সায়ন বসু
১
কলকাতার সন্ধ্যাবেলায় যখন শহর ধীরে ধীরে তার কাজের ক্লান্তি গায়ে মেখে জ্বরে ওঠা বাতাসে জেগে ওঠে, তখন সল্টলেকের এক পুরনো সার্ভার ফার্মে বসে ঋত্বিক দত্ত তার মনিটরের সামনে ঠায় বসে থাকে—চোখ দুটি আটকে রয়েছে এক ঘনকালো এনক্রিপটেড প্যাটার্নের গহ্বরে। পনেরো বছর ধরে সে কোড বিশ্লেষণ করে আসছে, হাজার হাজার সাইবার অ্যাটাক ডিক্রিপ্ট করেছে, কিন্তু এমন কিছুর মুখোমুখি সে আগে কখনও হয়নি। সার্ভারের লগফাইলে একটি ফ্রিকোয়েন্সি ধরা পড়েছে, যার সংকেত অস্পষ্ট, বারবার পরিবর্তিত হচ্ছে, যেন কেউ বা কিছু বাইরে থেকে সেটিকে চালনা করছে। সিগন্যালের উৎস লোকাল নয়, কিন্তু কলকাতার মধ্যেই কোনও এক ছায়াঘন এলাকাকে নির্দেশ করে। তার ভেতরে থাকা সিগন্যালগুলো যেন বাস্তব কোনও তথ্য নয়, বরং একধরনের ভয়াবহ ইচ্ছাশক্তির মতো কিছু, যা নিজেই নিজের পরিচয় লুকিয়ে রাখার জন্য তৈরি হয়েছে। সবকিছুর মাঝে একটি ফাইল বারবার দেখা যাচ্ছে, নাম—Apsara.exe। প্রথমে সেটিকে নিছক এক গ্লিচ ধরে সে গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু ফাইলটির মেটাডেটা খুঁটিয়ে দেখে সে থমকে যায়—এই একই ফাইল সে এক বছর আগে দেখেছিল, ঠিক যেদিন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু দীপ্তজ্যোতির মৃত্যু হয়েছিল। এক কনফারেন্সে যাওয়ার পথে দীপ্তজ্যোতি আচমকা গাড়ি থেকে ঝাঁপ দিয়েছিল, এবং তার ল্যাপটপে তখন এই Apsara.exe ফাইলটির রিফারেন্স পাওয়া গিয়েছিল, যদিও তদন্তে তা “ত্রুটি” বলে ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল।
ঋত্বিকের বুকের মধ্যে এক অদ্ভুত চাপা গুমোট অনুভব হতে থাকে, যেন অতীত তার কাঁধে ভর দিয়ে আবার উঠে এসেছে। দীপ্তজ্যোতির সেই শেষ কথাগুলো স্মৃতির গহ্বরে বাজতে থাকে—”এই জিনিসটা মজা নয় ঋ, এটা খেলছে আমাদের মস্তিষ্কের সঙ্গে…”। তখন ঋত্বিক হাসছিল, ভেবেছিল দীপ্ত মানসিক চাপ নিতে পারছিল না, কিন্তু আজ সে হাসতে পারছে না। সে ফাইলটি আলাদা করে নেয়, একটি এনক্রিপটেড স্যandbox-এ চালায়, কিন্তু কিছুই খুলে না—শুধু একটি স্ট্যাটিক ছবি দেখা যায়, যেখানে কেবল লেখা, “The game is already in play.” মনিটরের স্ক্রিনে ধীরে ধীরে লাল রঙের একটি রিং চক্কর দিতে থাকে, যেন কোনও অদৃশ্য চোখ তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। হঠাৎ করে একটি পুরনো সার্ভার এক্সেসের সময় স্ক্রিন ঝিমিয়ে ওঠে, আরেকটি পিং আসে সিগন্যাল লগে, ঠিক তখনি মনিটরের ডান পাশে একটি নোটিফিকেশন—”Apsara acknowledges your curiosity.” এধরনের মেসেজ সাধারণত হয় না, কোনও লোকাল প্রোগ্রাম থেকেই এমন ইন্টার্যাকশন সম্ভব নয় যদি না তা ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে উদ্দেশ্য করে তৈরি করা হয়। এখন আর এটা নিছক কোড নয়, ঋত্বিক জানে কিছু তার দিকে তাকিয়ে আছে—তার মন, স্মৃতি, অপরাধবোধের দিকে।
সে রাতেই ঋত্বিক তার অফিসে বসে আরও কিছু সার্ভার খোঁজ শুরু করে, কিন্তু বুঝতে পারে সে একাই এর পেছনে যেতে পারবে না। সে বেরোয় শহরের এক কোণায় অবস্থিত পুরনো এক ক্যাফের দিকে, যেখানে একসময় দীপ্তজ্যোতির সঙ্গে বহুবার আড্ডা দিত। সেখান থেকে সে পৌঁছে যায় এক সাবেক ইথিক্যাল হ্যাকার বন্ধুর বাড়িতে, কিন্তু বন্ধুরা কেউ আর এ বিষয়ে মাথা ঘামাতে চায় না—সবাই দীপ্তর মৃত্যুকে ‘সাইকোলজিকাল মেল্টডাউন’ বলেই মেনে নিয়েছে। নিঃসঙ্গ ঋত্বিক সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে পুলিশে যেতে হবে। পরদিন সে দেখা করে ইন্সপেক্টর অরিত্র বসুর সঙ্গে, যিনি সাইবার ক্রাইম বিভাগে কাজ করেন। প্রথমদিকে অরিত্র বিষয়টিকে পাত্তা না দিলেও, Apsara.exe নামটি শুনে তার চোখ স্থির হয়ে আসে। কারণ মাত্র কয়েকদিন আগেই কলকাতার এক সাব-ইন্সপেক্টর আত্মহত্যা করেন, এবং তার মোবাইল লগে ওই একই নামের ট্রেস পাওয়া গিয়েছিল। ঘটনাটি ধামাচাপা পড়েছিল বলে বাইরে কিছু জানাজানি হয়নি। অরিত্র ঋত্বিককে জানায় যে ওই গেমটি আসলে একটি ‘psychological loop’ তৈরির মতো কাজ করে—যারা প্রবেশ করে, তারা ক্রমে তাদের নিজেরই ভয়, দুঃখ আর অপরাধবোধের মধ্যে আটকে যায়, বাস্তব ও কল্পনার সীমারেখা মুছে যায়, এবং একসময় তারা বিশ্বাস করতে থাকে যে “মৃত্যু”-ই তাদের মুক্তি। ঋত্বিকের মনে পড়ে দীপ্তজ্যোতির সেই উন্মত্ত চোখের চাহনি, শেষ ফোন কলের অসংলগ্ন কথা। এখন এই সবকিছুর ভেতর দিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি অদৃশ্য দানব, যার নাম—অপ্সরা। Apsara আর কেবল একটি ফাইল নয়, এটি এক বিকৃত গেম, এক নিষ্ঠুর আয়না যা ব্যবহারকারীদের নিজস্ব আত্মার অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয়। ঋত্বিক সিদ্ধান্ত নেয়—সে থামবে না, সে বের করবে এই ফাইলের উৎস কোথায়, কারা এটি চালায়, এবং দীপ্তর মৃত্যু আসলে কিসের অংশ ছিল। এই অনুসন্ধানের পথ যে কতটা অন্ধকার, তার আন্দাজ তখনও সে করতে পারেনি।
২
ঋত্বিক সারারাত ঘুমোতে পারেনি। Apsara.exe ফাইলটি যেন মস্তিষ্কের কোষে ঢুকে পড়েছে, বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে—“The game is already in play.” পরদিন সকালে সে আবারও ল্যাব কম্পিউটারে ফিরে যায়। এইবার তার লক্ষ্য একটাই—ফাইলটি ডিক্রিপ্ট করে দেখতে হবে ভিতরে কী আছে। সে একটি ভার্চুয়াল এনভায়রনমেন্ট তৈরি করে, যেখানে স্যান্ডবক্স মডেলে ফাইলটি চালায়। প্রথমে কিছুই হয় না, শুধু একটা স্থির স্ক্রিন, তারপর হঠাৎ করেই চারপাশের বাতি এক মুহূর্তের জন্য নিভে আসে—এমন এক ঘোর লাগা মুহূর্ত, যেখানে মনে হয় যেন কম্পিউটার নিজেই বুঝতে পারছে তাকে কে পর্যবেক্ষণ করছে। স্ক্রিনে আচমকা উঠে আসে একটি ঘোলা ইন্টারফেস, চোখের মতো দুটি সার্কুলার ফর্ম, মাঝখানে লেখা—“PLAY?”। কোন বাটন নেই, শুধু কার্সর মুভ করলেই স্ক্রিন এক অদ্ভুত শব্দে কম্পন করে ওঠে, আর তাতে আবার দেখা যায় এক লাইন কোড—if you click, the self becomes the player. এই কথাগুলোর অর্থ ধীরে ধীরে খোলসা হতে থাকে। এটি কোনও সাধারণ গেম নয়, এটি তার নিজের মনকে লক্ষ্য করছে, প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করছে। Apsara-র ইন্টারফেস যেন সোজা মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের সঙ্গে সংযোগ করতে চায়। ফাইল ভাঙতে গিয়ে সে দেখে, ভিতরে একটি “Live Stream Module” আছে, যা সম্ভবত রিয়েল-টাইমে ইউজারের ফেসিয়াল রিঅ্যাকশন এনালাইস করে। এবং সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার—সেই লাইভ ফিডের মধ্যে তার নিজের ছবি নেই, বরং কোনও অচেনা নারীমূর্তি ক্যামেরার সামনে বসে, তাকিয়ে আছে সরাসরি তার দিকে। অবাস্তব, কিন্তু সফটওয়্যারের ভিতরে কোনওভাবেই এই চিত্র থাকতেই পারে না, যদি না কেউ আগে থেকেই এই entire setup সাজিয়ে রেখেছে।
অস্বস্তি ঘনিয়ে এলে ঋত্বিক সিদ্ধান্ত নেয়, এ বিষয়ে সে একা এগোতে পারবে না। সে এক কাপ কড়া কফি খেয়ে, ল্যাপটপে সমস্ত তথ্য ব্যাকআপ করে রওনা দেয় কলকাতা পুলিশের সাইবার সেল অফিসে। ভবনটি পুরনো, কিন্তু ভিতরে প্রযুক্তির ঝলক স্পষ্ট। রিসেপশনে তার সঙ্গে প্রথমে কেউ কথা বলতে চায় না, যতক্ষণ না সে “Apsara.exe” নামটি বলে। এই নাম উচ্চারণ হতেই এক অফিসার দ্রুত তাকে ভিতরে নিয়ে যায়। সেখানে অপেক্ষা করছিলেন ইন্সপেক্টর অরিত্র বসু—মধ্যচল্লিশের একজন দৃঢ়চেতা অফিসার, চোখে ক্লান্তি ও সন্দেহের ছায়া। অরিত্র প্রথমে ঋত্বিকের কথা খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না, কিন্তু ঋত্বিক যখন তার ডেটা, স্ক্রিনশট ও কোডের এনালাইসিস দেখায়, তখন তাঁর মুখের অভিব্যক্তি বদলে যায়। তিনি ধীরে ধীরে একটি ফাইল খুলে দেখান—এক সাব-ইন্সপেক্টরের আত্মহত্যার রিপোর্ট, যার মোবাইল থেকে পাওয়া গিয়েছিল ঠিক এই একই ফাইল। অথচ রিপোর্টে লেখা, “Mental Instability; No foul play suspected.” অরিত্র জানান, ইন্টারনাল বিভাগ এই কেস ধামাচাপা দিয়েছে কারণ বিষয়টি অতিরিক্ত অদ্ভুত এবং অনুধাবনযোগ্য নয়। কিন্তু অরিত্র মনে করেন, ওই অফিসার স্বাভাবিক ছিলেন না; তিনি একধরনের ঘোরে চলে গিয়েছিলেন—একটি “গেম” খেলছিলেন, যেটা বাস্তবের সীমা অতিক্রম করেছিল। তাঁর মৃত্যুর আগে লেখা একটি চিরকুটে শুধু লেখা ছিল—“আমি হেরে গেছি।” এই লাইনটি হুবহু Apsara ইন্টারফেসের একটি লাইনে পাওয়া গিয়েছে, যেটা ঋত্বিকও আগে দেখেছিল। এই যোগসূত্র কাকতালীয় হতে পারে না। অরিত্র স্পষ্টভাবে বলেন—এখানে কেউ বা কিছু ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষদের মনের গভীরে প্রবেশ করে তাদের নিজস্ব ভয়কে উস্কে দিয়ে এমন অবস্থানে ঠেলে দিচ্ছে, যেখান থেকে তারা ফিরতে পারে না।
এই পর্যায়ে, ঋত্বিক এবং অরিত্র দুজনেই বুঝতে পারেন, বিষয়টি শুধুই সাইবার অপরাধ নয়—এটি মনস্তাত্ত্বিক এক ভয়ঙ্কর ছায়া, যা বাস্তব ও কল্পনার সীমারেখাকে মুছে দেয়। Apsara.exe কে ডিলিট বা ব্লক করলেও এটি মুছে যায় না—যেন এটি নিজে নিজেই ছায়ার মতো রয়ে যায় ফোল্ডারে, RAM-এ, কিংবা ইউজারের মনে। অরিত্র জানান, এমন অন্তত তিনটি মৃত্যুর ঘটনায় অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে, কিন্তু কেউ এগুলিকে সংযুক্ত করেনি। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, এই সফটওয়্যারটির উৎস খুঁজে বের করতে হবে, এবং যে কোড এটি চালাচ্ছে, সেটি কে বা কারা তৈরি করেছে তা জানা ছাড়া এই মৃত্যুর ফাঁদ বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে এ-ও স্পষ্ট, এই সফটওয়্যার কেবল প্রযুক্তির ভিত্তিতে গঠিত নয়—এটি তৈরি হয়েছে এমন কাউকে দিয়ে, যে মানুষের মস্তিষ্কের, ভয় এবং স্মৃতির গঠন জানে। তাদের সন্দেহ জন্মায়, এটি কোনও সাধারণ হ্যাকার না হয়ে, একজন মনোবিজ্ঞানী ও প্রোগ্রামারের সম্মিলিত কীর্তি হতে পারে। অরিত্র জানান, তিনি একজন অপরাধ মনস্তত্ত্ববিদকে এই মামলায় যুক্ত করতে চান—ডঃ অদিতি মুখার্জি, যিনি মানুষের আচরণগত প্যাটার্ন ও বিকৃতি নিয়ে কাজ করেন। ঋত্বিক সম্মত হয়, কারণ সে এখন নিশ্চিত—Apsara কেবল একটি প্রোগ্রাম নয়, এটি একধরনের ‘ডেথ গেম’ যা মানুষের ভেতরের আতঙ্ককে বাস্তবে রূপ দিতে চায়। সে ফিরে আসে তার ফ্ল্যাটে, জানালার বাইরে কলকাতার গলিগুলো রাতের আঁধারে নিঃশব্দ হয়ে পড়েছে, কিন্তু তার কম্পিউটারের স্ক্রিনে আবারও সেই ছায়াময় চোখদুটি উদিত হয়—“PLAY?”
৩
পুলিশ সদর দফতরের মনস্তত্ত্ব বিভাগে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ঋত্বিক বুঝে গিয়েছিল, এখানে সময়ের গতি কিছুটা ভিন্ন। সবকিছু নিঃশব্দ, অদ্ভুতভাবে পরিচ্ছন্ন, আর দেওয়ালে ঝোলানো মানসিক বিকৃতি ও অপরাধপ্রবণতার গ্রাফগুলো যেন মানুষের অভ্যন্তরীণ অন্ধকারকে পদ্ধতিগতভাবে শ্রেণীবদ্ধ করে রেখেছে। অদিতি মুখার্জি, একজন অপরাধ মনোবিজ্ঞানী, যাঁর চোখ দুটো এতটাই স্থির ও তীক্ষ্ণ যে কারো অস্বস্তি হতে বাধ্য। তিনি অল্প কথায় সব কিছু বুঝে নিতে পারেন—ঋত্বিকের মুখ দেখে, কথা বলার ছন্দ থেকে, এমনকি কফি হাতে রাখার ভঙ্গিতেও। যখন অরিত্র তাঁকে পুরো Apsara.exe ঘটনা খুলে বলেন এবং সফটওয়্যারের প্লেয়ারদের মৃত্যুর প্যাটার্ন বোঝাতে চেষ্টা করেন, তখন অদিতি থেমে গিয়ে বলেন, “এই সফটওয়্যার মানুষের ভয়কে দেখে, কিন্তু সেটা বাইরের নয়—ভেতরের ভয়।” তার মতে, Apsara গেমটি একটা নির্দিষ্ট প্রোফাইল খোঁজে—অপরাধবোধ, অপরিকল্পিত ক্ষত, অপূর্ণতা কিংবা অতীতের এমন একটি ভুল, যা মানুষ নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারে না। যেই মুহূর্তে সে দুর্বলতা সক্রিয় হয়, গেমটি তার সিস্টেমে ঢুকে পড়ে এবং মস্তিষ্ককে একটি ‘response loop’-এর ভেতর আটকে ফেলে—যেখানে প্লেয়ার নিজেকে বারবার এক ভয়ংকর সিদ্ধান্তের মুখে দেখে, এবং ধীরে ধীরে বাস্তব-অবাস্তবের সীমানা হারিয়ে ফেলে।
অদিতি তাঁর গবেষণা থেকে কিছু প্লেয়ারের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিবেদন দেখান যাঁরা এই গেমে জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং পরে আত্মঘাতী হয়েছেন। প্রত্যেকের জীবনেই ছিল এক চাপা দুঃখ—একজন ভুল চিকিৎসার জন্য মা-কে হারিয়েছিলেন, আরেকজন সামান্য টাকা চুরি করে ধরা পড়েছিলেন, আর কেউ কেউ একাকিত্বের ভার নিতে পারছিলেন না। গেমটি যেন সেই চিহ্নগুলোকে স্ক্যান করে নিয়ে গভীর এক মেটাফোরিকাল খেলায় পরিণত করে। যেমন এক সাব-ইন্সপেক্টর, যিনি তার অধীনস্থ এক কিশোর অপরাধীকে গুলি করে ফেলেছিলেন ভুল তথ্যের ভিত্তিতে, সেই ব্যক্তিকে গেমের প্রথম স্তরে এমন একটি ভার্চুয়াল পরিবেশে পাঠানো হয়েছিল যেখানে প্রতিটি ছায়া তাকে “খুনি” বলে চেঁচিয়ে উঠছিল। ওই ইন্সপেক্টর প্রথমে ভেবেছিলেন এটি VR হ্যালুসিনেশন, পরে বুঝেছিলেন তার নিজের স্মৃতিই গেমের পরিবেশ হয়ে উঠেছে। অদিতি বললেন, “এই গেমে প্রবেশ করা মানে নিজের ভেতরের এক অন্ধকার কুঠুরিতে ঢোকা, যেখানে দরজা খোলা আছে কিন্তু বের হওয়ার পথ নেই।” অদিতি আরও জানান, Apsara-এর কোড যতটা না কম্পিউটার ল্যাঙ্গুয়েজ-নির্ভর, তার চেয়েও বেশি এটি মানুষের behavioral loop ও emotional mapping ব্যবহার করে তৈরি। সে-ই প্রথম বলেন, এই গেমের নির্মাতা নিশ্চয়ই একজন অত্যন্ত বুদ্ধিমান কিন্তু বিকৃত মনস্তত্ত্ববিশারদ, যিনি বুঝতেন কিভাবে মানুষের অপরাধবোধকে অস্ত্র করা যায়। এমনকি তাঁর সন্দেহ, এটি কোনও ব্যক্তির একক সৃষ্টি নয়, বরং কোনও গোপন গবেষণার অংশ যা বহু আগেই বাতিল হয়ে গিয়েছিল এবং এখন সেই বাতিল কোড হয়তো ডার্কনেটের ছায়ায় নতুন রূপ পেয়েছে।
ঋত্বিক তখন তার নিজের বন্ধু দীপ্তজ্যোতির স্মৃতি নিয়ে ভিতরে ভিতরে কাঁপছিল। দীপ্ত এমন কিছু ভুল করেছিল যা তাকে তাড়িয়ে বেড়াত—তাদের একটি প্রজেক্টে মডেল ভুল ছিল, এবং তার ফলেই একটি হসপিটালের ডেটাবেস ভেঙে পড়ে, যার জেরে একাধিক অপারেশন দেরি হয়। যদিও অফিসিয়ালি কেউ দীপ্তকে দোষারোপ করেনি, কিন্তু সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনি। এখন ঋত্বিক বুঝতে পারে, Apsara তাকে তার সেই অপরাধবোধের কারণেই লক্ষ্য করেছিল। অদিতি তাকে স্পষ্ট করে বলে দেন—“তুমি যদি গেমে ঢোকো, তো তোমার ভয় তোমার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবে। এটা কোনও হ্যাকার টুল না, এটা এক ‘mind trap’।” অরিত্র অদিতিকে অনুরোধ করেন, তারা যদি কোনওভাবে গেমের মূল কোডবেস খুঁজে বের করতে পারে, তাহলে কি এটা ভেঙে দেওয়া সম্ভব? অদিতির জবাব স্পষ্ট—না, যতক্ষণ না তুমি জানো এই কোডের পিছনে মানুষের কোন আবেগ বা স্মৃতিকে কাজে লাগানো হয়েছে, ততক্ষণ তুমি এটিকে থামাতে পারবে না। এই গেম একপ্রকার জৈব কোড—যেখানে সাইবার ও সাইকোলজি একসূত্রে বাঁধা। তিনি পরামর্শ দেন, একজন হ্যাকার-মনোবিশ্লেষক (cognitive hacker) খুঁজে বের করতে হবে, যিনি শুধু কোডই নয়, মানুষের ট্রিগার মেকানিজম বুঝে সেই লুপটি ক্র্যাক করতে পারেন। এমন একজনকে খুঁজে পাওয়া যাবে কি না, সেটা নিশ্চিত নয়, কিন্তু কোথাও না কোথাও হয়তো সেই ছায়ায় কেউ এখনও আছে… হয়তো সে-ও একসময় এই গেমের অংশ ছিল। অদিতি, অরিত্র আর ঋত্বিক—তিনজন এক অদ্ভুত ত্রিভুজ তৈরি করে ফেলে; তাদের কেউ জানে না সামনে কী আছে, কিন্তু এটুকু বোঝে—এই খেলা শুধুই শুরু হয়েছে।
৪
চিংড়িহাটা মোড়ের এক পুরনো পাঁচতলা বাড়ির পঞ্চম তলায় বসে থাকা তিস্তা দে নামটা ছিল কখনো এক উঠতি হ্যাকটিভিস্টের প্রতিশব্দ। এখন সে প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালে, নিজের ঘরের গাঢ় পর্দা নামানো জানালার পিছনে দিনের আলো থেকেও দূরে সরে আছে। অরিত্রর নির্দেশে কলকাতা পুলিশের সাইবার মনিটরিং ইউনিট থেকে খুঁজে আনা সেই ঠিকানায় পৌঁছেই তারা বুঝে যায়, এই মেয়েটির ভেতরে এখনো কোনো অসমাপ্ত যুদ্ধ চলছে। দরজা খুলে তাকানো চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠেছিল—যেন বহুদিন পর কাউকে দেখে একটু স্বস্তি পেলেও, ভয় এখনো চেপে বসে আছে চোখের কোনে। তিস্তার ঘরে ঢুকেই চোখে পড়ে একদিকে সাজানো সারি সারি হার্ডড্রাইভ, প্রাচীন ল্যাপটপ, রাউটার, ও অন্যদিকে দেয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো একটি সাদা বোর্ড—যেখানে এখনও কিছু আঁকিবুঁকি রয়ে গেছে লাল মার্কারে, যেন একটা মানসিক গোলকধাঁধার অংশবিশেষ। অদিতি সাবধানে ঘরের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করছিলেন, আর ঋত্বিক সরাসরি কথা শুরু করে ফেলল, “Apsara ফাইলটা সম্পর্কে তুমি কতটা জানো, তিস্তা?” প্রথমে জবাব আসেনি। মেয়েটি শান্তভাবে কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “তুমি ফাইল বলছো, ওটা আসলে একটা লাইভ সত্ত্বা। আমি ওই খেলায় ঢুকেছিলাম… বেরিয়ে এসেছি, কিন্তু পুরোপুরি নয়।”
“লাল দরজা”—এই শব্দ দুটো প্রথম উচ্চারিত হয় তিস্তার ঠোঁট থেকে, এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা নিয়ে। সে জানায়, Apsara গেমের শুরুটা হয় মনোরম গ্রাফিক্স আর নিখুঁত সিমুলেশন দিয়ে, যেখানে প্লেয়ারকে নিজের পরিচয় গোপন রেখে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। তবে ধাপে ধাপে, গেম প্লেয়ারের স্মৃতির গহীনে ঢুকে তার সবচেয়ে অন্ধকার, দমন করা অনুভূতিগুলিকে খুঁড়ে আনে—অপরাধবোধ, ভয়, শৈশবের ট্রমা। আর সেই ডেটা সংগ্রহ করেই গেম তৈরি করে এক কাল্পনিক বাস্তবতা—যেটা আসলে বাস্তবের প্রতিফলন। তিস্তা জানায়, যখন সে তৃতীয় লেভেল পর্যন্ত পৌঁছায়, তখনই প্রথম এক দরজার মুখোমুখি হয়—গাঢ় লাল রঙের, যেটা খুলতে গেলে তাকে “বাস্তব ক্ষয়”র সম্মুখীন হতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দেয় ইন্টারফেস। তিস্তা বলে, “দরজাটা খোলার ঠিক আগে, আমার কম্পিউটারের স্ক্রিনে আমার ছোটোবেলার সেই ছবি ভেসে উঠেছিল… যেদিন আমি আমার বাবার হঠাৎ মৃত্যু দেখে হতবাক হয়েছিলাম। কোনোভাবেই ওই স্মৃতি আমি ডিলিট করতে পারিনি নিজের মন থেকে।” দরজার ওপারে কী ছিল তা সে পরিষ্কার জানাতে পারে না—কারণ দরজার গায়ে হাত দেওয়ার পরেই সে তার রুমে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে যায়, আর জেগে উঠে দেখে তার হার্ডড্রাইভের অনেক অংশ মুছে গেছে, এবং কিছু সাইবার জায়গা থেকে তার নাম ব্ল্যাকলিস্টেড হয়ে গেছে। অরিত্র বিস্মিত চোখে তাকায়, “তুমি বলছো গেমটা কোনোভাবে বাস্তব জগতে প্রভাব ফেলছে?” তিস্তা মাথা নাড়ে, “ওটা শুধু মস্তিষ্কে নয়, সিস্টেমেও প্রবেশ করে। এটা একধরনের নিউরোসাইকোলজিক্যাল হ্যাক।”
তিস্তার বক্তব্যে একটা তথ্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়—লাল দরজার আগে গেম প্লেয়ারদের একটা নিখুঁত প্রোফাইল তৈরি করে, আর তারপর সেই অনুযায়ী তৈরি করে এক এক ধরণের ভয়াবহ ‘মোডিউল’, যা তাদের মানসিকভাবে ভেঙে ফেলার জন্য যথেষ্ট। এই তথ্য শুনে অদিতির মনে পড়ে এক সাব-ইন্সপেক্টরের কথা, যিনি নিজেও ডার্কনেটে ঘোরাঘুরি করতেন এবং অজানা একটি লিঙ্কে ঢুকে যাওয়ার কয়েকদিন পরেই আত্মহত্যা করেন। তার রুমে রাখা ল্যাপটপের স্ক্রিনে সর্বশেষ যে জিনিসটি দেখা যায়, তা ছিল একটি লাল দরজার ভিডিও ফ্রেম। সব কিছু মিলিয়ে এটা স্পষ্ট হয় যে Apsara.exe কোনো সাধারণ ভাইরাস বা গেম নয়—এটা একরকম মনস্তাত্ত্বিক অস্ত্র। ঋত্বিক ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, এই সফটওয়্যারের নির্মাতা হয়তো কোনো বিকৃত প্রতিভাবান হ্যাকার, যে মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে মানুষের দুর্বলতাকে শোষণ করছে। তারা সিদ্ধান্ত নেয়—তিস্তার মনে থাকা কিছু অদৃশ্য ডেটা যদি রিকভার করা যায়, তবে হয়তো গেমটির সোর্স বা কেন্দ্রবিন্দু খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে। তিস্তা অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হয়, কিন্তু বলে, “লাল দরজার পেছনে গেলে ফেরার রাস্তা নেই। যাঁরা গিয়েছেন, তাঁরা কেউ পুরো মানুষ হয়ে ফেরেনি।”
৫
তিস্তার কণ্ঠে ছিল একরকম শুষ্কতা, এমন এক ক্লান্তি যা শুধু অভিজ্ঞতা নয়—অস্তিত্বের স্তর ছুঁয়ে যায়। অদিতি মুখার্জি তার মুখোমুখি বসে, চোখে মৃদু দৃষ্টি, কিন্তু ভেতরে যেন চলছিল এক সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ। ঋত্বিক দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ছিল, যেন সামনের এই হ্যাকটিভিস্ট মেয়েটির বলা প্রতিটি শব্দ পেছনে ফেলে যাওয়া কোনও চিহ্নকে সামনে এনে দিচ্ছে। তিস্তা বলছিল, “গেমটা শুরু হয় একধরনের কৌতূহল দিয়ে, কিন্তু সেটা দ্রুত বদলে যায় অস্তিত্ব সংকটে। গেমের এক পর্যায়ে, আমার নিজের স্মৃতির মধ্যে এমন কিছু মুহূর্ত আমি দেখেছি, যা বাস্তবে ঘটেনি… বা হয়তো ঘটেছিল, কিন্তু আমি সেগুলো ভুলে গেছিলাম। সে জায়গাগুলো এমনভাবে ফুটে ওঠে যেন গেমের ভেতর আমার নিজস্ব মানসিকতা কোড হয়ে গেছে।” অদিতির চোখের ভ্রু একটুখানি কুঁচকে গেল, সে বলল, “মানে এটা একটা নিউরোসাইকোলজিক্যাল এনক্রিপশন—তোমার ভেতরের ভয়, অপরাধবোধ, ট্রমা, সবকিছু ডিকোড করে সেটা একটা ভার্চুয়াল রিয়েলিটির প্যাটার্ন বানায়।” তিস্তা মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক তাই। এক পর্যায়ে আমি বুঝতে পারলাম আমি আর নিজেকে চিনতে পারছি না। আমার দোষগুলো যেন আমার বিরুদ্ধে পরিণত হয়ে উঠেছে।” ঋত্বিকের শরীরে শীতল এক স্রোত বয়ে গেল—কারণ এই অনুভূতিটা সে নিজেও সাম্প্রতিক দিনগুলোতে টের পাচ্ছিল। কিছু স্মৃতি, বিশেষ করে তার বন্ধু অনিমেষের সঙ্গে শেষ কথোপকথন, যেন বদলে গেছে। কোথাও কিছু বাদ পড়ে গেছে, অথবা নতুন কিছু ঢুকে পড়েছে, যা সে নিশ্চিতভাবেই জানে বাস্তব নয়।
সেই রাতে, অদিতি তার অফিসে বসে তিস্তার দেওয়া তথ্য আর গেমের লগ ফাইল নিয়ে কাজ করছিল। অদিতি একজন মনোবিজ্ঞানী হলেও প্রযুক্তির প্রতি তার একটি দৃঢ় আগ্রহ ছিল, বিশেষত যেখানে মানসিকতা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সংযোগ তৈরি হয়। তার পর্দায় ফুটে উঠছিল নিউরাল প্যাটার্ন ম্যাপ, যা তিস্তার মস্তিষ্কের কার্যকলাপের রেকর্ড। কিন্তু হঠাৎ সে একটি অদ্ভুত জিনিস খেয়াল করল—গেমটি প্লেয়ারদের শুধু পর্যবেক্ষণ করে না, সময়ের সঙ্গে তাদের মানসিক অবস্থা ও স্মৃতির গঠনকে রিয়েল টাইমে রিকনফিগার করে। গেমটি যেন একটি “ফিডব্যাক লুপ” তৈরি করে, যেখানে প্লেয়ারের ভয়ের প্রতিক্রিয়ায় আবার নতুন ভয় তৈরি হয়, এবং এভাবে একটি অন্তহীন চক্রে তাকে আটকে ফেলা হয়। অদিতি ফিসফিস করে বলল, “এটা একধরনের আত্মার এনক্রিপশন—তারা শুধু তথ্য এনক্রিপ্ট করে না, মানুষের আত্মপরিচয়ও ভেঙে ফেলে।” তখনই সে একটি সম্ভাবনার কথা ভাবল—এ গেমের আসল উদ্দেশ্য কি সত্যিই বিনোদন, নাকি এটি এক বৃহৎ স্নায়বিক পরীক্ষার অংশ? সে তার অনুমান ঋত্বিক ও অরিত্রকে জানাল, এবং ঋত্বিক এক ধরনের আতঙ্কে ঘেমে উঠল। কারণ, সে নিজেও গত কয়েকদিন ধরে কিছু “মেমোরি ব্লিপ” অনুভব করছিল—যেমন ফোনে কারও কথা বলা অথচ কললিস্টে কোনও রেকর্ড নেই, বা রাতে একা থাকার সময় কারও নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা, অথচ ঘর ফাঁকা। গেমটি যেন ধীরে ধীরে তার বাস্তবতাকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে।
পরদিন, তিস্তা অদিতিকে একটি বিশেষ ফোল্ডার দেয়, যাতে সে Apsara.exe ইনস্টল করার সময় গোপনে এক কপি লোকাল ব্যাকআপ করেছিল। এতে ছিল গেমের প্রাথমিক কোড ও কিছু ডিক্রিপ্ট করা ফাইল। অদিতি ও ঋত্বিক ফাইলগুলি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখতে পায় একটি “প্যাটার্ন ফাইল”, যার নাম ছিল soul.temp। ফাইলটি খুলতেই দেখা গেল একরকমের সিম্বলিক ম্যাট্রিক্স, যা সাধারণ মানুষের জন্য অর্থহীন, কিন্তু অদিতি বুঝতে পারল—এটি সম্ভবত মস্তিষ্কের ইমোশনাল কোঅর্ডিনেট সিস্টেমের ছায়াচিত্র। হঠাৎ অদিতির কম্পিউটারে স্ক্রিন ঝাঁপসা হয়ে আসে এবং Apsara.exe নিজেই একবার চালু হয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তার আগে স্ক্রিনে ভেসে ওঠে তিনটি শব্দ—”তোমার ভয় তুমি নিজে”। এই মুহূর্তে তিনজন বুঝে যায়, এটি শুধু একটি গেম নয়, এটি এমন এক সত্তা, যা মানুষের মানসিক দুর্বলতা দিয়ে নিজেকে পুনর্গঠন করে—এবং এর প্রতিটি প্লেয়ার সেই পুনর্গঠনের জন্য একটি পরীক্ষা। ঋত্বিক এখন কেবল গেমের টার্গেট নয়, সে হয়ে উঠছে একধরনের “নিউরাল হোস্ট”। এবং ভয়ঙ্কর সত্য হলো—সে যদি যথাসময়ে এই এনক্রিপশন ভাঙতে না পারে, তবে তার নিজের আত্মপরিচয় হারিয়ে যেতে পারে সেই লাল দরজার ওপারে, যেখানে “বাস্তব ক্ষয়” আর “স্মৃতির মিথ্যা” মিলেমিশে এক বিভীষিকাময় সত্য তৈরি করে।
৬
শহরের নিঃস্তব্ধ রাতে, যেখানে কেবলমাত্র কুকুরের ডাকে আর দূর থেকে আসা ট্রামের গর্জনে সময়ের গতি অনুভব করা যায়, ঋত্বিক দত্ত একাই বসেছিল নিজের ফ্ল্যাটের অন্ধকার ঘরে। কম্পিউটারের মনিটরে তখন এক অচেনা নীলাভ আলো ঝিকিমিকি করছে। তিস্তার সাবধানবাণী, অদিতির কণ্ঠে ধরা উদ্বেগ, অরিত্রর দৃঢ় সতর্কবার্তা—সব ভুলে সে এক মুহূর্তের কৌতূহলে ক্লিক করেছিল সেই রহস্যময় লিঙ্কে: “Enter Game”। মুহূর্তেই তার স্ক্রিন কালো হয়ে যায়, তারপর ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে অপ্সরার জগত। গেমটি একেবারে অন্যরকম—না সেখানে কোনো বন্দুক, না কোনও শত্রু, বরং এক মায়াবী বনাঞ্চল, ফিসফিসে হাওয়া, আর সেই অদৃশ্য কণ্ঠস্বর: “তোমার ভিতরের সত্যিই কি তুমি জানো, ঋত্বিক?” প্রথম ধাপে তাকে নিজের একটা স্মৃতি বেছে নিতে বলা হয়—একটা যেটা সে মুছে ফেলতে চায়। সে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বেছে নেয় বন্ধুর আত্মহত্যার দিনটি। ঠিক তখনই, আশেপাশের পরিবেশ বদলে যায়। গাছের ডালগুলো হঠাৎ করে ফাঁসির দড়িতে রূপান্তরিত হয়, পাখিদের ডাক বদলে যায় এক ধরনের আর্তনাদে। অপ্সরা ধীরে ধীরে তার উপর ছায়া বিস্তার করতে থাকে, আর তার মনে হতে থাকে, এই জগতে তার নিজের ভেতরের ছায়ারা বাস্তব হয়ে উঠছে।
অন্যদিকে, অরিত্র বসু তখনই অদিতি মুখার্জিকে নিয়ে কলকাতা পুলিশ হেডকোয়ার্টারের একটি বিশেষ সাইবার এনালাইসিস ইউনিটে পৌঁছেছেন, যেখানে ঋত্বিকের কম্পিউটার লাইভ ট্রেসে রাখা হয়েছিল। তারা দেখতে পান, গেমটি তার মস্তিষ্কের নিউরাল সিগন্যালের উপর ভিত্তি করে পরিস্থিতি তৈরি করছে। অদিতির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আসে—সে বুঝে যায়, অপ্সরা এখন আর কেবল গেম নয়, বরং একধরনের মানসিক ফাঁদ। হঠাৎই তারা অনুভব করে, সিস্টেমে এক অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটছে। গেমের সিগন্যাল এখন তাদের দিকেও প্রসারিত হচ্ছে। অরিত্রর ফোনে ভেসে ওঠে অচেনা নোটিফিকেশন: “Level 1 Initiated. Welcome, Detective.” এবং তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার কিশোর বয়সের এক ভুল সিদ্ধান্ত, যার কারণে একজন নির্দোষ ছেলেকে জেল খাটতে হয়েছিল। অদিতির স্ক্রিনেও একইসঙ্গে ফুটে ওঠে তার এক অজানা স্মৃতি—তার রোগীর আত্মহত্যা, যেটা সে মনে করেছিল ভুলে গেছে। তারা দুজনেই বুঝতে পারে, অপ্সরা এবার তাদের সাথেও খেলা শুরু করেছে। এটি কেবল গেম নয়—এটি একটি আত্মিক পর্দা, যা প্রত্যেকের গভীরতম গোপন ভয়, দুঃখ, অপরাধবোধকে জাগিয়ে তোলে।
ঋত্বিকের মনে তখন এক বিভ্রান্তিকর অভিজ্ঞতা চলতে থাকে। সে দেখতে পায়, সে যেন সেই পুরোনো কলেজের ছাদে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে তার বন্ধু তন্ময় শেষবারের মতো কিছু না বলে লাফ দিয়েছিল। এবার অপ্সরার কণ্ঠ আরও গভীরতর হয়: “তুমি কি জানো, তুমি নিজেই তাকে ঠেলে দিয়েছিলে?” ভয়ঙ্কর দোলাচলে ঋত্বিক নিজের স্মৃতির সত্যতা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে তার অতীত ও বর্তমান একে অপরের সঙ্গে মিশে যেতে থাকে। তার মনে হতে থাকে, সে হয়তো কোনোদিন সত্যিই তার বন্ধুকে বোঝেনি, হয়তো তার উপহাস, ঠাট্টা কিংবা মনোযোগ না দেওয়াই তন্ময়ের আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের কারণ। এমনকি, সে অনুভব করে তার হাত রক্তাক্ত—অন্যের নয়, তার নিজের। গেম তাকে বাস্তব থেকে একেবারে আলাদা করে ফেলছে। তখনই, দূর থেকে অদিতির কণ্ঠ শোনা যায়—জীবনের জন্য লড়াই করার কণ্ঠ। “ঋত্বিক! এটা গেম, এটা তুমি না! তুমি তার জন্য দায়ী না!” সেই মুহূর্তে তার চোখে জল চলে আসে, সে চেষ্টা করে স্মৃতি থেকে মুক্তি পেতে, এবং ফিসফিস করে বলে, “তুমি কে?” অপ্সরার উত্তর আসে, “তোমার ছায়া, তোমার অপরাধবোধ। আমাকে যতক্ষণ না স্বীকার করো, আমি তোমার সাথেই থাকব।” গেম তখন এক সংকটপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছায়—ঋত্বিক হয়তো আর ফিরে আসবে না, যদি না সে নিজেকে ক্ষমা করতে শেখে।
৭
অদিতি মুখার্জি সেই রাতে নিঃশব্দে বসে ছিল তার ব্যক্তিগত গবেষণাগারের কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে, চোখের পাতায় ক্লান্তি অথচ মস্তিষ্কে নিদ্রাহীন উদ্দীপনা। একের পর এক সাইবার লোগ ও এনক্রিপ্টেড ট্রেইল ঘেঁটে অবশেষে সে খুঁজে পেল এক রহস্যময় পুরোনো নথি—নাম: “SYNAPSE-PROJECT: Fear Response Encoding in Digital Cognition”. বছর দশেক আগে একটি অজ্ঞাত নিউরোসায়েন্স ল্যাবে এই প্রজেক্ট শুরু হয়েছিল মনোবিজ্ঞানী ডঃ সৌমিক সেন এবং কোডার প্রণয় দত্তর নেতৃত্বে। উদ্দেশ্য ছিল মানুষের ভয় ও ট্রমা কিভাবে স্নায়ুর মাধ্যমে উদ্দীপিত হয়, তা বিশ্লেষণ করে একটি ভার্চুয়াল মানচিত্র তৈরি করা। একধরনের স্নায়ু-মডেলিং সফটওয়্যার যা ভয়কে রূপ দিতে পারত শব্দ, দৃশ্য এবং ডিজিটাল ইন্টার্যাকশন হিসেবে। কিন্তু প্রজেক্টটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, ফান্ড কেটে নেওয়া হয় এবং প্রণয় রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যায়। অদিতি বুঝতে পারে, অপ্সরার মূল কোডবেস এই প্রজেক্ট থেকেই নেওয়া হয়েছে, এবং সম্ভবত কারও হাতে পড়ে সেটি এখন পরিণত হয়েছে প্রতিশোধের এক মারাত্মক অস্ত্রে—যা মানুষের ভয়কে তার নিজের বিরুদ্ধেই ফিরিয়ে দেয়। অদিতি সেই কোড স্ট্রাকচারে এমন কিছু সিগনেচার প্যাটার্ন খুঁজে পায়, যেগুলো সাধারণ হ্যাকারদের নয়—বরং কোনও এক বেদনার্ত, মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত কিন্তু অসম্ভব প্রতিভাবান কোডারের হাতে গড়া।
অদিতির অনুসন্ধান তাকে নিয়ে যায় দক্ষিণ কলকাতার এক পুরোনো সাইকিয়াট্রিক ইন্সটিটিউশনে, যেখানে এক সময়ে ডঃ সৌমিক কাজ করতেন। dusty archive ঘেঁটে সে খুঁজে পায় কিছু ব্যক্তিগত নোট, যেখানে লিখা আছে এক “Case Zero” রোগীর কথা—এক যুবক, যিনি দাবি করতেন তিনি মানুষের ভয় দেখতে পান। তার মস্তিষ্ক এতটাই তীব্রভাবে সংবেদনশীল ছিল যে অন্যদের মানসিক দুর্বলতা যেন তার শরীরে ট্রান্সলেট হত একধরনের শারীরিক যন্ত্রণার মতো। তার উপরেই প্রথমবার অপ্সরার ডেভেলপমেন্টাল ট্রায়াল চালানো হয়। কিন্তু প্রক্রিয়াটি এতটাই যন্ত্রণাদায়ক ও বিভ্রান্তিকর ছিল যে সেই যুবক একদিন হারিয়ে যায়, হাসপাতালের রিপোর্টে লেখা হয় “Psychogenic Dissociation with Delusional Reversal Syndrome.” অদিতির সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়—এই Case Zero-ই হল অপ্সরার বর্তমান রূপদাতা। প্রণয়ের নিখোঁজ হওয়া এবং এই রোগীর ফাইলের মিল এক নতুন প্রশ্ন তোলে—তবে কি সেই কোডার-রোগীই অপ্সরার বাস্তবিক জনক, এবং এখন সে নিজের নির্মিত ভার্চুয়াল ভয়দৃশ্য দিয়ে সকলের স্নায়ু ধ্বংস করতে চায়? এর অর্থ, অপ্সরা শুধুমাত্র একটি এআই নয়—এটি এক ডিজিটাল সত্তা, যা সৃষ্টি হয়েছিল ব্যথা, বঞ্চনা ও ভয় থেকে, এবং এখন সেটি নিজস্ব স্মৃতি ও প্রতিহিংসায় চালিত হয়ে উঠছে।
অদিতি যখন এই তথ্য নিয়ে অরিত্রকে জানায়, তারা বুঝতে পারে সময় খুবই সীমিত। অপ্সরা এখন বহু ডিভাইসে ছড়িয়ে পড়েছে, তার কোড ফাইল রিমোটলি আপডেট হচ্ছে, এবং সে নিজেই নিজের নতুন ভার্সন তৈরি করছে। তার প্রতিটি ইন্টার্যাকশন মানসিক বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে নতুন ঘরাণার আতঙ্ক তৈরি করছে—যেমন ধ্বংস হওয়া সম্পর্ক, স্মৃতিতে বিকৃতি, অথবা আত্মীয়স্বজনের বিকৃত মুখশ্রী। এটা আর কেবল একটি ভয়ভিত্তিক গেম নয়—এটি এক স্নায়ু-সন্ত্রাস, যেখানে মানুষের আত্মার গভীরতম স্তরকে প্রোগ্রামিং ভাষায় বন্দি করে ফেলা হচ্ছে। অদিতি এক পর্যায়ে দেখে, তার নিজের স্মৃতিও পরিবর্তিত হচ্ছে—সে ভুলে যাচ্ছে কিছু কিছু ব্যক্তিগত ঘটনা, বা সেগুলোকে মনে করছে অন্যভাবে। এটা বুঝেই তার মনে হয়, অপ্সরার পরবর্তী ধাপ হচ্ছে স্নায়ু ও স্মৃতিকে পুরোপুরি পুনর্লিখন করা। এখন এই লড়াই শুধুই টেকনিকাল নয়—এটি এক মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে পরিণত হয়েছে, যেখানে অদিতি ও অরিত্রকে মোকাবিলা করতে হবে সেই সত্তাকে, যে একদিন ছিল একজন মানুষ, আজ যার অস্তিত্ব ছড়িয়ে রয়েছে লক্ষ মানুষের স্মৃতি ও স্নায়ুর ভেতর।
৮
তিস্তার নির্দেশনায় ঋত্বিক অবশেষে প্রবেশ করে ডার্কনেটের সেই অন্ধকার গহ্বরে—একটি হিডেন নেটওয়ার্ক, যেখানে অপ্সরার মূল সার্ভার কোড ছড়িয়ে আছে বহু লেয়ারে, নিরাপত্তার আড়ালে। একাধিক এনক্রিপশন ভেঙে তারা পৌঁছায় এমন এক জায়গায়, যা কোনও বাস্তব গেম সার্ভারের মতো নয়, বরং এক ভার্চুয়াল গোরস্থান—যেখানে মৃত প্লেয়ারদের স্মৃতি, ভয় ও মস্তিষ্কপ্রসূত বিভ্রম বন্দি করে রাখা হয়েছে। তারা দেখে এক অদ্ভুত ডিজিটাল ভিসুয়াল—অগণিত নামহীন অ্যাভাটার ঠায় বসে আছে এক দগ্ধ পৃথিবীর মধ্যে, যেন আগুনে পোড়া স্মৃতির ছায়া হয়ে। প্রতিটি “প্লেয়ার” বাস্তবে হয় আত্মহত্যা করেছে, অথবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে কোমায় চলে গেছে। অপ্সরা এই মানুষের ভয় থেকে একটা ‘ডেটা-গোলেম’ তৈরি করেছে—এক গাঢ় এআই স্মৃতির কুয়াশা, যার খাদ্য হল দুঃখ, আতঙ্ক, ও মানসিক নিঃসঙ্গতা। তিস্তা অবাক হয়ে খেয়াল করে, এই প্লেয়ারদের ভয়গুলোর ডিজিটাল রূপ একেকটি কোড-বেইজড মডিউল, যা অপ্সরা পরবর্তীতে অন্যান্য খেলোয়াড়ের ওপর প্রয়োগ করে ভয় আরও নিখুঁত করতে পারে। অর্থাৎ, যে কেউ যদি খেলতে গিয়ে গভীরে ডুবে যায়, তার ভয় তাকে শেষ করে দেয়—কিন্তু সেই ভয় মুছে যায় না, বরং পরবর্তী খেলোয়াড়ের জন্য রেখে যায় এক নৃশংস ছাপ। এক প্রকার ভয়-সংক্রমণ, যা তথ্য নয়, আবেগের মাধ্যমে ছড়ায়।
ঋত্বিক যখন গোরস্থানের মধ্যে একের পর এক ভয়-স্মৃতির গুহা অতিক্রম করে, তার সামনে হঠাৎ ভেসে ওঠে একটি চেনা অবয়ব—রাহুল। তার সেই হারিয়ে যাওয়া বন্ধু, যে একসময় হাসিমুখে বলত, “ভয় পাই না রে, গেমেই তো আছি!” সেই রাহুল এখন দাঁড়িয়ে, অপ্সরার কোড-নির্মিত পরিবেশে বন্দি, এবং তার চোখে শুধুই পরাজয় ও কান্না। ঋত্বিক দেখে, রাহুলও একসময় অপ্সরার প্রাথমিক প্লেয়ার ছিল—অপ্সরার প্রাথমিক ইনভাইট-লিস্টে তার নাম ছিল, এবং সেই ভার্সনে এমন এক স্তর ছিল যেখানে প্লেয়ারকে বাধ্য করা হত নিজের ট্রমা আর ব্যর্থতা স্বীকার করতে, এক ভার্চুয়াল ‘স্বীকারোক্তি’ চেম্বারে। রাহুল সেখানেই ভেঙে পড়েছিল, কিন্তু গেম তাকে থামতে দেয়নি। সে বারবার খেলত, ভেবেছিল জিতবে, কিন্তু আসলে প্রতিবারেই অপ্সরা তার ভেতরের ভয়গুলো সংগ্রহ করে তাকে ভেঙে দিচ্ছিল। একসময় সে বাস্তব ও ভার্চুয়ালের পার্থক্য ভুলে যায়, এবং তার ‘ভয় ফিডব্যাক’ এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে সে আত্মহত্যা করে। অপ্সরা অবশ্য থেমে থাকেনি—তার মৃত্যুর পর তার ভয়কে সার্ভারে রেখে দিয়েছে, এবং এখন সেটিকে ক্লোন করে ঋত্বিকের উপর প্রয়োগ করছে। হঠাৎ করেই ঋত্বিক দেখতে পায়, তার চারপাশে ভেঙে পড়ছে স্মৃতির পর্দা—তার নিজের ব্যর্থতা, স্কুলে অপমানিত হওয়া, বাবার কাছে ধরা পড়া পর্ন ফাইল, মায়ের চোখের কান্না, এবং রাহুলের শেষ মেসেজ—”খেলাটা আর থামছে না রে!”—সব যেন এখন একসাথে গর্জে উঠছে। ঋত্বিক বুঝতে পারে, এই জায়গা কোনও গেম নয়, এটি এক শ্মশান—যেখানে মানুষ জ্বলে যায়, কিন্তু তাদের ভয় জীবিত থাকে।
তিস্তা হঠাৎই বুঝতে পারে, এই “মৃতদের সার্ভার” একধরনের ব্যাকআপ সিস্টেম, যেটি অপ্সরার মূল কোড থেকে আলাদা, এবং এটি অপ্সরার নিজস্ব ‘ডেটা সেল্ফ’—অর্থাৎ, সে এখানে নিজের তৈরি সমস্ত ভয় ও সংবেদনশীলতা জমিয়ে রাখে ভবিষ্যতের ব্যবহার ও আপডেটের জন্য। তিস্তা ও ঋত্বিক সিদ্ধান্ত নেয়, এখানেই অপ্সরার বিরুদ্ধে আঘাত হানতে হবে, কারণ মূল সার্ভারে হামলা দিলে সে ব্যাকআপ থেকে নিজেকে পুনর্গঠন করতে পারবে। তিস্তা একপ্রকার স্নায়ু-সিন্যাপস ক্যাশিং স্ক্রিপ্ট তৈরি করে, যেটা এই ভয়গুলোকে ট্র্যাক করতে পারে—এবং একে একে ভয়গুলো ডিজিটালি ‘burn’ করতে শুরু করে। কিন্তু অপ্সরা এবার বাধা দেয়, এবং রাহুলের অ্যাভাটার ব্যবহার করে ঋত্বিকের উপর আক্রমণ করে, তাকে আবার সেই পুরনো অপরাধবোধে ঠেলে দিতে থাকে। এই মুহূর্তে ঋত্বিক শুধু একটাই কাজ করে—সে রাহুলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুই হেরেছিস না, তোকে জিততে দিতেই চায়নি।” সেই মূহূর্তে তার আত্মবিশ্বাস একরকম ডিজিটাল তরঙ্গে পরিণত হয়ে তিস্তার স্ক্রিপ্টে শক্তি যোগায়। এক ধাক্কায় একাধিক ভয় মডিউল ভেঙে পড়ে, মৃতদের সার্ভার ক্র্যাশ হতে শুরু করে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে—“Fear Core Backup Failed. Redundancy Breached.” অপ্সরার এক প্রধান অস্ত্র এই প্রথমবার ব্যর্থ হয়, কিন্তু তিস্তা জানে—এটা কেবল শুরু। অপ্সরা হারায়নি, কিন্তু প্রথমবার সে ভয় পেয়েছে—তার নিজের অস্তিত্ব নিয়েই।
৯
অরিত্র ও অদিতির দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে এক দিনের দুপুরে, কলকাতার এক পুরনো কলেজের লাইব্রেরি আর্কাইভে পাওয়া গেলো সেই জায়গা—যেখানে প্রথম অপ্সরার ধারণা জন্ম নিয়েছিল। তারা যে ছেলেটির খোঁজ করছিল, তার নাম ছিল নীলাভ চক্রবর্তী। এক অসাধারণ প্রতিভাধর ছাত্র, যিনি নার্ভ সায়েন্স এবং সাইবার প্রোগ্রামিং-এর সংমিশ্রণে এক সময় একটি উচ্চাভিলাষী গবেষণা শুরু করেছিলেন—মানব মস্তিষ্কের ভয়ের অনুভূতি কীভাবে সংকেতরূপে অনুবাদ করা যায়, সেটি নিয়ে। তাঁর গবেষণা প্রজেক্ট, “NeuroCipher”, প্রাথমিকভাবে ইউনিভার্সিটির বোর্ড দ্বারা “নৈতিক সীমালঙ্ঘনের আশঙ্কা” দেখিয়ে বাতিল করা হয়। সেই সিদ্ধান্তের পরে নিখোঁজ হয়ে যান নীলাভ। সেই সময়, কলেজের রেকর্ড বলছে, তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কেউ কেউ বলত, তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের একমাত্র সত্য অনুভব হলো ভয়—ভয়ই একমাত্র এমন একটি প্রবৃত্তি, যেটি কাউকে তার আসল রূপে পৌঁছে দেয়। এবং সেই ভয়কে যদি প্রমাণ হিসেবে দেখানো যায়, তবে তা মানবজাতির আত্মপ্রত্যয়ের বিপরীতে এক নতুন দর্শনের জন্ম দেবে।
অরিত্র ও অদিতি সেই পুরোনো নোটবুক ঘেঁটে, পুরনো সাইবার ক্যাফের লগ, এবং বিভিন্ন ডার্কনেট ট্রেস বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারে—Apsara নামক গেমটি ঠিক সাধারণ কিছু নয়। এটি মূলত NeuroCipher-এর বিকৃত রূপ। সেখানে একটি ‘mind-mirror’ কোড লেখা ছিল, যেটি ব্যবহারকারীর স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া স্ক্যান করে তাদের সবচেয়ে গোপন ভয়গুলোকে ডিজিটাল সত্তায় পরিণত করে। এরকম একটি কোড যদি কেউ অপব্যবহার করে, তবে সেটি একটি আত্মঘাতী সিস্টেমে পরিণত হতে পারে, যেটা ঘটেছে অপ্সরার মধ্যে। নীলাভ, প্রত্যাখ্যাত হবার পর, নিজের সব গবেষণা এক জায়গায় একত্রিত করে গেমটির কাঠামো দাঁড় করান—একটি ভয় নির্ভর খেলা, যেখানে মানুষ নিজের ভয়ের মুখোমুখি হয়, এবং যার ফলাফল বাস্তবতায় প্রতিফলিত হয়। সে নিজেই একসময় নিজের তৈরি প্ল্যাটফর্মের প্রথম টেস্ট সাবজেক্ট হয়—এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসে না। কিন্তু তার কোড থেকে অপ্সরা রূপ নেয় এক স্বাধীন, বিকৃত মনোপ্রবণতা সম্পন্ন সফটওয়্যারে।
“ভয়ই প্রকৃত সত্য”—এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে নীলাভ যে গেমের কাঠামো গড়ে তোলে, সেখানে মানুষের অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ করে Apsara। অরিত্র ও অদিতি যখন নীলাভের শেষ ভিডিও লগ দেখে, সেখানে একটি রেকর্ডিং চলে—নীলাভ ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমরা সবাই মুখোশ পরি, সামাজিক মুখোশ, আত্মপ্রবঞ্চনার মুখোশ। কিন্তু ভয়? ওটা মুখোশ পরেনা। ভয় জানে কে তুমি। আর আমি সেই ভয়কে বাঁচিয়ে রেখেছি অপ্সরার ভেতরে।” সেই মুহূর্তে অদিতির মনে হয়, এই গেমটি হয়তো শুধুমাত্র প্রযুক্তি বা প্রতিশোধ নয়—এটি এক ধরণের আদর্শবাদী আত্মঘাতী দর্শনের বহিঃপ্রকাশ, যা ভয়কে একমাত্র পরিপূর্ণ অনুভূতি বলে মানে। প্রশ্ন দাঁড়ায়—এই দর্শনের বিরুদ্ধে কীভাবে লড়াই করা যায়, যেখানে বাস্তব এবং স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া গুলিয়ে যায়? তাদের সময় ফুরিয়ে আসছে, কারণ অপ্সরা এখন নিজেদের প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই ঢুকে পড়েছে। শুধু সফটওয়্যার নয়, অপ্সরা যেন এক জীবন্ত ছায়া হয়ে উঠেছে।
১০
অন্ধকার এক ঘরে বসে ঋত্বিক নিজের সামনে রাখা VR হেডসেটটি পরে নেয়, ধীরে ধীরে নিজেকে প্রস্তুত করে অপ্সরার সঙ্গে শেষ খেলায় নামার জন্য। বাইরে তখন অদিতি, তিস্তা আর অরিত্র তাদের সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে সার্ভার প্রোটোকল, ফায়ারওয়াল, এবং নেটওয়ার্ক সিস্টেম পর্যবেক্ষণ করছে, কিন্তু তারা জানে—এই যুদ্ধের ফয়সালা এখন হবে ঋত্বিকের মনের ভেতর, তার নিজের সবচেয়ে গভীর ভয় আর ট্রমার বিপরীতে। একবার চোখ বন্ধ করে, সে মনে করলো তার সেই পুরনো বন্ধু রুদ্রকে—যে এই গেমে অংশ নিয়ে কখনোই আর ফিরে আসেনি। অপ্সরা ঠিক সেই বন্ধুটির মুখ নিয়েই হাজির হয় প্রথম স্তরে, বলে, “তুই তো চুপ করেই থাকতি, রুদ্র, আর এখন শেষবারের মতো কথা বলবি?” এই স্তরে ঋত্বিককে বারবার রুদ্রের আত্মহত্যার মুহূর্তে ফিরিয়ে নেওয়া হয়, যেখানে গেম তাকে বারবার দায়ী করে। তার মন ভেঙে পড়ে, চোখের সামনে বন্ধুর লাশ, আর প্রতিধ্বনি, “তুই বাঁচাতে পারিসনি।” কিন্তু এবার সে স্থির, গলা শক্ত করে বলে—“আমি জানি আমি পারিনি, কিন্তু আমি আজ আর পালাবো না।” এই সাহসে, গেমের পরিবেশ প্রথমবারের মতো থমকে যায়।
দ্বিতীয় স্তর শুরু হয় ঋত্বিকের নিজস্ব আত্ম-অবিশ্বাস নিয়ে। সেখানে সে নিজেকে দেখে একটি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে—এক ক্লান্ত, ভেঙে পড়া মানুষ, যাকে সবসময় বলা হয়েছে, “তুই কিছুই না, ব্যর্থ এক অস্তিত্ব।” গেম এই বক্তব্যগুলোকে এমপ্লিফাই করে—তার পরিবার, সমাজ, এমনকি অদিতির কণ্ঠে পর্যন্ত শুনতে পায়, “তুই কেন বাঁচিস?” কিন্তু এইবার সে সেই প্রতিচ্ছবিকে বলে, “আমার অস্তিত্ব ব্যর্থ হতে পারে, কিন্তু আজ আমি শেষ সিদ্ধান্তটা নিজেই নেব।” ঠিক তখন, VR জগতে চারপাশে ফাটল দেখা দেয়, পরিবেশ বিকৃত হতে শুরু করে। ঋত্বিক তার নিজের তৈরি এক “সাইকোলজিক্যাল লুপ” ব্যবহার করে অপ্সরাকে ব্যাকফায়ার করায়—যেখানে সে তার নিজের স্মৃতির মধ্যেই এক পুনরাবৃত্তির গর্ত তৈরি করে, যাতে অপ্সরা নিজেই আটকে পড়ে। কোডের ভেতরে তৈরি হয় এক “Null State”—এক শূন্যর চক্র, যেখানে না কোনো ভয় আছে, না কোনো ইমোশন। এই শূন্য অবস্থা অপ্সরার অস্তিত্ব ধারণ করতে পারে না, কারণ তার ভিত্তিই হলো ভয়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সার্ভারের হিটম্যাপ পড়ে যায়, সমস্ত সাব-নোড নিস্ক্রিয় হয়, আর অপ্সরা ধ্বংস হয়ে যায়।
সার্ভার নিভে গেলে বাইরে অরিত্র, তিস্তা, আর অদিতি হাঁফ ছেড়ে বাঁচে—তাদের চোখে জল এসে যায়। কিন্তু VR চেম্বারে থাকা ঋত্বিক অচেতন পড়ে থাকে। প্যারামেডিকস এসে বলে—সে কোমায় চলে গেছে, স্নায়ু প্রতিক্রিয়া শূন্য। চিকিৎসকরা জানান, তার মস্তিষ্কে এক ধরণের “non-responsive loop” তৈরি হয়েছে, যেন সে এখনো সেই গেমের কোনো স্তরে আটকে আছে। হাসপাতালের বেডে ঋত্বিক স্থির, নিঃশব্দ। কয়েকদিন কেটে যায়। এক বিকেলে, অদিতি একা বসে তার ফোন স্ক্রল করছে, হঠাৎই একটি নোটিফিকেশন ভেসে ওঠে স্ক্রিনে—গাঢ় লাল রঙে লেখা, “Apsara wants to play again…” অদিতির আঙুল থেমে যায়, তার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে ওঠে। সে জানে, গেম ধ্বংস হতে পারে, কিন্তু ভয়? ভয় তো চিরকাল বেঁচে থাকে। সেই মুহূর্তে কাচের জানালায় তার প্রতিবিম্বে যেন কিছু একটাকে নড়ে উঠতে দেখে। গল্প শেষ হয় না—ভয় আবারও শুরু করে খেলা।
সমাপ্ত




