দেবিকা দাশগুপ্ত
১
গ্রামের প্রাচীন মন্দিরটি যেন সময়ের বুক চিরে দাঁড়িয়ে আছে, শত বছরের নীরবতা আর শ্যাওলাধরা দেওয়ালে জমে থাকা ইতিহাস নিয়ে। চারপাশে কেবল বন আর পুরোনো বটগাছের ছায়া, গা ছমছমে নৈঃশব্দ্যকে আরও ঘনীভূত করে তুলেছে। পূর্ণিমার চাঁদ আকাশের মাঝে যেন এক অলৌকিক প্রদীপ, তার রুপালি আলোয় মন্দিরের ভাঙা ইট, পাথরের সিঁড়ি আর ভেতরের শিবলিঙ্গ সব যেন ঝলমল করে উঠেছে। গ্রামের লোকেরা সাধারণত রাতে এখানে আসে না—কারও চোখে ভৌতিক ভয়, কারও মনে অশুভ বিশ্বাস। কিন্তু ঋজু আলাদা। কলকাতায় পড়াশোনা করে ফেরা এই তরুণ কুসংস্কারের ভিড়ে আটকে নেই; তার মধ্যে আছে রহস্য বোঝার এক অদম্য কৌতূহল। সেদিন পূর্ণিমার রাতে হঠাৎই সে টান অনুভব করেছিল—যেন কেউ তাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে মন্দিরের দিকে। ঘরের ভেতর বসে থাকতে তার দমবন্ধ লাগছিল, তাই নিঃশব্দে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে সে মন্দিরের ভাঙা সিঁড়িতে বসে পড়ল। রাতের বাতাস ঠান্ডা, চারপাশে কেবল ঝিঁঝিঁর ডাক, আর দূরে বনের মধ্যে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা। ঋজুর বুকের ভেতর ধুকপুক করছে, কিন্তু ভয় নয়—বরং এক অনির্বচনীয় টান, যা তাকে অদ্ভুত ভাবে শান্তও করছে আবার অস্থিরও করছে।
ঋজু বসে আছে, আকাশের দিকে তাকিয়ে। মেঘহীন আকাশে পূর্ণিমার আলো যেন সবকিছু ভিজিয়ে দিয়েছে। মন্দিরের পুরোনো গম্বুজের ওপর ঝরে পড়া সেই আলোকে দেখে তার মনে হচ্ছিল, কোনো প্রাচীন কাহিনি আবার বেঁচে উঠছে। হঠাৎ করেই সে অনুভব করল—কেউ যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রথমে মনে হলো বোধহয় বিভ্রম, হয়তো বনের অন্ধকারে কোনো প্রাণী নড়াচড়া করছে। কিন্তু পর মুহূর্তেই, আলোয় ধরা পড়ল এক ছায়া। ধীরে ধীরে সেই ছায়া স্পষ্ট হতে শুরু করল—আর দেখা গেল এক তরুণী দাঁড়িয়ে আছে মন্দিরের সিঁড়ির নিচে। ঋজুর নিশ্বাস কেঁপে উঠল। মেয়েটির পরনে সাদা শাড়ি, চুল কোমর অবধি নেমে এসেছে, আর তার চোখে এমন এক গভীর দৃষ্টি, যা চেনা অথচ অচেনা। চাঁদের আলোয় তার গায়ের রং যেন আরও উজ্জ্বল, প্রায় অপার্থিব। আশ্চর্যজনকভাবে, তার পায়ের নিচে কোনো ছায়া পড়ছে না। ঋজু চোখ মুছে আবার তাকাল, কিন্তু না—সে সত্যিই আছে। মাধুরী নামটি পরক্ষণেই তার মনের ভেতর জন্ম নিল, যদিও সে জানত না কে এই মেয়ে। মেয়েটি কোনো শব্দ না করে মৃদু হেসে তাকাল ঋজুর দিকে, আর সেই দৃষ্টিতে এমন এক অদ্ভুত টান ছিল যে ঋজুর বুক কেঁপে উঠল।
মাধুরীর উপস্থিতি যেন হাওয়ার মতো—অদৃশ্য অথচ স্পষ্ট। ঋজু প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মেয়েটির মুখের সেই শান্ত হাসি আর চোখের অপার্থিব দীপ্তি তাকে আশ্চর্যভাবে সাহসী করে তুলল। চারপাশে নৈঃশব্দ্য, শুধু চাঁদের আলো আর দুজন মানুষের নিঃশ্বাস। ঋজু ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, কিন্তু তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল, কথা বের হচ্ছিল না। মাধুরী এক পা এক পা করে এগিয়ে এল, যেন বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসছে। তার হাঁটার শব্দ নেই, মাটির ধুলো উড়ছে না, কেবল মনে হচ্ছে মাটি স্পর্শ না করেই সে এগোচ্ছে। হঠাৎ সে থেমে গেল ঋজুর কয়েক হাত দূরে, আর তার ঠোঁট নড়ল—কিন্তু শব্দ হলো না। ঋজু ভীত-শঙ্কিত গলায় বলল, “তুমি… কে?” মাধুরী আবার মৃদু হেসে তার চোখের দিকে তাকাল, আর সেই দৃষ্টিতে ঋজুর বুকের সব ভয় মিলিয়ে গেল। মনে হলো, এই মেয়ে তাকে অনেকদিন ধরে চেনে, হয়তো তার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু ঋজুর মনে প্রশ্ন জাগল—গ্রামের কেউ তো এমন মেয়ের কথা কখনও বলেনি, তবে সে কে? সত্যিই কি মাংস-মজ্জার মানুষ, নাকি পূর্ণিমার আলোয় জন্ম নেওয়া কোনো অন্য জগতের সত্তা? উত্তর না পেয়ে ঋজুর ভেতরে কেবল জমতে থাকল আরও রহস্য, আর মন্দিরের চারপাশের নীরবতা যেন সেই রহস্যকেই আরও গাঢ় করে তুলল। পূর্ণিমার সেই প্রথম রাতে, মাধুরীর আবির্ভাব ঋজুর জীবনে এমন এক অধ্যায়ের সূচনা করল, যা তার সব বিশ্বাস, অনুভূতি আর বাস্তবতার সীমারেখাকে ভেঙে দেবে।
২
ঋজু দাঁড়িয়ে আছে নিস্তব্ধ মন্দিরের সামনে, পূর্ণিমার রুপালি আলোয় তার চোখ ভরে উঠছে বিস্ময়ে। মাধুরী তখনও সেই মায়াময় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, যেন সময়ের গতি তার জন্য আলাদা। দুজনের মাঝে এমন এক নীরবতা জমে উঠেছিল, যা শব্দের থেকেও গভীর। অবশেষে ঋজু সাহস করে এগিয়ে গেল কয়েক পা, বুকের ভেতর অনিয়মিত ধুকপুকানি আর কণ্ঠ শুকনো। “তুমি কে?”—গলাটা কেঁপে উঠল, তবু প্রশ্নটা বেরিয়ে এল। মাধুরী হালকা করে মুখ তুলল, চুলের আড়াল থেকে তার দীপ্ত চোখ জ্বলে উঠল, আর সেই দৃষ্টিতে অদ্ভুত এক শান্তি। সে মৃদু স্বরে বলল, “আমার নাম মাধুরী।” তার কণ্ঠে এমন এক সুর ছিল যা মানুষের হলেও অতিপ্রাকৃত মনে হয়—যেন দূরের বাঁশির সুর, যা হাওয়া বেয়ে ভেসে আসে। ঋজু ভেবেছিল, হয়তো গ্রামের নতুন কেউ, কিন্তু তার পোশাক, ভঙ্গি, এমনকি চোখের ভেতরের সেই অচেনা গভীরতা বোঝাচ্ছিল—এই মেয়েটি সাধারণ নয়। সে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি এখানে কেন? এর আগে তো কখনও দেখিনি তোমাকে।” মাধুরী কেবল মৃদু হাসল, ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত স্থিরতা, তারপর ধীরে বলল, “আমাকে দেখা যায় না প্রতিদিন। আমি আসি কেবল পূর্ণিমার রাতে।” কথাগুলো শোনামাত্র ঋজুর শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল, বুকের ভেতর শিহরণ বয়ে গেল। পূর্ণিমার রাত মানেই রহস্য, আর এই মেয়েটির অস্তিত্ব যেন সেই রহস্যের শরীরী রূপ।
ঋজু স্থির চোখে তাকিয়ে রইল মাধুরীর দিকে, মনে হচ্ছিল পৃথিবীর আর সবকিছু অদৃশ্য হয়ে গেছে—শুধু এই মেয়ে আর তার কথাই এখন বাস্তব। “শুধু পূর্ণিমার রাতে?”—সে নিজের অজান্তেই ফিসফিস করে প্রশ্ন করল। মাধুরী মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, তার চোখে এক ধরনের অদ্ভুত দুঃখ খেলে গেল, যেন কোনো গভীর ব্যথা লুকিয়ে আছে। “হ্যাঁ, এই রাতেই আমার মুক্তি হয়, আর এই রাতেই আমি মানুষ হয়ে উঠতে পারি কিছু সময়ের জন্য।” ঋজু হকচকিয়ে গেল, “তুমি কি বলছ! তুমি… মানুষ নও?” প্রশ্নটা বেরোতেই হঠাৎ চারপাশের বাতাস যেন আরও ভারী হয়ে উঠল, মন্দিরের ভাঙা দেওয়াল আর বটগাছের ছায়া যেন নিঃশব্দে শুনছিল তাদের কথা। মাধুরী শান্ত গলায় বলল, “আমি এই গ্রামেরই মানুষ ছিলাম, অনেককাল আগে। আমার গল্প হয়তো কেউ আর মনে রাখেনি, কিন্তু আমার আত্মা বেঁচে আছে এই মন্দিরে। পূর্ণিমার রাতে চাঁদের আলোয় আমি রূপ পাই, কিন্তু দিনের আলোয় আমি অদৃশ্য হয়ে যাই।” কথাগুলো ঋজুর কানে ঢুকল, কিন্তু মস্তিষ্ক মেনে নিতে চাইছিল না। এমন হতে পারে? তবু মেয়েটির চোখ, তার কণ্ঠ, তার চারপাশের অদ্ভুত মায়া সবকিছু যেন ঋজুকে বিশ্বাস করাতে বাধ্য করল। ভেতরে বিজ্ঞানী মন চিৎকার করছিল—এ বিভ্রম, এ কল্পনা—কিন্তু হৃদয় মেনে নিচ্ছিল, এ সত্য।
দীর্ঘ সময় তারা দুজন শুধু নীরবে তাকিয়ে রইল একে অপরের দিকে। ঋজু বুঝতে পারছিল, তার ভেতরের ভয় ধীরে ধীরে কৌতূহল আর টান হয়ে উঠছে। এই মেয়েটির মধ্যে এমন কিছু আছে, যা তাকে শুধু আকর্ষণ করছে না, বরং অদৃশ্য এক বন্ধনে জড়িয়ে ফেলছে। সে ধীরে বলল, “তুমি চাইলে আমি তোমার কথা বিশ্বাস করব। কিন্তু বলো, কেন তুমি এভাবে আটকে আছ? তোমার মুক্তি নেই?” মাধুরীর ঠোঁটে এক বিষণ্ণ হাসি ফুটে উঠল। “মুক্তি…” সে থেমে গেল, যেন শব্দটাই খুব ভারী। “আমার মুক্তি জড়ানো এই মন্দিরের সঙ্গে। আমি চাইলে মিলিয়ে যেতে পারতাম চিরতরে, কিন্তু কোনো অজানা কারণে আমি এখনও বাঁধা এখানে। হয়তো কোনো অসম্পূর্ণ গল্প, হয়তো কোনো অপূর্ণ স্বপ্ন।” তার চোখে সেই মুহূর্তে এমন এক গভীর শূন্যতা ফুটে উঠল, যা ঋজুর বুক কাঁপিয়ে দিল। সে এগিয়ে এল কয়েক কদম, কিন্তু মাধুরী হালকা করে হাত তুলে ইঙ্গিত দিল থামতে। “তুমি কাছে আসতে পারবে না, ঋজু। আমার জগত আলাদা, তোমার জগত আলাদা। তবুও আজ রাতে তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ—হয়তো এইও কোনো অদৃশ্য ইশারা।” ঋজুর ভেতরে অদ্ভুত আবেগ জমল—ভয়, আকর্ষণ, বিস্ময়, আর অকারণ ভালোবাসার এক অঙ্কুরোদ্গম। সে জানল, এই মেয়ে বাস্তব হোক বা অলৌকিক, তার জীবন আর আগের মতো থাকবে না। পূর্ণিমার আলোয় ভেসে থাকা মন্দির আর মাধুরীর ছায়া ঋজুর ভেতরে এমন এক অমোঘ প্রশ্ন রেখে গেল, যার উত্তর পেতে তাকে আরও গভীরে নামতে হবে এই রহস্যের আঁধারে।
৩
পরদিন সকালে গ্রামের বাতাসে যেন অন্যরকম এক অস্থিরতা ভেসে বেড়াচ্ছিল। ভোরের কুয়াশা সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষজন উঠোনে বসে আড্ডা জমিয়েছে, কারও হাতে কাঁচা চা, কারও হাতে হুঁকো। ঋজুর নাম তখন প্রায় সবার মুখে। বলা হচ্ছিল—গতরাতে নাকি তাকে কেউ দেখেছে মন্দিরের সিঁড়িতে বসে এক মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, গ্রামের কারও কাছেই সেই মেয়েটির অস্তিত্ব জানা নেই। “মেয়েটা কে?”—এই প্রশ্ন ছড়িয়ে পড়েছিল প্রতিটি উঠোনে, প্রতিটি দোকানে। অনেকে বলল, ঋজু শহরে পড়ে এসে মাথা খারাপ করেছে, ভৌতিক বিভ্রমে ভুগছে। কেউ কেউ আবার ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, এ নিশ্চয়ই মন্দিরের অশরীরীর ছায়া, যা ঋজুর সামনে রূপ নিয়েছে। বৃদ্ধারা গম্ভীর মুখে মনে করিয়ে দিল বহু পুরনো কাহিনি—যে এই মন্দিরের সঙ্গে একটি মেয়ের অকালমৃত্যুর ছাপ রয়ে গেছে, আর পূর্ণিমার রাতে তার আত্মা প্রকাশ পায়। ছোটরা ভয়ে বড়দের গা ঘেঁষে দাঁড়াল, আর মাঝবয়সীরা নিছক কৌতূহল মেটাতে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। দিন যত এগোল, গুজব তত বেড়ে উঠল, আর ঋজুর নাম হয়ে উঠল গ্রামের প্রতিটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
ঋজু অবশ্য কারও সঙ্গে এ নিয়ে কিছু বলতে চাইছিল না। সে জানত, যদি সত্যিটা বলে—মাধুরীর নাম উচ্চারণ করে, কিংবা সেই কথোপকথনের কথা প্রকাশ করে—তাহলে সবাই আরও বেশি ভয় পাবে, আর হয়তো তাকে পাগল বা ভৌতিক আসক্ত বলে দাগিয়ে দেবে। তাই সে চুপ রইল, শুধু মনে মনে বারবার রাতের সেই মুহূর্তগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে লাগল। মাধুরীর চোখ, তার শান্ত কণ্ঠ, সেই অদ্ভুত সত্যি-অসত্যির মাঝামাঝি উপস্থিতি—সব যেন তার মনের ভেতরে মায়াজাল বুনে ফেলেছিল। কিন্তু একইসঙ্গে তার ভেতরে জন্ম নিল এক নতুন কৌতূহল। সত্যিই কি মাধুরী শুধু পূর্ণিমার রাতেই আসে? আর কেন সে এই মন্দিরে বাঁধা? তার অতীতটা কী? এই প্রশ্নগুলো ঋজুকে শান্ত থাকতে দিল না। দিনের বেলায়ও তার চোখ চলে যেত মন্দিরের দিকে, যেন দিনের আলোয়ও সে কিছু খুঁজে পাবে। গ্রামের লোকেরা যখন তার পিছনে ফিসফিস করছিল, হাসছিল বা ভয়ে নাম জপছিল, ঋজু তখন ভেতরে ভেতরে আরও বেশি একাগ্র হয়ে উঠছিল সত্যিটা জানার জন্য।
গুজবের ভিড়ে কিছু মানুষ ঋজুর প্রতি সহানুভূতিও দেখাল। কেউ কেউ বলল, হয়তো সে নিঃসঙ্গ, তাই এমন কল্পনার জগতে হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের স্কুলের শিক্ষক মৃদু গলায় পরামর্শ দিলেন—“তুমি হয়তো বই বেশি পড়ছ, শহরের ভাবনা মাথায় চেপেছে। সব ভুলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরো।” কিন্তু ঋজু জানত, এটা কল্পনা নয়। সেই রাতের প্রতিটি মুহূর্ত বাস্তব ছিল, মাধুরীর উপস্থিতি বাস্তব ছিল, যদিও সবাই তা অস্বীকার করছে। মন্দিরের পুরনো পূজারিও একদিন তাকে ডাকলেন। ধূসর দাড়ি, চোখে রহস্যময় দৃষ্টি—তিনি বললেন, “বাবা, যা দেখেছ, তা নিয়ে বাইরে বেশি বলিস না। মানুষ ভয় পাবে, তুই বিপদে পড়বি। তবে মনে রাখিস, এই মন্দিরে অনেক কিছু চাপা আছে, যা চোখে দেখা যায় না।” কথাগুলো ঋজুর কৌতূহল আরও বাড়িয়ে দিল। সে বুঝতে পারল, গুজব, ভয় আর অজ্ঞতার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক অজানা সত্য, যা কেবল সে-ই দেখতে পেয়েছে। আর সেই সত্য জানার টানই তাকে টেনে নিয়ে যাবে আরও গভীরে, যেখানে মাধুরীর রহস্যময় পরিচয় লুকিয়ে আছে।
৪
পূর্ণিমার রাতের সেই অদ্ভুত সাক্ষাতের পর থেকে ঋজুর মন এক অদ্ভুত টানে ভরে উঠল। দিনের বেলায় যখন সে গ্রামের লোকদের ফিসফিসানি শুনত, তখন মনে মনে শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরত—মাধুরী কে? আর রাতে, মন্দিরের পথ ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় তার বুক ধকধক করত—আজ কি আবার দেখা হবে? এক রাতে, আকাশে চাঁদ উঠতেই ঋজু আবার মন্দিরে চলে গেল। চারপাশ নীরব, কেবল বাতাসের হালকা দোলায় বটগাছের পাতা সরে সরে শব্দ করছিল। মন্দিরের সিঁড়িতে বসে ঋজু দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করল। হঠাৎ যেন রুপালি কুয়াশার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল মাধুরী। আগের মতোই তার চোখে গভীরতা, মুখে শান্ত হাসি। কিন্তু সেদিন ঋজুর মনে এক অদ্ভুত কৌতূহল জাগল—সে লক্ষ্য করতে লাগল মেয়েটির চারপাশ। চাঁদের আলো এত উজ্জ্বল, কিন্তু মাধুরীর শরীরের পাশে কোনো ছায়া পড়ছে না। ঋজু প্রথমে ভেবেছিল, হয়তো চোখের ভুল। কিন্তু বারবার দৃষ্টি মাটির দিকে ফেরাতে গিয়ে সে বুঝল, না—মাধুরীর ছায়া নেই। বরং চারপাশের সবকিছুর ছায়া পড়ছে, বটগাছের, ভাঙা গম্বুজের, এমনকি তার নিজের ছায়া স্পষ্ট, কিন্তু মেয়েটি যেন আলো-অন্ধকারের নিয়ম মানে না।
ঋজু শিউরে উঠল। বুকের ভেতর ভয় চেপে ধরল, কিন্তু মাধুরীর শান্ত দৃষ্টি সেই ভয়কে আবার কোমল করে দিল। সে যেন বুঝতে পারল ঋজুর ভাবনা। মৃদু স্বরে বলল, “ভয় পেয়ো না। আমি এভাবেই আছি। আমি আলোতে জন্মাই, কিন্তু ছায়া আমার নেই।” ঋজুর ভেতরে দ্বন্দ্ব শুরু হলো—একদিকে বাস্তবতার নিয়মে বিশ্বাস, অন্যদিকে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই অলৌকিক সত্য। আরও অদ্ভুত ব্যাপার হলো, মাধুরী যখন চলতে শুরু করল, তার পায়ের শব্দ শোনা গেল না। শুকনো পাতার ওপর হাঁটলেও একটুও শব্দ হলো না, যেন সে বাতাসকে ভেদ করে ভেসে চলছে। ঋজু বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। মাধুরী মাঝে মাঝে থেমে তার দিকে তাকাত, আর সেই দৃষ্টিতে ঋজু অনুভব করল অদ্ভুত এক টান, যা ভয়কে ভেঙে ভালোবাসায় রূপান্তরিত করছে। তবুও তার ভেতরে প্রশ্ন জমল—এ কেমন সত্তা, যে আলোতে আছে কিন্তু ছায়াহীন, যে পৃথিবীতে হাঁটে কিন্তু পায়ের শব্দ শোনায় না? আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়—মাঝেমধ্যে হঠাৎ করেই সে মিলিয়ে যায়, যেন কুয়াশায় ভেসে অদৃশ্য হয়ে গেছে। একবার এমনই ঘটল; ঋজু কথা বলছিল, হঠাৎই মাধুরী কোথায় গেল বোঝাই গেল না। চারপাশে কেবল ফাঁকা সিঁড়ি আর ঠান্ডা বাতাস। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার সে ফিরে এল, যেন কিছুই হয়নি।
ঋজুর বুক কেঁপে উঠলেও মাধুরীর প্রতি তার টান কমল না, বরং বেড়ে গেল বহুগুণ। সে অনুভব করল, এই মেয়ে তাকে ভয় দেখাতে নয়, বরং অজানা এক জগতে টেনে নিয়ে যেতে এসেছে। তার ভেতরে জন্ম নিল এক সিদ্ধান্ত—যে করেই হোক মাধুরীর রহস্য সে জানবে। হয়তো মেয়েটি মানুষ নয়, হয়তো সে অলৌকিক কোনো অস্তিত্ব, কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি, তার হাসি, তার অদৃশ্য উপস্থিতি ঋজুর মনে এক অদ্ভুত প্রেমের বীজ বুনে দিয়েছে। গ্রামে যেভাবেই ফিসফিসানি ছড়াক না কেন, ঋজু জানত সে মাধুরীকে আর এড়িয়ে যেতে পারবে না। বরং এই রহস্যময় ছায়াহীন সত্তার টান তাকে প্রতিটি পূর্ণিমার রাতে মন্দিরের পথে টেনে নিয়ে যাবে। সেই রাতের পর ঋজুর মনে স্থির হলো—ভয় আর সংশয় নয়, এবার সে মাধুরীর অতীত খুঁজবে, তার অস্তিত্বের রহস্য ভেদ করবে। কারণ এই ছায়াহীন মেয়েটি শুধুই ভূতের গল্প নয়, সে ঋজুর জীবনে প্রবল সত্য হয়ে উঠছে।
৫
প্রথমে ঋজু কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না, এমন কাহিনি আসলে আদৌ বাস্তব হতে পারে কিনা। সে একরকম সন্দেহ নিয়েই বৃদ্ধ পূজারির কাছে গিয়েছিল, যিনি বহু বছর ধরে মন্দিরের সেবায় নিয়োজিত। পূজারির চোখ ছিল কুয়াশাচ্ছন্ন, বয়সের ভারে ক্লান্ত হলেও দৃষ্টি যেন অতীতের দিকে সবসময় ফিরে থাকে। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বাবা, এই মন্দিরে যা ঘটেছিল, তা শুধু এক ইতিহাস নয়—এ যেন গ্রামের আত্মার মধ্যে গেঁথে যাওয়া ক্ষত।” পূজারি ধীরে ধীরে বললেন, বহু বছর আগে, জমিদারী আমলে, গ্রামের মন্দিরে এক তরুণীকে বলি দেওয়া হয়েছিল। জমিদারের লোভ আর কুসংস্কারের ফলেই এই বিভীষিকা নেমে এসেছিল। তরুণীর নাম ছিল মাধুরী, এক সাধারণ কৃষকের মেয়ে। গ্রামজুড়ে তার সৌন্দর্যের খ্যাতি ছিল, আর সেই সৌন্দর্যের জন্যই জমিদারের নজর পড়ে তার উপর। কিন্তু মাধুরী কখনও জমিদারের প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি, বরং সরল জীবনে সন্তুষ্ট থাকতে চেয়েছিল। জমিদার এ অপমান সইতে পারেননি। গ্রামের লোকদের মধ্যে ভয় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন—গ্রামের শান্তি আনতে দেবীকে মানব বলি দিতে হবে। আর সেই বলির পাঁঠা হয়ে ওঠে মাধুরী। পূর্ণিমার রাতে গ্রামের সকলের সামনে, মন্দিরের গর্ভগৃহে সেই নিষ্ঠুর বলি সম্পন্ন হয়েছিল। কেউ প্রতিবাদ করেনি, সবাই আতঙ্কে চুপ করে গিয়েছিল। বৃদ্ধ পূজারি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “সেই রাতের পর থেকে মন্দিরে আর শান্তি নেই। মাধুরীর আত্মা নাকি বন্দি হয়ে আছে এই জায়গায়। তাই তো পূর্ণিমার রাতে মন্দিরে তার ছায়া, তার উপস্থিতি অনুভব করা যায়।” ঋজুর বুকের ভেতর ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। এতদিন ধরে যে মেয়েটির সাথে সে কথা বলছে, যার প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করছে, সে আসলে সেই আত্মা—এক বলির শিকার আত্মা, যে আজও মুক্তি পায়নি।
ঋজুর মাথায় ঘূর্ণির মতো সবকিছু ঘুরছিল। হঠাৎ তার মনে পড়ল সেই সব অদ্ভুত মুহূর্ত—মাধুরীর ছায়া কখনও না পড়া, তার পায়ের শব্দ না হওয়া, হঠাৎ মিলিয়ে যাওয়া—সবই যেন সত্যের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছিল। ঋজু বুঝতে পারছিল, সে এক ভূতের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে, অথচ তার হৃদয়ে এক অদ্ভুত টান জন্ম নিয়েছে। সে এই সত্য মেনে নিতে চাইছিল না, কিন্তু মনে হচ্ছিল মাধুরীর আত্মা শুধু একটি কিংবদন্তি নয়, বরং তার জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। পূজারির কথা শুনে গ্রামে গুজব আরও বেড়ে গেল। লোকজন বলাবলি করতে লাগল, ঋজু নাকি অভিশপ্ত হয়ে গেছে, কারণ সে মাধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করছে। অনেকেই তাকে সতর্ক করে বলল, “ওর কাছ থেকে দূরে থাকো, নইলে তোর সর্বনাশ হবে।” কিন্তু ঋজুর কৌতূহল ভয়কে হার মানাল। তার মনে হলো, মাধুরী যদি সত্যিই আত্মা হয়, তবে সে নিশ্চয়ই কোনো কারণেই বারবার তার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। হয়তো মুক্তি চায়, হয়তো কোনো কথা বলতে চায়। গ্রামজুড়ে যখন ভয়ের বাতাবরণ, তখনও ঋজুর হৃদয় কেমন করে যেন মাধুরীর কাছে পৌঁছতে চাইছিল। সেই রাতে বাড়ি ফিরে শুয়ে পড়লেও ঘুম আসেনি। জানলার বাইরে তাকিয়ে ঋজু হঠাৎ দেখল, মন্দিরের দিক থেকে যেন হালকা নীলচে আলো বের হচ্ছে। বাতাস ভারী হয়ে উঠল, গ্রামের কুকুরেরা হঠাৎ একসাথে চিৎকার করে উঠল। ঋজুর মনে হলো, যেন মাধুরী তাকে ডাকছে। সেই টান অদ্ভুতভাবে প্রবল হয়ে উঠল। তার মনে হচ্ছিল, গ্রামের ইতিহাস, ভয় আর মিথ সব মিলে এই মন্দিরেই যেন লুকিয়ে আছে এক অনন্ত রহস্য।
পরদিন সকালে ঋজু আবার পূজারির কাছে গিয়ে জানতে চাইল, “কোনও উপায় নেই কি? মাধুরীর আত্মা কি কখনও মুক্তি পেতে পারে না?” বৃদ্ধ পূজারি ক্লান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বাবা, আত্মা মুক্তি পায় যখন তার অসমাপ্ত বাসনা পূর্ণ হয়, কিংবা যখন তার দুঃখের ভার ঘুচে যায়। মাধুরীর আত্মা আজও পূর্ণিমার রাতে উপস্থিত হয় কারণ তার আত্মা শান্তি খুঁজে পায়নি। হয়তো কেউ তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হয়েছে। হয়তো তার প্রেম অপূর্ণ থেকে গেছে।” ঋজুর মনে অদ্ভুত একটা শক্তি সঞ্চারিত হলো। সে ভাবল, হয়তো মাধুরী তাকে বেছে নিয়েছে তার অসমাপ্ত কাহিনি বলার জন্য। হয়তো তাকে-ই বেছে নেওয়া হয়েছে সত্য জানার, আর হয়তো মুক্তি দেওয়ার জন্য। ঋজু নিজেকে এক অদ্ভুত দায়িত্বের ভারে আবদ্ধ অনুভব করল। ভয়ের পাশাপাশি তার ভেতরে জন্ম নিল এক দৃঢ় সংকল্প। সে জানল, গ্রামের এই অভিশপ্ত ইতিহাসের সত্যিটা উন্মোচন করা দরকার। মাধুরী হয়তো তার সঙ্গেই কথা বলছে কারণ ঋজুই সেই মানুষ, যে অতীতের অন্ধকার সরিয়ে সত্যের আলো আনতে পারবে। মন্দিরের গোপন কাহিনি ঋজুর জীবনের গতিপথ পাল্টে দিল। সে বুঝতে পারল, তার এই যাত্রা শুধু এক রহস্য উন্মোচন নয়—এটা হয়তো এক আত্মার মুক্তির লড়াই, আর একইসাথে নিজের ভেতরের ভয়ের মুখোমুখি হওয়ার এক অদ্ভুত সাধনা।
৬
মাধুরীর স্বীকারোক্তি ঋজুর ভেতর যেন বজ্রাঘাতের মতো আঘাত করে। চারপাশের বাতাস মুহূর্তে থমকে যায়, মন্দিরের পুরোনো ইটের ফাঁক দিয়ে উঠে আসা শ্যাওলার গন্ধও যেন স্থির হয়ে যায়, আর দপদপে প্রদীপের আলো তার মুখের অবয়বকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, ঋজুর দিকে তাকিয়ে, কিন্তু তার দৃষ্টিতে এক অদ্ভুত অস্থিরতা—ভালোবাসা, অপরাধবোধ আর অমোঘ নিয়তির ছায়া যেন মিশে আছে। ধীরে ধীরে মাধুরী বলে ওঠে, “ঋজু, তুমি আমাকে মানুষ ভেবেছ, কিন্তু আমি কেবল এই মন্দিরের এক বন্দি আত্মা। একসময় আমি ছিলাম এই গ্রামেরই এক সাধারণ মেয়ে, আমারও স্বপ্ন ছিল, হাসি-কান্না ছিল, ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা ছিল। কিন্তু এক রাতে, পূর্ণিমার আকাশের নিচে, আমাকে বলি দেওয়া হয় এই দেবীর উদ্দেশ্যে। তখন থেকে আমার শরীর মাটির নিচে মিশে গেলেও, আমার আত্মা বাঁধা রয়ে গেছে এই মন্দিরের গায়ে, এই পুরোনো পাথরের মাঝে।” তার কণ্ঠে কোনো রাগ নেই, কোনো প্রতিশোধস্পৃহা নেই—কেবল গভীর এক শূন্যতা, যেন দীর্ঘকাল ধরে নীরব থেকে জমে থাকা কথা আজ অবশেষে ফেটে বেরিয়ে আসছে। ঋজু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে, তার গলা শুকিয়ে যায়, হাতের তালু ভিজে ওঠে অজানা উত্তেজনায়, সে ভাবতেই পারে না এই মেয়েটি, যার প্রতি তার হৃদয় অজান্তেই আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল, সে আসলে জীবিত কোনো মানুষ নয়। কিন্তু মাধুরীর চোখে জল চিকচিক করে ওঠে, যেন আত্মার গভীর থেকে তার যন্ত্রণা এখনও জেগে আছে।
ঋজু এগিয়ে এসে আস্তে করে তার হাত ধরতে চায়, অথচ স্পর্শ করতেই সে টের পায়—হাতটা ঠান্ডা, প্রাণহীন, যেন কুয়াশার মতো ভেসে ওঠা কোনো অস্তিত্ব। মাধুরী মৃদু হেসে বলে, “তুমি আমার হাত ধরতে পারো, কিন্তু তা তোমাকে উষ্ণতা দেবে না। আমি জানি তোমার চোখে আমি মেয়ে হয়েছি, তুমি আমাকে মানুষ হিসেবে দেখছ, কিন্তু আমার শরীর নেই—শুধু এক অদৃশ্য শৃঙ্খলে বাঁধা প্রাণ।” ঋজুর ভেতর থেকে যেন হাজার প্রশ্ন একসাথে জেগে ওঠে—কেন এই মন্দির তার আত্মাকে ছাড়ছে না, কেন পূর্ণিমার রাতে সে দৃশ্যমান হয়, আর কেন তার ভালোবাসা এতটা মানবিক অথচ এতটাই নিষ্ফল? সে মাধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে, “তবু আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আত্মা হও বা মানুষ, আমার কাছে তুমি মাধুরী। তোমার হাসি, তোমার চাহনি, তোমার নীরবতা—সবকিছু আমার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে।” মাধুরীর চোখ ভিজে ওঠে, সে ফিসফিস করে বলে, “ঋজু, এটাই আমার ভয়। তুমি আমাকে ভালোবেসেছ, কিন্তু আমি তো মুক্তি পাইনি। এই মন্দির, এই অভিশাপ, এই শিকল—এসবের ভেতর আমি আটকে আছি। তুমি আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না, আমার সঙ্গে পথ চলতে পারবে না, আমার পাশে বসে জীবনের সুখ-দুঃখ ভাগ করতে পারবে না। তবু আমি মানুষকে ভুলে যেতে পারিনি। তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে আবার সেই পুরোনো অনুভূতি জেগে উঠেছে, আমি আবার কাঁপতে শিখেছি, হাসতে শিখেছি, ভালোবাসতে শিখেছি।” তার কণ্ঠে এমন এক বেদনা, যা ঋজুকে ভেতর থেকে টেনে নিয়ে যায়।
মাধুরী ধীরে ধীরে তার চোখ নামিয়ে নেয়, যেন নিজের অপরাধ স্বীকার করছে। “ঋজু, আমি জানি আমাদের সম্পর্ক অসম্ভব। আমি যদি মুক্তি না পাই, তবে তোমাকে আমি কখনোই পুরোপুরি আমার করতে পারব না। আমি তোমাকে ভালোবাসি, কিন্তু আমার ভালোবাসা তোমার জন্য শাপ হয়ে দাঁড়াবে। হয়তো তুমি আমার কাছে এসে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে, হয়তো তুমি গ্রামের অন্যদের মতো আতঙ্কে পালিয়ে যাবে। তবু আজ বলতে চাই—আমি তোমাকে ভালোবাসি, সত্যিই ভালোবাসি, তোমাকে ছাড়া এই অসীম শূন্যতায় আমার কোনো অস্তিত্ব নেই।” তার চোখের জল তখন মাটির ওপর ফোঁটা ফোঁটা পড়ে, অথচ আশ্চর্যের বিষয়, মাটি ভিজে ওঠে না। ঋজু গভীর শ্বাস নেয়, তার মনে হয় পৃথিবীর সব যুক্তি, সব নিয়ম যেন মাধুরীর সামনে এসে ভেঙে পড়ছে। সে মাধুরীর মুখ দু’হাতে ধরতে চায়, কিন্তু তার হাত আবারও কেবল শূন্যতা স্পর্শ করে। তবু সে থেমে যায় না, বরং দৃঢ় কণ্ঠে বলে, “অসম্ভব বলে কিছু নেই। তুমি যদি আত্মা হও, তবে আমি সেই আত্মার সঙ্গেই বাঁচব। তুমি যদি বাঁধা থাকো, তবে আমি চেষ্টা করব তোমাকে মুক্ত করার। তুমি আমাকে যাই বলো না কেন, আমার কাছে তুমি কেবল মাধুরী—যে আমাকে ভালোবাসে, আর যাকে আমি ভালোবাসি।” এই কথাগুলো শুনে মাধুরীর চোখে এক অদ্ভুত আলো জ্বলে ওঠে—আলো, যা ছিল না তার অস্তিত্বে, কিন্তু যা এক মুহূর্তে ঋজুকে বিশ্বাস করায়, ভালোবাসা হয়তো মৃত্যুকেও অতিক্রম করতে পারে। আর সেই রাত, মন্দিরের নীরবতায়, দুটি আত্মা—একটি দেহহীন, একটি জীবন্ত—তাদের ভালোবাসার প্রথম সত্য স্বীকারোক্তি উচ্চারণ করে, যদিও তারা দুজনেই জানে সামনে অপেক্ষা করছে এক ভয়ঙ্কর অজানা নিয়তি।
৭
ঋজুর মনে তখন এক অদ্ভুত ঝড় বয়ে চলেছে। দিন যত যাচ্ছে, মাধুরীর অস্তিত্ব ততই তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, অথচ আশেপাশের মানুষের কাছে তা নিছকই ভ্রম বা কল্পনার গল্প। গ্রামের লোকেরা যখন মন্দিরের পুরনো কাহিনি বলে, তাদের চোখে আতঙ্ক ও সন্দেহ একইসঙ্গে ভেসে ওঠে। ঋজু ভাবতে থাকে—যদি মাধুরী সত্যিই তার কল্পনার সৃষ্টি হয়, তবে এতবার তার সাথে কথোপকথন, সেই গভীর দৃষ্টি, সেই মায়ায় ভরা স্পর্শ কেমন করে সম্ভব? নিজের সত্যি প্রমাণ করার জন্য একরকম দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নিল সে। বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে বলল, “পূর্ণিমার রাতে মন্দিরে চল। আমি তোমাদের চোখের সামনে মাধুরীকে দেখাব।” বন্ধুরা প্রথমে ভয়ে পিছিয়ে গেলেও শেষে কৌতূহল তাদের জয় করল। তারা মনে করল, হয়তো ঋজু চাপা অস্থিরতার শিকার, আর তাকে বোঝানোর জন্য একবার মন্দিরে যাওয়াই ভালো। পূর্ণিমার রাতে মন্দিরকে ঘিরে অস্বাভাবিক নীরবতা নেমে আসে। চারপাশে শাল-সেগুনের বন যেন কোনো অদৃশ্য শক্তির নিঃশ্বাসে কেঁপে উঠছে। গ্রামের লোকজন দূরে থাকতেই পছন্দ করে, কারণ তারা বিশ্বাস করে এই রাতে মন্দির অভিশপ্ত হয়ে ওঠে। অথচ ঋজু অদ্ভুত দৃঢ়তায় মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল, পিছনে কয়েকজন সন্ত্রস্ত বন্ধু তার সঙ্গে।
মন্দিরের ভেতর ঢুকতেই বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠল, মশালের আলো কাঁপতে কাঁপতে দেয়ালের ভাঙা প্রতিমার ছায়া ফেলে দিচ্ছিল। একসময় সবাই গা ছমছমে নিস্তব্ধতায় দাঁড়িয়ে থাকে। ঋজু ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে মাধুরীর নাম ধরে ডাকল—তার কণ্ঠে এক ধরনের আকুলতা আর দৃঢ়তা মিলেমিশে প্রতিধ্বনি তুলল। কয়েক মুহূর্ত পরেই চারপাশে ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করল, যেন মন্দিরের ভেতরকার শূন্যতা জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ঋজুর চোখ খুলতেই সে দেখল—মাধুরী সাদা শাড়ি পরে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তার মুখে দুঃখ মেশানো কোমল হাসি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ঋজুর চারপাশে থাকা বন্ধুরা কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। তারা আতঙ্কিত চোখে শুধু ঋজুকে চেয়ে দেখছে, যে শূন্যের দিকে হাত বাড়িয়ে কারও সাথে কথা বলছে। ঋজু বলল, “দেখো, ও এখানে! আমি বলেছিলাম, মাধুরী সত্যি আছে।” কিন্তু বন্ধুদের চোখে তখন শুধু শূন্যতা। তাদের একেকজন মনে করল—ঋজুর মাথা পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে গেছে। কেউ কেউ ভয়ে পিছিয়ে যেতে শুরু করল, কেউ আবার তাকে টেনে নিতে চাইল। কিন্তু ঋজু ততক্ষণে মাধুরীর উপস্থিতিতে মগ্ন হয়ে গেছে। তার চোখে জল, কণ্ঠে কাঁপা উত্তেজনা। মাধুরী এগিয়ে এসে ধীরে বলল, “ঋজু, তারা আমাকে দেখতে পারবে না। আমি কেবল তোমার কাছে ধরা দিই। আমি চাইতেও পারি না যে সবাই আমাকে বিশ্বাস করুক।”
ঋজুর বন্ধুদের ধৈর্য তখন ফুরিয়ে গেছে। তারা বাইরে বেরিয়ে গিয়ে জোরে বলতে লাগল, “ঋজু পাগল হয়ে গেছে। ওর মাথায় ভুতের ভ্রম ঢুকে গেছে।” কিন্তু ঋজু জানে, সে পাগল নয়। সে বুঝতে পারে—মাধুরীর অস্তিত্ব আর পাঁচজনের চোখে প্রমাণ করা হয়তো সম্ভব নয়, কারণ তাদের জগৎ ভিন্ন, আর মাধুরী বাঁধা অন্য এক অদৃশ্য জগতে। অথচ এই অদ্ভুত সত্যিই তার হৃদয়কে নাড়িয়ে দেয়। যে মানুষটিকে সে অনুভব করছে, যাকে সে ভালোবেসে ফেলেছে, তার অস্তিত্ব অস্বীকার করলে নিজের জীবনের মানেই হারিয়ে যাবে। মাধুরীর চোখে গভীর অনুরোধ—“আমাকে প্রমাণ করতে যেও না, ঋজু। বিশ্বাস আর অনুভবের ওপরই আমাদের বন্ধন টিকে আছে। ভয়কে জয় করো, কিন্তু অকারণ লড়াই কোরো না।” রাত গভীর হয়, বন্ধুরা ঋজুকে টেনে নিয়ে যায়, কিন্তু তার মনের ভেতর তখন এক নতুন লড়াই শুরু হয়েছে। সমাজ তাকে অবিশ্বাস করবে, বন্ধুরা তাকে কটুকথা বলবে, তবু ঋজু জানে—যা সে দেখেছে, তা মিথ্যে নয়। এই পরীক্ষাই তাকে বুঝিয়ে দিল, ভালোবাসা কেবল দৃশ্যমান প্রমাণের ওপর নির্ভর করে না, বরং বিশ্বাসের গভীরতায় টিকে থাকে। আর সেই বিশ্বাসের জন্য ঋজু সামনে আসা প্রতিটি ভয়কে মোকাবিলা করতে প্রস্তুত।
৮
ঋজুর মনে এক অস্থিরতা জমে উঠেছিল। এতদিন ধরে সে মাধুরীর উপস্থিতিকে অনুভব করেছে, তাকে দেখেছে, তার সাথে কথা বলেছে, এমনকি তার হাসি-কান্না সবকিছুই নিজের জীবনের অংশ করে নিয়েছে। কিন্তু সেই অনুভূতির আড়ালে যে এক অদ্ভুত রহস্য লুকিয়ে আছে, তা সে ক্রমশ বুঝতে শুরু করেছিল। মন্দিরের পুরোহিতের পুরনো পুঁথি ঘেঁটে সে জানতে পারে, শতাব্দী আগে এক নারীর রক্ত পড়েছিল এক বিশেষ কালো পাথরের ওপর, আর সেই রক্তেই তার আত্মা ওই পাথরের গর্ভে বন্দি হয়ে যায়। সেই নারীই মাধুরী, যার শরীর নেই, অথচ ভালোবাসা আছে; যার মুক্তি নেই, অথচ মায়া আছে। ঋজু বুঝতে পারে—যে শক্তি তাকে মাধুরীর সাথে মিলিয়ে দিয়েছে, সেই শক্তিই তাকে বন্দি করে রেখেছে। পুঁথির প্রতিটি শব্দ যেন তার হৃদয়ে আঘাত করছিল—“যে আত্মা রক্তের বন্ধনে বাঁধা থাকে, তার মুক্তির পথ হলো সেই বন্ধন ছিন্ন করা।” কিন্তু এর মানে দাঁড়ায়, যদি সেই কালো পাথর ভেঙে দেওয়া যায়, তবে মাধুরী মুক্তি পাবে, আর মুক্তি মানেই তার চিরবিদায়। ঋজুর মন তখন দুই খণ্ডে বিভক্ত—একদিকে সে চায় মাধুরী বেঁচে থাকুক, অন্তত আত্মারূপে তার পাশে থাকুক; অন্যদিকে সে চায় মাধুরীকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে সত্যিকারের শান্তি দিতে। কিন্তু মুক্তি মানে তার নিজের জীবনে এক গভীর শূন্যতা, যে শূন্যতা কোনোদিন পূরণ হবে না।
ঋজুর মনে তুমুল দ্বন্দ্ব চলছিল। মাধুরীর সাথে যখন সে একা কথা বলে, তখন তার চোখের গভীর আকুতি তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দেয়। মাধুরী জানে, তার ভালোবাসা অসম্পূর্ণ; সে চায় না ঋজু তার জন্য কষ্ট পাক। তবু, মাধুরীর চোখে এক অদ্ভুত দ্বিধা দেখা যায়—সে মুক্তি পেতে চায়, কিন্তু ঋজুকে ছেড়ে যেতে ভয় পায়। ঋজু তাকে বলে, “তুমি কি সত্যিই মুক্তি চাও, মাধুরী?” মাধুরী চুপ করে থাকে, শুধু তার ঠোঁটে এক ব্যথাতুর হাসি খেলে যায়। চারপাশের অন্ধকার মন্দির যেন তখন এক অদ্ভুত নীরবতায় ঢেকে যায়, বাতাস থেমে যায়, আর শ্বেতপাথরের মূর্তিগুলোও যেন শ্বাসরোধ করে তাকিয়ে থাকে। ঋজু বুঝতে পারে—মাধুরী আসলে ঋজুর সাথে জড়িয়ে পড়েছে, এই অসম্ভব সম্পর্কের বাঁধন ছিঁড়তে পারছে না। অথচ সে জানে, যতদিন না সেই পাথর ভাঙা হচ্ছে, ততদিন তার আত্মা বন্দি থাকবে, আর এই বন্দিত্ব ধীরে ধীরে তাকে অদৃশ্য যন্ত্রণায় শেষ করে দেবে। ঋজুর বুকের ভেতরে তখন এক দহন শুরু হয়—সে কি নিজের স্বার্থে মাধুরীকে বেঁধে রাখবে, না কি ভালোবাসার প্রকৃত অর্থ বুঝে তাকে মুক্তি দেবে? সেই মুহূর্তে তার মনে পড়ে যায় এক পুরনো গল্প—ভালোবাসা মানেই অধিকার নয়, বরং ত্যাগ। কিন্তু এই ত্যাগের ব্যথা সে কীভাবে সহ্য করবে?
রাত বাড়তে থাকে, মন্দিরে পূর্ণিমার আলো ঢুকে পড়ে, আর সেই আলোয় কালো পাথরটা ভেসে ওঠে রহস্যময় আভায়। ঋজু এগিয়ে গিয়ে হাত রাখে সেই পাথরের ওপর। ঠান্ডা, রুক্ষ স্পর্শে তার সারা শরীরে কাঁপুনি ধরে যায়, আর তার ভেতর থেকে ভেসে আসে মাধুরীর নিঃশব্দ কান্না। যেন সেই পাথরের ভেতর থেকে মাধুরীর আত্মা চিৎকার করছে—“মুক্তি দাও আমাকে।” ঋজুর চোখ ভিজে যায়, সে ফিসফিস করে বলে, “আমি তোমাকে হারাতে চাই না… কিন্তু তোমাকে বেঁধেও রাখতে পারি না।” তার হাত শক্ত করে ধরে, যেন সংকল্পে ভর করে আছে। সে জানে, যদি পাথরটা ভাঙতে চায়, তবে তাকে প্রচণ্ড সাহস জোগাড় করতে হবে—কারণ মাধুরীকে মুক্তি দেওয়া মানেই নিজের হৃদয়কে ছিন্ন করা। দূরে শোনা যায় মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি, রাতের পাখির ডাক, আর বাতাসে বয়ে যায় এক অদ্ভুত শীতলতা। ঋজুর মনে তখন কেবল একটাই প্রশ্ন—সে কি ভালোবাসার বন্ধন ধরে রাখবে, না কি সেই বন্ধন ভেঙে সত্যিকারের ভালোবাসার পথ দেখাবে? উত্তরটা সে জানে না, কিন্তু মনে হচ্ছে সময় খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে, যখন তাকে এক চরম সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর সেই সিদ্ধান্তই বদলে দেবে তার আর মাধুরীর নিয়তি—চিরতরে।
৯
পূর্ণিমার আলোয় ভেসে ওঠা রাতটি যেন আকাশের শূন্যতায় ঝুলে থাকা এক অন্তহীন দ্বন্দ্বের সাক্ষী হয়ে দাঁড়ায়। ঋজুর বুকের ভেতরে সেই দ্বন্দ্ব কেবল যুক্তির নয়, গভীর এক অনুভূতির, যেখানে প্রেমের টান ও করুণার দাবি পরস্পরের সঙ্গে লড়াই করছে। সে জানে—মাধুরীর আত্মা এই পৃথিবীতে আবদ্ধ হয়ে আছে অদৃশ্য শিকলে, পাথরের গর্ভে পড়ে থাকা রক্তের টানে। মুক্তি মানেই তাকে শূন্যে বিলীন করে দেওয়া, তাকে পরম অদৃশ্যে পাঠিয়ে দেওয়া। কিন্তু একইসঙ্গে এটাও সত্য, যে এই পৃথিবীর প্রতিটি দিন তার জন্য যন্ত্রণা, প্রতিটি রাত অবিরাম বন্দিত্ব। মাধুরী হয়তো তার পাশে আছে, কিন্তু সেই পাশে থাকা শুধু এক অর্ধেক, এক কেবল ছায়ার মতো—সে হাসতে পারে না, কাঁদতে পারে না, ছুঁতে পারে না। ঋজু এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারে না, অথচ মেনে নিতেও পারে না। রাত যত গভীর হয়, তার ভেতরের অস্থিরতা তত ঘনিয়ে ওঠে। মাধুরীর মুখ মনে পড়তেই বুকের ভেতরে ঢেউ খেলে যায়—সে যদি সত্যিই মুক্তি পায়, তবে কি আর কখনও দেখা দেবে না? পূর্ণিমার আলোয় এই প্রশ্নের উত্তর যেন তার চারপাশের নীরবতায় লুকিয়ে থাকে, আর সে খুঁজে চলে সেই অজানা উত্তর।
ঋজু জানালার পাশে বসে আছে, বাইরে খোলা আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ দীপ্ত হয়ে জ্বলছে। বাতাসে হালকা ঠান্ডা, আর দূরের নদীর ঢেউয়ের শব্দ যেন সময়কে ধীর করে দিয়েছে। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে মাধুরীর অশ্রুভরা মুখ, যেটি সে দেখেছিল সেদিন মন্দিরে। বন্ধুরা তখন তাকে পাগল বলেছিল, বিভ্রমে ভুগছে বলেছিল, কিন্তু সে জানে—তার চোখের সেই দৃষ্টি কেবল তার কল্পনা নয়। সেই দৃষ্টির ভেতরে ছিল মুক্তির আকুতি, আর সেই আকুতির ভেতরে ছিল অনন্ত ভালোবাসা। মাধুরী তাকে কখনও বলেনি যে সে যেতে চায়, কিন্তু তার চোখের নীরবতা সব বলে দিয়েছে। ঋজু মনে করে, ভালোবাসা কি তবে শুধু পাওয়া নয়, দেওয়ার মধ্যেও আছে তার সত্য? যদি সত্যিই ভালোবাসে, তবে কি তাকে মুক্তি দিতে হবে? তার ভেতরে এক ঝড় বইতে থাকে—প্রেম তাকে টেনে রাখে, করুণা তাকে ঠেলে দেয় ছেড়ে দিতে। মুহূর্তের পর মুহূর্ত গড়িয়ে যায়, চাঁদের আলো যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, আর প্রতিটি মুহূর্তে সেই টানাপোড়েন আরও গভীর হচ্ছে।
শেষরাতের নীরবতা যখন মাটির গায়ে ছড়িয়ে পড়ে, ঋজু বুঝতে পারে—এই সিদ্ধান্তের ভার থেকে সে পালাতে পারবে না। তার সামনে দুটো পথ—একটিতে রয়েছে নিজের সুখ, যেখানে মাধুরী চিরকাল তার পাশে থেকেও ছুঁতে পারবে না; আরেকটিতে রয়েছে মাধুরীর মুক্তি, যেখানে সে থাকবে না, থাকবে শুধু স্মৃতি। আকাশে ঝলমল করা পূর্ণিমার আলো যেন তাকে উত্তর দিতে চাইছে—মুক্তি না দিলে ভালোবাসা কখনও পূর্ণ হয় না। কিন্তু তার ভেতরে আবারও প্রেমের টান জেগে ওঠে—যদি মুক্তি দিয়েই মাধুরী হারিয়ে যায়, তবে সে কীভাবে বাঁচবে? তার হৃদয় যেন ভেঙে দু’টুকরো হয়ে যায়। ভোরের আগের অন্ধকারে বসে ঋজু একরাশ চোখের জল মুছে নেয়, আর নিঃশব্দে মাধুরীর নাম উচ্চারণ করে। সে জানে, যে রাত তার ভেতরের এই দ্বন্দ্বের সাক্ষী হয়ে আছে, এই রাতই হয়তো শেষ রাত, যেখানে সে তাকে নিজের কাছে ধরে রাখতে পারবে, কিংবা ছেড়ে দিয়ে অনন্তের হাতে তুলে দেবে। সেই রাতের নিঃসঙ্গতায় ঋজু বুঝতে পারে—প্রেম মানেই কখনও কখনও বিদায় বেছে নেওয়া।
১০
পূর্ণিমার রাত, শালবনের নিস্তব্ধতায় দাঁড়িয়ে থাকা ঋজুর সামনে যেন সময় থেমে গেছে। চারপাশের গাছপালার ডালপালা হাওয়ায় দুললেও সেই সুর ধরা পড়ছে না তার কানে; শুধু কানে বাজছে মাধুরীর কণ্ঠের প্রতিধ্বনি, সেই কণ্ঠ যা তাকে এতদিন পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে এই অন্ধকার রহস্যের ভেতর। মন্দিরের শিলাস্তম্ভে খোদাই করা পুরোনো শাপের ইতিহাস মনে করিয়ে দেয় তাকে, কত শতাব্দী ধরে মাধুরী এই বন্দিত্বের যন্ত্রণা বয়ে চলেছে। কিন্তু এখন আর সময় নেই দ্বিধার—প্রেম আর করুণার টানাপোড়েনের পরিণতি নিতে হবে আজ রাতেই। তার হাতে ধরা ভারী লোহার হাতুড়ি যেন আগুনের মতো গরম হয়ে আছে; সে জানে একবার আঘাত করলেই এই পাথরের আবরণ ভেঙে যাবে, মুক্তি পাবে মাধুরীর আত্মা। অথচ মুক্তি মানেই বিচ্ছেদ, মানেই নিঃসঙ্গতার অন্ধকারে ফিরে যাওয়া। তার বুকের ভেতর ঢেউ খেলে যায়, শ্বাসপ্রশ্বাস ভারী হয়ে ওঠে, যেন পৃথিবীর সমস্ত আকাশ ভেঙে পড়েছে তার বুকে। দূরে পূর্ণিমার চাঁদ মন্দিরের শিলায় রূপালি আলো ফেলেছে, সেই আলোয় মাধুরীর অবয়ব ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠল—তার চোখে জল, ঠোঁটে এক অচেনা অথচ আপন হাসি। ঋজুর চোখ ভিজে উঠল মুহূর্তেই, সে বুঝল—এই মুহূর্তেই তাদের প্রেমের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা।
ঋজু হাত তুলতেই শীতল বাতাস বয়ে গেল, যেন প্রকৃতিও তাকে সতর্ক করে দিল—এ আঘাতের পর আর কিছু আগের মতো থাকবে না। মাধুরী তার দিকে হাত বাড়ালেন, তার চোখে ছিল এক নিঃশব্দ অনুরোধ, “আমায় মুক্তি দাও, ঋজু।” সেই দৃষ্টি ভেদ করে যেন শিরদাঁড়া বেয়ে কেঁপে উঠল ঋজুর শরীর, কিন্তু প্রেমের কাছে হার মানল সব দ্বিধা। এক আঘাত, আরেক আঘাত—প্রতিটি আঘাতের সঙ্গে শিলায় ফেটে উঠল বজ্রের মতো শব্দ। চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠল, মন্দিরের ভেতর প্রতিধ্বনি তুলল শত বছরের জমে থাকা অভিশাপ। পাথরের আস্তরণ ভাঙতেই আলো ছড়িয়ে পড়ল, সেই আলো এতটাই তীব্র যে ঋজু হাত দিয়ে চোখ ঢাকতে বাধ্য হল। আলো মিলিয়ে গেলে সে দেখল—মাধুরী ধীরে ধীরে দূরত্বে মিলিয়ে যাচ্ছেন। তার শাড়ির আঁচল বাতাসে ভেসে উঠল, যেন চন্দ্রালোকের আলোয় গড়া এক স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে। তার চোখে ছিল জলকণা, কিন্তু সেই জলকণার আড়ালে ঝিলমিল করছিল শান্তির দীপ্তি। ঠোঁটে অদ্ভুত এক হাসি—যা যেন কৃতজ্ঞতায় ভরা, আবার বেদনারও শেষ প্রতিধ্বনি। ঋজুর হাত কাঁপছিল, বুকের ভেতর চিৎকার আটকে যাচ্ছিল, কিন্তু সে কিছু বলতে পারল না। কেবল দাঁড়িয়ে রইল, নিঃশব্দে অনুভব করল কীভাবে তার ভালোবাসার মানুষটি রাতের আকাশের আলোয় বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
সব শেষ হয়ে গেলে নিস্তব্ধতা নেমে এল শালবনে। শুধু আকাশে রূপালি চাঁদ জ্বলজ্বল করে রইল, যেন সাক্ষী থেকে গেল এই অসমাপ্ত প্রেমের। ঋজু দাঁড়িয়ে রইল একা, চারপাশে শুধু নীরবতা আর ম্লান আলো। তার মনে হলো—মাধুরী চলে গেলেও তিনি রয়ে গেছেন তার হৃদয়ের অন্তরে, চন্দ্রালোকের প্রতিটি আলোছায়ায়। হয়তো এই অসম্পূর্ণতাই তাদের প্রেমকে চিরন্তন করে রাখবে, হয়তো এই বেদনার ছায়াতেই জন্ম নেবে এক অমর স্মৃতি। পূর্ণিমার রাত সেই সাক্ষাৎকে রূপান্তর করল বিদায়ে, অথচ সেই বিদায়ও এক অদ্ভুত আশীর্বাদের মতো ঋজুর বুক ভরিয়ে দিল। সে অনুভব করল—যতদিন সে বাঁচবে, আকাশে যখনই পূর্ণিমার আলো ঝরে পড়বে, তখনই মাধুরীর মায়াভরা হাসি ফিরে আসবে তার কাছে। সে জানল, ভালোবাসা কখনও সত্যিই হারিয়ে যায় না, কেবল আড়ালে চলে যায়—চন্দ্রালোকের আড়ালে, যেখানে অনন্তকাল ধরে বেঁচে থাকে অসমাপ্ত প্রেমের প্রতিটি নিঃশ্বাস।
-শেষ-