অরিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়
পর্ব ১ : শ্মশানের গহ্বর
রাত তখন ন’টা পেরিয়েছে। আষাঢ়ের ভিজে হাওয়া কলকাতার গলিগুলোকে এক অদ্ভুত কুয়াশার মতো জড়িয়ে রেখেছে। দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গার ধারে ছোট্ট একটা শ্মশান—লেখাপড়ার বইতে নাম নেই, লোকমুখে প্রচলিত কেবল—“কালকেতুর আখড়া”। স্থানীয়রা বলে, এখানে শবদাহ হলে আগুন নেভার পরে অচেনা ছায়ারা ভিড় করে, যেমন করে কাক ভিড় করে ছাইয়ের স্তূপে।
অয়ন, জাদুঘরে কাজ করা এক তরুণ গবেষক, সেই শ্মশানের দিকে এগোচ্ছিল। তার হাতে মোটা চামড়ার ফাইল, ভেতরে কিছু পুরোনো তালপাতার পুঁথি। সেগুলোর অক্ষর কালো হয়ে গিয়েছে, তবু সেখানে যে শব্দ লেখা আছে, সেগুলো অয়ন এক সপ্তাহ ধরে পড়ছে। শব্দগুলোতে লুকিয়ে আছে এক অদ্ভুত আকর্ষণ—“অমায়া তন্ত্র”—এক গোপন শাখার ইঙ্গিত, যেটা নাকি মূল তান্ত্রিক শাস্ত্রেও উল্লেখ নেই।
তার যাত্রার কারণ ছিল সোজা—সে শুনেছিল, এই শ্মশানের ভেতরেই সেই তন্ত্রের শেষ সাধক একদিন নিখোঁজ হয়ে যায়, শবাগ্নির আগুনে মিশে গিয়ে। গ্রামের পুরনো দাদুরা বলে, তার দেহ আর মেলে নি, শুধু আগুনের শিখায় নীলাভ আলো দেখা গিয়েছিল।
অয়ন টর্চ জ্বালাল। ভেতরের পথ প্রায় অচেনা। বাঁশঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে বাতাসে শিস। হঠাৎ একটা শুকনো পাতা তার কপালে এসে লাগতেই সে চমকে উঠল। মনে হল কেউ ফিসফিস করে বলল—“ফিরে যা।”
কিন্তু তার ভিতরে কৌতূহলের আগুন আরও জ্বলল। পুঁথির ভাঁজে ভাঁজে যে মন্ত্রগুলি লেখা আছে, সেগুলো বারবার তাকে টানছিল। তার বিশ্বাস, যদি সেই মন্ত্র উচ্চারণ করা যায়, তাহলে অমায়া তন্ত্রের গোপন দরজা খুলবে।
শ্মশানের একেবারে ভেতরে গিয়ে অয়ন থামল। আগুন নেই, শব নেই, অথচ একটা তীব্র গন্ধ—চন্দনের সঙ্গে মিশ্রিত পোড়া মাংসের। হঠাৎ টর্চের আলোতে সে দেখতে পেল এক ভাঙা পাথরের শিবলিঙ্গ। লিঙ্গের গায়ে লালচে দাগ, যেন কেউ সবে রক্ত ছেটেছে।
অয়নের গলা শুকিয়ে এল। তবু সে ফাইল খুলে পড়তে লাগল—
“ॐ অমায়া ভৈরবী তন্ত্রায় নমঃ। অঙ্গ প্রণাম করো, আত্মা অর্ঘ্য দাও।”
হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ায় ফাইলের পাতা উলটে গেল। আলো নিভে গেল। অন্ধকারে শুধু শোনা গেল গঙ্গার ঢেউয়ের শব্দ আর দূরে কুকুরের কান্না।
এরপর অয়ন অনুভব করল—মাটির নিচ থেকে কিছু একটা নড়ছে। যেন শুকনো ছাইয়ের নিচ থেকে হাত বেরোতে চাইছে। সে পিছু হটতে গিয়েও পারল না, তার পা যেন শেকড়ে বাঁধা।
ঠিক তখনই তার কানে এল ভাঙা কণ্ঠস্বর—
“যা খুঁজছিস, সেটা তোর জন্য নয়… অমায়া তন্ত্র তোর রক্ত চাইবে।”
অয়ন ভয়ে কাঁপতে লাগল। কিন্তু কৌতূহল তার ভয়কে ঢেকে দিল। সে গলা কাঁপিয়ে জিজ্ঞেস করল—
“কে তুমি?”
কোনও উত্তর এল না। শুধু অন্ধকারে দেখা গেল এক মুহূর্তের জন্য দুটি চোখ—নীলাভ, অগ্নিশিখার মতো।
অয়ন জানল, সে সত্যিই এমন কিছুতে পা দিয়েছে যেখান থেকে ফিরে আসা সহজ নয়।
পর্ব ২ : রক্তের দাগ
অয়ন বাড়ি ফিরেছিল গভীর রাতে, কিন্তু তার শরীর আর মন দুটোই কাঁপছিল। শ্মশানে যা দেখেছিল, সেটা স্বপ্ন নয়, ভ্রমও নয়—সেটা ছিল বাস্তব। সেই চোখদুটি এখনও তার মাথার ভেতর ভেসে আছে। বাড়ি এসে সে আলো জ্বালিয়ে বিছানায় বসে পড়ল, ফাইলের ভেতরকার পুঁথিগুলো আবার খুলল। পাতাগুলো শুকনো, কিন্তু কোথাও কোথাও যেন ভিজে। আলো ফেলতেই মনে হল অক্ষরগুলোর চারপাশে অদ্ভুত আভা জ্বলছে, যেন শব্দগুলো এখনই উঠে এসে তার ঘরে ঘুরে বেড়াবে। অয়ন হাত কাঁপতে কাঁপতে পড়তে লাগল—অমায়া তন্ত্রের মূল মন্ত্রগুলো। সেখানে লেখা—“যে রক্ত তার নয়, সেই রক্তই অর্ঘ্য।” অয়ন থেমে গেল। এর মানে কী? সে জানে তন্ত্রে রক্তবলি নতুন কিছু নয়, কিন্তু এখানে লেখা আছে অন্যরকম কিছু, যেন নিজের নয় অথচ আপন হয়ে ওঠা রক্তের দরকার। সে ঘামতে লাগল, ভাবল, “তাহলে কি আত্মীয়ের? বন্ধুর? নাকি এমন কারও, যার সাথে আত্মার যোগ আছে?” ঠিক সেই সময় জানলার কাঁচে টক্ করে শব্দ হল। বাইরে তাকাতেই সে দেখল এক ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার আলোয় অস্পষ্ট সেই অবয়ব নড়ল না, কেবল তাকিয়েই রইল। অয়ন হঠাৎ ভয় পেয়ে লাইট অফ করে দিল, কিন্তু বুকের ধড়ফড় থামল না। মিনিট খানেক পরে আবার সাহস করে আলো জ্বালাতেই ছায়াটা উধাও। অয়ন ভেবেছিল হ্যালুসিনেশন, কিন্তু বুকের ভেতরের কাঁপুনি কমল না।
পরদিন সকালে অয়ন অফিসে গেল। কিন্তু তার চোখে-মুখে অস্থিরতা সবাই টের পেল। সহকর্মী সায়ন্তনী এসে বলল, “তুমি ঠিক আছ তো? সারারাত ঘুমাওনি নাকি?” অয়ন একটু এড়িয়ে গেল, বলল, “রিসার্চের কাজ, দেরি হয়ে গিয়েছিল।” সায়ন্তনী হেসে বলল, “তুমি এসব নিয়ে একদিন পাগল হয়ে যাবে।” এই কথাটাই অয়নের মনে অদ্ভুতভাবে গেঁথে গেল—পাগল হয়ে যাওয়া, হয়তো সেটাই শুরু হয়ে গেছে। দুপুরে অফিসের লাইব্রেরিতে বসে সে আবার পুঁথি পড়ছিল। হঠাৎ করিডোর দিয়ে সায়ন্তনী হেঁটে যাচ্ছিল, তার হাত থেকে একটা বই পড়ে গেল। অয়ন দৌড়ে গিয়ে তুলতে গিয়ে চমকে উঠল—বইটার নাম “শবতন্ত্র রহস্য”। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এই বই পড়ো?” সায়ন্তনী হাসল, “আমার দাদু শ্মশানের পুরোহিত ছিলেন। এসব বই আমার কাছে নতুন নয়।”
অয়ন স্তম্ভিত হয়ে গেল। এই মেয়ে এতদিন তার সহকর্মী, অথচ সে জানতই না তার অতীত এ রকম। সাহস করে সে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি অমায়া তন্ত্রের নাম শুনেছ?” সায়ন্তনীর মুখ মুহূর্তে গম্ভীর হয়ে গেল। ঠোঁট শুকিয়ে সে ধীরে ধীরে বলল, “তুমি কোথায় এর নাম শুনেছ?” অয়ন বলল, “একটা পুঁথি পেয়েছি। আর কাল রাতে…” বলে থেমে গেল। সায়ন্তনী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল, “তুমি কি কাল কালকেতুর আখড়ায় গিয়েছিলে?” অয়ন কিছু না বলে কেবল মাথা নেড়ে সায় দিল। সায়ন্তনী কপালে হাত চাপা দিয়ে ফিসফিস করে বলল, “তুমি ভয়ানক ভুল করেছ।”
অয়ন উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করল, “তুমি কিছু জানো? বলো, প্লিজ।” সায়ন্তনী অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর বলল, “অমায়া তন্ত্র মানে মৃত্যু আর জীবনের মাঝের গহ্বর। ওটা খোলা মানে নিজের আত্মা বিক্রি করা। আর একবার বিক্রি করলে আর ফেরার পথ থাকে না।” অয়ন বলল, “কিন্তু আমি তো এখনই থামতে পারি।” সায়ন্তনী কেমন বিষণ্ণভাবে তাকাল, “থামতে পারবে? গতকাল কি তুমি ওদের ডাক শুননি? সেই চোখ দেখনি? এখন তারা তোমাকে বেছে নিয়েছে।”
অয়ন স্তব্ধ হয়ে গেল। সে জানত মেয়েটির কথা ফাঁকা ভয় নয়। তার মনে পড়ল সেই অদ্ভুত নীলাভ চোখ, যে কণ্ঠস্বর তাকে বলেছিল রক্ত চাইবে। সেদিন রাতে বাড়ি ফেরার পর যখন সে ঘুমোতে যাচ্ছিল, সে স্পষ্ট শুনেছিল কেউ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বলছে—“তুই আমার।”
সেদিন রাতটা আবার এল। বিছানায় শোয়া অয়ন শুনতে পেল জানলার ধারে ফিসফিসানি। সে উঠে দাঁড়াতেই বাতাসে ঠাণ্ডা ছড়িয়ে পড়ল। ফাইলটা টেবিলে খোলা ছিল, তার পাতাগুলো নিজে নিজেই উলটে গেল। শব্দগুলো যেন জেগে উঠল—“অর্ঘ্য… অর্ঘ্য…” অয়ন বুক চেপে ধরল। ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁতেই সে দেখল ঘরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ছায়ামূর্তি, লম্বা, মুখ দেখা যায় না, কিন্তু হাতের আঙুলগুলো রক্তে ভেজা। অয়ন চিৎকার করতে পারল না, কেবল কাঁপল। সেই মূর্তি মাটিতে কিছু আঁকল, লালচে রেখা, যেন রক্ত দিয়েই। তারপর হঠাৎ মিলিয়ে গেল। অয়ন দৌড়ে টর্চ জ্বালাতেই দেখল মেঝেতে স্পষ্ট রক্তের দাগ।
ভয়ে তার মাথা ঘুরে গেল। কিন্তু তবু মনে হল, এ যেন একটা আহ্বান, এক গোপন দরজার দাওয়াই। তার ভেতরে অদ্ভুত টান জেগে উঠল—সে এই রহস্যের ভেতর ঢুকবেই, না হলে শান্তি পাবে না।
পর্ব ৩ : ছায়ার অর্ঘ্য
অয়ন সকালবেলা উঠে বুঝল তার শরীর যেন জ্বরে পুড়ছে, অথচ থার্মোমিটারে কোনো তাপ নেই। মাথা ভারী, চোখের তলায় কালো দাগ, সারারাত ঘুম হয়নি। মেঝের দিকে তাকাতেই তার বুক কেঁপে উঠল—সেই রক্তের দাগ এখনও শুকিয়ে গাঢ় লাল হয়ে আছে। কতবার মুছে ফেলল, সাবান, পানি, ডিটারজেন্ট—কিছুতেই যায় না। যেন মেঝের সাথে মিশে গেছে। ভয়ের বদলে এখন অদ্ভুত এক আকর্ষণ কাজ করছে তার ভেতরে, যেন ওখানেই লুকিয়ে আছে রহস্যের দরজা। সে ফাইল খুলে বসলো আবার। পাতাগুলো এবার আর জড় অক্ষর মনে হল না, বরং জীবন্ত। সেখান থেকে ফিসফিস করে ভেসে আসছে শব্দ—“অর্ঘ্য চাই, অর্ঘ্য চাই।” অয়ন আঙুল বুলিয়ে দিল পুঁথির গায়ে, মনে হল পাতার ভেতর দিয়ে অদ্ভুত কম্পন ছড়িয়ে যাচ্ছে তার শরীরে।
অফিসে গেলেও মন বসছিল না। সায়ন্তনী পাশে এসে ফিসফিস করে বলল, “কাল রাতে আবার কিছু হয়েছে?” অয়ন চুপ করে রইল, শুধু তাকাল। তার চোখে এত আতঙ্ক জমে ছিল যে সায়ন্তনী আর প্রশ্ন করল না। কিন্তু অফিস ছুটির পর সে অয়নকে থামিয়ে বলল, “তুমি একা পারবে না। যদি সত্যিই অমায়া তন্ত্র তোমাকে টেনে নেয়, তবে অন্তত পাশে কাউকে থাকতে হবে।” অয়ন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি থাকবে?” সায়ন্তনী একটু দ্বিধা করে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। কারণ আমার দাদুর অসমাপ্ত সাধনার সঙ্গে হয়তো এই তন্ত্রের যোগ আছে।”
দুজন মিলে রাতে আবার গেল কালকেতুর আখড়ায়। আকাশে মেঘ, গঙ্গার হাওয়া বয়ে আসছে, গাছের ডালপালা দুলছে। শ্মশান একেবারে নিস্তব্ধ, শুধু মাঝে মাঝে পেঁচার ডাক ভেসে আসছে। তারা শিবলিঙ্গটার কাছে পৌঁছাল, যেখানে অয়ন প্রথমবার সেই নীলাভ চোখ দেখেছিল। চারপাশে কেমন ভ্যাপসা গন্ধ, পচা আর ধূপের গন্ধ মিশে আছে। অয়ন মন্ত্র পড়তে শুরু করতেই চারদিক কেঁপে উঠল। বাতাস হু-হু করে বইতে লাগল, বাঁশঝাড়গুলো শিস দিচ্ছে। সায়ন্তনী তার হাত শক্ত করে ধরল, বলল, “সাবধানে থেকো, ওরা আসছে।”
ঠিক তখন মাটির ভেতর থেকে উঠে এলো এক ছায়া। মানুষের মতো কিন্তু পুরো নয়, আধা স্বচ্ছ, কণ্ঠস্বর ফাটা। সে বলল, “অর্ঘ্য দাও।” অয়ন স্তব্ধ হয়ে গেল। সায়ন্তনী কাঁপতে কাঁপতে বলল, “তারা রক্ত চাইছে।” অয়ন গলা শুকিয়ে গেল, সে তো কিছুই আনেনি। তখনই ছায়াটা তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল, আঙুলগুলো লম্বা, নখে রক্ত ঝরছে। অয়ন পিছু হটতে গিয়েও পারল না। ঠিক তখন সায়ন্তনী নিজের আঙুলে ব্লেড চালিয়ে রক্ত বের করে দিল মাটিতে। মুহূর্তেই ছায়াটা ঝুঁকে পড়ল সেই রক্তের দিকে, মাটি ভিজে উঠল লালচে হয়ে। বাতাসে এক অদ্ভুত গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল—মিষ্টি অথচ শ্বাসরুদ্ধকর।
অয়ন চিৎকার করে উঠল, “না, তুমি কেন?” কিন্তু সায়ন্তনী স্থির কণ্ঠে বলল, “অন্য উপায় নেই।” ছায়াটা মিলিয়ে গেল কিন্তু তার কণ্ঠস্বর রয়ে গেল বাতাসে—“এটাই শুরু।”
ফিরে আসতে আসতে অয়ন অসাড় হয়ে ছিল। সায়ন্তনী ফ্যাকাশে মুখে হাঁটছিল, তার হাত কাপড়ে বাঁধা। গঙ্গার ধারে এসে সে থামল, বলল, “তুমি কি বুঝেছ, এরা এখন আমাদের ছেড়ে দেবে না।” অয়ন গম্ভীর গলায় বলল, “তাহলে কী করতে হবে?” সায়ন্তনী অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “অমায়া তন্ত্রের শেষ মন্ত্র খুঁজে বের করতে হবে। নইলে ওরা আমাদের আত্মা টেনে নেবে।”
বাড়ি ফেরার পর অয়ন আয়নার সামনে দাঁড়াল। তার চোখে কেমন নীলাভ আভা ফুটে উঠেছে। সে চমকে গেল। নিজের ভেতর থেকেই যেন কারও গলা শুনতে পেল—“তুই আমার।” সে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। ফাইলটা টেবিলে খোলা ছিল। পাতাগুলো আবার উলটে গিয়ে থেমে গেল এক জায়গায়। সেখানে লেখা—“রক্ত যদি আত্মীয়ের হয়, দ্বার খুলবে। আত্মা যদি বেছে নেওয়া হয়, তবেই সাধনা পূর্ণ।”
অয়ন ভয়ে কেঁপে উঠল। এর মানে কী? তবে কি কারও নিকটজনের রক্ত দিতে হবে? সে ভাবতে লাগল, তার পরিবার, তার বন্ধুরা—এদের মধ্য থেকে কাকে নিতে চাইছে তন্ত্র? ঘরের মধ্যে হঠাৎ ফিসফিসানি শুরু হল, অদৃশ্য কণ্ঠগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেন শ্মশানের ছায়ারা এখন তার ঘরে এসে গেছে।
সে জানালার দিকে তাকাল, বাইরে কেউ নেই, অথচ পর্দা নড়ছে, ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। টেবিলে রাখা পানির গ্লাস নিজে থেকে উলটে পড়ল, পানি ছড়িয়ে গেল মেঝেতে, আর সেই পানিতে ভেসে উঠল অদ্ভুত প্রতীক—ত্রিভুজের ভেতর এক চোখ। অয়ন কাঁপতে কাঁপতে প্রতীকটার দিকে তাকাল।
হঠাৎ তার ফোনে মেসেজ এল। অচেনা নাম্বার থেকে লেখা—“অর্ঘ্য ছাড়া মুক্তি নেই। কাল গঙ্গার ধারে এসো।” অয়ন স্তব্ধ হয়ে গেল। সে বুঝল, এখন তার আর ফেরার পথ নেই।
রাতভর সে ঘুমাতে পারল না। তার ভেতরে অদ্ভুত দ্বন্দ্ব চলল—সে কি এই পথে এগোবে? নাকি সব ছেড়ে পালাবে? কিন্তু যতবার চোখ বন্ধ করল, ততবার সেই নীলাভ চোখ সামনে ভেসে উঠল। গলা শুনল—“তুই বেছে নেওয়া।”
অয়ন জানত, কাল তাকে যেতে হবে।
পর্ব ৪ : গঙ্গার ধারে আহ্বান
অয়ন সারারাত ঘুমোতে পারেনি। শরীরটা ছিল ক্লান্ত, কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠছিল সেই অদ্ভুত প্রতীক—ত্রিভুজের ভেতর এক চোখ, আর চারপাশে রক্তের রেখা। বারবার মনে হচ্ছিল কেউ তার ঘরে হেঁটে বেড়াচ্ছে, অথচ আলো জ্বালালে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সকালে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই চমকে উঠল—তার চোখের সাদা অংশ হালকা নীলাভ হয়ে উঠেছে। মুখ ধোওয়ার সময় ঠান্ডা পানি চোখে পড়তেই মনে হল অগ্নিশিখা ভেতরে জ্বলছে।
সেদিন অফিসে গেলেও মন বসছিল না। সায়ন্তনী কাছে এসে কানে কানে বলল, “আমারও ফোনে মেসেজ এসেছে। ওরা আমাদের দুজনকেই ডাকছে।” অয়ন অবাক হয়ে তাকাল, “তাহলে তুমি যাবে?” সায়ন্তনী এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে বলল, “যদি না যাই, তারা আমাদের ছাড়বে না। পালানো সম্ভব নয়।”
সন্ধ্যার পর তারা দুজনে গঙ্গার ধারে পৌঁছাল। দক্ষিণেশ্বর থেকে কিছুটা দূরে, যেখানে আলো কম, শুধু চাঁদের আলো গঙ্গার বুকে সাদা রেখার মতো পড়ছে। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল কেউ—অর্ধেক ছায়া, অর্ধেক মানুষ। তার মুখ দেখা যাচ্ছিল না, শুধু চোখদুটি জ্বলছিল নীলাভ আভায়। চারপাশের বাতাস যেন জমে গিয়েছে, ঠাণ্ডা কুয়াশা তাদের গা ঘিরে ধরল।
ছায়ামূর্তি বলল, “তোমরা আহ্বান করেছ। দরজা খুলতে অর্ঘ্য চাই।” তার কণ্ঠস্বর যেন গঙ্গার জল থেকে উঠে আসছে—গভীর, গর্জনময়, অথচ ফিসফিসের মতো।
অয়ন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “কোন অর্ঘ্য?” উত্তর এলো, “রক্ত। আত্মীয়ের রক্ত। না হলে পথ খুলবে না।” সায়ন্তনী আঁতকে উঠল, “কী আত্মীয়?” ছায়ামূর্তি বলল, “যে তোমার রক্তের সাথে বাঁধা, অথচ যার মৃত্যুতে তুমি ভাঙবে।”
অয়ন হঠাৎ বুঝল, এটা কেবল বলি নয়, এটা পরীক্ষা। তন্ত্রের দ্বার খুলতে হলে তাকে সবচেয়ে প্রিয়জনের রক্ত দিতে হবে। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল, মায়ের মুখ ভেসে উঠল চোখে, বাবার কণ্ঠস্বর, শৈশবের স্মৃতি। সে চিৎকার করে উঠল, “না, আমি পারব না।”
ছায়ামূর্তি স্থির স্বরে বলল, “তাহলে তুই বেছে নেওয়া নোস।” ঠিক তখনই গঙ্গার ঢেউ তীব্র হয়ে উঠল, যেন বন্যার মতো জল উঠছে। আকাশের মেঘ ফেটে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। অয়ন ও সায়ন্তনী দৌড়ে পিছু হটতে গিয়েও দেখল তাদের পা যেন বালিতে আটকে যাচ্ছে।
সায়ন্তনী কাঁপতে কাঁপতে বলল, “অয়ন, যদি কিছু না দিই, ওরা আমাদের মেরে ফেলবে।” অয়ন হতাশ গলায় বলল, “কিন্তু আমি কাকে দেব? কাকে বলি দেব?”
ঠিক তখন ছায়ামূর্তি হাত তুলে বলল, “তোর ঘরে ইতিমধ্যেই চিহ্ন আঁকা হয়েছে। তোর অর্ঘ্য ঠিক করা হয়ে গেছে।” অয়ন শিউরে উঠল। তার মনে পড়ল মেঝের রক্তের দাগ, ফাইলের প্রতীক, ফোনের বার্তা—সব যেন আগেই লিখে রাখা।
বাড়ি ফিরে অয়ন দেখল ঘরে মৃদু আলো জ্বলছে, অথচ সে তো কোনো আলো রেখে যায়নি। ভেতরে ঢুকেই স্তব্ধ হয়ে গেল—টেবিলে ফাইল খোলা, আর মেঝেতে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়া। মুখ দেখা যায় না, কিন্তু এবার কণ্ঠস্বর একেবারে পরিষ্কার—“তোর মায়ের রক্ত চাই।”
অয়ন যেন আকাশ থেকে পড়ে গেল। সে চিৎকার করে বলল, “না! না, এটা অসম্ভব!” কিন্তু ফিসফিসানি চারদিক থেকে ভেসে আসতে লাগল, “অর্ঘ্য দাও… নইলে তুমি হারাবে…”
সেদিন রাতে অয়ন একটুও ঘুমাতে পারল না। সারারাত বসে রইল জানলার পাশে। ভোরে মা দরজায় নক করল, চা এনে দিল। মায়ের চোখে সেই স্নেহমাখা দৃষ্টি, অয়ন ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ল। তার মনে হচ্ছিল, এই তন্ত্র আসলে তাকে মনের গভীর থেকে ছিঁড়ে নিতে চাইছে।
দুপুরে সায়ন্তনী এলো। তার মুখ আরও ফ্যাকাশে। সে বলল, “আমারও বলেছে, আমার দাদুর আত্মা অর্ঘ্য চাইছে।” অয়ন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার দাদু তো মারা গেছেন অনেক আগে।” সায়ন্তনী গম্ভীর গলায় বলল, “হ্যাঁ। হয়তো মৃত আত্মার রক্ত মানে স্মৃতির রক্ত, উত্তরাধিকারীর রক্ত। আর আমি তো তার বংশধর।”
অয়ন অসহায়ভাবে বলল, “আমরা কি পারব না এর থেকে বেরোতে?” সায়ন্তনী চোখ নামিয়ে বলল, “হয়তো পারব, যদি শেষ মন্ত্র খুঁজে পাই। তন্ত্র যেমন রক্ত চায়, তেমনই নাকি মুক্তির পথও বলে দেয়।”
অয়ন ফাইলের পাতাগুলো উলটেপালটে দেখতে লাগল। হঠাৎ সে এক জায়গায় আটকে গেল। সেখানে লেখা—“যদি সাধক আত্মাকে অর্ঘ্য দিতে না পারে, তবে তার ছায়া অর্ঘ্য দেবে। আর ছায়া যদি অর্ঘ্য দেয়, সাধক মুক্ত হবে।”
অয়ন স্তব্ধ হয়ে গেল। এর মানে কী? তার নিজের ছায়া? তাহলে কি তাকে নিজের ছায়াকে উৎসর্গ করতে হবে? এটা কীভাবে সম্ভব? ঠিক তখন জানলার বাইরে সূর্যের আলো পড়ল, আর সে স্পষ্ট দেখল তার ছায়া মেঝেতে নড়ছে—কিন্তু তার শরীর নড়ছে না।
অয়ন আতঙ্কে পিছিয়ে গেল। সায়ন্তনী চমকে বলল, “তোমার ছায়া…” দুজনেই নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল মেঝের দিকে। ছায়াটা ধীরে ধীরে হাত তুলল, যেন ওরাও ফাইলের শব্দ পড়ছে।
অয়ন তখন বুঝল, খেলা আরও গভীরে চলে গেছে। অর্ঘ্য হয়তো শুধু মাংস আর রক্তের নয়—আত্মার প্রতিফলনেরও।
সে কেঁপে উঠে মনে মনে বলল, “তাহলে কাল রাতে গঙ্গার ধারে আবার আমাকে যেতে হবে। এবার হয়তো আমার নিজের ছায়াই যাবে।”
পর্ব ৫ : ছায়ার রক্ত
রাত নেমেছে। অয়ন বসে আছে তার ঘরে, টেবিলের ওপরে ফাইল খোলা। ঘড়ির কাঁটা যত এগোচ্ছে, তার বুকের ভেতরের ধকধকনিও তত বেড়ে যাচ্ছে। প্রতিটি পাতার অক্ষর যেন আলো ছড়াচ্ছে, ঘরের দেয়ালে ছায়াগুলো লম্বা হয়ে নাচছে। সে হাত বাড়িয়ে আলো নিভিয়ে দিল, কিন্তু আলো নিভতেই দেখল, অন্ধকারে তার ছায়া এখনও স্পষ্ট। জানালার বাইরে চাঁদ নেই, তবুও ছায়া আছে। সেই ছায়া ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, মাথা ঘুরিয়ে তার দিকেই তাকাল। অয়ন ঘামতে লাগল, হাত কাঁপতে লাগল, কিন্তু সে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য। ছায়াটা হঠাৎ ঠোঁট নাড়ল—কোনও শব্দ নেই, তবু মনে হল যেন বলছে—“অর্ঘ্য।”
অয়ন কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বলল, “তুই কে?” ছায়াটা এবার এক পা এগিয়ে এলো, তার সাথে সাথে ঘরটা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। অয়ন পেছোতে গিয়ে খাটের ধারে গিয়ে থেমে গেল, তার আর জায়গা নেই। ছায়াটা বলল, এবার শব্দ শোনা গেল স্পষ্ট—“আমি তুই।” অয়ন স্তম্ভিত। “তুই?” উত্তর এল, “হ্যাঁ, আমি তোর রক্তের প্রতিফলন, তোর পাপ, তোর ভয়, তোর গোপন ইচ্ছে।” অয়ন শিউরে উঠল। ছায়াটা আরও বলল, “তোর বদলে আমি অর্ঘ্য হতে পারি, কিন্তু তার মানে তুই আমাকে ত্যাগ করতে হবে।”
অয়ন বুঝতে পারছিল, খেলা এখন তার আত্মার ভেতরে। যদি ছায়াকে অর্ঘ্য দেয়, তবে সে হয়তো মুক্ত হবে, কিন্তু তার ভেতরের অন্ধকার কি তবে বেঁচে থাকবে না? তার কপাল বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছে, মাটিতে পড়ছে। ঠিক তখন দরজায় টোকা পড়ল। সায়ন্তনী এসে দাঁড়াল। তার চোখে ভয়ের ছাপ, কিন্তু মুখ দৃঢ়। সে বলল, “আমি সব দেখেছি। তোর ছায়া এখন তোর শত্রু।” অয়ন চমকে উঠল, “তুই কীভাবে জানিস?” সায়ন্তনী ধীরে ধীরে বলল, “আমার দাদু একবার এই পথে গিয়েছিল। শেষ রাতে আমি দেখেছিলাম, তার ছায়া তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আর সকালে আমরা শুধু মৃত দেহটা পেয়েছিলাম।”
অয়ন স্তব্ধ হয়ে গেল। বুঝল, ছায়াকে অর্ঘ্য দিলে হয়তো সে বাঁচবে না। কিন্তু যদি না দেয়, তবে ছায়ার হাত থেকে রেহাই নেই। ঠিক তখন ছায়াটা আবার বলল, “আজ রাতে গঙ্গার ধারে আসতে হবে। নইলে আমি তোর রক্ত নিয়েই নেব।”
সেদিন রাত বারোটার পরে তারা দুজনে গেল গঙ্গার ধারে। কালকেতুর আখড়া নিস্তব্ধ, বাতাসে ধূপ আর ছাইয়ের গন্ধ। গঙ্গার জল কালো হয়ে বইছে, মাঝেমাঝে ঢেউ এসে বালিতে আছড়ে পড়ছে। অয়ন ফাইলটা হাতে নিল, মন্ত্র পড়তে শুরু করল। হঠাৎই মাটির নিচ থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে এল, যেন শত শত কণ্ঠ একসাথে ফিসফিস করছে—“অর্ঘ্য… অর্ঘ্য…” চারদিক থেকে ছায়ারা ঘিরে ফেলল, বাতাসে হাহাকার ভেসে আসছে।
অয়নের নিজের ছায়া এবার মাটি থেকে উঠে দাঁড়াল, তার চেয়েও উঁচু, ভয়ঙ্কর। চোখ দুটো নীলাভ, হাতে ধারালো নখ। ছায়া বলল, “তুই আমাকে দে, আমি তোর হয়ে যাব।” অয়ন কাঁপতে লাগল, হাত থেকে ফাইল পড়ে গেল মাটিতে। পাতাগুলো বাতাসে ছড়িয়ে গেল। সায়ন্তনী চিৎকার করে উঠল, “না! ছায়াকে দিস না! ওকে দিলে তুই বেঁচে থাকবি, কিন্তু মানুষ থাকবি না।”
অয়ন দ্বিধায় পড়ে গেল। চারপাশে ছায়ারা চিৎকার করছে, গঙ্গার জল উথালপাথাল করছে। তার নিজের ছায়া তার দিকে এগিয়ে আসছে, ঠোঁটে ভয়ঙ্কর হাসি। অয়ন হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, চোখ বন্ধ করল। মনে পড়ল মায়ের মুখ, শৈশবের স্মৃতি, সায়ন্তনীর কণ্ঠস্বর। হঠাৎ তার বুকের ভেতর থেকে এক শক্তি উঠে এল। সে চিৎকার করে উঠল, “আমি কাউকে অর্ঘ্য দেব না!”
মুহূর্তেই চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। ছায়ারা স্থির হয়ে গেল, গঙ্গার ঢেউ থেমে গেল। কিন্তু তার নিজের ছায়া হঠাৎ বিকট হাসি দিয়ে বলল, “তাহলে আমি তোর রক্ত নেব।” এক ঝাঁপে ছায়া তার গলায় হাত বসাল। অয়ন শ্বাস নিতে পারছিল না। সায়ন্তনী দৌড়ে এসে ফাইলের এক টুকরো পাতা ছিঁড়ে আগুন ধরিয়ে ছায়ার দিকে ছুঁড়ে দিল। আগুনে ছায়াটা কেঁপে উঠল, অদ্ভুত গর্জন করে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
অয়ন মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, হাঁপাতে লাগল। তার গলা ব্যথায় অবশ হয়ে গেছে। সায়ন্তনী কাঁপতে কাঁপতে বলল, “তুই ছায়াকে মানতে চাইনি, এটাই তোর শক্তি। কিন্তু খেলা এখানেই শেষ নয়। এখন থেকে ওরা তোর রক্তের পিছে লাগবে।”
অয়ন শূন্য চোখে গঙ্গার দিকে তাকাল। ঢেউ আবার বয়ে যাচ্ছে, আকাশে মেঘ সরে গিয়ে এক টুকরো চাঁদ বেরিয়েছে। কিন্তু তার মনে হল, গঙ্গার বুকে এখনো সেই নীলাভ চোখদুটি ভেসে উঠছে, তাকিয়ে আছে শুধু তার দিকেই।
সে জানল, মুক্তি এখনও অনেক দূরে।
পর্ব ৬ : শাপভঙ্গ
অয়ন সেই রাতের পর থেকে বদলে গেল। তার চোখে সবসময় অদ্ভুত এক নীলচে আভা লেগে থাকত, যেন ভেতরে এক শিখা জ্বলছে। অফিসে সহকর্মীরা খেয়াল করত, সে আগের মতো স্বাভাবিক নেই—চুপচাপ বসে থাকে, কখনও হঠাৎ কাগজে অদ্ভুত প্রতীক আঁকে, আবার মুহূর্তের মধ্যেই ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সায়ন্তনী তাকে একদিন সরাসরি বলল, “তুই প্রতিদিন একটু একটু করে তোর ছায়ার দখলে চলে যাচ্ছিস।” অয়ন উত্তর দিল না, শুধু জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল।
বাড়িতে মা খেয়াল করছিল, ছেলে একেবারেই বদলে যাচ্ছে। রাতে খাওয়ার সময় মা ডাকলেও অয়ন চুপ করে বসে থাকে, কখনও খায়, কখনও খায় না। একদিন মা বললেন, “বাবা, তোর চোখে কেমন অদ্ভুত আলো দেখি আজকাল, কিছু হয়েছে?” অয়ন গলা শুকিয়ে উত্তর দিল, “না মা, কিছু হয়নি।” কিন্তু ভেতরে ভেতরে জানত, তন্ত্র তার শরীরে ঢুকে যাচ্ছে।
এক রাতে অয়ন স্বপ্ন দেখল—সে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল চত্বরের মাঝে, চারপাশে শ্মশানের ছাই, আর কেন্দ্রে এক বিশাল শিবলিঙ্গ। তার চারপাশে অগণিত ছায়া দাঁড়িয়ে, একসাথে গলা মেলাচ্ছে—“অর্ঘ্য দাও, অর্ঘ্য দাও।” শিবলিঙ্গ থেকে হঠাৎ নীলাভ আগুন বেরিয়ে তার দিকে এগোলো। আগুন ছুঁতেই অয়ন জেগে উঠল, কিন্তু ঘরের ভেতরও গন্ধ ছড়িয়ে আছে—পোড়া মাংস আর ধূপের মিশ্রণ।
সকালে সায়ন্তনী এল। তার হাতে একটা পুরোনো বাক্স। অয়ন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “ওটা কী?” সায়ন্তনী বলল, “এটা আমার দাদুর রেখে যাওয়া। এর ভেতরে একটা তালপাতার পুঁথি আছে, হয়তো মুক্তির মন্ত্র।” বাক্স খুলতেই ভেতরে একটি পাতলা, প্রায় ভাঙা-ভাঙা পুঁথি দেখা গেল। তাতে লেখা—“অমায়া শাপভঙ্গ মন্ত্র।” দুজনেই স্তব্ধ হয়ে গেল।
তারা বসে পড়ল পড়তে। তাতে লেখা—“যদি সাধক নিজের ছায়াকে ত্যাগ না করে, যদি রক্ত অর্ঘ্য দিতে না চায়, তবে তাকে তার ভয়কে রক্ত দিতে হবে। ভয়কে হত্যা করলে মুক্তি আসবে।”
অয়ন বিভ্রান্ত হয়ে বলল, “ভয়কে রক্ত দেব মানে কী?” সায়ন্তনী গম্ভীর গলায় বলল, “মানে, তোর ভয়কে সামনে আনতে হবে। যে জিনিসটাকে তুই সবচেয়ে ভয় করিস, সেটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে শেষ করতে হবে। নইলে ছায়া তোর শরীর দখল করবে।”
অয়ন অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “আমার সবচেয়ে ভয় মায়ের মৃত্যু। যদি ওরা সেটা চায়?” তার গলা কেঁপে উঠল। সায়ন্তনী শক্ত গলায় বলল, “না। তুই যদি ভয়কে ভয় না করিস, তবে ওরা কিছু করতে পারবে না।”
রাত হল। তারা আবার গেল কালকেতুর আখড়ায়। শ্মশান নির্জন, কিন্তু আজ কেমন অন্যরকম। বাতাস থেমে গেছে, পোকামাকড়ের শব্দও নেই। শুধু শূন্য নীরবতা। শিবলিঙ্গের সামনে দাঁড়াতেই হঠাৎ গঙ্গার ঢেউ গর্জন করে উঠল, ছায়ারা চারদিক থেকে ভিড় করে এলো।
অয়ন ফাইল থেকে শাপভঙ্গ মন্ত্র পড়তে শুরু করল—“ॐ অমায়া মুক্তায় স্বাহা, ভয়কে অর্ঘ্য দাও, ছায়া ভাঙো, আত্মা ফিরিয়ে আনো।”
ছায়ারা গর্জন করল, চারদিক অন্ধকারে ঢেকে গেল। হঠাৎ অয়ন দেখল সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার মা। মায়ের চোখে জল, কাঁপা গলায় বলছে, “বাবা, তুই কেন আমাকে দিচিস?” অয়ন চিৎকার করে উঠল, “না মা, আমি তোমায় দেব না।” ছায়ারা গর্জন করল, চারদিক কাঁপতে লাগল।
অয়ন বুঝল, এ তার ভয়। ভয়কে রক্ত দিতে হবে মানে ভয়কে শেষ করতে হবে। সে মন্ত্র পড়তে পড়তে এগিয়ে গেল, মায়ের মূর্তির চোখে সরাসরি তাকাল। বলল, “তুই সত্যি না, তুই আমার ভয়।”
মুহূর্তেই মূর্তিটা ছাই হয়ে মিলিয়ে গেল। চারদিকের অন্ধকার একটু হালকা হল। ছায়ারা পিছিয়ে গেল, গঙ্গার ঢেউ শান্ত হল। কিন্তু তখনই আবার এক ছায়া সামনে এলো, অয়নের নিজের ছায়া। সে গর্জে উঠল, “তুই ভয় জিতেছিস, কিন্তু আমায় হারাতে পারবি না। আমি তো তোরই অন্ধকার।”
অয়ন কাঁপা গলায় বলল, “হ্যাঁ, তুই আমার অন্ধকার। কিন্তু আমি তোর মালিক।” সে মন্ত্র পড়তে শুরু করল, কণ্ঠে দৃঢ়তা আসছিল—“ভয়কে অর্ঘ্য দাও, ছায়া ভাঙো, আত্মা ফিরিয়ে আনো।”
ছায়াটা চিৎকার করে উঠল, কণ্ঠে যন্ত্রণার গর্জন। মাটিতে অদ্ভুত কম্পন শুরু হল। সায়ন্তনী তাকে ধরে রাখল, বলল, “চালিয়ে যা, থেমে যাস না।” অয়ন চোখ বন্ধ করে পড়তেই থাকল।
হঠাৎ আলো ঝলসে উঠল। শিবলিঙ্গ থেকে আগুন বেরিয়ে এসে অয়নের ছায়ার ওপর পড়ল। ছায়াটা দাউদাউ করে জ্বলতে লাগল, গর্জন করতে করতে মিলিয়ে গেল। চারদিকের ছায়ারা একে একে অদৃশ্য হল। গঙ্গার হাওয়া আবার বইতে শুরু করল, পোকামাকড়ের ডাক ফিরল।
অয়ন হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে বসে পড়ল। মনে হল শরীর থেকে একটা বিশাল ভার নেমে গেছে। তার চোখের নীলাভ আভা মুছে গিয়ে স্বাভাবিক হল। সায়ন্তনী কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “শাপভঙ্গ হয়েছে।”
কিন্তু গঙ্গার জলে তখনও যেন ক্ষীণ নীলাভ আলো ভেসে আছে। দূর থেকে ফিসফিস করে শোনা গেল, “এটা শেষ নয়…”
অয়ন জানল, সে ছায়াকে জিতেছে ঠিকই, কিন্তু তন্ত্রের মূল রহস্য এখনও বাকি।
পর্ব ৭ : অগ্নিদ্বার
অয়ন শাপভঙ্গের রাতের পর কদিন একেবারে স্তব্ধ হয়ে ছিল। শরীর হালকা লাগছিল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে জানত, গঙ্গার জলে যে ফিসফিসানি বাকি রেখেছিল, সেটা নিছক সতর্কতা নয়। দিনরাত মনে হচ্ছিল কেউ তার কানে নিঃশ্বাস ফেলছে, ঘুমের মধ্যে যেন মন্ত্র গুনগুন করছে। সায়ন্তনী বারবার বলছিল, “তুই মুক্তি পেয়েছিস, কিন্তু পুরোপুরি নয়। অমায়া তন্ত্র কখনো অর্ধেক খোলা থাকে না। ওটা যদি জেগে ওঠে, তবে শেষ পর্যন্ত একটা দরজা খুলবেই।”
অয়ন বারবার ফাইলটা খুলে পড়ত। কিন্তু শাপভঙ্গ মন্ত্রের পর পুঁথির পাতাগুলো হঠাৎ অচেনা হয়ে গেছে। আগের কালো অক্ষরগুলো যেন মুছে গিয়ে জায়গায় অগ্নিলাল প্রতীক ভেসে উঠছে। সে চোখ কচলালেও মুছল না। সায়ন্তনী এসে একদিন পাতাগুলো দেখে চমকে উঠল, বলল, “এগুলো অগ্নিদ্বার মন্ত্র। মানে শেষ দরজা। একবার খুললে আর ফেরার পথ নেই।”
অয়ন হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল, “মানে?” সায়ন্তনী নিচু গলায় বলল, “অমায়া তন্ত্রের আসল শক্তি প্রকাশ পায় অগ্নিদ্বারে। যারা ওটা খোলে, তারা হয় দেবতুল্য সাধক, নয় অগ্নির ছাই। তুই যদি অগ্নিদ্বার খুলিস, তবে হয়তো মুক্তি আসবে, আবার হয়তো তুই হারিয়ে যাবি।”
রাত গভীর হলে অয়ন বিছানায় বসে পুঁথির ওপর হাত রাখল। ভেতরে অদ্ভুত টান কাজ করছিল। সে চোখ বন্ধ করল, মনে হল ভেতর থেকে কণ্ঠস্বর আসছে—“এসো, আগুনের মধ্যে এসো, তোর মুক্তি সেখানেই।”
পরদিন ভোরে সে স্বপ্ন দেখল, শ্মশানের ভেতর আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। শিবলিঙ্গ অগ্নিশিখার মধ্যে দাঁড়িয়ে, আর চারপাশে ছায়ারা চিৎকার করছে। তাদের গলা যেন মন্ত্রের মতো—“অগ্নিদ্বার, অগ্নিদ্বার।” ঘুম ভাঙতেই সে বুঝল, এটা শুধু স্বপ্ন নয়, আহ্বান।
সায়ন্তনীকে সে বলল, “আমাকে যেতে হবে।” সায়ন্তনী রাগে চিৎকার করল, “তুই পাগল নাকি? ওরা তোকে মেরে ফেলবে।” অয়ন শান্ত স্বরে বলল, “হয়তো মেরে ফেলবে। কিন্তু না গেলে ওরা আমাদের শান্তিতে থাকতে দেবে না।”
সন্ধ্যায় তারা আবার গেল কালকেতুর আখড়ায়। আকাশ কালো, বজ্রপাত হচ্ছিল দূরে। শ্মশানে পৌঁছাতেই দেখা গেল আগুন নেই, অথচ ভেতর থেকে আলো আসছে। বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে যেন লাল আভা ছড়িয়ে পড়ছে।
অয়ন শিবলিঙ্গের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাতাস হঠাৎ জমে গেল, চারপাশ নিস্তব্ধ। পুঁথির পাতা খুলতেই আগুন জ্বলে উঠল। প্রতীকগুলো আলোর মতো ঝলসে উঠল। সে মন্ত্র পড়তে শুরু করল—“ॐ অমায়া অগ্নিদ্বার স্বাহা।”
মুহূর্তেই শিবলিঙ্গ ফেটে গেল, আগুনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক দ্বার। লাল অগ্নি-অঙ্গার দিয়ে গড়া এক দরজা, তার ওপর চোখ আঁকা, তীব্র আলো ছড়াচ্ছে। চারপাশ থেকে ছায়ারা হাহাকার করে উঠল, বাতাসে পোড়া মাংসের গন্ধ ছড়িয়ে গেল।
অয়ন কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে গেল। সায়ন্তনী চিৎকার করে বলল, “না, পাগল! ওটা ছুঁস না।” কিন্তু অয়ন থামল না। দরজার সামনে দাঁড়াতেই কণ্ঠস্বর শোনা গেল—“অর্ঘ্য চাই।”
অয়ন গলা শুকিয়ে বলল, “আমি তো আগেই ছায়াকে হারিয়েছি, ভয়কে জিতেছি।” উত্তর এলো, “না, আগুন রক্ত ছাড়া জ্বলে না। অর্ঘ্য দাও।”
অয়ন হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। এবার মনে পড়ল তার নিজের শরীরটাই হয়তো অর্ঘ্য। হাত কেটে রক্ত দিল মাটিতে। মুহূর্তেই আগুন শিখা হয়ে উঠল তীব্র, দরজা আরও উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠল।
অগ্নিদ্বারের ভেতর থেকে এক বিশাল আকৃতি বেরিয়ে এল। আধা মানুষ, আধা আগুন, চোখ দুটো অগ্নিশিখার মতো জ্বলছে। সে গর্জে উঠল, “তুই আমাকে জাগিয়েছিস। এখন তোর আত্মা আমার।”
অয়ন দাঁড়িয়ে পড়ল। বুকের ভেতর ভয় তীব্র, কিন্তু সে মন্ত্র পড়া থামাল না। তার চারপাশে আগুন ঘিরে ধরল, সায়ন্তনী চিৎকার করে দৌড়ে এল, কিন্তু আগুনের দেয়াল তাকে আটকে দিল।
অয়ন গলা কাঁপিয়ে পড়তে থাকল—“অগ্নি মুক্তায়, আত্মা মুক্তায়, অমায়া স্বাহা।” আগুন-মানব গর্জে উঠল, আকাশ বিদ্যুৎ চিরে দিল। গঙ্গার জল উথালপাথাল করে উঠল।
ঠিক তখন অয়ন অনুভব করল, তার শরীর জ্বলছে, রক্ত ধীরে ধীরে আগুনে মিশে যাচ্ছে। কিন্তু বুকের ভেতরে এক শান্তি আসছে, যেন বহুদিনের বোঝা নেমে যাচ্ছে।
অগ্নি-মানব তার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “তুই সাহসী। কিন্তু সাহসের দাম দিতে হয়।” এক ঝটকায় সে অয়নের শরীরে হাত বসাল। অয়ন যন্ত্রণায় কাঁপতে লাগল, মনে হল আত্মা দগ্ধ হচ্ছে। কিন্তু সে শেষ শক্তি দিয়ে মন্ত্র শেষ করল।
আলোর ঝলকানি ছড়িয়ে পড়ল। আগুন-মানব চিৎকার করে মিলিয়ে গেল অগ্নিদ্বারের ভেতর। দরজা দাউদাউ করে জ্বলতে জ্বলতে হঠাৎ ভেঙে পড়ল, ছাই হয়ে গেল। চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
অয়ন মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, রক্তে ভিজে গেছে। সায়ন্তনী দৌড়ে এসে তাকে ধরে কাঁদতে লাগল, “তুই বাঁচিস প্লিজ, প্লিজ।” অয়ন চোখ আধখোলা রেখে ফিসফিস করে বলল, “অগ্নিদ্বার বন্ধ হয়েছে… কিন্তু ওরা বলেছিল… এটা শেষ নয়…”
তার চোখ ধীরে ধীরে বুজে এল। গঙ্গার ঢেউ আবার শান্ত, আকাশে মেঘ সরে গিয়ে তারা ভরে উঠছে। কিন্তু দূরে জলে এখনো হালকা নীলাভ আলো ভেসে উঠছে, যেন অগ্নির ভেতর থেকেও কারও চোখ তাকিয়ে আছে।
পর্ব ৮ : রক্তঋণ
অয়ন সেই রাতের পর তিন দিন অচেতন ছিল। সায়ন্তনী তাকে নিজের বাড়িতে রেখেছিল, ডাক্তার ডেকে কিছুতেই বোঝানো গেল না এই অসুস্থতার কারণ। ডাক্তার শুধু বলেছিল, “ওর শরীর জ্বরে পুড়ছে, কিন্তু শরীরে কোনো রোগ নেই। এ যেন শরীরের ভেতরে আগুন জ্বলছে।” সায়ন্তনী জানত এ চিকিৎসা দিয়ে সারানো যাবে না। অয়ন জেগে উঠল চতুর্থ দিনে, চোখে সেই নীলচে আভা নেই, কিন্তু মুখে ক্লান্তি আর কপালে অদ্ভুত দাগ—ত্রিভুজ আর চোখের প্রতীক যেন দগ্ধ হয়ে বসে আছে। সে ধীরে ধীরে উঠে বসে বলল, “অগ্নিদ্বার বন্ধ হয়েছে, কিন্তু আমি মুক্ত নই। আমার শরীর এখন তন্ত্রের রক্তঋণ বহন করছে।”
সায়ন্তনী চমকে গিয়ে বলল, “রক্তঋণ?” অয়ন শান্ত গলায় উত্তর দিল, “হ্যাঁ। আমি রক্ত দিয়ে আগুনকে তুষ্ট করেছি, কিন্তু তার বিনিময়ে ওরা আমার শরীরে দাগ বসিয়েছে। মানে, এখন আমি ঋণী। এই ঋণ শোধ না করলে ওরা আবার ফিরে আসবে।”
দিনগুলো কাটতে লাগল। বাইরে পৃথিবী স্বাভাবিক, অফিসে কাজ, মানুষের কোলাহল, ট্রাম আর বাসের ভিড়। কিন্তু অয়নের কাছে সবকিছু ফাঁকা মনে হচ্ছিল। তার কানে সারাক্ষণ ফিসফিস শোনা যাচ্ছিল—“রক্তঋণ… রক্তঋণ…” রাতে ঘুমোতে গেলে মনে হত বিছানার নিচে কেউ হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরছে, জানলার কাচে নখ ঘষছে। একদিন সে দেখল বাথরুমের আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব হাসছে, অথচ তার ঠোঁট নড়ছে না।
সায়ন্তনী ভয় পেতেও পিছপা হয়নি। সে পুঁথির পাতাগুলো বারবার পড়ছিল, সমাধান খুঁজছিল। অবশেষে একদিন বলল, “এখানে লেখা আছে, রক্তঋণ শোধ করার একমাত্র উপায় হল অর্ঘ্য নয়, আত্মদান।” অয়ন চমকে উঠল, “আত্মদান মানে কী?” সায়ন্তনী গম্ভীর গলায় বলল, “তোর আত্মাকে ওদের হাতে না দিয়ে, নিজে স্বেচ্ছায় সমর্পণ করা। তাতে হয়তো তোর দেহ নষ্ট হবে, কিন্তু আত্মা মুক্ত হবে।”
অয়ন চুপ করে রইল। তার মাথায় কেবল একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল—“আমি কি মরব?” উত্তর সে পাচ্ছিল না, কেবল শরীরের ভেতরে আগুনের জ্বালা আরও বেড়ে যাচ্ছিল।
সেদিন রাতে আবার সে স্বপ্ন দেখল। বিশাল শ্মশান, আগুনের স্তূপ, আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক অন্ধকার চেহারা। তার চোখ দুটো নীল, হাতে রক্তমাখা থালা। সে বলল, “তোর রক্ত আমার। ঋণ শোধ কর।” অয়ন হাঁটুতে পড়ে গেল, কণ্ঠরোধ হয়ে আসছিল। ঠিক তখন দূরে সায়ন্তনীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল—“ভয়কে দিস না।” অয়ন চোখ খুলে উঠল।
সকালে সায়ন্তনী তাকে বলল, “আমরা যদি শেষটা না করি, তবে ওরা আমাদের ছাড়বে না। তোর রক্তঋণ শুধু তোর নয়, আমাকেও টেনে নিচ্ছে।” অয়ন অবাক হয়ে তাকাল। সায়ন্তনীর কবজিতে ততদিনে দগ্ধ প্রতীক ভেসে উঠেছে। তারও শরীরে তন্ত্র ঢুকে পড়েছে।
অয়ন হতাশ গলায় বলল, “তাহলে আমরা দুজনেই শেষ হয়ে যাব।” সায়ন্তনী দৃঢ়ভাবে বলল, “না। যদি আমরা মন্ত্রের শেষ পর্ব পড়তে পারি, তবে মুক্তি আসবে।”
তারা সিদ্ধান্ত নিল আর একবার যাবে কালকেতুর আখড়ায়। রাত বারোটায় দুজনে পৌঁছাল। এবার আখড়াটা আরও ভয়ঙ্কর। মাটিতে শুকনো রক্তের দাগ, গাছের ডালগুলোতে কালো কাপড় বাঁধা, আর বাতাসে অদ্ভুত গন্ধ। শিবলিঙ্গের সামনে দাঁড়াতেই মাটি ফেটে আগুন বেরোল।
অয়ন মন্ত্র পড়তে শুরু করল—“ॐ অমায়া রক্তঋণ স্বাহা, আত্মদান মুক্তি স্বাহা।” চারপাশ কেঁপে উঠল। ছায়ারা ভিড় করে এলো, গর্জন করল, “রক্ত চাই।” অয়ন বুকের রক্ত ঝরতে লাগল, কপালের দাগ জ্বলতে লাগল। সায়ন্তনী তার হাত ধরল, একসাথে মন্ত্র পড়তে লাগল।
তখন অদ্ভুত কিছু হল। তাদের শরীর থেকে আলো বেরোতে লাগল। আলো ছড়িয়ে ছড়িয়ে শ্মশানের ছায়াদের দিকে গেল। ছায়ারা চিৎকার করতে করতে পিছিয়ে গেল। আগুনে ঘেরা দরজা আবার ভেসে উঠল, কিন্তু এবার সেটা সাদা আলোর দরজা।
অয়ন দাঁড়িয়ে গেল। কণ্ঠ ফেটে গিয়েছিল, তবু বলল, “আমি আমার আত্মা স্বেচ্ছায় দিচ্ছি মুক্তির জন্য, শাপভঙ্গের জন্য, রক্তঋণ শোধের জন্য।” সায়ন্তনীও একই মন্ত্র পড়ল।
হঠাৎ আগুন শান্ত হয়ে গেল। চারদিক আলোয় ভরে গেল। মনে হল আকাশ ফেটে সাদা শিখা নেমে আসছে। ছায়ারা একে একে গলে গেল, গঙ্গার জলে মিলিয়ে গেল। শিবলিঙ্গে জ্বলতে থাকা দাগও মিলিয়ে গেল।
অয়ন মাটিতে পড়ে গেল, নিস্তেজ। সায়ন্তনী তাকে ধরে চিৎকার করল, “না! তুই মরবি না।” কিন্তু অয়ন তখনও মৃদু হেসে বলল, “রক্তঋণ শোধ হয়েছে।”
তখন গঙ্গার জলে আবার হালকা আলো ভেসে উঠল। এক কণ্ঠস্বর শোনা গেল, মৃদু কিন্তু তীক্ষ্ণ—“ঋণ শোধ হয়েছে, কিন্তু খেলা শেষ হয়নি।”
সায়ন্তনী শিউরে উঠল। অয়ন অচেতন, তার কপালে প্রতীকের দাগ মুছে গেছে, কিন্তু বুকের ওপর লাল রেখা যেন এখনও জীবন্ত।
পর্ব ৯ : শ্মশানের রাজ্য
অয়ন ধীরে ধীরে চোখ খুলল। শরীরটা ভাঙা, হাড়গোড় যেন ভেঙে যাচ্ছে, তবু মনে হল সে বেঁচে আছে। পাশে বসে সায়ন্তনী কাঁদছিল, চোখ লাল, গলা ভাঙা। অয়ন ঠোঁট শুকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আমি মরিনি?” সায়ন্তনী মাথা নেড়ে বলল, “না, তুই মরিসনি। কিন্তু তোর বুকের ওপর যে লাল রেখা বসে আছে, সেটা এখনো জ্বলছে।” অয়ন চোখ নামাল, দেখল বুকের মাঝখানে আগুনের দাগের মতো এক লাল প্রতীক স্পষ্ট—ত্রিভুজের ভেতর এক চোখ। মনে হল প্রতীকটা নিজে থেকে শ্বাস নিচ্ছে, ওঠানামা করছে তার বুকের সাথে।
সেই রাতেই অয়ন অদ্ভুত এক স্বপ্নে ঢুকল। সে দেখল, সে হাঁটছে এক অন্তহীন শ্মশানের ভেতর। চারপাশে অগণিত চিতা, প্রতিটিতে আগুন জ্বলছে, আর প্রতিটি চিতার ভেতর থেকে নীল চোখওয়ালা মুখ ভেসে উঠছে। তারা সবাই একসাথে বলছে, “তুই আমাদের ঋণী।” অয়ন কাঁপতে কাঁপতে হাঁটতে লাগল, আরেকটু পর দেখল সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক সিংহাসন, হাড় আর ছাই দিয়ে গড়া। সেই সিংহাসনে বসে আছে এক বিশাল ছায়ামূর্তি। তার চোখ দুটো লালচে আগুন, হাতে ত্রিশূল। তার কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল, “তুই আমার রাজ্যে ঢুকে পড়েছিস।”
অয়ন কণ্ঠ কাঁপিয়ে বলল, “আমি মুক্তি চাই।” ছায়ামূর্তি হেসে উঠল, “মুক্তি? অমায়া তন্ত্রে কেউ মুক্তি পায় না। যে একবার এই দ্বারে আসে, সে আমার রাজ্যে বেঁচে থাকে কিংবা মরে যায়। তুই ঋণ শোধ করেছিস, ঠিক, কিন্তু এখন তুই আমার চিহ্ন বহন করছিস।” অয়ন গলা শুকিয়ে গেল। সে কিছু বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই পাশে সায়ন্তনীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। আশ্চর্যের বিষয়, সেও এই স্বপ্ন-শ্মশানে দাঁড়িয়ে আছে।
সায়ন্তনী ফিসফিস করে বলল, “এটা শুধু তোর স্বপ্ন নয়, আমাকেও টেনে এনেছে।” তারা দুজনেই বুঝল, এবার আর খেলার সীমা নেই। এটা শ্মশানের রাজ্য, অগ্নিদ্বারের পরের স্তর। এখানে যেটা হবে, সেটা সত্যি হয়ে যাবে।
ছায়ামূর্তি ত্রিশূল মাটিতে গেঁথে দিল। মুহূর্তেই চারপাশে ছায়াদের ফৌজ বেরিয়ে এল। তারা একসাথে গলা মেলাল—“অর্ঘ্য দাও, আত্মা দাও।” সায়ন্তনী কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আমরা তো সব দিয়েছি। আর কী চাইছে?” অয়ন গভীর গলায় বলল, “এখন তারা আমাদের পুরো আত্মা চাইছে। যদি না দিই, এই রাজ্যে আটকে পড়ব।”
তখন অয়ন মনে করল পুঁথির শেষ দিকের একটা বাক্য—“শ্মশানের রাজ্যে মুক্তি একটাই—আত্মাকে আগুনে সমর্পণ নয়, আত্মাকে আলোয় জাগানো।” কিন্তু আলো কোথায়? চারদিকে শুধু আগুন আর ছাই।
সায়ন্তনী কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তুই কিছু কর, না হলে আমরা এখানেই শেষ।” অয়ন চোখ বন্ধ করল। তার মায়ের মুখ, বাবার হাসি, শৈশবের রোদ্দুর, স্কুলের দিন, বন্ধুত্ব—সব ছবি ভেসে উঠল। এইসবই তো আলো। সে হাত জোড় করে দাঁড়াল, বুকের প্রতীক জ্বলতে শুরু করল। ছায়ামূর্তি গর্জে উঠল, “না! এভাবে নয়।”
অয়ন দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আমি আমার আত্মাকে আগুনে নয়, আলোয় সমর্পণ করছি।” বুকের প্রতীকটা আগুন থেকে হঠাৎ সাদা আলোতে রূপান্তরিত হল। সেই আলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। ছায়াদের চিৎকার ভেসে উঠল, তারা গলে যেতে লাগল, ছাই হয়ে মিলিয়ে গেল। সায়ন্তনী আলোয় ভেসে উঠল, তার কবজির দাগ মিলিয়ে গেল।
ছায়ামূর্তি ত্রিশূল উঁচিয়ে গর্জন করল, “তুই আমার রাজ্য ভাঙছিস।” কিন্তু অয়ন চোখ খুলে সরাসরি তাকাল তার দিকে। বলল, “তোর রাজ্য ভয়ের ওপর দাঁড়িয়ে। আমি ভয়কে মেনে নিলাম না।” মুহূর্তেই ছায়ামূর্তির শরীর ফেটে গেল, অগ্নিশিখা ছড়িয়ে পড়ল, আর শ্মশানের রাজ্য ভেঙে পড়ল এক বিশাল বিস্ফোরণে।
অয়ন আর সায়ন্তনী চিৎকার করে জেগে উঠল। তারা দুজনেই নিজেদের বাড়িতে, কিন্তু বুক ধড়ফড় করছে, শরীর ঘামে ভিজে গেছে। তারা একে অপরকে ফোনে জানাল, “তুইও দেখেছিস?”—“হ্যাঁ।”
অয়ন আয়নার সামনে দাঁড়াল। বুকের প্রতীকটা নেই, কেবল পোড়া চামড়ার মতো দাগ। কিন্তু আয়নায় তাকাতেই সে চমকে উঠল। আয়নায় তার পিছনে সেই ছায়ামূর্তির অবয়ব এক মুহূর্তের জন্য ভেসে উঠল, তারপর মিলিয়ে গেল।
সে বুঝল, শ্মশানের রাজ্য থেকে তারা বেরিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ছায়া পুরোপুরি মরে যায়নি। এটা শেষ নয়।
পর্ব ১০ : মুক্তির ছাই
অয়ন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। বুকের দাগ পোড়া চামড়ার মতো শুকনো, কিন্তু চোখের গভীরে এখনও সেই ভয় লেগে আছে। আয়নার ভেতর ভেসে ওঠা ছায়ামূর্তিটা তার মনে করিয়ে দিল—যতই সে আলোতে দাঁড়াক, তন্ত্রের ছায়া তাকে ছাড়বে না। তার ফোনটা বেজে উঠল, সায়ন্তনী। অপর প্রান্তে গলা কাঁপছিল, “অয়ন, আজ রাতে ওরা আবার ডাকছে। আমি স্বপ্নে দেখেছি। কালকেতুর আখড়া এবার শেষবারের মতো খুলবে। যদি আমরা না যাই, তাহলে হয়তো ওরা আমাদের আত্মা পুরোপুরি টেনে নেবে।”
অয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে হচ্ছিল শরীরের ভেতরে এখনো আগুন জ্বলছে। সে ধীরে ধীরে বলল, “তাহলে শেষবার যেতে হবে।”
রাত নামল। গঙ্গার ওপর ভেসে উঠল অদ্ভুত নীলাভ কুয়াশা। চাঁদ নেই, তারা নেই, অথচ আলো আছে। অয়ন আর সায়ন্তনী পৌঁছাল কালকেতুর আখড়ায়। এবার জায়গাটা একেবারে বদলে গেছে। শিবলিঙ্গ ভেঙে গেছে, মাটির ফাঁক থেকে আগুন বেরোচ্ছে, চারপাশে কালো ছাই উড়ে বেড়াচ্ছে। বাতাসে কান্নার আওয়াজ, যেন শত শত মৃত আত্মা চিৎকার করছে।
হঠাৎ তারা দুজনেই দেখতে পেল এক বিশাল অগ্নিদ্বার আবার দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু এবার সেটা রক্তলাল। তার ওপর অসংখ্য চোখ আঁকা, সবগুলো তাদের দিকে তাকিয়ে। দ্বারের ওপাশ থেকে ধোঁয়া আর হাহাকার আসছে। তারপর ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো সেই ছায়ামূর্তি—এবার সে আরও বিশাল, সিংহাসনের রাজা নয়, যেন অগ্নি-দেবতার অন্ধকার প্রতিবিম্ব। সে গর্জন করে বলল, “তোমরা আমার খেলায় এসেছো, কিন্তু খেলাটা শেষ হয়নি। তোমরা ভয় জিতেছো, ছায়া ভেঙেছো, তবু আমার রাজ্যে ঋণ রয়ে গেছে। মুক্তি পেতে চাইলে এবার তোমাদের আত্মা দিতে হবে। না হলে তোমাদের রক্ত আমার আগুনে জ্বলবে।”
সায়ন্তনী ভয় পেলেও শক্ত গলায় বলল, “আমরা আত্মা দেব না। আমরা আলো বেছে নিয়েছি।” ছায়ামূর্তি হেসে উঠল, “আলো? আলো তো ভস্ম হয়ে যায়। ছাইয়ের রাজ্যেই সব শেষ হয়।”
অয়ন বুকের ওপর হাত রাখল। প্রতীকটা আবার জ্বলতে শুরু করেছে। সে বুঝল, শেষ লড়াই এটাই। সায়ন্তনী তার হাত ধরল, বলল, “আমরা একসাথে করব।” তারা দুজন মন্ত্র পড়তে শুরু করল—“ॐ অমায়া মুক্তি স্বাহা, ছায়া ভাঙো, আলো জাগাও।”
অগ্নিদ্বারের ওপাশ থেকে হাহাকার আরও জোরে ভেসে এলো। ছায়ামূর্তি ত্রিশূল উঁচিয়ে গর্জন করল, “তোমাদের আলো আমি ছাই করে দেব।” সে এগিয়ে এলো, চারপাশ আগুনে ভরে গেল। কিন্তু অয়ন আর সায়ন্তনী হাত শক্ত করে মন্ত্র পড়তে থাকল। মন্ত্রের শব্দ থেকে সাদা আলো বেরোতে লাগল। প্রথমে ক্ষীণ, তারপর তীব্র, চারদিক আলোকিত হয়ে গেল।
অগ্নিদ্বারের চোখগুলো একে একে ফেটে গেল। রক্তধারা বেরোল, মাটিতে পড়তেই সাদা আলোতে মিলিয়ে গেল। ছায়ামূর্তি চিৎকার করে উঠল, তার দেহ ফেটে যেতে লাগল, আগুন থেকে ধোঁয়া, ধোঁয়া থেকে ছাই। সে গর্জে উঠল, “তোমরা ভাবছো মুক্তি পাবে? মুক্তি বলে কিছু নেই, সবকিছুই ছাই।”
অয়ন দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “ছাই মানেই শেষ নয়। ছাই থেকেই আলো জন্মায়।” সে বুকের প্রতীকটা তুলে ধরল, প্রতীক সাদা আলোতে জ্বলে উঠল। সেই আলো ছায়ামূর্তির ভেতরে ঢুকে গেল। মুহূর্তেই এক বিস্ফোরণ হল, আগুন ভেঙে পড়ল, আখড়া দাউদাউ করে জ্বলে উঠল।
অগ্নিদ্বার ভেঙে গেল, ভেতর থেকে বেরোল কেবল ছাই আর বাতাস। ছায়ামূর্তি মিলিয়ে গেল, তার চিৎকার শূন্যে ভেসে রইল—“মুক্তি নেই… মুক্তি নেই…” তারপর নিস্তব্ধতা।
অয়ন আর সায়ন্তনী মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। চারপাশ আগুনে ছাই হয়ে গেছে, কিন্তু আকাশে ভোরের প্রথম আলো ফুটছে। পাখির ডাক শোনা গেল, গঙ্গার জল শান্ত। মনে হচ্ছিল দীর্ঘ অন্ধকার শেষে নতুন দিন এসেছে।
অয়ন ধীরে ধীরে উঠে বসল। বুকের দাগটা নেই, শুধু হালকা পোড়া দাগ, কিন্তু আর জীবন্ত নয়। সায়ন্তনীর কবজিও স্বাভাবিক। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে বুঝল—এখন তারা মুক্ত।
কিন্তু ঠিক তখনই গঙ্গার জলে ক্ষীণ নীল আলো ভেসে উঠল। সায়ন্তনী ফিসফিস করে বলল, “দেখছিস?” অয়ন শান্ত গলায় উত্তর দিল, “হ্যাঁ, কিন্তু সেটা আর ভয় নয়। ওটা শুধু ছাইয়ের আলো।”
তারা দুজন হাঁটতে হাঁটতে আখড়া ছেড়ে বেরিয়ে এলো। সকালের রোদ গায়ে পড়ছিল, গরম, পরিচিত, মানবিক। শহরের কোলাহল দূরে শোনা যাচ্ছিল।
অয়ন অনুভব করল, তার ভেতরে আর কোনও ভয় নেই। হয়তো অমায়া তন্ত্র চিরকালই রয়ে যাবে পৃথিবীর অন্ধকার কোণে, নতুন শিকার খুঁজবে, কিন্তু সে আর তার শৃঙ্খলে বাঁধা নয়।
সায়ন্তনী তার পাশে হাঁটছিল। দুজনেই জানত, তারা ভয়, ছায়া আর আগুন পেরিয়ে এসেছে। এখন তাদের কাছে মুক্তি মানে মৃত্যু নয়, বরং জীবনের প্রতিটি আলোকে আঁকড়ে ধরা।
আর কালকেতুর আখড়ার জায়গাটা? সেদিন থেকে ওখানে আর কেউ যায়নি। গ্রামবাসীরা বলে, এখন ওটা শুধু পোড়া ছাইয়ের স্তূপ, যেখানে রাতের আঁধারেও কোনও ছায়া নড়ে না।
অয়ন মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দাঁড়ায়, বুকের পোড়া দাগটা দেখে। আর হেসে ফেলে। কারণ সে জানে—ওটা আর অভিশাপ নয়, ওটা তার জয়।
সমাপ্ত