অন্বেষা চক্রবর্তী
১
শীতের ভোরের কুয়াশা তখনও পুরোপুরি কাটেনি, তবুও গ্রামমাঠে মানুষের ঢল নেমেছে। চারদিক যেন উৎসবের রঙে ভরে আছে—কেউ খেজুর গাছ থেকে রস নামাচ্ছে, কেউ মাটির হাড়িতে গরম পিঠে সাজাচ্ছে, আর দূরে বাঁশের মাচায় বসে বাউলরা প্রস্তুত হচ্ছে দিনের প্রথম গানের জন্য। রুদ্র পাল, পাতলা গড়নের, গভীর কালো চোখের এক তরুণ, সেই মাচার এক কোণে বসে ধীর হাতে একতারার তার টানটান করছে। লাল মাটির ধুলোয় ভিজে থাকা তার পায়ে কোনো জুতো নেই, কিন্তু চোখে এমন এক দীপ্তি, যেন ভিড়ের প্রতিটি মানুষকে সে গানের মধ্য দিয়ে স্পর্শ করবে। রুদ্রর জন্ম এই গ্রামেই—শৈশবে বাবার কণ্ঠে বাউল গান শুনে বড় হয়েছে, আর দাদুর কাছ থেকে শিখেছে কীভাবে সুর দিয়ে হৃদয় জয় করা যায়। আজকের দিনটি তার জন্য বিশেষ, কারণ এই মেলায় আশেপাশের বহু গ্রাম থেকে মানুষ এসেছে, এমনকি শহর থেকেও কয়েকজন অতিথি এসেছে শুনতে, আর রুদ্রর মনে কোথাও এক লুকোনো আশা—হয়তো কেউ তার গানের কথা শহরে নিয়ে যাবে, আর সে মাটির সুর শহরের বাইরে পৌঁছে দিতে পারবে।
সকালের প্রথম আলোয় যখন রুদ্র মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়াল, তখনো ভিড়ের গুঞ্জন চলছিল, কিন্তু একতারার প্রথম ঝংকারে যেন পুরো মাঠ থমকে গেল। তার গলায় ভেসে উঠল সেই চিরচেনা সুর—”মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি…”—যা গ্রামের বৃদ্ধরা ঠোঁট নাড়িয়ে গাইতে লাগল, আর শিশুদের চোখে পড়ল এক নতুন বিস্ময়ের ঝিলিক। রুদ্র গাইতে গাইতে চারপাশে তাকাল—মাঠের এক কোণে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধা চোখ মুছছে, কয়েকজন তরুণ তালে তালে হাততালি দিচ্ছে, আর সামনের সারিতে বসে এক শহুরে মহিলার চোখে কৌতূহল ও মুগ্ধতার মিশ্রণ। প্রতিটি লাইনে রুদ্র যেন নিজের প্রাণ ঢেলে দিচ্ছে, যেন সুরের মধ্যেই তার জীবনধারা, সংগ্রাম, আর স্বপ্ন একাকার হয়ে গেছে। তার মনে হয়, এই মুহূর্তটাই সত্যি, বাকিটা সব ক্ষণস্থায়ী—কিন্তু তারপরই মনে পড়ে যায়, গানের বাইরে তার জীবন কত অনিশ্চিত। তবুও এই মুহূর্তে সে শুধু একতারা, কণ্ঠ, আর ভিড়ের উষ্ণতার মধ্যে ডুবে যায়, আর মনে হয়—যদি কোনোদিন এই মাটির সুর বিশ্বজুড়ে পৌঁছে দিতে পারে, তবে জীবন সার্থক হবে।
গান শেষ হলে মাঠে হাততালির ঢেউ বয়ে যায়, কেউ কেউ এগিয়ে এসে তাকে মাটির মুদ্রা, পিঠে, বা গরম চায়ের কাপ হাতে দেয়। রুদ্র হাসিমুখে সবার শুভেচ্ছা গ্রহণ করে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার হৃদয়ে এক ধরনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা দানা বাঁধে—এই লাল মাটি, খোলা আকাশ, গাছের পাতায় বাতাসের শিস, সবকিছুই তার প্রাণের অংশ, কিন্তু এই সীমার বাইরে যে পৃথিবী, সেখানে কি তার জন্য কোনো জায়গা আছে? গ্রামের মঞ্চে তার সুর মানুষকে মুগ্ধ করতে পারে, কিন্তু শহরে, এমনকি দেশের বাইরে কি কেউ শুনবে এই একতারার শব্দ? ভিড়ের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে হঠাৎ আকাশের দিকে তাকায়—নীল আকাশের ওপারে অচেনা দিগন্ত যেন তাকে ডাকছে। সেদিন মেলার গন্ধ, মানুষের উষ্ণতা, আর একতারার সুর মিলেমিশে রুদ্রর মনে বুনে দেয় এক অদ্ভুত স্বপ্নের বীজ, যা হয়তো কয়েক মাস পর এক অচেনা ইমেলের মাধ্যমে অঙ্কুরিত হবে।
২
শীতের শেষে যুক্তরাষ্ট্রের সেই ছোট্ট শহরে রাত যেন আরও নীরব হয়ে যায়। বাইরে তুষারের সাদা চাদরে রাস্তা ঢেকে আছে, মাঝে মাঝে দূরে কোনো গাড়ি ধীরে চলে গেলে সেই শব্দ ভেসে আসে জানালার কাচ পেরিয়ে। অনন্যা দত্ত নিজের অ্যাপার্টমেন্টের ডেস্কে বসে শেষ মুহূর্তের অফিস রিপোর্ট টাইপ করছে—টাইম জোনের পার্থক্যের জন্য তাকে মাঝরাত পর্যন্ত জেগে থাকতে হয় প্রায়ই। চারপাশে নীরবতা, কেবল ল্যাপটপের কীবোর্ডের শব্দ আর মাঝে মাঝে হিটার চালু হওয়ার হালকা গুঞ্জন। তার কফির কাপ অনেকক্ষণ আগে ঠান্ডা হয়ে গেছে, কিন্তু সে চুমুক দেয় অভ্যাসবশত, যেন ক্লান্তি আর একাকীত্বের মাঝেও নিজেকে ধরে রাখতে পারে। এই শহরে আসার পর পাঁচ বছর কেটে গেছে—ভালো চাকরি, আর্থিক নিরাপত্তা, আর নির্দিষ্ট ছন্দে বাঁধা জীবন—সবই আছে, তবুও কোথাও একটা শূন্যতা রয়ে গেছে, যা তাকে মাঝেমধ্যেই টেনে নিয়ে যায় দূরদেশের গন্ধ, শব্দ আর স্মৃতির দিকে।
রিপোর্ট শেষ করে সে ল্যাপটপে নতুন ট্যাব খুলে ইউটিউবে ঢোকে—শখের বশে এমনটাই করে প্রতিদিন রাতে, ঘুমানোর আগে কিছু গান শোনার জন্য। সাধারণত রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি বা কোনো পুরোনো বাংলা সিনেমার গান খোঁজে, কিন্তু সেদিন কী মনে করে সার্চ বক্সে লিখল ‘বাউল গান লাইভ’। ফলাফলের তালিকায় কয়েকটি ভিডিও ভেসে উঠল, তার মধ্যে একটি থাম্বনেলে দেখা গেল ধুলো-মাখা মঞ্চে দাঁড়ানো এক তরুণ, হাতে একতারা। ছবিটা দেখে কেন যেন থমকে গেল অনন্যা—মনে হলো ছবির চোখদুটো তার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন কোনো দূর অতীতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। কৌতূহলবশত সে ভিডিওতে ক্লিক করল। স্ক্রিনে ফুটে উঠল লাল মাটির গ্রামের এক খোলা মাঠ, আর মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ানো সেই তরুণ গাইছে এক মাটির সুর—“মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি…”। অনন্যা প্রথম ঝংকারেই বুঝতে পারল, এই সুর অন্যরকম—এখানে শহুরে পরিশুদ্ধতা নেই, আছে ধুলো, গন্ধ, আর এমন এক সরলতা যা সোজা হৃদয়ে গিয়ে লাগে। সে চোখ বন্ধ করে শুনতে লাগল, যেন গানের ভেতর দিয়ে শৈশবের গরম দুপুর, গ্রামের পুকুরের ধারে খেলা, আর মাটির গন্ধে ভরা পাকা ধানের মৌসুম তার সামনে ফিরে আসছে।
গান শেষ হলে অনন্যা বুঝতে পারল, তার চোখের কোণে জল এসে গেছে। সে ভিডিওটির বিবরণ খুলে দেখল—গায়কের নাম রুদ্র পাল, বীরভূম, পশ্চিমবঙ্গ। চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা খুব বেশি নয়, কিন্তু মন্তব্যের ঘরে কেউ লিখেছে, “এই সুর শহরে পৌঁছানো দরকার।” অনন্যা হাসল—ঠিক সেই কথাটাই তো তার মনেও গুনগুন করছিল। সে ভিডিওটি রিপ্লে করে আবার শুনল, এবার আরও মনোযোগ দিয়ে, একতারার প্রতিটি টান, কণ্ঠের প্রতিটি কম্পন যেন তাকে অদৃশ্য সুতোয় বেঁধে ফেলছে। গান শেষ হতেই সে সিদ্ধান্ত নিল, এই মানুষটার কাছে তাকে কিছু লিখতেই হবে—শুধু প্রশংসা নয়, জানাতে হবে যে তার সুর হাজার মাইল দূরের একজন মানুষের মন ভরিয়ে দিয়েছে। সে চ্যানেলের লিঙ্ক কপি করে মিউজিক ব্লগের সার্চে নাম লিখল, আর কয়েক মিনিটের মধ্যে খুঁজে পেল রুদ্র পালের একটি প্রোফাইল, যেখানে যোগাযোগের জন্য একটি ইমেল দেওয়া আছে। স্ক্রিনের আলোয় তার মুখে এক ধরনের অদ্ভুত উজ্জ্বলতা ফুটে উঠল—যেন শীতের এই বরফঢাকা দেশে, সে হঠাৎই খুঁজে পেয়েছে নিজের মাটির গন্ধমাখা এক জানালা।
৩
অনন্যা অনেকক্ষণ ধরে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিল। রুদ্র পালের প্রোফাইলে দেওয়া সেই ইমেল ঠিকানাটা যেন তাকে ডাকছিল, কিন্তু আঙুল কীবোর্ডে রাখলেই এক অদ্ভুত দ্বিধা তাকে আটকে দিচ্ছিল। সে ভাবছিল—একজন সম্পূর্ণ অচেনা মানুষকে এভাবে হঠাৎ ইমেল পাঠানো কি ঠিক হবে? হয়তো সে বিরক্ত হবে, হয়তো উত্তর দেবে না। কিন্তু সেই রাতের গানের সুর, একতারার প্রথম ঝংকার, আর রুদ্রর গলায় লুকিয়ে থাকা মাটির গন্ধ যেন বারবার ফিরে এসে তাকে ধাক্কা দিচ্ছিল—“লিখো।” অবশেষে সে গভীর শ্বাস নিয়ে টাইপ করতে শুরু করল—“প্রিয় রুদ্র, আজ রাতে ইউটিউবে আপনার গান শুনলাম। অনেকদিন পর এমন সুর শুনে মনে হল যেন বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে আছি। আপনার কণ্ঠে মাটির গন্ধ আছে, যা এখানে হাজার মাইল দূর থেকেও অনুভব করা যায়। ধন্যবাদ এই সুর পৌঁছে দেওয়ার জন্য।” তারপর কিছুক্ষণ ভেবে, আর কোনো অতিরিক্ত কথা না লিখে, ‘Send’ বাটনে চাপ দিল। মেসেজ পাঠানোর পরও তার মন শান্ত হলো না—বরং কৌতূহল, প্রত্যাশা আর হালকা অস্বস্তি মিশে এক অদ্ভুত অনুভূতি বুকের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল।
অন্যদিকে, বীরভূমের গ্রামে তখন ভোরের আলো ফুটছে। রুদ্র রাতভর একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গান গেয়ে দেরিতে ফিরেছিল, তাই ঘুম কিছুটা ভাঙা ভাঙা। সকালে বাজারে যাওয়ার আগে মুঠোফোন হাতে নিয়ে সে মিউজিক ব্লগে ঢুকল—নতুন কোনো মন্তব্য আছে কিনা দেখতে। চোখে পড়তেই থমকে গেল—একজন ‘Ananya Dutta’ নামে বিদেশে থাকা মেয়ে তার গানের জন্য এমন প্রশংসা লিখেছে, যা আগে কেউ দেয়নি। রুদ্রর ভেতরে এক মুহূর্তে আনন্দ আর সন্দেহ একসাথে জন্ম নিল—বিদেশে বসে কেউ তার গান শুনছে, এটা কি সত্যিই সম্ভব? নাকি কেবল সৌজন্যমূলক কিছু কথা? তার ইন্টারনেট ব্যবহারের অভ্যাস খুব সীমিত, তাই মেসেজের উত্তরে কী লিখবে তা ভেবে থমকে গেল। প্রথমে মনে হলো উত্তর না দিলেই ভালো—কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। কিন্তু তারপর মনে পড়ল, গান গাওয়া তো শুধু নিজের জন্য নয়, শোনার মানুষের সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে তোলার জন্যও। অবশেষে সে ধীরে ধীরে টাইপ করল—“আপনার বার্তা পেয়ে খুব ভালো লাগল। আমি জানতাম না, আমার গান এত দূর পর্যন্ত পৌঁছেছে। ধন্যবাদ সময় নিয়ে শোনার জন্য। আশা করি ভালো থাকবেন।” সংক্ষিপ্ত, সরল উত্তর—কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার মন হালকা হয়ে গেল।
এইভাবেই অদ্ভুত এক সংযোগের শুরু হলো। অনন্যা তার ইনবক্সে রুদ্রর উত্তর দেখে বিস্মিত ও আনন্দিত হলো—ভেবেছিল হয়তো সে আর কোনোদিন শোনাবে না। দু’জনের প্রথম কথোপকথন খুব ছোট, কিন্তু সেই কয়েকটি বাক্যের ভেতর যেন এক অদৃশ্য সেতু গড়ে উঠল। অনন্যা বুঝতে পারল, রুদ্রর ভাষা সরল, বিনয়ী—কিন্তু প্রতিটি শব্দের পেছনে আন্তরিকতা আছে। রুদ্রও বুঝল, অনন্যার প্রশংসায় কেবল সৌজন্য নয়, এক ধরনের সত্যিকারের অনুভূতি আছে, যা দূরত্ব পেরিয়ে পৌঁছে এসেছে। পরের কয়েকদিন তারা মাঝে মাঝে ছোট ছোট বার্তা বিনিময় করল—কখনো অনন্যা নতুন কোনো গান শোনার লিঙ্ক পাঠায়, কখনো রুদ্র তার গ্রামের ছবি শেয়ার করে। তারা কেউই জানত না এই আলাপ কোথায় গিয়ে থামবে, কিন্তু দু’জনের মনেই এক নতুন কৌতূহল জন্ম নিল—যেন সুর আর শব্দ মিলে এক নতুন গল্প লিখতে শুরু করেছে, যার পরবর্তী লাইন তারা নিজেরাও জানে না।
৪
শীতের এক সন্ধ্যায় রুদ্র তার ঘরের মাটির মেঝেতে বসে ছিল, পাশে একতারা রাখা। সেদিন গ্রামের মেলায় গিয়ে ফেরার পর হঠাৎ মনে হলো অনন্যাকে কিছু পাঠানো দরকার—যা কেবল কথা নয়, তার হৃদয়ের টুকরো। সে একতারা হাতে তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে বাজাতে শুরু করল, নিজের লেখা একটি নতুন গান, যা সে কখনো কাউকে শোনায়নি। গানের কথায় ছিল নদীর ওপারে অপেক্ষা, হাওয়ার ভেতরে মাটির গন্ধ, আর দূরদেশে থাকা প্রিয়জনের জন্য মনের আকুলতা। সে মোবাইলের রেকর্ডারে গানটি ধরে রাখল—শব্দের মধ্যে যেন সন্ধ্যার পাখির ডাক, দূরে হেঁটে যাওয়া গরুর ঘণ্টার আওয়াজও ধরা পড়ল। রুদ্র গান রেকর্ড করে ইমেলে লিখল, “এই গানটা শুধু আপনার জন্য। জানি না ভালো লাগবে কিনা, কিন্তু মনে হলো পাঠিয়ে দিই।” পাঠানোর পর তার মনে একধরনের অস্বস্তি জন্ম নিল—হয়তো অনন্যা বুঝবে না, হয়তো এই সরল সুর বিদেশের শহরে পৌঁছে গেলে অচেনা লাগবে। তবুও ভেতরে কোথাও একটা বিশ্বাস ছিল, গানই তার সবচেয়ে সত্য ভাষা।
অনন্যা যখন ইমেলটি খুলল, তখন তার শহরে ভোরের আলো উঠছে। ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই সে রুদ্রর বার্তাটি দেখতে পেল। হালকা কফি বানিয়ে জানালার পাশে বসে হেডফোন কানে দিয়ে প্লে বোতাম চাপল। একতারার প্রথম টানেই যেন তার ঘরের ভেতর বীরভূমের মাঠ ঢুকে পড়ল—মাটির গন্ধ, কুয়াশার ভেজা হাওয়া, আর সেই গভীর কণ্ঠের ভেতরে লুকিয়ে থাকা এক ধরনের নির্ভেজাল আন্তরিকতা। গানের শেষ লাইনটি শুনে তার মনে হলো, যেন রুদ্র গানটির ভেতরে তার জন্যই একটি জানালা খুলে দিয়েছে, যেখান দিয়ে সে দেখতে পাচ্ছে এক অচেনা অথচ আপন পৃথিবী। আবেগে ভরে গিয়ে অনন্যা উত্তর লিখতে বসে গেল—কেবল ধন্যবাদ নয়, সে নিজের প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতের কয়েকটি লাইন লিখল—“তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম…।” সঙ্গে লিখল, “এই গান আমার কাছে ঠিক তেমনই মনে হলো—যেন নীরবে এসে থেকে যাচ্ছে।” পাঠানোর আগে কিছুক্ষণ ভেবে তার পুরোনো এক রেকর্ডিংও জুড়ে দিল, যেখানে সে শখ করে সেই রবীন্দ্রসঙ্গীতটি গেয়েছিল, বছরখানেক আগে, এক বন্ধুর জন্মদিনে।
এভাবেই তাদের ইমেল একরকম সঙ্গীতের বিনিময়ে পরিণত হলো। রুদ্র অবাক হয়ে শুনল অনন্যার কণ্ঠ—নরম, সুরেলা, একটু শহুরে পরিশীলিত, কিন্তু তাতে একধরনের সহজাত মাধুর্য আছে। সে উত্তরে লিখল, “আপনার গলায় এই গান যেন নতুনভাবে বাঁচল।” পরের দিন অনন্যা তাকে জানাল, ছোটবেলায় সে প্রায়ই গান শিখত, কিন্তু পড়াশোনা আর কাজের চাপে গান ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে। রুদ্র মজা করে লিখল, “তাহলে হারানো সুরগুলো খুঁজে বের করতে হবে, আমি আছি।” সেই মুহূর্তে তারা দু’জনেই বুঝতে পারল, দূরত্ব যতই হোক, সুর আর শব্দ মিলে তাদের মধ্যে এক অদৃশ্য সেতু গড়ে তুলছে—যা মাইলের পর মাইল দূরে থেকেও দু’জনকে ক্রমশ কাছে টেনে আনছে। অনন্যা তার দৈনন্দিন ব্যস্ততার মাঝেও এখন রুদ্রর ইমেলের জন্য অপেক্ষা করে, আর রুদ্রও রাতের শেষে একতারা হাতে নিয়ে ভাবে, “আজ কী পাঠাবো?” এইভাবে, অজান্তেই, তাদের হৃদয়ের মধ্যে এক নতুন তাল বেজে উঠল, যা কোনো মাপের ক্যালেন্ডার বা ঘড়ির সঙ্গে বাঁধা নয়—শুধু সুরের সময়েই চলে।
৫
রুদ্র সবসময় শহুরে প্রযুক্তির দুনিয়ায় নিমগ্ন, আর তার ভাষা, রসবোধ ও ভাবনার ধরনও তেমনই আধুনিক। অনন্যার সামনে বসে সে হালকা হাসিতে ভরা ভঙ্গিতে নানা মজার গল্প বলতে থাকে—কিভাবে অফিসে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে প্রেজেন্টেশন বানায়, কিভাবে অনলাইন মিটিংয়ে বসে একই সঙ্গে কফি শপে আড্ডা দেয়, কিংবা ডেলিভারি অ্যাপে মাত্র এক ক্লিকের মাধ্যমে যে কোনো দেশের খাবার পেয়ে যায়। অনন্যা মুগ্ধ দৃষ্টিতে শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যায়, এই সহজসাধ্য জীবনের সাথে তার অভিজ্ঞতার কতটা পার্থক্য! সে ভাবে—যেখানে রুদ্রের জন্য জীবন মানে হলো দ্রুততা, সংযোগ, আর প্রযুক্তির আরামে ডুবে থাকা, সেখানে তার জীবন কাটে ধানক্ষেতের পাশে হাঁটতে হাঁটতে, সন্ধ্যায় পুকুরপাড়ে বসে পায়ের কাছে হাঁসেদের কোলাহল শুনতে শুনতে, আর উৎসবে পাড়ার সবাই মিলে পিঠে, নারকেল নাড়ু বানাতে বানাতে গল্পে মেতে উঠতে। দুজনের গল্পে যেন এক অদৃশ্য সেতু তৈরি হয়—একপাশে ঝকঝকে কাঁচের অফিস আর অন্যপাশে কাঁচা রাস্তার ধুলোর গন্ধ।
আলাপের ফাঁকে অনন্যা রুদ্রকে বলে তার শৈশবের কথা—কীভাবে সে সকালে বাবার সঙ্গে খেতের কাজ দেখতে যেত, কীভাবে শীতের ভোরে গরম ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি খাওয়া ছিল সবচেয়ে বড় আনন্দ, আর কীভাবে পুজোর সময় গোটা গ্রাম এক হয়ে যেত যেন এক পরিবার। রুদ্র মন দিয়ে শোনে, চোখের কোণে যেন অন্যরকম এক আলো—হয়তো স্মৃতির, হয়তো কৌতূহলের। সে স্বীকার করে, ছোটবেলায় দাদুর কাছে গ্রামে কয়েকদিন কাটানোর স্মৃতি তারও আছে, কিন্তু বড় হতে হতে সেই শিকড় থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে গেছে। অনন্যার গল্পে সে যেন নিজের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোকে আবার ছুঁয়ে ফেলছে। দুজনেই টের পায়, তাদের জীবনধারা যতই আলাদা হোক না কেন, সেই শিকড়ের টান অস্বীকার করা যায় না। প্রযুক্তি হয়তো রুদ্রকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে নিয়ে গেছে, কিন্তু অনন্যার কথায় সে বুঝতে পারে—গ্রামীণ জীবনের ধীর অথচ গভীর ছন্দের মধ্যে এক অদ্ভুত শান্তি আছে, যা তার জীবন থেকে অনুপস্থিত।
সন্ধ্যার আলো নেমে এলে তারা একসঙ্গে বসে গরম চায়ের কাপে চুমুক দেয়। চায়ের ভাঁপের ভেতর দিয়ে রুদ্র তাকায় দূরের গাছপালার দিকে, আর অনন্যা ভাবছে, কত সহজে মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে বদলে যায়, অথচ মনের ভেতরের আসল পরিচয়, সেই শিকড়, কোথাও হারায় না। রুদ্র হেসে বলে, “তুমি জানো অনন্যা, তোমার এই গল্পগুলো শোনার পর মনে হচ্ছে, হয়তো আমিও ফিরে যেতে চাই সেই দাদুর উঠোনে, যেখানে আমগাছের ছায়ায় বসে দুপুর কাটত।” অনন্যা নীরবে হাসে—সে বুঝতে পারে, প্রবাস যত দূরেরই হোক, শিকড়ের ডাকে সাড়া দেওয়া থেকে কেউই মুক্ত নয়। এই মুহূর্তে, তারা দুজনই অনুভব করে, জীবন শুধু গন্তব্যের নয়, বরং সেই পথে পাওয়া অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, আর সম্পর্কের বুননেই তার আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে।
৬
রুদ্রের মনে অনেকদিন ধরেই একধরনের কৌতূহল ছিল—অনন্যা ঠিক কী কাজ করে, আর কেন সে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ের পর ফোন ধরতে বা মেসেজের উত্তর দিতে পারে না। একদিন কাকতালীয়ভাবে রুদ্র জানতে পারল যে অনন্যা আসলে একটি বহুজাতিক কোম্পানির উচ্চপদে কাজ করছে, যেখানে তার পদমর্যাদা এবং দায়িত্ব দুটোই বিশাল। এই খবর শোনার পর রুদ্রের মনে মিশ্র অনুভূতি তৈরি হয়। সে খুশি হয়েছিল যে অনন্যা এতটা সফল, এতটা স্বাধীন, কিন্তু একই সাথে বুকের গভীরে হালকা একটা খচখচানি লাগল—সে নিজে একটি ছোট স্টার্টআপে কাজ করে, যেখানে বেতন কম, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, আর প্রায়শই মাসের শেষে টাকার হিসাব মেলাতে হিমশিম খেতে হয়। রুদ্র নিজের অজান্তেই তুলনা শুরু করে—অনন্যার গাড়ি, দামি পোশাক, আন্তর্জাতিক অফিস সফর, আর নিজের একরকম সাধারণ জীবনযাপন। এদিকে অনন্যার দিক থেকেও কিছু প্রশ্ন তৈরি হতে শুরু করল। সে অবাক হয়ে দেখল রুদ্র মাঝে মাঝে কিছু ছোটখাটো খরচ এড়িয়ে যায়, প্রায়শই বাড়তি আড্ডা বা রেস্তোরাঁর বিল দেওয়ার সময় একটু দ্বিধা করে। ধীরে ধীরে অনন্যা বুঝতে পারল যে রুদ্র অর্থনৈতিকভাবে বেশ চাপের মধ্যে আছে, এবং সেই বোঝাটা সে একা বয়ে নিয়ে চলেছে।
এই উপলব্ধির পর দুজনের সম্পর্কের ভেতরে অদৃশ্য এক দেয়াল গড়ে উঠতে লাগল। কথা হয়, হাসি হয়, কিন্তু গভীরের কোথাও যেন এক অনুচ্চারিত অস্বস্তি থেকে যায়। রুদ্র নিজের ভেতরে একটা অহংকার লালন করত—সে চায়নি অনন্যা তার প্রতি সহানুভূতি দেখাক বা তাকে ‘কম’ ভাবুক। অন্যদিকে অনন্যা চেয়েছিল রুদ্র নিজের সমস্যাগুলো খোলাখুলি শেয়ার করুক, যাতে তারা একে অপরকে বুঝতে পারে এবং সমর্থন দিতে পারে। কিন্তু দুজনেই নিজের নিজের দিক থেকে চুপ থেকেছে—রুদ্র কারণটা নিজের দুর্বলতা ভেবে, আর অনন্যা কারণটা সম্মানের জায়গা থেকে। এই নীরবতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। অনন্যার বিলাসী অফিস জীবন, ব্যস্ত শিডিউল, আর কর্পোরেট মিটিং-এর গল্প রুদ্রের কাছে যেন এক অন্য জগতের কথা মনে হতে থাকে। একসময় সে ভাবতে শুরু করে—তারা কি সত্যিই একই পথে হাঁটছে? নাকি তাদের জীবনযাত্রার ফারাক একদিন এতটাই বড় হয়ে যাবে যে একে অপরকে আর ধরেও রাখা যাবে না?
এদিকে অনন্যারও মনে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সে রুদ্রকে ভালোবাসে, কিন্তু বুঝতে পারে যে তার সাফল্য অনিচ্ছায় রুদ্রের কাছে দূরত্ব তৈরি করছে। সে জানে, ভালোবাসা কেবল আবেগ নয়—এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বাস্তব জীবন, অর্থনৈতিক সামঞ্জস্য, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা। তার ভয় হয়, রুদ্র হয়তো একদিন নিজেকে তার জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে না। কিন্তু আবার এই ভয়কে সে পরাজিত করতে চায়, কারণ রুদ্রের সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত তাকে মনে করিয়ে দেয় যে সম্পর্কের আসল শক্তি বোঝাপড়া আর মমতায়। তবুও, তাদের মধ্যে যে ফাঁক তৈরি হচ্ছে তা ধীরে ধীরে বাড়ছে—কেউ সরাসরি কিছু বলছে না, কিন্তু চোখের ভাষা, নীরব মুহূর্ত, আর অর্ধেক হাসি যেন সব বলে দিচ্ছে। প্রেমের পথে এই অদৃশ্য অসমতা কি একদিন এমন বাধা হয়ে দাঁড়াবে যা তারা কেউই পার হবে না? নাকি তারা সময়ের সঙ্গে একে অপরের জগৎকে গ্রহণ করতে শিখবে—এটাই এখন অজানা ভবিষ্যতের প্রশ্ন।
৭
অনন্যা বহুদিন ধরে এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিল। চাকরির টানাপোড়েনের মাঝেও তার মনে ছিল এক অদ্ভুত উৎকণ্ঠা—ভারতে ফিরে এসে রুদ্রের সঙ্গে সরাসরি দেখা হবে, গানের মানুষটির চোখে চোখ ঢেলে কথা বলা হবে। অবশেষে ছুটির অনুমোদন পেয়ে সে ঠিক করল কলকাতায় এসে রুদ্রের সঙ্গে দেখা করবে। বিমান থেকে নামার পর কলকাতার গরম আর ভিড় তার মনে এক অচেনা উচ্ছ্বাস এনে দিল—একসময় তার শৈশবের শহর হলেও এতদিন পরে এখানে এসে তার মনে হল যেন সারা জীবন ধরে সে অপেক্ষা করছিল। ফোনে একাধিকবার কথা বলার পর, রুদ্রের সঙ্গে দেখা করার দিন নির্ধারণ হলো শহরের এক জনপ্রিয় পার্কে। সেই দিন সকাল থেকেই অনন্যার মন ভরে উঠেছিল।
রুদ্র আগেই পার্কে পৌঁছে ছিল। তার হাতে ছিল একতারা, আর মুখে লেগে ছিল অপ্রকাশিত উত্তেজনা। সে বারবার ফোন চেক করছিল, কখন অনন্যার বার্তা আসবে। যখন শেষমেষ দূরের রাস্তা দিয়ে অনন্যাকে দেখল, তার বুকটা যেন ধাক্কা দিল। অনন্যার কাঁধে লম্বা চুল পড়ে আছে, চোখে চশমা, আর চেহারায় অদ্ভুত এক শান্তি। দু’জনের চোখ মেলতেই একে অপরের ভেতরে সেই দিনের হাজার মাইলের দূরত্ব ঘুচে গেল। রুদ্র ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলল, “অনন্যা, তুমি আসলে জীবনে যেই গান শুনতে চেয়েছিলে, সেটা আমি তোমার জন্য গাইতে এসেছি।” অনন্যার চোখে জলে ভেজা হাসি ফুটল, সে বলল, “আর আমি তোমার সেই সুর শুনতে আসছি, যা শুধু ইমেলে নয়, হৃদয়ে বাজে।” তখন পার্কের গাছপালা, পাখিদের কিচিরমিচির, আর শহরের দূরের আওয়াজ সব মিলেমিশে এক অদ্ভুত সুর তৈরি করল—একতারা আর তাদের চোখের ভাষার।
তারা পাশে বসে কথা বলতে লাগল—রুদ্র তার গ্রামের ছোট্ট গল্প শুনাল, আর অনন্যা শহরের ব্যস্ততার কথা বলল। দু’জনেই বুঝতে পারল, সরাসরি মুখোমুখি কথা বলার মধ্যেই ছিল সেই জাদু, যা ইমেলে কখনো আসেনি। রুদ্র একতারা বাজিয়ে গান গাইতে লাগল, আর অনন্যা চোখ বন্ধ করে শোনল। মাঝে মাঝে সে হাত বাড়িয়ে রুদ্রর হাত ছুঁয়ে নিত, যেন এই সুর আর স্পর্শ তাদের সম্পর্ককে আরও গভীর করে তোলে। সেই দুপুরের আলো, মাটির গন্ধ, আর দু’জনের আবেগ মিলে তাদের মনে করিয়ে দিল—দূরত্ব যতই হোক, সঙ্গীত এবং ভালোবাসার ভাষা সবসময় কাছাকাছি থাকে। তাদের প্রথম সাক্ষাৎ শুধু একটি মূহুর্ত নয়, বরং ছিল এক নতুন অধ্যায়ের শুরু, যেখানে একতারার তার আর চোখের ভাষা এক হয়ে গেল।
৮
অনন্যার ছুটির শেষের সূচনা যখন কাছাকাছি এসে পৌঁছল, তখনও তার ও রুদ্রের মধুর সময় কাটানোর আকাঙ্ক্ষা কমেনি। কলকাতার গন্ডি পেরিয়ে রুদ্র তাকে নিয়ে গেল তার গ্রামের সেই ছোট্ট মাটির বাড়িতে, যেখানে খেজুর গাছের ছায়ায় সকাল শুরু হয় আর শীতের কুয়াশায় গাছপালার ওপর শিশির ঝরে। গ্রামের বাতাসে এক অদ্ভুত সজীবতা ছিল, যেন প্রতিটি নিঃশ্বাসেই মাটির গন্ধ মিশে আছে। অনন্যা সেই সব দেখতে পেয়ে মুগ্ধ হল, তার হৃদয়ে একধরনের শান্তি নেমে এল—শহরের জ্যাম, শব্দকোলাহল থেকে অনেক দূরে, প্রকৃতির কোলে তাদের ছোট্ট জগৎ। রুদ্রের মা তার জন্য গরম চা নিয়ে এলেন, আর গ্রামের বাচ্চারা ঘুরে বেড়াচ্ছিলো দৌড়ে। রুদ্র আর অনন্যা একসঙ্গে হাঁটতে লাগল পাকা রাস্তা ধরে, মাটির গন্ধে ভেজা পথ পেরিয়ে খেজুর বাগানের দিকে। সেখানে রুদ্র একতারা হাতে বসে গান গাইতে শুরু করল—তার সুর আর অনন্যার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা হাসি যেন মেঘের ভেদ করে সূর্যের আলো হয়ে পড়ল দু’জনের মাঝে। সেই গানের তালে তারা যেন সময় থেমে গেল।
গ্রামের সেই কয়েকদিনে দু’জনের সম্পর্ক আরও গভীর হল। অনন্যা রুদ্রের গ্রামের মানুষের সঙ্গে মিশে গেল, তাদের খাদ্যাভ্যাস, ভাষা, আর সংস্কৃতির মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলল। সে বুঝতে পারল, এই গ্রামীণ জীবনধারা কেবল ধীরগতি নয়, বরং এটি জীবনের সত্যিকারের স্পন্দন। রুদ্র তাকে খোলা মাঠে নিয়ে গেল যেখানে তারা একসাথে সূর্যাস্ত দেখল, আর রাতে মাটির চুলোয় আগুন জ্বেলে বসে কথা বলল। অনন্যা বলল, “এখানকার বাতাসে একটা অন্যরকম মাধুর্য আছে, যা শহরে কখনো পাই না।” রুদ্র হাসল, “তুমি জানো, আমি সবসময় চাইতাম কেউ আমার এই জীবন বুঝুক, আর তুমি সেটা করছো।” এই সময়ে দু’জনের মধ্যে এমন এক অনুভূতি তৈরি হল, যা শুধু ভালোবাসা নয়—বুঝাপড়া, সমঝোতা আর সহানুভূতির এক অদ্ভুত মেলবন্ধন।
তবু, ছুটির শেষের ধাপ আসতেই একধরনের অজানা টান সৃষ্টি হল। অনন্যার মনে দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল—সে ভাবতে লাগল, যখন ফিরে যাবে বিদেশ, তখন কি এই সম্পর্ক টিকে থাকবে? রুদ্রও অনুভব করল সময়ের এই সীমা তাদের মধুর মুহূর্তগুলোকে ঘিরে একটি নীরব চাপ সৃষ্টি করছে। এক সন্ধ্যায়, গ্রামের একাকী পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে তারা নীরব ছিল। হঠাৎ রুদ্র বলল, “অনন্যা, আমি জানি এই জীবন তোমার জন্য কঠিন হতে পারে, কিন্তু আমি চাই তুমি জানো, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।” অনন্যার চোখ ভিজে গেল, সে কাঁধে তার হাত দিল। সেই মুহূর্তে বোঝা গেল—ছুটি যতই শেষের দিকে আসুক, তাদের মনের বন্ধন যেন আরও শক্তিশালী হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবতার আওয়াজও ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। এভাবেই সময়ের সীমা তাদের ভালোবাসার পথে এক বড় বাঁক নিয়ে আসে—যা শুধুমাত্র দুই হৃদয়ের নয়, দুই জগতের মিলনের পরীক্ষাও বটে।
৯
অনন্যার ছুটির শেষ হওয়ার দিন দ্রুত এগিয়ে আসছিল। কলকাতার রাস্তায় হেঁটে হাঁটতে হাঁটতে, মাটির গন্ধে মিশে থাকা শীতের হালকা বাতাসে সে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে লাগল। একটা প্রশ্ন বারবার তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল—“আমি কি সত্যিই সব ছেড়ে রুদ্রের কাছে থাকতে পারব?” বিদেশের উচ্চপদে তার চাকরি, আর্থিক সুরক্ষা, শহরের ব্যস্ততা—সবকিছু যেন তার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর রুদ্র, যার জীবন মাটির গন্ধে, গ্রামের মেলায়, একতারার সুরে আবদ্ধ। সে জানত, সেই জীবনের ছন্দে মানিয়ে নেওয়া সহজ হবে না। অনন্যার মনে দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকল—তার ভালোবাসা, তার আকাঙ্ক্ষা, আর বাস্তবতার মধ্যকার দূরত্ব কি কখনো পেরোতে পারবে? সে ভাবল, এই সিদ্ধান্ত শুধু তার নয়, বরং দুই জনের জীবনের পরিবর্তনের এক বড় ধাপ। রুদ্রের সাথে থাকা মানে নতুন জায়গায় নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তোলা, আর সেটা কি তার জন্য সম্ভব? এই প্রশ্নের সামনে সে কিছুটা দুর্বল বোধ করল, কিন্তু ভালোবাসার শক্তি তাকে কিছুটা সাহসও দিল।
অন্যদিকে রুদ্রও ছিল দ্বিধায়। অনন্যার সঙ্গে কাটানো কয়েকদিন তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় ছিল, কিন্তু সেই সময়ের শেষে যখন সে একাকী বসে ভাবল, তার বুক ভারী হয়ে উঠল। বিদেশের বড় শহরে অনন্যার জীবন, আধুনিকতা, আর তার পরিবারের আশেপাশে ঘোরাফেরা—সবকিছুই রুদ্রর কাছে ছিল অচেনা, অসুবিধাজনক, এমনকি মাঝে মাঝে ভয়ংকর। সে জানত, অনন্যা তাকে নিজের বিশ্বে নিয়ে আসতে চায়, কিন্তু সে নিজেকে সেই জগতে মানিয়ে নিতে পারবে কি? আর্থিক দুর্বলতা, শিক্ষা, জীবনযাত্রার পার্থক্য সব মিলিয়ে তার মনে হলো যেন সে ওই দুনিয়ার বাইরে। আবার একদিকে তার নিজের গ্রামীণ শিকড়, মাটির সুর, আর স্বপ্ন—যা থেকে সে সহজে সরে আসতে চায় না। একদিন সন্ধ্যায়, অনন্যার সঙ্গে কথা বলার সময় সে ভেসে উঠল এই সমস্ত দ্বিধা। সে চেয়েছিল সত্যি কথা বলতে, কিন্তু সেই মায়া ও গৌরবের জটিলতা তাকে থামিয়েছিল। অনন্যার প্রতি ভালোবাসা ছিল প্রচুর, কিন্তু তার মনে জেগে উঠল এক অনিশ্চিত প্রশ্ন—“আমরা কি সত্যিই একসাথে থাকতে পারব?”
ফেরার দিন আসতেই দু’জনের মাঝে সেই চুপচাপ উত্তেজনা বাড়তে থাকল। বিমানবন্দরের পথে অনন্যা বারবার তার ব্যাগ ঠিক করছিল, কিন্তু হৃদয় যেন অচেনা ভারী হয়ে আসছিল। রুদ্র চুপচাপ তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, মুখে ছিল এক অদ্ভুত দুশ্চিন্তাময় হাসি। তাদের চোখ মেলে একবার, তারপর দুজনেই জানত—এই বিদায় কিন্তু শুধু আজকের নয়, এটি এক নতুন পরীক্ষার শুরু। অনন্যার মনে হচ্ছিল, এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কতটাই বা তার হাতে আছে? আর রুদ্র ভাবছিল, সে কেমন করে অনন্যার জগতে নিজেকে খুঁজে পাবে? দু’জনেই অনুভব করছিলেন, ভালোবাসা কতই না শক্তিশালী, কিন্তু বাস্তবতার বাধা তা থেকে অনেক কঠিন। তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত শূন্যতা তৈরি হল, যা তারা একে অপরকে বুঝাতে পারছিল না। এভাবেই “ফেরার পথের দ্বন্দ্ব” তাদের ভালোবাসার মেলবন্ধনের এক কঠিন অধ্যায় হয়ে দাঁড়াল।
১০
রুদ্রের হাতে একতারা। রাতে, গ্রাম্য ঘরের এক কোণে বসে সে তার সমস্ত অনুভূতি গাঁথে একটি নতুন সুরে। মাটির গন্ধ আর একতারা, তার কণ্ঠের কম্পনে যেন সব স্মৃতি জেগে ওঠে—অনন্যার সঙ্গে কাটানো দিনগুলি, তাদের কথোপকথন, দূরত্বের বেদনা আর আশা। সে জানত, এই গানের প্রতিটি নোট অনন্যার জন্য, একটা চিঠি যা সে মেল কিংবা কথায় প্রকাশ করতে পারেনি। অবশেষে সে গিটার থেকে সরে এসে একতারা তুলে নিল এবং তার ফোনে গান রেকর্ড করতে লাগল। গানের প্রতিটি শব্দে ছিল তার আত্মার ভাষা, দূরত্বের কাঁপন, ও ভালোবাসার গভীরতা। সে রেকর্ড শেষ করে সেই অডিও ফাইলটি ইমেলের সঙ্গে সংযুক্ত করল, “এই গানটা তোমার জন্য, যা আমার মন থেকে তোমার কাছে নিয়ে যাবে আমার সব কথা।” পাঠিয়ে দেওয়ার পর, তার বুক ভারী হলেও একধরনের শান্তি পেল।
অনন্যা বিদেশের একান্ত নিভৃত ঘরে বসে সেই ইমেল খুলল। তার চোখ ভিজে উঠল গান শুনে, যেন রুদ্রের গানের সঙ্গে তার নিজের মনও একসাথে বাজছে। সে তখন লিখতে শুরু করল—একটি দীর্ঘ ইমেল, যেখানে সে নিজের সমস্ত দ্বন্দ্ব, আশা আর ভালোবাসা প্রকাশ করল। সে জানালো, দূরত্ব, সামাজিক ভেদাভেদ, আর বাস্তবতার কঠিন সীমানা তার জন্য এক গভীর পরীক্ষার মত, কিন্তু এই গান তার মনে সাহস জুগিয়েছে। সে লিখল, “তোমার সুর আমার জন্য শুধু সুর নয়, এটি আমার আত্মার প্রতিফলন। আমি জানি, আমাদের পথ সহজ নয়, কিন্তু এই সুরই আমাদের এক করে রাখবে, হয়তো একদিন আমরা একসাথে বসে এই গান গাইবো।” ইমেলটির প্রতিটি শব্দে ছিল তার আত্মার গভীরতা, রুদ্রের প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশ, আর সেই অজানা ভবিষ্যতের অপেক্ষা।
তাদের গল্প এখানেই শেষ হলো না—কিন্তু সমাপ্তির দিক স্পষ্ট হল। রুদ্র ও অনন্যার মধ্যে সম্পর্কের নরম বুননে রঙ ঢেলে দিয়েছে একতারার সুর আর ইমেলের শব্দ। পাঠকরা এই গল্প পড়ে ভাবতে বাধ্য হয়—এই প্রেম কি শেষ পর্যন্ত মিলনের স্বাদ পাবে, নাকি থেকে যাবে দূরত্বের বাধায় অনির্বচনীয়, ইমেল ও সুরের মধ্যকার এক মায়াবী ছায়া? গল্পের শেষ মুহূর্তে পাঠকের মন উদাসীন নয়, বরং প্রশ্নবিদ্ধ, যেন তারা একান্তই জানে, ভালোবাসার এই সুর কখনো শেষ হয় না, তা হয়তো শুধু অন্য কোনো আকাশের নিচে গেয়ে ওঠে।
-শেষ-