Bangla - রহস্য গল্প

বিলুপ্ত লাইব্রেরি

Spread the love

অনিরুদ্ধ পাল


অধ্যায় ১: পুরনো মানচিত্রের ছায়া

কলকাতার উত্তরে শ্যামবাজার অঞ্চলের এক পুরনো গলিতে দাঁড়িয়ে ছিল একটি জীর্ণ পোড়ো বাড়ি। গেটের উপরে অর্ধেক ভাঙা পাথরের ফলকে খোদাই করা অক্ষরগুলো প্রায় অস্পষ্ট — শুধু একটি লাইন চোখে পড়ত: “আর্কাইভ অফ টাইম – ১৮৭৪”

অর্ণব রায়, কলকাতার এক যুব ইতিহাসবিদ, সম্প্রতি ব্রিটিশ আমলের কিছু হারিয়ে যাওয়া লাইব্রেরি নিয়ে গবেষণা করছিলেন। পুরনো নথি ঘাঁটতে ঘাঁটতে তিনি একটি মানচিত্রে এই গলির উল্লেখ পান — সেখানে লেখা, “লস্ট রিডিং চেম্বার – প্রবেশ নিষেধ”।

তাঁর কৌতূহল জাগে। এমন একটি জায়গা কীভাবে এত বছর লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেল? একদিন সকালের দিকে তিনি সেই ঠিকানার খোঁজে রওনা দিলেন। হুঁশিয়ারিতে ভরা গলি, যেখানকার বাসিন্দারাও মনে রাখেনি এই লাইব্রেরির অস্তিত্ব। তিনি এক বৃদ্ধার কাছ থেকে শুনলেন —

“ছেলেমানুষ, ওদিকে যাস না। বহু বছর আগে কেউ গিয়েছিল। আর ফেরেনি।”

অর্ণব হেসে ফেললেন। তিনি ইতিহাস বিশ্বাস করেন, ভূত নয়।তবে যেই না তিনি গেট ঠেলে ঢুকলেন, একটা অদ্ভুত ঠান্ডা হাওয়া এসে গায়ে লাগল। বাড়ির দরজাটা যেন আপন-আপনিই খোলা ছিল। ভেতরে ঢুকেই তিনি দেখলেন বিশাল একটি পাথরের হলঘর — ছাদের নিচে ঝুলছে ধূলিধুসর ঝাড়বাতি। দেওয়ালের চারপাশজুড়ে তাক — হাজার হাজার পুরনো বই, নীলচে আলোর নিচে ছায়ার মত কাঁপছে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, ঘড়ির কাঁটা থেমে গেছে। দেয়াল ঘড়ি ঠিক বারোটায় আটকে আছে — অর্ণব তখন ফোনে দেখলেন ঠিক রাত বারোটা বাজে। তিনি একটা পুরনো বই টেনে নিলেন — মোটা চামড়ার বাঁধাই, নাম নেই। খুলতেই এক ধাক্কায় ঘরটা যেন ঝাঁকুনি খেল। চারপাশে গা ছমছমে নিস্তব্ধতা। হঠাৎ কোথা থেকে একটা আওয়াজ এল, যেন কেউ বলল, “পড়ো… এবং ফিরে চলো…”

দৃশ্য ঝাপসা হয়ে এল। অর্ণব আর বুঝতে পারলেন না তিনি কোন যুগে আছেন।

অধ্যায় ২: বইয়ের পাতা খুললেই

আলো-আঁধারির মধ্যে অর্ণবের মাথা ঘুরছিল। যেন চারপাশের বাস্তবতা হঠাৎ বদলে গেছে। বইখানা হাত থেকে মাটিতে পড়ে গিয়েছে। কিন্তু সেটা আর আগের মতো ঠাণ্ডা ও পুরনো ছিল না। পাতাগুলো যেন গরম হয়ে উঠেছে, অদ্ভুত এক উষ্ণতা ছড়াচ্ছে বইয়ের শরীর থেকে। তিনি চোখ খুলে তাকালেন। লাইব্রেরির হলঘরটা আর আগের মতো নেই। ধুলোর স্তর আর নেই, বইগুলো ঝাঁ চকচকে, কাঠের তাকগুলো সদ্য পালিশ করা। বিশাল এক কাঁচের জানালায় বাইরে রোদ পড়ছে, আর জানালার ওপার থেকে শোনা যাচ্ছে ট্র্যাম চলার ঠকঠক শব্দ।

অর্ণব তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর চোখ পড়ল দেয়ালে ঝোলানো একটি ক্যালেন্ডারে — তারিখ: ৩রা জুলাই, ১৯২৫।

তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। একমুঠো স্বপ্ন কি তবে? নাকি এই লাইব্রেরিই তাঁকে নিয়ে গেছে সেই সময়ে? একজন বৃদ্ধ গ্রন্থাগারিক আস্তে হেঁটে এলেন তাঁর দিকে। চুল-দাড়ি ধবধবে সাদা, পরনে সাদা ধুতি ও রেশমের পাঞ্জাবি। গলায় একটা পুরনো ঘড়ি ঝোলানো।

“আপনি নতুন পড়ুয়া বুঝি?” বৃদ্ধ কণ্ঠে বললেন।

অর্ণব কিংকর্তব্যবিমূঢ়। “…আমি… মানে… এই যে… আমি একটু আগেই…”

“শান্ত হোন,” গ্রন্থাগারিক বললেন, “আপনি আর্কাইভ অফ টাইম-এ প্রবেশ করেছেন। একবার খুলে ফেললে সেই বিশেষ বইটি, আপনি ফিরে যান সেই কালের ভিতর, যেটা বইয়ে লেখা আছে।”

অর্ণব থ হয়ে রইল।

“মানে? তাহলে কি আমি এখন ১৯২৫ সালে?”

গ্রন্থাগারিক একটু হেসে বললেন, “ঠিক ধরেছেন। তবে সময় এখানে স্থির নয়। আপনি যতক্ষণ এখানে আছেন, আপনার সঙ্গে সময়ের সংযোগ থাকবে। যতক্ষণ না আপনি ফিরে যাবার পথ খুঁজে পান, ততক্ষণ আপনি এই সময়েই আটকে থাকবেন।”

“আর ফিরে যাব কীভাবে?” অর্ণবের কণ্ঠ কেঁপে উঠল।

“ফেরার পথ একটি বিশেষ বইতে লেখা আছে। তবে আপনি সেটি নিজেই খুঁজে বের করবেন। কারণ প্রতিটি পাঠক তার নিজস্ব ‘সময়চিহ্ন’ অনুসরণ করেই ফিরে যায়।”

অর্ণব জানল, এই লাইব্রেরির নামই সত্যি — “আর্কাইভ অফ টাইম”। এইখানে শুধু বইই নয়, সময়ও সংরক্ষিত। প্রতিটি বই একেকটা সময়ের দরজা। কেউ বই খুললে, বইয়ের পাতাগুলি সময়ের দরজা খুলে দেয় — এবং পাঠক সেই সময়ে সশরীরে প্রবেশ করে। গ্রন্থাগারিক বললেন, “আপনি যদি চান, তাহলে এক্ষুনি একবার ‘রিডিং হল’-এ যান। নতুন পাঠকদের জন্য একটা বিশেষ নির্দেশিকা আছে।”

অর্ণব হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছল এক গোল ঘরে। সেখানে আরও কিছু মানুষ বসে আছেন — পোশাক দেখে বোঝা যায়, তাঁরা কেউ ১৮৫৭ সালের বিপ্লবের সময় থেকে, কেউ আবার ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের অধ্যায় থেকে এসে পড়েছেন।

একজন নারী এগিয়ে এলেন — তাঁর নাম পরিনীতা, শান্তিনিকেতন থেকে এসেছেন। তিনি বললেন, “তিন মাস আগে আমি এক কাব্যগ্রন্থ খুলেছিলাম — পুরনো ঠাকুরবাড়ির এক সংস্করণ। আর এখন আমি ১৯১২ সালে আটকে আছি।”

অর্ণবের মনে পড়ল — এই মহিলাকে তিনি আগে কোথাও দেখেছেন। হ্যাঁ, সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে তিনি একদিন গবেষণা করতে গিয়েছিলেন, তখনই এক বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ান বলেছিলেন — “একজন গবেষক ছিলেন পরিনীতা সেন নামে, হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান ২০২২ সালে। তাঁর খোঁজ আর পাওয়া যায়নি…”

তাহলে এই পরিনীতা সেই ব্যক্তি? অর্ণব ঠান্ডা ঘামে ভিজে গেল।

তাহলে এই লাইব্রেরিতে ঢুকলে মানুষ কেবল সময় ভ্রমণই করে না — তারা এই সময়ে আটকে যায়! রিডিং হলে টেবিলের উপর রাখা বইগুলো খুললে দেখা যায়, প্রতিটি বইয়ের প্রথম পাতায় লেখা —

“এই গ্রন্থ আপনাকে নিয়ে যাবে সেই সময়ে, যার বিবরণ এতে রক্ষিত। পাঠক নিজ দায়িত্বে বই খুলুন। একবার প্রবেশ করলে, ফেরার পথ শুধু আপনার অভ্যন্তরে।”

অর্ণব একটি নতুন বই হাতে নিল — “কলকাতার ছায়া: ১৯৪৩”। হঠাৎ সেখানে শোনা গেল একটা চিৎকার। এক যুবক বই খুলেই অদৃশ্য হয়ে গেল — তার চেয়ার উল্টে পড়ে থাকল মেঝেতে। ঘর জুড়ে নিস্তব্ধতা। সবাই বুঝল, আরও একজন আরেক সময়ে চলে গেল। পরিনীতা বললেন, “আপনার ফিরতে হলে আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে সেই বইটি, যেটি আপনাকে আবার আপনার সময়ে ফিরিয়ে দেবে। আমি এখনও খুঁজে পাইনি। কিন্তু আমি আশা ছাড়িনি।”

অর্ণব জানে, তাকে তার সময়চিহ্ন খুঁজে বের করতেই হবে।

অধ্যায় ৩: টেম্পোরাল কিপারের দিনলিপি

অর্ণব রায় রাতের গভীরে রিডিং হল থেকে ধীরে ধীরে ফিরে আসছিল তার দেওয়া ছোট্ট ঘরে। মাথাটা যেন জ্যামিতির অজানা গাণিতিক সূত্রে ভরা — কীভাবে একটি লাইব্রেরি তাকে সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে? কীভাবে বইয়ের পাতা খুললেই তার বাস্তব বদলে যায়? আর সেই পরিনীতা — যাকে সে ২০২২ সালের একটি রিপোর্টে ‘নিখোঁজ গবেষক’ হিসেবে পড়েছিল — আজ সেই নারী নিজেই তার চোখের সামনে!

ঘরে ঢুকে জানালার পাশে রাখা কাঠের ডেস্কে বসতেই অর্ণবের চোখে পড়ল একটা ছোট চামড়ার ডায়েরি, ধুলোমাখা, অথচ ধুলোটুকু যেন হালকাভাবে জমেছে — ঠিক যেন কেউ সদ্য রেখে গেছে। বাইরে চাঁদের আলো বইছে, জানালার কাঁচে ভেসে আছে পুরনো কলকাতার ট্র্যামের টুং টাং। অর্ণব ডায়েরিটা খুলে পড়তে শুরু করল।

আজ আবার একজন নতুন পাঠক এসেছে। দেখতে আধুনিক, কিন্তু চোখে সেই চিরচেনা কৌতূহল। যে চোখের দৃষ্টি শুধু অতীতকে বোঝার নয় — বদলানোর বাসনাতেও আচ্ছন্ন। আমি তাকে কিছু বলিনি। নিয়ম বলে, কাউকে আগে বলা যায় না তার ভাগ্য।

আমার নাম অনুব্রত। আমি আর্কাইভ অফ টাইম-এর একজন ‘টেম্পোরাল কিপার’ — সময়রক্ষক। আমার কাজ হল এই লাইব্রেরির বইগুলিকে পর্যবেক্ষণ করা, সময়ের যাত্রাপথে পাঠকদের গতিবিধি লক্ষ রাখা, এবং সময়ের কোন সুতার টান কোথায় গিয়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে, তা ধরতে পারা। কিন্তু আমি আর একজন কিপার মাত্র। সত্যিকারের নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে নেই। বইগুলোর নিজস্ব ইচ্ছা আছে — তারা কাকে কোথায় নিয়ে যাবে, কতদিন রাখবে, কাকে ফিরিয়ে দেবে না — তা নির্ধারণ করে তারাই। আমিও একদিন পাঠক ছিলাম। ১৯৮৪ সালে এই লাইব্রেরিতে প্রবেশ করেছিলাম, রবীন্দ্রনাথের জীবনের একটি দুঃখময় অধ্যায় পড়তে গিয়ে। এখন আমি আর ফিরে যেতে পারি না। সময় আমায় গ্রহণ করেনি। তবে আজ নতুন ছেলেটাকে দেখে মনে হল, সে বোধহয় ফেরার চাবি খুঁজে পাবে। অবশ্য, তার জন্য আগে এক মারাত্মক সত্যের মুখোমুখি হতে হবে — ‘আয়না ঘর’-এর রহস্য।”

অর্ণবের হাত থেকে ডায়েরিটা পড়ে গেল। এই কিপার… অনুব্রত… তাহলে কি তিনিও আটকে আছেন এই ‘সময় গ্রন্থাগার’-এ? আর সেই আয়না ঘর? কী আছে সেখানে?

হঠাৎ দরজায় টোকা। অর্ণব দরজা খুলে দেখল — সেই বৃদ্ধ গ্রন্থাগারিক দাঁড়িয়ে। তিনি শান্ত গলায় বললেন, “তোমাকে ডাকা হয়েছে। আজ রাতের তৃতীয় প্রহরে আয়না ঘর খোলা হবে। শুধু নবাগতদের মধ্য থেকে কাউকে পাঠানো হয়। আর এবার নির্বাচিত তুমি।”

“আয়না ঘর কী?”

“সময় যেখানে নিজেকে দেখে।”

অর্ণব কিছু না বলে বৃদ্ধের সঙ্গে রওনা দিল।

গ্রন্থাগারের পেছনের দিকে গিয়ে দেখা গেল একটা ছোট্ট করিডোর। করিডোরের শেষে ছিল একটা লোহার দরজা। দরজার উপরে লেখা — “Reflexio Tempora” (লাতিনে — সময়ের প্রতিবিম্ব)। বৃদ্ধ কিপার দরজা খুলে দিলেন। ভেতরে কালো ঘর। চারদিকে কাচের আয়না, মাঝখানে একটি কাঠের চেয়ার।

“তোমার কাজ একটাই,” বৃদ্ধ বললেন, “চেয়ারে বসে নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে হবে। যদি সাহস থাকে।”

অর্ণব ঢুকল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। চারদিকের আয়নায় হঠাৎ একে একে দৃশ্য ফুটে উঠল —

এক আয়নায় সে দেখল — সে একটি কনফারেন্সে বক্তৃতা দিচ্ছে, পাশে লেখা “বিশ্ব ইতিহাস সম্মেলন ২০২৭”।

অন্য আয়নায় — সে দাঁড়িয়ে আছে ভাঙা লাইব্রেরির ধ্বংসস্তূপে, পাশে লেখা — “আর্কাইভ অফ টাইম – শেষ দিন”।

আরও এক আয়নায় — সে পড়ে আছে নিঃজীব দেহ হিসেবে, হাতে সেই পুরনো বইটা, পাশে একটা ধূসর ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। শেষ আয়নায় হঠাৎ এক চেনা মুখ — পরিনীতা। তিনি ফিসফিস করে বলছেন, “তোমাকে ফিরে যেতে হবে… আমার সময় শেষ হয়ে আসছে…”

ঘরটা কেঁপে উঠল। সব আয়না হঠাৎ চূর্ণ হয়ে গেল, কাচ ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। আর একসঙ্গে একটা কণ্ঠস্বর ঘুরে উঠল — “সময় জানে, কে ফিরে যাবে… কে থেকে যাবে… তুমি কী করবে, অর্ণব?”

অর্ণব হুঁশ ফিরল তখন, যখন সে নিজের ঘরে ফিরেছে। পাশে ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা — “এখন তুমি জানো। এখন তোমার পথ শুরু। তুমি যদি সাহস করো, তবে বইটা খুলে ফেলো — ‘শেষ সূত্র’”

চোখের সামনে সেই বই — চামড়ার বাঁধাই করা, নাম নেই, শুধুই খোলা এক শেষ অধ্যায়।

অধ্যায় ৪: শেষ সূত্র

ঘরটা নিঃস্তব্ধ। অর্ণবের সামনে খোলা আছে সেই চামড়ার বাঁধাই করা পুরনো বই, যার নাম নেই, কোনো সূচিপত্র নেই, শুধু শেষ পাতার ওপরে কালো কালি দিয়ে লেখা — “শেষ সূত্র”।

তার বুকের ভেতর তীব্রভাবে কাঁপছে কিছু — ভয়? উত্তেজনা? না কি ভবিষ্যতের দৃষ্টিপথে ঢোকার এক চূড়ান্ত প্রস্তুতি? সে ধীরে ধীরে পাতা উল্টালো। প্রথমেই চোখে পড়ল এক শিরোনাম — “সময়রেখার দ্বন্দ্ব ও ধ্বংসের পূর্বাভাস”

নিচে লেখা এক বিস্ময়কর বর্ণনা:

“প্রতিটি পাঠক যিনি বিলুপ্ত লাইব্রেরিতে প্রবেশ করেন, তারা কেউই কেবল পাঠক থাকেন না। তাদের প্রত্যেককে কোনো না কোনো সময়ে সময়ের এক সুতো ধরে টেনে আনা হয়, কোনও অতীত বা ভবিষ্যতের বিভ্রান্তিতে।

‘শেষ সূত্র’ হল সেই অজানা প্রবেশদ্বার, যেখান থেকে কেউ কেউ ফিরতে পারে — যদি তারা নিজের সত্য চেনে, যদি তারা সময়ের আয়নায় নিজেকে দেখে।

তবে সাবধান — ‘শেষ সূত্র’ জানার অর্থই হতে পারে নিজেকে হারিয়ে ফেলা। কারণ সময় নিজেই এক জীবন্ত সত্তা — সে মনে রাখে, সে প্রতিশোধ নেয়।

শেষ সূত্র শুরু হয় একটি নাম দিয়ে। যে নাম চেনা, অথচ সম্পূর্ণ অচেনা…”

পাঠের সেই মুহূর্তে হঠাৎ যেন অর্ণবের চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। বইয়ের ভেতর থেকে ধোঁয়ার মতো কিছু উঠছে। তার চোখের সামনে সেই লাইন ফুটে উঠল: “সূত্র ১: নাম — মহীরুহ সেনগুপ্ত। ভবিষ্যতের সময়রেখা তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাকে থামাতে না পারলে গ্রন্থাগার ভেঙে পড়বে।”

অর্ণব চমকে উঠল। মহীরুহ? এই নাম সে আগেও কোথাও শুনেছে… মনে পড়ল, ঠিক দুই দিন আগে তার এক পুরনো বন্ধু ঋদ্ধিমান বলছিল এক গবেষকের কথা, যিনি ১৯৭৯ সালে রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যান — নাম ছিল ডঃ মহীরুহ সেনগুপ্ত। অর্ণব দ্রুত ডায়েরির শেষ পাতাগুলো উল্টাতে থাকল। প্রতিটি পাতায় শুধুই সংকেত, ইতিহাসের ছিন্ন অংশ, অজানা মানচিত্রের উল্লেখ। হঠাৎ সে দেখতে পেল একটি পৃষ্ঠা যার নিচে লেখা — “রহস্যপথ – সিঁড়ির নিচের দরজা”

লাইব্রেরির উত্তর কোণে থাকা পুরনো ধাতব সিঁড়ির নিচে একটি ছোট দরজার কথা লেখা আছে, যেটা সাধারণ পাঠকদের চোখে পড়ে না। সে দরজার পেছনে আছে “কন্ট্রোল ভল্ট” — যেখানে লাইব্রেরির সময়-স্মৃতি জমা রাখা হয়।

পরদিন রাতে, যখন পুরো লাইব্রেরি নিস্তব্ধ, অর্ণব একা বের হলো সেই সিঁড়ির দিকে। তার হাতে সেই বই, আর মনের ভেতর তীব্র কৌতূহল। সিঁড়ির নিচে এসে সে হাত বুলিয়ে নিয়ে এক জায়গায় ধাক্কা দিল। ক্লিক! একটা লুকানো প্যানেল খুলে গেল। ছোট্ট দরজাটা খুলে দিল এক অন্ধকার টানেল।

টর্চের আলো ফেলতেই দেখল — সিঁড়ির মতো পথ, দেয়ালের গায়ে অজস্র ঘড়ির ছবি। কিছু ঘড়ি চলছে, কিছু থেমে আছে, কিছু উল্টো দিকে যাচ্ছে! সব শেষে পৌঁছাল এক দরজার সামনে। দরজায় একটা লোহার ফলক, তাতে খোদাই করা:

“Control Vault of Time. Authorized Temporal Keepers Only.”

অর্ণব নিঃশ্বাস টেনে দরজা ঠেলে দিল। ভেতরে বিশাল এক গোলাকার ঘর, চারদিকে অগণিত বই, পাণ্ডুলিপি, আর মাঝখানে এক ভাসমান স্ফটিক — যাকে ঘিরে এক উজ্জ্বল বলয়। অর্ণব এগিয়ে যেতেই স্ফটিকের ভেতরে দৃশ্য ফুটে উঠল। সে দেখতে পেল — মহীরুহ সেনগুপ্ত একটি ভবিষ্যতের যন্ত্র তৈরি করছেন, যা দিয়ে লাইব্রেরির বইগুলোর সময়-চেতনা মুছে ফেলা যায়। উদ্দেশ্য — ইতিহাসকে বদলে দেওয়া। পরিবর্তন করা পৃথিবীর সময়রেখা।

আর এক দৃশ্যে — পরিনীতা দাঁড়িয়ে আছেন এক ধ্বংসপ্রাপ্ত লাইব্রেরির ধ্বংসস্তূপে, বলছেন, “যদি তুমি তাকে না থামাও, এই লাইব্রেরি আর কেউ পাবে না। সময় নিজেই বিলুপ্ত হবে।”

হঠাৎ এক বিকট শব্দে দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল। পেছনে দাঁড়িয়ে এক লোক — চুল সাদা, চোখে হালকা গোল চশমা।
তিনি ধীরে ধীরে বললেন, “তুমি যদি সত্যিই শেষ সূত্র পড়েছ, তবে জানো — আমি কে।”

“মহীরুহ সেনগুপ্ত?” — কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল অর্ণব।

“ঠিক বলেছ। আর তুমি — সেই অনুপ্রবেশকারী যে ভুল সময়ে ঢুকে ভুল জিনিস খুলে ফেলেছে। এখন একটাই রাস্তা — আমায় থামাও… যদি পারো!”

ঘরটা দুলে উঠল। স্ফটিক বিস্ফোরিত হলো আলোর ঝলকে। মহীরুহ এক যন্ত্র বের করে অর্ণবের দিকে এগিয়ে এল। অর্ণব কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। তার হাতে ছিল কেবল সেই বই — আর তার নিজের বিশ্বাস যে সে সত্যিই পাল্টে দিতে পারে সময়ের গল্প।

অধ্যায় ৫: সময়যুদ্ধ

ঘরটা আলোয় ঝলসে উঠেছে। কন্ট্রোল ভল্টের মাঝখানে মহীরুহ সেনগুপ্ত দাঁড়িয়ে, এক অদ্ভুত সময়-যন্ত্র হাতে। অর্ণবের সামনে খোলা আছে সেই ‘শেষ সূত্র’ নামক বইটি, যার পাতাগুলো অদ্ভুতভাবে কাঁপছে, যেন নিজেই সময়ের স্পন্দনে সাড়া দিচ্ছে। মহীরুহের চোখদুটো অদ্ভুত আলোয় জ্বলছে।

“তুমি জানো না, এই লাইব্রেরির ক্ষমতা কতটা বিপজ্জনক! ইতিহাস পাল্টে দিতে পারি আমি — মুছে ফেলতে পারি পুরো সভ্যতার স্মৃতি!”

অর্ণব ধীরে ধীরে পেছন দিকে সরে আসে। তার চোখ পড়ে দেয়ালের এক অংশে — যেখানে পুরনো সব ঘড়ি উল্টো দিকে ঘুরছে। এই ঘড়িরাই সময়কে এখানে নিয়ন্ত্রণ করে।

“কিন্তু কেন?” সাহস সঞ্চয় করে অর্ণব জিজ্ঞেস করল। “তুমি ইতিহাসের একজন শ্রদ্ধেয় গবেষক ছিলে। কেন এই সর্বনাশ?”

মহীরুহ হেসে উঠলেন। কণ্ঠে তীব্র বিদ্বেষ।

“আমি ছিলাম ইতিহাসের এক তুচ্ছ চাকর — কেবল পর্যবেক্ষক। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম পরিবর্তনকারী হতে। এই লাইব্রেরি আমাকে সেই সুযোগ দিয়েছে। কারণ এখানে সময় বেঁধে নেই — একেকটা বই একেকটা বিকল্প সময়রেখা! আমি চাই এমন এক ইতিহাস, যেখানে মানুষ যুদ্ধ করেনি, পুথিপত্র পোড়ায়নি, জ্ঞানকে হত্যা করেনি।”

অর্ণব বলল, “সেটা noble শোনাতে পারে, কিন্তু সেটা বাস্তব নয়! তুমি সত্য মুছে ফেলতে চাইছো! ইতিহাস বিকৃত করে কোনো ভবিষ্যৎ গড়া যায় না।”

এই কথার সঙ্গে সঙ্গেই মহীরুহ যন্ত্রটি সক্রিয় করলেন। ঘরের ভেতরে ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হলো — যেন সময় নিজেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। অর্ণব অনুভব করল তার শরীর যেন হালকা হয়ে যাচ্ছে, বাতাস তার চারপাশ থেকে সরে যাচ্ছে। যন্ত্রের বিকিরণ তাকে টেনে নিচ্ছে এক অজানা ভেতরে। হঠাৎ করেই সে চলে গেল এক সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতে। চারপাশে ভেঙে পড়া ভবন, আকাশ রক্তবর্ণ, বাতাস ভারী। সে বুঝতে পারল — এটি একটি বিকৃত ভবিষ্যৎ, যেখানে লাইব্রেরি ধ্বংস হয়ে গেছে, সময়রেখা ছিন্নভিন্ন।

একজন বৃদ্ধা এসে তাকে বললেন, “তুমি যদি কিছু না করো, এটাই হবে চূড়ান্ত ভবিষ্যৎ। মহীরুহ সব ইতিহাস মুছে দিয়েছে — কেউ জানে না রবীন্দ্রনাথ কে, বা নালন্দা কোথায় ছিল।”

অর্ণব কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আমি কী করব? আমি তো সময়যাত্রী নই!”

বৃদ্ধা হাসলেন। “কিন্তু তুমি বই-যাত্রী। লাইব্রেরির বই তোমাকে গ্রহণ করেছে। তুমি পারো।”

তার হাতে তুলে দেওয়া হল একটি ছোট পাথর — সময়স্মৃতি।

“এটি লাইব্রেরির হৃদয়। একে কেন্দ্র করে সময়কে বাঁকানো যায় — কিন্তু শুধুই যদি মন নিঃস্বার্থ হয়।”

ঝড়ের মত করে অর্ণব ফিরে এল কন্ট্রোল ভল্টে। তার সামনে এখনও দাঁড়িয়ে মহীরুহ, এবার যন্ত্র আরও ভয়ঙ্কর আকারে গর্জন করছে।

“তুমি কোথায় গিয়েছিলে?” চমকে উঠলেন মহীরুহ।

“ভবিষ্যতের সেই সময়রেখায়, যেটা তুমি গড়তে চাইছো — যেখানে কেউ কিছু মনে রাখে না, বই নেই, শিকড় নেই, ভাষা নেই!”

অর্ণব সময়স্মৃতি পাথরটি উপরের দিকে তুলতেই সেই আলো ছড়িয়ে পড়ল। ঘরের সব ঘড়ি থেমে গেল। মহীরুহ চিৎকার করে উঠলেন, “না! তুমি এটা থামাতে পারো না! এটা আমার সময়!”

কিন্তু ততক্ষণে চারপাশের বাতাস ঘন হতে শুরু করল। এক অদ্ভুত কণ্ঠ শুনতে পেল অর্ণব — “সময় শুধু ইতিহাসের নয়, স্মৃতিরও। যিনি স্মৃতি নষ্ট করতে চান, তাকেই সময় নিজেই মুছে দেয়।”

মহীরুহের শরীর ধীরে ধীরে আলোর কুয়াশায় মিশে যেতে লাগল। তাঁর মুখে একটা বিস্ময়, একটা স্বস্তিও যেন।

“হয়তো তুমিই ঠিক… হয়তো সময় কোনো একভাবে আমাদের বিচার করে…”

তারপরই তিনি অন্তর্ধান হলেন।

বাতাস শান্ত হলো। সময়ের স্ফটিক আবার কেন্দ্রে স্থিত হয়ে গেল। অর্ণব বইটি হাতে নিল।

‘শেষ সূত্র’ এখন নিজের পাতাগুলো শান্তভাবে উল্টাচ্ছে। যেন লাইব্রেরির ভেতরে সময় আবার সঠিক পথে চলতে শুরু করেছে। দেয়ালের ঘড়িগুলো আবার টিক টিক করছে। হঠাৎই ভল্টের এক দেয়ালে লেখা ফুটে উঠল — “সময় একমাত্র তাকে গ্রহণ করে, যে জ্ঞানকে সুরক্ষা দিতে চায়।”

অর্ণব বুঝতে পারল, তার কাজ এখানেই শেষ নয়। লাইব্রেরির প্রধান হলঘরে ফিরে এসে সে দেখল পরিনীতা বসে আছেন। তাঁর চোখে বিস্ময়, আনন্দ।

“তুমি পেরেছো, অর্ণব। আজ লাইব্রেরি আবার শান্ত।”

“কিন্তু এটা কি চিরস্থায়ী?”

“না,” হাসলেন পরিনীতা। “কারণ সময়ের গল্প কখনো চিরস্থায়ী নয়। প্রতিদিন কেউ না কেউ এসে নতুন পৃষ্ঠা উল্টাবে। কেউ একজন হয়তো আবার ভুল করবে। কিন্তু ততদিন তুমি থাকবে, আমি থাকব, লাইব্রেরি থাকবে।”

অর্ণব জানাল, “আমি এখানেই থেকে যাব। আমি হব এই লাইব্রেরির এক নতুন অভিভাবক।”

অধ্যায় ৬: ভবিষ্যতের পাঠক

লাইব্রেরি এখন অনেকটাই নিস্তব্ধ। সময়ের ঘূর্ণাবর্ত থেমে গেছে, মহীরুহ আর নেই, কিন্তু তার রেখে যাওয়া ছায়া এখনও দেয়ালজুড়ে যেন ছায়া ফেলে রেখেছে। অর্ণবের দিন কাটছে বইয়ের পাহাড়ে, সেইসব অদ্ভুত বই যেগুলোর প্রতিটি পৃষ্ঠা একেকটা সময়রেখার দ্বার। আর পরিনীতা, এক রহস্যময় পথপ্রদর্শক, যিনি কি না নিজেও এই লাইব্রেরির অংশ—প্রতিটি অলিন্দে তার ছায়া যেন ছড়িয়ে আছে। সেদিন ছিল এক অদ্ভুত সকাল। অর্ণব টেবিলে বসে লাইব্রেরির মানচিত্র আঁকছিল—কারণ এই বিশাল ভবনের অনেক গোপন কক্ষ এখনও তার অজানা। ঠিক তখনই প্রধান প্রবেশদ্বারে শব্দ হল—পুরনো কাঠের কপাটটা খোলার ধ্বনি। অর্ণব উঠে গেল দেখতে, এমন কেউ এল কি না যে সময়ের পথ ভুল করে এখানে এসে পড়েছে। কিন্তু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক কিশোর। বয়স বড়জোর ষোলো। হাতে একটা আধুনিক ই-রিডার, চোখে ভার্চুয়াল গ্লাস, পিঠে একটা ছোট ব্যাগ।

“এই… এটা কি ‘টাইম-আর্কাইভ লাইব্রেরি’? আমি একটা অদ্ভুত QR কোড স্ক্যান করে এখানে চলে এসেছি,” বলল সে কৌতূহলী স্বরে। অর্ণব স্তব্ধ।

“তুমি কোথা থেকে এসেছো?”

“আমি ২০৫৯ সালের পাঠক। আমি ভেবেছিলাম এটা কোনো ভার্চুয়াল সিমুলেশন। কিন্তু এখানে তো সব বাস্তব!”

অর্ণব হেসে ফেলল।

“তুমি ভবিষ্যতের পাঠক! এই লাইব্রেরি সব সময়কে গ্রহণ করে। কিন্তু কেমন তোমাদের যুগে বই পড়া?”

“বই তো আছে, কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সবকিছু সাজিয়ে দেয়, কেমন যেন নির্জীব। আমি খুঁজছিলাম কিছু ‘আসল’। আর এই কোডটা স্ক্যান করতেই, আমি একটা লাল আলোয় ডুবে গিয়েছিলাম… আর তারপর তোমার দরজায়!”

কিশোরটির নাম — ঋভু। সে বলে, “আমি পুরোনো বাংলা গল্প ভালোবাসি। আমার দাদু রবীন্দ্রনাথ আর শরৎচন্দ্রের পুরোনো বইগুলো পড়াতেন, যদিও ওগুলো আজকাল নিষিদ্ধ প্রায়। আমি তো একদিন লাইব্রেরির বুকে ডুব দিতে চেয়েছিলাম… আর সত্যিই এসে পড়লাম এখানে!”

অর্ণব তাকে নিয়ে গেল লাইব্রেরির “স্মৃতি-কক্ষ” নামে পরিচিত এক অংশে। সেখানে শত শত হাতের লেখা পাণ্ডুলিপি, ছাপা হয়নি এমন কাহিনি, অদ্ভুত অক্ষরে লেখা বই। ঋভু একটার পর একটা বই পড়তে শুরু করল। তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।

“এই লাইব্রেরি কি আমাদের ভবিষ্যৎ থেকে গোপন রাখা হয়েছে?” সে প্রশ্ন করে।

“না, বরং ভবিষ্যতের পাঠকদের জন্যই তো রক্ষা করে রাখা। তবে এটা কেউ খুঁজে পায় না, যদি না তারা প্রকৃত পাঠক হয়,” উত্তর দেয় পরিনীতা, যিনি অদৃশ্য থেকেও সব শুনছিলেন।

ঋভু হঠাৎ এক পুরনো কাঠের দরজার সামনে দাঁড়ায়। দরজার গায়ে লেখা — “ভবিষ্যতের পাঠক, তুমি প্রস্তুত তো?”

অর্ণব তাকে থামাতে যায়, কিন্তু দরজাটি নিজেই খুলে যায়।ভেতরে এক অন্ধকার ঘর — দেয়ালে অসংখ্য বই, কিন্তু প্রতিটির পেছনে বসানো একরকম সময়-ক্যাপসুল। সেগুলোতে লেখা: “নতুন সময়ের জন্য সংরক্ষিত”, “বহিষ্কৃত ইতিহাস”, “নিষিদ্ধ কাব্য”।

ঋভু বলে, “আমার যুগে এই লেখাগুলো পাওয়া যায় না। ইতিহাসও ভুলে গেছে আমাদের শিকড়। আমি যদি এখান থেকে কিছু নিয়ে ফিরি, তবে কি সেটা চুরি হবে?”

অর্ণব একটু চিন্তা করে বলল, “না। তুমি যদি পাঠক হও, তাহলে তুমি বাহকও — স্মৃতির বাহক। সত্যিকারের পাঠক স্মৃতি বহন করে, চুরি নয়।”

ঠিক তখনই চারপাশ ঝলসে উঠল। একটা উচ্চ স্বরে কম্পন — “অসামঞ্জস্য সময়গমন সনাক্ত হয়েছে। বহিরাগত পাঠক, তুমি নিয়ম ভেঙেছো।”

তিনটি ছায়ামূর্তি ঘরে প্রবেশ করল। তারা সময়রক্ষী — এই লাইব্রেরির রক্ষক, যারা সময়ের ভারসাম্য বজায় রাখে।

“এই কিশোর এখনও প্রস্তুত নয়। ভবিষ্যতের তথ্য সে বহন করলে টাইম-রিভার্সাল হতে পারে,” বলল এক ছায়া।

অর্ণব সামনে দাঁড়িয়ে যায়।

“সে এক সত্যিকারের পাঠক। সে কিছু নেয়নি, কেবল বোঝার চেষ্টা করছে। সময় বদলায় পাঠকদের জন্য, শুধু সময়রক্ষীদের জন্য নয়।”

পরিনীতা এবার প্রকাশ্যে আসে।

“তোমরা ভুলে গেছো, লাইব্রেরি শুধু রক্ষা করার জায়গা নয়, ভাগ করে নেওয়ারও জায়গা। এই পাঠক সেই জিনিস খুঁজছে যা তার যুগে হারিয়ে গেছে। তাকে যদি থামাও, তবে ভবিষ্যৎ আরও শূন্য হবে।”

ছায়ারা থেমে যায়।

“তাহলে একটি পরীক্ষা,” তারা বলে।

ঋভুকে বলা হয়, একটি বই খুলতে — যেটা লাইব্রেরির প্রাচীনতম সময়ের। বইটি নিজেই প্রশ্ন করবে।

বইটির নাম — “অক্ষরলোক”। সেটা খুলতেই পাতাগুলো হাওয়ায় ওড়াতে থাকে। একটা কণ্ঠ ভেসে আসে —

“তুমি কেন পাঠ করতে চাও?”

ঋভু নির্ভরতায় বলে, “কারণ আমি ভুলে যেতে চাই না। আমরা যাদের কথা ভুলে গেছি, আমি তাদের ফিরিয়ে আনতে চাই আমার মধ্যে। আমি চাই আগামী প্রজন্ম জানুক কোথা থেকে আমরা এসেছি।”

বইয়ের পৃষ্ঠায় ঝলসে উঠল এক আলো — “তুমি প্রস্তুত। সময় তোমার পথ উন্মুক্ত করুক।”

ছায়ারা মাথা নিচু করে হেঁটে চলে যায়।

ঋভুকে বিদায় জানাতে আসে অর্ণব ও পরিনীতা। লাইব্রেরির প্রবেশদ্বার আবার সেই লাল আলোয় ঝলসে উঠেছে, তার পথ খুলে দিয়েছে ভবিষ্যতে ফেরার।

“তুমি মনে রাখবে তো এখানে যা দেখলে?” অর্ণব জিজ্ঞেস করে।

ঋভু বলে, “আমার মনে থাকবে… আর আমি আমার যুগের ছেলেমেয়েদের বলব—বইয়ের গন্ধ, শব্দের জাদু, অতীতের ইতিহাস… সব কিছু। আমি হয়তো ফিরতে পারব না, কিন্তু আমি সব নিয়ে যাব।”

তার চোখে জল। অর্ণব তাকে জড়িয়ে ধরে।

“তুমি আমাদের আশা। ভবিষ্যতের পাঠক।”

ঋভু চলে যায়। দরজাটা আবার বন্ধ হয়। অর্ণব তাকিয়ে থাকে সেই ফাঁকা দরজার দিকে। পরিনীতা ধীরে এসে পাশে দাঁড়ায়।

“তুমি জানো, হয়তো আবার কেউ আসবে। হয়তো আরও এক পাঠক, আরও এক সময়যাত্রী।”

অর্ণব মৃদু হেসে বলে, “আমি অপেক্ষা করব। লাইব্রেরি তো চুপ করে থাকতে পারে, কিন্তু পাঠকেরা তো হারিয়ে যায় না। কে জানে, হয়তো একদিন আমি নিজেও হব ভবিষ্যতের পাঠক।”

অধ্যায় ৭: শেষ পৃষ্ঠা

বাইরে তখন গা-ছমছমে সন্ধ্যা। পশ্চিমের আকাশে লালচে আলো, যেন রক্তাক্ত সূর্য অস্ত যাচ্ছে। লাইব্রেরির বারান্দা থেকে সেই আলো এসে পড়েছে সিঁড়িতে। অর্ণব জানে, সব কিছুর শেষ যেমন থাকে, তেমনি নতুন শুরুও থাকে শেষের গর্ভে। কিন্তু আজকের সন্ধ্যাটা অন্যরকম। কোথাও একটা অদ্ভুত সুনসান। যেন শব্দও সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে গেছে।

অর্ণব লাইব্রেরির ‘স্মৃতির কক্ষ’-এ ঢুকে পড়ল। এটাই লাইব্রেরির সবচেয়ে পুরনো অংশ, যেখানে খোলা থাকে না জানালা, আলো এসে পড়ে না, আর বইগুলো নিজেদের মতো জেগে থাকে ঘুমন্ত পাঠকদের অপেক্ষায়। সে এক পুরনো বই টেনে বের করল—তাতে কোনো নাম নেই। মলাটে ছোপছোপ ছাই, কিছু অংশ পুড়ে গেছে। কিন্তু মাঝখানে এখনও একটুকরো বাক্য স্পষ্ট— “শেষ পৃষ্ঠা কখনও লেখা থাকে না, সেটা পাঠককেই লিখতে হয়।”

অর্ণব বইটা খুলতে গেল, কিন্তু তখনই পুরো ঘরটা এক ঝাঁকুনিতে কেঁপে উঠল। দেয়ালে একটা ফাটল দেখা দিল। লাইব্রেরি কেঁপে কেঁপে উঠছে যেন! দেয়ালের দিকে তাকিয়ে অর্ণব দেখতে পেল এক সোনালী আলো ফুটে উঠেছে—লাইব্রেরির সংকেত, যা কেবল শেষ মুহূর্তে জ্বলে। পরিনীতা ছুটে এল।

“সময়ের ভারসাম্য ভেঙে যাচ্ছে। লাইব্রেরির সীমান্তে ফাটল ধরেছে। বহির্বিশ্ব জানছে এই জায়গার অস্তিত্ব। আমাদের সময় শেষ!”

অর্ণব স্তব্ধ হয়ে গেল।

“তবে কি লাইব্রেরি ধ্বংস হতে চলেছে?”

“না, লাইব্রেরি ধ্বংস হয় না। ও হারিয়ে যায়। সময়ের এক গোপন অলিন্দে গুটিয়ে নেয় নিজেকে। পাঠকদের জন্য আবার একদিন ফিরে আসে। কিন্তু এই রূপে নয়।”

অর্ণব জানে—এখন তার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সে এই লাইব্রেরির শেষ পাঠক। তাকে ঠিক করতে হবে কী রেখে যাবে ভবিষ্যতের জন্য।

অর্ণব নিজের ডেস্কে গিয়ে একটা কাগজ টেনে নিল। সেখানে লেখা শুরু করল— “আমি অর্ণব। আমি এই লাইব্রেরির শেষ পাঠক। আমার দেখা সময়ের গল্প, আমার চোখে ধরা পড়া বইয়ের জাদু—সব লিখে যাচ্ছি, যেন কেউ একদিন খুঁজে পায় এই স্মৃতি…”

সে লিখে চলল—ঋভুর কথা, ভবিষ্যতের পাঠক, মহীরুহের মৃত্যু, প্রথমদিনের সেই গন্ধ, পরিনীতা, আর বইয়ের কথা—যেগুলো সময়কে ভুলিয়ে রাখত। লেখা শেষে সে বইটা রাখল সেই নামহীন বইয়ের শেষ পাতায়।

“এটাই হোক লাইব্রেরির শেষ পৃষ্ঠা”—বলে সে পাতা বন্ধ করল। আবার কম্পন শুরু হল। বইগুলো এক এক করে আলোর বলয়ে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। কাঠের তাকগুলো ফাটল ধরছে। দেওয়ালে সময়ের রেখা ক্রমে মুছে যাচ্ছে।

পরিনীতা বলল— “তুমি আর ফিরতে পারবে না, অর্ণব। চাইলে এই লাইব্রেরির সঙ্গে মিশে যেতে পারো—সময়ের আত্মায়।”

অর্ণব মৃদু হাসল।

“লাইব্রেরি একা হতে পারে, কিন্তু পাঠক একা নয়। যতদিন পাঠক থাকবে, এই লাইব্রেরি ফিরবে। হয়ত অন্য নামে, অন্য রূপে, কিন্তু ফিরবেই।”

সে ধীরে ধীরে লাইব্রেরির মধ্যভাগে গিয়ে দাঁড়াল। চারপাশে তখন ঘূর্ণাবর্ত, শব্দ, আলো, ছায়া সব মিলেমিশে এক অদ্ভুত মহাশূন্যতায় পরিণত হচ্ছে। একটি ধোঁয়ার মতো সাদা আলো নেমে এল তার শরীরের ওপর।

পরিনীতা তার দিকে হাত বাড়াল।

“তুমি প্রস্তুত তো?”

অর্ণব মাথা নাড়ল।

“হ্যাঁ। শেষ পৃষ্ঠা আমি লিখেছি। এবার সময় অন্যের।”

আলো তাকে গিলতে গিলতে অদৃশ্য করে দিল।

অনেক বছর পরে…

এক বৃষ্টিভেজা সকালে কলকাতার উত্তর শহরের এক পুরনো গলিতে এক ছোট্ট মেয়ের হাতে ধরা একটি বই। বইটা নামহীন, ছেঁড়া পাতার ভেতরে লেখা— “শেষ পৃষ্ঠা কখনও লেখা থাকে না, সেটা পাঠককেই লিখতে হয়।”

মেয়েটা তার বাবাকে প্রশ্ন করে, “বাবা, এই বইটা কোথা থেকে এল?”

বাবা হেসে বলে, “জানো না? ওটা এক বিলুপ্ত লাইব্রেরির গল্প। যেখানে সময় হারিয়ে যেত, আবার ফিরে আসত। তুমি যদি সত্যি পাঠক হও, তাহলে বইটা তোমার জন্যই অপেক্ষা করছে।”

মেয়েটা চোখ বড় করে বলে, “তাহলে আমি কি যেতে পারি সেখানে?”

বাবা হেসে বলল, “তুমি হয়ত সেখানে একদিন পৌঁছবে, হয়তো এক লাইব্রেরির পেছনের গলিতে… সময় যদি চায়।”

লাইব্রেরি আর নেই। কিন্তু একটা কথা বাতাসে রয়ে গেছে।

“পাঠক কখনও হারিয়ে যায় না।”

 

সমাপ্ত

1000022634.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *