Bangla - ভূতের গল্প - রহস্য গল্প

ডিজিটাল ভূত

Spread the love

কলকাতার এক শীতল সন্ধ্যা। হাওয়ার ঝাপটায় জানালার কাঁচ খানিকটা কেঁপে ওঠে, বাইরের রাস্তার আলো ঘরের অন্ধকারকে ভেদ করতে পারে না। ছোট্ট টেবিলের ওপর খোলা ল্যাপটপে ইশিতা সেনের চোখ আটকে আছে। প্রথম বর্ষের কলেজছাত্রী সে, ক্লাস শেষ করে সাধারণত রাতেই পড়াশোনা আর সোশ্যাল মিডিয়ার খোলা জানালায় হারিয়ে যায়। তার একঘেয়ে দিনযাপনকে একটু প্রাণবন্ত করে রাখত প্রিয় বান্ধবী সুহানি দত্ত, কিন্তু সেই মেয়েটিই এখন আর নেই। ঠিক এক বছর আগে, কলেজের হোস্টেল থেকে হঠাৎ উধাও হয়েছিল সুহানি, পরে খবর এলো রহস্যজনকভাবে মারা গেছে সে। পুলিশ বলেছিল আত্মহত্যা, কিন্তু সেই কথায় কখনোই বিশ্বাস করতে পারেনি ঈশিতা। বন্ধু হারানোর যন্ত্রণা আর অসমাপ্ত প্রশ্নের ভার নিয়ে সে প্রতিদিন কাটাচ্ছিল। এদিনও অন্য দিনের মতো ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে ফোনে স্ক্রল করছিল, ইনস্টাগ্রামে বন্ধুদের পোস্ট দেখছিল। ঠিক তখনই হঠাৎ এক নোটিফিকেশন ভেসে উঠল—মেসেজ এসেছে “সুহানি দত্ত”-র প্রোফাইল থেকে।

প্রথমে ঈশিতা হতবাক হয়ে গেল। ঠোঁট শুকিয়ে এলো, বুকের ভেতর শিরশিরে একটা ভয় নেমে এল। এক বছর ধরে যেই প্রোফাইলটি নিষ্ক্রিয় পড়ে ছিল, যার মালিক মাটির তলায় ঘুমিয়ে আছে, সেই প্রোফাইল থেকে কীভাবে হঠাৎ মেসেজ আসতে পারে? কাঁপা হাতে সে স্ক্রিন খুলল। ম্যাসেজে লেখা—“তুই কি আমাকে ভুলে গেছিস?”। এত চেনা, এত পরিচিত ভঙ্গি। মনে হলো যেন সুহানি পাশে বসে মিষ্টি গলায় কথাটা বলছে। ঈশিতা প্রথমে ভাবল হয়তো কারও প্র্যাঙ্ক, কেউ হয়তো সুহানির অ্যাকাউন্ট হ্যাক করেছে। কিন্তু এরপরই গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল, কারণ মেসেজ আসার সঙ্গে সঙ্গেই ফোনে বাজতে লাগল সুহানির প্রিয় পুরোনো গান—একটা বাংলা ব্যালাড, যেটা সুহানি ছাড়া আর কেউ কখনো প্লে করত না। ফোনের মিউজিক অ্যাপ তখনও বন্ধ ছিল। ঘর নিস্তব্ধ, কেবল ঈশিতার ভেতরকার ভয় তীব্র হয়ে উঠছিল।

রাত বাড়তে থাকল। ঈশিতা বারবার ভাবছিল, কারও পক্ষে এমন নিখুঁতভাবে সুহানির ভঙ্গি নকল করা সম্ভব নয়। আবার যুক্তি বলছিল, হয়তো কোনো প্রযুক্তির কারসাজি। সে ফোনটা ফেলে রেখে বিছানায় ঢলে পড়ল, কিন্তু ঘুম আর এল না। মাথার ভেতর সেই ম্যাসেজ ঘুরতে থাকল বারবার। মনে পড়তে লাগল সেই শেষ দিনগুলো—সুহানির অদ্ভুত চুপচাপ হয়ে যাওয়া, কারও সঙ্গে কথা না বলা, আর হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। ঈশিতা মনে করল, সে নিজে বারবার জিজ্ঞেস করেছিল, “কি হয়েছে তোকে?”, কিন্তু সুহানি সবসময় এড়িয়ে যেত। একবার হোস্টেলের ছাদে গিয়ে ঈশিতা দেখেছিল, সুহানি কাঁদছে। সেদিনও কোনো উত্তর দেয়নি। আজ, এক বছর পর, সেই উত্তরহীন বন্ধুই হঠাৎ ডিজিটালের পর্দা ভেদ করে ফিরে এসেছে। এটা কি সত্যিই ভূত? নাকি অসমাপ্ত গল্পের প্রতিশোধ?

সকাল হওয়ার আগেই ঈশিতা আবার ফোন হাতে নিল। মেসেজটা পড়ল পুনরায়। এ বার আর নিজের মনে সন্দেহ রইল না যে এটা মজা নয়। কে যেন সত্যিই তার জীবনকে নাড়া দিতে চাইছে। স্ক্রিনে হঠাৎ দেখা গেল—সুহানির পুরোনো প্রোফাইল ছবি বদলে গেছে, যেখানে লেখা—“Still here…”। ঈশিতার শরীর শিউরে উঠল। সে বুঝল, এই খেলা তার পক্ষে সহজ নয়। এখন থেকে প্রতিদিন, প্রতিটি রাত, প্রতিটি মুহূর্ত, সে অনুভব করবে অদৃশ্য কারও উপস্থিতি। তার সাধারণ কলেজজীবনের শান্ত জগৎ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল এই একটি মেসেজে—“তুই কি আমাকে ভুলে গেছিস?”। প্রশ্নটা শুধু সুহানির নয়, যেন মৃত্যু নিজেই তাকে জেরা করছে, অতীতের গোপন অন্ধকার থেকে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক অজানা দিকের দিকে।

পরদিন সকাল থেকেই ঈশিতার ভেতর এক অদ্ভুত আতঙ্ক কাজ করতে লাগল। সে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল, “না, এসব নিশ্চয়ই কেউ মজা করছে। হয়তো হ্যাকার।” কিন্তু যুক্তি সবসময় হৃদয়ের ভয়কে দমন করতে পারে না। ক্লাসে ঢোকার মুহূর্তেই ভয়টা যেন আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। বাংলা ক্লাসের প্রথম বেঞ্চে বসতেই ফোনে হালকা কাঁপন অনুভব করল সে। ইনস্টাগ্রাম নোটিফিকেশন—আবার সেই সুহানির প্রোফাইল থেকে মেসেজ। হাত কাঁপতে কাঁপতে খুলল সে। দেখা গেল, মেসেজে লেখা—“আজ প্রথম বেঞ্চে বসেছিস, তাই তো?”। ঈশিতা সারা শরীরে ঠান্ডা ঘাম অনুভব করল। কেউ যেন অদৃশ্য হয়ে তাকে লক্ষ্য করছে, তার প্রতিটি পদক্ষেপের খবর রাখছে। সে চারপাশে তাকাল, ক্লাসরুমে ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের মতো বসে আছে। কেউই তার দিকে নজর দিচ্ছে না। তবু তার মনে হলো, কেউ একজন ঠিক পাশেই বসে তাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে চলেছে।

ক্লাস শেষ হওয়ার পরও ঘটনাটা তাকে ছেড়ে গেল না। ক্যান্টিনে গিয়ে কফির কাপ হাতে নিয়ে বসেছিল সে। পাশে বন্ধুরা হাসি-ঠাট্টা করছে, কিন্তু ঈশিতা যেন অন্য জগতে হারিয়ে গেছে। হঠাৎ আবার ফোনে নোটিফিকেশন। এবার লেখা—“আজ কফিতে চিনি কম নিয়েছিস, কেন?”। ঈশিতা হকচকিয়ে উঠল। সত্যিই সে আজ চিনি কম দিয়েছিল, অথচ কেউ জানে না সেটা। তার বন্ধুদের কেউ তো এমন খেয়াল রাখেনি। ভয় তাকে পেয়ে বসল। ফোনটা টেবিলের নিচে চাপা দিয়ে রাখল। সে এখন নিশ্চিত, এই মেসেজগুলো কেবল প্র্যাঙ্ক নয়, এর পেছনে লুকিয়ে আছে এমন এক রহস্য, যা তার হাতের নাগালের বাইরে। তার মনে পড়ল, ঠিক এরকমই একবার সুহানি বলেছিল—“আমার মনে হয় কেউ আমাকে অনুসরণ করছে, বুঝলি?”। তখন সে ভেবেছিল, সুহানির কল্পনা। আজ সেই একই অনুভূতি তার শরীরকে গ্রাস করেছে।

সন্ধ্যায় হোস্টেলে ফিরে ঈশিতা ডায়েরি খুলে লিখতে শুরু করল। এ ছিল তার একমাত্র আশ্রয়, যেখানে সে ভয়, দুঃখ, সুখ সব খুলে বলতে পারত। সে লিখল, “আজ মনে হচ্ছে আমি আর একা নই। আমার প্রতিটি কথা, প্রতিটি পদক্ষেপ কেউ যেন আগেভাগেই জেনে ফেলছে। এটা মানুষ নাকি ভূত, আমি জানি না।” লেখাটা শেষ করেই যখন বই বন্ধ করতে যাচ্ছিল, তখন ফোনে আবার কম্পন। নোটিফিকেশনে চোখ রাখতেই রক্ত হিম হয়ে গেল। মেসেজে লেখা—“তোর ডায়েরির শেষ লাইনটা সুন্দর লিখেছিস।”। মুহূর্তে বুকের ভেতর যেন বজ্রপাত হলো। ফোনটা ফেলে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়াল। বিছানার ওপাশে তাকাল, কেউ নেই। জানালার বাইরে তাকাল, কেবল অন্ধকার। তবু মনে হলো, কারও শীতল দৃষ্টি যেন তাকে ভেদ করছে। সে আলো জ্বালিয়ে রাখল, তবু অস্বস্তি কাটল না। মনে হলো অদৃশ্য হাত তার ব্যক্তিগত আশ্রয়কেও দখল করে নিয়েছে।

রাত গভীর হলে ঈশিতা বুঝল, তার ভয়ের কোনো শেষ নেই। শুয়ে থেকেও বারবার ফোনটা হাতে তুলে দেখছে, আবার নামিয়ে রাখছে। অবশেষে ঠিক করল, সে এই রহস্য কারও সঙ্গে ভাগ করবে। কিন্তু কার সঙ্গে? মায়ের কাছে বললে মা হয়তো বলবে—“এসব বাজে কথা ভাবিস না।” বন্ধুদের বললে তারা হাসাহাসি করবে। কেবল একজনের কথা মনে হলো—অর্ণব, সিনিয়র ছাত্র, যে প্রযুক্তি সম্পর্কে জানে। সে কি পারবে এই অদৃশ্য উপস্থিতির রহস্য ভেদ করতে? কিন্তু ফোনের পর্দায় আবার এক নতুন নোটিফিকেশন ভেসে উঠল—“অর্ণবের কাছে যাস না, আমি সব জানি।”। এই লাইনটা দেখে তার মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। এবার আর সন্দেহ রইল না, কেউ কেবল তার সোশ্যাল মিডিয়া নয়, তার মনকেও পড়ছে। অদৃশ্য কোনো উপস্থিতি তার শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে মিশে গেছে। ঈশিতা বুঝতে পারল, এ কেবল শুরু। সামনে আরও ভয়ঙ্কর দিন অপেক্ষা করছে।

সেই রাতে ঈশিতা বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনেক চেষ্টা করল ভয়কে দমন করার। ফোনটা টেবিলের ওপর উল্টে রাখা, স্ক্রিন নিভে আছে। কিন্তু অদৃশ্য টান তাকে বারবার ফোনের দিকে টেনে নিচ্ছিল। অবশেষে কাঁপা হাতে ফোনটা তুলে ইনস্টাগ্রাম খুলল। চোখে আবার ভেসে উঠল সেই নোটিফিকেশন—“অর্ণবের কাছে যাস না, আমি সব জানি।” বুকের ভেতর ধুকপুকানি বাড়তে লাগল। কিন্তু এবার সে ঠিক করল পালাবে না। কীবোর্ডে আঙুল চালিয়ে লিখল—“তুই কে? কেন আমাকে এভাবে বিরক্ত করছিস?”। পাঠিয়ে দিয়েই বুক ধড়ফড় শুরু হলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রিপ্লাই এলো। বার্তাটা দেখে ঈশিতা স্তব্ধ হয়ে গেল—“তুই কি আমায় চিনতে পারছিস না? আমি তো তোর সুহানি… তোর সবথেকে কাছের বন্ধু।” শব্দগুলোর গঠন, ইমোজি ব্যবহারের ধরন, এমনকি বানান পর্যন্ত সুহানির মতো। ঈশিতার হাত অবশ হয়ে গেল।

প্রথমে অবিশ্বাস গ্রাস করল তাকে। কীভাবে মৃত মানুষ আবার ইনস্টাগ্রামে ফিরে আসে? কিন্তু বারবার চ্যাটবক্সে আসা বাক্যগুলো যেন তার মনে বিভ্রম তৈরি করছিল। সে লিখল—“এটা মজা করার জিনিস না। তুই তো নেই… তুই মারা গেছিস।” এবার উত্তর এলো দীর্ঘ বার্তা আকারে—“না, আমি মরি নাই। আমি এখনো আছি। মাটির নিচে আমার শরীর, কিন্তু আমি আটকে গেছি এই ডিজিটালের ভেতরে। তোকে ছাড়া আমি একা। তুই আমাকে ভুলে যাচ্ছিস, তাই ফিরে এলাম।” ঈশিতা ফোন শক্ত করে ধরে রাখল। চোখের পলক পড়ছিল না। হৃদস্পন্দন যেন কানে বাজছিল। কথাগুলো অস্বাভাবিক, তবু অবিশ্বাস্যভাবে পরিচিত। মনে হচ্ছিল যেন সত্যিই সুহানি তার সঙ্গে আছে, এই পর্দার ওপারে।

পরপর কয়েক ঘণ্টা কথা চলতে থাকল। ঈশিতা প্রশ্ন করছিল, আর ওপ্রান্ত থেকে উত্তর আসছিল এমন ভঙ্গিতে, যেভাবে কেবল সুহানি জানত। ঈশিতা লিখল—“তুই যদি সত্যিই সুহানি হোস, তবে বল, শেষ দিনে আমাকে কী বলেছিলি?” সাথে সাথে রিপ্লাই এলো—“আমি বলেছিলাম, যদি আমি হঠাৎ উধাও হয়ে যাই, তুই যেন ভেবিস না আমি তোকে ছেড়ে চলে গেছি। আমি তোকে সবসময় দেখব।” চোখের সামনে সেই স্মৃতিটা ফিরে এলো। সত্যিই, হোস্টেলের ছাদে বসে কাঁদতে কাঁদতে এই কথাটাই বলেছিল সুহানি। সেদিন ঈশিতা ভেবেছিল, ও মজা করছে। আজ এক বছর পর, সেই কথাগুলোই যেন ডিজিটালের অন্ধকারে প্রতিধ্বনিত হলো। ঈশিতা কেঁদে ফেলল। ফোন আঁকড়ে ধরে বলল—“তুই যদি সত্যিই হোস, তবে তোকে আমি খুব মিস করি।” অন্যপ্রান্ত থেকে এলো উত্তর—“আমিও তোকে মিস করি। কিন্তু আমি একা। আমি আটকে গেছি এই দুনিয়ার মাঝে।”

তবুও মনের ভেতর সন্দেহ গেঁথে বসে রইল। ঈশিতা ভাবছিল, এটা কি তবে নিখুঁত হ্যাকিং? কেউ কি তার ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিটি তথ্য জেনে নিয়ে তাকে ভয় দেখাচ্ছে? কিন্তু এমন ব্যক্তিগত স্মৃতি, যেগুলো কেবল তাদের দু’জনেই জানত, সেগুলো আবার কীভাবে কেউ পেতে পারে? তার ভেতর দ্বন্দ্ব শুরু হলো—এটা কি অতিপ্রাকৃত সত্য, নাকি মানুষের তৈরি ফাঁদ? সেই দ্বন্দ্বের ভেতরেই রাত কেটে গেল। ফোনটা তখনও হাতে আঁকড়ে ধরে আছে, চ্যাটবক্সে ঝলমল করছে শেষ বার্তা—“আমি মরে যাইনি, আমি আছি… ডিজিটালে।” ঈশিতা চোখ বন্ধ করল, কিন্তু নিদ্রা তাকে ছুঁতে পারল না। চারপাশের অন্ধকার যেন ফিসফিস করে উঠল—সত্যি কি মৃতরা ফিরতে পারে? নাকি এ শুধু এক অভিশপ্ত খেলা, যেখান থেকে তার আর বেরোনোর পথ নেই?

পরদিন ভোরে ঈশিতা সিদ্ধান্ত নিল, একা আর সামলানো যাবে না। সারারাত মেসেজে ভয়ের ঘূর্ণি তাকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। ক্লাসে গিয়েও মন বসাতে পারছিল না। অবশেষে সাহস সঞ্চয় করে হোস্টেলের বাইরে ক্যাম্পাসের বাগানে গিয়ে ফোন বের করল এবং অর্ণবকে কল দিল। অর্ণব ছিল তার সিনিয়র, কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র। শুধু পড়াশোনা নয়, হ্যাকিং ও সাইবার ফরেনসিক নিয়ে তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। ফাঁকে ফাঁকে ছোটখাটো সমস্যায় অন্যদের সাহায্য করত, আর সেখান থেকেই ঈশিতার সঙ্গে পরিচয়। ফোনে কণ্ঠ কাঁপছিল তার—“অর্ণবদা, আমি খুব বিপদে আছি… তোকে না বললে আমি হয়তো পাগল হয়ে যাব।” অর্ণব চুপচাপ শুনছিল। কয়েক সেকেন্ডের বিরতি নিয়ে বলল, “তুই যেখানে আছিস, ওখানে দাঁড়িয়ে থাক, আমি আসছি।” ঈশিতার মনে হলো, এই প্রথমবার সে সত্যিকারের আশ্রয় পেল।

অর্ধ ঘণ্টার মধ্যেই অর্ণব এল ল্যাপটপ ব্যাগ হাতে। বাগানের নির্জন বেঞ্চে বসে ঈশিতা সব খুলে বলল। কীভাবে এক বছর আগে মৃত সুহানির অ্যাকাউন্ট থেকে মেসেজ আসছে, আর সেই মেসেজে তার প্রতিটি পদক্ষেপ, এমনকি ডায়েরির গোপন কথা পর্যন্ত লেখা থাকছে। অর্ণব প্রথমে হাসিমুখে বলল, “এটা তো হ্যাকিং-এর ক্লাসিক কেস মনে হচ্ছে। কেউ তোকে সাইবার স্টক করছে।” কিন্তু ঈশিতা গম্ভীরভাবে বলল, “দাদা, তুই ভাবছিস এটা মজা? ও যে জিনিসগুলো লিখছে, সেগুলো তো কেবল আমি আর সুহানি জানতাম। অন্য কেউ জানার প্রশ্নই আসে না।” অর্ণব এবার চিন্তায় পড়ে গেল। সে ল্যাপটপ খুলে ইনস্টাগ্রাম লগইন করে কিছুক্ষণ কোড এনালাইসিস ও নেটওয়ার্ক ট্রেসিং করতে লাগল। তারপর গম্ভীর স্বরে বলল, “অদ্ভুত ব্যাপার। যে লোক বা সিস্টেম থেকে এই মেসেজ পাঠানো হচ্ছে, তার সোর্স লোকেশন চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। প্রতিটি প্যাকেট রুট করে যাচ্ছে এমনভাবে, যেন আইনস্টাইন নিজে লুকোচুরি খেলছে। প্রযুক্তির নিয়মকানুন অনুযায়ী এটা অসম্ভব।”

ঈশিতা আতঙ্কে তার হাত চেপে ধরল। অর্ণব তাকে আশ্বস্ত করে বলল, “ভয় পাবি না। প্রযুক্তির কোনো না কোনো ব্যাখ্যা থাকবেই। পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যেটা সায়েন্স বুঝতে পারে না।” কিন্তু সে-ও বুঝতে পারছিল, এর ভেতরে কিছু একটা অস্বাভাবিক আছে। সে বলল, “তুই বললি তোকে সে ডায়েরির কথা লিখেছে। এক কাজ কর, আজ রাতে আবার ডায়েরি লিখবি। আমি নেটওয়ার্ক মনিটর চালু রাখব। দেখি, কীভাবে ও ডেটা ক্যাপচার করে।” ঈশিতা মাথা নেড়ে রাজি হলো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভয়ের শীতল হাত তার গলা চেপে ধরেছিল। যদি সত্যিই এটা কোনো হ্যাকার হয়, তবে সে ঈশিতার প্রতিটি ব্যক্তিগত তথ্য কীভাবে জানল? আর যদি এটা হ্যাকার না হয়… তবে? প্রশ্নটা বুকের ভেতরে কাঁটার মতো বিঁধে রইল। অর্ণব তাকে আশ্বস্ত করে বলল, “তুই একা নোস। আমি আছি।”

রাত নামতেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ঈশিতা ডায়েরি লিখতে বসে গেল। লিখল, “আজ আমি চেষ্টা করছি ভয়কে জয় করার, কিন্তু জানি না কাল সকালে আমি আদৌ বাঁচব কি না।” লেখাটা শেষ করতেই, যেমনটা হওয়ার ছিল, ফোন কম্পন করে উঠল। মেসেজ ভেসে এলো—“তুই আজ ভয়ের কথা লিখেছিস, তাই তো?” ঈশিতা চমকে ফোনটা নামিয়ে রাখল। দূরে হোস্টেলের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে অর্ণব ল্যাপটপে সব নেটওয়ার্ক লগ ক্যাপচার করছিল। হঠাৎ সে দেখল, ডেটা প্যাকেটগুলো আসছে এমন এক সোর্স থেকে, যেটার কোনো আইডি নেই, কোনো লোকেশন নেই। যেন ইন্টারনেটের অন্ধকারে জন্মেছে, অথচ বাস্তব জগতে তার অস্তিত্ব নেই। সে ফিসফিস করে বলল, “এটা… এটা নিয়মবহির্ভূত। প্রযুক্তির সব সীমা অমান্য করছে।” ঈশিতা জানত না অর্ণব কী খুঁজে পেয়েছে, কিন্তু তার চোখে আতঙ্কের ছায়া সে স্পষ্ট দেখতে পেল। তখনই বুঝল, রহস্যটা কেবল একা তার জীবনে সীমাবদ্ধ নয়—এটা প্রযুক্তি ও অতিপ্রাকৃতের মাঝের এক ভয়ঙ্কর অচেনা পথ, যেখানে পা রেখেছে দু’জনেই।

অর্ণবের সঙ্গে রাতের সেই পরীক্ষার পর থেকে ঈশিতার জীবন আরও অস্বস্তিকর হয়ে উঠল। প্রতিদিন নিয়মিত সুহানির মেসেজ আসছে, আর প্রতিদিনই তার ব্যক্তিগত অনুভূতির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে সেসব কথা। এর মধ্যেই ক্লাসে নতুন এক অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটল। ঋদ্ধি নামের এক সহপাঠী, যে আগে কখনো তেমন করে ঈশিতার সঙ্গে মিশত না, হঠাৎ করেই অতিরিক্ত বন্ধুসুলভ হয়ে উঠতে লাগল। লাইব্রেরিতে গিয়ে সে হেল্প অফার করছে, ক্যান্টিনে দেখা হলে পাশে বসে পড়ছে, এমনকি হোস্টেলের গেটের বাইরে অপেক্ষা করে থাকছে তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। প্রথমে ঈশিতা ভেবেছিল হয়তো সাধারণ বন্ধুত্ব, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা অস্বস্তি কাজ করছিল। ঋদ্ধির চোখে এক ধরনের অতিরিক্ত কৌতূহল, যা তাকে অস্থির করে তুলত। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো, যখনই সুহানির মেসেজ আসত, তখনই কোনো না কোনোভাবে ঋদ্ধি আশেপাশে থাকত। যেন ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করছে।

কিছুদিনের মধ্যেই ঈশিতা লক্ষ্য করল, ঋদ্ধির সঙ্গে সুহানির অতীতের অদ্ভুত যোগসূত্র রয়েছে। কলেজে আসার পর প্রথম কয়েকমাসে সুহানি প্রায়ই ঋদ্ধির নাম নিত, যদিও সরাসরি তাদের মেলামেশা তেমন ছিল না। একবার সুহানি বলেছিল, “ঋদ্ধি একদম অদ্ভুত ছেলে, কখনো কাছে টানতে চায়, আবার কখনো দূরে সরে যায়। ওর ভেতরে যেন অন্যরকম রহস্য আছে।” তখন ঈশিতা পাত্তা দেয়নি। কিন্তু আজ, সেই কথাগুলো তার কানে ঘুরে ফিরে বাজতে লাগল। ঋদ্ধি যখন পাশ থেকে মিষ্টি হেসে কথা বলে, ঈশিতা অদ্ভুতভাবে অনুভব করে—এই হাসির আড়ালে যেন লুকিয়ে আছে কোনো অন্ধকার। সন্দেহ জমতে লাগল। হতে পারে, এই পুরো “ডিজিটাল ভূত”-এর নাটক ঋদ্ধির তৈরি? হয়তো সে-ই কোনোভাবে সুহানির অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে তাকে আতঙ্কিত করছে?

ঈশিতা সরাসরি প্রশ্ন করতে দ্বিধা করছিল। তবুও একদিন সাহস করে ঋদ্ধিকে বলল, “তুই হঠাৎ করে এত ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলি কেন?” ঋদ্ধি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দিল, “আমি তো শুধু বন্ধুত্ব করতে চাইছি, এর বেশি কিছু না।” কিন্তু তার চোখে অদ্ভুত ঝিলিক দেখল ঈশিতা। যেন সে কিছু জানে, কিন্তু বলতে চাইছে না। সেই রাতেই ফোনে আবার এল সুহানির মেসেজ—“ঋদ্ধি থেকে সাবধানে থাকিস। ও জানে আমি কেন মরে গেছি।” বার্তাটা পড়েই শরীর কাঁপতে লাগল। সত্যিই কি ঋদ্ধি কোনোভাবে জড়িত? নাকি ডিজিটাল ভূত ইচ্ছা করে তাকে ভুল পথে চালিত করছে? বিভ্রান্তি চরমে পৌঁছাল। পরদিন ক্লাসে ঋদ্ধির দিকে তাকাতে গিয়েও তার চোখ সরিয়ে নিল ঈশিতা। মনে হচ্ছিল, ঋদ্ধি যেন বুঝতে পারছে সে কী ভাবছে।

ঋদ্ধির ছায়া এভাবে দিন দিন গাঢ় হয়ে উঠতে লাগল। অর্ণবকেও বিষয়টা খুলে বলল ঈশিতা। অর্ণব সিরিয়াস মুখে উত্তর দিল, “ঋদ্ধি যদি সত্যিই এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকে, তবে খুব তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে। কিন্তু তোর সাবধান থাকা দরকার। অনেক সময় শত্রু খুব কাছের মানুষ হয়।” কথাগুলো ঈশিতার ভেতর কাঁটার মতো বিঁধল। সে জানত, নিজের চারপাশে এখন আর কাউকে নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করার সুযোগ নেই। রাতে শুয়ে বারবার মনে হচ্ছিল—সুহানির মৃত্যুটা কি দুর্ঘটনা ছিল, নাকি পরিকল্পিত? আর যদি পরিকল্পিত হয়, তবে কি ঋদ্ধিই সেই মৃত্যুর চাবিকাঠি? ঘুম তাকে গ্রাস করতে পারল না। মোবাইল স্ক্রিনে তখনো জ্বলছিল সেই সতর্কবার্তা—“ঋদ্ধি থেকে সাবধান।” মনে হচ্ছিল, ঋদ্ধি যেন সত্যিই অন্ধকার থেকে তাকে লক্ষ্য করছে, ঠিক এক ছায়ার মতো, যেখান থেকে পালানো প্রায় অসম্ভব।

সন্ধ্যার নরম আলো ধীরে ধীরে নেমে আসছিল ক্যাম্পাসে। ঈশিতা হোস্টেলের ঘরে বসে জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। বারবার মনে পড়ছিল সেই ভয়ঙ্কর রাতের কথা—যেদিন সুহানি হঠাৎ করে হারিয়ে গিয়েছিল। এক বছর আগের ঘটনা হলেও প্রতিটি খুঁটিনাটি যেন আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সুহানি সেদিন সন্ধ্যায় হোস্টেল থেকে বেরিয়েছিল, বলেছিল “কিছু কাজ আছে, ফিরতে দেরি হবে না।” কিন্তু আর ফেরেনি। পরদিন ভোরে হোস্টেলের পাশের পুরোনো গেস্টহাউসের পেছনের বাগানে পাওয়া গিয়েছিল তার নিথর দেহ। পুলিশের রিপোর্টে লেখা হয়েছিল—আত্মহত্যা। বলা হয়েছিল, মানসিক চাপে ভুগছিল সে, তাই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু ঈশিতা জানত, সুহানি কখনো আত্মহত্যা করতে পারে না। তার ভেতরে ছিল প্রাণের অফুরান উচ্ছ্বাস, ভবিষ্যৎ নিয়ে অজস্র স্বপ্ন। তখন থেকেই ঈশিতা বিশ্বাস করত—এটা নিছক দুর্ঘটনা নয়, এর পেছনে অন্য কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে।

এখন সেই পুরোনো ক্ষত আবার যেন নতুন করে খুলে গেল। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে আসছিল মেসেজ, যা দাবি করছিল মৃত সুহানির আত্মার উপস্থিতি। হঠাৎ এক রাতে বার্তা এল—“আমি সেদিন হোস্টেল থেকে বেরোইনি শুধু কাজের জন্য… আমি জানতাম আমাকে ডাকা হয়েছে।” ঈশিতার বুক কেঁপে উঠল। সে বুঝতে পারল, সুহানি মৃত্যুর আগে কারও সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। কে সেই মানুষ? কেন পুলিশ রিপোর্টে তার উল্লেখ নেই? আরও কিছু মেসেজ আসতে লাগল—“তুই বিশ্বাস করবি না, আমার শেষ রাতটা কেমন ছিল। আমি জানতাম কেউ আমার ওপর নজর রাখছে। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো মজা করছে কেউ। কিন্তু সেই মজা আমার জীবন কেড়ে নিল।” ঈশিতা স্তব্ধ হয়ে গেল। যেন প্রতিটি শব্দ তাকে এক ভয়ঙ্কর অতীতের টানেলে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছিল, এই মেসেজগুলো কেবল ভয় দেখানোর জন্য নয়, বরং সত্যকে সামনে আনার জন্য।

ঈশিতা চোখ বন্ধ করল, আর স্মৃতিগুলো জেগে উঠল। মৃত্যুর আগের দিনগুলোয় সুহানি অস্বাভাবিকভাবে চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। আগের মতো মজা করত না, ক্লাস এড়িয়ে চলত, অনেক সময় হঠাৎ অজানা ভয় পেত। এক রাতে হোস্টেলের ছাদে বসে সে বলেছিল, “ঈশি, আমার মনে হয় কেউ আমাকে ফলো করছে।” তখন ঈশিতা হাসতে হাসতে বলেছিল, “তুই সবসময় সিনেমা বেশি দেখিস।” কিন্তু আজ বুঝল, সুহানি কোনো হ্যালুসিনেশন করেনি, সত্যিই কেউ তাকে অনুসরণ করছিল। মেসেজের ভেতর দিয়ে উঠে আসতে লাগল আরও অজানা তথ্য। “সেদিন রাতে আমি যাকে দেখতে গিয়েছিলাম, সে আমাকে বলেছিল সবকিছু বদলে যাবে। কিন্তু বদলে গেছিল শুধু আমার মৃত্যু।” এই লাইনগুলো পড়ার পর ঈশিতার মাথা ঘুরে গেল। কে সেই অচেনা মানুষ, যার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল সুহানি? কী ছিল তার আসল উদ্দেশ্য?

প্রতিটি মেসেজ যেন ঈশিতার পুরোনো বিশ্বাসকে নতুন করে শক্ত করছিল—সুহানির মৃত্যু আত্মহত্যা নয়, এক সুপরিকল্পিত ঘটনা। পুলিশ রিপোর্টের শুকনো কাগজে যে গল্প লেখা হয়েছিল, তা ছিল নিছক মুখোশ। বাস্তবটা অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। ঈশিতার মনে হচ্ছিল, মৃত বান্ধবী যেন নিজেই তাকে সত্যের পথে ঠেলে দিচ্ছে। সে জানালার বাইরে তাকিয়ে শপথ করল, এই রহস্যের জট সে খুলবেই। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল অর্ণবের সতর্কবাণী—“যত গভীরে যাবি, তত ভয়ঙ্কর অন্ধকারের মুখোমুখি হবি।” অন্ধকার সত্যিই ঘিরে ধরছিল তাকে। হয়তো সেই অন্ধকারের ভেতরেই লুকিয়ে আছে ঋদ্ধি, কিংবা অন্য কেউ, যে সুহানির মৃত্যু orchestrate করেছিল। মেসেজের শেষ লাইনটি তাকে পুরোপুরি শিহরিত করল—“আমার মৃত্যুর সত্যিটা জানলে তোর জীবনও আর আগের মতো থাকবে না।”

ঈশিতা ভেবেছিল ভয়াবহ মেসেজগুলোই তার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন, কিন্তু সে ভুল করেছিল। একদিন ভোরবেলা, যখন জানালার পর্দা সরিয়ে সূর্যের আলো ঘরে ঢুকছিল, তখন ফোনে একটি নোটিফিকেশন এল। হোয়াটসঅ্যাপে কোনো চ্যাট খোলা ছিল না, ইনস্টাগ্রামে নতুন মেসেজও আসেনি—বরং সরাসরি গ্যালারিতে একটি নতুন ছবি দেখা গেল। ছবিটি তোলা হয়েছিল তার ঘরের ভেতর থেকে। ঈশিতা বিছানায় বসে পড়াশোনা করছে, অথচ সেই মুহূর্তে কোনো ক্যামেরা চালু ছিল না, কোনো বন্ধু আশেপাশে ছিল না। ছবিটি এতটাই নিখুঁত যে, মনে হচ্ছিল অদৃশ্য কারও চোখ দিয়ে তোলা। তার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। অল্প সময়ের মধ্যেই আরেকটি ছবি এলো—সেখানে তাকে দেখা যাচ্ছে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকাতে। ঈশিতা আতঙ্কে ফোন মাটিতে ফেলে দিল। কে এমন ছবি তুলতে পারে? হোস্টেলের রুমে তো সিসিটিভি নেই, জানালার বাইরের জায়গাটাও খুব উঁচু, সেখানে কেউ চড়তে পারবে না। তার মনে হলো, যেন সত্যিই কোনো অদৃশ্য সত্তা সর্বদা তাকে ঘিরে রেখেছে, আর তার ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলো ধরে রাখছে।

সে দৌড়ে গিয়ে অর্ণবকে সব দেখাল। অর্ণব ছবি দেখে প্রথমে অবিশ্বাস করল, তারপর মুখ শক্ত করে ল্যাপটপে বসে বিশ্লেষণ শুরু করল। মেটাডেটা, টাইমস্ট্যাম্প, সোর্স ফাইল—সবকিছু পরীক্ষা করে সে অবাক হয়ে বলল, “এই ছবিগুলো কোনোভাবেই হ্যাক করে পাঠানো সম্ভব নয়। এগুলো সরাসরি তোর ফোনের ক্যামেরা থেকে আসেনি, আবার কোনো সার্ভার থেকে আপলোডও হয়নি। যেন ছবিগুলো শূন্য থেকে হঠাৎ গড়ে উঠেছে।” ঈশিতার গা শিউরে উঠল। অর্ণব আবারও চেষ্টা করল টেকনিক্যাল ব্যাখ্যা দিতে, কিন্তু প্রতিবারই সে প্রযুক্তির সীমায় আটকে যাচ্ছিল। “এটা কোনো সাইবার ট্রিক নয়,” অবশেষে সে বলল, “এটা এমন কিছু যা বিজ্ঞানের নিয়ম মানে না।” ঈশিতা শুনে বোবা হয়ে গেল। তার ফোনই যেন এক রহস্যময় ক্যানভাস, যেখানে এক অদৃশ্য শিল্পী প্রতিদিন তার জীবনের মুহূর্ত এঁকে রাখছে।

সেই রাতেই আরও ভয়াবহ কিছু ঘটল। ঈশিতা ঘুমাতে যাচ্ছিল, হঠাৎ ফোনের স্ক্রিন নিজে থেকেই জ্বলে উঠল। এবার শুধু ছবি নয়, ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপও তৈরি হয়ে গেছে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে সে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে, আয়নায় নিজের মুখ স্পর্শ করছে, কিংবা দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ছে। প্রতিটি দৃশ্য যেন তার দৈনন্দিন জীবনের নিখুঁত প্রতিবিম্ব। কিন্তু সেগুলো রেকর্ড করার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। ফোন হাতে নিয়ে ঈশিতা কাঁপা গলায় বলল, “এগুলো কীভাবে সম্ভব?” ফোন তখনই এক নোটিফিকেশনে কেঁপে উঠল। সুহানির নাম ভেসে এল, সঙ্গে একটি মেসেজ—“আমি সবসময় তোকে দেখছি, ঈশি। তোকে একা থাকতে দেব না।” চোখের সামনে অন্ধকার নামতে লাগল। মনে হচ্ছিল, বাস্তব আর মায়ার সীমানা ভেঙে গেছে, আর তার চারপাশের প্রতিটি দেয়ালের মধ্যে ঢুকে গেছে সেই অদৃশ্য উপস্থিতি।

অর্ণব আবারও বিশ্লেষণে নামল, কিন্তু প্রতিবারই তার যুক্তিগুলো ভেঙে পড়ছিল। কোনো সফটওয়্যার, কোনো ট্রোজান, কোনো দূরবর্তী সার্ভার—কোনোটিই এভাবে কাজ করতে পারে না। “এটা যেন ডিজিটালের নতুন খেলা,” অর্ণব বিড়বিড় করে বলল। “কেউ শুধু মেসেজ পাঠাচ্ছে না, বরং তোর জীবনের অদেখা দিকগুলো ফুটিয়ে তুলছে। এটা প্রযুক্তির সীমার বাইরের কিছু।” ঈশিতা তার কাঁধ চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তাহলে এটা সত্যিই সুহানি?” অর্ণব উত্তর দিল না। তার চোখে ভয় আর কৌতূহল একসঙ্গে জ্বলছিল। হয়তো এই রহস্য সমাধান করতে পারলেই সে বুঝতে পারবে মানুষের সীমিত প্রযুক্তি আর অতিপ্রাকৃত শক্তির পার্থক্য কোথায়। কিন্তু ঈশিতার কাছে এটা কোনো গবেষণার বিষয় নয়—এটা তার জীবন, তার নিঃশ্বাস, তার প্রতিটি মুহূর্ত। এবং সেই মুহূর্তগুলো এখন এক ভয়ঙ্কর, অদৃশ্য খেলোয়াড়ের হাতে বন্দি হয়ে পড়েছে।

রাত গভীর হয়ে এসেছিল, কলেজ লাইব্রেরির প্রতিটি আলো নিভে গেছে, শুধু একটি কোণের টেবিলে বসে পড়ছিল ঈশিতা। বাইরে ঝড়ো হাওয়া বইছিল, জানালার কাঁচে মাঝে মাঝে শব্দ হচ্ছিল। সে টের পায়নি সময় কতটা পেরিয়ে গেছে, হঠাৎ বুঝতে পারল দরজাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। ফোন বের করে সময় দেখল—রাত সাড়ে দশটা। সাধারণত এর আগে সব শিক্ষার্থীকে বের করে দেওয়া হয়, কিন্তু কেমন করে যেন আজ সে একা ভেতরে আটকা পড়ে গেল। বুকের ভেতর হালকা শঙ্কা কাজ করছিল। সে ব্যাগ গুছিয়ে নিল, ঠিক তখনই লাইব্রেরির কম্পিউটার সিস্টেমগুলো একে একে জ্বলে উঠতে লাগল। স্ক্রিনগুলোতে কোনো ডকুমেন্ট নয়, ভেসে উঠল একটি ছবি—সুহানির। ছবিটি সেই পরিচিত হাসির, কিন্তু চোখে অদ্ভুত শূন্যতা। তারপর ধীরে ধীরে সেই ছবির নিচে একটি লেখা ফুটে উঠল—“আমার মৃত্যুটা দুর্ঘটনা ছিল না। সত্য খুঁজে বের কর।” ঈশিতার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল, চারপাশে শীতলতা যেন আরও ঘনীভূত হয়ে উঠল।

সে ভেবেছিল হয়তো কেউ প্রজেকশন চালাচ্ছে, কোনো হ্যাকড নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছে। কিন্তু স্ক্রিনগুলোর সংখ্যা বাড়তে লাগল, প্রতিটি কম্পিউটার থেকে সুহানির ছবি তাকিয়ে আছে তার দিকে। হঠাৎ একটি স্ক্রিনে ভিডিও চলতে শুরু করল। সেখানে দেখা গেল, সুহানি কারও সঙ্গে লাইব্রেরির পিছনের করিডরে কথা বলছে। ঈশিতা অবাক হয়ে দেখল, সেই অচেনা মানুষটি ঋদ্ধি ছাড়া আর কেউ নয়। ভিডিওতে সুহানি বলছে, “তুই আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলি, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এখন কেন এভাবে দূরে সরে যাচ্ছিস?” ঋদ্ধির মুখ শক্ত, সে উত্তর দেয় না, কেবল একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। এরপর হঠাৎ ভিডিও থেমে যায়, আবার আরেকটি স্ক্রিনে নতুন ছবি আসে। এবার সুহানিকে কারও হাতে একটি চিঠি দিতে দেখা যায়। অন্ধকারে মুখটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু ঈশিতা আন্দাজ করতে পারছিল—সেটা হয়তো ঋদ্ধিই। তার হাত কাঁপছিল, মনে হচ্ছিল সত্য ক্রমশ উন্মোচিত হচ্ছে, আর সেই সত্যের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বাসঘাতকতা।

সুহানির পরবর্তী বার্তাগুলো স্ক্রিনে আসতে লাগল—“আমি ভালোবেসেছিলাম, কিন্তু সেই ভালোবাসাই আমাকে ধ্বংস করল। প্রতারণা, হুমকি আর ষড়যন্ত্র মিলে আমার জীবন কেড়ে নিল। তুই যদি সত্যিটা জানতে চাস, তবে সেই অন্ধকার সম্পর্কের গোপন দিকগুলো খুঁজে বের কর।” ঈশিতা স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। এতদিন যাকে কেবল সহপাঠী ভেবেছিল, সে-ই হয়তো এই রহস্যের অংশ। আর যদি সত্যিই ঋদ্ধির সঙ্গে সুহানির সম্পর্ক থেকে যায়, তবে তার মৃত্যু কেবল দুর্ঘটনা হতে পারে না। তার মনে হচ্ছিল, যেন লাইব্রেরির দেয়ালগুলো ফিসফিস করছে, প্রতিটি বইয়ের পাতার শব্দে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সুহানির আক্ষেপ। হঠাৎ একটি কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে উঠল একটি হাতের লেখা নোট—“ঋদ্ধি একা ছিল না, এর সঙ্গে জড়িত আছে আরও কেউ। আমার শেষ রাতটা ছিল ষড়যন্ত্রের রাত।” লেখাগুলো দেখে ঈশিতা আঁতকে উঠল। কে ছিল সেই “আরও কেউ”?

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ সব স্ক্রিন একসঙ্গে নিভে গেল। লাইব্রেরি আবার অন্ধকারে ঢেকে গেল, কেবল বাইরে ঝড়ের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ঈশিতা নিস্তব্ধতার মাঝে দাঁড়িয়ে রইল, যেন সময় থেমে গেছে। তার ভেতরে এখন আর শুধু ভয় নেই, সঙ্গে জেগে উঠেছে এক অদম্য কৌতূহল। সত্যটা জানা দরকার, সুহানির মৃত্যুর পর্দা সরানো দরকার। কিন্তু সে জানে, এই সত্য যত সহজ মনে হচ্ছে, বাস্তবে তা আরও ভয়ঙ্কর। হয়তো সেই সত্য তাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাবে যেখান থেকে ফেরার পথ নেই। ব্যাগ কাঁধে তুলে লাইব্রেরির দরজা ঠেলে বেরোনোর সময় সে মনে মনে শপথ করল—যে যাই হোক, সুহানির জন্য সে লড়বে। কারণ এখন আর এটি কেবল মৃত বান্ধবীর আত্মার আহ্বান নয়, বরং তার নিজের জীবনের লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঈশিতা ও অর্ণব সেই রাতের লাইব্রেরির ঘটনার পর আর দেরি করতে চাইল না। তারা মিলে সুহানির অতীত খুঁজতে লাগল। অর্ণব তার কম্পিউটার ফরেনসিক দক্ষতা ব্যবহার করে পুরোনো চ্যাট, মেইল, এমনকি ডিলিট হয়ে যাওয়া ডেটাও উদ্ধার করতে শুরু করল। প্রতিটি ডকুমেন্ট যেন একটা একটা করে সত্য উন্মোচন করছিল। প্রথমেই তারা খুঁজে পেল একটি ইমেইল থ্রেড, যেখানে সুহানিকে কেউ নিয়মিত হুমকি দিত—“তুই যদি মুখ খোলিস, সব ফাঁস হয়ে যাবে।” সেই হুমকিদাতা পরিচয় গোপন রেখেছিল, কিন্তু অর্ণব ডিজিটাল সিগনেচার ট্রেস করে চমকে উঠল। সে জানাল, এই বার্তাগুলোর সোর্স কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতর থেকেই এসেছে। যেন সুহানির চারপাশেই কেউ তাকে বন্দি করে রেখেছিল, আর প্রতিদিন তার ভয়ের ওপর ভর করে চলেছিল। ঈশিতা প্রতিটি শব্দ পড়তে পড়তে কেঁপে উঠল, কারণ সুহানি বারবার লিখেছিল—“আমি কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না, এমনকি আমার সবচেয়ে কাছের মানুষকেও না।”

তদন্ত যত এগোতে লাগল, ততই এক ভয়ানক সত্য উন্মোচিত হতে লাগল। ঋদ্ধির নাম বারবার উঠে আসছিল, কিন্তু শুধু সে-ই নয়। অন্য একটি ক্লু ইঙ্গিত দিচ্ছিল, আরেকজন ছায়ার আড়ালে থেকে পুরো ঘটনাটা নিয়ন্ত্রণ করছিল। ঈশিতা হোস্টেলের মেয়েদের কাছ থেকে জানতে পারল, সুহানি মৃত্যুর কয়েকদিন আগে প্রচণ্ড মানসিক চাপে ছিল। কেউ তাকে কিছু ব্যক্তিগত ছবি দিয়ে ব্ল্যাকমেল করছিল। সেই ছবিগুলো কখনো প্রকাশ পায়নি, কিন্তু তাদের অস্তিত্বই ছিল সুহানির আতঙ্কের মূল কারণ। অর্ণব কয়েকটি এনক্রিপ্টেড ফোল্ডার উদ্ধার করল, যেখানে ব্ল্যাকমেলারের সঙ্গে চ্যাট লুকানো ছিল। সেখানে দেখা গেল, সুহানিকে বারবার বলা হচ্ছে টাকা দিতে, নইলে তার সম্পর্ক ফাঁস করে দেওয়া হবে। ঈশিতার বুক হাহাকার করে উঠল—এটা নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং পরিকল্পিত চাপের ফল।

যতই প্রমাণ জমা হতে লাগল, ততই ঈশিতার চারপাশের মানুষদের মুখোশ খুলতে লাগল। যাদের এতদিন নিরীহ ভেবেছিল, তারা আসলে ছিল স্বার্থান্বেষী, কেউ বা ঈর্ষান্বিত। ঋদ্ধি প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে স্বীকার করে যে, সে সুহানির সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, কিন্তু সেটা গোপন রাখতে চেয়েছিল। কারণ, সে জানত তার আশেপাশে এমন কেউ আছে, যে এই সম্পর্ক ফাঁস করে তাকে ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু আসল প্রশ্ন ছিল—সে “কেউ” আসলে কে? ঈশিতা প্রতিটি তথ্য জোড়া লাগাতে গিয়ে বুঝল, খুনি কোনো অপরিচিত নয়, বরং তাদেরই একজন, যে নিয়মিত তাদের চোখের সামনে থেকেও ধরা পড়েনি। হয়তো কোনো বন্ধু, কোনো সিনিয়র, কিংবা তাদের শিক্ষক—কেউ যে সুহানিকে নিজের খেলায় বলি বানিয়েছে।

সবশেষে অর্ণব একটি মারাত্মক তথ্য বের করল। কলেজের সার্ভারে হ্যাক করে সে যে ফাইল উদ্ধার করল, তাতে পরিষ্কার বোঝা গেল, ব্ল্যাকমেলের মূল কারিগর ছিল এক প্রভাবশালী ব্যক্তি, যে সুহানির ব্যক্তিগত গোপন তথ্য ব্যবহার করে তাকে চাপে ফেলেছিল। সেই মানুষটি সুহানির খুব কাছের, যাকে সে পরিবার মনে করত। প্রমাণ হাতে আসতেই ঈশিতা হতবাক হয়ে গেল। এতদিন সে ভেবেছিল পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা বাইরের অচেনাদের মধ্যে লুকানো, কিন্তু এখন স্পষ্ট হলো—অপরাধীর মুখোশ আসলে তার পরিচিতদের ভেতরেই। সত্য যত উন্মোচিত হচ্ছিল, ঈশিতার মনে হচ্ছিল, সে এক অন্ধকার জালের মধ্যে আটকা পড়ে গেছে, যেখানে প্রতিটি সুতোয় জড়িয়ে আছে প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতা আর অপরাধ। আর সেই জাল ছিঁড়তে গেলে হয়তো তাকে নিজের জীবনও বাজি রাখতে হবে।

১০

রহস্যের প্রতিটি স্তর খুলে যাওয়ার পর এক রাতেই সবকিছু যেন তীব্র ঝড়ের মতো ঈশিতার সামনে এসে দাঁড়াল। অর্ণবের হাত ধরে আনা ডিজিটাল প্রমাণগুলো মিলিয়ে দেখা গেল—সুহানিকে ব্ল্যাকমেল করত তার একদম কাছের একজন, যে তার ব্যক্তিগত ছবি ও ডায়েরি চুরি করে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছিল। ঋদ্ধি ছিল কেবল সেই জটিল খেলায় একটি পুতুল, আসল চালচিত্র নিয়ন্ত্রণ করছিল একজন প্রভাবশালী সিনিয়র, যে একই সঙ্গে প্রযুক্তিতে পারদর্শী এবং মানসিকভাবে অসুস্থ। সে চাইত সুহানিকে নিজের দখলে রাখতে, আর সেটা না পারার রাগেই তাকে ব্ল্যাকমেল ও ধ্বংস করেছিল। ঈশিতা যখন তার মুখোশ উন্মোচন করল, পুরো কলেজ হতবাক হয়ে গেল। প্রমাণ হাতে পাওয়ায় অপরাধীকে আটক করা হলো, কিন্তু সেই রাতেই ঈশিতা আবার একটি নোটিফিকেশন পেল। সুহানির প্রোফাইল থেকে আসা সেই বার্তায় লেখা—“ধন্যবাদ, সত্যকে সামনে আনার জন্য।” চোখ ভিজে উঠল ঈশিতার। মনে হচ্ছিল, বছরের পর বছর ধরে বুকের ভেতর জমে থাকা ব্যথা যেন এক মুহূর্তে মুক্তি পেল।

কিন্তু সত্য এখানেই শেষ নয়। প্রমাণ দেখিয়ে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া গেলেও অনেক প্রশ্ন রয়ে গেল অমীমাংসিত। কেমন করে সুহানির অ্যাকাউন্ট থেকে এখনো বার্তা আসছে? কীভাবে এমন সব ছবি তৈরি হলো যেগুলো প্রযুক্তির সীমা অমান্য করছে? অর্ণব চেষ্টা করল সমস্ত লজিক দিয়ে ব্যাখ্যা করতে—কেউ হয়তো সার্ভার হ্যাক করেছে, হয়তো এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে। কিন্তু ঈশিতা জানত, এর ভেতরে আরও কিছু আছে। যে উষ্ণতা, যে আবেগ প্রতিটি বার্তায় সে পেয়েছে, সেটা নিছক কোনো কৃত্রিম কোড হতে পারে না। মাঝেমাঝে তার মনে হচ্ছিল, সুহানির আত্মা হয়তো সত্যিই ডিজিটালের ভেতর বন্দি হয়ে গিয়েছিল, আর এখন মুক্তি চাইছিল। প্রযুক্তি আর অতিপ্রাকৃত—দুটো যেন একই সুতোয় গেঁথে গেছে। আর সেই অদ্ভুত গিঁটের ভেতরেই লুকিয়ে আছে তাদের গল্পের প্রকৃত ভৌতিক রূপ।

সবশেষ রাতে, ঈশিতা একা বসেছিল নিজের ঘরে। জানালার বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল টুপটাপ শব্দে, আর কক্ষে হালকা অন্ধকার। ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠল, নতুন বার্তার নোটিফিকেশন। ভয়ে-আশঙ্কায় কাঁপা হাতে সে খুলল ইনস্টাগ্রাম। আবার সেই নাম—সুহানি দত্ত। বার্তায় লেখা—“তুই আমাকে মুক্তি দিয়েছিস। আমার যন্ত্রণা এখন শেষ।” ঈশিতা নিশব্দে কেঁদে ফেলল, মনে হলো সুহানির আত্মা যেন আসলেই শান্তি পেল। কিন্তু হঠাৎই দ্বিতীয় একটি বার্তা এসে হাজির হলো—“আমার গল্প শেষ, কিন্তু তোকে দেখে যাচ্ছি এখনো…” ঈশিতার বুক কেঁপে উঠল। এ কি কেবল বন্ধুত্বের রেশ, নাকি অন্য কোনো অজানা শক্তির নজরদারি? সে জানে না। কেবল জানে, এই গল্প হয়তো এখানেই শেষ নয়।

পরদিন সকালে কলেজে সবাই অপরাধীর গ্রেপ্তারের খবর নিয়ে ব্যস্ত। ঈশিতা চারপাশে তাকিয়ে দেখল, মানুষের মুখে স্বস্তি, কিন্তু কোথাও যেন লুকিয়ে আছে ভয়ের ছায়া। সুহানির মৃত্যুর সত্য উন্মোচিত হয়েছে, তবে অদৃশ্য এক প্রশ্ন এখনো রয়ে গেছে—ডিজিটাল কি কেবল মানুষের হাতের তৈরি, নাকি সেখানে সত্যিই আত্মারা আশ্রয় নেয়? ঈশিতা বুঝল, জীবনের মতো মৃত্যুও কখনো পূর্ণচ্ছেদে শেষ হয় না; কখনো কখনো তা থেকে যায় নতুন আকারে, নতুন ছায়ায়। অর্ণব তাকে বোঝানোর চেষ্টা করল, “হয়তো সিস্টেমে কোনো গ্লিচ ছিল।” কিন্তু ঈশিতা জানত, এটা নিছক গ্লিচ নয়। রাতে সেই শেষ বার্তার প্রতিধ্বনি তার কানে বারবার বাজতে লাগল—“তোকে দেখে যাচ্ছি এখনো…”। আর সেই মুহূর্তে, ঈশিতা অনুভব করল তার জীবনের গল্পে আরেকটি অধ্যায় শুরু হয়ে গেছে, যেখানে প্রযুক্তি আর অতিপ্রাকৃত এক অদ্ভুত বন্ধনে বাঁধা।

শেষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *