আত্রেয়ী প্রধান
মফস্বলের ছোট্ট স্টেশন। চারপাশে ধুলো উড়ছে, শিউলি গাছের নিচে পড়ে থাকা সাদা ফুলে ভরে গেছে পথ। বিকেলের আলো ধীরে ধীরে নেমে আসছে, আকাশের রং লালচে হয়ে উঠছে। এই সময়টায় স্টেশনটা যেন অন্যরকম লাগে—না শহরের কোলাহল, না গ্রামের নির্জনতা। মাঝামাঝি কোথাও দাঁড়িয়ে থাকা এই স্টেশন এক অদ্ভুত নীরবতার মধ্যে মোড়া।
অমৃতা প্রায়ই এখানে আসে। তার কলেজ থেকে হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনে পৌঁছোতে সময় লাগে পনেরো মিনিট। কেন আসে, সে নিজেও ঠিক জানে না। হয়তো এই স্টেশনের নীরবতা তার ভেতরের অস্থিরতাকে শান্ত করে। হয়তো ট্রেনের হুইসেল শুনলেই মনে হয় সে একদিন অচেনা কোথাও চলে যাবে, যেখানে কেউ তাকে চিনবে না।
আজও সে বসেছিল প্ল্যাটফর্মের পুরোনো কাঠের বেঞ্চে। হাতে একটা বই খোলা, কিন্তু পড়ায় মন নেই। ঠিক তখনই পাশের চায়ের দোকানে ঢুকল শুভ। কলেজের বইয়ের বোঝা হাতে, চুলে হালকা ঘাম জমে উঠেছে। দোকানদারকে বলল,
— দাদা, এক কাপ লিকার দিন।
শুভ যখন কাপটা হাতে নিয়ে ঘুরল, চোখাচোখি হল অমৃতার সঙ্গে। মুহূর্তটা ছোট, কিন্তু অদ্ভুতভাবে দীর্ঘ হয়ে গেল। অমৃতার বুকের ভেতর হঠাৎ কেমন যেন দপ করে উঠল। শুভ হালকা হেসে তাকাল, তারপর তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিল।
এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই এই একই সময়ে তাদের দেখা হতে থাকে। শুভ চা খেতে আসে, অমৃতা বেঞ্চে বসে বইয়ের পাতায় চোখ রাখে। কিন্তু দু’জনেই জানে, বই পড়া বা চা খাওয়া কোনো কারণ নয়—অদৃশ্য একটা টান প্রতিদিনই তাদের এখানে টেনে আনে।
শুভ খুব কম কথা বলে। বন্ধুদের মাঝেও তাকে একটু শান্ত, চুপচাপ বলেই সবাই চেনে। কলেজে মেয়েরা তার দিকে তাকায়, কিন্তু সে কারো সঙ্গে তেমন মিশতে চায় না। অথচ অমৃতার সামনে দাঁড়ালেই তার বুকের ভেতর কেমন একটা অচেনা সাহস জাগে—যেন সে কথা বলতে পারবে।
অমৃতাও ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করল, এই নীরব দৃষ্টি বিনিময়ের মধ্যে একটা গল্প জমে উঠছে। সে জানে না শেষ পর্যন্ত কী হবে, কিন্তু অপেক্ষার এই মুহূর্তগুলোই যেন তাকে বাঁচিয়ে রাখে।
একদিন ট্রেন আসতে একটু দেরি হচ্ছিল। প্ল্যাটফর্ম প্রায় ফাঁকা। অমৃতা তখনও বেঞ্চে বসে। শুভ এগিয়ে এসে পাশের জায়গায় বসে পড়ল। কয়েক সেকেন্ড নীরবতা, তারপর শুভ মৃদু গলায় বলল,
— তুমি কি প্রতিদিন এখানে আসো?
অমৃতা চমকে তাকাল। বুকের ভেতর ঢেউ খেলল, কিন্তু ঠোঁটে শুধু একটা ছোট্ট হাসি ফুটল।
— হ্যাঁ… আর তুমি?
শুভও হাসল।
— হয়তো তোমাকে দেখার জন্যই আসি।
অমৃতার চোখে আলো ঝিলিক দিল। জীবনের প্রথম সত্যিকারের কথোপকথন, অথচ মনে হচ্ছিল যেন বহুদিনের চেনা।
স্টেশনের দূরে তখন ট্রেনের হুইসেল বাজল। চারপাশের ধুলো হাওয়া হয়ে উড়ল, কিন্তু তাদের দু’জনের ভেতরে শুরু হল একেবারে অন্যরকম এক যাত্রা—নিঃশব্দ, কিন্তু গভীর।
সেই দিনের পর থেকে অমৃতা আর শুভর মধ্যে যেন এক অদ্ভুত বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। কথাবার্তা খুব বেশি নয়, কিন্তু যতটুকু হয় তাতে একটা অদ্ভুত স্বস্তি মিশে থাকে। স্টেশনের বেঞ্চ যেন তাদের দু’জনের গোপন জায়গা হয়ে উঠল। প্রতিদিন প্রায় একই সময়ে তারা দু’জন বসে, আর চারপাশের কোলাহল থেকে দূরে নিজেদের নীরব জগতে ঢুকে পড়ে।
অমৃতা হঠাৎই একদিন শুভকে জিজ্ঞেস করল—
— তুমি এত চুপচাপ কেন? তোমার বন্ধুরা বলে তুমি নাকি একেবারেই মিশুক নও।
শুভ হেসে মাথা নিচু করল।
— চুপচাপ থাকলে মানুষকে বোঝা সহজ হয়। অনেক সময় বেশি বললেই ভুল হয়ে যায়।
অমৃতা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। সত্যিই, শুভর ভেতরে যেন কোনো এক গভীর নীরবতা আছে, যা তাকে আলাদা করে দেয়।
সেদিন বিকেলে দু’জন হাঁটতে হাঁটতে স্টেশন থেকে বেরোল। রাস্তার দুই পাশে খেজুরগাছ আর শিউলি ফুল ঝরে পড়া পথ। বাতাসে একটা গরমে-মেশানো নরম গন্ধ। শুভ হঠাৎ থেমে গেল।
— জানো, আমি ছোটবেলায় প্রায়ই ট্রেনের পেছনে দৌড়তাম। মনে হত কোথাও চলে যাব, নতুন জায়গা দেখব।
অমৃতা হেসে বলল—
— আমি তো এখনও সেই স্বপ্ন দেখি। মনে হয় একদিন ট্রেনে চেপে চলে যাব, অনেক দূরে।
তাদের চোখে এক মুহূর্তের জন্যে একসাথে ধরা পড়ল একই স্বপ্ন।
কিন্তু মফস্বল শহরে এমন সম্পর্কের কথা সবাই মেনে নেয় না। শিউলি গাছের নিচ দিয়ে হাঁটার সময় পাশের এক প্রতিবেশী চোখ কুঁচকে তাকাল। অমৃতা জানে, এই শহরে কথা ছড়াতে সময় লাগে না। তবু সে থামল না। শুভর পাশে হাঁটার ভেতরে এমন এক শান্তি আছে, যা কোনো ভয়ের চেয়ে অনেক বড়।
দিনগুলো যেতে থাকে। শুভর কলেজে পরীক্ষা শুরু হলো, অমৃতারও প্রজেক্ট জমা দেওয়ার চাপ। তবু তারা প্রতিদিন বিকেলটুকু একসাথে কাটায়। কখনও শুধু স্টেশনের বেঞ্চে বসে থেকে, কখনও স্টেশনের কাছের মাঠে গিয়ে ঘাসের উপর শুয়ে আকাশ দেখে।
একদিন আকাশে হঠাৎ মেঘ জমে এলো। বৃষ্টি নামল ঝমঝম করে। অমৃতা দৌড়ে এসে দাঁড়াল স্টেশনের ছাউনির নিচে। শুভও ভিজে দৌড়ে এল। দু’জনের ভিজে চুল থেকে জল পড়ছে, চোখে জল আর হাসি একসাথে মিশে আছে। শুভর বুকের ভেতর তখনই কেমন এক ঝড় উঠল। সে ঠোঁট নড়াল, কিন্তু শব্দ বেরোল না। শুধু অমৃতার দিকে তাকিয়ে রইল।
অমৃতা সেই দৃষ্টি পড়ল। বুকের ভেতর হঠাৎ অকারণ কাঁপুনি এল। তবু সে হাসল।
— চুপচাপ থাকলে সব বোঝানো যায় নাকি?
শুভ তাকিয়ে রইল, নীরবতায় ভরা চোখ। বাইরের বৃষ্টি যেন তার ভাষা হয়ে উঠল।
শহরের ছোট্ট পরিসরে খবর ছড়াতে সময় লাগে না। কয়েকদিন ধরে স্টেশনে, মাঠে শুভ আর অমৃতাকে একসাথে দেখেছে অনেকে। প্রথমে ফিসফাস, তারপর ধীরে ধীরে গুঞ্জন। চায়ের দোকানের আড্ডায়, রিকশার আসনে বসা লোকেদের কথায়, এমনকি বাজারের সবজিওয়ালার মুখেও উঠে আসতে লাগল তাদের নাম।
অমৃতার মা একদিন সরাসরি প্রশ্ন করলেন—
— তুমি কি কারও সঙ্গে বেশি ঘোরাঘুরি করছো?
অমৃতা চুপ করে গেল। বুকের ভেতর ধাক্কা খেলেও চোখ নামিয়ে নীরবে বলল—
— কলেজের বন্ধু মাত্র।
কিন্তু মায়ের চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সে টের পেল। মফস্বলের সমাজে মেয়েদের স্বাধীনতা অনেক সীমিত। কথাটা জানে অমৃতা, তবু শুভর পাশে কাটানো মুহূর্তগুলো যেন সব ভয় ভুলিয়ে দেয়।
অন্যদিকে শুভরও কিছু চাপ আসতে লাগল। তার এক বন্ধুই একদিন মজা করে বলল—
— কী রে, নীরব দারুণ প্রেম জমাচ্ছিস নাকি?
শুভ কিছু বলল না। শুধু হেসে চুপ করে থাকল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে বুঝল, এই নীরব সম্পর্ক এখন আর শুধু তাদের দু’জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বাইরের পৃথিবীও ধীরে ধীরে তাদের ভেতরে ঢুকে পড়ছে।
তবু সন্ধ্যের সময় এলে তারা দু’জনই আবার দেখা করল। অমৃতা সেই কাঠের বেঞ্চে বসেছিল, হাতে বই। শুভ এসে পাশে বসতেই অমৃতা মৃদু গলায় বলল—
— জানো, সবাই আমাদের নিয়ে কথা বলছে।
শুভ ধীরে মাথা নেড়ে বলল—
— জানি। তবু আমি চাই না এই নীরবতাটা ভাঙুক।
অমৃতা তাকিয়ে রইল শুভর মুখের দিকে। তার চোখে যেন এক অচঞ্চল শান্তি। এই ছেলেটার নীরবতাই তাকে আশ্রয় দেয়, আবার এই নীরবতাই ভয়ও দেখায়।
ঠিক তখনই ট্রেন এসে দাঁড়াল স্টেশনে। মানুষের ভিড়ে, হইচইয়ে ভরে গেল চারদিক। শুভ একবার অমৃতার হাত ছুঁয়ে ফেলল, ভিড়ের ভেতরে যাতে হারিয়ে না যায়। অমৃতা কেঁপে উঠল, কিন্তু হাত সরাল না। দু’জনের চোখে তখন একরকম অদ্ভুত সাহস জমে উঠছিল—যেন তারা লড়বে সবার বিরুদ্ধে, যদি লড়াই আসে।
কিন্তু মফস্বলের সমাজ সহজে মেনে নেয় না। পরদিন কলেজে যাওয়ার পথে অমৃতা শুনল কিছু মেয়ের গলা—
— ওই তো, স্টেশনের রোমান্স-গার্ল।
অমৃতার বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠল। সে দ্রুত হাঁটা বাড়াল, কিন্তু চোখের কোণে জল জমে গেল।
সন্ধ্যায় দেখা হলে সে শুভকে বলল—
— সবকিছু এত কঠিন কেন হয় জানো? শুধু শান্তিতে থাকতে চাই, তাও পারি না।
শুভ কিছুক্ষণ নীরব রইল। তারপর আস্তে বলল—
— যদি কষ্ট হয়, আমি দূরে চলে যাব।
অমৃতা অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। বুকের ভেতর কেঁপে উঠল, যেন হঠাৎ আকাশ ভেঙে পড়ছে।
— দূরে গেলে কী হবে শুভ? তুমি যদি না থাকো, আমি বাঁচব কীভাবে?
শুভ প্রথমবার এত গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। ধীরে ধীরে বলল—
— তবে আমাদের এই চুপচাপ প্রেমকে আওয়াজ দিতে হবে, অমৃতা। নাহলে পৃথিবী আমাদের গিলে ফেলবে।
স্টেশনের হুইসেল আবার বাজল। দু’জনের বুকের ভেতরে তখন নতুন করে জন্ম নিচ্ছে এক লড়াই—প্রেমের লড়াই, সমাজের বিরুদ্ধে।
বাড়ির ভেতরে অমৃতার উপর চাপ বাড়তে লাগল। মায়ের দৃষ্টি প্রতিদিনই আরও কঠিন হয়ে উঠছিল। একদিন দুপুরে খাওয়ার সময় মা সরাসরি বলে উঠলেন—
— শুনেছি স্টেশনে তোকে প্রায়ই এক ছেলের সঙ্গে দেখা যায়। নাম কী ওর?
অমৃতা স্তব্ধ হয়ে গেল। কাঁটাচামচ হাত থেকে পড়ে গিয়ে শব্দ করল থালায়। বাবা তখন সংবাদপত্র নামিয়ে তাকালেন, গলা খাঁকারি দিলেন—
— আজকালকার মেয়েরা খুব বেশি স্বাধীনতা চায়। পড়াশোনা করে কী হবে, যদি সংসার সামলাতে না পারে?
অমৃতা কোনো জবাব দিল না। বুকের ভেতর হাহাকার জমে উঠল। সন্ধেবেলা স্টেশনে গিয়ে শুভর পাশে বসে সে প্রায় ফিসফিস করে বলল—
— মা-বাবা জানে সব। এখন হয়তো আমাকে তোমার সঙ্গে দেখা করতে দেবে না।
শুভ চুপ করে শুনছিল। কিছুক্ষণ পরে বলল—
— যদি ওরা না মানে? তুমি কি লড়াই করবে?
অমৃতা মাথা নিচু করে থাকল। চোখে জল ভরে উঠছিল। ছোট মফস্বলের সমাজে বাবা-মায়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাওয়াটা মানে অনেক ঝড় ডেকে আনা।
অন্যদিকে শুভরও বাড়িতে চাপ শুরু হয়েছিল। তার কাকা একদিন বললেন—
— ছেলে, কলেজের পড়াশোনা শেষ করো, চাকরি-বাকরি দেখো। এইসব প্রেমে সময় নষ্ট করলে চলবে না। মফস্বলে কারও কারও মুখে তোমার কথাও শুনছি।
শুভ চুপ করে রইল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে অদ্ভুত একটা শক্তি জেগে উঠছিল।
একদিন বিকেলে, যখন তারা দু’জন মাঠের ধারে বসেছিল, শুভ হঠাৎ বলল—
— তুমি জানো, আমি খুব বেশি স্বপ্ন দেখি না। শুধু একটা স্বপ্ন দেখি—তুমি আর আমি একসাথে থাকব।
অমৃতা তার চোখের দিকে তাকাল। বুকের ভেতর কেঁপে উঠল।
— কিন্তু যদি পরিবার না মানে?
শুভ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
— তখনও আমরা পথ খুঁজে নেব। আমি তোমাকে ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না।
ঠিক তখনই মাঠের ধারে দু’জনকে দেখল কয়েকজন অচেনা মানুষ। তারা হাসাহাসি করে চলে গেল। অমৃতার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। সে জানত, এই দৃশ্যও হয়তো কাল বাজারে আলোচনার বিষয় হবে।
সেই রাতে ঘরে ফেরার পর মা দরজা বন্ধ করে দিলেন। কড়া গলায় বললেন—
— অমৃতা, কাল থেকে আর বাইরে যাওয়া বন্ধ করবে। কলেজ যাবে, সরাসরি বাড়ি ফিরবে। ওই ছেলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখবে না।
অমৃতা কেঁদে ফেলল। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হল, তার চারপাশে সব দরজা বন্ধ হয়ে আসছে।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা দৃঢ়তা জন্ম নিচ্ছিল। শুভর কথা বারবার কানে বাজছিল— “আমাদের চুপচাপ প্রেমকে আওয়াজ দিতে হবে।”
অমৃতা ঠিক করল, সমাজ যতই বাধা দিক, সে শুভকে ছাড়বে না।
অমৃতার উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ নেমে এল। মা প্রতিদিন খেয়াল রাখতেন—কলেজ থেকে কখন ফিরছে, কার সঙ্গে কথা বলছে, মোবাইল ফোনে কাকে মেসেজ দিচ্ছে। এমনকি দরজার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে উঁকি মারতেন। যেন অমৃতার প্রতিটি শ্বাসকেই আটকাতে চাইছেন।
কিন্তু প্রেম একবার শিকড় গেড়ে ফেললে তাকে আর কোনো বেড়া দিয়ে আটকানো যায় না। অমৃতা কলেজে যাওয়ার পথে রিকশা থেকে নেমে, গলিপথ ধরে হেঁটে, ছোট্ট চিঠি গুঁজে দিত শুভর হাতে। আবার শুভও সুযোগ পেলে খাতার পাতায় লিখে দিত ছোট্ট শব্দ— “ভয় পেয়ো না, আমি আছি।”
এই গোপন বিনিময়ই তাদের প্রেমকে আরও গভীর করে তুলল। সমাজের চোখ, পরিবারের কড়া শাসন—সবকিছুর মাঝেও তারা নিজেদের পৃথিবী তৈরি করল।
একদিন বিকেলে, কলেজ শেষে অমৃতা ইচ্ছে করে অন্য রাস্তা ধরে হাঁটল। রাস্তার ধারে পুরনো শিমুলগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল শুভ। অমৃতা কাছে যেতেই শুভ ফিসফিস করে বলল—
— তোমার মা কি এখনও কড়া নজর রাখছে?
অমৃতা মাথা নেড়ে হেসে ফেলল।
— আরও বেশি। তবু তোমাকে না দেখে থাকতে পারি না।
শুভর চোখে অদ্ভুত ঝিলিক দেখা গেল।
— আমি একদিন তোমাকে নিয়ে এই শহর ছাড়ব, অমৃতা।
অমৃতা চমকে উঠল।
— এত সহজ নাকি?
শুভ ধীরে বলল—
— সহজ নয়। কিন্তু অসম্ভবও নয়।
তারা দু’জন খুব কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। বাতাসে গরম, পাখিদের ডাক, দূরে বাজছিল মসজিদের আজান। সেই মুহূর্তে অমৃতার বুকের ভেতর এমন এক আলোড়ন উঠল, যা কোনো শব্দে বোঝানো যায় না।
কিন্তু ঠিক তখনই হঠাৎ রাস্তার ধারে দু’জন লোক থেমে গেল। তারা দু’জনের দিকে তাকিয়ে একে অপরকে কিছু বলল, তারপর হাঁটতে হাঁটতে হেসে উঠল। অমৃতার বুক কেঁপে উঠল। শুভ হাত ধরে বলল—
— ভয় পেয়ো না। গুজবকে ভয় করলে আমাদের প্রেম টিকবে না।
পরদিনই গুজব আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল। কলেজে, বাজারে, এমনকি অমৃতার বাড়ির কাছাকাছি দোকানদারের মুখেও শোনা গেল তাদের নাম। মায়ের রাগ বেড়ে উঠল ভয়ানকভাবে। এক সন্ধ্যায় মা চিৎকার করে বললেন—
— তুমি আমাদের মুখ কালো করছো! ওই ছেলের সঙ্গে দেখা বন্ধ করো একেবারে।
অমৃতা কিছু বলল না। কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা ফুটে উঠল। জানালার বাইরে তাকিয়ে সে শুধু মনে মনে বলল—
— শুভ, আমি তোমাকে ছাড়ব না। যা-ই হোক না কেন।
সেই রাতে শুভ এক ছোট্ট চিরকুট পাঠাল তার হাতে—
“আগামীকাল সন্ধ্যায় স্টেশনের পেছনে দেখা করো। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
অমৃতার বুক ধড়ফড় করে উঠল। মনে হল সামনে কোনো ঝড় অপেক্ষা করছে।
সন্ধের অন্ধকার ধীরে ধীরে নেমে আসছে। স্টেশনের ভিড় একটু কমে গেলে প্ল্যাটফর্মের পেছনের ফাঁকা জায়গাটা প্রায় নির্জন হয়ে পড়ে। পুরোনো লাল ইটের দেয়াল, ভাঙাচোরা বেঞ্চ, আর পাশে একটা নষ্ট ল্যাম্পপোস্ট—সেখানে দাঁড়িয়েই অমৃতা শুভকে খুঁজে পেল।
শুভ আগেই এসে দাঁড়িয়ে ছিল। চোখে চাপা উত্তেজনা, হাতে কাগজের ছোট্ট ব্যাগ। অমৃতাকে দেখেই এগিয়ে এল।
— তুমি এসেছো, ভয় হয়নি?
অমৃতা হেসে মাথা নেড়ে বলল—
— ভয় পাচ্ছি, তবু তোমাকে না দেখে থাকতে পারিনি।
শুভ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
— অমৃতা, এইভাবে আর লুকিয়ে থাকা সম্ভব নয়। সমাজের চোখ, বাড়ির শাসন—সব মিলিয়ে আমাদের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
অমৃতা চুপ করে তাকিয়ে রইল। তার চোখে ভয়ও আছে, আবার অদ্ভুত সাহসও।
— কী ধরনের সিদ্ধান্ত?
শুভ ব্যাগ থেকে বের করল একটা নোটবুক। তাতে কিছু ঠিকানা, কিছু ফোন নম্বর লেখা।
— আমি ভেবেছি, পড়াশোনা শেষ হলেই চাকরির জন্য অন্য শহরে চলে যাব। তুমি চাইলে… আমার সঙ্গে যাবে।
অমৃতার বুক কেঁপে উঠল। অন্য শহর! মানে এই মফস্বলের গণ্ডি ভেঙে একেবারে নতুন জীবন! কিন্তু সাথে সাথেই বাবার মুখ মনে পড়ল, মায়ের চোখের রাগ মনে পড়ল। চোখের কোণে জল জমে গেল।
— শুভ, এটা এত সহজ না। মা-বাবা ছাড়া… আমি কি পারব?
শুভ মৃদু স্বরে বলল—
— আমি তোমাকে একা হতে দেব না। তুমি শুধু একবার বলো, আমি সব ব্যবস্থা করে নেব।
ঠিক তখনই দূরে থেকে কারও পায়ের শব্দ ভেসে এল। দু’জন চমকে গেল। কেউ যেন তাদের খুঁজতে এসেছে। শুভ দ্রুত অমৃতার হাত ধরল।
— ভয় পেয়ো না।
অমৃতা ফিসফিস করে বলল—
— যদি কেউ দেখে ফেলে?
শুভর চোখে তখন অদ্ভুত দৃঢ়তা।
— দেখুক। এতদিন চুপচাপ থেকেছি, এখন আর লুকোব না।
এক মুহূর্তের জন্য অমৃতা তাকিয়ে রইল তার চোখে। মনে হল এই ছেলেটার নীরবতার ভেতরে এক অদম্য শক্তি লুকিয়ে আছে। তারপর আস্তে আস্তে বলল—
— আমি প্রস্তুত, শুভ। যেখানে তুমি যাবে, আমি যাব।
শুভর বুকের ভেতর হঠাৎ ঝড়ের মতো বয়ে গেল আনন্দ আর ভয়। সে জানত, এই সিদ্ধান্ত সহজ নয়, কিন্তু অমৃতার হাত ধরে যেন সবকিছুই সম্ভব হয়ে উঠছে।
দূরে আবার ট্রেনের হুইসেল বাজল। অন্ধকার আকাশের নিচে, স্টেশনের পেছনে, তাদের প্রতিজ্ঞার মতোই সেই শব্দ ছড়িয়ে পড়ল—একটা নতুন যাত্রার ডাক।
অমৃতার ঘরে যেন হঠাৎ ঝড় নেমে এলো। সেদিন রাতে সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় চুপ করে ছিল। শুভর হাত ধরে করা প্রতিজ্ঞা বারবার কানে বাজছিল— “যেখানে তুমি যাবে, আমি যাব।” অথচ এই ঘরের দেয়াল, বাবা-মায়ের কঠিন মুখ, সমাজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি—সবকিছু যেন তাকে শেকলে বেঁধে রেখেছে।
পরের দিন দুপুরে মা আবার প্রশ্ন করলেন, এবার কড়া গলায়—
— তোমার ওই ছেলের সঙ্গে সত্যিই কী চলছে?
অমৃতা বুক শক্ত করে উত্তর দিল—
— আমি ওকে ভালোবাসি।
ঘর হিম হয়ে গেল। মা চমকে তাকালেন, বাবা চশমা খুলে টেবিলে আছাড় মারলেন।
— লজ্জা করে না তোকে? এখনও কলেজের ছাত্রী, প্রেম করতে বসেছে! আমাদের মান-সম্মান কী হবে?
অমৃতা চোখের জল সামলে বলল—
— মান-সম্মান যদি সত্যিকারের ভালোবাসাকে অস্বীকার করে, তবে সে মান-সম্মান আমার চাই না।
বাবা-মা নির্বাক হয়ে গেলেন। কয়েক মুহূর্তের নীরবতার পর মা ফেটে পড়লেন—
— ঠিক আছে, তাহলে কাল থেকে আর কলেজে যাবে না। ঘরে বসে পড়াশোনা করবি।
অমৃতার বুকের ভেতর হুহু করে উঠল। কিন্তু সে কিছু বলল না। সে জানত, মুখ খোলার মানে আরও ঝড়।
অন্যদিকে শুভর উপরেও চাপ বাড়ছিল। তার কাকা একদিন সরাসরি বলে দিলেন—
— ওই মেয়েটা তোমার জন্য ঠিক নয়। তার পরিবার কখনোই তোমাদের মেনে নেবে না। তুমি যদি এইসব বন্ধ না করো, আমরা তোমাকে আর সাহায্য করব না।
শুভ নীরবে শুনল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার চোখে আগুন জ্বলে উঠল।
সন্ধেবেলায় স্টেশনের বেঞ্চে শুভ অমৃতাকে দেখল না। সে বারবার তাকিয়ে রইল চারপাশে, কিন্তু অমৃতা এল না। বুকের ভেতর কেমন খালি খালি লাগল।
দু’দিন পর হঠাৎই চিঠি পেল শুভ। অমৃতা তার কলেজের এক বান্ধবীর মাধ্যমে গোপনে পাঠিয়েছে। ছোট্ট কাগজে কাঁপা হাতের লেখা—
“আমাকে ঘর থেকে আটকে রাখা হচ্ছে। কিন্তু আমি আমার প্রতিজ্ঞা ভাঙব না। তুমি শুধু অপেক্ষা করো।”
চিঠিটা পড়েই শুভর বুক কেঁপে উঠল। রাগ, ভয় আর ভালোবাসা মিশে এক অদ্ভুত ঝড় তৈরি হল। সে জানল, আর সময় নষ্ট করা যাবে না।
রাতের আঁধারে সে অমৃতাকে একটা ফোন করল। কাঁপা গলায় বলল—
— অমৃতা, আমরা লড়াই করব। তুমি কি প্রস্তুত?
ফোনের ওপাশে কিছুক্ষণ নীরবতা, তারপর ভাঙা গলায় অমৃতা বলল—
— হ্যাঁ, শুভ। আমি প্রস্তুত।
অন্ধকার রাতে তাদের নীরব প্রতিজ্ঞার মধ্যে যেন এক যুদ্ধের ঘোষণা বাজল।
শহরের আকাশে তখন বর্ষার ভারী মেঘ জমে আছে। প্রতিদিনকার মতো গুজব আর নজরদারি বেড়ে চলেছে। অমৃতাকে ঘর থেকে প্রায় বন্দি করে রাখা হচ্ছে। তবু মনের ভিতর জ্বলতে থাকা আগুন কেউ নেভাতে পারছে না। সে জানত, শুভ তাকে টেনে নিয়ে যাবে নতুন এক পৃথিবীর দিকে।
শুভ দিনরাত পরিকল্পনা করছে। বন্ধুর কাছ থেকে ধার করা মানচিত্র, পুরোনো ডায়েরিতে লেখা ট্রেনের সময়সূচি, আর সামান্য কিছু টাকা—সব জড়ো করেছে। সে ভেবেছে, বড় শহরে গিয়ে প্রথমে একটা ছোটখাটো চাকরি করবে, তারপর ধীরে ধীরে নতুন জীবন শুরু করবে।
এক সন্ধ্যায় সুযোগ পেয়ে অমৃতা আবার চিঠি পাঠাল। কাগজে শুধু চারটি শব্দ—
“আমি প্রস্তুত, কবে?”
শুভর বুক কেঁপে উঠল। সে জানল, আর দেরি করা যাবে না।
দু’দিন পর রাতে সে অমৃতাকে ফোনে জানাল—
— শনিবার ভোরের ট্রেন। স্টেশনের পেছনে এসে দাঁড়াবে। আমরা চলে যাব।
অমৃতার বুক ধুকপুক করতে লাগল। ভয় আর উত্তেজনায় তার হাত কাঁপছিল।
— শুভ… যদি কেউ দেখে ফেলে?
শুভ দৃঢ় গলায় বলল—
— দেখুক। এতদিন চুপ করে থেকেছি, এখন আর পিছিয়ে আসব না।
কিন্তু মফস্বলের শহর এত সহজ নয়। তাদের গোপন পরিকল্পনার আভাস কিছু মানুষের কানে পৌঁছে গেল। অমৃতার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় সন্দেহ করছিল অনেকদিন। সে একদিন হঠাৎ অমৃতাকে জানালার ধারে বসে চিঠি লিখতে দেখে ফেলল। খবর ছড়িয়ে পড়ল মুহূর্তেই।
শনিবার ভোর আসতে না আসতেই অমৃতার ঘরে পাহারা বসানো হল। মা দরজার বাইরে বসে রইলেন, বাবা কঠিন মুখে সংবাদপত্রে চোখ রাখলেন।
কিন্তু অমৃতার বুকের ভিতর তখন ঝড় বইছে। তার মনে হচ্ছিল, জানালার বাইরের হুইসেল বাজছে শুধু তার জন্য। শুভ হয়তো ইতিমধ্যেই স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে।
সত্যিই তাই। শুভ দাঁড়িয়ে ছিল স্টেশনের অন্ধকার প্রান্তে, হাতে ছোট ব্যাগ। আকাশে তখন প্রথম আলোর রেখা উঠছে। চারপাশে টুকটুক করে জোনাকি মিলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার চোখে ছিল শুধু একটাই আশা—অমৃতা আসবে।
সময় কেটে যাচ্ছিল। ট্রেন আসতে দেরি নেই। শুভর বুকের ভেতর কাঁপুনি উঠছিল। সে জানত, অমৃতাকে যদি আটকানো হয়, তবে আজীবনের জন্য তারা আলাদা হয়ে যাবে।
এদিকে অমৃতা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে কাঁপা হাতে ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে ছিল। মায়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর বাবার কঠোর মুখ তার মনে ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছিল, কিন্তু শুভর হাতের প্রতিজ্ঞা বারবার মনে পড়ছিল।
শেষ মুহূর্তে সে নিজের বুকের ভেতর থেকে সাহস জোগাড় করল। জানালার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পড়ল ভোরের আঁধারে।
ট্রেনের হুইসেল দূরে বাজতে শুরু করল। শুভর চোখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল—অন্ধকার ভেদ করে ছুটে আসছে অমৃতা।
কিন্তু ঠিক তখনই, স্টেশনের প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন লোক তাদের দেখে ফেলল। প্রতিবেশী, আত্মীয়, আর কিছু কৌতূহলী চোখ। তাদের দৃষ্টি যেন ধারালো ছুরির মতো কেটে যাচ্ছিল।
শুভ দাঁতে দাঁত চেপে অমৃতার হাত ধরল।
— এবার পিছু হটলে সব শেষ।
অমৃতা শ্বাসকষ্টের মতো কাঁপছিল, কিন্তু হাত ছাড়ল না।
ট্রেন ঢুকে পড়ল প্ল্যাটফর্মে। মানুষের ভিড়, হইচই, চিৎকার—সবকিছুর ভেতর দিয়ে তারা এগিয়ে চলল, যেন ঝড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন।
ট্রেন তখন প্ল্যাটফর্মে ঢুকেছে। হুইসেলের শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠছে। লোকজন দৌড়ে উঠছে বগিতে, কন্ডাক্টরের হাঁকডাক, ঠেলাঠেলি—সব মিলিয়ে বিশৃঙ্খলা। সেই ভিড়ের মাঝেই শুভ অমৃতার হাত শক্ত করে ধরে টেনে এগোচ্ছিল। দু’জনের চোখে তখন শুধু একটাই দৃঢ়তা—আজ তারা থামবে না।
কিন্তু প্ল্যাটফর্মের অন্য প্রান্তে দেখা গেল পরিচিত মুখ। অমৃতার মামা, দুই প্রতিবেশী, আর কয়েকজন আত্মীয় দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখে রাগ আর কৌতূহল মিশে এক অদ্ভুত আগুন। একজন চিৎকার করে উঠল—
— ওরা পালাচ্ছে! থামাও!
মুহূর্তের মধ্যে চারপাশের নজর ঘুরে গেল তাদের দিকে। অমৃতার বুক ধড়ফড় করে উঠল। শুভ দাঁতে দাঁত চেপে বলল—
— ভয় পেয়ো না, দৌড়াও!
দু’জন ছুটে গেল প্ল্যাটফর্ম ধরে। পিছনে চিৎকার, লোকজনের ধাওয়া। বগির সিঁড়ি তখন হাতের কাছে। শুভ প্রথমে অমৃতাকে ঠেলে তুলতে গেল। অমৃতা হাত বাড়াল, কিন্তু হঠাৎই কারও শক্ত হাত তার আঁচল চেপে ধরল।
— কোথায় পালাচ্ছিস? — কড়া গলায় বলে উঠল তার মামা।
অমৃতা চিৎকার করে উঠল—
— ছাড়ো আমাকে!
শুভ ততক্ষণে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তার চোখে সেই চুপচাপ ছেলেটির রূপ নেই, আছে আগুন।
— ওকে কেউ আটকাবে না!
শুভ ধাক্কা দিয়ে লোকটিকে সরিয়ে দিল। ভিড়ের মধ্যে হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। কেউ বলল, “এভাবে চলে যাওয়া লজ্জার!”, কেউ বলল, “ওদের ভালোবাসা আটকানো যায় নাকি?”
অমৃতার চোখ ভিজে উঠল। শুভর এই রূপ সে আগে কখনও দেখেনি—চুপচাপ ছেলেটি আজ যেন বজ্রের মতো গর্জে উঠেছে।
শুভ আবার তার হাত ধরল।
— ওঠো, সময় নেই!
ঠিক তখনই বাবার কণ্ঠ ভেসে এল। অমৃতার বাবা দমফাটা গলায় চিৎকার করলেন—
— অমৃতা! এক পা এগোলে আর এই বাড়িতে ফিরতে হবে না!
অমৃতা মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। বুকের ভেতর কেমন যেন শূন্য হয়ে গেল। চোখে ভেসে উঠল মায়ের মুখ, সেই ছোটবেলার ঘর, শিউলি গাছের নিচে খেলা করা দিনগুলো।
কিন্তু শুভ তার হাত শক্ত করে ধরে বলল—
— তুমি যদি আজ পিছিয়ে যাও, তবে আমাদের আর কিছু থাকবে না।
ট্রেন তখন হুইসেল বাজিয়ে ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
অমৃতা কাঁপা গলায় বলল—
— আমি তোমার সঙ্গেই যাব।
লোকজনের চিৎকার, আত্মীয়দের রাগ, বাবার হুমকি—সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে তারা দু’জন দৌড়ে উঠল বগির সিঁড়ি বেয়ে। ট্রেন ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে শুরু করল।
প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের মুখ ধীরে ধীরে দূরে সরে গেল। চিৎকার মিলিয়ে গেল রেললাইনের শব্দে। অমৃতা শুভর বুকের ভেতর মুখ লুকিয়ে কেঁদে ফেলল।
শুভ মাথায় হাত রেখে ফিসফিস করল—
— আমরা পেরেছি, অমৃতা। এবার থেকে আর শুধু “চুপচাপ শুভ” নয়—আমাদের গল্প সবার সামনে বাজবে।
ট্রেন ছুটে চলল অচেনা আকাশের দিকে। কিন্তু দু’জনের চোখে তখন একটাই সত্য—তারা একসাথে, এটাই সবচেয়ে বড় জয়।
ট্রেন ছুটে চলল লালচে আকাশের ভেতর দিয়ে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে অমৃতা প্রথমবারের মতো জানালার বাইরে তাকাল। মফস্বলের পরিচিত মাঠ, গলিপথ, শিউলিগাছ সব পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছে। বুকের ভেতর হুহু করছিল, কিন্তু সেই শূন্যতার মাঝেও শুভর হাত শক্ত করে ধরা থাকায় মনে হচ্ছিল সে ভেসে যাচ্ছে এক অচেনা আশ্রয়ের দিকে।
শুভ তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল—
— ভয় পাচ্ছো?
অমৃতা মাথা নেড়ে চোখ মুছল।
— ভয় তো লাগছে, তবু মনে হচ্ছে এটাই সঠিক।
ট্রেন যখন বড় শহরের প্ল্যাটফর্মে ঢুকল, চারদিক ভরা অপরিচিত কোলাহল। বিশাল ভিড়, উঁচু বিলবোর্ড, গরম বাতাসে মিশে থাকা ধোঁয়া—সবই নতুন। দু’জনের হাতে তখন শুধু ছোট্ট ব্যাগ আর একে অপরের প্রতি আস্থা।
প্রথম কয়েকদিন তারা এক বন্ধুর ভাড়া করা ছোট্ট ঘরে উঠল। একখানা খাট, মেঝেতে পাতলা গদি, কোণে একটা টেবিল ফ্যান। কিন্তু সেই ঘরেই যেন তাদের পৃথিবী তৈরি হল। রাত জেগে শুভ চাকরির ফর্ম পূরণ করে, অমৃতা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে সস্তার হাঁড়িতে ভাত ফোটায়। একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েই তারা বুঝল—ভালোবাসা মানে শুধু স্বপ্ন নয়, দায়িত্বও।
এক বিকেলে শুভ অমৃতাকে নিয়ে গেল শহরের নদীর ধারে। আকাশে তখন ঢল নামছে, বাতাসে নোনাধরা গন্ধ। শুভ অমৃতার হাত ধরে বলল—
— দেখো, আমরা কত দূরে চলে এসেছি। সমাজ থামাতে পারেনি আমাদের।
অমৃতা হাসল, চোখ ভিজে উঠল।
— কিন্তু এখন থেকে আমাদের লড়াই অন্যরকম। সংসার চালাতে হবে, নিজেদের জায়গা তৈরি করতে হবে।
শুভ মাথা নেড়ে বলল—
— আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যতই কষ্ট আসুক, তোমাকে কখনো একা হতে দেব না।
নদীর ওপরে তখন সেতুর আলো জ্বলে উঠছিল। অমৃতা শুভর কাঁধে মাথা রাখল। তার মনে হচ্ছিল, যেকোনো লড়াইয়ের মাঝেই যদি এই কাঁধ থাকে, তবে সে সব সামলাতে পারবে।
সময় কেটে যেতে লাগল। শুভ ছোট্ট একটা চাকরি পেল, অমৃতা টিউশনি শুরু করল। জীবন সহজ ছিল না, কিন্তু প্রতিদিনের সংগ্রামের ভেতরে একে অপরকে আঁকড়ে ধরেই তারা বাঁচতে শিখল।
একদিন সন্ধ্যায়, সেই ছোট্ট ঘরের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে অমৃতা হেসে বলল—
— মনে আছে, একসময় সবাই তোমাকে ডাকত “চুপচাপ শুভ”?
শুভও হেসে উঠল।
— আর আজ?
অমৃতা তার হাত ধরে বলল—
— আজ তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে জোরালো আওয়াজ।
দু’জনের হাসি মিশে গেল ঘরের নরম অন্ধকারে। বাইরে তখন শহরের কোলাহল, ভিড়, ট্রেনের শব্দ—সব চলছিল। কিন্তু তাদের দু’জনের পৃথিবী ছিল আলাদা, যেখানে ভালোবাসা সব বাধা পেরিয়ে বেঁচে আছে।
শুভ চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল—
— চুপচাপ আমি নই, চুপচাপ আমাদের প্রেমকথা। কিন্তু সেই নীরবতাই আজ সবচেয়ে বড় সত্যি।
***