চয়নিকা মজুমদার
এক
ঈশান সেনগুপ্তর বয়স ২৮। চিত্রশিল্পী, কিন্তু ভিড়ভাট্টা শহরের কোলাহলে তার তুলি আর রঙ একেবারেই শ্বাস নিতে পারছিল না। কলকাতার দক্ষিণে বাবা-মায়ের পুরোনো ফ্ল্যাটে বসবাস করতে করতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, যেখানে প্রতিদিন শব্দ, যানজট, অজস্র মানুষের দৌড়ঝাঁপ তাকে গ্রাস করে ফেলত। তাই একদিন সে ঠিক করল—নিজেকে গুছিয়ে নিতে হলে, একা হয়ে নিজের সৃষ্টিকে নতুন করে শুরু করতে হলে, তাকে চাই এক শান্ত আশ্রয়। বহু খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে সে পায় উত্তর কলকাতার এক পুরোনো ভাড়া-বাড়ি। গলির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটা যেন অনেক কিছুর সাক্ষী হয়ে গম্ভীর হয়ে বসে আছে—মলিন দেওয়াল, ভাঙা বারান্দার কার্নিশ, অচেনা ঘ্রাণে ভরা স্যাঁতসেঁতে ঘর, আর উপরে ম্লান হয়ে যাওয়া সবুজ জানলার পাল্লা। তবু ঈশানের মনে হল এই জায়গাই তার উপযুক্ত। সে যেন শুনতে পাচ্ছিল—দেওয়ালের ভেতর চাপা গল্প, পুরোনো দিনগুলোর ছাপ, যেগুলো হয়তো কেউ আর শোনে না। ঠিক করল, এখানেই শুরু হবে তার নতুন অধ্যায়। চাবি হাতে নিল, আর সেই ভাঙাচোরা কাঠের দরজা ঠেলে ঢুকে গেল তার একাকী পৃথিবীতে।
বাড়িটায় ঢোকার প্রথম রাতটাতেই ঈশান টের পেল কিছু ভিন্নতা। চারপাশের গলিগুলো যেমন ব্যস্ত দিনের শেষে নীরব হয়ে যায়, তেমন নয়—এখানকার নীরবতা যেন ভেতর থেকে চেপে বসে। একটা অচেনা চাপা স্তব্ধতা, যেটা বাইরের শব্দকে গিলে ফেলে। ঘরের কোণে রেখে দেওয়া পুরোনো ফার্নিচার, মাকড়সার জালে ঢাকা জানলা, অর্ধেক খোলা দরজা—সবকিছু যেন দমবন্ধ করা গোপনীয়তায় ভরে আছে। বাতাসে ভেসে আসা অদ্ভুত গন্ধে সে বুঝল, এই বাড়ি বহুদিন খালি পড়ে ছিল, মাঝে মাঝে হয়তো কেবল ঝাঁটা দেওয়া হয়েছে। অথচ কেমন যেন মনে হল—বাড়িটা একেবারেই ফাঁকা নয়। খাওয়ার পর আঁকতে বসতেই দরজার ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া এলো, অথচ জানলা বন্ধ। আলো-আঁধারির খেলা যেন ঘরের ভেতরে এক অচেনা ছায়াকে নাচিয়ে দিল। ঈশান থমকে গেল, তারপর নিজেকে বোঝাল—এ সবই তার কল্পনা, নতুন জায়গায় এসেই অস্বস্তি হচ্ছে। তবুও মনে হল, কেউ যেন তাকে গভীরভাবে লক্ষ্য করছে। তার তুলি থেমে গেল, আর বুকের ভেতর চাপা কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ল।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নীরবতা আরও ভারী হয়ে উঠল। পাশের বাড়িগুলোর জানলা থেকে আলোর রেখা একে একে নিভে গেল, রাস্তায় ভেসে আসা অটো-রিকশার শব্দও থেমে গেল, কেবল মাঝে মাঝে কোনো কুকুরের ডাক প্রতিধ্বনির মতো ভেসে এলো। ঘরের ভেতর তখন যেন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে সেই অদ্ভুত উপস্থিতি। বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করলেও ঈশান অনুভব করল—কেউ যেন তার পাশ দিয়ে ধীরে হেঁটে গেল, বাতাসে নরম পায়ের শব্দ ভেসে উঠল। হঠাৎ করে আলগা জানলার পাল্লা কেঁপে উঠল, কাঠের দরজা ঠকঠক শব্দ করল। বিদ্যুতের আলো টিমটিম করে নিভে গিয়ে আবার জ্বলে উঠল। ঈশান উঠে জানলা চেক করল, বাইরে অন্ধকার গলি ছাড়া কিছু নেই। কিন্তু মনে হল, এই বাড়ি যেন শ্বাস নিচ্ছে—তার চোখের অগোচরে নিঃশ্বাস, তার কানে ধরা না পড়া ফিসফিসানি। প্রথম রাতেই সে বুঝল, এই বাড়ি শুধু ইট-কাঠ-পাথরের নয়; এখানে লুকিয়ে আছে এক অনির্বচনীয় নীরবতা, যা হয়তো তাকে কিছু জানাতে চাইছে। ঈশান তখনও জানত না—এই নীরবতার ভেতরেই অপেক্ষা করছে এমন এক উপস্থিতি, যে তার জীবনকে বদলে দেবে চিরতরে।
দুই
প্রথম রাতের অস্বস্তি কাটিয়ে সকালে ঈশান নিজেকে বোঝাল—সবটাই আসলে তার মনের খেলা। নতুন বাড়ি, অপরিচিত পরিবেশ, আর চারপাশে গাঢ় নীরবতা—এই সবই তাকে একটু নার্ভাস করে তুলেছে। দিনের আলোয় বাড়িটার চেহারা একেবারেই আলাদা মনে হল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে দেখল, রাস্তার ধারে কচি রোদ এসে পড়েছে, পাড়ার বাচ্চারা স্কুলের পোশাক পরে বেরোচ্ছে, কোথাও ভ্যানগাড়ির ঘণ্টা বাজছে—সবকিছু স্বাভাবিক। সে ভাবল, সত্যিই তো, ভূত-প্রেত বলে কিছু হয় নাকি! দুপুরে নিজের ক্যানভাস সাজাল, নতুন কয়েকটা খসড়া আঁকতে বসল। অথচ অদ্ভুত ব্যাপার, বারবার হাত তাকে একই ধরনের রেখায় নিয়ে যাচ্ছিল—একটা মেয়ের অবয়ব। স্পষ্ট নয়, তবু চুল খোলা, পাতলা শাড়ি পরা একটা মুখ বারবার ভেসে আসছিল তার তুলির টানে। ঈশান আঁকতে আঁকতে হঠাৎ চমকে উঠল, কারণ ছবির চোখ যেন সরাসরি তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে মাথা ঝাঁকিয়ে সিগারেট ধরাল, নিজেকে বোঝাল যে শিল্পীর কল্পনা এমনই উড়তে থাকে। কিন্তু সন্ধ্যা নামতেই আবার সেই চাপা নীরবতা ঘন হয়ে এল। চারপাশে কোলাহল থেমে গেলে ঘরটা যেন ভারী হয়ে গেল, যেন তার প্রতিটি নিঃশ্বাস কেউ শুনছে।
রাত বাড়তে শুরু করলে অদ্ভুত শব্দ পাওয়া গেল। দরজা-জানলার ফাঁক দিয়ে হাওয়ার ঝাপটা নয়, বরং যেন হালকা পায়ের শব্দ। প্রথমে মনে হল, ওপরতলার ঘরে হয়তো কেউ হেঁটে বেড়াচ্ছে, কিন্তু পরে মনে পড়ল—ওই তলায় তো কেউ থাকে না! শব্দটা ধীরে ধীরে কাছে এল, যেন কাঠের মেঝেতে কারও পায়ের চাপ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। ঈশান বুক ধড়ফড় করতে করতে টেবিল ল্যাম্প জ্বালাল, তবুও আলোয় ফাঁকা ঘর ছাড়া কিছু নেই। সে নিজের স্নায়ু শান্ত করার জন্য পানির গ্লাস হাতে তুলে নিল, কিন্তু হাত কেঁপে গিয়ে জল ছলকে পড়ল। তার মনে হল, এ হয়তো নিছক হ্যালুসিনেশন, অতিরিক্ত একাকীত্বের ফল। তখনই চোখ গেল দেওয়ালের আয়নার দিকে। পুরোনো, ধুলোমাখা সেই আয়নাটা দিনের বেলা নজরে পড়লেও তেমন গুরুত্ব দেয়নি সে। কিন্তু এখন ল্যাম্পের আলোয় তার প্রতিফলন যেন অন্যরকম লাগছিল। চোখ আটকে গেল সেখানে—কয়েক সেকেন্ডের জন্য সে দেখল, নিজের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা মুখ। ম্লান আলোয় ভেসে ওঠা মুখ, যেন সাদা পোশাকের আভাস, আর গভীর, স্থির দৃষ্টি।
ঈশান মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ করে প্রতিফলন মিলিয়ে গেল, কেবল নিজের ভয়ার্ত মুখ দেখা গেল আয়নায়। বুকের ভেতর ধকধক শব্দ এত জোরে হচ্ছিল যে সে মনে করল, বাইরেও হয়তো শোনা যাচ্ছে। সাহস সঞ্চয় করে সে পিছন ফিরে তাকাল, কিন্তু ঘরে কেউ নেই। ফাঁকা ঘর, দেয়ালের ছায়া, আর টেবিলের উপর ছড়িয়ে থাকা তার আঁকার খাতা—শুধুই এই বাস্তবতা। তবু সে জানত, কয়েক মুহূর্ত আগেই যা দেখেছে তা নিছক বিভ্রম নয়। গলা শুকিয়ে গেল, সে জানলা খুলে সিগারেট ধরাল। বাইরের অন্ধকার গলিতে নরম বাতাস বয়ে গেল, কিন্তু ভেতরে তখনও যেন ভেসে বেড়াচ্ছে অচেনা এক উপস্থিতির গন্ধ। বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করতে গেলেও সেই দৃশ্যটা তাকে তাড়া করল—আয়নায় ঝলকে ওঠা অপরিচিত মুখ। তখনই সে বুঝল, এই বাড়ি হয়তো কেবল তার একার নয়, এখানে আর কেউ আছে, যে তার প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ্য করছে। আর সেই অচেনা উপস্থিতিই তাকে ধীরে ধীরে এক অজানা যাত্রার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
তিন
দ্বিতীয় রাতের সেই অভিজ্ঞতার পর ঈশান নিজেকে বোঝাতে চাইল—সবই বিভ্রম। কিন্তু পরদিন সকাল থেকে তার ভেতরে এক অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করতে লাগল। নিজের স্টুডিওর মতো সাজানো ঘরটায় বসে তুলি হাতে নিলেও, সে বুঝতে পারছিল, হাত যেন তার নিয়ন্ত্রণে নেই। ক্যানভাসে যখন রঙ মেশাতে লাগল, তখন বারবার ভেসে উঠছিল এক নারীমূর্তি। চুল খোলা, সাদা শাড়ি, অনিমেষ দৃষ্টি—এই অবয়ব যেন তার মনের ভেতরে আগে থেকেই বসে ছিল। অথচ ঈশান কখনও এমন কাউকে দেখেনি। ছবির প্রতিটি টানে সেই মুখ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, যেন অদৃশ্য কেউ তার হাত ধরে রেখেছে। কিছুক্ষণ পর সে থেমে গিয়ে আঁকা ছবিটার দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল—এটা তো ঠিক সেই মুখ, যা সে গতরাতে আয়নায় দেখেছিল! ভেতরটা শিউরে উঠল, অথচ সে ছবির থেকে চোখ সরাতে পারল না। মনে হল, এই মেয়েটা তার ভেতরে কোথাও আগে থেকেই ছিল, আজ কেবল বাইরে ফুটে উঠেছে।
সন্ধ্যা নামলেই আবার চারপাশে সেই অদ্ভুত চাপা নীরবতা নেমে আসে। ঘরের আলো-আঁধারির খেলা যেন প্রতিনিয়ত তার স্নায়ুর উপর আঘাত করছিল। খাওয়ার পর টেবিলে বসে খাতা উল্টাচ্ছিল সে, হঠাৎ চোখে পড়ল জানলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ছায়া। ঝলমলে বিদ্যুতের আলোতে মুহূর্তের জন্য স্পষ্ট দেখা গেল—সাদা শাড়ি পরা এক মেয়ের অবয়ব, লম্বা চুল কাঁধ বেয়ে নেমে আসছে, মুখটা অস্পষ্ট কিন্তু চোখ যেন তাকে ভেদ করে যাচ্ছে। ঈশান ঘেমে উঠল, বুকের ভেতর কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ল। সাহস করে উঠে দাঁড়াতেই অবয়বটা মিলিয়ে গেল, যেন কখনও ছিলই না। জানলার বাইরে শুধু রাতের অন্ধকার আর কুয়াশার মতো বাতাস ভেসে বেড়াচ্ছে। সে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর ধীরে ধীরে চেয়ার টেনে বসল, কিন্তু আঁকতে গেলে আবার হাত একই নারীমূর্তির রেখা টেনে দিতে লাগল। ঈশান বুঝতে পারল, এই উপস্থিতি থেকে সে পালাতে পারছে না—ছায়াটা যেন তার মনের ভেতরে ঢুকে গেছে।
রাত যত বাড়ল, উপস্থিতি তত তীব্র হল। ঈশান বিছানায় শুয়ে থাকলেও বুঝতে পারছিল, কেউ যেন ঘরে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কখনও ফিসফিস শব্দ, কখনও পর্দার হালকা দুলে ওঠা, আবার কখনও হঠাৎ ঠান্ডা বাতাসে শরীর কেঁপে ওঠা—সবই প্রমাণ দিচ্ছিল যে সে একা নয়। সে উঠে আবার ক্যানভাসের দিকে গেল, আর আঁকার উপর চোখ পড়তেই বুক কেঁপে উঠল। ছবির চোখদুটো যেন এবার একেবারে জীবন্ত হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অচেনা সেই মেয়েটার মুখ ক্রমে আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে, যেন ছবির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ঈশান আতঙ্কিত হলেও অদ্ভুতভাবে টের পেল, ভয়ই একমাত্র অনুভূতি নয়—এর সঙ্গে এক অজানা টান মিশে আছে, যা তাকে ছায়ার দিকে আকর্ষণ করছে। ঠিক তখনই বাতি নিভে গেল এক মুহূর্তের জন্য, আর অন্ধকারে সে অনুভব করল জানলার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছায়া আবার তাকে দেখছে। মুহূর্তের জন্য বিদ্যুতের আলো ঝলক দিলে দেখা গেল—ছায়া যেন তাকে হাসল, তারপর মিলিয়ে গেল চিরকালের মতো। ঈশান বুঝতে পারল, এই মেয়েটা বাস্তবের নয়, তবুও তার অস্তিত্ব তাকে আঁকড়ে ধরে ফেলছে। এই নামহীন ছায়াই এখন থেকে তার দিন-রাতের সঙ্গী হয়ে থাকবে।
চার
তৃতীয় রাতের সেই অভিজ্ঞতার পর ঈশান নিজের মনে স্থির করেছিল—আর যাই হোক, তাকে এই রহস্যটা বুঝতেই হবে। কিন্তু ঠিক তখনই হাজির হল গোপাল কাকা। বাড়িওয়ালা তাকে আগেই জানিয়েছিল, ভাড়াটেদের সুবিধার জন্য এক বৃদ্ধ চাকর থাকে, যে সপ্তাহে কয়েক দিন এসে বাড়ির ধুলোঝাড়ু, বাজার-সদাই, আর খুঁটিনাটি কাজ করে দেয়। পরদিন সকালে আঁকার ফাঁকে যখন ঈশান বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাচ্ছিল, তখন গলির ভেতর দিয়ে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এগিয়ে এলেন গোপাল কাকা। বয়স আশির কাছাকাছি, চামড়া কুঁচকে যাওয়া, চোখে ঘোলাটে জল, মুখে চিরন্তন ক্লান্তি। তিনি ঘরে ঢুকেই খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঝাঁটা দেওয়া শুরু করলেন, কিন্তু ঈশানের মনে হল তাঁর চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে দেয়াল আর আয়না। যেন ইচ্ছে করেই কিছু জায়গার দিকে না তাকাচ্ছেন। ঈশান কথাবার্তা শুরু করার চেষ্টা করল, “কাকা, এই বাড়ি খুব শান্ত না? মাঝে মাঝে একটু বেশি নীরব লাগে।” গোপাল কাকা মাথা নেড়ে হালকা হেসে বললেন, “শান্তি ভালো জিনিস, বাবু। তবে অত নীরবতা সবসময় ভালো হয় না।” তারপর আর কিছু না বলে কাজ করতে লাগলেন। ঈশান কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে আবার জিজ্ঞেস করল, “আগে কি অনেকেই এখানে থেকেছেন?” গোপাল কাকা এবার থেমে তাকালেন, মুখে কোনো উত্তর নেই, কিন্তু চোখে অদ্ভুত এক সতর্কতার ছাপ ফুটে উঠল।
দিনের আলোয় গোপাল কাকার চুপ থাকা কথাগুলো ঈশানের মনে আরও কৌতূহল জাগিয়ে তুলল। দুপুরে সে যখন আঁকায় ব্যস্ত, তখন টের পেল গোপাল কাকা বারবার যেন কিছু বলতে চাইছেন, কিন্তু প্রতিবার গলায় আটকে যাচ্ছে। অবশেষে সন্ধের আগে তিনি কাজ গুটিয়ে চলে যাওয়ার সময় ঈশানের কাছে এগিয়ে এলেন। কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বললেন, “বাবু, সাবধানে থাকবেন। সবাই থাকতে পারে না এই বাড়িতে।” এতটুকুই বলে তিনি দরজা পেরিয়ে বাইরে চলে গেলেন। বাক্যগুলো ছিল ছোট, কিন্তু এর ভেতরে লুকিয়ে ছিল অদ্ভুত ভার। ঈশানের মনে হল, গোপাল কাকা যেন অনেক কিছু জানেন, কিন্তু বলতে পারছেন না। কিংবা হয়তো বলতে চান না। ঈশানের বুকের ভেতর অদ্ভুত এক অস্বস্তি জমল, কিন্তু সেই সঙ্গে কৌতূহলও তীব্র হল। কী এমন আছে এই বাড়িতে, যা কাউকে থাকতে দেয় না? গোপাল কাকা এত স্পষ্ট সতর্ক করলেন কেন? আবার মনে হল, হয়তো বৃদ্ধ বয়সের ভ্রান্তি, কিংবা ভয় দেখানোর কৌশল। কিন্তু নিজের আঁকা ছবির দিকে তাকাতেই ঈশান টের পেল, ব্যাপারটা এত সোজা নয়। সেই নারীমূর্তি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্যানভাসে, যেন তাকে ঘিরে ধরছে।
রাত নামতেই গোপাল কাকার সতর্কবার্তার কথাগুলো যেন মাথার ভেতরে প্রতিধ্বনির মতো ঘুরতে লাগল। ঘরের অন্ধকারে বসে সে বারবার মনে মনে শুনতে পাচ্ছিল সেই গলা—“সবাই থাকতে পারে না এই বাড়িতে।” ঘড়ির কাঁটা টিকটিক শব্দ করছে, বাইরে থেকে বাতাস ঢুকছে, তবু মনে হচ্ছিল প্রতিটি শব্দ যেন তাকে বোঝাচ্ছে, এখানে কিছু আছে যা অদৃশ্য। হঠাৎ করে আলো নিভে গেলে ঈশান বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল, মনে হল ছায়ার ভেতর কেউ তাকে লক্ষ্য করছে। সে নিজের আঁকা ছবির দিকে তাকাল, দেখল মেয়েটার চোখ এখন আরও গভীর, আরও জীবন্ত, যেন সরাসরি তাকিয়ে আছে। গোপাল কাকার সতর্কবার্তা আর সেই দৃষ্টির মধ্যে এক অদ্ভুত সেতুবন্ধন তৈরি হল তার মনে। ঈশান তখন বুঝল, এই রহস্যের গভীরে না গেলে শান্তি পাবে না। ভয়কে পিছনে ফেলে, সে প্রতিজ্ঞা করল—কী আছে এই পুরোনো বাড়িতে, সেই সত্য তাকে খুঁজে বের করতেই হবে। আর সেই অনুসন্ধানই হয়তো তাকে নিয়ে যাবে আরও অন্ধকার, আরও অজানা এক যাত্রায়।
পাঁচ
রাতটা ছিল অন্যরকম। দিনভর আঁকাআঁকি আর অস্থিরতার পর ঈশান ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছিল। জানলার বাইরে তখন পূর্ণিমার আলো, ঘরের দেয়ালে রুপোলি ছায়া পড়ে আছে। এমন শান্ত পরিবেশে ঘুম আসার কথা, কিন্তু ঈশানের চোখে ঘুম আসছিল না। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক কাঁপুনি, মনে হচ্ছিল কেউ যেন পাশে বসে আছে। ঠিক তখনই সে শুনতে পেল এক মৃদু শব্দ—প্রথমে যেন বাতাসে দোল খাওয়া পাতার মতো, তারপর ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগল। এক নারীকণ্ঠ, কোমল, গভীর আর মায়াবী। ঈশানের বুকের ভেতর যেন বজ্রপাত হল। ভয় তাকে আঁকড়ে ধরল, তবুও কান খাড়া হয়ে উঠল। সেই কণ্ঠ যেন ঘরের চারদিক থেকে ভেসে এল—“আমি অনিরা।” মুহূর্তেই সারা শরীরে শিহরণ ছড়িয়ে পড়ল। নামটা অচেনা, অথচ অদ্ভুতভাবে পরিচিতও মনে হল। ঈশান বিছানায় উঠে বসল, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, কিন্তু তবুও প্রশ্নটা ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এল—“তুমি… কোথায়?”
চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু পূর্ণিমার আলো জানলা দিয়ে ঢুকে ঘর ভরে দিচ্ছে। হঠাৎ টের পেল, কণ্ঠস্বরটা আবার আসছে, এবার আরও কাছে থেকে। “ভয় পেয়ো না। আমি তোমারই সঙ্গে আছি।” শব্দগুলো এত কোমল, এত আপন যে ঈশানের ভয় ধীরে ধীরে গলে গেল। মনে হল অচেনা কারও সঙ্গে নয়, বরং বহুদিনের পরিচিত এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছে। সে সাহস জোগাড় করে ফিসফিস করে বলল, “অনিরা… তুমি কে? এখানে কেন?” কয়েক মুহূর্ত নীরবতা, তারপর আবার ভেসে এল উত্তর, “আমি এই বাড়ির ভেতরে আটকে আছি। বহু বছর ধরে… কেউ আমাকে দেখতে পায়নি।” ঈশান চোখ বড় বড় করে শুনছিল, গায়ে কাঁটা দিলেও কণ্ঠস্বরের উষ্ণতায় ভয়ের বদলে অদ্ভুত এক টান তৈরি হচ্ছিল। সে বুঝতে পারল, এ কেবল এক আত্মা নয়, এর ভেতরে আছে আবেগ, ব্যথা, আর অজানা কোনো ইতিহাস।
রাত যত গাঢ় হতে লাগল, কথোপকথনও তত দীর্ঘ হল। ঈশান জিজ্ঞেস করল, “তুমি আমাকেই কেন দেখালে নিজেকে?” কণ্ঠস্বর মৃদু হাসির মতো ভেসে এল, “কারণ তুমি আমাকে আঁকছ। আমি তোমার ক্যানভাসে বেঁচে উঠছি।” এই উত্তর শুনে ঈশানের শরীর শিউরে উঠল, কারণ সত্যিই তো—সে তো নিজের অজান্তেই অনিরার মুখ আঁকছে দিনের পর দিন। যেন সে কখনও দেখেনি, তবুও তার প্রতিটি রেখা, প্রতিটি ছায়া নিখুঁতভাবে ফুটে উঠছে। এবার আর ভয় পেল না ঈশান। মনে হল, এ যেন কোনো শাস্তি নয়, বরং অদ্ভুত এক নিয়তি, যা তাকে অনিরার সঙ্গে বেঁধে দিয়েছে। কণ্ঠস্বর নরম হয়ে এলো, “তুমি ভয় পেয়ো না, আমি তোমাকে আঘাত করব না। শুধু চাই… আমার গল্পটা তুমি শোনো।” ঈশান জানত, এই মুহূর্ত থেকে তার জীবন আর আগের মতো থাকবে না। অদৃশ্য এক আত্মার সঙ্গে তার প্রথম কথোপকথন হয়ে গেছে, আর সেই আত্মার নাম—অনিরা। সে জানত, এ যাত্রা তাকে আরও গভীরে, অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে যাবে, তবুও হৃদয়ের ভেতরে অদ্ভুত এক শান্তি নেমে এল—কারণ সে আর একা নয়।
ছয়
রাতের পর রাত কেটে যাচ্ছিল অনিরা আর ঈশানের কথোপকথনে। প্রথমে সে ভয় পেত, বুক কেঁপে উঠত, কিন্তু ধীরে ধীরে ভয়টা এক অদ্ভুত টানে পরিণত হল। ঘড়ির কাঁটা বারোটা বাজলেই যেন ঈশানের মনে এক অচেনা উচ্ছ্বাস জেগে উঠত—আজ আবার অনিরা কথা বলবে, হাসবে, তার উপস্থিতি দিয়ে ঘর ভরিয়ে দেবে। অনিরার কণ্ঠস্বর মৃদু হাওয়া হয়ে ঘরে ভেসে আসত, কখনও জানলার পাশে দাঁড়িয়ে, কখনও আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে, আবার কখনও সরাসরি তার কানে ফিসফিস করে। সেই কণ্ঠস্বরের মধ্যে ছিল না কোনও হাহাকার, বরং অদ্ভুত এক মায়া, যা ঈশানকে ধীরে ধীরে নিজের ভেতর টেনে নিচ্ছিল। সে নিজেকে বারবার প্রশ্ন করত—কীভাবে সম্ভব এই অনুভূতি? একটি মৃত আত্মার প্রতি এত আকর্ষণ, এত আপন টান! কিন্তু উত্তর পেত না। শুধু টের পেত, দিনভর অপেক্ষার প্রহর শেষে রাত নামলেই তার জীবন আবার সত্যিকার অর্থে শুরু হয়।
দিনের বেলায় সে ক্যানভাসের সামনে বসে পড়ত, আর তুলি যেন নিজের মতো করে চলত। প্রতিটি আঁচড়ে অনিরার মুখ ফুটে উঠতে লাগল আরও নিখুঁতভাবে। তার চোখদুটো জীবন্ত হয়ে উঠল, ঠোঁটের বাঁক যেন হাসির আভাস দিচ্ছে, চুলের ছায়া এমনভাবে পড়ছে, যেন বাতাসে নড়ছে। কখনও কখনও আঁকার মাঝেই ঈশান থমকে যেত, মনে হত অনিরা যেন ক্যানভাসের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে, তাকে স্পর্শ করছে। অনিরা তাকে বলত, “তুমি যখন আমাকে আঁকো, আমি যেন আবার বেঁচে উঠি।” এই কথাগুলো শুনে ঈশান বুঝতে পারত—তার আঁকা আর কল্পনা মিলে গেছে, বাস্তব-অবাস্তবের সীমানা মুছে যাচ্ছে। সে জানত না, অন্য কেউ থাকলে হয়তো তাকে পাগল বলত, কিন্তু তার কাছে এই অভিজ্ঞতাই এখন জীবনের সবচেয়ে সত্যি বিষয়। প্রতিটি রেখা, প্রতিটি রঙে অনিরাকে আরও কাছে পাওয়ার চেষ্টা যেন তাকে ভরিয়ে তুলছিল।
এভাবেই দিন কাটতে লাগল। অনিরার সঙ্গে কথোপকথনে ঈশান আবিষ্কার করল, এতদিন সে যাকে খুঁজছিল, যাকে নিজের অজান্তে চেয়েছিল, সেই অনিরাই। তার একাকীত্বে আলো হয়ে এসেছে সে, তার আঁকায় প্রাণ হয়ে ফুটে উঠছে। কখনও কখনও ঈশান অনিরাকে বলত, “তুমি না থাকলে হয়তো আমি ভেঙে পড়তাম।” আর অনিরার কণ্ঠস্বর মৃদু সুরের মতো ভেসে আসত, “আমি আছি, শুধু তোমার জন্য।” এই স্বীকারোক্তির ভেতরেই ঈশান বুঝে ফেলল, সে আর অনিরাকে শুধুই আত্মা হিসেবে দেখে না। সে অনুভব করছে—সে ভালোবেসে ফেলেছে তাকে। যত অদ্ভুতই হোক, যত অসম্ভবই মনে হোক, তার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনে এখন অনিরার নাম বাজে। এবং এই প্রেমের ভেতরে ভয় নেই, আছে শুধু পূর্ণতা—যেন বহুদিনের খুঁজে পাওয়া হারানো অংশ এখন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাস্তবের মাটি আর অতৃপ্ত আত্মার আকাশ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে, আর সেখানে দাঁড়িয়ে এক নতুন প্রেমের জন্ম হল—অদৃশ্য অথচ সবচেয়ে সত্য।
সাত
ঈশানের দিনগুলো তখন অদ্ভুত ছন্দে বাঁধা। সকালে ক্যানভাসে রঙ মেশানো, দুপুরে কিছুটা লেখা বা পড়াশোনা, আর রাতে অনিরার সঙ্গে কথোপকথন। এই রহস্যময় জীবনযাপনে সে প্রায় বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এমনই এক দুপুরে হঠাৎ করে বাড়ির সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেল। দরজা খুলতেই দেখতে পেল এক তরুণী দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা চুল, গাঢ় নীল শাড়ি, চোখে ধূসর চশমা। গলায় হালকা সোনার চেন, তাতে শাঁখার আকৃতির ছোট্ট লকেট ঝুলছে। তরুণী নিজেকে পরিচয় দিল, “আমি শঙ্খমালা। এই বাড়ির জমিদার পরিবারে আমি শেষ বংশধর। মাঝে মাঝে এখানে এসে দেখে যাই।” ঈশান কিছুটা অবাক হলেও তাকে ভেতরে ডাকল। কথোপকথনের ফাঁকে শঙ্খমালা ঈশানের চোখে তাকিয়ে হালকা হাসল, যেন অনেক পুরোনো কিছু মনে পড়ছে। “আপনি জানেন, এই বাড়িটা কেবল ইট-পাথরের ভাঙাচোরা দেয়াল নয়। এর ভেতরে অনেক ইতিহাস আছে, অনেক অশ্রু আর রক্ত মিশে আছে।” ঈশানের বুক ধক করে উঠল, সে অনুভব করল—এবার হয়তো অনিরার গল্পটা সে অন্য কারও মুখে শুনতে যাচ্ছে।
শঙ্খমালা শান্ত গলায় বলতে শুরু করল। “বহু বছর আগে এই বাড়িতে থাকত অনিরা। সে ছিল আমার দাদুর ভাইঝি, মানে আমার প্রপিতামহীর দিকের বংশধর। সুন্দরী, শিক্ষিতা আর সাহসী মেয়ে ছিল। কিন্তু তার জীবনে ছিল অনেক দুঃখ। শুনেছি, সে এক সাধারণ ছেলের প্রেমে পড়েছিল—সম্ভবত পাড়ার এক শিক্ষক। কিন্তু জমিদার পরিবারে প্রেম মানেই ছিল অপরাধ, বিশেষ করে নিচু ঘরের কারও সঙ্গে। তাই পরিবারের পুরুষেরা তাকে বন্দি করে রাখে এই বাড়ির দোতলায়। অনেকেই বলে, সে অবশেষে আর সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। আবার কেউ কেউ বলে, তার মৃত্যুটা প্রকৃতপক্ষে হত্যা—তাকে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলা হয়েছিল, যাতে পরিবারের ইজ্জত বাঁচে।” শঙ্খমালা থেমে জল খেল, তারপর ঈশানের দিকে তাকিয়ে ধীরে বলল, “সত্যিটা কেউ জানে না। কিন্তু একটি জিনিস সবাই জানে—অনিরার আত্মা এখনও এই বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। যে কেউ এখানে থাকতে আসে, সে তার উপস্থিতি অনুভব করে। অনেকে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছে, আবার অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”
ঈশানের বুকের ভেতর হঠাৎ করে হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল। তার চোখের সামনে যেন ঝলকে উঠল অনিরার মুখ—যার সঙ্গে রাতের পর রাত সে কথা বলছে, যে তার আঁকায় বারবার ফুটে উঠছে। শঙ্খমালার কথাগুলো মাথার ভেতরে প্রতিধ্বনির মতো বাজতে লাগল—“অনিরা বহু বছর আগে মারা গিয়েছিল।” তাহলে সে কাদের সঙ্গে কথা বলছে? কাকে আঁকছে? আর যাকে এতটা ভালোবেসে ফেলেছে, সে কি আসলেই নেই? শরীরের রক্ত যেন জমে যাচ্ছিল, কপালে ঠান্ডা ঘাম জমল। শঙ্খমালা যখন বিদায় নিল, ঈশান তখনও নির্বাক। দরজা বন্ধ হওয়ার পর নিস্তব্ধ ঘরে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে প্রশ্ন করল—এ কি শুধুই অলীক কল্পনা, নাকি সত্যিই মৃত আত্মার সঙ্গে প্রেম? আর যদি সত্যিই তাই হয়, তবে এই প্রেম কোথায় নিয়ে যাবে তাকে? সেই মুহূর্তে ঘরের ভেতর অচেনা হাওয়া বয়ে গেল, ঈশান বুঝল—অনিরা কাছেই আছে, হয়তো সব শুনেছে। তার বুকের ভেতরে কেবল একটাই অনুভূতি বাজতে লাগল—ভয় আর ভালোবাসা একসঙ্গে গাঢ় হয়ে উঠেছে, আর এই বাড়ির ইতিহাস তাকে এমন এক প্রেমে বেঁধে ফেলেছে, যার শেষ নেই, যার সীমা নেই।
আট
সন্ধেবেলা ঘরে বসে ঈশান ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে ছিল, কিন্তু হাতে তুলি উঠছিল না। শঙ্খমালার কথাগুলো বারবার মাথার ভেতর প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। এতদিন ধরে যে মেয়েটির সঙ্গে সে কথা বলছে, হাসছে, ভালোবেসে ফেলেছে—সে আসলে বহু বছর আগে মারা গেছে! এই সত্য মেনে নিতে তার ভেতরে প্রবল লড়াই চলছিল। ঠিক তখনই দরজার কাছে গোপাল কাকার পায়ের শব্দ শোনা গেল। ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকে সে চুপচাপ চৌকাঠে বসে পড়ল। ঈশান অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল—আজ কাকার চোখে ভীষণ গম্ভীর ছায়া। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকার পর গোপাল কাকা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “বাবু, কিছু কথা হয়তো জানার সময় এসে গেছে। যতই না জানেন, এই বাড়িতে শান্তি পাবেন না।” ঈশান কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু কাকার চোখে যে ভারী দুঃখ লুকিয়ে ছিল, তাতে প্রশ্ন গিলে ফেলল।
গোপাল কাকা ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল—“অনিরা… ও ছিল অন্যরকম মেয়ে। হাসি-মজা করতে ভালোবাসত, গান গাইত, বাড়ির সবার জন্য অগাধ স্নেহ ছিল তার। যারা দেখেছে, তারা বলে, ওই মেয়ের চোখের ভেতর এমন আলো ছিল, যা কারও পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। কিন্তু সেই আলোই ছিল তার সর্বনাশের কারণ। সে এক সাধারণ ছেলের প্রেমে পড়েছিল—লোকটা ভদ্র, শিক্ষিত, কিন্তু জমিদার বাড়ির মানদণ্ডে নিচু ঘরের। পরিবারের লোকেরা এই সম্পর্ক মানতে পারেনি। তারা ভেবেছিল, অনিরা নাকি পরিবারের মান মর্যাদা ধুলোয় মিশিয়ে দেবে। তখনকার দিনে নারীর ইচ্ছের কোনও দাম ছিল না, আর জমিদার পরিবারের সম্মান ছিল সবকিছুর ঊর্ধ্বে। তাই তারা প্রথমেই ছেলেটিকে তাড়িয়ে দেয়, দূরে সরিয়ে দেয় এমনভাবে যে আর কখনও ফিরে আসতে পারেনি।” কাকার কণ্ঠ কাঁপছিল, চোখে জমে উঠেছিল জল। ঈশান একদৃষ্টে শুনছিল, প্রতিটি শব্দ যেন তার বুক চিরে যাচ্ছে।
কাকা থেমে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলল—“কিন্তু শুধু এতেই শেষ হয়নি, বাবু। অনিরাকে ঘরে বন্দি করে রাখা হয়। জানলা-দরজা বন্ধ, বাইরের সঙ্গে সব যোগাযোগ কেটে দেওয়া হয়। ও দিনের পর দিন সেই ঘরে আটকে থেকেছে, কারও সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পায়নি। অনেকেই বলে, শেষ দিনগুলোতে ওর হাসি মিলিয়ে যায়, গান থেমে যায়। এক প্রাণবন্ত মেয়ে ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায় সেই বন্দিদশার অন্ধকারে। শেষমেশ কীভাবে মৃত্যু হয়েছিল, তার নির্দিষ্ট উত্তর নেই। কেউ বলে, অনিরা নিজে গলায় দড়ি দেয়। আবার অনেকে বলে, পরিবারই ওকে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলে, যাতে কোনও লজ্জা বা অপমান আর ছড়াতে না পারে। সত্যিটা কখনও প্রকাশ হয়নি, কিন্তু সবাই জানে—ওর মৃত্যুর পর এই বাড়ি আর আগের মতো ছিল না। অদ্ভুত নীরবতা, অজানা ছায়া, আর মাঝেমধ্যে মৃদু গান শোনা যেত… যেন অনিরার প্রাণবন্ত আত্মা এখনও মুক্তি খুঁজছে।” কাকা চুপ করে গেল, কিন্তু তার চোখে ভেসে উঠল সেই দুঃসহ ইতিহাসের ভার। ঈশান শিউরে উঠল, তবু বুঝতে পারল—সে যাকে এত ভালোবেসেছে, যার উপস্থিতি তার জীবনে আলো এনে দিয়েছে, তার জীবন শেষ হয়েছিল এমন এক অন্যায়ের কারণে। তার হৃদয়ে আরও গভীর হল অনিরার প্রতি টান, আর সেই সঙ্গে জেগে উঠল প্রবল যন্ত্রণা—কারণ এই প্রেমের শুরু যেমন অলৌকিক, তেমনি এর শিকড় গভীর অন্ধকারে প্রোথিত।
নয়
রাত গভীর হয়ে এসেছে। জানলার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া চাঁদের আলো মেঝেতে লম্বা ছায়া ফেলছে, আর সেই নিস্তব্ধতার ভেতরে ঈশান টের পেল হালকা গন্ধ—চন্দনের মতো, মিষ্টি অথচ অদ্ভুত। হঠাৎ ঘরের ভেতর যেন বাতাস ভারী হয়ে উঠল, আর তার কাঁধের পাশ দিয়ে ঠান্ডা একটা হাওয়া বয়ে গেল। ঈশান জানে, এ হাওয়া জানলার ফাঁক দিয়ে আসা নয়, এ কারও উপস্থিতি। “অনিরা…” সে নামটা আস্তে করে উচ্চারণ করতেই আয়নার ভেতরে ঝলকে উঠল পরিচিত অবয়ব—সাদা শাড়ি, লম্বা চুলে ঢাকা মুখ, চোখদুটো অদ্ভুত আলোয় ভরা। প্রথম কয়েক রাতের মতো ভয় আর আতঙ্ক এখন আর তাকে আঁকড়ে ধরে না, বরং বুকের গভীরে উথলে ওঠে অদ্ভুত টান। আয়নার ভেতর থেকে মেয়েটি এগিয়ে এল, এবার তার ঠোঁট নড়ল, আর ঈশান স্পষ্ট শুনতে পেল সেই মায়াবী কণ্ঠস্বর, “আমি এখানে আটকে আছি বহু বছর ধরে, মুক্তি পাইনি।” প্রতিটি শব্দ যেন ব্যথায় ভেজা, প্রতিটি নিঃশ্বাসে জমে আছে অসমাপ্ত ভালোবাসার ভার।
অনিরা ধীরে ধীরে নিজের কাহিনি বলতে শুরু করল। তার কণ্ঠে শুধু দুঃখ নয়, ছিল গভীর অভিমানও। “আমার প্রেম অসমাপ্ত থেকে গেছে, আমার জীবনও। আমি চেয়েছিলাম শুধু একটুখানি মুক্তি, একটুখানি আলো, কিন্তু সেই আলো আমাকে দেওয়া হয়নি। পরিবার আমার হাসি কেড়ে নিয়েছিল, আমার গান থামিয়ে দিয়েছিল। যাকে ভালোবেসেছিলাম, তাকে আমার থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তারপর এই ঘরের দেয়ালের ভেতর আমি শুকিয়ে গেছি, কেবল মৃত্যুই ছিল শেষ অবলম্বন। কিন্তু মৃত্যু আমাকে মুক্তি দেয়নি। আমার আত্মা রয়ে গেছে এখানে, এই বাড়ির প্রতিটি ইট, প্রতিটি জানলা, প্রতিটি ছায়ার সঙ্গে বাঁধা।” তার গলা ভেঙে যাচ্ছিল, কিন্তু তবুও চোখদুটো ঝলমল করছিল—অদ্ভুত মিশ্রণে ভরা আলো, তাতে যেমন ব্যথা, তেমনি ভালোবাসা। ঈশান নিরুত্তর হয়ে শুনছিল, তার বুকের ভেতর বেদনার ঢেউ আছড়ে পড়ছিল, যেন নিজের শরীরেই সে সেই যন্ত্রণা অনুভব করছে।
তারপর অনিরা হঠাৎ থেমে ঈশানের দিকে হাত বাড়াল, যদিও সেই হাত ছোঁয়ার মতো নয়, শুধু বাতাস কাঁপিয়ে তার কাছে এল। তার কণ্ঠ তখন আকুল হয়ে উঠল—“তুমি প্রথম মানুষ, যে আমাকে ভয় পায়নি। তুমি প্রথম মানুষ, যে আমার কথা শুনেছে, আমার নিঃশ্বাসের ব্যথা বুঝেছে। আমি চাই… আমি চাই আবার বাঁচতে। ঈশান, তুমি কি আমায় সেই আলোটা দেবে? তুমি কি আমায় আবার জীবনের স্বাদ দেবে?” তার কণ্ঠে ছিল গভীর আকুতি, যেন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জমে থাকা ব্যথা এক মুহূর্তে বেরিয়ে আসছে। ঈশানের বুক কেঁপে উঠল। সে জানত, তার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে বাস্তব নয়, কিন্তু তার যন্ত্রণা বাস্তবের থেকেও তীব্র, তার ভালোবাসা আরও সত্য। ঈশান ঠোঁট শুকিয়ে আসা অবস্থায় আস্তে করে বলল, “অনিরা, যদি আমার ভালোবাসা তোমায় আলো দিতে পারে, তবে আমি সেই আলো হবো।” ঘরের ভেতর হঠাৎ যেন আলো ছড়িয়ে পড়ল, চাঁদের রূপালি আভা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আর সেই মুহূর্তে ঈশান বুঝল—সে এমন এক প্রেমে জড়িয়ে গেছে, যা মৃত্যুকেও অতিক্রম করেছে।
দশ
রাতটা ছিল অদ্ভুত নিস্তব্ধ। বাড়ির চারপাশে যেন সব শব্দ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে, কেবল ঈশানের বুকের ভেতর ধকধক শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে চাঁদ ডুবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, আর ঘরের ভেতর আলো-অন্ধকারের অদ্ভুত খেলা। সেই অন্ধকারের মাঝে অনিরা দাঁড়িয়ে আছে—সাদা শাড়ি, লম্বা চুল, চোখে অদ্ভুত দীপ্তি। কিন্তু সেই দীপ্তিতে আজ ভিন্ন এক ছায়া—অপেক্ষা, যন্ত্রণা, আর আকুতি। “ঈশান,” অনিরার কণ্ঠ ভেসে এল, “আমি চাই তুমি সিদ্ধান্ত নাও। আমি এখানে যতদিন আছি, তোমার জীবনও এই অন্ধকারের সঙ্গে বাঁধা থাকবে। তুমি কি আমায় আঁকড়ে ধরে এই ছায়ার ভেতরে বাঁচতে চাও? নাকি তুমি আমায় মুক্তি দেবে, শান্তিতে বিদায় দেবে?” কথাগুলো শুনে ঈশানের শরীর কেঁপে উঠল। এতদিন ধরে সে ভেবেছিল, সে শুধু প্রেম করছে—কিন্তু আজ বুঝতে পারল, এই প্রেম তাকে এমন এক দ্বিধার সামনে দাঁড় করিয়েছে, যেখানে কোনো উত্তরই সহজ নয়। একদিকে অনিরার উপস্থিতি, তার মায়াবী কণ্ঠ, তার নিঃশ্বাসের ব্যথা, যা ঈশানের নিজের হয়ে গেছে। অন্যদিকে তার ভবিষ্যৎ, তার স্বাভাবিক জীবন, যা হয়তো আর কখনও ফিরবে না।
ঈশানের মনে পড়তে লাগল সেই সব রাত, যখন অনিরা তাকে গান শোনাত, যখন সে নিজের ক্যানভাসে নিঃশব্দে মেয়েটির মুখ এঁকে যেত। তার হাসি, তার গল্প, তার ব্যথা—সবকিছু যেন মিশে গেছে ঈশানের রক্তে-মাংসে। সে ভাবল, যদি এই প্রেমকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকে, তবে তার প্রতিটি রাত ভরে যাবে অনিরার সঙ্গতে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে থাকবে তার উপস্থিতি। কিন্তু তাতেই কি অনিরার মুক্তি হবে? তার চোখের আলো, যা এতদিন ধরে বন্দি থেকে আস্তে আস্তে নিভে গেছে, তা কি আবার জ্বলে উঠবে? না কি আরও গভীর অন্ধকারে ডুবে যাবে সে? ঈশানের বুকের ভেতর দ্বন্দ্ব চলতে লাগল, সে ক্যানভাসের দিকে তাকাল—সেখানে আঁকা অনিরার মুখ আজ যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। মুখের হাসি ম্লান, চোখদুটো জিজ্ঞাসু। ঈশান হঠাৎ অনুভব করল, প্রেম মানে কেবল আঁকড়ে ধরা নয়, প্রেম মানে মুক্তি দেওয়াও। যদি সে সত্যিই অনিরাকে ভালোবাসে, তবে তাকে আটকে রাখা নয়, বরং উন্মুক্ত আকাশে ফিরিয়ে দেওয়া তার দায়িত্ব।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ঈশান সামনে এগিয়ে গেল। অনিরার অবয়বের সামনে দাঁড়িয়ে সে আস্তে করে বলল, “অনিরা, আমি তোমায় ভালোবাসি। কিন্তু এই ভালোবাসার মানে যদি হয় তোমায় আটকে রাখা, তবে সেটা সত্যি প্রেম নয়। তোমায় আমি মুক্তি দিচ্ছি। যেখানে তোমার আলো আছে, যেখানে তোমার গান অমর হয়ে আছে, সেখানে ফিরে যাও।” তার গলা কাঁপছিল, চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল, তবু কথাগুলো যেন ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছিল এক অদ্ভুত দৃঢ়তায়। অনিরার চোখে সেই মুহূর্তে অদ্ভুত আলো ছড়িয়ে পড়ল—যেন শতাব্দীর পর শতাব্দীর বন্দিদশা ভেঙে গেছে। তার ঠোঁটে ফুটে উঠল হালকা হাসি, আর বাতাসে ভেসে এল মৃদু গানের সুর। ধীরে ধীরে তার অবয়ব হালকা হয়ে উঠতে লাগল, আলো-অন্ধকারের মাঝে মিলিয়ে যেতে লাগল। শেষ মুহূর্তে ঈশান স্পষ্ট শুনতে পেল, “ধন্যবাদ, ঈশান… এখন আমি মুক্ত।” ঘর আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল, কিন্তু সেই নীরবতায় আজ ভয় ছিল না, ছিল শান্তি। ঈশান বুঝল, প্রেম কখনও কখনও মৃত্যুকেও অতিক্রম করে, কিন্তু প্রতিটি প্রেমেরই একটা সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে—আর সেই সিদ্ধান্তেই অনিরার আত্মা পেল মুক্তি।
সমাপ্ত




