Bangla - ভূতের গল্প

হেডফোনের আওয়াজ

Spread the love

এক

অভিষেক রুমের এক কোণে বসে তার ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে চোখ স্থির করে তাকাল। হোস্টেলের ঘরটি ভোরবেলার কেমন অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় মুড়িয়ে আছে, যেখানে কেবল তার নিজের নিশ্বাস আর কিবোর্ডের হালকা শব্দই ভেসে আসছে। ঘরের জানালা দিয়ে ঢোকার সূক্ষ্ম আলো তার চারপাশের সবকিছুকে ফিকে করে দিয়েছে, যেন পুরো রুমটা ধীরে ধীরে বাস্তব থেকে অমূর্তে রূপান্তরিত হচ্ছে। প্রতিদিনের অনলাইন ক্লাসের সময় অভিষেকের কাছে এই নিস্তব্ধতা কিছুটা স্বস্তি দেয়, আবার কিছুটা চাপের অনুভূতিও তৈরি করে। তার একাকীত্ব তাকে মানসিকভাবে কিছুটা ক্লান্ত করেছে, কারণ শহরের এই হোস্টেল জীবনে সামাজিক কোনো সম্পর্ক তার কাছে থাকেনা। ল্যাপটপের হেডফোনটি কানে দিয়ে সে ক্লাসে যোগ দিতে গিয়ে শিক্ষকের কথার সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিল, কিন্তু তার মন মাঝেমধ্যে বিচলিত হয়ে উঠে। অনুভূতিটি এমন—যেন রুমের চারপাশের নিঃশব্দতা তার চারপাশে একটা অদৃশ্য ও ভারী বালিশের মতো চাপিয়ে আছে, এবং সে সেই চাপকে অনুভব করতে পারে।

অভিষেকের চোখ স্ক্রিনের উপরে ঝুলন্ত ভিডিও লেকচারের দিকে ফিক্সড ছিল। অধ্যাপক সেনগুপ্তের কণ্ঠ তখনো ভারী এবং কঠোর, একদিকে যেমন পড়ানোর জন্য উৎসাহ জাগাচ্ছিল, অন্যদিকে কিছুটা ভীতি ও চাপ তৈরি করছিল। অধ্যাপক ছিলেন অভিষেকের জীবনের এমন একজন শিক্ষক, যিনি শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা এবং নিয়মিত উপস্থিতির উপর প্রবল জোর দিতেন। তার চোখ যেন সবসময় পর্যবেক্ষণ করছে, প্রতিটি শিক্ষার্থীর মনোযোগ এবং প্রতিক্রিয়া ধরার জন্য প্রস্তুত। অভিষেক জানত, এক মুহূর্তের অবহেলা বা মনোযোগ না থাকা তার জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। লেকচারের মধ্যে মাঝে মাঝে অধ্যাপক সেনগুপ্ত তার চোখ ক্যামেরার দিকে ঝাপসা করে তাকান, যেন হোস্টেলের সেই অন্ধকার ঘরেও তার উপস্থিতি অনুভূত হয়। অভিষেকের মনে এক অদ্ভুত চাপ তৈরি হয়, কিছুটা ভয়, কিছুটা উত্তেজনা।

ক্লাস চলতে চলতে অভিষেক নিজের চারপাশের ঘরটি লক্ষ্য করতে থাকে। দেয়ালে ঝুলানো ঘড়ির কাঁটা যেন তার হৃদয়ের ছন্দকে প্রতিফলিত করছে, আর পেছনের দিকে সাজানো বইয়ের স্তূপ যেন প্রতিনিয়ত ধ্বনির জন্য প্রস্তুত। হোস্টেলের অন্যান্য শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন শহর থেকে অনলাইনে যোগ দিচ্ছিল, কিন্তু তাদের উপস্থিতি যেন শুধু শব্দের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ, তাদের চোখ বা শরীরের ভাষা অভিষেককে স্পর্শ করতে পারছিল না। এই একাকীত্ব এবং আলাদা পরিবেশ তাকে আরও গভীরভাবে নিজের ভেতরের মনস্তাত্ত্বিক চাপের সঙ্গে যুক্ত করে। সে অনুভব করতে পারে, তার জীবনের রুটিন—যা ক্লাস, পড়াশোনা এবং হোস্টেলের সীমিত জীবন দিয়ে গঠিত—ধীরে ধীরে তার মনকে ঘিরে ফেলছে, যেন একটি নিঃশব্দ অদৃশ্য জাল। হেডফোনের আওয়াজ, অধ্যাপকের কঠোর কণ্ঠ, এবং ঘরের নিস্তব্ধতা একত্রে একটি মিশ্র অনুভূতি তৈরি করছে, যা কখনও ভীতি, কখনও একাকীত্বের ভারী চাপ মনে হচ্ছে।

অভিষেক ক্লাসের মধ্যে মনোযোগ বজায় রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু হঠাৎ তার মনে একটি অদ্ভুত অনুভূতি আসে—হেডফোনের ভেতর দিয়ে এমন শূন্যতার মধ্যে যেন একটা মৃদু ফিসফিস শোনা যাচ্ছে, যা সে প্রথমে নিজের কল্পনা মনে করে উপেক্ষা করে। রুমের নিঃশব্দতা, অধ্যাপকের কণ্ঠ এবং ল্যাপটপের আলো—সবকিছুর মধ্যে এই অদ্ভুত ফিসফিস যেন আরো প্রকট হয়ে উঠে। অভিষেক স্বাভাবিকভাবে দমকে ওঠে, কিন্তু নিজেকে ধরিয়ে নেয়, বলেই মনে করে হয়তো এটা শুধু তার একাকীত্ব এবং মানসিক চাপের প্রভাব। সে হেডফোন ঠিকমত বসিয়ে আবার লেকচারে মনোযোগ দেয়, কিন্তু মনে একটা অদ্ভুত অনুভূতি থেকে যায়—একটি এমন অনুভূতি, যা ভীতির সঙ্গে এক ধরনের আকর্ষণও তৈরি করছে, যেন সে জানে, তার সামনে কিছু এমন ঘটতে যাচ্ছে যা তার জীবনের বাস্তব এবং নিঃশব্দ একাকীত্বকে চিরতরে পাল্টে দিতে পারে।

দুই

অভিষেক তার হেডফোন ঠিকমতো বসিয়ে আবার ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে চোখ স্থির করল। ক্লাসের অডিও ভেসে আসছিল, অধ্যাপক সেনগুপ্তের কণ্ঠ স্বাভাবিকের মতো কঠোর, প্রতিটি শব্দ যেন শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য বাতাসের মতো প্রবাহিত হচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ এক অদ্ভুত ফিসফিসের আওয়াজ তার কানের ভেতর ভেসে আসে। প্রথমে সে ভাবতে থাকে এটি কেবল নেটওয়ার্কের সামান্য গ্লিচ, কারণ অনলাইন ক্লাসের সময় মাঝে মাঝে অদ্ভুত শব্দগুলো হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এই ফিসফিসের আওয়াজ অন্যরকম, এটি সরাসরি তার দিকে কথা বলার চেষ্টা করছে—“তুই কি আমাকে শুনছিস?” শব্দগুলো এতটাই স্পষ্ট যে অভিষেক চমকে ওঠে। হঠাৎ ঘরটা যেন আরো অন্ধকার হয়ে গেছে, হেডফোনের ভেতর প্রতিটি শব্দ তার মস্তিষ্কে হালকা কম্পন তৈরি করছে। সে হাত তুলে হেডফোন ঠিক করে, আবার শব্দের উৎস খুঁজতে থাকে, কিন্তু তার চারপাশ নিঃশব্দ, কেবল ল্যাপটপের স্ক্রিনের নীল আলোই তার রুমের চারপাশে ঝলমল করছে।

এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতা তার মনকে পুরোপুরি ব্যস্ত করে তোলে। সুমন, যিনি পাশের রুমে বসে আছে, হঠাৎ অভিষেকের অস্থিরতা লক্ষ্য করে। সুমন হেসে বলে, “তোকে গ্লিচ দেখাচ্ছে, বা নেটওয়ার্কের সমস্যা।” তবে অভিষেক জানে—এটা কোনো সাধারণ প্রযুক্তিগত ত্রুটি নয়। শব্দটি যেন তার ভেতরের কোন অচেনা অনুভূতিকে ছুঁয়ে যাচ্ছে, একটি ক্ষণস্থায়ী শিহরণ তৈরি করছে। সে হঠাৎ মনে করতে থাকে, এই আওয়াজের সাথে তার মানসিক অবস্থা কিছুটা জড়িয়ে গেছে—হেডফোনের ভেতর দিয়ে আসা শব্দ যেন তার একাকীত্বের ছায়া প্রকাশ করছে। প্রতিটি কথার ভেতর ভেসে আসে একটি অদ্ভুত আবেশ, যা তাকে ভীতও করছে এবং একই সঙ্গে আকৃষ্টও করছে। সে জানে, যদি এটি শুধু তার কল্পনা হতো, তাহলে এমন স্পষ্ট শব্দের অভিজ্ঞতা সম্ভব হতো না।

অভিষেককে ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করে যে এই আওয়াজ কেবল একটি সাধারণ ডিস্টরশন নয়, বরং যেন তার কাছে কোনো বার্তা পৌঁছাচ্ছে। শব্দের ভেতর চাপা যন্ত্রণার মতো কিছু আছে, একটি ক্ষীণ ও দুঃখময় আবেদন, যা তার মস্তিষ্কে গভীরভাবে প্রবেশ করছে। সে হঠাৎ অনুভব করে—যদি এটি বাস্তব হয়, তবে এটি কেবল একটি কণ্ঠ নয়, বরং কারও অভিজ্ঞতা, ব্যথা বা অসমাপ্ত জীবন। সে চোখ বন্ধ করে হেডফোনের ভেতর মনোযোগ দেয়, শব্দের উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা করে, যেন বুঝতে পারে, কে তার সাথে কথা বলছে এবং কেন। অভিষেকের ভেতরের ভয়, আগ্রহ, এবং বিস্ময়—সবকিছু একত্রে মিশে এক অদ্ভুত মানসিক উত্তেজনা তৈরি করে।

ক্লাসের বাকি অংশ চলতে থাকে, কিন্তু অভিষেক এখন আর সাধারণভাবে লেকচারে মনোযোগ দিতে পারছে না। সে বারবার হেডফোন ঠিক করছে, শব্দের প্রতি অদ্ভুতভাবে সংবেদনশীল হয়ে উঠছে। প্রতিটি শব্দ তার মনকে চিড়িয়ে দিচ্ছে, এবং তার মনে প্রশ্ন জাগছে—এটা কি আসলেই কোনো প্রাক্তন ছাত্রের আওয়াজ, নাকি কেবল তার কল্পনা? পাঠকও এই মুহূর্তে অভিষেকের সাথে অনুভব করবে সেই অদ্ভুত শূন্যতা, যেখানে প্রযুক্তিগত ত্রুটি এবং অতিপ্রাকৃতির সংমিশ্রণ ধীরে ধীরে গল্পের রহস্য তৈরি করছে। এই অধ্যায়ে, প্রথমবার সেই কণ্ঠ ভেসে আসে, যা পুরো গল্পের ভীতিকর ও রহস্যময় আবহের ভিত্তি স্থাপন করে, এবং পাঠককে এক অদ্ভুত উত্তেজনায় টেনে নিয়ে যায়।

তিন

অভিষেক আবার তার ল্যাপটপের সামনে বসে ক্লাস শুরু করে। রুমের নিস্তব্ধতা যেন আরও গভীর হয়ে গেছে; জানালা দিয়ে ঢোকার আলো কমে গেছে, এবং দেয়ালের ছায়াগুলো হঠাৎ বড় এবং অদ্ভুতভাবে বিকৃত মনে হচ্ছে। হেডফোন কানে দিয়ে সে অধ্যাপক সেনগুপ্তের বক্তৃতা শোনার চেষ্টা করছে, কিন্তু এই মুহূর্তে তার মন পুরোপুরি অন্যদিকে মনোযোগ দিচ্ছে। হঠাৎ আবার সেই কণ্ঠ ভেসে আসে, এবার আগের চেয়ে অনেক স্পষ্ট: “তুই কি আমাকে শুনছিস?” শব্দটি এতটা বাস্তবিক যে অভিষেক চমকে ওঠে, হাত স্বয়ংক্রিয়ভাবে হেডফোন ঠিক করতে চলে যায়। হঠাৎ ঘরের চারপাশের নিস্তব্ধতা আরও তীব্র হয়ে ওঠে, যেন সময় থেমে গেছে। প্রথমবারের মতো সে ভয় পেলেও এবার সে বুঝতে পারে, এটি কোনো সাধারণ নেটওয়ার্ক গ্লিচ নয়। শব্দের ভেতরে যেন চাপা আতঙ্ক এবং এক অজানা আকর্ষণ মিলেমিশে আছে, যা তার হৃদয়কে অচেতনভাবে টানে।

কণ্ঠের সঙ্গে ধীরে ধীরে কিছু অচেনা আবহ প্রকাশ পেতে থাকে। অভিষেক চোখ বন্ধ করে বসে শোনে, এবং মনে হয় যেন শব্দের ভেতর থেকে কোনো ছায়াময় প্রাণ ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে। প্রথমে তা কেবল অন্ধকারের মধ্যে ঝলমল করছে, আর চোখে কিছু দেখা যাচ্ছে না, শুধু কণ্ঠের ভেতরের যন্ত্রণা তার হৃদয়ে স্পর্শ করছে। অভিষেকের হৃদয় দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে, সে অনুরূপ কোনো অভিজ্ঞতা আগে কখনো পাননি। হঠাৎ কণ্ঠের ভেতর একটি ক্ষীণ কণ্ঠফিসফিস শুনতে পায়, যা যেন তার ভেতরের এক অজানা ভয়কে জাগিয়ে তোলে। শব্দটি ভয়ঙ্কর এবং অপ্রত্যাশিত, কিন্তু সেই সঙ্গে একটি অদ্ভুত আকর্ষণও তৈরি করে—যেন সে জানে, তার সামনে কিছু রহস্যময় ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।

সুমন পাশের রুমে বসে হঠাৎ অভিষেকের আচরণ লক্ষ্য করে। সে প্রথমে হেসে বলে, “তোকে আবার গ্লিচ দেখাচ্ছে। একেবারেই প্রযুক্তিগত ত্রুটি।” তবে সুমনের চোখের কোণ থেকে বোঝা যায়, ভিতরে সে কিছুটা শঙ্কিত। অভিষেকের অস্থিরতা এবং হঠাৎ চমকে ওঠার ভঙ্গি তাকে অস্বস্তিকরভাবে চিন্তিত করে। সুমন জানে, সবকিছু সাধারণ প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে নয়, তবে সে নিজের যুক্তির উপর দাঁড়াতে চায়। সে অভিষেককে ধমক দেয় না, কিন্তু তার ভেতরের ভয় এবং অস্বস্তি তাকে ভাবায়—কী হলো যা সে স্বাভাবিকভাবে বুঝতে পারছে না। এই দ্বন্দ্ব, বাস্তব বনাম সম্ভাব্য অতিপ্রাকৃত, অধ্যায়ের ভেতর একটি চরম উত্তেজনা তৈরি করে, যা পাঠককে অব্যাহতভাবে অভিষেকের অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত রাখে।

অভিষেক নিজেকে বলছে যে এটি হয়তো তার মানসিক চাপের প্রতিফলন, তবে কণ্ঠ এতটা বাস্তব এবং স্পষ্ট যে তাকে উপেক্ষা করা অসম্ভব। সে হঠাৎ অনুভব করে, এই শব্দগুলো কেবল তার কল্পনা নয়, বরং কোনো জীবিত অভিজ্ঞতা বা ছায়াময় অস্তিত্বের প্রকাশ। হেডফোনের ভেতর প্রতিটি শব্দ যেন তার রক্তে প্রবাহিত হচ্ছে, তার মনকে চাপা ভয় এবং কৌতূহলে জর্জরিত করছে। ধীরে ধীরে, কণ্ঠ শুধু ভয় দেখাচ্ছে না, বরং তার উপস্থিতি আবিষ্কারের চেষ্টা করছে, যেন সে অভিষেকের মনস্তত্ত্বের ভেতর প্রবেশ করতে চাইছে। অধ্যায়ের শেষে পাঠকও অভিষেকের ভেতরের দ্বন্দ্ব অনুভব করবে—ভয়, কৌতূহল এবং অসমাপ্ত রহস্য একসাথে মিলেমিশে তার অভিজ্ঞতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে, যা পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য উত্তেজনা তৈরি করছে।

চার

রুমের দরজা হঠাৎ খোলার শব্দে অভিষেক চমকে উঠে। হেডফোনের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে ভেসে আসা কণ্ঠটি স্থবির হয়ে গেল, আর তার মন কিছুটা স্বস্তি পেল। মায়া ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করে, হাতে এক ছোট ব্যাগে রাখানো বই ও খাতা। অভিষেককে দেখে সে অদ্ভুতভাবে কিছুটা লাজুকভাবে হাসে। মায়া, রুদ্রর ছোট বোন, প্রথমবার আসে তার ভাইয়ের পুরোনো জিনিসগুলো নিতে, কারণ দীর্ঘদিন রুদ্রর রুম ফাঁকা ছিল এবং হোস্টেলের নীতিমালা অনুযায়ী তার মালামাল সরিয়ে নেওয়া দরকার। অভিষেক প্রথমে অবাক হয়, কারণ সে আগে কখনো মায়াকে দেখেনি, তবে একই সঙ্গে মনে হয় যেন এই আগমন কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। রুমের স্থিরতা, বইয়ের স্তূপ, এবং মায়ার উপস্থিতি— একসাথে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করে যা অতীতের স্মৃতিকে ধীরে ধীরে জীবিত করে তোলে।

মায়া ধীরে ধীরে একটি পুরোনো খাতা তুলে ধরে এবং বলল, “এইগুলো ভাইয়ের লেখা। আমি কিছুটা দেখতে চাই যে সে কি লিখত।” অভিষেক খাতা গ্রহণ করে, এবং সেই মুহূর্তে হঠাৎ হেডফোনের ভেতর থেকে রুদ্রের কণ্ঠ খুব স্পষ্টভাবে আসে—“তুই কি আমাকে বুঝতে পারছিস?” শব্দটি এতটাই বাস্তব, যেন রুমের ভিতরে কেউ সত্যিই উপস্থিত। অভিষেক হালকা কাঁপুনি অনুভব করে, কিন্তু এবার সে ভয়কে উপেক্ষা করে এবং খাতায় লেখা কিছু শব্দ লক্ষ্য করতে শুরু করে। সেখানে লেখা ছিল তার ছাত্রজীবনের চাপ, একাকীত্ব, এবং সেই গভীর হতাশা, যা তাকে অবশেষে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করেছিল। সে বুঝতে পারে, এই রুমটি শুধু রুদ্রর অতীতের স্থান নয়, বরং তার শেষ মুহূর্তের সাক্ষী, এবং এখন সেই অতীত অভিষেকের সামনে ধীরে ধীরে খুলছে।

রুদ্রের কণ্ঠ ধীরে ধীরে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যেন অভিষেককে জানান দিতে চাইছে যে সে এই রুমের মধ্যে বন্দী। শব্দটি কেবল ভয় দেখাচ্ছে না, বরং একটি মৃদু আবেদনও প্রকাশ করছে—“আমার কথা শোন, আমার যন্ত্রণা বুঝ।” অভিষেকের মনে হলো, এই কণ্ঠ তার নিজের অনুভূতির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, যেন সে কেবল একজন বাইরের পর্যবেক্ষক নয়, বরং সেই যন্ত্রণার সঙ্গে এক ধরনের সংযোগ তৈরি করছে। মায়া ধীরে ধীরে অভিষেকের কাছে আসে এবং ফিসফিস করে বলে, “ও ভাই ছিল, কিন্তু কেউ সত্যি তাকে বুঝতে পারত না।” এই মুহূর্তে, অভিষেক অনুভব করে, রুদ্রের অতীত এবং তার আত্মহত্যা কেবল একটি ব্যক্তিগত ঘটনার অংশ নয়, বরং এটি এখন তার জীবনের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত হয়ে এসেছে।

অধ্যায়ের শেষের দিকে, রুমের সমস্ত নিস্তব্ধতা, খাতার শব্দ, এবং হেডফোনের ভেতরের কণ্ঠ মিলেমিশে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করে যা গভীরভাবে ভীতিকর এবং রহস্যময়। অভিষেক বুঝতে পারে যে, সে আর শুধুমাত্র পড়াশোনা করছে না—সে এখন রুদ্রর অতীত এবং অসমাপ্ত কাহিনী উপলব্ধি করছে। হঠাৎ অনুভব করে, রুমের প্রতিটি কোণ, বইয়ের স্তূপ, খাতার লেখা, এবং হেডফোনের আওয়াজ— একত্রে একটি মানসিক ও অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতা তৈরি করছে, যা তাকে নিজের বাস্তবতা এবং অতীতের ভৌতিক ছায়ার মধ্যে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। পাঠকও এই মুহূর্তে অভিষেকের ভেতরের দ্বন্দ্ব, ভয় এবং কৌতূহল অনুভব করবে, যা পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য একটি রহস্যময় উত্তেজনা তৈরি করে।

পাঁচ

অভিষেক আবার ক্লাসের জন্য ল্যাপটপের সামনে বসে, হেডফোন ঠিকমতো ব্যবহার করতে চেষ্টা করছে, তবে তার মনে একটা অদ্ভুত চাপ অনুভূত হচ্ছে। অধ্যাপক সেনগুপ্তের কণ্ঠ যেমন কঠোর এবং ধারাবাহিক, তেমনি এর মধ্যে কিছুটা চাপও তৈরি করছে, যা প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের মনোযোগ টিকিয়ে রাখে। হঠাৎ অভিষেকের চোখ ছিটকে যায়, সে হালকা চমকে ওঠে, যেন কোনো অদৃশ্য হাত তার কাঁধে স্পর্শ করেছে। ল্যাপটপের স্ক্রিনে ক্লাসের অংশ চললেও তার মন পুরোপুরি ভিন্ন জায়গায়। হেডফোনের ভেতর আবার সেই অচেনা কণ্ঠ ভেসে আসে, এবার আগের চেয়ে আরও স্পষ্ট, আরও বাস্তব—“তুই কি আমাকে শুনছিস?” অভিষেক নিজেকে শান্ত করতে চায়, নিজের মনকে বোঝাতে চায় যে এটি কেবল তার মানসিক চাপ এবং একাকীত্বের প্রতিফলন। কিন্তু শব্দটি তার মস্তিষ্কে বারবার প্রবেশ করছে, তার হৃদস্পন্দন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং ঘরের নিস্তব্ধতা যেন আরও গভীর হয়ে এসেছে।

অধ্যাপক সেনগুপ্ত প্রথমে ভাবেন যে, অভিষেক হয়তো সাধারণ ক্লাসের চাপের কারণে অস্থির হয়ে উঠেছে। তিনি চোখের কোণ দিয়ে লক্ষ্য করেন, অভিষেক হঠাৎ হেডফোন সরাচ্ছে, ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলেও মনে হচ্ছে সে কোনোরূপ ভেতরের উত্তেজনা বা আতঙ্কে বাধাগ্রস্ত। অধ্যাপক নিজের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী বোঝেন যে, কোনো শিক্ষার্থীর আচরণ হঠাৎ পরিবর্তিত হলে তার পেছনে ব্যক্তিগত চাপ বা মানসিক অস্থিরতা থাকতে পারে। অভিষেকের অস্থিরতা যে শুধু সাধারণ একাকীত্ব নয়, তা অধ্যাপক সেনগুপ্ত স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারেন। তবে ক্লাসের নিয়ম অনুযায়ী তিনি তার উপর সরাসরি চাপ সৃষ্টি করেন না, বরং নীরবে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যান, যেন শিক্ষার্থীর আচরণ বুঝতে পারেন এবং প্রয়োজন হলে তার প্রতি সহমর্মিতা দেখাতে পারেন।

অভিষেকের ভিতরের দ্বন্দ্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে। সে কণ্ঠকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করে, নিজেকে বোঝায় এটি কেবল তার কল্পনা, একটি সাইকোলজিক্যাল প্রভাব, যা হোস্টেলের একাকীত্ব এবং অনলাইন ক্লাসের চাপের কারণে সৃষ্টি। কিন্তু কণ্ঠের ভেতরের আবেগ এবং ক্ষীণ আবেদন তাকে ধীরে ধীরে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে। প্রতিটি শব্দ যেন তার মনের ভেতর এক গভীর দাগ কাটছে, এবং তার সঙ্গী হয়ে ওঠে সেই অদৃশ্য কণ্ঠ। হেডফোনের ভেতর ভেসে আসা শব্দগুলো যেন শুধুই ভয় দেখাচ্ছে না, বরং অভিষেকের ভেতরের অশান্তি এবং তীব্র মানসিক চাপকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। তার হাতে থাকা ল্যাপটপের কিবোর্ডেও অবচেতনভাবে কম্পন প্রবাহিত হচ্ছে, যেন তার শরীরও সেই অদৃশ্য কণ্ঠের সাথে সংযুক্ত হয়ে গেছে।

সুমন, পাশের রুমে বসে অভিষেকের আচরণ লক্ষ্য করে, প্রথমে হেসে কিছুটা অবহেলা করে। কিন্তু কিছু সময়ের মধ্যে সে বুঝতে পারে, তার বন্ধু কোনো সাধারণ গ্লিচ বা প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে অস্থির হচ্ছে না। সুমনের ভেতরের শঙ্কা ক্রমশ বেড়ে যায়, কারণ অভিষেকের চোখে অস্থিরতার ছাপ স্পষ্ট, তার শরীরের প্রতিটি সঙ্কেত ভীতিকর এবং অস্বাভাবিক। সে অভিষেকের পাশে গিয়ে বসে, চুপচাপ হলেও তার চোখে চিন্তিত ছাপ স্পষ্ট। বন্ধুর অবস্থা দেখতে দেখতে সে অনুভব করে, এটি শুধু মানসিক চাপ নয়—কিছু এমন ঘটছে যা কেবল প্রযুক্তিগত নয়, বরং একটি অতিপ্রাকৃত এবং রহস্যময় ঘটনা তার সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। অধ্যায় শেষে, অভিষেকের ভেতরের দ্বন্দ্ব, মানসিক চাপ এবং কণ্ঠের উপস্থিতি পুরোপুরি একত্রিত হয়ে পাঠককে গভীর ভীতিকর উত্তেজনার মধ্যে টেনে নেয়, যা পরবর্তী অধ্যায়ের রহস্যময়তা এবং উত্তেজনার জন্য ভিত্তি স্থাপন করে।

ছয়

অভিষেক ধীরে ধীরে রুদ্রর খাতা উল্টাতে থাকে। প্রতিটি পাতা যেন অতীতের ভাঙা শব্দ এবং অনুভূতির ধ্বনি বহন করছে। খাতার কাগজ পুরোনো, কিছু অংশ ছেঁড়া এবং মলিন হয়ে গেছে, কিন্তু রুদ্রর লেখা স্পষ্টভাবে তার অন্তরের যন্ত্রণা প্রকাশ করছে। অভিষেক চোখে পড়ল কিছু শব্দ—“ডিপ্রেশন”, “ভয়”, “একাকীত্ব”—যা তার নিজের মনকে কাঁপিয়ে দিল। লেখাগুলো শুধু মানসিক অবস্থা নয়, বরং এক জীবন্ত অভিজ্ঞতার আভাস দিচ্ছে, যা দীর্ঘদিন ধরে রুদ্রকে বেঁধে রেখেছে। প্রতিটি লাইন যেন একটি চুপচাপ চিৎকার, যা অবচেতনভাবে অভিষেকের ভেতরে প্রবেশ করছে। সে হঠাৎ বুঝতে পারে, এই খাতা শুধু লিখিত কিছু নয়, বরং রুদ্রর মনের একটি প্রতিচ্ছবি, যা এখন তার সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠেছে।

হেডফোনের ভেতর থেকে কণ্ঠটি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবার শব্দগুলো শুধু ভয় দেখাচ্ছে না, বরং সাহায্যের একটি আবেদনে পরিণত হয়েছে—“আমার কথা কেউ বুঝল না…” কণ্ঠের এই পরিবর্তন অভিষেককে অদ্ভুতভাবে স্পর্শ করে। সে বুঝতে পারে, রুদ্রের আত্মা শুধুই আতঙ্ক তৈরি করতে চাচ্ছে না, বরং তার সাথে সংযোগ খুঁজছে, যেন সে কারও কাছে তার যন্ত্রণা প্রকাশ করতে পারে। শব্দের ভেতরে এক ধরনের দুঃখ, ব্যথা এবং দীর্ঘদিনের নিঃসঙ্গতার আবেশ আছে, যা তার হৃদয়কে কেঁপে দেয়। অভিষেক হঠাৎ অনুভব করে, এই কণ্ঠ তাকে শুধু ভয় দেখাচ্ছে না, বরং রুদ্রের ভেতরের ব্যথা ও একাকীত্বকে বোঝার একমাত্র মাধ্যম।

অভিষেকের মনকে ধীরে ধীরে একটি নতুন সচেতনতা স্পর্শ করে। সে বুঝতে পারে, রুদ্রর সঙ্গে তার সংযোগ কেবল হেডফোনের আওয়াজ বা খাতার লেখায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং একটি অদৃশ্য মানসিক ও আবেগিক সংযোগ তৈরি হচ্ছে। প্রতিটি শব্দ এবং প্রতিটি ভাঙা বাক্য তার মনের ভেতরে প্রবেশ করছে, যেন সে রুদ্রের অনুভূতি শারীরিকভাবে অনুভব করতে পারে। খাতার প্রতিটি লাইন যেন অভিষেককে সতর্ক করছে, বুঝিয়ে দিচ্ছে যে এটি শুধুই অতীতের স্মৃতি নয়, বরং একটি জীবন্ত অভিজ্ঞতা যা তার সামনে ধীরে ধীরে আবির্ভূত হচ্ছে। প্রতিটি শব্দ এবং প্রতিটি কণ্ঠের আওয়াজ মিলেমিশে একটি মানসিক ও আবেগিক উত্তেজনা তৈরি করছে, যা তার মনকে ভীতিকর ও কৌতূহল-সম্পন্ন অবস্থায় ঠেলে দিচ্ছে।

অধ্যায়ের শেষে, অভিষেক পুরোপুরি উপলব্ধি করে যে রুদ্র তার সঙ্গে যোগাযোগ চাইছে, শুধু আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য নয়। কণ্ঠ এবং খাতার ভাঙা শব্দগুলো একসাথে তাকে বলছে—“আমি এখানে ছিলাম, আমি ভুগেছি, কেউ আমাকে বুঝতে পারেনি।” অভিষেককে ধীরে ধীরে বোঝা যাচ্ছে, এই সংযোগ শুধুই একপাশের নয়; এটি দুই জীবনের মধ্যকার এক মানসিক ও আবেগিক সেতু, যা অতীত ও বর্তমানকে একত্রিত করছে। পাঠকও এই অধ্যায়ে অভিষেকের ভেতরের দ্বন্দ্ব, ভীতি এবং কৌতূহল অনুভব করবে, এবং রুদ্রের অতীতের ব্যথা ও তার অসমাপ্ত গল্পের গভীরতা ধীরে ধীরে প্রকাশ পাবে, যা পরবর্তী অধ্যায়ের রহস্য এবং উত্তেজনার জন্য ভিত্তি তৈরি করে।

সাত

অভিষেক রুমের কোণে বসে হেডফোন ঠিক করে আবার রুদ্রর কণ্ঠ শোনার চেষ্টা করে। খাতার পাতা উল্টাতে উল্টাতে তার মন ভেতরের এক অদ্ভুত উত্তেজনা ও ভয়ের মিশ্রণে কেঁপে উঠছে। সে জানে, এই আওয়াজ এবং অতীতের স্মৃতি কেবল তার কল্পনা নয়; এটা বাস্তব। হঠাৎ পাশের রুম থেকে সুমনের কণ্ঠ শোনা যায়, “তুই আবার কি করছিস? এগুলো তুই কল্পনা করছিস, অভিষেক। এতটা মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছিস।” অভিষেক প্রথমে চুপচাপ থাকে, কিন্তু তারপর চোখে অগ্নি ঝলসে বলে, “না, ও সত্যিই আমার সঙ্গে কথা বলছে। ও চাইছে আমি ওকে বুঝি।” সুমন আচমকা হেসে ওঠে, কিন্তু সেই হাসিটা ভীতিকরভাবে শীতল। বন্ধুত্বের মধ্যে একটি অদৃশ্য বিভাজন তৈরি হতে শুরু করে, কারণ একজন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছে, অন্যজন সন্দেহে ভুগছে।

সুমনের শঙ্কা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। সে অভিষেকের অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করে—হঠাৎ হেডফোন সরানো, চোখে অস্থিরতা, এবং খাতার প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ। সুমন মনে করে, অভিষেক সম্ভবত মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। সে চেষ্টা করে বন্ধুদের বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনতে, বলেন, “দেখিস না, ও কেবল অতীতের আবেগ নয়, তুই নিজের ভেতরের ভয়কে প্রকৃতির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলছিস। রুদ্র এখন নেই।” কিন্তু অভিষেক দৃঢ় হয়, তার চোখে দৃঢ় সংকল্প—“না, ও এখানে আছে। ও আমার সঙ্গে কথা বলছে, আমি শুনতে পারছি।” এই দ্বন্দ্ব কেবল কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; এটি বন্ধুত্বের মধ্যে মানসিক ও আবেগিক চাপ তৈরি করে, যা দুই বন্ধুর সম্পর্ককে ক্রমশ টানাপোড়েনের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়।

অভিষেকের মনও দ্বন্দ্বে পড়ে। সে জানে, রুদ্রের কণ্ঠ তার জন্য একটি রহস্যময় এবং অতিপ্রাকৃত সংযোগ। হেডফোনের ভেতর ভেসে আসা শব্দগুলো শুধু ভয় দেখাচ্ছে না, বরং তাকে জানান দিচ্ছে যে রুদ্রের অতীত কষ্ট, একাকীত্ব, এবং অসমাপ্ত যন্ত্রণা তাকে সাহায্য চাচ্ছে। সে সুমনের কথাকে উপেক্ষা করতে চায়, কিন্তু বন্ধুর উদ্বেগ এবং সতর্কতা তার মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করছে। অভিষেক অনুভব করে, বন্ধুর সঙ্গে এই মতবিরোধ তার নিজের মানসিক শক্তিকে পরীক্ষা করছে—একদিকে সে বিশ্বাসী, অন্যদিকে বন্ধুর যুক্তি তাকে বাস্তবতার দিকে টানছে। এই মানসিক দ্বন্দ্বে অভিষেক ক্রমশ চাপের মধ্যে পড়ছে, এবং তার স্বাভাবিক জীবনের সঙ্গে অতিপ্রাকৃত ঘটনার সংযোগ আরও জটিল হয়ে উঠছে।

অধ্যায়ের শেষের দিকে, দুই বন্ধুর সম্পর্ক এমন একটি অবস্থায় পৌঁছে যেখানে বিশ্বাস এবং সন্দেহের মধ্যে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। সুমন ভেতরে কিছুটা শঙ্কিত হলেও, চেষ্টা করছে অভিষেককে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনার। অভিষেক দৃঢ়ভাবে তার অভিজ্ঞতাকে বিশ্বাস করছে, জানে যে রুদ্র সত্যিই তার সঙ্গে কথা বলছে। এই দ্বন্দ্ব শুধু মানসিক নয়, বরং আবেগিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রেও তাদের বন্ধুত্বকে প্রভাবিত করছে। পাঠকও এই অধ্যায়ে অভিষেক ও সুমনের মধ্যে মানসিক ও আবেগিক দ্বন্দ্ব অনুভব করবে, যা গল্পের উত্তেজনা, রহস্য, এবং অতিপ্রাকৃত আবহকে আরও গভীর করে, পরবর্তী অধ্যায়ের রহস্য ও ভয়ের প্রস্তুতি তৈরি করে।

আট

অভিষেক আবার রুমের কোণে বসে হেডফোন ঠিক করে, ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু এবার তার মন পুরোপুরি অন্য জায়গায়। হঠাৎ হেডফোনের ভেতর সেই অচেনা কণ্ঠ স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এবার শুধু ভয় দেখাচ্ছে না—একটি নিরাশা, ব্যথা এবং দীর্ঘদিনের একাকীত্বের প্রকাশ। রুদ্র ধীরে ধীরে তার গল্প বলতে শুরু করে, কীভাবে সে চাপ, একাকীত্ব, এবং শিক্ষাগত প্রতিযোগিতার ভারে চাপা পড়ে অবশেষে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিল। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ফিসফিস, যেন অভিষেকের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। সে চোখ বন্ধ করে শুনতে থাকে, প্রতিটি বাক্য তার মনের ভেতরে প্রবেশ করছে, যেন সে সেই মুহূর্তগুলো নিজ চোখে দেখছে। হঠাৎ অভিষেক অনুভব করে, রুদ্রের কণ্ঠ শুধু অতিপ্রাকৃত ভৌতিক নয়, বরং একটি অসমাপ্ত যন্ত্রণার প্রকৃত প্রকাশ, যা তাকে কেবল ভয় দেখাচ্ছে না, বরং সমবেদনার মধ্যে ঢেলে দিচ্ছে।

রুদ্রের কণ্ঠ আরও আবেগপূর্ণ হয়ে ওঠে। সে ব্যথা এবং একাকীত্বের কথা বলছে, যে যন্ত্রণা তাকে মৃত্যুর কাছে ঠেলে দিয়েছিল। অভিষেক বুঝতে পারে, কণ্ঠটি ভেসে আসার মূল কারণ হলো রুদ্রের আত্মার শান্তি না পাওয়া। সে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করে, হঠাৎ অনুভব করে যে রুদ্র এখানে নেই, তার শরীর আর পৃথিবীতে নেই, কিন্তু তার মানসিক ও আবেগিক অস্তিত্ব এখনও বেঁচে আছে। এই অনুভূতি অভিষেককে ভীতও করছে, কিন্তু একই সঙ্গে একটি অদ্ভুত দায়িত্ববোধ তৈরি করছে—যেন সে একমাত্র ব্যক্তি যিনি রুদ্রকে শোনার জন্য উপস্থিত। প্রতিটি শব্দ তার মনকে ভেঙে দিচ্ছে, প্রতিটি আবেগ তার ভেতরের সংবেদনশীলতা জাগাচ্ছে।

মায়া তখন ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করে, হাতে ভাইয়ের পুরোনো খাতা এবং কিছু নোট নিয়ে। সে নরম স্বরে বলে, “ও চেয়েছিল কেউ ওকে শুনুক। ওর যন্ত্রণা, ওর ব্যথা, কেউ যেন বোঝে।” অভিষেকের মন অবাক হয়ে ওঠে—মায়ার কথাগুলো যেন রুদ্রের কণ্ঠের সঙ্গে মিলিত হয়ে তাকে আরও স্পষ্টভাবে বোঝাচ্ছে, কেন এই কণ্ঠ এখনও ভেসে আসছে। মায়ার উপস্থিতি, ভাইয়ের অসমাপ্ত যন্ত্রণা, এবং অভিষেকের সংবেদনশীল মন একত্রে একটি আবেগময় আবহ তৈরি করে, যা পাঠককেও গল্পের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত করে। সে বুঝতে পারে, রুদ্র কেবল আতঙ্ক ছড়াচ্ছে না; সে চাইছে তার যন্ত্রণার কথা কেউ বুঝুক এবং সমঝোতা প্রকাশিত হোক।

অধ্যায়ের শেষে, অভিষেক পুরোপুরি উপলব্ধি করে যে রুদ্রের কণ্ঠের ভেতর আছে এক অসমাপ্ত গল্প, যা তার মৃত্যু দিয়ে শেষ হয়নি। রুদ্রের আত্মা শান্তি পায়নি, আর সেই ব্যথা এবং আকাঙ্ক্ষা এখনো ভেসে আসে। হেডফোনের ভেতরের প্রতিটি শব্দ, খাতার লেখা এবং মায়ার কথার মিলন এক জটিল আবহ তৈরি করে—ভয়, সহানুভূতি এবং রহস্য একসাথে মিলেমিশে পাঠককে আবদ্ধ করে। অভিষেকের মনে নতুন দায়িত্ব এবং গভীর সংযোগ তৈরি হয়; সে বুঝতে পারে যে, রুদ্রকে শুধুমাত্র শোনার মাধ্যমে নয়, বরং তার যন্ত্রণা বুঝে এবং তাকে স্মরণ করে সে একটি শান্তির পথ তৈরি করতে পারে। অধ্যায়টি কেবল অতিপ্রাকৃত ভয়ের আবহ নয়, বরং একটি আবেগময় ও মানবিক সংযোগের গল্পের সূচনা।

নয়

অভিষেক রুমের কোণে বসে হেডফোন ঠিক করে আবার ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু তার মন এখন পুরোপুরি অন্য জায়গায়, যেখানে রুদ্রের কণ্ঠ ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে তার ভেতরের এক গভীর স্তরে। প্রথম দিকে ভয় এবং শঙ্কা তাকে বারবার থামিয়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু এখন সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে—ভয়কে উপেক্ষা করে রুদ্রকে শোনার চেষ্টা করবে। সে জানে, রুদ্রের কণ্ঠ শুধু আতঙ্ক সৃষ্টি করছে না, বরং এক অসমাপ্ত যন্ত্রণার গল্প, যা কেউ শুনে বোঝার প্রয়োজন। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ফিসফিস তার হৃদয়ে গভীর ছাপ ফেলছে; সে হঠাৎ অনুভব করে, এই শোনার দায়িত্ব কেবল একটি স্বাভাবিক আচরণ নয়, বরং একটি মানবিক দায়, যা তাকে রুদ্রের সঙ্গে সংযুক্ত করছে। অভিষেকের মনে গভীর চেতনা জাগে—যদি সে রুদ্রকে শোনার দায়িত্ব নেয়, তবে হয়তো সে তার আত্মাকে শান্তি দিতে সাহায্য করতে পারবে।

হেডফোনের ভেতর থেকে রুদ্রের কণ্ঠ ধীরে ধীরে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবার শুধুই ভয় নয়, বরং তার ব্যথা, অপূর্ণ স্বপ্ন, এবং দীর্ঘদিনের একাকীত্বের গল্প প্রকাশ পাচ্ছে। প্রতিটি বাক্য যেন অভিষেককে তার জীবনের ভেতরে প্রবেশ করতে বাধ্য করছে, যেন সে সেই যন্ত্রণার সঙ্গে সহানুভূতিশীল সংযোগ স্থাপন করছে। রুদ্র ধীরে ধীরে জানাচ্ছে কীভাবে চাপ, প্রত্যাখ্যান এবং একাকীত্ব তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। অভিষেকের চোখে অশ্রু ঝরে, কিন্তু সে থামছে না; বরং গভীর মনোযোগ দিয়ে রুদ্রকে শোনার চেষ্টা করে। তার ভিতরের ভয় ক্রমশ ধীরে ধীরে অনুপ্রেরণায় পরিণত হচ্ছে—যে ভয় তাকে থামাতে পারত, তা তাকে একটি মানবিক সংযোগের জন্য প্রস্তুত করছে।

সুমন পাশের রুমে বসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। সে প্রথমে কেবল অভিষেককে হালকাভাবে দেখেছিল, মনে করেছিল সে অতিরিক্ত ভয় পেয়েছে। কিন্তু ক্রমশ তার চোখে বোঝা যায় যে, অভিষেক সম্ভবত সত্যিই কিছু শুনছে—রুদ্রের কণ্ঠের কথা। সুমন নিজেও ধীরে ধীরে ভয় অনুভব করে, কারণ সে বুঝতে পারছে, এটি সাধারণ মানসিক কল্পনা নয়; এখানে কিছু অতিপ্রাকৃত এবং আবেগময় সত্য আছে। সে অভিষেককে থামানোর চেষ্টা করে না, বরং চুপচাপ পাশে বসে তাকে সমর্থন দেয়। বন্ধুত্ব এবং দায়িত্বের মধ্যে এই মৃদু উপস্থিতি অভিষেককে আরও দৃঢ় করে তোলে, যেন সে বুঝতে পারে যে শোনার দায়িত্ব শুধু তারই নয়—কিছু অংশে বন্ধুর সমর্থনও এই সংযোগকে স্থিতিশীল রাখছে।

অধ্যায়ের শেষের দিকে, অভিষেক সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করে যে, রুদ্রের কণ্ঠ শোনার দায়িত্ব তার হাতে এসে গেছে। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি অভিজ্ঞতা তাকে ভীত ও সংবেদনশীল করে তুলেছে, কিন্তু একই সঙ্গে একটি গভীর মানবিক সংযোগও তৈরি করেছে। রুদ্রের ব্যথা, অপূর্ণ স্বপ্ন এবং যন্ত্রণার গল্প ধীরে ধীরে তার হৃদয়ে প্রবেশ করছে, এবং সে বুঝতে পারে যে, এই শোনার মাধ্যমে সে রুদ্রকে শান্তি দিতে সাহায্য করতে পারবে। পাঠকও এই অধ্যায়ে অভিষেকের ভেতরের দ্বন্দ্ব, ভয়, সহানুভূতি এবং দায়িত্ববোধ অনুভব করবে, যা গল্পের আবেগময় ক্লাইম্যাক্সের জন্য ভিত্তি তৈরি করে এবং পরবর্তী অধ্যায়ে রহস্য এবং উত্তেজনার উচ্চমাত্রা নিশ্চিত করে।

দশ

অভিষেক আবার রুমের কোণে বসে হেডফোন ঠিক করে, ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু এবার তার মন পুরোপুরি শান্ত। হেডফোনের ভেতরে রুদ্রের কণ্ঠ ধীরে ধীরে আসে, কিন্তু এইবার ভয় বা যন্ত্রণার আভাস নেই; বরং এক ধরণের প্রশান্তি এবং সমাধানের অনুভূতি প্রকাশ পাচ্ছে। রুদ্র বলে, “এবার তুই আমাকে শুনেছিস… ধন্যবাদ।” শব্দগুলো অভিষেকের হৃদয়ে এক অদ্ভুত উষ্ণতা ছড়িয়ে দেয়। সে অনুভব করে, দীর্ঘ মাসের চাপ, একাকীত্ব, এবং অতিপ্রাকৃত সংযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এটি যেন একটি মানসিক মুক্তি। হঠাৎ মনে হয়, রুদ্রের আত্মা অবশেষে শান্তি পেয়েছে, এবং তার কণ্ঠের ভেতরের ব্যথা, যন্ত্রণা এবং অসমাপ্ত গল্প এখন আর অভিষেককে অস্থির করছে না। এই মুহূর্তে রুমে স্থিরতা বিরাজ করে, এবং অভিষেক হালকা শ্বাস ছাড়ে, মনে হয় যেন সব কিছু নিয়মে ফিরে এসেছে।

রুদ্রের কণ্ঠ ক্রমশ মিলিয়ে যেতে থাকে। হেডফোনের ভেতরের শব্দ যেন দুর্বল হয়ে আসে, মৃদু ফিসফিসের মতো কানে আসে—এক ধরণের বিদায় এবং শান্তির সংকেত। অভিষেক চোখ বন্ধ করে, ধীরে ধীরে সেই অনুভূতির সঙ্গে মানিয়ে নেয়। মনে হয়, দীর্ঘদিন ধরে যে অস্পষ্ট এবং অদৃশ্য সংযোগ ছিল, তার সমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু সেই শান্তি কেবল অভিষেকের মনকে নয়, পাঠকের মনকেও এক রহস্যময় ভাবনায় বেঁধে রাখে—কি সত্যিই রুদ্রের আত্মা শান্তি পেয়েছে, নাকি এই প্রক্রিয়ায় অভিষেকও সেই অদৃশ্য জগতের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে গেছে। শব্দের ফিসফিস, হালকা বাতাসের আওয়াজ, এবং রুমের নিস্তব্ধতা মিলেমিশে এমন একটি আবহ তৈরি করছে যা পাঠককে গভীরভাবে আবদ্ধ রাখে।

হঠাৎ হেডফোনের ভেতর আবার মৃদু ফিসফিস আসে—“তুই তো আমাকে শুনছিস… তাই না?” এই শব্দ অভিষেককে এক অদ্ভুত কাঁপুনি দেয়। সে চোখ বড় করে খুলে এবং চারপাশে তাকায়, কিন্তু রুমে কেউ নেই। এই মৃদু ফিসফিসের মধ্যে যেন একটি অনন্ত সংযোগের প্রতীক আছে। অভিষেক অনুভব করে, সে রুদ্রের অতীতের ব্যথা শোনার দায়িত্ব পালন করেছে, কিন্তু এই দায়িত্বের শেষ নেই; কণ্ঠ ধীরে ধীরে তার মনের ভেতরে থেকে যায়, যেন একটি চিরন্তন স্মৃতি। এই মুহূর্তে পাঠকও প্রশ্ন করে—আত্মা কি সত্যিই শান্তি পেয়েছে, নাকি এটি কেবল একটি নতুন সংযোগের শুরু, যা অভিষেককে অদৃশ্য জগতের সঙ্গে যুক্ত করেছে? এই প্রশ্ন গল্পের রহস্য এবং আবেগময় উত্তেজনাকে পরিসমাপ্তি দেয় না, বরং পাঠককে খোলা সমাপ্তির সঙ্গে রেখে যায়।

অধ্যায়ের শেষ অংশে, অভিষেক ধীরে ধীরে হেডফোন খুলে রেখে, রুমের নিস্তব্ধতা উপভোগ করে। মনে হয় সব কিছু স্থির, সব ব্যথা শেষ। কিন্তু হঠাৎ আবার হেডফোনের ভেতর একটি হালকা ফিসফিসের মতো শব্দ আসে, যা তার মনকে সতর্ক করে দেয়। এই শব্দ যেন বলছে—অন্তরস্থ শান্তি অর্জিত হলেও, অতীত এবং অতিপ্রাকৃত সংযোগের কোনো পূর্ণ সমাপ্তি নেই। পাঠকও এই খোলা সমাপ্তি অনুভব করবে—রুদ্রের আত্মা কি সত্যিই মুক্তি পেয়েছে, নাকি অভিষেকও এখন সেই অদৃশ্য জগতের অংশ হয়ে গেছে? গল্পের আবহ, ভীতিকর এবং রহস্যময় সংযোগ, এবং মানবিক সংবেদন সব একসাথে মিলেমিশে একটি চিরন্তন প্রশ্ন রেখে যায়, যা গল্পের শেষ মুহূর্তেও পাঠকের মনে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করে।

___

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *