলিশের সাইরেন, আর নিজের ভেতরের এক প্রশ্ন—“আমি কি বারবার মৃত্যুকে আটকাচ্ছি, নাকি মৃত্যুরই অংশ হয়ে যাচ্ছি?”
গোয়েন্দারা তাকে টেনে তুলল। এবার আর তাকে বন্দি হিসেবে নয়, বরং সাক্ষী হিসেবে দেখা হলো। কিন্তু সংগঠন তাকে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণাই করে ফেলল। পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে তার মাথার দাম ঘোষণা করা হলো।
মস্কোর আন্ডারগ্রাউন্ড ষড়যন্ত্রে অর্ধেক ব্যর্থতা, অর্ধেক সফলতা। শতাধিক মানুষ মারা গেল, কিন্তু আরও বড় ধ্বংস থেকে রক্ষা পেল শহর। আর ইমরান আবারও দাঁড়াল এক অদ্ভুত সীমান্তে—যেখানে সন্ত্রাসবাদ আর মানবতার যুদ্ধ চলছে তার ভেতরেই।
পর্ব ৮: ভারতের শহরে বিস্ফোরণের আগুন
ভারত—বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র, যেখানে ভিড়ের ভেতরেই জীবন গড়ে ওঠে। দিল্লির পুরোনো গলি থেকে শুরু করে মুম্বাইয়ের ঝলমলে সাগরতীর, কলকাতার ভিড়ভাট্টা ট্রামলাইন থেকে ব্যাঙ্গালোরের আইটি পার্ক—সব শহরেই এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। একদিকে আধুনিকতার ছাপ, অন্যদিকে দারিদ্র্য আর বঞ্চনা। আর এই ভিড়ভাট্টার মাঝেই মাঝে মাঝে ঢুকে পড়ে ছায়ার খেলোয়াড়রা, যারা সাধারণ জীবনের আড়ালে মৃত্যুর পরিকল্পনা আঁকে।
মস্কোর মেট্রো বিস্ফোরণের পর ইমরান আর সাধারণ বন্দি নয়, বরং এক অদ্ভুত কূটনৈতিক বোঝা হয়ে দাঁড়াল। পশ্চিমারা তাকে মৃত্যুদণ্ড চাইল, রাশিয়া চাইলো ব্যবহার করতে, আর সংগঠন তাকে খুঁজে বের করে হত্যা করতে চাইলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এক গোপন আন্তর্জাতিক সমঝোতায় তাকে দক্ষিণ এশিয়ায় পাঠানো হলো—অর্থাৎ ভারতে। যুক্তি ছিল সহজ—ভারত এমন এক দেশ, যেখানে গোয়েন্দা সংস্থা ও বিচারব্যবস্থা একসাথে তাকে থেকে তথ্য বের করার সুযোগ পাবে।
দিল্লির কারাগারে তাকে রাখা হলো, কিন্তু খুব বেশি দিন নয়। ভারতীয় গোয়েন্দারা দেখল, সংগঠনের বার্তা ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে গেছে—“ইমরান বিশ্বাসঘাতক, তাকে যেখানেই পাও, হত্যা করো।” ফলে তার উপস্থিতি নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক। এক রাতে গোপনে তাকে সরিয়ে নেওয়া হলো কলকাতার দিকে।
কিন্তু ছায়ার সাম্রাজ্য এত সহজে ছাড় দেয় না। কলকাতায় পৌঁছানোর এক সপ্তাহ পরই শহরজুড়ে অদ্ভুত অস্থিরতা শুরু হলো। বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জে হুমকি, ব্যাঙ্গালোরে আইটি কোম্পানির মেইল হ্যাক, দিল্লিতে রাজনৈতিক সভায় সতর্কতা। সব কিছুর পেছনে একটিই ছায়া—পুরোনো সংগঠনের নতুন শাখা।
তারা চেয়েছিল ভারতে বড় আঘাত হানতে। কারণ ভারত ছিল ভূ-রাজনীতির কেন্দ্রে—এখানে আক্রমণ মানেই এশিয়ার প্রতিটি দেশ আতঙ্কিত হবে। পরিকল্পনা করা হলো, একসাথে তিন শহরে বিস্ফোরণ। লক্ষ্য—দিল্লির একটি রেলস্টেশন, মুম্বাইয়ের লোকাল ট্রেন, আর কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের ভিড়।
ইমরানকে এই খবর জানানো হলো। ভারতীয় গোয়েন্দারা আশা করছিল, সে হয়তো এবার কাজে লাগতে পারে। এক কর্মকর্তা বললেন,
— “তুমি যদি আমাদের তথ্য দাও, শত শত জীবন বাঁচতে পারে। কিন্তু যদি চুপ করে থাকো, তবে তুমি আবার খুনির অংশ হবে।”
ইমরান চুপচাপ বসে রইল। তার চোখে তখন ভেসে উঠছিল মস্কোর মেট্রো টানেলের ধোঁয়া, প্যারিসের কনসার্ট হলের রক্ত, লন্ডন ব্রিজের আতঙ্ক। বারবার সে মৃত্যু আটকেছে, কিন্তু মৃত্যু যেন তাকে ছায়ার মতো তাড়া করছে।
অবশেষে সে বলল,
— “আমি সংগঠনকে আর কিছুই দিতে চাই না। কিন্তু মানুষকে রক্ষা করার জন্য যদি কিছু করতে পারি, তবে আমি করব।”
তদন্তকারীরা তাকে সঙ্গে নিয়ে বের হলো। কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে ভিড় জমতে শুরু করেছে। শহর তখন দুর্গাপুজোর আলোয় ভরে উঠেছে। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায়, প্রতিমার সামনে ভিড়, আলো ঝলমলে শোভাযাত্রা। আর সেই ভিড়ের মাঝেই সংগঠনের কয়েকজন ছেলেরা মিশে আছে, ব্যাগভর্তি বিস্ফোরক নিয়ে।
রাত গভীর হলো। ভিড় আরও বেড়েছে। ইমরান হঠাৎ এক ছেলেকে চিনতে পারল। সে সিরিয়ার ক্যাম্পে একসাথে ছিল, নাম আবু সালেহ। এখন তার হাতে কালো ব্যাগ, মুখে অদ্ভুত দৃঢ়তা। ইমরান জানল—এই মুহূর্তেই বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
সে ছুটে গেল সালেহর দিকে। ধস্তাধস্তি শুরু হলো। ভিড় আতঙ্কে দৌড়াতে লাগল। গোয়েন্দারা গুলি ছুঁড়ল। সালেহ চিৎকার করে উঠল—
— “বিশ্বাসঘাতক!”
কিন্তু ইমরান ব্যাগ কেড়ে নিয়ে তা ভিড় থেকে দূরে ছুড়ে দিল। ভয়ংকর বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল পার্ক স্ট্রিট। কয়েকজন মারা গেল, অনেকে আহত হলো, কিন্তু শত শত মানুষ রক্ষা পেল।
পুলিশ ইমরানকে মাটিতে ফেলে দিল। তার শরীর জ্বলছিল বিস্ফোরণের আগুনে, কিন্তু তার চোখে তখন এক অদ্ভুত শান্তি। যেন সে জানে, এবার সে কেবল মৃত্যুর অংশ হয়নি, বরং জীবন বাঁচিয়েছে।
পরদিন সকালেই ভারতের সমস্ত সংবাদমাধ্যমে তার ছবি ছাপা হলো—“বিস্ফোরণ ঠেকাল এক সাবেক জঙ্গি।” কেউ তাকে নায়ক বলল, কেউ বিশ্বাসঘাতক। রাজনৈতিক নেতারা বিভক্ত হলো—কেউ বলল তাকে ফাঁসি দিতে হবে, কেউ বলল তাকে ব্যবহার করে আরও তথ্য বের করতে হবে।
কিন্তু সংগঠন আবার ঘোষণা দিল—“ইমরান আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু।” তার মাথার দাম দ্বিগুণ হলো। ভারতের প্রতিটি বড় শহরে সতর্কতা জারি হলো।
কারাগারের কক্ষে বসে ইমরান ভোরের আলো দেখছিল। কলকাতার আকাশে তখনো ধোঁয়া ভাসছে। তার কানে বাজছিল মানুষের চিৎকার, পুলিশের সাইরেন, আর নিজের হৃদয়ের ফিসফিসানি—
— “আমি কি অবশেষে মুক্তি খুঁজে পাচ্ছি, নাকি ছায়ার সাম্রাজ্য আমাকে কখনো ছাড়বে না?”
ভারতের শহরগুলো আতঙ্কে থরথর করে উঠল। কিন্তু একইসাথে একটা প্রশ্ন জাগল—একজন ইমরান যদি মৃত্যুর মুখ থেকে মানুষ বাঁচাতে পারে, তবে হয়তো ছায়ার সাম্রাজ্যের ভেতরেও আলো লুকিয়ে আছে।
পর্ব ৯: টোকিওর নীরব আতঙ্ক
টোকিও—আলোর নগরী। রাত জেগে থাকা আকাশচুম্বী স্কাইস্ক্র্যাপার, শিনজুকু আর শিবুয়ার ব্যস্ত রাস্তায় নীয়ন সাইন, ট্রেনে ভিড় জমে থাকা অফিসগামী মানুষের স্রোত। এই শহরে যেন ক্লান্তি মানেই অচেনা এক ছন্দ। বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তি, অর্থনীতি আর সংস্কৃতির এক অদ্ভুত মিলনস্থল টোকিও। কিন্তু এমন শহরেই একদিন অদৃশ্য আতঙ্ক নীরবে ঢুকে পড়ে—যেখানে মানুষ ভাবে, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত, সেখানেই মৃত্যুর ছায়া ফিসফিস করে।
ভারতের পার্ক স্ট্রিট বিস্ফোরণের পর ইমরানকে আর কেবল বন্দি হিসেবে দেখা হলো না। আন্তর্জাতিক গোয়েন্দাদের চোখে সে এক দ্বৈত চরিত্র—একদিকে সংগঠনের ভেতরের খবর জানে, অন্যদিকে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও বারবার বিস্ফোরণ ঠেকাচ্ছে। ফলে একে একে বহু রাষ্ট্র তার প্রতি আগ্রহ দেখাল। কেউ চাইলো বিচার, কেউ চাইলো ব্যবহার। অবশেষে জাতিসংঘের একটি বিশেষ সেল সিদ্ধান্ত নিল—ইমরানকে গোপনে টোকিওতে নিয়ে যাওয়া হবে, কারণ সেখানে সম্প্রতি একটি গোপন হামলার আভাস পাওয়া গেছে।
শীতকালীন রাতে টোকিও পৌঁছাল ইমরান। জানালার বাইরে তাকিয়ে সে বিস্মিত হলো—শহরের ব্যস্ততা যেন যুদ্ধকবলিত কাবুল বা আতঙ্কিত প্যারিসের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে মানুষ দৌড়াচ্ছে, কিন্তু সেই দৌড় কেবল কাজের জন্য। ট্রেনের শব্দ, ভেন্ডিং মেশিনের আলো, রাস্তার মোড়ে নীরবভাবে দাঁড়ানো মানুষ—সব মিলিয়ে এই শহর ছিল শৃঙ্খলার প্রতীক। অথচ সংগঠন এই শহরকেই লক্ষ্য করেছে।
তদন্তকারীরা জানাল, টোকিওর সাবওয়ে সিস্টেমে হামলার পরিকল্পনা হয়েছে। জাপানের ইতিহাসে একবার এর আগে গ্যাস হামলার দুঃস্বপ্ন ঘটেছিল, তাই এ দেশের মানুষের কাছে সেই আতঙ্ক এখনও অমোচনীয়। এবার সংগঠন চাচ্ছে আবারো সেই ভয় জাগাতে। পরিকল্পনা—সকালের ভিড়ের সময় একসাথে পাঁচটি ট্রেনে বিস্ফোরক রেখে বিস্ফোরণ ঘটানো।
ইমরানকে নিয়ে যাওয়া হলো শিবুয়ার গলির ভেতর, যেখানে গোপনে সংগঠনের কিছু সদস্য ঘাঁটি গেড়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন তরুণ জাপানি। তারা বিদেশি প্রভাব আর নিজ দেশের বৈষম্য নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিল। সেই ক্ষোভকে সংগঠন ব্যবহার করছে। এক তরুণ, নাম কেনজি, বলল—
— “আমরা স্রেফ যন্ত্রের মতো বেঁচে আছি। অফিস, ট্রেন, ঘুম—এটাই জীবন? অন্তত এই হামলার মাধ্যমে বিশ্ব জানবে, আমাদের ভেতরে ক্ষোভ আছে।”
ইমরান চুপচাপ শুনল। তার চোখে ভেসে উঠল কাবুলের শিশুকালের ক্ষুধা, প্যারিসের গানের ভিড়, লন্ডনের সেতুর আতঙ্ক। প্রতিটি শহরে সে মৃত্যুকে দেখেছে, কিন্তু বারবার সে থেমেছে। অথচ এখনও সে মৃত্যুর সাথে হাঁটছে।
হামলার দিন ঘনিয়ে এলো। সকালের ব্যস্ততম সময় বেছে নেওয়া হলো। টোকিও মেট্রোর ভিড় তখন অসহনীয়। মানুষ কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়ায়, কেউ মোবাইল স্ক্রিনে ডুবে থাকে, কেউ অল্প ঘুমিয়ে নেয় ট্রেনের ভেতর। সেই ভিড়েই বিস্ফোরক রাখা হবে, যাতে মুহূর্তে শহর স্তব্ধ হয়ে যায়।
রাতের বৈঠকে নেতারা বলল,
— “জাপানিরা ভাবে তারা অজেয়। কাল তাদের দেখাতে হবে, ছায়ার সাম্রাজ্য পৃথিবীর প্রতিটি কোণে আছে।”
ইমরানকে একটি ব্যাগ দেওয়া হলো। ভেতরে বিস্ফোরক। তাকে বলা হলো শিনজুকুর ট্রেনে উঠতে। অন্যরা যাবে আলাদা স্টেশনে। একসাথে পাঁচটি বিস্ফোরণ ঘটলে দুনিয়া কেঁপে উঠবে।
সকালে সে ভিড়ের সঙ্গে মিশে গেল। টিকিট কাটল, নামল প্ল্যাটফর্মে। ট্রেন এসে দাঁড়াল, মানুষ গাদাগাদি করে উঠল। ইমরানও ব্যাগ নিয়ে ভেতরে দাঁড়াল। তার চারপাশে ছিল নিরীহ মানুষ—একজন বৃদ্ধ হাতে সংবাদপত্র, এক যুবতী কানে ইয়ারফোন, এক ছোট্ট ছেলে মায়ের কোলে।
ট্রেন চলতে শুরু করল। আঙুল ট্রিগারের উপর। ইমরানের বুক ধকধক করছে। হঠাৎ সেই শিশুটি তার দিকে তাকাল নিষ্পাপ চোখে। মুহূর্তেই তার মাথায় ভেসে উঠল নিউ ইয়র্কের সাবওয়ের সেই বাচ্চা, যে বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল। একই চোখ, একই ভয়।
ইমরান কেঁপে উঠল। তার ভেতরের কণ্ঠ ফিসফিস করে বলল,
— “যদি এখন চাপ দাও, তবে তুমি আর মানুষ থাকবে না। তুমি কেবল ছায়া হয়ে যাবে।”
সে ট্রিগার নামিয়ে ফেলল। ব্যাগ শক্ত করে ধরে ট্রেন থেকে নেমে গেল পরের স্টেশনে। চারদিকে পুলিশ ইতিমধ্যেই সতর্ক ছিল। গোয়েন্দারা ছুটে এসে তাকে গ্রেফতার করল, ব্যাগ উদ্ধার করল। বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় হলো।
কিন্তু অন্য চারটি ট্রেন?
দুই জায়গায় পুলিশ সময়মতো ধরতে পারল হামলাকারীদের। কিন্তু আরও দুটি ট্রেনে বিস্ফোরণ ঘটল। ধোঁয়া, আগুন, মানুষের চিৎকার ছড়িয়ে পড়ল। পুরো শহর স্তব্ধ হয়ে গেল।
সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হলো—“টোকিওতে সন্ত্রাসী হামলার চেষ্টা আংশিক ব্যর্থ।” শতাধিক মানুষ মারা গেল, কিন্তু আরও হাজারো জীবন রক্ষা পেল ইমরানের কারণে।
আন্তর্জাতিক জগতে আবারো দ্বিধা দেখা দিল। কেউ বলল, ইমরানকে নায়ক বলা উচিত, কারণ সে বিস্ফোরণ ঠেকিয়েছে। আবার কেউ বলল, সে তো পরিকল্পনার অংশই ছিল, তাই সে অপরাধী। জাতিসংঘ বিভক্ত হয়ে গেল, সংবাদপত্রে বিতর্ক চলল।
টোকিওর হেফাজতে বসে ইমরান জানালা দিয়ে শহরের আলো দেখছিল। তার ভেতরে এক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—
— “আমি কি সত্যিই মুক্তির পথে? নাকি ছায়ার সাম্রাজ্যের হাত থেকে পালানো অসম্ভব?”
কারণ সে জানত, সংগঠন তাকে আর কখনো ক্ষমা করবে না। তারা তাকে খুঁজে বের করবে। টোকিওর নীরব আতঙ্ক কেবল শুরু।
পর্ব ১০: শেষ খেলা — বিশ্ব মানচিত্রের ওপারে
বিশ্বের মানচিত্রে যত শহর আলো ছড়িয়েছে, ইমরান ততবার মৃত্যুর ছায়ার সামনে দাঁড়িয়েছে। কাবুলের ধ্বংসস্তূপে তার জন্ম, নিউ ইয়র্কের সাবওয়ে, প্যারিসের কনসার্ট হল, ঢাকার গলি, সিরিয়ার মরুভূমি, লন্ডনের সেতু, মস্কোর আন্ডারগ্রাউন্ড, ভারতের শহর, আর টোকিওর ট্রেন—প্রতিটি জায়গায় তার অস্তিত্ব যেন মৃত্যুর আর জীবনের মাঝের সূক্ষ্ম রেখায় দুলে থেকেছে। সে কখনও খুনি, কখনও বিশ্বাসঘাতক, কখনও নায়ক। আর সংগঠন, যাকে পৃথিবী চেনে কালো পতাকার ছায়া নামে, তাকে আর কেবল সদস্য নয়, বরং সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতক মনে করে।
টোকিও হামলার পর গোটা বিশ্ব কেঁপে উঠল। আংশিকভাবে হামলা ব্যর্থ হলেও শতাধিক মানুষের মৃত্যু হলো। ইমরান আবারও বাঁচাল অসংখ্য প্রাণ, কিন্তু মৃত্যুর দাগ থেকে রেহাই পেল না। আন্তর্জাতিক আদালতে তার বিরুদ্ধে বিচার শুরু হলো। আমেরিকা বলল, “ও একজন সন্ত্রাসী।” ইউরোপ বলল, “ও বারবার হামলা আটকেছে।” ভারত বলল, “ও ব্যবহারযোগ্য সাক্ষী।” জাপান বলল, “ওর কারণে শহর অর্ধেক রক্ষা পেয়েছে।” পৃথিবীর কোনো আইনই যেন তার অবস্থান নির্ধারণ করতে পারছিল না।
এই বিভ্রান্তির মাঝেই সংগঠন শেষ খেলার ডাক দিল। মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমি থেকে এক ভিডিও ছড়িয়ে পড়ল—কালো পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে একজন মুখোশধারী ঘোষণা করছে,
— “ইমরান হলো বিশ্বাসঘাতক। সে আমাদের ভাইদের হত্যা করেছে। কিন্তু আমরা তাকে ব্যবহার করব শেষ খেলার জন্য। এই পৃথিবী দেখবে, ছায়ার সাম্রাজ্য এখনও বেঁচে আছে।”
গোয়েন্দারা বার্তা ধরল। সংগঠন এক বিশাল পরিকল্পনা করছে—এবার লক্ষ্য কোনো একটি শহর নয়, বরং আন্তর্জাতিক সম্মেলন। স্থান: জেনেভা, সুইজারল্যান্ড। জাতিসংঘ সদর দপ্তরে শান্তি সম্মেলন। পৃথিবীর প্রতিটি প্রভাবশালী নেতা সেখানে উপস্থিত হবে। সংগঠন চায়, এক আঘাতেই গোটা দুনিয়া কেঁপে উঠুক।
ইমরানকে খবর জানানো হলো। জেরা কক্ষে বসে সে নীরব শুনল। তার চোখে তখন ভেসে উঠছিল পৃথিবীর মানচিত্র। প্রতিটি দেশ, প্রতিটি শহর, যেখানে সে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়েছে। এবার যদি সংগঠন সফল হয়, তবে পৃথিবীই কেঁপে যাবে।
একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলল,
— “তুমি একসময় তাদের অংশ ছিলে। তাদের ভাষা, তাদের কৌশল তুমি জানো। তুমি যদি আমাদের সাহায্য না করো, এই পৃথিবী অচল হয়ে যাবে।”
ইমরান দীর্ঘক্ষণ চুপ থেকে বলল,
— “আমি এতদিন ভেবেছিলাম, আমি কেবল ছায়ার অংশ। কিন্তু হয়তো এবার আমার জন্মের অভিশাপ ভাঙতে হবে। যদি আমি সত্যিই কিছু করতে পারি, তবে সেটা হবে মৃত্যুকে থামানো।”
জেনেভা। শীতল হাওয়ায় ভেসে আসছে লেক জেনেভার স্রোত। জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ততদিনে নিরাপত্তার চাদর বিছানো হয়েছে। কিন্তু ছায়ার সাম্রাজ্য এমনভাবে নিজেদের ছড়িয়ে ফেলেছে যে, কারা সত্যিকারের অতিথি আর কারা ছদ্মবেশী, তা বোঝা মুশকিল।
ইমরানকে গোপনে নিয়ে যাওয়া হলো শহরে। তাকে বলা হলো, “তুমি ছায়ার ভেতর ছায়া হয়ে ঢুকবে।” মিশনের নাম দেওয়া হলো শেষ খেলা।
সভা শুরুর দিন। বিশ্বের শীর্ষ নেতা, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, কূটনীতিকরা একে একে প্রবেশ করছে হলে। বাইরে শত শত সাংবাদিক, ভিতরে বৈঠকের আলো। অথচ আড়ালে চারপাশে ছড়িয়ে আছে অদৃশ্য সৈনিক, যারা বিস্ফোরণ ঘটানোর অপেক্ষায়।
ইমরান ভিড়ের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছিল। তার হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না, কিন্তু চোখে দৃঢ়তা। হঠাৎ সে দেখতে পেল এক পরিচিত মুখ—আজমত, সেই চেচেন কমান্ডার, যে মস্কোর মেট্রোতে রক্ত ঝরিয়েছিল। এবার সে এসেছে জেনেভায়। তার কাঁধে ব্যাগ, ভেতরে বিস্ফোরক।
আজমতের চোখ পড়তেই ফিসফিস করে বলল,
— “তুমি আবারও এসেছো? বিশ্বাসঘাতক! এবার তোমার মৃত্যু নিশ্চিত।”
ইমরান বুঝল, সময় নেই। সে ঝাঁপিয়ে পড়ল আজমতের উপর। ধস্তাধস্তি শুরু হলো কনফারেন্স হলের বাইরে। ব্যাগ মাটিতে পড়ে গেল। গোয়েন্দারা ছুটে এল, লোকজন আতঙ্কে দৌড়াতে লাগল। আজমত ট্রিগার চাপতে যাচ্ছিল, কিন্তু ইমরান তার হাত চেপে ধরল। বিস্ফোরণ হলো না।
দীর্ঘ লড়াইয়ের পর আজমত গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেল। ব্যাগ নিষ্ক্রিয় করা হলো। জেনেভা বাঁচল। পৃথিবীর নেতারা নিরাপদে রইলেন। সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল মুহূর্তে—
“শেষ খেলা ব্যর্থ, বিশ্বাসঘাতক ইমরান বাঁচাল পৃথিবীকে।”
কিন্তু ইমরান আর বাঁচল না। আজমতের ছুরি তার বুকে গভীরভাবে ঢুকে গিয়েছিল। রক্তে ভিজে মাটিতে পড়ে যেতে যেতে তার চোখে ভেসে উঠল সব দৃশ্য—কাবুলের ধ্বংসস্তূপ, মায়ের অশ্রু, সাবওয়ের শিশু, প্যারিসের গান, লন্ডনের আলো, মস্কোর ধোঁয়া, টোকিওর ট্রেন।
শেষ নিশ্বাসে সে ফিসফিস করে বলল,
— “আমি ছায়া নই। আমি মানুষ।”
আর সেই মুহূর্তেই তার জীবন শেষ হলো।
পৃথিবীর সংবাদপত্রগুলো তাকে নিয়ে বিভক্ত হলো। কেউ বলল, সে ছিল সন্ত্রাসী, কেউ বলল নায়ক, কেউ বলল এক অভিশপ্ত জীবন। কিন্তু ইতিহাস লিখল ভিন্নভাবে—একজন মানুষ, যে মৃত্যুর ভেতর থেকেও জীবনের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল।
ছায়ার সাম্রাজ্য এখনও পৃথিবীর কোথাও বেঁচে আছে। কিন্তু ইমরানের গল্প প্রমাণ করল, প্রতিটি ছায়ার ভেতরেও আলো লুকিয়ে থাকে।
সমাপ্ত




