Bangla - প্রেমের গল্প

ডিজিটাল দাগ

Spread the love

অনন্যা ঘোষ


কলকাতার শরতের বিকেলটা ছিল অদ্ভুত নীরব। কলেজ থেকে ফিরে ঈশা নিজের ছোট্ট ঘরের জানলার ধারে বসে ছিল, হাতে ল্যাপটপ। শাদা কাপে চা ধোঁয়া তুলছিল, আর পাশে খোলা ছিল ফেসবুক। সাহিত্যের প্রতি ঈশার টান বরাবরই প্রবল, তাই সে কিছুদিন আগে ফেসবুকের একটি লিটারেচার গ্রুপে যোগ দিয়েছিল। ওই গ্রুপে মাঝেমাঝেই নতুন নতুন কবিতা, গল্প, আলোচনার পোস্ট আসত, আর ঈশা সেগুলো পড়ে আনন্দ পেত। সেদিনও সে স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ একটি কবিতার ওপর চোখ আটকে গেল। কবিতার নাম ছিল—“অচেনার ছায়া।” কবিতার ভাষা ছিল সহজ অথচ গভীর, যেন শহরের ব্যস্ত রাস্তাঘাট থেকে দূরে কোনো নিঃশব্দ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের একাকিত্বকে কাগজে ধরা হয়েছে। কয়েক লাইন পড়তেই ঈশার মনে হলো, এ লেখা যেন তার ভেতরের অদৃশ্য কষ্টের প্রতিধ্বনি। সে লেখাটিকে একটুখানি থেমে আবার পড়ল, তারপর খুব অচেতনভাবে লাইক বাটনে চাপ দিল। সেই মুহূর্তে তার ভেতরে কিছু একটা সাড়া দিল, যেন এই লেখাটির আড়ালে থাকা মানুষটির সঙ্গে পরিচয় না হলে তার কিছু একটা অপূর্ণ থেকে যাবে। কবিতার লেখকের নাম দেওয়া ছিল—অভিরাজ নন্দী। নামটা নতুন, অচেনা, কিন্তু শব্দের ভেতরে যেন অনেক পুরনো এক আত্মীয়তা। ঈশার মনে হলো, অন্তত একটি ধন্যবাদ জানানো যায় লেখককে, যদিও আগে কোনোদিন সে এই গ্রুপে কাউকে মেসেজ করেনি।

ইনবক্সের ছোট্ট জানলাটা খুলে ঈশা টাইপ করতে শুরু করল, “আপনার কবিতাটা খুব সুন্দর লেগেছে। কিছু লাইন পড়ার সময় মনে হলো যেন আমাকেই লেখা।” কয়েক সেকেন্ড দ্বিধা হলো—পাঠাবে কি পাঠাবে না। অবশেষে পাঠিয়ে দিল। জানলাটা বন্ধ করে দিলেও মনটা বারবার সেদিকে ফিরে যাচ্ছিল। বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ নোটিফিকেশন এল—“অভিরাজ নন্দী replied to your message.” হৃদস্পন্দন একটু বেড়ে গেল ঈশার। সে জানল খুলল। সেখানে লেখা—“আপনার মেসেজ পড়ে ভীষণ ভালো লাগল। আমি ভেবেছিলাম হয়তো কবিতাটা কাউকে স্পর্শই করতে পারবে না। আপনার মন্তব্য আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া।” ঈশা অবাক হয়ে গেল। কী অদ্ভুত, এমন এক মানুষ যে তাকে কখনও দেখেনি, তার কণ্ঠ শোনেনি, অথচ কয়েক লাইনের মাধ্যমে এত কাছাকাছি পৌঁছে গেল। এভাবেই শুরু হলো কথোপকথন। প্রথমদিন কবিতা নিয়ে আলাপ হলো, তারপর সাহিত্যিকদের নাম, প্রিয় বই, শহরের গল্প। অভিরাজ জানাল যে সে বেঙ্গালুরুতে কাজ করে, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দিনভর কোড লিখে, কিন্তু রাত নামলেই গিটার বাজায় আর কবিতা লিখে। ঈশা মুগ্ধ হলো এই সমন্বয়ে—একদিকে প্রযুক্তি, অন্যদিকে শব্দ আর সুর। সে নিজেও বলল যে কলেজে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ে, কবিতা লেখে, কিন্তু কখনো প্রকাশ করার সাহস পায় না। আলাপের মাঝেই কোথাও অদ্ভুত এক সহজ সম্পর্ক গড়ে উঠতে লাগল।

দিনগুলো কেটে যেতে লাগল। প্রথম আলাপের সেই সন্ধ্যার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই তাদের মেসেজ চালাচালি হতো। একবার কবিতা, একবার বই, কখনো আবার একেবারেই অচেনা বিষয়—বৃষ্টির শব্দ, কলকাতার পুরোনো রাস্তার গন্ধ, কিংবা বেঙ্গালুরুর আইটি পার্কের ব্যস্ততা। অচেনা দুই শহরের মানুষ দুজনেই নিজেদের জীবনের ভেতরের একাকিত্ব ভাগ করে নিতে শুরু করল। ঈশা অবাক হয়ে দেখল, যেসব কথা সে নিজের বন্ধুদের সঙ্গেও শেয়ার করে না, সেসব কথা অবলীলায় বলে ফেলছে অভিরাজকে। অন্যদিকে অভিরাজও স্বীকার করল, অফিসের বাইরের জগতে সে প্রায় কারো সঙ্গে এতটা খোলামেলা হয় না। এই চ্যাট উইন্ডো যেন হয়ে উঠল তাদের দুজনের আশ্রয়, যেখানে তারা নিজের অজানা দিকগুলোকে অবলীলায় প্রকাশ করতে পারে। কখনো রাত গভীর হয়ে যেত, ঘড়িতে আড়াইটে বেজে যেত, অথচ তাদের আলাপ থামত না। তারা বুঝতে পারছিল না ঠিক কী নামে এই সম্পর্ককে ডাকা যায়—বন্ধুত্ব, না কি তার চেয়ে অন্য কিছু। কিন্তু একটা অদৃশ্য টান প্রতিদিন আরও গভীর হয়ে উঠছিল। ঈশার মনে হচ্ছিল, হয়তো এভাবেই শুরু হয় এমন সম্পর্ক, যা দূরত্ব মেনে নেয় না, যা ধীরে ধীরে স্ক্রিনের ওপারে থেকেও মনের ভেতরে গেঁথে যায়। আর অভিরাজও ভাবছিল, এই মেয়েটি হয়তো তার একাকিত্বের কবিতা বুঝতে পারল বলেই সে এতটা স্বস্তি পেয়েছে। দুজনেই জানত না ভবিষ্যৎ কোথায় যাবে, কিন্তু তারা অনুভব করছিল যে “চ্যাট উইন্ডোতে আলাপ” নামের এই অচেনা পথচলা আর যেভাবেই হোক থেমে যাবে না।

কলকাতার শীতল জানুয়ারির রাত, পড়ার টেবিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা নোটবই আর ল্যাপটপের আলোয় বসে আছে ঈশা। ঘড়ির কাঁটা তখন প্রায় সাড়ে দশটা ছুঁইছুঁই। সারা দিনের কলেজ, ক্লাস, টিউশনি সব শেষে এই সময়টুকুই তার কাছে সবচেয়ে প্রিয় হয়ে উঠেছে। কারণ এই সময়েই অভিরাজ অনলাইনে আসে। কয়েক মাস ধরে তাদের আলাপ এখন প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, আর সেই অভ্যাসের মধ্যেই ঈশা খুঁজে পায় একরকম স্থিরতা। ল্যাপটপের স্ক্রিনে হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল—অভিরাজের ভিডিও কল। ঈশার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক কাঁপুনি বয়ে গেল, সে কল রিসিভ করল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল অভিরাজের মুখ—এক হাতে হেডফোন, আরেক হাতে গিটার। ক্লান্ত চোখ, কিন্তু ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। “আজ দারুণ একটা সুর পেয়েছি,” বলল অভিরাজ, আর স্ক্রিনের ওপার থেকে গিটারের মৃদু সুর ভেসে এল। সেই সুরের সঙ্গে ঈশা মিশিয়ে দিল তার নিজের কণ্ঠে কয়েক লাইন কবিতা। দুজনের হাসি, গল্প, গান মিলেমিশে রাতটা হয়ে উঠল এক অন্য রকম জগৎ। ফোনের ছোট্ট পর্দাটা যেন ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছিল—একটা শহরের ব্যস্ততা, অন্য শহরের একাকিত্ব—সব পেরিয়ে তাদের জন্য গড়ে উঠছিল এক অভিন্ন পৃথিবী। তবুও মাঝে মাঝে ঈশার মনে হতো, স্ক্রিনটা যেন এক অদৃশ্য প্রাচীর, যার ওপারে ছুঁতে পারে না অভিরাজকে, স্পর্শ করতে পারে না তার গিটার ধরা আঙুলগুলোকে।

অভিরাজের জীবনও বদলাচ্ছিল। দিনভর অফিসে অসংখ্য লাইনের কোড, নির্দিষ্ট টার্গেট, টিম মিটিং—সব শেষে যখন রাত নামত, সে যেন নতুন করে বাঁচত। সেই বাঁচার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঈশা। দিনের মধ্যে ছোট ছোট সময়ে যখন ফাঁক মিলত, সে ঈশাকে মেসেজ করে জানাত—“আজ রাতে তোমার জন্য একটা গান শোনাবো।” অফিস থেকে ফেরার পর ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে ঢুকেই সে ল্যাপটপ চালাত, যেন এক অদৃশ্য টানে টেনে নেয় তাকে ঈশার পৃথিবী। ভিডিও কলে দুজনের মধ্যে শুধু কথাবার্তাই হতো না; তারা একসঙ্গে সিনেমা দেখত, একই গান শুনত, কিংবা হঠাৎ নিঃশব্দে শুধু একে অপরকে দেখত। ঈশা তার প্রিয় বই থেকে লাইন পড়ে শোনাত, অভিরাজ গিটার বাজিয়ে উত্তর দিত। সময় যেন গলে যেত, আর তাদের সম্পর্কও গোপনে জমাট বাঁধত। তবুও সেই গোপন আনন্দের ভেতরেই থেকে যেত এক অনিশ্চয়তা। অভিরাজ মাঝেমাঝে ভাবত—এই মেয়েটিকে সত্যিই ছুঁতে পারব তো কোনোদিন? নাকি সম্পর্কটা থেকে যাবে কেবল পর্দার ভেতরেই? আর ঈশার মনের গভীরেও ছিল একই প্রশ্ন—বাস্তবের অভিরাজ কি স্ক্রিনের এই অভিরাজের মতোই হবে? নাকি সবই এক মায়া? কিন্তু এই প্রশ্নগুলোকে তারা আপাতত চাপা দিয়ে রাখত, কারণ সেই মুহূর্তে একে অপরের হাসি, একে অপরের উপস্থিতিই ছিল তাদের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস।

রাতগুলো এভাবেই কেটে যেত। অনেক সময় দেখা যেত, ঘড়িতে তখন রাত আড়াইটা বাজে, অথচ তাদের কথার শেষ নেই। কলেজের পরীক্ষার চাপ, অফিসের ডেডলাইন—সব কিছুর মাঝেও তারা দুজনেই রাতজাগা কথোপকথনকে আঁকড়ে ধরে থাকত। যেন দিনের ভেতর তাদের জন্য রাখা সবচেয়ে ব্যক্তিগত, সবচেয়ে শান্ত সময়টুকু এটাই। ঈশা প্রায়ই জানলার ধারে বসে আকাশের তারা দেখত আর বলত, “ভাবতে পারো, আমরা এখন দুই শহরে থেকেও একই আকাশের নিচে আছি।” অভিরাজ মৃদু হেসে উত্তর দিত, “একই আকাশ, কিন্তু তোমার শহরের চাঁদটা বুঝি একটু বেশি উজ্জ্বল।” সেইসব লঘু কথার ভেতরেও জমে উঠত অগাধ আবেগ, অনুচ্চারিত স্বপ্ন। তবুও কোথাও যেন এক অদৃশ্য দূরত্ব থেকে যেত। যখন ঈশার ইচ্ছে হতো অভিরাজের হাত ধরে বলতে—“আজ থেকো পাশে”—তখন মনে হতো স্ক্রিনের এই আলো তার আর কিছুতেই ধরা দেবে না। যখন অভিরাজ চাইত ঈশার চোখের ভেতর সরাসরি তাকিয়ে দেখতে, তখন মনে হতো ক্যামেরার কাচে সব কিছুই অপূর্ণ থেকে যায়। তবুও তারা থামত না, কারণ এই রাতজাগা ভিডিও কলের ভেতরেই তারা পেত এমন এক পৃথিবী, যেখানে দুজনের একাকিত্ব ভেঙে যেত, আর ভোর পর্যন্ত জেগে থেকেও মনে হতো—ক্লান্তি নয়, বরং নতুন করে বাঁচার শক্তি মিলছে। এভাবেই গড়ে উঠছিল তাদের সম্পর্কের ভিত্তি—ডিজিটালের আলোয়, কিন্তু হৃদয়ের গভীরে ছড়িয়ে পড়া এক নিঃশব্দ টান, যা তাদের দুজনকেই ধীরে ধীরে এক নতুন যাত্রার দিকে ঠেলে দিচ্ছিল।

শীত কাটিয়ে বসন্তের হাওয়া যখন কলকাতার রাস্তায় নেমে আসছে, ঠিক তখনই ঈশার সকালগুলো অন্যরকম হয়ে উঠেছিল। আগে দিনের শুরুটা হতো এলোমেলো অ্যালার্মে, কখনো দেরিতে উঠে কলেজে দৌড়ে যাওয়া, কখনোই কোনো নির্দিষ্ট ছন্দ থাকত না। কিন্তু এখন সকাল মানেই মোবাইলের স্ক্রিনে এক চেনা নোটিফিকেশন—অভিরাজের পাঠানো “গুড মর্নিং।” কোনো দিন কেবল দুটি শব্দ, কোনো দিন ছোট্ট একটি শুভেচ্ছা—“আজ ভালো থেকো, সামনে সুন্দর দিন অপেক্ষা করছে।” আবার কোনো দিন মজার কোনো স্টিকার বা ছবি, যেটা দেখে ঈশার মন হাসিতে ভরে যেত। এই নিয়মিত বার্তাগুলো যেন ঈশার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল। ঘুম থেকে উঠেই সেই মেসেজ পড়া, তারপর নিজের মতো করে একটা উত্তর লেখা, এই ছোট ছোট অভ্যাসগুলোই তার সকালকে আলোয় ভরিয়ে তুলত। ধীরে ধীরে ঈশা বুঝতে পারছিল, এই সম্পর্ক আর শুধু কথোপকথনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই—বরং এক অদৃশ্য প্রতিশ্রুতির বাঁধনে জড়িয়ে যাচ্ছে। অভিরাজের প্রতি তার ভরসা প্রতিদিন আরও বাড়ছিল, যেন স্ক্রিনের ওপার থেকে এই মানুষটি সত্যিই তার দিন শুরু আর শেষের সঙ্গী হয়ে উঠেছে।

অন্যদিকে অভিরাজের জীবনেও এই ছোট্ট রুটিনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। অফিসের ব্যস্ততা, মিটিংয়ের চাপ, অন্তহীন কোডিংয়ের মাঝে ঈশার নামটা তার কাছে হয়ে উঠেছিল একধরনের অবলম্বন। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রথম কাজ ছিল ঈশাকে মেসেজ করা। একদিন অফিসে বসে অভিরাজ লিখল, “তুমি জানো, দিনটা কেমন কাটবে সেটা আসলে নির্ভর করে দিনের প্রথম মুহূর্তটা কেমন গেল তার ওপর। আর আমার প্রতিদিনের প্রথম মুহূর্ত এখন তোমার সঙ্গে কাটে।” ঈশা এই মেসেজ পড়ে উত্তর দিল একটি ছোট্ট কবিতা—

“দিনের আলোয় তোমার শুভেচ্ছা,
জীবনের রঙে মিশে যায়।
অচেনা হলেও প্রতিশ্রুতি যেন,
হৃদয়ের পাতায় লিখে যায়।”
এই প্রথম ঈশা তার নিজের লেখা কবিতা কাউকে পাঠাল, এবং সেটা অভিরাজকে। অভিরাজ দীর্ঘক্ষণ চুপ করে বসে সেই লাইনগুলো পড়ল বারবার। তার মনে হলো, এ কেবল একটি কবিতা নয়, বরং এক অদৃশ্য শপথ, যে তারা দুজনেই একে অপরকে আপন করে নিচ্ছে। সে লিখে পাঠাল, “একদিন তোমাকে এই কবিতার লাইনগুলো সামনাসামনি শুনতে চাই।” সেই মেসেজটা যেন নিঃশব্দে একটি প্রতিশ্রুতির জন্ম দিল—যেভাবেই হোক, তাদের সম্পর্ক একদিন এই ভার্চুয়াল পৃথিবী থেকে বেরিয়ে আসবে।

তাদের আলাপ এখন প্রায়ই ঘুরে যেত ভবিষ্যতের দিকে। কখন দেখা হবে, কোথায় দেখা হবে, কেমন হবে সেই মুহূর্ত—এইসব নিয়ে তারা দীর্ঘক্ষণ কথা বলত। অভিরাজ বলত, “আমি চাই আমাদের প্রথম দেখা হোক হাওড়া ব্রিজের নিচে গঙ্গার ধারে, যেখানে শহরের আলো আর নদীর ঢেউ একসঙ্গে মিলেমিশে যায়।” ঈশা মৃদু হেসে উত্তর দিত, “আর আমি চাই তুমি কলকাতার বইমেলায় আসো, আর আমরা একসঙ্গে ঘুরে ঘুরে বই কিনি।” এইসব স্বপ্নমাখা কথোপকথনের মধ্যেই তারা বুঝতে পারছিল, এই সম্পর্ককে তারা আর সামান্য কোনো ডিজিটাল আলাপ হিসেবে ভাবতে পারছে না। প্রতিদিনের শুভেচ্ছা, প্রতিদিনের কবিতা, প্রতিদিনের প্রতিশ্রুতি তাদের ভেতরে গড়ে তুলছিল এক অটুট বিশ্বাস—যে দূরত্ব যতই হোক, এই ভালোবাসা বাস্তবে রূপ নেবেই। তবুও মাঝে মাঝে ঈশার মনে এক অদ্ভুত ভয় ঢুকে যেত। সে ভাবত, বাস্তবে যদি তারা একে অপরকে ভিন্নভাবে খুঁজে পায়? যদি স্ক্রিনের এই অভিরাজ আর বাস্তব অভিরাজ একই না হয়? কিন্তু প্রতিবারই অভিরাজের মেসেজ, তার নিরন্তর মনোযোগ, তার প্রতিটি ছোট্ট খেয়ালের যত্ন নেওয়া—এই সবকিছু যেন সেই ভয় মুছে দিয়ে নতুন ভরসা তৈরি করত। ঈশার কবিতার মতোই তাদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে লিখে যাচ্ছিল এক নতুন অধ্যায়, যেখানে “ডিজিটাল প্রতিশ্রুতি” হয়ে উঠছিল একদিন বাস্তবের হাতছানি।

ঈশার দিনগুলো এক অদ্ভুত ছন্দে কাটছিল। অনলাইনে অভিরাজের সাথে তার আলাপ যেন প্রতিদিন একটু একটু করে গভীর হচ্ছিল, অথচ সেই গভীরতার ওপর ভরসা রাখার মতো কিছুই নেই—কোনো বাস্তব দেখা হয়নি, কোনো স্পর্শ নেই, কেবল শব্দ আর ছবির ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা এক বন্ধন। এক সন্ধ্যায় কলেজ ক্যাম্পাসের ক্যান্টিনে বসে মৌ হঠাৎ বলেছিল, “শোন ঈশা, অনলাইনে মানুষকে কতটুকু চেনা যায়? যদি সে সত্যিই অন্যরকম হয়? যদি সে মিথ্যে বলে?” কথাটা ছিল স্রেফ এক ধরনের সতর্কতা, কিন্তু ঈশার ভেতরে সেটা হঠাৎ করেই ছোট্ট এক আঁচড় কাটল। সে অবাক হয়ে মৌ-এর দিকে তাকাল, মনে মনে ভাবল—আসলে তো ঠিকই বলছে মৌ। একটা স্ক্রিনের ওপাশে বসে থাকা মানুষটাকে কতটুকুই বা জানা যায়? সে যা বলছে, যে ছবি পাঠাচ্ছে, সবকিছুই তো সাজানো হতে পারে। তারপরও কেন জানি ঈশা বিশ্বাস করছিল যে অভিরাজ আলাদা, তার কথাগুলো সত্যিই মন থেকে আসছে। তবুও বন্ধুর প্রশ্ন তাকে অস্বস্তিতে ফেলল, রাত গভীর হলে সে নিজেকে প্রশ্ন করতে শুরু করল—“আমি কি খুব তাড়াহুড়ো করছি? নাকি সত্যিই এ বিশ্বাস আমার নিজের তৈরি এক ভ্রম?” মৌ হয়তো স্রেফ হেসে ফেলার মতো কথাই বলেছিল, কিন্তু ঈশার মনে সন্দেহের রেখা টেনে দিয়ে গেল।

অন্যদিকে মুম্বাইতে অভিরাজের দিন চলছিল রুটিন মতো। কিন্তু এক রাতে রোহিত—অভিরাজের রুমমেট—হাসতে হাসতে টিজ করল। ল্যাপটপ স্ক্রিনে ঈশার নাম ভেসে উঠতেই সে বলল, “আরে বাহ! আবার সেই মিষ্টি বাংলা কন্যা? ভাই, তুমি কি সিরিয়াস? স্ক্রিনে দেখা মেয়েকে নিয়ে এত ডুবে যাচ্ছো?” অভিরাজ প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিলেও পরে রোহিত একটু বেশিই মজা করতে শুরু করল, “দেখো দোস্ত, অনলাইনে কেউ কারও প্রেমে পড়ে? যদি ও অন্যরকম হয়? যদি শুধু মজা নিচ্ছে?” রোহিতের কণ্ঠে যদিও কৌতুক ছিল, কিন্তু শব্দের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সন্দেহ যেন অভিরাজকেও মুহূর্তের জন্য দোল খাইয়ে দিল। সে জানে, ঈশার সাথে তার আলাপগুলো একেবারেই আলাদা, গভীর। ঈশা শুধু সুন্দরীই নয়, বুদ্ধিদীপ্তও। কিন্তু রোহিতের ঠাট্টা মনে করিয়ে দিল, আসলে সে ঈশাকে একবারও চোখে দেখেনি, একসাথে হেঁটে বেড়ায়নি, হাত ধরেনি। শুধুমাত্র শব্দের ওপর ভরসা করা কি খুব হালকা ভিত্তি নয়? সেই রাতেই সে হঠাৎ নিজের ভেতরে অনুভব করল—যেন কোনো অজানা অনিশ্চয়তার ছায়া তাকে ঘিরে ধরছে।

এই দুই শহরে দুই মানুষ আলাদা জায়গায় বসে একই ধরনের সন্দেহে আক্রান্ত হলো, অথচ কেউই অন্যকে সরাসরি কিছু বলল না। ঈশা পরদিন মৌ-এর সঙ্গে তর্ক করতে গিয়েও থেমে গেল, ভেবেছিল—হয়তো অযথা এই প্রশ্নটা বড় করে ফেলছে। অভিরাজও রোহিতের সামনে তেমন কিছু প্রকাশ করল না, কিন্তু মনে মনে এক অদ্ভুত খচখচানি থেকে গেল। তাদের সম্পর্কের বুনন এতদিন ধরে ছিল মিষ্টি কথোপকথন আর অদেখা স্বপ্নে ভরা, এখন সেই বুননে হঠাৎ করে এক অচেনা সূতা ঢুকে গেল—সন্দেহের সূতা। হয়তো তারা কেউই পুরোপুরি বিশ্বাস ভাঙেনি, কিন্তু এই ছোট্ট প্রশ্নই ভবিষ্যতের পথে বড় এক মোড় আনতে চলেছে। কারণ সন্দেহ যখন একবার মনে জায়গা করে নেয়, তখন সেটা আর সহজে মুছে যায় না; বরং প্রতিটি কথোপকথনের ফাঁক গলে নতুন নতুন প্রশ্ন জন্ম দেয়। আর ঈশা ও অভিরাজ—যারা এখনো একে অপরকে বাস্তবে স্পর্শ করেনি—তাদের জন্য এই প্রশ্নগুলো হয়ে উঠতে পারে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।

অবশেষে বহুদিনের প্রতীক্ষার পর অভিরাজ কলকাতার ট্রেনে চেপে আসে। রাতভর যাত্রার পর ভোরের আলো যখন হাওড়া ব্রিজের গায়ে পড়ে, তখন তার বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে যায়। কতবার সে কল্পনা করেছে এই মুহূর্তটা—ঈশাকে সামনাসামনি দেখার, যার সঙ্গে দিনের পর দিন কথা বলে, রাতের পর রাত জেগে থেকেছে। ট্রেন যখন প্ল্যাটফর্মে ঢুকল, অভিরাজের হাতের তালু ভিজে উঠল ঘামে, বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ শব্দ যেন কানে বাজছিল। ব্যাগ কাঁধে নামিয়ে যখন ভিড়ের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করল, তখন মনে হচ্ছিল প্রতিটি পদক্ষেপ তাকে এক অচেনা অথচ বহু কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ফোনে তাদের শেষ কথোপকথনটা মনে পড়ছিল—“স্টেশনেই অপেক্ষা করব, চিনতে ভুল করবে না।” সেই কণ্ঠস্বরের উষ্ণতা যেন কানে গুঞ্জন তুলছিল। চারপাশে হইচই, ঘোষণা, ট্রেনের সিটি, কোলাহলের ভিড়—সবকিছু সত্ত্বেও তার মন কেবল একটি চোখের দিকে খুঁজছিল। হঠাৎ দূর থেকে ঈশার খয়েরি রঙের শাল চোখে পড়ে—সেটা যেন মুহূর্তেই সমস্ত ভিড় থেকে আলাদা হয়ে ওঠে।

ঈশারও মনে হচ্ছিল বুকের ভেতরে পাখির মতো কিছু উড়ে যাচ্ছে। আগের দিন রাতে ঘুম হয়নি একফোঁটাও। বারবার আয়নায় দাঁড়িয়ে ভেবেছে, প্রথম দেখায় অভিরাজ তাকে কেমন দেখবে, কেমন লাগবে। ফোনে তাদের যে নিরন্তর আলাপ, হোয়াটসঅ্যাপে দিনের পর দিন লেখা ছোট্ট ছোট্ট শব্দ—সেগুলো আজ রক্তমাংসের মানুষ হয়ে তার সামনে দাঁড়াবে। স্টেশনের কোলাহল, চায়ের দোকানের ধোঁয়া, যাত্রীদের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে তার মনে হচ্ছিল পৃথিবীটা যেন এক জায়গায় থেমে গেছে। তারপর চোখ যখন পড়ল সেই পরিচিত মুখে—ফোনের স্ক্রিনে যাকে সে এতবার দেখেছে, তার সেই মিষ্টি নার্ভাস হাসি, সামান্য অবিন্যস্ত চুল, হাতে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ—তখন বুকের ভেতরকার সমস্ত দ্বিধা, সমস্ত ভয়েরা যেন মিলিয়ে গেল। অভিরাজের চোখে সে দেখল এক ধরনের উষ্ণতা, যেন বহু বছরের আলাপচারিতা, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা সব এক মুহূর্তে গলে মিশে গেছে দৃষ্টিতে। অথচ ঠোঁটে কোনো শব্দ এলো না, শুধু লাজুক চোখে তাকিয়েই যেন দুজনের মধ্যে ভাষার বাইরে এক যোগাযোগ তৈরি হয়ে গেল।

মুহূর্তটা ছিল সিনেমার দৃশ্যের মতো—যেন ভিড়ের ভেতরেও তারা দুজন আলাদা এক বৃত্ত তৈরি করেছে, যেখানে শুধু তাদের দুজনের হৃদস্পন্দন শোনা যাচ্ছে। অভিরাজ নার্ভাস হয়ে হেসে ফেলল, আর সেই হাসিতেই ভেঙে গেল সমস্ত অস্বস্তি। ঈশা একটু নিচে তাকাল, ঠোঁটে লাজুক হাসি ফুটল। এটাই ছিল তাদের প্রথম দেখা—কোনো ফুলের তোড়া, কোনো সাজানো আয়োজন, কোনো প্রস্তুতি ছাড়া, একেবারে স্বাভাবিক আর জীবন্ত। তবু সেই সরল মুহূর্তেই ছিল এক গভীর জাদু, যা তাদের সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করে দিল। প্ল্যাটফর্মের ভিড় পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসার পথে তারা দুজনেই চুপচাপ পাশাপাশি হাঁটল, কিন্তু সেই নীরবতায়ই কথা ছিল হাজার। ঈশা মনে মনে ভাবছিল—এই তো মানুষটা, যাকে এতদিন ধরে হৃদয়ের ভেতরে বুনে রেখেছিল। আর অভিরাজের মনে হচ্ছিল—ফোনের আলোয় যাকে দেখেছে, সেই মেয়ে আসলে তার চেয়েও অনেক বেশি বাস্তব, অনেক বেশি সুন্দর। সেই প্রথম দেখার মুহূর্তে সময় যেন থমকে দাঁড়াল, আর দুজনেই বুঝল—এভাবেই হয়তো শুরু হয় জীবনের সবচেয়ে সত্যিকারের অধ্যায়।

অভিরাজের সঙ্গে সরাসরি দেখা করার পর ঈশার মনে যেন নতুন এক জগত খুলে গেল। এতদিন সে অভিরাজকে শুধু ভিডিও কলের মধ্যে চিনত—স্ক্রিনের ওপারে থাকা এক মুখ, যার হাসি, চোখের চাহনি, কিংবা মাঝে মাঝে ভ্রু কুঁচকে কথা বলার ভঙ্গি ঈশার কাছে ছিল এক অদ্ভুত টান। কিন্তু যখন তারা দুজন একসঙ্গে প্রথমবার কফি শপে বসল, তখন ঈশা অনুভব করল তার সামনে যে মানুষটা বসে আছে সে যেন একেবারেই অন্যরকম। অভিরাজের শরীরী উপস্থিতি কেবল দৃশ্যমান নয়, তা যেন চারপাশে ছড়িয়ে থাকা এক আবহ, যা তাকে নিজের অজান্তেই আকর্ষণ করছে। কফির মগের ধোঁয়া, আশেপাশের কোলাহল, টেবিলে রাখা দুটো হাত—এসবের ভেতর দিয়ে ঈশা আবিষ্কার করল যে মানুষকে চোখের দেখা পাওয়া আর তার উপস্থিতি অনুভব করার মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। অভিরাজ যখন হাসছিল, ঈশা শুধু তার ঠোঁটের নড়াচড়া দেখছিল না, বরং সেই হাসির উষ্ণতা যেন তার শরীরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তারা বই, সিনেমা, গান নিয়ে কথা বলল, যেন বহুদিনের পরিচিত। অথচ প্রতিটি মুহূর্তে ঈশা নিজেকে মনে করাচ্ছিল, “এ তো সেই মানুষ যাকে এতদিন আমি শুধু পর্দার ওপারে চিনেছি।” কফি শপ থেকে বেরোনোর সময় ঈশার মনে হচ্ছিল, শহরের ভিড়ভাট্টা সত্ত্বেও অভিরাজের পাশে হাঁটার মধ্যে একরকম প্রশান্তি আছে—যেন চারপাশের কোলাহল মিলিয়ে গিয়ে কেবল দুজন মানুষের নীরব সংলাপ বেঁচে থাকে।

পরের সপ্তাহে তারা বইমেলায় গেল। বইমেলার ভিড়, ধুলো, আলো আর রঙিন ব্যানারের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঈশার মনে হচ্ছিল যেন তারা একসঙ্গে একটা অন্যরকম যাত্রায় বেরিয়েছে। অভিরাজের হাতে ধরা কাগজের ঠোঙায় বই জমা হচ্ছিল একটার পর একটা, আর ঈশা দেখছিল কেমন সহজভাবে সে বইগুলো বেছে নিচ্ছে। ওর পছন্দের মধ্যে ছিল পুরনো বাংলা কবিতার সংকলন থেকে শুরু করে আধুনিক ইংরেজি উপন্যাস। মাঝে মাঝে সে ঈশাকে তাকিয়ে বলত, “এই বইটা তুমি পড়েছ? না হলে তোমার পড়া উচিত।” এই সোজাসাপ্টা কথার মধ্যে ঈশা এমন এক আন্তরিকতা অনুভব করল যা তাকে স্পর্শ করছিল। তারা বইমেলার মাঠের ভিড় ঠেলে একসঙ্গে ঘুরে বেড়াল, কোনো স্টলে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে পুরনো বইয়ের গন্ধ শুঁকল, আবার কোনো ফুড কোর্টে বসে ঝালমুড়ি খেল। সেই মুহূর্তগুলোতে ঈশা বুঝতে পারছিল, ভিডিও কলের অভিরাজ হয়তো তার চিন্তার সঙ্গী ছিল, কিন্তু মেলায় অভিরাজ যেন একেবারে তার জীবনের সঙ্গী হয়ে উঠছে। হাতের কাছে থাকা, কাঁধ ছুঁয়ে যাওয়া, হাসির শব্দ কানে প্রতিধ্বনিত হওয়া—এসব কিছু তার মনে এক ধরনের নেশা জাগাচ্ছিল। তারা যখন সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে বইমেলা থেকে বেরোল, তখন ঈশা টের পেল অভিরাজের পাশে দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যে এক অদ্ভুত নিরাপত্তা আছে, যা সে আগে কখনও অনুভব করেনি।

শেষে তারা গঙ্গার ঘাটে হাঁটতে গেল। সন্ধ্যা নামছিল ধীরে ধীরে, গঙ্গার জলে প্রতিফলিত হচ্ছিল আকাশের শেষ আলো। শীতের হাওয়ায় হালকা কাঁপুনি ধরছিল, অথচ ঈশার মনে হচ্ছিল অভিরাজের উপস্থিতি যেন এক উষ্ণ কম্বল মেলে দিয়েছে তার চারপাশে। তারা একসঙ্গে বসে নদীর দিকে তাকিয়ে ছিল, কখনো কথা বলছিল, কখনো চুপ করে থাকছিল। সেই নীরবতার মধ্যেই ঈশা অনুভব করছিল সবচেয়ে বড় কথোপকথনটা হচ্ছে—কোনো শব্দ ছাড়াই। অভিরাজ যখন নদীর জলে পাথর ছুঁড়ে দিচ্ছিল, ঈশা তাকিয়ে ছিল তার দিকে, আর মনে হচ্ছিল প্রতিটি মুহূর্তে অভিরাজ যেন আরও কাছে চলে আসছে। শরীরের উপস্থিতি এখানে শুধু চোখে দেখা বা কানে শোনা নয়, বরং হৃদয়ের ভেতরে একটা সাড়া জাগানো অনুভূতি। ঈশা বুঝতে পারছিল, সে যেভাবে অভিরাজকে এখন দেখছে, তা আর কখনো ভিডিও কলে দেখা সম্ভব নয়। বাস্তবের স্পর্শ, উপস্থিতির গন্ধ, চোখের দৃষ্টির গভীরতা—এসব কেবল সামনাসামনি পাওয়া যায়। আর সেখানেই জন্ম নেয় এক অন্যরকম সংযোগ, যা হয়তো ধীরে ধীরে প্রেমের রূপ নিচ্ছে। রাত যখন নেমে এল, গঙ্গার ঘাটের আলো-আঁধারিতে অভিরাজ আর ঈশা একসঙ্গে হাঁটছিল, আর ঈশা অনুভব করছিল তার জীবনের ছবিতে এক নতুন অধ্যায় যোগ হয়ে গেল—এক অধ্যায়, যেখানে শরীরী উপস্থিতিই হয়ে উঠছে সমস্ত অনুভূতির ভাষা।

সন্ধ্যার হালকা আলোয় ভিজে থাকা কফিশপের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ঈশা এক অদ্ভুত অস্বস্তি অনুভব করছিল। দিনের পর দিন তারা একে অপরকে জানছে, ভালোবাসছে, কথার জাদুতে গড়ে উঠেছে সম্পর্কের এক মায়াবী বাঁধন, কিন্তু বাস্তবে সেই অনুভূতিগুলো প্রকাশ করা কতটা জটিল হতে পারে, সেটা আজই যেন প্রথমবার টের পেল। ফোনে কিংবা অনলাইনে অভিরাজ যখন কথা বলে, তখন সে হাসি-ঠাট্টায় ভরিয়ে দেয় ঈশার মন; প্রতিটি শব্দ যেন যত্নের সঙ্গে বোনা থাকে। কিন্তু মুখোমুখি হয়ে কথোপকথনটা একেবারেই ভিন্ন। ঈশা নিজের অজান্তেই অভিমানী স্বরে একটা ছোট্ট প্রশ্ন করে ফেলেছিল—“তুমি কি সত্যিই সময় পাও না, নাকি ইচ্ছা করেই আমার সঙ্গে বাইরে বেরোতে চাও না?” প্রশ্নটা তার মনে অনেক দিন ধরেই জমে ছিল, কিন্তু জিজ্ঞেস করার পরই যেন বাতাস ভারী হয়ে উঠল। অভিরাজ চুপচাপ কফির কাপে চামচ নেড়ে চলেছিল, তার চোখে কোনো উত্তর ছিল না। সেই নীরবতা ঈশাকে ভেঙে দিল। নিজের ভেতরে জমানো সন্দেহ, অবিশ্বাস, আর ভালোবাসার নিরাপত্তাহীনতা মিলেমিশে একটা চাপা ঝড় তুলল। চোখ ভিজে উঠল, ঠোঁট কাঁপল, আর কিছু না বলেই ঈশার গাল বেয়ে অশ্রু নেমে এল। সেই দৃশ্য যেন কফিশপের আলোতেও এক অদ্ভুত অন্ধকার ছড়িয়ে দিল। চারপাশে লোকজন হাসছিল, গল্প করছিল, অথচ তাদের টেবিলের উপর নেমে এলো এক নিঃশব্দ দ্বন্দ্ব, যা শুধুমাত্র তাদের দুজনেরই।

অভিরাজ জানত, সে ইচ্ছে করে ঈশাকে আঘাত দেয়নি, কিন্তু তার চুপ করে থাকার স্বভাবটাই যেন ভুল বোঝাবুঝির জন্ম দেয়। তার কাছে নীরবতা ছিল নিজের ভেতর কথাগুলো গুছিয়ে নেওয়ার সময়, কিন্তু ঈশার কাছে সেটা ছিল এড়িয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত। এই পার্থক্যটাই তাদের সম্পর্ককে টানটান করে তুলেছিল। ঈশা যখন কাঁদছিল, অভিরাজ তার দিকে তাকাতে পারছিল না; ভেতরে ভেতরে তারও কষ্ট হচ্ছিল। সে জানত, ঈশার প্রত্যাশা অন্যরকম—শব্দে, ছোঁয়ায়, উপস্থিতিতে। অথচ তার অভ্যস্ততা নীরবতায় লুকিয়ে থাকা। একদিকে ঈশা চেয়েছিল আশ্বাস, অন্যদিকে অভিরাজ ভেবেছিল সময়ই সব প্রমাণ করবে। কিন্তু ভালোবাসার ক্ষেত্রে সময় নয়, মুহূর্তটাই আসল। এই ভুল বোঝাবুঝির মুহূর্তে তারা যেন একই টেবিলে থেকেও আলাদা দ্বীপে ভাসছিল। ঈশার চোখে জল জমে উঠলেও তার ভেতরে ভালোবাসার শিকড় শক্ত ছিল। সে চাইছিল অভিরাজ একটু হাত বাড়িয়ে দিক, একটা কথা বলুক—“আমি আছি, তুমি ভয় পেয়ো না।” অথচ অভিরাজ দ্বিধায় বন্দি হয়ে গেল। একদিকে নিজের ভেতরের লাজুকতা, অন্যদিকে ঈশার কান্না—সে বুঝতে পারছিল না কোনটা আগে সামলাবে। ফলে, মুহূর্তটা কেটে গেল এক অদ্ভুত অস্বস্তির আবহে, যেখানে ভালোবাসা থাকলেও তা প্রকাশ করার ভাষা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।

ঈশার কান্না ধীরে ধীরে থেমে এলে কফিশপের বাইরে হালকা বৃষ্টি শুরু হলো। কাঁচের ওপারে জলবিন্দু গড়িয়ে পড়ছিল, যেন সেই অশ্রুর প্রতিফলন ঘটাচ্ছে প্রকৃতিও। তারা দুজনই চুপচাপ বসে রইল, কেউই নতুন করে কথার শুরু করতে পারল না। অভিরাজ মনে মনে ভাবছিল, এই নীরবতাই হয়তো সম্পর্কের সবচেয়ে বড় শত্রু—অনলাইনে যেখানে সে একেবারে মুক্ত, সেখান থেকে বাস্তব জীবনের মুখোমুখি কথোপকথনে তার সংকোচ যেন এক অদৃশ্য দেয়াল তুলে দেয়। ঈশা মনের ভেতরে শপথ করল, আর কখনোই এমন ছোট্ট ভুল বোঝাবুঝি তাদের মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়াতে দেওয়া যাবে না। ভালোবাসার শক্তি কোনো অভিমান কিংবা চোখের জল দিয়ে শেষ হয় না, বরং সেখান থেকেই গড়ে ওঠে গভীরতা। অভিরাজও বুঝতে পারল, ঈশাকে হারানোর ভয় তার ভেতরে আরও তীব্র হয়ে উঠছে। হয়তো কথাটা সে সেই মুহূর্তে উচ্চারণ করেনি, কিন্তু তার দৃষ্টিতে লুকানো অনুতাপ, অপরাধবোধ আর নিঃশব্দ ভালোবাসা ঈশার চোখে ধরা পড়ল। বাইরে বৃষ্টির ফোঁটা আর ভেতরে দুজনের নীরবতা একসঙ্গে মিশে গিয়ে তৈরি করল সেই দ্বন্দ্বের অধ্যায়, যা তাদের সম্পর্ককে আরও নরম অথচ দৃঢ় করে তুলবে। এ এক দ্বন্দ্ব, যেখানে কান্না আর নীরবতা থেকেও জন্ম নিল নতুন বোঝাপড়া, যদিও তারা তখনও সেটা প্রকাশ করে উঠতে পারেনি।

প্রথমবারের মতো স্ক্রিনের বাইরে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে তাদের ভেতরে দ্বিধা ও উত্তেজনার মিশ্র অনুভূতি তৈরি হয়েছিল। এতদিন ধরে চ্যাট, ভয়েস নোট, রাতজাগা ভিডিও কল—সবকিছু যেন একটা নিজস্ব দুনিয়া গড়ে তুলেছিল, যেখানে একে অপরকে ভালোবাসা সহজ ছিল, কারণ সেখানে মুখোমুখি লজ্জা, পারিবারিক চাপ বা সমাজের বিচার ছিল না। কিন্তু এবার পরিস্থিতি অন্যরকম। শিউলি বারবার নিজের মনে প্রশ্ন করছিল, অর্ণবের সামনে দাঁড়ালে সে কি ঠিক তেমনটাই থাকবে, যেমনটা স্ক্রিনে থেকেছে? তার চোখের দিকে তাকিয়ে কি নিজের মনের সত্যিটা প্রকাশ করতে পারবে? একইভাবে অর্ণবের মধ্যেও আতঙ্ক কাজ করছিল—সে কি বাস্তবে তেমন আকর্ষণীয়, তেমন গভীর, যেরকম শিউলি তাকে মনে করেছে এতদিন ধরে? ভেতরে ভেতরে তারা দুজনেই জানত, বাস্তব আর ডিজিটালের দুনিয়া এক নয়। চ্যাটে যেখানে সবকিছু লিখে নেওয়ার সময় থাকে, উত্তর দেওয়ার আগে ভাবার সুযোগ থাকে, সেখানে মুখোমুখি দেখা হলে অনুভূতি মুহূর্তেই প্রকাশ পাবে, এবং ভুল করলে সেখানেই ধরা পড়বে। অর্ণব মনে মনে ভেবেছিল, বাস্তবে তাদের দেখা হলে হয়তো বোঝা যাবে—এই ভালোবাসা সত্যিই জায়গা করে নিতে পারবে কি না। তবুও শিউলির পাঠানো শেষ মেসেজ—“আমরা কি সত্যিই প্রস্তুত?”—অর্ণবকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল।

তাদের দেখা হওয়ার আগের রাতটা দুজনের কাছেই ছিল অস্থিরতায় ভরা। শিউলি বিছানায় শুয়ে মোবাইল স্ক্রিনের আলোয় পুরোনো চ্যাটগুলো পড়ছিল—যেখানে অর্ণব হঠাৎ করে লিখেছিল, “তুমি ছাড়া আমার সকাল অসম্পূর্ণ।” সেসব লাইন পড়ে তার মনে হচ্ছিল, এমন কি সম্ভব যে এগুলো শুধু স্ক্রিনের খেলা? আবার তার মনে পড়ছিল রাতের পর রাত অর্ণবের ভয়েসে ঘুমিয়ে পড়া, অথবা কঠিন দিনে শুধু এক লাইনের একটা শুভকামনা পাওয়ায় বুক ভরে যাওয়া। কিন্তু বাস্তব দেখা যদি সবকিছু পাল্টে দেয়? যদি তার সামনে দাঁড়িয়ে অর্ণব সেই মানুষটাই না হয় যাকে সে এতদিন ধরে কল্পনা করেছে? একই সময়ে অর্ণব নিজের ছোট্ট ঘরে বসে ভাবছিল, শিউলি তার সামনে দাঁড়ালে সে কীভাবে নিজেকে সামলাবে। ডিজিটাল দুনিয়ায় তার সাহস ছিল, কিন্তু বাস্তবে? সে কি তার সামনে সঠিকভাবে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারবে? বাইরে থেকে তার বন্ধুদের গলায় শোনা যাচ্ছিল হাসাহাসি, কারো মজার গল্প, কিন্তু অর্ণব যেন অন্য এক দুনিয়ায় ছিল—যেখানে প্রতিটি সেকেন্ড তাকে টেনে নিচ্ছিল অনিশ্চয়তার গহ্বরে। তাদের ভেতরে ভেতরে প্রশ্ন ছিল একই—এই সম্পর্ক কি কেবল স্ক্রিনের আলোর মধ্যে টিকে থাকবে, নাকি বাস্তবের আলোতেও বেঁচে থাকবে?

সকালে যখন তারা দেখা করল, দুজনেই এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল। শিউলি প্রথমে অর্ণবকে দেখে বুঝতেই পারছিল না, এতদিন ধরে যাকে ফোনের স্ক্রিনে দেখেছে, সে-ই কি সত্যি সামনে দাঁড়িয়ে আছে? আর অর্ণবও স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, যেন বাস্তব আর ডিজিটালের ভেদরেখা এক নিমিষে মিলিয়ে গেছে। তাদের কথোপকথন শুরু হল সাধারণ বিষয় দিয়ে—আবহাওয়া, কফির স্বাদ, আশেপাশের শব্দ। কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের চোখের দৃষ্টিই বলে দিচ্ছিল—এখানে শুধু পর্দার সম্পর্ক নয়, এর চেয়েও গভীর কিছু আছে। শিউলি লক্ষ্য করছিল, অর্ণবের মুখে হালকা নার্ভাস হাসি, আর সেটাই তাকে বিশ্বাস করাচ্ছিল, সে-ই সেই মানুষ যে ভয়েস মেসেজে তাকে ঘুম পাড়াতো। অর্ণবও বুঝতে পারছিল, শিউলির চোখে সেই একই উজ্জ্বলতা আছে, যা তাকে ডিজিটাল পর্দার ওপার থেকেও ছুঁয়ে যেত। সেই মুহূর্তে তারা দুজনেই বুঝে গিয়েছিল, ভয়ের পর্দা সরিয়ে দিলে আসলে অনুভূতির সত্যিটা বদলায় না। সম্পর্কটা শুধুই ডিজিটালের ছিল না, বরং বাস্তবেও তার শেকড় গজাতে শুরু করেছে। যদিও সামনে আরও অনেক প্রশ্ন, আরও অনেক পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে, তবু সেই এক মুহূর্তে তাদের মনে দৃঢ় হয়ে গিয়েছিল—এই সম্পর্ক কেবল স্ক্রিনে আটকে নেই, বরং বাস্তবেই বাঁচতে চায়।

অভিরাজের ঘরে সেদিন সন্ধ্যা নেমে এসেছিল ধীরে ধীরে। জানলার বাইরে থেকে হালকা হাওয়া বইছিল, শহরের আলো তখনও জ্বলে উঠেনি, তবে গোধূলির আভা ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। অভিরাজ তার প্রিয় গিটারটা কোলে তুলে নিয়ে আস্তে আস্তে টান দিল প্রথম সুরে। সেই সুর যেন ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে এক অদৃশ্য ঢেউ ছড়িয়ে দিল। ঈশা তখন জানলার পাশে বসে তাকে দেখছিল, মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি, যেন বহু দিনের অপেক্ষার প্রাপ্তি ধীরে ধীরে সত্যি হতে চলেছে। এতদিন ধরে তারা শুধু স্ক্রিনের ওপারে একে অপরকে দেখেছে, হাসি-কান্না ভাগ করেছে ভিডিও কলে, কিন্তু আজ তাদের মাঝখানে কোনো পর্দা নেই। অভিরাজের আঙুলের ছোঁয়ায় গিটারের তার যখন কেঁপে উঠছিল, তখন ঈশার চোখে ভেসে উঠছিল এক অদ্ভুত আলো, যা সে নিজেও আগে খেয়াল করেনি। অভিরাজ গান ধরল—তার কণ্ঠে কোনো অতিরিক্ত সাজসজ্জা নেই, শুধু আন্তরিকতা আর ভালোবাসার স্রোত। ঈশার মনে হচ্ছিল, এই সুরটা যেন তার নিজের হৃদয়ের ভিতর থেকেই বেরিয়ে আসছে, অভিরাজ শুধু তা প্রকাশ করছে তার গিটারের তার আর কণ্ঠের সুরে। সুরের আবেশে সময়ের অনুভূতি হারিয়ে যাচ্ছিল, বাইরের জগৎ যেন একেবারেই নেই।

গান যখন শেষ হলো, তখন ঘরে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এলো। সেই নিস্তব্ধতায় ঈশার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও যেন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। অভিরাজ কিছুক্ষণ নীরব থেকে ধীরে ধীরে গিটারটা এক পাশে রেখে ঈশার দিকে তাকাল। চোখে চোখ পড়তেই দুজনেই হেসে ফেলল, তবে সেই হাসিতে লজ্জার আভা মিশে ছিল। এতদিন ধরে তাদের সমস্ত অনুভূতি ভাষা আর দূরত্বের মধ্যে আটকে ছিল, আজ হঠাৎই কাছে আসার সুযোগে যেন তারা দুজনেই একটু অচেনা লাগছিল। ঈশার হাত তখন টেবিলের উপর রাখা, আর অভিরাজ ধীরে ধীরে নিজের হাত বাড়িয়ে তার হাতের উপর রাখল। সেই মুহূর্তে সময় থমকে গেল বলে মনে হলো। ঈশা চমকে উঠল না, বরং তার চোখে এক নীরব স্বীকৃতি ঝলমল করল। প্রথমবার অভিরাজের হাতের উষ্ণতা অনুভব করে ঈশা বুঝল—শরীরী ছোঁয়ার ভেতরে এক অন্যরকম সত্য লুকিয়ে আছে, যা কোনো ভিডিও কল বা ভার্চুয়াল সংযোগে পাওয়া যায় না। তাদের হৃদয় এতদিন ধরে শুধু শব্দ আর ছবির মাধ্যমে একে অপরকে ছুঁয়েছিল, কিন্তু আজ তাদের দেহের উষ্ণতা এক নতুন বিশ্বাসের জন্ম দিল।

এই মুহূর্তে দুজনেই একে অপরকে আর কোনো ব্যাখ্যা দিতে চাইল না। তাদের চোখ, তাদের নীরবতা, আর হাতের আলতো চাপই সবকিছু বলে দিল। ঈশার মনে হচ্ছিল, এ যেন এমন এক স্বপ্ন, যা সে কখনো ভাঙতে চাইবে না। অভিরাজও বুঝতে পারছিল, এতদিনের অপেক্ষা, দ্বিধা আর কল্পনার পর আজ তারা এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে কোনো অজুহাত বা সীমারেখা নেই। তাদের নিঃশ্বাসের ফাঁকে ফাঁকে মিশে যাচ্ছিল অদৃশ্য সুর, যেন অভিরাজের গিটার এখনও বাজছে তাদের হৃদয়ের ভেতর। বাইরে তখন শহরের আলো জ্বলে উঠেছে, কিন্তু ঘরের ভেতর তাদের চোখেই সবচেয়ে বড় আলো জ্বলছিল। সেই সন্ধ্যার নিস্তব্ধতায় তারা দুজনেই বুঝতে পারল—প্রেম শুধু কথায়, সুরে বা পর্দার ওপারে নয়; প্রেমের সত্যতা ছোঁয়ার ভেতরেও লুকিয়ে থাকে, আর সেই ছোঁয়া মানুষকে এক অদ্ভুত পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যায়। সেদিন রাতেই তাদের সম্পর্ক এক নতুন সংজ্ঞা পেল—যেখানে দূরত্বের আর কোনো অস্তিত্ব নেই, আছে শুধু কাছাকাছি থাকার অনন্ত প্রতিশ্রুতি।

১০

সমাপ্তির ঠিক আগে গল্পের গতি যেন হঠাৎ ধীর হয়ে আসে, যেমন একটি ঝড় অনেকক্ষণ তাণ্ডব চালিয়ে শেষে হাওয়া থেমে গিয়ে ফেলে যায় ভেজা গাছপালা, ভাঙা ডাল, কাদা, আর স্মৃতির স্তূপ। নীল ও অর্ণব—যাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল একেবারেই ভার্চুয়াল পরিসরে, এখন এসে দাঁড়িয়েছে এমন এক মুহূর্তে যেখানে তারা জানে, ভবিষ্যৎ অন্ধকার কুয়াশার মতো অনিশ্চিত। একদিকে তাদের মধ্যে জন্ম নেওয়া স্নেহ, টান, আকর্ষণ—যা দিনের পর দিন মেসেজ, ইমোজি, রাতজাগা চ্যাট, ভিডিও কলের মাধ্যমে বেড়ে উঠেছিল; অন্যদিকে বাস্তব জীবনের বাঁধন, দায়িত্ব, ভৌগোলিক দূরত্ব, সামাজিক শর্ত—সব মিলিয়ে সম্পর্কটিকে এক অমীমাংসিত প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে। শেষবার যখন তারা অনলাইনে কথা বলল, তখন এক অদ্ভুত নীরবতা ভেসে বেড়াচ্ছিল, কথার ভেতরে ঢুকে পড়েছিল অনিশ্চয়তা আর বেদনার স্রোত। তবুও তারা স্বীকার করল—এই সম্পর্ক কখনও অকারণ ছিল না। এই ভার্চুয়াল যোগাযোগ তাদের ভিতরে যে নরম অথচ গভীর ছাপ রেখে দিয়েছে, সেটি মুছবার মতো নয়। নীল তার কীবোর্ডে আঙুল রাখলেও আর কিছু লিখতে পারছিল না, অর্ণবের শেষ মেসেজ কেবল একটা ছোট্ট বাক্য—“আমরা হয়তো কখনও বাস্তবে মিলব না, কিন্তু তুমিই ছিলে আমার সবচেয়ে সত্যি অনুভূতি।” সেই বাক্য পড়তে পড়তে নীল বুঝেছিল, এই দাগ ব্যথা দিলেও তাকে সারাজীবন মনে করিয়ে দেবে যে সে একসময় সত্যিই ভালোবেসেছিল।

এই ডিজিটাল দাগ একরকম দ্বিমুখী স্মৃতি হয়ে ওঠে—একদিকে অপূর্ণতা, অন্যদিকে অর্জনের অনুভূতি। তারা দু’জনেই জানে, বাস্তবের পথ যদি কখনও মিলেও যায়, তবু এই সম্পর্ক হয়তো তখন ভিন্ন রূপ নেবে। হয়তো অর্ণব বিদেশে তার ক্যারিয়ার গড়ে তুলবে, নীল থেকে যাবে কলকাতার ছায়াঘেরা রাস্তায়, নিজের ছোট সংসারের ভিড়ে। কিন্তু সেই ভিন্ন ভিন্ন জীবনের মাঝেও, মনের ভেতর টুকে থাকবে রাতজাগা সেই মেসেজগুলো, সেই হাসির ইমোজি, হঠাৎ করা অডিও কল, কিংবা চোখে জল আনা চ্যাটবক্সের দীর্ঘ লেখা। প্রযুক্তি তাদের এক করেছে, আবার প্রযুক্তিই তাদের আলাদা করে দিয়েছে, কিন্তু এর মধ্যেই তৈরি হয়েছে এক বিশেষ রসায়ন—যা রক্তমাংসের সম্পর্কের মতো স্পর্শযোগ্য না হলেও ভেতর থেকে হৃদয়ে দাগ কেটে দিয়েছে। মাঝে মাঝে হয়তো তারা একে অপরের সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল চুপচাপ দেখে নেবে, লাইক না করেও ছবিগুলো দেখে মনে মনে বলবে—“তুমি ভালো থেকো।” আবার হয়তো ব্যস্ততার ভিড়ে ভুলে যাবে, কিন্তু হঠাৎ কোনও বিশেষ দিন, কোনও গান, কিংবা হঠাৎ ভেসে ওঠা অনলাইন নোটিফিকেশন তাদের সেই স্মৃতির গহ্বর থেকে টেনে আনবে। এই অসম্পূর্ণতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সম্পূর্ণতার এক অদ্ভুত অনুভূতি, যা মানুষকে শেখায়—প্রেম কেবল মেলানো নয়, বরং ভেতরে একটি অমোচনীয় ছাপ রেখে যাওয়া।

গল্প শেষ হয় এক মিশ্র আবহে—না পুরো সুখ, না পুরো দুঃখ; বরং এমন এক স্মৃতির গন্ধে যা চিরকাল রয়ে যায়। অনলাইনের জন্ম দেওয়া এই সম্পর্ককে হয়তো সমাজ স্বীকৃতি দেবে না, বাস্তবতাও সহজভাবে গ্রহণ করবে না, কিন্তু তা সত্ত্বেও নীল ও অর্ণব জানে—তাদের যাত্রা বৃথা নয়। এটি যেন এক ডিজিটাল দাগ, যা মাঝে মাঝে ব্যথা দেবে, আবার অনেক সময়ে মিষ্টি নস্টালজিয়ার মতো মন ভরিয়ে দেবে। তারা জানে, সামনে আরও অনেক সম্পর্ক আসবে, অনেক মুখ দেখা হবে, জীবনের গতি নতুন দিকে মোড় নেবে, কিন্তু সেই এক বিশেষ মানুষের সাথে ডিজিটালভাবে কাটানো মুহূর্তগুলো প্রতিটি নতুন অভিজ্ঞতার ভিতর লুকিয়ে থাকবে। যেমন ছোটবেলায় পাওয়া কোনো কাটা দাগ, বছর কেটে গেলেও শরীর থেকে মুছে যায় না—তেমনই এই প্রেমের ছাপ, যা কখনও পুরোপুরি ভোলা যায় না। এই সমাপ্তি তাই নিছক বিদায় নয়, বরং মানুষের অনুভূতির আর্কাইভে সংরক্ষিত এক অনন্ত অধ্যায়। পাঠক যখন শেষ লাইন পড়ে, তখন তাদের মনে হয়, হয়তো এই সম্পর্ক পূর্ণ হয়নি, কিন্তু অসম্পূর্ণতার ভেতর দিয়েই জীবনের সবচেয়ে সত্যি ভালোবাসা অনেক সময় প্রকাশ পায়, আর সেটাই হলো এই গল্পের আসল উত্তরাধিকার—এক অমোচনীয় ডিজিটাল দাগ।

-শেষ-

 

1000055008.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *