Bangla - প্রেমের গল্প

এক ফোঁটা সাদা মেঘ

Spread the love

অদিতি বসু


ট্রেনের ধাতব শব্দ যেন ধীরে ধীরে একটানা লোরির মতো বাজছিল—টকটকটকটক—কলকাতার ব্যস্ত হাওড়া স্টেশন ছাড়িয়ে গতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জানালার বাইরের দৃশ্যও বদলে যাচ্ছিল। অনির্বাণের সামনে রাখা ছিল একটা পুরোনো ক্যানন ক্যামেরা আর ছোট্ট এক ব্যাগ, যার ভেতরে শার্ট, উলের সোয়েটার, আর দু’টো বই ছাড়া আর কিছু নেই। ব্যাগটা দেখলেই বোঝা যায়, এই সফরটা তার জন্য লাগেজ নয়, বরং মনকে হালকা করার এক চেষ্টার মতো। ট্রেনের সীটের পাশে বসে সে একবার মোবাইলটা হাতে নিয়েও আবার রেখে দিল—এবারের ভ্রমণে সে সামাজিক মাধ্যম থেকে নিজেকে দূরে রাখবে ঠিক করেছে। গাঢ় নীল শার্টের কলার খুলে রেখে ঠান্ডা হাওয়া গায়ে মেখে নিতে নিতে মনে হল, শেষ কবে এইরকম একা বেরিয়েছে? অফিসের ক্রিয়েটিভ ডিপার্টমেন্টের মাথাব্যথা, ডেডলাইন, আর কিছু কিছু অব্যক্ত ব্যক্তিগত স্মৃতি—সবকিছু যেন ট্রেনের ধোঁয়ার সঙ্গে ফেলে রেখে আসতে চাইছে সে। জানালার বাইরে ধানক্ষেতের সবুজ, ছড়িয়ে থাকা খড়ের গাদা, ছোট নদীর উপর দিয়ে পেরোনো লোহার ব্রিজ—সব যেন একেকটা ছবি হয়ে তার চোখে ধরা দিচ্ছে। মাঝে মাঝে ঝলসে ওঠা সন্ধ্যার সোনালি আলো যেন তাকে এক অদ্ভুত প্রশান্তি দিচ্ছে, যা শহরের কংক্রিটের ভেতর বহুদিন খুঁজে পায়নি।

যতই সময় গড়াচ্ছে, দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে আরও দ্রুত। সমতলের বিস্তৃত মাঠ, শাল-পলাশের গাছের সারি পেরিয়ে ধীরে ধীরে পাহাড়ি ঢালু দেখা দিতে শুরু করেছে। দূরে নীলচে কুয়াশার আবছা রেখা, তার ওপরে সূর্যের শেষ আলোয় ঝলমল করা পাহাড়ের আউটলাইন—এই দৃশ্যের জন্যই যেন সে এতদিন অপেক্ষা করছিল। সীটের হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল অনির্বাণ, কিন্তু ঘুম এল না। বরং তার মনে চলতে লাগল নানা অদ্ভুত অনুভূতির মিশেল—একদিকে এই যাত্রার উচ্ছ্বাস, অন্যদিকে একরকম শূন্যতা, যেন সে কোথাও থেকে পালিয়ে আসছে অথচ ঠিক জানে না, কোথায় গিয়ে পৌঁছাতে চায়। ট্রেনের কামরায় কয়েকজন পাহাড়ি বিক্রেতা উঠে উলের টুপি, স্কার্ফ বিক্রি করছিল, তাদের গলার সুরে একটা সহজ সরল হাসিখুশি ভাব—যা শহুরে ব্যবসার চাতুর্যের থেকে একেবারেই আলাদা। একজন ছোট্ট ছেলে চা বিক্রি করছিল, কাপে ঢালার সময় ধোঁয়া উড়ছিল যেন কুয়াশার আভাস। অনির্বাণ এক কাপ নিয়ে চুমুক দিতেই বুঝল—স্বাদে আছে কেমন যেন মাটির গন্ধ, যা তার শৈশবের কোনও অস্পষ্ট স্মৃতিকে টেনে আনছে। এমন মুহূর্তে সে অনুভব করল, হয়তো এই ভ্রমণ তাকে শুধু দৃশ্য দেখাবে না, বরং নিজের ভেতরের হারানো অংশগুলোকেও খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।

সন্ধ্যা নেমে আসার সময় ট্রেন পাহাড়ি লুপ দিয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগল, বাঁক নিতে নিতে নিচের আলো ঝিলমিল করে দেখা যাচ্ছিল—ছোট্ট ছোট্ট বসতি, কিছু চায়ের দোকান, কুয়াশায় ঢাকা রাস্তা। হাওয়ার মধ্যে ঠান্ডার ছোঁয়া স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, এবং জানালার কাঁচে ধোঁয়া জমে এক ধরনের ঝাপসা ছবি তৈরি করছিল। এই ঝাপসা ছবির দিকে তাকিয়ে অনির্বাণ হঠাৎ মনে করল—জীবনও যেন অনেকটা এরকম, কখনো স্পষ্ট, কখনো অস্পষ্ট, আর মাঝে মাঝে এমন মুহূর্ত আসে যখন সবকিছু শুধু অনুভব করা যায়, দেখা যায় না। সে বুঝতে পারল, আজকের রাতটা তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ—এটা এক প্রকার সেতু, যা শহরের জীবনের একঘেয়েমি থেকে অজানা পাহাড়ি দিনের দিকে নিয়ে যাবে। ট্রেনের সান্ধ্য নীরবতায়, পাহাড়ি অন্ধকারের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে, অনির্বাণের মনে প্রথমবার একরকম অদ্ভুত প্রত্যাশা জন্মাল—হয়তো এই সফরে কিছু ভিন্ন ঘটবে, এমন কিছু যা সে আগাম আন্দাজ করতে পারছে না, কিন্তু অনুভব করছে ঠিক যেমন দূরের কুয়াশায় ঢাকা আলো থেকে বোঝা যায়—সেখানে হয়তো কেউ অপেক্ষা করছে।

দার্জিলিংয়ের প্রথম সকালটা যেন রঙ আর গন্ধে ভরা এক নতুন ক্যানভাসের মতো খুলে গেল অনির্বাণের সামনে। রাতের কুয়াশা ভেঙে সকালে সূর্যের হালকা সোনালি আলো পড়েছে চৌরাস্তার উপর, যেখানে ধীরে ধীরে জমে উঠছে মানুষের ভিড়। চারপাশে চায়ের দোকানের কাচের গ্লাসে ধোঁয়া উঠছে, কেউ কেউ পাহাড়ি উলের টুপি পরে হেঁটে যাচ্ছে, আর কিছু পর্যটক মোবাইলে সেলফি তুলছে পেছনে কানচেনজঙ্ঘার আভাস ধরা পড়ার জন্য। অনির্বাণ হাতে ক্যামেরা নিয়ে ঘুরছিল, কিন্তু ছবির থেকেও যেন বেশি তার নজর আটকে যাচ্ছিল মানুষের ভঙ্গিমা আর কথাবার্তায়। এমন সময় তার চোখে পড়ল একজন—গলায় উজ্জ্বল সবুজ উলের স্কার্ফ, হাতে পুরোনো ধাতব মাথাওয়ালা কাঠের ছাতা, আর মুখে এমন এক নির্ভার হাসি যেন সারা দুনিয়ার সময় তার হাতে আছে। ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে, আর একদল বিদেশি পর্যটককে পথ দেখাচ্ছে। কথা বলার মধ্যে যে স্রোত, তাতে বোঝা যায় সে শুধু রাস্তা দেখাচ্ছে না, যেন প্রতিটা মোড়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা গল্পও খুলে দিচ্ছে। অনির্বাণ খানিকটা কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেল, আর ঠিক তখনই ছেলেটির চোখ তার দিকে পড়ল—একটা অদ্ভুত উষ্ণতা আর সহজ বন্ধুত্বের আমন্ত্রণ ছিল সেই দৃষ্টিতে।

“গাইড লাগবে?” খুব স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করল ছেলেটি, আর অনির্বাণ এক মুহূর্ত দেরি না করে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। নিজের নাম বলল—তাশি লামা। নামের ভেতরেই যেন পাহাড়ি হাওয়ার গন্ধ মিশে আছে। হাঁটতে হাঁটতে তাশি একটা ছোট্ট ম্যাপ খুলে দেখাতে লাগল আজ কোথায় কোথায় যাওয়া যেতে পারে, কিন্তু ম্যাপের মধ্যে আটকে থাকল না—প্রতিটা জায়গার সাথে জুড়ে দিল গল্প। সে বলল, এই পাহাড়ে নাকি মেঘেরও রং বদলায়, কখনো তা দুধসাদা, কখনো হালকা গোলাপি, আবার সূর্যাস্তের সময় সোনালি হয়ে যায়—যেন আকাশ নিজেই প্রেমপত্র লিখে পাঠাচ্ছে পৃথিবীর কাছে। পথে যেতে যেতে তাশি এক পুরোনো বিল্ডিং দেখিয়ে বলল, এখানে একসময় এক ব্রিটিশ চা-ব্যবসায়ী এক পাহাড়ি মেয়ের প্রেমে পড়েছিল, কিন্তু সমাজের নিয়মে তারা একসাথে হতে পারেনি। অনির্বাণ বুঝতে পারল, এই ছেলে শুধু গাইড নয়—সে এক গল্পকথক, যে পাহাড়ের প্রতিটি বাঁকে মানুষের হাসি-কান্না, স্বপ্ন-ভাঙন ধরে রেখেছে। তার কথা শোনার সময় অনির্বাণ মনে মনে ছবি তুলছিল, কিন্তু ক্যামেরা দিয়ে নয়—নিজের মনে, যেখানে এই শব্দ আর দৃশ্য মিলেমিশে তৈরি করছিল এক অদ্ভুত উষ্ণতা।

চৌরাস্তার ব্যস্ততা পেছনে ফেলে তারা যখন একটি নির্জন গলির দিকে ঢুকল, তখন তাশির গলায় বাজতে লাগল এক পাহাড়ি সুর—হয়তো অজান্তে, হয়তো অভ্যাসবশত। সুরটা ছিল ধীর, কিন্তু তাতে এমন এক মায়া ছিল যে অনির্বাণ থেমে শুনতে বাধ্য হল। “এটা কি তোমার নিজের গান?” অনির্বাণ জিজ্ঞেস করতেই তাশি হেসে বলল, “না, এটা আমার দাদু গাইতেন… প্রেমের গান, যেখানে মেয়েটি অপেক্ষা করে, কিন্তু ছেলেটি ফিরে আসে না।” কথাটা বলার সময় তাশির চোখে এক মুহূর্তের জন্য এক ধরনের দূরের দৃষ্টি ভেসে উঠল—যেন তার নিজের জীবনেও কোথাও এক অসম্পূর্ণ গল্প লুকিয়ে আছে। তারা এগিয়ে চলল, কিন্তু অনির্বাণের মনে হল, এই প্রথম দিনের প্রথম ঘণ্টাগুলোতেই তার যাত্রা যেন অন্য পথে মোড় নিয়েছে। তাশির উপস্থিতি, তার গল্প বলার ভঙ্গি, আর সেই নির্ভার হাসি—সব মিলিয়ে এমন এক সংযোগ তৈরি হয়েছে যা যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায় না, শুধু অনুভব করা যায়, ঠিক যেমন পাহাড়ি কুয়াশা—যা এক মুহূর্তে তোমাকে ঘিরে ধরে, আর পরের মুহূর্তে মিলিয়ে যায়, কিন্তু তোমার ত্বকে তার শীতলতার ছাপ রেখে যায়।

পরদিন সকালে আকাশে হালকা মেঘ, কিন্তু তার ভেতরেই ফোটে থাকা রোদের উজ্জ্বলতা অনির্বাণকে জানিয়ে দিল—আজকের দিনটা আলাদা হবে। তাশি ঠিক সময়েই হাজির হল, গলায় সেই চেনা সবুজ স্কার্ফ, হাতে গিটার কেস আর চোখেমুখে একধরনের দুষ্টুমি মেশানো হাসি। “আজ তোমাকে শহরের ভিড়ের বাইরে নিয়ে যাব,” বলল সে, আর তার হাঁটার ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছিল—সে যেদিকে যাচ্ছে, সেটাই যেন আসল দার্জিলিং। তারা প্রথমে ঢুকল এক সরু পাহাড়ি পথে, যেটা সাধারণ পর্যটকরা এড়িয়ে যায়, কারণ সেখানে কোনও চকচকে সাইনবোর্ড বা সেলফি স্পট নেই। পথটা ধীরে ধীরে নামছিল এক জঙ্গলপথে, যেখানে শালের গাছের ফাঁক দিয়ে হাওয়া হু হু করে বইছে, আর পায়ের নিচে শুকনো পাতার মচমচে শব্দ—শহরের শব্দহীনতায় অভ্যস্ত অনির্বাণের কানে এই শব্দ যেন এক ধরনের গোপন সঙ্গীত হয়ে উঠল। মাঝপথে তাশি থেমে একটা পুরোনো পাথরের বেঞ্চ দেখিয়ে বলল, “এখানে নাকি এক পাহাড়ি বৃদ্ধ সারা জীবন বসে থেকেছেন, তাঁর স্ত্রীর ফেরার অপেক্ষায়… তিনি আর আসেননি, কিন্তু বৃদ্ধ নাকি শেষ দিন পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন, একদিন কুয়াশা সরলেই স্ত্রী ফিরবেন।” অনির্বাণ চুপচাপ শুনছিল—সে জানে, এই পাহাড় শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নয়, এখানে মানুষের জীবনের গল্পও মাটির গন্ধে মিশে আছে।

জঙ্গলের পথ পেরিয়ে তারা পৌঁছাল এক পরিত্যক্ত চা-বাগানের ধারে। সারি সারি চা-গাছ এখন অবহেলায় বড় হয়ে ঝোপে পরিণত হয়েছে, আর মাঝখানে পড়ে থাকা কাঠের সেতুটি ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। বাতাসে আছে এক ধরনের পুরোনো দিনের গন্ধ, যেন এখানে একসময় হাসি, কাজের শব্দ, আর মানুষের কোলাহল ছিল, যা এখন কেবল স্মৃতির ভেতর বেঁচে আছে। তাশি চুপচাপ দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সেই দৃশ্য দেখল, তারপর বলল, “আমার মা এখানে কাজ করতেন, যখন আমি খুব ছোট। একদিন এই বাগান বন্ধ হয়ে গেল, সবাই ছড়িয়ে পড়ল অন্য গ্রামে।” তার কণ্ঠে কোনও নাটকীয়তা নেই, বরং এক ধরনের মেনে নেওয়া অভ্যাস—যেমন পাহাড়ের মানুষ সময়ের স্রোতে ভেসে যায়, অভিযোগ না করেই। তারা এগিয়ে গেল এক ভিউপয়েন্টে, যেখানে পাহাড়ি ঢেউয়ের মতো সবুজ উপত্যকা, দূরে কানচেনজঙ্ঘা হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা, আর বাতাসে শীতের সতেজতা। তাশি এখানে দাঁড়িয়ে আরও গল্প বলল—পাহাড়ি দেবতার কাহিনি, হারিয়ে যাওয়া প্রেমের কিংবদন্তি, এমনকি এক পাহাড়ি ছেলের কথা, যে নাকি সাদা মেঘের পিছু নিয়ে একদিন চিরতরে অদৃশ্য হয়ে যায়। অনির্বাণের মনে হল, তাশির এই গল্প বলার ভঙ্গি একধরনের যাদু—সে শুধু শোনাচ্ছে না, বরং গল্পগুলোকে জীবন্ত করে তুলছে, যেন অনির্বাণ নিজেই সেগুলোর ভেতর দিয়ে হাঁটছে।

সন্ধ্যা নেমে এলে তারা ফিরল এক ছোট্ট কাঠের দোকানে, যেটা পাহাড়ি রাস্তায় একেবারে গোপনে বসে আছে—টিনের ছাদে মৃদু বৃষ্টির শব্দ, ভেতরে গরম চায়ের গন্ধ, আর কোণে তাশির গিটার রাখা। তারা কাঠের টেবিলে বসে ধোঁয়া ওঠা চা খেতে খেতে কথা বলছিল, হঠাৎ তাশি গিটার বের করে কোলে নিল। কোনও প্র্যাকটিস ছাড়াই আঙুল ছুঁয়ে দিল তারে, আর সুর ভেসে উঠল—ধীর, গভীর, পাহাড়ি প্রেমের গান। ভাষা অনির্বাণ পুরো বুঝতে পারছিল না, কিন্তু সুরের ভেতরে ছিল এক অদ্ভুত টান, যা কোনও অনুবাদের প্রয়োজন পড়ে না। তাশির চোখ সেই মুহূর্তে যেন দূরের দিকে চলে গেছে—হয়তো কোনও অচেনা মুখ, হয়তো কোনও হারিয়ে যাওয়া সময়। অনির্বাণ শুনছিল, কিন্তু কেবল সুর নয়, সে শুনছিল এক মানুষের ভেতরের নিঃশব্দ গল্প, যা কথায় বলা হয় না, কেবল গানেই মিশে যায়। গানের শেষ লাইনে তাশি মৃদু হেসে বলল, “এই গানটা আমার প্রিয়, কারণ এটা শেষ হয় না… শেষ লাইনে প্রেমিক শুধু বলে, ‘আমি আসব’, কিন্তু আর বলে না কবে।” সেই মুহূর্তে অনির্বাণের মনে হল, এই সফরে যে কিছুর খোঁজে এসেছে, হয়তো তার প্রথম ইঙ্গিত সে পেয়ে গেছে—এক মানুষের মধ্যে, যে পাহাড়ের মতোই রহস্যময়, আর যার গল্পও যেন কুয়াশার মতো—স্পর্শ করা যায়, কিন্তু ধরা যায় না।

সেই সকালে পাহাড়ের রং বদলে গিয়েছিল। জানালা খুলে অনির্বাণ দেখল, পুরো শহর যেন তুলোর নরম চাদরে মোড়া। গাছের মাথা, রাস্তার মোড়, দূরের বাড়ির ছাদ—সবকিছু মিলিয়ে গেছে এক অদৃশ্য সাগরে, যেখানে শুধু সাদা আর ধূসর রঙের ঢেউ। বাতাসে ভিজে থাকা শীতলতা যেন চুপিসারে ত্বকের ভেতর ঢুকে পড়ছিল। তাশির সাথে ঠিক হয়েছিল সকালে পাহাড়ি পথে হাঁটতে যাবে, তাই শীতের মধ্যে গা গুটিয়ে চৌরাস্তার দিকে রওনা দিল সে। তাশি সেখানে অপেক্ষা করছিল—গলায় সেই সবুজ স্কার্ফ, মাথায় উলের টুপি, হাতে পুরোনো ছাতা। কিন্তু আজ তার চোখেও যেন কুয়াশার মায়া লেগে আছে। তারা দুজন ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করল, পাথরের সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে, যেখানে প্রতিটা বাঁকের পর শুধু সাদা পর্দা। রাস্তার ধারে ছোট্ট দোকানগুলো থেকে বাষ্প আর চায়ের গন্ধ ভেসে আসছিল, কিন্তু কোনও মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না—শুধু আকারগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে, যেন স্বপ্নে দেখা মানুষের মতো। এই অস্পষ্টতার ভেতর এক ধরনের শান্তি ছিল, কিন্তু সেই শান্তি অনির্বাণের মনে কোথাও অদ্ভুত অস্থিরতাও জাগিয়ে তুলছিল।

একসময় তাশি থেমে গেল, একদম কোনও পূর্বাভাস ছাড়াই। কুয়াশার ভেতরে দাঁড়িয়ে সে মৃদু হেসে বলল, “জানো, কিছু কিছু জিনিস কুয়াশা থাকলেই সুন্দর লাগে। স্পষ্ট হয়ে গেলে হয়তো সেই ম্যাজিকটা হারিয়ে যায়।” কথাটা হাওয়ার মতো হালকা, কিন্তু তাতে ছিল এক অদ্ভুত গভীরতা। অনির্বাণ হঠাৎই নিজের ভেতর ঢুকে গেল—মনে পড়ল তার পুরোনো সম্পর্কের কথা, যে মেয়েটির সাথে একসময় প্রতিদিন কথা হতো, হাসি-ঠাট্টা ভাগাভাগি হতো, কিন্তু একদিন যখন তারা একে অপরকে পুরোপুরি চিনে ফেলল, যখন সবকিছু স্পষ্ট হয়ে গেল, তখন যেন সেই জাদু হারিয়ে গেল। তারা ধীরে ধীরে দূরে সরে গেল, আর একসময় সম্পর্কটা শুধু অভ্যাস হয়ে বেঁচে রইল, যতদিন না সেটাও মুছে যায়। তাশির কথা যেন সেই ভোলানো স্মৃতিটাকে আবার ধুলো ঝেড়ে বের করে আনল, আর অনির্বাণ চুপ করে রইল—কারণ কিছু স্মৃতির জন্য কোনও উত্তর থাকে না। কুয়াশা তাদের চারপাশে ঘুরছিল, যেন এই নীরব কথোপকথন শুনে আরও ঘন হয়ে উঠছে।

তারা আবার হাঁটা শুরু করল, কিন্তু এবার অনির্বাণ তাশির পেছনে পেছনে চুপচাপ চলছিল। রাস্তার পাশে পাহাড়ি ফুলের গাছ কুয়াশার ভেতর থেকে হঠাৎ হঠাৎ উঁকি দিচ্ছিল, যেন মুহূর্তের জন্য নিজেকে দেখিয়ে আবার লুকিয়ে যাচ্ছে। তাশির পায়ের শব্দ পাথরের উপর নরমভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, আর সেই ছন্দে মিশে যাচ্ছিল দূরের কোনও অদৃশ্য ঘণ্টার ধ্বনি—হয়তো কোনও মঠ থেকে আসছে। অনির্বাণের মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তটা যেন সময়ের বাইরে—না অতীত, না ভবিষ্যৎ, শুধু এক দীর্ঘ, সাদা নিঃশ্বাস। তাশির কথাগুলো এখনও কানে বাজছে, আর তার ভেতরে জন্ম দিচ্ছে এক ধরনের ভয়—যদি এই ভ্রমণের জাদুটাও একদিন স্পষ্ট হয়ে যায়, আর তখন কি থাকবে? কিন্তু সেই ভয়কে সে এখন শব্দে আনতে পারল না। তারা কুয়াশার ভেতরে মিলিয়ে গেল, যেন কোনও গল্পের দুই চরিত্র, যাদের গন্তব্য জানা নেই, কিন্তু পথটা এতটাই সুন্দর যে থামার প্রয়োজনও নেই।

সেই দিন বিকেলে আকাশে মেঘ জমে ছিল, আর হালকা বৃষ্টি পড়ছিল টিনের ছাদে টুপটাপ শব্দ তুলে। অনির্বাণ হোমস্টের লবি-তে বসে গরম লাল চা খাচ্ছিল, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছিল রাস্তা ধোয়া ভিজে রঙে ঝলমল করছে। চারপাশে এক ধরনের শান্তি, কিন্তু সেই শান্তির মাঝেও সে অনুভব করছিল, যেন বাতাসে কিছু অদেখা গল্প লুকিয়ে আছে। তখনই ধীরে ধীরে ভেতরে এলেন মিসেস দোলমা শেরপা—হোমস্টের মালিক, যিনি সারাক্ষণ মুখে নরম হাসি নিয়ে অতিথিদের যত্ন নেন। তার চোখে বয়সের রেখা, কিন্তু সেই রেখার ভেতর যেন পাহাড়ের অগণিত বছরের অভিজ্ঞতা গাঁথা। তিনি অনির্বাণের বিপরীতে এসে বসে হালকা কৌতূহলী দৃষ্টিতে বললেন, “তুমি তাশির সাথে অনেক ঘুরছ দেখছি।” অনির্বাণ একটু হেসে মাথা নেড়ে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, ও আমাকে এমনসব জায়গা দেখাচ্ছে, যা আমি নিজে কোনওদিন খুঁজে পেতাম না।” মিসেস দোলমা তখন কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, যেন শব্দ বেছে নিচ্ছেন। তারপর ধীরে, প্রায় ফিসফিস করে বললেন, “তাশি ভালো ছেলে… কিন্তু সব সময় কাছে থাকে না।” কথাটা বলেই তিনি আবার চায়ের কাপে চুমুক দিলেন, যেন কিছুই হয়নি।

অনির্বাণ প্রথমে বুঝতে পারল না—এটা কি কোনও সতর্কবার্তা, নাকি শুধু এক রকম সাধারণ মন্তব্য? কিন্তু মিসেস দোলমার চোখে তখন এমন এক ঝলক ছিল, যা তাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিল। সে ভেবে দেখল, তাশির মধ্যে সত্যিই এক ধরনের রহস্য আছে—যেভাবে সে হঠাৎ কোথা থেকে এসে হাজির হয়, আবার কোনও কথা না বলেই হারিয়ে যায়; কিংবা যেভাবে পাহাড়ি গল্প বলে কিন্তু নিজের গল্প খুব কমই শোনায়। অনির্বাণ প্রশ্ন করতে চাইছিল, কিন্তু মিসেস দোলমা যেন ইচ্ছে করেই সুযোগ দিচ্ছিলেন না। তিনি প্রসঙ্গ বদলে স্থানীয় চায়ের স্বাদ, পর্যটকের ভিড়, আর আবহাওয়ার কথা বলতে শুরু করলেন। অনির্বাণ বুঝতে পারছিল, তাঁর হাসির আড়ালে কিছু লুকিয়ে আছে—এক ধরনের তথ্য, যা হয়তো বললে অনির্বাণের ভ্রমণের ছন্দ বদলে যাবে। কিন্তু সেই কথাটা তিনি বলছেন না, শুধু এক অস্পষ্ট, প্রাচীন পাহাড়ি হাসি দিয়ে ঢেকে দিচ্ছেন।

বৃষ্টি ততক্ষণে আরও জোরে পড়তে শুরু করেছে, টিনের ছাদে তার শব্দ যেন ছোট্ট ঢেউয়ের মতো উঠানামা করছে। অনির্বাণ অনুভব করছিল, মিসেস দোলমার অল্প কথার ভেতরে যেন কোনও অদৃশ্য ফাঁদ আছে—যেখানে তাশির সাথে তার এই নতুন বন্ধুত্বের ভবিষ্যতের একটা আভাস লুকিয়ে রয়েছে। কিন্তু পাহাড়ি মানুষের মতো তিনিও হয়তো বিশ্বাস করেন, কিছু কথা মুখে বলার জন্য নয়—সময়ই সেগুলো প্রকাশ করবে। তিনি বিদায় নিলেন সেই একই নীরব হাসি নিয়ে, রেখে গেলেন অনির্বাণের মনে এক অদ্ভুত অস্বস্তি আর কৌতূহল। বাইরে রাস্তার ধারে হালকা কুয়াশা জমে যাচ্ছিল, আর অনির্বাণ হঠাৎ ভাবল—হয়তো এই অস্পষ্টতার ভেতরেই পাহাড়ের আসল রহস্য লুকিয়ে আছে, যা জানা সহজ নয়, কিন্তু একবার জানলে হয়তো ফেরা কঠিন হয়ে যাবে।

সকালের আকাশটা ছিল পরিষ্কার নীল, আর রোদের উষ্ণতা পাহাড়ি বাতাসের শীতলতার সাথে মিশে এক নিখুঁত আবহ তৈরি করেছিল। অনির্বাণ ভেবেছিল আজকের ট্রেক আগের দিনের মতোই হবে—পরিচিত পথ, চারপাশে সবুজ পাহাড়ের ঢাল, আর মাঝে মাঝে তাশির হাসি আর গল্পে সময় কাটানো। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পরই তাশি হঠাৎ এক মোড়ে বাঁ দিকে ঘুরে গেল, যেখানে কোনও সাইনবোর্ড নেই, আর পথটা যেন এক অজানা জঙ্গলের ভেতরে মিলিয়ে যাচ্ছে। অনির্বাণ প্রথমে একটু দ্বিধা করল, কিন্তু তাশির আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপ দেখে অনুসরণ করল। পথটা ছিল সরু, জায়গায় জায়গায় শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল, আর চারপাশে ঘন গাছের ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের আলো ছায়া ফেলে এক রহস্যময় পরিবেশ তৈরি করছিল। পাখিদের ডাকও এখানে অন্যরকম—কিছুটা দূরের, কিছুটা একাকী শোনাচ্ছিল। ধীরে ধীরে নীরবতা বাড়তে লাগল, আর সেই নীরবতার ভেতরে অনির্বাণের মনে হচ্ছিল তারা যেন এক ভিন্ন জগতে প্রবেশ করছে, যেখানে সময়ের কোনও মাপ নেই।

কিছুক্ষণ পরে গাছের আড়াল সরে গিয়ে হঠাৎই এক ফাঁকা জায়গা দেখা দিল। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল এক ভাঙাচোরা বৌদ্ধস্তূপ—পাথরের গায়ে শ্যাওলা জমে গেছে, ফাটল ধরে আছে, আর কোথাও কোথাও ভেঙে পড়েছে। চারপাশে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল পুরোনো প্রার্থনাপতাকা, যেগুলোর রঙ প্রায় মুছে গেছে, তবুও সেগুলো নীরবে বাতাসের সাথে দুলছিল, যেন পুরোনো কোনও মন্ত্র এখনও ছড়িয়ে দিচ্ছে। জায়গাটা এতটাই নির্জন যে মনে হচ্ছিল বহু বছর কেউ এখানে আসেনি। অনির্বাণ সেই দৃশ্য দেখে এক ধরনের বিস্ময় ও শ্রদ্ধায় ভরে গেল—এ যেন ইতিহাসের কোনও হারিয়ে যাওয়া পাতায় হঠাৎ চোখ পড়েছে। কিন্তু ঠিক তখনই সে লক্ষ্য করল তাশির দিকে। তাশির চোখে অদ্ভুত এক বিষণ্নতা ফুটে উঠেছে, যা অনির্বাণ আগে দেখেনি। সে স্তূপটার দিকে তাকিয়ে ছিল, যেন কোনও স্মৃতি বা অনুভূতির মধ্যে হারিয়ে গেছে, আর মুখের হাসিটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে।

অনির্বাণ চুপচাপ তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, তারপর ধীরে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখানে আগে এসেছ?” তাশি কিছুক্ষণ চুপ রইল, তারপর শুধু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল, কিন্তু আর কিছু যোগ করল না। অনির্বাণ বুঝতে পারল, তাশির নীরবতার ভেতরে কোনও গভীর গল্প লুকিয়ে আছে—হয়তো ব্যক্তিগত, হয়তো বেদনার। সে আর চাপ দিল না, কারণ পাহাড়ি মানুষের মতো তাশিও হয়তো বিশ্বাস করে, কিছু কথা কেবল নিজের কাছেই রাখা ভালো। তারা কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইল—প্রার্থনাপতাকার ফাঁক দিয়ে হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল, আর সেই হাওয়ায় মিশে যাচ্ছিল এক অদৃশ্য সুর, যা মনে হচ্ছিল বহু দূরের, বহু আগের। অবশেষে তাশি নীরবে ফিরে চলতে শুরু করল, আর অনির্বাণও তার পেছনে হাঁটল। কিন্তু সেই দিনের পরে অনির্বাণের মনে তাশিকে নিয়ে কৌতূহল আরও গভীর হয়ে গেল—এ যেন এক রহস্য, যার কোনও স্পষ্ট মানচিত্র নেই, কেবল অচেনা পথে হারিয়ে যাওয়ার সাহস চাই।

দার্জিলিংয়ের বিকেলটা সেদিন ছিল অদ্ভুত সুন্দর। আকাশ যেন সারা দিন ধীরে ধীরে রঙ বদলাতে বদলাতে এক নরম কমলা আর গোলাপি আভায় ভরে উঠেছিল। অনির্বাণ আর তাশি পাহাড়ের একটি চূড়ায় বসে সূর্যাস্ত দেখছিল—চারপাশে চা-বাগানের সবুজ ঢাল, দূরে নীলাভ কুয়াশায় মোড়া পাহাড়ের সারি। বাতাসে হালকা ঠান্ডা আর শুকনো পাতার গন্ধ, যা শহরের কোলাহল থেকে বহু দূরে এনে দিয়েছে এক প্রশান্তি। ঠিক তখনই অনির্বাণের চোখে পড়ল—পাহাড়ের মাথার ওপরে ধীরে ধীরে ভেসে আসছে এক টুকরো একদম সাদা মেঘ। মেঘটা যেন একা, নিঃশব্দে আকাশের রঙিন পটভূমির ওপর ভেসে চলেছে। তাশি চুপচাপ তাকিয়ে ছিল সেটার দিকে, তারপর হঠাৎ মৃদু স্বরে বলল, “এগুলো স্থায়ী হয় না… যেমন কিছু সম্পর্কও।” কথাটা যেন বাতাসের সাথে মিলেমিশে কোথাও হারিয়ে গেল, কিন্তু অনির্বাণের মনে তা গভীরভাবে আঘাত করল। সে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু ভাষা খুঁজে পেল না—শুধু মনে হলো, এই কয়েক দিনের ভেতর যে অনুভূতিটা ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছিল, সেটা হয়তো তাশির কাছে পৌঁছোনোর আগেই থেমে যাবে।

মেঘটা ধীরে ধীরে সূর্যের রঙে রঙিন হতে লাগল—প্রথমে হালকা সোনালি, তারপর কমলা, তারপর ধূসর। অনির্বাণ বুঝতে পারছিল, তাশির কথার মধ্যে কোনও সাধারণ পর্যটক-গাইড সম্পর্কের কথা নেই; বরং সেখানে আছে এক গভীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ছাপ। তাশির চোখে তখন এক ধরনের দূরত্ব, যেন সে অনির্বাণের পাশে থেকেও অন্য কোথাও আছে। অনির্বাণের মনে প্রশ্ন জাগল—তাশি কি আগে এমন কোনও সম্পর্কে ছিল, যা হঠাৎ শেষ হয়ে গেছে? নাকি এই পাহাড়ের জীবনে অস্থায়ী সম্পর্কই স্বাভাবিক? সে কিছু জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও থেমে গেল, কারণ সে জানত, তাশির নীরবতার ভেতরে এমন কিছু আছে যা জোর করে বের করা যাবে না। তারা দুজনেই চুপচাপ বসে রইল, শুধু মেঘটার ভেসে যাওয়া আর সূর্যের নিচে নামা দেখল। দূরের পাখিদের ডাক আর বাতাসের শব্দ সেই নীরবতাকে আরও গভীর করে তুলছিল।

যখন সূর্য পুরোপুরি পাহাড়ের পেছনে হারিয়ে গেল, তখন মেঘটাও যেন গলে গিয়ে আকাশের ধূসরতায় মিশে গেল। তাশি উঠে দাঁড়াল, আর অনির্বাণও ধীরে ধীরে তার পেছনে হাঁটতে লাগল। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরে ফেরার সময় অনির্বাণ অনুভব করল, এই মুহূর্তটা তার মনে চিরকাল থেকে যাবে—যেমন থেকে যায় কোনও অসম্পূর্ণ বাক্য বা অর্ধেক বলা গল্প। সে বুঝল, তাদের মধ্যে একটা অদৃশ্য দেয়াল আছে, যা হয়তো কখনও পুরোপুরি ভাঙা যাবে না। আর সেই দেয়ালটা হয়তো পাহাড়ের কুয়াশার মতোই—ছুঁতে গেলে মিলিয়ে যায়, কিন্তু কখনও পুরোপুরি সরে না। তার মনে পড়ল তাশির কথাগুলো, আর সে বুঝল, হয়তো এই পাহাড়ে তার সবচেয়ে বড় শিক্ষা হবে এইটাই—সব সুন্দর জিনিসকে ধরে রাখা যায় না; কিছু কেবল চোখের সামনে ভেসে এসে, ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়… ঠিক এক ফোঁটা সাদা মেঘের মতো।

আকাশ সেদিন ছিল মলিন কমলা, যেন সূর্যাস্তও ক্লান্ত হয়ে ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে। চা-বাগানের ঢালে বাতাসে চা পাতার গন্ধ ভাসছিল, আর দূরের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক সেই গন্ধের সাথে মিশে এক ধরনের মন খারাপ করা সুর তৈরি করছিল। অনির্বাণ আর তাশি পাশাপাশি বসে ছিল—কেউ কিছু বলছিল না, শুধু পায়ের নিচে শুকনো পাতার ওপর বাতাস বয়ে যাওয়ার শব্দ শুনছিল। কয়েকদিনের ভ্রমণ একসাথে কাটানোর পর এই নীরবতা ছিল ভিন্ন ধরনের; এখানে অস্বস্তি নেই, আছে এমন এক বোঝাপড়া যেখানে কথা না বললেও সব বলা হয়ে যায়। অনির্বাণ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চারপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে ভাবছিল, এই পাহাড়ের সাথে তার এক অদ্ভুত টান তৈরি হয়ে গেছে, আর সেই টানের ভেতর তাশির উপস্থিতি যেন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু ঠিক তখনই তাশির কণ্ঠস্বর সেই ভাবনার ভেতর প্রবেশ করল—নিম্ন, স্থির, কিন্তু তাতে এক ধরনের দূরত্বের আভাস ছিল, “কাল সকাল খুব ব্যস্ত থাকব, হয়তো দেখা হবে না।”

অনির্বাণ প্রথমে কথাটার অর্থ বুঝতে একটু সময় নিল। হয়তো তাশি স্রেফ ব্যস্ততার কথা বলছে, কিন্তু তার স্বরের ভেতরে একটা ‘বিদায়’ লুকিয়ে ছিল—এমন এক বিদায় যা আগে থেকে প্রস্তুত করা হয়, যাতে আকস্মিক বিচ্ছেদে মন ভেঙে না যায়। অনির্বাণ চাইল কিছু বলতে, হয়তো এমন কিছু যা এই মুহূর্তটাকে থামিয়ে রাখতে পারে—কিন্তু গলার কাছে আসা শব্দগুলো যেন আটকে গেল। সে তাশির দিকে তাকাল; তাশির মুখ তখন ছায়ায় ঢাকা, শুধু চোখদুটি স্পষ্ট—সেখানে কোনও অনুশোচনা নেই, কিন্তু আছে এক ধরণের চূড়ান্ততা, যেন সিদ্ধান্ত আগে থেকেই নেওয়া। এই সময় বাতাস হালকা ঠান্ডা হয়ে উঠল, আর দূরের মেঘগুলো ধীরে ধীরে পাহাড়ের মাথায় নেমে আসতে লাগল, যেন দৃশ্যপটও তাদের নীরব কথোপকথনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে। অনির্বাণ শুধু মাথা নেড়ে হাসল, কিন্তু সেই হাসির আড়ালে ছিল এক ধরনের অসহায়তা, যা কাউকে বোঝানো যায় না।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে চারপাশে চায়ের বাগান যেন অন্ধকারে ঢেকে গেল, শুধু দূরের কয়েকটা আলোর বিন্দু ঝিকমিক করছিল। তারা চুপচাপ বসে রইল, মাঝে মাঝে চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়ানো ছাড়া আর কোনও নড়াচড়া নেই। অনির্বাণ জানত, এই মুহূর্তের পর আর কোনও নিশ্চিত দেখা নাও হতে পারে, তবু সে জোর করল না—কারণ কিছু জিনিস নিজের গতিতে মিলিয়ে যাওয়াই হয়তো ঠিক। হঠাৎ বাতাসে এক ঝাপটা এসে তাশির স্কার্ফ উড়িয়ে দিল, তাশি সেটাকে ঠিক করে আবার গলায় পেঁচিয়ে নিল—এ যেন অনির্বাণের চোখে সেই মুহূর্তটাকে আঁকড়ে ধরা, যদিও সে জানত, বাস্তবে কিছুই আটকানো যাবে না। রাত নামার আগে তাশি উঠে দাঁড়াল, হালকা মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, “চলো, ফিরি।” সেই শব্দের ভেতরে কোনও প্রতিশ্রুতি ছিল না, আর অনির্বাণও বুঝে গেল—এই নীরব সন্ধ্যাই হয়তো তাদের শেষ যৌথ মুহূর্ত, যা সে চিরকাল মনে রাখবে, ঠিক একটি ম্লান হয়ে যাওয়া পাহাড়ি বিকেলের মতো।

সকালটা শুরু হয়েছিল এক অদ্ভুত নীরবতায়। জানালার বাইরে অনির্বাণ প্রথম চোখ মেলে যা দেখল, তা হলো ঘন কুয়াশায় ঢাকা গোটা পাহাড়—সবুজ চা-বাগান, পাথরের রাস্তা, এমনকি দূরের বাড়িগুলোও যেন এক সাদা চাদরের নিচে হারিয়ে গেছে। বাতাসে ছিল আর্দ্রতার গন্ধ, আর কোথাও কোথাও ভেজা মাটির সোঁদা সুবাস। অনির্বাণ জানত, আজই তার ফেরার দিন, কিন্তু সেই ফেরার প্রস্তুতির চেয়ে তার মন বেশি ব্যস্ত ছিল অন্য একটি প্রশ্নে—তাশির দেখা কি আর মিলবে? তাড়াতাড়ি গরম চা খেয়ে, একটি পাতলা জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে সে বেরিয়ে পড়ল চৌরাস্তার দিকে। পথে হাঁটতে হাঁটতে সে লক্ষ্য করল, কুয়াশার ভেতর দিয়ে মানুষজন ধীরে চলেছে, কারও মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। চারপাশে শুধু ধোঁয়ার মতো সাদা, যার ভেতরে পা বাড়ালেই মনে হয় অজানা কোথাও ঢুকে পড়া হচ্ছে।

চৌরাস্তা পৌঁছে অনির্বাণ থেমে গেল। সাধারণত এই সময় জায়গাটা প্রাণবন্ত থাকে—চায়ের দোকানগুলো খোলা, পর্যটকরা হাঁটাহাঁটি করে, ঘোড়ার টগবগ শব্দ শোনা যায়। কিন্তু আজ সবকিছু যেন কুয়াশার ভেতরে চাপা পড়ে গেছে। দোকানের শাটার আধখোলা, চায়ের কেটলি থেকে ধোঁয়া উঠছে, কিন্তু মানুষের মুখগুলো অস্পষ্ট ছায়ার মতো। অনির্বাণ চারপাশে তাকিয়ে তাশির খোঁজ করতে লাগল—হয়তো সে তার পুরোনো ছাতাটা হাতে নিয়ে আসছে, বা উজ্জ্বল সবুজ স্কার্ফটা কুয়াশার ভেতর থেকে দেখা দেবে। কিন্তু যতই সে অপেক্ষা করল, ততই বুঝতে পারল, আজ সেই দেখা হবে না। পায়ের নিচে ভেজা রাস্তায় জমে থাকা জল আর বাতাসের হালকা শীতলতা যেন তার বুকের ভেতরের শূন্যতাকে আরও স্পষ্ট করে তুলছিল। তখনই মিসেস শেরপা, যিনি কাছের দোকান থেকে কিছু কিনে ফিরছিলেন, তার চোখে পড়লেন। তিনি অনির্বাণকে দেখে থামলেন, কিন্তু কিছু বললেন না—শুধু মাথা নেড়ে এক ধরনের নীরব ইঙ্গিত দিলেন, যা অনির্বাণের কাছে স্পষ্ট অর্থ বহন করল: তাশি চলে গেছে, আর তার ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই।

অনির্বাণের মনে হলো, এই কুয়াশাই হয়তো আজকের দিনের প্রকৃত চরিত্র—যা স্পষ্ট হতে দেয় না, কেবল ধীরে ধীরে মিলিয়ে দেয়। সে চৌরাস্তার এক কোণে দাঁড়িয়ে রইল, অনেকক্ষণ পর্যন্ত, যেন হঠাৎ করে কিছু বদলে যাবে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে কুয়াশা আরও ঘন হতে লাগল, মানুষের পদচারণা কমে গেল, দোকানগুলোর ভেতর থেকে কেবল চামচের টুংটাং আর দূরের গাড়ির হর্ন ভেসে আসছিল। শেষে সে ধীরে ধীরে ফিরে গেল হোমস্টের দিকে। কুয়াশার ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল, তাশির সাথে তার সময়টুকুও ঠিক এই সাদা চাদরের মতো—হঠাৎ এসে সব ঢেকে দিয়েছিল, কিছুদিন ধরে কাছে ছিল, আর শেষে নিঃশব্দে মিলিয়ে গেল। হোমস্টের সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার সময় সে একবার পিছনে তাকাল—কুয়াশার ভেতরে পাহাড়, রাস্তা, আর মানুষ—সবকিছু যেন মিশে গিয়ে এক হয়ে গেছে, ঠিক যেমন তাশির অস্তিত্ব এখন তার স্মৃতির ভেতরে মিশে গেছে, অদৃশ্য কিন্তু অমলিন।

১০

কলকাতায় ফেরার ট্রেনযাত্রা যেন অনির্বাণের কাছে ছিল এক দীর্ঘ স্বপ্নভঙ্গের পথচলা। শহরের কোলাহল, হর্নের শব্দ, আর ধোঁয়াটে আকাশের নিচে সে আবার তার পরিচিত জীবনে ফিরে এল, কিন্তু ভেতরে যেন কিছু একটার অনুপস্থিতি থেকে গেল। কয়েকদিন পেরিয়ে যাওয়ার পর এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায়, ঘরের কোণে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সে ল্যাপটপ খুলল—দার্জিলিং ভ্রমণের তোলা ছবিগুলো দেখতে শুরু করল। ছবিগুলো একের পর এক ফুটে উঠছিল—পাহাড়ি রাস্তা, সবুজ চা-বাগান, ভিউপয়েন্ট থেকে সূর্যোদয়—প্রতিটি ছবির মধ্যেই ছিল এক ধরনের সতেজতা, কিন্তু যখন তাশির সাথে থাকা ছবিগুলো এলো, অনির্বাণ থমকে গেল। আশ্চর্যজনকভাবে বেশ কিছু ছবিতে তাশির মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না—কখনো কুয়াশায় ঢাকা, কখনো আলোর প্রতিফলনে ঝাপসা হয়ে যাওয়া। মনে হচ্ছিল, যেন ছবিগুলোও কোনওভাবে তার অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার গল্প জানে, আর তাই তাকে ধরে রাখার বদলে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

সে ছবিগুলো বড় করে দেখতে লাগল, যেন প্রতিটি ফ্রেমের ভেতরে লুকানো কোনও ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া যাবে। একটি ছবিতে তাশিকে দেখা যাচ্ছে পুরোনো কাঠের দোকানের সামনে গিটার হাতে বসে থাকতে, কিন্তু তার মুখের অভিব্যক্তি স্পষ্ট নয়—আলো আর ছায়ার মিশেলে তা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। আরেকটি ছবিতে, তারা একসাথে পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটছে, কিন্তু তাশির শরীরের অর্ধেকটাই কুয়াশায় ঢাকা, যেন প্রকৃতি নিজেই তাকে আড়াল করে রাখছে। অনির্বাণের মনে হলো, এই ঝাপসা ছবিগুলো শুধু প্রযুক্তিগত ত্রুটি নয়—এগুলো যেন তাদের সম্পর্কের রূপক, যা কখনো পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। প্রতিটি ঝাপসা ফ্রেম তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল সেই অনুচ্চারিত কথাগুলো, যেগুলো তাশির সাথে তার শেষ সন্ধ্যায় গলায় আটকে গিয়েছিল। ছবিগুলোর ভেতরে সে শুনতে পাচ্ছিল পাহাড়ি বাতাসের হাহাকার, ভিজে মাটির গন্ধ, আর তাশির কণ্ঠে বলা সেই বাক্যগুলো—“এগুলো স্থায়ী হয় না… যেমন কিছু সম্পর্কও।”

সবশেষে স্ক্রিনে ভেসে উঠল একটি ছবি, যা দেখে অনির্বাণ দীর্ঘক্ষণ স্থির হয়ে রইল। তাশিকে দেখা যাচ্ছে দূরে দাঁড়িয়ে—গায়ে হালকা জ্যাকেট, হাতে ছাতা নেই, মাথা সামান্য উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মাথার ওপর, নীল-সাদা আকাশে, একটি মাত্র সাদা মেঘ ধীরে ভেসে যাচ্ছে। দৃশ্যটা ছিল সরল, অথচ গভীর—ঠিক তাদের সম্পর্কের মতো। সুন্দর, ক্ষণস্থায়ী, আর চিরকাল অস্পষ্ট। অনির্বাণ স্ক্রিনে আঙুল ছুঁয়ে দেখল, যেন মেঘের আকারটা স্পর্শ করতে পারবে, কিন্তু বুঝল—যেমন সেই মেঘ আকাশে মিলিয়ে গেছে, তেমনি তাশিও মিলিয়ে গেছে তার জীবনের দৃশ্যপট থেকে। তবু এই ছবিটিই সে সংরক্ষণ করে রাখল, কারণ এর ভেতরেই বন্দি ছিল তাদের অল্পদিনের সম্পর্কের সমস্ত উষ্ণতা, রহস্য, আর অপূর্ণতার সৌন্দর্য। বাইরে তখন বৃষ্টি পড়ছিল, আর অনির্বাণ জানল—কিছু স্মৃতি ঠিক এই মেঘের মতোই, কখনো ধরা যায় না, শুধু দেখা যায়… আর অনুভব করা যায় চিরকাল।

_____

 

1000051268.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *