দেবদীপ মুখার্জী
পুরনো ভাড়াবাড়ি
শহরের প্রান্তে, যেখানে নতুন উঁচু ফ্ল্যাটের দালান এখনও পুরোপুরি গজিয়ে ওঠেনি, সেখানেই একপাশে দাঁড়িয়ে আছে ভাঙাচোরা, শ্যাওলা-ঢাকা একটি ভাড়াবাড়ি। বাইরে থেকে দেখলেই মনে হয় বহুদিন কেউ থাকেনি। কিন্তু আসলে সেটা ভাড়ার জন্যই রাখা হয়েছে—সস্তা ভাড়া, সামান্য মেরামতির খরচে কেউ যদি সাহস করে থাকতে রাজি হয়।
রুদ্র, সদ্য কলেজ শেষ করে সাংবাদিকতার চাকরিতে ঢোকা এক তরুণ, তার অফিসের কাছে একটা থাকার জায়গা চাইছিল। শহরের ভেতরে ভাড়া সামলানো সম্ভব হচ্ছিল না। ঠিক তখনই এক প্রপার্টি ডিলারের মাধ্যমে এই বাড়ির খোঁজ পায়। বাড়িটা দেখতে এসে প্রথমেই বুক কেঁপে উঠেছিল—কালচে দেওয়াল, কাঠের জানালায় ফাটল, ছাদের কোণে বাদুড় ঝুলে আছে। কিন্তু ভাড়া এত কম যে উপায় ছিল না।
“সাহেব, বাড়িটা পুরনো বটে, কিন্তু ভেতরে একবার ঢুকলে দেখবেন টিকেই থাকবে। এই এলাকায় এত কম ভাড়া পাবেন না।” প্রপার্টি ডিলার একরকম জোর করেই তাকে বোঝায়।
রুদ্র ভেতরে ঢুকে দেখে, ঘরগুলো বড় বড়, একেবারে প্রাচীন আমলের গড়ন। কাঠের মেঝে, মোটা কড়ি-বরগা, আর লম্বা করিডর দিয়ে ঘরগুলো যুক্ত। দিনের আলোয় ভয় পাওয়ার কিছু নেই—বরং কেমন যেন এক আকর্ষণ কাজ করছিল। তাই সে ঠিক করে, এক মাসের জন্য ভাড়া নিয়ে থাকবেই।
প্রথম কয়েকদিন সব স্বাভাবিকই ছিল। অফিস থেকে ফেরার পর সে নিজের ল্যাপটপে কাজ করত, নোট লিখত, কিংবা শহরের খবর জোগাড় করত। প্রতিবেশীদের সঙ্গে খুব একটা কথা বলার সুযোগ হয়নি—কারণ পাশের বাড়িগুলো ফাঁকা, আর সামনের দিকটা খোলা মাঠের মতো। রাতের বেলা মাঠের অন্ধকার থেকে ঝিঁঝিঁর ডাক শোনা যেত।
কিন্তু তৃতীয় রাতেই অদ্ভুত কিছু ঘটল।
সেদিন অফিস থেকে একটু দেরি করে ফিরেছিল। রাত তখন সাড়ে দশটা। রান্নাঘরে গিয়ে চা বানানোর সময় হঠাৎ করিডর দিয়ে যেন কারও পায়ের শব্দ ভেসে এল—মসৃণ কিন্তু ভারী পায়ের চাপ। প্রথমে ভেবেছিল প্রতিবেশীর কেউ হয়তো এসেছে। কিন্তু বাড়িটা তো একেবারে একতলা, আর সেদিন দরজা ভিতর থেকে লাগানোই ছিল।
সে আলোটা জ্বেলে করিডরে তাকিয়ে রইল। কেউ নেই। খালি করিডরটা যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে।
রুদ্র তখন নিজেকে বোঝাল—বাড়ি পুরনো, কাঠে-লোহায় খচখচ শব্দ হবেই। কিন্তু ভেতরে কোথাও যেন এক টান লাগল, একটা ঠান্ডা বাতাস গা ছুঁয়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি চা নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল।
পরদিন অফিসে এই ঘটনা সে কাউকে বলেনি। হাসাহাসি করবে। কিন্তু রাতে আবার শব্দ এল। এবার শুধু পায়ের চাপ নয়—স্পষ্ট দরজা খোলার আওয়াজ। কড়িকাঠে চিড় ধরার মতন খচখচ শব্দ, তারপর যেন একটা ভারী দরজা ধীরে ধীরে খোলা হচ্ছে।
রুদ্রের মনে হল এই বাড়িতে কি লুকোনো কোনো ঘর আছে?
চা কাপ হাতে নিয়ে সে করিডরে বেরিয়ে এল। বাতাস অস্বাভাবিক ঠান্ডা। তার পা কাঁপছে, কিন্তু কৌতূহল টানছিল। করিডরের শেষ মাথায় একটা দরজা আছে, যেটা এতদিন খেয়াল করেনি। দরজাটা যেন দেওয়ালের সঙ্গে মিশে আছে, রঙ চটে গেছে, বোঝাই যায় অনেকদিন কেউ খোলেনি। অথচ শব্দ আসছিল সেখান থেকেই।
সে সাহস করে হাত রাখল দরজার কড়ায়। কড়াটা বরফের মতো ঠান্ডা। চাপ দিতেই দরজা কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে গেল। ভিতরটা ঘন অন্ধকার।
রুদ্র টর্চ বার করে আলো ফেলল। একটা ছোট ঘর—মেঝেতে পুরনো কার্পেট, কোণে ধুলো জমে থাকা টেবিল, আর দেওয়ালে ঝুলছে কালচে হয়ে যাওয়া একটা ফটোফ্রেম। ফ্রেমের ভেতরে কারও প্রতিকৃতি অস্পষ্ট। আলো পড়তেই মনে হল যেন ছবির চোখ দুটো চকচক করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
রুদ্র ঘরে ঢুকতেই হাওয়া যেন জমাট বেঁধে গেল। বুকের ভেতর কেমন চাপা ভয় জমতে শুরু করল। সে তাড়াতাড়ি ফিরে দরজা বন্ধ করে দিল।
রাতে ঘুম এল না। বারবার সেই ছবির চোখ মনে পড়তে লাগল। কে ছিল সে মানুষ? কেন এই ঘরটা এভাবে লুকিয়ে রাখা হয়েছে?
পরদিন সকালে রুদ্র প্রপার্টি ডিলারকে ফোন করল।
—“শুনুন, ওই ঘরটা নিয়ে কিছু জানেন?”
ওপাশ থেকে লোকটা কেমন যেন এড়িয়ে গেল।
—“ঘর? ওটা তো স্টোররুম ছিল। পুরনো মালপত্র রাখা হত। আপনি থাকবেন তো?”
—“থাকব বটে… কিন্তু ছবিটা কার?”
—“ছবি? ওসব নিয়ে মাথা ঘামাবেন না, বাবু। ওই বাড়ি নিয়ে অনেক কথাই আছে। সব গুজব। আপনি কাজ নিয়ে থাকুন।”
এই উত্তর শুনে রুদ্রর সন্দেহ আরও ঘনীভূত হল। গুজব মানে নিশ্চয় কিছু আছে।
সন্ধের দিকে অফিস থেকে ফেরার সময় সে লক্ষ্য করল, বাড়ির সামনে এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি, হাতে লাঠি, মুখে কুঞ্চিত দাড়ি। রুদ্রকে দেখে সে ফিসফিস করে বলল—
“তুমি ওই ঘরটা খুলেছ, তাই না?”
রুদ্র থমকে গেল।
—“আপনি কে?”
—“আমি এই পাড়ার পুরোনো মানুষ। সবাই সরে গেছে। শুধু আমি আছি। ওই ঘরটা কখনও খুলো না। ওখানে যে আছে, সে বাঁচলে কেউ বাঁচবে না।”
বৃদ্ধ চলে গেল অন্ধকারে মিলিয়ে। রুদ্র দাঁড়িয়ে রইল স্তব্ধ হয়ে। গা শিরশির করে উঠল। সত্যিই কি ওই ঘরে কেউ আছে? নাকি কেবলই এক অদৃশ্য দরজা?
সেদিন রাতে আবার সেই দরজা থেকে শব্দ এল। এবার শুধু দরজা খোলা নয়—মৃদু একটা ফিসফিসানি। যেন কারও গলা, দূর থেকে ডাকছে—
“রুদ্র… রুদ্র…”
সে ঘামতে ঘামতে বিছানা থেকে উঠে বসল। টর্চটা হাতে নিল। ভয় আর কৌতূহলের টান তাকে করিডরের দিকে টেনে নিয়ে গেল।
দরজাটা খানিকটা ফাঁক হয়ে আছে। ভেতর থেকে অন্ধকারের গন্ধ, ঠান্ডা ধোঁয়ার মতো কুয়াশা বেরোচ্ছে। আর সেই ফিসফিসানি ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।
রুদ্র ধীরে ধীরে দরজার সামনে দাঁড়াল। তার মনে হল—একবার ঢুকলেই হয়তো আর ফেরার পথ নেই। তবু হাত বাড়াল কড়ার দিকে।
দরজা ভেতর থেকে যেন নিজে থেকেই খুলে গেল।
অন্ধকার ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল তীব্র ঠান্ডা বাতাস—আর সেই সঙ্গে শোনা গেল এক অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর—
“এতদিন পর… কেউ এলো…”
রুদ্রর চোখ বিস্ফারিত। আর ঠিক তখনই টর্চের আলো নিভে গেল।
ফিসফিসানির রাত
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রুদ্রর মনে হচ্ছিল, বুকের ভেতর ধুকপুক ধ্বনি যেন গোটা বাড়ি শুনতে পাচ্ছে। টর্চ নিভে যাওয়ার পর চারপাশে যেন কালো পর্দা নেমে এসেছে। অথচ সেই অন্ধকারের ভেতরেও সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে এক কণ্ঠস্বর—ধীরে ধীরে কাছে আসছে, যেন কারও নিশ্বাস মিশে আছে সেই ফিসফিসানির সঙ্গে।
“এতদিন পর… অবশেষে…”
রুদ্র আতঙ্কে হাতড়াতে লাগল। টর্চ আবার জ্বালাতে চাইল, কিন্তু বোতাম চাপতেই শুধু টুকটুক শব্দ হল, আলো এল না। হাত কাঁপতে কাঁপতে সে ঘরের ভেতরে পা বাড়াল। ঠান্ডা মেঝেতে পা দিতেই মনে হল শূন্যতার মধ্যে নেমে যাচ্ছে। হঠাৎ তার চোখ অভ্যস্ত হয়ে এলো অন্ধকারে। ঘরের ভেতর যে প্রতিকৃতিটা ছিল—কালো হয়ে যাওয়া সেই ফটোফ্রেম—এবার কেমন যেন ঝলমল করছে।
ছবির চোখদুটো অদ্ভুতভাবে জীবন্ত, যেন মুহূর্তে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ভয় আর বিস্ময়ে রুদ্র দাঁড়িয়ে রইল। ছবির নীচে ম্লান হরফে লেখা নামটা এখন স্পষ্ট—
“দেবাশীষ লাহিড়ী, ১৯৪৭”।
এক ঝটকায় ঘরটা অচেনা লাগল। যেন মুহূর্তেই আরেক সময়ে গিয়ে পড়েছে। করিডরের ঘড়িটা তখন একবার বাজল—টং টং করে বারোটা। সঙ্গে সঙ্গেই হাওয়ার ঝাপটা এসে দরজা ঠাস করে বন্ধ হয়ে গেল।
রুদ্র ঝাঁপিয়ে দরজার দিকে দৌড় দিল, কিন্তু দরজা আর খুলল না। ঘরে আটকে পড়ে সে অনুভব করল—কেউ একজন তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। ফিসফিসানির গলা এবার স্পষ্টভাবে বলল,
“আমাকে ভুলে গেছে সবাই… কিন্তু তুমি এলে…”
রুদ্র চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল, অন্ধকারের ভেতর থেকে আবছা আকার তৈরি হচ্ছে। লম্বা চেহারা, ধবধবে মুখ, চোখদুটো শূন্য অথচ ভয়ংকর দীপ্ত। ধীরে ধীরে সেই অবয়ব ছবির ভেতর থেকে আলাদা হয়ে বেরিয়ে আসছে।
রুদ্রর শরীর জমে গেল। মুখ দিয়ে শব্দ বেরোলো না।
এক মুহূর্ত পরে আচমকা আলো ফিরে এল। টর্চ নিজে থেকেই জ্বলে উঠল, আর অবয়ব মিলিয়ে গেল হাওয়ায়। দরজাও খুলে গেল।
সে দৌড়ে বেরিয়ে এসে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। সারা রাত আর ঘুম হল না। মাথার ভেতর শুধু ঘুরছিল নামটা—দেবাশীষ লাহিড়ী। কে ছিল এই মানুষ? কেন তার প্রতিকৃতি ওই ঘরে রাখা আছে? আর কেনই বা তাকে ডাকা হচ্ছে?
পরদিন সকালে রুদ্র ইন্টারনেটে খোঁজখবর শুরু করল। “দেবাশীষ লাহিড়ী” নাম দিয়ে সে বিভিন্ন খবরের কাগজের পুরনো আর্কাইভে সার্চ করতে লাগল। কিছু পুরনো রিপোর্ট বেরোল। ১৯৫০-এর দশকে এই এলাকায় এক ধনী জমিদার পরিবার ছিল, লাহিড়ী পরিবার। তাঁদের ছেলে দেবাশীষ হঠাৎই অদৃশ্য হয়ে যায়। পুলিশের খোঁজাখুঁজি চলেছিল মাসের পর মাস, কিন্তু তার হদিস মেলেনি। শেষমেশ ধরা হয়েছিল, হয়তো বিদেশে পালিয়ে গেছে।
কিন্তু এক প্রতিবেশীর সাক্ষাৎকারে লেখা ছিল—
“ওই বাড়ির ভেতর থেকে মাঝরাতে অদ্ভুত শব্দ শোনা যেত। দেবাশীষ নিখোঁজ হওয়ার আগের দিন রাতেও আলো-ছায়ার খেলা দেখেছিলাম জানালার ফাঁক দিয়ে।”
রুদ্রর গা শিউরে উঠল। তাহলে এই বাড়িটাই কি সেই লাহিড়ী পরিবারের ভিটে?
সে ঠিক করল, আরও খোঁজ নিতে হবে।
অফিসের কাজ শেষ করে সন্ধেবেলা আবার বাড়ি ফেরার পথে সে ওই বৃদ্ধকে খুঁজতে লাগল যিনি আগের দিন সতর্ক করেছিলেন। সৌভাগ্যবশত, মাঠের ধারে এক চায়ের দোকানের কাছে দেখা পেল। বৃদ্ধ তখন নিঃশব্দে বসে ছিলেন, দূরে তাকিয়ে।
রুদ্র কাছে যেতেই বৃদ্ধ কড়া গলায় বলল,
“তুমি আবার সেই ঘরে গেছ, তাই না?”
—“হ্যাঁ… কিন্তু বলুন তো, আসলে ব্যাপারটা কী?”
বৃদ্ধ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।
“ওই যে ছবিটা… ওটা দেবাশীষ লাহিড়ীর। এই পাড়ার মানুষ ছিল। কিন্তু সে শুধু নিখোঁজ হয়নি… তাকে খুন করা হয়েছিল।”
রুদ্রর রক্ত হিম হয়ে গেল।
—“খুন? কিন্তু কোথায়?”
—“এই বাড়িতেই। করিডরের ওই গোপন ঘরে। গুজব আছে, সে রাতের পর থেকে তার আত্মা বেরোয়নি। যে ঘরে সে মারা গিয়েছিল, সেই ঘরেই তার উপস্থিতি।”
রুদ্র মাথায় হাত দিল। সবকিছু জুড়ে মিলতে লাগল। কিন্তু প্রশ্ন রইল—কেন তাকে ডাকা হচ্ছে?
সেদিন রাতে আবারও সেই দরজার সামনে দাঁড়াল রুদ্র। এবার আর ভয় নয়—সে যেন উত্তর খুঁজে বের করতেই এসেছে। দরজাটা ঠেলে খুলতেই হাওয়ার ঝাপটা লাগল, আর ঘর ভেতর থেকে আবার সেই ফিসফিসানি—
“আমার সত্যিটা বের করো… নইলে আমি কখনও শান্তি পাব না।”
রুদ্র কেঁপে উঠল। কিন্তু এবার সাহস করে বলল,
“আমি বের করব। তুমি শুধু আমাকে পথ দেখাও।”
মুহূর্তে প্রতিকৃতির চোখদুটো আগুনের মতো জ্বলে উঠল। ঘরের কোণে ধুলোভরা টেবিলের ওপরে কিছু লেখা যেন হালকা হয়ে ভেসে উঠল—ম্লান কালিতে আঁকাবাঁকা অক্ষর:
“কোনও বিশ্বাসঘাতকই রক্ষা পায় না।”
হঠাৎ করেই চারপাশের আলো নেভে গেল, ঘড়ি বাজল একবার, আর সবকিছু আবার আগের মতো নিস্তব্ধ।
রুদ্র হাঁপাতে হাঁপাতে বেরিয়ে এল। মনে হল সে একটা দায়িত্ব নিয়েছে—কোনও না কোনওভাবে দেবাশীষ লাহিড়ীর মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করতে হবে।
কিন্তু কে সেই বিশ্বাসঘাতক? কে খুন করেছিল দেবাশীষকে? আর কেন এত বছর ধরে আত্মা বন্দি এই ঘরে?
রুদ্র জানত—এখন থেকে তার প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত জড়িয়ে যাবে এই রহস্যের সঙ্গে।
আর ঠিক সেই রাতেই, দূরে মাঠের অন্ধকার থেকে দেখা গেল—একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে বাড়িটার দিকে। তার চোখে জ্বলজ্বল করছে অদ্ভুত দীপ্তি।
পুরনো কেসফাইল
রুদ্রর মাথা যেন ঘুরপাক খাচ্ছিল। দেবাশীষ লাহিড়ীর নাম এখন আর শুধু একটি পুরনো ছবির ভেতরে আটকে নেই, তার জীবনে ঢুকে পড়েছে অচেনা শীতল হাওয়ার মতো। অফিসে খবর লেখার সময়ও সে অন্যদিকে মনোযোগ দিতে পারছিল না। একটাই চিন্তা ঘুরছিল—কীভাবে দেবাশীষ খুন হয়েছিল, আর কে সেই বিশ্বাসঘাতক?
পরদিন দুপুরবেলা সে অফিসের লাইব্রেরি ঘেঁটে পুরনো খবরের কাগজ বার করল। সাদা-কালো পাতায় তখনও সেই সময়কার রিপোর্ট মুদ্রিত। ১৯৫৩ সালের একটি প্রতিবেদনে বড় করে লেখা—“লাহিড়ী পরিবারের উত্তরাধিকারীর নিখোঁজ হওয়া নিয়ে জল্পনা”। তার নীচে ছোট হরফে সাক্ষাৎকার: দেবাশীষ নাকি পাড়ার এক জমি-সংক্রান্ত দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিল।
আরেকটি রিপোর্টে লেখা, দেবাশীষের পরিবার তখনও ভয়াবহভাবে ভেঙে পড়েছিল। তার বাবা অল্পদিনের মধ্যেই মারা যান, আর মা নাকি মানসিক ভারসাম্য হারান। বাড়িটা এরপর থেকে ফাঁকা হয়ে যায়।
রুদ্রর মনে হল—এই গল্পটা শুধুই নিখোঁজ হওয়া নয়, এর সঙ্গে কোনও ষড়যন্ত্র জড়িয়ে আছে।
সন্ধেবেলা আবার সে ওই বৃদ্ধের খোঁজ করল। মাঠের পাশে, ভাঙা বেঞ্চে বসে বৃদ্ধ বিড়ি টানছিলেন। রুদ্র এগিয়ে যেতেই বৃদ্ধ বললেন,
“তুমি থামছো না দেখছি।”
রুদ্র উত্তর দিল,
“থামব কীভাবে? এই রহস্য আমাকে শান্তি দিচ্ছে না। আপনি তো বলেছিলেন, খুন হয়েছিল দেবাশীষ। কে খুন করেছিল জানেন?”
বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“সেটাই তো কেউ জানে না। সবাই বলে জমির ঝামেলায় হয়তো কেউ তাকে মেরেছিল। কিন্তু আমি ছোটবেলায় যেটুকু দেখেছি… সেই রাতের কথা এখনও ভুলতে পারিনি।”
রুদ্রর চোখ চকচক করে উঠল।
“কী দেখেছিলেন?”
বৃদ্ধ একটু থেমে বললেন,
“রাত তখন বারোটা। আমি জানলার ফাঁক দিয়ে দেখেছিলাম—দেবাশীষকে ঘরে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনজন মানুষ ছিল। মুখ দেখা যায়নি, কিন্তু একজনের হাতে ছিল রক্তে ভিজে থাকা ছুরি। আর… তারপরেই চিৎকার থেমে যায়। পরে পুলিশ এলে কেবল বলল, ছেলে পালিয়ে গেছে। কেউ বিশ্বাস করেনি।”
রুদ্রর বুক কেঁপে উঠল। অর্থাৎ তিনজন মিলে হত্যা করেছিল! কিন্তু কারা তারা?
বৃদ্ধ আবার ফিসফিস করে বললেন,
“তুমি যদি খুঁজতে চাও, তবে পুরনো থানার রেকর্ড ঘেঁটো। অনেক কিছু চাপা পড়ে গেছে।”
রুদ্র পরদিনই শহরের পুরনো পুলিশ হেডকোয়ার্টারে গেল। ধুলো জমা আলমারিতে পুরনো কেসফাইল রাখা আছে। সে অনুমতি নিয়ে ফাইলগুলো ঘাঁটতে লাগল। অবশেষে একটা পাতলা নীল কাগজে হাত পড়ল—কেস নম্বর ৪৫/১৯৫৩: দেবাশীষ লাহিড়ীর নিখোঁজ হওয়া।
ফাইলে লেখা—
- রাত বারোটার সময় শেষবার দেখা যায় দেবাশীষকে।
- প্রতিবেশীরা আলো-ছায়ার নড়াচড়া দেখেছে।
- পুলিশের রিপোর্টে লেখা: “কোনও প্রমাণ মেলেনি। মৃতদেহ উদ্ধার হয়নি। তদন্ত বন্ধ।”
কিন্তু পাতার এক কোণে পেন্সিলে দাগ কাটা ছিল। সেখানে লেখা—
“প্রধান সন্দেহভাজন: সোমনাথ দত্ত, প্রাক্তন কর্মচারী।”
রুদ্রর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। সোমনাথ দত্ত! নামটা সে আগে শোনেনি। কে এই মানুষ?
ফাইল থেকে আরেকটি সূত্র পাওয়া গেল। সোমনাথ লাহিড়ী পরিবারের বিশ্বস্ত ম্যানেজার ছিল, কিন্তু পরে জমির দলিল নিয়ে গণ্ডগোল হয়। গোপনে সে বিরাট টাকার কারবার করছিল।
রুদ্র তখনই বুঝল, রহস্যের সূত্রপাত এখানেই। কিন্তু কেন তদন্ত বন্ধ হয়ে গেল? কীভাবে সে বেঁচে গেল?
রাতের বেলা বাড়িতে ফেরার পর রুদ্র আবার সেই গোপন ঘরে গেল। এবার দরজা যেন তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। ভিতরে ঢুকতেই ছবির চোখ আবার উজ্জ্বল হল।
সে ধীরে ধীরে বলল,
“দেবাশীষ, আমি তোমার ফাইল পড়েছি। তুমি কি সোমনাথের হাতে খুন হয়েছিলে?”
ঘরের বাতাস হঠাৎ জমে গেল। প্রতিকৃতির ভেতর থেকে আওয়াজ এল—
“সোমনাথ… আর দুজন… তারা বিশ্বাসঘাতক। আমার রক্তে শপথ… সত্যি প্রকাশ করো।”
রুদ্রর মেরুদণ্ডে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।
“আর দুজন কারা? বলো!”
কিন্তু আওয়াজ থেমে গেল। শুধু দেওয়ালে রক্তের মতো দাগ ফুটে উঠল:
“তিনজন…”
হঠাৎ করে ঘরের টেবিলের ওপর কিছু পড়ে গেল। রুদ্র টর্চ ফেলে দেখল—একটা ছেঁড়া চিঠি। তাতে লেখা—
“আমি সব জানি। কাল রাতেই ফাঁস করব। আর চুপ করে থাকতে পারব না।”
চিঠির নিচে সই করা নাম—দেবাশীষ।
রুদ্র স্তম্ভিত। অর্থাৎ সে সত্যিই কিছু গোপন তথ্য জানত, যেটা ফাঁস করার আগেই তাকে খুন করা হয়।
হঠাৎ পিছন থেকে করিডরে পায়ের শব্দ ভেসে এল। রুদ্র টর্চের আলো ফেলতেই দেখল—কেউ নেই। কিন্তু মেঝেতে তাজা কাদার ছাপ, যেন কেউ সবে ভেতর থেকে বেরিয়ে গেল।
সে বুঝল, শুধু আত্মা নয়, আরও কিছু আছে এই বাড়িতে। হয়তো এখনো সেই বিশ্বাসঘাতকের ছায়ারা ঘুরে বেড়াচ্ছে।
রুদ্র বিছানায় শুয়ে সারারাত ভাবতে লাগল—কীভাবে রহস্য উদঘাটন করবে। সোমনাথ দত্তর নাম সে জেনেছে, কিন্তু বাকি দুজন কে? আর কেন তারা এত বছর পরও শান্তি পায়নি?
ভোরের আলো ফুটতেই সে ঠিক করল—পরের ধাপ হবে সোমনাথ দত্তর খোঁজ বের করা।
কিন্তু সকালে দরজা খুলতেই সে অবাক হয়ে গেল। দরজার বাইরে রাখা কাগজের খামে বড় হরফে লেখা—
“সতর্ক হও। তুমি যদি খোঁজ চালিয়ে যাও, তবে তোমারও শেষ হবে।”
রুদ্রর হাত কেঁপে উঠল। কে দিল এই খাম? কে জানল সে রহস্যের পথে এগোচ্ছে?
দূরে মাঠের ধারে আবারও সেই ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে ছিল। এবার সূর্যের আলোয়ও তাকে দেখা যাচ্ছিল স্পষ্টভাবে—একজন পুরুষ, কোট-প্যান্ট পরা, কিন্তু মুখ অন্ধকারে ঢাকা।
রুদ্র বুঝল, খেলাটা কেবল ভূতের নয়। এর মধ্যে মানুষও আছে।
হুমকির খাম
রুদ্রর হাতে ধরা সাদা খাম যেন জ্বলতে লাগল। “সতর্ক হও, তুমি যদি খোঁজ চালিয়ে যাও, তবে তোমারও শেষ হবে।” এই কথাগুলো বারবার চোখের সামনে ঘুরছিল। ঘাড়ের পশম দাঁড়িয়ে গেল।
সে চারপাশে তাকাল। মাঠের ধারে সেই অন্ধকার ছায়ামূর্তি আর নেই। কিন্তু মাটিতে এখনও ভেজা কাদার দাগ টাটকা। কারও পায়ের চাপে যেন ভিজে মাটি নরম হয়ে আছে। ভোরবেলায় কে এল তার দরজার সামনে?
রুদ্র খামের ভেতর আরও কিছু খুঁজল। ভিতরে একটা পুরনো পত্রিকার কেটে রাখা টুকরো—শিরোনাম: “লাহিড়ী পরিবারের অভিশপ্ত বাড়ি।” তার নিচে দুটো লাইন দাগ দেওয়া:
“যে এই বাড়ির রহস্য জানার চেষ্টা করবে, তার মৃত্যু অবধারিত।”
রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভয় পাওয়ার জন্য নয়, বরং রাগে। কে চায় সে এই খোঁজ বন্ধ করুক? এতদিন পরে কার স্বার্থ জড়িয়ে আছে এই রহস্যে?
দিনভর অফিসে বসেও মন পড়ে রইল কেসের দিকে। সন্ধের পর ঠিক করল থানায় আবার যাবে। সোমনাথ দত্তর সম্পর্কে আরও খোঁজ দরকার।
থানার পুরনো রেজিস্টার ঘেঁটে অবশেষে পেল তথ্য। সোমনাথ দত্ত ১৯৬২ সালে রহস্যজনকভাবে মারা যায়। কাগজে লেখা—“ট্রেন দুর্ঘটনা।” কিন্তু তার পরেই অদ্ভুত লাইন: “মৃত্যুর আগে কয়েকবার তাকে আতঙ্কিত অবস্থায় দেখা গিয়েছিল। প্রায়ই সে বলত, কেউ তাকে তাড়া করছে।”
রুদ্র শিউরে উঠল। তাহলে দেবাশীষের আত্মা কি সত্যিই তাকে শাস্তি দিয়েছিল?
বাইরে বেরিয়ে এল সে। থানার পুরনো সেপাই, যিনি রেকর্ড ঘাঁটছিলেন, হঠাৎ ফিসফিস করে বললেন,
“তুমি এসব খোঁজ কেন করছ? ওই বাড়ি ভাল নয়। আমি নিজে শুনেছি, সোমনাথ মরার আগে বারবার একটাই নাম বলত—দেবাশীষ।”
রুদ্রর মনে হল রহস্য আরও ঘনীভূত হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন এখনো রয়ে গেল—যদি সোমনাথ মারা যায়, তবে বাকি দুজন কোথায়?
সেই রাতে বাড়ি ফিরে রুদ্র আবারও সেই গোপন ঘরে ঢুকল। ঘরটা যেন তাকে ডাকছিল। দরজা ঠেলে ঢুকতেই প্রতিকৃতির চোখ জ্বলে উঠল।
“সোমনাথ মরে গেছে,” রুদ্র বলল। “এটা কি তোমার কাজ ছিল?”
এক ঝড়ো হাওয়া ঘর ভরে দিল। ছবির ভেতর থেকে আসা কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল—
“সে বিশ্বাসঘাতক ছিল। আমার মৃত্যু তার হাতেই হয়েছিল। আমি ন্যায় চাই।”
রুদ্র সাহস করে প্রশ্ন করল,
“বাকি দুজন কে? তাদের নাম বলো।”
কণ্ঠস্বর থেমে গেল। দেওয়ালের ধুলো ঝরে পড়ল। তারপর অস্পষ্ট অক্ষরে ফুটে উঠল দুটো নাম—
“হিরণ্ময়, অমিয়”।
রুদ্র হাঁপাতে লাগল। এরা কারা? নাম দুটি আগে শোনেনি।
মুহূর্তে বাতি নিভে গেল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল ভিতর থেকে। রুদ্র টর্চ জ্বালাতে গিয়ে দেখল, ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়ামূর্তি। উঁচু দেহ, ফ্যাকাশে মুখ। মুখে বিকৃত হাসি।
“তুমি বেশি খোঁজ করছ,” অবয়বটা বলল। “যেটুকু জানো, তাতেই শেষ করো। নয়তো তোমার পরিণতিও সোমনাথের মতো হবে।”
রুদ্র জমে গেল। গলা শুকিয়ে কাঠ। তবু সে কাঁপা গলায় বলল,
“তোমরা কারা? হিরণ্ময়? অমিয়? তোমরা কি এখনো বেঁচে আছো?”
ছায়ামূর্তি উত্তর দিল না। এক ঝড়ো বাতাসে মিলিয়ে গেল। দরজা আবার খুলে গেল, আর বাইরে থেকে কুকুরের হুঙ্কার শোনা গেল।
রুদ্র সারা রাত চোখের পাতা এক করতে পারল না। জানত, এখন খোঁজ চালানো মানে জীবনের ঝুঁকি। তবু পিছু হটার উপায় নেই।
পরদিন সকালে সে আবার বৃদ্ধের কাছে গেল। বৃদ্ধ খবরটা শুনে ভুরু কুঁচকে বললেন,
“হিরণ্ময় আর অমিয়… নাম দুটো আমি জানি। ওরা ছিল লাহিড়ী পরিবারের আত্মীয়। জমি দখল করার জন্যই ওরা দেবাশীষকে সরিয়ে দেয়। সোমনাথকে টাকা দিয়ে কিনেছিল। কিন্তু জানো তো, লোভের শাস্তি শেষ পর্যন্ত কেউ এড়াতে পারে না।”
রুদ্র অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তাহলে ওরা এখন কোথায়?”
বৃদ্ধ নিঃশ্বাস ছাড়লেন।
“হিরণ্ময় মারা গেছে বহু বছর আগে। হার্ট অ্যাটাক। কিন্তু লোকজন বলে, মৃত্যুর আগে সে চিৎকার করে বলেছিল, কেউ তাকে গলা টিপে ধরছে। আর অমিয়… সে এখনো বেঁচে আছে।”
রুদ্র চমকে উঠল।
“অমিয় বেঁচে আছে? কোথায়?”
বৃদ্ধ চোখ নামিয়ে বললেন,
“এই শহরের এক প্রান্তে। বুড়ো হয়ে গেছে। কিন্তু… তুমি যদি তার কাছে যাও, সাবধান। সে জানলে তুমি খোঁজ করছ, তোমার ক্ষতি করতে পারে।”
রুদ্রর মস্তিষ্ক তখন জ্বলজ্বল করছিল। অর্থাৎ রহস্যের একটা প্রান্ত এখনো জীবিত আছে—অমিয়।
বিকেলবেলা অফিস থেকে বেরিয়ে সে ঠিক করল, খুঁজে বের করবেই অমিয়কে। ডিরেক্টরিতে নাম ঘেঁটে অবশেষে একটি ঠিকানা পেল। শহরের পুরনো অংশে, নদীর ধারের একটি ভগ্নপ্রায় বাড়ি।
সে সেদিকে রওনা দিল। রাস্তা ফাঁকা, চারপাশে গুমোট অন্ধকার। বাড়িটার সামনে দাঁড়াতেই বুক কেঁপে উঠল। লোহার গেটে তালা নেই, শুধু ঠেলা দিলেই খুলে যায়।
ভেতরে ঢুকে সে দেখল—ধুলো জমে থাকা বারান্দায় এক বৃদ্ধ বসে আছেন। চশমা চোখে, মুখে গভীর ভাঁজ, কিন্তু চোখে অদ্ভুত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।
রুদ্র ধীরে ধীরে বলল,
“আপনি কি অমিয় লাহিড়ী?”
বৃদ্ধ তাকালেন। ঠোঁটে সামান্য হাসি ফুটল।
“হ্যাঁ। তুমি কে?”
রুদ্রর গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। সে সাহস করে বলল,
“আমি সাংবাদিক। দেবাশীষ লাহিড়ীর মৃত্যুর সত্যি খুঁজছি।”
অমিয়র চোখ হঠাৎ চকচক করে উঠল। কণ্ঠস্বর ঠান্ডা।
“তাহলে তুমি অনেক দূর চলে গেছ, ছেলে। এখন তোমার আর ফেরার পথ নেই।”
রুদ্র অনুভব করল, গা শিরশির করছে। বাড়ির ভেতর থেকে যেন কারও অদৃশ্য হাসির শব্দ ভেসে আসছে।
অমিয়ের ছায়া
অমিয় লাহিড়ীর বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে রুদ্র বুঝতে পারছিল, তার শরীরের প্রতিটি স্নায়ু টানটান হয়ে আছে। অমিয়র চোখে অদ্ভুত এক শীতল দৃষ্টি, যেন এত বছর পরও কোনও অপরাধের স্মৃতি মুছে যায়নি।
“দেবাশীষের সত্যি খুঁজছ?” অমিয় ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল। “তাহলে তুমি হয় ভীষণ সাহসী, নয়তো নির্বোধ।”
রুদ্র ঠোঁট কামড়ে উত্তর দিল,
“আমি শুধু সত্যিটা জানতে চাই। কেন খুন হয়েছিল দেবাশীষ? কারা করেছিল?”
অমিয় কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হেসে উঠল—একটা কর্কশ, শূন্য হাসি।
“সত্যিটা? সত্যি কখনও বিনা মূল্যে পাওয়া যায় না, ছেলে।”
রুদ্র সাহস করে এক ধাপ এগোল।
“আমি ফাইল ঘেঁটে জেনেছি—আপনি, হিরণ্ময় আর সোমনাথ মিলে ওকে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। এটা কি সত্যি?”
অমিয়র মুখ মুহূর্তে গম্ভীর হয়ে উঠল। চোখে তীব্র দৃষ্টি।
“তুমি অনেক জানো। কিন্তু সব জানো না। সোমনাথ ছিল আমাদের হাতের পুতুল, টাকা আর লোভে চালিত। হিরণ্ময় লোভী ছিল, জমি চেয়েছিল। আর আমি…”
সে থেমে গেল। তারপর নিচু গলায় বলল,
“আমি জানতাম দেবাশীষ সব ফাঁস করবে। তাই ওকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।”
রুদ্রর বুক ধড়ফড় করতে লাগল। অর্থাৎ অমিয় নিজেই স্বীকার করছে। কিন্তু হঠাৎই অমিয় উঠে দাঁড়াল। তার কণ্ঠস্বর শীতল হয়ে গেল।
“তুমি এবার চলে যাও। এই বাড়ি আর আমার নাম মুখে এনো না। আমি বেঁচে আছি কারণ অনেক কিছু চাপা ছিল। তুমি যদি এগোও, তুমি মরবে।”
রুদ্র দাঁড়িয়ে রইল, গলা শুকিয়ে কাঠ। অবশেষে সে ঘুরে বেরিয়ে এল।
বাড়ি থেকে বেরোতেই নদীর হাওয়ায় শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। কিন্তু বুকের ভেতর আগুন জ্বলছিল—অমিয় নিজেই স্বীকার করেছে। এটাই প্রমাণ! কিন্তু কোনও রেকর্ড নেই, সাক্ষীও নেই। শুধু তার নিজের শোনা কথা।
রাত্রে বাড়ি ফিরে আবার সেই গোপন ঘরে ঢুকল রুদ্র। এবার দরজার কড়া ঠেলতেই ঘরটা যেন হাহাকার করে উঠল। ছবির চোখদুটো রক্তলাল।
“আমি জানি,” রুদ্র বলল হাঁপাতে হাঁপাতে। “অমিয় স্বীকার করেছে। তোমাকে ওরাই খুন করেছিল।”
কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হল,
“ন্যায় চাই… শাস্তি চাই…”
হঠাৎ টেবিলের ওপর এক পুরনো কাগজ ভেসে উঠল। তাতে লেখা—
“যদি সত্যি প্রকাশ না হয়, তবে প্রতিশোধ চলতে থাকবে।”
রুদ্র ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তার মনে হচ্ছিল, সময় শেষ হয়ে আসছে। দেবাশীষের আত্মা শান্তি পাচ্ছে না। অথচ একদিকে আছে অমিয়, যে এখনও জীবিত, অন্যদিকে এই অভিশপ্ত বাড়ি।
সেই রাতে ঘুম ভাঙল দরজার শব্দে। করিডরে যেন কেউ হেঁটে বেড়াচ্ছে। রুদ্র টর্চ জ্বালাল। আলো পড়তেই দেখতে পেল—মেঝেতে টাটকা রক্তের দাগ, করিডর ধরে এগিয়ে গেছে গোপন ঘরের দিকে।
সে কাঁপতে কাঁপতে এগোল। দরজা অল্প ফাঁক হয়ে আছে। ভিতর থেকে অদ্ভুত আলো বেরোচ্ছে। ভেতরে উঁকি দিয়ে সে দেখল—দেবাশীষের প্রতিকৃতি আর নেই। বদলে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে রক্তমাখা এক তরুণের অবয়ব। চোখদুটো শূন্য, মুখে যন্ত্রণার রেখা।
“অমিয়…” অবয়বটা ফিসফিস করে বলল। “ওকে থামাও… নইলে অভিশাপ শেষ হবে না।”
রুদ্র ভয়ে ঘামতে লাগল।
“কীভাবে থামাব? কী করব?”
অবয়ব ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে তার কানে ফিসফিস করল,
“ওর পাপ প্রকাশ করো। ওর সত্যি আলোয় আনো।”
পরদিন সকালে রুদ্র ছুটল আর্কাইভ অফিসে। পুরনো কাগজ, নথি ঘেঁটে খুঁজতে লাগল। অবশেষে পেল একটা দলিল—হিরণ্ময় আর অমিয়র স্বাক্ষর করা জমির কাগজ, যা দেবাশীষের মৃত্যুর পর হস্তান্তর হয়েছিল। অর্থাৎ প্রমাণ আছে, ওরা ষড়যন্ত্র করেছিল।
কিন্তু বড় সমস্যা হল—এখনকার দিনে কে বিশ্বাস করবে এত পুরনো গল্প? অমিয় এখনও জীবিত, আর সে প্রভাবশালীও।
সন্ধের দিকে রুদ্র আবার অমিয়র বাড়ির সামনে দাঁড়াল। এবার আর ভয় নয়—তার মনে শুধু একটাই উদ্দেশ্য। দরজা ঠেলে ঢুকতেই সে দেখল অমিয় বসে আছে, যেন তার আসার অপেক্ষাতেই ছিল।
“তুমি আবার এলে?” অমিয় হেসে উঠল। “আমি তো বলেছিলাম, বেশি জানলে বিপদ হবে।”
রুদ্র চুপচাপ কাগজটা বের করে ধরল।
“এটা দেখুন। দেবাশীষের মৃত্যুর পর আপনারা জমি নিজেদের নামে করে নেন। এটা প্রমাণ।”
অমিয়র চোখে আতঙ্কের ছায়া ভেসে উঠল। কিন্তু মুহূর্তেই সে সামলে নিল।
“তাহলে কী হবে? কে তোমার কথা শুনবে? এত বছর কেটে গেছে।”
ঠিক তখনই ঘরের ভেতর থেকে বাতাস হুহু করে উঠল। জানলার কাঁচ কেঁপে উঠল। অমিয় হঠাৎ ঘামতে লাগল। তার চোখে আতঙ্ক।
“না… আবার নয়… দেবাশীষ…”
রুদ্র চমকে উঠল। ঘরের কোণে যেন আবছা ছায়া তৈরি হচ্ছে। ধীরে ধীরে রক্তমাখা দেবাশীষের অবয়ব স্পষ্ট হতে লাগল।
অমিয় চিৎকার করে উঠল,
“আমাকে ক্ষমা করো! আমি বাধ্য ছিলাম… হিরণ্ময় চাপ দিয়েছিল…”
অবয়বটা ক্রমশ কাছে আসছিল। ঘর ভরে উঠছিল অদ্ভুত ঠান্ডায়। রুদ্র স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
ঠিক তখনই লাইট চলে গেল। অন্ধকারে শুধু শোনা গেল অমিয়র গলায় হাহাকার—
“না-আ-আ!”
রুদ্র ছুটে বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। বাইরে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল। ভেতর থেকে তখনও অস্পষ্ট চিৎকার আসছিল।
কিছুক্ষণ পর সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
সে ভয়ে আবার ভেতরে ঢুকল। কিন্তু অবাক হয়ে দেখল—চেয়ারে আর অমিয় নেই। শুধু মেঝেতে পড়ে আছে ফাঁকা চশমা। আর দেওয়ালে অদ্ভুত অক্ষরে রক্তের মতো লেখা—
“দুইজন শেষ… এক বাকি।”
রুদ্রর শরীর কেঁপে উঠল। অর্থাৎ সোমনাথ আর অমিয়র শাস্তি হয়েছে। হিরণ্ময় মারা গেছে অনেক আগেই, তবু আত্মা বলছে “এক বাকি।” সেটা কাকে বোঝাচ্ছে?
তার মাথার ভেতর ঘুরছিল একটাই প্রশ্ন—আসলে কি এখনও আরও কেউ বেঁচে আছে, যে দেবাশীষকে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল?
চতুর্থ নাম
অমিয়র বাড়ি থেকে বেরোনোর পর রুদ্রর বুক ধকধক করছিল। দেওয়ালের সেই অদ্ভুত রক্তলিখন—“দুইজন শেষ… এক বাকি।”—এই লাইন যেন মাথার ভেতর ঘুরছিল অবিরত। কিন্তু কী করে সম্ভব? হিরণ্ময় তো অনেক আগেই মারা গেছে, সোমনাথ দুর্ঘটনায়, আর অমিয় আজ তার চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে গেল। তাহলে “এক বাকি” কার উদ্দেশ্যে লেখা?
রুদ্র সারা রাত ঘুমাতে পারল না। ভোর হতেই নোটবুক হাতে বসে কাগজে নামগুলো লিখল—
- সোমনাথ দত্ত (ম্যানেজার) – মৃত
- হিরণ্ময় লাহিড়ী (আত্মীয়) – মৃত
- অমিয় লাহিড়ী (আত্মীয়) – নিখোঁজ/অদৃশ্য
— তাহলে আর কে?
সে মনে করল বৃদ্ধের কথা। প্রথম দিন থেকেই বৃদ্ধ তাকে সতর্ক করছিলেন। বৃদ্ধ যদি জানেন, তবে এ রহস্যের শেষ চাবি ওর কাছেই।
সন্ধেবেলা মাঠের ধারে সেই ভাঙা বেঞ্চে গিয়ে রুদ্র বৃদ্ধকে পেল। বৃদ্ধ তখন চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। রুদ্র কাছে যেতেই বৃদ্ধ বললেন,
“তুমি থামছো না দেখছি।”
রুদ্র গলা কাঁপিয়ে বলল,
“আপনি বলেছিলেন তিনজন মিলে দেবাশীষকে খুন করেছিল। কিন্তু এখন প্রতিকৃতি বলছে—একজন এখনও বাকি। সেটা কীভাবে সম্ভব?”
বৃদ্ধ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
“সবাই ভাবে তিনজনই ছিল। আসলে চতুর্থ একজনও জড়িত ছিল।”
রুদ্রর বুক কেঁপে উঠল।
“চতুর্থ? কে?”
বৃদ্ধ চোখ নামিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
“দেবাশীষের নিজেরই পরিবার থেকে একজন।”
এই কথা শুনে রুদ্র স্তম্ভিত।
“মানে? পরিবার থেকে? কে?”
বৃদ্ধ ধীরে ধীরে বললেন,
“তার মা।”
রুদ্রর শরীর কেঁপে উঠল।
“কী বলছেন আপনি? মা নিজের ছেলেকে?”
বৃদ্ধ চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন,
“গুজব আছে, দেবাশীষের মা তখন মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন। কিন্তু অনেকেই বলত, আসলে তিনি সম্পত্তির জন্য চাপের মধ্যে ছিলেন। জমির কাগজপত্রে তাঁরও স্বাক্ষর ছিল। যদি সত্যি হয়, তবে তাঁর হাতও মিশেছিল এই খুনে।”
রুদ্র ভেবে পেল না, এ কীভাবে সম্ভব। কিন্তু তার ভেতর একটা অদ্ভুত টান কাজ করছিল—যেন সত্যি আরও গভীরে লুকিয়ে আছে।
সেই রাতে বাড়িতে ফিরে আবার সেই গোপন ঘরে গেল। দরজা ঠেলতেই প্রতিকৃতি ঝলমল করে উঠল।
“তুমি চতুর্থ জনকে খুঁজছ,” কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হল।
“তুমি কি বলতে পারো, সত্যিই তোমার মা জড়িত ছিল?” রুদ্র প্রশ্ন করল।
এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর ছবির চোখ থেকে জল পড়ার মতো ঝলক বেরোল। কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে বলল,
“মা… আমাকে বাঁচাতে পারেনি। কিন্তু তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে…”
বাক্য অসম্পূর্ণ থেকে গেল। হাওয়ার ঝাপটা দরজা ঠাস করে বন্ধ করে দিল।
রুদ্র ঘরে আটকা পড়ল। হঠাৎ ঘরের টেবিলের ওপর ছেঁড়া একটা ডায়েরি ভেসে উঠল। সে কাঁপতে কাঁপতে ডায়েরিটা খুলল। ভিতরে কয়েকটা লাইন পড়া যাচ্ছিল—
“আমার ছেলেকে বাঁচাতে পারলাম না। তারা আমাকে বাধ্য করেছিল স্বাক্ষর করতে। নইলে আমাকেও শেষ করে দিত। আমি অভিশপ্ত…”
ডায়েরির শেষে স্বাক্ষর—শান্তশ্রী লাহিড়ী।
রুদ্র বুঝল—মা সরাসরি খুনে অংশ নেননি, কিন্তু চাপের মুখে বাধ্য হয়েছিলেন। অথচ তার আত্মাও হয়তো আজও শান্তি পায়নি।
রুদ্র ভাবতে লাগল—তাহলে প্রতিকৃতির ‘এক বাকি’ কথার মানে কী? মায়ের আত্মা? নাকি অন্য কেউ এখনো জীবিত?
ঠিক তখনই করিডরে শব্দ হল। রুদ্র দরজা খুলে দেখল—মাটিতে আবার সেই কাদার ছাপ। এবার সোজা তার ঘর পর্যন্ত এসেছে। আর টেবিলের ওপর রাখা আছে আরেকটা খাম।
ভেতরে একটা ছোট্ট কাগজ:
“চতুর্থ নাম তুমি জেনেছ। কিন্তু মনে রেখো—এখন তোমাকেই শেষজন হতে হবে।”
রুদ্রর শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। কে এটা লিখছে? কে এত কাছ থেকে তার প্রতিটি পদক্ষেপ নজরে রাখছে?
পরদিন সকালে সে বৃদ্ধকে খুঁজে পেল না। বেঞ্চ ফাঁকা। আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করল, কেউ জানল না বৃদ্ধ কোথায় গেছে।
রুদ্র সন্দেহে ভরে উঠল। বৃদ্ধ কি সত্যিই পাড়ার মানুষ, নাকি সেও এই খেলায় জড়িত?
সন্ধের দিকে আবার থানায় গেল সে। রেকর্ড অফিসারকে ঘুষ দিয়ে আরও কিছু পুরনো ফাইল দেখতে পেল। হঠাৎ চোখে পড়ল এক আশ্চর্য তথ্য—শান্তশ্রী লাহিড়ী, দেবাশীষের মা, নাকি খুনের ঘটনার কিছুদিন পর মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হন। কিন্তু রেকর্ডে লেখা—তিনি সেখান থেকে হঠাৎ নিখোঁজ হন। আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি।
রুদ্রর মাথা ঘুরে গেল। তাহলে দেবাশীষের মা কি বেঁচে ছিলেন? তাঁর আত্মাও কি আজও ছুটে বেড়াচ্ছে?
রাত নেমে এলো। বাড়িতে ফেরার পথে রুদ্রর মনে হচ্ছিল কেউ তাকে অনুসরণ করছে। গলির মোড়ে ছায়া নড়ছিল, কিন্তু ঘুরলেই কিছু নেই। অবশেষে বাড়িতে ঢুকে দরজা বন্ধ করল।
কিন্তু রাত বারোটায় আবার দরজা নিজে থেকেই কড়কড় করে খুলে গেল। ঠান্ডা বাতাস ঢুকে পড়ল ঘরে। আর সেই সঙ্গে প্রতিকৃতির গলা—
“তুমি আমার সত্যি জানো। এখন তোমার সময় এসেছে…”
রুদ্র স্তম্ভিত। বুক ধড়ফড় করছে।
“কী সময়?” সে ফিসফিস করে বলল।
কণ্ঠস্বর ভেসে এল—
“শেষ বলি…”
হঠাৎ চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। জানলার বাইরে থেকে এক নারীকণ্ঠের ক্রন্দন শোনা গেল। রুদ্র ছুটে জানলা খুলতেই দেখল—আবছা এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে বাগানে। সাদা শাড়ি, মুখ অস্পষ্ট, চোখ থেকে টপটপ করে রক্তের মতো জল গড়াচ্ছে।
“মা…” প্রতিকৃতির কণ্ঠস্বর গর্জে উঠল। “তুমি আমাকে বাঁচাওনি…”
রুদ্র শিউরে উঠল। বাগানের মহিলা ফিসফিস করে বলল,
“আমাকে দোষ দিও না। আমি বাধ্য ছিলাম। কিন্তু অভিশাপ থামবে না…”
রুদ্রর চোখে অন্ধকার নেমে এল। মনে হল মাটি তার পায়ের তলা থেকে সরে যাচ্ছে।
অদৃশ্য মা
রুদ্রর চোখের সামনে বাগানে দাঁড়িয়ে থাকা সেই সাদা শাড়িপরা নারীর অবয়ব যেন কুয়াশার মধ্যে গড়ে উঠছিল আবার মিলিয়েও যাচ্ছিল। ভিজে হাওয়ায় নারীর কণ্ঠস্বর যেন ভেসে আসছিল করুণ ফিসফিসানির মতো—
“আমাকে দোষ দিও না… আমি বাধ্য ছিলাম…”
রুদ্র স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হাত-পা জমে গেছে। ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। মনে হচ্ছিল, বুকের ভেতর জমাট বরফ গলতে গলতে একধরনের যন্ত্রণায় রক্তে মিশে যাচ্ছে।
“শান্তশ্রী দেবী… আপনি সত্যিই কি দেবাশীষের মা?” রুদ্রর কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল।
অবয়বটা ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। মুখ ঝাপসা, কিন্তু চোখদুটো শূন্য, জলভরা।
“হ্যাঁ… আমি তার মা। আমি ছেলেকে রক্ষা করতে পারিনি। তারা আমাকে ভয় দেখিয়েছিল। বলেছিল, আমি যদি স্বাক্ষর না করি, তবে আমাকেও শেষ করে দেবে। আমি ভেবেছিলাম হয়তো কাগজে সই করলেই ওকে ছেড়ে দেবে… কিন্তু ওরা…”
কথা শেষ করার আগেই ঝোড়ো হাওয়া বইতে লাগল। অবয়ব মিলিয়ে গেল রাতের অন্ধকারে।
রুদ্র ঘরে ফিরে এল হাঁপাতে হাঁপাতে। মনে হচ্ছিল, রহস্য যেন গোলকধাঁধার মতো আরও জটিল হয়ে যাচ্ছে। সে বুঝতে পারল, দেবাশীষের মা দোষী হয়েও ভুক্তভোগী। সত্যিটা তার কণ্ঠেই চাপা পড়ে গেছে।
সকালে উঠে রুদ্রর মাথা ব্যথায় ফেটে যাচ্ছিল। অফিসে যেতেও মন চাইছিল না। সে আবার থানায় গেল। মানসিক হাসপাতালের পুরনো রেকর্ড ঘাঁটতে ঘাঁটতে বেরিয়ে এল এক অদ্ভুত তথ্য—শান্তশ্রী দেবীকে হাসপাতালের নথিতে “রোগী নম্বর ২১৭” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ভর্তি হয়েছিলেন ১৯৫৪ সালে, কিন্তু ১৯৫৫-র মাঝামাঝি নথি থেকে তার নাম কেটে দেওয়া হয়েছে। পাশে লেখা: “নিখোঁজ।”
রুদ্রর মনে হল, এ নিখোঁজ হওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই রহস্য আছে। কে বা কারা তাকে সরিয়ে দিল?
থানা থেকে বেরিয়ে আসার সময় এক পুলিশ কর্মচারী তাকে ডেকে বলল,
“আপনি অনেক খোঁজখবর করছেন। সাবধান থাকবেন। অনেক সময় পুরনো কেস খুঁড়ে বের করলে নতুন শত্রু তৈরি হয়।”
রুদ্র হালকা হেসে বলল,
“শত্রু তো আমি আগেই তৈরি করে ফেলেছি।”
সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরতেই গা শিরশির করে উঠল। বাড়িটার প্রতিটি দেওয়াল যেন কান পাতছে। গোপন ঘরের দরজা আধখোলা। ভিতর থেকে ফিসফিসানি—
“রুদ্র… তুমি শেষ সত্যির কাছাকাছি পৌঁছে গেছ…”
সে ভেতরে ঢুকল। ছবির চোখ লালচে দীপ্তিতে জ্বলজ্বল করছে।
“তুমি চতুর্থ জনকে দেখেছ,” কণ্ঠস্বর বলল। “কিন্তু সত্যি এখনো অর্ধেক। কেউ তাকে নিখোঁজ করেছিল… যাতে আমার অভিশাপ তার গায়ে না লাগে।”
রুদ্র কেঁপে উঠল।
“মানে? তাহলে আপনার মায়ের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে অন্য কেউ আছে?”
“হ্যাঁ…” প্রতিকৃতি গর্জে উঠল। “যে সত্যিটা ঢেকে রাখার জন্য অদৃশ্য শক্তিকে ডেকে এনেছিল… সে-ই আসল অপরাধী।”
রুদ্রর মাথা ঘুরতে লাগল। এতদিন ধরে ভেবেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা তিনজন, পরে জানল মা-ও বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু এখন প্রতিকৃতি বলছে—আরও কেউ, এক অদৃশ্য চরিত্র, সবকিছুর আড়ালে ছিল।
হঠাৎ ঘরের টেবিলের ওপর ছেঁড়া কাগজ ভেসে উঠল। তাতে লেখা:
“আমি অভিশাপকে থামাতে চেয়েছিলাম। আত্মা শান্তি পেলে বাড়িটা বেঁচে যাবে। কিন্তু কেউ চায়নি শান্তি।”
স্বাক্ষর নেই। শুধু এক অদ্ভুত প্রতীক—ত্রিভুজের ভেতরে বৃত্ত।
রুদ্র বিস্মিত। এ প্রতীক কোথাও আগে দেখেনি। সে ডায়েরির পাতাগুলো গুছিয়ে রাখল। ঠিক তখনই দরজা ঠাস করে বন্ধ হয়ে গেল। অন্ধকার ঘর ভরে উঠল ঠান্ডা বাতাসে।
কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হল—
“ওরা এখনো তোমার ওপর নজর রাখছে… সাবধান…”
রুদ্র ভয়ে দৌড়ে বেরিয়ে এল। কিন্তু বেরিয়েই দেখল, করিডরে আবার সেই ভেজা কাদার ছাপ। এবার সোজা তার শোবার ঘর পর্যন্ত গেছে। টেবিলের ওপর আরেকটা খাম রাখা।
খামের ভেতরে একটাই লাইন:
“তুমি সত্যি খুঁজতে খুঁজতে নিজেই বলি হয়ে যাবে।”
রুদ্র খাম মুঠো করে চেপে ধরল। কে লিখছে এসব? মানুষ, না আত্মা?
রাত গভীর হল। ঘুম আসছিল না। হঠাৎ বাইরের জানলার কাঁচে শব্দ হল—টুপটাপ করে যেন কেউ আঙুল ঠুকছে। সে ভয়ে উঠে দাঁড়াল। জানলা খুলতেই দেখল—অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে সেই বৃদ্ধ!
“আপনি?” রুদ্র হাঁপাতে হাঁপাতে বলল।
বৃদ্ধ ফিসফিস করে বললেন,
“তুমি যা দেখছ, তার অর্ধেকও জানো না। সত্যিটা চাপা পড়ে আছে এই শহরের মাটির নিচে। চতুর্থ নামটা আসলে তোমার ধারণার বাইরে।”
রুদ্র প্রশ্ন করার আগেই বৃদ্ধ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
সে বুঝল, এবার হয়তো সত্যি প্রকাশের শেষ ধাপ শুরু হয়েছে। কিন্তু মনে হচ্ছিল, যেন কেউ ইচ্ছে করে তাকে খেলায় টেনে আনছে।
পরদিন সকালে অফিসের কাজ ফেলে সে লাইব্রেরিতে গেল। পুরনো সাময়িকীতে প্রতীকের খোঁজ করতে লাগল। কয়েক ঘণ্টা ঘাঁটার পর অবশেষে পেল মিল—এই প্রতীক একসময় স্থানীয় এক গুপ্তসমিতির চিহ্ন ছিল। তারা গোপন আচার ব্যবহার করত, আর অনেকে বলত—ওরা আত্মাকে বন্দি করতে পারত।
রুদ্রর শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। তাহলে কি দেবাশীষের মৃত্যু কোনও সাধারণ খুন নয়, বরং এক আচার বা তন্ত্রের মাধ্যমে আত্মাকে বন্দি করার ষড়যন্ত্র?
সন্ধেবেলা বাড়িতে ফিরতেই সে আবার সেই গোপন ঘরে গেল। দরজা ঠেলে ঢুকতেই ছবির চোখ রক্তলাল হয়ে উঠল।
“তুমি বুঝতে পেরেছ,” কণ্ঠস্বর গর্জে উঠল। “আমার মৃত্যু শুধু খুন ছিল না… আমাকে বাঁধা হয়েছিল এই ঘরে। যাতে আমার সত্যি আর বেরোতে না পারে।”
রুদ্র ঘামতে লাগল।
“কে করেছিল এটা? কে আসল ষড়যন্ত্রকারী?”
ঘর ভরে উঠল বজ্রপাতের শব্দে। দেওয়ালে রক্তের মতো লেখা ফুটে উঠল—
“অভিশপ্ত সমিতি… আর তাদের নেতা…”
রুদ্র জোরে জিজ্ঞেস করল,
“কে সেই নেতা?”
কিন্তু উত্তর এল না। শুধু ঘর ভরে উঠল নারীকণ্ঠের কান্না আর পুরুষকণ্ঠের হাহাকার।
সে দৌড়ে বেরিয়ে এল। বাইরে বেরিয়েই দেখল, মাঠের ধারে কালো কোট পরা সেই ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে। এবার অন্ধকারে নয়, দিনের আলোয় স্পষ্ট—কিন্তু মুখ ঢেকে আছে কালো কাপড়ে।
ছায়ামূর্তি হাত তুলে ইশারা করল—“থেমে যাও।”
রুদ্র স্তব্ধ হয়ে গেল। বুকের ভেতর যেন কারও ঠান্ডা হাত চেপে ধরল।
গুপ্তসমিতির ছায়া
মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা কালো কোট পরা ছায়ামূর্তিকে দেখে রুদ্রর বুক কেঁপে উঠল। প্রথম দিন থেকে সে লক্ষ্য করছিল—যেই মুহূর্তে রহস্য এক ধাপ এগোয়, অচেনা কেউ না কেউ তাকে সতর্ক করে। এবারও তাই। কোটপরা মানুষটা হাত তুলে স্পষ্ট ইঙ্গিত দিল—“থেমে যাও।”
রুদ্র স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। “আপনি কে? কেন আমাকে আটকাচ্ছেন?”
কোনও উত্তর এল না। শুধু বাতাসের শিস দিয়ে যেন আওয়াজ ভেসে এল, “সত্যি জানলে বাঁচবে না।”
এরপর চোখের পলকেই মানুষটা মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
রুদ্র হাঁপাতে লাগল। মনে হচ্ছিল, প্রতিটি পদক্ষেপ যেন তাকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তবু পিছিয়ে আসার উপায় নেই। সে জানত, দেবাশীষের আত্মা শান্তি না পেলে এই বাড়ি, এই ইতিহাসের অভিশাপ কোনওদিনও শেষ হবে না।
সে আবার লাইব্রেরির পুরনো আর্কাইভ ঘাঁটতে শুরু করল। গুপ্তসমিতি নিয়ে খোঁজ করতে করতে বেরোল অদ্ভুত কিছু তথ্য। ১৯৪০-৫০ এর দশকে এই শহরে একটা গোপন দল ছিল—“অগ্নিমণ্ডল”। স্থানীয় প্রভাবশালী জমিদাররা নাকি এই সমিতির সদস্য ছিল। তারা তন্ত্র-আচার ব্যবহার করে মানুষকে ভয় দেখাত, ক্ষমতা ধরে রাখত। অনেক গুজব আছে—ওরা মৃত্যুকে ব্যবহার করত শক্তি অর্জনের জন্য।
রুদ্রর বুক কেঁপে উঠল। তাহলে কি দেবাশীষের খুন এই সমিতিরই কাজ ছিল?
পুরনো কাগজের এক কোণে একটি রিপোর্টে নাম পাওয়া গেল—“সমিতির প্রধান: রাজকুমার লাহিড়ী।”
রুদ্র অবাক হয়ে গেল। রাজকুমার লাহিড়ী—এই নাম সে আগে শোনেনি। কিন্তু লাহিড়ী পরিবারের সঙ্গেই যুক্ত। হতে পারে দেবাশীষের চাচা?
সে দ্রুত নোট করে রাখল।
রাতে বাড়িতে ফিরতেই আবার অস্বস্তি শুরু হল। করিডরে মৃদু পদশব্দ। দরজা ঠেলতেই গোপন ঘরের ভেতর থেকে আলো ফুঁটে বেরোল। রুদ্র সাহস করে ঢুকল। প্রতিকৃতি ঝলমল করছে।
“আমি জেনেছি,” রুদ্র বলল। “অগ্নিমণ্ডল নামের এক সমিতি ছিল। তোমাকে ওরা হত্যা করে আত্মাকে বেঁধে রেখেছিল। আর নেতা ছিল রাজকুমার লাহিড়ী।”
প্রতিকৃতির চোখ রক্তলাল দীপ্তিতে জ্বলে উঠল। কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হল—
“হ্যাঁ… চাচা… তিনিই আসল বিশ্বাসঘাতক। ওর লোভ, ওর ক্ষমতার নেশা… আমাকে ধ্বংস করল।”
ঘরের ভেতর হঠাৎ বজ্রপাতের মতো আওয়াজ হল। টেবিলের ওপর ছেঁড়া দলিল ভেসে উঠল। তাতে লেখা—
“সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকার হস্তান্তর করা হবে রাজকুমার লাহিড়ীর নামে।”
তারিখ: ১৯৫৩, দেবাশীষের মৃত্যুর কয়েকদিন পর।
রুদ্রর হাত কেঁপে উঠল। প্রমাণ পেয়ে গেছে সে।
কিন্তু তখনই হাওয়া জমাট বাঁধল। করিডরের দিক থেকে ভেসে এল ভারী পায়ের চাপ। রুদ্র দরজা ফাঁক করে দেখল—একজন দাঁড়িয়ে আছে। কালো কোট, মুখ ঢাকা।
“তুমি অনেক দূর চলে গেছ,” মানুষটা বলল কর্কশ গলায়। “রাজকুমারের নাম উচ্চারণ কোরো না। নয়তো আজ রাতেই তোমার শেষ।”
রুদ্র টর্চ জ্বালাল। আলো পড়তেই মানুষটা মিলিয়ে গেল দেওয়ালের ভেতরে।
সে ভয়ে ঘরে ফিরে এল। কিন্তু ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের জেদ জেগে উঠল—যদি সত্যি এভাবে চাপা পড়ে থাকে, তবে এটাই প্রকাশ করা তার দায়িত্ব।
পরদিন সে বৃদ্ধকে খুঁজতে গেল। বেঞ্চে বৃদ্ধকে পেল না। পাড়ার একজন বলল,
“ও বৃদ্ধ? কাল রাতে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেছে। কেউ খেয়ালও করেনি।”
রুদ্র হতবাক। যে বৃদ্ধ তাকে এতদিন পথ দেখাচ্ছিল, সে-ই যদি অদৃশ্য হয়ে যায়, তবে কি বৃদ্ধও এই সমিতির খেলায় অংশ ছিল? নাকি সত্যিই শাস্তি পেয়েছে?
সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার পথে রুদ্র অনুভব করল কেউ তাকে অনুসরণ করছে। মোড় ঘুরলেই পিছনে পায়ের শব্দ থেমে যাচ্ছে। অবশেষে সাহস করে সে এক অন্ধকার গলিতে দাঁড়াল। হঠাৎ পিছন থেকে ছায়া বেরিয়ে এল। মুখোশ পরা দুই ব্যক্তি তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
“থেমে যাও,” একজন ফিসফিস করল।
“তুমি অভিশাপ জাগিয়ে তুলেছ,” আরেকজন বলল।
রুদ্র প্রাণপণে লড়াই করল। অবশেষে টর্চের আলো দিয়ে এক জনকে ধাক্কা মেরে পালাল। কিন্তু তাদের একজনের মুখোশ খানিকটা খুলে গেল। রুদ্র ঝলক দেখল—ধূসর চুল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, এবং কপালে অদ্ভুত সেই ত্রিভুজ-বৃত্ত প্রতীক আঁকা।
সে দৌড়ে বাড়ি ফিরল। দরজা বন্ধ করে হাঁপাতে লাগল। তখনই গোপন ঘর থেকে আওয়াজ এল—
“অগ্নিমণ্ডল এখনো বেঁচে আছে। তাদের ছায়া তোমার চারপাশে। কিন্তু সত্যি তোমার হাতে পৌঁছে গেছে। এবার শুধু প্রকাশ করতে হবে।”
রুদ্র ভয়ে-রাগে কেঁপে উঠল।
“কীভাবে প্রকাশ করব? কার কাছে?”
কণ্ঠস্বর বলল,
“সবার সামনে… লেখায়, কাগজে, কলমে। তুমি সাংবাদিক। সত্যি লুকোতে পারবে না।”
রুদ্র বুঝল, এই রহস্য ভাঙার একটাই পথ—প্রমাণ নিয়ে রিপোর্ট লিখে ছাপানো। কিন্তু তাতে কি বিপদ এড়ানো যাবে? অগ্নিমণ্ডল কি তাকে ছেড়ে দেবে?
রাত বারোটায় আবার সেই নারীকণ্ঠ ভেসে এল—শান্তশ্রী দেবীর কণ্ঠ।
“আমার ছেলেকে বাঁচাতে পারিনি… কিন্তু তুমি পারবে তার নাম মুক্ত করতে।”
রুদ্র চোখের কোণে জল টের পেল। বুকের ভেতর ভয় আর দায়িত্ব একসঙ্গে কাজ করছিল।
কিন্তু ঠিক তখনই জানলার বাইরে কালো কোটপরা মানুষটা দাঁড়িয়ে উঠল। এবার আর দূরে নয়—একেবারে কাছে। তার হাতের আঙুল কাঁচে ঠুকছে, আর ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি।
“আগামীকাল ভোরেই তোমার মৃত্যু হবে।”
শব্দটা শীতল বাতাস কেটে প্রতিধ্বনিত হল।
রুদ্র জানল, এখন বাঁচার একটাই উপায়—সত্যি প্রকাশ করা, এবং অভিশাপের জাল ছিঁড়ে ফেলা।
শেষ সত্য
রুদ্র জানলার কাঁচে ঠুকতে থাকা কালো কোটপরা মানুষের ছায়া দেখছিল। বুকের ভেতর কাঁপুনি ধরলেও সে জানত—এখন আর পিছিয়ে আসার উপায় নেই। তার হাতে প্রমাণ আছে, তার কাছে দেবাশীষের ডায়েরি, দলিল, আর সবচেয়ে বড় কথা—আত্মার কণ্ঠস্বর। অগ্নিমণ্ডল তাকে চুপ করাতে চাইছে, কিন্তু এখন যদি থেমে যায় তবে সত্যিটা চিরকাল চাপা পড়ে থাকবে।
রাত্রি ভোরের দিকে গড়ালে, রুদ্র ল্যাপটপ খুলে লিখতে শুরু করল। খবরের কাগজের জন্য রিপোর্ট বানাচ্ছিল, কিন্তু আসলে সেটা ছিল তার নিজের লড়াই। প্রতিটি লাইনে সে লিখল—কীভাবে লাহিড়ী পরিবারের ভেতরে ষড়যন্ত্র হয়েছিল, কেমন করে জমির লোভে এক তরুণ উত্তরাধিকারীকে খুন করা হয়, আর কীভাবে তার আত্মাকে বন্দি রাখা হয়েছিল এই বাড়ির গোপন ঘরে।
রুদ্রর আঙুল থামছিল না। একসময় মনে হল যেন কেউ তার কানে ফিসফিস করছে—
“লিখে যাও… লিখে যাও…”
সকাল হতেই রিপোর্ট পাঠিয়ে দিল সে। সম্পাদক প্রথমে অবাক হলেন, পরে টেলিফোনে বললেন,
“এটা বোমার মতো ফাটবে। তুমি নিশ্চিত তো সব প্রমাণ পাকা?”
রুদ্র নিঃশ্বাস ফেলে উত্তর দিল,
“প্রমাণ আছে। আর যদি দরকার হয়, বাড়িটাই সাক্ষী।”
দুপুর নাগাদ খবর ছাপা হল অনলাইন পোর্টালে। শিরোনাম: “লাহিড়ী পরিবারের রহস্য: অগ্নিমণ্ডলের অভিশাপ কি আজও বেঁচে?”
প্রকাশ হতেই ঝড় বয়ে গেল। পাঠক থেকে পুলিশ, সবাই চমকে উঠল। অনেকেই দাবি করল—এটা নিছক গল্প, আবার অনেকে বলল—এ তো বহুদিনের চেপে রাখা সত্যি।
কিন্তু রুদ্র জানত, আসল ঝড় এখনও আসেনি।
সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফেরার সময় সে লক্ষ্য করল, রাস্তায় তাকে অনুসরণ করছে দুজন মানুষ। কালো কোট, মুখোশ ঢাকা। তারা কাছে আসতেই হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
বাড়িতে ঢুকতেই সে গোপন ঘরের দরজা খোলা পেল। ভিতর থেকে আলো বেরোচ্ছে। রুদ্র সাহস করে ঢুকল। প্রতিকৃতি আর নেই—তার জায়গায় এখন এক তরুণের অবয়ব দাঁড়িয়ে। মুখে শান্তির রেখা।
“তুমি পেরেছ,” দেবাশীষের আত্মা ফিসফিস করে বলল। “আমার নাম মুক্ত হয়েছে। অভিশাপ ভাঙছে।”
রুদ্রর চোখে জল এসে গেল। “এখন কি তুমি শান্তি পাবে?”
অবয়ব হেসে মাথা নাড়ল। কিন্তু ঠিক তখনই ঘর হঠাৎ কেঁপে উঠল। দেওয়ালের ভেতর থেকে কর্কশ কণ্ঠ ভেসে এল—
“না… অভিশাপ এত সহজে ভাঙবে না।”
কালো কোটপরা সেই মানুষ এবার প্রতিকৃতির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। মুখোশ খুলে ফেলতেই রুদ্র স্তম্ভিত হয়ে গেল—এ রাজকুমার লাহিড়ীর প্রতিচ্ছবি!
অবয়ব গর্জে উঠল,
“আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না। আমি তাকে বশ করেছি। তাই এতদিন ধরে আমার ছায়া টিকে আছে। তুমি ভেবেছ এক টুকরো লেখায় আমাকে হারাতে পারবে?”
দেবাশীষের আত্মা চিৎকার করে উঠল,
“তোমার লোভ, তোমার বিশ্বাসঘাতকতা শেষ হবে আজ!”
ঘর কেঁপে উঠল। বজ্রপাতের মতো শব্দে মেঝে ফেটে গেল। ঠান্ডা হাওয়া বইতে লাগল, টেবিলের কাগজপত্র উড়ে গেল। রুদ্র দাঁড়িয়ে রইল মাঝখানে, যেন সাক্ষী এই লড়াইয়ের।
রাজকুমারের অবয়ব ঝাঁপিয়ে পড়ল দেবাশীষের ওপর। কিন্তু মুহূর্তেই প্রতিকৃতির চোখ থেকে আগুনের মতো আলো বেরোল। অবয়ব পিছিয়ে গেল। গর্জে উঠল,
“তুমি শান্তি পেতে পারবে না! আমি এই বাড়ি, এই শহর ছেড়ে যাব না।”
রুদ্র বুক কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করল,
“যে সত্যি প্রকাশ হয়েছে, তাকে কেউ আটকাতে পারে না। তুমি মরে গেছ, রাজকুমার। এখন তোমার সময় শেষ!”
মুহূর্তেই চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। তারপর এক অদ্ভুত আলো ঘর ভরিয়ে দিল। রাজকুমারের অবয়ব হাহাকার করতে করতে মিলিয়ে গেল হাওয়ায়।
দেবাশীষের আত্মা ধীরে ধীরে রুদ্রর দিকে তাকাল। মুখে এক শান্ত হাসি।
“ধন্যবাদ… আমাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। এখন আর অভিশাপ থাকবে না।”
আলোর ঝলকে অবয়ব মিলিয়ে গেল। প্রতিকৃতি ফ্রেম থেকে খসে পড়ল মেঝেতে। কাঁচ ভেঙে গেল। ছবির কাগজ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল।
ঘর নিস্তব্ধ। বাতাস থেমে গেছে। যেন দীর্ঘকাল পরে বাড়িটার বুক হালকা হল।
রুদ্র হাঁপাতে হাঁপাতে করিডরে বেরোল। বাইরের আকাশ তখন ভোরের আলোর মতো উজ্জ্বল। মনে হল—অবশেষে মুক্তি।
কিন্তু গল্প এখানেই শেষ নয়।
কয়েকদিন পর খবরের কাগজে রুদ্রর লেখা নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরু হল। পুলিশ পুরনো কেস আবার খোলার চেষ্টা করল। অনেকেই বলল, এগুলো নিছক কুসংস্কার। আবার অনেকেই বলল, এ এক ঐতিহাসিক সত্যি যা এতদিন চাপা ছিল।
রুদ্র বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় উঠে গেল। তবু মাঝরাতে অনেক সময় তার ঘুম ভেঙে যায়। মনে হয়, করিডরে এখনও কারও পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
একদিন ডাকবাক্সে আবার পেল একটি খাম। ভেতরে কেবল একটি কাগজ—
“সত্যি কখনও শেষ হয় না। প্রতিটি দরজা আবার খোলে।”
রুদ্রর বুক ঠান্ডা হয়ে গেল। বাইরে তাকাল—মাঠের ধারে কোনও মানুষ নেই, কিন্তু হাওয়ায় কেমন এক শূন্য হাসি ভেসে বেড়াচ্ছে।
হয়তো সত্যিই রহস্যের শেষ নেই। প্রতিটি অদৃশ্য দরজা কেবল আরেকটা দরজার শুরু।
সমাপ্ত