১
ড. অরিন্দম মুখার্জি, কলকাতার একটি নামকরা গবেষক, তাঁর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে সুন্দরবনের অদূরপ্রান্তে অবস্থিত ছোট্ট গ্রাম ধনডুবি পৌঁছান। তিনি বন এবং নদীর সঙ্গে মিশে থাকা গ্রামীণ জীবনের স্বাভাবিকতায় নিজেকে পুরোপুরি নিমগ্ন করতে চান, তবে তাঁর আসল উদ্দেশ্য আরও রহস্যময়—গ্রামের লোককথা অনুযায়ী প্রতি পূর্ণিমার রাতে নদীর পারে যে কালো লন্ঠন জ্বলে ওঠে, তা নিয়ে তিনি গভীর গবেষণা করতে চাচ্ছেন। গাছ-গাছালির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, অরিন্দম অনুভব করেন যে এই গ্রামটি অন্য যে কোনও স্থানের মতো নয়। নদীর জলের নীরবতা, পাতা ছিঁড়ে পড়ার শব্দ, দূরে কোথাও পাখির ডাকে, সব মিলিয়ে যেন এক অদ্ভুত সুরের সৃষ্টিকর্ম। গ্রামের প্রধান রাস্তার ধারে পৌঁছলে, তিনি লক্ষ্য করেন ঘরবাড়ি সবই প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে নির্মিত—কাঠ, বাঁশ, ও খোদের মিশ্রণে। গ্রামের মানুষজন তাঁকে কিছুটা সজাগ দৃষ্টিতে দেখে, যেন তাঁরা জানেন কেউ নতুন এসেছে, তবে তাঁদের মুখে আতঙ্কের স্পর্শ রয়েছে। তিনি বুঝতে পারেন যে গ্রামে কালো লন্ঠনের ভয়ের ইতিহাস কেবল গল্প নয়, এটি বাস্তবের সঙ্গে জড়িত।
অরিন্দম যখন গ্রামের মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতা শুরু করেন, তখন জানতে পারেন যে কালো লন্ঠন শুধুমাত্র একটি রহস্য নয়, এটি গ্রামবাসীর বিশ্বাস এবং আচরণের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। বৃদ্ধ লোকেরা জানান, বহু বছর আগে এক রাত্রে নদীর ধারে এক যুবক অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, এবং সেই রাতের পর থেকে প্রতি পূর্ণিমার রাতে কালো লন্ঠন জ্বলে ওঠে। অরিন্দমের মন কৌতূহল ও ভয়ের সংমিশ্রণে উদ্দীপ্ত হয়। তিনি গ্রামবাসীর চোখে আতঙ্ক এবং আশঙ্কার মিশ্রণ লক্ষ্য করেন—যারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নদীর দিকে তাকায় না, তারা নিরাপদ থাকে; কিন্তু যারা লন্ঠনের দিকে ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করে, তারা রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়। অরিন্দম মনে মনে এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে থাকেন। তিনি ভাবেন, হয়তো এটি কোনো প্রাকৃতিক ঘটনাক্রম, নদীর তলের গ্যাসের উত্থান বা অন্য কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে। কিন্তু গ্রামবাসীর গল্পগুলো, বিশেষ করে বৃদ্ধাদের বর্ণনা, যা শুধুমাত্র আতঙ্ক তৈরি করে তা নয়—এতে লুকানো আছে এমন কিছু তথ্য যা কেবল গভীর পর্যবেক্ষণ এবং সাহসী গবেষণার মাধ্যমে জানা সম্ভব।
রাত নামতেই অরিন্দম তাঁর অস্থায়ী আবাসস্থলে ফিরে আসেন, নদীর দিকে মনোযোগ দিয়ে। পূর্ণিমার আলো নদীর জলে প্রতিফলিত হচ্ছে, এবং দূরে কিছু অদ্ভুত ছায়া নড়াচড়া করছে। অরিন্দম তাঁর নোটবুকে সবকিছু লিখতে শুরু করেন—গ্রামের পরিবেশ, মানুষদের অভ্যন্তরীণ মনোভাব, নদীর ধারের অদ্ভুত নীরবতা এবং ছায়ার খেলাধুলা। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, তিনি লক্ষ্য করেন নদীর পারে একটি দুর্লভ আলো—কালো লন্ঠনের প্রথম ঝলক। অরিন্দমের মনে ভয় এবং উত্তেজনার মিলিত অনুভূতি জাগে। তিনি বুঝতে পারেন যে তাঁর সামনে শুধুমাত্র একটি লোককথা নয়, একটি গভীর রহস্য অপেক্ষা করছে। ধনডুবি গ্রামের শান্ত পরিবেশ, নদীর নীরবতা, এবং কালো লন্ঠনের জ্বলন্ত আলো—সবকিছু মিলিয়ে যেন একটি মায়াবী পৃথিবী তৈরি করেছে, যেখানে বিজ্ঞান এবং পৌরাণিক কাহিনীর সীমারেখা মিশে গেছে। অরিন্দমের গবেষণার এই প্রথম রাত তাকে জানিয়ে দেয় যে সুন্দরবনের গভীর অরণ্যে তিনি এক দীর্ঘ, রহস্যময়, এবং বিপজ্জনক অভিযানের শুরুতে প্রবেশ করেছেন।
২
দ্বিতীয় দিনে, অরিন্দম গ্রামের মানুষের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন। গ্রামের ছোট্ট পাঠশালায় তাঁকে স্বাগত জানান মধুমিতা দাস, যিনি সাধারণভাবে সবাইকে মধু নামে চিনেন। মধু কেবল একজন শিক্ষিকা নয়, তিনি গ্রামের মানুষদের ইতিহাস, লোককথা, এবং সংস্কৃতির জীবন্ত অভিধান। অরিন্দম তাঁর কাছে কালো লন্ঠন এবং নদীর ধারের রহস্য সম্পর্কে জানতে চাইলেই মধু চোখে এক গভীর সতর্কতার ছাপ দিয়ে বললেন, “ডক্টর সাহেব, আমাদের গ্রামের কথা কেবল গল্প নয়। নদীর পারে যে আলো জ্বলে, তা নিছক দ্যুতিময় বা মনোরম নয়। যারা তার দিকে আকৃষ্ট হয়, তারা প্রায়শই ফিরে আসে না। আমাদের সবাইকে প্রতিটি পূর্ণিমার রাতে সাবধান থাকতে হয়। অনুপযুক্ত কৌতূহল কখনো কখনো বিপদের মুখ খুলে দেয়।” মধুর কণ্ঠে ভয় ও সতর্কতার সংমিশ্রণ অরিন্দমকে মুগ্ধ করার পাশাপাশি চিন্তিতও করে। তিনি বুঝতে পারেন, এই গ্রামে লোককথা শুধু সংস্কৃতির অংশ নয়, এটি মানুষের আচরণ এবং নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
সন্ধ্যার দিকে, অরিন্দম গ্রামের মানুষের সঙ্গে আরও কিছু তথ্য সংগ্রহ করার সময় করিম মাঝির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। করিম মাঝি, যিনি বহু বছর ধরে নদীতে জাহাজ চালান, তাঁর চোখে গভীর বেদনা ও আতঙ্ক নিয়ে অরিন্দমকে বলেন, “ডক্টর সাহেব, আমার ছোট ভাইও এই নদীর ধারে নিখোঁজ হয়েছিল। সেই রাতের পর থেকে কেউ আর সে সম্পর্কে কিছু জানে না। আমরা তখনই বুঝেছিলাম, এই নদীর পারে কিছু আছে যা মানব বুদ্ধি সহজে ধরতে পারে না।” করিম মাঝির কণ্ঠে কষ্ট ও আতঙ্কের ছাপ অরিন্দমকে হাঁচি দেয়। তিনি লক্ষ্য করেন, এই ঘটনা কেবল অতীতের নয়—এটি গ্রামবাসীর দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। গ্রামের বয়স্করা রাত নামলেই ঘরে ঢুকে যায়, দরজা জানালা বন্ধ করে রাখে, এবং কেউ নদীর দিকে ঝুঁকে তাকায় না। শিশুদেরও ছোটবেলায় শেখানো হয় যে নদীর ধারে অজানা আলোকে স্পর্শ করা বিপজ্জনক। অরিন্দম সমস্ত তথ্য মনোযোগ দিয়ে নোটবুকে লিখতে থাকেন, যেন প্রতিটি কথার আভাসে লুকানো রহস্য খুঁজে বের করতে পারেন।
রাত নামতেই ধনডুবি গ্রামের পুরো পরিবেশই পরিবর্তিত হয়ে যায়। নদীর তীরে হাওয়া বইতে শুরু করে, পাতা ঝরে এবং দূরে কোথাও অদ্ভুত শব্দ শুনা যায়। অরিন্দম লক্ষ্য করেন, গ্রামের মানুষজন এক অদ্ভুত নীরবতা মেনে চলে—কেউ কণ্ঠে কথা বলেন না, কেউ মুখে হাসি ফোটান না। কিন্তু অরিন্দমের মন কৌতূহল ও বৈজ্ঞানিক তৃষ্ণায় উত্তপ্ত। তিনি নদীর পারে কালো লন্ঠনের প্রভাব অনুভব করতে থাকেন। দূরে দূরে অন্ধকারে হালকা আলো ঝলমল করছে, এবং নদীর স্রোতের ধ্বনি যেন রহস্যময় একটি সুর তৈরি করছে। মধু তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, “ডক্টর সাহেব, শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণ করলেই হবে; হাত লাগাবেন না। কালো লন্ঠনের রহস্য আমাদের জন্য কখনও বন্ধুত্বপূর্ণ নয়।” অরিন্দম বুঝতে পারেন, এই রাতটি কেবল একটি পরীক্ষা নয়—এটি তাঁর ধৈর্য, সাহস এবং বৈজ্ঞানিক বোধের জন্য প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ। গ্রামের আতঙ্ক, সতর্কবার্তা, এবং রহস্যময় আলো—সব মিলিয়ে অরিন্দমকে জানিয়ে দেয় যে ধনডুবি গ্রামে তিনি এক গভীর এবং বিপজ্জনক অভিযানের প্রারম্ভে প্রবেশ করেছেন, যেখানে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান এবং পৌরাণিক কাহিনীর সীমানা একত্রিত হয়ে এক অজানা রহস্যের দিগন্ত খুলে দিচ্ছে।
৩
ধনডুবি গ্রামের রাতের নীরবতা অরিন্দমের মনে এক অদ্ভুত উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। তিনি তাঁর নোটবুক হাতে নিয়ে নদীর ধারের রহস্যময় আলো পর্যবেক্ষণ করছিলেন, তখন হঠাৎ পেছন থেকে একজন মহিলার সিলুয়েট দেখা যায়। তিনি যত ঘনিষ্ঠভাবে তাকান, ততই মহিলার উপস্থিতি যেন অন্ধকারের মধ্যে আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মহিলার নাম রেবতী বউদি, গ্রামের সকলেই তাঁকে এক রহস্যময়, অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে জানে। রেবতী বউদি অরিন্দমের কাছে আসেন, তাঁর ধীর কণ্ঠে আভাস দিয়ে বলেন, “ডক্টর সাহেব, এই আলো কোনো সাধারণ দ্যুতি নয়। এটি অপমৃত আত্মাদের ডাক। যারা এর কাছে যায়, তাদের শরীর আর ফিরে আসে না। শুধু আত্মা—প্রলপ্ত আত্মা—ঘোরে এই লন্ঠনের চারপাশে।” অরিন্দম প্রথমে হাসি চেপে ধরেন। তিনি মনে মনে ভাবেন, এটি কেবল গ্রামের লোককথা, কুসংস্কার এবং ভয়ের মনস্তাত্ত্বিক ফল। তবে রেবতী বউদির চোখে যে গভীর সতর্কতা এবং বাস্তবতার ছাপ, তা অরিন্দমকে অজান্তে ভাবতে বাধ্য করে।
রেবতী বউদি অরিন্দমকে আরও জানান, বহু বছর ধরে গ্রামের মানুষ এই লন্ঠনের রহস্য নিয়ে সতর্ক থাকে। “ডক্টর সাহেব,” তিনি আরও বললেন, “প্রতি পূর্ণিমার রাতে যারা লন্ঠনের দিকে অদৃশ্য আকর্ষণে এগিয়ে যায়, তাদের কোনো জীবন্ত প্রমাণ পাওয়া যায় না। আমরা বহুবার চেষ্টা করেছি, অনুসন্ধান করেছি, কিন্তু কেউ ফিরেছে না। যারা চলে যায়, তারা হয়তো মৃত্যুর সীমা অতিক্রম করে, কিংবা এই গ্রামে স্থায়ীভাবে অন্য রূপে উপস্থিত থাকে।” অরিন্দম মনোযোগ দিয়ে রেবতী বউদির কথাগুলো শোনেন, কিন্তু তাঁর বৈজ্ঞানিক মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবেই যুক্তি খুঁজতে থাকে। তিনি ভাবেন, এটি কোনো মানসিক বিভ্রম, রাতে আলো এবং ছায়ার খেলা, বা নদীর তলার গ্যাসীয় প্রক্রিয়ার ফল। কিন্তু রেবতী বউদির শব্দ এবং দৃষ্টিভঙ্গি অরিন্দমকে এক অদ্ভুত জিজ্ঞাসা বোধ করায়—কেন গ্রামের মানুষজন এত গভীরভাবে আতঙ্কিত? কেন কেউ ঝুঁকি নিতে চায় না, যদিও যুক্তি বলে এটি কেবল একটি আলো?
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অরিন্দম তাঁর তত্ত্ব তৈরি করতে থাকেন। তিনি নদীর তীরে হেঁটে যেতেই লক্ষ্য করেন দূরে, অন্ধকারের মধ্যে, সেই কালো লন্ঠনের ঝলক। মৃদু বাতাসে লন্ঠনের আলো নদীর জলের সঙ্গে মিশে এক অদ্ভুত প্রতিফলন তৈরি করছে। অরিন্দম রেবতী বউদির কথাগুলো চিন্তায় ভরা মনে যাচাই করতে থাকেন—এই আলো কি সত্যিই অপমৃত আত্মাদের ডাক? যদি তাই হয়, তাহলে গ্রামবাসীর সতর্কতা কি শুধু আধ্যাত্মিক অভ্যাস নাকি বাস্তব বিপদের প্রমাণ? তিনি নোটবুক খুলে সব পর্যবেক্ষণ লিখতে শুরু করেন—লন্ঠনের গতি, আলো, বাতাসের দিক, নদীর স্রোতের ধরন এবং গ্রামের মানুষের আচরণ। রেবতী বউদির উপস্থিতি অরিন্দমকে এক অদ্ভুত বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়; তাঁর বৈজ্ঞানিক যুক্তি এবং গ্রামবাসীর আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম সীমারেখা টানতে থাকে। রাত শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অরিন্দম বুঝতে পারেন যে এই অভিযান কেবল তথ্য সংগ্রহের নয়, এটি তাঁর সাহস, বুদ্ধিমত্তা, এবং বাস্তবতার সীমা পরীক্ষা করার এক গভীর অভিজ্ঞতা। রেবতী বউদির ছায়া, কালো লন্ঠনের রহস্য, এবং নদীর নীরবতা—সব মিলিয়ে অরিন্দমকে জানিয়ে দেয় যে ধনডুবি গ্রামের এই রহস্যময় পরিবেশ তাঁর জন্য এক দীর্ঘ, বিপজ্জনক এবং মায়াবী অনুসন্ধানের সূচনা মাত্র।
৪
পূর্ণিমার রাত ধনডুবি গ্রামে বিশেষ ধরনের নীরবতা নিয়ে আসে। নদীর জলে চাঁদের আলো লেগে এক অনন্য দ্যুতি সৃষ্টি করছে, যা অরিন্দমের কৌতূহলকে আরও তীব্র করে তুলেছে। তিনি করিম মাঝি ও মধু বউদির সঙ্গে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে সমস্ত প্রস্তুতি নেন। করিম মাঝি ভয়ে কম্পমান কণ্ঠে বলেন, “ডক্টর সাহেব, আমি বলেছিলাম না—এই আলোয় কাছের মানুষরা হারায়। আমাদের এখানে দাঁড়ানো ঠিক নয়।” মধু বউদি স্থির চোখে নদীর দিকে তাকিয়ে সাবধানতার সংকেত দেয়। কিন্তু অরিন্দম, তাঁর বৈজ্ঞানিক আগ্রহ এবং গবেষণার জিজ্ঞাসায় উদ্দীপ্ত হয়ে, নদীর জলের ওপর ঝুঁকে পড়ার প্রস্তুতি নেন। তিনি নোটবুক হাতে রাখেন, ক্যামেরা প্রস্তুত রাখেন এবং প্রত্যেকটি পদক্ষেপ লক্ষ্য করেন। রাতের হাওয়া নদীর পৃষ্ঠে হালকা ঢেউ তৈরি করছে, পাতা ঝরে পড়ছে, আর দূরে অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসছে—যেন কোনো অদৃশ্য সত্তা তাদের উপস্থিতি অনুভব করছে।
হঠাৎ নদীর পারে, অন্ধকারের মাঝে, কালো লন্ঠনের আলো জেগে ওঠে। আলো ধীরে ধীরে জ্বলতে শুরু করে, বাতাসে মৃদু নাচের ছাপ তৈরি করে এবং প্রতিফলিত হয় নদীর জলে। অরিন্দম দ্রুত নোটবুক খুলে প্রতিটি পর্যবেক্ষণ লিখতে থাকেন। ঠিক তখনই দূরে অচেনা এক ছায়া নড়ে ওঠে। ছায়ার অকারণ নড়াচড়া করিম মাঝিকে ভয় দেখায়। তিনি আতঙ্কিত হয়ে নৌকায় চেপে পালাতে চান, কিন্তু অরিন্দম তাঁর পদক্ষেপে স্থির থাকেন। তাঁর মনে হয়, এটি একমাত্র সুযোগ যেখান থেকে তিনি রহস্যের মুখোমুখি হতে পারেন। ছায়ার অদৃশ্য গতিবিধি, লন্ঠনের মায়াবী আলো এবং নদীর নীরবতা—সব মিলিয়ে যেন এক অদ্ভুত ভয়ানক এবং রহস্যময় পরিবেশ তৈরি করছে। অরিন্দমের হৃৎস্পন্দন বাড়ে, কিন্তু তাঁর কৌতূহল তাঁকে এগিয়ে নিয়ে যায়, এবং তিনি একটি সাহসী সিদ্ধান্ত নেন—এখান থেকে পিছু হটবেন না।
ছায়া ধীরে ধীরে নদীর ধারের দিকে আসে, এবং অরিন্দম লক্ষ্য করেন যে এটি কোনো মানুষেরই রূপ নয়। এটি যেন আলো এবং অন্ধকারের মধ্যে এক অদ্ভুত মিলনের প্রতীক। তিনি যতটা সম্ভব স্থির থাকার চেষ্টা করেন, প্রতিটি শব্দ, নড়াচড়া এবং আলোকে পর্যবেক্ষণ করেন। করিম মাঝি আতঙ্কে নৌকায় চেপে যাওয়ার জন্য বারবার হাত বাড়ান, কিন্তু অরিন্দম তাঁকে বাধা দিয়ে বলেন, “শান্ত থাক, করিম। শুধু লক্ষ্য কর। সত্যি জানার জন্য আমাদের সাহসী হতে হবে।” মধু বউদি নীরবে দাঁড়িয়ে অরিন্দমের পাশে থাকেন, যেন তাঁর উপস্থিতি অরিন্দমকে মানসিক সমর্থন দিচ্ছে। রাতের অন্ধকারে লন্ঠনের আলো এবং অচেনা ছায়া এক অদ্ভুত নৃত্য শুরু করে, যা অরিন্দমের বৈজ্ঞানিক ও আধ্যাত্মিক অনুভূতিকে একত্রিত করে। এই প্রথম দর্শন অরিন্দমকে জানিয়ে দেয় যে ধনডুবি গ্রামের রহস্য শুধুমাত্র লোককথা নয়—এটি বাস্তব এবং বিপজ্জনক, এবং তিনি নিজেই এখন সেই রহস্যের মুখোমুখি, যেখানে সাহস, কৌতূহল এবং সতর্কতার সমন্বয় প্রয়োজন।
৫
পূর্ণিমার রাতের পর ধনডুবি গ্রামের পরিবেশ যেন আরও গভীর ও রহস্যময় হয়ে ওঠে। অরিন্দম নদীর ধারে দাঁড়িয়ে কালো লন্ঠনের আলো পর্যবেক্ষণ করছিলেন, ঠিক তখনই দূরের অন্ধকার থেকে একটি সুর ভেসে আসে। এটি কোনো সাধারণ সুর নয়—বাঁশির মৃদু এবং মেলানকোলিক সুর যেন তাঁর শৈশবের কোনো হারানো বন্ধুর আত্মার স্পর্শ নিয়ে আসে। অরিন্দম প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁর হৃদয়ে এক অদ্ভুত আবেগ জাগে—স্মৃতির গভীরে লুকানো আনন্দ, ব্যথা, এবং একাকীত্বের মিশ্রণ। তিনি বুঝতে পারেন যে এই আলো শুধু চোখের সামনে প্রদর্শিত কোনো দৈহিক ঘটনা নয়; এটি মানুষের গভীর মন এবং স্মৃতিকে আকৃষ্ট করে। বাঁশির সুরের প্রতিটি নোট যেন তাঁর অতীতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে, হারানো দিনের স্মৃতি উন্মোচন করে। নদীর নীরবতা, বাতাসের হাওয়া, এবং লন্ঠনের নীলাভ আলো—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব সৃষ্টি করছে, যা অরিন্দমকে এক রহস্যময় ও আবেগময় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করছে।
সেই মুহূর্তে, অরিন্দম লক্ষ্য করেন মধুও কেঁপে উঠেছেন। তিনি চুপচাপ অরিন্দমের পাশে দাঁড়িয়ে, তাঁর চোখে ভয় এবং দুঃশ্চিন্তার প্রতিফলন দেখাচ্ছেন। অরিন্দম বুঝতে পারেন, মধুর ভয় কেবল ভৌতিক আলো বা ছায়ার জন্য নয়, এটি সেই মানসিক সংবেদনশীলতার জন্য, যা মানুষকে অতীত এবং স্মৃতির সঙ্গে যুক্ত করে। অরিন্দম মধুকে স্থির হতে বললেও, তাঁর মনোযোগ পুরোপুরি বাঁশির সুরের দিকে। প্রতিটি সুরে, প্রতিটি নোটে যেন একটি গল্প লুকানো—কোনো হারানো সম্পর্কের স্মৃতি, কোনো অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা, কোনো অতীতের ব্যথা। অরিন্দম বুঝতে শুরু করেন যে এই লন্ঠনের আলো এবং দূরের সুর একে অপরের সঙ্গে জড়িত। আলো মানুষের দৃষ্টি টানে, আর সুর মানুষের স্মৃতিকে। এই রহস্যময় মিলন, যা কেবল রাতের নীরবতা এবং নদীর স্রোতের মধ্যে ঘটে, অরিন্দমকে ভাবায় যে তিনি কেবল একটি বৈজ্ঞানিক ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছেন না—তিনি মানুষের অন্তরাত্মার সঙ্গে সংযোগের এক অদ্ভুত এবং অস্পষ্ট দ্বার খুলে দেখছেন।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুর আরও গভীর এবং স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অরিন্দম লক্ষ্য করেন, নদীর ধারে বাতাসে হালকা কম্পন, লন্ঠনের নরম আলো, এবং দূরে বাঁশির সুর—সব মিলিয়ে একটি একক বাস্তবতা সৃষ্টি করছে, যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়। মধু স্থির থাকতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু অজান্তেই কাঁপছেন। অরিন্দম তাঁর নোটবুক খুলে প্রতিটি সূক্ষ্ম পরিবর্তন এবং সুরের প্রভাব লিপিবদ্ধ করতে থাকেন। তিনি বুঝতে শুরু করেন যে ধনডুবি গ্রামের রহস্য কেবল ভৌতিক নয়—এটি মানুষের অভ্যন্তরীণ সংবেদন, স্মৃতি, এবং হারানো সম্পর্কের এক অদ্ভুত প্রতিফলন। এই রাত অরিন্দমকে জানিয়ে দেয় যে তিনি এখন এমন এক পর্যবেক্ষণের মুখোমুখি, যেখানে বিজ্ঞান, মানসিকতা এবং আধ্যাত্মিকতার সীমা মিলিত হয়েছে। হারিয়ে যাওয়া সুরের মধ্য দিয়ে অরিন্দম উপলব্ধি করেন যে এই রহস্যময় অভিজ্ঞতা কেবল দেখতে নয়, অনুভব করতে হবে, এবং তা করতে গেলে তাঁকে নিজের কৌতূহল, সাহস, এবং অন্তর্দৃষ্টি একত্রিত করতে হবে।
৬
ধনডুবি গ্রামের রাতের নীরবতা ক্রমেই অরিন্দমের কৌতূহলকে গভীর করে তুলছিল। গ্রামের বৃদ্ধ হরিপদের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ আলাপচারিতায় তিনি জানতে পারেন যে গ্রামের প্রতিটি পরিবারের ইতিহাসে অন্তত একটি নিখোঁজ মানুষের গল্প লুকিয়ে আছে। হরিপদ কণ্ঠে এক গভীর শোক নিয়ে বলেন, “ডক্টর সাহেব, আমার স্ত্রীও এক রাতে নদীর ধারে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। আমরা বহু চেষ্টা করেছি, অনুসন্ধান করেছি, কিন্তু কোনো খোঁজ পাইনি। সে যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে, আর শুধু স্মৃতিই রয়ে গেছে।” অরিন্দম মনোযোগ দিয়ে শুনেন, প্রতিটি কথা তাঁর হৃদয়ে এক অদ্ভুত গভীর প্রভাব ফেলে। নদীর ধারের কালো লন্ঠন, যে আলো মানুষের দৃষ্টি টানে, সেই আলো যেন মানুষের আত্মার সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। হরিপদের অভিজ্ঞতা শুধু একটি নিখোঁজ ঘটনার বিবরণ নয়; এটি গ্রামে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলা এক ধূসর ইতিহাসের অংশ, যেখানে প্রতিটি নিখোঁজ মানুষ নদীর রহস্যময় শক্তির সঙ্গে যুক্ত। অরিন্দম লক্ষ্য করেন, প্রতিটি নিখোঁজের ঘটনা শুধু মানুষের শারীরিক অদৃশ্যতার নয়—সেটি মানসিক, আবেগগত এবং আধ্যাত্মিক স্তরে একটি বিশাল প্রভাব ফেলে, যা গ্রামবাসীর দৈনন্দিন আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে।
অরিন্দমের পর্যবেক্ষণ আরও গভীর হয়ে ওঠে যখন তিনি দেখতে পান যে গ্রামের প্রতিটি পরিবারই নিখোঁজের ভয়ের মধ্যে বাস করে। কেউ কেবল কথায় প্রকাশ করে না, তবে চোখের গভীরে সেই আতঙ্ক স্পষ্ট। গ্রামের বয়স্করা সতর্ক করে বলেন, নদীর ধারে কোনো অজানা আলো বা অদ্ভুত ছায়া দেখা মাত্রই মানুষ হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। এই রহস্যময় ঘটনাগুলোর সত্যতা যাচাই করতে অরিন্দম সিদ্ধান্ত নেন পুলিশ কনস্টেবল গোপালের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। গোপাল এসে নিজের কণ্ঠে সতর্কতা জানান, তিনি অরিন্দমকে সঙ্গে নিয়ে রাতের নিরীক্ষার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু রাত নামার পরই নদীর ধারে অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়—দূরে হাহাকার, বাতাসে হালকা কম্পন, এবং এমনকি কিছু অদৃশ্য পদধ্বনি। গোপাল, যিনি সাধারণত সাহসী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সেই শব্দে কেঁপে ওঠেন। অরিন্দম তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন, তবে তাঁর মনে হয় যে রহস্য কেবল ভৌতিক নয়; এটি মানুষের মনস্তত্ত্ব, স্মৃতি এবং অজানা শক্তির এক জটিল মিশ্রণ।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অরিন্দম এবং গোপাল লক্ষ্য করেন যে নদীর ধারে প্রতিটি নিখোঁজ ব্যক্তির জন্য যেন এক নির্দিষ্ট নিদর্শন বা নিঃসঙ্গ চিহ্ন থাকে। লন্ঠনের আলো, বাতাসের নড়াচড়া, দূরের শব্দ এবং নদীর ধারা—সব মিলিয়ে এক রহস্যময় প্রক্রিয়া সৃষ্টি করে, যা মানুষকে আত্মার দিকে টেনে নিয়ে যায়। অরিন্দম নোটবুকে প্রতিটি শব্দ, পদধ্বনি, আলো এবং ছায়ার নোট লিখতে থাকেন। তিনি বুঝতে পারেন যে ধনডুবি গ্রামের রহস্য শুধুমাত্র স্থানীয় লোককথা বা কুসংস্কার নয়; এটি প্রায়শই বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত, যেখানে হারানো মানুষের স্মৃতি, গ্রামের আবহ, এবং অদ্ভুত প্রাকৃতিক ঘটনা একত্রিত হয়ে একটি জটিল ধাঁধা তৈরি করেছে। রাত শেষ হওয়ার আগে অরিন্দম উপলব্ধি করেন যে তিনি শুধু একটি রহস্যের মুখোমুখি হয়েছেন না; তিনি এক বৃহৎ, প্রজন্মান্তর ধরে চলে আসা একটি রহস্যময় প্রক্রিয়ার সাক্ষী, যেখানে হারানো মানুষরা অদৃশ্য হলেও তাঁদের গল্প, স্মৃতি এবং উপস্থিতি এখনও নদী ও গ্রামের মাঝে প্রতিফলিত হচ্ছে। এই রাত অরিন্দমকে জানিয়ে দেয় যে ধনডুবি গ্রামের রহস্যের গভীরতা এতটাই জটিল এবং বিপজ্জনক, যে এটিকে সমাধান করতে শুধু বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি নয়, ধৈর্য, সাহস এবং অন্তর্দৃষ্টি প্রয়োজন।
৭
ধনডুবি গ্রামের রাতের রহস্য অরিন্দমের বৈজ্ঞানিক মনকে এক চূড়ান্ত পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করায়। তিনি নদীর ধারে দাঁড়িয়ে কালো লন্ঠনের আলো পর্যবেক্ষণ করতে করতে নিজেকে যুক্তি দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করেন। তাঁর মনে বারবার প্রশ্ন জাগে—কেন এই আলো মানুষের দৃষ্টি টানে, কেন কেউ কাছাকাছি গেলে আর ফিরে আসে না। অরিন্দম ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেন, “এটি হয়তো কোনো প্রাকৃতিক ঘটনা। নদীর তলে থাকা গ্যাস, বিশেষত ফসফরাস, বাতাসের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করে এমন আলোর সৃষ্টি করতে পারে। এটি জ্বলে ওঠার সময় আলোর প্রকৃতি এবং প্রতিফলন মানুষের চোখকে বিভ্রান্ত করে। কেউ অজান্তেই নদীর ধারের দিকে এগিয়ে যায়, এবং এই ভুল বোঝাবুঝি ভয় তৈরি করে।” তিনি প্রতিটি পর্যবেক্ষণ, ব্যাখ্যা, এবং সম্ভাব্য বৈজ্ঞানিক কারণ নোটবুকে লিখতে থাকেন। তাঁর ভাষায় রয়েছে যুক্তি, কারণ এবং বাস্তবতার খোঁজ। তবে যত বেশি তিনি ব্যাখ্যা করেন, ততই গ্রামবাসীর চোখে ভয় এবং অনিশ্চয়তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মধু এবং গ্রামের মানুষজনের সাথে আলাপচারিতায় অরিন্দম বুঝতে পারেন যে এই আলো কেবল বৈজ্ঞানিক কারণে ব্যাখ্যা করা যায় না। মধু ভয় ও সতর্কতার সঙ্গে বলেন, “ডক্টর সাহেব, আমরা জানি প্রাকৃতিক কারণও থাকতে পারে। কিন্তু এই আলো শুধু আলো নয়। এটি মৃতদের ডাক। যারা এর কাছে যায়, তারা হয়তো শুধু দেহে নয়, আত্মায়ও নদীর কাছে টেনে আনা হয়। আমাদের পরিবারে বহু মানুষ এই আলোয় হারিয়েছে। আমরা জানি যে এটি শুধু বিজ্ঞান নয়—এটি আমাদের আত্মার সঙ্গে যুক্ত।” অরিন্দম প্রথমে হাসি দিয়ে উড়িয়ে দেন, মনে মনে ভাবেন এটি কেবল কুসংস্কার। কিন্তু গ্রামের চোখের সতর্কতা, চোখে ভয়ের ছাপ, এবং নিখোঁজ মানুষের গল্পগুলো তাঁকে থামাতে বাধ্য করে। তিনি অনুভব করেন, এই আলো কেবল দেখার বা বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের বিষয় নয়; এটি মানুষের মনস্তত্ত্ব, ভয়, এবং অতীতের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পর্কিত।
রাতের নিরবতা আরও গভীর হয়, এবং অরিন্দম বুঝতে পারেন যে বিজ্ঞান এবং লোকবিশ্বাসের মধ্যে একটি দৃঢ় সংঘর্ষ চলছে। তাঁর যুক্তি এবং প্রমাণের কথা শুনেও গ্রামের মানুষরা তাঁর ব্যাখ্যায় বিশ্বাস করতে পারেন না। তারা বলছেন, “আপনার ব্যাখ্যা শোনার পরও আমাদের ভয় কমে না। আমরা জানি, এই নদী, এই লন্ঠন, এবং এই আলো আমাদের জন্য শুধুই রহস্য নয়; এটি আমাদের আত্মার সঙ্গে সম্পর্কিত। কেউ যদি অনিরাপদভাবে কাছে আসে, সে আর ফিরে আসে না।” অরিন্দম কিছুটা হতবাক হন। তিনি উপলব্ধি করেন যে এই দ্বন্দ্ব কেবল বৈজ্ঞানিক যুক্তি বনাম লোকবিশ্বাসের নয়; এটি বাস্তবতার দুটি স্তরের সংঘর্ষ—দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য, বোধগম্য এবং অপ্রত্যক্ষ। রাতের নীরবতা, লন্ঠনের আলো, এবং নদীর স্রোতের নরম শব্দ একত্রিত হয়ে একটি অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি করে, যা অরিন্দমকে জানিয়ে দেয় যে এই রহস্য সমাধান করা সহজ নয়। তিনি নোটবুকে লিখতে থাকেন, বিজ্ঞানকে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন, কিন্তু সাথে রয়েছে গ্রামবাসীর বিশ্বাস এবং আধ্যাত্মিক সতর্কতার সমান প্রভাব। এই রাত অরিন্দমকে জানিয়ে দেয় যে ধনডুবি গ্রামের রহস্য কেবল পর্যবেক্ষণ ও ব্যাখ্যার বিষয় নয়; এটি একটি জীবন্ত দ্বন্দ্ব, যেখানে বিজ্ঞান, বিশ্বাস, আতঙ্ক এবং মানব মনস্তত্ত্ব একসঙ্গে মিশে একটি জটিল এবং বিপজ্জনক ধাঁধা তৈরি করেছে।
৮
ধনডুবি গ্রামের দ্বিতীয় পূর্ণিমার রাতটি আগের রাতের চেয়ে আরও গভীর ও রহস্যময় ছিল। অরিন্দম, কেবল নিজের কৌতূহল এবং বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের তৃষ্ণা মেনে, একা নদীর ধারে পৌঁছান। হাওয়া শীতল এবং নীরব, শুধু নদীর ধারের ঢেউ ও পাতার নড়াচড়ার হালকা শব্দ ভেসে আসে। তাঁর হৃদয়ে এক অদ্ভুত উত্তেজনা আর আতঙ্কের মিশ্রণ কাজ করছে। লন্ঠনের আলো, যা আগের পূর্ণিমায় দূরের অন্ধকারে ঝলমল করেছিল, এবার ধীরে ধীরে কাছে আসে। অরিন্দম প্রথমে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে তাকান, বিশ্বাস করতে পারেন না চোখের সামনে যা দেখা যাচ্ছে। আলো এত উজ্জ্বল এবং দৃশ্যমান, যে যেন প্রতিটি কণিকায় রহস্য এবং শক্তি লুকানো। নদীর জলের উপর আলোর প্রতিফলন এত নরম, এত প্রলুব্ধকর, যে অরিন্দম অনুভব করেন—এই আলো কেবল একটি বস্তু নয়, এটি যেন জীবন্ত, শক্তিশালী, এবং মানুষের মনের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত।
হঠাৎ অরিন্দম স্পষ্টভাবে দেখেন—ছায়ার মুখ তাঁর মৃত গবেষক বন্ধু অভিজিতের মতো। অভিজিত, যিনি বহু বছর আগে এক গবেষণার উদ্দেশ্যে সুন্দরবনের এই অঞ্চলে গিয়েছিলেন এবং অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন, এখন অরিন্দমের চোখের সামনে এক অদ্ভুত ছায়ার আকারে উপস্থিত। অরিন্দমের রক্ত হিমায়িত হয়ে যায়, কিন্তু তাঁর বৈজ্ঞানিক মন তাঁকে স্থির থাকতে বলছে। তিনি বুঝতে পারেন, এটি কেবল চোখের ধোঁকা নয়; এটি কোনো আধ্যাত্মিক এবং রহস্যময় বাস্তবতা, যা তাঁকে অভিজিতের নিখোঁজ হওয়ার ইতিহাস এবং লন্ঠনের শক্তির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করছে। তাঁকে ভয়কে চেপে ধরে রাখতে হয়, কারণ এই দৃশ্যকে নথিভুক্ত করা তাঁর একমাত্র সুযোগ। অরিন্দম ক্যামেরা খুলে দৃশ্যটি ধারণ করার চেষ্টা করেন। হালকা কম্পন, হাত কাঁপা, এবং হৃদয়ের দ্রুত স্পন্দন—সব কিছু মিলিয়ে তিনি জানেন যে এটি তাঁর জীবনের সবচেয়ে বিপজ্জনক, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধান।
আলো আরও কাছে আসে, অভিজিতের ছায়া ধীরে ধীরে অরিন্দমের দিকে এগোয়। নদীর নীরবতা, বাতাসের শব্দ, এবং লন্ঠনের উজ্জ্বল আলো একত্রিত হয়ে এমন এক পরিবেশ তৈরি করে যা চোখে দৃশ্যমান হলেও বাস্তবের সীমারেখা অতিক্রম করছে। অরিন্দম প্রতিটি মুহূর্ত ক্যামেরার লেন্সে ধারণ করতে চেষ্টা করেন, কিন্তু একই সঙ্গে তাঁর মনে গভীর প্রশ্ন জাগে—কেন এই আলো মানুষের আত্মাকে টানে, এবং কেন অভিজিতের মতো নিখোঁজরা এবার তাঁর সামনে প্রলুব্ধ হয়ে এসেছে? আতঙ্ক এবং কৌতূহলের মিলিত অনুভূতি তাঁকে প্রলুব্ধ করে, তবে তিনি স্থির থাকেন এবং সকল পর্যবেক্ষণ নোটবুকে লিখতে থাকেন। রাতের শেষ দিকে, অরিন্দম উপলব্ধি করেন যে এই দ্বিতীয় পূর্ণিমার অভিজ্ঞতা কেবল একটি রহস্য নয়; এটি একটি ব্যক্তিগত পরীক্ষা, যেখানে তাঁর সাহস, যুক্তি, এবং মানুষের অতীত ও আত্মার সঙ্গে সংযোগ পরীক্ষা করা হচ্ছে। অভিজিতের ছায়া, লন্ঠনের আলো, এবং নদীর নীরবতা—সব মিলিয়ে অরিন্দমকে জানিয়ে দেয় যে ধনডুবি গ্রামের রহস্য এখন তার জন্য কেবল পর্যবেক্ষণ নয়, এটি জীবনের সবচেয়ে গভীর, বিপজ্জনক এবং প্রলুব্ধিকর অভিজ্ঞতা হয়ে উঠেছে।
৯
দ্বিতীয় পূর্ণিমার রাতে অরিন্দম নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়, তাঁর সমস্ত মনোযোগ লন্ঠনের আলো ও অভিজিতের ছায়ার দিকে নিবদ্ধ ছিল। হঠাৎই, তাঁর ক্যামেরা অচল হয়ে যায়—লেন্সে ছবি উঠছে না, ফ্ল্যাশ কাজ করছে না। অরিন্দম চমকে উঠেন, কারণ এই মুহূর্তে তিনি বুঝতে পারেন যে শুধু আলোই নয়, পুরো পরিবেশ যেন তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। নদীর নীরবতা, বাতাসের হাওয়া, এবং লন্ঠনের নরম উজ্জ্বলতা এক অদ্ভুত চাপ তৈরি করছে, যা প্রতিটি দিক থেকে তাঁকে ঘিরে ফেলেছে। তিনি ক্যামেরার লেন্সের মাধ্যমে সবকিছু ধারণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রযুক্তি ঠিক সময়ে কাজ করছে না। হঠাৎই দূরের অন্ধকার থেকে আসে একটি পরিচিত, অদ্ভুত ডাক—কেউ তাঁর নাম উচ্চারণ করছে। অরিন্দম স্থির হয়ে শোনেন। শব্দটি যেন কেবল ধ্বনি নয়; এটি যেন শক্তির মতো, যা তাঁর মন এবং শরীরের প্রতিটি কোষে প্রবেশ করছে। এই পরিচিত কণ্ঠ তাঁকে অতীত এবং উপস্থিতির এক অদৃশ্য রেখায় টেনে নিয়ে যায়।
অরিন্দম প্রথমে ভয় পেয়েও চেষ্টা করেন স্বাভাবিক থাকতে, কিন্তু একসময় তাঁরা বুঝতে পারেন যে লন্ঠনের আলো তার নিজের নিয়মে কাজ করছে। হঠাৎই তিনি অনুভব করেন—আলো তাঁকে ধীরে ধীরে টেনে নিচ্ছে, যেন নদীর দিকে, লন্ঠনের কেন্দ্রের দিকে। তাঁর শরীর কাঁপছে, কিন্তু চোখে কেবল কালো লন্ঠনের শিখা। এই মুহূর্তে অরিন্দমের মনোযোগ, যুক্তি, এবং সজাগতা এক অদ্ভুত পরীক্ষার মধ্যে ফেলা হয়েছে। তিনি মধু এবং করিমের দিকে তাকান, যারা দৌড়ে এসে তাঁকে টানতে চেষ্টা করছেন। মধু কণ্ঠে চিৎকার করে বলেন, “ডক্টর সাহেব, থামুন! পিছু হটুন!” করিমও তাঁর হাতে ধরা দিয়ে বলছেন, “না! ফিরে আসুন! এটা বিপদ!” কিন্তু অরিন্দম নিজেকে এক অদ্ভুত আকর্ষণে আবদ্ধ অনুভব করেন। তাঁর চোখে কেবল লন্ঠনের রহস্যময় শিখা, যা তাঁকে বিদ্যমান বাস্তবতার বাইরে টানছে।
নদীর তীরের এই মুহূর্তটি অরিন্দমের জীবনের সবচেয়ে বিপজ্জনক ও প্রলুব্ধিকর মুহূর্ত হয়ে দাঁড়ায়। তিনি অনুভব করেন যে তাঁর বৈজ্ঞানিক কৌতূহল, সাহস, এবং অতীতের স্মৃতি একত্রিত হয়ে এক অদ্ভুত ফাঁদ তৈরি করছে। মধু এবং করিমে তাঁকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছেন, কিন্তু লন্ঠনের আলো যেন তাঁর আত্মার সঙ্গে খেলছে। বাতাসে হাওয়া, নদীর ঢেউ, এবং দূরের ধ্বনি—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত অমিল সৃষ্টি করছে, যা কেবল অরিন্দমকে আরও গভীরে টানছে। তিনি নিজেকে পরীক্ষা করতে থাকেন—মানসিকভাবে স্থির থাকতে, তবে লন্ঠনের রহস্যময় শিখার প্রতি তাঁর আকর্ষণ ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। এই রাতটি অরিন্দমকে জানিয়ে দেয় যে ধনডুবি গ্রামের রহস্য কেবল দর্শন বা পর্যবেক্ষণের বিষয় নয়; এটি একটি জীবন্ত ফাঁদ, যেখানে বিজ্ঞান, সাহস, আতঙ্ক এবং আত্মার সংযোগ একসাথে একটি জটিল এবং বিপজ্জনক কল্পিত জাল তৈরি করছে।
১০
পূর্ণিমার রাতের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার পর ধনডুবি গ্রামে নিস্তব্ধতা ও আতঙ্ক একই সঙ্গে বিস্তার লাভ করে। অরিন্দম, যিনি নিজেকে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান এবং রহস্যের সন্ধানে উত্সর্গ করেছিলেন, হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান। মধু, করিম এবং অন্যান্য গ্রামবাসী তাঁর জন্য গভীরভাবে চিন্তিত এবং ভীত। রাতের নীরবতা যেন আরও গাঢ় হয়ে আসে, নদীর ধারের লন্ঠনের আলো আরও রহস্যময়ভাবে জ্বলতে থাকে। গ্রামের বয়স্করা মনে করেন, এটি কোনো সাধারণ ঘটনা নয়; যে কেউ একবার লন্ঠনের কাছাকাছি যায়, সে আর শারীরিক দেহে ফিরে আসে না। মধু স্থিরভাবে বিশ্বাস করেন, অরিন্দম হয়তো এখন এক অদৃশ্য, আত্মিক রূপে ওই লন্ঠনের পাশে ঘুরছেন, তাঁর আত্মা লন্ঠনের রহস্যময় শক্তির মধ্যে আবদ্ধ। নদীর তীর, হাওয়া, এবং লন্ঠনের নরম আলো—সব মিলিয়ে গ্রামে এক অদ্ভুত এবং অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, যা প্রত্যেককে ভয়ে স্থির থাকতে বাধ্য করছে।
গ্রামের প্রতিটি পরিবার অরিন্দমের নিখোঁজ হওয়ার খবর পেয়ে আতঙ্কিত হয়। হারানো মানুষের কাহিনী এবং লন্ঠনের সাথে যুক্ত অতীতের অভিজ্ঞতা আবার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে। মধু রাতে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে তাঁর অভ্যন্তরীণ শক্তিকে জড়িয়ে ধরে, অরিন্দমের জন্য প্রার্থনা করেন এবং ভাবেন—তিনি কি সত্যিই চিরকাল এই লন্ঠনের বাঁধনে বাঁধা পড়েছেন? তিনি নদীর ধারের নীরবতা অনুভব করেন, যেখানে কেবল হালকা বাতাস এবং দূরের লন্ঠনের আলো আছে। এই আলো যেন জীবন্ত, অশরীরী শক্তি; যা মানুষের দৃষ্টি টানে, আত্মাকে স্পর্শ করে এবং অনিশ্চয়তার জগতে ডেকে নিয়ে যায়। গ্রামবাসীর আতঙ্ক ক্রমেই বাড়ছে, কারণ তারা জানে যে ধনডুবি গ্রামের এই রহস্য শুধু লন্ঠনের আলো নয়, এটি মানুষের আত্মার সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত।
শেষ দৃশ্যে, রেবতী বউদি ধীর ও গভীর কণ্ঠে বলেন, “যে আলো একবার দেখে, সে চিরকাল লন্ঠনের বাঁধনে বাঁধা থাকে।” এই শব্দের সঙ্গে, দূরে নদীর ধারে কালো লন্ঠনের অশরীরী আলো আরও উজ্জ্বলভাবে জ্বলতে থাকে। বাতাসে হালকা কম্পন, নদীর ঢেউ, এবং লন্ঠনের প্রতিফলন এক অদ্ভুত মায়াবী পরিবেশ তৈরি করছে। অরিন্দমের নিখোঁজ হওয়া, গ্রামবাসীর আতঙ্ক, এবং লন্ঠনের অশরীরী উপস্থিতি—সব মিলিয়ে ধনডুবি গ্রামে এক চিরস্থায়ী রহস্যের ছাপ ফেলে। এই রাত শুধুমাত্র শেষ আলোকছটা নয়; এটি প্রমাণ করে যে রহস্য, ভয় এবং আধ্যাত্মিক শক্তি কখনও সহজে সমাধান হয় না। লন্ঠনের আলো এখন গ্রামে এক ধ্রুব সত্যের প্রতীক, যা মানুষের কৌতূহল, সাহস এবং ভয়—সবকিছু একসাথে পরীক্ষা করে, এবং অরিন্দমের মতো যে কেউ একবার মুখোমুখি হয়, তাকে চিরকাল পরিবর্তিত করে রেখে যায়।
***