Bangla - ভূতের গল্প

কালো জানালার ভেতর

Spread the love

উপাসনা রায়


উত্তর কলকাতার যে রাস্তার নাম বারবার বদলেছে, সেখানে একটা বাড়ি আছে যার নাম কখনও বদলায়নি—লোকমুখে “কালোজানালা বাড়ি”। অর্পণ যখন প্রথম দিন চাবিটা হাতে পেল, বিকেলের আলো তখন ছেঁকে পড়ছে ছাদের ধুলোতে; সিঁড়ির মুখে জোনাকি বাতির মতো ঝুলছে পুরনো বাল্ব, আর মেঝের কালো-সাদা মোজাইকের ফাঁক থেকে উঠছে এক ধরনের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ—আদ্রতা আর শেওলার মিশ্রণ। বাড়িওয়ালার সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই, দালাল বাবু বলেছিল, “এখানে যারা থাকে তারা নিজ দায়িত্বে থাকে। পানীয় জল নিজের মতো জোগাড় করবেন, আর… কালো জানালাগুলো বন্ধ রাখবেন।” কথাটা বলে একটু থেমে হেসেছিল, যেন মজা করছে। অর্পণ ভেবেছিল, পুরনো বাড়ির দোষ। কিন্তু যে জানালাগুলোর কাঠে সরু লোহার খাঁজ, তাতে পুরনো কালো রঙ এমনভাবে বসে আছে যে, প্রথম দেখাতেই মনে হবে—এ রঙ উজ্জ্বল নয়, বরং আলো খেয়ে ফেলে।

ঘরে ঢুকে পর্দা সরাতেই ধুলো উড়ে উঠল, কাঠের আলমারি থেকে এক চিমটি মথবল গন্ধ ছিটকে এল, আর সেই সঙ্গে অর্পণের মাথায় ঢুকে পড়ল কাজের তাড়া—সপ্তাহখানেকের মধ্যে তাকে শহরের একটা ছোট প্রদর্শনীর জন্য সিরিজ বানাতে হবে। ছবি তোলো, আবার দেখো, বেছে নাও, তাতে রাত কেটে যায়—এই তো তার রুটিন। ফ্রিল্যান্সারদের দিন-রাত আলাদা থাকে না। তবু এই বাড়িটায় ঢোকার পর থেকেই সে বারবার থমকে যাচ্ছিল। বারান্দা-পেছনের গলির দিকে মুখ করা কালো জানালাগুলোর কাচে নিজের ছায়া পড়ে, তবু যেন কোথাও একটা আরেক ছায়া লেগে আছে, নড়ছে না, তাকিয়েই আছে। প্রথম দিন সে নিজেকে বোঝাল—অভ্যেস নেই বলে লাগছে।

সন্ধের পর চায়ের কাপে দ্বিতীয় চুমুকটা দিতে না দিতেই দরজায় টোকা পড়ল। “আমি মোহিনী,” বাইরে থেকে একটি বয়স্ক নারীকণ্ঠ। দরজা খুলতেই অর্পণ দেখল, সাদা শাড়িতে ধূসর পাড়, কাঁধে একটা পুরনো ব্যাগ, চোখদুটি শান্ত কিন্তু নজর ধারালো। “দারোয়ান-ঘরে থাকি। কোনও কাজ থাকলে আমাকে বলবেন। আর…” সে এক মুহূর্ত থামল, তারপর বলল, “কালো জানালাগুলোর শিকলগুলো খোলা রাখবেন না। এখানে বাতাস ঘুরতে হলে পর্দা উঠিয়ে দরজার ওপরের ভেন্টিলেশনটা চালিয়ে দেবেন। জানালা খুললে ঠান্ডা পড়ে যায়।” ঠান্ডা পড়ে যাওয়া তো বাড়ির দোষ, অর্পণ ভেবেছিল। হালকা হেসে বলল, “আচ্ছা, বুঝেছি।” মোহিনী ব্যাগ থেকে একটা ছোট থলে বার করে বলল, “লবণ। এখানে রাত্তিরে থাকলে, চারকোণে এক চিমটি ছিটিয়ে দিন। স্যাঁতসেঁতে কমে। আমার মা করত।” লোকাল কুসংস্কার, ভেবেও থলেটা রেখে দিল অর্পণ; কুসংস্কারেরও এক ধরনের গন্ধ আছে, মানসিক নিরাপত্তার, ঠিক মথবলের মতো।

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজ জমে উঠছিল। ক্যামেরা, লেন্স, ট্রাইপড, ল্যাপটপ—সব সাজিয়ে সে টেবিলে বসে ছবি ছাঁকছিল। বাইরে গলি দিয়ে একবার টায়ারের স্ক্রিচ, তারপর যেন খুব দূরে শঙ্খভাঙা আওয়াজ—কোন মন্দিরের আরতি বোধহয়। ঘড়ির কাঁটা এগোতে এগোতে বারোটার কোঠা ছোঁয়, ঠিক তখনই মৃদু একটা ধাতব শব্দ—শিকল নড়ে ওঠার মতো। অর্পণ মুখ তুলেই বুঝল না, শব্দটা ভেতর থেকে এল, না বাইরে থেকে। সে চুপ করে শুনতে থাকল। আবার সেই শব্দ। তার ঘরে যে কালো জানালাটা, সেটা তো শিকলপিঞ্জর সহ বন্ধ। তবু শিকল নড়ার শব্দ কিভাবে? উঠে গিয়ে জানালার সামনে দাঁড়াতেই মনে হল, কাচের পিছনে জল জমেছে; একটুকরো কুয়াশা যে ভাবে ভিজে কাচে বসে থাকে, এই কাচেও তেমন ভেজাভাব—তবু গলিতে তো আজ বৃষ্টি হয়নি। সে আলতো করে কাচ ছুঁয়েই ফিরে এল—বরফের মতো ঠান্ডা।

লাইটটা নিভিয়ে অর্পণ একটা টেস্ট শট নিল—ট্রাইপডে ক্যামেরা স্থির, জানালার দিকে ২ সেকেন্ডের এক্সপোজার। সে ছবি উঠে আসার অপেক্ষায় ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিল। প্রথম ছবিটা গ্রেনি, স্বাভাবিক; দ্বিতীয়টা তুলতেই ফ্রেমে অনাকাঙ্ক্ষিত একটা ঝাপসা ছায়া—মানুষের মতো কি? সে চোখ কচলাল। তৃতীয়টা নিতেই স্পষ্ট, জানালার অন্ধকারে দুটি ছোট্ট আলোর বিন্দু—যেন কারও চোখ। অর্পণ ক্যামেরা থেকে চোখ সরিয়ে সরাসরি জানালার দিকে তাকাল। কিছু নেই, শুধু কালো; কাচে নিজের ঘোলাটে প্রতিবিম্ব। আবার সে স্ক্রিনে ফিরতেই সেই দু’টি বিন্দু একটু অন্য জায়গায়। অর্পণ ঠোঁট ভেজাল, গলার ভিতরটা শুকিয়ে যাচ্ছে। একবার ভাবল—প্রতিবিম্ব? কিন্তু ঘরে তো আলো কমানো, তার নিজের চোখেও তেমন আলো নেই। উল্টো দিকের গলিতে একটা ল্যাম্পপোস্ট, তার মরা আলো জানালার ধার ঘেঁষে পড়ছে—হয়তো সেই আলোতে কিছু একটা দিচ্ছে।

সেই সময়ই দরজার নিচ দিয়ে, ফাঁকটুকু দিয়ে, বাতাস ঢুকে গেল—একটা ঠান্ডা, সাদা, গন্ধহীন বাতাস। কাগজগুলো নড়ে উঠল, কাপে চায়ের চামচটা টুং করে বাজল, এবং অর্পণের কানে এল একদম নীচু স্বরে একটা ভেজা শব্দ, যেন কেউ পানির তলায় কথা বলছে, “তুমি আমার ছবি তুলেছো… তাই তুমি এখন আমার।” কথাটা খুব স্পষ্ট নয়, যেন দূর থেকে হুঁশিয়ারি বা আদুরে ডাক, দু’টোর মাঝামাঝি। অর্পণ হকচকিয়ে উঠে দাঁড়াল। জানালার দিকে এক পা, তারপর আরেক পা। কাচের গায়ে হাত রাখতেই হাতের তালু জ্বালাপোড়া, কিন্তু ঠান্ডা। সে হাত সরিয়ে নিতেই কাচে একটি সরু, জলের রেখা; যেন ভিতর থেকে কেউ ভেজা আঙুল দিয়ে লাইন কেটেছে। অর্পণের চোখের সামনে সেই লাইন দিয়ে ধীরে ধীরে গড়ে উঠল একটি শব্দ—“এসো।”

তার মনে হল, দরজাটা একটু খোলা রাখা দরকার; অথবা, সোজাই বেরিয়ে গিয়ে একটু সিগারেট খেয়ে আসা যায়। পালিয়ে যাওয়ার যে সহজতম প্রবৃত্তি, সেটা ঠিক তখনই মনের এক কোণায় হাত তুলল; অন্য কোণায়, যে বেপরোয়া কৌতূহল ফটোগ্রাফারদের বাঁচিয়ে রাখে, সে বলল—এটার ছবি প্রমাণ হিসেবে থাক। অর্পণ আবার ট্রাইপড টাইট করে শাটার খুলল। এবার এক্সপোজার একটু বাড়িয়ে দিল। শাটারের ক্লিকের পর সেকেন্ড কয়েকের নীরবতা। বাইরে গলির বিড়াল একবার কেঁদে উঠল। স্ক্রিনে ইমেজ উঠতেই সে চেয়ার থেকে একটু পিছিয়ে গেল—ফ্রেমের ভেতরে, জানালার কাচের ওপারে, জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এক তরুণী; কাঁধভেজা চুল থেকে টপটপ জল পড়ছে, চোখ দুটি অবিশ্বাস্যরকম জ্বলজ্বলে, ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক হাসি। অর্পণ স্রেফ জুম করে দেখল—ছবির দানায়ও সেই হাসি নড়ছে না, কিন্তু চোখদুটি যেন স্ক্রিনের ভিতর দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।

কতক্ষন পেরিয়েছে বোঝা গেল না। ঘড়ি বলছিল রাত একটা। অর্পণ হঠাৎ বুঝল, সে নিঃশ্বাস আটকে রেখেছিল। শ্বাস ছাড়তেই ঠান্ডা রুমে ধোঁয়ার মতো কুয়াশা বেরিয়ে এল, যেন ঘরের বাতাসের ঘনত্ব বেড়ে গেছে। সে সোজা দরজার দিকে হাঁটল; দরজা খুলতে গিয়ে হাত কাঁপল—কী মূর্খতা! ভয়ে দরজা খোলা? তারই তো দরকার দরজা বন্ধ করা। সে বোঝাল নিজেকে—নিচে গিয়ে মোহিনীর ঘরের সামনে দাঁড়ালে অন্তত একটা মানুষ পাওয়া যাবে। তবু, দরজা খোলার আগেই, পিছন দিক থেকে সেই একই ভেজা স্বরের ফিসফিস, এবার একটু কাছে, “তুমি তো ইতিমধ্যেই এসেছো। জানালার ওপাশে।” অর্পণ পিছন ফিরে তাকাল; ঘর ফাঁকা, কিন্তু জানালার কাচে তার নিজের প্রতিচ্ছবি নেই। কাচে দেখা যাচ্ছে শুধু কালো, আর তার ভেতরে দিশাহীন জল, আর ওই জোড়া চোখ।

সে ঝাঁপিয়ে গিয়ে পর্দা টেনে দিল। শিকলটা শক্ত করে বেঁধে দিল। তারপর দরজাটা সত্যিই খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। সিঁড়ির বাল্বটা তখন কাঁপতে কাঁপতে নিভে গেল, আবার জ্বলে উঠল। এক তলা নামতেই জুতোর ভারী টকটক শব্দ—মোহিনী আসছে কি? “শোনো,” অর্পণ ডাকল, গলা কেঁপে গেল, “উপরের ঘরটা একটু—” কথাটা শেষ করতেই দেখল, মোহিনী নয়, বাড়ির গেট থেকে এক লোক ঢুকছে, হাতে কুঁচকোনো নিউজপেপার, পায়ে রাবার স্যান্ডাল—রাতপাহারা দেয় যে, তার নাম কী যেন—বাবুল? লোকটা চোখ তুলে বলল, “কিছু লাগবে দাদা?” অর্পণ বলল, “না… কিছু না।” সে বুঝল, নিজের ভয় নিজের ভিতরে রাখা ভাল। মুচকি হেসে লোকটা চলে গেল, আর অর্পণ সিঁড়ি বেয়ে আবার উপরে ওঠার সময় দেখল, তার ঘরের দরজা আধখোলা। সে কি বন্ধ করেনি? করেছিল তো!

ঘরে ঢুকেই দেখল, ল্যাপটপের স্ক্রিন স্লিপ থেকে জেগে উঠেছে, এবং তাতে নতুন একটা ছবি ওপেন। সে তো আর শাটার টেপেনি। ছবিটা তার টেবিলের—ক্যামেরা, কাপ, লবণের থলে, সবকিছু—কিন্তু ফ্রেমের এক কোণে স্পষ্ট একটি ভেজা হাতের ছাপ পড়ে আছে, যেন কেউ লেন্সের দিকে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়েছে। হাতের তালু সরু, আঙুল লম্বা, নখে হালকা সাদা দাগ। অর্পণের বুকের ভেতরটা ধপধপ করতে লাগল। সে জানালার দিকে চাইল—পর্দা টানা, শিকল বাঁধা, তবু ঠান্ডা বাতাসের অস্ফুট শোঁ শোঁ। সে টেবিলে রাখা লবণের থলেটা খুলে চারকোণে এক চিমটি করে ছিটিয়ে দিল। লবণ দানার টুপটাপ শব্দ মেঝেতে পড়তেই একটু সময়ের জন্য সব শব্দ থেমে গেল, যেন কেউ নিঃশ্বাস আটকে রেখেছে।

ঠিক তখনই কানে এল মৃদু বৃষ্টির আওয়াজ। অর্পণ অবাক—বাইরে তো বৃষ্টি হচ্ছিল না। সে পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল—গলি শুকনো। বৃষ্টি হচ্ছে ঘরের ভেতর, কাচের ওপাশে; জানালার কাচ যেন ভিতর থেকে ভিজে উঠছে, জলের রেখা নেমে আসছে ধীরে ধীরে, আর সেই জলকণার মধ্যে, খুব কাছে, সেই মুখটা আবার। এবার আর ঝাপসা নয়। তরুণীর চোখ দুটি শীতল, কিন্তু টান আছে, বাঁচার মতো টান। ঠোঁটে দীর্ঘশ্বাসের মতো হাসি। সে ঠোঁট নেড়ে বলল—এবার অর্পণ স্পষ্ট শুনল—“আমার নাম রজনীনি। আমি বেরোতে পারি না। কিন্তু তুমি তো পারো ঢুকতে… হাতটা দাও।” কাচের ওপাশ থেকে সাদা, ভেজা এক হাত ধীরে ধীরে উঠে এল, কাচের ঠিক গায়ে এসে থামল। অর্পণ নিজের হাত তুলল—এক মুহূর্তে সে যেন সমস্ত যুক্তি ভুলে যাচ্ছে, যেন ভেজা শৈশবের মতো একটা স্মৃতি ডাকছে—এমন ডাক তো আর কেউ দেয় না।

তার আঙুল কাচে ছোঁয়াতেই কাচ গলে গেল কি? না, তেমন কিছু নয়। তবে কাচের ঠান্ডার মধ্যে আবার সেই জ্বালাপোড়া অনুভূতি, আর এইবার স্পষ্ট, কাচের ভিতর থেকে আঙুলটাও নড়ে উঠল—আঙুলের পিঠে জলের ফোঁটা, এবং তাতে গলির ল্যাম্পের মরা আলোটা আটকে আছে। অর্পণ শ্বাস টানতেই ঠোঁটে জল লেগে গেল; সে কেঁপে উঠল, পিছিয়ে এল, যেন হঠাৎ গভীর জলের পাড় থেকে পিছিয়ে আসছে। দূরে কোথাও কুকুর ডেকে উঠল—দীর্ঘ, ক্লান্ত, রাতভোর পাহারার ডাকে যেমন ক্লান্তি থাকে।

অর্পণ তখনই বুঝল—এ বাড়িতে রাত মানে শুধু রাত নয়। কিছু একটা পুরোনো ঘটনাচক্র, এমন এক শীতল পুনরাবৃত্তি, যা প্রতিরাতে একই জায়গায় এসে থামে। সে ল্যাপটপ বন্ধ করে দিল, ক্যামেরা ব্যাগে ভরল, যেন তাকে এই মুহূর্তে বেরোতেই হবে। কিন্তু দরজার কাছে যেতে না যেতেই মেঝেতে লবণের চারকোণে, উত্তর দিকের শীতল দেওয়ালের পাশে, ক্ষীণ এক ছায়া জমে উঠল—জলের কণায় প্রতিফলিত আলোর মতো। তারপর সেই ছায়া নড়ে উঠল, এবং অর্পণের পায়ের কাছে এসে থামল; খুব আলতো, শীতল স্পর্শ—পায়ের পাতা ভিজে গেল। কানে এল মোহিনীর কণ্ঠ, যেন সিঁড়ির মাথা থেকে—“চেনা নেই এমন জলে পা দিও না, বাবু। কাল রাতে তোকে ডেকেছেও। কালো জানালায় তাকিয়ে থাকিস না।” অর্পণ দরজা খুলে বাইরে বেরোতে যেতে যেতে শেষবারের মতো জানালার দিকে তাকাল—কাচে আর কেউ নেই, শুধু লবণের দানার মধ্যে আটকে পড়া আলো, আর শিকলের কাঁপুনির পরে যে দীর্ঘ নীরবতা, সেটা।

দরজা টেনে সে বাইরে এল। সিঁড়ির কোণে মোহিনী দাঁড়িয়ে। তার চোখদুটি অন্ধকারে আরও গভীর। “নাম বলেছে তো?” সে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল। অর্পণ মাথা নাড়ল। “রজনীনি।” মোহিনী চুপ করে রইল, তারপর বলল, “তাহলে কাল সকালটা বাঁচিয়ে রাখো। আমার সঙ্গে পেছনের উঠোনে এসো। একটা পুরনো কাগজ দেখাব।” নিচে গলির দিকে তাকিয়ে অর্পণ দেখল, ল্যাম্পপোস্টটা নিভে গেছে। অন্ধকারটা অনর্থক নয়—তার ভিতরে যেন জল জমে আছে। আর সে বুঝল, এই বাড়ির গল্পের শুরু হয়েছে মাত্র; কাল সকালেই সে জানবে, কীভাবে এক জানালার ভেতরেই আটকে থাকে একটি বৃষ্টির রাত, আর কীভাবে সেই রাত, একদিন, জানালার এপাশটাকেও ভিজিয়ে ফেলতে পারে।

ভোরে ঘুম ভাঙল কাকের ডাক আর কাঠের দরজার খসখসে শব্দে। রাতের ঠান্ডা যেন এখনও লেগে আছে ত্বকে, অথচ বাইরে আলো ফুটে উঠেছে। অর্পণ বিছানায় আধো-ঘুমে শুয়ে, হাত বাড়িয়ে ল্যাপটপের ঢাকনা নামিয়ে দিল—কিন্তু মনে পড়ল, সে তো গত রাতে বন্ধ করে রেখেছিল। ঢাকনাটা তাই খোলা কীভাবে? আর মনিটরে ঝলসে ওঠা স্ক্রিনে কোনও ডেস্কটপ ওয়ালপেপার নেই, আছে শুধু কালো পটভূমিতে এক লাইনের টেক্সট—সাদা, ভিজে ফন্টের মতো আঁকা—“আজ রাত বৃষ্টি হবে।”

তার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। ল্যাপটপ খুলে দেখে নিল সিস্টেম লগ—কেউ রাত আড়াইটায় ফাইল ওপেন করেছে, অথচ সে তখন দরজা দিয়ে বেরিয়েছিল। এটার মানে কী? ভাবতে ভাবতেই দরজায় টোকার শব্দ। মোহিনী দাঁড়িয়ে, হাতে একটা হলদেটে খাম।

“চলুন, পেছনের উঠোনে নিয়ে যাই। আপনার জন্যই বের করেছি,” বলে খামটা বাড়িয়ে দিল। খামের ভেতর থেকে বেরোল ভাঁজ-করা একটা খবরের কাগজের কাটিং। তারিখ—১৬ আগস্ট, ১৯৭১। শিরোনাম: ‘জমিদার কন্যার মৃত্যুরহস্য: বিয়ের আগের রাতেই আত্মহত্যা’। ছবিতে ঝাপসা মুখ—ক্যামেরার ফোকাস যেন ইচ্ছে করেই মিস করেছে। নিচে লেখা—রজনীনি দেবী, বয়স বাইশ।

অর্পণ কাটিংটা হাতে নিয়েই বুঝল, মুখটা স্পষ্ট না হলেও চোখদুটো চেনা। এ সেই চোখ—যা কাল রাতে কাচের ওপারে তাকিয়ে ছিল।

মোহিনী ধীরে ধীরে বলতে লাগল, “বিয়ের আগের রাতে এই ঘরেই ছিলেন উনি। তখন এই জানালাগুলো খোলা থাকত, কালো রঙ হয়নি। কেউ জানে না কেন তিনি নিজের গলায় শাড়ি বেঁধেছিলেন। কিন্তু তখন থেকেই, বৃষ্টির রাতে, জানালায় তাঁকে দেখা যায়—চুল ভিজে, চোখে সেই একই আলো।”

অর্পণ চুপচাপ শুনছিল, কিন্তু একটাই প্রশ্ন তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল—কালো রঙ লাগানো হয়েছিল কেন? মোহিনী যেন প্রশ্নটা আন্দাজ করেই বলল, “পরে জমিদারের ছেলে জানালা বন্ধ করে কালো করে দেয়, যাতে ভেতরের আর বাইরের কেউ একে অপরকে দেখতে না পায়। কিন্তু যাদের চোখে সে ধরা দেয়, তারা আর… বাদ যায় না।”

অর্পণ হেসে ফেলল, যদিও হাসিটা জোর করে। “এ সব লোককথা, মোহিনী মাসি।”

মোহিনী কোনো উত্তর দিল না। বরং খামটা ভাঁজ করে আবার ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল, তারপর বলল, “আজ বিকেলে বাড়ি ফিরবেন তো?”

“হ্যাঁ, ফিরব,” অর্পণ বলল।

“ফিরে এলেই লবণ ছিটিয়ে দেবেন, আর জানালা থেকে দূরে থাকবেন। আজ রাতটা ভালো নয়।”

অর্পণ ভেবেছিল, এগুলো স্রেফ ভয়ের গল্প। কিন্তু বিকেল গড়াতেই চারপাশে এক অদ্ভুত ভারি ভাব নামল। আকাশ ধূসর হয়ে এল, দূরে মেঘের গর্জন। রোদ যেন মুহূর্তে নিভে গেল। গলির ল্যাম্পপোস্টে বাতি জ্বলে উঠল দিনের আলোয়, যেন রাত ভুল করে আগে চলে এসেছে।

কাজে মন বসছিল না। মাঝে মাঝে সে পর্দার ফাঁক দিয়ে জানালার দিকে তাকাচ্ছিল—কালো কাচ নিস্তব্ধ, নিজের প্রতিবিম্ব ছাড়া কিছু নেই।

রাত আটটার দিকে প্রথম বৃষ্টি নামল। ফোঁটার শব্দ জানালার কাচে লাগতে না লাগতেই অর্পণের বুকের ভেতর অকারণ শিরশির। হঠাৎই সেই ধাতব শব্দ—শিকল নড়ার মতো। এবার শব্দটা একবার নয়, বারবার।

সে হাতের কাছে ক্যামেরা নিল, শাটার প্রেস করল। প্রথম ফ্রেমে শুধু কাচ আর তার প্রতিফলন। দ্বিতীয় ফ্রেমে—কোণায় অস্পষ্ট এক হাতের ছাপ। তৃতীয় ফ্রেমে—ছাপটা স্পষ্ট, ভেজা হাতের আঙুলে গড়িয়ে পড়া জল। আর চতুর্থ ফ্রেমে—সেই চোখ, আগের চেয়ে অনেক কাছে, যেন কাচের এপাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

তখনই শুনল ফিসফিস—“আজ আমি তোমাকে নিতে এসেছি।”

কাচে আলতো টোকা পড়ল ভেতর দিক থেকে। ধপধপে ঠান্ডা তার শিরায় ঢুকে গেল।

অর্পণ আরেকবার শাটার টিপল, কিন্তু এবার ফ্রেমে কোনও ছবি উঠল না—শুধু কালো, আর স্ক্রিনের ডানদিকের কোণে ভিজে সাদা অক্ষরে লেখা—“তুমি এখন ওপারে।”

বৃষ্টির শব্দ যেন হঠাৎ বদলে গেল—আগে বাইরে থেকে আসছিল, এখন মনে হচ্ছে ভেতর থেকে ভেসে আসছে। ঘরের আলো নিভে গেছে, অথচ সে বুঝতে পারছে, কোথাও একধরনের অস্পষ্ট আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে আছে, যেন গভীর জলের তলদেশে দাঁড়িয়ে আছে।

অর্পণ এক পা পিছিয়ে আসতে গেল, কিন্তু পায়ের তলায় কেমন নরম, শ্যাওলা-মাখা মাটি। একদম কাদা নয়, আবার শুকনোও নয়—পা যত সরায়, মনে হয় জল টেনে নিচ্ছে। চারপাশে অদ্ভুত নীরবতা, শুধু দূরে কোনও নারীকণ্ঠে ধীর, টানা এক সুর—অচেনা, তবু কেমন যেন চেনা লাগে।

হঠাৎ সামনে দাঁড়িয়ে যায় সে—রজনীনি। চুল কাঁধে লেপ্টে, ঠোঁটে ম্লান হাসি, আর চোখে এক অদ্ভুত আলো—ভালোবাসা আর শীতলতা মিলেমিশে আছে।

“তুমি এসেছো,” সে ফিসফিস করে বলে, কণ্ঠস্বর জলভেজা। “এখানে কেউ আসে না এত সহজে।”

অর্পণ গলার স্বর খুঁজে পায় না। “এটা কোথায়?”

রজনীনি মাথা ঘুরিয়ে ইশারা করে—দূরে এক অন্তহীন ধূসর প্রান্তর, যেখানে কোনও আকাশ নেই, শুধু কুয়াশার মধ্যে ভেসে বেড়ানো অসংখ্য জানালা। প্রতিটি জানালার ওপারে কোনও না কোনও ঘর—কোথাও কেউ বসে কাঁদছে, কোথাও কেউ হেসে ছবি আঁকছে, কোথাও কেউ শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে।

“এরা সবাই…” অর্পণ বলতে গিয়েও থেমে যায়।

“যারা একদিন জানালায় তাকিয়েছিল,” রজনীনি উত্তর দেয়, চোখ না সরিয়েই। “এখানে সময় থেমে থাকে। কেউ বেরোতে পারে না, যতক্ষণ না কেউ তাদের জায়গা নেয়।”

অর্পণের বুকের ভেতরটা জমে আসে। “তাহলে… আমি?”

রজনীনি ধীরে ধীরে কাছে আসে। “তুমি এখন আমার সঙ্গী। আর তোমার জায়গায় কেউ না এলে…”

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই, পেছনে ভিজে কাদা চাপড়ানোর শব্দ—অর্পণ ঘুরে দেখে, দূরে এক পুরুষ ছায়া এগিয়ে আসছে। চোখদুটো জ্বলজ্বলে, কিন্তু তার মুখে কোনও চামড়া নেই—শুধু জলের ফোঁটা ঝরছে, আর হাসি যেন খোলা হাড়ের ফাঁক দিয়ে বেরোচ্ছে।

রজনীনি ফিসফিস করে, “চলো, ওর থেকে দূরে থাকতে হবে। সে অনেকদিন ধরে বেরোতে পারেনি।”

অর্পণ যখন তার হাত ধরে টেনে নেয়, তখনই চারপাশের কুয়াশা ঘন হয়ে যায়, আর দূরের জানালাগুলো একে একে নিভে যেতে শুরু করে। বৃষ্টির শব্দ আরও ভারি, আরও কাছাকাছি—যেন জল এখন সত্যিই গলা পর্যন্ত উঠে আসছে।

রজনীনির হাত শক্ত করে ধরে অর্পণ দৌড়াতে লাগল, কিন্তু মাটি যেন একেক ধাপে আরও নরম হচ্ছে। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত কাদা, আর তার ভেতর দিয়ে কেমন যেন ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে, যেন কারও আঙুল গোড়ালি ঘিরে ধরেছে।

দূরের সেই হাড়-মুখো লোকটা থেমে নেই—সে ধীরে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে এগিয়ে আসছে। তার চোখের ভেতর ফাঁপা আলো, মুখের ফাঁক দিয়ে জল পড়ছে, আর প্রতিটি পদক্ষেপে মাটি থেকে বাবল উঠে ফেটে যাচ্ছে—তার সঙ্গে এক ভ্যাপসা গন্ধ।

“ও কে?” হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল অর্পণ।

“সে একসময় আমার বরের জায়গায় ছিল,” রজনীনি ফিসফিস করল। “কিন্তু কেউ আর তাকে বদলাতে আসেনি। তাই তার শরীর ভেঙে গেছে, শুধু খোলস আর জল বাকি।”

অর্পণের শরীর শিরশির করে উঠল। “তাহলে আমারও—”

“চুপ!” রজনীনি থামিয়ে দিল। “তুমি যদি এখন ভয় পাও, জল তোমাকে ডেকে নেবে।”

হঠাৎ তাদের সামনে আরেকটা জানালা দেখা গেল—কালো কাঠের, কাচে ধুলো জমে আছে। রজনীনি বলল, “ওইটা পার হলে ফিরতে পারবে।”

অর্পণ এক ধাপ এগোতেই বুঝল, জানালার ওপাশে দৃশ্যটা তার নিজের ঘরের মতো—টেবিল, ল্যাপটপ, ক্যামেরা—সব কিছু। কিন্তু জানালার কাচের এই দিকটা ভিতরের থেকে দেখলে অদ্ভুত ঝাপসা, যেন পাতলা বরফে ঢাকা।

সে কাচে হাত রাখতেই ভিতর দিক থেকে এক অচেনা মুখ দেখা গেল—একজন তরুণী, চোখে আতঙ্ক, ঠোঁটে জমাট বাঁধা শব্দ। রজনীনি ধীরে বলল, “তোর জায়গা নিতে ও এসেছে। তাকে ডাক।”

অর্পণ হকচকিয়ে তাকাল। “না! আমি কাউকে টেনে আনতে পারি না।”

রজনীনি চোখ সরু করল। “তাহলে তুই চিরদিন এখানে থাকবি, তার মতো।”

পেছনে সেই হাড়-মুখো লোকটা আরও কাছে এসেছে—তার ভেজা পায়ের শব্দ এখন গায়ের লোম খাড়া করে দেয়। চারপাশের কুয়াশা ঘুরপাক খাচ্ছে, বৃষ্টির জল কোমর ছুঁয়ে ফেলেছে।

অর্পণের বুক ধড়ফড় করছে, হাত কাঁপছে, কিন্তু সে জানালার কাচে মুঠো মেরে আঘাত করল—“বের হতে চাই!”

কাচে ফাটল ধরল, কিন্তু ওপাশের তরুণী পিছু হটল না—বরং সে হাত বাড়িয়ে দিল, আর অর্পণ দেখল, সেই হাতেও ভেজা ফোঁটা, ঠিক রজনীনির মতো…

ঠিক আছে — এবার শুরু করছি পঞ্চম ও শেষ পর্ব, যেখানে ফাইনাল টুইস্টে বোঝা যাবে অর্পণের ভাগ্য।

জল এখন বুকে এসে ঠেকেছে। বৃষ্টির শব্দ যেন কানে গেঁথে যাচ্ছে, আর প্রতিটি ফোঁটা অর্পণের শরীরে ঢুকে হাড় অব্দি ঠান্ডা করে দিচ্ছে। কুয়াশার ভিতর থেকে হাড়-মুখো লোকটা প্রায় হাতের নাগালে—তার শ্বাসে গন্ধ নেই, আছে শুধু জল, যা ঘন কাদা হয়ে চারপাশের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে।

অর্পণ জানালার কাচে মুষ্টি চালাল—ফাটল বড়ো হল, ভেতরের তরুণীর মুখ আরও কাছে এল। তার চোখে আতঙ্ক, কিন্তু ঠোঁটে এক অদ্ভুত কৌতূহলও আছে, যেন বুঝতে পারছে এই কাচের ওপারে কী আছে।

“তুমি আমার জায়গা নেবে?” অর্পণ গলা কাঁপিয়ে বলল। তরুণী কিছু বলল না—শুধু হাত বাড়িয়ে দিল।

রজনীনি পেছন থেকে চাপা গলায় বলল, “এটাই নিয়ম। নইলে তুইও ওই লোকটার মতো হবি।”

অর্পণের বুক ধড়ফড় করছে। জল গলা ছুঁতে যাচ্ছে, কুয়াশা চোখে মুখে ঢুকে শ্বাস রোধ করছে। ঠিক তখনই, তার হাত কাচ ছুঁল—আর কাচ যেন জলে ভিজে গলে গেল।

এক মুহূর্তে চারপাশ অন্ধকার। পায়ের নিচে শক্ত মেঝে। অর্পণ হাঁপাতে হাঁপাতে দেখল—সে তার নিজের ঘরে দাঁড়িয়ে। জানালার কাচ শুকনো, শিকল বাঁধা, লবণের দানা চার কোণে পড়ে আছে।

সবকিছু শান্ত। শুধু বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, আর গলির ল্যাম্পপোস্টের আলো কাচে লেগে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে।

অর্পণ টেবিলে গিয়ে ল্যাপটপ খুলল—স্ক্রিনে কোনও ছবি নেই, শুধু কালো ব্যাকগ্রাউন্ডে সাদা অক্ষরে লেখা—“ধন্যবাদ।”

তার বুকের ভেতরটা হালকা হল, যেন কোনো দুঃস্বপ্ন থেকে ফিরেছে। কিন্তু চেয়ারের পেছনে রাখা ক্যামেরাটা হাতে নিতে গিয়েই তার চোখ স্থির হয়ে গেল—মেমোরি কার্ডের শেষ ছবিটা খুলতেই ফ্রেমে দেখা গেল সেই তরুণী, ভিজে চুল কাঁধে লেপ্টে, চোখ জ্বলজ্বলে… আর তার হাত শক্ত করে ধরে আছে রজনীনি।

তাদের পিছনে, কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে হাড়-মুখো লোকটা, কিন্তু তার মুখটা এখন অর্পণের—ফাঁপা চোখ, ঠোঁটের কোণে জমাট হাসি।

অর্পণ বুঝল, সে ফিরেছে ঠিকই, কিন্তু জানালার ওপারে তার আরেকটা সত্তা এখন চিরকাল দাঁড়িয়ে থাকবে, অপেক্ষা করবে পরের বৃষ্টির রাতে…

পরদিন সকালটা অদ্ভুতভাবে পরিষ্কার। আকাশে কোনও মেঘ নেই, গলিতে রোদ পড়ে পুরনো ইটের দেয়ালে সোনালি ছায়া ফেলছে। কিন্তু অর্পণের ভেতরে আলো ঢুকছে না। গত রাতের ঘটনা সে যতই ‘দুঃস্বপ্ন’ বলে বোঝাতে চায়, ততই মনে হচ্ছে কিছু ফেলে এসেছে—না, ভুল বলল—কিছু রেখে এসেছে, যা এখনও তাকে ডাকছে।

কফি মগ হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার নজর পড়ল গলির মাথায়—একজন যুবক দাঁড়িয়ে, মাথায় হুড টেনে, চোখ তুলে এই দিকেই তাকিয়ে। সেই চোখে হালকা ভিজে জ্যোতি, যেন রোদেও অদ্ভুত কুয়াশা ভাসছে। অর্পণ শিরশির করে উঠল। যুবকটা হাসল, তারপর ধীরে ধীরে রওনা হল, কিন্তু পা রাখছে এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে—যেন পায়ের তলা কাদায় ডুবে আছে, অথচ মাটিতে জল নেই।

বিকেলে মোহিনী এল, কিন্তু আজ তার চেহারা অন্যরকম—চোখের নিচে কালচে ছায়া, গলায় হালকা ভিজে দাগ। “তুমি ফিরেছো, তাই ভাবছো সব শেষ? জানালার ওপারের জল খুব ধৈর্যশীল। তুই ফিরেছিস, মানে আরেকজন ঢুকেছে—কিন্তু দরজা পুরো বন্ধ হয়নি। যাকে ঢুকিয়েছিস, সে যদি বেরিয়ে আসে…”

অর্পণ থমকে গেল। “মানে?”

মোহিনী ব্যাগ থেকে পুরনো এক রূপোর চাবি বের করল। “এটা ‘ফেরার দরজা’-র চাবি। কিন্তু এটা শুধু ওপার থেকেই খোলে। আর মনে রাখিস—যে একবার এপারে এসে পড়ে, সে বদল ছাড়া টিকতে পারে না।”

রাতে অর্পণ ঘুমোতে পারল না। জানালায় পর্দা টানা, শিকল বাঁধা, তবুও মনে হচ্ছে কাচের ওপাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ভোরের ঠিক আগে, অদ্ভুত এক শব্দে তার ঘুম ভাঙল—জলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার ছপছপ শব্দ, কিন্তু আসছে ঘরের ভেতর থেকে।

সে ধীরে ধীরে পর্দা সরাল—কাচে ভিজে আঙুলের দাগ, আর তার ওপাশে সেই তরুণী, যাকে সে গত রাতে ঢুকিয়েছিল। কিন্তু আজ তার চোখে ভয় নেই, বরং অদ্ভুত এক দৃঢ়তা। ঠোঁট নেড়ে সে বলল—“তুমি ভেবেছিলে আমি শুধু তোমার জায়গা নেব? আমি ফিরব, আর তোমাকে টেনে নেব।”

অর্পণ পেছনে সরে এল, কিন্তু মেঝেতে লবণের দানা গলে যাচ্ছে, জল মিশে ছড়িয়ে পড়ছে তার পায়ের দিকে। বাইরে রোদ উঠেছে, অথচ তার ঘরের ভেতর হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টির গন্ধ, আর খুব ধীরে… শিকল নিজে নিজেই খুলে যাচ্ছে।

রাতটা পুরোপুরি চুপচাপ থাকার কথা ছিল, কিন্তু শিকল যখন ধীরে ধীরে খসে মেঝেতে পড়ল, সেই ধাতব ঠক্ শব্দে অর্পণের বুক কেঁপে উঠল। বাতাসে এখন ঠান্ডা নেই, বরং কেমন গুমোট উষ্ণতা, যেন ঘরের ভেতর বৃষ্টি না হয়ে জল বাষ্পে ভরে উঠছে। কাচের ওপারে দাঁড়িয়ে তরুণী এবার একদম কাছে—চুল ভেজা, কিন্তু জল পড়ছে না, চোখে সরাসরি একরকম তৃপ্তি।

ঠিক তখনই দরজা খুলে ঢুকল মোহিনী। তার হাতে সেই রূপোর চাবি, মুখ গম্ভীর। “আমি জানতাম আজ রাতেই হবে,” সে বলল, একদৃষ্টে কাচের দিকে তাকিয়ে। তরুণীর ঠোঁট বাঁকা হল—“মোহিনী, তুমি এখনও আছো?”

অর্পণ অবাক হয়ে তাকাল। “তুমি… চেনো একে?”

মোহিনী ধীরে মাথা নেড়ে বলল, “আমি ছিলাম রজনীনির কাজের মেয়ে। সেদিন বিয়ের আগের রাতে আমি একমাত্র শুনেছিলাম, সে জানালার ওপারের কারও সঙ্গে কথা বলছে। পরে যখন সে মরল, সবাই বলল আত্মহত্যা… কিন্তু আমি জানতাম, ওকে টেনে নিয়েছিল। তারপর থেকে প্রতি প্রজন্মে জানালা একজনকে নেয়, একজনকে ছাড়ে।”

তরুণী হাসল—“তোমার পালা তখন আসেনি, মোহিনী। এখন এসেছে।”

অর্পণ এগিয়ে এসে বলল, “না, আজ কেউ যাবে না।”

“তুমি ভাবছো, দরজা তুমি বন্ধ রাখতে পারবে?” তরুণীর কণ্ঠে ছিল জলের গভীর টান। মুহূর্তেই জানালার কাচ গলে গিয়ে জলের ঢেউ এপাশে ঢুকে পড়ল, পায়ের তলায় ছড়িয়ে গেল ঠান্ডা ভেজাভাব। ঘরের চার কোণের লবণ একে একে গলে মিলিয়ে গেল।

মোহিনী রূপোর চাবিটা অর্পণের হাতে ধরিয়ে দিল। “যদি পড়ে যাও, এই চাবি আঁকড়ে ধরো—এটাই একমাত্র পথ।”

জল এখন হাঁটু ছাড়িয়ে কোমরে উঠেছে। কুয়াশা ঘন হয়ে চারপাশ ঢেকে দিচ্ছে। তরুণী কাচের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল—তার আঙুলের ডগা কাচে লাগতেই চারপাশের শব্দ মিলিয়ে গিয়ে শুধু শোনা যাচ্ছে শিকল বাঁধার আর খোলার একসাথে চলতে থাকা শব্দ।

অর্পণ শেষবার মোহিনীর দিকে তাকাল—সে যেন একইসঙ্গে ভয় আর দৃঢ়তায় দাঁড়িয়ে আছে। পরের মুহূর্তেই জল তার বুক ছুঁয়ে ফেলল, আর কুয়াশার মধ্যে তারা দু’জন একসাথে টেনে নেওয়া হল কাচের ওপারে।

চারপাশে সেই অন্তহীন ধূসর প্রান্তর, অসংখ্য জানালা কুয়াশায় ভাসছে। দূরে হাড়-মুখো লোকটা দাঁড়িয়ে, কিন্তু এবার সে একা নয়—তার পাশে দাঁড়িয়ে আরও কয়েকজন, সবার চোখ জ্বলজ্বলে। আর কুয়াশার ভেতরে ভেসে আসছে রজনীনির কণ্ঠ—“স্বাগত… তোমাদের দু’জনকেই।”

কুয়াশার ভেতর দিয়ে অর্পণ আর মোহিনী এগিয়ে চলেছে, পায়ের নিচে ভিজে শ্যাওলা আর কাদা, কিন্তু কোনও গন্তব্য নেই। অসংখ্য জানালা ভাসছে, প্রতিটা থেকে ভেসে আসছে ফিসফিস, কান্না, কখনও বা অদ্ভুত হাসি। হঠাৎ সামনের কুয়াশা ফাঁক হয়ে দাঁড়াল রজনীনি—আজ তার চোখে অদ্ভুত প্রশান্তি, আর ঠোঁটে ব্যথার ছোঁয়া।

“তোমরা জানতে চাও কেন এই জায়গা আছে?” সে ধীরে বলল।

মোহিনী মাথা নাড়ল। অর্পণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, কারণ তার মনে হচ্ছিল রজনীনির দৃষ্টি সরাসরি তার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে, যেন মন পড়ে ফেলছে।

রজনীনি বলল, “১৯৭১-এর সেই রাতে, আমার বিয়ের আগের দিন, আমি জানালার ওপারে একটা ছায়াকে দেখেছিলাম। সে বলেছিল, যদি আমার হাতে হাত দিই, আমি আর কষ্ট পাব না। তখন আমার বিয়ে হচ্ছিল এক বৃদ্ধ জমিদারের সঙ্গে, যার লোভে আমার বাবা আমাকে বিক্রি করে দিচ্ছিল। আমি… হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। কাচ গলে গেল, আমি এপারে এলাম। কিন্তু এই জায়গায় আসার পর বুঝলাম—এখান থেকে ফেরার জন্য একজনকে আনতে হয়। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম এটা মুক্তি, পরে বুঝলাম এটা অভিশাপ।”

অর্পণ জিজ্ঞেস করল, “অভিশাপটা কীভাবে এল?”

রজনীনি চোখ নামিয়ে বলল, “আমাকে টেনে এনেছিল যে… সে ছিল আমার আগের জন্মের প্রেমিক। যুদ্ধ, মৃত্যু আর প্রতারণায় সে পাগল হয়ে গিয়েছিল। তার অভিশাপ ছিল—যারা এই জানালায় তাকাবে, তারা সবাই তার একাকীত্ব ভাগ করে নেবে। যতক্ষণ না কেউ নিজের ইচ্ছায় আরেকজনকে আনে, সে বেরোতে পারবে না। আর অভিশাপ ছিঁড়তে হলে… জানালা আর জলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিজের স্মৃতি ত্যাগ করতে হয়।”

মোহিনী কাঁপা গলায় বলল, “মানে?”

“যে স্মৃতি তোমাকে মানুষ করে রেখেছে, যা তোমাকে বাড়ি ফিরতে বাধ্য করে—তা ত্যাগ করতে হবে। তখনই জানালা তোমাকে ছেড়ে দেবে। কিন্তু স্মৃতি চলে গেলে তুমি কাকে খুঁজে বাড়ি ফিরবে?”

অর্পণ অনুভব করল বুকের ভেতর থেকে এক অদৃশ্য হাত টানছে—তার মা’র হাসি, প্রথম ক্যামেরা হাতে পাওয়ার মুহূর্ত, বৃষ্টির দিনে কলেজের করিডর—সব ছবির মতো ভেসে উঠছে, আর একে একে মিলিয়ে যাচ্ছে। রজনীনি ফিসফিস করে বলল, “যদি বেরোতে চাও, ঠিক করো—তুমি কী ভুলে যেতে রাজি?”

দূরে হাড়-মুখো লোকটা এগিয়ে আসছে, সঙ্গে আরও কয়েকজন—তাদের চোখে ক্ষুধা, যেন তারা চায় কেউ তাড়াতাড়ি সেই ত্যাগ করুক, যাতে তারাই বেরোতে পারে।

মোহিনী অর্পণের হাত চেপে ধরল। “তুই কিছু ভুলিস না, বাপু। মনে রাখিস—ভুলে গেলে তুই ফিরবি, কিন্তু তুই আর তুই থাকবি না।”

অর্পণ কুয়াশার মধ্যে তাকিয়ে দেখল—একটা জানালায় তার ঘর স্পষ্ট, কিন্তু জানালার কাচের ওপাশে সে নেই, শুধু ফাঁকা চেয়ার আর লবণ ছড়ানো মেঝে। রজনীনি নরম স্বরে বলল, “এটাই শেষ সুযোগ। ত্যাগ করো, নইলে চিরকাল এখানেই…”

অর্পণের চারপাশে কুয়াশা ঘুরছে, ভারি জল বুক পর্যন্ত উঠে এসেছে, আর দূরের জানালায় ঝিকমিক করছে তার নিজের ঘর। কাচের ওপাশে খোলা ল্যাপটপ, টেবিলে ক্যামেরা, কিন্তু সে জানে—সেখানে পৌঁছাতে হলে নিজের কিছু হারাতে হবে। রজনীনি স্থির চোখে তাকিয়ে আছে, কণ্ঠে জলের ফোঁটা মিশে থাকা স্বর—“একটা স্মৃতি ত্যাগ করো, যেটা তোমাকে সবচেয়ে বেশি বেঁধে রেখেছে।”

অর্পণের মাথায় ভেসে উঠছে মা’র হাসি, বাবার কাঁধে চেপে ভিড়ের মেলা দেখা, প্রথম প্রেমিকার হাত ধরা, কলেজের করিডরে বৃষ্টির গন্ধ। প্রতিটি মুহূর্তই জীবনের গভীর শিকড়। তার গলা শুকিয়ে গেল। “যদি এগুলো হারিয়ে ফেলি, আমি কি তখনও আমি থাকব?”

রজনীনি ধীরে বলল, “তুমি ফিরবে, কিন্তু বদলে যাবে। এটা মুক্তি নয়, বিনিময়।”

পেছনে হাড়-মুখো লোকটা আরেক কদম কাছে এল—এবার তার চোখে যেন উন্মত্ততা, হাত বাড়িয়ে বলছে, “দাও! ত্যাগ করো! আমি বেরোব!” আরও কয়েকজন এগিয়ে এসেছে, তাদের চোখে একই তৃষ্ণা। মোহিনী এগিয়ে এসে অর্পণের সামনে দাঁড়াল, রূপোর চাবিটা তার হাতে গুঁজে দিল। “তুই কিছু ভুলিস না, অর্পণ। থাকবি এখানে হলেও থাকবি তুই।”

জল এখন গলা ছুঁয়ে ফেলেছে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কুয়াশার ভেতর জানালার ফ্রেমটা কেমন যেন কাছে সরে এসেছে—ওপাশে উজ্জ্বল আলো, শুকনো মেঝে। অর্পণ হঠাৎ বুঝল, তার মনের ভিতর থেকে এক স্মৃতি জোর করে টেনে বের করা হচ্ছে—মা’র মুখ। সে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে আঁকড়ে ধরতে, কিন্তু আঙুলের ফাঁক দিয়ে জল পড়ে যাওয়ার মতো সেটা সরে যাচ্ছে।

“না!” সে গর্জে উঠল, হাত দিয়ে কুয়াশা ঠেলে মোহিনীর হাত শক্ত করে ধরল। “আমি কিছুই ত্যাগ করব না।”

রজনীনির মুখে প্রথমবার বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠল। “তাহলে তুমি এখানেই…”

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই অর্পণ চাবিটা দু’হাতে ঘুরিয়ে ধরল, আর আশ্চর্যজনকভাবে চারপাশের জল কেঁপে উঠল—শিকল বাঁধার আর খোলার শব্দ একসঙ্গে মিলিয়ে গেল, কুয়াশা ফেটে গেল, আর এক প্রবল স্রোত তাদের দু’জনকে (অর্পণ ও মোহিনী) ধাক্কা মেরে জানালার ফ্রেমের দিকে ছুঁড়ে দিল।

শেষ যে দৃশ্যটা সে দেখল, তা হল হাড়-মুখো লোকটার হাহাকার, আর রজনীনির চোখে তীব্র হতাশা—যেন কেউ বহু বছরের খেলা হারিয়ে ফেলেছে।

এক মুহূর্ত পর অর্পণ ধপ করে মেঝেতে পড়ল—তার নিজের ঘরে। পাশে শ্বাসকষ্টে কাঁপছে মোহিনী। বাইরে ভোরের আলো, আকাশে কোনও মেঘ নেই। কিন্তু জানালার কাচের ভিতর থেকে খুব ক্ষীণ কুয়াশার আস্তরণে ভেসে উঠল রজনীনির মুখ—সে ঠোঁট নেড়ে বলল, “তুমি বেঁচে ফিরেছো… কিন্তু খেলা শেষ হয়নি।”

দিন গড়িয়ে সপ্তাহ। অর্পণ আর মোহিনী যেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে—কমপক্ষে বাইরে থেকে দেখলে তাই মনে হয়। মোহিনী বাজারে যায়, অর্পণ আবার ফটোগ্রাফির কাজে ব্যস্ত হয়। তবুও প্রতিটি রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে তারা দু’জনই জানালার শিকল টেনে পরীক্ষা করে, চার কোণে লবণ ছিটিয়ে রাখে।

প্রথম ক’দিন সব শান্ত ছিল। জানালার কাচ স্বচ্ছ, কুয়াশা নেই, শিকল নড়ে না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে অর্পণ জানত, এ শান্তি কেবল সাময়িক। কারণ সেই কণ্ঠ—যা সে কাচের ওপার থেকে শুনেছিল—কখনও একেবারে মুছে যায়নি, শুধু যেন গভীর জলের তলায় ডুবে ছিল।

তারপর এল আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টি। দুপুর থেকেই আকাশ কালো হয়ে গিয়েছিল, বাতাসে জলের গন্ধ, আর দূরের বজ্রপাতের পরপরই অদ্ভুতভাবে বাড়ির ভেতর আলো ম্লান হয়ে গেল। বাইরে বৃষ্টি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিকলের ধাতব কাঁপুনির শব্দ আবার কানে এল—এবার একবার নয়, অবিরাম।

মোহিনী সোজা অর্পণের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। “আমি জানতাম আজ হবে। প্রথম বৃষ্টির রাত…” তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল।

অর্পণ ক্যামেরা হাতে জানালার দিকে তাকাল—কাচ ভেজেনি, কিন্তু ভিতর থেকে আলো যেন চুঁইয়ে আসছে, ঠিক যেমন জলের তলায় সূর্যের আলো ছেঁকে আসে। তারপর দেখা দিল রজনীনি। কিন্তু আজ তার মুখের সাথে আরেকটা মুখ মিশে আছে—হাড়-মুখো লোকটার, আর সেই ভেজা তরুণীর। যেন তিনটি মুখ মিলে এক হয়ে গেছে, আর চোখগুলো আগের চেয়ে দ্বিগুণ উজ্জ্বল।

“তোমরা ভেবেছিলে খেলা শেষ?” কণ্ঠটা তিনজনের মিশ্রণ, জলে ডোবা শব্দে ভরা। “তোমরা ফিরেছো ঠিকই, কিন্তু শিকল আমাদের। যতদিন জানালাটা থাকবে, ততদিন আমরা ডাকব।”

বাইরের বৃষ্টি হঠাৎ থেমে গেল, অথচ কাচের ওপাশে ফোঁটা পড়তে শুরু করল—ভেতরের বৃষ্টি। ফোঁটাগুলো কাচ বেয়ে নামতে নামতে অদ্ভুত আকার নিচ্ছে—একটা চাবির, একটা চোখের, আর শেষে একটি হাতের।

অর্পণ শিকল আরও শক্ত করে বাঁধতে গেল, কিন্তু বুঝল শিকল ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, আর ধীরে ধীরে তার হাতে গলে জলে পরিণত হচ্ছে। মোহিনী পিছন থেকে বলল, “আমরা বাঁচব কেবল যদি জানালাটাই ভেঙে দিই।”

রজনীনি হাসল—“যা ভাঙো, তা আবার গড়ে ওঠে। যতদিন এই বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, কালো জানালার ওপারে পথ খোলা থাকবে।”

ঠিক তখনই, এক ঝলক বিদ্যুৎ ঘর ভরে দিল। অর্পণ স্পষ্ট দেখল—কাচের ওপারে দাঁড়ানো আরও অনেকে, যাদের চোখে সেই একই জ্যোতি। তাদের মধ্যে একজনের মুখ অবিকল তার নিজের… কিন্তু ঠোঁটে সেই জমাট বাঁধা হাসি।

বজ্রপাত মিলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব নিস্তব্ধ। শিকল স্থির, কাচ শুকনো। যেন কিছুই হয়নি।

কিন্তু অর্পণ জানে—এ কেবল প্রথম ডাক। আর পরের বৃষ্টির রাত হয়তো এত সহজে কাটবে না।

***

Lipighor_1754717321229.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *