তৃষা চ্যাটার্জী
পর্ব ১: সমুদ্র কেনা মানুষটি
শৌর্য রায়চাঁদ ছোট জানালা পছন্দ করতেন না।
মোনাকোর শৃঙ্গরেখা বেয়ে উঠে যাওয়া চেমিন দে রেভোয়ারস-এর ওপর তাঁর বিলাসবহুল ভিলার চব্বিশতলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে, সমুদ্রের দিকে মুখ করে বিশাল কাঁচঘেরা দেওয়াল জুড়ে সূর্যালোক খেলে যাচ্ছিল। প্রতিদিনের মতো আজও সকালে, তিনি নগ্ন পায়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন কাঁচের সামনে—এক হাতে অ্যাস্প্রেসো, অপর হাতে খোলা লিনেন শার্ট, যেন দিগন্তরেখা একটা সমীকরণ যা তিনি প্রায় বুঝে ফেলেছেন।
তাঁর বয়স ছত্রিশ।
ফোর্বস এশিয়ার তালিকা বলছে তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ ২.৭ বিলিয়ন ডলার। ক্রিপ্টো থেকে শুরু করে অ্যাঞ্জেল ফান্ড, কার্বন-নিউট্রাল ইনভেস্টমেন্ট, স্টার্টআপ একুইজিশনের একাধিক চেইন—শৌর্য কোনো সাম্রাজ্য গড়েননি; তিনি শুধু অন্যের তৈরি সাম্রাজ্যকে সম্পাদনা করেছেন।
এই পৃথিবীতে অনেক বিলিয়নিয়ার আছেন। কিন্তু শৌর্য রায়চাঁদ তাদের মধ্যে সেই ধরনের, যিনি শব্দ কেনেন না, নীরবতা কেনেন। যিনি ঘড়ি পরেন না কারণ সময় তাঁর মালিকানায়।
তবু, সেই সকালে, যখন সূর্য ধীরে ধীরে মন্টে কার্লোর ক্যাসিনো চত্বরে ছায়া ফেলে দিচ্ছে, তখন তাঁর ফোনটা কেঁপে উঠল—একটা নাম নিয়ে, যেটা তিনি শেষবার দেখেছিলেন এগারো বছর আগে।
অনন্যা ভরগব।
তিনি ফোন ধরলেন না। প্রথমে না।
বরং, একটা ডাভিডফ সিগার জ্বালালেন—যা তিনি সচরাচর খান না—and বারান্দায় হাঁটলেন, যেখানে তাঁর বেন্টলে বেন্টায়গা দাঁড়িয়ে ছিল, লেবু গাছের ছায়ায় অর্ধেক ঢাকা।
স্টাফদের তিনি আগেই বলে রেখেছেন, সকাল ৯টার আগে কেউ বিরক্ত করবে না। তখন ৭টা ৪২।
সমুদ্রের গন্ধ আজ অন্যরকম—ধাতব, স্মৃতিভারাক্রান্ত। হয়তো ঝড় আসছে। নয়তো—অতীত।
ফোনটা আবার বেজে উঠল। সেই নাম। সেই নম্বর।
একদিন সেই নাম মানে ছিল দিল্লির ছাদে ঠান্ডায় কাঁপা গায়ে চা, ভেঙে যাওয়া IIT-র স্বপ্ন, আর বর্ষার রাতে উচ্চারিত একটা প্রতিশ্রুতি—
“তুমি হারিয়ে যাবে না, শৌর্য। যদি যাও, আমিই খুঁজে বার করব।”
কিন্তু তিনিই নিজে হারিয়ে গিয়েছিলেন।
বাবার টেক্সটাইল ব্যবসা ভেঙে পড়ার পর, একটা ব্যাকপ্যাক, একটা কোড স্ক্রিপ্ট আর তিরিশ ঘণ্টার ফ্লাইটে তিনি চলে গিয়েছিলেন বার্লিন। আজ যিনি মনাকোতে ট্রাফল রিসোটো খান, তিনি একদিন ক্রয়ৎসবের্গে হ্যাকার স্কোয়াটে থাকতেন, ম্যাগির প্যাকেট নিয়ে।
তিনি এবার ফোনটা ছুঁয়ে রাখলেন। ধরলেন না।
ভয়েসমেইলে পাঠিয়ে দিলেন।
—
১০টা নাগাদ তিনি বসলেন তাঁর চেনা জায়গায়—ক্যাফে দে লা মের, বন্দর লাগোয়া। তাঁর বডিগার্ড এতিয়েন, সাদা পোলো ও সানগ্লাস পরে দূরে এক টেবিলে। কেউ চিনে উঠতে পারে না।
শৌর্যের মিটিংগুলো চলে দাবার মতো। কোনো সৌজন্য নয়, শুধুই হিসেব।
তবু আজ তিনি সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকলেন বারবার, যেন তার ঢেউয়ের ফাঁকে লুকানো কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন।
নিচে দিয়ে একটা রিভা ইয়ট ছুটে গেল জলের ওপর। এক দম্পতি চুমু খেলেন, হাসলেন, যেন টাকা অক্সিজেন।
শেষমেশ, শৌর্য খুললেন সেই ভয়েস মেসেজ—
> “শৌর্য… আমি অনন্যা। ফোন করার দরকার নেই। কাল রাতে তোমায় CNBC-তে দেখলাম। মোনাকো তোমার গায়ে মানায়। হঠাৎ মনে পড়ল—তুমি কখনো সকাল পছন্দ করতে না। এখনও করো না, হয়তো।
আসলে… তোমার মা আমায় ফোন করেছিলেন। উনি ভাল নেই। স্টেজ টু… বলছে। তোমায় কিছু বলবে না, কিন্তু আমি বলছি—তুমি একবার দেশে এসো। ওনার প্রাপ্য।”
“আর… আমি খুঁজে পেয়েছি তোমার পুরোনো ডায়েরি। সেই যে, সমুদ্র আঁকা ছিল।”
মেসেজটা শেষ।
—
মোনাকো হঠাৎই ছোট মনে হলো। আয়নার ভেতরের একটা বাক্স।
তাঁর মা। দেরাদুন। স্টেজ টু। ক্যান্সার? ছয় বছর হয়ে গেল কথা বলেন না।
শেষবার বলেছিলেন—“তুই নিজের আত্মা বিক্রি করেছিস। স্ক্রিনের জন্য।”
আর অনন্যা? এখন? কেন?
ডায়েরির কথা বলেছিল? তিনি আজও সেটা রেখেছেন। নিরাপদে। সত্যিই কি খুঁজে পেয়েছে?
তিনি দুটো মিটিং বাতিল করলেন। এতিয়েনকে ছুটি দিয়ে দিলেন।
ড্রাইভ করে চললেন লা তুর্বির পাহাড়ে, যেখানে গেলে কেউ তাঁকে চিনে না।
গাড়ি থামিয়ে বসে পড়লেন এক পাথরের ওপর। নিচে, মোনাকো ঝকঝকে, গয়নার বাক্সের মতো। কিন্তু তার বহু দূরে—অদৃশ্যভাবে—আছে ভারত। যে দেশকে তিনি ভালোবেসেছিলেন, আবার ছেড়েও এসেছেন।
তিনি ব্যাগ থেকে বের করলেন সেই ডায়েরি।
শেষ পাতায় আঁকা এক বিশৃঙ্খল সমুদ্র—চারকোল পেনসিলে আঁকা, কাঁপা হাতের রেখা। নিচে লেখা—
“একদিন আমি সমুদ্র কিনব। তখন হয়তো শান্তি পাব।”
শৌর্য একটা ক্লান্ত হাসি দিলেন।
তিনি কিনেছেন—সমুদ্র, ভিউ, ইয়ট, সময়, নীরবতা।
তবে…
শান্তি?
সেটা এখনও বাকি।
পর্ব ২: বৃষ্টির মধ্যে সেই নারী
মোনাকোর আকাশে সেদিন দুপুরে অদ্ভুত আলো ছিল—রোদ আর মেঘের মাঝের এক অস্থির দ্বন্দ্ব। সাগরের ওপর হালকা ধূসর ছায়া নেমে এসেছে, কিন্তু মেরিনার ধারে ঝিকমিক করছে ইয়টের সাদা ডানা। শৌর্য রায়চাঁদ, সেদিন দুপুরে, কোনো রকম পরিকল্পনা ছাড়াই হেঁটে যাচ্ছিলেন বন্দর থেকে পাহাড়মুখী পথে।
অনন্যার ভয়েসমেসেজ যেন তাঁর মাথার ভেতর একটা অদৃশ্য ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে দিয়েছে। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি থেমে যাওয়া নিশ্বাস যেন চেনা—আর তবু অচেনা। এগারো বছর আগে যে কণ্ঠ তাঁকে তার নিজের দেশে আটকে রেখেছিল, সেটাই আজ হাজার মাইল পেরিয়ে ডেকে আনছে।
সামনের রাস্তা দিয়ে হঠাৎ এক ঝাপটা হাওয়া এল, সমুদ্রের লবণাক্ত গন্ধে ভরে গেল বাতাস। তখনই আকাশ যেন ফেটে পড়ল—বৃষ্টি।
মোনাকোর বৃষ্টি আলাদা। ভারী নয়, কিন্তু তীক্ষ্ণ, যেন একে একে কাচে আঙুল ছোঁয়া। শৌর্য দাঁড়িয়ে গেলেন। এই মুহূর্তে, এই জায়গায়, একটা স্মৃতি হঠাৎ তীব্র হয়ে উঠল—দিল্লির এক বর্ষার রাত, অনন্যার ভেজা চুল, আর তাঁর ঠোঁটে আটকে থাকা সেই বাক্য—
“তুমি পালিয়ে গেলে, আমি খুঁজে নেব।”
—
বৃষ্টির ভেতর দিয়ে তিনি ফিরে এলেন নিজের ভিলায়। বাইরে ভিজে রাস্তায় গাঢ় রঙের গন্ধ, ভিতরে কেবল নীরবতা। লিভিং রুমে দাঁড়িয়ে থাকা মেহগনি বুকশেলফের ভেতরে তাঁর সেফ। পাসওয়ার্ড দিলেন। খুললেন।
সেখানে ডায়েরি। পাতাগুলো আজও লবণজলে দাগ কাটা—যেন সমুদ্রও এর মালিকানা দাবি করছে।
তিনি পাতাগুলো উল্টে দেখতে লাগলেন। লেখাগুলো অদ্ভুতভাবে কাঁপা, যেন কাগজের মধ্যে কোনো ঝড় আটকে আছে। কিছু নোট ছিল অনন্যার হাতের লেখা—পুরনো কোনো সিনেমার ডায়লগ, কখনো আবার দু-তিনটা শব্দ যা হয়তো শুধু দু’জনেই বুঝত।
একটা পাতায় আটকে থাকা শুকনো ফুল দেখে হাত থেমে গেল। তখন বয়স তাঁর চব্বিশ। ক্রয়ৎসবের্গের এক ছোট্ট কফি শপে বসে অনন্যা চুপচাপ সেই ফুলটা তাঁর ডায়েরিতে রেখেছিল—কারণটা তিনি তখনও জিজ্ঞেস করেননি। আজও জানেন না।
—
রাত নামল ধীরে ধীরে। দূরে মন্টে কার্লোর ক্যাসিনো ঝলমল করছে, রাস্তায় কালো ল্যাম্বরগিনি, রোলস-রয়েসের লাইন। এই শহরে ধনীরা কেবল গাড়ি চালায় না—তারা নিজের অস্তিত্ব চালায় শো-রুমের মতো।
কিন্তু শৌর্যের মাথায় এখন শুধু ভারত। দেরাদুনের পুরনো বাড়ি, মায়ের শ্বাসের শব্দ, আর এক কণ্ঠ—যে তাঁকে আবার ফিরিয়ে আনছে।
ফোন তুললেন। ডায়াল করলেন অনন্যার নম্বর।
— “তুমি মেসেজটা শুনেছ?”
ওপাশে নিঃশ্বাস ফেলা।
— “হ্যাঁ।”
— “তাহলে?”
— “তুমি জানো, আমি দেশে ফেরার জন্য তৈরি না।”
— “তোমার মা ক্যান্সারে… শৌর্য, এটা ব্যবসা নয়। এখানে সময় কেটে গেলে আর ফেরানো যাবে না।”
শব্দগুলো কেটে যাচ্ছিল বৃষ্টির ফোঁটার মতো—তীক্ষ্ণ, অস্থির।
—
ফোন রেখে তিনি চুপ করে বসে রইলেন। বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু বারান্দা থেকে দেখা সমুদ্র অন্ধকার হয়ে আছে—মাঝে মাঝে ঢেউয়ের সাদা ফেনা যেন রাতের গায়ে দাগ কাটছে।
তাঁর মাথায় শুধু একটা ছবি—অনন্যা, বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে, চোখে এমন কিছু যা কিনতে পারে না কোনো অর্থ, কোনো ইয়ট, কোনো ভিলা।
তিনি জানতেন, এই গল্প এখানেই থামবে না। কারণ অতীত, বিশেষ করে অসম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতি, কখনো নিছক স্মৃতি হয়ে থাকে না। সেটা ধীরে ধীরে দরজায় কড়া নাড়ে—যতক্ষণ না দরজা খুলে দেওয়া হয়।
শৌর্য হয়তো সেই দরজা খুলতে যাচ্ছেন।
পর্ব ৩: ভারতের পথে
মোনাকোর সকালগুলোতে এক ধরনের অলস সৌন্দর্য থাকে—যেন শহর নিজেকে জাগাতে তাড়াহুড়ো করে না। কিন্তু সেই সকালে, শৌর্য রায়চাঁদের ভিলায় ভোরের আলো ঢোকার আগেই স্যুটকেস বন্ধ হয়ে গেছে, পাসপোর্ট প্রস্তুত, আর বুক করা হয়েছে নিস বিমানবন্দর থেকে এমিরেটসের ফার্স্ট ক্লাস টিকিট—নিস থেকে দুবাই, তারপর সোজা দিল্লি।
শৌর্য কখনো যাত্রার আগে ব্যস্ত হন না। তাঁর স্টাফদের সব নির্দেশ আগেই দেওয়া থাকে। কিন্তু আজ সকালটা আলাদা। যেন প্রতিটি মুহূর্ত তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে—এ যাত্রা ব্যবসার জন্য নয়, বরং এমন এক কারণে যা তিনি এত বছর ধরে এড়িয়ে গেছেন।
—
বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে, গাঢ় নীল বেন্টলেতে বসে, তিনি শহরটাকে শেষবারের মতো চোখে নিলেন—সাগরের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা ইয়টগুলো, পাহাড়ি ঢাল বেয়ে উঠে যাওয়া প্রাসাদোপম বাড়িগুলো, রাস্তার ধারে ল্যাভেন্ডারের গন্ধ। এখানে তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছেন এক নতুন মানুষ হিসেবে—যার শিকড় কেটে ফেলা হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে।
এতিয়েন, তাঁর বডিগার্ড, গাড়ি চালাচ্ছিলেন। হঠাৎ বললেন—
— “সব ঠিক তো, স্যার? আপনাকে একটু… আলাদা লাগছে।”
শৌর্য হালকা হাসলেন।
— “আলাদা? হতে পারে। কখনো কখনো অতীতও ভিসা পেয়ে যায়, এতিয়েন। তখন আমাদেরও যেতে হয়।”
—
নিস বিমানবন্দর। প্রাইভেট টার্মিনাল। ফ্লাইট ছাড়তে তখনও কিছু সময় বাকি। লাউঞ্জে বসে শৌর্য ফোন বের করলেন। অনন্যাকে একটা মেসেজ লিখলেন—
“আমি আসছি। মায়ের জন্য। তোমার জন্য নয়।”
কিন্তু ‘সেন্ড’ করার আগেই থেমে গেলেন।
শেষমেশ শুধু লিখলেন—“ফ্লাইটে উঠছি।”
—
দুবাই পর্যন্ত যাত্রা নিঃশব্দে কেটে গেল। জানালার বাইরে অসীম নীল, আর ভিতরে কেবিনের নরম আলো। প্লেনের খাবারের স্বাদ পেলেন না। বরং চোখে বারবার ভেসে উঠছিল দেরাদুনের পুরনো বাড়ি—বাগানের আমগাছ, ভোরে রেডিওতে ভজন, আর রান্নাঘরে মায়ের কাশির শব্দ।
দুবাই এয়ারপোর্টের ভিড় সবসময়ই এক অদ্ভুত গন্ধে ভরা—আধুনিকতার ধাতব গন্ধের সঙ্গে মিশে থাকে মরুভূমির ধুলো। কানেক্টিং ফ্লাইটে উঠতে গিয়ে তিনি হঠাৎ একটা জোড়া চোখ দেখলেন—কালো, গভীর, যেন অনেক কথা লুকিয়ে রেখেছে। এক ভারতীয় নারী, সালোয়ার কামিজ পরে, তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন।
শৌর্য মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। ভিড়ের মধ্যে চোখ হারিয়ে গেল, কিন্তু মনে অদ্ভুতভাবে থেকে গেল।
—
দিল্লি ফ্লাইটে ওঠার সময় তাঁর বুকের ভেতর একটা চাপা ধকধক শুরু হলো। জানেন না—এটা দীর্ঘ অনুপস্থিতির অপরাধবোধ, নাকি সামনে কী আসছে তার অজানা ভয়।
ফ্লাইটের প্রথম ঘণ্টা পেরোতেই বাইরে অন্ধকার নেমে এলো। নিচে ঝলমলে শহরগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছে, আর তাঁর মনে পড়ছে এক অদ্ভুত সংলাপ—অনন্যা একদিন বলেছিল,
“তুমি যত দূরে যাবে, তত তোমার ফেরা কঠিন হবে।”
তখন তিনি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। আজ মনে হচ্ছে, হয়তো কথাটা সত্যি ছিল।
—
দিল্লি বিমানবন্দরে নামলেন ভোরের আগে। গরম, ধুলো, আর এক ধরনের তীব্র শব্দ—যা মোনাকোতে নেই। লাগেজ হাতে বেরোতেই দেখলেন অনন্যা দাঁড়িয়ে আছে। সাদা কুর্তা, চুল বাঁধা, চোখে সেই একই তীক্ষ্ণতা—যা এগারো বছর আগেও ছিল।
— “তুমি এলেই।”
শৌর্য শুধু মাথা নেড়ে বললেন—
— “মায়ের খবর কী?”
অনন্যা এক মুহূর্ত চুপ করে রইল, তারপর ধীরে বলল—
— “তুমি সময়মতো এসেছ। কিন্তু কতটুকু সময় আছে, সেটা জানি না।”
তারপর গাড়ি চলতে শুরু করল দেরাদুনের পথে। আর শৌর্য বুঝলেন, এই যাত্রা শুধু মায়ের অসুখের জন্য নয়—এটা আসলে অতীতের সঙ্গে এক চূড়ান্ত সাক্ষাৎ।
পর্ব ৪: দেরাদুনের পুরনো বাড়ি
গাড়ি যখন দেরাদুন শহরে ঢুকল, তখন সকালের আলো পাহাড়ের গায়ে গড়িয়ে পড়ছে। বৃষ্টিভেজা পাইন আর স্যালের গন্ধে বাতাস ভারী, আর রাস্তার পাশে ছিটেফোঁটা চায়ের দোকানগুলো থেকে ধোঁয়া উড়ছে।
শৌর্য চুপচাপ বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলেন। এত বছর পর এই শহরে ফেরা যেন এক অদ্ভুত স্বপ্ন—যেখানে রঙ একই, কিন্তু সবকিছুই যেন বদলে গেছে। তাঁর মনে পড়ল স্কুলের দিনগুলো, রিকশায় করে বিকেলের বাজার যাওয়া, আর বর্ষায় রাস্তা ভিজে ওঠার শব্দ।
অনন্যা গাড়ি চালাচ্ছিলেন। তার চোখ সামনে, কিন্তু মুখে এক ধরনের টান টান নীরবতা। শৌর্য কয়েকবার কথা বলতে চাইলেন, কিন্তু থেমে গেলেন। হয়তো তিনি বুঝতে পারছেন—এ যাত্রায় শব্দের চেয়ে নীরবতা বেশি কিছু বলে।
—
পাহাড়ের কোলে দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো রায়চাঁদ বাড়ি ধীরে ধীরে সামনে এল। একতলা, লাল ছাদের নীচে সাদা দেওয়াল, চারপাশে বুনো ফুলে ভরা বাগান। গেটের পাশে মরচে ধরা নামফলক—“রায়চাঁদ ভিলা”—এখনও একই আছে।
গাড়ি থামতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এল এক বৃদ্ধা মহিলা—গৃহপরিচারিকা শ্যামলী। বয়স সত্তরের কাছাকাছি, কিন্তু চোখে চেনা উজ্জ্বলতা। শৌর্যকে দেখে তিনি মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেন, তারপর এগিয়ে এসে হাত ছুঁয়ে প্রণাম করলেন।
— “বাবু… আপনি এসেছেন! মা ভোর থেকে আপনাকে নিয়েই কথা বলছেন।”
—
ঘরের ভিতরে ঢুকতেই নাকে এল সেই চেনা গন্ধ—পুরনো কাঠের, স্যাঁতসেঁতে বইয়ের, আর রান্নাঘরে ফুটতে থাকা চায়ের। লিভিং রুমে সেই পুরনো সোফা, দেয়ালে বাবা-মায়ের বিয়ের সেপিয়া ফ্রেমে বাঁধানো ছবি, আর কোণে ধুলো ধরা হারমোনিয়াম।
মা শোবার ঘরে শুয়ে ছিলেন। তাঁর মুখ শুকিয়ে গেছে, চোখের তলার কালো দাগ গভীর, কিন্তু সেই চোখেই রয়েছে এক অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা। শৌর্য চৌকাঠে দাঁড়িয়ে রইলেন কয়েক সেকেন্ড—যেন এই কয়েক সেকেন্ডে তাঁর ভেতরের সব দেয়াল ধসে পড়ছে।
— “এসেছ?”
মায়ের কণ্ঠ ভাঙা, কিন্তু তাতে কোনো অভিযোগ নেই। শুধু এক ধরনের শান্তি।
— “হ্যাঁ… আমি এসেছি, মা।”
শৌর্য কাছে গিয়ে হাত ধরলেন। তাঁর আঙুলের হাড় যেন কাগজের মতো ভঙ্গুর।
মা হাসলেন।
— “তুমি এখন অনেক বড় মানুষ। কিন্তু জানো, এখানে সবকিছুই আগের মতো আছে। শুধু তুমি ছিলে না।”
—
সেদিন বিকেলটা কেটে গেল কথা বলতে বলতে—বেশিরভাগই নীরবতায়। শৌর্য মাঝে মাঝে জানালার বাইরে তাকাতেন, পাহাড়ের গায়ে মেঘ জমছে। অনন্যা রান্নাঘরে গিয়ে শ্যামলীর সঙ্গে খাবারের ব্যবস্থা করছিলেন।
রাত নামার আগে শৌর্য মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়ালেন। দূরে শহরের আলো ঝিলমিল করছে, কিন্তু এখানে কেবল জোনাকির মৃদু আলো আর দূরের ঝিঁঝিঁর ডাক।
তিনি জানেন, এই শহরে তাঁর ফেরা শুধু একজন অসুস্থ মায়ের কাছে আসা নয়। এটা একটা হিসাব চুকানোর শুরু—যা তিনি এতদিন ফেলে রেখেছিলেন।
পর্ব ৫: পুরনো ঋণ
রাতের দেরাদুনে এক ধরনের অদ্ভুত শান্তি থাকে—যেন পাহাড় আর আকাশের মাঝে এক গোপন চুক্তি হয়েছে, বাইরের দুনিয়ার সব শব্দ এখানে ঢুকবে না। কিন্তু সেই রাতে, রায়চাঁদ ভিলার ভেতরে শৌর্যের মাথায় যেন অনেকগুলো অদৃশ্য শব্দ গুঞ্জন করছিল—অতীতের কথা, পুরনো মুখ, অসমাপ্ত আলাপ।
বারান্দায় বসে তিনি দেখছিলেন, অনন্যা উঠোনে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। তার কণ্ঠ নিচু, কিন্তু ভেতরে এক ধরনের তাড়াহুড়ো আছে। শৌর্যের মনে পড়ল, একসময় সে খুব জোরে হাসত, রেগে গেলে কথার গতি দ্বিগুণ হয়ে যেত, আর বৃষ্টিতে ভিজে গেলে চুলের গন্ধে মিশে থাকত লেমন শ্যাম্পুর সুবাস।
তিনি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন—
— “কার সঙ্গে কথা বলছ?”
অনন্যা তাকাল না, শুধু বলল—
— “কাজের ব্যাপার।”
শৌর্য ঠান্ডা স্বরে বললেন—
— “তুমি কি এখনও কাজের আড়ালে অনেক কিছু লুকিয়ে রাখো?”
অনন্যা এবার ঘুরে তাকাল। চোখে একটুও ভয় নেই।
— “সবাই রাখে, শৌর্য। তুমি-ও রেখেছিলে। আর তোমার লুকোনো জিনিসের দাম আমি অনেক আগেই দিয়ে দিয়েছি।”
—
এই কথাগুলো শৌর্যের মাথায় হাতুড়ির মতো আঘাত করল। এগারো বছর আগে, যখন তিনি বার্লিনে পাড়ি দিলেন, তখন শুধু ব্যবসায়িক ব্যর্থতা নয়—অন্য এক ব্যর্থতার দায়ও রেখে গিয়েছিলেন অনন্যার কাঁধে।
মায়ের অসুস্থতার সময়ও সেই ব্যর্থতা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল।
তিনি মায়ের ঘরে ঢুকলেন। মা অর্ধেক ঘুমিয়ে, অর্ধেক জেগে শুয়ে ছিলেন। বিছানার পাশে টেবিলে পুরনো এক চিঠি পড়ে আছে—হলদে হয়ে যাওয়া খাম, যার ওপর অনন্যার হাতের লেখা।
— “এটা এখানে কেন?” শৌর্য জিজ্ঞেস করলেন।
মা চোখ খুলে তাকালেন।
— “কারণ ঋণ শোধ না হলে, চিঠি ফেরত আসে না।”
—
চিঠিটা খুলে শৌর্য পড়তে শুরু করলেন। তারিখ—২০১৪ সালের জুন।
> “শৌর্য,
তুমি চলে যাওয়ার পর প্রথম কয়েক মাস আমি অপেক্ষা করেছি—মেসেজ, ফোন, ইমেল… কিছুই আসেনি। তারপর বুঝলাম, তুমি শুধু দেশ ছাড়োনি, আমাকেও ছেড়ে দিয়েছ।
তুমি বলেছিলে, একদিন সমুদ্র কিনে শান্তি পাবে। হয়তো পেয়ে গেছ। কিন্তু আমি চাইনি তোমার সমুদ্রের তলায় আমার গল্প চাপা পড়ে থাকুক।”
পড়তে পড়তে শৌর্যের বুকের ভেতর একটা শূন্যতা জমে উঠছিল। তিনি জানতেন না, মা এত বছর ধরে এই চিঠি রেখেছেন—হয়তো তাঁকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যে কিছু ঋণ শুধু টাকায় শোধ হয় না।
—
বাইরে হালকা হাওয়া উঠেছে। পাইনগাছের ফাঁকে চাঁদের আলো ভেসে আসছে। অনন্যা উঠোনে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। শৌর্য চিঠিটা হাতে নিয়ে বারান্দায় এলেন।
— “তুমি এই চিঠি লিখেছিলে, কিন্তু পাঠাওনি কেন?”
অনন্যা ধীরে বলল—
— “কারণ আমি জানতাম, একদিন তুমি ফিরবে। আর আমি চাইছিলাম, চিঠিটা তোমার হাতে দেওয়ার মুহূর্ত যেন বাস্তব হয়।”
শৌর্যের চোখে প্রথমবারের মতো সেই নীরব স্বীকারোক্তি ফুটে উঠল—যে তিনি শুধু অনন্যার কাছে নয়, নিজের কাছেও ঋণী।
পর্ব ৬: পাহাড়ের গোপন কথা
সকালের দেরাদুনে আকাশ ছিল কুয়াশায় মোড়া। দূরের পাহাড়গুলো যেন হঠাৎ করে কাছাকাছি চলে এসেছে, আবার মুহূর্তেই আড়াল হয়ে যাচ্ছে ধূসর পর্দার আড়ালে। শৌর্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলেন, হাতে সেই পুরনো ডায়েরি—যেটা এখন আর শুধু অতীতের নিদর্শন নয়, বরং এক ধরনের প্রশ্নপত্র হয়ে উঠেছে।
অনন্যা এসে বলল—
— “চলো, তোমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব।”
শৌর্য ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।
— “কোথায়?”
— “পাহাড়ের ওপারে। যেখানে তোমার বাবা একসময় প্রায়ই যেতেন।”
বাবার কথা উঠলেই শৌর্যের মনে একটা অদ্ভুত গাঢ়তা নেমে আসে। ব্যবসা ধ্বংস হওয়ার পর বাবা যেন নীরবে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন—শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও। শৌর্য তেমন কোনো উত্তর দিলেন না, শুধু মাথা নেড়ে প্রস্তুত হয়ে নিলেন।
—
পাহাড়ি রাস্তা ধরে জিপে করে তারা চলতে লাগল। বাঁক ঘুরলেই নিচে গাঢ় সবুজ উপত্যকা, কোথাও দূরে ছোট্ট গ্রাম, ধোঁয়া উড়ছে রান্নাঘরের চিমনি থেকে। অনন্যা গাড়ি চালাচ্ছিলেন দক্ষ হাতে, মাঝে মাঝে জানালা নামিয়ে ঠান্ডা হাওয়া টেনে নিচ্ছিলেন গভীর শ্বাসে।
— “তুমি জানো, শৌর্য, তোমার বাবা এখানে অনেকের কাছে ঋণী ছিলেন।”
শৌর্য তাকালেন।
— “ঋণ? কার?”
— “শুধু টাকা নয়… প্রতিশ্রুতিরও। কিছু মানুষ ছিলেন যাদের জন্য উনি নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছিলেন। আর সেই গল্পগুলো তোমাকে কেউ বলেনি।”
শৌর্য কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু অনন্যার কণ্ঠে এক ধরনের দৃঢ়তা ছিল—যেন এই ভ্রমণ শুধু ঘুরতে যাওয়া নয়, বরং একটি দরজা খোলার প্রক্রিয়া।
—
গাড়ি থামল এক নির্জন জায়গায়। সামনে পাথরের সিঁড়ি, যা উঠে গেছে এক প্রাচীন মন্দিরের দিকে। চারপাশে শুধু পাইনগাছের ফিসফিসানি। মন্দিরের গায়ে শ্যাওলা জমে গেছে, আর ঘণ্টাগুলো বাতাসে ধীরে ধীরে দুলছে।
অনন্যা বলল—
— “এখানে তোমার বাবা প্রায়ই আসতেন। কিন্তু আসল কারণ কেউ জানত না।”
তারা মন্দিরের আঙিনায় ঢুকতেই, এক বৃদ্ধ পুরোহিত এগিয়ে এলেন। চোখে বয়সের ধূসরতা, কিন্তু দৃষ্টিতে অদ্ভুত স্বচ্ছতা।
— “আপনি… রায়চাঁদের ছেলে?”
শৌর্য মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন।
— “আপনার বাবা আমাকে একবার বলেছিলেন, যদি তাঁর ছেলে ফিরে আসে, তাহলে যেন আমি এই জিনিসটা দিই।”
তিনি পকেট থেকে বের করলেন এক ছোট্ট লকেট। রূপার, কিন্তু অনেক পুরনো। ভিতরে ভাঁজ করা এক টুকরো কাগজ। শৌর্য কাগজটা খুলে দেখলেন—তার মধ্যে লেখা আছে কয়েকটা শব্দ, ইংরেজি ও হিন্দির মিশ্রণে—
“The debt is not in gold, but in silence. When the sea calls, remember the hills.”
—
শৌর্যের বুকের ভেতর ধকধক শুরু হলো। এই কথার মানে কী? আর “the sea calls”—এটা কি তাঁর পুরনো স্বপ্নের সঙ্গে যুক্ত? নাকি বাবা কোনো রহস্য রেখে গেছেন, যা এখন তাঁর জীবনকে টেনে নিয়ে যাবে অন্য পথে?
অনন্যা ধীরে বলল—
— “এটা শুধু তোমার বাবার নয়, তোমারও গল্প, শৌর্য। আর আমি ভয় পাচ্ছি… এই গল্পের শেষ হয়তো মোনাকোতে নয়।”
শৌর্য লকেটটা শক্ত করে চেপে ধরলেন। মনে হলো, পাহাড়ের নীরবতা যেন ভেতরে ভেতরে তাঁকে কিছু বলতে চাইছে—যা এখনো পুরোপুরি শোনা হয়নি।
পর্ব ৭: সমুদ্রের ডাক
পাহাড়ি মন্দির থেকে ফেরার সময় দেরাদুনের আকাশে বিকেলের সোনালি আলো মেখে ছিল। জিপের জানালা দিয়ে হাওয়া কানে বাজছিল, কিন্তু শৌর্যের মন যেন আর এখানে নেই—লকেটটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরে তিনি ভাবছিলেন সেই অদ্ভুত বাক্যগুলো নিয়ে।
“The debt is not in gold, but in silence. When the sea calls, remember the hills.”
— ঋণ সোনা দিয়ে শোধ হয় না, হয় নীরবতায়। আর সমুদ্র যখন ডাকবে, পাহাড়কে মনে রেখো।
এই কথার ভেতরে যেন একাধিক তালা, আর প্রতিটি তালা খোলার জন্য দরকার এমন চাবি যা তাঁর কাছে নেই—বা হয়তো আছে, কিন্তু তিনি বুঝতে পারছেন না।
—
রাত নামতেই তিনি মায়ের ঘরে গেলেন। মা তখন ওষুধ খেয়ে আধো ঘুমে। বিছানার পাশে বসে শৌর্য ধীরে ধীরে বললেন—
— “বাবা মন্দিরে যেতেন, আমি জানতাম না।”
মা চোখ খুলে তাকালেন, যেন তাঁর ভেতরের চিন্তাগুলো পড়ছেন।
— “তোমার বাবা সবকিছু বলতেন না, শৌর্য। কিছু কথা পাহাড়ের মতো—ওগুলো দাঁড়িয়ে থাকে, শুধু সঠিক সময়ে দেখা দেয়।”
— “এই লকেটটা…?”
মা চোখ ফিরিয়ে জানালার বাইরে তাকালেন।
— “এটার কথা আমাকে জিজ্ঞেস করো না। কিছু উত্তর খুঁজে পেতে হলে তোমাকে মোনাকো ফেরত যেতে হবে।”
—
পরের দিন ভোরে শৌর্য একাই বেরিয়ে গেলেন রাজপুর রোডের দিকে। পাহাড়ের চূড়া থেকে দেখা শহর তখনো কুয়াশায় ঢাকা। মনে হচ্ছিল, এই শহরটা যেন তাঁকে কিছু ফিসফিস করে বলছে—কিন্তু ভাষাটা তিনি চিনতে পারছেন না।
একটা পুরনো চায়ের দোকানে বসে, গরম চা হাতে, তিনি ফোনে মোনাকোর আবহাওয়ার খবর দেখলেন। সমুদ্রের ওপর ঝড়ের সতর্কতা জারি হয়েছে। খবরের সঙ্গে এক পরিচিত ছবি—মন্টে কার্লোর মেরিনা, আর সেখানে বাঁধা তাঁর নিজের ইয়ট Elysium।
হঠাৎ যেন মেরুদণ্ড বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। “When the sea calls”—এ কি সেই ডাক? নাকি কেবল কাকতালীয়?
—
অনন্যা তাঁর বিপরীতে এসে বসল।
— “তুমি মোনাকো ফিরবে?”
— “হয়তো। বাবার ঋণ শোধ করতে হলে… হয়তো সমুদ্রের কাছে যেতে হবে।”
অনন্যা চোখ সরু করল।
— “সাবধান থেকো, শৌর্য। সমুদ্র শুধু ডাক দেয় না—কখনো কখনো গিলে ফেলে।”
—
সন্ধ্যার মধ্যেই শৌর্য এমিরেটসের টিকিট বুক করলেন—দিল্লি থেকে দুবাই, দুবাই থেকে নিস। ফেরার পথে মনে হচ্ছিল, তিনি যেন আর সেই মানুষ নন যে কয়েকদিন আগে মোনাকো ছেড়েছিলেন।
প্লেনে বসে, জানালার বাইরে অন্ধকার মেঘের স্তূপের দিকে তাকিয়ে, তিনি লকেটটা খুলে আবার পড়লেন ভেতরের শব্দগুলো। এবার সেগুলো যেন আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট লাগছিল। হয়তো কারণ এখন সমুদ্র সত্যিই তাঁকে ডাকছে।
আর শৌর্য জানেন—এই ডাক এড়িয়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে আর সম্ভব নয়।
পর্ব ৮: মোনাকোতে ফিরে
নিস বিমানবন্দরে নামতেই শৌর্যের বুকের ভেতর অদ্ভুত এক চাপা টান অনুভূত হলো। মোনাকোর গাঢ় নীল আকাশ, সাগরের নোনা গন্ধ—সবই যেন তার চেনা, অথচ এইবার ফিরে আসার মধ্যে ছিল ভিন্ন ধরনের ভার।
ড্রাইভার এয়ারপোর্ট গেটে অপেক্ষা করছিল। বেন্টলি কনটিনেন্টালে বসতেই শৌর্য দেখতে পেলেন রাস্তার ধারে পর্যটকের ভিড়—ক্যাসিনো স্কয়ারের ঝলমলে আলো, সোনালি সন্ধ্যার সঙ্গে মিশে থাকা গাড়ির চকচকে বডি, আর নৌবন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা ইয়টের সারি। তার চোখ একেবারে গিয়ে থামল নিজের ইয়ট Elysium-এর দিকে—সাদা গায়ের ওপর কালো লাইন, যেন নিখুঁত ভাস্কর্য।
কিন্তু কিছু যেন ঠিক নেই। দূর থেকে দেখতে পেলেন, ইয়টের ডেকে একজন অপরিচিত মানুষ দাঁড়িয়ে। মুখে সানগ্লাস, হাতে ফোন, কিন্তু ভঙ্গিতে এক ধরনের অস্বাভাবিক স্থিরতা।
—
ভিলায় পৌঁছেই শৌর্য স্টাফদের জিজ্ঞেস করলেন—
— “ইয়টে ওই মানুষটা কে?”
একজন নাবিক হালকা কণ্ঠে বলল—
— “স্যার, তিন দিন আগে থেকে ইয়টে কেউ ঘোরাফেরা করছে। নিজেকে বলছে maintenance crew, কিন্তু আইডি দেখাতে চায়নি।”
শৌর্যের ভেতর শিরশিরে সন্দেহ জন্ম নিল। তিনি জানতেন, মোনাকোতে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কম নয়। আর বাবার লকেটের ইঙ্গিত এখন যেন আরও ভারি হয়ে উঠছে—“When the sea calls…”—হয়তো সমুদ্র ডাকছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বিপদও আনছে।
—
সন্ধ্যা নামতেই তিনি নিজে গিয়ে উঠলেন Elysium-এ। ইয়টের ভেতরে সব স্বাভাবিক দেখালেও বাতাসে ছিল এক ধরনের চাপা গন্ধ—পুরনো লোহার মতো, যেন লুকিয়ে রাখা কোনো বস্তু ধীরে ধীরে মরচে ধরছে।
ক্যাপ্টেনের কেবিনে গিয়ে তিনি ডেস্কের ড্রয়ার খুললেন। ভেতরে রাখা ছিল একটি খাম—সাদা, কোনো নাম নেই। ভেতরে একটুকরো কাগজে লেখা—
“The silence you bought will end soon.”
(“যে নীরবতা তুমি কিনেছিলে, তা শিগগিরই শেষ হবে।”)
—
শৌর্যের কপাল শক্ত হয়ে গেল। কে এটা রেখে গেল? আর ‘silence’ বলতে কী বোঝাচ্ছে? তার ব্যবসা? তার অতীত? নাকি বাবা রেখে যাওয়া কোনো রহস্য?
ইয়ট থেকে নামতে নামতে তিনি খেয়াল করলেন, দূরে বন্দরপাড়ে সেই অচেনা মানুষটি আবার দাঁড়িয়ে আছে—এইবার সিগার টানছে, কিন্তু তার চোখ শৌর্যের ওপর নিবদ্ধ।
—
রাতের মোনাকো আবারও চকমকে হয়ে উঠল—ক্যাসিনোর আলো, বারান্দায় বসে থাকা ধনী পর্যটক, ব্যয়বহুল রেস্টুরেন্টের কোলাহল। কিন্তু শৌর্যের কাছে সবকিছুই যেন এক অস্থির ছায়ার মতো লাগছিল।
ভিলায় ফেরার পর তিনি লকেটটা টেবিলে রেখে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। মনে হলো, সমুদ্র শুধু ডাক দিচ্ছে না—এবার যেন দাবিও জানাচ্ছে।
আর এই দাবির হিসাব মেটাতে গেলে হয়তো তাঁকে এমন পথে হাঁটতে হবে, যেখান থেকে ফেরার পথ আর থাকবে না।
পর্ব ৯: ছায়ার মুখোমুখি
পরদিন ভোরে মোনাকো বন্দরের ওপর ধোঁয়াটে কুয়াশা নেমেছিল। সাগরের ঢেউগুলো ধীরে ধীরে উঠে এসে ইয়টের গায়ে আছড়ে পড়ছিল, যেন সমুদ্রও কোনো খবর দিতে চাইছে। শৌর্য জানতেন—এভাবে বসে থাকলে উত্তর আসবে না। তাকে খুঁজে বের করতে হবে সেই অচেনা মানুষটিকে।
একটা কালো হুডি পরে তিনি নেমে গেলেন বন্দরপথে। সকালের পর্যটক ভিড় তখনও জমেনি। শুধু কিছু স্থানীয় জেলে আর ইয়ট সার্ভিস ক্রু ঘুরে বেড়াচ্ছে। দূর থেকে তিনি দেখলেন—গাঢ় নীল জ্যাকেট পরা সেই লোকটা পিয়ারের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে, হাতে সিগারেট, আর চোখ সমুদ্রের দিকে।
শৌর্য ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন। কাছে যেতেই লোকটা মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। চোখে ছিল এক অদ্ভুত হাসি—না পুরো বন্ধুত্বপূর্ণ, না পুরো শত্রুভাবাপন্ন।
— “তুমি আমার ইয়টে কেন ছিলে?” শৌর্যের কণ্ঠ ঠান্ডা।
লোকটা ধীরে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ল।
— “তোমার ইয়ট? নাকি তোমার বাবার?”
—
শব্দগুলো শৌর্যের ভেতর ছুরির মতো ঢুকে গেল।
— “তুমি আমার বাবাকে চিনতে?”
— “চিনতাম? বরং বলা ভালো, তোমার বাবা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ঋণী ছিলেন।”
শৌর্যের কপাল ভাঁজ পড়ল।
— “কিসের ঋণ?”
লোকটা পকেট থেকে একটা ছোট্ট ইউএসবি বের করে শৌর্যের হাতে দিল।
— “উত্তর এর ভেতরে আছে। কিন্তু সাবধান—তুমি যে নীরবতার দাম দিয়ে বেঁচেছ, সেটাই তোমাকে গিলে খেতে পারে।”
কথা শেষ করেই লোকটা ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল। শৌর্য পেছন পেছন গেলেন, কিন্তু মিনিটের মধ্যেই তাকে আর দেখা গেল না—যেন সে কখনো ছিলই না।
—
ভিলায় ফিরে শৌর্য ইউএসবি ল্যাপটপে লাগালেন। ভেতরে মাত্র একটি ভিডিও ফাইল। প্লে হতেই পর্দায় ভেসে উঠল পুরনো ফুটেজ—মোনাকোর সমুদ্রতীরে এক রাতের দৃশ্য। ক্যামেরা কাঁপছে, কিন্তু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে—তাঁর বাবা এবং আরও তিনজন মানুষ ইয়টের ডেকে দাঁড়িয়ে তর্ক করছে। কণ্ঠস্বর চাপা, কিন্তু কয়েকটা শব্দ স্পষ্ট ধরা পড়ল—
“Shipment… no police… gold stays… silence.”
তারপর হঠাৎ একটা ঝাঁপসা নড়াচড়া, চিৎকার, আর সমুদ্রে পড়ার শব্দ।
—
শৌর্যের নিঃশ্বাস আটকে গেল। তিনি বুঝলেন, এই ঘটনা শুধু ব্যবসায়িক কোনো লেনদেন নয়—এটা হয়তো এক অপরাধ, যা তাঁর বাবা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত গোপন রেখেছিলেন। আর সেই নীরবতার ভার এখন তাঁর কাঁধে এসে পড়েছে।
ফাইলের শেষে একটা বার্তা—
“When the sea calls, it wants the truth.”
—
রাত গভীর হলো, কিন্তু শৌর্য ঘুমোতে পারলেন না। লকেটটা হাতে নিয়ে জানালার বাইরে সমুদ্রের দিকে তাকালেন। ঢেউগুলো যেন ফিসফিস করে কিছু বলছে—কিন্তু ভাষাটা এখনও অস্পষ্ট।
তিনি জানতেন, এই ধাঁধার শেষ অংশটা হয়তো সমুদ্রের বুকেই লুকিয়ে আছে। আর সেটাই খুঁজে বের করার জন্য তাঁকে প্রস্তুত হতে হবে—যেভাবেই হোক।
পর্ব ১০: শেষ যাত্রা
মোনাকোর ভোরে সাগরের জল ছিল অস্বাভাবিকভাবে শান্ত। বন্দরের বাতাসে লবণের গন্ধ, আর দূরে পাহাড়ের গায়ে প্রথম সূর্যের আলো। কিন্তু শৌর্য জানতেন—আজকের দিন শান্তির নয়, বরং মুখোমুখি হওয়ার।
Elysium প্রস্তুত। ক্রুদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে—কোনো যাত্রী নয়, কোনো অতিরিক্ত কার্গো নয়। কেবল তিনি একা সমুদ্রের দিকে যাবেন। অনন্যা ভিলার গেটে দাঁড়িয়ে দেখছিল।
— “তুমি নিশ্চিত?”
— “সমুদ্র ডাকছে, অনন্যা। আর আমি এই ডাক এড়িয়ে যেতে পারি না।”
তার চোখে এক মুহূর্তের জন্য উদ্বেগ দেখা গেল, কিন্তু কিছু বলল না। শুধু মাথা নেড়ে বিদায় জানাল।
—
ইয়ট সমুদ্রের গভীরে ঢুকে পড়ল। উপকূলের রঙ ফিকে হতে হতে হারিয়ে গেল। চারপাশে শুধু নীল, আর নীরবতা—যেটা এখন আর শান্ত লাগছে না, বরং চাপা উত্তেজনায় কাঁপছে।
শৌর্য ককপিটে বসে লকেটটা খুলে দেখছিলেন। সেই একই কাগজ—
“The debt is not in gold, but in silence. When the sea calls, remember the hills.”
হঠাৎ তিনি বুঝলেন—‘hills’ বলতে দেরাদুনের পাহাড় নয়, বরং তাঁর বাবার অতীতের এক গোপন স্থান—মোনাকোর বাইরে এক ছোট্ট দ্বীপ, যেটাকে স্থানীয়রা Les Collines বলে।
ইয়টের রুট পাল্টে দিলেন। সেদিকে এগোতে থাকলেন।
—
দ্বীপের কাছে পৌঁছাতেই আবহাওয়া বদলে গেল। কালো মেঘ জমে উঠল, বাতাস ভারী, ঢেউ উঁচু। তবু তিনি থামলেন না। দ্বীপের কাছাকাছি এক ফাঁকা উপসাগরে ইয়ট থামালেন। জলের রঙ এখানে গভীর সবুজ, আর নিচে অন্ধকারের ঘূর্ণি।
ডাইভিং স্যুট পরে পানিতে নামলেন। ঠান্ডা জল শরীরে আঘাত করছিল, কিন্তু তিনি এগোতে থাকলেন। কিছু দূরে দেখতে পেলেন—সমুদ্রতলের এক ধাতব বাক্স, অর্ধেক বালির নিচে ঢাকা।
বাক্স খুলতেই বেরিয়ে এল সোনার বার, পুরনো নথি, আর একটি সিল করা খাম। খামের ভেতরে চিঠি—তাঁর বাবার হাতের লেখা।
—
> “শৌর্য,
যদি তুমি এই চিঠি পড়ছ, তবে জানো—আমার নীরবতার মূল্য সোনা ছিল না, ছিল জীবন। সেই রাতে ইয়টে আমি একটি অপরাধের সাক্ষী হয়েছিলাম। আমি কথা বলিনি, কারণ তোমার নিরাপত্তা চাইতাম। কিন্তু এই নীরবতা আমাদের রক্তের ওপর ঋণ হয়ে রইল।
যদি তুমি এই বাক্স খুঁজে পাও, তাহলে সিদ্ধান্ত তোমার—সত্য প্রকাশ করবে, নাকি সমুদ্রের সঙ্গে সমাধি দেবে।”
—
শৌর্যের বুকের ভেতর তীব্র দ্বন্দ্ব। সত্য প্রকাশ মানে তাঁর পরিবারের নাম ধ্বংস, হয়তো তাঁর সাম্রাজ্যের পতন। আর চুপ থাকা মানে বাবার অপরাধকে চিরদিনের জন্য ঢেকে রাখা।
তিনি সোনার বারগুলিকে সমুদ্রতলে রেখে দিলেন, শুধু নথি আর চিঠি নিয়ে ওপরে উঠলেন। Elysium ফিরতে লাগল, কিন্তু তাঁর মনে হচ্ছিল—আজ তিনি আর সেই শৌর্য রায়চাঁদ নন, যিনি নীরবতা কিনে বাঁচতেন।
—
মোনাকোর বন্দরে পৌঁছালে অনন্যা অপেক্ষা করছিল। তাঁর হাতে চিঠি দিয়ে শৌর্য বললেন—
— “এটা তোমার কাছেই থাকবে। হয়তো একদিন, সঠিক সময়ে, তুমি জানাবে সবার কাছে।”
অনন্যা ধীরে মাথা নেড়ে বলল—
— “তুমি পাহাড় আর সমুদ্র—দুটোকেই মনে রেখেছ।”
শৌর্য সাগরের দিকে তাকালেন। ঢেউ ভাঙছে, কিন্তু এবার সেই শব্দে আর শুধু ডাক নেই—আছে এক ধরনের মুক্তি।
শেষ




