Bangla - প্রেমের গল্প

মেঘলা দুপুরে তুমি

Spread the love

মধুরিমা বসু


অর্ণবের জীবন ছিল ভীষণ ব্যস্ততার, ভিড়ে ভরা শহরের একঘেয়ে ছন্দের। প্রতিদিনের যান্ত্রিক সকাল আর রাত তাকে যেন ধীরে ধীরে গ্রাস করছিল। অফিস থেকে বাড়ি, বাড়ি থেকে অফিস—এটাই তার জীবনের রুটিন হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে নিজের ভেতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা অনুভব করত সে, যেন কোথাও কিছু হারিয়ে গেছে। এই শূন্যতাই তাকে শহর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করেছিল। তাই হঠাৎ করেই একদিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল—শান্তি খুঁজতে পাহাড়ের কোলে যাবে। সে ঠিক করল, কোনো জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রে নয়, বরং এক প্রত্যন্ত গ্রামে যাবে, যেখানে শহরের কোলাহল নেই, শুধু প্রকৃতির নিশ্বাস টের পাওয়া যায়। ট্রেন থেকে নামার পর ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিপে চলতে চলতে যখন সেই গ্রামে পৌঁছল, তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেলের দোরগোড়ায়। কিন্তু সময়ের সেই সীমা যেন অদ্ভুতভাবে এখানে আলাদা। আকাশ জুড়ে ঘন মেঘ, পাহাড়কে ঢেকে রেখেছে সাদা-কালো তুলোর মতো কুণ্ডলী পাকানো কুয়াশা, আর তার ভেতর লুকানো এক রহস্যময় নীরবতা। অর্ণব প্রথমবার অনুভব করল—এই গ্রাম যেন কেবল ভৌগোলিকভাবে শহর থেকে দূরে নয়, বরং অন্য এক সময়ের ভেতরে আটকে আছে।

গ্রামের সরু মাটির রাস্তা বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে চারপাশে তাকাল। কাঁচা ঘরগুলো কুয়াশায় ঢাকা, ছাদের মাটির টালি ভিজে গাঢ় রঙ ধারণ করেছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই, কেবল দূরে একটা পাখির ডাক কানে এল। গ্রামের মানুষজনও যেন খুব বেশি বাইরে বেরোয় না, কেবল মাঝে মাঝে দু-একজন বৃদ্ধ বা বাচ্চা ছুটোছুটি করতে দেখা গেল। অর্ণবের মনে হল, যেন কোনো অদৃশ্য চাদর গ্রামটিকে ঢেকে রেখেছে—একটা স্নিগ্ধ অথচ অচেনা ছায়া। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণার শব্দ দূর থেকে ভেসে আসছিল, কিন্তু সেই সুরও কেমন যেন অদ্ভুতভাবে নিস্তব্ধতার অংশ হয়ে গিয়েছে। গ্রামের ভেতরকার ছোট্ট সরাইখানায় থাকার ব্যবস্থা করল অর্ণব। ঘরের জানালা খুলতেই তার চোখে ধরা পড়ল ধূসর আকাশের নিচে লুকোনো পাহাড়চূড়া, যার গা বেয়ে মেঘ নেমে এসেছে নিচে, ঠিক যেন কেউ হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবে। সে মুহূর্তে অর্ণবের মনে হল—এ যেন কেবল প্রকৃতির দৃশ্য নয়, বরং কোনো অচেনা হাত তাকে ডেকে আনছে এই অদ্ভুত পরিবেশে।

সময় গড়াতে গড়াতে দুপুর ক্রমশ গভীরতর হল। সূর্যের আলো পুরোপুরি ঢেকে গেল মেঘে, আর চারপাশে নেমে এল একটা অদ্ভুত ধূসর আলো। সাধারণত দুপুরে গ্রামের প্রাণবন্ত চেহারা থাকার কথা, কিন্তু এখানে সবকিছু যেন একেবারেই উল্টো। মেঘের আবরণে গাঢ় হয়ে উঠল ছায়া, বাতাসে এল শীতলতা, আর অর্ণব অনুভব করল এক অচেনা ভীতি। অথচ সেই ভীতির ভেতরেও ছিল এক অদ্ভুত টান। পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তার মনে হল, যেন কেউ তাকে লক্ষ্য করছে, যেন দৃষ্টি অতিক্রম করে কারও চোখ তাকে অনুসরণ করছে। কিন্তু চারদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। গ্রামটা এতটাই নির্জন যে, মনে হয় প্রতিটি গাছ, প্রতিটি ঘর, প্রতিটি ছায়া যেন নিজস্ব কোনো গল্প লুকিয়ে রেখেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে তার মনে হল—এই গ্রাম কোনো সাধারণ গ্রাম নয়; এখানে সময় থেমে আছে, আর সেই সময়ের গহ্বরেই হয়তো লুকিয়ে আছে অচেনা কোনো রহস্য।

অর্ণবের মনে হল, এই অদ্ভুত দুপুরে গ্রামটা যেন তাকে স্বাগত জানাচ্ছে, আবার একই সঙ্গে সতর্কও করছে। সে জানালার ধারে বসে চারপাশের দৃশ্য দেখছিল, মেঘের ভেতরে ডুবে থাকা পাহাড় যেন কোনো অদৃশ্য রহস্যের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। অচেনা গ্রামে প্রথম দিনেই তার মনে হল—এখানে কেবল প্রকৃতি নয়, কিছু ভিন্ন অনুভব আছে, যা তাকে গভীরভাবে নাড়া দিচ্ছে। শহরের একঘেয়ে জীবনে সে যেটা খুঁজছিল—অদ্ভুততা, রহস্য, আর আবেগের ছোঁয়া—সবকিছুই যেন এই গ্রামে মিশে আছে। মেঘে ঢাকা এই দুপুর তাকে ভেতর থেকে নতুন এক যাত্রার আহ্বান জানাচ্ছিল, যার শুরু আজ থেকে, কিন্তু শেষ কোথায়—তা সে নিজেও জানে না। অর্ণব জানত না যে, এই নিস্তব্ধ গ্রামেই তার সঙ্গে ঘটতে চলেছে এমন এক ঘটনা, যা চিরকাল তার জীবন বদলে দেবে, আর এই অচেনা মেঘলা দুপুরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা রহস্যময় চোখের সঙ্গে তার দেখা হয়ে যাবে খুব শিগগিরই।

গ্রামে আসার দ্বিতীয় দিনটিও ছিল ভীষণ মেঘলা। আকাশের রঙ ধূসর, পাহাড়গুলো যেন কালো কালি দিয়ে আঁকা ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে। সকাল থেকে হালকা ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছিল, তারপর দুপুরের দিকে বৃষ্টি থেমে গিয়ে চারপাশে ভেসে এল এক অন্য রকম শান্তি। সরাইখানা থেকে বেরিয়ে অর্ণব হাঁটতে শুরু করল গ্রামের কাঁচা পথ ধরে। সে চেয়েছিল একেবারে নির্জন কোনো জায়গায় গিয়ে প্রকৃতিকে উপভোগ করবে। পথের দু’পাশে ঘন সবুজ গাছপালা, আর মাঝে মাঝে ছোট ছোট কুঁড়েঘর দেখা যাচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তার মনে হল, কেউ যেন তাকে দেখছে। সেই অনুভূতি এতটাই প্রবল ছিল যে, সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও একবার পিছন ফিরে তাকাল। কাউকে দেখা গেল না, কেবল মেঘের চাদরে ঢাকা পাহাড়ের ঢালে হাওয়া বইছে। ঠিক তখনই সামনে দূরে একটি মেয়েকে দেখতে পেল। মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল পুরোনো এক কুঁড়েঘরের আঙিনায়। তার চেহারা অদ্ভুত শান্ত, অথচ চোখে ছিল গভীর রহস্য। অর্ণবের মনে হল, এই চোখ যেন কোথাও আগে দেখেছে, যদিও বাস্তবে তা কখনো সম্ভব নয়।

মেয়েটির পোশাক দেখে অর্ণব আরও অবাক হল। তার পরনে ছিল হালকা বাদামি রঙের এক সাদাসিধে পোশাক, যার কাপড়টা যেন বহুদিন আগের, সময়ের গন্ধ মাখানো। মাথায় ছিল ওড়নার মতো একটি কাপড়, যা তাকে একেবারেই অন্য এক যুগের মানুষ বলে মনে করাচ্ছিল। অথচ তার ভঙ্গি, দাঁড়ানোর ভঙ্গি, আর মৃদু হাসিতে এক অদ্ভুত স্বাভাবিকতা ছিল। অর্ণব ভাবল, হয়তো এ গ্রামের কোনো স্থানীয় মেয়ে, কিন্তু তার চেহারায় এক ধরনের অচেনা দীপ্তি ছিল যা সহজে ব্যাখ্যা করা যায় না। দূর থেকে তাকে দেখেই অর্ণবের মনে হল, মেয়েটি যেন তাকে অনেক দিন ধরে চেনে। যেন তার প্রতিটি পদক্ষেপের অপেক্ষায় ছিল এতদিন। অথচ মায়ার চোখে এমন এক নীরবতার ছাপ ছিল, যা অর্ণবকে এক মুহূর্তে কাঁপিয়ে দিল। মনে হল, এই চোখ শুধু তাকিয়ে নেই, বরং অনেক না-বলা গল্প লুকিয়ে রেখেছে।

অর্ণব ধীরে ধীরে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেল। সে কোনো কথা বলছিল না, কেবল স্থির দৃষ্টিতে অর্ণবকে দেখছিল। তার চোখে ছিল না কৌতূহল, না ভীতি—বরং এক অদ্ভুত শান্তি, যেন অর্ণবের আগমনের ব্যাপারে সে আগে থেকেই জানত। অবশেষে অর্ণব কিছুটা দ্বিধা নিয়েই বলল, “তুমি এখানে থাকো?” প্রশ্নটা খুব সাধারণ ছিল, কিন্তু মায়ার উত্তর সাধারণ নয়। সে খুব শান্তভাবে বলল, “হ্যাঁ, আমি এখানেই আছি। অনেকদিন ধরে।” তার কণ্ঠে ছিল নরম সুর, যেন বাতাসে ভেসে আসা কোনো অচেনা সঙ্গীত। অর্ণব বুঝতে পারছিল না কেন, কিন্তু কথাগুলো তার ভেতর এক অদ্ভুত কম্পন জাগাল। তার মনে হল, মেয়েটির প্রতিটি শব্দ সময়ের ভেতর দিয়ে ছুটে এসেছে, আর এখন তার সামনে এসে থেমেছে। অর্ণব আরও অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, মেয়েটি তাকে নিয়ে মোটেও বিস্মিত নয়। বরং সে এমন আচরণ করছে যেন অর্ণবের সঙ্গে তার বহুদিনের পরিচয় আছে।

অর্ণব কিছুক্ষণ নীরব দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর সাহস সঞ্চয় করে আবার বলল, “আমি শহর থেকে এসেছি। এখানে দু’দিন হল আছি। গ্রামটা খুব অদ্ভুত লাগছে।” মায়া মৃদু হাসল। সেই হাসি ছিল নিঃশব্দ, কিন্তু চোখের ভেতর যেন বজ্রপাতের মতো আলো ঝলসে উঠল। সে উত্তর দিল, “অদ্ভুত তো বটেই। এই গ্রামকে সবাই একইভাবে দেখে না। কেউ শান্তি খুঁজে পায়, কেউ ভয় পায়। তুমি কোনটা দেখছো?” অর্ণব হতবাক হয়ে গেল। তার মনে হচ্ছিল, এই অচেনা মেয়ে যেন তার মনের ভেতর ঢুকে পড়ছে, প্রতিটি অনুভূতি পড়ে নিচ্ছে। সে উত্তর দিতে গিয়েও থেমে গেল। তার ভেতরে এক ঝড় বইছিল—এ মেয়ে কে? কেন তার মধ্যে এত রহস্য? কেন সে সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রতিচ্ছবি বলে মনে হয়? অথচ আশ্চর্যজনকভাবে, মায়ার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকতে তার একটুও অস্বস্তি লাগছিল না। বরং মনে হচ্ছিল, এই দেখা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরিণতি। অর্ণব বুঝতে পারছিল না, কিন্তু মনে হচ্ছিল—তার জীবন হয়তো এখান থেকেই বদলে যাবে।

অর্ণবের দ্বিতীয় দিনের বিকেলটা কেটে গেল এক অদ্ভুত অস্বস্তি আর বিস্ময়ের ভেতর দিয়ে। সেই মেয়েটির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে তার মন একেবারেই স্থির হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, পরিচয়ের খুব স্বাভাবিক অথচ গভীর কোনো সেতু যেন তৈরি হয়ে গেছে, অথচ সেই সেতুর দিক বা গন্তব্য কেউই জানে না। সন্ধ্যার দিকে সে গ্রামটার ভেতর হাঁটতে বেরোল। গ্রামটার প্রতিটি কোণ অর্ণবের কাছে নতুন, আবার একই সঙ্গে অদ্ভুতভাবে পরিচিত লাগছিল। সরু কাঁচা পথ ধরে হেঁটে গিয়ে সে পৌঁছল এক পুরোনো অশ্বত্থ গাছের নিচে, যেখানে কয়েকজন গ্রামবাসী বসেছিল। তাদের ভেতর একজন বৃদ্ধ লোক, সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে, হাতে লাঠি নিয়ে ধীরে ধীরে সবাইকে গল্প শোনাচ্ছিলেন। অর্ণব আগ্রহ নিয়ে সেখানে গিয়ে বসল। বৃদ্ধের চোখে বয়সের ছাপ থাকলেও দৃষ্টিতে ছিল গভীর শান্তি, আর কথার মধ্যে ছিল অদ্ভুত মাধুর্য। গ্রামবাসীরা তাকে সবাই “দাদু” বলেই সম্বোধন করছিল।

আলাপ শুরু হতেই দাদু অর্ণবকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “শহর থেকে এসেছো তো? অনেক দূর থেকে এখানে আসা সহজ নয়। শান্তি খুঁজতে এসেছো নিশ্চয়ই?” অর্ণব অবাক হল, কারণ এটাই তার ভেতরের প্রকৃত কারণ ছিল। সে শুধু হেসে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, একটু অন্যরকম পরিবেশ চাইছিলাম।” দাদু ধীরে ধীরে হাসলেন। তারপর কিছুক্ষণ নীরব থেকে হঠাৎই বললেন, “শোনো বাবা, এই গ্রাম শান্ত হলেও এখানে কিছু বিষয় আছে যা সবার চোখে ধরা পড়ে না। তুমি কি আজ দুপুরে কারও সঙ্গে দেখা করেছো?” প্রশ্নটা শুনে অর্ণব কেঁপে উঠল। সে মুহূর্তে মনে হল, দাদু যেন তার ভেতরের লুকোনো ঘটনাগুলোও পড়ে ফেলছেন। সে কিছুটা দ্বিধা নিয়েই বলল, “একটা মেয়েকে দেখেছিলাম। খুব অদ্ভুত লাগছিল। কিন্তু সে পুরোপুরি স্বাভাবিক আচরণ করছিল।” দাদুর চোখ তখন আরও গভীর হয়ে উঠল। তিনি নিচু স্বরে বললেন, “সে মেয়ে যদি সত্যিই মেঘলা দুপুরে তোমার সামনে এসে থাকে, তবে বুঝতে হবে তুমি অন্য কিছু দেখেছো। এখানে এক মেয়ের দেখা পাওয়া যায়, যার নাম মায়া। কিন্তু মনে রেখো, সে তোমার সময়ের নয়। সে বহু আগের মানুষ।”

অর্ণব প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইলো না। তার যুক্তিবাদী মন সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করল। সে বলল, “কিন্তু আমি তো স্পষ্ট দেখেছি। সে আমার সঙ্গে কথা বলেছে। বাস্তবের মতোই মনে হচ্ছিল। এটা কীভাবে সম্ভব?” দাদু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বাস্তব আর অবাস্তবের সীমানা এই গ্রামে অনেক সময় মিলেমিশে যায়। মায়া এই গ্রামে বহু বছর আগে বেঁচে ছিল। হঠাৎ এক দুর্ঘটনায় তার জীবন শেষ হয়, কিন্তু তার আত্মা মুক্তি পায়নি। তখন থেকেই মেঘলা দুপুরে সে ফিরে আসে, যেন কারও অপেক্ষায় আছে। গ্রামের অনেকে তাকে দেখেছে, কিন্তু সবাই বিশ্বাস করে না। কেউ ভয়ে দূরে সরে যায়, কেউ ভাবে চোখের ভুল। কিন্তু একথা সত্যি যে, সে তোমার মতোই একেবারে বাস্তব মনে হয়। তুমি যদি তাকে দেখো, তবে সাবধান থেকো। সে অচেনা হলেও তোমাকে এক অদ্ভুত টানে টেনে নেবে।” দাদুর কণ্ঠে ছিল না ভয় দেখানোর সুর, বরং ছিল এক ধরনের সতর্কতা, এক ধরনের করুণ সত্য।

অর্ণবের ভেতরে তখন দ্বন্দ্ব শুরু হল। সে কি সত্যিই ভিন্ন সময়ের কারও সঙ্গে কথা বলেছে? নাকি তার কল্পনার জালেই আটকে পড়েছে? শহরের পড়াশোনায় আর আধুনিক যুক্তিতে বিশ্বাসী সে ছেলে এমন কিছুকে সহজে মানতে চায় না। কিন্তু মনে মনে একটা অস্বীকার-না-করা টান কাজ করছিল। মায়ার চোখ, তার কণ্ঠ, তার শান্ত অথচ রহস্যময় উপস্থিতি—এসব কোনো হ্যালুসিনেশন হতে পারে না। দাদুর সতর্কবাণী অর্ণবকে আরও কৌতূহলী করে তুলল। সে বুঝতে পারছিল, এখানে কিছু একটা রহস্য আছে, যা হয়তো তার জীবনকেই অন্য দিকে নিয়ে যাবে। দাদুর কথার শেষে যখন চারপাশে আবার পাহাড়ি বাতাস বইতে লাগল, তখন অর্ণব অনুভব করল—এক অচেনা সুর তার কানে ভেসে আসছে, যেন পাহাড়ের বুক চিরে মায়ার অদৃশ্য কণ্ঠস্বর ডাকছে তাকে। আর অর্ণব জানত, সে আর সেই ডাক এড়িয়ে যেতে পারবে না।

পরদিন দুপুরে আবারও আকাশ জুড়ে নেমে এল ঘন মেঘের আবরণ। চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে উঠেছিল, যেন প্রকৃতি নিজেই নিশ্বাস আটকে রেখেছে। অর্ণব অজানাই জানত, এই সময়েই তার মনে হয় কিছু ঘটতে চলেছে। গত রাত দাদুর সতর্কবাণী তার মনে বারবার ভেসে উঠেছিল—“সে তোমার সময়ের নয়।” যুক্তি দিয়ে নিজেকে বোঝাতে চাইলেও অর্ণবের ভেতরে কৌতূহলের আগুন আরও জ্বলে উঠছিল। তাই দুপুর নামতেই সে আবার বেরিয়ে পড়ল গ্রামের নির্জন পথে, সেই পুরোনো কুঁড়েঘরের দিকেই যেখানে প্রথমবার মেয়েটিকে দেখেছিল। অদ্ভুতভাবে, মনে হচ্ছিল মেঘের ছায়া তাকে ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। আর সত্যিই, কুঁড়েঘরের আঙিনায় দাঁড়িয়ে ছিল সেই মেয়েটি—মায়া। ঠিক আগের দিনের মতোই শান্ত, অথচ চোখে লুকোনো গভীর রহস্য। তার মুখে দেখা গেল সেই পরিচিত মৃদু হাসি, যেন অর্ণবের আগমনের অপেক্ষাতেই ছিল সে। অর্ণবের বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে গেল, কিন্তু সে সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গেল।

মায়া এবার নিজেই কথা শুরু করল। বলল, “তুমি আবার এসেছো। ভেবেছিলাম হয়তো আসবে।” তার কণ্ঠস্বর ছিল অদ্ভুত মোলায়েম, যেন বাতাসের ভেতর দিয়ে বহু পুরোনো কোনো সুর ভেসে আসছে। অর্ণব জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখানে একা থাকো?” মায়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দিল, “আমি একাই আছি। অনেক বছর ধরেই।” কথাগুলোতে এক অদ্ভুত ব্যঞ্জনা ছিল। অর্ণব প্রথমে ভাবল, হয়তো সে গ্রামের প্রাচীন কোনো পরিবারের মেয়ে, একেবারে সাদাসিধে জীবন কাটায়। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হল, উত্তরটা যেন সময়ের গভীর থেকে ভেসে এসেছে। আলাপ চলতে চলতে অর্ণব বুঝতে শুরু করল, মেয়েটির কথার ভেতর দিয়ে অন্য এক যুগের ছাপ ফুটে উঠছে। সে এমন সব শব্দ, এমন সব অভ্যাসের কথা বলছিল, যা আজকের পৃথিবীতে শোনা যায় না। যেমন, মায়া গ্রামের মেলার কথা বলছিল, কিন্তু সেই মেলার বর্ণনা এমন ছিল যা বহু দশক আগেকার। সে নদীর ধারে আলপথে প্রদীপ জ্বালানোর কথা বলছিল, কিংবা কচি বাঁশ দিয়ে তৈরি খেলার কথা বলছিল—যা অর্ণবের শৈশবেও কখনো দেখা যায়নি।

অর্ণবের মনে অদ্ভুত এক স্রোত বইতে শুরু করল। যুক্তিবাদী মস্তিষ্ক তাকে টেনে আনছিল বাস্তবের জগতে, বলছিল—এ অসম্ভব। কিন্তু হৃদয়ের ভেতর অন্য এক টান ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠছিল। মায়ার চোখের ভেতরে অর্ণব দেখছিল এক গভীর সময়ের গহ্বর, যেখানে আজকের দিন ঢুকে যাচ্ছে আর অতীতের ছায়া বেরিয়ে আসছে। সে কিছুক্ষণ দ্বিধা করে বলল, “তুমি কোন সময়ের কথা বলছো? আজকের দিনে তো এগুলো কিছুই নেই।” মায়া তখন এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল, যেন উত্তর দেওয়ার আগেই তার মনের ভেতর সব পড়ে ফেলল। তারপর মৃদু হেসে বলল, “আমার সময় তোমাদের আজকের মতো নয়। আমার পৃথিবী অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। তবুও আমি রয়ে গেছি।” কথাগুলো শুনে অর্ণবের শরীর শীতল হয়ে উঠল। তার মনে হল, সে সত্যিই এক অদৃশ্য সময়ের ফাঁদে আটকে পড়ছে—যেখানে বাস্তব আর অতীত মিলে যাচ্ছে, যেখানে বর্তমান আর ইতিহাসের সীমানা ভেঙে যাচ্ছে।

দুজনের আলাপ চলতে থাকল, আর অর্ণব ক্রমে নিজের চারপাশ ভুলতে লাগল। সে বুঝতে পারছিল, মেয়েটি কোনো সাধারণ মানুষ নয়। তার প্রতিটি শব্দে ছিল অতীতের ছাপ, তার প্রতিটি দৃষ্টিতে ছিল অপূর্ণতার ছায়া। তবুও মায়ার সঙ্গে কথা বলার মধ্যে অর্ণব এক ধরনের শান্তি খুঁজে পাচ্ছিল, যা সে শহরের কোলাহলে কোনোদিন পায়নি। মনে হচ্ছিল, সময়ের সীমা ভেঙে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক অপূর্ণ কাহিনি, আর সে নিজেই সেই কাহিনির সাক্ষী হতে এসেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে একটা ভয়ও কাজ করছিল—এই টান তাকে কোথায় নিয়ে যাবে? দাদুর সতর্কবাণী কি সত্যি হয়ে উঠছে? মায়ার হাসি, তার নরম স্বর, তার অতীতের ছাপ—সব মিলিয়ে অর্ণব তখন বুঝতে পারল, সে ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত সময়ের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছে, যেখান থেকে হয়তো আর বেরোনো সম্ভব নয়।

মেঘলা দুপুরের সেই নিস্তব্ধ পরিবেশে অর্ণবের সামনে মায়া যেন ধীরে ধীরে নিজের আসল রূপ প্রকাশ করতে শুরু করল। গ্রামের আঁকাবাঁকা সরু পথে দু’জনে পাশাপাশি হাঁটছিল, চারদিকে পাহাড়ে ভেজা সবুজ, দূরে কুয়াশায় ঢাকা চূড়া, আর বাতাসে অদ্ভুত এক শীতলতা। অর্ণব কৌতূহলী হয়ে তাকিয়েছিল মেয়েটির দিকে, তার প্রতিটি কথায় যেন লুকিয়ে ছিল এক রহস্যময় অতীত। মায়া প্রথমে নীরব ছিল, তার চোখে একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছিল গভীর দুঃখের, যেন হাজার বছরের বেদনা জমে আছে সেখানে। হঠাৎ থেমে গিয়ে সে নিচু স্বরে বলল—“অর্ণব, তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না, কিন্তু আমি এই সময়ের মানুষ নই।” অর্ণবের মনে মুহূর্তের জন্য শীতল স্রোত বইল, যেন মেঘলা দুপুরে দাঁড়িয়ে কোনো অসম্ভব সত্য শোনার অপেক্ষায় আছে।

মায়ার কণ্ঠে ধীরে ধীরে ভেসে উঠল তার জীবনের গল্প। সে জানাল, বহু বছর আগে, যখন এই পাহাড়ি গ্রামে রাস্তা, বিদ্যুৎ কিংবা বাইরের যোগাযোগ এত সহজ ছিল না, তখনই তার জন্ম হয়। ছোটবেলা থেকে মায়া এই পাহাড়ের রূপে বড় হয়েছে—নদীর ধারে, ফুলে ভরা অজস্র বাগানে, আর মেঘে ঢাকা দুপুরের নিস্তব্ধতায়। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে তার জীবন দীর্ঘ হয়নি। অর্ণব চমকে শোনে, এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায়—পাহাড় ধসের মধ্যে মায়ার মৃত্যু হয় অল্প বয়সেই। গ্রামবাসীরা তার নাম স্মরণ করে এখনো, কিন্তু কেউ সাহস করে তার কথা বলে না। মায়া থেমে গিয়ে দূরে মেঘের আড়ালে মিলিয়ে যাওয়া পাহাড়ের দিকে তাকায়—“সেদিন থেকে, আমার অস্তিত্ব এই দুপুরের মেঘে বাঁধা পড়ে গেছে। আমি আর পুরোপুরি চলে যেতে পারিনি, আবার ফিরে আসতেও পারিনি।” অর্ণব স্তব্ধ হয়ে শুনছিল, তার মনে হচ্ছিল, এক অদৃশ্য সেতু তাকে মায়ার জগতের সঙ্গে বেঁধে দিয়েছে।

অর্ণবের কানে তখনো বাজছিল মায়ার কণ্ঠের প্রতিটি শব্দ। তার চোখে দেখা যাচ্ছিল অদ্ভুত এক মিশ্র অনুভূতি—ভয়, বিস্ময়, আর মায়ার প্রতি এক অজানা টান। সে বুঝতে পারছিল, মায়া কেবল কোনো কল্পনা নয়, বরং বাস্তবের সীমানার বাইরের এক সত্য। মায়া হালকা হেসে বলল—“প্রতিটি মেঘলা দুপুরে আমি ফিরে আসি। কেউ কেউ হয়তো আমাকে দেখে, আবার কেউ দেখে না। কিন্তু তুমি দেখছ, কারণ হয়তো তোমার মন খুঁজছিল এক অদ্ভুত সত্যকে।” অর্ণব অবিশ্বাস আর কৌতূহলের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে ভাবছিল, কেনো এই পাহাড়ি গ্রামে তার আসা, আর কেনো মায়ার দেখা পাওয়া—সব কিছু কি কেবল কাকতালীয়? না কি নিয়তির অদ্ভুত খেলা? তার চোখে ভেসে উঠল মায়ার সেই শূন্য দৃষ্টি, যেখানে জীবনের সমস্ত অসমাপ্ত স্বপ্ন যেন আটকে আছে।

বিকেলের মেঘ আরও ঘন হয়ে এল, বাতাসে কাঁপতে লাগল গাছের পাতা, আর দূরে বাজ পড়ার মতো শব্দ ভেসে এল। সেই মুহূর্তে অর্ণব হঠাৎ অনুভব করল, মায়ার উপস্থিতি তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে, এক অদ্ভুত রহস্যময় আভা তৈরি করছে। মায়ার গল্প যেন এই গ্রামের প্রতিটি গাছ, প্রতিটি পথ, প্রতিটি মেঘে ছড়িয়ে আছে। অর্ণবের মনে হচ্ছিল, সে আর আগের মতো শহরের মানুষ নেই—সে যেন ধীরে ধীরে টেনে নেওয়া হচ্ছে সময়ের সেই ফাঁদে, যেখানে মায়া আটকে আছে। কিন্তু মায়ার চোখে তখন একটুখানি শান্তি ফুটে উঠল—কারণ এতদিন পর প্রথমবার কেউ তার গল্প শুনছে, বুঝছে, আর বিশ্বাস করছে। অর্ণবের মনে হলো, এই মেঘলা দুপুরে সে শুধু এক ভূতের গল্প শুনছে না, বরং এক অসমাপ্ত জীবনের দীর্ঘশ্বাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

অর্ণবের দিনগুলো যেন এক অদ্ভুত আবেশে ভরে উঠছিল। পাহাড়ি গ্রামের সেই মেঘলা দুপুরে যখন প্রথম মায়াকে দেখেছিল, তখন থেকেই তার ভেতরে অচেনা এক অনুভূতি জন্মেছিল। কিন্তু এখন সেই অনুভূতি যেন আরও গভীর, আরও অদ্ভুত হয়ে উঠছে। প্রতিদিন সে গ্রামের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, মন যেন অদৃশ্য কোনো সুতোয় বাঁধা—যেন কেউ তাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে। আর সেই ডাকা আসছে মায়ার দিক থেকে। যখনই মায়ার চোখের গভীরতায় হারিয়ে যায়, তার চারপাশের পৃথিবী থেমে যায়। অথচ তার মস্তিষ্কের এক কোণায় সবসময় প্রশ্ন জাগে—কীভাবে সম্ভব এটা? একজন মানুষ কি সত্যিই অন্য সময়ে আটকে থাকতে পারে? আর যদি মায়া সত্যিই অতীতের কোনো অস্তিত্ব হয়, তবে কেন সে এখনও এতটা বাস্তব মনে হয়?

অর্ণব মায়ার কাছে যতবারই যায়, অনুভব করে দুজনের মধ্যে এক অদৃশ্য সেতু তৈরি হচ্ছে। কোনো শব্দ ছাড়াই তারা একে অপরের সঙ্গে কথোপকথন চালাতে পারে—চোখের দৃষ্টি, নিঃশ্বাসের ছন্দ, আর পাহাড়ি হাওয়ার হালকা ঝাপটা যেন দুজনকে যুক্ত করে রাখে। অর্ণব নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে, হয়তো এ সবই তার কল্পনা, হয়তো পাহাড়ের নিঃসঙ্গতা তার মনে ভ্রম সৃষ্টি করছে। কিন্তু মায়ার উপস্থিতি এত স্পষ্ট, এত জীবন্ত যে অর্ণব নিজের সন্দেহকে চেপে রাখতে পারে না। রাতে যখন গ্রামের নিস্তব্ধতায় শুয়ে থাকে, তখনও মনে হয় মায়ার কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে ডেকে যাচ্ছে—“অর্ণব…”। তার ঘুম ভেঙে যায়, বুকের ভেতর অদ্ভুত এক শূন্যতা নিয়ে সে জানালার বাইরে তাকায়, আর দূরের কুয়াশার ভেতর যেন মায়ার ছায়া ভেসে বেড়ায়।

মায়ার সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত অর্ণবকে ভেতরে ভেতরে বদলে দিচ্ছিল। সে যে শহুরে জীবন থেকে পালিয়ে এখানে এসেছিল, সেই জীবন এখন অনেক দূরের, অচেনা বলে মনে হয়। তার ফোন, ইমেইল, বন্ধুবান্ধব—সব যেন অসার হয়ে গেছে। এখন তার পৃথিবী কেবল এই পাহাড়ি গ্রাম, আর মায়ার চোখে লুকোনো সেই গভীর রহস্য। এক বিকেলে যখন মায়া তাকে নিয়ে গেল গ্রাম থেকে একটু দূরের পাহাড়ের ঢালে, তখন অর্ণব অনুভব করল, মায়া যে জায়গাটিকে দেখাচ্ছে, সেখানে দাঁড়ালে যেন সময় থেমে যায়। চারপাশে পাখিদের ডাক, দূরের নদীর গর্জন, আর উপরের আকাশে ঘন মেঘের স্তর—সবকিছু মিলিয়ে এমন এক আবহ তৈরি হলো, যেখানে অর্ণব আর মায়া ছাড়া পৃথিবীতে কেউ নেই। মায়া তখন হঠাৎ করে বলেছিল, “অর্ণব, তুমি আমাকে কেন খুঁজে ফিরছো?” এই প্রশ্নে অর্ণব কিছু বলার মতো শব্দ খুঁজে পায়নি। তার মনে হচ্ছিল, সে নিজেই জানে না আসলে কেন এতটা টান অনুভব করছে।

তবে যতই মায়ার কাছে টেনে নিচ্ছে এই অদৃশ্য শক্তি, অর্ণব ততই ভয় পাচ্ছে নিজের ভেতরে। সে জানে, যদি মায়া সত্যিই অতীতের আত্মা হয়, তবে এ সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তবুও সে নিজেকে আটকাতে পারছে না। মানুষের জীবনে এমন এক অদৃশ্য টান আসে, যা কোনো যুক্তি মানে না—হৃদয়ের গোপন স্রোত বয়ে নিয়ে যায় এমন জায়গায়, যেখানে হয়তো ধ্বংস অপেক্ষা করছে, কিংবা হয়তো মুক্তি। অর্ণব বুঝতে পারছে, মায়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক এমনই এক যাত্রা। সে জানে না এই যাত্রার শেষ কোথায় হবে, কিন্তু তবুও থেমে যেতে পারছে না। গ্রামের লোকেরা বারবার সতর্ক করছে, “মেঘলা দুপুরে একা যেও না,” কিন্তু অর্ণবের কাছে এখন প্রতিটি দুপুরই এক অদৃশ্য টানে বাঁধা—যেখানে মায়া অপেক্ষা করছে, আর তার হৃদয় ধীরে ধীরে বাস্তব আর কল্পনার সীমারেখা মুছে দিচ্ছে।

অর্ণবের দিনগুলো ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছিল। গ্রামের লোকেরা তার দিকে এখন আর সেভাবে তাকাচ্ছিল না। কেউ কেউ ফিসফিস করে বলত, “ওই শহরের ছেলেটা বোধহয় মেয়েটার ছায়ায় আটকে পড়েছে।” আবার কেউ সরাসরি সতর্ক করত—“ভাই, ওই মেয়ে মানুষ নয়। ওর থেকে দূরে থাকাই ভালো।” কিন্তু অর্ণবের মনে তখন একরকম জেদ কাজ করছে। সে ঠিক করেছে, এই রহস্যের শেষ পর্যন্ত যাবে। প্রতিটি মেঘলা দুপুর তার জন্য অপেক্ষার সময় হয়ে দাঁড়ায়, কারণ সে জানত, সেই সময়েই মায়া তার সামনে আসবে। গ্রামের পরিবেশ ক্রমে ভারী হয়ে উঠছিল, আর অর্ণবের ভেতরেও এক অজানা দ্বন্দ্ব চলছিল—সে জানত, সবাই তাকে সাবধান করছে, কিন্তু হৃদয় তাকে টেনে নিচ্ছিল সেই মেয়েটির কাছে।

এই টানাপোড়েনের মধ্যেই একদিন আবার বৃদ্ধ দাদুর সঙ্গে দেখা হয়। অর্ণব চুপচাপ বসেছিল গ্রামের পুরোনো বটগাছের নিচে, আর দাদু এসে ধীরে ধীরে বললেন, “বাবা, তুমি জানো না তুমি কী বিপদ ডেকে আনছো।” অর্ণব বিস্মিত হয়ে বলল, “কিন্তু কেন, দাদু? সে তো আমাকে কোনো ক্ষতি করেনি। বরং মনে হয়, আমি যেন তাকে অনেক আগে থেকে চিনি।” দাদু গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলেন—“মায়া ছিল এই গ্রামের মেয়ে। আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে, এক ঝড়ের দিনে পাহাড়ি নদীতে ভেসে গিয়েছিল সে। তার মৃত্যু এত আকস্মিক হয়েছিল যে, কেউ ঠিকমতো বিদায়ও জানাতে পারেনি। তারপর থেকেই শোনা যায়, মেঘলা দুপুরে তাকে এই গ্রামে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। কতজনকে সে টেনে নিয়েছে তার দুনিয়ায়, তার হিসেব কেউ রাখে না।” অর্ণব স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। তার বুকের ভেতরটা কেমন হিম হয়ে আসছিল, তবু মনে হচ্ছিল, গল্পটা যেন অদ্ভুতভাবে সত্যি।

দাদুর গল্প শুনে অর্ণবের মনে আরও হাজারটা প্রশ্ন জেগে উঠল। সে ভাবছিল—যদি সত্যিই মায়া মৃত, তবে কেন সে এতটা বাস্তব মনে হয়? তার চোখের দৃষ্টি, তার হাসি, তার কথাবার্তা—সবকিছুই তো একেবারে জীবন্ত। অর্ণব সেই রাতেই সিদ্ধান্ত নিল, সে আবার মায়ার সঙ্গে দেখা করবে, আর সরাসরি জিজ্ঞেস করবে সত্যিটা। রাতটা তার কাছে দীর্ঘতম হয়ে উঠল, চোখের পাতা এক মুহূর্তের জন্যও নামল না। মনে হচ্ছিল, প্রতিটি মুহূর্ত যেন সময়ের ফাঁদে আটকে আছে। অবশেষে যখন ভোর হলো, অর্ণব জানত, আজকের মেঘলা দুপুরই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে।

সেদিন দুপুরে আকাশ আবার ধূসর হয়ে এল, চারপাশে হালকা ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে লাগল। অর্ণব গ্রামের পথ ধরে হাঁটছিল, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আর ঠিক তখনই দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মায়াকে সে দেখতে পেল। সাদা পোশাকে সে যেন এক অন্য জগতের ছায়া। অর্ণব কাছে গিয়ে দাঁড়াল, বুকের ভেতর কাঁপুনি হলেও চোখে দৃঢ়তা। ধীরে ধীরে সে বলল, “মায়া, সবাই বলে তুমি এই সময়ের নও। তারা বলে তুমি বহু বছর আগে মারা গেছো। এটা কি সত্যি?” মায়ার মুখে প্রথমে এক রহস্যময় হাসি ফুটল, তারপর তার চোখে এক গভীর দুঃখের ছায়া নেমে এল। সে নরম স্বরে বলল, “হ্যাঁ অর্ণব, আমি সেই মায়া—যে একদিন ঝড়ের পানিতে হারিয়ে গিয়েছিল। আমার দেহ শেষ হয়েছিল, কিন্তু আমার আত্মা এই গ্রামে রয়ে গেছে। আর তুমি… তুমি সেই একজন, যে আমার গল্পটা আবার শুনতে এলে।” অর্ণবের চোখ ভিজে উঠল। সত্য অবশেষে তার সামনে দাঁড়িয়ে গেল—ভয়ঙ্কর অথচ অদ্ভুতভাবে সুন্দর এক সত্য, যা তাকে আর ফিরে যেতে দেবে না।

মেঘলা দুপুরের সেই চিরচেনা আবেশে ভিজে অর্ণব মায়ার সামনে দাঁড়িয়েছিল। চারপাশে হালকা কুয়াশার মতো মেঘ জমে আছে, গাছগুলো নিঃশব্দ সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে। মায়ার চোখে সেইদিন গভীর এক ক্লান্তি, অথচ অদ্ভুত কোমলতা। অনেকদিনের জমে থাকা যন্ত্রণার মতো কিছু যেন ধীরে ধীরে ভেসে উঠছিল তার ভেতর থেকে। অর্ণব তাকিয়ে ছিল নিঃশব্দে, যেন চোখের ভেতর দিয়ে মায়ার প্রতিটি না-বলা কথা পড়তে চাইছে। অবশেষে মায়া নরম স্বরে বলল—“আমার জীবনের গল্প তুমি তো জানো না, অর্ণব। আমি এই গ্রামে ছিলাম, ঠিক তোমার মতো সাধারণ এক মেয়ে। কিন্তু আমার জীবনের সবথেকে বড় সত্য হলো, আমি কাউকে ভালোবেসেছিলাম, অথচ সেই ভালোবাসা পূর্ণ হয়নি।” তার কণ্ঠে হাহাকার ছিল, কিন্তু সেই হাহাকার কেবল শব্দে নয়, চারপাশের বাতাসে মিশে গিয়ে অর্ণবের বুককে ভারী করে তুলছিল। অর্ণব হঠাৎ অনুভব করল, সে যেন এক অদৃশ্য সময়ের খাতায় মায়ার হারানো অধ্যায়গুলো পড়ছে।

মায়ার গল্প ধীরে ধীরে অর্ণবের সামনে খুলে যাচ্ছিল। সে বলল, “আমি তখন কিশোরী, পাহাড়ি গ্রামটা তখনো কোলাহলমুক্ত, সময় যেন অন্য ছন্দে চলত। আমাদের গ্রামের পাশের উপত্যকায় এক তরুণ আসত—চোখে স্বপ্ন, মনে সাহস। ওর সঙ্গে আমার দেখা হতো নদীর ধারে, মেঘলা দুপুরে কিংবা পূর্ণিমার রাতে। সে গান গাইতে ভালোবাসত, আমি শোনাতাম পাহাড়ি লোকগান। আমাদের মধ্যে যেন এক অদ্ভুত বোঝাপড়া তৈরি হয়েছিল, অথচ কখনোই আমরা স্পষ্ট করে কিছু বলিনি। শুধু চোখে চোখে কথোপকথন চলত, আর সেই নীরবতার ভেতরেই লুকিয়ে ছিল অজানা প্রেম।” মায়ার চোখ ভিজে উঠছিল, যেন সে সেই স্মৃতির গভীর থেকে ফিরে আসছে। অর্ণব বুঝতে পারছিল, মায়া যে কথাগুলো বলছে, সেগুলো কেবল অতীত নয়, সেই অসম্পূর্ণ অনুভূতির দগ্ধ দাগ আজও মুছে যায়নি।

“কিন্তু একদিন হঠাৎ সব শেষ হয়ে গেল,” মায়ার গলা কেঁপে উঠল। “আমার জীবনের শেষ দুপুরটা ছিল মেঘলা, তোমার আজকের মতোই। গ্রামের কাছে পাহাড়ে একটা দুর্ঘটনা ঘটে। আমি সেখানে আটকে পড়ি, আর ফিরে আসতে পারিনি। সে অপেক্ষা করেছিল, আমি আর যাইনি। আমার মৃত্যু হয়তো দেহের জন্য ছিল, কিন্তু মনের যে আকাঙ্ক্ষা—যে না-বলা ভালোবাসা, তা রয়ে গেল অপূর্ণ। সেই অসমাপ্ত টানই আমাকে আজও মুক্তি দেয় না। তাই প্রতিটি মেঘলা দুপুরে আমি ফিরে আসি, যেন খুঁজে বেড়াই সেই ভালোবাসার উত্তর।” মায়ার কণ্ঠ নিস্তব্ধ হয়ে এলে চারপাশের বাতাস আরও ঘন হয়ে উঠল। অর্ণব অনুভব করল, তার শরীরের ভেতর কাঁপন বইছে—একটি আত্মার অসমাপ্ত প্রেমের ভার যেন তার বুকেও এসে জমা হয়েছে।

অর্ণব চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল, কিন্তু মনে হচ্ছিল, এই গল্পের প্রতিটি শব্দ তার নিজের সত্তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সে বুঝতে পারল কেন সে প্রথম থেকেই মায়ার প্রতি অদ্ভুত এক টানে বাঁধা পড়েছিল। হয়তো সে-ই সেই অসমাপ্ত প্রেমের প্রতিচ্ছবি, হয়তো সময় তাকে এখানে এনেছে কেবল এই আত্মার গল্পকে শেষ করার জন্য। তার ভেতর অদ্ভুত এক দ্বন্দ্ব তৈরি হলো—এ কি কেবল কল্পনা, নাকি সময় সত্যিই তার সঙ্গে খেলা করছে? সে হঠাৎ বলল, “মায়া, হয়তো আমি তোমার সেই অসমাপ্ত ভালোবাসার উত্তর। আমি জানি, তোমার অনুভূতি আমি মুছতে পারব না, কিন্তু আমি যদি তোমার সঙ্গে থেকে সেই শূন্যতা ভরাট করি?” মায়ার চোখে অদ্ভুত আলো ঝিলিক দিল, যেন শতাব্দীর দীর্ঘ অন্ধকার ভেদ করে আশার এক রেখা ঢুকে পড়েছে। অথচ সেই আলোয়ও ছিল এক অসহায়তা—কারণ সময়ের ফাঁদে আটকে থাকা আত্মা কখনোই মানুষের জগতের সুখ-দুঃখ পুরোপুরি ছুঁতে পারে না। তবুও সেই মেঘলা দুপুরে অর্ণবের হৃদয়ে আর মায়ার আত্মায় এক সেতু তৈরি হলো, যা বাস্তব আর অতীতের সীমারেখাকে ভেঙে দিল।

মেঘে ঢাকা সেই দুপুরে অর্ণবের মনে হচ্ছিল গ্রাম যেন এক অচেনা ছায়ায় মোড়া। চারদিকে ঘন কুয়াশার মতো সাদা মেঘ, পাখির ডাক নেই, বাতাসও থমকে আছে। হঠাৎ মায়া তাকে ডাকল—তার স্বর অদ্ভুত কোমল অথচ গভীর, যেন বহুকালের প্রতিধ্বনি। অর্ণব বিস্মিত হয়ে দেখল, মায়া তাকে পাহাড়ের চূড়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পথ অতিক্রম করতে করতে তার মনে হচ্ছিল, প্রতিটি পদক্ষেপে সে বাস্তব থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। গ্রাম, মানুষ, সময়—সব যেন মুছে যাচ্ছে, শুধু এই রহস্যময় পথ আর মায়ার ছায়া রয়ে গেছে। মায়ার চোখে তখন অদ্ভুত এক শান্তি, যেন সে জানে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, অথচ অর্ণবের মনে ভয় আর কৌতূহল একসঙ্গে ভিড় করছে। চারপাশে নীরবতার মধ্যে কেবল তার হৃদয়ের ধুকপুকানি শোনা যাচ্ছিল।

চূড়ায় পৌঁছে মায়া থেমে গেল। আকাশ মেঘে ঢেকে আছে, সূর্যের আলো নেই, তবুও জায়গাটা যেন এক অলৌকিক আলোয় ভরে উঠেছে। মায়া ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল, “এই জায়গাতেই আমার শেষ দুপুর কেটেছিল।” অর্ণব বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। মায়া জানাল, বহু বছর আগে এক ঝড়ের দিনে সে প্রিয়জনের অপেক্ষায় এখানে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বিশ্বাস করেছিল, তার প্রিয় মানুষ আসবে, কিন্তু হঠাৎ এক পাহাড়ি দুর্ঘটনায় সব শেষ হয়ে যায়। তার দেহ মাটিতে মিলিয়ে যায়, কিন্তু আত্মা রয়ে যায় অসমাপ্ত প্রতিশ্রুতির বাঁধনে। অর্ণবের চোখের সামনে যেন দৃশ্যগুলো ভেসে উঠল—এক তরুণী ঝড়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, হঠাৎ বজ্রপাত, গড়িয়ে পড়া পাথর, আর অশ্রুসিক্ত চিৎকার। অর্ণব শিউরে উঠল, কিন্তু মায়ার চোখে তখন আর কোনো ভয় নেই—শুধু অদ্ভুত এক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।

অর্ণব ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, তার এখানে আসা মোটেই কাকতালীয় নয়। মায়ার কণ্ঠে যে অসমাপ্ত প্রেমের ব্যথা, তা যেন তার ভেতরে প্রতিধ্বনি তুলছিল। অর্ণব উপলব্ধি করল, সে-ই সেই প্রতিচ্ছবি, যার কাছে মায়ার অপেক্ষা এতদিন ধরে ছিল। হয়তো নিয়তির টানেই সে এই গ্রামে এসেছে, এই মেঘলা দুপুরে মায়ার সাথে দেখা হয়েছে। মায়া যখন তার হাত ধরল, অর্ণব স্পষ্ট বুঝতে পারল—তার শরীরে ঠান্ডা বাতাসের মতো স্পর্শ, অথচ অদ্ভুতভাবে সত্য। তাদের চোখে চোখ পড়তেই অর্ণব অনুভব করল, সময়ের সীমা মুছে যাচ্ছে। এ যেন জীবিত আর মৃত, অতীত আর বর্তমান, সবকিছুর সীমা ভাঙার মুহূর্ত।

শেষে মায়া ধীরে ধীরে হাসল। সেই হাসিতে অদ্ভুত এক শান্তি, এক পরিসমাপ্তির আভাস। সে বলল, “তুমি এসেছ বলেই আমি মুক্তি পাব। আমার অসমাপ্ত দুপুর আজ শেষ হলো।” হঠাৎ হাওয়া জোরে বইতে লাগল, মেঘ ছিঁড়ে আলো ফুটে উঠল। অর্ণব অবাক হয়ে দেখল, মায়ার অবয়ব ধীরে ধীরে কুয়াশায় মিলিয়ে যাচ্ছে। সে হাত বাড়িয়ে তাকে আঁকড়ে ধরতে চাইলো, কিন্তু ফাঁকা বাতাস ছাড়া আর কিছু পেল না। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে অর্ণব বুঝতে পারল, তার জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত মুহূর্ত এটাই—যেখানে নিয়তির টান তাকে এক অদৃশ্য প্রেমের গল্পের সাক্ষী করেছে। আর নিচে নেমে আসতে আসতে তার মনে হচ্ছিল, হয়তো এই শেষ দুপুরই তাকে বদলে দিয়েছে চিরতরে। মায়া নেই, কিন্তু তার ছায়া আর অনুভূতি যেন অর্ণবের আত্মায় গেঁথে রইল।

১০

মেঘলা দুপুরের সেই অদ্ভুত আবহে পাহাড়ি গ্রামটি যেন আজ অন্যরকম লাগছিল। অর্ণব জানত—এটাই শেষ দেখা, শেষ সাক্ষাৎ। তার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক শূন্যতা আর ভার মিলে এক অচেনা অনুভূতি তৈরি করছিল। চারদিকে পাহাড়ি হাওয়ার সঙ্গে মিশে মেঘের সাদা স্রোত বয়ে যাচ্ছিল, আর সেই স্রোতের মাঝেই দাঁড়িয়ে ছিল মায়া—শান্ত, স্থির অথচ গভীর বিষণ্ণতায় ভরা। অর্ণব ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, “তুমি যে অসমাপ্ত প্রেমের কথা বলেছিলে, হয়তো সেই প্রেমই আমার ভেতরে কোথাও থেকে তোমায় ডাকছিল। আমি জানি, আমি অতীতকে ফিরিয়ে দিতে পারব না, কিন্তু অন্তত আমি তোমাকে স্বীকৃতি দিতে পারি, তোমার ভালোবাসাকে পূর্ণতা দিতে পারি।” কথাগুলো শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই মায়ার চোখ ভিজে উঠল। সে কোনো কথা বলল না, শুধু অর্ণবের দিকে তাকিয়ে নীরব সম্মতি জানাল। এই নীরবতার ভেতরেই যেন দুই সময়ের দুই হৃদয় মিলিত হয়ে গেল—অতীতের অসমাপ্ততা আর বর্তমানের স্বীকৃতি।

মায়া ধীরে ধীরে হাত বাড়াল, যেন অর্ণবের হাত ছুঁতে চাইছে। কিন্তু তাদের মধ্যে ছিল এক অদৃশ্য দেয়াল—জীবন আর মৃত্যুর দেয়াল। অর্ণব অনুভব করল, তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি শরীরী নয়, তবুও সে যেন আগের চেয়ে অনেক কাছাকাছি। আকাশে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের ক্ষীণ আলো পড়তে লাগল, আর হাওয়ায় বয়ে এল এক অদ্ভুত সুর—যেন পাহাড়ের বুক ফেটে মায়ার গল্প গেয়ে উঠছে। মায়ার ঠোঁট নড়ল, সে ধীরে বলল, “আমার মুক্তি তোমার হাতেই ছিল। আজ তুমি আমাকে স্বীকার করলে, আমার ভালোবাসাকে পূর্ণতা দিলে। আমি আর বেঁধে নেই। কিন্তু মনে রেখো, অর্ণব, আমি হারিয়ে যাব না—আমি রয়ে যাব এই মেঘে, এই দুপুরে, তোমার স্মৃতিতে।” কথাগুলো শুনে অর্ণবের বুক ভারী হয়ে উঠল, যেন সে নিজের ভেতর থেকেই কাউকে হারাতে চলেছে।

ঠিক সেই মুহূর্তে চারদিকের আবহাওয়া বদলে গেল। মায়ার শরীর ক্রমশ স্বচ্ছ হতে লাগল, মেঘের সঙ্গে মিশে যেতে লাগল। অর্ণব ছুটে গেল তার দিকে, হাত বাড়াল, কিন্তু শুধুই বাতাস ধরতে পারল। মায়ার মুখে এক অদ্ভুত শান্তির হাসি ফুটল—যেন সে বহু বছরের বাঁধন থেকে মুক্তি পেয়েছে। ধীরে ধীরে তার অবয়ব মিলিয়ে গেল আকাশের মেঘে, শুধু ভেসে রইল তার কণ্ঠের প্রতিধ্বনি, “তুমি রয়ে গেলে আমার সঙ্গে, অর্ণব… এই মেঘলা দুপুরের চিরন্তন স্মৃতিতে।” অর্ণব স্থির দাঁড়িয়ে রইল পাহাড়ের চূড়ায়, তার চোখে জল জমে উঠল, কিন্তু সেই জলের মধ্যে ছিল না কেবল দুঃখ—ছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি, কারণ সে জানত, সে মায়ার অসমাপ্ত যাত্রাকে শেষ করতে পেরেছে।

শেষ বিকেলের আলো ধীরে ধীরে পাহাড়ের গায়ে মিশে যেতে লাগল। অর্ণব একা দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু একাকীত্বের ভেতরেও অনুভব করল, মায়া আসলে হারায়নি। তার উপস্থিতি মিশে আছে এই মেঘে, এই বাতাসে, এই দুপুরের অদ্ভুত নিস্তব্ধতায়। অর্ণব জানত, তার জীবনে এই অভিজ্ঞতা তাকে বদলে দেবে, তাকে শিখিয়ে দেবে ভালোবাসার অর্থ—ভালোবাসা শুধু শরীরী উপস্থিতিতে নয়, বরং স্মৃতি, অনুভূতি আর স্বীকৃতির ভেতরেও বেঁচে থাকে। সে ধীরে ধীরে পাহাড় থেকে নেমে এল, কিন্তু মনে মনে বারবার শুনতে পেল মায়ার কণ্ঠস্বর—“আমি রয়ে গেলাম তোমার সঙ্গে, মেঘে…” আর তখনই অর্ণব বুঝল, জীবনের পথে যত দূরেই যাক না কেন, প্রতিটি মেঘলা দুপুর তার কাছে হয়ে উঠবে এক চিরন্তন স্মৃতি, যেখানে মায়া চিরকাল বেঁচে থাকবে।

___

 

1000056191.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *