Bangla - রহস্য গল্প

ড্রোন খুনি

Spread the love

সৃজন বসু


এক

পার্ক স্ট্রিটের রাত মানেই আলো, কোলাহল, গাড়ির হর্ন আর মানুষের হাসি-আড্ডায় ভরা এক জীবন্ত ছবি। সেদিনও ব্যতিক্রম ছিল না। শীতের শুরুতে রাস্তায় রঙিন লাইটের মালা, বিদেশি আর দেশি সুরের মিশ্রণ, আর খাবারের গন্ধে ভরে উঠেছিল বাতাস। রাত সাড়ে নয়টার দিকে ‘দ্য ব্লু অর্কিড’ নামের এক বিলাসবহুল রেস্তোরাঁয় ডিনারের ভিড় ঠাসা। মোটা মোটা গ্লাসের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছিল, শহরের ধনী-প্রভাবশালী মহল ব্যস্ত নিজেদের গল্পে, কেউ চুমুক দিচ্ছে রেড ওয়াইনে, কেউবা কাঁটাচামচে কেটে নিচ্ছে স্যামন স্টেকের টুকরো। হঠাৎ করেই দূরের আকাশে একটি মৃদু গুঞ্জন শোনা যায়—প্রথমে মনে হয় কোনো মোটরসাইকেল পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে, কিন্তু শব্দের দিকনির্দেশ যেন উপরের দিকে থেকে আসছে। কেউ কেউ জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখল, একটি কালো ড্রোন, চারটি রটার ভয়ঙ্কর গতিতে ঘুরছে, সরাসরি রেস্তোরাঁর দিকে নেমে আসছে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেটি হঠাৎ পাশের বারান্দা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ল, আর তার নিচের মাউন্টে লাগানো তীক্ষ্ণ ব্লেড মুহূর্তে আঘাত হানল সামনের টেবিলে বসা একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোকের ঘাড়ে। রক্ত ছিটকে গিয়ে মেঝে আর টেবিল কাপড় লাল করে দিল। চিৎকার, ভাঙা গ্লাসের শব্দ, আর আতঙ্কের ঢেউ মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল রেস্তোরাঁয়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ড্রোনটি নিজে থেকেই এক অদ্ভুত শব্দ করে বিস্ফোরিত হলো—শুধু ধোঁয়া আর কিছু গলে যাওয়া ধাতব টুকরো ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট রইল না।

খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায় কলকাতা পুলিশের টহল গাড়ি, তারপর সাইবার ক্রাইম শাখার দল। রেস্তোরাঁর ভেতরে তখন বিশৃঙ্খলা চরমে, কেউ কাঁদছে, কেউ ফোনে ভিডিও করছে, কেউ আবার মোবাইলে প্রিয়জনকে ফোন করে নিজের নিরাপত্তার খবর দিচ্ছে। মৃত ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত করতে বেশি সময় লাগেনি—তিনি শহরের প্রভাবশালী শিল্পপতি সমরেশ দত্ত, যিনি সম্প্রতি একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সংস্থার সাথে ব্যবসায়িক চুক্তি করেছিলেন। তাঁর স্যুটের পকেটে দামি ফোন, ভিজিটিং কার্ড, আর কিছু ব্যক্তিগত নথি পাওয়া গেল। কিন্তু ড্রোনের খোঁজে তদন্তকারীরা হতাশ—কারণ বিস্ফোরণের পর যা অবশিষ্ট ছিল, তা কার্যত বিশ্লেষণ করার মতো কিছুই নয়। ধাতব খোলস ভেঙে পুড়ে গেছে, সার্কিট বোর্ড প্রায় ছাই হয়ে গেছে। তবুও, বিস্ফোরণের আগে কিছু সেকেন্ড রেস্তোরাঁর সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে—ড্রোনটির ফ্রেম ছিল কমপ্যাক্ট, সামরিক মানের, এবং তাতে কোনো দৃশ্যমান সিরিয়াল নম্বর বা চিহ্ন ছিল না। ডেপুটি কমিশনার অনিকেত রায়, লম্বা, ধীরস্থির স্বভাবের মানুষ, কালো ওভারকোটে ঢুকে আসেন ঘটনাস্থলে। সবার আতঙ্কের মাঝেও তাঁর চোখে ছিল একধরনের ঠান্ডা পর্যবেক্ষণ—তিনি মৃতদেহের চারপাশ, ছড়িয়ে থাকা ধ্বংসাবশেষ, আর আতঙ্কিত সাক্ষীদের মুখ একে একে খুঁটিয়ে দেখছিলেন। কয়েক মিনিট চুপচাপ থেকে তিনি শুধু বললেন, “এটা কোনো সাধারণ ক্রিমিনাল ড্রোন নয়।”

অনিকেতের কথায় উপস্থিত অফিসারদের কপালে ভাঁজ পড়ে। ড্রোন হামলার ক্ষেত্রে সাধারণত দুটি সম্ভাবনা থাকে—হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ড্রোনের সিস্টেম দখল করে নেওয়া, অথবা সরাসরি প্রোগ্রামিং করে লক্ষ্যবস্তু আক্রমণ করানো। কিন্তু এই ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিশ্লেষণেই বোঝা গেল, ড্রোনের প্রোগ্রামিংয়ে কোনো ‘কিল কমান্ড’ লেখা ছিল না। তার মানে—এটি রিমোট কন্ট্রোলে, অত্যন্ত দক্ষ কারও হাতে, বাস্তব সময়ে পরিচালিত হয়েছে। এত নির্ভুলতা, এত নিখুঁত টার্গেট সিলেকশন—এটা কেবল অভিজ্ঞ সামরিক বা উচ্চমানের প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞের পক্ষেই সম্ভব। অনিকেত জানতেন, বিষয়টি কেবল একটি হত্যাকাণ্ড নয়; এখানে কেউ আড়ালে থেকে প্রযুক্তিকে অস্ত্র বানিয়ে খুন করছে। তিনি সিসিটিভি ফুটেজ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ সংগ্রহের নির্দেশ দিলেন, আর রেস্তোরাঁর পেছনের ছাদে উঠে গেলেন নিজে—সেখানে কিছু চূর্ণ প্লাস্টিক, পুড়ে যাওয়া কার্বন ফাইবারের গন্ধ, আর দূরের আকাশে মিলিয়ে যাওয়া হেলিকপ্টারের মতো শব্দের স্মৃতি ছাড়া কিছুই নেই। অনিকেত সিগারেট ধরালেন, ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে তাকালেন শহরের আলোকিত আকাশে। মনে মনে ভাবলেন—যে-ই হোক, সে বার্তা দিয়ে গেছে স্পষ্ট: এটাই শুধু শুরু।

দুই

পরদিন সকাল। কলকাতা পুলিশের সাইবার ক্রাইম ল্যাবের সাদা আলোয় মোড়া ঘরে অনিকেত রায় দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে সদ্য পাওয়া ফরেনসিক রিপোর্ট। গতরাতের ঘটনার পর তিনি প্রায় ঘুমোতে পারেননি। রিপোর্ট খুলতেই চোখ আটকে গেল প্রথম লাইনেই—“No lethal command found in the code”। ড্রোনের সিস্টেম মেমরি থেকে উদ্ধার করা ডেটায় কোথাও কোনো ‘মারো’, ‘ধ্বংস করো’ বা টার্গেট-লক সংক্রান্ত নির্দেশ নেই। এটি যেন একটি সাধারণ রিকনাইস্যান্স ড্রোনের প্রোগ্রাম—ক্যামেরা, সেন্সর, ন্যাভিগেশন—সব ঠিকঠাক, কিন্তু কোনো মারাত্মক অ্যাকশন স্ক্রিপ্ট লেখা নেই। অনিকেত জানতেন, এর মানে কেবল একটাই—ড্রোনটি গতরাতে রিয়েল-টাইমে, একজন জীবন্ত অপারেটরের হাতে চালানো হয়েছে, যে সম্পূর্ণ আলাদা চ্যানেল দিয়ে কিল সিগন্যাল পাঠিয়েছে। তিনি একবার জানালার বাইরে তাকালেন—সকালের রোদে শহর স্বাভাবিক ছন্দে চলেছে, অথচ এই স্বাভাবিকতার নীচে লুকিয়ে আছে এক নিখুঁত, ঠান্ডা মাথার খুনি। রিপোর্টটা নামিয়ে রেখে তিনি ইন্টারকমে বললেন, “লীনা মুখার্জীকে পাঠান। এখনই।”

লীনা ঢুকল তীক্ষ্ণ পায়ের শব্দে, কালো জিন্স আর ধূসর হুডি পরে, কাঁধে ল্যাপটপ ব্যাগ। তার চোখে ছিল একধরনের অস্থির উত্তেজনা—যেন মস্তিষ্কে সবসময় কোনো সমাধান খোঁজার প্রক্রিয়া চালু আছে। অনিকেত তাকে বসতে বললেন এবং ল্যাবের মনিটরে ড্রোনের ধ্বংসাবশেষের ছবি দেখালেন। লীনা কয়েক সেকেন্ড মনোযোগ দিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে রইল, তারপর ধীরে ধীরে বলল, “আমি এই ফ্রেম চিনি… খুব ভাল করেই চিনি।” তার কণ্ঠে বিস্ময় মিশ্রিত আতঙ্ক। অনিকেত ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মানে?” লীনা গভীর শ্বাস নিয়ে জানাল, চার বছর আগে সে এক সামরিক ডেমো প্রজেক্টে কাজ করেছিল—‘আর্গাস’-কোডনেম ড্রোন—যা মূলত সীমান্ত নজরদারি ও শত্রুপক্ষের অবস্থান রেকর্ড করার জন্য তৈরি হয়েছিল। ওই প্রজেক্টের হার্ডওয়্যার কনফিগারেশন, ব্লেড ডিজাইন, এমনকি প্রোপেলার গার্ড—সবই এই ধ্বংসপ্রাপ্ত ড্রোনের সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে। কিন্তু তার দাবি, প্রজেক্টটি কেবল ডেমো পর্যায়ে ছিল এবং পরে সেটি বাতিল করা হয়েছিল; এর কোনো পূর্ণাঙ্গ কমব্যাট ভার্সন তৈরি হয়নি। অনিকেত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন—তিনি জানতেন, সামরিক প্রযুক্তি বাতিল হয়ে গেলে সেটি হারিয়ে যায় না, বরং কোথাও না কোথাও থেকে যায়, আর ভুল হাতে পড়লে হয়ে উঠতে পারে প্রাণঘাতী।

“তুমি বলছো এগুলো কেবল ডেমো ছিল, কিন্তু এই ড্রোন গতকাল একজন মানুষকে হত্যা করেছে,” অনিকেতের গলা ছিল নিম্ন অথচ ধারালো। লীনা ঠোঁট কামড়ে বলল, “ডেমো মডেল কোনো অবস্থাতেই কিলার মোডে যেতে পারে না, যদি না কেউ হার্ডওয়্যার মডিফিকেশন করে।” সে দ্রুত ল্যাপটপ খুলে ড্রোনের অবশিষ্ট চিপ থেকে উদ্ধার করা ফার্মওয়্যার ডেটা বিশ্লেষণ শুরু করল। মিনিট দশেক পর সে স্ক্রিন ঘুরিয়ে অনিকেতকে দেখাল—কোডে মূল প্রোগ্রাম অক্ষত, কিন্তু একটি অদ্ভুত ব্ল্যাঙ্ক সেক্টর আছে, যা থেকে বোঝা যায়, কোনো অজানা এক্সটার্নাল ডিভাইস রিয়েল-টাইম কমান্ড ইনজেক্ট করেছে। “যে এটা করেছে, সে কেবল প্রোগ্রামার নয়, বরং মিলিটারি-গ্রেড কমিউনিকেশন সিস্টেম চালাতে জানে,” লীনার কণ্ঠে দৃঢ়তা। অনিকেত নীরবে সিগারেট ধরালেন, ধোঁয়া ছেড়ে ধীরে বললেন, “তাহলে খোঁজটা এখন শুরু হল। কে এই মানুষটা, যার অস্তিত্ব আমরা এখনো রেকর্ডে খুঁজে পাইনি?” ঘরের ভেতরে মুহূর্তে এক ভারী নীরবতা নেমে এল—যেন বাইরের শহরের কোলাহলও হঠাৎ থেমে গেছে।

তিন

পরের দিন সকালটা ছিল কলকাতার অন্য দিনের মতোই—চা-স্টলগুলোতে খবরের কাগজ নিয়ে বিতর্ক, স্কুলবাসের হর্ণ, আর ভোরের রোদে নদীর ধারে হাঁটতে বের হওয়া মানুষের ভিড়। কিন্তু এই স্বাভাবিক দৃশ্য মুহূর্তে ভেঙে গেল। সকাল আটটা কুড়ি মিনিটে এলগিন রোডের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চিরে দিল এক ভয়ঙ্কর শব্দ—আকাশ থেকে নেমে আসা একটি ড্রোন, আগের রাতের মতোই কালো, কমপ্যাক্ট, এবং মারাত্মক দ্রুতগতি। ড্রোনটি নির্দ্বিধায় নেমে এসে সোজা আক্রমণ করল সড়কের পাশে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধ ভদ্রলোককে, যিনি গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলেন। মুহূর্তের মধ্যে তীক্ষ্ণ ব্লেড তার গলা কেটে দিল; রক্ত ছিটকে গিয়ে গাড়ির সাদা দরজায় লাল দাগ ফেলে দিল। চিৎকারে আশেপাশের মানুষ দৌড়াতে শুরু করল, কিন্তু ততক্ষণে ড্রোনটি ঘুরে ওপরে উঠে এল এবং সেকেন্ড খানেকের মধ্যেই বিস্ফোরিত হয়ে মিলিয়ে গেল আকাশের ধোঁয়ায়। ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটল যে উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শীরা বোঝার আগেই খুন সম্পন্ন হয়ে গেছে। কয়েকজন মোবাইল ফোনে ভিডিও করেছিল, কিন্তু রেজল্যুশন ও গতির কারণে স্পষ্ট কিছু ধরা যায়নি—শুধু এক ঝলক কালো যন্ত্র, মৃত্যুর পরশ নিয়ে চলে যাচ্ছে।

মিনিট দশেকের মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায় অনিকেত রায়ের দল। তিনি মৃত ব্যক্তির পরিচয় জানতে পারলেন—অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অরুণাভ সেন, যিনি একসময় দেশের অন্যতম প্রভাবশালী হাইকোর্ট বেঞ্চে ছিলেন। ঘটনাস্থলে ভিড়ের মধ্যে ছিলেন আরব বসু, শহরের খ্যাতনামা অনুসন্ধানী সাংবাদিক, হাতে ক্যামেরা আর কাঁধে ব্যাগ। অনিকেত তাকে চিনতেন—প্রায়শই বিতর্কিত রিপোর্টের জন্য শিরোনামে থাকে, কিন্তু তথ্যের নির্ভুলতা ও সাহসী অনুসন্ধানের জন্য সমানভাবে পরিচিত। আরব এসে সরাসরি বলল, “আপনি জানেন তো, এটা কেবল সিরিয়াল কিলিং নয়, এর পেছনে ইতিহাস আছে।” অনিকেত ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। আরব ব্যাগ থেকে একটি পাতলা ফাইল বের করে দিলেন—তার মধ্যে পত্রিকা কাটিং আর কিছু পুরনো নথি। “সমরেশ দত্ত আর অরুণাভ সেন—দুজনেই একসময় ‘প্রজেক্ট ব্ল্যাকশিল্ড’-এর সাথে যুক্ত ছিলেন,” আরব বলল, কণ্ঠে একধরনের বিজয়ী দৃঢ়তা। অনিকেত নামটা শুনে চুপ হয়ে গেলেন; তিনি জানতেন, এটি ছিল এক গোপন সামরিক চুক্তি, যার অস্তিত্ব সরকারি নথিতেও প্রায় নেই, আর যা বাতিল হয়ে যায় রহস্যজনক পরিস্থিতিতে।

লীনা তখন ঘটনাস্থলে এসে ড্রোন বিস্ফোরণের অবশিষ্টাংশ পরীক্ষা করছিল। সে লক্ষ্য করল, আগের ড্রোনের মতোই এটিতেও একই হার্ডওয়্যার মডিফিকেশন—ব্লেড অ্যাসেম্বলি ও মোটরের গতি সুনির্দিষ্টভাবে মারাত্মক আঘাতের জন্য ক্যালিব্রেট করা। অনিকেত ফাইলটি লীনার হাতে দিলেন, সে দ্রুত পৃষ্ঠাগুলো উল্টিয়ে দেখল এবং বলল, “প্রজেক্ট ব্ল্যাকশিল্ড কেবল নজরদারির জন্য ছিল না; এতে সীমিত আক্রমণ ক্ষমতাও ছিল, কিন্তু সেটা কখনো কার্যকর হয়নি—অথবা অন্ততপক্ষে আমাদের জানানো হয়নি।” অনিকেত ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন, যেন কিছু একটা মনের ভিতরে জুড়ে বসছে। আরব শান্ত গলায় বলল, “দেখুন, যদি এই হত্যাগুলো সংযুক্ত হয়, তাহলে বাকি জীবিত সদস্যরাও বিপদে আছেন। আর সবচেয়ে বড় কথা, যে এটা করছে সে শুধু খুন করছে না—সে বার্তা দিচ্ছে।” অনিকেত তার দিকে তাকালেন, কণ্ঠে অদ্ভুত শান্তি, “বার্তা? নাকি প্রতিশোধ?” বাতাসে হালকা ঠান্ডা শিহরণ বয়ে গেল, যেন আকাশের অদৃশ্য কোথাও থেকে আরেকটি ড্রোন তাকিয়ে আছে, পরবর্তী শিকারের অপেক্ষায়।

চার

প্রজেক্ট ব্ল্যাকশিল্ডের নথিপত্রে ঘাঁটতে ঘাঁটতে অনিকেত ও লীনা একটি নামের উপর বারবার আটকে যাচ্ছিলেন—কর্নেল রণদীপ সেন। প্রাক্তন সেনা অফিসার, যিনি ড্রোন কমব্যাট ইউনিটের প্রধান হিসেবে প্রকল্পের নকশা, পরীক্ষা এবং কৌশলগত প্রয়োগের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু অবাক করার মতো ব্যাপার হলো, সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর তাঁর কোনো সরকারি রেকর্ড নেই—না বর্তমান ঠিকানা, না পেনশন রেজিস্ট্রি, এমনকি ভোটার তালিকাতেও নাম মুছে গেছে। যেন তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের অস্তিত্ব মুছে ফেলেছেন। লীনা বলল, “যদি কেউ এই প্রযুক্তি পুনরায় চালু করে থাকে, তাহলে কর্নেল তার ব্যাপারে জানবেন—অথবা তিনি নিজেই এর পেছনে আছেন।” অনিকেত সম্মত হলেন, কিন্তু জানতেন, এতটা সাবধানী একজন মানুষকে খুঁজে বের করা সহজ হবে না। তিনি নিজের পুরনো এক সূত্রকে সক্রিয় করলেন—গোপনে তথ্য সরবরাহকারী এক প্রাক্তন গোয়েন্দা কর্মকর্তা, যিনি শহরের অন্ধকার আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্কে এখনও সক্রিয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সূত্র জানাল, কর্নেলকে শেষবার দেখা গেছে উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি এক প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে সামরিক অবসরপ্রাপ্তদের জন্য গড়ে ওঠা কয়েকটি নিভৃত কটেজ আছে।

পরদিন ভোরেই অনিকেত যাত্রা শুরু করলেন—একটা জিপ গাড়িতে চড়ে পাহাড়ি পথ ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলতে চলতে তিনি পৌঁছালেন এক ছোট্ট গ্রামে, যেখানে কুয়াশা আর শীতের ঠান্ডা বাতাস মিলে এক রহস্যময় পরিবেশ তৈরি করেছে। গ্রামের প্রান্তে, পাইনগাছের ফাঁকে দেখা গেল একটি একতলা কাঠের বাড়ি, যার বারান্দায় পুরনো সেনা চেয়ার রাখা। দরজায় কড়া নাড়তেই কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন রণদীপ সেন—প্রায় ষাটের কোঠায়, তবু শরীর সোজা, চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। অনিকেত নিজের পরিচয় দিয়ে কথা শুরু করলেন, কিন্তু কর্নেল শীতল গলায় বললেন, “আপনি ভুল জায়গায় এসেছেন। আমি কোনো প্রজেক্ট ব্ল্যাকশিল্ড চিনি না।” অনিকেত তবু থামলেন না; তিনি জানালেন, গত কয়েক দিনে দুইজন প্রাক্তন সদস্য নিহত হয়েছেন, এবং তাঁর নামও সেই তালিকায় থাকতে পারে। কর্নেল চুপচাপ শুনছিলেন, কিন্তু তাঁর চোখে মাঝে মাঝে এক অদ্ভুত অস্থিরতা দেখা যাচ্ছিল—যেন তিনি কিছু জানেন, কিন্তু বলার সাহস পাচ্ছেন না। লীনা, যে পাহাড়ি পথ ধরে পরে এসে পৌঁছেছিল, নরম স্বরে বলল, “স্যার, আমরা জানি আপনি মূল নকশা বানিয়েছিলেন। যদি সত্যিই কেউ এই প্রযুক্তি হাতে পেয়ে থাকে, তাহলে তাকে থামানোর উপায় আপনিই জানবেন।”

কর্নেল হঠাৎ বারান্দায় রাখা চেয়ারে বসে সিগারেট ধরালেন, ধোঁয়া ছেড়ে দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর ধীরে ধীরে বললেন, “যা তোমরা খুঁজছো, তা থামানো সহজ নয়। ব্ল্যাকশিল্ড কখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি—আমাদের ভেতরে এমন কেউ ছিল, যে চেয়েছিল এটিকে গোপনে চালু রাখতে।” অনিকেত জিজ্ঞাসা করলেন, “কে?” কর্নেল উত্তর দিলেন না, বরং হঠাৎ কণ্ঠ দৃঢ় করে বললেন, “যদি আমি তোমাদের সাহায্য করি, তবে তোমাদের ফিরে যাওয়ার পথ থাকবে না।” তাঁর চোখের দৃষ্টি কঠোর, কিন্তু তার গভীরে চাপা ভয়ের ছায়া স্পষ্ট—যেন তিনি জানেন, ঘোস্ট অপারেটর শুধু অতীতের কোনো শত্রু নয়, বরং এমন কেউ, যে তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ নজর রাখছে। পাহাড়ি বাতাসে পাইনগাছের শব্দ মিলিয়ে গেল সেই নীরবতায়, আর অনিকেত অনুভব করলেন—তাদের তদন্ত এখন এমন এক পর্যায়ে ঢুকে গেছে, যেখান থেকে ফিরে আসা হয়তো আর সম্ভব হবে না।

পাঁচ

সেই রাতটা ছিল পাহাড়ে অস্বাভাবিক নীরব। কুয়াশা নামছিল ধীরে ধীরে, আর দূরের বনে কোথাও এক-দুটি নিশাচর পাখির ডাক শোনা যাচ্ছিল। অনিকেত ও লীনা কর্নেল রণদীপের বাড়ির ভেতরে বসে সম্ভাব্য পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করছিলেন। কর্নেল খুব কম কথা বলছিলেন, কিন্তু তাঁর চোখে স্পষ্ট ছিল, তিনি নিজের মনে কিছু হিসাব কষছেন। হঠাৎ অনিকেতের টিমের সিকিউর মিলিটারি কমিউনিকেশন ডিভাইসটি হালকা শব্দ করে বীপ দিতে শুরু করল। এটি কেবল এনক্রিপ্টেড নেটওয়ার্কে কাজ করে—সেখানে প্রবেশ করা প্রায় অসম্ভব। তবু স্ক্রিনে ভেসে উঠল এক অচেনা কোড, তারপর স্ট্যাটিক নয়েজ, আর মুহূর্তের মধ্যে ভেসে এল এক বিকৃত, শীতল কণ্ঠ, যেন ধাতব ফিসফিস, “তোমরা যা খুঁজছো, তা নেই।” কণ্ঠটি তেমন জোরে ছিল না, কিন্তু প্রতিটি শব্দে এক অদ্ভুত ভারী চাপ অনুভূত হচ্ছিল, যেন অদৃশ্য কেউ ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে। অনিকেত চোখে-চোখে ইঙ্গিত দিলেন লীনাকে রেকর্ড করতে, কিন্তু কণ্ঠ থেমে যাওয়ার সাথে সাথে ডিভাইসটি হঠাৎ অফ হয়ে গেল, যেন কোনো অদৃশ্য হাত সংযোগ কেটে দিয়েছে।

লীনা তৎক্ষণাৎ ল্যাপটপ খুলে রিসিভড সিগন্যালের লগ চেক করতে লাগল। তার আঙুল দ্রুত কীবোর্ডে নাচছিল, আর চোখে এক ধরনের টানটান উত্তেজনা। কয়েক মিনিটের মধ্যে সে বলল, “এটা সাধারণ রেডিও ইন্টারসেপ্ট নয়—এটি হাই-লেভেল এনক্রিপ্টেড সিগন্যাল, যা সরাসরি স্যাটেলাইট লিঙ্ক থেকে এসেছে। মানে… যে এটা পাঠিয়েছে, সে পৃথিবীর যে কোনো জায়গা থেকে কাজ করতে পারে, কিন্তু মিলিটারি-গ্রেড চ্যানেলে প্রবেশ করার ক্ষমতা তার আছে।” কর্নেল রণদীপ ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন, “আমি জানতাম… ও ফিরে এসেছে।” অনিকেত কৌতূহলী চোখে তাকালেন, “কে?” কর্নেল ঠোঁট চেপে চুপ রইলেন, যেন নাম উচ্চারণ করলেই কেউ শুনে ফেলবে। লীনা স্ক্রিনে সিগন্যাল প্যাটার্ন জুম করে দেখাল—একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গের পুনরাবৃত্তি, যা মিলিয়ে দেয় ঘোস্ট কল সিগন্যালের মতো পুরনো সামরিক প্রটোকল। সে বলল, “এটিই প্রথমবার কেউ সরাসরি আমাদের সাথে যোগাযোগ করল, কিন্তু এমনভাবে যে ট্র্যাক করা অসম্ভব।”

পরদিন সকালেই পুরো টিম এই কণ্ঠকে একটি নাম দিল—“ঘোস্ট অপারেটর”। নামটি ছড়িয়ে পড়ল টিমের অভ্যন্তরে যেন কোনো ছায়া তাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কর্নেল বললেন, “ও এমনভাবে কাজ করে যে অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না। প্রতিটি বার্তা এক ধরনের ধাঁধা, আর এর পেছনে থাকে একধরনের মানসিক খেলা। ও জানে তোমরা কোথায় আছো, কী করছো—এবং কখন থামাতে হবে।” অনিকেত মনে মনে উপলব্ধি করলেন, এই শত্রু শুধু প্রযুক্তিতে নয়, মনস্তাত্ত্বিক লড়াইতেও অতুলনীয়। লীনা তখন সিগন্যাল প্যাটার্ন ডিকোড করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু প্রতিবারই নতুন নতুন এনক্রিপশন ভেঙে বেরিয়ে আসছিল, যেন ঘোস্ট অপারেটর আগেই জানে, তারা কীভাবে তাকে ধরতে চাইছে। পাহাড়ি রাতের সেই কণ্ঠ এখন তাদের মনে একটি স্থায়ী প্রতিধ্বনি হয়ে রইল—অদৃশ্য, অথচ উপস্থিত; অস্তিত্বহীন, অথচ প্রাণঘাতী। আর অনিকেত বুঝতে পারলেন, তাদের শিকার এখন এমন এক ছায়া, যে দেখতে পাওয়ার আগেই আঘাত হানতে পারে।

ছয়

আরব বসু কয়েকদিন ধরে কলকাতার আন্ডারগ্রাউন্ড তথ্য নেটওয়ার্ক ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, এমন সব সূত্রের খোঁজে যারা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত বা প্রযুক্তি সংক্রান্ত প্রকল্পে কাজ করেছেন। বেশিরভাগ দরজা তাঁর সামনে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু এক রাতে, শিয়ালদার পুরনো এক চা দোকানের পেছনের ঘরে বসে তিনি এক বয়স্ক তথ্যদাতার কাছ থেকে শুনলেন একটি নাম—”ঘোস্ট প্রোটোকল”। নামটি শোনার সাথে সাথেই তাঁর মনে হল এটি কোনো চলচ্চিত্রের নয়, বরং বাস্তবের এক গোপন সামরিক অভিযান। সেই বৃদ্ধ ফিসফিস করে বললেন, “দশ বছর আগে… এক প্রকল্প ছিল, যা জনসমক্ষে কখনও আসেনি। তারা এমন ড্রোন বানাচ্ছিল, যা মানুষের সিদ্ধান্ত ছাড়াই যুদ্ধক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।” আরব নোটপ্যাডে লিখতে শুরু করলেন, কিন্তু বৃদ্ধ হাত তুলে ইঙ্গিত করলেন—“সব লিখে রেখো না, ছেলে। এই নামটিই বিপদ ডেকে আনতে পারে।” এরপর তিনি শুধু একটি পুরনো পেনড্রাইভ আরবের হাতে দিয়ে বললেন, “এটুকুই আমার কাছে আছে, আর বাকি জানার জন্য তোমাকে নিজে খুঁজতে হবে।”

পেনড্রাইভ খুলতেই আরব দেখলেন ফাইলগুলোর বেশিরভাগ এনক্রিপ্টেড, কিন্তু একটি ভিডিও খোলা যায়। ফুটেজে দেখা গেল একটি পরীক্ষামূলক যুদ্ধক্ষেত্র—মরুভূমির মাঝখানে চার-পাঁচটি এআই-নিয়ন্ত্রিত ড্রোন দ্রুত নড়াচড়া করছে, শত্রুর অবস্থান শনাক্ত করে বিদ্যুৎগতিতে আক্রমণ করছে। একটি ড্রোনের উপরে লেখা “X-9 Ghost”। ভিডিও শেষ হওয়ার আগে এক ঝলক দেখা গেল একটি ফিল্ড কমান্ডারকে, যিনি সরাসরি মাঠের ভেতর থেকে অপারেশন পর্যবেক্ষণ করছেন—এবং তাঁর মুখ একেবারেই চেনা… কর্নেল রণদীপ সেন। আরব স্তব্ধ হয়ে গেলেন; কর্নেল যে শুধু প্রকল্পের সাথে যুক্ত ছিলেন তাই নয়, তিনি এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী ফাইলগুলিতে উল্লেখ ছিল, এই প্রকল্প কয়েক মাস পর হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা ছাড়াই। ডকুমেন্টে আরও একটি ভয়ঙ্কর তথ্য উঠে এল—প্রকল্পের সাথে যুক্ত অন্তত পাঁচজন বিজ্ঞানী এবং দুইজন প্রযুক্তি কর্মকর্তা নিখোঁজ হয়ে যান, তাদের খোঁজ আর পাওয়া যায়নি। ফাইলগুলিতে কোথাও কোথাও “মিসিং ইন অ্যাকশন” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যা সাধারণত সামরিক যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।

আরব অবাক হলেন যে “ঘোস্ট প্রোটোকল” শুধু প্রযুক্তিগত পরীক্ষা নয়, বরং এক ধরনের গুপ্ত সামরিক ষড়যন্ত্রের আড়াল হতে পারে। তাঁর মনে প্রশ্ন জাগল—প্রকল্পটি কেন বন্ধ করা হলো? নিখোঁজ বিজ্ঞানীরা কি এই প্রযুক্তি নিজেদের হাতে নিয়ে ফেলেছিলেন, নাকি কাউকে বিক্রি করেছিলেন? আর যদি ঘোস্ট অপারেটর সত্যিই এই প্রকল্পেরই উত্তরসূরি হয়, তাহলে সে সম্ভবত সেই হারিয়ে যাওয়া দল বা তাদের উত্তরাধিকার। আরব এই তথ্য নিয়ে কর্নেলের মুখোমুখি হলে, রণদীপ দীর্ঘক্ষণ নীরব রইলেন, তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “ঘোস্ট প্রোটোকল ছিল এক দুঃস্বপ্ন, যা আমরা নিজেরাই ডেকে এনেছিলাম। আমি ফিল্ড কমান্ডার ছিলাম, কিন্তু বিশ্বাস করতাম আমরা শুধু দেশরক্ষার জন্য কাজ করছি। পরে বুঝলাম, আমাদের তৈরি জিনিস কারও ব্যক্তিগত ক্ষমতার খেলায় পরিণত হয়েছে।” কর্নেলের চোখে অপরাধবোধের ছাপ স্পষ্ট ছিল, কিন্তু তাঁর কণ্ঠে ভয়ও ছিল—যেন তিনি জানেন, অতীতের সেই ছায়া এখনো জীবিত, এবং যে কোনো মুহূর্তে তাদের দিকে হাত বাড়াতে পারে। আরব বুঝলেন, তাঁদের শত্রু কেবল একজন সন্ত্রাসী নয়—সে এক পুরনো সামরিক গোপন মিশনের অদৃশ্য উত্তরাধিকারী, যার হাতে আছে সীমাহীন প্রযুক্তি ও অদম্য প্রতিশোধস্পৃহা।

সাত

গভীর রাতের আলো-আঁধারিতে অনিকেত কর্নেল সেনের সঙ্গে বসেছিলেন তাঁর পাহাড়ি বাড়ির পুরনো কাঠের টেবিলে। লীনা পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে সব শুনছিলেন। অনিকেতের হাতে ছিল আরব বসুর দেওয়া নতুন রিপোর্ট, যেখানে স্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে—ঘোস্ট প্রোটোকলের আসল মাস্টারমাইন্ড কর্নেল নন। সেই ফাইলের মধ্যে ছিল একটি সামরিক মৃত্যুসনদের কপি, যেখানে প্রকল্পের প্রধান ইঞ্জিনিয়ার অর্ণব মুখোপাধ্যায়-এর মৃত্যু নথিভুক্ত ছিল দশ বছর আগে এক বিস্ফোরণে। কিন্তু রিপোর্টে দেখা গেল, মৃত্যুর পরবর্তী বছরগুলোতে কিছু সিকিউরিটি ফুটেজ, স্যাটেলাইট ইমেজ, এবং কালোবাজারি প্রযুক্তি লেনদেনের রেকর্ডে এক ছায়ামূর্তি বারবার দেখা গেছে—যা অর্ণবের সঙ্গে মিলে যায় অবিকল। অনিকেত কণ্ঠ নিচু করে বললেন, “আপনি এতদিন ধরে ঘোস্ট অপারেটরের ছায়া এড়াতে চেয়েছেন, কিন্তু আসলে সেই ছায়া আপনার প্রাক্তন সহকর্মীর।” কর্নেলের মুখে যেন বহু বছরের বোঝা ভেঙে পড়ল। তিনি ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন, “অর্ণব… আমি ভেবেছিলাম বিস্ফোরণে ও মারা গেছে। কিন্তু সত্যি কথা হল, ওই বিস্ফোরণটাই ছিল ওর নিজের সাজানো নাটক।”

কর্নেল বলতে শুরু করলেন সেই দিনের ঘটনা—প্রকল্পের শেষ পর্যায়ের পরীক্ষার সময় হঠাৎ একটি নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ ঘটে, যা পুরো ল্যাব ধ্বংস করে দেয়। সবাই ভেবেছিল অর্ণব মারা গেছে, কিন্তু কর্নেলের সন্দেহ ছিল, কারণ বিস্ফোরণের আগে অর্ণব প্রজেক্ট সার্ভার থেকে পুরো এআই কোর চুরি করে নিয়েছিল। “ও সবসময় বিশ্বাস করত, মানুষের হাতে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত থাকা উচিত নয়—যন্ত্রই সিদ্ধান্ত নেবে, কারণ যন্ত্রের বিচার ঠান্ডা, অনুভূতিহীন। কিন্তু আমি বলেছিলাম, এরকম ক্ষমতা একদিন ভুল হাতে গেলে পৃথিবীকে ধ্বংস করবে।” কর্নেলের কণ্ঠে অনুতাপ ছিল। লীনা তখন পর্যন্ত চুপ ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ করেই তাঁর চোখে এক অদ্ভুত শীতলতা নেমে এল। তিনি ধীরে ধীরে বললেন, “অর্ণব মুখোপাধ্যায়… আমার ভাইয়ের হত্যাকারী।” অনিকেত বিস্মিত হয়ে তাঁর দিকে তাকালেন। লীনা ব্যাখ্যা করলেন, কয়েক বছর আগে তাঁর ভাই সাইবার সিকিউরিটি ফোর্সে কাজ করতেন এবং একদিন হঠাৎ নিখোঁজ হন। পরে জানা যায়, একটি ড্রোন হামলায় তিনি মারা যান। লীনার বিশ্বাস ছিল, হামলাটি একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং পরীক্ষামূলক প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিচালিত হত্যা—আজ সেই সন্দেহ নির্দিষ্ট রূপ নিল।

ঘরের ভেতরের বাতাস হঠাৎ ভারী হয়ে উঠল। অনিকেত বুঝলেন, তাদের মিশন এখন শুধু একটি সন্ত্রাসীকে থামানো নয়, বরং ব্যক্তিগত প্রতিশোধের আগুনও এতে মিশে গেছে। কর্নেল সোজাসাপ্টা বললেন, “অর্ণব একাই এই অপারেশন চালাচ্ছে না। সে পুরনো ঘোস্ট প্রোটোকল নেটওয়ার্ক সক্রিয় করেছে, যা পৃথিবীর যে কোনো জায়গা থেকে ড্রোন নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম।” তিনি আরও জানালেন, প্রকল্পের ড্রোনগুলো একবার সক্রিয় হলে সেগুলোকে ট্র্যাক করা যায় না, কারণ প্রতিটি ডিভাইস নিজস্ব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে রুট পরিবর্তন করতে সক্ষম। লীনা দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “তাহলে এবার সময় এসেছে ওকে থামানোর—স্থায়ীভাবে।” অনিকেত চুপচাপ তাঁদের দুজনের মুখের দিকে তাকালেন। তিনি জানতেন, সামনে যা আসছে, তা হবে সরাসরি মস্তিষ্ক বনাম মেশিনের লড়াই, এবং এতে শুধু প্রযুক্তি নয়, আবেগও সমানভাবে ভূমিকা রাখবে। আরব তখন দূর থেকে আসা খবর পাঠালেন—অর্ণবের পরবর্তী হামলার টার্গেট সম্ভবত একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। সময় ফুরিয়ে আসছিল, আর তারা জানত, এবার ভুলের সুযোগ নেই।

আট

অনিকেতের টিম সারারাত ধরে বিভিন্ন ডিজিটাল নেটওয়ার্ক স্ক্যান করছিল, অর্ণবের যোগাযোগের সূত্র খুঁজতে। ভোররাতের দিকে লীনা হঠাৎ এক সিগন্যাল ট্র্যাক করেন—এটি ছিল একটি গভীরভাবে এনক্রিপ্টেড ডেটা প্যাকেট, যা কোনো সামরিক স্যাটেলাইট চ্যানেল ব্যবহার করে প্রেরণ করা হয়েছে। সাইবার ফরেনসিক টুল দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেষ্টা করার পর তারা অবশেষে আংশিক ডিক্রিপ্ট করতে সক্ষম হয়। ফাইলটির শিরোনাম ছিল “Directive-X: Termination Queue”। এর ভেতরে একটি তালিকা—১৫টি নাম, প্রত্যেকের পাশে ছবিসহ সংক্ষিপ্ত বায়োডাটা। নামগুলো পড়তে পড়তে অনিকেতের ভ্রু কুঁচকে গেল; তালিকার প্রথমেই ছিল সেই শিল্পপতির নাম, যিনি পার্ক স্ট্রিট হামলায় নিহত হয়েছিলেন। দ্বিতীয়জন, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, যিনি সকালবেলার ড্রোন হামলায় মারা গেছেন। বাকি নামগুলোও কম ভয়ংকর নয়—প্রাক্তন সামরিক কমান্ডার, প্রভাবশালী শিল্পপতি, কিছু উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, এবং এমনকি একজন প্রাক্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। তাদের সবার একটি মিল আছে—তারা সবাই ঘোস্ট প্রোটোকল মিশনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন।

কর্নেল সেন তালিকাটি দেখে হঠাৎ খুব চুপ হয়ে গেলেন। অনিকেত তাঁর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি এই মানুষগুলোকে চেনেন?” কর্নেল ধীরে মাথা নাড়লেন, “এরা সবাই সেই চুক্তিতে সই করেছিল… যেদিন প্রকল্প বন্ধ করা হয়, সেদিন আমাদের সবাইকে একটি গোপন ডকুমেন্টে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়। বলা হয়েছিল, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে প্রকল্পের সব তথ্য চিরতরে গোপন রাখা হবে। কিন্তু অর্ণব কখনোই সেই চুক্তিকে মেনে নেয়নি। ও বিশ্বাস করত, আমাদের প্রত্যেককে এর ফলাফলের জন্য দায়ী হতে হবে—প্রাণ দিয়ে হলেও।” লীনা কণ্ঠে চাপা রাগ নিয়ে বললেন, “মানে, ও শুধু প্রতিশোধ নিচ্ছে না, ও নিজের বিকৃত ন্যায়বিচার কায়েম করছে।” কর্নেল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ঠিক তাই। অর্ণবের কাছে এই তালিকা শুধু নামের নয়, রায় ঘোষণার তালিকা।”

অনিকেত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন—তালিকার বাকিদের বাঁচাতে হলে তাদের অবিলম্বে সুরক্ষা দিতে হবে। কিন্তু সমস্যা হল, নামগুলো ছড়িয়ে আছে সারা শহর এবং আশপাশের জেলায়। তারও বড় সমস্যা, অর্ণবের ড্রোন একবার আকাশে উঠলে সেটি থামানো বা ট্র্যাক করা প্রায় অসম্ভব। লীনা বললেন, “আমাদের আগে থেকে তার হামলার ধরন ও সময় আন্দাজ করতে হবে, নইলে আমরা শুধু মৃতদেহ গুনব।” আরব, যিনি বাইরে থেকে তথ্য জোগাড় করছিলেন, জানালেন যে কয়েকটি নাম ইতিমধ্যেই শহর ছাড়তে শুরু করেছে, কিন্তু তবুও তারা নিরাপদ নয়—ড্রোনগুলো দূর থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টার্গেট শনাক্ত করতে পারে। অনিকেত কর্নেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি অর্ণবকে সবচেয়ে ভালো চেনেন। তার পরবর্তী টার্গেট কে হতে পারে?” কর্নেলের মুখে এক মুহূর্ত দ্বিধা দেখা দিল, তারপর তিনি নিচু স্বরে বললেন, “সম্ভবত… আমার নামও এই তালিকায় আছে।” ঘরের ভেতর নীরবতা নেমে এল, সবাই জানত—এবার শিকার এবং শিকারী একই খেলার বোর্ডে দাঁড়িয়ে গেছে।

নয়

নদীর ধারে পুরনো, ভগ্নপ্রায় ওয়্যারহাউসটিকে বাইরে থেকে দেখলে মনে হতো বহু বছর ধরে অচল পড়ে আছে—জং ধরা লোহার দরজা, ভাঙা জানালা, আর ঘাসে ঢেকে যাওয়া প্রবেশপথ। কিন্তু কর্নেল সেনের সামরিক অভিজ্ঞতা বলছিল, ভেতরে কিছু চলছে। রাতের আঁধারে, টর্চের হালকা আলো ও নীরবতার ভেতর দিয়ে অনিকেত, লীনা, কর্নেল এবং আরব ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করলেন। প্রথমেই তাঁদের চোখে পড়ল—দূরের দেয়ালে সারিবদ্ধভাবে বসানো বিশাল স্ক্রিন, প্রতিটিতে শহরের বিভিন্ন এলাকা ও টার্গেটের লাইভ ফিড চলছে। স্ক্রিনগুলোর সামনে একটি কন্ট্রোল প্যানেল, যেখান থেকে একাধিক ড্রোনের ফ্লাইট রুট, টার্গেটিং সিস্টেম এবং কমান্ড স্ক্রিপ্ট একসাথে পরিচালিত হচ্ছে। লীনা চুপিচুপি প্যানেলের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, “এই সিগন্যাল প্যাটার্নটা দেখো… এটা স্যাটেলাইট রিলে থেকে সরাসরি আসছে।” কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে, ছাদের ভেতর থেকে একটি হাই-পিচ শব্দ ভেসে এল—যেন ধাতুর ব্লেড বাতাস চিরে এগিয়ে আসছে।

পরবর্তী কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ছায়ার ভেতর থেকে তিনটি সিকিউরিটি ড্রোন বেরিয়ে এল—প্রতিটির সাথে ছিল দ্রুত ঘূর্ণায়মান ব্লেড, উচ্চক্ষমতার টেজার, আর ইনফ্রারেড সেন্সর। অনিকেত দ্রুত কভার নিয়ে পিস্তল বের করলেন, কর্নেল সেন সামরিক ভঙ্গিতে সঠিক কোণে গুলি চালালেন। লীনা সাথে সাথে কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে ছুটে গিয়ে চেষ্টা করলেন সিস্টেমে হ্যাক করতে, যাতে ড্রোনগুলোকে বন্ধ করা যায়। কিন্তু প্রোগ্রামটি লক করা ছিল মাল্টি-লেয়ার এনক্রিপশনে, যা রিয়েল-টাইমে ভাঙা প্রায় অসম্ভব। আরব তখন পাশের একটি ধাতব পাইপ তুলে একটি ড্রোনের রোটরে আঘাত করলেন, সেটি জোরে কেঁপে মাটিতে পড়ে বিস্ফোরিত হলো। বাকি দুই ড্রোন আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠল—একটি কর্নেলের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল, অন্যটি সোজা লীনার দিকে। অনিকেত ঝুঁকি নিয়ে লীনার সামনে দাঁড়িয়ে গুলি চালালেন, ড্রোনটি মাঝআকাশে স্পার্ক ছড়িয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ল। কিন্তু কর্নেলের সাথে লড়তে থাকা ড্রোনটিকে থামাতে তিনজনেরই লাগল সম্মিলিত প্রচেষ্টা—পাইপ, গুলি আর একটি বড় কাঠের বাক্স ব্যবহার করে সেটিকে শেষমেশ ধ্বংস করা গেল।

ড্রোনগুলো ধ্বংস হতেই ভেতরে এক মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে এল। সবাই শ্বাস ফেলছিল ভারীভাবে, কিন্তু লীনার হাত তখনও কীবোর্ডে নাচছিল। “আমাদের হাতে খুব কম সময় আছে,” সে বলল, “এই সিস্টেম থেকে আমি কেবলমাত্র আংশিক লোকেশন ট্রেস করতে পেরেছি—এটি মূলত একটি রিমোট কন্ট্রোল হাব, আর আসল কোর সার্ভার অন্য জায়গায়।” স্ক্রিনে শহরের মানচিত্র ফুটে উঠল, কয়েকটি লাল বিন্দু ঝিকমিক করছে—যেখান থেকে ড্রোনগুলো অপারেট করা হচ্ছে। কর্নেল ধীরে বললেন, “মানে আমরা এখনও ঘোস্ট অপারেটরের আসল আস্তানায় পৌঁছাইনি।” কিন্তু হঠাৎ করেই স্পিকারের মাধ্যমে একটি বিকৃত কণ্ঠ ভেসে এল—অর্ণবের ঠান্ডা, ব্যঙ্গমিশ্রিত কণ্ঠ, “তোমরা ভেবেছো, আমাকে এখানে পাবে? এটা তো শুধু খেলার প্রথম ধাপ।” এর পর স্ক্রিনে ড্রোনের নতুন একদল সক্রিয় হওয়ার ফুটেজ দেখা গেল, আর মানচিত্রে লাল বিন্দুগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। অনিকেত বুঝলেন—এখন শুধু শত্রুর পিছু নেওয়ার সময় নয়, বরং তার খেলা উল্টে দেওয়ার সময়।

দশ

ড্রোন ধ্বংসের পরেও ওয়্যারহাউসের ভেতর অস্বাভাবিক নীরবতা বিরাজ করছিল, কিন্তু লীনার মনে হচ্ছিল কিছু একটা এখনো ঠিক মিলছে না। হ্যাকিং লগ ও সিগন্যাল লেটেন্সি ডেটা বিশ্লেষণ করতে করতে সে হঠাৎ খেয়াল করল—প্রধান কন্ট্রোল সিগন্যালের টাইমস্ট্যাম্পের সাথে স্যাটেলাইট রিলের কোনো ল্যাগ নেই। মানে, অপারেটর রিমোট লোকেশন থেকে নয়, বরং সরাসরি এই সিস্টেমের ফিজিক্যাল কোরে সংযুক্ত। লীনার শ্বাস ভারী হয়ে এল, তার চোখ স্ক্রিন থেকে সরে গিয়ে অন্ধকার কোণের দিকে স্থির হলো। সে ধীরে ধীরে ইশারা করল অনিকেত ও কর্নেলের দিকে, আর সবাই অস্ত্র তুলে সেই দিকে এগোল। ধুলায় ভরা একটি স্টোরেজ এরিয়ার দরজা ঠেলে খোলার সাথে সাথে ভেতরের আলো জ্বলে উঠল—আর সেখানে বসে আছে একজন মানুষ, ধাতব কনসোলের সামনে, চোখে হেড-মাউন্টেড ডিসপ্লে। লীনার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল—এ তো অর্ণব দত্ত, তার প্রাক্তন সহকর্মী, সেই “প্রজেক্ট হেড” যাকে তারা বহু বছর আগে মৃত বলে মনে করেছিল।

অর্ণব ধীরে হেডসেট খুলে তাকাল, ঠোঁটে এক ঠান্ডা হাসি। “তোমরা শেষমেশ এসেছো,” সে বলল, যেন বহুদিনের প্রতীক্ষিত অতিথি এসেছে। অনিকেত বন্দুক উঁচিয়ে বললেন, “সব শেষ, অর্ণব। তোমার ড্রোন খুন বন্ধ হবে এখানেই।” কিন্তু অর্ণব শান্তভাবে মাথা নাড়ল, “তোমরা বোঝো না… তারা আমাকে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। ‘ঘোস্ট প্রোটোকল’ বন্ধ হওয়ার রাতে, আমি একা থেকে গিয়েছিলাম প্রকল্পের সব দায় কাঁধে নিয়ে। কর্নেল, আপনি তখন আপনার মানুষ বাঁচাচ্ছিলেন, কিন্তু আমাকে মরার জন্য ছেড়ে গিয়েছিলেন।” কর্নেলের চোখে তীব্র আঘাতের ছাপ ফুটে উঠল। লীনা কণ্ঠে কাঁপুনি নিয়ে বলল, “তুমি লোকে হত্যা করে ন্যায়বিচার করছো বলে ভাবছো? ওরা সবাই তোমার শত্রু ছিল না।” অর্ণবের ঠোঁট বাঁকা হয়ে গেল, “ন্যায়বিচার নয়… হিসাব। কেউই এই রক্তের দাগ থেকে মুক্ত নয়।” এর মধ্যে স্ক্রিনে আবার কিছু ড্রোনের সিস্টেম অনলাইনে ফিরে আসতে শুরু করল, প্রমাণ করে যে অর্ণব শেষ মুহূর্তেও খেলা চালিয়ে যাচ্ছে।

কর্নেল সেন তখন আর অপেক্ষা করলেন না। “তুমি ইতিমধ্যেই অনেক দূর চলে গেছো, অর্ণব,” তিনি বললেন, আর চোখে কোনো দ্বিধা ছাড়াই ট্রিগার টিপলেন। গুলির শব্দ ওয়্যারহাউসের ভেতরে প্রতিধ্বনিত হলো, আর অর্ণব মাটিতে পড়ে গেল, ঠোঁটে শেষ হাসি নিয়ে। কিন্তু মৃত্যুর আগে সে নিচু স্বরে বলল, “আমার মত আর একজন আছে… যার নামও তোমরা জানো না।” এই কথায় চারজনের শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেল—মানে পুরো সত্য এখনো উন্মোচিত হয়নি, আর খেলা শেষও হয়নি। বাইরে ভোরের আলো ফুঁটে উঠছিল, কিন্তু শহরের আকাশে সেই আলো এখনো নিঃশঙ্ক নয়। ড্রোন খুনির গল্প শেষ হলেও, নতুন এক ছায়া, অদৃশ্য এক অপারেটরের অস্তিত্ব, আরও একবার মৃত্যু ও ষড়যন্ত্রের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অপেক্ষা করছিল ভবিষ্যতের কোনো অদৃশ্য আঘাতের জন্য।

____

1000052849.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *