Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

শিমুলফুলের দিনগুলো

Spread the love

তিতলি মুখার্জী


অধ্যায় ১: শিমুলগাছের ছায়ায়

তিতির পালের জীবনের সেইসব দিন, যেগুলো সে পরবর্তীকালে স্মরণ করত “শিমুলফুলের দিন” নামে, আসলে ছিল এক অবিচল, নির্ভেজাল গ্রামীণ শৈশবের প্রতিচ্ছবি। তার গ্রাম—জয়নগর, ছিল যেন এক আলসে দুপুরের মতো ধীর, ছায়াঘেরা, অথচ অনুভবের গভীরে গাঁথা। কাঁচা রাস্তার দু’ধারে খেজুরগাছের ছায়া, পুকুরপাড়ে বসে থাকা ধলেশ্বর মাছের প্রত্যাশায় জাল ফেলে রাখা, আর বিকেলে মাঠের ধারে ছুটোছুটি—এইসবই ছিল তিতিরের দুনিয়া। তাদের ছোট্ট কুঁড়েঘরটি ছিল শিমুলগাছের পাশে, যে গাছের ছায়ায় বসে তিতির স্কুলের হোমওয়ার্ক করত। সেই গাছ, গাঢ় লাল শিমুলফুলে ভরা, যেন তার ছোট্ট জীবনের প্রতিটি স্বপ্নকে আগলে রাখত। হরিপদ পাল—তিতিরের বাবা, ছিলেন একজন গ্রাম্য পাঠশালার শিক্ষক, যিনি নিজের মেয়েকে নাম দিয়েছিলেন ‘শিমুলফুল’, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন মেয়েরা যত নরম হোক, ততটাই রঙিনও। প্রতিদিন সকালে যখন তিতির মায়ের হাতে ভেজানো মুড়ি আর গুড় খেয়ে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যেত, তখন সে বাবার কণ্ঠে শুনত, “তুই একদিন আকাশ ছুঁবি রে, আমার শিমুলফুল।”

তবে সেই শিমুলফুলের ছায়ায়ও ছিল অন্ধকারের রেখা। হরিপদ যখন বাড়ি ফিরতেন, তখন তার চোখে-মুখে থাকত ক্লান্তি, সামান্য বেতনের টানাপোড়েন, আর গায়ের ক্লাসে ছেলেমেয়েদের পড়তে অনীহার হতাশা। চন্দনা—তিতিরের মা, ছিলেন একেবারে ঘরকুনো, অথচ সুনিপুণ নারী। তিনি রুটি বানাতেন, হাড়ি মাজতেন, ভোরবেলায় শিবঠাকুরের সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রার্থনা করতেন—সবই নিঃশব্দে, কারো কাছে নিজেকে বোঝাতে না গিয়ে। চন্দনা চাইতেন তিতির পড়ুক, তবে সমাজের দৃষ্টিতে একটি মেয়ে বড় হলে কতখানি চলা যায়—তা তিনি জানতেন বলেই মাঝে মাঝে মেয়েকে স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হলে চোখে কুঁচকে তাকাতেন। যদিও মনে মনে গর্বও হতো তার—যখন মেয়েকে শীতের সকালের কুয়াশা ঠেলে স্কুল যেতে দেখতেন, চটিজোড়া ভিজে উঠলেও পা টলত না। তিতিরের বন্ধুর সংখ্যা খুব বেশি ছিল না—সে বরং একা চলতেই ভালোবাসত। ছুটির দিনে সে পুকুরঘাটে বসে সাদা শাড়ি পরা কাকিমাদের গা ধোওয়ার দৃশ্য দেখে ভাবত, “এইরকম শান্তি একদিন আমিও কিনে আনব”—যেন শান্তি কিনে আনা যায়! পড়ার ফাঁকে মাঝে মাঝে সে বাবার রেখে যাওয়া পুরোনো বইগুলোর পাতায় ডুবে যেত—‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘সুকুমার রায়’, আর ‘লীলাবতী’র অঙ্কগুলো তার ছোট্ট মনে একরকম জাদু তৈরি করত।

তবে প্রথমবার স্কুলে যাওয়া তার জীবনের মোড় ঘোরানো ঘটনা ছিল। সেই দিনটার কথা স্পষ্ট মনে পড়ে তার—গায়ে ছিল বাবার কিনে আনা গোলাপি ফ্রক, হাতে একজোড়া নতুন চটি, আর কাঁধে একটা টিনের বাক্স—যেখানে বইয়ের গন্ধ ছিল ঠিক ফুলের মতো। স্কুলে গিয়ে সে প্রথমবার দেখে ছেলেমেয়েরা একসাথে বসে, লেখাপড়া করে, খেলার মাঠে দৌড়ঝাঁপ করে—এই নতুন জগত তার বুকের ভিতর একধরনের স্পন্দন তুলেছিল। ক্লাসে যখন বাসন্তী দে প্রথম প্রশ্ন করেন, “কে কবিতা বলতে পারবে?”—তিতির গলা কাঁপিয়ে বলেছিল “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।” শিক্ষকতার কণ্ঠস্বর, বইয়ের পাতায় শব্দের ছন্দ, আর ব্ল্যাকবোর্ডে চকের আওয়াজ—সবই তিতিরের চোখে ছিল একধরনের জাদুময়তা। তবে শুরুর আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। যখন গ্রামের কেউ কেউ বলল, “মেয়েমানুষ বেশি লেখাপড়া করিলে বেয়াদপি বাড়ে,” তখন চন্দনা দ্বিধায় পড়ে যান। রাতের খাবার খেতে খেতে বাবার মুখ ভার হয়ে থাকত, আর মা ধীরে ধীরে বলতেন, “এইসব কানে নিস না… তুই শুধু মন দে পড়ায়।” কিন্তু তিতির জানত, তার মাও ভয় পায় সমাজের কথা, পাড়ার বুড়ো লোকেদের চাওয়াটাকে। তবুও, তিতির ঠিক করেছিল—সে শিমুলগাছের নিচে বসে পড়বেই, যতই চারপাশে ছায়া ঘনায়, তার চোখে জ্বলবে সেই আগুন, যে আগুন একদিন তার শিমুলফুলকে আলোতে ভরিয়ে দেবে।

অধ্যায় ২: স্কুলবাড়ির সিঁড়িগুলো

তিতিরের স্কুলজীবনের প্রথম দিনগুলো যেন ধোঁয়ায় মোড়ানো সকাল—সবকিছুই কুয়াশায় আবৃত, অথচ ভিতরে এক গভীর উত্তেজনা। সে ছিল স্কুলের সবচেয়ে নতুন আর সবচেয়ে কৌতূহলী ছাত্রীদের একজন। জয়নগর উচ্চ বিদ্যালয়টা ছিল গ্রামের একমাত্র হাইস্কুল, লাল ইটের পুরনো দালান, ছাদের কড়িকাঠ থেকে ঝুলে থাকা বাদুড়ের বাসা, আর একটা উঁচু ঘড়ির টাওয়ার—যেটা অনেকদিন ধরে আর সময় বলে না। স্কুলে ঢোকার সময় তার প্রথম চোখে পড়ে বাসন্তী দে’কে—একটা সাদা শাড়ি, চোখে চশমা, হাতে রুলার, আর কণ্ঠে এমন এক কঠিন শাসনের ধ্বনি, যা শুনেই তিতিরের বুক কেঁপে ওঠে। কিন্তু বাসন্তী দে’র চোখে ছিল অদ্ভুত এক মমতা, যেটা ধরা পড়ে তখনই যখন তিনি বোর্ডে লিখে বলে ওঠেন, “এই দেখো, যে পড়তে চায়, সে কখনো ছোট হয় না।” এই কথাটাই ছিল তিতিরের ভরসার প্রথম শিকড়। স্কুলের সিঁড়িগুলোর ধুলো, শ্রেণীকক্ষের বেঞ্চ, ছুটির ঘণ্টা—সবকিছুতেই সে খুঁজে পেতে থাকে নতুন জীবনের আভাস। তিতিরের মনটা বারবার ছুটে যেতে থাকে সেদিকটায়, যেদিকে একটা জানলা দিয়ে শিমুলগাছটা দেখা যায়—যেন সেই গাছটাও এসে তার জীবনের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে, চোখের আড়ালে সজাগ।

ক্লাসরুমে তার পাশের বেঞ্চে বসত শুভজিৎ মণ্ডল, এক রকম শান্ত-স্বভাবের ছেলে, যে কথা বলত খুব কম, কিন্তু চোখে ছিল অসম্ভব আত্মবিশ্বাস। শুভ ছিল তিতিরের ঠিক উল্টো—একটা সম্ভ্রান্ত কৃষক পরিবারের ছেলে, তার বাবা পঞ্চায়েতের সদস্য, পরিবারে টিভি আছে, বাইসাইকেল আছে, এমনকি মাঝে মাঝে বাজার থেকে ম্যাগাজিনও আসে। তিতির প্রথমে তার পাশে বসতে সংকোচ বোধ করত, কিন্তু একদিন হঠাৎ বাসন্তী দে তাকে সামনে বসিয়ে বলেন, “তুই আর শুভ একসাথে পড়বি, আমি দেখতে চাই তোমরা দু’জন কে বেশি এগোয়।” তিতির সেই দিন নিজের লেখার খাতার পাশেই দেখতে পায় শুভর পরিপাটি অক্ষর। দুজনেই নীরব প্রতিযোগিতার ভেতর দিয়ে একে অপরকে চেনা শুরু করে। শুভ মাঝে মাঝে তিতিরকে চুপিচুপি প্রশ্ন করে, “তুই কবিতা পড়িস?” আর তিতির হেসে বলে, “রবীন্দ্রনাথ পড়ি, তবে বাবার ছেঁড়া বই থেকে।” সেই হালকা কথোপকথনের মধ্যেই গড়ে ওঠে এক গোপন সখ্যতা, যা প্রেম না হলেও, তার অঙ্কুর বলা যায়। স্কুলের লাইব্রেরির পুরনো বইগুলোর মধ্যে বসে শুভ তিতিরকে একদিন তার নিজের লেখা কবিতা পড়ে শোনায়—“তুই শিমুল ফুল নাকি আগুন?”—তিতির তখন লজ্জায় মুখ ঘোরায়, কিন্তু মনে মনে সেই লাইন বারবার আবৃত্তি করে। স্কুলের সিঁড়িতে বসে, ছুটির পর খেলতে গিয়ে কিংবা পরীক্ষার আগের রাতে—তারা হয়ত একে অপরকে ভালোবেসে ফেলে, কিন্তু মুখে তা কেউ বলে না।

তবে এইসব সম্পর্ক, পড়াশোনা আর স্বপ্নের উড়ান সবাই মেনে নেয় না। গ্রামের লোকেরা কথা তুলতে শুরু করে—“মেয়েমানুষ আর ছেলের পাশাপাশি বসা ঠিক নয়”, “তিতির মেয়ে হয়েও ছেলে পাসে বসে, একদিন চরিত্র যাবে”—এসব মন্তব্য ভেসে আসে হাট থেকে, পুকুরঘাট থেকে, এমনকি নিজের উঠোন থেকেও। চন্দনা মাঝে মাঝে মেয়ে বাড়ি ফিরলে চোখে চোখ রাখেন না, শুধু বলেন, “খুব দেরি করিস না, রাস্তায় লোকজন কী বলবে?” তিতির জানে, তার মা ভয় পায়—ভয় পায় কথার, গুজবের, সমাজের বিচারবোধের। কিন্তু সে নিজে ভয় পায় পড়া বন্ধ হওয়ার—এই ভয়েই সে প্রতিদিন স্কুলে যায়, সেই একই সিঁড়ি বেয়ে, যেটা তাকে নতুন করে গড়ে তোলে। বাসন্তী দে একদিন ক্লাসে বলে ওঠেন, “সমাজ কখনোই মেয়েদের সহজে স্বাধীনতা দেয় না, সেটা ছিনিয়ে নিতে হয়।” তিতির সেই দিন অনুভব করে, তার পড়ার খাতা, তার কবিতা আর তার প্রতিদিনের উপস্থিতিই একপ্রকার প্রতিবাদ। শুভ তাকে একদিন বলে, “তুই বদলাবি সবকিছু”, আর সে ভাবে, বদল না হোক, অন্তত নিজের জীবনটা তো গড়তে পারব। স্কুলের সিঁড়িগুলো তখন কেবল ইট আর সিমেন্টের তৈরি নয়, বরং এক একটা ধাপ যেন তার স্বপ্নের সিঁড়ি, যেখানে প্রতিটি পা ফেলেই সে উঠে যায় জীবনের পরবর্তী স্তরে—যেখানে রয়েছে সংগ্রাম, প্রশ্ন, প্রেম আর আশার আলো।

অধ্যায় ৩: পকেটে রাখা কবিতা

শীতের শেষপ্রান্তে গ্রামের আকাশটা একটু বেশি নীল হয়ে উঠছিল, আর তিতিরের মনও যেন সেই আকাশের মতোই হালকা, মেঘহীন হয়ে উঠছিল শুভর সঙ্গে সময় কাটিয়ে। ক্লাস শেষে সিঁড়ির ধাপে বসে থাকা, লাইব্রেরির পুরোনো বইয়ের মধ্যে একে অপরকে খুঁজে ফেরা, কিংবা হেঁটে বাড়ি ফেরা পথে চুপিচুপি হাসাহাসি—সব মিলিয়ে একটা নরম, স্পর্শযোগ্য অনুভব জমে উঠছিল তাদের মধ্যে, যার নাম তখনো কেউ উচ্চারণ করেনি। একদিন শুভর ব্যাগ থেকে একটা ছেঁড়া খাতার পৃষ্ঠা মাটিতে পড়ে যায়। তিতির কুড়িয়ে নেয়, খুলে দেখে সেই পাতায় লেখা: “যদি শিমুল ফুল হতেই চাস, তবে আগুনকেও ভয় পাস না… কারণ তুই নিজেই আগুন।” কবিতার নিচে কোনও নাম নেই, কিন্তু ভাষা এত চেনা, শব্দের গন্ধ এত আপন যে বুঝতে দেরি হয় না—এটা শুভর লেখা। তিতিরের গাল গরম হয়ে ওঠে, সে পৃষ্ঠা ভাঁজ করে নিজের বইয়ের ভাঁজে গুঁজে রাখে। স্কুলে আর চোখে চোখ রাখে না, শুভ কিছু না বুঝে তার পিছু নেয়, আর তিতির বারবার এড়িয়ে যায়। দিন তিনেক পরে, বাসন্তী দে-র চোখের আড়ালে, লাইব্রেরির জানালার পাশের বেঞ্চে তিতির চুপচাপ বসে থাকে। শুভ এসে পাশে বসে বলে, “তুই কবিতাটা পড়েছিস?” তিতির কোনো উত্তর দেয় না। সে জানত, এইসব অনুভবের নাম যদি কেউ দেয়, তবে তার দায় তাকে বহন করতে হবে।

কিন্তু অনুভব তো চুপ করে থাকতে জানে না। ধীরে ধীরে শুভ চুপিচুপি তাকে ছোট্ট কাগজে লাইন লিখে দেয়, “আজ আকাশটাকে মনে হচ্ছে তোর মতো—লাল রঙের আলোয় ভিজে যাওয়া।” তিতির সেই চিঠি পড়ে ব্যাগের গোপন খোপে রেখে দেয়, রাতে পড়ার খাতার নিচে থেকে বার করে পড়ে, আবার লুকিয়ে ফেলে। একদিন স্কুল ছুটির পর পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে তারা দুজনে পাশাপাশি হাঁটছিল, কোনও কথা বলছিল না। শুভ ধীরে ধীরে হাতটা এগিয়ে দিল, আর তিতির থেমে গিয়ে তার আঙুল ছুঁয়ে নিল—না চেপে, না ছাড়িয়ে, শুধু এক মুহূর্তের জন্য। সেই মুহূর্ত যেন একটা ছোট্ট কবিতা হয়ে ওদের ভেতরে ঢুকে যায়। প্রথম প্রেম এমনই হয়—না বলার ভাষা থাকে, না স্পষ্টতা, কিন্তু তবুও সমস্ত কিছু বলে দেয় এক নিঃশব্দ ছোঁয়া। তারা জানত, এই সম্পর্ক কারো সামনে আনা যাবে না। পুকুরের ধারে বুধন কাকার চোখ, মাঠের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা গুড্ডুদের দল, কিংবা দোকানের পাশের মহিলাদের চিরন্তন চোখচাউনির ফাঁদ—সবই তাদের গোপন ভালোবাসার দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে সেই গোপন রোমাঞ্চে ছিল অন্যরকম উত্তেজনা। শুভ একদিন বলেছিল, “তোর জন্য আমি নদীর পারে দাঁড়িয়ে থাকব, যদি তুই একদিন সব ছেড়ে আসিস।” তিতির হাসতে হাসতে বলেছিল, “আমি নদী নই শুভ, আমি আগুন… আর তুই কাদায় দাঁড়িয়ে আছিস।” কিন্তু সে কথার অর্থ যে প্রেম ছিল, তা দুজনেই জানত।

তাদের এই সম্পর্ক যত গভীর হচ্ছিল, ততই তাদের মধ্যে আসছিল দ্বিধা। তিতির জানত, তার জন্য এই ভালোবাসা যদি মা জেনে যায়, তাহলে পড়াশোনা বন্ধ করে দেবে, পাত্র দেখা শুরু হবে, সমাজে কথা ছড়াবে। শুভও জানত, তার বাবা গণেশ মণ্ডলের চোখে পড়লে সে আর স্কুলে আসতে পারবে না। তাই তারা সম্পর্কটাকে রাখত নীরবে, পকেটে রাখা কবিতার মতো—যেটা কেউ পড়ে না, তবুও সব কিছু বলে দেয়। তারা চিঠির আদলে ছোট ছোট কাগজে কথা লিখত, কবিতার ছায়ায় আবেগ রাখত, আর মাঝেমাঝে স্কুলের খাতায় ভুল করে একে অপরের নাম লিখে কাটিয়ে দিত। তিতির প্রতিদিন ভাবত, “এই সম্পর্ক কি থাকবে?” আবার পরক্ষণেই ভাবত, “এইটুকু তো আমার নিজের থাকা উচিত।” প্রথম প্রেম ছিল যেমন মধুর, তেমনি ছিল ভয়ঙ্কর এক যন্ত্রণার উৎস—কারণ ভালোবাসা কখনও প্রকাশ পেলে জীবন ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু তবুও, তিতির প্রতিদিন স্কুলে যেত, শুভর পাশে বসত, আর ভেতরে ভেতরে সেই ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখত—একটা পকেটে রাখা কবিতার মতো, যেটা হয়তো কাউকে দেখানো যায় না, কিন্তু হৃদয়ের প্রতিটি বাক্যে তার গন্ধ মিশে থাকে।

অধ্যায় ৪: বাবা নেই, তবু আছি

হরিপদের মৃত্যুর খবরটা যেন হঠাৎ এক বজ্রপাতের মতো নেমে এল তিতিরদের ছোট্ট সংসারে। একরাশ কান্না, অপার শূন্যতা আর দায়িত্বের চাপ যেন মুহূর্তে তিতিরের কোমল কাঁধে ভারী বোঝার মতো এসে পড়ল। বাবার মৃত্যুর পর প্রথম কয়েকটা দিন তিতির বুঝতেই পারেনি কীভাবে সময় পার হয়ে যাচ্ছে। চারপাশের লোকজন, আত্মীয়-পরিজনের ভিড়, প্রতিবেশীদের সান্ত্বনা—সবকিছু যেন এক অচেনা স্বপ্নের মতো লাগছিল। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই যখন সবাই নিজেদের জীবনে ফিরে গেল, তখন তিতির অনুভব করল, সে আর আগের মতো নেই। যে মেয়েটি আগে শুধু ক্লাসে পড়াশোনা আর গল্পের বই পড়ে সময় কাটাতো, সে এখন টেবিলে বসে ভেবে চলে—মাসের শেষে কীভাবে বাজার হবে, কীভাবে মায়ের ওষুধ আসবে, আর বোন টুনুর স্কুলের খরচটাই বা কোথা থেকে আসবে। দাদা বা কাকারা কেউ কোনও দায়িত্ব নিতে আসেনি, শুধু পরামর্শ দিতে এসেছিল একবার—”মেয়ে মানুষ বেশি পড়ে কী করবে, কাজ শেখা দরকার এখন!” চন্দনা দেবী, হরিপদের স্ত্রী, ভাঙা গলায় বলেছিলেন—”বাড়ির বড় মেয়েটা এখন সংসার সামলাবে, ওকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনতে হবে।” কিন্তু তিতির চোখের জল গিলে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “স্কুল ছাড়লে বাবার স্বপ্নটাই শেষ হয়ে যাবে মা!” মা কিছু বলেননি, শুধু জানলার বাইরে তাকিয়ে ছিলেন অনেকক্ষণ। সেদিন রাতেই তিতির নিজের মনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল—এই লড়াই একা ওকেই লড়তে হবে।

পরদিন সকাল থেকে তিতির একটা নতুন রুটিনে ঢুকে পড়ল। ভোরবেলা উঠে মায়ের সঙ্গে রান্না, বোনের টিফিন বানানো, তারপর নিজের বই খাতা নিয়ে স্কুলে ছোটা। কিন্তু স্কুল থেকে ফিরে আর বিশ্রামের সময় ছিল না। পাড়ার এক দিদির বাড়িতে গিয়ে কাপড় সেলাই শেখা, আবার ফিরেই মায়ের সঙ্গে ভাত বাড়া, বাসন মাজা, এরপর রাত করে পড়া। প্রথম প্রথম মনে হতো সে যেন একা একা এক বিরাট অন্ধকার গুহায় হাঁটছে। কিন্তু একসময় সেই অন্ধকারেই চোখ সয়ে গেল। ক্লাসে সে আগের মতোই মনোযোগী, কিন্তু এখন সে আর স্বপ্ন দেখতে সাহস পায় না। আগে যখন বাংলা সাহিত্যের ক্লাসে জীবনানন্দ পড়ানো হত, সে কল্পনায় ভেসে যেত দূরের কোনো কুয়াশামাখা পথের ভিতর। কিন্তু এখন সেই কল্পনা থেমে গেছে। এখন তার চোখে শুধু বাজারের তালিকা, কাপড়ের মাপ, আর মাথার ওপরের ফ্যানটা কবে সারাতে হবে, সেই চিন্তা। স্কুলে শিক্ষকরা কেউ কেউ বোঝেন তার চোখের গভীর ক্লান্তি, কিন্তু সবাই তো আর সাহায্য করতে পারে না। একদিন প্রিয় শিক্ষিকা অপর্ণা মিস তাঁকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, “তিতির, সব ঠিক আছে তো?” সে হেসে বলে, “হ্যাঁ ম্যাম, একটু ব্যস্ত আছি, তাই সময় মতো হোমওয়ার্ক হয়নি।” অপর্ণা মিস বুঝতে পারেন, মেয়েটির ভেতরে কিছু একটা কষ্ট জমে আছে, কিন্তু যতক্ষণ না তিতির নিজে খুলে বলছে, কিছু বলা যায় না। তবে ওই হাসিটার ভেতরেই যেন একটা জেদও ছিল—”বাবা নেই, কিন্তু আমি আছি, দাঁড়িয়ে আছি, শেষ হব না!”

এক সন্ধ্যায় মা আচমকা বলে বসলেন, “তোর স্কুলে যাওয়া বন্ধ করতে হবে তিতির। এই অবস্থায় আর পড়াশোনার ঝামেলা নেওয়া ঠিক নয়।” চুপচাপ বসে থাকল তিতির। চোখ দিয়ে জল পড়ছিল, কিন্তু মুখে কিছু বলল না। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর ধীরে ধীরে বলল, “মা, আমি স্কুল ছাড়ব না। পড়াশোনা ছেড়ে দিলে বাবা সত্যি মরে যাবে। আমি কাজ করব, সেলাই শিখে নেব, টিউশনি করব, কিন্তু স্কুল ছাড়ব না।” চন্দনা কেঁদে ফেললেন, বললেন, “তুই বুঝবি না মা, সংসার চালাতে গেলে পেটের চিন্তা আগে আসে।” তখন তিতির হাত ধরে বলল, “পেটের চিন্তা আমি বুঝি মা, কিন্তু স্বপ্নও দরকার। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলতো, তুই অনেক দূর যাবি। আমি বাবার স্বপ্ন ফেলে দিতে পারব না।” সেই রাতটা নিঃশব্দে কেটে গেল। পরদিন সকালে মা কিছু না বলেই তার জন্য জামা ইস্ত্রি করে দিলেন—তা ছিল এক নীরব সম্মতি। সেই দিনের পর থেকে তিতির একটা দ্বৈত জীবনে ঢুকে পড়ে। সে একদিকে সংসারের জন্য রান্না করে, সেলাই করে, কখনো টিউশনি খুঁজে বেরায়, আবার অন্যদিকে ক্লাসে সব প্রশ্নের উত্তর দেয়, টিফিনে বোনকে খাবার পাঠায়, আর সুযোগ পেলেই লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পড়ে। তার এই লড়াইয়ের খবর ছড়িয়ে পড়ে স্কুলে। হেডমাস্টার একদিন তাকে ডেকে বলেন, “তুই সাহস হারাস না, আমাদের যতটুকু সামর্থ্য আছে ততটা সাহায্য করব।” সেই প্রথমবার তিতির একটু নিশ্চিন্তে হাসে। এই অধ্যায় জুড়ে তিতিরের স্বপ্ন আর বাস্তবের সংঘাত উঠে আসে নির্মমভাবে, কিন্তু তার ভেতরের আগুনই বলে—সব হারিয়ে ফেলার পরেও যদি বুক ভরে শ্বাস নেওয়া যায়, তবে যুদ্ধে এখনও আশা আছে। তিতির বুঝে যায়, বাবা নেই, তবু সে আছেই, এবং থেকে যাবে।

অধ্যায় ৫: বধূ হওয়ার আগে

সকালবেলা থেকেই বাড়ির উঠোনে কেমন একটা অদ্ভুত ব্যস্ততা। কাকের ডাক, ধানের গন্ধ, আর কলাপাতার উপর সাজানো জিলিপির থালা—সব মিলিয়ে যেন উৎসবের প্রস্তুতি। তিতির কিছুই বোঝে না, শুধু টের পায়, আজকে তার পড়ার সময়টুকু কেড়ে নেওয়া হয়েছে। মা চন্দনা তাকে বারবার বলে, “একটু ভালো করে বস, জামাটাও বদলে ফেল।” তিতির আয়নায় তাকিয়ে দেখে তার সালোয়ারের গলার কাটা খানিকটা ঢিলে, চুল দুটো খোলা, আর মুখে একফোঁটা ঘাম। সে চায় না এসব সাজপোশাক করতে, চায় না কেউ এসে তাকে দেখে যাক। অথচ উঠোনের একপাশে চারটা মোড়া পাতা, সেখানে বসে গম্ভীর মুখে গল্প করছে পাত্রপক্ষের লোকেরা। মাথায় সাদা পাগড়ি, পেছনে দাঁড়িয়ে গামছা কাঁধে পাত্রের বাবা, আর সামনের মোড়ায় বসা ছেলেটির মুখে বয়ঃসন্ধির গোঁফের রেখা। তিতির বুঝতে পারে না, এ লোকটি তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করবে? তার খাতা, তার গল্পের বইগুলো, তার স্বপ্নের মতো উড়ে যাওয়া দিনগুলোর বদলে তাকে এই লোকটির ঘরকন্নার কথা ভাবতে হবে? সে তাকিয়ে দেখে শুভ দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আছে, কিছু বলছে না, চোখ দুটো ঘোলাটে। তিতির তাকিয়ে থাকে শুভর দিকে, যেন এক ধরনের নীরব আকুতি পাঠাতে চায়—বল না কিছু, বাঁচাও আমাকে।

চন্দনার মনেও দ্বন্দ্ব। সে জানে, এই গ্রামে মেয়েদের ভাগ্যে বেশিদূর পড়াশোনা লেখা থাকে না। কিন্তু তিতির অন্যরকম—এই মেয়েটার চোখে সে স্বপ্ন দেখেছে, মুক্ত আকাশের স্বপ্ন। সে চায়, তার মেয়ে বড় হোক, লেখা পড়া করুক, শহরে চাকরি করুক। কিন্তু সমাজের এই অদৃশ্য বেড়া, যেখানে মেয়েদের শৈশব কেমন সহজে হারিয়ে যায়, তার ভিতর থেকে সে বের হতে পারে না। পাত্রপক্ষ খুশি, মেয়েটি দেখতে ভালো, চুপচাপ, শিক্ষিত ঘরের মেয়ে। তারা বলে, “আমাদের ছেলেও এখন মাধ্যমিক পাস করেছে, কৃষির কাজ ভালোই জানে। বউকে খুব খুশি রাখতে পারবে।” কথাগুলো শুনে চন্দনার গলা শুকিয়ে আসে। সে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তিতিরের দিকে তাকায়—মেয়ে কি কিছু বলবে? তিতির চুপ করে থাকে। তার ভিতরে একটা বিদ্রোহের ঢেউ ওঠে, কিন্তু সে জানে, এই সমাজে মেয়েদের আওয়াজ ধাক্কা খেয়ে ফেরত আসে। সে তাকিয়ে থাকে তার আলমারিতে রাখা বইগুলোর দিকে, কেমন যেন হাহাকার শোনায় তারা। এমন সময় এসে হাজির হয় বাসন্তী দে—গ্রামের একমাত্র মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী, যিনি একরকম নিজের দায়িত্বে গ্রামের মেয়েদের জন্য কথা বলেন, লড়েন।

বাসন্তী দে এসে সোজা বলে, “চন্দনা, তোর মেয়ে এখনো খুব ছোট। ওর শরীরও এখনো তৈরি না। এখনই বিয়ে দিলে, বিপদ হবে।” চন্দনা কাঁপা গলায় বলে, “কিন্তু আপনি তো জানেন, কীভাবে সমাজ তাকায়। সবাই বলছে—এখন ভালো ঘর পেলে দিয়ে দাও। পরে তো পাবে না।” বাসন্তী কঠিন গলায় বলে, “সমাজ কি তোর মেয়ের বুকের দুধ দেবে? সমাজ কি তোর মেয়ের গর্ভযন্ত্রণা ভাগ করে নেবে? মেয়েটা যদি একবারও না চায়, তবে তার পছন্দটা শোনার অধিকার কি নেই?” এই কথায় চুপ করে যায় সকলে। শুভ একটু এগিয়ে আসে, চোখ নামিয়ে বলে, “তিতিরের খুব পড়ার ইচ্ছে, ও স্কুলে ভালো করে… আমি চাই ওর বিয়ে না হোক।” তার এই কথায় যেন হাওয়া বদলায়। পাত্রপক্ষ একটু অস্বস্তিতে পড়ে, বলে, “আমরা পরে আবার কথা বলবো।” তারা বিদায় নেয়। চন্দনা ফুঁপিয়ে ওঠে, বাসন্তী তাকে জড়িয়ে ধরে। আর তিতির—সে দাঁড়িয়ে থাকে কাঠ হয়ে, বুকের ভেতর অজানা এক আলোড়নে কাঁপতে কাঁপতে ভাবতে থাকে—এই সমাজে তার মতো কত মেয়েই তো শুধু নীরব থেকে নষ্ট হয়ে যায়, যদি কেউ তাদের হয়ে একবার মুখ খোলে, তাহলে হয়তো তারা হারিয়ে যায় না। এবং সেইদিন রাতে, চাঁদের আলোয় তিতির প্রথমবার অনুভব করে—সে শুধু একটা মেয়ে নয়, সে নিজেও একজন মানুষ, যার স্বপ্ন, আশা আর ইচ্ছেগুলোও বেঁচে থাকার সমান অধিকার রাখে।

অধ্যায় ৬: বিদ্রোহিনী

বিয়ের মণ্ডপের আলোর নিচে, যখন ঢাক বাজছিল, কান্না চাপা দিয়ে তিতির একটা শেষ সিদ্ধান্ত নেয়—এই বিয়ে, এই সমাজের শেকল, এই সম্মতি ছাড়া দেওয়া ভবিষ্যৎ সে গ্রহণ করবে না। সবাই যখন সিঁদুরের অপেক্ষায়, তখন হঠাৎই সে উঠে দাঁড়ায়, বিয়ের গয়না খুলে পায়ের আলতা মুছে ফেলে। সবাই চমকে ওঠে, কিন্তু তিতির পেছন ফিরে না তাকিয়ে সোজা হাঁটতে থাকে। মাথায় তখন শুধু একটা কথা—সে শিক্ষিকার কক্ষে ফিরবে, যেখানে তার স্বপ্ন এখনও টিকে আছে। পেছনে রীতিমতো দৌড় শুরু হয়। কনের পালিয়ে যাওয়া মানেই অপমান, মানেই ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যর্থতা। কিন্তু তিতির জানে, এই পালানো কোনো ভীরুতা নয়, এ তার প্রথম সাহসী সিদ্ধান্ত, যার দায় সে নিজেই নেবে। রাতের আঁধার, লজ্জা আর কান্না মাড়িয়ে সে স্কুলের প্রধান ফটক ঠেলে ঢোকে, যেখানে তার চেনা ক্লাসরুম, তার খাতা-কলম অপেক্ষা করছে। সেই পুরোনো কাঠের বেঞ্চে বসে সে যেন একটা যুদ্ধ জয় করে ফেলেছে।

ভোর হতে না হতেই খবর ছড়িয়ে পড়ে। পঞ্চায়েত প্রধান গণেশ মণ্ডল রাগে অগ্নিশর্মা। গ্রামের পুরুষ শাসিত সমাজের বুকের ভেতর থাবা দিয়েছে এই ঘটনা। “মেয়েমানুষ বিয়ের মঞ্চ ছেড়ে পালায়—এই কথা শুনলে লোক হাসবে,” বলে ক্ষোভে ফেটে পড়েন তিনি। তার সঙ্গে আছেন বুধন কাকা—যিনি একসময় তিতিরের বাবার বন্ধু ছিলেন, আজ সেই তিতিরকে ফিরিয়ে আনতে দায়িত্ব পেয়েছেন। দুজনে স্কুলে গিয়ে দেখে—তিতির একটা গরম চায়ের কাপ নিয়ে ক্লাসে বসে, খাতা খুলে বাংলার কবিতা লিখছে। গণেশ মণ্ডল গর্জে উঠলেন, “এই কি তোমার ভবিষ্যৎ? গ্রামের লোকজন হাসছে, তুই কী করলি জানিস?” কিন্তু তিতির মাথা নিচু না করে বলে, “হ্যাঁ, জানি। আমি জানি তারা হাসছে। কিন্তু একদিন তারা বুঝবে, মেয়ে মানেই কেবল বিয়ের পুতুল নয়। আমি পড়তে চাই। আমি শিক্ষক হতে চাই। আপনারা ফিরিয়ে নিতে পারেন আমার নাম, কিন্তু আমার স্বপ্ন নয়।” বুধন কাকা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। তার চোখে জল, মনের ভেতর দ্বন্দ্ব। সমাজের নিয়ম মেনে মেয়েটাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, কিন্তু নিজের অন্তর বলে—এই মেয়েটি ঠিক করছে।

গ্রামের চৌরাস্তার মোড়ে মানুষ জমে যায়। কেউ হাসে, কেউ ভয় পায়, কেউ গাল দেয়—কিন্তু কেউ কেউ চুপচাপ চোখে জল নিয়ে ভাবে—এই মেয়েটি কি তবে সত্যি অন্যরকম? পঞ্চায়েত অফিসে মিটিং ডাকা হয়। বুধন কাকা পরে বলেন, “তিতির যদি ফেরে, তাকে আগের নিয়মে আর বাঁধা যাবে না। সে নিজে তার পথ বেছে নিয়েছে।” এবং সেই প্রথম, তিতির একজন ‘বিদ্রোহিনী’ নয়, একজন পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠে। ক্লাসরুমে বসে তার ছবি কেউ একজন মোবাইলে তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেয়। ক্যাপশনে লেখে—“একটা মেয়ের সাহস। একটি গ্রামের লজ্জা নাকি গর্ব?” সেই ছবি ছড়িয়ে পড়ে। শহরের এক NGO যোগাযোগ করে, “এই মেয়েটিকে সাহায্য করতে চাই।” তিতির জানে, তার পথ কাঁটায় ভরা, সামনে আরও অপমান, হুমকি, বাধা আসবে—কিন্তু আজ প্রথমবার সে বোঝে, সত্যিকারের শিক্ষা মানে শুধুই বইয়ের পাতা নয়—এই সমাজের চোখে চোখ রেখে নিজের জায়গা করে নেওয়াটাও একপ্রকার শিক্ষার রূপ। তার চোখে সেই সাহসের আলো, যা একটা প্রজন্মকে বদলাতে পারে, একটা গ্রামকে নতুন দিশা দেখাতে পারে। বিদ্রোহ শুরু হয় একজন দিয়ে, আর বদল শুরু হয় সেই একজনের বুকের আগুন দিয়ে। তিতির সেই আগুন এখন, এক সাহসিনী, এক গল্প যা আজ থেকে সবাই মনে রাখবে—একটা মেয়ের প্রথম ‘না’ বলাটাই যখন হয়ে দাঁড়ায় সমাজের চোখে সবচেয়ে বড়ো ‘হ্যাঁ’।

অধ্যায় ৭: লালপাড় শাড়ির দিনগুলো

তিতিরের জীবনে প্রথম আলো নেমে আসে মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্টের দিন। এক পুরনো কাঠের আলমারির মতো নীরব ছিল তার জীবন, সেই আলমারির দরজা যেন হঠাৎ খুলে গেল সেদিন। তার নাম প্রথম স্থানে ছাপা হয়েছে, শুধু স্কুলে নয়, গোটা জেলায়। সেই খবর প্রথমে এল বাবার হাতে কাঁপতে থাকা একখানা খবরের কাগজে—পেছনের পাতায় ছোট্ট একটা কলামে। কিন্তু সেই ছোট্ট জায়গাটুকুই যেন এক বিশাল আকাশ হয়ে উঠল তিতিরের জন্য। মা রান্নাঘরে কাজ করছিলেন, বাবার ডাকে ছুটে এসে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন খবরের কাগজের দিকে তাকিয়ে। তিতির, লালপাড় শাড়ি পরে, সেদিন স্কুলে গিয়েছিল মার্কশিট নিতে। সবাই তাকে দেখে হাততালি দিচ্ছিল, শিক্ষকরা তাকে ঘিরে ছিলেন, যাদের কাছে একসময় সে ছিল শুধুই আরও একজন ‘চুপচাপ মেয়ে’। কিন্তু এখন সে হয়ে উঠেছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। তিতির শুধু হাসে, কারও চোখে চোখ রাখে না। তার চোখে এক অদ্ভুত নির্লিপ্ত বোধ। সে জানে, এই কৃতিত্বের পেছনে কতটা অভিমান, কতটা নিঃসঙ্গতা, কত রাতের কান্না আর দিনের না বলা কথা জমে রয়েছে। এই সাফল্য শুধুই নম্বরের নয়, এই তার নিজের অস্তিত্বের জোরালো উচ্চারণ।

সেই সময় শহরের জনপ্রিয় এক সাংবাদিক, কমলিকা সেন, তিতিরের বাড়িতে আসে। তিনি পত্রিকায় ‘অচেনা মুখ, নতুন গল্প’ নামের এক সাপ্তাহিক ফিচার লেখেন। তিতিরের নাম শুনেই তিনি ফোন করেন, তারপর এক বিকেলে এসে হাজির হন, একগুচ্ছ প্রশ্ন নিয়ে। তিতির তখন স্কুলের ইউনিফর্মে বসে ছিল, কিন্তু তার মুখে ছিল না কোনও শিশুসম স্নিগ্ধতা—বরং এক প্রকার দৃষ্টিশক্তিহীন প্রাপ্তবয়স্কতার স্থিরতা। কমলিকা প্রথমে কিছু জিজ্ঞেস করলেন—তুমি কত ঘণ্টা পড়াশোনা করতে? কোন বিষয়ে সবচেয়ে ভাল লাগে?—তিতির ছোট ছোট উত্তর দিল। কিন্তু ধীরে ধীরে কথাবার্তা গাঢ় হতে লাগল। কমলিকা জানতে চাইলেন—তুমি এত ভালো রেজাল্ট করলে কীভাবে? কোনও টিউশন ছিল না? বাড়িতে কারা আছেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরে তিতির এমনভাবে তাকাল, যেন প্রশ্নের মধ্যে আঘাত লুকিয়ে আছে। সে বলল, “না, কোনও টিউশন ছিল না। মা ঘরে কাজ করেন, বাবা দিনমজুর। আমি দুপুরে পয়সার জন্য বাচ্চাদের পড়াই, রাতে পড়াশোনা করি।” কমলিকার কলম থেমে যায় কিছু সময়ের জন্য। তিতির বলে না, তার শৈশব কেমন ছিল; বলে না, কখনও কোনও পুতুল পায়নি সে, অথবা নতুন জামা কেনা হয়নি বছর দুই। তবে তার চোখ বলে দেয়—সে এখন আর সেই ছোট্ট তিতির নয়, যে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত বারান্দার এক কোণে।

সেই দিনের পর, তিতিরকে নিয়ে পত্রিকায় একখানি পাতাজোড়া প্রতিবেদন ছাপে—তার ছবি, তার গল্প, তার উঠে আসার লড়াই। প্রতিবেদনটি পড়ে শহরের মানুষ চমকে ওঠে। অনেকেই ফোন করে, সাহায্য করার ইচ্ছা প্রকাশ করে, কেউ বই দিতে চায়, কেউ স্কলারশিপের ব্যবস্থা করতে চায়। স্কুলে তার জন্য সাংবর্ধনা হয়, তাকে নিয়ে লোকজন কথা বলে—“তিতির একদিন বড় কিছু হবে।” কিন্তু তিতিরের ভিতর একধরনের কৌতূহলহীন শান্তি। সে জানে, এই কৃতিত্বই তার সব নয়, বরং এই পথের শুরু মাত্র। তার লালপাড় শাড়ির দিনগুলো, যে শাড়ি সে প্রথম পড়েছিল স্কুলে পুরস্কার নিতে যাওয়ার দিন, যেন তার লড়াইয়ের পতাকা হয়ে উঠেছে। সে জানে, সামনে অনেক বড় লড়াই অপেক্ষা করছে—নতুন শহর, নতুন পরিবেশ, আরও কঠিন প্রতিযোগিতা। কিন্তু তিতির এখন আর ভয় পায় না। তার চোখে আত্মবিশ্বাসের সেই আলো জ্বলে, যা কোনও কোচিং সেন্টার শেখাতে পারে না, যা গড়ে ওঠে রাতের পর রাত নিজের সঙ্গে কথা বলে, কান্না গোপন করে, জেদে আগুন ধরে রেখে। লালপাড় শাড়ির সেই দিনগুলো তার মনে এক দাগ রেখে গেছে—যেখানে সে প্রথম অনুভব করেছিল, সে শুধু মেয়েমানুষ নয়, সে এক লড়াকু, এক অদম্য চেতনা।

অধ্যায় ৮: শুভর চিঠি

শুভর পলিটেকনিক কলেজে ভর্তি হওয়ার দিনটা যেন কোনোভাবে সবার চোখ এড়িয়ে গেল, শুধু তিতিরের নয়। কারও মনে হয়নি এই নিরীহ, শান্ত ছেলেটা একদিন চুপিসারে চলে যাবে, তার সমস্ত আবেগ আর না-বলা অনুভবগুলিকে পিঠে বেঁধে এক অচেনা শহরের অচেনা হোস্টেলের দিকে পা বাড়াবে। সেই ছোট্ট চৌচালা ঘর, যেখানে শুভর পরিবার বহু কষ্টে দিন কাটাত, সেখানে সে একদিন সিদ্ধান্ত নেয়, ভালোবাসা থাকলেও জীবনে নিজের অবস্থান তৈরি করা চাই। সেই ভোরে যখন সে বাড়ি ছাড়ে, তিতির তখন ঘুমিয়ে—নাকি জেগে, সেটা বলা মুশকিল। ঘুমের আবরণে লুকানো এক বিষাদে সে বুঝেছিল, শুভ চলে যাবে, আবারও তাদের দেখা হবে না—এই বুঝি সেই শেষ সকাল। দিন কয়েক পর, স্কুল থেকে ফেরার পর তিতির তার ব্যাগে একটা বাদামি খামের চিঠি পায়। তার নামের নিচে লেখা শুভর হাতের লেখা—একটা সহজ, কাঁচা লেখা, ঠিক যেমন ছিল শুভর ভালবাসা।

চিঠিতে শুভ লিখেছে, “তিতির, আমি জানি তুই এই চিঠি পড়ে হয়তো কাঁদবি, আবার হয়তো রাগ করবি। কিন্তু তোকে কিছু না বলেই চলে আসার পেছনে শুধু আমার লজ্জা ছিল, অপরাধবোধ ছিল না। আমি তোকে ভালোবাসি, জানিস? ঠিক সেই দিন থেকে যেদিন তোকে প্রথম দেখেছিলাম আমাদের স্কুলের লাইব্রেরির কোণে, চোখে ছিল একটা চাপা আগ্রহ, মুখে ছিল না কোনো অহংকার। সেই দিন থেকে তোকে চিনতে চাই, বুঝতে চাই—কিন্তু কখনও সাহস পাইনি বলেই তোকে বলিনি। তুই তো এমন এক মেয়ে, যার চোখে স্বপ্নের ঘোর, পায়ের নিচে নিজস্ব পথ, আর কাঁধে দায়িত্বের জিনিসপত্র। আমি বুঝি তোর চলার গতি আলাদা, তোকে আটকানো যাবে না। আমি তো শুধু চাইতাম তুই একদিন বুঝিস, আমি ছিলাম। এই যে আমি বেরিয়ে এলাম আমাদের গলির শেষ মাথা পেরিয়ে, একটা নতুন জায়গায়, সেটা আমার ইচ্ছের নয়, আমার প্রয়োজনের পথ। আমি তোর জীবনে বোঝা হতে চাইনি, হতে চেয়েছিলাম ছায়া। যদি কোনোদিন মন খারাপ হয়, যদি মনে হয় তোকে কেউ বোঝে না—তাহলে এই চিঠিটা পড়িস। কারণ এই চিঠিতে আমি আমার সব কথা রেখে যাচ্ছি, ভালোবাসা রেখে যাচ্ছি। শুভ।” চিঠির এই শব্দগুলো যেন তিতিরের হৃদয়ের গোপন অলিন্দে মৃদু ঢেউ তোলে। তার চোখের কোণ জলে ভরে আসে, কিন্তু তার হাত শক্ত করে ধরা তার জীবনের লক্ষ্য। এই ভালোবাসার সামনে মাথা নোয়াতে নেই কোনো সময়। চোখের জল মুছে সে জানলায় তাকিয়ে থাকে—যেন জানালার ওপারে শুভর সেই চোখজোড়া অপেক্ষা করছে, তিতির তাকে ডেকে বলবে, “আমি জানি।”

এই অধ্যায়টায় প্রেমের যেটুকু অনুপস্থিতি, সেটাই তাকে করে তোলে সবচেয়ে গভীর ও সত্যি। জীবনে সব প্রেম তো পূর্ণতা পায় না—কিছু প্রেম বুঝে নেয়, কেউ একজন স্বপ্নের পথ বেছে নিয়েছে। তিতির জানে, শুভ তার জন্যে অনেক কিছু করেছে, সেই মাটির বাড়িতে সে যতবার গিয়েছিল, সেই চুপ করে বসে থাকা মুহূর্তগুলোয় ছিল একটা স্নিগ্ধ ভাষা, যেটা কখনও মুখে আসেনি। আর এখন, যখন সে বুঝতে পারছে, জীবনে কেবলমাত্র ভালোবাসা নয়, নিজের পরিণতির দায়ও আছে, তখন শুভর চিঠি যেন সেই অপূরণীয় ভালবাসার একটি নিঃশব্দ প্রমাণ। চিঠির প্রতিটি শব্দ, শুভর প্রতিটি স্বীকারোক্তি, তিতিরকে যেমন কাঁদায়, তেমনি দৃঢ়তাও জোগায়। এই অপূর্ণ প্রেম, এই নীরব বিদায়, এই বোঝাপড়া—সব মিলিয়ে অধ্যায়টি হয়ে ওঠে জীবনের বাস্তব এক প্রতিচ্ছবি। তিতির জানে, শুভ তার পথে চলেছে, ঠিক যেমন সেও চলেছে নিজের গন্তব্যের দিকে। কিন্তু তাদের এই না-পাওয়া, এই না-বলা ভালোবাসা, সময়ের স্রোতেও মুছে যায় না। বরং মনের কোনো কোণায় থেকে যায় চিরদিনের মতো—যেমন থেকে যায় একটি চিঠি, একখানা বাদামি খামে, অনেক কথা আর একরাশ নীরবতায় মোড়া।

অধ্যায় ৯: ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা মা

চন্দনা জানত, তার জীবনের একেকটা ক্ষতই মেয়েকে নতুন এক যুদ্ধে নামিয়েছে। কখনও সে চুপচাপ ভাত বেড়েছে, কখনও দরজা বন্ধ করে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে। কিন্তু তিতিরের চোখের জেদ—যেটা ধীরে ধীরে আগুন হয়ে উঠেছে—সে আগুনের আঁচ এবার চন্দনার বুকেও লাগল। প্রথমদিকে সে ভয় পেয়েছিল, সমাজ, লোকের কথা, মেয়ে একা একা কী করে লড়বে! কিন্তু তিতিরের চোখের ভাষা তাকে যেন থামতে দেয় না। তিতির চুপচাপ নিজের কাজ করে, রাত জেগে পড়াশোনা করে, আবার গরিব মেয়েদের নিয়ে ক্লাসও নেয়। একদিন চন্দনা বুঝে যায়—এই মেয়ের পথ থামানো যাবে না। তখন সে আর না বলে না। সে নিজেই খোঁজ নেয় আশেপাশে কারা কারা স্কুল থেকে ছিটকে পড়েছে, কার মেয়ে বাড়িতে বসে কুঁচি সেলাই করে। তারা এসে বসে চন্দনার খুপরি বাড়ির একচিলতে উঠোনে। চন্দনা বোঝাতে শেখে, শব্দ বোঝায়, অক্ষর গেঁথে দেয়। চন্দনা যেন নিজের অপূর্ণতা পূরণ করে মেয়েদের ভিতর দিয়ে। সে আর শুধু একজন মা নয়, সে যেন একটি নিঃশব্দ বিপ্লবের ছায়া, যেখানে মা শব্দটির মানে হয় দাঁড়িয়ে থাকা, না ভেঙে পড়া।

পাড়ার লোকেরা প্রথমে হাসাহাসি করে। “ওরে! ও চন্দনা না? যার স্বামী বউ ফেলে গেছিল?”—এইসব কথার ভেতর দিয়েও চন্দনা মাথা নিচু করে না। সে জানে, কথায় কিছু যায় আসে না, কাজই একমাত্র উত্তর। বুধন কাকা, যে একসময় মেয়েদের স্কুলে পাঠানোকে সময় ও পয়সার অপচয় মনে করত, সে নিজেই একদিন তিতিরকে ডেকে বলে—“দেখো মা, নাতনিটাকে স্কুলে ভরতি করাবো ভাবছি। ও যদি তোদের মতো হয়!” তিতির বিস্ময়ে তাকায়। সে বোঝে না, এত কঠিন চেহারার এক মানুষ হঠাৎ এমন বদলে গেল কেন! কিন্তু চন্দনা জানে, সময় আর চোখের সামনে ঘটে যাওয়া বদল একেকটা পাথর গলিয়ে দিতে পারে। এখন আর পাড়ার লোক তিতিরকে ‘বখে যাওয়া মেয়ে’ বলে না। তারা বলে—“তিতিরদি, আমার মেয়েটাকে একটু পড়িয়ে দেবে?” এই বদল আসতে সময় লেগেছে, চোখের জল লেগেছে, অসম্মান লেগেছে—কিন্তু এসেছেও। এই পরিবর্তন চন্দনার ভিতরে এক অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দেয়। সে দেখে, মেয়েটা শুধু নিজের জন্য লড়ছে না, তার লড়াই অন্যদের মধ্যেও সাহস জোগাচ্ছে। সে মনে মনে ভাবে, যে রাত তাকে নিঃস্ব করেছিল, সেই রাতের পেছনে হয়তো এমনই একটা ভোর অপেক্ষা করছিল।

তিতির একদিন ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে দেখে মা চুপচাপ বারান্দায় বসে আকাশ দেখছে। সে ধীরে ধীরে গিয়ে মায়ের পাশে বসে। মা তার চুলে হাত বুলিয়ে দেয়, যেন তিতির আবার ছোট্ট মেয়েটি হয়ে গেছে। সেই মুহূর্তে কোনো কথা হয় না, শুধু নীরবতার ভিতর দিয়ে দুই প্রজন্মের নারী বুঝে নেয় একে অপরকে। তিতির জানে, মা হয়তো এখনও ভয় পায়—কী হবে ভবিষ্যতে, কতটা কঠিন হবে পথ। কিন্তু আজ সে জানে, তার পাশে একজন আছে যে শব্দ না করেও লড়াইয়ে শামিল। ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এই মা—তিতিরের সবচেয়ে বড় সাহস। দু’জনে বসে থাকে অনেকক্ষণ, আকাশে ধীরে ধীরে সন্ধ্যার ছায়া নামে। তিতির জানে না, জীবনে কী অপেক্ষা করছে, কিন্তু সে জানে, এই ছায়া তার জন্য ঢাল হয়ে থাকবে। সে মা’র দিকে তাকায়—একটা ভাঙা মুখে আজ অদ্ভুত শান্তি। সেই মুখে কোনো আক্ষেপ নেই, কোনো ভয় নেই—শুধু একরাশ গ্রহণ করা এবং সেখান থেকে জন্ম নেওয়া শক্তি। সেই দিন থেকেই তিতির বোঝে—সে একা নয়, তার লড়াই এখন অনেকের, তার স্বপ্ন আর কেবল নিজের নয়—একটা গোটা প্রজন্মের।

অধ্যায় ১০: শিমুলফুলের দিনগুলো

শীতের সকালে তিতির নিজের কলেজের সনদ হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসছিল। সোনাঝরা রোদে রাস্তাগুলো যেন স্বপ্নের মতো ঝিলমিল করছিল। তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের ওজন আজ একদমই অনুভব হচ্ছিল না, বরং মনে হচ্ছিল, একটা অদৃশ্য ডানা যেন তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। উচ্চমাধ্যমিকে সে শুধু স্কুলেই নয়, গোটা জেলার মধ্যে সেরা হয়েছে। এই খবর ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। পাড়ার সবাই যেভাবে তাকে দেখে—মাথায় হাত বুলিয়ে, চোখে গর্ব নিয়ে—তাতে তিতির একটু লজ্জা পেলেও, ভেতরে কোথাও একটা জায়গায় একটা আলো দপ করে জ্বলে উঠেছিল। সে জানে এই পথটা সহজ ছিল না। বাবার কাঠের ছোট দোকানে দিনের পর দিন বসে হোমওয়ার্ক করত, মা তার মাথায় তেল দিয়ে বলতেন, “মেয়ে মানুষ পড়াশোনা শিখলে সংসারও শিখে যায়।” এত কিছু পেরিয়ে আজকের এই দিন—এই ছোট্ট শহরের, পুরনো শিমুলগাছের তলায় দাঁড়িয়ে সে নিজেকেই যেন নতুন করে চিনতে পারছিল।

কলেজ থেকে সে স্কলারশিপ পেয়েছে—পুরো তিন বছরের ফান্ড, যার ফলে আর বাবাকে ভাবতে হবে না মেসের টাকা নিয়ে, মা’কে ভোরবেলা বাড়তি ঘরের কাজ নিতে হবে না। এই শিমুলগাছটা, যার নিচে দাঁড়িয়ে সে প্রথম কবিতা লিখেছিল, যার পাতার ফাঁক দিয়ে সে মেঘ দেখত, পাখির বাসা দেখত, সেই গাছটা আজও দাঁড়িয়ে আছে নীরব সাক্ষী হয়ে। কত কথা জমে আছে তার খোলে-খোলে, যেন সময়ের পাতায় খোদাই হয়ে আছে তিতিরের গল্প। একদিন এই গাছটার নিচে সে কান্না লুকিয়েছিল, যখন প্রাইভেট টিউশন যাওয়ার টাকা জোগাড় হয়নি; আর একদিন এই গাছেরই ডালে পাখি ডেকেছিল, যেদিন তার প্রথম গল্প পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। তিতির গাছের গা ছুঁয়ে বলে, “তুই ছিলি বলেই বোধহয় আমি ছিলাম।” এই অনুভূতিগুলো সে কারও সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে না, শুধু জানে—এই সমাজ, যেটা একদিন বলেছিল, “মেয়েমানুষ হয়ে এত বইপড়া কী হবে?”—তারাই আজ তার নামে মিষ্টি বিলোচ্ছে। যে সমাজ সন্দেহ করেছিল, চুপিচুপি তার ইচ্ছেগুলোকে দাফন করতে চেয়েছিল, সেই সমাজই আজ তার জয়গানে সুর তুলেছে।

তিতির জানে, এই জয় এখনও একটুখানি পথ। আসল লড়াই তো এখন শুরু হবে—একটা বড় শহরে গিয়ে নিজের জায়গা করে নেওয়ার যুদ্ধ, একটা নতুন জগতে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার অভিযাত্রা। কিন্তু আজ সে এসব ভাবছে না। আজ তার মনে হচ্ছে সে আকাশ ছুঁয়ে ফেলতে পারে। আজ তার শরীরে কোনও ক্লান্তি নেই, মনের মধ্যে এক অপার প্রশান্তি—যেন এই পুরনো শিমুলফুল গাছ তাকে আশীর্বাদ করেছে। জীবনের প্রতিটি ছোট ছোট মুহূর্ত আজ এক একটা আলোকচিত্র হয়ে ভেসে আসছে চোখের সামনে—মায়ের হেসে বলা কথাগুলো, বাবার চুপচাপ মাথা নোয়ানো, টিফিন বক্সে রেখে দেওয়া অতিরিক্ত সন্দেশ, স্কুলের বন্ধুদের কান্না জড়ানো বিদায়। সে জানে তার জীবনের গল্পটা এখনও লেখা শেষ হয়নি, কিন্তু আজ, এই মুহূর্তে, সে নিজের বুকের ভেতর এক বিশাল পরিপূর্ণতা অনুভব করছে। আর ঠিক সেই সময়, হাওয়ার ঝাপটায় গাছের ওপর থেকে একটা শিমুলফুল হেলে পড়ে তার হাতের উপর এসে পড়ে। তিতির তাকিয়ে হাসে। একদিন এই গাছের ডাল থেকে সে শিমুলফুল কুড়িয়ে মায়ের জন্য নিয়ে গিয়েছিল। আজ সেই গাছ তাকে নিজেই উপহার দিল, যেন বলছে—“তুই পেরেছিস।”

সমাপ্ত

1000050364.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *