Bangla - ছোটদের গল্প - প্রেমের গল্প

গোধূলির গোপন কথা

Spread the love

অদিতি চক্রবর্তী


(১)

ঋতমের কাছে গোধূলি বেলা সবসময়ই এক অদ্ভুত আকর্ষণের সময়। সূর্যের শেষ সোনালি আলো যখন নদীর জলে গিয়ে মিশে যায়, তখন আকাশ, জল আর বাতাস মিলেমিশে তৈরি করে এক রঙিন ক্যানভাস, যা তার আঁকার খাতায় ধরা পড়ে না, কিন্তু তার মনে গভীর ছাপ ফেলে। সেদিনও সে স্কুলের ব্যাগ ঘরে ফেলে দিয়ে হাতে স্কেচবুক আর পেন্সিল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল সেই পরিচিত বাঁকের দিকে। রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে শুনতে পায় পাখিদের বাসায় ফেরার ডাক, দূরে কারো গরু ফেরানোর বাঁশি, আর গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে হালকা আলো এসে তার গায়ে পড়ছে। নদীর ধারের কাশফুলগুলো তখন গোধূলির আলোয় যেন রুপালি আভা ছড়াচ্ছে, হাওয়ায় দুলে দুলে ফিসফিস করছে নিজেদের ভাষায়। এই বাঁকটা ঋতমের কাছে শুধু আঁকার জায়গা নয়, বরং এমন এক জগৎ যেখানে সে বাইরের কোলাহল থেকে মুক্তি পায়। কিন্তু সেদিনের বাঁকটা অন্যরকম—তার চোখ হঠাৎ থেমে গেল এক দৃশ্যে, যা সে আগে কখনো দেখেনি। কাশফুলের ভেতরে, নদীর কিনারে বসে আছে এক মেয়ে, মাথা সামান্য নীচু, চুল খোলা আর লম্বা, বাতাসে উড়ছে। তার পায়ের কাছে রাখা একটি পুরনো কাপড়ের ব্যাগ, আর হাতে একটি শুকনো কাশফুলের ডগা, যেটি দিয়ে সে হালকা করে জলের ওপর রেখা কাটছে।

ঋতম প্রথমে থমকে দাঁড়াল, যেন এই দৃশ্য ভাঙতে চায় না। সে এক অদ্ভুত দ্বিধায় পড়ে গেল—যদি মেয়েটি তাকিয়ে দেখে, তবে কি সে বিরক্ত হবে? কিন্তু একইসঙ্গে তার চোখ যেন সরছেই না সেই মুখ থেকে। মেয়েটির গায়ে ছিল সাদা-নীল ছাপা একটা পুরনো শাড়ির মতো ফ্রক, যা নদীর হাওয়ায় সামান্য উড়ছিল। তার চোখ নদীর ওপারে, যেখানে সূর্য ডুবতে বসেছে, আর আকাশের লাল আভা ধীরে ধীরে বেগুনি হয়ে আসছে। হঠাৎ সেই মেয়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই তাদের চোখাচোখি হলো। সেই দৃষ্টি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি—মাত্র কয়েক সেকেন্ড—কিন্তু তাতে এক অদ্ভুত কম্পন যেন ঋতমের বুকের ভেতর ছড়িয়ে পড়ল। মেয়েটির চোখে ছিল গভীরতা, যেন নদীর জলের মতো—উপর থেকে শান্ত, কিন্তু তলদেশে অগণিত গল্প লুকিয়ে আছে। ঋতম হালকা হাসি দিলেও মেয়েটি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না, শুধু আবার নদীর দিকে তাকিয়ে রইল। তার এই নীরবতা ঋতমকে কৌতূহলী করে তুলল। আঁকতে বসার আগে সে একবার চারপাশে তাকিয়ে নিল, যেন নিশ্চিত হতে চাইল যে এই মুহূর্ত শুধু তাদের দুজনের জন্য, কারো দৃষ্টি নেই। তারপর ধীরে ধীরে দূরে, কিন্তু কাছে শোনার মতো এক জায়গায় বসে স্কেচবুক খুলল।

হাওয়ায় ভেসে আসছিল নদীর জল ছলাৎছল শব্দ, আর দূরে কারো গৃহস্থালি হাঁড়ি চাপানোর আওয়াজ। ঋতম পেন্সিলের প্রথম রেখা টানতে গিয়েও খেয়াল করল, তার মনটা অদ্ভুতভাবে অস্থির হয়ে উঠেছে। সে জানে না মেয়েটি কে, কোথা থেকে এসেছে, বা কেন এই সময়ে নদীর ধারে বসে আছে, কিন্তু তার উপস্থিতি যেন পুরো পরিবেশের রং বদলে দিয়েছে। ঋতম আঁকতে গিয়ে প্রথমেই মেয়েটির চুল আঁকল—কারণ সেটাই ছিল সবচেয়ে জীবন্ত, বাতাসে দুলছে আর সূর্যের আলোয় মাঝে মাঝে সোনালি আভা ছড়াচ্ছে। তারপর ধীরে ধীরে কাশফুল, নদীর ঢেউ, আর গোধূলির আলো মিলিয়ে দিল ছবিতে। মাঝে মাঝে সে তাকিয়ে দেখছিল মেয়েটিকে, আর ভাবছিল—এই মুহূর্তটা হয়তো একদিন তার স্মৃতিতে রয়ে যাবে, এমনকি ছবির চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্টভাবে। নদীর হাওয়া যেন অদৃশ্য ভাষায় কিছু বলছিল, যা শুধু তারা দু’জনই শুনতে পাচ্ছিল। সেই দিন, সেই প্রথম দেখা, আর সেই চোখাচোখি—সব মিলিয়ে ঋতমের মনে জন্ম নিল এক প্রশ্ন, যা তার মন থেকে অনেকদিন যাবৎ মুছবে না: “এই মেয়েটি কে?” আর হয়তো উত্তরটা শুধু নদীই জানে।

(২)

পরের দিনও গোধূলির সময় ঋতম একই পথে হাঁটতে হাঁটতে নদীর বাঁকে এসে দাঁড়াল। তার মন অদ্ভুতভাবে প্রত্যাশিত হয়ে উঠেছিল—গতকালের সেই মেয়েটি কি আজও আসবে? নদীর গায়ে লালচে আভা পড়েছে, বাতাসে কাশফুল দুলছে, পাখিরা বাসায় ফেরার তাড়ায় ডাকছে। বাঁকের কাছে পৌঁছাতেই সে থমকে গেল—হ্যাঁ, মেয়েটি আছে। ঠিক আগের দিনের মতোই নদীর দিকে মুখ করে বসে, হাতের আঙুল দিয়ে কাশফুলের ডগায় আলতো করে বুলিয়ে দিচ্ছে। তবে আজ তার গায়ে ছিল আসমানি রঙের সুতির ফ্রক, চুল খোলা, কিন্তু ভেজা মনে হচ্ছে—সম্ভবত একটু আগেই মাথায় জল ঢেলেছে। ঋতম ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে নদীর ধারে, তার থেকে কিছুটা দূরে বসে পড়ল। দু’জনেই একে অপরের দিকে সরাসরি তাকাল না, কিন্তু অদ্ভুতভাবে বুঝে গেল যে একজনের উপস্থিতি আরেকজনের কাছে অনিচ্ছুক নয়। নদীর শব্দ যেন তাদের নীরবতার সঙ্গী হয়ে উঠল—জল ভেঙে যাওয়ার স্রোতের আওয়াজ, কাশফুলের পাতায় বাতাসের মৃদু সুর, আর দূরে গ্রামের কোথাও রান্নার হাঁড়িতে ফুটন্ত ডালের গন্ধ মিশে আসছে।

ঋতম স্কেচবুক খুলে নিল, পেন্সিল হাতে নিয়ে প্রথমে নদীর বাঁক আঁকতে লাগল। তার মন কিন্তু পুরোপুরি ছবিতে ডুবে ছিল না—প্রতি মুহূর্তে সে পাশের মেয়েটির দিকে চোরা দৃষ্টি দিচ্ছিল। মেয়েটির আঙুলে কাশফুলের সাদা তুলোর মতো অংশ ছিঁড়ে নদীতে ছুঁড়ে দেওয়ার একধরনের ছন্দ আছে—একটা ছিঁড়ে ছুঁড়ছে, আবার নতুনটা তুলছে, আবার ছুঁড়ছে। এভাবে যেন সে নদীর জলে সাদা চিঠি লিখে পাঠাচ্ছে, যার ভাষা কেউ পড়তে পারবে না, শুধু নদী বুঝবে। মাঝে মাঝে মেয়েটির কানের কাছে কিছু চুল উড়ে আসছিল, সে আঙুল দিয়ে সেগুলো সরিয়ে দিচ্ছিল—এই ছোট ছোট ভঙ্গিগুলো ঋতমের কাছে অদ্ভুত সুন্দর মনে হচ্ছিল। কিন্তু সে চুপচাপ রইল। কথা বলার ইচ্ছা হচ্ছিল, কিন্তু একই সঙ্গে মনে হচ্ছিল এই নীরবতাই হয়তো বেশি মূল্যবান—কারণ এখানে কোনো শব্দের প্রয়োজন নেই, শুধু উপস্থিতি আর সময়ের স্রোতই যথেষ্ট। তাদের মাঝখানে নদী নেই, দূরত্বও নেই—তারা পাশাপাশি বসে আছে, অথচ একে অপরের জগতে যেন আলাদা পথে চলেছে।

সময় ধীরে ধীরে গোধূলির শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছাল। আকাশের রঙ গাঢ় বেগুনি হয়ে যাচ্ছে, আর নদীর জলে প্রতিফলিত হচ্ছে প্রথম জোনাকির ক্ষীণ আলো। ঋতম তার ছবিতে শেষ কয়েকটি রেখা টেনে স্কেচবুক বন্ধ করল। সে অনুভব করছিল, এই নীরব সঙ্গই তাকে অন্য একরকম শান্তি দিয়েছে, যা হয়তো কথায় পাওয়া যায় না। মেয়েটি—যার নাম তখনও সে জানে না—কাশফুলের ডগা থেকে তুলো ছিঁড়ে নদীতে ছুঁড়ে দিয়ে হালকা করে দাঁড়াল, তারপর ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করল। ঋতম কোনো প্রশ্ন করল না, কোনো বিদায়ও জানাল না—শুধু তাকিয়ে রইল তার পেছনের দিকে, যতক্ষণ না সে বাঁক পেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। নদীর হাওয়া তখনো বইছে, কিন্তু আজ তার মধ্যে মিশে আছে অদ্ভুত এক ঘ্রাণ—সম্ভবত কাশফুল, হয়তো ভেজা চুল, হয়তো নীরবতার মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া অদৃশ্য এক সম্পর্কের প্রথম পরত। ঋতম জানত না, এই নীরবতার ভাষা তার জীবনে কত গভীর চিহ্ন রেখে যাবে।

(৩)

পরদিনও গোধূলির আলো পড়তে না পড়তেই ঋতম ব্যাগে স্কেচবুক গুঁজে নদীর ধারে চলে এল। তার ভেতরে এক অদ্ভুত টান ছিল—মেয়েটিকে আবার দেখার আকাঙ্ক্ষা, যদিও সে এখনো তার নাম জানে না। বাঁকের কাছাকাছি যেতেই চোখে পড়ল পরিচিত দৃশ্য—কাশফুলের মধ্যে বসে আছে সে, আজ গায়ে হালকা হলুদ রঙের ফ্রক, চুল খোলা আর কপালের একপাশে কাশফুল গোঁজা। নদীর স্রোত আজ খানিক দ্রুত, বাতাসে আর্দ্রতা, যেন দূরে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে। ঋতম এবার বেশি দ্বিধা না করে মেয়েটির থেকে প্রায় হাতখানেক দূরে গিয়ে বসে পড়ল। তারা প্রথমে একে অপরের দিকে তাকাল না, কিন্তু দুজনেই জানত—এখন তারা অপরিচিত নয়, বরং একে অপরের উপস্থিতি প্রত্যাশিত। ঋতম স্কেচবুক খুলে নদীর বাঁক আঁকতে লাগল, কিন্তু মনে মনে প্রস্তুত ছিল—হয়তো আজ কিছু বলা হবে, হয়তো নয়। নদীর শব্দের মাঝে, হঠাৎ এক সময় মেয়েটির কণ্ঠ ভেসে এল, যেন জলপাখির হালকা ডানার শব্দ—“তুমি কি নদী আঁকো, নাকি নদীর মন?” প্রশ্নটা এতটাই অপ্রত্যাশিত যে ঋতম প্রায় পেন্সিল ফেলে দিতে বসেছিল। সে মেয়েটির দিকে তাকাল—চোখে অদ্ভুত কৌতূহল, ঠোঁটে হালকা হাসি, যেন উত্তর শোনার আগেই সে কিছু জানে।

ঋতম কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকল, তারপর ধীরে ধীরে বলল, “নদীর মন তো দেখা যায় না… তবে হয়তো আমি সেটাই আঁকতে চাই।” মেয়েটি হেসে ফেলল—না, বড় করে নয়, যেন নিজের ভেতরে লুকিয়ে রাখা হাসি। তারপর বলল, “তুমি তাহলে আমার মতো। আমিও নদীর সঙ্গে কথা বলি, কিন্তু শব্দে নয়, মনে মনে।” এই প্রথম ঋতম বুঝতে পারল, এই মেয়েটি সাধারণ নয়—তার ভাবনায় নদী কেবল জলের ধারা নয়, বরং এক জীবন্ত সঙ্গী। এরপর থেকে তারা মাঝে মাঝে কথা বলতে লাগল—খুব বেশি নয়, ছোট ছোট বাক্যে। মেয়েটি জানাল, তার নাম মেঘলা। সে প্রায়ই এই নদীর ধারে আসে, কারণ এখানে এসে মনে হয় সব দুঃখ ভেসে যায়। ঋতম বলল, সে আঁকার জন্য আসে, কিন্তু আসল কারণটা হয়তো অন্য—এই সময়টা তাকে অন্য এক জগতে নিয়ে যায়, যেখানে পড়াশোনা, পরীক্ষা বা শহরের কোলাহল নেই। নদী যেন তাদের দুজনকেই চেনে, আর তাদের একে অপরের কাছে এনে দিয়েছে।

সেই দিন থেকে শুরু হলো তাদের গোধূলির নিয়মিত সাক্ষাৎ। প্রতিদিন বিকেলের শেষ আলো ফুরোতে না ফুরোতেই তারা দুজনেই নদীর ধারে চলে আসত, কেউ আগে এলে অপেক্ষা করত। কথাবার্তা হতো, কিন্তু নীরবতাও থাকত সমান গুরুত্বে। মেঘলা কাশফুল ছিঁড়ে নদীতে ছুঁড়ত, আর ঋতম পেন্সিল দিয়ে মেঘলার চুল, নদীর ঢেউ বা আকাশের রঙ আঁকত। মাঝে মাঝে তারা নিজেদের ছোট ছোট গল্প শোনাত—মেঘলা বলত তার মায়ের সেলাইয়ের কাজের কথা, ঋতম বলত স্কুলে আঁকার প্রতিযোগিতায় জেতার অভিজ্ঞতা। নদী, কাশফুল, হাওয়া—সবই যেন এই নতুন বন্ধুত্বের অংশ হয়ে গেল। সেই প্রথম কথোপকথন—“তুমি কি নদী আঁকো, নাকি নদীর মন?”—ঋতমের মনে রয়ে গেল এক রহস্যময় সুরের মতো, যা প্রতি গোধূলিতে আবার বাজত, যতক্ষণ না তারা মিলিত হতো সেই নদীর ধারে।

(৪)

কয়েকদিন ধরে একসঙ্গে বসতে বসতে নদীর ধারের একটি বিশেষ জায়গা যেন তাদের দুজনের জন্য আলাদা হয়ে উঠল। বাঁকের কাছেই, কাশফুলের সারির ফাঁকে একটি ছোট পাথরের টিলা ছিল, যা বন্যার সময় নদী বয়ে এনেছে এবং শুকনো মৌসুমে অর্ধেক মাটি, অর্ধেক শ্যাওলা দিয়ে ঢাকা পড়ে আছে। প্রথমে ঋতম সেখানে বসে স্কেচ করছিল, মেঘলা এসে তার পাশেই বসল, আর সেই মুহূর্তে তারা দুজনেই বুঝতে পারল—এই জায়গাটা অন্যরকম। এখান থেকে নদীর ধারা একটু বাঁক নিয়ে দূরে চলে যায়, মাঝপথে জলে কিছু পাথরের সারি দেখা যায়, আর ওপারে বনের গাছের ছায়া পড়ে জলের ওপর। এই দৃশ্যটা এত শান্ত, এত আলাদা যে মনে হয় যেন পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এক কোণ। তারা ঠিক করল, এটাই হবে তাদের আসন—তাদের গোপন রাজ্য, যেখানে বাইরের কেউ আসে না। বসার জায়গা ঠিক করার পর দুজনের মধ্যেই এক অদৃশ্য স্বত্বাধিকারবোধ জন্ম নিল, যেন নদী নিজেই এই জায়গাটা তাদের হাতে তুলে দিয়েছে।

সেদিন তারা প্রথম নিয়ম বানাল। মেঘলাই বলল, “এই জায়গার কথা তুমি কারো কাছে বলবে না, আমিও বলব না। এটা শুধু আমাদের।” ঋতম হাসল, মাথা নাড়ল। তাদের কথায় অদ্ভুত গুরুত্ব ছিল—এ যেন খেলার নিয়ম নয়, বরং গোপন বন্ধুত্বের চুক্তি। স্কুলে বা বাড়িতে কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে বিকেলে কোথায় যাও, তারা সাধারণ উত্তর দেবে, কিন্তু আসল সত্য কেউ জানবে না। ঋতমের মনে হলো, এই গোপনীয়তা তাদের সম্পর্ককে আরও গভীর করছে, কারণ তারা একে অপরের বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এমনকি তারা ঠিক করল, এই পাথরের টিলায় বসা মানেই স্কুলের, পরীক্ষার বা পরিবারের কথা নয়—শুধু নদীর কথা, আকাশের রঙের কথা, অথবা একেবারে চুপচাপ থাকা। এই নিয়মে এমন এক স্বস্তি ছিল, যা তারা অন্য কোথাও পেত না। চারপাশে নদীর শব্দ, বাতাসে কাশফুলের দোলা, আর ওপরে ধীরে ধীরে বদলাতে থাকা গোধূলির আকাশ—সব মিলিয়ে এই মুহূর্তগুলো একেবারে তাদের নিজস্ব হয়ে উঠল।

দিনগুলো যেতে লাগল, আর এই গোপন রাজ্যে তাদের উপস্থিতি এক অভ্যাসে পরিণত হলো। কখনো ঋতম মেঘলাকে দেখাত নতুন আঁকা ছবি, কখনো মেঘলা গল্প শোনাত তার শৈশবের, বা অদ্ভুত স্বপ্নের কথা। মাঝে মাঝে তারা কিছুই বলত না, শুধু নদীর দিকে তাকিয়ে থাকত—যেন নদী তাদের কাছে নিজের ভাষায় কিছু বলছে, যা বাইরের কেউ শুনতে পায় না। এই নীরবতার ভেতরেই তারা অনুভব করত, কতটা গভীরভাবে একে অপরকে বুঝতে শিখছে। বাইরের পৃথিবী হয়তো ভাবত তারা দুই সাধারণ কিশোর-কিশোরী, কিন্তু এই পাথরের টিলায় বসা দুজন জানত, তারা এক গোপন জগতে প্রবেশ করেছে—যেখানে সময় ধীরে চলে, শব্দের দরকার নেই, আর সম্পর্কের গভীরতা মাপা যায় শুধু বিশ্বাস দিয়ে। এই গোপন রাজ্যের সাক্ষী শুধু নদী, কাশফুল, আর ওপরে প্রতিদিন বদলে যাওয়া আকাশ।

(৫)

মেঘলা এক গভীর নিঃশ্বাস ফেলে নদীর পাড়ের নরম ঘাসে বসে পড়ল। বাতাসে ভেসে আসা ভিজে মাটির গন্ধ, দূরে পাড়ের কাছে ঢেউয়ের আলতো শব্দ, আর আকাশে ধীরে ধীরে জমে ওঠা মেঘ যেন তার মনকেও এক অন্যরকম শান্তি দিচ্ছিল। অনেকদিন ধরে বুকের ভেতর জমে থাকা কথা হঠাৎই আজ বলতে ইচ্ছে হলো—হয়তো ঋতমের চোখে যে মমতা, সেই নিরাপদ বিশ্বাসটাই তাকে সাহস দিল। মৃদু কণ্ঠে সে বলতে শুরু করল—তার বাবা নেই বহু বছর, খুব ছোটবেলায় একটা দুর্ঘটনায় হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সেই থেকে মা-ই তার ভরসা, মা-ই তার বন্ধু। কিন্তু সেই মা-কে প্রতিদিন সংসারের বোঝা টানতে দেখেছে সে—অর্থের টান, সমাজের চাপ, একা হাতে মেয়েকে মানুষ করার সংগ্রাম—সবই মেঘলার চোখের সামনে দিয়ে কেটেছে। সে ছোটবেলায় প্রায়ই ভাবত, কেন তাদের জীবনটা অন্যদের মতো স্বাভাবিক নয়, কেন প্রতিদিন একটা লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। বলতে বলতে তার চোখে জল এসে গেল, কিন্তু ঋতম কিছু না বলে শুধু তাকিয়ে রইল, যেন প্রতিটি শব্দ নিজের ভেতর টেনে নিচ্ছে। মেঘলা অনুভব করল, সে কাউকে তার জীবনের এই অধ্যায় এত খোলাখুলি বলেছে—এটা প্রথম।

ঋতম কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, যেন মেঘলার কথাগুলোকে পুরোপুরি আত্মস্থ করছে। তারপর মৃদু হেসে বলল, “তোমার গল্প শোনার পর আমার নিজের কথাটাও বলতে ইচ্ছে করছে।” সে জানাল, তারও একটা স্বপ্ন আছে—একদিন নদীর ধারে, ঠিক এই রকম শান্ত জায়গায়, সে একটা আর্ট গ্যালারি খুলবে। শুধু ছবি নয়, সেখানে থাকবে ভাস্কর্য, ফটোগ্রাফি, আর মানুষদের নিজের মতো করে গল্প বলার জায়গা। ঋতমের কণ্ঠে এমন এক দৃঢ়তা ছিল, যেন সে ভবিষ্যতের সেই ছবিটা স্পষ্ট দেখছে—গ্যালারির খোলা বারান্দা, দেওয়ালে ঝোলানো রঙিন ছবি, জানালা দিয়ে ভেসে আসা নদীর হাওয়া, আর মানুষদের মুখে হাসি। সে বলল, “আমি চাই মানুষ এখানে এসে শুধু শিল্পকর্ম না দেখুক, তারা যেন নিজেদের জীবনের রঙগুলোও খুঁজে পায়।” মেঘলা শুনছিল মুগ্ধ হয়ে—একজন মানুষ যখন সত্যিই নিজের স্বপ্নের কথা বলে, তখন তার চোখে যে আলো জ্বলে ওঠে, তা আর কিছুতে হয় না।

দু’জনের কথোপকথন ধীরে ধীরে এমন এক জায়গায় পৌঁছল, যেখানে তাদের গল্প আর স্বপ্ন একে অপরের সঙ্গে মিশে গেল। মেঘলা হঠাৎ বলল, “যদি একদিন তোমার গ্যালারি হয়, আমি সেখানে আমার লেখা কবিতা পড়ে শোনাব।” ঋতমের ঠোঁটে এক নিঃশব্দ হাসি ফুটে উঠল, “আর আমি তোমার জন্য সেই কবিতার চিত্র আঁকব।” নদীর হাওয়া তখন আরও ঠান্ডা হয়ে উঠেছে, সূর্যের আলো মেঘের আড়াল দিয়ে সোনালি রেখায় পড়ছে তাদের ওপর। মেঘলা অনুভব করল, এই মানুষটার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সময়ের হিসেব হারিয়ে ফেলা যায়—কারণ এখানে শুধু বর্তমান আছে, অতীতের যন্ত্রণা আর ভবিষ্যতের উদ্বেগ যেন মিলেমিশে গেছে এই মুহূর্তের শান্তির ভেতর। তারা বুঝতে পারল না কখন নদীর ধারে বসে থাকা দু’জন মানুষ, নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন জীবন থেকে উঠে এসে, পরস্পরের স্বপ্নে চুপিসারে একটা জায়গা পেয়ে গেল। আর সেই জায়গাটা ছিল অদ্ভুতভাবে সুন্দর—যেন নদীর স্রোতের মতো, যা চলতে থাকে থেমে না গিয়ে, তবুও সবসময় সঙ্গে বয়ে নিয়ে যায় প্রিয় কিছু মুহূর্ত।

(৬)

বর্ষা এসে নদীর চেহারা বদলে দিল একেবারে। আগের শান্ত স্রোত এখন ফুলে ওঠা ঢেউয়ে ভরে গেছে, পাড়ের ঘাস ও কাশফুল জলমগ্ন। আকাশ প্রায়ই কালো মেঘে ঢাকা থাকে, আর মাঝেমাঝে দূরে বিদ্যুতের রেখা দেখা যায়, সঙ্গে আসে গভীর গর্জন। এই সময়ে নদীর ধারে যাওয়া সহজ নয়, তবুও মেঘলা ও ঋতম ঠিক করল—বর্ষা যতই হোক, তারা দেখা করবেই। একদিন দুপুরে বৃষ্টি থেমে গেলে, দু’জনেই ছাতা হাতে বেরিয়ে পড়ল। পাথরের টিলা তখন অর্ধেক ডুবে আছে, কিন্তু তারা কাছেই শুকনো এক টুকরো জমি খুঁজে নিল। চারপাশে ভিজে মাটির গন্ধ, জলভরা বাতাসে ঠান্ডা শিরশিরে অনুভূতি—সব মিলিয়ে গোধূলির সেই পরিচিত সময় আজ নতুন রূপে হাজির। মেঘলা ভেজা চুল কানে গুঁজে দিল, আর ঋতম ছাতা ঠিক করে ধরে তার দিকে তাকাল—বর্ষার আলোতে মেঘলাকে যেন আরও শান্ত, আরও গভীর লাগছিল।

ঋতম সেই দিন প্রথমবার ব্যাগ থেকে সাবধানে একটি ফাইল বের করল। মেঘলা অবাক হয়ে তাকাল—এতদিন সে কখনো কিছু নিয়ে আসেনি, শুধু স্কেচবুক আর পেন্সিল ছাড়া। ফাইল খুলে মেঘলার হাতে দিল একটি স্কেচ—নদীর পাড়ে দাঁড়ানো এক মেয়ের ছবি, হাতে কাশফুল, দূরে বর্ষার আকাশ আর ফুলে ওঠা নদী। মেয়েটির মুখ এত নিখুঁতভাবে এঁকেছে যে কোনো সন্দেহই রইল না—এটা মেঘলার ছবি। সে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইল, যেন নিজের প্রতিবিম্ব নতুন করে দেখছে, কিন্তু এই প্রতিচ্ছবিতে শুধু বাইরের রূপ নয়—চোখের ভেতরের গভীরতাও ধরা পড়েছে। মেঘলার ঠোঁটে ধীরে ধীরে হাসি ফুটে উঠল, তবে সেই হাসির ভেতর লুকানো ছিল এক অদ্ভুত কৃতজ্ঞতা আর আবেগ। “তুমি… আমার এই ছবি কবে এঁকেছ?”—তার কণ্ঠে বিস্ময়। ঋতম শুধু বলল, “যেদিন তুমি তোমার গল্প বলেছিলে, সেদিনই মনে মনে ঠিক করেছিলাম, তোমাকে নদীর সঙ্গে এঁকব।”

বৃষ্টি আবার ঝিরঝির করে নামতে শুরু করল, ছাতার ওপর ফোঁটা পড়ে টুপটাপ শব্দ তুলছে। মেঘলা স্কেচটা বুকে চেপে রাখল, যেন বৃষ্টির ভেজা হাত থেকেও রক্ষা করতে চাইছে। তার চোখে জল জমে উঠলেও সেটা বৃষ্টির ফোঁটার সঙ্গে মিলেমিশে গেল। ঋতম অনুভব করল, এই মুহূর্তে তাদের মধ্যে যে নীরব বন্ধন তৈরি হয়েছে, সেটা আগের যেকোনো দিনের চেয়ে গভীর। কাশফুল এখন জলে ডুবে আছে, নদী উচ্ছ্বাসে ভরা, কিন্তু তাদের গোপন রাজ্য আরও দৃঢ় হয়ে উঠেছে। বর্ষার ঢেউ যেমন নদীর গভীরতা বাড়িয়ে দেয়, তেমনি এই ঋতু তাদের সম্পর্কের গভীরতাও বাড়িয়ে দিল। তারা জানত না, সামনে ঋতু বদলাবে, আকাশ বদলাবে, হয়তো জীবনের পথও বদলাবে—তবু এই বৃষ্টিভেজা দিন, একটি স্কেচ আর নদীর স্রোত চিরকাল থেকে যাবে তাদের মনে, যেন এক অবিনশ্বর চিহ্ন।

(৭)

সেপ্টেম্বরের এক বিকেলে, স্কুলের করিডরে মেঘলার চোখে পড়ল—ঋতম এক সহপাঠী মেয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। দু’জনের হাসি-আড্ডা এত স্বতঃস্ফূর্ত যে, বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে বহুদিনের বন্ধুত্ব। মেয়েটি হাতে কিছু আঁকা কাগজ নিয়ে এসেছে, হয়তো ঋতমকে দেখাতে, আর ঋতম সেই ছবিগুলো দেখে প্রশংসা করছে। কিন্তু দূর থেকে দাঁড়িয়ে থাকা মেঘলার কাছে দৃশ্যটা অন্যরকম লাগল—যেন ঋতমের মনোযোগ পুরোপুরি অন্য কারও দিকে সরে গেছে। তার ভেতরে হঠাৎই এক অচেনা অনুভূতি জন্ম নিল—হালকা কষ্ট, অজানা রাগ, আর অদ্ভুত শূন্যতা। সে বুঝতে পারল না, কেন এমন লাগছে, শুধু মনে হলো, আজ গোধূলিতে নদীর ধারে যাওয়া হবে না। মনে মনে একটা অদৃশ্য দূরত্ব তৈরি হলো, যা সে নিজেই বাড়িয়ে তুলল।

পরের কয়েকদিন মেঘলা নদীর ধারে যায়নি। স্কুল শেষ হলে সরাসরি বাড়ি চলে যেত, কিংবা বইয়ের অজুহাতে নিজেকে ঘরে আটকে রাখত। ঋতম প্রতিদিন সেই পাথরের টিলায় বসে অপেক্ষা করত, প্রথমে অবাক হয়ে, তারপর ধীরে ধীরে অস্থির হয়ে। নদীর স্রোতের শব্দ, কাশফুলের দোলা, গোধূলির আলো—সব একই রকম থেকেও, মেঘলার অনুপস্থিতিতে যেন অর্থহীন হয়ে উঠল। সে ভেবেছিল, হয়তো কোনো জরুরি কাজে মেঘলা আসতে পারছে না, কিন্তু একের পর এক দিন কেটে যাওয়ায় উদ্বেগ বাড়ল। সে নিজের মনে খুঁজে বের করার চেষ্টা করল—কোথায় ভুল করল, কী এমন হয়েছে যে মেঘলা কথা না বলে দূরে সরে গেল। এই অচেনা ফাঁকা অনুভূতি তাকে বুঝিয়ে দিল, মেঘলার উপস্থিতি তার জীবনে কেবল অভ্যাস নয়, বরং এক গভীর প্রয়োজন।

এক বিকেলে, আকাশে লালচে আলো পড়তে শুরু করেছিল, ঋতম নদীর ধারে বসে সিদ্ধান্ত নিল—এভাবে আর চলতে পারে না। তার মনে হচ্ছিল, গোপন রাজ্যের মতোই তাদের সম্পর্কও যেন ভাঙনের মুখে। নদী তখন স্বাভাবিক স্রোতে বইছে, কিন্তু তার চোখে মনে হচ্ছিল, যেন জলের রঙও ম্লান হয়ে গেছে। সে ভাবতে লাগল, যদি সত্যিই মেঘলা আর ফিরে না আসে, তবে এই পাথরের টিলা, এই গোধূলি, সবকিছু তার কাছে ফাঁকা খোলসের মতো হয়ে যাবে। সেই মুহূর্তে ঋতম স্পষ্ট বুঝতে পারল—মেঘলা কেবল একজন বন্ধু নয়; তার উপস্থিতি ঋতমের পৃথিবীকে পূর্ণ করে তোলে, ঠিক যেমন নদীর স্রোত তীরে এসে মিলিয়ে যায়। আর এই উপলব্ধিই তার ভেতরে এক দৃঢ় সংকল্প তৈরি করল—যেভাবেই হোক, তাকে ভুল বোঝাবুঝির সমাধান করতে হবে, কারণ মেঘলাকে ছাড়া এই গল্প অসম্পূর্ণ।

(৮)

সেই বিকেলটা ছিল নিস্তব্ধ, কিন্তু নিস্তব্ধতার ভেতরেও এক অদ্ভুত অস্থিরতা বয়ে যাচ্ছিল। নদীর ওপরের আকাশ তখন মেঘে ঢাকা, যেন কারও চুপচাপ কান্না জমে আছে সেখানে। গাছের পাতায় ভিজে বৃষ্টির ফোঁটার শব্দ, দূরে মাঝেমধ্যে শোনা যাচ্ছে নৌকার দাঁড় টানার টুপটাপ শব্দ। ঋতম দাঁড়িয়ে ছিল সেই পুরোনো বাঁশের ঘাটে, যেখানে তারা একদিন একসঙ্গে বসে কত গল্প করেছিল, কত হাসি ভাগ করে নিয়েছিল। গত কয়েক মাসের বিচ্ছেদ, ভুল বোঝাবুঝি আর অভিমান যেন তার বুকের ভেতর ইটের মতো জমাট হয়ে আছে। ঠিক তখনই, বৃষ্টির ফোঁটার আড়াল ভেদ করে দেখা গেল—মেঘলা আসছে। সাদা সালোয়ারের ওপর হালকা নীল ওড়না, ভেজা চুল কাঁধে পড়ে আছে, চোখে যেন অনেক রাত জাগার ছাপ। এক মুহূর্তের জন্য ঋতমের শ্বাস আটকে গেল, যেন এই দৃশ্যটা সে কেবল স্বপ্নে কল্পনা করেছিল। মেঘলার মুখে কোনও তাড়াহুড়ো নেই, বরং ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে, কিন্তু তার চোখে ভেসে উঠছে এক অগোছালো আবেগ—আশা, ভয়, আর অভিমানের মিশ্রণ।

মেঘলা কাছে এসে কিছুক্ষণ কিছু বলল না, শুধু দাঁড়িয়ে রইল, আর সেই নীরবতার মধ্যে যেন বৃষ্টির সুরও ম্লান হয়ে গেল। ঋতম নিজের ভেতরের সাহস জোগাড় করে বলল, “তুমি এসেছ, ভাবিনি।” মেঘলা তাকাল তার দিকে, চোখের গভীরে জমে থাকা অব্যক্ত ব্যথা নিয়ে। “ভাবা আর না ভাবার মাঝেই অনেক কিছু ঘটে যায়, ঋতম,” তার গলায় ভাঙা সুর। ঋতম বুঝতে পারল, এটাই সেই সময়, যখন কথা না বললে আর কোনও কথা বলার সুযোগ থাকবে না। সে ধীরে ধীরে নিজের ভিতরের সব গোঁড়ামি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ব্যাখ্যা করল সেই দিনগুলোর ভুল বোঝাবুঝি—কীভাবে কিছু কথার ভুল ব্যাখ্যা তাদের দূরে ঠেলে দিয়েছিল, কীভাবে এক মুহূর্তের অভিমান অনেক দিনের নীরবতায় রূপ নিয়েছিল। কথা বলতে বলতে তার গলা কেঁপে উঠল, আর মেঘলা স্থির দৃষ্টিতে শুনে গেল, মাঝে মাঝে চোখের কোণে জমা জল মুছে। যেন সেই সব দিনের জমে থাকা ভুল আর অভিমানের ভার ধীরে ধীরে হালকা হয়ে আসছে।

শেষ পর্যন্ত, কোনও আড়ম্বর বা নাটকীয়তার মধ্যে নয়, বরং এক সহজ, গভীর মুহূর্তে, ঋতম হাত বাড়িয়ে দিল। মুহূর্তের জন্য মেঘলা দ্বিধা করল—হয়তো অতীতের কষ্ট তাকে থামাতে চাইছিল। কিন্তু পরের মুহূর্তেই, যেন বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ তাকে সাহস দিল, সে ঋতমের হাতটা নিজের হাতে নিল। সেই স্পর্শে কোনও বড়সড় ঘোষণা ছিল না, ছিল না কোনও শর্ত—ছিল কেবল এক নিঃশব্দ স্বীকৃতি, যে তারা আবারও চেষ্টা করবে। নদীর ধারে বৃষ্টি তখনও ঝরছে, আকাশ ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসছে, আর সেই পুরোনো ঘাটে দাঁড়িয়ে দু’জন মানুষ একে অপরের হাত ধরে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চারপাশের পৃথিবী বদলাচ্ছে, নদীর জল বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেই মুহূর্তে তারা দু’জন যেন সময়কে থামিয়ে দিয়েছে—শুধু তারা, বৃষ্টি, আর এক নতুন শুরুর প্রতিশ্রুতি।

(৯)

শরতের এক দুপুরে, স্কুল থেকে ফিরে ঋতম জানতে পারল—তার বাবা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আগামী মাস থেকে তাকে কলকাতায় পাঠানো হবে পড়াশোনার জন্য। বাবার চোখে এটা ছিল এক সুবর্ণ সুযোগ, বড় শহরে ভালো শিক্ষা, নতুন সম্ভাবনা। কিন্তু ঋতমের কানে খবরটা পৌঁছাতেই মনে হলো, যেন কেউ তার ভেতরের সবচেয়ে নরম জায়গায় আঘাত করেছে। সে জানত, এটা হয়তো এড়ানো যাবে না, কিন্তু মেঘলাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবলেই বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা তৈরি হচ্ছিল। সেদিন বিকেলে নদীর ধারে এসে সে চুপচাপ বসে রইল, স্কেচবুক খুলল না, পেন্সিল হাতে নিল না। যখন মেঘলা এলো, তার চোখে সেই স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা ছিল না। কয়েক মুহূর্তের নীরবতার পর সে ধীরে ধীরে খবরটা জানাল। মেঘলার মুখে হাসি ধরে রাখার চেষ্টা ছিল, কিন্তু চোখের গভীরে এক অন্ধকার নেমে এলো—যেন হঠাৎ করেই দিনের আলো নিভে গেছে।

তারপরের দিনগুলো গোধূলির সাক্ষাৎগুলো এক অন্য রূপ নিল। আগে যেখানে নদীর ধারে তাদের দেখা ভরে থাকত গল্প, হাসি আর পরিকল্পনায়, এখন সেখানে নেমে এলো এক নীরব বিষণ্নতা। তারা জানত, সময় খুব বেশি নেই, তাই প্রতিটি মুহূর্তকে আঁকড়ে ধরতে চাইত। মেঘলা মাঝে মাঝে জোর করে ভবিষ্যতের কথা তুলত—“কলকাতায় গেলে তোমার নিশ্চয় অনেক নতুন বন্ধু হবে, অনেক জায়গা দেখবে”—কিন্তু তার গলায় চাপা কষ্ট লুকোনো থাকত। ঋতমও চেষ্টা করত কথা হালকা রাখতে, কিন্তু অনিচ্ছাকৃতভাবেই তারা দু’জনেই নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকত, যেন সময়ের প্রবাহকে থামিয়ে দিতে চাইছে। মাঝে মাঝে বৃষ্টি নামত, আকাশে সাদা মেঘ ভেসে যেত, কিন্তু তাদের মনের ভেতর জমে থাকা বিদায়ের ছায়া সরত না। এমনকি পাথরের টিলাটিও যেন তাদের অনুভূতির ভারে নুয়ে পড়েছিল।

বিদায়ের আগের দিন, গোধূলির আলো নদীর ওপর সোনালি ছায়া ফেলছিল। তারা পাশাপাশি বসে ছিল, দু’জনের হাত নীরবে একে অপরের হাতে গিঁট বাঁধা। কোনও প্রতিশ্রুতি উচ্চারণের দরকার ছিল না, তবুও ঋতম বলল, “আমি ফিরব… এই নদীর ধারে, আমাদের জায়গায়।” মেঘলার ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটল, কিন্তু সেই হাসি ছিল চোখের জলের আড়ালে। সে শুধু বলল, “তুমি যতদিন দূরে থাকবে, নদীকে বলব তোমার কথা মনে রাখতে।” তাদের চারপাশে সন্ধ্যা নামতে লাগল, নদীর স্রোত নিরবধি বয়ে চলল, আর তারা জানত—জীবন বদলে যাবে, ঋতু বদলাবে, কিন্তু এই মুহূর্তের প্রতিশ্রুতি, এই গোধূলির স্রোতে ভেসে থাকা স্মৃতি, চিরকাল বেঁচে থাকবে।

(১০)

বিদায়ের দিনটা এসে গেল অবশেষে—একটা দিন, যেটার জন্য না কোনও প্রস্তুতি ছিল, না কোনও ইচ্ছে। দুপুরের পর থেকেই আকাশে মেঘ জমে ছিল, কিন্তু বৃষ্টি পড়েনি; বাতাসে ছিল এক অদ্ভুত গুমোট ভাব, যেন প্রকৃতি নিজেও জানে আজকের মুহূর্তের ভার। ঋতম নির্ধারিত সময়ের আগেই নদীর ধারে এসে দাঁড়াল। গোধূলির আলো তখন নদীর জলে লালচে আভা ফেলছে, আর চারপাশে কাশফুলের ঝাঁক হালকা হাওয়ায় দুলছে। দূর থেকে মেঘলার আসার শব্দ শোনা গেল—পায়ের আওয়াজ, পাথরের ওপর হালকা চাপা খসখস। সে এলো ধীরে ধীরে, সাদা সালোয়ারের ওপর হালকা হলুদ ওড়না, চোখে এমন এক গভীরতা, যা শব্দে বোঝানো যায় না। তাদের চোখাচোখি হতেই দু’জনের মুখে এক নীরব হাসি ফুটল, কিন্তু সেই হাসির ভেতরে গোপন ছিল অসংখ্য অব্যক্ত কথা, অগণিত না বলা অনুভূতি।

তারা কিছুক্ষণ কিছু বলল না—শুধু পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে রইল। ঋতমের মনে হচ্ছিল, প্রতিটা সেকেন্ড যেন ফসকে যাচ্ছে আঙুলের ফাঁক দিয়ে, অথচ সে চাইলেই থামাতে পারছে না। অবশেষে সে বলল, “মনে রেখো, এই নদী… এই জায়গা… আমাদের গোপন কথা জানে।” মেঘলা হালকা মাথা নাড়ল, যেন এটাই তাদের সবচেয়ে বড় চুক্তি। তারপর ধীরে ধীরে তারা একে অপরের হাত ধরল—মজবুত করে, যেন এই এক স্পর্শের ভেতরেই তারা পরস্পরকে সব কথা বলে দেবে। নদীর ওপরে তখন গোধূলির লাল আভা আরও গাঢ় হচ্ছে, আকাশে প্রথম তারা দেখা দিয়েছে। দূরে একটা নৌকা ভেসে যাচ্ছে, দাঁড়ের ছন্দে জলের ওপর বৃত্ত তৈরি হচ্ছে, আর সেই বৃত্ত যেন তাদের মুহূর্তটিকে চারপাশ থেকে ঘিরে রাখছে।

যখন ঋতমের যাওয়ার সময় হলো, তারা ধীরে ধীরে হাত ছাড়ল, কিন্তু সেই স্পর্শের উষ্ণতা দু’জনের হাতেই রয়ে গেল, যেন কোনও অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। ঋতম ধীরে ধীরে বাঁকের দিকে হাঁটতে লাগল, আর মেঘলা দাঁড়িয়ে রইল সেই পাথরের টিলায়—যেখানে তাদের সব গল্প জমা আছে। সে দেখল, ঋতম ক্রমশ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে, আর তার চোখ ভিজে উঠল, কিন্তু কণ্ঠে কোনও শব্দ নেই। নদী তখনও বয়ে চলেছে, স্রোতের গভীরে যেন আটকে রেখেছে তাদের প্রতিশ্রুতির স্মৃতি। হয়তো বহু বছর পর, যখন ঋতম ফিরে আসবে, তখনও এই নদীই হবে প্রথম সাক্ষী—যে নিঃশব্দে জানবে, কেমন করে দুই মানুষের গল্প সময়কে পেরিয়ে আবার একসঙ্গে বেঁধে দেয়। সেই দিন পর্যন্ত নদী তার বুকে গোধূলির এই গোপন কথা লুকিয়ে রাখবে, নীরব, অবিচল, চিরন্তন।

শেষ

1000052317.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *