অরুণাভ চক্রবর্তী
১
গঙ্গার ধারে বরানগরের শ্মশানঘাট যেন সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক এলাকা। এখানে নদীর জল যেন অন্য রকম ছন্দে বয়ে চলে—দিনে আলো আর নৌকার কোলাহলে ভরা হলেও রাত নামলেই চারপাশে এমন এক নীরবতা নেমে আসে, যা মানুষের বুকের ভেতর কেমন একটা শূন্যতা তৈরি করে দেয়। পুরনো, বিশাল এক বটগাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক শ্মশানের পাশে, যার শিকড়গুলো মাটির ভেতর থেকে উঠে এসে কুণ্ডলী পাকিয়ে গিয়েছে, যেন মৃত মানুষের হাড়গোড় নদীর বাতাসে দুলছে। গাছের গায়ে শত বছরের শ্যাওলা, পেছনে নদীর কালো জলে পূর্ণিমা বা অমাবস্যার চাঁদের প্রতিফলন, আর দূরে জ্বলতে থাকা চিতার আগুনের লাল আভা—সব মিলিয়ে এক ভৌতিক চিত্রকল্প। রাত যত গভীর হয়, শ্মশানের দিক থেকে আসে কাঠ ফাটার শব্দ, হালকা ধোঁয়ার গন্ধ, আর মাঝে মাঝে গঙ্গার ঢেউয়ের সঙ্গে মিলেমিশে ভেসে আসে অদ্ভুত এক বাঁশির সুর। গ্রামে গুঞ্জন, এই সুর বাজায় কেউ জীবিত নয়—বরং বহু বছর আগে মারা যাওয়া এক সানাইওয়ালা, যে মৃত্যুর পরও তার শেষ অসমাপ্ত সুর বাজিয়ে যেতে চায়।
এই ভৌতিক কাহিনি নিয়েই গল্প করেন রজনী পাল, যিনি শ্মশানঘাটের কাছেই একটি ছোট চায়ের দোকান চালান। রজনী ষাট ছুঁইছুঁই বয়সের এক চটপটে মানুষ, গায়ে মাটির রঙ, মাথায় পাতলা সাদা চুল, কপালে সবসময় হাসি লেগে থাকে। কিন্তু বাঁশির গল্প বলতে শুরু করলেই তাঁর চোখের কোণে ভেসে ওঠে গম্ভীরতা। সেদিনও এমনই এক শীতল সন্ধ্যায়, গঙ্গার ধারে কুয়াশা নামতে শুরু করেছে, তিনি দোকানে নতুন গ্রাহক বিনু সরকারকে এক কাপ চা দিয়ে বসলেন কথা বলতে। বিনু শহরের ছেলে, কলেজে ইতিহাস পড়ছে, তবে লোককথা আর গ্রামীণ কুসংস্কারের প্রতি তার কৌতূহল বরাবরের। সে গবেষণার জন্য বরানগরে এসেছে, আর প্রথম দিনেই এই রহস্যময় বাঁশির গল্প শুনে যেন কিছুটা হতবাক। রজনী ধীরে ধীরে বললেন—“তুমি কি গোপাল হালদারের নাম শুনেছো? উনি ছিলেন এই এলাকার সেরা সানাইওয়ালা। এমন সুর তুলতেন যে, বিয়ে হোক বা পূজা—গোপালদা থাকলে সবাই অন্য সুরকারদের ভুলে যেত। কিন্তু একদিন হঠাৎ তাঁর জীবন থেমে যায়, আর তারপর থেকে শুরু হয় এই অদ্ভুত কাণ্ড।” দোকানের বাইরে তখন নদীর হাওয়া বয়ে যাচ্ছে, দূরে কোথাও কুকুর ডাকছে, আর বিনুর মনে অজানা এক শিহরণ খেলে যাচ্ছে।
গোপাল হালদারের গল্প শোনাতে শোনাতে রজনী যেন অতীতের ভেতর ঢুকে গেলেন। তিনি বললেন, গোপাল ছিলেন একদম সাধারণ মানুষ, সারাজীবন সানাই বাজিয়ে কাটিয়েছেন। গলায় সবসময় গামছা, হাতে পুরনো বাদামী রঙের সানাই, আর চোখে এক ধরনের অন্যমনস্কতা। জীবনের শেষ দিকে নাকি তিনি একটা নতুন সুর বানাচ্ছিলেন—একেবারে আলাদা, যেন গঙ্গার ঢেউ আর শরতের আকাশের মেঘ একসঙ্গে মিশে গেছে তাতে। কিন্তু সেই সুর আর শেষ করা হয়নি। পূজার আগের রাতে, নদীর ধারে শ্মশানঘাটের কাছাকাছি কোথাও বাজাতে বাজাতে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে নিয়ে গেলেও আর ফেরানো যায়নি। এরপর থেকেই গ্রামবাসীরা দাবি করে, ভোরের আগে সেই বটগাছের পাশে তাঁর সানাইয়ের অসমাপ্ত সুর ভেসে আসে। কেউ বলে, এটা আত্মার আর্তি—‘আমার সুর শেষ করো।’ কেউ আবার বলে, এটা গোপালের ভালোবাসা—জীবন তাকে থামিয়ে দিলেও, সুরকে থামাতে পারেনি। বিনু চুপচাপ শুনতে শুনতে বুঝতে পারল, এই কাহিনি কেবল একটা লোককথা নয়—এখানে লুকিয়ে আছে সময়, মৃত্যু, আর সঙ্গীতের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন, যা তাকে টেনে নিয়ে যাবে এই রহস্যের গভীরে।
২
গোপাল হালদারের জীবনের শুরু ছিল বরানগরেরই এক সাধারণ ঘরে, যেখানে সকালবেলা মাটির উঠোনে মা ধূপ জ্বালাতেন, আর বাবা মাটির কাজ করতেন। গোপালের বাবা একসময় মেলায় বাঁশি বাজাতেন, কিন্তু সংসারের চাপে সেই শখ ছেড়ে দিয়ে হাড়ভাঙা খাটুনির পেশায় ঢুকে পড়েছিলেন। গোপাল ছোট থেকেই বাবার বাঁশির সুরে মুগ্ধ ছিল। আট-নয় বছর বয়সে বাবার পুরনো সানাই হাতে পায়, যার বাঁশের গায়ে সময়ের দাগ স্পষ্ট। প্রথমে খেলাচ্ছলে, পরে ভোরবেলা গঙ্গার ধারে বসে নিজে নিজে সুর তোলা শুরু করে। গ্রামের পুরনো সানাইওয়ালা হরিবাবু তার প্রতিভা দেখে নিজেই শেখাতে শুরু করেন। হরিবাবুর হাতে গোপালের সুরের তালিম চলতে থাকে বছর পাঁচেক, আর ততদিনে গ্রামের বিয়ে, নামকরণ, পূজা—সব অনুষ্ঠানে গোপালের ডাক পড়তে শুরু করে। সানাই বাজানোর সময় তার চোখ বন্ধ থাকত, যেন সে অন্য এক জগতে চলে গেছে। গোপালের বাজানো সুরের মধ্যে ছিল নদীর ঢেউয়ের গতি, বাতাসের মৃদু দোলা, আর মানুষের হৃদয়ের গভীরতম অনুভূতি। বরানগর ছাড়িয়ে পাশের গ্রাম, এমনকি শহর পর্যন্ত গোপালের নাম পৌঁছে যায়।
কিন্তু জীবনের সব সুরই যে মধুর হয় না, তা গোপাল খুব ভালো করেই জানত। সানাই হাতে যার জীবন এত সুরেলা, তার ব্যক্তিগত জীবন ছিল একের পর এক করুণ শোকের কাহিনি। তরুণ বয়সে বিয়ে হয়েছিল ললিতা নামে এক মিষ্টি-স্বভাবের মেয়ের সঙ্গে। সংসারে সুখ ফিরেছিল, আর সেই সুখের পরিপূর্ণতা আসে যখন তাদের একমাত্র ছেলে, রতন, জন্ম নেয়। রতন ছিল গোপালের চোখের মণি—অল্প বয়সেই বাবার সানাই হাতে নিয়ে খেলত। কিন্তু সুখের সেই সুর হঠাৎ করেই থেমে যায়। প্রথমে ললিতা অসুস্থ হয়ে পড়ে—দীর্ঘদিন ভুগে এক বর্ষার রাতে সে চলে যায়। গোপালের বুকের ভেতর যেন কেউ ছুরি বসিয়ে দেয়, কিন্তু রতনের জন্য বেঁচে থাকা জরুরি ছিল। কয়েক বছরের মধ্যেই আরও বড় আঘাত আসে—বারো বছরের রতন জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে মারা যায়। সেই দিন গোপাল সানাই হাতে নিয়ে বসেছিল, কিন্তু একটিও সুর তুলতে পারেনি। জীবনের সুর যেন ফিকে হয়ে গিয়েছিল, তবু জীবিকার তাগিদে বাজানো ছাড়তে পারেনি। রাতের পর রাত সে গঙ্গার ধারে বসে নিজের সঙ্গে কথা বলত, নতুন সুর বানানোর চেষ্টা করত, যেন সুরের ভেতরেই নিজের শূন্যতাকে ঢেকে দিতে পারবে।
তার মৃত্যুর আগের দিন ছিল বরানগরের বড় পূজা—গঙ্গার ধারে মণ্ডপ, আলো, মানুষের ভিড়। গোপালকে ডাকা হয়েছিল সানাই বাজানোর জন্য। সেই সন্ধ্যায় সে মঞ্চে উঠে এমন এক নতুন সুর বাজানো শুরু করে, যা আগে কেউ শোনেনি। প্রথম অংশে ছিল হালকা আনন্দের ছোঁয়া, যেন শিউলির গন্ধ ভেসে আসছে, তারপর ধীরে ধীরে সুর নেমে যায় গভীর বিষণ্ণতায়, যেন শরতের আকাশে হঠাৎ মেঘ জমে গেছে। সবাই চুপ করে শুনছিল, কিন্তু হঠাৎ গোপাল বাজানো থামিয়ে দেয়—তার চোখে এক অদ্ভুত দূরের দৃষ্টি। দর্শকেরা ভেবেছিল সে হয়তো বিরতি নিচ্ছে, কিন্তু গোপাল সানাই নামিয়ে রেখে আস্তে আস্তে মঞ্চ থেকে নেমে যায়। কিছুক্ষণ পরে তাকে নদীর ধারে, বটগাছের পাশে বসে থাকতে দেখা যায়—সানাই হাঁটুর উপর রাখা, চোখ বন্ধ, ঠোঁটে এক রহস্যময় হাসি। সেই রাতেই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে, হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তার শেষ হয়ে যায়। পূজার ভিড়ে কেউ ভাবতেও পারেনি, সেই অসমাপ্ত সুরই হয়ে উঠবে এক অদ্ভুত রহস্যের সূত্র, যা মৃত্যুর পরও গঙ্গার ধারে বয়ে যাবে—ভোরের আগে, কুয়াশার মধ্যে, পুরনো বটগাছের নিচে।
৩
বরানগরের গঙ্গার ধারের সেই ছোট্ট চায়ের দোকান যেন সন্ধ্যার আড্ডার আখড়া। রজনী পালের দোকানে বসে আজও কয়েকজন মিলে গল্প জমিয়েছে—মেঘলা বিকেল, গঙ্গার হাওয়ায় কুয়াশার আভাস, আর টিনের কাপের ভেতর ধোঁয়া ওঠা চা। বিনু সেই দিনও চুপচাপ এক কোণে বসে শুনছিল, কিন্তু আজ আলোচনার কেন্দ্রে এসে পড়েছে গোপাল হালদারের বাঁশির গল্প। নন্দু মিস্ত্রি, যিনি গায়ে-গতরে পাতলা হলেও মুখে সবসময় চোঙা, সবার সামনে বলছে, “আমি নিজের কান দিয়ে শুনেছি রে! ভোরের আগে, ঠিক বটগাছের পাশে দাঁড়িয়ে বাঁশির সুর… একেবারে গোপালদার বাজানোর মতোই। প্রথমে ভেবেছিলাম, কেউ হয়তো রিহার্সাল করছে, কিন্তু কাছে যেতেই সুর থেমে গেল।” নন্দুর কথায় শিবু দাসও সায় দেয়। সে তো শ্মশানের কাঠ জোগান দেয়, তাই রাতের বেলায় সেখানে যাওয়া তার পক্ষে নতুন কিছু নয়। শিবুর গলা নিচু হয়ে যায়, “সুর থামলেই কেমন যেন হাওয়া ঠান্ডা হয়ে গেল, আর হাওয়ার মধ্যে যেন একটা দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল।” দোকানের অন্য গ্রাহকেরা একে অপরের দিকে তাকায়, কেউ অবিশ্বাসের হাসি হেসে ফেলে, কেউ আবার শিউরে ওঠে। বিনু কৌতূহলী হয়ে শোনে, কিন্তু মুখে কিছু বলে না—তার মনে এখন প্রশ্ন জমতে শুরু করেছে।
সেই সন্ধ্যাতেই বিনুর সঙ্গে কথা বলেন গ্রামের কয়েকজন বয়স্ক মানুষ, যাদের চোখ-মুখে গম্ভীরতা স্পষ্ট। তারা সবাই এককথায় বিনুকে সাবধান করে দেয়, “রাতের বেলায় শ্মশানের দিকে যেও না বাবা। ওখানে শুধু গোপালের বাঁশি নয়, আরও কত কিছু আছে, যা মানুষের চোখে দেখা ঠিক নয়।” একজন বৃদ্ধ, যিনি নিজেকে গোপালের দূর সম্পর্কের আত্মীয় বলে দাবি করেন, গল্প শোনান—কীভাবে এক যুবক একসময় কৌতূহলবশত ভোরের আগে শ্মশানঘাটে গিয়ে ফিরে এসেছিল অসুস্থ হয়ে, আর কয়েকদিনের মধ্যে মারা যায়। যদিও গল্পে সত্যি-মিথ্যে মিশে আছে, কিন্তু যারা শুনছে তাদের চোখে ভয়ের ছায়া স্পষ্ট। রজনী পালও বিনুকে বলে, “তুমি শহরের ছেলে, এসব কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেবে জানি, কিন্তু আমরা এখানে বড় হয়েছি—এই গঙ্গা, এই বটগাছ, এই শ্মশান—সব কিছুরই একটা আলাদা জগত আছে, যা সবসময় মানুষের বোঝার মধ্যে পড়ে না।” চায়ের দোকানের বাইরে তখন রাত নেমে গেছে, নদীর ওপর দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া বইছে, আর দূরে কোথাও ভেসে আসছে এক অচেনা সুরের মতো বাতাসের ফিসফিসানি।
সবাই তাকে সতর্ক করলেও বিনুর মনে ভয় নয়, বরং অদ্ভুত এক টান তৈরি হয়। তার গবেষণার স্বভাবটাই এমন—যা মানুষ এড়িয়ে চলে, সে সেদিকেই যায়। গোপাল হালদারের বাঁশির রহস্য যেন তাকে নিজের দিকে টেনে নিচ্ছে। সে ভাবে, যদি সত্যিই এই সুর মৃতের আত্মা বাজায়, তবে তা প্রমাণ করাই হবে তার জীবনের সেরা আবিষ্কার; আর যদি মিথ্যে হয়, তবে কুসংস্কারের জাল ভেঙে দেওয়া যাবে। সেই রাতে নিজের নোটবুকে সে কয়েকটি প্রশ্ন লিখে রাখে—“গোপালের অসমাপ্ত সুরের নোটেশন কি কারও কাছে আছে? ভোরের আগে বাঁশির সুর কতক্ষণ বাজে? কেন শুধু বটগাছের কাছাকাছি গিয়েই সুর থেমে যায়?” নোটবুক বন্ধ করেও তার মাথায় ঘুরপাক খায় বটগাছের শিকড়, নদীর কুয়াশা, আর দূরের সেই শীতল সুর। মনে মনে সে ঠিক করে ফেলে, একদিন ভোরের আগে, একদম একা, সে যাবে শ্মশানঘাটের সেই বটগাছের নিচে—যেখান থেকে রহস্যের স্রোত বইছে, আর যার শেষ প্রান্তে হয়তো অপেক্ষা করছে সত্য, অথবা ভয়।
৪
চাঁদহীন অন্ধকার রাত। বরানগরের গঙ্গার ধারে হালকা কুয়াশা নেমে এসেছে, দূরে শ্মশানঘাটের আগুনের ম্লান আভা কেবল মাঝে মাঝে ভেসে উঠছে। বিনু ও নন্দু মিস্ত্রি হাতে টর্চ নিয়ে ধীরে ধীরে নদীর ধার ঘেঁষে হাঁটছে। চারপাশে অদ্ভুত নীরবতা, কেবল গঙ্গার ঢেউয়ের শব্দ আর মাঝেমধ্যে দূরে কুকুরের হুক্কাহুয়া। নন্দুর মুখে সাহসের চিহ্ন দেখা গেলেও তার চোখের দৃষ্টি বারবার চারপাশে ঘুরছে, যেন অদৃশ্য কিছু তাদের অনুসরণ করছে। তারা যত এগোয়, বটগাছের কালো অবয়ব তত স্পষ্ট হয়—শিকড়গুলো যেন মৃত মানুষের হাড়ের মতো মাটির উপর ছড়িয়ে আছে। বিনুর বুকের ভেতর কৌতূহল আর উত্তেজনা জমতে থাকে, কিন্তু নন্দুর কণ্ঠে কাঁপুনি, “এই… ওইদিকে গেলেই সুর শোনা যাবে। কিন্তু বলি কি, তুমি থাকো, আমি একটু দোকানের দিকে যাই… চা খেয়ে আসি।” বিনু অবাক হয়ে কিছু বলার আগেই নন্দু পেছন ফিরে প্রায় দৌড়ে চলে গেল, টর্চের আলো মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
বিনু এবার একাই এগোতে শুরু করল। পায়ের নিচে শুকনো পাতা আর ভাঙা ডালের মচমচ শব্দ, গঙ্গার হাওয়া ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে আসছে। ঠিক তখনই তার কানে ভেসে এল এক অদ্ভুত সুর—খুব মৃদু, যেন বাতাসের সঙ্গে মিশে গেছে, কিন্তু মনোযোগ দিলেই বোঝা যায়, এটা বাঁশির সুর নয়, সানাইয়ের সুর। সে থমকে দাঁড়াল, কান খাড়া করল। সুরের প্রথম অংশে ছিল কোমলতা, যেন ভোরের শিশির, তারপর ধীরে ধীরে সুর ভারী হয়ে উঠল, যেন গভীর দুঃখে ভরা। চারপাশের নীরবতার মধ্যে সেই সুর যেন আরও স্পষ্ট হয়ে বাজতে লাগল, আর বিনুর বুকের ভেতর কেমন একটা শিহরণ ছড়িয়ে দিল। সে ধীরে ধীরে বটগাছের কাছে গেল, মনে হচ্ছিল সুরটা যেন গাছের ভেতর থেকেই বেরোচ্ছে। কাছাকাছি পৌঁছাতেই বাতাস হঠাৎ আরও ঠান্ডা হয়ে গেল, কুয়াশা ঘনিয়ে এসে চারপাশ ঢেকে ফেলল।
ঠিক সেই সময় সে দেখল—বটগাছের শিকড়ের কাছে, মাটির ওপর কেমন যেন সাদা আলো জমে উঠছে। চোখ কুঁচকে তাকাতেই মনে হল, আলোটা আসলে এক ঝলক সাদা ছায়া—মানুষের অবয়ব, কিন্তু মুখ অস্পষ্ট। বিনুর শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। ছায়াটা ধীরে ধীরে যেন গাছের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, আর সেই সঙ্গে সানাইয়ের সুরও ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য বিনু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর বুকের ভেতর প্রবল ভয়ের ঢেউ এসে পড়ল। সে ঘুরে দাঁড়াল, আর প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল পেছনের রাস্তার দিকে। গঙ্গার বাতাস তার কানে ফিসফিসিয়ে বয়ে যাচ্ছিল, আর দূরে মিলিয়ে যাওয়া সেই অসমাপ্ত সুর যেন তাকে পিছু ডাকছিল—একবার ফিরে এসে সুরটা শেষ করে যাও…
৫
বরানগরের পঞ্চায়েত অফিসের পুরনো কাঠের আলমারি খুলতেই ধুলোর গন্ধে ভরে গেল ঘর। বিনু সরকার নথিপত্রের খাতাগুলো উল্টে-পাল্টে দেখতে লাগল—প্রতিটি পাতায় হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজ, কালির দাগ ঝাপসা, যেন অতীতের অনেক কাহিনি গোপন করে রেখেছে। অবশেষে ১৯৯৮ সালের একটি পাতায় চোখ আটকাল—শিরোনাম: “সানাইওয়ালা গোপাল হালদারের মৃত্যু”। সেখানে লেখা, বরানগরের দুর্গাপূজার ষষ্ঠীর রাতে এক বরের বাড়িতে বাজানোর সময় গোপাল আচমকা মঞ্চ থেকে পড়ে যান, এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই প্রাণ হারান। মৃত্যুর কারণ ‘হৃদরোগ’ বলা হলেও, গোপালের শেষ সুর অসমাপ্ত থেকে যাওয়ার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল। বিনুর ভেতরে এক অদ্ভুত কৌতূহল জন্ম নিল—এত প্রতিভাবান একজন শিল্পীর শেষ মুহূর্তটা কি কেবলই একটি দুর্ঘটনা ছিল? নাকি সেই অসমাপ্ত সুরের ভেতরে লুকিয়ে আছে অদ্ভুত কোনো গল্প?
পঞ্চায়েত অফিস থেকে বেরিয়ে বিনু সোজা চলে গেল রজনী পালের চায়ের দোকানে। রজনী তখন কেতলির ধোঁয়ায় ভেসে থাকা দোকানের কোণে বসে সিগারেট ধরাচ্ছিল। বিনু খবরের কাগজের কপি দেখিয়ে বলল, “দেখো, আমি গোপালের মৃত্যুর খবর পেয়েছি।” রজনীর চোখে হঠাৎ যেন এক মুহূর্তের জন্য ছায়া নেমে এল। তিনি ধীরে ধীরে বললেন, “হুঁ… গোপাল শুধু সানাইওয়ালা ছিল না, সে ছিল এক জেদি মানুষও। মৃত্যুর আগের দিনও সে বলেছিল—‘আমার সুর শেষ না হলে শান্তি পাব না।’” রজনীর কণ্ঠে এমন এক গাম্ভীর্য ছিল, যা বিনুকে কাঁপিয়ে দিল। দোকানের বাইরে গঙ্গার ধারে তখন ঠান্ডা বাতাস বইছে, আর দূরে ভেসে আসছে কোনো অজানা সুরের মতো শোঁ শোঁ শব্দ—যেন হাওয়ার ভেতর দিয়ে কারও ফিসফিসানি। বিনুর মন দৃঢ় হয়ে উঠল—এই রহস্যের শেষ না দেখে সে থামবে না।
সেদিন সন্ধ্যায় বিনু বরানগরের গলিগুলোতে ঘুরে বেড়াল, প্রত্যেক বুড়ো-বুড়ির মুখে একই সতর্কবাণী—“শ্মশানের পথে যাস না রে। রাতের বেলায় গোপালের বাঁশি বাজে, শুনলে খারাপ কিছু হবে।” অথচ বিনুর মনে ভয়ের বদলে কেবলই বাড়তে লাগল অদম্য আকর্ষণ। সে মনে মনে ঠিক করল—যদি গোপালের আত্মা সত্যিই সেই অসমাপ্ত সুরের কারণে শান্তি না পায়, তবে সে নিজেই চেষ্টা করবে সেই সুরের শেষ অংশ খুঁজে বের করতে। হয়তো তাতেই গোপালের অদৃশ্য বাঁশি চিরতরে নীরব হবে। কিন্তু বিনু তখনও জানত না, এই অনুসন্ধান তাকে শুধু গোপালের জীবনের রহস্য নয়, বরং এমন এক অদৃশ্য জগতে টেনে নিয়ে যাবে, যেখান থেকে ফেরার পথ সবসময় খোলা থাকে না।
৬
বিনু সরকার মনে করল, শুধুমাত্র গল্প শোনা বা নথিপত্র দেখার মাধ্যমে এই রহস্য সমাধান হবে না; তাকে সরাসরি সেই সুরের উৎসের কাছে যেতে হবে। তাই সে বরানগরের আশেপাশের সকল প্রখ্যাত সানাইওয়ালার খোঁজ করতে শুরু করে। গ্রামের বুড়ো সানাইওয়ালা থেকে শুরু করে শহরের এক দুজন প্রবীণ শিল্পী, যারা একসময় গোপাল হালদারের সঙ্গে বাজিয়েছেন, বিনু তাঁদের কাছে যায়। প্রত্যেকের কাছেই তিনি পুরনো সুরের নোটেশন খুঁজে পান, অডিও রেকর্ডের মতো মৃদু সুরের টুকরো। কেউ বলেন, গোপাল এমনভাবে সুর বাঁধতেন যে নদীর ঢেউও যেন তার সঙ্গে মিশে যায়। বিনু ধীরে ধীরে সেই সমস্ত টুকরো সুর একত্রিত করতে থাকে, কাগজে নোট করে, নোটবুক ভর্তি করে রাখে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে বুঝতে পারে, গোপালের অসমাপ্ত সুরের কিছু অংশ শুধু নোটেশনে নেই—কিছু অংশ কেবল মনের গভীরে বাজে, এবং সেই অংশটি সম্ভবত মৃত্যুর পরও বটগাছের নিচে ভেসে আসে। এই উপলব্ধি বিনুকে আরও প্রবলভাবে টেনে আনে শ্মশানঘাটের দিকে, যেখানে সত্যের মুখোমুখি হতে হবে।
এক রাতে, স্থানীয় কাঠজোগানদার শিবু দাস বিনুর সাহসিকতা দেখে সিদ্ধান্ত নেন, তিনি নিজেই একবার সঙ্গে যাবেন। শিবু সাধারণত চুপচাপ মানুষ, কিন্তু রাতে শ্মশানঘাটে তার যাতায়াত স্বাভাবিক। তাঁরা হাত ধরাধরি করে গঙ্গার ধারে পৌঁছান। চারপাশে কুয়াশা ঘন, বাতাস ঠান্ডা, নদীর ঢেউ হালকা ফিসফিস করছে। বিনু সানাই হাতে নিয়ে বটগাছের দিকে এগোতে থাকে। প্রথমে দূর থেকে মৃদু সুর শুনতে পায়, যা আগের রাতে তার কানে এসেছিল তার চাইতে অনেক স্পষ্ট। হৃদয়ে এক অদ্ভুত উত্তেজনা—মিশ্র ভয় ও কৌতূহল। কিন্তু যত কাছে এগোয়, সুর হঠাৎ থেমে যায়। বিনু অবাক, থমকে দাঁড়ায়, মনে হয় কিছু অদৃশ্য হাত তার কাছে এসে সুর আটকিয়ে দিয়েছে। শিবু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, যেন জানে, এই মুহূর্তে কোনরকম হস্তক্ষেপ ঠিক নয়। কুয়াশার ভেতর দিয়ে হালকা ফিসফিসানি শোনা যায়—“শেষ করো…”—স্বরে যেন আত্মার গভীর আর্তি, যা বিনুকে এক মুহূর্তে ঠাসা করে দেয়।
বিনু মনে করে, এই শব্দটা কেবল সতর্কবার্তা নয়, বরং এক অনুরোধ—গোপালের অসমাপ্ত সুর সম্পূর্ণ করা এখন তার দায়িত্ব। সে বুঝতে পারে, শুধুমাত্র সুর বাজানো যথেষ্ট নয়; তাকে সেই সুরকে পুরোপুরি অনুভব করতে হবে, হৃদয় দিয়ে, যেন সে নিজেই সেই আত্মার সঙ্গে মিলিত হয়। শিবু চুপচাপ তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু বিনুর চোখে এক অদ্ভুত জেদ—এই রাতের অনুসন্ধান তাকে শুধু গোপালের জীবনের শেষ সুরের দিকে টেনে এনেছে না, বরং নিজের ভয়ের সীমারেখাও পরীক্ষা করছে। বাতাস ক্রমশ আরও ঠান্ডা হয়ে আসে, কুয়াশা ঘন হয়, এবং দূরের নদীর ধারে সানাইয়ের মৃদু প্রতিধ্বনি যেন হারিয়ে যায়। বিনু তখন বুঝতে পারে, এই অনুসন্ধান কেবল শুরু; শ্মশানঘাটের বটগাছের নিচে অপেক্ষা করছে সত্য, যা তাকে জীবনের অজানা এক জগতে প্রবেশ করাবে, যেখানে সময়, মৃত্যু, এবং সুরের মিলনের রহস্যের শেষ সীমা এখনো স্পর্শ করা বাকি।
৭
রজনী পালের ছোট চায়ের দোকান, যা বরানগরের নীরব রাতেও কেমন একটা জীবন্ত মনে হয়, সেই সন্ধ্যায় বিনুর জন্য অন্যরকম এক রহস্য খুলে দিল। রজনী একটি পুরনো, মলিন সানাই তুলে আনলেন, যার বাঁশের গায়ে সময়ের দাগ, পুরনো খোঁচা আর ছোটখাটো ফাটল। সাথে তিনি একটি ছোট নোটেশন বইও দিলেন, পাতাগুলো হলুদ হয়ে গেছে, প্রায় ছিঁড়ে যাওয়া। বইয়ের কভার খুলতেই বিনু দেখতে পেল, যে সুরটি গোপাল মৃত্যুর আগে তৈরি করেছিলেন, তার অনেক অংশ অসম্পূর্ণ। নোটেশন অনুযায়ী শুরুটা সুসঙ্গত, মাঝের অংশে ধীরে ধীরে সুর ভেঙে যায়, আর শেষ কিছু অংশ ফাঁকা রেখে দেওয়া হয়েছে—যেন গোপালই জানতেন, এই অংশ কেউ শুধুমাত্র তার হৃদয় দিয়ে পূর্ণ করতে পারবে। বিনু বইয়ের পাতা উল্টে যতবারই দেখল, তার মনে হচ্ছিল, এই ফাঁকা অংশে গোপালের শূন্যতা, তার দুঃখ, আর জীবনের অসমাপ্ত আকাঙ্ক্ষা লুকানো। প্রতিটি নোটের মধ্যে যেন নদীর ঢেউ, বাতাসের ফিসফিসানি, মানুষের হাহাকার—সব মিলেমিশে থাকা অনুভূতি ভেসে আসে।
বিনু সানাই হাতে নিয়ে প্রতিটি নোটেশন পরীক্ষা করতে শুরু করল। সে বুঝতে পারল, শুধু বই দেখলেই হবে না; সুরকে শোনতে হবে, অনুভব করতে হবে, যেন প্রতিটি নোট তার অন্তরের সঙ্গে মিশে যায়। শুরুতে কিছুটা ভুল হয়, তবে ক্রমশ তার আঙুল সেই গতিতে চলে যে, নদীর ঢেউ, বাতাসের ফিসফিসানি এবং বটগাছের ছায়া যেন তার সঙ্গে সমান্তরালভাবে নেচে ওঠে। বিনু বুঝতে পারল, গোপালের সুর শুধু তাল-ছন্দ নয়, এটি এক জীবন্ত অনুভূতি, যা শুধু তার হৃদয় দিয়ে সম্পূর্ণ করা সম্ভব। সেই অনুভূতি তাকে টেনে নিয়ে যায় গভীর মনস্তত্ত্বের মধ্যে, যেখানে সঙ্গীত আর স্মৃতি, জীবন আর মৃত্যু—সব মিলেমিশে একাকার। বিনু যেন বুঝতে পারল, সে শুধু একটি সুর পূর্ণ করছে না; সে এক আত্মার শান্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে, যার অপেক্ষা অনেক বছর ধরে সেই বটগাছের নিচে ছিল।
শেষ পর্যন্ত বিনু সিদ্ধান্ত নিল, সে এই অসমাপ্ত সুর শেষ করবে—চাই যেভাবেই হোক। রাতের অন্ধকারে চায়ের দোকানের কোণে বসে, সানাই হাতে নিয়ে সে ভাবল, শুধুমাত্র নোটেশন অনুসরণ করলেই হবে না, মন দিয়ে, হৃদয় দিয়ে, আর সময়ের সাথে মিশে এই সুরকে পূর্ণ করতে হবে। তার মনে অদ্ভুত এক দৃঢ়তা জন্ম নিল—গোপালের অসমাপ্ত জীবন আর তার নিজস্ব কৌতূহল একত্রিত হয়ে একটি চূড়ান্ত সঙ্গীতের পথে নিয়ে যাচ্ছে। মনে হয়, বটগাছের নিচে, শ্মশানঘাটের ম্লান আগুনের ছায়ায়, নদীর ধারে ভেসে আসা সেই ভুতুড়ে সুরকে এবার শোনানো হবে শেষ। বিনু জানে, একবার সুর শেষ হলেই শুধুমাত্র রহস্যের সমাধি হবে না, বরং গোপালের আত্মাও শান্তি পাবে। এই অনুভূতি তাকে আরও সাহসী করে তোলে—ভয়, অন্ধকার, কুয়াশা, সবই যেন তার কাছে ছোট হয়ে আসে। এখন তার একমাত্র লক্ষ্য—সুরের শেষ নোট পর্যন্ত পৌঁছানো এবং গোপালের অসমাপ্ত যাত্রাকে সম্পূর্ণ করা।
৮
পূর্ণিমার রাত। চাঁদের আলো কুয়াশার মধ্য দিয়ে নদীর ধারে ভেসে আসছে, গঙ্গার জল যেন হালকা কেঁপে উঠছে। বরানগরের শ্মশানঘাটের পুরনো বটগাছের নিচে বিনু সানাই হাতে বসে আছে। চারপাশে এক অদ্ভুত নীরবতা—কেবল দূরে নদীর ঢেউয়ের মৃদু শব্দ এবং কোথাও কোনো পশুর হুক্কাহুয়া। বাতাস হালকা, ঠান্ডা, এবং কুয়াশার সঙ্গে মিশে আছে মৃতের সুরের একটি অদৃশ্য ছোঁয়া। বিনুর মনে এক অদ্ভুত অস্থিরতা, ঠান্ডা কেঁপানি, কিন্তু একই সঙ্গে হৃদয়ে প্রবল উত্তেজনা। সে জানে—আজকের রাতটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই রাতেই সে গোপালের অসমাপ্ত সুর শেষ করার চেষ্টা করবে। প্রথমে আঙুল কাঁপছে, সানাইয়ের সুর মৃদু, অস্বস্তিকরভাবে ভেসে আসছে। সে থমকে থমকে সুর তুলে শুরু করে, যেন নিজেই অনুভব করতে চাইছে—নোটেশন, বাতাস, এবং আত্মার মধ্যে সংযোগ কতটা শক্তিশালী।
ধীরে ধীরে বিনু সুরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। শুরুতে কেবল নোটেশন অনুসরণ, তারপর হঠাৎ করে সুর যেন তার নিজের হৃদয়ে ঢুকে যায়। বাতাসের সঙ্গে মিশে যায় সানাইয়ের মৃদু ফিসফিসানি। দূরে নদীর ধারে কুয়াশা ঘন হয়ে আসে, এবং সুরের ছন্দ ক্রমশ গভীরতর হয়ে ওঠে। হঠাৎ, কুয়াশার ভেতর থেকে আলো-ছায়ার এক ঝলক দেখা যায়। বিনু প্রথমে ভেবে বসে, হয়তো বাতাসের খেলা, কিন্তু চোখ যখন আরও ফোকাস করে, সে দেখল—সাদা পোশাকে এক ছায়া ধীরে ধীরে বটগাছের দিকে এগোচ্ছে। হৃদয় জুড়ে এক অদ্ভুত কম্পন, ঠান্ডা কেঁপানি। বিনু বুঝতে পারে, এটি কোনো স্বাভাবিক ছায়া নয়। ধীরে ধীরে সেই ছায়া স্থির হয়ে বটগাছের পাশে দাঁড়ায়, এবং বিনু নিশ্চিত হয়—সে দাঁড়িয়ে আছে গোপাল হালদারের আত্মা।
অতীন্দ্রিয় ভয় আর বিস্ময়ের মধ্যে বিনু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আত্মার চোখ, যা যেন কোনো ধরনের দুঃখ ও আর্তি বহন করছে, সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে আছে। বিনু তখন সাহস করে সানাইয়ের শেষ অংশটি বাজাতে শুরু করে—ফাঁকা নোটেশন পূর্ণ করতে পূর্ণ হৃদয় দিয়ে, তার নিজের অনুভূতি দিয়ে। হঠাৎ কুয়াশা যেন নীরব হয়ে যায়, বাতাস থেমে যায়। আত্মার চোখে শান্তি, মুখে হালকা হাসি ফুটে ওঠে। সানাইয়ের শেষ সুর পুরোপুরি বেজে উঠে—নদীর ঢেউ, বাতাসের ফিসফিসানি, কুয়াশার ভেতরের আলো সব মিলিয়ে এক নিখুঁত সংযোগ। বিনু বোঝে, এই মুহূর্তে গোপালের অসমাপ্ত জীবন আর সুরের দুঃখ সমাধি পেল। আত্মা ধীরে ধীরে গায়েব হয়ে যায়, কিন্তু বাতাসে এবং নদীর ঢেউয়ে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ভেসে থাকে। সেই রাত থেকে শ্মশানঘাটে আর ভোরের আগে বাঁশির সুর শোনা যায় না—কিন্তু বটগাছের নিচে, চাঁদের আলো ও কুয়াশার খেলায়, গোপালের আত্মার শান্তি যেন চিরকাল বিরাজমান।
৯
বিনু সানাইয়ের শেষ নোটটি বাজালেই চারপাশের পরিবেশ একেবারে বদলে গেল। কুয়াশার ভেতর দিয়ে হালকা বাতাস ভেসে আসছিল, কিন্তু হঠাৎ সেই ঠান্ডা হাওয়া গরম হয়ে উঠল, যেন বরফ গলে সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ল। নদীর ঢেউও হঠাৎ নীরব হয়ে গেল, কেবল সানাইয়ের সুর শোনা যাচ্ছিল, যা এবার আর কেউ বাজাচ্ছে না—এটা যেন নিজে থেকেই বাতাসে ভেসে যাচ্ছে। বিনু থমকে দাঁড়াল, চোখ কুঁচকে তাকিয়ে। সে বুঝতে পারল, যে অসমাপ্ত সুর তার নিজের চেষ্টা এবং অনুভূতির মাধ্যমে পূর্ণ হয়েছে, তাই এখন সুরটি যেন স্বাধীন, বটগাছের নিচ থেকে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। বাতাসে মৃদু এক কম্পন, নদীর জলে আলোর নাচ—সব মিলিয়ে এমন এক অনিন্দ্য সুন্দর পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যা কেবল চোখে নয়, হৃদয়েও অনুভূত হয়। বিনুর বুকটা অবাক ও আনন্দে ভরে যায়, কারণ সে বুঝতে পারল—এবার গোপাল হালদারের আত্মা সত্যিই মুক্ত।
সেই সময়ে বিনু লক্ষ্য করল, গোপালের মুখে শান্তির হাসি ফুটে উঠল। কুয়াশার ভেতর সাদা ছায়া ধীরে ধীরে ধীরগতিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, আর তারপর শান্তভাবে মিলিয়ে গেল। বিনু প্রথমে চমকে গেল, কিন্তু সাথে সঙ্গে মনে হলো যেন চারপাশের অন্ধকার আর রহস্য কিছুকালের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। সে অনুভব করল, দীর্ঘদিন ধরে যে অমীমাংসিত আর্তি বাতাসে ভেসে চলছিল, সেটি শেষ হয়েছে। বটগাছের শিকড়ের কাছে থাকা সেই জায়গা যেন এখন আরও প্রশান্ত, আর নদীর জলও যেন একটু ধীরে ধীরে, শান্তভাবে বইছে। হাওয়া, নদী, চাঁদের আলো—সব কিছু একধরনের মিলন ঘটিয়েছে, যেখানে মৃত্যু, শোক, এবং সঙ্গীত একত্র হয়ে আত্মার শান্তি নিশ্চিত করেছে।
শ্মশানঘাটে এরপর আর কোনো বাঁশির সুর শোনা যায়নি। গ্রামের মানুষ আর ভোরের দিকে বটগাছের পাশে কিছু অদ্ভুত সুর শুনে ভয় পাননি। বরং সেই স্থান যেন নতুনভাবে নিস্তব্ধ হয়ে উঠেছে, শান্ত, প্রশান্ত, এক রহস্যময় সজীবতার সঙ্গে। বিনু বুঝতে পারে, এই অনুসন্ধান কেবল গোপালের আত্মার মুক্তিই নয়, বরং তার নিজের জীবনের সাহস, আবিষ্কার এবং সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসার চূড়ান্ত সাক্ষ্য। সে চায়ের দোকানে ফিরে এসে রজনীকে জানায়—“গোপালের সুর শেষ হয়েছে, আর এবার তার আত্মা শান্ত।” রজনী হালকা হাসি দিয়ে কেবল মাথা নাড়লেন, জানতেন—বিনুর এই সন্ধান এবং সাহসই সেই বহু বছরের কুসংস্কার ভেঙে দিয়েছে। সেই রাত থেকে বরানগরের বটগাছের নিচে আর ভোরের আগে বাঁশির সুর শোনা যায় না, কিন্তু বাতাসে, নদীতে এবং গ্রামের হৃদয়ে এক চিরস্থায়ী প্রশান্তি বিরাজ করছে, যা গোপালের আত্মার মুক্তির চিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে।
১০
কলকাতার ব্যস্ত রাস্তা, হাওড়া ব্রিজের হুড়মুড় এবং ট্রাফিকের কোলাহল—সবকিছু বিনুর চোখে একেবারেই নতুন মনে হচ্ছিল। বরানগরের সেই নীরব রাতের স্মৃতি এখনও তার মনের কোণে সজীব। অফিসের ডেক্সে বসে, স্যুটের তলে ল্যাপটপ খুলে সে টাইপ করতে শুরু করল। শ্মশানঘাটের বটগাছ, গঙ্গার ধারে ভেসে আসা সানাই, গোপাল হালদারের অসমাপ্ত সুর—সবকিছু যেন জীবন্ত হয়ে উঠল তার কীবোর্ডে। বিনু এক অধ্যায় লিখল তার নতুন বইয়ে, যার শিরোনাম “শ্মশানঘাটের বাঁশি”। প্রতিটি শব্দে স্থানীয় কুসংস্কার, রহস্য, ভয়, এবং শিল্পীর আত্মার শান্তি—সব মিলেমিশে একটি নিখুঁত গল্প রচিত হলো। সে জানে, এই গল্প শুধু পাঠকদের কৌতূহল জাগাবে না, বরং সঙ্গীত, আবেগ এবং মানুষের সীমাহীন ধৈর্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে। তার লেখার ভেতর থেকে যেন গোপালের সুর আবার একভাবে ফুটে উঠছে—শুধু নোট নয়, অনুভূতি, হৃদয়, এবং অদৃশ্য সম্পর্কের ছোঁয়া।
রজনী পালের ছোট চায়ের দোকান এখনও সেই পুরনো জায়গায় অবিকল আছে। নদীর ধারের কুয়াশা, বটগাছ, এবং পুরনো কাঠের টেবিল—সবকিছুই আগের মতো। গ্রামবাসীরা এখনও চায়ের কাপ হাতে গল্পের জন্য আসে। বিনুর বই বের হওয়ার পর থেকে মানুষ জানতে চায়—কীভাবে সেই ভুতুড়ে সুর শেষ হলো, কিভাবে একজন যুবক তার সাহস ও সঙ্গীতের প্রিয়তার মাধ্যমে অসমাপ্ত সুর সম্পূর্ণ করল। রজনী ধীরে ধীরে গল্প শোনায়, মাঝে মাঝে চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি, যেন গোপালের আত্মা তার পাশে বসে আছে। গ্রামের বাচ্চারা বিস্ময়ে তাকায়, বৃদ্ধরা অল্প চমকে হাসে, আর নবজাতকরা হাহাকারপূর্ণ গল্পের মধ্যে আত্মপ্রকাশ খুঁজে পায়। দোকানের কোণে বসে মানুষ নোটবুক খোলে, সানাইয়ের নোটেশন অনুধাবন করতে চায়, আর বাতাসে মৃদু গন্ধ ভেসে আসে—পুরনো কুয়াশার মতোই।
কিন্তু এক বৃষ্টির রাতে, যখন নদীর ধারে মৃদু কুয়াশা ঘন হয়ে আসে, তখন দূরে দূরে—খুব হালকা করে—একটি সানাইয়ের সুর ভেসে আসে। এতটাই নরম, এতটাই সূক্ষ্ম যে প্রথমে কেউ চিনতে পারে না। বিনু, কলকাতার নিজের অ্যাপার্টমেন্টের জানালা থেকে তাকিয়ে অবাক হয়ে শুনে—শুধু বাতাসের খেলাই না, বরং একটি অদৃশ্য স্মৃতি জীবিত হচ্ছে। মনে হয়, গোপালের আত্মা এখনও কোথাও নদীর ধারে ভেসে বেড়াচ্ছে, তার সুরের এক ক্ষুদ্র ঝলক ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই সুর কোনো ভয় নয়; বরং শান্তি, কৌতূহল এবং আবেগের সংমিশ্রণ। বিনু মৃদু হাসি দিয়ে জানায়, “শুধু শেষ হয়নি—শুধু নতুন কাহিনি শুরু হয়েছে।” গল্প, সুর, এবং সেই আত্মার স্পন্দন—সবই মিলেমিশে একটি চিরন্তন স্মৃতি তৈরি করছে, যা শ্মশানঘাটের বটগাছ, নদীর ধারে, এবং গ্রামের হৃদয়ে চিরকাল বয়ে চলবে।
সমাপ্ত




