Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

নীলতরঙ্গ

Spread the love

স্নিগ্ধা চক্রবর্তী


এক

ভোরের আলো ধীরে ধীরে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে ঢুকে মীরার সিঁথির পাশে খসে পড়া চুলে লেগে যায়। চায়ের কাপে দুধ গরম হওয়ার শব্দ, প্রেসার কুকারের শিস, আর পাশের ঘর থেকে ভেসে আসা অরুণের গম্ভীর কাশি—সব মিলিয়ে ঘরটা যেন এক অদৃশ্য নিয়মে চলছে। অথচ এই শব্দের ভেতরে মীরার মনটা থাকে অন্য কোথাও। হাতের কাজ চলতে থাকে অভ্যাসের মতো, কিন্তু মাথার ভেতর এক ফাঁকা গহ্বর—যেন দিনের শুরু মানেই আরেকটা একই রকম দিনের পুনরাবৃত্তি। সবার জন্য সকালের নাস্তা সাজিয়ে দেওয়ার পরও মনে হয়, কেউ যেন তাকে দেখে না, শোনে না। মীরার কাছে সংসারটা এখন যেন এক অদৃশ্য খাঁচা, যেখানে সে নিজেই তালা লাগিয়ে রেখেছে, আর চাবিটা কোথায় হারিয়ে ফেলেছে মনে নেই।

তার চোখ চলে যায় রান্নাঘরের জানালা দিয়ে দূরের নীল আকাশে। ওই আকাশের রঙ তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় বহু বছর আগে—যখন সে ছোট ছিল, স্কুলের ছুটির দুপুরে একা বসে নীলপদ্ম আঁকত। কত যত্নে আঁকত প্রতিটি পাপড়ি, প্রতিটি শিরা—নীল আর সাদা রঙের মিশ্রণে তৈরি হতো এমন এক সৌন্দর্য যা তার কাছে মুক্তির প্রতীক ছিল। তখনও সে জানত না, বড় হয়ে জীবনের ভারে সেই নীলপদ্ম শুধু স্মৃতির পাতায় আটকে যাবে। আকাশের দিকে তাকিয়ে মীরা হঠাৎ অনুভব করে, কতদিন হল সে আর তুলিতে রঙ লাগায়নি! কতদিন হল কাগজে নিজের অনুভূতি মেলেনি! রান্নার ধোঁয়া, ধোয়া কাপড়ের গন্ধ, বাজারের থলেতে ভরা সবজির ওজন—এসবের নিচে চাপা পড়ে গেছে তার রঙের স্বপ্ন।

কথা বলতে গেলে তার চারপাশে সবসময় কেউ না কেউ থাকে—অরুণের কাজের চিন্তা, রিয়ার পড়াশোনা, বাজারের হিসাব—সব মিলিয়ে ঘর ভরা মানুষ, কিন্তু মন ভরা শূন্যতা। অরুণ হয়তো রাতে ফিরে জিজ্ঞেস করে, “আজ বাজারে পটল ছিল?” বা “বিল মিটিয়েছ?” কিন্তু মীরার ভিতরের গল্প শোনার মতো সময় বা আগ্রহ তার নেই। রিয়া এখন কিশোরী—তার নিজের জগৎ আছে, যেখানে মায়ের জায়গা খুব সামান্য। মাঝে মাঝে মীরা ভাবে, হয়তো এটাই স্বাভাবিক; জীবন তো সবাইকে নিজের মতো করে বদলে দেয়। তবু, মনের ভেতর এক কষ্ট রয়ে যায়—যে মানুষটিকে সে সবচেয়ে বেশি চেনে, সেই হয়তো তাকে সবচেয়ে কম চেনে।

এই একাকীত্ব তার কাছে নতুন কিছু নয়, কিন্তু আজ সকালে জানালার বাইরে সেই নীল আকাশ আর দূরের এক ফোঁটা মেঘ দেখে মনে হল, হয়তো সে এখনও পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। হয়তো কোথাও একটা রঙিন কাগজ, শুকনো ব্রাশ আর অল্প কিছু রঙ পড়ে আছে, অপেক্ষা করছে আবার স্পর্শ পাওয়ার জন্য। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দেওয়ার সময় তার মনে হল, এই রঙগুলো শুধু কাগজে নয়, তার জীবনেও ফিরিয়ে আনা যায়। কিন্তু সেই মুহূর্তেই পাশের ঘর থেকে অরুণের ডাক এলো—“মীরা, আমার শার্টটা কোথায় রেখেছ?”—এবং বাস্তবের মাটিতে সে আবার নেমে এল। তবু আজকের সকালের নীল আকাশ তার ভেতরে একটা অদৃশ্য রেখা টেনে দিয়ে গেল, যেটা হয়তো একদিন নতুন কিছুর শুরু হবে।

দুই

মীরার ছোটবেলার দিনগুলো যেন রঙের গন্ধে ভরা ছিল। তখন তার পৃথিবী ছিল খুব ছোট—মফস্বলের একটা সরকারি স্কুল, কাঁচা রাস্তার ধুলো, দুপুরবেলা মাঠে গরমের হাওয়া, আর শীতের সকালে রোদ পোহাতে পোহাতে কাগজে তুলি চালানো। প্রতি বছর স্কুলে আর্ট প্রতিযোগিতা হত, আর মীরা থাকত প্রথম সারিতে। তার আঁকা ছবি অন্যদের থেকে আলাদা হত—শুধু রঙের সৌন্দর্যের জন্য নয়, বরং প্রতিটি ছবিতে থাকত একটা গল্প, একটা মায়া। একবার সে “বর্ষার পদ্ম” আঁকেছিল—জলমগ্ন পুকুরে নীলপদ্ম ফুটে আছে, আকাশে ধূসর মেঘ। সেই ছবি প্রথম পুরস্কার পায়, আর বাড়ি ফিরে বাবা তার হাতে তুলে দেন একটা রঙিন তুলি সেট, সঙ্গে কয়েকটা জলরঙের টিউব। তখন মনে হয়েছিল, এর চেয়ে মূল্যবান উপহার পৃথিবীতে আর কিছু হতে পারে না। সেই দিন বাবা বলেছিলেন, “তুই একদিন অনেক বড় শিল্পী হবি।” সেই কথাগুলো মীরার হৃদয়ে যেন গেঁথে গিয়েছিল, ঠিক যেমন নীলপদ্মের নরম পাপড়িতে শিশির জমে থাকে।

কিন্তু সময়ের সাথে সাথে জীবন অন্যদিকে মোড় নিল। কলেজ শেষ করেই বিয়ের প্রস্তাব এল, আর বাবা-মা খুশি মনে মীরাকে শহরের এক চাকরিজীবী অরুণ সেনের সাথে বিয়ে দিলেন। নতুন সংসারে প্রথম দিকে সবকিছুই নতুন, সবকিছুই ব্যস্ততায় ভরা—বাজার, রান্না, আত্মীয়দের আসা-যাওয়া। রঙ-তুলি তখনও আলমারির এক কোণে ছিল, মাঝে মাঝে মীরা সেগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবত—আজ না হয় একটু আঁকি। কিন্তু দিনশেষে রান্নার হাঁড়ি ধোয়া আর শার্ট ইস্ত্রি করতে করতে সেই ইচ্ছেটা হারিয়ে যেত। অরুণ কখনও আঁকার ব্যাপারে কিছু বলেনি, কিন্তু তার নীরবতা আর ব্যস্ত দৃষ্টি বুঝিয়ে দিয়েছিল—এইসব শখ-আহ্লাদ সংসারের জন্য খুব জরুরি নয়।

বছরের পর বছর কেটে যেতে যেতে রঙগুলো শুকিয়ে গেল, কাগজগুলো হলদেটে হয়ে গেল, আর তুলিগুলো ধুলো জমে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। “বাস্তব জীবন” তখন পুরোপুরি নিজের নিয়ম চাপিয়ে দিয়েছে মীরার ওপর। ভাড়ার ফ্ল্যাটের খরচ, মেয়ের স্কুল ফি, অরুণের অফিসের সময়সূচি—সব মিলিয়ে তার দিনগুলো একটা সুনির্দিষ্ট যন্ত্রের মতো চলতে লাগল। মাঝে মাঝে যখন বাজার থেকে ফিরতে ফিরতে রাস্তার ধারে কোনো চিত্রপ্রদর্শনী দেখতে পেত, তখন ভিতরে কোথাও যেন একটু কেঁপে উঠত—যেন কেউ অচেনা সুর ছুঁয়ে দিলো। কিন্তু সেই কম্পন মুহূর্তেই চাপা পড়ে যেত বস্তার ভেতর থাকা সবজির ওজন আর নিত্যদিনের হিসাবের নিচে।

তবু, মনের গভীরে সেই শৈশবের নীলপদ্ম এখনো বেঁচে ছিল। স্বপ্নটা যেন পুরোপুরি মরে যায়নি—শুধু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। মীরা জানত, একদিন যদি আবার তুলি হাতে নেয়, তবে সেই পদ্ম আবার ফুটবে। কিন্তু সেই দিনের অপেক্ষা যেন অন্তহীন হয়ে গেছে। কখনও মনে হয়, এই অপেক্ষা শুধু নিজের জন্য নয়—কেউ যেন বাইরে থেকে এসে বলুক, “তুমি পারবে, আবার শুরু করো।” কিন্তু ততদিন পর্যন্ত, ভুলে যাওয়া স্বপ্নটা আলমারির অন্ধকারে, শুকনো রঙের টিউব আর ধুলো জমা তুলির পাশে নীরবে পড়ে থাকবে—যেন একটা দীর্ঘশ্বাস, যা কেউ শোনে না।

তিন

সন্ধ্যার পর যখন অরুণ ঘরে ফেরে, তখন মীরার দিনের সব কাজ প্রায় শেষ হয়ে আসে। চুলা নিভে গেছে, থালা-বাসন ধুয়ে শুকোতে রাখা হয়েছে, আর রিয়া নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে পড়াশোনার অজুহাতে ফোনের পর্দায় ডুবে আছে। অরুণ জুতো খুলে বসে, ব্যাগটা টেবিলের পাশে রাখে, আর চশমাটা কপাল থেকে সরিয়ে বলে, “আজ বাজারে মাছ কেমন ছিল?” অথবা, “গ্যাস বিল কেটে নিয়েছে তো?” মীরা জবাব দেয়, মাথা নেড়ে বলে, “হ্যাঁ, সব মিটিয়ে দিয়েছি।” কথোপকথন সেখানেই শেষ হয়। একসময় তারা দু’জন ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করত—ছবি, বই, স্বপ্ন, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা—সবই ছিল আলোচনার বিষয়। এখন সেই জায়গায় এসেছে বাজারদর, বিদ্যুৎ বিল আর মেয়ের স্কুল ফি-এর ক্যালকুলেশন। মনে হয়, তাদের সম্পর্কটা যেন একটা নীরব চুক্তিতে পরিণত হয়েছে—যেখানে দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন হলেই সব ঠিক আছে, আবেগের কোনো আলাদা জায়গা নেই।

মীরার মধ্যে একটা অদৃশ্য চাপা ক্লান্তি জমে থাকে। সে জানে, অরুণ খারাপ মানুষ নয়—বরং সংসারের প্রতি তার দায়বদ্ধতা অটুট। কিন্তু দায়বদ্ধতা আর আন্তরিকতার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে, যা হয়তো অরুণ খেয়ালই করে না। মীরার চোখে কখনও ধরা পড়ে, অরুণের মুখে সেই হাসিটা নেই, যা আগে থাকত, যখন তারা একসাথে ছাদে বসে আকাশের তারা গুনত। হয়তো বয়স, হয়তো জীবনযাত্রার চাপ, অথবা হয়তো তারা দু’জনই ধীরে ধীরে অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে—কিন্তু সেই হারিয়ে যাওয়া কথাগুলো আর ফিরে আসে না। মীরা মাঝে মাঝে চেষ্টা করে অন্য কিছু বলতে—“আজ একটা ছবি দেখলাম পত্রিকায়, কত সুন্দর রঙের কাজ!”—কিন্তু অরুণের ছোট্ট উত্তর, “হ্যাঁ, ভালো” বা “হুঁ”—সবকিছু থামিয়ে দেয়।

রিয়ার সঙ্গেও দূরত্বটা একই রকম। স্কুল থেকে ফিরে রিয়া ব্যস্ত থাকে নিজের জগতে—হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, ইনস্টাগ্রাম পোস্ট, বন্ধুর ভিডিও কল। মায়ের সাথে তার কথাবার্তা সীমিত—“আজ টিফিনে কী দিয়েছিলে?”, “ম্যাডাম হোমওয়ার্ক দিয়েছেন”, বা “মোবাইলের চার্জার কোথায়?”। মীরা বুঝতে পারে, এটা রাগ বা অবহেলার জন্য নয়—এটা এক প্রজন্মের দূরত্ব, যেখানে তারা একে অপরের অভ্যস্ত ভাষা খুঁজে পায় না। মীরা যখন রান্নাঘর থেকে ডেকে বলে, “একটু বসে গল্প করবি?”, রিয়া বলে, “মা, পরে, এখন কাজ আছে।” সেই “পরে” আর আসে না। একসময় মায়ের কোলেই রিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে রঙপেন্সিল দিয়ে আঁকত, এখন সেই কোল ফাঁকা।

এই নীরবতার ফাঁকে মীরা মাঝে মাঝে নিজের মনেই কথা বলে। রান্না করতে করতে ভাবে, কবে শেষবার তারা তিনজন একসাথে বসে হেসে-খেলে খেয়েছিল। মনে করতে পারে না। যেন সংসারের যন্ত্রে তারা তিনজনই আলাদা চাকা হয়ে গেছে—একই দিকে ঘুরছে, কিন্তু একে অপরের সাথে সংযোগ নেই। মীরা জানে, এই কথার ফাঁক একদিনে তৈরি হয়নি—এটা ধীরে ধীরে এসেছে, ঠিক যেমন পুরনো বাড়ির দেওয়ালে ফাটল তৈরি হয়, আর কেউ খেয়াল না করলে তা বড় হতে থাকে। বাইরে থেকে সব ঠিকঠাক, কিন্তু ভিতরে কোথাও কোথাও শূন্যতা জমে আছে। সে জানে না, এই শূন্যতা একদিন পূর্ণ হবে কি না—কিংবা সে কি নিজেই নতুন কোনো শব্দ, নতুন কোনো রঙ খুঁজে বের করবে, যাতে এই নীরবতার দেয়াল ভেঙে পড়ে।

চার

সেদিন বিকেলে বাজারে বেরিয়েছিল মীরা—কেনাকাটার তালিকা হাতে, মাথায় হিসাব কষছে কোন দোকান থেকে কী নেবে। বাজারের ভিড়, সবজির গন্ধ, মাছের ডাকাডাকি—সবই একঘেয়ে, চেনা দৃশ্য। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ উচ্ছ্বসিত স্বরে ডেকে উঠল, “মীরা? মীরা সেন?” চমকে ঘুরে তাকাতেই সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে একজন নারী—চোখে চেনা ঝিলিক। কয়েক সেকেন্ড লেগে গেল মনে করতে, তারপরই মনে পড়ল—এ তো লীলা মিত্র, তার স্কুলের সেরা বন্ধু! একসময়ের সঙ্গী, যার সাথে মীরা অসংখ্য দুপুর কাটিয়েছে আঁকার প্রতিযোগিতা, গোপন ডায়েরি, আর অবিরাম গল্পের মধ্যে। দু’জনের চোখে তখনই সেই পুরনো দিনের উচ্ছ্বাস ফিরে এল, বাজারের ভিড় যেন মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল, তারা দাঁড়িয়ে রইল এক জায়গায়, সময় যেন কয়েক বছরের ব্যবধান মুছে দিল।

লীলা আজ অন্যরকম লাগছিল—চোখেমুখে আত্মবিশ্বাস, হাতে একটা কাপড়ের ব্যাগ, যেটা দেখে মনে হচ্ছিল নিজের বানানো কিছু নিয়ে এসেছে। গল্প করতে করতে লীলা জানাল, সে এখন নিজের একটা বুটিক চালায়। ছোট্ট একটা শোরুম, যেখানে হাতের কাজের পোশাক, ব্যাগ, আর শাড়ি বিক্রি হয়। “প্রথমে ভেবেছিলাম, পারব না,” লীলা হেসে বলল, “কিন্তু চেষ্টা করলে সব হয়, বুঝলি? নিজের শখকেই পেশায় বদলে ফেলেছি।” মীরা চুপ করে শুনছিল—শুধু শোনাই নয়, ভিতরে কোথাও যেন অদ্ভুত একটা আলো জ্বলে উঠছিল। লীলার গল্পে বাজারের শব্দ ডুবে যাচ্ছিল, কেবল স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল তার কথাগুলো—‘শখ’, ‘পেশা’, ‘নিজের কাজ’। মীরা মনে মনে ভাবছিল, লীলার চোখের এই দীপ্তি সে শেষ কবে নিজের চোখে দেখেছিল।

আলাপের ফাঁকে লীলা হঠাৎ মীরার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই তো দারুণ আঁকতিস। এখনো আঁকিস তো?” প্রশ্নটা যেন মীরার বুকের ভেতর কোথাও আঘাত করল। সে হাসিমুখে বলল, “না রে, এখন আর সময় পাই না।” কিন্তু সেই কথার আড়ালে ছিল দীর্ঘ বছরের আক্ষেপ—যা বলার ভাষা তার নেই। লীলা তবু থামল না, বরং বলল, “শোন, সময় পাওয়া যায় না, বানাতে হয়। তুই আঁকা শুরু কর, আমি তোকে ক্রেতা খুঁজে দেব।” মীরা তখনও দ্বিধায়—তার মনে হচ্ছিল, এ তো অবাস্তব; এতদিন বাদে আবার শুরু করা কি সম্ভব? কিন্তু লীলা যে ভঙ্গিতে বলছিল, তাতে মনে হচ্ছিল, সে যেন মীরার চেয়েও বেশি বিশ্বাস রাখছে তার উপর।

বিদায় নেওয়ার সময় লীলা হাসিমুখে বলল, “মনে রাখিস, তোর ভেতরে এখনো সেই শিল্পী আছে, শুধু দরজাটা খুলে দিতে হবে।” হাতে বাজারের ব্যাগ, কাঁধে সাদামাটা শাড়ি—মীরা বাড়ি ফেরার পথে হালকা বাতাসে চুল উড়তে উড়তে ভাবছিল, সত্যিই কি সেই দরজা খুলে দেওয়া সম্ভব? চারপাশে বাজারের হট্টগোল থাকলেও, তার মনে হচ্ছিল, ভেতরে কোথাও যেন একটি খুব পুরনো ঘুমন্ত রঙের বাক্স ধীরে ধীরে কাঁপতে শুরু করেছে। সেই কাঁপনই হয়তো ইঙ্গিত—যে ভুলে যাওয়া রঙ আর তুলি হয়তো আবার আলো দেখতে চাইছে।

পাঁচ

সেদিন রাতটা মীরার ঘুম এল না ঠিকমতো। বিছানায় শুয়ে বারবার মনে পড়ছিল লীলার কথাগুলো—“সময় পাওয়া যায় না, বানাতে হয়।” মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা আলোড়ন হচ্ছিল। এতদিন ধরে যে রঙ, যে তুলি, যে ক্যানভাস তার জীবনের বাইরে ঠেলে রাখা ছিল, হঠাৎ তারা যেন দরজায় কড়া নাড়ছে। পরদিন সকালের কাজ সেরে, অরুণ অফিসে আর রিয়া কলেজে বেরিয়ে যাওয়ার পর ঘরটা যখন ফাঁকা হয়ে গেল, তখন মীরা ধীরে ধীরে আলমারির কোণে জমে থাকা পুরনো একটা কার্টন বের করল। ধুলোয় ঢাকা, হলদেটে হয়ে যাওয়া কার্টন—যেন বহুদিনের অবহেলায় মুখ ফিরিয়ে থাকা কোনো পুরনো বন্ধু। কাঁপা হাতে ঢাকনাটা খুলতেই ভেতরে দেখা মিলল শুকিয়ে যাওয়া রঙের টিউব, শক্ত হয়ে যাওয়া তুলি, আর কয়েকটা ক্যানভাস পেপার। সেই গন্ধ—পুরনো রঙের হালকা মিষ্টি গন্ধ—মুহূর্তেই ফিরিয়ে নিল তাকে শৈশবের দুপুরে, যেখানে জানালার ধারে বসে নীলপদ্ম আঁকত সে।

প্রথমে মনে হয়েছিল, এতদিন পর হয়তো হাত কাঁপবে, লাইনগুলো ঠিকমতো উঠবে না। কিন্তু তুলি হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা অদ্ভুত নিশ্চিন্ততা ফিরে এল। মীরা এক নতুন জলরঙের সেট বের করল—যেটা কয়েক বছর আগে বাজার থেকে কিনে রেখেছিল ‘কখনো সময় পেলে আঁকবে’ বলে। সেই সময়টা যেন অবশেষে এসে গেছে। পানির গ্লাসে তুলি ভিজিয়ে প্রথমে নীল রঙ মিশিয়ে নিল সে—গাঢ়, অথচ কোমল। সাদা কাগজের উপর প্রথম তুলির আঁচড় পড়তেই মনে হল, বুকের ভেতরের জমে থাকা ভারী পাথর যেন একটু নড়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে গড়ে উঠল পাপড়ির আকার, জলকণার ছোঁয়া, আর চারপাশের নীলাভ পানির গভীরতা।

ছবিটা যত এগোতে লাগল, মীরার মন তত হালকা হতে লাগল। প্রতিটি রঙের স্তর যেন তার জীবনের ধুলো ঝেড়ে দিচ্ছিল—বছরের পর বছর যে অবহেলা, শূন্যতা আর ক্লান্তি জমে ছিল, তা রঙের সঙ্গে মিশে কাগজে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। নীলপদ্মের মাঝখানে যখন সোনালি রঙের ক্ষুদ্র পরাগচক্রের ছোঁয়া দিল, মনে হল, এই ফুলটা শুধু ছবিতে নয়, তার ভিতরেও ফুটছে। হয়তো বাইরের পৃথিবীতে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি—বাজারের তালিকা এখনও থাকবে, বিল এখনও দিতে হবে, রান্না করতেই হবে—কিন্তু অন্তত এই মুহূর্তে সে কেবল মীরা, একজন শিল্পী, যার তুলি জীবনের একঘেয়েমি ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে।

ছবি শেষ হওয়ার পর মীরা অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল তার দিকে। নীলপদ্মের পাপড়ি যেন কাগজের উপর ভাসছে, আর পানির গভীরতা টেনে নিচ্ছে তার সমস্ত ক্লান্তি। এই ছোট্ট ছবিটাই যেন প্রমাণ—সে এখনো বেঁচে আছে, শুধু বেঁচে থাকার জন্য নয়, নিজের মতো করে বাঁচার জন্যও। টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে, হাতে এখনো রঙের দাগ, সে অনুভব করল—এটাই হয়তো সেই প্রথম পদক্ষেপ, যেখান থেকে শুরু হবে নতুন এক যাত্রা। হয়তো ছোট, হয়তো অনিশ্চিত, কিন্তু তবু নিজের। সেই মুহূর্তে সে মনে মনে লীলাকে ধন্যবাদ দিল—কারণ যদি সেই বাজারে দেখা না হত, তবে হয়তো এই নীলপদ্ম আর ফুটত না।

ছয়

নীলপদ্ম আঁকার কয়েকদিন পর এক বিকেলে লীলা হঠাৎ মীরার বাড়িতে এল। হাতে ছোট্ট একটা কেকের বাক্স, মুখে সেই পুরনো চেনা হাসি। বসার ঘরে ঢুকেই চোখ পড়ল টেবিলের উপর শুকোতে রাখা ছবির দিকে। লীলা এগিয়ে গিয়ে ছবিটা হাতে তুলে নিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর এমনভাবে তাকাল যেন বহুদিন ধরে হারানো কোনো ধন খুঁজে পেয়েছে। “মীরা, তুই আবার শুরু করেছিস?” তার গলায় বিস্ময় আর আনন্দ মিশে ছিল। মীরা একটু লজ্জা পেল, ঠোঁটের কোণে নরম একটা হাসি খেলল। “হ্যাঁ, ভাবলাম একদিন চেষ্টা করে দেখি,” বলল সে ধীর গলায়। কিন্তু লীলার চোখে তখন শুধু বিস্ময় নয়, একটা গর্বও ছিল—যেন সে ঠিক জানত, মীরার ভিতরের শিল্পী এখনও বেঁচে আছে, শুধু জেগে উঠতে সময় লেগেছে।

লীলা ছবি হাতে নিয়ে বলল, “শোন, এটা আমি আমার সোশ্যাল মিডিয়ায় দেব। আমার বুটিকের পেজে প্রচুর মানুষ আসে, সবাই শিল্প আর হাতের কাজ ভালোবাসে। ওখানে দিলে তোর আঁকা অনেকের চোখে পড়বে।” মীরা চমকে উঠল, যেন কেউ তার ব্যক্তিগত ডায়েরির পাতা সবার সামনে পড়তে বলেছে। “না না, ওসবের দরকার নেই,” তাড়াতাড়ি বলে ফেলল সে। “আমি তো নিজের জন্যই আঁকি, এসব দেখিয়ে লাভ কী?” কিন্তু মনের গভীরে একটা ভয়ও কাজ করছিল—যদি মানুষ পছন্দ না করে? যদি কেউ খারাপ মন্তব্য করে? এত বছর পরে আঁকায় ফিরেছে, আর প্রথমেই যদি ব্যর্থ হয়, তবে কি আবার তুলি ধরার সাহস থাকবে? লীলা হেসে বলল, “তুই শুধু আঁকিস, বাকিটা আমার দায়িত্ব।”

সেই কথার পরও মীরা দ্বিধায় ছিল। রাতে খাওয়ার পর ছবিটার দিকে তাকিয়ে ভাবছিল, এটা কি সত্যিই অন্যদের দেখানোর মতো ভালো হয়েছে? নাকি লীলা শুধু বন্ধুত্বের কারণে বেশি প্রশংসা করছে? সে জানত, এই ছবিটা আঁকার সময় তার মন ভরে উঠেছিল, কিন্তু অন্যদের চোখে কি সেই অনুভূতি পৌঁছাবে? ভিতরে ভিতরে যেন এক দোলাচল চলছিল—একদিকে নিজের কাজকে স্বীকৃতি পাওয়ার ইচ্ছে, অন্যদিকে ব্যর্থতার ভয়। খাওয়ার টেবিলে অরুণকে বলতে গিয়েও থেমে গেল, কারণ সে বুঝতে পারল, স্বামীর প্রতিক্রিয়া হয়তো বেশি উৎসাহজনক হবে না। আর রিয়ার কাছে বললে হয়তো সে হালকা করে ‘কুল’ বলবে, তারপর নিজের ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়বে।

পরের দিন লীলা আবার ফোন করল, “মীরা, আমি ছবিটা আপলোড করছি, ঠিক আছে?” মীরা এবারও কিছু বলল না, শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ফোন কেটে দিয়ে জানালার বাইরে তাকাল—নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসছে। হঠাৎ মনে হল, এই ছবিটাও তো তার নিজের আকাশের একটা অংশ, কেন লুকিয়ে রাখবে? ভয়টা তখনও ছিল, কিন্তু তার চেয়ে বড় ছিল এক অদ্ভুত তাগিদ—নিজেকে প্রমাণ করার, শুধু নিজের কাছেই নয়, বাইরের পৃথিবীর কাছেও। ধীরে ধীরে মনে হল, হয়তো সত্যিই এই মুহূর্তটিই সেই ‘প্রথম সাহস’, যেটা একদিন তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।

সাত

লীলা মীরার অনুমতি পাওয়ার পরই ছবিটা নিজের বুটিকের সোশ্যাল মিডিয়া পেজে আপলোড করেছিল। সাথে লিখেছিল—“আমার শৈশবের প্রিয় বন্ধু মীরার হাতে আঁকা নীলপদ্ম। রঙের গভীরতা আর সূক্ষ্মতা দেখে আমি মুগ্ধ। আপনাদের কেমন লাগছে?” পোস্টটি দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কয়েক ডজন লাইক ও মন্তব্য জমা হতে শুরু করল। কেউ বলল, “এত সুন্দর নীল রঙ আগে দেখিনি”, কেউ লিখল, “চোখ সরানো যাচ্ছে না।” মীরা প্রথমে লীলার ফোনে বসে মন্তব্যগুলো দেখছিল, নিজের নাম না বলেও বুঝতে পারছিল, প্রতিটা প্রশংসা তার জন্যই। মনের ভেতরে একটা কাঁপুনি হচ্ছিল—এতদিন শুধু নিজের চোখেই দেখেছে নিজের ছবি, আজ প্রথম অন্য চোখে তা দেখল। প্রশংসার সাথে সাথে একটু অবিশ্বাসও জাগল—এতদিনের নীরবতার পর কি এত সহজে স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব?

পোস্ট হওয়ার দুই দিন পর, এক সন্ধ্যায় মীরার ফোনে লীলা মেসেজ করল—“দ্রুত কল দে, জরুরি।” কিছুটা বিস্মিত হয়ে মীরা ফোন করতেই লীলা উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “তোর জন্য একটা বড় খবর আছে। একজন মিস্টার অমল ঘোষ, কলকাতার একজন শিল্পপ্রেমী, তোর ছবিটা দেখে খুবই মুগ্ধ হয়েছেন। উনি চান তুই নীলপদ্ম সিরিজে পাঁচটা বড় সাইজের ছবি আঁকবি। আর দাম? উনি প্রতিটা ছবির জন্য এমন টাকা দেবেন, যা তুই কল্পনাও করিসনি।” মীরা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। মনে হচ্ছিল, যেন কেউ হঠাৎ করেই তার ছোট্ট ঘরে জানালা খুলে দিয়েছে, আর তাজা বাতাস ঢুকে পড়েছে। এতদিন যে রঙ কেবল মনের শান্তির জন্য ব্যবহার করত, তা আজ হঠাৎ বাস্তব অর্থে পরিণত হতে যাচ্ছে।

রাতে খাওয়ার সময় মীরা খবরটা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু কিছুটা সংকোচে থেমে গেল। সে ভয় পাচ্ছিল, অরুণ হয়তো গুরুত্ব দেবে না, অথবা বলবে—“ঠিক আছে, কর, তবে গৃহকাজ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।” তাই সে নিজেই মনে মনে ভাবল, আপাতত চুপ থাকাই ভালো, কাজ শেষ হলে তবেই ফলাফল দেখাবে। সেই রাতেই কাগজ, রঙ, তুলি সব বের করে রাখল। মনে হচ্ছিল, এ শুধু একটি অর্ডার নয়—এ যেন তার শৈশবের স্বপ্নের কাছে ফেরার এক সুবর্ণ সুযোগ। টেবিলের পাশে বসে পরিকল্পনা করতে লাগল—প্রতিটি নীলপদ্ম আলাদা হবে, রঙের ছায়া, পাপড়ির বিন্যাস, আর জলরঙের গভীরতায় প্রতিটি ছবিতে অন্যরকম অনুভূতি থাকবে।

পরবর্তী কয়েকদিন মীরা ভোর থেকে আঁকায় ডুবে থাকল। রিয়া কলেজে গেলে, অরুণ অফিসে গেলে, ঘর নিস্তব্ধ হয়ে যেত—শুধু কাগজে তুলির ছোঁয়া, পানির মৃদু শব্দ, আর রঙ মিশ্রণের গন্ধ ঘর ভরিয়ে রাখত। প্রতিটি তুলির আঁচড়ের সাথে সাথে তার মনে হচ্ছিল, সে যেন নিজের হারানো অংশগুলো একে একে খুঁজে পাচ্ছে। পাঁচটি ছবি শেষ হওয়ার পর সেগুলো লীলার মাধ্যমে মিস্টার ঘোষের কাছে পাঠানো হল। এক সপ্তাহের মধ্যে পেমেন্ট এল—সংখ্যাটা দেখে মীরা অবাক হয়ে গেল। এটা কেবল টাকা ছিল না, ছিল তার প্রতিভার স্বীকৃতি, বছরের পর বছর অবহেলার পর নতুন করে নিজের মূল্য বোঝার এক মুহূর্ত। সেই রাতে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে মীরা মনে মনে বলল, “আমি পারি।”

আট

মীরা যখন প্রথম মিস্টার ঘোষের অর্ডারের পেমেন্ট হাতে পেল, তখনো অরুণ কিছু জানত না। কিন্তু টাকা জমা পড়ার খবর আসতেই মীরা সিদ্ধান্ত নিল আর গোপন রাখা ঠিক হবে না। এক সন্ধ্যায়, চায়ের কাপ হাতে বসে ধীর স্বরে বলল, “শোনো, আমার একটা কাজের জন্য টাকা এসেছে।” অরুণ খবর শুনে কিছুটা অবাক হলেও কণ্ঠে একধরনের নির্লিপ্ততা ফুটে উঠল—“কাজ? কী কাজ? আবার ওই ছবি আঁকা? এসব করে কি সংসার চলে?” কথাটা বলেই সে কাপের শেষ চুমুক দিয়ে খবরের কাগজে চোখ রাখল, যেন আলোচনার আর কোনো গুরুত্ব নেই। মীরার মনে হালকা কষ্ট লাগল, তবে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না—বিয়ের এত বছর ধরে অরুণ তাকে শিল্পী হিসেবে দেখেনি, কেবল সংসারের একজন দায়িত্বশীল গৃহিণী হিসেবেই চিনেছে।

কিন্তু পরের কয়েকদিনে অরুণের ভেতরে অদৃশ্য কিছু পরিবর্তন হতে শুরু করল। সে খেয়াল করল, মীরা এখন আগের চেয়ে বেশি হাসে, রান্না করতে করতেও গুনগুন করে গান গায়। সকালে নাস্তা দিতে এসে মীরার চোখে একধরনের দীপ্তি দেখে সে চুপ করে থাকে, কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগে—“এ আলো কোথা থেকে এলো?” একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে সে লীলার বুটিকের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল, কাঁচের ভেতর ঝোলানো এক বড় ক্যানভাস তার চোখে পড়ে—মীরার আঁকা নীলপদ্ম। নিচে লেখা, ‘By Meera Sen’. অরুণ হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়াল, ক্যানভাসের গভীর রঙের মধ্যে সে নিজের স্ত্রীকে নতুন করে দেখতে পেল।

এক রাতে খাওয়ার সময় রিয়া ফোনে মগ্ন থাকলেও অরুণের চোখ মীরার দিকে বারবার চলে যাচ্ছিল। অবশেষে সে বলল, “তোমার ওই আঁকাগুলো… লোকজন পছন্দ করছে নাকি?” প্রশ্নের ভেতরে কৌতূহল ছিল, তবে গলায় আর অবহেলা নেই। মীরা হেসে বলল, “হ্যাঁ, কয়েকজন তো আবার পরের কাজের জন্যও বলেছে।” অরুণ নীরবে মাথা নেড়ে খাওয়া চালিয়ে গেল, কিন্তু মনে এক অদ্ভুত গর্বের অনুভূতি কাজ করল—সে হয়তো বলতে জানে না, কিন্তু অনুভব করছে, মীরার এই নতুন যাত্রা তার জন্যও কিছুটা গর্বের বিষয়।

দিন গড়াতে গড়াতে অরুণ ধীরে ধীরে মীরার বদলটা বুঝতে শুরু করল। সে খেয়াল করল, মীরার চোখের ক্লান্তি অনেকটাই কমেছে, যেন ভেতরের শূন্যতা ধীরে ধীরে পূর্ণ হচ্ছে। একদিন অফিসের সহকর্মীকে সে অনায়াসেই বলে ফেলল, “আমার স্ত্রী ছবি আঁকে, জানেন তো? খুব ভালো আঁকে।” কথাটা বলতে গিয়ে সে নিজেই চমকে উঠল—এতদিন যে কাজকে তুচ্ছ করত, আজ সেই কাজ নিয়েই গর্ব করতে শিখেছে। রাতে মীরার পাশে বসে হঠাৎ বলল, “তুমি আঁকা চালিয়ে যাও, আমি আছি।” মীরা কোনো কথা বলল না, শুধু হেসে তাকাল। সেই হাসির ভেতরে ছিল স্বীকৃতি, ভালোবাসা আর দীর্ঘদিনের অপেক্ষার পূর্ণতা।

নয়

মীরার জীবনে যেন এক নতুন ঋতু এসে পড়ল। দিনের একেকটা সময় এখন ক্যানভাসে রঙ মেশানোর জন্য আলাদা করে রাখা থাকে। মিস্টার ঘোষের অর্ডার শেষ করার পরও তার হাতে থামতে না পারা এক তৃষ্ণা তৈরি হয়েছে—আরও আঁকার, আরও রঙে নিজের ভেতরের গল্প বলার। লীলা একদিন এসে বলল, “তুমি তোমার কাজের জন্য একটা নাম দাও, সবাই যেন চিনতে পারে।” মীরা দীর্ঘক্ষণ ভেবে মনে করল সেই প্রথম ছবি—নীলপদ্ম, যা তার শূন্যতার মধ্যে প্রথম প্রাণের রঙ এনেছিল। যেন সেই ফুলটাই তার যাত্রার প্রতীক। তাই সে নিজের অনলাইন আর্ট পেজের নাম রাখল “নীলপদ্ম”। নামটা উচ্চারণ করতেই মনে হলো, যেন এই নামের মধ্যে লুকিয়ে আছে তার অতীতের কষ্ট, বর্তমানের আলো আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন।

নীলপদ্ম পেজে প্রথম পোস্টে মীরা লিখল—“প্রতিটি আঁকা আমার গল্প বলে। হয়তো আপনার গল্পও।” ছবির নিচে লাইক, কমেন্ট, শেয়ার বাড়তে লাগল। অনেকেই তার রঙের ব্যবহার, আলো-ছায়ার খেলা, আর ছবির ভেতরের আবেগের প্রশংসা করল। লীলা তার বুটিকের গ্রাহকদেরও পেজের লিঙ্ক পাঠাল, আর ধীরে ধীরে মীরার কাজ শহরের বাইরে থেকেও মানুষ দেখতে শুরু করল। মীরা অবাক হয়ে দেখল, যে স্বপ্নটাকে সে বহু বছর আগেই মৃত ভেবেছিল, সেটাই এখন নিজের ডানা মেলে উড়তে শুরু করেছে। রাতের বেলায় একা বসে কমেন্ট পড়তে পড়তে তার চোখ ভিজে উঠত—এই স্বীকৃতিই তো তার ভেতরের শিল্পীকে বাঁচিয়ে রাখছে।

একদিন ফোনে লীলা জানাল, “শোনো, শহরের বার্ষিক আর্ট প্রদর্শনীতে তোমার কাজ নেওয়ার কথা বলেছে। আমি তোমার কয়েকটা ছবি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।” মীরা হতবাক হয়ে গেল—প্রদর্শনীতে জায়গা পাওয়া তো শহরের প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের জন্য সম্মানের ব্যাপার। প্রথমে তার মনে সন্দেহ জাগল—“আমি কি যোগ্য?” কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল, প্রথম তুলির আঁচড় দেওয়ার মুহূর্তের সেই আনন্দ, আর মিস্টার ঘোষের দেওয়া স্বীকৃতি। প্রদর্শনীর দিন সকালে, শাড়ি পরে আয়নায় তাকিয়ে নিজের চোখে আত্মবিশ্বাসের ছাপ দেখল। যে মীরা একসময় রান্নাঘরের জানালা দিয়ে শূন্য আকাশ দেখত, সে আজ নিজেই তার আকাশে রঙ মাখাতে যাচ্ছে।

প্রদর্শনীর হলে গিয়ে মীরা দেখল, সাদা দেওয়ালে ঝুলছে তার নীলপদ্ম, পাশাপাশি আরও কয়েকটি ছবি। চারপাশে লোকজন থেমে থেমে ছবি দেখছে, কেউ কারও সাথে তার কাজ নিয়ে আলোচনা করছে। কেউ একজন চুপিচুপি বলল, “এই শিল্পী মীরা সেন—তার রঙের গভীরতা অসাধারণ।” মীরার মনে হলো, এই কয়েকটি শব্দই তার বছরের পর বছরের অবহেলা, একাকীত্ব আর নিজের উপর অবিশ্বাস মুছে দিতে যথেষ্ট। সেদিন রাতে বাড়ি ফেরার সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, নীলপদ্ম শুধু একটা নাম নয়, এটা তার নিজের পরিচয়, তার পুনর্জন্মের প্রতীক। আর এই যাত্রা কেবল শুরু।

দশ

শীতল ভোরের আলো ধীরে ধীরে মীরার ঘরে ঢুকে পড়ছে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে দেখছে, দূরের আকাশে সূর্যের প্রথম রঙ মাখা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে, জীবনের গতিপথ এক অদ্ভুত শান্তি আর দৃঢ়তায় ভরে উঠেছে। বহু বছর ধরে সে যে নিজের ভেতরে এক শূন্যতার খাঁচায় বন্দি ছিল, আজ সেই খাঁচার দরজা খুলে গেছে। মীরা এখন জানে—সে কেবল অরুণের স্ত্রী বা রিয়ার মা নয়, সে একজন শিল্পী, একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। এই পরিচয় তাকে শুধু গর্ব দেয় না, তার ভেতরে জন্ম দেয় এক গভীর স্বাধীনতার অনুভূতি। রান্নাঘরের গন্ধ, বাজারের তালিকা, বকেয়া বিল—এসব তার জীবনের অংশ হয়েও আজ আর তাকে আটকে রাখতে পারছে না। বরং সেগুলোর মাঝেও সে খুঁজে পায় রঙের ছোঁয়া, খুঁজে পায় গল্পের উপাদান।

নীলপদ্ম এখন শুধু একটি অনলাইন পেজ নয়—এটি মীরার আত্মার প্রতিচ্ছবি। প্রতিটি ছবি যেন তার জীবনের একটি অধ্যায়, যেখানে ব্যথা, আনন্দ, আশা আর ভালোবাসা একসাথে মিলেমিশে গেছে। সে এখন শহরের আর্ট প্রদর্শনীতে নিয়মিত আমন্ত্রিত হয়, নতুন নতুন অর্ডার আসে, এমনকি কিছু শিল্পপত্রিকায় তার সাক্ষাৎকারও ছাপা হয়েছে। এসব স্বীকৃতি তাকে খুশি করে, কিন্তু তার চেয়েও বড় তৃপ্তি আসে যখন কোনো অচেনা মানুষ তাকে বলে, “আপনার ছবিটা আমার মনের কথা বলে দিয়েছে।” সেই মুহূর্তে মীরা অনুভব করে, তার রঙের স্পর্শ কেবল ক্যানভাসেই থেমে নেই—এটি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। এই সংযোগই তাকে মনে করিয়ে দেয়, সে ঠিক পথেই এগোচ্ছে।

অরুণের সাথেও তার সম্পর্কের বদল এসেছে। যে মানুষ একসময় বলেছিল, “এসব করে কি সংসার চলে?”, সেই আজ তার প্রতিটি প্রদর্শনীর দিন তাকে গর্বভরে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়—“এই হল আমার স্ত্রী, শিল্পী মীরা সেন।” রিয়াও মাঝে মাঝে মায়ের সাথে বসে ছবি দেখে, রঙ বেছে দিতে সাহায্য করে। এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলো মীরার মনে এক অদ্ভুত শান্তি আনে। পরিবার এখনও তার জীবনের মূল ভিত্তি, কিন্তু আজ সে জানে—সে নিজেও নিজের ভিত্তি গড়ে তুলেছে। নিজের পায়ের তলায় দৃঢ় মাটি অনুভব করা, এটাই তার সবচেয়ে বড় সাফল্য।

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে মীরা গভীর শ্বাস নেয়। শীতল হাওয়া তার চুলে খেলে যায়, দূরে পাখিরা উড়তে শুরু করেছে। সে মনে মনে বলে ওঠে, “নীলপদ্ম এবার সত্যিই ফুটেছে।” এই ফুল কেবল ক্যানভাসের মধ্যে নয়, বরং তার নিজের ভেতর, তার সাহস, তার বিশ্বাস আর তার স্বাধীনতায়। একসময় যে আকাশকে সে শুধু দূর থেকে দেখত, আজ সেই আকাশ তার নাগালের মধ্যে। হয়তো এই আকাশের রঙ বদলাবে, মেঘ আসবে, বৃষ্টি নামবে—কিন্তু সে জানে, তার নীলপদ্ম আর শুকিয়ে যাবে না। তার জীবনের গল্প এখনও চলছে, আর সামনে যে রঙের সম্ভার অপেক্ষা করছে, তা আঁকতে সে প্রস্তুত। আজ সে সত্যিই নিজের আকাশ খুঁজে পেয়েছে।

-শেষ-

1000051761.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *