ঋষভ সরকার
এক
২০৭৫ সালের কলকাতা তখন একেবারে নতুন রূপে দাঁড়িয়ে আছে। গঙ্গার তীর ঘেঁষে উঁচু উঁচু টাওয়ার, আকাশপথে নীরব ভেসে চলা ম্যাগনেটিক ট্রেন, আর রাস্তায় স্বয়ংচালিত যানবাহনের মৃদু গুঞ্জন মিলে শহরকে দিয়েছে ভবিষ্যতের স্বাদ। রাস্তার দুই পাশে আলোকিত বিলবোর্ডে ভেসে আসে হোলোগ্রাফিক বিজ্ঞাপন—কখনও তাজা ফল বিক্রি করছে, কখনও পুরনো বাংলা সিনেমার ডিজিটাল রিমাস্টার রিলিজের ঘোষণা দিচ্ছে। শহরের উপর আকাশে ভেসে থাকে আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণের কৃত্রিম মেঘ, যা নির্দিষ্ট এলাকায় বৃষ্টি নামিয়ে দেয়, আবার কোথাও রোদ ঝলমল রাখে। এই ব্যস্ত শহরের এক কোণে, গঙ্গার ধারের পুরনো পোস্ট অফিসের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ঝকঝকে, সাদা-নীল কাঁচের “টাইম-পোস্ট সেন্ট্রাল হাব”—যেখানে কাজ করে অরুণেশ সেন, একজন সময়ের ডাকপিয়ন। এখানে সাধারণ পোস্ট অফিসের মতো চিঠি পাঠানো হয় না; বরং এখানে চিঠি আর পার্সেল অতীত বা ভবিষ্যতের নির্দিষ্ট তারিখে পাঠানো যায়। বাইরে থেকে ভবনটি নিঃশব্দ, কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করলেই শোনা যায় ইলেকট্রনিক কনভেয়ারের নরম গুঞ্জন, দূরের ডকিং স্টেশনে ধাতব ক্লিকের শব্দ, আর মাঝে মাঝে হালকা নীল আলোর ঝলক, যা বোঝায় কোনও প্যাকেজ সময়ের স্রোতে মিলিয়ে গেল।
অরুণেশের দিন শুরু হয় সকাল সাতটায়, যখন শহর তখনও আধো ঘুমে। সে তার ডেলিভারি স্যুট পরে, ডান কানে ছোট্ট ইয়ারপিস সেট করে নেয়—যা সরাসরি “টাইম-পোস্ট নেটওয়ার্ক”-এর সাথে যুক্ত। ইউনিফর্মের বুকে ঝকঝকে রূপালি ব্যাজে লেখা—Chrono Courier। সে যখন ডেলিভারি হাবে ঢোকে, রিসেপশনেই চোখে পড়ে বিশাল স্ক্রিনে “টাইমলাইন শিডিউল”—যেখানে লাল, নীল আর সবুজ লাইনে চিহ্নিত থাকে প্যাকেজের গন্তব্য সময় ও তারিখ। নীল লাইন মানে অতীতে ডেলিভারি, লাল লাইন ভবিষ্যতের জন্য, আর সবুজ মানে একই দিনে বা কাছাকাছি সময়ে পাঠানো। প্রতিটি প্যাকেজের সাথে থাকে একটি “টাইম-সিল”, যেটি প্যাকেজটিকে নির্দিষ্ট সময়ে স্থিতিশীল রাখে। সিল একবার সক্রিয় হলে তা ভাঙা সম্ভব নয়—যেন সময় নিজেই এক অদৃশ্য তালা লাগিয়ে দিয়েছে। নিরাপত্তা এখানে অতুলনীয়; প্রতিটি ডাকপিয়নকে যাত্রার আগে শারীরিক ও মানসিক স্ক্যান দিতে হয়, যাতে বোঝা যায় সে সময়-যাত্রার চাপ সামলাতে পারবে কি না। কারণ সময়ে যাত্রা করা মানে কেবল শূন্যে ভাসা নয়—এটি একধরনের চাপ, যা অতীতের গন্ধ বা ভবিষ্যতের আলোকে এতটাই বাস্তব করে তোলে যে অনেকের মনে বিভ্রম বা নস্টালজিয়া তৈরি হয়।
অরুণেশ তার রুটিন মেনে নিজের ডেলিভারি রুমে গিয়ে প্রথম শিফটের কাজ শুরু করে। সেখানে দেয়ালের একপাশে সারি সারি ট্রান্সক্রোনো পড সাজানো, যা দেখতে স্লিম ধাতব কেবিনের মতো, ভেতরে নরম আলো জ্বলছে। এই পডগুলিই হল সময়ে যাত্রার মাধ্যম। প্রতিটি পডে গন্তব্য তারিখ, সময়, এমনকি সেকেন্ড পর্যন্ত সেট করা হয়। আজ তার প্রথম ডেলিভারি একটি পার্সেল—যা ১৯৯৫ সালের ২১ জুন সকালে উত্তর কলকাতার এক পুরনো বাড়িতে পৌঁছাবে। প্যাকেজ হাতে নিয়ে অরুণেশ আঙুল ছুঁইয়ে দেখে নেয় টাইম-সিলের সক্রিয়তা, তারপর ধীরে ধীরে পডের ভেতরে ঢোকে। মেশিনের দরজা বন্ধ হতেই বাইরে থেকে সব শব্দ মিলিয়ে যায়, ভেতরে কেবল শোনা যায় নিজের শ্বাসের শব্দ। পডের নিয়ন্ত্রণপ্যানেলে নীল আলো ঝলকায়, কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ে মেঝেতে, আর মুহূর্তের মধ্যে সময় যেন উল্টো দিকে বয়ে যেতে থাকে—দেয়ালে অদৃশ্য ক্যানভাসে ভেসে ওঠে ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টানোর মতো ঝাপসা দৃশ্য, রঙের মিশ্রণে তৈরি সময়ের ঢেউ।
ডেলিভারি শেষে যখন সে ফিরে আসে, তার মনে হয় এই কাজ যতই নিয়মের বাঁধনে বাঁধা হোক না কেন, এর ভেতরে একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চ আছে। সে জানে, প্রতিটি চিঠি বা পার্সেল কারও জীবনের গতিপথ বদলে দিতে পারে—হয়তো কারও হারানো প্রেমকে ফিরিয়ে দেবে, হয়তো কোনও পুরনো রহস্য উন্মোচন করবে, অথবা ভবিষ্যতের কাউকে সতর্ক করবে আসন্ন বিপদের জন্য। তবুও এখানে কোনও ডাকপিয়নেরই অনুমতি নেই প্যাকেজের ভেতর কী আছে বা কেন পাঠানো হচ্ছে তা জানার। অরুণেশ কাজটা পছন্দ করে, কারণ এই নীরব দায়িত্বের মধ্যে একধরনের মর্যাদা আছে। তবুও, মাঝে মাঝে সে ভাবে—যদি কোনওদিন এমন চিঠি আসে যা ঠিক তার নিজের জন্য, তখন কী হবে? সে জানে না, এমন ঘটনা ঘটলে নিয়ম তাকে কী করতে বলবে, কিন্তু হৃদয়ের গভীরে একধরনের অজানা কৌতূহল ইতিমধ্যেই শিকড় গেঁড়ে বসেছে। আর সেদিন সকালে, যখন সে সেন্ট্রাল হাবের লবিতে দাঁড়িয়ে আকাশপথে ভেসে চলা মেঘের নিচে শহরের আলো দেখছিল, সে বুঝতে পারেনি যে সেই প্রশ্নের উত্তর খুব শিগগিরই তার হাতে এসে পড়তে চলেছে।
দুই
সকালটা শুরু হয়েছিল অন্য দিনের মতোই—নির্ধারিত সময়ে সেন্ট্রাল হাবে এসে অরুণেশ নিজের ডেলিভারি রুমে ঢুকে পড়েছিল। কাচের দেয়াল ঘেরা ঘরে প্যাকেজ স্ক্যানারের নরম গুঞ্জন, লাইন ধরে সাজানো টাইম-সিল প্যাকেজ, আর কোণে ভাসমান স্ক্রিনে একের পর এক ডেলিভারির সময়সূচি ভেসে উঠছিল। হাতে নেওয়া প্রথম কাজ ছিল একটি পুরনো ধাতব ট্রাঙ্ককে ১৯৮৭ সালের শিলিগুড়িতে পৌঁছে দেওয়া, আর তারপরে একটি ছোট্ট সিলভার কেস ২১২০ সালের নিউ টোকিওতে পাঠানো। অরুণেশের কাজের অভ্যাস ছিল সবকিছু ঠিকঠাক ক্রমানুসারে করা, তাই দিনের তৃতীয় ডেলিভারির সময় সে অবাক হয়ে গেল—কারণ সিস্টেম স্ক্রিনে কোনও প্রাপক বা গন্তব্য তারিখ দেখাচ্ছে না, বরং একটি লাল সতর্কবাণী ঝলসে উঠছে—”Special Internal Delivery – Hand Receive”। এই ধরণের ডেলিভারি সে আগে দেখেনি। কিছু বুঝে ওঠার আগে রুমের একপাশের প্যানেল খুলে গিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো একটি সাধারণ কাগজের খাম, যেটি একেবারে হাতে ধরবার মতো করে তার সামনে থেমে গেল।
অরুণেশ খামটি হাতে তুলে নিতেই ঠাণ্ডা এক শিরশিরানি তার আঙুল বেয়ে উঠে গেল। এই অনুভূতি সে চেনে—যখনই কোনও বস্তু দূর অতীত থেকে আসে, তখন তার তাপমাত্রা বা গন্ধে একটা অদ্ভুত অসঙ্গতি থাকে, যেন সময়ের কোলাহল পেরিয়ে সে এখানে পৌঁছেছে। খামের উপর প্রেরকের নাম দেখে সে প্রায় স্থির হয়ে গেল—”অরুণেশ সেন, ২০৬৫”। নিজের নাম, কিন্তু দশ বছর আগের। তার মনে প্রথমেই এল, হয়তো এটা কোনও প্র্যাঙ্ক বা সিস্টেমের ত্রুটি, কিন্তু চোখের কোণে পড়তেই তার বুক ধুকপুক করতে লাগল—খামের উপর টাইম-সিলের নীল চিহ্ন অটুট আছে, যার মানে এই ডেলিভারি সম্পূর্ণ বৈধ ও যাচাই করা। চারপাশে তাকিয়ে দেখল, ডেলিভারি রুম তখন প্রায় ফাঁকা, দূরে এক সহকর্মী হেডসেট কানে দিয়ে পড কন্ট্রোলে ব্যস্ত। অরুণেশ ধীরে ধীরে খাম ছিঁড়ে ভেতরের পাতাটি বের করল। চিঠিটি সাদামাটা সাদা কাগজে হাতে লেখা, কোনও ডিজিটাল ছাপ নেই। হাতের লেখা সে অবলীলায় চিনতে পারল—এটি তারই, শুধু খানিকটা কাঁপা ও ক্লান্ত।
চিঠির প্রথম লাইনেই যেন শ্বাস আটকে গেল—”যদি তুমি এটা পড়ছ, তার মানে আমি শেষ সুযোগটা হারাইনি।” এরপরের কয়েকটি বাক্যে লেখা ছিল একটি সতর্কবার্তা—কয়েক বছরের মধ্যে এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয় আসবে, যা সময়ের প্রবাহকে ভেঙে দেবে। কোনও নির্দিষ্ট তারিখ বা স্থান উল্লেখ করা হয়নি, কিন্তু চিঠিতে বলা হয়েছে যে এর পেছনে আছে এমন কিছু মানুষ, যারা টাইম-পোস্ট সার্ভিসের প্রযুক্তি নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। শেষ দিকে একটি লাইন ছিল, যা পড়ে তার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল—”তুমি হয়তো ভাবছ, এটা অসম্ভব, কিন্তু আমি তোমারই ভবিষ্যৎ রূপ। আর এই বিপর্যয় ঠেকাতে তোমাকেই প্রথম পদক্ষেপ নিতে হবে।” তার মনের মধ্যে হাজার প্রশ্ন ভিড় করল—এমন ঘটনা কি সত্যিই সম্ভব? যদি সত্যি হয়, তবে কেন চিঠিতে এত অস্পষ্টতা? আর কিভাবে দশ বছর আগের সে জানল যে ভবিষ্যতে এই চিঠি নিজের কাছেই পাঠাতে হবে? এই চিন্তাগুলো তাকে এমনভাবে ঘিরে ধরল যে আশেপাশের যন্ত্রের গুঞ্জনও তার কানে আর পৌঁছাল না।
খামটি আবার হাতে নিয়ে অরুণেশ এক মুহূর্ত ভাবল, সে কি এই বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবে? কিন্তু টাইম-পোস্ট সার্ভিসের নিয়ম খুব কঠোর—নিজের নামে বা নিজের জন্য পাঠানো কোনও প্যাকেজ সরাসরি হস্তান্তর করতে হয় তদন্ত বিভাগে। এর মানে চিঠি পৌঁছানোর সাথেই হয়তো তা তার হাতছাড়া হয়ে যাবে, আর তার মধ্যে থাকা তথ্য গোপন নথির মতো কোথাও তালাবদ্ধ থাকবে। সে অনুভব করল, এই চিঠির উৎস ও উদ্দেশ্য জানার একমাত্র উপায় হল নিজেই সত্য খুঁজে বের করা। বুক পকেটে চিঠিটি ভাঁজ করে রেখে দিল সে, আর বাইরে বেরিয়ে লবির কাচের দেয়াল দিয়ে তাকাল ভবিষ্যতের কলকাতার ব্যস্ততার দিকে—আকাশপথে ধীরে ধীরে ভেসে যাচ্ছে মালবাহী ড্রোন, দূরের টাওয়ারের গায়ে হোলোগ্রাফিক বিজ্ঞাপন ঝলমল করছে। কিন্তু তার মন এখন অতীতের দিকে বাঁধা, আর তার হাতে ধরা পাতলা কাগজের চিঠিটা যেন এক অদৃশ্য সুতোর মতো তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সময়ের স্রোতের উল্টো দিকে।
তিন
বিকেলের দিকে শিফট শেষ হতেই অরুণেশ সোজা রওনা দিল কায়া বসুর ল্যাবের দিকে। কায়া তার কলেজজীবনের বন্ধু, এখন টাইম-পোস্ট সার্ভিসের ডেটা আর্কাইভ সেকশনে সিনিয়র অ্যানালিস্ট। প্রযুক্তি ও ইতিহাসের উপর অসাধারণ দখল আছে তার, আর অরুণেশ জানে, অফিসিয়াল রেকর্ডে কিছু অস্বাভাবিক থাকলে কায়াই প্রথমে তা ধরতে পারবে। ল্যাবটি সেন্ট্রাল হাবেরই এক গোপন উইং-এ, যেখানে প্রবেশ করতে হলে একাধিক বায়োমেট্রিক স্ক্যান পেরোতে হয়। লম্বা করিডর পেরিয়ে, সারি সারি সার্ভার টাওয়ারের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অরুণেশ পৌঁছাল কায়ার ডেস্কে। কায়া তখন এক বিশাল হোলোগ্রাফিক ডিসপ্লেতে টাইমলাইন ডেটার উপর কাজ করছে—নীল আর সোনালি রেখায় ভবিষ্যৎ ও অতীতের ডেলিভারির গতিপথ আঁকা। অরুণেশ কোনও ভূমিকা না দিয়ে সরাসরি ব্যাগ থেকে খামটি বের করল। কায়া চিঠির উপরের টাইম-সিল আর তারিখ দেখে চোখ কুঁচকাল, তারপর স্ক্যানারের উপর রাখল খামটি। মেশিনের আলো একবার ঝলসে উঠল, তারপর অদ্ভুতভাবে নিস্তব্ধ হয়ে গেল—যেন সেটি কোনও রেকর্ড খুঁজে পাচ্ছে না।
“এটা অদ্ভুত,” কায়া ধীরে ধীরে বলল, হোলোগ্রাফিক স্ক্রিনে ডেটা স্ক্রল করতে করতে। “প্রতিটি টাইম-সিলের সঙ্গে একটি ট্রেস-কোড থাকে, যা ডেলিভারির পূর্ণ রেকর্ড সংরক্ষণ করে—প্রেরক, প্রাপক, তারিখ, এমনকি টাইম-শিফটের সময়ের অবস্থাও। কিন্তু এখানে কিছুই নেই। এই চিঠির কোনও সরকারি রেকর্ড নেই।” অরুণেশ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “মানে? এটা কি সম্ভব?” কায়া মাথা নাড়ল, “শুধুমাত্র একটাই সম্ভাবনা—এটি একটি ‘অফ-গ্রিড ডেলিভারি’। এমন ডেলিভারি সম্পূর্ণ সিস্টেমের বাইরে হয়, কোনও কেন্দ্রীয় অনুমোদন ছাড়া। সরকারি ভাবে এর অস্তিত্ব নেই। আর এর মানে, কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এটিকে টাইম-পোস্ট নেটওয়ার্ক থেকে আড়াল করেছে।” কথাটা বলার সময় কায়ার কণ্ঠে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা মিশে ছিল, কারণ এমন ঘটনা তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে আগে কখনও ঘটেনি।
দুজনেই জানত, ‘অফ-গ্রিড ডেলিভারি’ তত্ত্বত সম্ভব হলেও বাস্তবে এটি করা প্রায় অসম্ভব। কারণ প্রতিটি টাইম-সিল তৈরি হয় কেন্দ্রীয় চেম্বারে, যেখানে বহুমাত্রিক কোডিংয়ের ফলে কোনও সিলের নকল তৈরি করা বা সেটিকে অদৃশ্য রাখা যায় না। তাছাড়া প্রতিটি ডেলিভারি পড এবং এর ট্রান্সক্রোনো পথ নির্দিষ্ট সেন্সর দ্বারা পর্যবেক্ষণ করা হয়। যদি কেউ ইচ্ছা করে সিস্টেম বাইপাস করে, তবে তাকে একই সঙ্গে প্রযুক্তিগত জ্ঞান, অভ্যন্তরীণ অ্যাক্সেস, আর অসাধারণ দক্ষতা থাকতে হবে। কায়া তার কনসোলে আরও কিছু স্ক্যান চালাল, কিন্তু প্রতিবারই রেজাল্ট আসছে একই—No Record Found। শেষমেশ সে স্ক্যান বন্ধ করে বলল, “যদি এটা সত্যি হয়, তাহলে এই চিঠি পাঠিয়েছে এমন কেউ, যে খুব গভীর পর্যায়ে সিস্টেমে হাত দিতে পারে। আর সবচেয়ে বড় কথা—যদি প্রেরক সত্যিই তুমি হও, তবে তোমার ভবিষ্যতের কোনও সংস্করণ সিস্টেম ভেঙে কাজ করছে।” কথাটা শুনে অরুণেশের পিঠ বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। নিজের ভবিষ্যৎ রূপ কিভাবে এই ক্ষমতা পেল, আর কেন, তা ভাবতেই তার ভেতরে অদ্ভুত আতঙ্ক ও কৌতূহল একসঙ্গে দানা বাঁধল।
তারা সিদ্ধান্ত নিল, এখনই বিষয়টি কারও কাছে প্রকাশ করবে না। কায়া বলল, “আমরা ধীরে ধীরে এগোবো। প্রথমে খুঁজে বের করব, টাইম-সার্ভিসের ইতিহাসে এরকম অফ-গ্রিড রেকর্ডের কোনও উল্লেখ আছে কি না। তারপর বোঝার চেষ্টা করব, এর পেছনে কারা থাকতে পারে।” দুজনে আর্কাইভের ডিপ-স্টোরেজে ঢুকে গেল—যেখানে শত বছরের টাইম-পোস্ট লগ সংরক্ষিত আছে, কিছু এমনকি প্রথম টাইম-ডেলিভারি পরীক্ষার সময়কার। মৃদু আলোয় ভাসমান ডেটা-অরবগুলিতে হাত বুলিয়ে কায়া পুরনো ফাইলগুলো খুলতে লাগল, আর অরুণেশ মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি এন্ট্রি পড়তে লাগল। ঘণ্টা দুয়েকের অনুসন্ধানের পরও কিছু পাওয়া গেল না—কোনও রেকর্ডে এমন ডেলিভারির উল্লেখ নেই। কিন্তু এক পুরনো, ধুলোমাখা লগবুকে তারা দেখতে পেল অদ্ভুত এক নোট—“Chrono breach suspected. Untraceable package. Investigation inconclusive.” নোটটির তারিখ ২০৩৯ সাল, আর লেখকের নাম ছিল শুধু “R”. দুজনেই একে অপরের দিকে তাকাল—এটা কি সম্ভব যে এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাই এখন তাদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল, কারণ অনুভব করছিল, এই চিঠি কেবল একটা সতর্কবার্তা নয়—এটি হয়তো এমন এক রহস্যের দরজা, যার ওপারে লুকিয়ে আছে সময়ের সবচেয়ে বিপজ্জনক সত্য।
চার
ড. ইশান বাগচীর সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাব এল কায়ার তরফ থেকে। কায়া জানত, টাইম-সার্ভিসে কাজ করা সত্ত্বেও ইশান বাগচীকে সবাই একটু দূরে রাখে—কারণ তিনি গবেষণায় যতটা তত্ত্বকথা টানেন, ততটাই সরকারি নিয়ম ভাঙতে দ্বিধা করেন না। অতীতে তিনি বেশ কয়েকবার বিতর্কিত রিপোর্ট পেশ করেছেন, যেখানে সময়ে হস্তক্ষেপের সম্ভাব্য বিপদের কথা তুলে ধরেছেন। সেন্ট্রাল হাবের গবেষণা সেকশনের একদম শেষ প্রান্তে তার ল্যাব, চারদিকে কাচে ঘেরা, ভেতরে একাধিক টাইম-মডেল সিমুলেটর সারি সারি রাখা। অরুণেশ ও কায়া ঢুকতেই ইশান ডেস্ক থেকে মুখ তুলে তাকালেন, কাঁচের মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে তার চোখে তীক্ষ্ণ কৌতূহল। বিনা ভূমিকা দিয়ে কায়া খাম আর চিঠিটি তার সামনে রাখল। ইশান মনোযোগ দিয়ে খামটি হাতে তুলে নিলেন, আঙুল বুলিয়ে দেখলেন টাইম-সিলের ধাতব তল, তারপর ধীরে ধীরে চিঠিটি খুলে পড়তে লাগলেন।
পড়া শেষ হলে ইশান চশমা খুলে টেবিলে রাখলেন, মুখে গভীর ভাব। “তোমরা জানো, সময়ে কিছু নির্দিষ্ট বিন্দু থাকে, যেগুলোকে আমি ‘শূন্যবিন্দু’ বা Zero Points বলি,” তিনি শুরু করলেন। “এগুলো এমন মুহূর্ত, যেখানে ঘটনাপ্রবাহ খুবই অস্থির—যেখানে একটুখানি পরিবর্তন, এমনকি এক সেকেন্ডের বিলম্বও, ভবিষ্যতের পুরো পথ বদলে দিতে পারে। সাধারণ সময়ে হস্তক্ষেপের তুলনায় এগুলো অসীমভাবে বিপজ্জনক, কারণ এখানে সামান্য বিচ্যুতিই চেইন রিঅ্যাকশনের মতো অসংখ্য ঘটনার ফলাফল পাল্টে দেয়।” তিনি হোলোগ্রাফিক প্রজেক্টরে হাত নেড়ে কয়েকটি টাইম-মডেল দেখালেন—প্রথমে ছিল এক সরলরেখা টাইমলাইন, যেখানে একটি বিন্দুতে ক্ষুদ্র পরিবর্তনের ফলে পুরো রেখাটি অন্য পথে বাঁক নিয়েছে; তারপর আরও জটিল মডেল, যেখানে পরিবর্তন তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে বহু সমান্তরাল টাইমলাইনকে বিকৃত করেছে। “আমি সন্দেহ করছি,” ইশান বললেন, “এই চিঠি এসেছে কোনও বিপজ্জনক শূন্যবিন্দুর প্রান্ত থেকে। আর এর মানে, প্রেরক জানে যে তুমি—অথবা তোমার কোনও সিদ্ধান্ত—সেই বিন্দুর ভাগ্য নির্ধারণ করবে।”
অরুণেশ ভ্রু কুঁচকে বলল, “কিন্তু এই ধরনের বিন্দুতে হস্তক্ষেপ কি সবসময় বিপজ্জনক? যদি লক্ষ্য হয় ভবিষ্যতের বিপর্যয় ঠেকানো, তাহলে তো হস্তক্ষেপ প্রয়োজনীয়।” ইশান মাথা নাড়লেন, “সমস্যা সেখানেই। শূন্যবিন্দুতে হস্তক্ষেপ করা মানে তুমি এক গভীর নদীর স্রোতে ঝাঁপ দিচ্ছ, যেখানে প্রতিটি ঢেউ তোমাকে অজানা দিকে ঠেলে দিতে পারে। তুমি হয়তো বিপর্যয় ঠেকাতে পারবে, কিন্তু একই সঙ্গে অন্য আরও ভয়ঙ্কর কিছু তৈরি করতে পারো। আর যে কেউ এই বিন্দুগুলো ব্যবহার করতে চাইবে, তাকে নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা করতে হবে—কারণ এখানে দ্বিতীয় সুযোগ নেই।” কায়া জিজ্ঞেস করল, “কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে অফ-গ্রিড ডেলিভারি পাঠিয়ে থাকে, তবে কি এর মানে সে সিস্টেমের বাইরে থেকেও এই শূন্যবিন্দুতে পৌঁছাতে পারে?” ইশান উত্তর দিলেন, “তা সম্ভব, তবে এজন্য চাই প্রচুর অভ্যন্তরীণ তথ্য, উন্নত টাইম-টেক অ্যাক্সেস, আর সিস্টেমের গভীরে লুকিয়ে থাকা ব্যাকডোরগুলোর জ্ঞান। এমন কেউ, যে অনেক বছর ধরে ছায়ায় থেকে কাজ করছে।”
ইশান শেষে তাদের এক গুরুতর সতর্কবার্তা দিলেন। তিনি বললেন, “যদি এই চিঠি সত্যিই শূন্যবিন্দুর কাছ থেকে এসে থাকে, তবে তোমরা এখন বিপজ্জনক খেলায় নেমেছ। যে-ই হোক প্রেরক, তার উদ্দেশ্য হয়তো সৎ, হয়তো নয়—তবে নিশ্চিতভাবে সে জানে, তোমরা দুজনই এই ঘটনার কেন্দ্রে থাকবে। আর সবচেয়ে খারাপ সম্ভাবনাটা হল—এই শূন্যবিন্দুর পর যা ঘটবে, তা আর কোনও টাইম-সংশোধন দিয়ে ঠিক করা যাবে না। অর্থাৎ, ভুল পথে গেলে ইতিহাস স্থায়ীভাবে বদলে যাবে।” ইশানের কণ্ঠে এমন এক চাপা আতঙ্ক ছিল, যা অরুণেশের বুকের ভেতর শীতল শূন্যতা তৈরি করল। ল্যাবের কাচের দেয়ালের বাইরে তখন শহরের আলোর রেখা ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে, আর আকাশে ভেসে বেড়ানো বিজ্ঞাপন-ড্রোনের ঝলকানি ম্লান হয়ে আসছে—যেন সময় নিজেই নিঃশব্দে তাদের সতর্ক করছে, অদূরে কোনও অদৃশ্য বিন্দুর দিকে তারা এগোচ্ছে, যার প্রভাব থেকে আর ফেরা যাবে না।
পাঁচ
রাত প্রায় শেষের দিকে, কায়ার ডেস্কের সামনে অরুণেশ ও কায়া বসে ছিল, চোখ তাদের বিশাল হোলোগ্রাফিক ডিসপ্লের দিকে স্থির। টাইম-পোস্ট সার্ভিসের নিরাপত্তা আর্কাইভে ঢোকার জন্য কায়াকে বিশেষ অনুমতি নিতে হয়েছিল, আর এর জন্য তাদের নাম নথিভুক্ত হয়েছে—মানে এই অ্যাক্সেস তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবেও ব্যবহার হতে পারে। তবুও দুজনেই জানত, সত্য জানতে হলে ঝুঁকি নিতেই হবে। কায়া প্রথমে সেই তারিখটি খুঁজে বের করল, যেদিন চিঠিটি অরুণেশের হাতে আসে। ফুটেজে দেখা গেল—রাতের নিস্তব্ধতায় সেন্ট্রাল হাবের ড্রপ-ডেস্কে একজন প্রবেশ করছে, মুখ প্রায় ছায়ায় ঢাকা, কিন্তু যখন সে টাইম-সিল স্ক্যানারে খামটি রাখে, তখন আলোর ঝলকে তার মুখ স্পষ্ট হয়ে যায়। অরুণেশ নিঃশ্বাস আটকে দেখছিল—সে যেন আয়নায় নিজেকে দেখছে। একই উচ্চতা, একই মুখাবয়ব, এমনকি পুরনো টাইম-পোস্ট ইউনিফর্ম, যেটি কয়েক বছর আগে অবসর নেওয়া হয়েছে। দৃশ্যটা কয়েক সেকেন্ড স্থির থাকে, তারপর মানুষটি কোনও কথা না বলে চিঠিটি রেখে ধীরে ধীরে বেরিয়ে যায়।
“এটা তুমি,” কায়া ফিসফিস করে বলল, “কিন্তু কোনওভাবেই এটা হতে পারে না।” অরুণেশ নিজের চোখ বিশ্বাস করতে পারছিল না। ভিডিওর সময়মুদ্রা স্পষ্ট করে দেখাচ্ছে—২০৭৫ সালের এক রাত, চিঠি পাওয়ার ঠিক কয়েকদিন আগে। ফুটেজ থামিয়ে কায়া টাইম-ডেলিভারি লগ বের করল, যাতে প্রতিটি জমা দেওয়া আইটেমের কোড সংরক্ষিত থাকে। তালিকায় সত্যিই সেই খামের কোড আছে—কিন্তু এর কয়েক সেকেন্ড পরেই এন্ট্রি মুছে গেছে, যেন কেউ ভিতরে ঢুকে সরাসরি মূল ডেটাবেস থেকে এটি মুছে ফেলেছে। “এটা কেবল সিস্টেম-অ্যাডমিন স্তরের অ্যাক্সেসে সম্ভব,” কায়া ব্যাখ্যা করল, “আর সেই লগ-ডিলিটের সময় চিহ্নও এখানে নেই। পুরো সিস্টেম যেন কয়েক সেকেন্ডের জন্য অন্ধ হয়ে গিয়েছিল।”
অরুণেশের মাথায় যেন হাজার প্রশ্ন একসঙ্গে ঘুরপাক খাচ্ছিল। যদি ভিডিওতে থাকা ব্যক্তি সত্যিই তার ভবিষ্যৎ রূপ হয়, তবে সে কেন অতীতে এসে নিজেকেই চিঠি দিল? আর কেন পুরনো ইউনিফর্ম পরে? মনে হচ্ছিল যেন এই ছদ্মবেশ কোনও নির্দিষ্ট বার্তা বহন করছে—হয়তো অতীতের কোনও সংকেত, যা কেবল সে নিজে বুঝতে পারবে। কিন্তু একই সঙ্গে ভয়ঙ্কর সম্ভাবনাও মাথায় ঢুকল—যদি ভবিষ্যতের সে কোনও কারণে বিপজ্জনক কিছু করতে চায়, আর এই চিঠি সেই পরিকল্পনার অংশ হয়? কায়া মনোযোগ দিয়ে ভিডিওটি কয়েকবার রিপ্লে করল, প্রতিবারই সেই ক্ষণিকের ঝলকানি আর পরিচিত মুখ তাদের শিরদাঁড়ায় শীতল স্রোত বয়ে দিচ্ছিল।
হঠাৎ স্ক্রিনের ছবিটি বিকৃত হতে শুরু করল। প্রথমে শুধু ঝাপসা দাগ, তারপর সম্পূর্ণ ফুটেজ অদৃশ্য হয়ে গেল—একটা কালো পর্দায় কেবল একটা ঝলকানি লেখা, “Record not found”। কায়া হতবাক হয়ে বলল, “এটা এখনই ঘটল! কেউ লাইভ সিস্টেম থেকে ভিডিও মুছে দিল।” মানে স্পষ্ট—তারা যখনই সত্যের কাছে পৌঁছাতে যাচ্ছে, তখনই কেউ ছায়ার আড়াল থেকে সিস্টেমে হস্তক্ষেপ করছে। এই রহস্যময় দ্বিতীয় অরুণেশ যেন কেবল অতীত থেকে নয়, বর্তমানের ভেতর থেকেও তাদের অনুসরণ করছে। বাইরে তখন রাত গভীর, আর শহরের আলো দূরে ঝাপসা হয়ে আসছে, কিন্তু কাচের ঘরের ভেতরে অরুণেশ ও কায়ার মনে হচ্ছিল, তারা যেন এক অদৃশ্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছে—যেখানে সময় নিজেই অভিনয় করছে, আর তাদের ভূমিকা এখনও স্পষ্ট নয়।
ছয়
অরুণেশের হৃদয় দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছিল, যখন সে সেন্ট্রাল হাবের নিষিদ্ধ উইং-এ প্রবেশ করল—যেটি সাধারণ কর্মীদের জন্য সম্পূর্ণ অপ্রবেশযোগ্য। এখানে ছিল প্রোটোটাইপ টাইম-গেট, যেটি মূলত পরীক্ষামূলক মডেল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু অত্যন্ত গোপনীয় নিরাপত্তার কারণে বহু বছর ধরে বন্ধ রাখা হয়েছে। কায়াকে কিছু না জানিয়েই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে—চিঠির রহস্যের জবাব অতীতেই আছে, আর সেই অতীতে না গেলে এই খেলা শেষ হবে না। হাবের অন্ধকারে ঝলসে ওঠা মেশিনের আলো, প্যানেলের ঝিকমিক করা নির্দেশক, আর হালকা ধাতব গন্ধ—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত চাপা উত্তেজনা ছড়াচ্ছিল। তার হাত ধীরে ধীরে কনসোলের উপর চলল, কোঅর্ডিনেট সেট করল ২০৬৫ সালের জুন মাস, টাইম-পোস্ট সার্ভিসের সূচনালগ্ন। মুহূর্তের মধ্যে গেটের বৃত্তে তরল আলোর মতো এক ঘূর্ণি সৃষ্টি হল, আর অরুণেশ গভীর শ্বাস নিয়ে তাতে পা রাখল। চোখ বন্ধ করে আবার খোলার আগেই সে অনুভব করল—মাটি বদলে গেছে, বাতাস বদলে গেছে, আর তার চারপাশের শহরের শব্দে অতীতের এক অপরিচিত ছন্দ।
২০৬৫ সালের কলকাতা ছিল ভিন্ন এক শহর—প্রযুক্তি উন্নত হলেও, তখনও ভবিষ্যতের সেই আকাশচুম্বী টাওয়ার, ভাসমান বিজ্ঞাপন-ড্রোন বা আলোক-রেলপথ গড়ে ওঠেনি। রাস্তায় ছুটে চলা স্বয়ংক্রিয় ট্যাক্সিগুলোর পাশে সাধারণ গাড়িও চলাচল করছিল, আর ফুটপাত ভরতি ছিল মানুষের কোলাহলে। অরুণেশ ধীরে ধীরে এগিয়ে টাইম-পোস্ট সার্ভিসের প্রথম সদর দপ্তরের দিকে গেল, যেটি এখনকার বিশাল সেন্ট্রাল হাবের তুলনায় ছোট্ট এক প্রশাসনিক ভবন। ভেতরে ঢুকে সে একেবারে ভিন্ন এক আবহ পেল—কর্মীরা সবাই নতুন ধরনের কাজ নিয়ে উচ্ছ্বসিত, যেন সময় ডেলিভারির স্বপ্ন তখনও তাজা আর সম্ভাবনায় ভরা। তবে এই স্বাভাবিক চিত্রের আড়ালে অরুণেশ দ্রুত বুঝতে পারল কিছু অসঙ্গতি আছে। এক কোণে সে দেখল কয়েকজন লোক সাধারণ কর্মীদের চেয়ে আলাদা পোশাক পরে, নীরবে নিজেদের মধ্যে কোডেড বার্তা বিনিময় করছে। তাদের চোখে ছিল এক অস্বাভাবিক সতর্কতা, যেন তারা কাউকে এড়িয়ে চলছে।
রাত নামতেই অরুণেশ সেই রহস্যময় দলটিকে অনুসরণ করল। তারা সদর দপ্তরের মূল ভবন থেকে সরে এসে এক পুরনো গুদামঘরে ঢুকল, যেখানে সাধারণ ডেলিভারি টার্মিনালের মতো দেখতে কিছু যন্ত্রপাতি ছিল, কিন্তু কাছে গিয়ে অরুণেশ বুঝল—এগুলো সিস্টেমের অফিশিয়াল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত নয়। তার মানে, এখানে গোপনে “অফ-গ্রিড” টাইম-ডেলিভারি চলছে। দলের নেতা, লম্বা দেহী, তীক্ষ্ণ দৃষ্টির এক ব্যক্তি, এক ধরনের পুরনো-ধাঁচের টাইম-সিল ব্যবহার করছিল, যা অরুণেশ আগে কখনও দেখেনি। ডেলিভারি প্রক্রিয়াটি ছিল দ্রুত আর নিঃশব্দ, আর প্যাকেটের গন্তব্য ও প্রেরকের তথ্য কোনও সরকারি রেকর্ডে থাকার উপায় নেই। ঠিক তখনই অরুণেশ দেখল—একটি খাম পাঠানো হল, যার উপরে অদ্ভুত এক চিহ্ন খোদাই করা আছে, যা তার পাওয়া চিঠির কোণের খোদাইয়ের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।
এই আবিষ্কারে অরুণেশের বুক কেঁপে উঠল। মানে, ২০৬৫ সালেই এই গোপন ডেলিভারি নেটওয়ার্ক সক্রিয় ছিল, আর সম্ভবত তার হাতে আসা চিঠিটিও এখান থেকেই পাঠানো। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেল—কে বা কারা এই নেটওয়ার্ক চালাচ্ছে, আর তাদের উদ্দেশ্য কী? গুদামঘরের ছায়া থেকে বেরিয়ে অরুণেশ বুঝতে পারল, অতীতের এই যাত্রা তাকে কেবল উত্তর দেয়নি, বরং আরও গভীর এক ফাঁদে ফেলেছে। যদি এই নেটওয়ার্ক বহু বছর ধরে গোপনে চলতে পারে, তবে তাদের ক্ষমতা ও প্রভাব সময়ের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে আছে। আর এর মানে, এই রহস্যের সমাধান শুধু বিপজ্জনক নয়—সম্ভবত প্রাণঘাতীও হতে পারে, কারণ একবার ধরা পড়লে সময়ের ভেতরেই তার অস্তিত্ব মুছে দিতে তারা দ্বিধা করবে না।
সাত
অরুণেশের মাথায় তখনও ২০৬৫ সালের সেই গোপন নেটওয়ার্কের দৃশ্য ভাসছিল, কিন্তু কায়ার পাঠানো এনক্রিপ্টেড মেসেজ সবকিছু বদলে দিল—সে বলল, আর্কাইভে নতুন ডেটা ফাঁস হয়েছে। সেন্ট্রাল হাবের সুরক্ষিত ভল্টে রাখা সেই ডেটা প্যাকেটে ভবিষ্যতের টাইম-স্ট্যাম্প ছিল—২০৮০ সালের জুন। নিয়ম ভেঙে অরুণেশ তৎক্ষণাৎ কায়ার সঙ্গে সেই ডেটা ডিকোড করতে বসে। ফাইল খুলতেই সামনে এলো এক ভয়ঙ্কর দৃশ্যের হোলোগ্রাফিক সিমুলেশন—এক শহর ভেঙে পড়ছে, আকাশে কুয়াশার মতো ফেটে যাচ্ছে সময়ের স্তর, আর ভেতর থেকে উন্মুক্ত হচ্ছে হাজারো ভিন্ন ভিন্ন টাইমলাইন, প্রতিটি কয়েক সেকেন্ড টিকে গিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। কায়া গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “এটা হচ্ছে টাইম-লুপ ক্র্যাশ। ভবিষ্যতের কোনও এক দিনে টাইম-নেটওয়ার্কের এত বড় অস্থিরতা তৈরি হবে যে সমান্তরাল অসংখ্য টাইমলাইন একসঙ্গে ধ্বংস হয়ে যাবে।” স্ক্রিনে সেই সিমুলেশনের শেষ দৃশ্যে দেখা গেল—পুরো পৃথিবী যেন এক বিশাল ফাঁকা ক্যানভাসে পরিণত হয়েছে, যেখানে সময়ের কোনও চিহ্ন নেই।
অরুণেশ তখনই বুঝে গেল, এটা কোনও দুর্ঘটনা নয়। ডেটা প্যাকেটের গভীরে ঢুকে তারা আবিষ্কার করল একটি নকশা—একটি প্রোগ্রামিং ব্লুপ্রিন্ট, যা টাইম-পোস্ট সার্ভিসের মূল কাঠামোকে হ্যাক করে সুনির্দিষ্ট “শূন্যবিন্দু”তে হস্তক্ষেপ করতে পারে। এই নকশায় দেখা যাচ্ছে, কোন কোন বছরে, কোন কোন ঘটনায় পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে সময়ের প্রবাহ অস্থিতিশীল হয় এবং শেষমেশ ২০৮০ সালের ক্র্যাশ নিশ্চিত হয়। কায়া কোডের উৎস ট্রেস করার চেষ্টা করল, আর যা পেল তা আরও ভয়ঙ্কর—এটি এসেছে এক গোপন গোষ্ঠীর সার্ভার থেকে, যারা নিজেদের “ক্রোনো সিন্ডিকেট” বলে পরিচয় দেয়। তারা প্রযুক্তি, অর্থনীতি এবং রাজনীতির প্রতিটি স্তরে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণ করে, আর সময়ের মধ্য দিয়ে ঘটনাগুলো পাল্টিয়ে নিজেদের ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখে। নকশা অনুযায়ী, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু ঐতিহাসিক ঘটনায় ক্ষুদ্র কিন্তু গভীর পরিবর্তন আনছে, যা ভবিষ্যতের ভারসাম্য ধ্বংস করবে।
এই তথ্য পেয়ে অরুণেশের মনে পড়ল নিজের হাতে আসা চিঠির কথা—সতর্কবার্তায় বলা হয়েছিল যে এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয় সময়ের প্রবাহ ভেঙে দেবে। এখন স্পষ্ট, চিঠি তাকে এই নকশার সূত্রে পৌঁছে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু অরুণেশ ভাবছিল, চিঠিটি কি সত্যিই তার ভবিষ্যৎ রূপ পাঠিয়েছিল, নাকি কেউ তাকে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে? কায়া জানাল, “যদি আমরা এই নকশার একটিও মূল শূন্যবিন্দু বদলে দিই, তাহলে ক্র্যাশ আটকানো সম্ভব।” কিন্তু এর মানে হবে—তাদের অতীত ও ভবিষ্যতের অনেক ঘটনার সঙ্গে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে হবে, যা অবৈধ এবং প্রাণঘাতী। আরও বড় কথা, সিন্ডিকেট যদি তাদের গতিবিধি টের পায়, তবে তারা শুধু অরুণেশদের নয়, পুরো টাইম-রেকর্ড থেকেই তাদের মুছে ফেলতে পারে।
রাত গভীর হচ্ছিল, কিন্তু হোলোগ্রাফিক প্রজেকশনে ২০৮০ সালের ধ্বংসস্তূপের চিত্র যেন অরুণেশের চোখে পুড়ে বসে ছিল। সে জানত, সময়ের এই যুদ্ধ থামাতে হলে তাকে শুধু চিঠির উৎস খুঁজে বের করা নয়, বরং এই বিপর্যয়ের স্থপতিদের মুখোমুখি হতে হবে। আর এর মানে, তাকে এমন এক যাত্রায় নামতে হবে যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে অতীত ও ভবিষ্যত উভয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। কায়া তাকে একবার জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি প্রস্তুত?” অরুণেশ কোনও উত্তর দিল না—শুধু হোলোগ্রামে ভাসতে থাকা সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরের দিকে তাকিয়ে রইল, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—যা-ই হোক, ক্রোনো সিন্ডিকেটকে থামাতেই হবে, কারণ এটাই হয়তো তার জীবনের একমাত্র সুযোগ সময়কে রক্ষা করার।
আট
অরুণেশের জন্য রাতটি ছিল অদ্ভুতভাবে নীরব, যেন শহরের সব শব্দ হঠাৎ চেপে গেছে। সেন্ট্রাল হাবের এক পরিত্যক্ত লোডিং ডকের দিকে এগোতে গিয়ে তার মনে হচ্ছিল, প্রতিটি পদক্ষেপ যেন তাকে এক অনিবার্য মুখোমুখির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেখানে, ছায়ার ভেতর দাঁড়িয়ে ছিল সেই মানুষটি—যাকে সে শুধু সিসিটিভি ফুটেজে দেখেছিল। আলোর ঝলকে দেখা গেল, মুখের রেখা, চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, এমনকি শ্বাস নেওয়ার ভঙ্গি পর্যন্ত হুবহু তার নিজের মতো। কিন্তু পার্থক্য ছিল পোশাকে—পুরনো মডেলের টাইম-পোস্ট ইউনিফর্ম, যেটি অন্তত দশ বছর আগে ব্যবহৃত হতো। অরুণেশ এক পা এগিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে?” ছায়ার মানুষটি ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে নিঃশব্দে উত্তর দিল, “আমি তুমি—যে তুমি এখনো হতে পারোনি।” অরুণেশের শরীরে হালকা শীতল স্রোত বয়ে গেল, যেন সময় নিজেই তার গায়ে হাত রেখেছে।
দ্বিতীয় অরুণেশ তাকে বসতে বলল, আর দু’জন মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল সেই ডকের ধাতব সিঁড়ির পাশে। গম্ভীর কণ্ঠে সে বলল, “আমি এসেছি তোমাকে সতর্ক করতে—একটি পার্সেল আছে, যা তুমি আগামী সাত দিনের মধ্যে ডেলিভারি করবে। সেটি করলেই ক্রোনো সিন্ডিকেটের পরিকল্পনা পূর্ণ হবে এবং টাইম-লুপ ক্র্যাশ নিশ্চিত হবে।” অরুণেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু ডেলিভারি না করলে কী হবে?” দ্বিতীয় অরুণেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তাহলে ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ থেমে যাবে, আর সেই শূন্যস্থান পূরণ হবে অন্যভাবে—যা আমরা অনুমান করতে পারি না। এর ফলে বহু জীবন বদলে যাবে, কিছু হয়তো মুছে যাবে।” এই উত্তর শুনে অরুণেশ বুঝল, সিদ্ধান্তটি শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং সময়ের প্রতিটি স্তরে প্রভাব ফেলবে। সে অনুভব করল—যে পথই সে বেছে নিক, কোনওটাই নিখুঁত নয়।
কথোপকথনের সময় অরুণেশ লক্ষ্য করল, দ্বিতীয় অরুণেশের চোখে এক অদ্ভুত ক্লান্তি—যেন সে বহুবার একই সতর্কতা দিয়েছে, কিন্তু খুব কমই কেউ শুনেছে। “তুমি কি নিশ্চিত, এটা থামানোর আর কোনও উপায় নেই?” অরুণেশ প্রশ্ন করল। উত্তর এল ধীরে, “আমরা দুজনেই জানি, কিছু মুহূর্ত একবারই আসে, আর একবার গেলে ফেরে না। আমি দেখেছি ক্র্যাশের পর কীভাবে সময়ের স্তরগুলো ধসে পড়ে—মানুষ নয়, ইতিহাস নিজেই বিলীন হয়ে যায়। এই পার্সেলটি সেই ডোমিনোর প্রথম টুকরো।” দ্বিতীয় অরুণেশের হাত কাঁপছিল, যেন নিজের অতীত সংস্করণের কাছে অনুরোধ জানাতে গিয়ে তার ভেতরের চাপা বেদনা প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে। সে হালকা স্বরে যোগ করল, “আমি জানি, তুমি নিয়ম ভাঙতে ঘৃণা করো। কিন্তু এবার নিয়ম মানা মানেই ধ্বংস।”
রাতের ঠান্ডা হাওয়া তাদের চারপাশে বইছিল, কিন্তু সেই মুহূর্তে অরুণেশের মনে হচ্ছিল সময় যেন স্থির হয়ে আছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভবিষ্যতের নিজের প্রতিচ্ছবি, যে তাকে এমন এক সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দিচ্ছে যার ফলাফল অনিশ্চিত, কিন্তু বিপদের সম্ভাবনা নিশ্চিত। দ্বিতীয় অরুণেশ ধীরে ধীরে পেছিয়ে গেল, ছায়ায় মিলিয়ে যেতে যেতে বলল, “আমি আর দেখা দেব না। যা করবার, তুমি-ই করবে।” অন্ধকারে একা দাঁড়িয়ে অরুণেশ অনুভব করল, এই সাক্ষাৎ শুধু একটি সতর্কবার্তা নয়—এটি ছিল এক বোঝা, যা এখন তাকে বহন করতে হবে। তার হাতে সময় সীমিত, আর সামনে রয়েছে এমন এক পথ যেখানে ভুলের মূল্য হবে ইতিহাসের ধ্বংস।
নয়
টাইম-পোস্ট সেন্ট্রালের কন্ট্রোল রুমে দাঁড়িয়ে অরুণেশ মনিটরগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল, আর প্রতিটি স্ক্রিনে ভেসে উঠছিল ভিন্ন ভিন্ন টাইমলাইনের দৃশ্য। ২০৭৫ সালের কলকাতার আকাশে হঠাৎই অদ্ভুত আলোর ফাটল দেখা দিল, যা প্রতিটি মিনিটে বড় হতে লাগল। একই সময়ে ২০৬৫ সালের পুরনো সেন্ট্রাল হাবে, কায়া তার পোর্টেবল টাইম-অ্যানালাইজারের সাহায্যে চিহ্নিত করছিল কোন ডেলিভারিগুলো সরাসরি ক্রোনো সিন্ডিকেটের পরিকল্পনার অংশ। তাদের মিশন ছিল—এই চিহ্নিত পার্সেলগুলো পৌঁছানোর আগে থামানো। সমস্যা ছিল, তারা দুজন ভিন্ন সময়ে অবস্থান করলেও প্রতিটি পদক্ষেপ অন্যটির টাইমলাইনে সরাসরি প্রভাব ফেলছিল। অরুণেশ ২০৭৫ সালে একটি ডেলিভারি বাতিল করলেই ২০৬৫ সালের এক ঘটনাপ্রবাহ বদলে যাচ্ছিল, আর কায়া অতীতে কিছু বদলালে বর্তমানের দৃশ্য তৎক্ষণাৎ পরিবর্তিত হচ্ছিল। এটা ছিল এক অদ্ভুত সমান্তরাল যুদ্ধ, যেখানে অস্ত্র ছিল শুধু সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত।
প্রথম বড় পরীক্ষাটি এল তখন, যখন কায়া ২০৬৫ সালের এক পার্সেল চিহ্নিত করল—যেটি পাঠানো হবে এক প্রখ্যাত বিজ্ঞানীর কাছে, যার গবেষণা পরবর্তীতে টাইম-পোস্ট সার্ভিসের মূল স্থাপত্য গড়ে তুলবে। নকশা অনুযায়ী, সিন্ডিকেট চায় এই বিজ্ঞানীর প্রকল্পটি সামান্য পরিবর্তিত হোক, যাতে ১৫ বছর পর টাইম-নেটওয়ার্কে একটি দুর্বলতা তৈরি হয়। কায়া জানাল, যদি পার্সেলটি থামানো হয়, তাহলে বিজ্ঞানীর কাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে, কিন্তু একইসঙ্গে ক্র্যাশের একটি মূল কারণও মুছে যাবে। অরুণেশ দ্বিধায় পড়ে গেল—তারা কি ভবিষ্যত রক্ষার জন্য ইতিহাসের এই স্তম্ভকে ভেঙে দেবে? শেষমেশ কয়েক সেকেন্ডের ভেতরে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, কারণ টাইম-ডেলিভারি ড্রোন ইতিমধ্যেই উড়ে যাচ্ছে। অরুণেশ গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “থামাও।” কায়া তৎক্ষণাৎ কমান্ড পাঠাল, আর স্ক্রিনে দেখা গেল ড্রোনটি মাঝ আকাশে স্থির হয়ে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কিন্তু প্রতিটি সিদ্ধান্তেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিল। ২০৭৫ সালের স্ক্রিনে দেখা গেল—হঠাৎই কয়েকটি রাস্তার নাম বদলে গেছে, কিছু মানুষ যাদের অরুণেশ আগে চিনত, তারা আর নেই, যেন তারা কখনোই জন্মায়নি। কায়া জানাল, টাইমলাইনের ভেতরে ক্ষুদ্র পরিবর্তনগুলো ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়ছে, এবং তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ সেই ঢেউকে বড় করছে। এর মাঝেই আরেকটি সংকেত এল—সিন্ডিকেট তাদের কার্যক্রম টের পেয়েছে। হঠাৎ কন্ট্রোল রুমে লাল সতর্ক সংকেত বাজতে শুরু করল, আর স্ক্রিনে ভেসে উঠল “ইন্টারসেপ্ট ইন প্রগ্রেস”। এর মানে, সিন্ডিকেট সরাসরি ডেলিভারি রুটে প্রবেশ করেছে এবং নিজেদের এজেন্ট পাঠাচ্ছে টাইমলাইনে হস্তক্ষেপ ঠেকাতে। অরুণেশ জানত, যদি তারা একটিও গুরুত্বপূর্ণ পার্সেল ভুল হাতে পড়তে দেয়, তাহলে আগের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে।
চাপ বাড়তে থাকল, কারণ সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছিল। দুই ভিন্ন শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও তারা যেন একই ঘড়ির কাঁটার তাড়ায় দৌড়াচ্ছিল। ২০৭৫ সালে অরুণেশ এক হাতে কনসোল চালাচ্ছিল, আর অন্য হাতে বিশেষ কোডেড কী ব্যবহার করে ডেলিভারি চেইন লক করছিল। ২০৬৫ সালে কায়া পুরনো হাবের রক্ষণাবেক্ষণ টানেল দিয়ে গোপনে ড্রোনগুলোর রুট পরিবর্তন করছিল, যাতে সিন্ডিকেটের লোকেরা তাদের ধরতে না পারে। প্রতিটি বাতিল হওয়া পার্সেলের সঙ্গে সঙ্গে আকাশের সেই আলোর ফাটল কিছুটা সংকুচিত হচ্ছিল, কিন্তু একইসঙ্গে টাইমলাইনগুলো আরও অনির্দিষ্ট হয়ে উঠছিল। শেষ কয়েক মিনিটে তারা একসঙ্গে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ ডেলিভারি থামাতে সক্ষম হল—এবং তখনই আলোর ফাটল হঠাৎ থেমে গেল, যেন সময় কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়েছে। নিঃশ্বাস ফেলার সময় পেল না কেউ, কিন্তু তারা বুঝতে পারল—এখন আর পিছু হটার উপায় নেই, কারণ এই যুদ্ধ তার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
দশ
কন্ট্রোল রুমের বাতাসে তখন এক ধরনের ভারী নীরবতা ঝুলে ছিল, যার মধ্যে কেবল যন্ত্রের হালকা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। অরুণেশ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখল—শেষ ডেলিভারি, সেই অভিশপ্ত পার্সেল, টাইম-চ্যানেলের মাধ্যমে সক্রিয় হতে চলেছে। দ্বিতীয় অরুণেশের সতর্কবার্তা তার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, কিন্তু সে জানত, এবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানে হবে নিজের অস্তিত্বকে শূন্যে মুছে ফেলা। কায়া সংযোগ লাইনে চিৎকার করল, “অরুণ, তুমি যদি এখন এটি থামাও, তাহলে তোমার টাইমস্ট্রিম মুছে যেতে পারে!” কিন্তু অরুণেশ শান্ত স্বরে উত্তর দিল, “কেউ না কেউকে তো করতে হবে, কায়া… নাহলে সব শেষ।” তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত দৃঢ়তা—যেন এই মুহূর্তের জন্যই সে এতদিন বেঁচে ছিল। ধীরে ধীরে সে কনসোলে কোড ইনপুট করল, যার মাধ্যমে পার্সেলটির চ্যানেল স্ব-ধ্বংসের প্রক্রিয়ায় যাবে।
স্ব-ধ্বংসের প্রক্রিয়া শুরু হতেই কন্ট্রোল রুমের আলো একবার ঝলকে উঠল, আর চারপাশে টাইম-এনার্জির ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল। স্ক্রিনে দেখা গেল—পার্সেলটি ধীরে ধীরে সময়ের ভেতর থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে সেই বিকৃতি ও ফাটলও অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একইসঙ্গে, অরুণেশ অনুভব করল তার নিজের শরীরের ভেতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা জন্ম নিচ্ছে, যেন স্মৃতি, অনুভূতি, এবং অস্তিত্বের প্রতিটি সূত্র ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে। তার আঙুল কনসোল থেকে সরে এলো, কিন্তু আর এক মুহূর্তও সে দাঁড়াতে পারল না। হাঁটু ভেঙে মেঝেতে বসে পড়ল, আর চোখে ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে এল। শেষবারের মতো কায়ার কণ্ঠ সে শুনতে পেল—“অরুণ!”—তারপর সব মিলিয়ে গেল।
সবকিছু থেমে গেলে, কায়া ২০৭৫ সালের টাইম-আর্কাইভে দাঁড়িয়ে ছিল। সেন্ট্রাল ডাটাবেসের মূল কক্ষে ঢুকে সে খুঁজতে লাগল অরুণেশের ফাইল। কয়েক মুহূর্ত আগে যেটিতে শত শত মিশনের রেকর্ড, পদকপ্রাপ্তির নথি, আর ছবিতে ভরা ছিল, এখন সেটি কেবল একটি খালি পৃষ্ঠা—শুধু ফাইল নম্বর, নাম, আর বাকিটা সাদা। যেন অরুণেশ ছিলই না, তবু কোনওভাবে তার ছায়া রয়ে গেছে ইতিহাসের প্রান্তে। কায়া ফাইলটি স্পর্শ করল, আর অনুভব করল এক অদ্ভুত শীতলতা, যেন সময়ের গভীরে এখনো কোথাও অরুণেশের অস্তিত্বের ক্ষুদ্র প্রতিধ্বনি ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে বুঝল, এই খালি পৃষ্ঠা কেবল এক রেকর্ড নয়, বরং এক ত্যাগের স্মারক, যা কেউ জানবে না, কেউ স্মরণও করবে না।
আর্কাইভ রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে দেখা যাচ্ছিল, শহর আগের মতোই ব্যস্ত, মানুষ তাদের প্রতিদিনের জীবন কাটাচ্ছে, কেউ জানেই না যে কিছুক্ষণ আগে তাদের ইতিহাস প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। কায়া জানত, অরুণেশ বেঁচে থাকলে এই দৃশ্য দেখে হয়তো একটুখানি হাসত—কারণ তার লড়াই ছিল মানুষের এই স্বাভাবিক জীবনটুকু বাঁচিয়ে রাখার জন্য। সে ধীরে ধীরে জানালা থেকে সরে এসে আর্কাইভ রুমের দরজা বন্ধ করল, আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—যতদিন সে বেঁচে থাকবে, ততদিন অন্তত একজন এই গল্প মনে রাখবে। কায়া জানত, ইতিহাস হয়তো অরুণেশকে ভুলে যাবে, কিন্তু সে ভুলবে না—কারণ সময়ের ডাকপিয়নের আসল চিঠি ছিল এই ত্যাগ, যা কেবল একজন বন্ধুই পড়তে পারে।
সমাপ্ত




