Bangla - রহস্য গল্প

অরণ্যের প্রান্তে

Spread the love

অভিষেক দত্ত


পর্ব ১ : অরণ্যের প্রান্তে

সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে গড়িয়ে পড়ছে। লালচে আলো যেন মায়ার পর্দার মতো ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। মহারানী অরণ্যের গাঢ় সবুজ ছাতার উপর সেই আলোর আভা পড়তেই জঙ্গলটা আরও রহস্যময়, আরও গম্ভীর হয়ে উঠছে। বাতাসে এক অদ্ভুত শীতলতা, অথচ গ্রীষ্মকাল, গরমের দাপট চরমে থাকার কথা। যেন এই জঙ্গলের আলাদা এক নিজস্ব ঋতুচক্র আছে—বাকি পৃথিবীর সাথে যার কোনো সম্পর্ক নেই।

অভিজিৎ ট্রেকিং ব্যাগ পিঠে চাপিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল ধুলোমাখা কাঁচা রাস্তায়। তার চোখে কৌতূহলের ঝিলিক। বয়স পঁচিশের কাছাকাছি, সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা এক বন্যপ্রাণী গবেষক। তার লক্ষ্য—অদৃশ্যপ্রায় বন্যপ্রাণীদের খোঁজ পাওয়া। কত গল্পই না ছড়ানো আছে এ অরণ্য ঘিরে—কোথাও নাকি আছে কালো চিতাবাঘের দল, কোথাও এমন সব পাখি যারা শুধু পূর্ণিমার রাতে গান গায়। বিজ্ঞান এসব মানতে চায় না, কিন্তু অভিজিৎ বিশ্বাস করে প্রতিটি গুজবের মধ্যে কোথাও না কোথাও লুকিয়ে থাকে সত্যের টুকরো।

গাইড হরিদাস, এক শীর্ণকায় বৃদ্ধ, গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে সতর্ক করল,
—“বাবু, এর ভেতরে বেশি দূর যেও না। দিনের আলো শেষ হলে জঙ্গলের চেহারা পাল্টে যায়। পথ চিনতে পারবি না, আর রাতে এই অরণ্য কাউকেই ছাড়ে না।”

অভিজিৎ হাসল হালকা ভঙ্গিতে।
—“আপনি চিন্তা করবেন না। আমার কাছে মানচিত্র আছে, কম্পাস আছে, ক্যামেরা আছে। আর ভয়… সেটা আমি সঙ্গে আনিনি।”

হরিদাস মাথা নাড়িয়ে বলল,
—“ভয়কে সঙ্গে না আনলে অরণ্য রাগ করে বাবু। মনে রেখো, এই জঙ্গলকে জেতা যায় না, কেবল মানতে হয়।”

কথা শেষ করেই সে ফিরে গেল গ্রামের দিকে। সারা পথ ধুলোর মধ্যে তার খুপরি স্যান্ডেলের শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। অভিজিৎ তখন একা দাঁড়িয়ে রইল অরণ্যের প্রান্তে। সামনে যেন এক অদৃশ্য দেওয়াল, গাছেদের পুরু স্তর। কোকিলের ডাক ভেসে এল দূর থেকে, কিন্তু তার সুরে ছিল না কোনো মধুরতা, বরং ছিল হালকা শিহরণ জাগানো সুর।

অভিজিৎ গভীর নিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে গেল। জঙ্গলের ভেতর ঢুকতেই কেমন যেন শব্দ বদলে গেল। বাইরে যেখানে গাড়ির শব্দ, মানুষের গলা শোনা যাচ্ছিল, এখানে কেবল পাতা নড়ার শব্দ, কোথাও পোকামাকড়ের ঝিরঝির ডাক, আর অচেনা এক নিস্তব্ধতা। মনে হল গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে পাহারাদারের মতো, যেন তাকে যাচাই করছে—ওকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া উচিত কি না।

প্রথম আধঘণ্টা সব স্বাভাবিকই মনে হল। নানারকম গাছ, অচেনা ফুল, শুকনো পাতার গন্ধ। ক্যামেরা দিয়ে কয়েকটা ছবি তুলল। কিন্তু যতই ভেতরে যাচ্ছে, ততই সূর্যের আলো ম্লান হয়ে আসছে। গাছের শিকড়গুলো মাটির উপরে উঠে কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে, যেন কারও ফাঁদ। মাঝে মাঝে শালগাছের ফাঁক দিয়ে হাওয়া এসে গায়ে লাগছে, কিন্তু সেই হাওয়া কেমন যেন ঠাণ্ডা, প্রায় শীতল।

হঠাৎ তার চোখে পড়ল কিছু অদ্ভুত চিহ্ন। মাটির উপর খোঁড়া দাগ, যেন কেউ ইচ্ছে করে রেখেছে। দাগগুলো বৃত্তাকারে সাজানো, ভেতরে ছাইয়ের মতো কিছু পড়ে আছে। দেখতে অনেকটা আগুন জ্বালানোর জায়গার মতো, কিন্তু আশেপাশে মানুষের উপস্থিতির কোনো চিহ্ন নেই।

সে হাঁটু গেড়ে বসে খুঁটিয়ে দেখল। ছাইয়ের ভেতরে কিছু পোড়া হাড়ের টুকরো। মানুষের হাড় নাকি প্রাণীর, বোঝা গেল না। বুকের ভেতর কেমন একটা অস্বস্তি হল, কিন্তু কৌতূহলও বাড়ল। ডায়েরির পাতায় নোট লিখে রাখল।

ঠিক তখনই হাওয়ার মধ্যে কানে এল ফিসফিসের মতো এক শব্দ—“ফিরে যা… ফিরে যা…”

অভিজিৎ চারপাশে তাকাল। কেউ নেই। কেবল ঝোপের ভেতর দিয়ে হাওয়ার সোঁ সোঁ শব্দ। হয়তো কানে ভুল শোনা। কিন্তু কেন যেন মনে হল গাছের পাতাগুলো সত্যিই কথা বলছে।

কম্পাস বের করে দিক নির্ণয় করতে গেল, হঠাৎ দেখল সূঁচটা একেবারে উত্তরের দিকে ঘুরে গিয়ে স্থির হয়ে আছে। কোনোভাবেই আর নড়ছে না। সে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। দাদুর দেওয়া কম্পাস কখনো খারাপ হয়নি, অথচ আজ হঠাৎ এটা কাজ করছে না কেন?

সন্ধ্যার আঁধার তখন নেমে এসেছে। আকাশে অদ্ভুত কমলা-নীল রঙ মিশছে। জঙ্গলের ভেতর আলো যেন আরও দ্রুত নিভে যাচ্ছে। অভিজিৎ বুঝল, ক্যাম্প করার জায়গা খুঁজতে হবে। একটু দূরে শুকনো নদীর খাতের ধারে একটা জায়গা পেল। চারদিকে ঝোপঝাড়, মাঝখানে সমতল মাটি। সেখানে ব্যাগ নামিয়ে একটা ছোট তাঁবু খাটাল।

তাঁবুর বাইরে বসে শুকনো খাবার খেতে খেতে সে ভাবছিল, আজকের অভিজ্ঞতাগুলো নোট করতে হবে। ডায়েরি খুলতেই আবার শুনতে পেল সেই ফিসফিসানি। এবার একটু স্পষ্ট—
“তুই কেন এলি এখানে?”

সে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাল। অন্ধকার নেমে গেছে। কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। দূরে কোথাও একটা অদ্ভুত আলো দেখা গেল—একটা নীলচে আলোর গোলা, গাছের ফাঁক দিয়ে ধীরে ধীরে ভেসে যাচ্ছে।

অভিজিৎ চোখ মেলতে পারল না। ক্যামেরা হাতে নিয়ে ছবি তুলতে গেল, কিন্তু বোতাম চাপতেই ক্যামেরা হঠাৎ নিভে গেল।

অন্ধকার আরও ঘন হল। বাতাসে এক গুমোট গন্ধ ভেসে এল, অনেকটা পোড়া কাঠ আর হাড়ের গন্ধের মতো। অভিজিতের মনে হল, কেউ যেন ওর ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে। ঘাড়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল। সে ধীরে ধীরে ঘুরল।

কিন্তু সেখানে কেউ নেই। কেবল ছায়ার মতো কিছু গাছের কাণ্ডের আড়ালে নড়ল।

অভিজিৎ মনে মনে বলল, “এ সব বিভ্রম। ক্লান্তি আর অন্ধকারের কারণে মস্তিষ্ক খেলা করছে।”

কিন্তু অন্তরে কোথাও ভয় চেপে বসেছে। মনে পড়ল হরিদাসের কথা—
“ভয়কে সঙ্গে না আনলে অরণ্য রাগ করে।”

আজ রাতটা যে সহজে কেটে যাবে না, সেটা অভিজিৎ টের পেল। অরণ্য যেন তাকে পরীক্ষা নিচ্ছে, তাকে ভেতরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক গভীর অজানার দিকে।

এবং তখনও সে জানত না, এই জঙ্গল শুধু গাছপালা বা প্রাণীর নয়—এখানে আছে পুরোনো অভিশাপ, এমন এক অদৃশ্য শক্তি যার ডাক থেকে পালানো যায় না।

পর্ব ২ : রাতের অন্ধকার

রাত নেমেছে অরণ্যে। আকাশের ওপরে অসংখ্য তারা ঝিকমিক করছে, কিন্তু ঘন গাছপালার কারণে তাদের আলো মাটিতে পৌঁছচ্ছে না। অন্ধকার যেন স্পর্শযোগ্য—ঘন, ভারী আর গা ছমছমে। অভিজিৎ তাঁবুর ভেতরে বসে ডায়েরিতে দিনের অভিজ্ঞতা লিখছিল।

“আজ সন্ধ্যায় অদ্ভুত শব্দ শুনলাম। মনে হল পাতারা ফিসফিস করছে। আবার দেখলাম এক নীলচে আলো, ভেসে যাচ্ছিল বাতাসে। ক্যামেরায় ধরা গেল না। কম্পাস হঠাৎ কাজ করা বন্ধ করে দিল। এসব কি প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা, নাকি অন্য কিছু?”

ডায়েরির পাতায় লিখতে লিখতে তার হাত থেমে গেল। বাইরে থেকে ভেসে আসছে অদ্ভুত শব্দ—মনে হচ্ছে কেউ শুকনো পাতার উপর দিয়ে হাঁটছে। হালকা চাপা শব্দ, কিন্তু স্পষ্ট।

অভিজিৎ নিঃশ্বাস আটকে কান পাতল। শব্দটা থেমে গেল। অরণ্য আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল। তবু তার ভেতরে অস্বস্তি কাটল না। ব্যাগ থেকে টর্চ বের করে আলো ফেলে বাইরে তাকাল। ঝোপঝাড় নড়ছে বাতাসে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, বাতাস তো তখন একেবারেই নেই। পাতাগুলো যেন নিজে থেকেই কাঁপছে।

সে বাইরে বেরিয়ে এল। টর্চের আলোয় গাছেদের ছায়া দীর্ঘ হয়ে পড়েছে মাটিতে। হঠাৎ দূরে চোখে পড়ল দুটো জ্বলজ্বলে বিন্দু। ঠিক মানুষের চোখ নয়, আবার প্রাণীরও মনে হল না। আলো যেন ভিতর থেকে উজ্জ্বল হচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, কোনো অচেনা প্রাণী দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারের ভেতরে।

অভিজিৎ সাহস করে এগোতে গেল। তখনই আলো মিলিয়ে গেল। কেবল নিস্তব্ধতা।

ফিরে এসে তাঁবুর সামনে বসতেই আবার গন্ধ পেল—পোড়া কাঠ আর হাড়ের গন্ধ। চারপাশে তাকাল। কেউ নেই। কেবল বাতাসে একরকম ভারী গুমোট ভাব। বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেমন টনটন করে উঠল।

রাত যত গভীর হচ্ছে, ততই অরণ্যের শব্দ পাল্টাচ্ছে। কোথাও পেঁচার ডাক, কোথাও অজানা প্রাণীর হুঙ্কার। কিন্তু এগুলোর মধ্যে এক অচেনা সুর মিশে আছে। মনে হচ্ছে গাছের শিকড়ের নিচ থেকে কেউ ফিসফিস করছে।

ঠিক তখনই সে শুনতে পেল পায়ের শব্দ। এ বার স্পষ্ট। কেউ তার তাঁবুর কাছাকাছি আসছে। অভিজিৎ টর্চ জ্বালিয়ে আলো ফেলতেই দেখল, এক অদ্ভুত দৃশ্য—একটি শিশু, বয়স দশ বা এগারো, ছেঁড়া কাপড় পরে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। চোখ দুটো ফাঁকা, কেবল ফ্যাকাশে।

অভিজিৎ হতভম্ব হয়ে গেল।
—“কে তুমি? এখানে এলে কীভাবে?”

শিশুটি কোনো উত্তর দিল না। শুধু দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ ধীরে ধীরে পেছন ঘুরে অন্ধকারে ঢুকে গেল।

অভিজিৎ দ্বিধায় পড়ল—পিছু নেবে, না এখানেই থাকবে? কৌতূহল তাকে ছাড়ল না। টর্চ হাতে পা বাড়াল শিশুটির পেছনে।

ঝোপঝাড় সরিয়ে এগোতেই সে পৌঁছল এক খোলা জায়গায়। মাঝখানে আগুনের পুরোনো চিহ্ন, যেটা সন্ধ্যায়ও সে দেখেছিল। কিন্তু এবার সেখানে স্পষ্ট দেখতে পেল কয়েকটি কাঠের মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে বৃত্তাকারে। মূর্তিগুলো মানুষের আকারের মতো, কিন্তু মুখ নেই। কেবল ফাঁকা কাঠের ফাঁপা অংশ।

শিশুটি সেই মূর্তিগুলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নিচু।

অভিজিৎ এগোতে যাচ্ছিল, হঠাৎ সব মূর্তি একসাথে কেঁপে উঠল। শুকনো কাঠের ফাঁপা আওয়াজ ভেসে এল—“ফিরে যা… না হলে শেষ হবে…”

টর্চের আলো কাঁপতে লাগল। ব্যাটারি যেন এক নিমেষে ফুরিয়ে আসছে। আতঙ্কে অভিজিৎ ছুটে পালিয়ে এল তাঁবুর দিকে।

তাঁবুতে ঢুকে দরজা চেপে বসে রইল। বুক ধড়ফড় করছে। ঘাম ঝরছে কপাল বেয়ে। নিজের মনকে বোঝাতে চাইল—
“এ সব হ্যালুসিনেশন। অন্ধকার, ক্লান্তি আর ভয় মিলে মস্তিষ্কে ভ্রম তৈরি করছে।”

কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে জানে, যেটা দেখল সেটা নিছক ভ্রম নয়। অরণ্যের ভেতর কোনো শক্তি লুকিয়ে আছে।

রাত আরও গভীর হল। চোখ বন্ধ করেও ঘুম এল না। কানে বারবার বাজতে থাকল সেই অদ্ভুত শব্দ—
“ফিরে যা… ফিরে যা…”

অভিজিৎ বুঝল, আজ রাতটা পার করা তার জন্য সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।

সকালের আলো আসার আগেই অরণ্যের অন্ধকার তাকে চিরতরে গ্রাস করবে কি না—সেই উত্তর জানে কেবল মহারানী অরণ্য।

পর্ব ৩ : ভোরের ছায়া

রাতের আতঙ্কে অভিজিৎ ঠিকমতো চোখ মেলতে পারেনি। কতবার যে স্বপ্ন আর জাগরণের সীমারেখা মিশে গিয়েছিল, সে নিজেই বুঝতে পারেনি। কখনও মনে হয়েছে তাঁবুর বাইরে কেউ হাঁটছে, কখনও মনে হয়েছে দূরে মন্ত্রপাঠের মতো গলা ভেসে আসছে। আবার কখনও হঠাৎ শরীর ভারী হয়ে গেছে, যেন অদৃশ্য হাত বুক চেপে ধরেছে। আর সবকিছুর মাঝেই সেই ফিসফিসানি—“ফিরে যা…”

অবশেষে রাত শেষ হল। ভোরের প্রথম আলো যখন গাছের ফাঁক দিয়ে এসে পড়ল, অরণ্যের চেহারা যেন পাল্টে গেল। রাতের অন্ধকারে যে ভীতি চারদিককে গ্রাস করেছিল, দিনের আলোয় তার কোনো চিহ্ন নেই। চারদিকে পাখির ডাক, হাওয়ায় কচি পাতার গন্ধ, আর সবুজের মধ্যে নরম সূর্যের আলো। যেন কিছুই ঘটেনি।

অভিজিৎ তাঁবুর বাইরে বেরোল। চারপাশে তাকিয়ে অবাক হল। যে জায়গায় রাতের বেলা কাঠের মূর্তিগুলো দেখেছিল, সেখানে এখন কিছু নেই। সমতল মাটি, শুকনো পাতার স্তূপ। কোনো চিহ্ন নেই।

সে ভাবল, তবে কি সত্যিই সবই ভ্রম ছিল? হয়তো অরণ্যের নিস্তব্ধতা মস্তিষ্কের সঙ্গে খেলা করেছে।

কিন্তু তারপরেই তার চোখে পড়ল এক অদ্ভুত জিনিস। তাঁবুর দরজার সামনে মাটিতে ছাই দিয়ে আঁকা বৃত্ত। বৃত্তের ভেতরে কয়েকটা অচেনা চিহ্ন—ত্রিভুজ, সর্পিল আর বাঁকা রেখা। রাতের বেলা এগুলো ছিল না। কে আঁকল এগুলো?

অভিজিৎ থমকে দাঁড়াল। ভেতরে ভয় জাগল, কিন্তু কৌতূহলও বাড়ল। ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে ছবি তুলল। তারপর নোটবুকে লিখল,
“অরণ্যের ভেতরে কোনো অচেনা গোষ্ঠী থাকতে পারে। তাদের রীতি-নীতি হয়তো এইসব প্রতীক আঁকার মধ্যে লুকিয়ে আছে।”

সকালের নাশতা করে সে ঠিক করল আরও ভেতরে যাবে। তার গবেষণার লক্ষ্য অদ্ভুত প্রাণী খোঁজা, আর রাতের অস্বাভাবিক ঘটনাগুলো তাকে আরও দৃঢ় করেছে।

প্রথম আধঘণ্টা পথ সহজ ছিল। শাল, সেগুন আর বাঁশঝাড় পেরিয়ে যেতে যেতে সে লক্ষ করল, সূর্যের আলো যত ভেতরে আসছে, ততই গাছের ছায়া ঘন হয়ে যাচ্ছে। অনেক জায়গায় আলো পৌঁছচ্ছে না। চারদিক স্যাঁতসেঁতে, ভিজে মাটির গন্ধ উঠছে।

হঠাৎ সে শুনল পানির শব্দ। ঝরনার কলকল ধ্বনি। এগিয়ে গিয়ে দেখল এক সরু ঝর্ণা নেমে এসেছে পাহাড়ের বুক থেকে। জল একেবারে স্বচ্ছ, তলদেশে পাথরের ফাঁক দেখা যাচ্ছে। হাঁটু গেড়ে বসে জল ছুঁতেই তার বুক ভিজে উঠল অদ্ভুত শীতলতায়। যেন এই জল কেবল শরীর ঠান্ডা করছে না, মনকেও গ্রাস করছে।

ঠিক তখনই চোখে পড়ল কিছু। ঝর্ণার ধারে ভেজা মাটিতে পায়ের ছাপ। মানুষের পায়ের মতো, কিন্তু আকারে অনেক বড়। অন্তত দ্বিগুণ। আর সেই ছাপ একেবারে ঝর্ণার দিক থেকে এসেছে, তারপর হঠাৎ মিলিয়ে গেছে।

অভিজিৎ হতবাক হয়ে গেল।
“এটা কোন প্রাণীর? মানুষ? নাকি অন্য কিছু?”

ছাপের ছবি তুলে রাখল। তারপর ঝর্ণার ধার ধরে হাঁটতে লাগল। গাছেদের ফাঁক দিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল এক পুরোনো কাঠের সেতু, আধভাঙা, নীচে গভীর খাদ। সেতুর উপর শুকনো লতাপাতা জড়িয়ে আছে। মনে হয় বহুদিন কেউ এ পথে আসেনি।

সেতুর ওপারে জঙ্গলের গাঢ় ছায়া, যেন একেবারে অন্য জগৎ। অভিজিৎ দ্বিধায় পড়ল। কিন্তু কৌতূহল তাকে ছাড়ল না। সাবধানে পা বাড়াল সেতুর উপর। কাঠ চাপা শব্দ করে কেঁপে উঠল। সে নিঃশ্বাস আটকে ধীরে ধীরে এগোল।

অর্ধেকটা পার হতেই বাতাসে হঠাৎ ভেসে এল আবার সেই কণ্ঠস্বর—
“ফিরে যা… না হলে শেষ হবে…”

অভিজিতের শরীর শিউরে উঠল। পেছনে তাকাল—কেউ নেই। সামনে তাকাল—কুয়াশায় ঢেকে গেছে পথ। তবু সে থামল না। শেষ পর্যন্ত সেতু পার হয়ে পৌঁছল ওপারে।

ওপারে এসে অবাক হয়ে গেল। অরণ্যের চেহারাই যেন পাল্টে গেছে। গাছগুলো আরও উঁচু, পাতাগুলো ঘন, আলো আরও কম। বাতাসে অন্যরকম গন্ধ, অনেকটা ধূপের মতো। মনে হল, এখানে প্রকৃতি আলাদা নিয়ম মেনে চলে।

মাঝখানে এক ফাঁকা জায়গা। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল বটগাছ। তার শিকড় মাটিতে নয়, বরং চারপাশে ছড়িয়ে একরকম দেওয়াল তৈরি করেছে। গাছটার বয়স শত বছরের বেশি।

অভিজিৎ কাছে যেতেই গায়ে কাঁটা দিল। বটগাছের গায়ে অসংখ্য প্রতীক খোদাই করা। ঠিক সেই প্রতীক, যেগুলো সকালে সে দেখেছিল ছাইয়ের বৃত্তে। সর্পিল, ত্রিভুজ, বাঁকা রেখা। প্রতিটি প্রতীক অদ্ভুত আলো ছড়াচ্ছে, যেন সূর্যের আলোয় নয়, ভেতর থেকেই আলো বেরোচ্ছে।

সে অবাক হয়ে ক্যামেরা তুলল। ঠিক তখনই হাওয়া বয়ে এল। শিকড়গুলো কেঁপে উঠল, আর শোনা গেল চাপা আওয়াজ—
“এখানে প্রবেশ করিস না…”

অভিজিৎ এক পা পিছিয়ে গেল। কিন্তু কৌতূহল তাকে আবার টেনে নিল সামনে। গাছের গোড়ায় নীচের দিকে একটি ফাঁক দেখা যাচ্ছে, অনেকটা গুহার মুখের মতো। অন্ধকার, ভেতরে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

সে টর্চ জ্বালাল। আলো ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল ভেতরে কেউ নড়ল। এক ঝলক যেন চোখে পড়ল—শিশুটি! যে রাতে তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। এবারও সে কিছু বলল না, শুধু অন্ধকারের ভেতরে মিলিয়ে গেল।

অভিজিৎ কেঁপে উঠল। তবু সাহস করে সামনে এগোল।

গুহার ভেতরে ঢুকতেই গন্ধ পেল ধূপ আর ছাইয়ের মিশ্রণ। দেওয়ালে খোদাই করা আরও অদ্ভুত প্রতীক। আর মাঝখানে এক পাথরের বেদি। তার উপর রাখা আছে কিছু পুরোনো পাথরের মূর্তি—অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক পশুর আকার।

অভিজিতের চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল।
“এটা কী? প্রাচীন কোনো গোষ্ঠীর পূজাস্থল?”

ঠিক তখনই বাতাস ভারী হয়ে উঠল। গুহার ভেতরে প্রতিধ্বনির মতো ভেসে এল শব্দ—
“তুই দেরি করে ফেলেছিস… অরণ্য তোকে বেছে নিয়েছে।”

অভিজিৎ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কণ্ঠস্বর কোথা থেকে আসছে, বোঝা গেল না।

কিন্তু তার বুকের ভেতরে যেন কিছু জেগে উঠল—ভয় আর কৌতূহলের মাঝামাঝি এক অনুভূতি।

সে জানল, এ যাত্রা শুধু গবেষণার নয়। এ এক অদৃশ্য খেলা, যেখানে অরণ্য নিজেই খেলোয়াড়কে বেছে নেয়।

আর সে, অভিজিৎ, এখন সেই খেলার অংশ।

পর্ব ৪ : বটগাছের গোপন রহস্য

অভিজিৎ গুহার ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে। টর্চের আলো কাঁপছে, তার শ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে। দেওয়ালের প্রতীকগুলো অদ্ভুতভাবে আলো ছড়াচ্ছে, যেন তারা জীবন্ত। আর সেই পাথরের বেদির ওপরে থাকা মূর্তিগুলো—কখনও মনে হচ্ছে জড় বস্তু, আবার কখনও মনে হচ্ছে তারা তাকিয়ে আছে তার দিকে।

সে ডায়েরির পাতায় লিখতে চাইল, কিন্তু হাত কাঁপছে। কণ্ঠস্বর এখনও প্রতিধ্বনির মতো ভেসে আসছে—
“অরণ্য তোকে বেছে নিয়েছে…”

এই কথা বারবার কানে বাজতে থাকায় মাথা ঝিমঝিম করছে। ভয় কাটানোর জন্য অভিজিৎ ক্যামেরা তুলল। শাটার চাপতেই ফ্ল্যাশের আলোয় গুহার দেওয়াল আলোকিত হল। আর তখনই সে দেখল—গুহার ভেতরে শুধু সে নেই। প্রতিটি কোণে, প্রতিটি ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে মানুষ-আকৃতির ছায়া। তারা নড়ছে না, কিন্তু উপস্থিতি স্পষ্ট।

অভিজিৎ পেছনে সরে এল। টর্চের আলো পড়তেই ছায়াগুলো মিলিয়ে গেল। শুধু নিস্তব্ধতা।

সে গভীর নিশ্বাস নিয়ে গুহা থেকে বেরোল। বাইরে এসে দেখল সূর্য অনেকটা উপরে উঠে গেছে, অথচ আলো এই জঙ্গলে পৌঁছচ্ছে না। চারদিকে অদ্ভুত অন্ধকার, যেন সময় আটকে আছে।

বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে সে ভাবছিল, তখনই শিকড়ের আড়াল থেকে কারও ডাক শোনা গেল।
—“তুমি কে?”

অভিজিৎ চমকে তাকাল। এক কিশোরী, বয়স ষোলো-সতেরোর বেশি নয়। চুল এলোমেলো, গায়ে মাটির দাগ, চোখে গভীর অস্বাভাবিক জ্যোতি।

অভিজিৎ সাবধানে উত্তর দিল,
—“আমি গবেষক। বন্যপ্রাণী নিয়ে পড়াশোনা করি। তুমি এখানে কী করছ?”

মেয়েটি হেসে উঠল, অদ্ভুত সেই হাসি—অর্ধেক নিষ্পাপ, অর্ধেক ভয়াল।
—“এই অরণ্য আমার ঘর। আমি এখানেই জন্মেছি।”

—“কিন্তু এ জঙ্গল তো মানুষশূন্য। এখানে গ্রাম নেই, বাড়ি নেই।”

মেয়েটির চোখ লালচে হয়ে উঠল।
—“তুমি যা দেখছ, সবই ভ্রম। এ জঙ্গলে মানুষ ছিল, বহু আগে। তারা সবাই হারিয়ে গেছে। অরণ্য তাদের গ্রাস করেছে।”

অভিজিৎ থমকে গেল।
—“তুমি কি তাদের মধ্যে একজন?”

মেয়েটি কোনো উত্তর দিল না। শুধু আঙুল তুলে দেখাল বটগাছের গোড়ার দিকটা। সেখানে শিকড়ের মধ্যে আটকানো আছে কিছু পুরোনো খুলির হাড়। অন্তত দশ-বারোটা।

অভিজিৎ কেঁপে উঠল।
—“এগুলো… এরা কারা?”

মেয়েটি শান্ত স্বরে বলল,
—“যারা অরণ্যের ডাক শুনেছিল, আর ফিরতে পারেনি।”

তারপর মেয়েটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল শিকড়ের আড়ালে। অভিজিৎ দৌড়ে গিয়ে খুঁজল, কিন্তু কাউকে পেল না।

সে ভেতরে ভেতরে অনুভব করল, এই জঙ্গল শুধু একটি প্রাকৃতিক স্থান নয়। এখানে ইতিহাস লুকিয়ে আছে—রক্তের ইতিহাস, অভিশাপের ইতিহাস।

বিকেল নামতে শুরু করল। আকাশ আবার অদ্ভুত রঙে ভরে উঠল। এবার অভিজিৎ ঠিক করল, অন্ধকার নামার আগে গ্রামে ফিরে যাবে। কিন্তু কোন দিকে যাবে বুঝতে পারল না। মানচিত্র বের করল, কম্পাস আবার ব্যর্থ। সূঁচ স্থির হয়ে আছে উত্তর দিকে।

ঠিক তখনই বনের ভেতর থেকে আবার ভেসে এল সেই অচেনা শিশুটির উপস্থিতি। এবার দূর থেকে সে হাত নেড়ে ডাকছে।

অভিজিৎ দোটানায় পড়ল। গ্রামে ফেরার পথ অজানা, আর এই শিশুটি হয়তো তাকে পথ দেখাতে পারে। অথবা হয়তো এ-ও অরণ্যেরই ফাঁদ।

সে শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিল শিশুটির পিছু নেবে।

ঘন অরণ্যের ভেতর দিয়ে তারা হাঁটতে লাগল। অন্ধকার নামছে, পাখির ডাক থেমে গিয়ে অন্যরকম শব্দ ভেসে আসছে। ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে বারবার মনে হচ্ছে কেউ তাদের অনুসরণ করছে।

একসময় তারা পৌঁছল এক খোলা জায়গায়। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক ভাঙা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। মন্দিরের দেওয়ালে লতা-পাতা ঢেকে গেছে, ভেতরে ছাই ছড়ানো। কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যায়, একসময় এখানে পূজা হত।

শিশুটি মন্দিরের ভেতরে ঢুকে গেল। অভিজিৎও পিছু নিল। ভেতরে ঢুকতেই সে অবাক হয়ে গেল। মাটিতে আবার সেই প্রতীক আঁকা, যেগুলো সে আগেও দেখেছিল। মন্দিরের ভেতরের বাতাস ভারী, ধূপের গন্ধ ছড়িয়ে আছে।

হঠাৎ শিশুটি তার দিকে ঘুরে তাকাল। ফ্যাকাশে মুখে একটুও অভিব্যক্তি নেই। ঠোঁট না নড়িয়েই তার কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনির মতো ভেসে এল—
—“অরণ্য তোকে বেছে নিয়েছে। তুই পালাতে পারবি না।”

অভিজিৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। গলার স্বর আটকে গেল ভয় আর বিস্ময়ে। ঠিক তখনই মন্দিরের দেওয়াল কেঁপে উঠল, ছাই উড়ে গেল বাতাসে, আর গম্ভীর এক গলা প্রতিধ্বনির মতো ভেসে এল—
“অরণ্যের রক্ত চাই…”

অভিজিৎ পেছনে সরে এল। মন্দিরের ভেতরে অদ্ভুত এক শক্তি জমাট বাঁধছে। বাতাস ঘূর্ণি হয়ে ঘুরছে, প্রতীকগুলো জ্বলজ্বল করছে।

সে জানে, এখান থেকে পালাতে না পারলে আজ রাতেই অরণ্য তাকে গ্রাস করবে।

পর্ব ৫ : অরণ্যের রক্ত

মন্দিরের ভেতরটা তখন একেবারে দমবন্ধ করা। দেওয়ালের প্রতীকগুলো জ্বলছে অদ্ভুত লাল আলোয়। বাতাস ঘূর্ণি হয়ে ঘুরছে, চারদিকে ছাই উড়ছে। অভিজিৎ অনুভব করল মাটি যেন তার পায়ের নিচে কেঁপে উঠছে।

শিশুটি মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ এখন আর ফাঁকা নয়—আগুনের মতো লালচে। ঠোঁট না নড়িয়েই আবার শোনা গেল সেই ভয়াল স্বর—
—“অরণ্যের রক্ত চাই…”

অভিজিৎ গলার ভেতর শুকনো লালা গিলল। তার মাথায় কেবল একটাই প্রশ্ন—“অরণ্যের রক্ত মানে কী?”

ঠিক তখনই মন্দিরের দেওয়ালের এক কোণা ফেটে গেল। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক অদ্ভুত প্রাণী। অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক পশু। শরীরটা মানুষের মতো, কিন্তু মাথাটা অনেকটা হরিণের খুলি, তাতে শিং বেরিয়ে আছে। চোখ দুটো জ্বলছে অগ্নিশিখার মতো। হাতে লম্বা দণ্ড।

অভিজিৎ আতঙ্কে এক পা পিছিয়ে গেল। মনে হল মস্তিষ্ক কাজ করছে না। ক্যামেরা বের করারও ক্ষমতা নেই।

প্রাণীটা ধীরে ধীরে তার দিকে এগোতে লাগল। প্রতিটি পদক্ষেপে মন্দির কেঁপে উঠছে। শিশুটি তখনও দাঁড়িয়ে, চোখে অদ্ভুত দীপ্তি।

হঠাৎ প্রাণীটা দণ্ড উঁচিয়ে মাটিতে আঘাত করল। সঙ্গে সঙ্গে প্রতীকগুলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আর অভিজিৎ অনুভব করল তার শরীরের ভেতর থেকে রক্ত যেন টেনে নিচ্ছে কেউ। বুক ভারী হয়ে আসছে, শ্বাস আটকে যাচ্ছে।

সে হাঁটু গেড়ে পড়ে গেল। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। মনে হল অরণ্য তাকে শুষে নিচ্ছে।

ঠিক তখনই তার মনে পড়ল দাদুর দেওয়া কম্পাস। ব্যাগ থেকে বের করতেই অবাক হল—এখন সেটার সূঁচ ঘুরছে পাগলের মতো। আলো ছড়াচ্ছে অস্বাভাবিক।

অভিজিৎ এক অদ্ভুত তাগিদে কম্পাসটা মাটির প্রতীকের উপর ছুঁড়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণের মতো আলো ছড়িয়ে পড়ল। মন্দির কেঁপে উঠল, প্রাণীটা পিছিয়ে গেল ভয়ঙ্কর গর্জনে। প্রতীকগুলো নিভে গেল একে একে।

অভিজিৎ শ্বাস নিতে পারল। বুকটা হালকা হয়ে এল।

শিশুটি তখন তার দিকে তাকাল, চোখের লাল আলো মিলিয়ে গেছে। ফ্যাকাশে মুখে একটুখানি দুঃখের ছায়া। ধীরে ধীরে সে বলল—
—“তুমি প্রতিরোধ করলে… কিন্তু অরণ্য থামবে না। তুমি এখন নির্বাচিত। তুমি ছাড়া মুক্তি নেই।”

এ কথা বলেই শিশুটি মিলিয়ে গেল বাতাসে। যেন কোনোদিন ছিলই না।

মন্দির এখন নিস্তব্ধ। কিন্তু ভেতরে এক ভয়াল গন্ধ রয়ে গেছে—পোড়া হাড় আর রক্তের মিশ্রণ। অভিজিৎ হাঁপাতে হাঁপাতে বাইরে এল।

অরণ্যের আকাশ তখন লালচে। সূর্য ডুবে যাচ্ছে। চারদিকের গাছেরা আরও উঁচু হয়ে উঠেছে মনে হচ্ছে। বাতাস ভারী, পাখির ডাক থেমে গেছে।

সে জানে, রাত নামছে। আর রাত মানে ভয়, মৃত্যু আর অভিশাপ।

দৌড়ে গিয়ে সে তাঁবুর কাছে ফিরল। কিন্তু গিয়ে দেখল—তাঁবু নেই। ব্যাগ নেই। শুধু মাটিতে ছাই ছড়িয়ে আছে। আর তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক কাঠের মূর্তি। মানুষের আকার, মুখ ফাঁকা।

অভিজিৎ নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকাল। এই মূর্তিটা একেবারে তার নিজের মতো! উচ্চতা, গড়ন, সবকিছু।

সে বুঝল, অরণ্য তাকে বন্দি করতে চাইছে। মূর্তি তৈরি হয়ে গেছে, এখন শুধু তার প্রাণ চাই।

ভয় আর হতাশায় সে পেছনে সরে গেল। কিন্তু অরণ্য যেন তাকে ঘিরে ফেলেছে। চারদিকে গাছের শিকড় ছড়িয়ে এসে পথ বন্ধ করে দিল। বাতাসে আবার সেই ফিসফিস—
“তুই পালাতে পারবি না…”

অভিজিৎ ঘেমে উঠল। চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল, “আমি গবেষক। আমি এসেছি সত্যি খুঁজতে, মৃত্যুকে নয়।”

হঠাৎ কোথা থেকে এক আলো পড়ল তার উপর। মাথা তুলে দেখল—আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। সেই আলো গাছের ফাঁক দিয়ে এসে পড়েছে সরাসরি তার গায়ে।

মূর্তিটা তখন কেঁপে উঠল। শিকড়গুলো সরে যেতে লাগল ধীরে ধীরে। ফিসফিসের শব্দ মিলিয়ে গেল।

অভিজিৎ হাঁপাতে হাঁপাতে বুঝল—চাঁদের আলোয় এই অভিশাপ দুর্বল হয়ে যায়। অন্তত কিছু সময়ের জন্য।

সে মাটিতে বসে পড়ল। শরীর অবশ, মাথা ঝিমঝিম করছে। কিন্তু মনে হল এক মুহূর্তের জন্য মুক্তি পেয়েছে।

কিন্তু তার ভেতরে ভয়াল সত্যি স্পষ্ট হয়ে গেল—
অরণ্য তাকে বেছে নিয়েছে। তার থেকে মুক্তি নেই।

পর্ব ৬ : প্রাচীন কাহিনি

চাঁদের আলোয় রাতটা কোনোভাবে পার করল অভিজিৎ। গাছের ছায়া, পাখির ডাক, আর সেই অদ্ভুত নিস্তব্ধতা—সব মিলিয়ে যেন সময় থেমে গিয়েছিল। ঘুম আসেনি। ভোর হওয়ার আগেই সে উঠে দাঁড়াল। শরীর ক্লান্ত, মাথা ভারী, কিন্তু কৌতূহল তাকে এগোতে বাধ্য করল।

আকাশ ফ্যাকাশে হয়ে আসছে। পাখিরা ডাকতে শুরু করেছে। অরণ্য আবার স্বাভাবিক চেহারায় ফিরছে। যেন রাতের ভয়ের কোনো অস্তিত্বই ছিল না।

অভিজিৎ হাঁটতে শুরু করল উত্তরমুখে। কম্পাস এখনও ঘুরছে পাগলের মতো, কাজ করছে না। তবে আজ আর সে মানচিত্রে ভরসা করল না। মনে হচ্ছিল, জঙ্গল নিজেই তাকে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে।

এক ঘণ্টার মতো হাঁটার পর হঠাৎ এক বিস্তৃত ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়াল সে। মাঝখানে একটা বিশাল পাথরের স্তম্ভ। স্তম্ভটা অনেকটা স্মৃতিস্তম্ভের মতো, কিন্তু অর্ধেক ভাঙা। শ্যাওলা আর লতা-পাতা ঢেকে রেখেছে। তবুও খোদাই স্পষ্ট বোঝা যায়—অদ্ভুত প্রতীক, সর্পিল রেখা, আর মানুষের মতো মুখ।

অভিজিৎ স্তম্ভের সামনে দাঁড়িয়ে ডায়েরিতে লিখল। ঠিক তখনই পিছন থেকে শব্দ হল। ঘুরে তাকাতেই দেখল সেই কিশোরী, যাকে সে বটগাছের কাছে দেখেছিল।

সে শান্তভাবে বলল,
—“এটা দেখছ? এ অরণ্যের ইতিহাস।”

অভিজিৎ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
—“তুমি আবার এলে? তুমি কে?”

মেয়েটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
—“আমার নাম মাধুরী। বহু বছর আগে এই অরণ্যে মানুষ বাস করত। তারা গড়ে তুলেছিল এক গোপন সম্প্রদায়। তাদের বিশ্বাস ছিল, অরণ্য দেবতা। তারা বলত, অরণ্যকে খুশি রাখতে হলে রক্ত দিতে হয়।”

অভিজিৎ স্তম্ভের খোদাইয়ে হাত বুলিয়ে বলল,
—“মানববলিদান?”

মাধুরীর চোখ চকচক করে উঠল।
—“হ্যাঁ। প্রতি পূর্ণিমায় একজন মানুষকে উৎসর্গ করা হত। রক্ত দিয়ে অরণ্যের দেবতাকে শান্ত করা হত। এভাবেই তারা বেঁচে থাকত।”

অভিজিৎ শিউরে উঠল।
—“তাহলে… এ মূর্তি, এ প্রতীক—সবই সেই সময়ের চিহ্ন?”

মাধুরী মাথা নেড়ে বলল,
—“হ্যাঁ। কিন্তু একদিন সম্প্রদায়ের এক অংশ বিদ্রোহ করেছিল। তারা বলেছিল, এ সব কুসংস্কার। অরণ্যের দেবতা বলে কিছু নেই। তারা বলি বন্ধ করে দিয়েছিল। সেই দিন থেকেই অভিশাপ নেমে আসে। যারা বলি বন্ধ করেছিল, তারা একে একে হারিয়ে যায়। আর তাদের আত্মা আটকে যায় এই অরণ্যে। এখন অরণ্য নতুন শিকার খোঁজে। যেই ভেতরে প্রবেশ করে, তাকেই বেছে নেয়।”

অভিজিৎ হকচকিয়ে গেল।
—“তাহলে আমি…”

মাধুরী চোখ নামিয়ে বলল,
—“হ্যাঁ। অরণ্য তোকে বেছে নিয়েছে।”

চারপাশে বাতাস ভারী হয়ে উঠল। হঠাৎ স্তম্ভের গায়ে খোদাই করা মুখগুলো একসাথে কেঁপে উঠল। চোখ থেকে লাল আলো বেরোতে লাগল। বাতাসে চাপা গুঞ্জন—“রক্ত… রক্ত…”

অভিজিৎ দৌড়ে সরে এল। মাধুরী দাঁড়িয়ে রইল, যেন সবকিছু জানে। তার ঠোঁট থেকে ধীরে ধীরে ভেসে এল গান। অদ্ভুত এক সুর, অনেকটা ল lullaby-র মতো। কিন্তু সেই সুরে ভয়ের ছাপ।

অভিজিৎ চিৎকার করে উঠল,
—“তুমি মানুষ? না অরণ্যের ছায়া?”

মাধুরী গান থামিয়ে তাকাল। তার চোখে জল চিকচিক করছে।
—“আমি মানুষ ছিলাম। বহু বছর আগে বলির রাতে আমাকেও উৎসর্গ করা হয়েছিল। কিন্তু অরণ্য আমাকে গ্রাস করেনি। আমাকে এখানে আটকে রেখেছে। আমি না মানুষ, না আত্মা। আমি কেবল অরণ্যের কণ্ঠস্বর।”

অভিজিৎ স্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস আটকে গেল। তার মস্তিষ্ক ভরে গেল অসংখ্য প্রশ্নে।

—“তাহলে মুক্তির পথ কী? এ অরণ্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি কীভাবে সম্ভব?”

মাধুরী ধীরে ধীরে বলল,
—“অরণ্যের দেবতা কেবল একটি জিনিসে দুর্বল হয়—চাঁদের আলোয় রক্তের প্রতীক ধ্বংস করলে। কিন্তু তা করতে গেলে নিজেকেই বলি দিতে হয়।”

অভিজিৎ চমকে উঠল।
—“মানে? আমাকে নিজের রক্ত দিতে হবে?”

মাধুরী মাথা নিচু করল।
—“হ্যাঁ। এ জঙ্গল তৃষ্ণার্ত। হয় তুই নিজেকে উৎসর্গ করবি, না হলে অরণ্য তোকে এমনিতেই গ্রাস করবে।”

অভিজিৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। বুকের ভেতর দমবন্ধ হয়ে আসছে। সে বুঝতে পারছে, এ যাত্রা আর গবেষণার নয়—এটা তার জীবনের প্রশ্ন।

ঠিক তখনই আবার শোনা গেল শিশুটির কণ্ঠস্বর—
—“অরণ্যের রক্ত চাই…”

অভিজিৎ ঘুরে তাকাল। ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সেই শিশুটি। তার চোখ ফাঁকা, মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই।

মাধুরী ফিসফিস করে বলল,
—“এটাই তোর সতর্কবার্তা। তুই এখন দুই জগতের মাঝে। বাঁচতে চাইলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”

অভিজিৎ গভীর নিশ্বাস নিল। আকাশের দিকে তাকাল। সূর্য উঠেছে অনেকটা, কিন্তু অরণ্যের ভেতর অন্ধকার এখনও ঘন। সে জানে, সময় কম।

মাধুরীর দিকে তাকিয়ে বলল,
—“আমি লড়ব। অরণ্যের অভিশাপ ভাঙব। যদি রক্ত চাই, তবে আমি দেব। কিন্তু আমি মরতে আসিনি।”

মাধুরীর চোখে প্রথমবার একটুখানি হাসি ফুটল।
—“তাহলে প্রস্তুত হও। রাত আসছে। আর পূর্ণিমার রাতে অরণ্যের শক্তি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হয়।”

অভিজিৎ শিউরে উঠল। সে জানে, সামনে অপেক্ষা করছে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই।

আর অরণ্যের দেবতা তাকে ছেড়ে কথা বলবে না।

পর্ব ৭ : পূর্ণিমার পূর্বসন্ধ্যা

সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ছে। লাল আভায় অরণ্যের প্রতিটি গাছ যেন রক্তে রঞ্জিত। বাতাসের ভেতর চাপা শিহরণ। দূরে পেঁচার ডাক, আর কোথাও অচেনা জন্তুর গর্জন।

অভিজিৎ বটগাছের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথায় বারবার বাজছে মাধুরীর কথা—
“পূর্ণিমার রাতে অরণ্যের শক্তি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হয়। মুক্তি পেতে হলে রক্ত চাই।”

সে জানে, আর এক রাতের বেশি সময় নেই। যদি আজ প্রস্তুতি না নেয়, কাল রাতেই হয়তো সে শেষ হয়ে যাবে।

মাধুরী তার পাশে এসে দাঁড়াল। গায়ের মাটির দাগ, চোখে অনন্ত ক্লান্তি, কিন্তু মুখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা।
—“তুই কি প্রস্তুত?”

অভিজিৎ নিঃশ্বাস টেনে বলল,
—“আমি মরতে আসিনি। কিন্তু যদি নিজের রক্ত দিয়েই অভিশাপ ভাঙতে হয়, আমি দেব। তবে তার আগে জানতে চাই—অরণ্যের দেবতা কে?”

মাধুরী দূরে তাকাল। গাছের ফাঁক দিয়ে আসা আলোয় তার চোখ চিকচিক করছিল।
—“অরণ্যের দেবতা মানুষই ছিল একসময়। সম্প্রদায়ের পুরোহিত। বলির রক্তে সে অমর হতে চেয়েছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সে শক্তি সঞ্চয় করেছে। এখন সে অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক ছায়া। তাকে দেখা মানেই মৃত্যু।”

অভিজিৎ শিউরে উঠল।
—“তাহলে আমি কীভাবে তাকে পরাজিত করব?”

মাধুরী বলল,
—“চাঁদের আলোয় তার শক্তি দুর্বল হয়। তুই যদি সাহস করে রক্তের প্রতীক ধ্বংস করতে পারিস, তবে হয়তো মুক্তি মিলবে।”

অভিজিৎ বুঝল, আজ রাতে আর বিশ্রাম নেই। সে কম্পাসটা বের করল। অবাক হয়ে দেখল, সূঁচ আর পাগলের মতো ঘুরছে না। স্থির হয়ে আছে এক দিকের দিকে—উত্তর-পূর্বে।

মাধুরী ফিসফিস করে বলল,
—“ওদিকেই মন্দির। সেখানেই দেবতা অপেক্ষা করছে।”

অভিজিৎ ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। মাধুরী পিছু নিল। জঙ্গল ঘন হয়ে আসছে, আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে। পূর্ণিমার চাঁদ ওঠার আগে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এসেছে।

কিছু দূর যেতেই তারা দেখল শুকনো নদীর খাত। মাটিতে পায়ের ছাপ—মানুষের মতো, কিন্তু দৈত্যাকার। প্রতিটি ছাপ যেন মাটিতে পুড়ে গিয়েছে।

অভিজিৎ শিউরে উঠল। মাধুরী শান্ত গলায় বলল,
—“ওই ছাপ তারই।”

অভিজিৎ ক্যামেরা তুলতে যাচ্ছিল, কিন্তু মাধুরী হাত চেপে ধরল।
—“এ ছবি তোলা যাবে না। যেটা অরণ্য গোপন রেখেছে, তাকে প্রকাশ করলে মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়।”

অভিজিৎ নিরব সম্মতিতে মাথা নেড়ে আবার এগোল।

ধীরে ধীরে অরণ্য খুলে গেল। সামনে ভাঙা পাথরের মন্দির দেখা দিল। অর্ধেক ধ্বংস, তবুও তার ভেতর থেকে অদ্ভুত আলো বেরোচ্ছে। প্রতিটি পাথরের গায়ে সেই প্রতীক খোদাই, আর তাদের মাঝে শুকনো রক্তের দাগ।

অভিজিৎ এক পা এগোতেই হঠাৎ বাতাস ভারী হয়ে উঠল। নিস্তব্ধতার ভেতর ভেসে এল ভয়ঙ্কর গলা—
—“অরণ্যের রক্ত…”

মাধুরী কেঁপে উঠল।
—“সে জেগে উঠেছে।”

হঠাৎ মন্দিরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল ছায়ার ঝড়। ধোঁয়ার মতো, তবুও প্রাণবন্ত। সেই ছায়ার মধ্যে ধীরে ধীরে এক দৈত্যাকার অবয়ব ফুটে উঠল। মাথায় শিং, চোখে আগুন, শরীর কুয়াশার মতো কালো। হাতে লম্বা দণ্ড।

অভিজিৎ থমকে গেল। বুকের ভেতর দম বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হল, পৃথিবীর সব ভয় একসাথে এসে চেপে ধরেছে তাকে।

অবয়ব গর্জে উঠল—
—“কে আমার ঘুম ভাঙাতে সাহস করেছে?”

অভিজিৎ কাঁপা গলায় বলল,
—“আমি… আমি সত্যি খুঁজতে এসেছি।”

অবয়ব হেসে উঠল—শুকনো পাতার মতো ভয়ঙ্কর শব্দ।
—“সত্যি খুঁজতে? সত্যি একটাই—অরণ্যের তৃষ্ণা কখনও শেষ হয় না। প্রতিটি প্রজন্মে রক্ত দিতে হয়। এবার তোর পালা।”

সে দণ্ড উঁচিয়ে মাটিতে আঘাত করল। সঙ্গে সঙ্গে প্রতীকগুলো জ্বলজ্বল করতে শুরু করল। মাটি কাঁপতে লাগল। গাছের শিকড়গুলো উঠে এসে অভিজিৎকে ঘিরে ধরল।

অভিজিৎ মরিয়া হয়ে ব্যাগ থেকে কম্পাস বের করল। কিন্তু এবার কম্পাস অদ্ভুতভাবে নিস্তব্ধ। কোনো আলো নেই। সূঁচ নড়ছে না।

সে চিৎকার করে উঠল,
—“আমাকে কী করতে হবে?”

মাধুরী চোখ বুজে ফিসফিস করে বলল,
—“রক্ত দিতে হবে। তোর রক্তেই প্রতীক ভাঙবে।”

অভিজিৎ দ্বিধায় পড়ল। বুকের ভেতর আতঙ্ক, মাথায় বিশৃঙ্খলা। কিন্তু অরণ্যের শক্তি প্রতিনিয়ত তাকে গ্রাস করছে।

সে শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিল। ছুরি বের করে হাতের তালুতে কেটে দিল। রক্ত ঝরে পড়তেই মাটি কেঁপে উঠল। প্রতীকগুলো লাল হয়ে জ্বলে উঠল।

অবয়ব গর্জন করে উঠল—
—“না-আ-আ…”

চাঁদ তখন গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল। তার আলো পড়ে রক্তের ফোঁটার উপর। সঙ্গে সঙ্গে প্রতীকগুলো একে একে নিভতে লাগল। শিকড়গুলো সরে গেল, বাতাস হালকা হয়ে এল।

অভিজিৎ হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে পড়ে গেল। রক্তে হাত ভিজে গেছে। মাথা ঘুরছে।

কিন্তু সে জানল, এই লড়াই শেষ হয়নি। অরণ্য দুর্বল হয়েছে মাত্র, জয় হয়নি।

অবয়ব ছায়ায় মিলিয়ে গেল, কিন্তু তার গর্জন প্রতিধ্বনির মতো বাজল—
—“আমি আবার আসব। পূর্ণিমা শেষ হয়নি।”

মাধুরী অভিজিতের পাশে বসে হাত চেপে ধরল।
—“আজ তুই সময় কিনেছিস। কিন্তু কাল রাতেই হবে আসল লড়াই। যদি হেরে যাস, তুইও কাঠের মূর্তি হয়ে যাবি।”

অভিজিৎ আকাশের দিকে তাকাল। চাঁদ তখন পূর্ণ, সাদা আলো ছড়িয়ে আছে। তার চোখে একটিই প্রতিজ্ঞা—
সে লড়বে। যাই হোক না কেন।

পর্ব ৮ : পূর্ণিমার রাত

রাত নেমেছে মহারানী অরণ্যে। আকাশে বিশাল পূর্ণিমার চাঁদ, তার আলো গাছেদের ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু আলো যত আসছে, ততই অরণ্যের ছায়া আরও গভীর হচ্ছে। বাতাসে শীতলতা, মাটির গন্ধ, আর চাপা অস্বস্তি।

অভিজিৎ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হাতের তালুতে এখনো ক্ষতের দাগ। রক্ত শুকিয়ে গিয়েছে, কিন্তু ব্যথা মনে করিয়ে দিচ্ছে গত রাতের ভয়। আজ সেই রাত, যেদিন সবকিছু নির্ধারিত হবে।

মাধুরী তার পাশে এসে দাঁড়াল। চোখে কোনো ভয় নেই, কেবল গম্ভীরতা।
—“সময় হয়ে গেছে। আজ হয় তুই অভিশাপ ভাঙবি, না হলে তুইও কাঠের মূর্তি হয়ে যাবি।”

অভিজিৎ কাঁপা গলায় বলল,
—“যদি আমি ব্যর্থ হই?”

মাধুরী নিঃশব্দে আঙুল তুলল মন্দিরের দেওয়ালের দিকে। সেখানে সারি সারি কাঠের মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটির মুখ ফাঁকা, চোখহীন। কিন্তু অদ্ভুতভাবে মনে হয় তারা তাকিয়ে আছে।
—“ওরা সবাই ব্যর্থ হয়েছিল।”

অভিজিতের বুক ধকধক করতে লাগল। সে জানে, পিছু হটার উপায় নেই।

চাঁদের আলো পড়তেই মন্দিরের প্রতীকগুলো একে একে জ্বলে উঠল। বাতাসে ধূপের মতো গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। আর গর্জনের মতো শোনা গেল সেই কণ্ঠস্বর—
—“অরণ্যের রক্ত চাই…”

ভূকম্পনের মতো মাটি কেঁপে উঠল। ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে উঠে এল সেই দৈত্যাকার অবয়ব। শিংওয়ালা মাথা, জ্বলন্ত চোখ, কালো কুয়াশায় মোড়া শরীর। হাতে দণ্ড।

অভিজিৎ দাঁতে দাঁত চেপে স্থির রইল। এবার আর সে পালাবে না।

অবয়ব ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। প্রতিটি পদক্ষেপে মাটির শিকড় নড়ছে, গাছ কেঁপে উঠছে। চারপাশের ছায়াগুলো নড়েচড়ে জীবন্ত হয়ে উঠছে। তারা যেন অসংখ্য হাত বাড়িয়ে অভিজিৎকে টেনে নিতে চাইছে।

অভিজিৎ ব্যাগ থেকে দাদুর দেওয়া কম্পাস বের করল। কিন্তু অবাক হয়ে দেখল, কম্পাসটা এবার আলো ছড়াচ্ছে না। নিস্তব্ধ, মৃতের মতো।

অবয়ব গর্জে উঠল—
—“তোর রক্ত ছাড়া মুক্তি নেই। মেনে নে, নইলে আজ রাতেই শেষ।”

অভিজিৎ গভীর নিশ্বাস নিল। ছুরি বের করে আবার হাত কাটল। রক্ত ঝরে পড়ল মাটিতে আঁকা প্রতীকের উপর। সঙ্গে সঙ্গে প্রতীকগুলো লাল হয়ে উঠল।

অবয়ব কেঁপে উঠল। কিন্তু এবার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরোধ করল। দণ্ড উঁচিয়ে বজ্রপাতের মতো আঘাত নামাল। আগুনের রেখা মন্দির চিরে ফেলল। অভিজিৎ মাটিতে ছিটকে পড়ল। শরীর জ্বলে উঠল তীব্র যন্ত্রণায়।

মাধুরী চিৎকার করে উঠল—
—“লড়াই কর! ভয় পেলে তুইও ওদের মতো মূর্তি হয়ে যাবি!”

অভিজিৎ দাঁতে দাঁত চেপে উঠে দাঁড়াল। রক্তে মাটি ভিজে গেছে। কিন্তু সে বুঝল, কেবল রক্ত দেওয়া যথেষ্ট নয়। তাকে প্রতীকগুলো ধ্বংস করতে হবে।

সে পাথর কুড়িয়ে নিয়ে প্রতীকগুলোর উপর আঘাত করতে শুরু করল। প্রতিটি আঘাতে প্রতীক কেঁপে উঠছে, আলো নিভছে। অবয়ব আরও ভয়ঙ্কর গর্জে উঠছে।

হঠাৎ ছায়াগুলো একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ল। শীতল হাতের মতো চারদিক থেকে চেপে ধরল অভিজিৎকে। তার বুক চেপে আসছে, শ্বাস আটকে যাচ্ছে।

ঠিক তখনই চাঁদের আলো তীব্র হয়ে পড়ল। মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ যেন রুপোলি আলোয় ভরে গেল। সেই আলোয় ছায়াগুলো পিছিয়ে গেল।

অভিজিৎ শেষ শক্তি দিয়ে প্রতীকগুলো ভাঙল। একে একে সব প্রতীক নিভে গেল।

অবয়ব চিৎকার করে উঠল—
—“না-আ-আ…”

কিন্তু শেষ প্রতীক ভাঙতেই মাটি কেঁপে উঠল। অবয়ব ছাই হয়ে মিলিয়ে গেল বাতাসে। ছায়াগুলো ধোঁয়ার মতো উধাও হয়ে গেল।

অভিজিৎ হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে পড়ে গেল। শরীর ভেঙে পড়েছে, কিন্তু মনে হল সে জিতেছে।

মাধুরী এগিয়ে এসে তার মাথা কোলে নিল। চোখে জল চিকচিক করছে।
—“তুই পেরেছিস। অভিশাপ দুর্বল হয়েছে।”

অভিজিৎ ফিসফিস করে বলল,
—“দুর্বল মানে? সম্পূর্ণ ভাঙেনি?”

মাধুরী ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল।
—“না। এ শুধু শুরু। অরণ্যের দেবতা শতাব্দীর শক্তি নিয়ে বেঁচে আছে। সে শেষ হয়নি। কাল রাতেই শেষ লড়াই হবে।”

অভিজিৎ চোখ বন্ধ করল। ক্লান্ত শরীর বিশ্রাম চাইছে, কিন্তু তার ভেতরে একটাই প্রতিজ্ঞা—
শেষ লড়াইয়ে সে মরবে না। অরণ্যের অভিশাপ সে ভাঙবেই।

আকাশে তখন পূর্ণিমার চাঁদ নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে। অরণ্য নিস্তব্ধ। কিন্তু সেই নীরবতার ভেতরে লুকিয়ে আছে আসন্ন ঝড়।

পর্ব ৯ : শেষের শুরু

অভিজিৎ অচেতন ঘুম থেকে জেগে উঠল ভোরের আলোয়। শরীর জ্বালা করছে, রক্তশূন্য হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। তার কাটা হাতটা ব্যান্ডেজ করা—কে করল সে জানে না। চারপাশে তাকিয়ে দেখল, সে আবার বটগাছের নিচে শুয়ে আছে। মাধুরী তার পাশে বসে আছে নিঃশব্দে।

—“তুই বেঁচে গেছিস,” মাধুরী শান্ত গলায় বলল, “কিন্তু এটা কেবল শুরু। পূর্ণিমার শেষ রাতেই সিদ্ধান্ত হবে।”

অভিজিৎ উঠে বসে শ্বাস নিল গভীরভাবে।
—“কাল রাতের লড়াই আমি জিতেছিলাম। তাহলে এখনও কেন সব শেষ হয়নি?”

মাধুরী ধীরে ধীরে বলল,
—“কারণ তুই প্রতীক ভেঙেছিস, কিন্তু দেবতার শিকড় এখনও আছে। সে অরণ্যের ভেতরে লুকিয়ে আছে। তাকে ধ্বংস না করলে মুক্তি নেই।”

অভিজিৎ আকাশের দিকে তাকাল। সূর্যের আলো ফুটেছে, কিন্তু অরণ্যের ভেতরে অন্ধকার আরও গভীর। সে বুঝল, এই জায়গায় সময় আর বাস্তবতার নিয়ম কাজ করে না।

দিনভর তারা প্রস্তুতি নিল। অভিজিৎ শরীর সামলে নিল কিছুটা। মাধুরী তাকে প্রাচীন কিছু মন্ত্র শেখাল—যেগুলো অরণ্যের দেবতার শক্তি দুর্বল করতে পারে। “এগুলো শুধু ঢাল,” মাধুরী বলল, “আক্রমণ নয়। আক্রমণের জন্য তোর সাহসই যথেষ্ট।”

অভিজিৎ নোটবুকে প্রতিটি শব্দ লিখে রাখল। তার চোখে আর কেবল কৌতূহল নেই—এখন তীব্র সংকল্প।

সন্ধ্যা নামতেই আবার চারপাশ বদলে গেল। পাখির ডাক থেমে গেল, বাতাস ভারী হয়ে উঠল। পূর্ণিমার চাঁদ ওঠার আগেই অরণ্য নিস্তব্ধ হয়ে গেল, যেন সব প্রাণী ভয় পেয়ে লুকিয়ে পড়েছে।

মাধুরী বলল,
—“সময় এসেছে। আজ রাত যদি পারিস, তবে অভিশাপ ভাঙবে।”

অভিজিৎ দাঁড়াল। হাতে কম্পাস, ব্যাগে ছুরি। তার রক্ত ঝরতে পারে, কিন্তু এবার সে জানে, ভয় দেখালে অরণ্য জয়ী হবে।

চাঁদ উঠতেই মন্দিরের দিক থেকে গর্জন ভেসে এল। মাটি কেঁপে উঠল। প্রতীকগুলো আবার জ্বলে উঠল, আগের চেয়েও ভয়ঙ্কর।

অভিজিৎ আর মাধুরী একসাথে মন্দিরের দিকে এগোল। দূর থেকে তারা দেখল—অবয়বটি এবার আগের চেয়ে বিশাল, আরও অন্ধকার। তার শরীর গাছের শিকড় দিয়ে তৈরি, চোখে আগুন, আর কণ্ঠে বজ্রধ্বনি।

—“অরণ্যের রক্ত!” অবয়ব গর্জে উঠল।

অভিজিৎ দাঁড়িয়ে রইল। কাঁপছিল ভেতরে, কিন্তু চোখ স্থির।
—“তুই মানুষ ছিলি। একদিন তুই নিজেই অভিশাপ ডেকেছিলি। আজ আমি তা শেষ করব।”

অবয়ব হেসে উঠল—পোড়া কাঠের মতো শব্দ।
—“মানুষ আমাকে দেবতা বানিয়েছে। তুই আমাকে শেষ করতে পারবি না।”

সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে ছায়া এসে ঘিরে ধরল তাদের। হাজারো ফাঁপা চোখ তাকিয়ে আছে। মাটি থেকে বেরিয়ে এল শিকড়, হাতের মতো পেঁচিয়ে ধরতে লাগল অভিজিৎকে।

মাধুরী চিৎকার করে মন্ত্র পড়তে শুরু করল। প্রতিটি শব্দে আলো ছড়াল। ছায়াগুলো কিছুটা পিছিয়ে গেল, কিন্তু সম্পূর্ণ নয়।

অভিজিৎ ছুরি বের করল। হাত কাটল আবার। রক্ত মাটিতে পড়তেই প্রতীকগুলো কেঁপে উঠল।

অবয়ব গর্জন করল,
—“তোর রক্তেই আমি অমর হব!”

সে দণ্ড উঁচিয়ে আঘাত করল। বজ্রপাতের মতো আগুন ছুটল অভিজিতের দিকে। অভিজিৎ লাফিয়ে সরে গেল, কিন্তু শরীরের একপাশ ঝলসে গেল। যন্ত্রণা তীব্র, কিন্তু সে দাঁত চেপে রইল।

সে দৌড়ে গিয়ে পাথরের বেদির কাছে পৌঁছল। সেখানে রাখা মূর্তিগুলো একে একে জ্বলছে। অভিজিৎ ছুরি দিয়ে একে একে ভাঙতে শুরু করল। প্রতিটি মূর্তি ভাঙতেই অবয়ব চিৎকার করে উঠল, আকাশ কেঁপে উঠল।

কিন্তু অবয়ব হার মানল না। তার শিকড় মাটির ভেতর থেকে উঠে এসে পেঁচিয়ে ধরল অভিজিৎকে। বুক চেপে ধরছে, শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

অভিজিৎ মরিয়া হয়ে কম্পাসটা বের করল। অবাক হয়ে দেখল, এবার কম্পাস আলো ছড়াচ্ছে। সূঁচ ঘুরে গিয়ে সরাসরি অবয়বের দিকে স্থির হল।

সে বুঝল, এটিই তার অস্ত্র।

সে শেষ শক্তি দিয়ে কম্পাসটা ছুঁড়ে মারল অবয়বের বুকের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে সাদা আলো বিস্ফোরণের মতো ছড়িয়ে পড়ল।

অবয়ব চিৎকার করে উঠল। শিকড়গুলো সরে গেল। আলো তার শরীর ভেদ করে গেল। চোখের আগুন নিভে আসছে।

কিন্তু তবু সে শেষ চেষ্টা করল। বজ্রপাতের মতো দণ্ড আঘাত করল অভিজিতের দিকে।

মাধুরী ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে সরিয়ে দিল। বজ্রপাত মাধুরীর শরীর ছুঁয়ে গেল। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

অভিজিৎ চিৎকার করে উঠল—
—“না-আ-আ!”

কিন্তু মাধুরী হাসল, মুখে রক্ত, চোখে শান্তি।
—“শেষ কর… এখনই।”

অভিজিৎ দাঁতে দাঁত চেপে ছুরি তুলে নিল। সে নিজের রক্ত শেষবার ঝরাল প্রতীকের উপর। চাঁদের আলো সেই রক্তে পড়ল। প্রতীকগুলো একসাথে ভেঙে পড়ল।

অবয়ব গর্জন করে ধসে গেল ছাই হয়ে। আকাশ কেঁপে উঠল, মাটি ফেটে গেল। আর তারপর সব নিস্তব্ধ।

অভিজিৎ হাঁপাতে হাঁপাতে চারদিকে তাকাল। ছায়া নেই, গর্জন নেই। অরণ্য নীরব।

কিন্তু তার সামনে মাধুরী পড়ে আছে। ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে।

—“তুই পেরেছিস,” সে ফিসফিস করে বলল, “অরণ্য মুক্ত হল। আমি-ও মুক্ত হলাম।”

তারপর সে আলো হয়ে আকাশে মিলিয়ে গেল।

অভিজিৎ মাটিতে বসে পড়ল। চোখে জল, শরীরে ব্যথা, কিন্তু মনে হল অরণ্য প্রথমবার শান্ত হয়েছে।

আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ তখন সাদা আলোয় ভাসছে।

এ লড়াই শেষ হয়েছে—নাকি এখনও কিছু বাকি আছে, সে জানে না।

পর্ব ১০ : মুক্তি না অভিশাপ

অভিজিৎ স্তব্ধ হয়ে বসে আছে ধ্বংসস্তূপের মাঝখানে। বাতাসে ছাই উড়ছে, মাটিতে শুকনো রক্তের দাগ। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ সাদা আলো ছড়াচ্ছে, কিন্তু অরণ্য নিস্তব্ধ—অস্বাভাবিক নিস্তব্ধ। শতাব্দীর ভয়াবহতা যেন এক মুহূর্তে থেমে গেছে।

মাধুরী আর নেই। তার ছায়া মিলিয়ে গেছে আলোতে। অথচ অভিজিৎ এখনো শুনতে পাচ্ছে তার কণ্ঠস্বর—“তুই পেরেছিস…”

সে জানে, এই জঙ্গলের মাটি শত শত বছরের অভিশাপ বহন করছে। বলি দেওয়া মানুষের হাড়, রক্ত, আর ছায়া আজও শিকড়ের নিচে লুকিয়ে আছে। কিন্তু আজ রাতের লড়াই কি সত্যিই শেষ করেছে সবকিছু? নাকি এটা শুধু নতুন চক্রের শুরু?

শরীর ক্লান্ত, ক্ষতবিক্ষত। তবু সে উঠে দাঁড়াল। হাতে দাদুর দেওয়া কম্পাস। এবার কম্পাস শান্ত—সূঁচ উত্তরমুখে স্থির। অনেক দিন পর প্রথমবার স্বাভাবিক আচরণ করছে। অভিজিৎ বুঝল, অরণ্যের ক্রোধ হয়তো কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়েছে।

সে ধীরে ধীরে অরণ্যের পথ ধরে হাঁটতে লাগল। সূর্যের প্রথম আলো আকাশে উঠছে। পাখিরা ডাকছে, পাতায় শিশির জমে আছে। অরণ্য যেন আবার নতুন ভোরকে স্বাগত জানাচ্ছে। গত রাতের অন্ধকার, শিকড়ের শ্বাসরোধ করা ভয়, আর দৈত্যাকার অবয়ব—সব কিছু কি তবে ভ্রম ছিল?

না। অভিজিৎ জানে, এটা ভ্রম নয়। তার শরীরের ক্ষত, শুকনো রক্ত, আর মাধুরীর বিসর্জনই প্রমাণ যে সবই বাস্তব ছিল।

সে কয়েক ঘণ্টা হাঁটল। অবশেষে জঙ্গলের প্রান্তে এসে পৌঁছল। দূরে গ্রাম দেখা যাচ্ছে। সকালের কুয়াশায় ঢাকা ঘরবাড়ি, ধোঁয়া ওঠা চুল্লি, আর মানুষজনের ব্যস্ততা।

হঠাৎ বুকের ভেতর কেমন যেন ব্যথা হল। মনে পড়ল হরিদাসের সতর্কবার্তা—“ভয়কে সঙ্গে না আনলে অরণ্য রাগ করে।” সত্যিই কি সে ভয়কে সঙ্গে এনেছিল? নাকি ভয়ই তাকে বেছে নিয়েছিল?

গ্রামে পৌঁছতেই লোকজন তাকে দেখে বিস্মিত হল।
—“তুমি ফিরে এসেছ? মহারানী অরণ্য থেকে কেউ আর ফেরে না!”

অভিজিৎ ক্লান্ত গলায় বলল,
—“অরণ্য মুক্ত হয়েছে। অভিশাপ শেষ।”

গ্রামবাসীরা একে অপরের মুখের দিকে তাকাল। তাদের চোখে বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মিশ্রণ। কেউ কেউ তাকে স্পর্শ করে দেখল—সে সত্যিই মানুষ, ছায়া নয়।

কয়েকদিন গ্রামে থেকে অভিজিৎ ধীরে ধীরে সুস্থ হল। কিন্তু অরণ্যের অভিজ্ঞতা তাকে বদলে দিয়েছে। রাত হলে এখনও সে শুনতে পায় মাধুরীর গান, যেন বাতাসে ভেসে আসে।

অবশেষে সে শহরে ফিরে এল। তার গবেষণার নোট, ছবি, আর ডায়েরি নিয়ে বসে থাকল দীর্ঘদিন। অনেক বিজ্ঞানী তার গল্প শুনে হেসে উড়িয়ে দিল। তারা বলল—“ক্লান্তির কারণে হ্যালুসিনেশন হয়েছে। এ সব বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার বাইরে নয়।”

কিন্তু অভিজিৎ জানে, তারা ভুল। এই অভিজ্ঞতা বৈজ্ঞানিক নয়, বাস্তব। অরণ্য ছিল জীবন্ত—দেবতা, অভিশাপ, আর মুক্তির সন্ধিক্ষণ।

সে সিদ্ধান্ত নিল, তার অভিজ্ঞতা লিখে যাবে। বইয়ের পাতায় লিপিবদ্ধ করবে অরণ্যের ডাক, যাতে ভবিষ্যতের কেউ যদি মহারানী অরণ্যে প্রবেশ করে, তারা সতর্ক হয়।

এক রাতে সে লেখার টেবিলে বসে ডায়েরি খুলল। হঠাৎ বুকের ভেতর শীতলতা অনুভব করল। আলো নিভে গেল ঘরের। জানলার বাইরে হাওয়ায় পাতার ফিসফিসানি—“অরণ্যের রক্ত…”

অভিজিৎ থমকে গেল। বুকের ভেতর কাঁপন ধরল। ধীরে ধীরে টেবিলের উপর রাখা কম্পাসটা ঘুরতে শুরু করল। সূঁচ থেমে নেই—দ্রুত, অস্থির, পাগলের মতো ঘুরছে।

তার চোখ স্থির হয়ে গেল কম্পাসের উপর। মনে হল, অরণ্য এখনো শেষ হয়নি। হয়তো অভিশাপ শুধু দুর্বল হয়েছে, ভাঙেনি।

সে আয়নায় নিজের মুখের দিকে তাকাল। চোখে ক্লান্তি, ঠোঁটে শুকনো রক্তের দাগ। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, আয়নায় তার নিজের ছায়া নয়—কোনো অচেনা অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে।

অভিজিৎ গভীর নিঃশ্বাস নিল। কলম হাতে নিয়ে ডায়েরির প্রথম পাতায় লিখল—
“মহারানী অরণ্যের ডাক থেকে পালানো যায় না। আমি শুধু সময় কিনেছি। হয়তো একদিন আবার সে আমাকে খুঁজে নেবে।”

আকাশের বাইরে পূর্ণিমার চাঁদ ঝলমল করছে। তার আলো জানলার ফাঁক দিয়ে এসে পড়ছে টেবিলের উপর। কম্পাসের সূঁচ থেমে গেছে উত্তর দিকে।

কিন্তু হাওয়ায় ফিসফিসানি ভেসে আসছে এখনও—
“ফিরে যা… ফিরে যা…”

অভিজিৎ বুঝল, এই গল্পের কোনো শেষ নেই। অরণ্য মুক্ত হয়নি, কেবল অপেক্ষা করছে নতুন শিকারের জন্য।

সে কলম রেখে জানলার দিকে তাকাল। গভীর ছায়ার মধ্যে মনে হল মাধুরীর অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটে শান্ত হাসি, চোখে অশ্রু।

আর তখনই অভিজিৎ জানল—মুক্তি আর অভিশাপের মাঝের সীমানা অরণ্যে চিরকাল অদৃশ্য থাকবে।

***

WhatsApp-Image-2025-08-21-at-2.03.33-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *