Bangla - প্রেমের গল্প

সমুদ্রতটে একদিন

Spread the love

সুমিতা বিশ্বাস


সকালটা অদ্ভুত এক নির্জনতায় ভরে ছিল। কলকাতার ভিড়ভাট্টা আর প্রতিদিনের দৌড়ঝাঁপের মধ্যে বছরের পর বছর কেটে গেছে তনিমার। সে একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করে, আর স্কুলের দায়িত্ব যেন তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত গ্রাস করে রেখেছে। খাতা দেখা, লেসন প্ল্যান তৈরি, পরীক্ষা নেওয়া, অভিভাবকদের অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দেওয়া—সবকিছুর ভিড়ে তার নিজের জন্য যেন কোনো সময়ই বাকি থাকে না। অফিস থেকে ফিরে বাড়ির কাজ, পরিবারের চাপ—সব মিলিয়ে সে ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে উঠেছে। অথচ তার ভেতরে কোথাও একটা চিরকালীন অস্থিরতা কাজ করে। ছোটবেলায় যেমন ছুটির দিন মানেই ছিল খোলা আকাশের নিচে খেলা, ঘুরে বেড়ানো আর অজানা আনন্দ খোঁজা, তেমনটা আর অনেকদিন হয়নি। তাই এবারের স্কুলের গ্রীষ্মের ছুটি তার কাছে শুধু বিশ্রামের সুযোগ নয়, বরং নিজের সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হওয়ার এক প্রয়াস। তনিমা একদিন হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিল—সে একা দিঘায় যাবে। কোনো বন্ধু, কোনো আত্মীয় নয়, শুধু সে আর সাগরের ঢেউ। বুকের ভেতরে দীর্ঘদিন জমে থাকা দমবন্ধ করা নিঃশ্বাস যেন মুক্তি চাইছিল, আর সে বিশ্বাস করল সমুদ্রই সেই মুক্তি দিতে পারবে। ব্যাগ গোছাতে গোছাতে সে অনুভব করছিল—এটা কেবল ভ্রমণ নয়, এটা তার ভেতরের অস্থিরতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।

ট্রেন ধরার মুহূর্তে তার চোখে এক অদ্ভুত ঝিলিক ছিল। বহুদিন পর সে সত্যিই নিজের জন্য কিছু করছে। ভোরের ট্রেনের জানালায় বসে সে দেখছিল পাশ কাটিয়ে যাওয়া সবুজ খেত, নদীর ধারা, গ্রাম আর ছোট শহরের চিত্র। সেই দৃশ্যগুলো যেন তার ভেতরের ক্লান্তি ধুয়ে দিচ্ছিল। চারপাশে অন্য যাত্রীরা হইহুল্লোড় করলেও তনিমা নিজের ভেতরে চুপচাপ বসে ছিল। তার বুকের ভেতর ছোট্ট একটা উত্তেজনা জেগেছিল—সমুদ্রকে সামনে থেকে দেখা, তার গর্জন শোনা আর একা একা সেই বিশালতার ভেতরে নিজেকে খুঁজে পাওয়া। এতদিন সে শুধু বইতে পড়েছে কিংবা ছবিতে দেখেছে, কিন্তু সমুদ্রের কাছে গিয়ে মনকে খুলে দেওয়ার অভিজ্ঞতা এবারই প্রথম। ট্রেনের জানালায় উড়ে আসা হাওয়ায় সে মুখটা বারবার বাইরে বের করছিল, যেন সেই হাওয়ায় আগাম সমুদ্রের গন্ধ পাবে। স্টেশন থেকে নামার পর গাড়ি ধরে দিঘার পথে যেতে যেতে তার চোখে ধরা দিল আকাশের নীল গভীরতা আর রোদের ঝলক। শহরের ধুলো আর যান্ত্রিকতার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে এই মুক্তির ছোঁয়া তাকে অদ্ভুতভাবে স্বস্তি দিল। সে যেন নতুন করে শ্বাস নিতে পারছে, নতুন করে অনুভব করতে পারছে নিজের অস্তিত্ব।

অবশেষে যখন সে দিঘার সমুদ্রতটে এসে পৌঁছল, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে। হোটেলে ব্যাগ রেখে সোজা সাগরের দিকে হাঁটতে শুরু করল। দূর থেকে প্রথমবারের মতো সাগরের ঢেউয়ের গর্জন কানে আসতেই তার শরীরের ভেতর দিয়ে শিহরণ বয়ে গেল। সমুদ্রকে সামনে থেকে দেখা যেন এক বিশাল আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে যাওয়ার মতো অভিজ্ঞতা। সে বালির ওপর বসে অনেকক্ষণ নিরব হয়ে সেই ঢেউয়ের ওঠানামা দেখছিল। প্রতিটি ঢেউ যেন তাকে ডাকছিল—“এসো, তোমার সব ক্লান্তি আর বাঁধন আমাকে দাও, আমি নিয়ে যাব।” তনিমা নিজের অজান্তেই চোখ বন্ধ করে ফেলল, আর বুক ভরে শ্বাস নিল। আকাশে তখন ধীরে ধীরে সূর্য নামছে, আকাশের রঙ লাল-কমলা হয়ে উঠছে। তার মনে হচ্ছিল—এমন রঙ তো জীবনে সে কখনো দেখেনি। হয়তো দেখেছে, কিন্তু চোখে রাখার মতো সময় ছিল না। ঢেউয়ের ছন্দ, বাতাসের শীতল স্পর্শ আর আকাশের রঙিন আলোয় সে বুঝতে পারল—এই ছুটি কেবল বিশ্রামের নয়, বরং তার ভেতরের বন্দিত্ব থেকে পালিয়ে আসার গল্প। তনিমার মন ভরে উঠল এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে, যেন সে দীর্ঘদিন পর সত্যিই নিজের সঙ্গে একা থাকতে পারল। এভাবেই তার ছুটির প্রথম দিন শেষ হতে চলল, আর তার মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি জেগে উঠল—এই যাত্রা হয়তো তার জীবনের গতিপথকেই বদলে দেবে।

রৌনকের দিনগুলো যেন এক অদৃশ্য যন্ত্রের মধ্যে আটকে গেছে। কলকাতার এক ছোট্ট ফ্ল্যাটে সকালে ঘুম ভাঙে তার অ্যালার্ম ঘড়ির শব্দে, তারপর শুরু হয় অফিস যাওয়ার প্রস্তুতি, যানজট, মিটিং, ডেডলাইন, আর রাত অবধি লড়াই। সে একটি স্টার্ট-আপে কাজ করে, আর স্টার্ট-আপ মানেই অনিশ্চয়তার সঙ্গে প্রতিদিন যুদ্ধ। নতুন প্রজেক্ট আনতে হবে, টিমকে চালাতে হবে, বিনিয়োগকারীর প্রত্যাশা সামলাতে হবে—সবকিছু যেন তার কাঁধেই এসে ভর করছে। রৌনক মনের দিক থেকে সবসময় প্রাণবন্ত, কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে অফিসের চাপ তার ভেতরের উজ্জ্বলতাকে নিভিয়ে দিয়েছে। তার হাসি আগের মতো উজ্জ্বল থাকে না, তার চোখে এক ধরনের ক্লান্তি জমে আছে, যা সে বাইরে কখনো প্রকাশ করে না। তার বন্ধুরা যখন দিঘায় ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করে, সে রাজি হয় বটে, কিন্তু মনে মনে ভাবে—সমুদ্রের পাশে দাঁড়িয়ে হয়তো কিছুক্ষণের জন্য অন্তত এই অস্থিরতা থেকে মুক্তি মিলবে। বন্ধুদের সঙ্গে মজা করার ইচ্ছে তার নেই, তবুও সে যাত্রা শুরু করে। হয়তো একা ঘরে বসে থেকে আরও ক্লান্ত হওয়ার চেয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাওয়া ভালো।

দিঘায় পৌঁছে বন্ধুরা হৈচৈ শুরু করল। কেউ সেলফি তুলছে, কেউ ঘোড়ায় চড়তে চাইছে, কেউ আবার দোকান থেকে চিপস-চা কিনে আড্ডা জমাচ্ছে। রৌনক হাসিমুখে সঙ্গ দেয়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে এক শূন্যতা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। মানুষের ভিড়ে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে অদ্ভুতভাবে একা অনুভব করে। তার মনে হয়, এই হৈচৈ আর শব্দ আসলে তাকে আরও নিঃসঙ্গ করে তোলে। তাই হঠাৎ করেই সে সিদ্ধান্ত নেয়—সে একা সাগরের তীরে হাঁটতে যাবে। চটি হাতে নিয়ে বালির ওপর খালি পায়ে হেঁটে চলা শুরু করে সে। দূরের ভিড় আর হট্টগোল পেছনে পড়ে যায়, আর সামনে কেবল অসীম সমুদ্রের ডাক। ঢেউগুলো আসছে, ভাঙছে, আবার ফিরছে—এই ছন্দ তার মনে অদ্ভুত প্রশান্তি জাগায়। রৌনক হাঁটতে হাঁটতে নিজের জীবনের চাপগুলো নিয়ে ভাবতে থাকে। সে ভাবে, এত দৌড়ঝাঁপ, এত পরিশ্রম—কিন্তু এর শেষে কী? সুখ কোথায়? তার ভেতরে চাপা পড়ে থাকা প্রশ্নগুলো ঢেউয়ের শব্দে যেন আরও জোরে বাজতে থাকে। অথচ এই প্রশ্নের উত্তর সে খুঁজে পায় না, শুধু হাঁটতে থাকে নির্জনতায়।

আকাশে তখন সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিমে ঝুঁকছে, সোনালি আলোয় সমুদ্র ঝলমল করছে। সেই আলোয় রৌনকের চোখে যেন নতুন করে কিছু ধরা দেয়। ভিড় থেকে দূরে এসে সে অনুভব করে, এই নির্জনতা তার জন্য অপরিহার্য ছিল। ভিড় তাকে ক্লান্ত করে, কিন্তু সমুদ্রের বিশালতা তাকে শান্ত করে। হাঁটতে হাঁটতে সে পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখে, বন্ধুরা একের পর এক কল দিচ্ছে—কোথায় গেলি? ছবি তুলতে আয়। কিন্তু সে ফোনটা সাইলেন্ট করে ফেলে। আজ সে কারও সঙ্গে থাকতে চায় না, আজ শুধু নিজের সঙ্গে সময় কাটাতে চায়। ঢেউ তার পায়ের কাছে এসে ভিজিয়ে যায়, বালি তার তলায় নরম হয়ে যায়, আর ঠান্ডা বাতাস বুকের ভেতরে জমে থাকা ক্লান্তিকে আস্তে আস্তে সরিয়ে দিতে শুরু করে। রৌনকের মনে হয়—সমুদ্রের এই অসীমতা হয়তো তাকে মনে করিয়ে দিতে এসেছে যে মানুষের জীবন আসলে অনেক ছোট, এত কষ্ট, এত চাপ নিয়ে বেঁচে থাকার মানে নেই। এই হাঁটার প্রতিটি পদক্ষেপ তাকে নিজের কাছে একটু একটু করে ফিরিয়ে আনছে। আর ঠিক তখনই, সে জানে না কেন, মনে হয়—এই সমুদ্রতটেই তার জীবনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার শুরু হতে চলেছে।

সন্ধ্যার সময়টা যেন সমুদ্রের নিজের এক বিশেষ মুহূর্ত। দিনের কোলাহল, রোদ্দুরের তীব্রতা সব ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়, আর তার জায়গা নেয় এক অদ্ভুত শান্তি। আকাশে লাল, কমলা আর বেগুনি রঙের মিশ্রণ ছড়িয়ে পড়ে, যেন প্রকৃতি নিজের হাতে এক মহাকাব্য আঁকছে। তনিমা তখন সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। তার চুলে লেগে থাকা লবণাক্ত বাতাস, চোখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি—এমনভাবে দাঁড়িয়ে ছিল যেন সে সমুদ্রের সঙ্গে মিশে গেছে। অনেকক্ষণ ধরে বালির ওপর হাঁটার পর সে থেমেছিল একটু দূরে, সাগরের ঢেউকে দেখার জন্য। তার ওড়না হালকা হাতে কাঁধে জড়ানো ছিল, কিন্তু দিঘার সমুদ্রতটে হঠাৎ উঠে আসা ঝোড়ো হাওয়ায় সেটি উড়ে গিয়ে বাতাসে ভেসে ওঠে। ওড়নাটা যেন মুক্তি পেয়ে সমুদ্রের দিকে ছুটছিল। তনিমা প্রথমে আঁকস্মিক চমকে উঠল, তারপর ছোট্ট এক অস্থিরতায় সেটি ধরতে হাত বাড়াল, কিন্তু বাতাসের সঙ্গে লড়াই করা সহজ হলো না। ঠিক তখনই, এক অচেনা হাত এগিয়ে এসে সেই ওড়নাটা থামিয়ে দিল। হাওয়ার ঝাপটায় ওড়নাটা ছেলেটির হাতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ল। তনিমা বিস্মিত হয়ে তাকাল।

ওই মুহূর্তে দুজনের চোখ প্রথমবারের মতো মিলল। রৌনক ছিল সেই ছেলেটি, যে সারাদিন ভিড় থেকে দূরে একা একা হাঁটছিল। তনিমার চোখে তখন সূর্যাস্তের আলো পড়েছিল, রৌনকের চোখে প্রতিফলিত হচ্ছিল সেই আলোয় ভরা আকাশ। অদ্ভুতভাবে দুজনের দৃষ্টি যেন স্থির হয়ে গেল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। তনিমা ভেবেছিল, ওড়না হাতে পেয়ে ধন্যবাদ দিয়ে সরে যাবে, কিন্তু অচেনা সেই মানুষটার চোখে এমন এক অচেনা উজ্জ্বলতা ছিল, যা তাকে আটকে রাখল। রৌনকও তার দৃষ্টি ফেরাতে পারছিল না। ওর ভেতরে দিনের পর দিনের ক্লান্তি, নিঃসঙ্গতা যেন ওই দৃষ্টির ভেতরে কোথাও গলে যাচ্ছিল। ওড়নাটা ফেরত দেওয়ার মুহূর্তে রৌনক হেসে ফেলল, একেবারে স্বাভাবিক একটা হাসি, কিন্তু সেই হাসির ভেতরে লুকিয়ে ছিল বহুদিনের চাপা যন্ত্রণা গলে যাওয়ার আরাম। তনিমাও অনিচ্ছাকৃতভাবে এক হালকা হাসি ফিরিয়ে দিল। সাগরের গর্জন, বাতাসের ঝাপটা আর দূরে সূর্যাস্তের দৃশ্য—সব মিলিয়ে মুহূর্তটা যেন সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। তারা দুজনেই অনুভব করল, হয়তো জীবনে এই প্রথম কোনো অপরিচিতকে দেখে এভাবে এক অচেনা পরিচিতির স্বাদ পেল।

পরের কয়েক মুহূর্তে আর কোনো কথা হয়নি, শুধু দৃষ্টি আর উপস্থিতির বিনিময়। তনিমা ওড়না কাঁধে গুঁজে নিল, আর রৌনক হাত নামিয়ে নরম স্বরে বলল, “বাতাসে এখানে জিনিস সামলানো বেশ কঠিন।” কথাটা সাধারণ হলেও তাতে এক অদ্ভুত আন্তরিকতা ছিল। তনিমা শুধু মাথা নেড়ে সায় দিল, কিন্তু তার ভেতরে কোথাও একটা ঢেউ বইতে শুরু করেছে। সে হঠাৎ টের পেল, সমুদ্রতট শুধু মুক্তির জায়গা নয়, এ যেন তার জীবনের কোনো নতুন গল্পের শুরু। রৌনকও একইভাবে অনুভব করল—দিনভর একা হাঁটার পর এই অচেনা মুখের সঙ্গে দেখা হওয়া কাকতালীয় নয়, বরং ভাগ্যেরই কোনো ইঙ্গিত। তারা দুজনেই নিজেদের মনের ভেতরে না বলা হাজারো প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, অথচ সেই মুহূর্তেই যেন এক অদৃশ্য সেতু গড়ে উঠল তাদের মাঝে। সূর্য তখন ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছিল সমুদ্রের বুকে, কিন্তু তাদের চোখে জ্বলে উঠছিল এক অচেনা আলো, যা হয়তো জীবনের অর্থকেই নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে।

সন্ধ্যার আলো তখন ক্রমশ গাঢ় হতে শুরু করেছে। সমুদ্রতটের ভিড় ধীরে ধীরে পাতলা হয়ে আসছে, দোকানগুলোর কোলাহলও আর ততটা জোরালো নয়। ঢেউয়ের ছন্দ যেন সবকিছুকে এক ধরণের ধ্যানের ভেতরে টেনে নিচ্ছে। তনিমা এবং রৌনক পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল, যদিও তাদের মধ্যে এক অচেনা অস্বস্তি ছিল—অপরিচিত কারও সঙ্গে হঠাৎ কথা বলা তো সহজ নয়। তবু বাতাসের টানে কিংবা মুহূর্তের যাদুতেই হোক, আলাপ শুরু হয়ে গেল। তনিমা প্রথমে চুপচাপ সমুদ্রের দিকে তাকিয়েই বলল, “আমি যখন খুব ক্লান্ত হয়ে যাই, মনে হয় যেন কোথাও গাঢ় অন্ধকার জমে আছে, তখন সমুদ্রের কথা ভাবি। মনে হয়, যদি ঢেউয়ের কাছে যেতে পারি, তাহলে হয়তো একটু শান্তি পাব।” কথাগুলো ছিল সরল, কিন্তু রৌনকের মনে সেগুলো গভীর ছাপ ফেলল। সে অনেকক্ষণ ধরে সমুদ্রের পাশে হাঁটছে, কিন্তু এই সরল বাক্যে যেন নিজের না বলা অনুভূতিগুলোও খুঁজে পেল। একটু থেমে রৌনক হেসে বলল, “আমার কাছে সমুদ্র একটু অন্যরকম। আমি মনে করি, সমুদ্র মানে নতুন শুরু। ঢেউ আসে, ভেঙে যায়, আবার নতুন করে গড়ে ওঠে। যেন প্রতিটি ঢেউ বলে—যা হারিয়ে গেছে, তাকে ভাসিয়ে দাও, নতুন করে শুরু করো।” তনিমা তার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হলো—কেননা তারও ভেতরে বহুদিনের ক্লান্তি এমন নতুন শুরু চাইছিল।

এরপর আলাপ আর থামল না। সমুদ্র যেন তাদের মধ্যে কথার সেতু গড়ে দিল। তারা দুজনেই নিজেদের ভেতরের চাপা কথা বলা শুরু করল, যা সাধারণত কেউ অপরিচিতকে বলে না। তনিমা বলল, ছোটবেলা থেকেই সে অনেক দায়িত্ব নিয়ে বড় হয়েছে। পড়াশোনার চাপ, পরিবারের প্রত্যাশা, আর এখন স্কুলের কাজ—সবকিছু মিলে তার ভেতরে এক অদৃশ্য ভার জমে আছে। কখনো নিজের স্বপ্নের দিকে এগোতে পারেনি, কারণ অন্যদের স্বপ্ন পূরণ করতেই ব্যস্ত ছিল সে। রৌনক মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। তার নিজের গল্পও তেমন আলাদা নয়। সে জানাল, কীভাবে অফিসের কাজে ডুবে গিয়ে নিজের ভেতরের মানুষটাকে হারিয়ে ফেলেছে। প্রতিদিন নতুন কিছু বানানোর, প্রমাণ করার দৌড়ে সে এতটাই ক্লান্ত হয়ে গেছে যে এখন মনে হয়, এই দৌড়ের কোনো শেষ নেই। তনিমা ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিল, তারা দুজনেই ভিন্ন ভিন্ন পৃথিবী থেকে এলেও ভেতরের যন্ত্রণা অনেকটা একই রকম। যেন একে অপরের ভেতরে নিজেদের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাচ্ছে। এই উপলব্ধি তাদের সম্পর্ককে হঠাৎ করেই কাছাকাছি টেনে আনল।

আলোচনার এক ফাঁকে হঠাৎ নীরবতা নেমে এলো। তারা দুজনেই একসঙ্গে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইল। আকাশে তখন লালিমা মিলিয়ে গিয়ে নীলচে অন্ধকার নেমে এসেছে, দূরে কিছু নৌকা আলোর ঝিকিমিকি নিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। তনিমা অনুভব করল, অনেকদিন পর তার বুকের ভেতরটা হালকা লাগছে। এমন কারও সঙ্গে নিজের ভেতরের চাপা যন্ত্রণা ভাগ করে নিতে পেরে তার মনে হচ্ছিল, সে হয়তো সত্যিই একটুখানি শান্তি পেল। অন্যদিকে, রৌনকও বুঝল, তার যে ক্লান্তি এতদিন তাকে গ্রাস করে রেখেছিল, তা আজ একটু হলেও হালকা হয়েছে। আলাপটা তেমন বিশেষ কিছু নয়—কোনো প্রতিশ্রুতি বা গভীর দার্শনিক আলোচনা নয়—তবু এর ভেতরে ছিল অদ্ভুত এক আন্তরিকতা। মনে হচ্ছিল, তারা দুজনেই যেন দীর্ঘদিন ধরে এই কথোপকথনের অপেক্ষায় ছিল। ঢেউ তখনও নিরবিচ্ছিন্ন ছন্দে আছড়ে পড়ছে, আর তার মাঝেই দুজন অপরিচিত মানুষ নিজেদের ভেতরে এক অচেনা আলো খুঁজে পাচ্ছে। এই আলাপই হয়ে উঠল তাদের সম্পর্কের প্রথম সেতুবন্ধন, যার ওপর দাঁড়িয়ে আগামী দিনের গল্প লেখা হবে।

সমুদ্রতটে তখন নরম অন্ধকার নেমে এসেছে। আকাশের প্রান্তে চাঁদের আলো ফুটতে শুরু করেছে, আর চারপাশে বাতাসে ভেসে আসছে লবণাক্ত সোঁদা গন্ধ। তনিমা আর রৌনক দুজনেই অনুভব করছিল, কথোপকথনের সেই মুহূর্ত থেকে তাদের মধ্যে দূরত্ব অনেকটাই কমে গেছে। তাই আর কোনো দ্বিধা না করেই তারা পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল। খালি পায়ে বালির ওপর হাঁটার মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভূতি ছিল—প্রতিটি পদক্ষেপ যেন তাদের ভেতরের ভার হালকা করে দিচ্ছিল। ঢেউ এসে মাঝে মাঝে তাদের পা ছুঁয়ে যাচ্ছিল, ঠান্ডা জলের স্পর্শে মনে হচ্ছিল প্রকৃতি যেন সঙ্গী হয়ে হাঁটছে তাদের সঙ্গে। প্রথমে তারা সাধারণ বিষয় নিয়ে কথা বলল—কোনো ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, কোনো সিনেমা বা গান, বা শখের গল্প। তনিমা জানাল, বই পড়া আর ছবি আঁকা তার সবচেয়ে প্রিয় কাজ, কিন্তু ব্যস্ত জীবনে এখন সে আর সেভাবে সময় পায় না। রৌনক জানাল, ছোটবেলায় সে গান শিখত, কিন্তু অফিসের চাপ আর দায়িত্ব তাকে সেই শখ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এই সাধারণ আলাপ ধীরে ধীরে এমন জায়গায় পৌঁছাল যেখানে তারা নিজেদের অনেক বেশি ভেতরের কথা প্রকাশ করতে শুরু করল।

হাঁটতে হাঁটতে রৌনক হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, “জানো, মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা আসলে নিজের জন্য নয়। প্রতিদিন যেন শুধু অন্যদের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যস্ত আছি। কবে শেষবার নিজের জন্য বাঁচলাম, মনে নেই।” তার কণ্ঠে ছিল গভীর ক্লান্তি আর চাপা যন্ত্রণার ছায়া। তনিমা ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বলল, “আমারও তাই মনে হয়। ছোটবেলা থেকে সবাই বলেছে—ভালো করে পড়াশোনা করো, ভালো চাকরি করো, দায়িত্ব নাও। সেই সব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মনে হয় আমি যেন নিজের স্বপ্নগুলো কোথাও হারিয়ে ফেলেছি। আমি একসময় লেখক হতে চেয়েছিলাম। অনেক গল্প আমার মাথায় ঘুরত, কিন্তু এখন আর লিখতে পারি না।” কথাগুলো বেরিয়ে আসার পর সে একটু অবাক হলো—কারণ এত ব্যক্তিগত কিছু কথা এত সহজে এক অপরিচিতকে বলা যায়, সে কখনো ভাবেনি। কিন্তু রৌনকের সামনে এসব বলতে তার কোনো বাধা লাগছিল না। বরং মনে হচ্ছিল, এই মানুষটা বুঝবে, তার কথা শুনবে, বিচার করবে না। রৌনকও তেমন অনুভব করছিল। সে বলল, “আমিও আসলে সঙ্গীতশিল্পী হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন যে পথে হাঁটছি, সেখানে গান কেবল একটা শখ হয়ে পড়ে আছে, আর জীবনটা একেবারে আলাদা পথে চলে গেছে।” তাদের কথায় এক ধরনের আক্ষেপ ভেসে উঠছিল, কিন্তু সেই আক্ষেপ ভাগ করে নেওয়ার ফলে যেন মনটা হালকা হচ্ছিল।

এই হাঁটাটা ছিল নিছক এক ভ্রমণ নয়, বরং দুজনের আত্মার মধ্যে এক সেতুবন্ধন তৈরি হওয়ার মুহূর্ত। ঢেউয়ের ছন্দে, অন্ধকারের শান্ত পর্দায়, তারা নিজেদের যন্ত্রণার সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নও ভাগ করছিল। তনিমা বলল, “হয়তো আবার লিখব কোনোদিন। হয়তো নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা আবার শুরু করব।” রৌনক তার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল, “তাহলে আমি আবার গান গাইব। অন্তত নিজের জন্য হলেও।” তারা দুজনেই হেসে ফেলল, যেন এই প্রতিশ্রুতি হালকা আনন্দের রঙ এনে দিল চারপাশে। হাঁটতে হাঁটতে তারা বুঝল, নিজেদের ভেতরের ভাঙাচোরা জায়গাগুলোকে সারানোর জন্য কখনো কখনো একজন সঠিক মানুষের উপস্থিতিই যথেষ্ট। এই হাঁটার প্রতিটি মুহূর্তে তারা অপরিচিত থেকে ধীরে ধীরে আপন হয়ে উঠছিল, আর সেই আপনত্ব যেন এতটাই সত্যি ছিল যে কথার প্রয়োজনও থাকত না। সমুদ্রের অসীমতা তাদের কথোপকথনের সাক্ষী হয়ে রইল, আর সেই এক সন্ধ্যায় তারা অনুভব করল—মানুষের জীবনে সব সম্পর্ক সময় দিয়ে মাপা যায় না, কিছু সম্পর্ক কেবল অনুভূতি দিয়েই গড়ে ওঠে।

সন্ধ্যার রঙ তখন সম্পূর্ণ মিলিয়ে গিয়ে চারপাশে গাঢ় অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। সমুদ্রতটে মানুষজনের ভিড়ও এখন অনেক কমে গেছে। যে কোলাহলে দুপুরে চারদিক ভরে ছিল, সেই ভিড়ের স্থান নিয়েছে নিস্তব্ধতা। হোটেলের আলো দূরে ঝিলমিল করছে, কয়েকটি চায়ের দোকান এখনও জ্বলজ্বল করছে, আর মাঝেমধ্যে রাস্তার পাশ দিয়ে গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ ভেসে আসছে। কিন্তু সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে থাকলে এসব শব্দও তেমন শোনা যায় না—শোনা যায় শুধু ঢেউয়ের গর্জন, আর তার ভেতর লুকিয়ে থাকা এক প্রশান্ত সুর। তনিমা ও রৌনক তখনও পাশাপাশি হাঁটছিল, কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে কথা বলার পর হঠাৎ যেন দুজনেই থেমে গেল। কথার আর প্রয়োজন রইল না। তাদের চোখে-মুখে এক ধরনের প্রশান্তি, মনে হচ্ছিল যেন এতক্ষণ যা কিছু তারা ভাগ করে নিয়েছে, তার পর আর নীরবতার মধ্যেই সব বলা হয়ে যায়। দূরের আকাশে তারা ফুটতে শুরু করেছে, আর হালকা চাঁদের আলো সমুদ্রের ঢেউয়ে পড়ছে। সেই আলোয় তাদের মুখে যেন অন্যরকম দীপ্তি ফুটে উঠছিল।

নীরবতার মধ্যে ঢেউয়ের শব্দই তখন প্রধান সঙ্গীত। ঢেউ এসে পায়ের কাছে আছড়ে পড়ছে, আবার ফিরে যাচ্ছে, যেন জীবনও ঠিক এইভাবেই আসা-যাওয়া করছে। এই ছন্দের সঙ্গে তনিমা আর রৌনকের হৃদস্পন্দন মিলেমিশে যাচ্ছিল। তারা দুজনেই নিজেদের ভেতরে অনেক কিছু ভাবছিল, কিন্তু কোনো শব্দে তা প্রকাশ করছিল না। তনিমা মনে মনে ভেবেছিল—এই মানুষটা একেবারেই অপরিচিত, তবুও আজ সে তাকে নিজের এত গভীর কথা বলে ফেলল কেন? হয়তো কারণ তার চোখে এক ধরনের বিশ্বাস আছে, যা কাউকে নিজের কথা বলতে বাধ্য করে। রৌনকও নিজের ভেতরে অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করছিল। এতদিন ধরে যে ক্লান্তি, একাকিত্ব তার বুকের ভেতরে জমে ছিল, আজ যেন সেটা একটু হলেও দূরে সরে গেছে। সে তাকাল তনিমার দিকে—তার চোখ তখন ঢেউয়ের দিকে নিবদ্ধ, কিন্তু মুখে এমন এক শান্ত অভিব্যক্তি যা রৌনকের মনে ছুঁয়ে গেল। তাদের মধ্যে কোনো কথা হচ্ছিল না, কিন্তু সেই নীরব মুহূর্তটাই যেন সবকিছুর চেয়ে বেশি সত্যি হয়ে উঠছিল।

ঠিক তখন দূরের দিগন্ত থেকে ভেসে এলো মৎস্যজীবীদের গান। কয়েকটি নৌকা সাগরের বুক চিরে এগোচ্ছিল, আর জেলেরা সমস্বরে একসঙ্গে গান গাইছিল—সেই গানে ছিল কষ্ট, শ্রম, অথচ অদ্ভুত এক আনন্দও। সেই গান আর ঢেউয়ের ছন্দ একসঙ্গে মিশে গিয়ে রাতটাকে আরও জাদুময় করে তুলল। তনিমা ও রৌনক দুজনেই চুপচাপ সেই গান শুনছিল। তারা বুঝতে পারল, মানুষের জীবনে সবসময় শব্দ দরকার হয় না; অনেক সময় শুধু উপস্থিতিই যথেষ্ট। সেই নীরবতা আর উপস্থিতি তাদের সম্পর্ককে আরও গভীর করে দিল। মনে হচ্ছিল, যেন তারা একে অপরকে দীর্ঘদিন ধরে চেনে, অথচ বাস্তবে তো আজই প্রথম পরিচয়। সমুদ্রতটে দাঁড়িয়ে তারা দুজনেই উপলব্ধি করল, জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে যা শব্দে প্রকাশ করা যায় না—শুধু অনুভব করা যায়। সেই রাতের নীরবতা, ঢেউয়ের সঙ্গীত, আর একে অপরের সান্নিধ্যই তাদের জীবনের এক স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে রইল।

রাত তখন অনেকটাই গভীর হয়েছে। আকাশে তারা আরও ঘন হয়ে উঠেছে, আর সমুদ্রের ঢেউ যেন আগের চেয়ে ধীর ও গভীর ছন্দে তীর ভাঙছে। তনিমা আর রৌনক পাশাপাশি বালুর ওপর বসে ছিল, সামনে বিশাল সমুদ্র বিস্তার। এতক্ষণ যে নীরবতা তাদের একসঙ্গে বেঁধেছিল, এখন যেন তা ভেঙে কোনো অচেনা স্বর উঁকি দিল ভেতর থেকে। রৌনক দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ থাকার পর হঠাৎই কথা বলল। কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত কম্পন, যেন বহুদিন ধরে চাপা পড়ে থাকা এক ব্যথা বেরিয়ে আসছে—“তুমি জানো, আমি আসলে একা নই… কিন্তু হয়তো সেইজন্যই আমি সবচেয়ে একা। কয়েক বছর আগে আমি কাউকে হারিয়েছি। খুব কাছের মানুষ ছিল। জীবনটা তখন থেকে পাল্টে গেছে। আমি আর কখনো সত্যিকারের স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারিনি।” কথাগুলো বলতে বলতে তার গলা ভারী হয়ে এলো। চোখ নামিয়ে সে ঢেউয়ের দিকে তাকাল, যেন সাগরের বিশালতায় নিজের বেদনা হারিয়ে ফেলতে চাইছে। তনিমা নিঃশব্দে শুনছিল। তার চোখে তখন ছিল সহানুভূতির আভা, আর এক ধরনের কোমল বোঝাপড়া। এই স্বীকারোক্তির মুহূর্তে রৌনক যেন নিজের ভেতরের এক অন্ধকার দরজা খুলে দিল, যা এতদিন ধরে বন্ধ ছিল।

তনিমা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে নরম কণ্ঠে বলল, “আমি-ও তো খুব একটা আলাদা নই, রৌনক। হয়তো তোমার মতো কাউকে হারাইনি, কিন্তু নিজের স্বপ্নকে হারিয়েছি। ছোটবেলায় আমি চেয়েছিলাম অনেক কিছু করতে—ছবি আঁকতে, ভ্রমণ করতে, নিজের মতো করে জীবন কাটাতে। কিন্তু বাড়ির দায়িত্ব, পড়াশোনা, চাকরি… সবকিছু মিলে নিজের ভেতরের সেই স্বপ্নগুলোকে একে একে গুম করে ফেলেছি। আজ আমি বেঁচে আছি, কিন্তু কখনো নিজের মতো করে বাঁচিনি।” কথাগুলো বলতে বলতে তার চোখে যেন একটা চাপা যন্ত্রণা ভেসে উঠল। এতদিন ধরে সে কাউকে এসব বলেনি। তার সহকর্মী, তার পরিবার—কেউ-ই বোঝেনি যে দায়িত্বের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক অসম্পূর্ণ মন। কিন্তু আজ এই অপরিচিত, সমুদ্রের তীরে বসা মানুষটির সামনে সে যেন অকপট হয়ে উঠল। রৌনকের মতো তাকেও নিজের ভেতরের অন্ধকারটুকু খুলে দিতে হলো। দুজনের স্বীকারোক্তি যেন একে অপরের জীবনের আয়না হয়ে দাঁড়াল—একজন হারিয়েছে প্রিয় মানুষ, আরেকজন হারিয়েছে নিজের স্বপ্ন। তবুও সেই হারানোর যন্ত্রণা তাদের আরও কাছে টেনে আনল।

সেই মুহূর্তে তনিমা ও রৌনক দুজনের মাঝের দূরত্ব যেন ভেঙে গেল। সমুদ্রের শব্দ তখনও চারপাশে গমগম করছিল, কিন্তু তার ভেতর দিয়ে তারা যেন শুনতে পাচ্ছিল একে অপরের হৃদয়ের ধ্বনি। রৌনক ধীরে ধীরে বলল, “অদ্ভুত, তাই না? আমরা দুজনেই অপরিচিত, অথচ আজ একে অপরকে জীবনের সবচেয়ে কঠিন সত্যিটা বলে ফেললাম।” তনিমা হেসে মাথা নেড়ে বলল, “হয়তো অপরিচিত বলেই এত সহজে বলা যায়। যাদের চিনি, তাদের সামনে এসব বলতে ভয় লাগে। কিন্তু তোমার চোখে আমি বিচার দেখি না, শুধু বোঝাপড়া দেখি।” সেই হাসিতে ছিল এক ধরনের মুক্তি, যা রৌনককে গভীরভাবে ছুঁয়ে গেল। সে অনুভব করল, এই স্বীকারোক্তি আসলে তাদের মধ্যে অদ্ভুত এক সেতু তৈরি করেছে। দুজনের একাকিত্ব যেন মিলেমিশে এক অদ্ভুত বন্ধন হয়ে উঠল। সেই রাতে, সমুদ্রের ঢেউ, তারাভরা আকাশ আর একে অপরের সান্নিধ্যে তারা উপলব্ধি করল—কখনো কখনো জীবনের সবচেয়ে অন্তরঙ্গ সত্য ঠিক এইভাবেই প্রকাশ পায়, কোনো শব্দের ভারে নয়, বরং বিশ্বাসের কোমলতায়। সেই খোলামেলা মুহূর্তে তনিমা আর রৌনক আর শুধু দুজন অপরিচিত ভ্রমণকারী রইল না, বরং তারা হয়ে উঠল একে অপরের জীবনের নীরব সাক্ষী।

রাত নেমে এসেছে ধীরে ধীরে, যেন আকাশের সব আলো একে একে নিভে গিয়ে কেবল চাঁদই রয়ে গেছে তার রাজত্ব বিস্তার করতে। পূর্ণিমার আলোয় সমুদ্রতট যেন রূপকথার মতো ঝলমল করছে। ঢেউয়ের প্রতিটি ভাঙন চাঁদের আলোয় রুপালি রেখা টেনে দিচ্ছে, যেন সমুদ্রের বুকের ওপর কোনো অদৃশ্য শিল্পী নিজের তুলির আঁচড় বুলিয়ে দিচ্ছে। বাতাসে লবণের ঘ্রাণ আরও তীব্র হয়ে উঠেছে, সঙ্গে এক অচেনা প্রশান্তি। তনিমা আর রৌনক পাশাপাশি বসে আছে বালুর ওপর, কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। দিনের শেষে, ক্লান্তির ভাঁজ তাদের চোখে থাকলেও রাতের এই আবেশ যেন সমস্ত ব্যথা মুছে দিয়েছে। চাঁদের আলোয় তনিমার মুখ হালকা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, আর রৌনক অনুভব করল, কতটা নির্ভার দেখাচ্ছে তাকে। তনিমার চোখও একবার রৌনকের দিকে ফিরল, কিন্তু সে দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিল। কোনো প্রতিশ্রুতি নেই, কোনো ঘোষণা নেই—তবুও সেই মুহূর্তে দুজনের ভেতরে যেন একই প্রশ্ন বেজে উঠল: “এমন একজন সঙ্গী যদি সারাজীবনের জন্য পাশে থাকত, তবে জীবনটা কি অন্যরকম হত না?” সমুদ্রের অন্তহীন শব্দ সেই প্রশ্নের উত্তর দেয়নি, কিন্তু নীরবতাই যেন হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে শক্তিশালী ভাষা।

রাতের নিস্তব্ধতায় তারা অনুভব করল, জীবনের সব কোলাহল, সব দাবি-দাওয়া থেকে দূরে এই সমুদ্রতটে বসে থাকা যেন এক নতুন পৃথিবীর অভিজ্ঞতা। রৌনকের মনে পড়ল তার ব্যথার অতীত, যে মানুষকে সে হারিয়েছে তার স্মৃতি এখনো তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। কিন্তু আজ তনিমার উপস্থিতিতে সেই শূন্যতা যেন খানিকটা পূর্ণ হয়ে উঠছে। তনিমার ভেতরেও একই রকম এক অদ্ভুত শান্তি কাজ করছিল। এতদিন সে ভেবেছিল তার দায়িত্বই তাকে গেঁথে রেখেছে, সে চাইলেও মুক্ত হতে পারবে না। কিন্তু আজ এই অপরিচিত মানুষের পাশে বসে সে অনুভব করছে, জীবন আসলে কেবল দায়িত্বের নাম নয়, জীবন মানে হলো মুহূর্তকে বাঁচা। তারা দুজনই জানে, আগামীকাল হয়তো আলাদা হয়ে যাবে, হয়তো এই রাতের পর তাদের পথ ভিন্ন দিকে বাঁক নেবে। কিন্তু সেই জ্ঞান তাদের আনন্দ কেড়ে নিতে পারল না। বরং ঠিক উল্টোটা ঘটল—তারা আরও গভীরভাবে বর্তমান মুহূর্তে ডুবে গেল। সমুদ্রের ঢেউ, রাতের বাতাস, চাঁদের আলো—সবকিছু মিলে এক যাদুকরী আবহ তৈরি করল। তারা কেউ কিছু বলছিল না, কিন্তু তাদের চোখে যে নীরব স্বীকারোক্তি জমছিল, তা-ই যেন হাজারো শব্দের চেয়ে সত্যি।

সময় থমকে দাঁড়িয়েছিল সেই সমুদ্রতটে। দূরে কোথাও মৎস্যজীবীদের নৌকায় ক্ষীণ আলো জ্বলছিল, যেন আকাশের তারারা নেমে এসেছে জলে। রৌনক মুঠো করে একমুঠো বালি হাতে তুলে আবার ছেড়ে দিল, যেন বলতে চাইছে জীবনের সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী, তবুও সেই ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তগুলোই আসলে আমাদের বেঁচে থাকার আসল কারণ। তনিমা তা দেখছিল আর ভাবছিল, হয়তো সেও এমন একজন সঙ্গী খুঁজছিল, যার কাছে কিছু বলার দরকার নেই—যার সঙ্গে কেবল চুপচাপ বসে থাকলেই বোঝা যায় ভেতরের অনুভূতি। সেদিন রাতে তারা কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি, ভবিষ্যতের কোনো ছবি আঁকেনি। তারা শুধু বসে থেকেছে, তাকিয়েছে সমুদ্রের দিকে আর অনুভব করেছে একে অপরের উপস্থিতি। কিন্তু সেই নীরবতাই হয়ে উঠল তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রতিশ্রুতি—যা বলা হয়নি, তবুও বোঝা গেছে। রাতের সমুদ্র তাদের শিখিয়ে দিল, সব সম্পর্ক প্রতিশ্রুতিতে বাঁধা নয়, কিছু সম্পর্ক কেবল অনুভূতির সেতুতে দাঁড়িয়ে থাকে, আর সেই সেতুই হয়তো সবচেয়ে টেকসই। তনিমা আর রৌনক তখন জানত না আগামীকাল কী ঘটবে, কিন্তু সেই মুহূর্তে তারা নিশ্চিত ছিল—এমন একজন সঙ্গী সারা জীবন চাই।

ভোরের আলো তখনও পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েনি, সমুদ্রতটের আকাশে হালকা সোনালি রঙের আভা ফুটে উঠছিল। রাতের নিস্তব্ধতা ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে, দূরে মৎস্যজীবীদের নৌকা ফিরছে, আর ভোরের বাতাসে ভিজে লবণাক্ত গন্ধ ভেসে আসছে। তনিমা তার ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছে আগেই, কারণ আজ সকালে তাকে কলকাতার ট্রেন ধরতে হবে। রৌনকও জানে তার ফেরার সময় হয়েছে, অফিসের ব্যস্ততা আবার তাকে গ্রাস করবে। কিন্তু ঘর ছাড়ার মুহূর্তে তনিমার মনে হচ্ছিল, এই সমুদ্রতট, এই বাতাস, এই ঢেউ—সব যেন তাকে জড়িয়ে ধরে রাখতে চাইছে। কাল রাতের সেই নীরবতার আবেশ এখনও তার ভেতরে লেগে আছে, যেন সেই মুহূর্তগুলো কখনও শেষ হয়নি। রৌনক দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চুপচাপ তাকিয়ে ছিল তনিমার দিকে। কেউ কিছু বলছে না, তবুও যেন অগণিত অপ্রকাশিত শব্দ তাদের চোখের দৃষ্টির ভেতর দিয়ে ভেসে আসছিল। ভোরের এই ঠান্ডা হাওয়ায় তাদের হৃদয়ের স্পন্দন যেন একসাথে বেজে উঠছিল। বিদায়ের বেদনা অদৃশ্য হলেও এতটা গভীর হয়ে ওঠে যে, তনিমা নিজের ভেতরে এক অদ্ভুত ভার অনুভব করল। এক দিনের পরিচয়, এক রাতের সঙ্গ—তবুও কেন এই বিদায় যেন সমস্ত সম্পর্কের চেয়ে বেশি যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠল?

স্টেশন পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া যেন তাদের জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ পথ হয়ে দাঁড়াল। গাড়ির হর্ন, সকালের তাড়াহুড়ো, মানুষের কোলাহল—সবকিছুর মাঝেও তনিমা আর রৌনক নিজেদের চারপাশকে শুনতে পাচ্ছিল না। তারা কেবল নিজেদের ভেতরের নীরবতাকে শুনছিল। ট্রেন ধরার আগে অপেক্ষা করার জন্য তারা একটি বেঞ্চে পাশাপাশি বসে রইল। তনিমা চুপচাপ হাতের মুঠোয় তার টিকিট শক্ত করে ধরে রেখেছিল, যেন এ কাগজটিই তার সমস্ত ভাগ্যের প্রতীক। রৌনকের হাত সামান্য নড়ল, কিন্তু সে জানত এই মুহূর্তে হাত বাড়িয়ে দেওয়া মানে এমন একটি প্রতিশ্রুতি দেওয়া, যা হয়তো তাদের কেউ রাখতে পারবে না। তাই সে কেবল দূরে তাকাল, তবুও তার চোখের দৃষ্টিতে যে অদ্ভুত কোমলতা ভাসছিল, তা তনিমা অনুভব করল। তারা দুজনেই বুঝল, এ বিদায় চিরদিনের জন্য নয়, আবার এ বিদায়ের পর দেখা হবে কিনা, তাও নিশ্চিত নয়। তবুও তারা কোনো কথা বলেনি, কারণ কখনও কখনও কথার প্রয়োজন হয় না। চোখের ভাষাই হয়ে ওঠে সবচেয়ে স্পষ্ট, সবচেয়ে সত্য। সেই চোখের দৃষ্টি বলছিল—“তুমি থেকে যেও, কিন্তু আমার ভেতরে রয়ে যাবে।”

ট্রেন যখন ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্মে ঢুকল, তখন সময় যেন থেমে গেল। তনিমা উঠে দাঁড়াল, ব্যাগ হাতে নিল, আর একবার রৌনকের দিকে তাকাল। তার চোখে কোনো জল ছিল না, তবুও বিদায়ের ভার যেন চোখের গভীরে জমে ছিল। রৌনকও তাকাল, তার ঠোঁটে কোনো হাসি ছিল না, তবুও চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি। তারা জানত না, এ বিদায়ের পর আবার তাদের দেখা হবে কিনা। হয়তো জীবন আবার তাদের ব্যস্ততার ঘূর্ণিতে ছুঁড়ে দেবে, হয়তো কোনোদিন তারা একে অপরের নামও ভুলে যাবে। তবুও এই এক দিনের সম্পর্ক, এই কয়েক ঘণ্টার আলাপ, হাঁটা, নীরবতা আর চাঁদের আলোয় ভাগাভাগি করা মুহূর্ত তাদের ভেতরে চিরকালের মতো থেকে যাবে। ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠল, তনিমা ধীরে ধীরে ডিব্বার ভেতরে উঠে গেল। রৌনক প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে রইল, যতক্ষণ না ট্রেন দূরে অদৃশ্য হয়ে গেল। বিদায়টি ছিল নিঃশব্দ, কিন্তু সেই নিঃশব্দ বিদায়ই হয়ে উঠল হাজারো শব্দের চেয়েও গভীর, হাজারো প্রতিশ্রুতির চেয়েও স্থায়ী। ভোরের আলো পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েছিল তখন, আর সমুদ্রতটের মতোই তাদের হৃদয়ের ভেতরও নতুন দিনের সূচনা হয়েছিল—যেখানে বিদায় মানেই শেষ নয়, বরং হয়তো এক অদৃশ্য শুরুর সম্ভাবনা।

১০

কলকাতায় ফিরে আসার পর তনিমা যেন একেবারেই নতুন মানুষ হয়ে উঠল। স্কুলের কাজ, ব্যস্ততা, দৈনন্দিন দায়িত্ব—সবকিছু আগের মতোই ছিল, তবুও তার চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি ফুটে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল, দিঘার সেই একদিনের অভিজ্ঞতা তার ভেতরের দীর্ঘদিনের ক্লান্তি আর শূন্যতাকে মুছে দিয়েছে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে নতুন করে বাঁচার শক্তি এনে দিয়েছে। সে বুঝতে পারল, এতদিন ধরে সে শুধু দায়িত্বের চাপে নিজের স্বপ্নকে মেরে ফেলেছিল, অথচ নিজের ভেতরের ইচ্ছেগুলোই তাকে সত্যি করে জীবিত রাখার শক্তি দিতে পারে। সেই একদিন তাকে শিখিয়েছে—জীবনকে শুধু টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য নয়, বরং তার প্রতিটি ক্ষণকে অর্থপূর্ণ করে তোলার জন্যই বাঁচতে হয়। তাই তনিমা আবার লিখতে শুরু করল, যেটা সে বহু বছর আগে ছেড়ে দিয়েছিল। খাতার পাতা ভরে উঠতে লাগল তার ভেতরের অভিজ্ঞতা, ব্যথা, আনন্দ আর নতুন স্বপ্নের কাহিনিতে। ক্লাস নেওয়ার সময়েও সে এখন ছাত্রছাত্রীদের শুধু পড়ায় না, বরং তাদের শেখায় কীভাবে নিজের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। তার জীবন আগের মতোই কঠিন, তবুও সেই একদিনের আলো তাকে ভেতরে ভেতরে শক্ত করে তুলেছে।

রৌনকের জীবনেও একইরকম এক অদ্ভুত পরিবর্তন এলো। অফিসের ক্লান্তিকর চাপ, টার্গেট, মিটিং—সবকিছুই আগের মতো চলছিল, কিন্তু সে আর আগের মতো নিস্তেজ হয়ে থাকত না। দিঘার সেই এক রাত, সেই চাঁদের আলোয় বসে থাকা, আর এক অচেনা মেয়ের নিঃশব্দ সঙ্গ তাকে শিখিয়ে দিয়েছিল—জীবন সবসময় শুধু হারানোর নয়, জীবনের ভেতরে নতুন পাওয়া লুকিয়ে থাকে। সে বুঝল, একাকীত্বও কখনো কখনো সুন্দর হতে পারে, যদি কেউ তাকে নতুনভাবে দেখতে শেখায়। সেই একদিনের পরিচয় তাকে শেখাল—মানুষের ভেতরে আসলে কতটুকু শক্তি লুকিয়ে থাকে, আর কীভাবে এক মুহূর্তই জীবনের দিশা বদলে দিতে পারে। রৌনক এখন প্রতিদিন সকালের সূর্যোদয় দেখার অভ্যাস করেছে, যেন প্রতিটি ভোর তাকে নতুন করে মনে করিয়ে দেয় যে জীবনের মানে কেবল কষ্ট নয়, আশা-আনন্দও আছে। সে আবার পুরোনো গিটারটা তুলে নিল, বহুদিন ধরে ধুলো জমে থাকা তারে নতুন সুর তুলল। সুরের ভেতরে সে খুঁজে পেল সেই সমুদ্রতটের বাতাস, সেই ঢেউয়ের শব্দ, আর সেই চোখের দৃষ্টি, যা কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি, তবুও তাকে প্রতিদিন বাঁচার শক্তি দিয়ে গেছে।

তাদের দুজনের জীবনে পথ আলাদা হয়ে গেলেও সেই একদিনের সম্পর্ক যেন চিরস্থায়ী হয়ে রইল। তারা জানত না আর কখনো দেখা হবে কি না, তবুও মনে হচ্ছিল, সেই সমুদ্রতটের একদিন যেন তাদের ভেতরে অমর হয়ে আছে। হয়তো তনিমা যখন খাতায় নতুন গল্প লিখছে, তখন তার কলমের অক্ষরের ভেতরে রৌনকের চোখের দীপ্তি মিশে যাচ্ছে। হয়তো রৌনক যখন গিটার বাজাচ্ছে, তখন তার সুরের ভেতরে তনিমার নিঃশব্দ হাসি ভেসে উঠছে। তাদের জীবন নতুন অর্থে ভরে উঠল—তারা শিখল, সব সম্পর্ক প্রতিশ্রুতির বাঁধনে বাঁধা পড়ে না, কিছু সম্পর্ক কেবল স্মৃতির ভেতর থেকেই শক্তি দেয়। দিঘার সেই একদিন তাদের দুজনের ভেতরে এমন এক অমূল্য অভিজ্ঞতা দিয়ে গেল, যা কোনো বই, কোনো মানুষ, কোনো শিক্ষা দিয়ে দিতে পারত না। তারা বুঝল, জীবনের অর্থ সবসময় বড় কোনো পরিকল্পনায় লুকিয়ে নেই, বরং ছোট ছোট মুহূর্তের ভেতরেই সবচেয়ে গভীর সত্য লুকিয়ে থাকে। হয়তো ভবিষ্যতে তারা আবার একদিন কোথাও হঠাৎ দেখা করবে, হয়তো কোনোদিনই করবে না। কিন্তু সমুদ্রতটে কাটানো সেই একদিন তাদের জীবনের ক্যালেন্ডারে চিরকালীন হয়ে থাকবে—একদিন, যা শুধু সময় নয়, বরং তাদের অস্তিত্বের অংশ হয়ে গেছে।

-শেষ-

1000056126.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *