নয়ন বিশ্বাস
১
কলকাতার ঘুমন্ত ভোরে, যখন গলির কুকুরগুলোও নিস্তব্ধ হয়ে যায়, ঠিক তখনই অরুণাভর স্বপ্ন শুরু হয়। এক নির্জন নীলচে আলোর ঘেরাটোপে সে দাঁড়িয়ে থাকে, সামনে দূরের এক বটগাছ, যার পাতা ঝরে না—শুধু ধীরে ধীরে হাওয়ায় ভাসে। প্রতিবার স্বপ্নটা শুরু হয় সেই গাছের নিচে, আর সেই মেয়েটি ধীরে ধীরে আবছা হয়ে এগিয়ে আসে কুয়াশার ভেতর থেকে। তার পরনে নীল রঙা ধুতি-সদৃশ এক শাড়ি, মুখে কোনো সাজ নেই, অথচ চোখে একধরনের জ্যোতি, যেন চাঁদের আলো সেখানে ঘনীভূত হয়েছে। “তুমি আবার এসেছো,” মেয়েটি বলে ধীর কণ্ঠে। “আমি জানতাম তুমি ফিরে আসবে। কিন্তু মনে রেখো, আমি বাস্তব না… আমি তোমার হৃদয়ে আছি।” এই কথাগুলো প্রতিটি রাতে, প্রতিটি স্বপ্নে, যেন এক অভ্যস্ত অনুরণনের মতো ফিরে আসে। আর অরুণাভ তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকে। সে জানে এটা স্বপ্ন, সে জানে এটা বাস্তব নয়। তবু কেন যেন বাস্তবের থেকেও বেশি সত্যি লাগে এই অনুভূতিটাকে। মেয়েটি তার দিকে এগিয়ে আসে, হাত বাড়ায়, ছুঁয়ে দিতে চায়। কিন্তু ঠিক ছোঁয়ার মুহূর্তে সবকিছু মিলিয়ে যায়, ভোরের আলো চোখে পড়ে, আর অরুণাভ জেগে ওঠে—হৃদয়জোড়া শূন্যতা নিয়ে।
অরুণাভ সেন, ২৮ বছরের ফ্রিল্যান্স গ্রাফিক ডিজাইনার, কলকাতার শ্যামবাজারের পুরনো এক বনেদি বাড়িতে একা থাকে। তার বাবা-মা দীর্ঘদিন আগেই বিদেশে চলে গেছে—সে একাই থাকাকে বেছে নিয়েছে, নিজের জগতে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। বাইরে সে সাধারণ, অল্প কথার, ভদ্র, নরম মানুষ; কিন্তু ভিতরে তার ভেতর গাঁথা আছে কিছু অসমাপ্ত ছবি, কিছু স্বপ্নযাত্রা। সকালবেলা উঠে চা বানিয়ে সে নিজের ছোট্ট স্টুডিওর কোণে বসে যায়। ক্যানভাসে সে কিছু না কিছু আঁকে—কখনো দূর পাহাড়ের ছায়া, কখনো নদীর গন্ধ, কিন্তু সবচেয়ে বেশি সে আঁকে মেয়েটির মুখ। স্বপ্নের সেই মেয়েটি—যার নাম জানে না, যার অস্তিত্ব নেই, অথচ যার ছায়া প্রতিটি দৃষ্টিতে, প্রতিটি রঙে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে মিশে থাকে। অরুণাভ কখনো বন্ধুদের বলে না এসব কথা, কারণ তারা এসব শুনে হাসে, ভাবে ওর ঘুম ঠিকঠাক হয় না, বা ডিপ্রেশনে আছে। কিন্তু অরুণাভ জানে, এই অনুভূতিটা কোনো রোগ নয়—এটা তার হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা কিছু। কেউ কেউ ভালোবাসার জন্য ছুটে বেড়ায় মানুষজনের মধ্যে, আর কেউ কেউ জন্ম থেকেই বহন করে তার ছায়া। অরুণাভ যেন তেমনই একজন—যার প্রেম আগে থেকেই নির্ধারিত, কেবল সেই মেয়েটি বাস্তবে নেই।
এক রাতে, যখন শহরটা আরও নিঃসাড়, আর বৃষ্টি ধীরে ধীরে জানালার কাঁচে শব্দ তুলছিল, অরুণাভ সেই একই স্বপ্নে আবার ঢুকে পড়ে। কিন্তু এবার কিছুটা ভিন্ন। মেয়েটি আসে, তার চোখ দুটো আগে থেকেও উজ্জ্বল, কণ্ঠে এক অদ্ভুত তীব্রতা। সে বলে, “তুমি যদি সত্যি আমাকে খোঁজো, তবে এসো… দক্ষিণের দিকে চলে এসো। আমি এখানে অপেক্ষা করছি… নোনাজলের ধারে।” অরুণাভ ঘুম থেকে উঠে বসে পড়ে, বুক ধড়ফড় করতে থাকে, মাথা ঝিমঝিম করে, কিন্তু চোখে অদ্ভুত শান্তি। মেয়েটি আগে কখনো কোনো নির্দিষ্ট স্থান বলেনি। এবার বলেছে। সে কি তবে চাইছে অরুণাভ সত্যি তাকে খুঁজে পাক? না কি এটা কেবল তার মনের ভুল, তার কল্পনার খেলা? সকাল হতেই অরুণাভ নিজের খাতায় লিখে ফেলে—“নোনাজলের ধারে”—তার নিচে আঙুল দিয়ে টেনে একটা রেখা টানে, যেন এই শব্দগুলো বাস্তবের সীমানায় পা রাখতে চলেছে। বাইরে তখনও বৃষ্টি, পাখিরা ডানা মেলেনি, কিন্তু অরুণাভর মনে তখন ঝড় বইছে—ভবিষ্যতের দিকে, কোনো এক অজানা পথে, যেখানে স্বপ্ন আর বাস্তবের ভেতরকার পর্দা ফাটতে শুরু করেছে। আর ঠিক সেখান থেকেই শুরু হবে তার যাত্রা—নীলময়ীর ছায়া ছুঁয়ে সত্যের রূপ খোঁজার পথে।
২
শহরটা কলকাতা হলেও, অরুণাভর কাছে এটা এক নিঃশব্দ মঞ্চ। বাইরে বাস চলাচলের শব্দ, হকারের হাঁকডাক, ট্র্যাফিক সিগন্যালের ঝাঁঝালো বাঁশি—সবই থাকে, কিন্তু তার কানে যেন ঢোকে না। ভেতরে এক গভীর স্তব্ধতা। মাঝে মাঝে ছাদে উঠে দাঁড়িয়ে সে দেখে, ছায়া পড়ে ভবনের ওপর দিয়ে—পাখি নয়, মানুষ নয়, যেন কোনো অতীতের মুখ ভেসে যায় ইমারতের গায়ে। বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বলতে শুধু মাঝে মাঝে ফোনে ‘হ্যালো, কেমন আছিস’—তার বেশি নয়। তার জীবনের বড় অংশই এখন নেমে এসেছে এক অভ্যন্তরীণ জগতে, যেখানে কেউ প্রবেশ করে না। কাজের চাপে যখন বাইরের কাস্টোমারদের সঙ্গে কথা বলতে হয়, তখন সে মুখে হাসি মেখে নেয়, কিন্তু জানে এ সবই একটা মুখোশ। তার সত্যিকারের জগৎ—তার ক্যানভাস, আর সেই স্বপ্ন। মেয়েটির মুখ এতবার আঁকতে আঁকতে, এখন তার চোখের পলক, ঠোঁটের বাঁক, কপালের তিল—সবই অরুণাভর কাছে বাস্তব মনে হয়। সে মাঝে মাঝে নিজের আঁকা ছবির সঙ্গে কথা বলে। হয়তো পাগলামি, কিন্তু এতে তার কিছু যায় আসে না। অন্তত এই ছবিগুলো তাকে মিথ্যা বলে না, প্রশ্ন করে না, কল্পনা বলে উড়িয়ে দেয় না।
এক সন্ধ্যায়, আকাশে হালকা ঝাপসা, বাতাসে ঠাণ্ডা, অরুণাভ হেঁটে বেড়াতে বেরোয় উত্তর কলকাতার ভিক্টোরিয়ান রাস্তায়। পুরনো বাড়ির গায়ে রঙ উঠে গেছে, জানালায় ধুলো জমে আছে, কিন্তু এ শহরের পুরনোত্বে তার একটা টান আছে। হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে পড়ে ‘বুক স্টল’ নামের এক ছোট্ট পুরনো বইয়ের দোকানের সামনে। সেখানে একটা পাতলা বই তার চোখে পড়ে—“স্মৃতির নদী”—লেখক অচেনা। সে বইটা হাতে নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখে, এক জায়গায় চোখ আটকে যায়:
“যে স্বপ্নে তুমি বারবার ফিরো, সে কখনও কেবল স্বপ্ন থাকে না। ভালোবাসা একমাত্র অনুভূতি, যা সময়ের গায়ে ছায়া ফেলে।”
বইটা সে না ভেবেই কিনে ফেলে, বাড়ি ফিরেও বারবার ওই লাইনটাই পড়ে। কেমন যেন ভিতরে কিছু নড়ে ওঠে। সে ভাবে, এই লেখক কি তার মতোই? যে এক অদ্ভুত প্রেমে বন্দি? যার প্রেমের মূর্তি বাস্তব জগতে নেই? নাকি স্বপ্নেরা মাঝে মাঝে নিজেদের প্রেরণা পাঠায়, অন্যদের কলমে, অন্যদের ভাষায়? সেদিন রাতে ঘুম ভাঙে হঠাৎ করেই, গা ঘেমে ভিজে গেছে, যেন আগুনের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে এল। মেয়েটি এবার স্বপ্নে চুপ ছিল, কেবল তাকিয়ে ছিল অরুণাভর চোখে। তাকিয়ে থেকে বলল না কিছু, কিন্তু তার চোখ দুটো যেন কথা বলছিল—এক অদ্ভুত আর্তি, এক অনুনয়, এক অসমাপ্ত আকুতি। অরুণাভ মনে মনে বুঝে নিল—সময় শেষ হয়ে আসছে।
পরদিন সকালে সে একরকম জেদ নিয়ে নিজের খাতা, ফোন, আর একজোড়া টিকিট কেটে রাখে—গন্তব্য দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা। অজুহাত বানিয়ে নিজের দুই ক্লায়েন্টকে মেইল করে, বলে সে কয়েকদিনের জন্য অফলাইনে থাকবে। ভিতরের একটা কিছু তাকে বলে—এই শহর তার নয়, অন্তত এই প্রেমের জন্য নয়। সে জানে না কী খুঁজতে যাচ্ছে, জানে না কাকে দেখতে পাবে। কিন্তু সেই স্বপ্নের মেয়েটি, যাকে সে এখন আর কল্পনার মূর্তি বলে ভাবতে পারে না, তাকে ছাড়া তার বেঁচে থাকা অসম্পূর্ণ। তার মতো কেউ এই বাস্তব পৃথিবীতে থাকতেই পারে না—এমন কথা অরুণাভ নিজেকেই আর বোঝাতে পারে না। ট্রেনের জানালার ধারে বসে, শহরটা ধীরে ধীরে পিছিয়ে যায়, কুয়াশা জমে গাড়ির কাঁচে, আর ভিতরে ভিতরে সে এক নতুন যাত্রার দিকে এগিয়ে চলে—যেখানে স্বপ্নের ধোঁয়া মিশে যাবে বাস্তবের আলোয়। ঠিক সেই মুহূর্তে, তার ফোনে একটি নোটিফিকেশন আসে—কোনো অচেনা নম্বর থেকে একটি মেসেজ:
“নোনাজলের ধারে আজ পূর্ণিমা উঠবে… তুমি কি আসছো?”
অরুণাভ থমকে যায়। সে তো কাউকে বলেনি কিছুই। তবে কী… মেয়েটি জানে? স্বপ্নটা কি আর শুধু ঘুমের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই? নাকি সত্যিই—এই নিঃশব্দ শহরের পেছনে লুকিয়ে ছিল এক শব্দহীন ডাক?
৩
ট্রেনের জানালার বাইরে সময় যেন অন্যরকম। কলকাতার কংক্রিটের পেছনে ফেলে অরুণাভ যখন দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার দিকে এগিয়ে চলেছে, সবকিছু যেন ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। শহরের কোলাহল পেছনে ফেলে আসতে আসতে সে দেখল মাঠের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা সরু খাল, দূরের তালগাছ, আর কোথাও কোথাও একটা-দুটা মাটির বাড়ি, যার দরজার সামনে কলস রেখে কেউ ধুপ জ্বালাচ্ছে। সকাল থেকে বিকেল হয়ে এসেছে, কিন্তু অরুণাভর বুকের ভেতর কেমন অদ্ভুত ধকধক করছে—একটা অনুভূতি, যেন সে কোথাও আগে এসেছিল। মনে হচ্ছিল, এই দৃশ্যগুলো তার খুব চেনা, যেন কোনো ঘুমের ঘোরে এগুলোকে সে হাজার বার দেখেছে। ট্রেন যখন কাকদ্বীপ স্টেশনে এসে থামে, তখন সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ছে, আকাশে একধরনের সোনালি ছায়া। নেমে পড়ে সে একরকম মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে চারপাশে। প্ল্যাটফর্মে খুব একটা ভিড় নেই, শুধু কয়েকজন জেলে, একটা চা-ওয়ালা, আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক গরিব লোকের ফাটা ব্যানার—“ফেরিঘাটের পথে অটো”। অরুণাভ ধীরে হাঁটতে হাঁটতে অটোতে উঠে পড়ে, মুখে বলে, “গঙ্গার ধারে যাবো, যেখানে নদীটা বেশি প্রশস্ত।” অটোচালক কিছু না বলে মাথা নাড়ে, আর অরুণাভ জানে না সে ঠিক কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু তার ভেতরে ভরসা আছে—এই যাত্রা কোনো খেয়াল নয়, এই পথেই সে তার সেই অলৌকিক অনুভূতির উৎস খুঁজে পাবে।
গ্রামটা খুব নিরিবিলি। পথঘাট শুনশান, মাঝে মাঝে শোনায় পাখির ডাক, দূরে কুয়োর পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া গরুর ঘন্টা বাজে। অরুণাভ যখন অটো থেকে নেমে পড়ে, তখন সন্ধ্যা নামছে। সে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছায় নদীর ধারে। জোয়ার এসেছে, নদীর জল উঁচু হয়ে উঠেছে, আর পূর্ণিমার চাঁদ উঠতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। হঠাৎ তার চোখে পড়ে, নদীর কিনারে বসে আছে এক নারী—পেছন থেকে দেখা যায় শুধু তার ঘন চুল, পরনে নীল-সাদা সুতির শাড়ি, মাথায় ওড়না নেই, কিন্তু বাতাসে তার চুলের নাচনে এক অদ্ভুত সুর বাজে। অরুণাভর গলা শুকিয়ে যায়। সে নিঃশব্দে কয়েক কদম এগোয়, মেয়েটি তখনও মুখ ফেরায়নি। কিন্তু যেন তার উপস্থিতি আগেই টের পেয়েছে। হঠাৎ সে ধীরে ধীরে ফিরে তাকায়—আর অরুণাভর সমস্ত শরীর ঝাঁকিয়ে ওঠে। এই মুখ, এই চোখ, এই দৃষ্টি… এগুলো তো সে শত শত রাত ধরে স্বপ্নে দেখেছে! মেয়েটি তার দিকে চেয়ে রইল, চোখে বিস্ময় নয়, বরং একধরনের শান্ত স্নেহ। সে বলল না কিছু, কেবল তাকিয়ে থাকল। আর অরুণাভ, কিছু বলতে পারল না। এই তো বাস্তব! এই তো সেই মুখ, যার জন্য সে এতটা পথ পেরিয়ে এসেছে। কিন্তু মেয়েটি তো বলেছিল, “আমি বাস্তব না…” তাহলে?
মেয়েটি উঠে দাঁড়াল, কাছে এসে ধীরে বলে, “আপনি এখানে নতুন, তাই না?” তার কণ্ঠে পরিচিত শব্দের ধরণ নেই, নেই স্বপ্নের সেই নরম ঢেউ। বরং বাস্তবিক দৃঢ়তা, স্পষ্ট উচ্চারণ। অরুণাভ কোনওভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা হেঁট করে বলে, “আমি… হ্যাঁ… একটু ঘুরতে এসেছি…” মেয়েটি মৃদু হেসে বলে, “ঘুরতে আসা মানুষজন এমন গভীর চোখ নিয়ে তাকায় না, মিস্টার…” সে নাম জানতে চায় না, কিন্তু অরুণাভ নিজেই বলে ফেলে, “অরুণাভ।” মেয়েটি নিজেকে পরিচয় দেয়, “রিজুতা পাল। এখানকার স্কুলে ইতিহাস পড়াই।” নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই অরুণাভর বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে—এমন নাম সে কখনো শোনেনি, কিন্তু যেন শোনার সঙ্গে সঙ্গেই বহু পুরনো কোনো কাহিনী মনে পড়ে গেল। রিজুতা! এই মেয়েটা বাস্তব, অথচ মুখ, চোখ, হাসি—সবই সেই স্বপ্নের মতো। সে চুপ করে তাকিয়ে থাকে, আর ভাবতে থাকে—স্বপ্ন কি তাহলে আগেই বলে দিয়েছিল? না কি বাস্তব এত নিখুঁতভাবে স্বপ্নকে অনুকরণ করতে পারে? রিজুতার চোখে ততক্ষণে পড়ে গেছে অরুণাভর বিস্ময়। সে আবার বলে, “আপনি ঠিক আছেন তো?” অরুণাভ শুধু বলে, “হয়তো এখন প্রথমবার ঠিক আছি।” নদীর ঢেউ তখন ছুঁয়ে যাচ্ছে তার পায়ের গোড়ালি, আর চাঁদের আলো মিশে যাচ্ছে জলের রূপালি উজ্জ্বলতায়। বাস্তব আর স্বপ্ন—এই দুইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে অরুণাভ বুঝে যায়, তার যাত্রা শুরু হয়েছে সত্যিকার অর্থেই।
৪
রিজুতা পালের জীবন ছিল সাদামাটা, ব্যতিক্রমহীন। কাকদ্বীপের এই ছোট্ট গ্রামে দিনগুলো কেটেছে নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা নিয়মে। সকালে উঠে পুকুরে স্নান, বাবার পুরনো সাইকেলে স্কুলে যাওয়া, ইতিহাসের ক্লাসে বাচ্চাদের ‘মৌর্য’ আর ‘মুঘল’ শেখানো, আর সন্ধ্যায় ফিরে ঘরের কোণে পুরনো বইয়ের সাথে সময় কাটানো। কিন্তু আজকের বিকেল তার কাছে যেন কিছু অন্যরকম। নদীর পাড়ে বসে থাকাকালীন ছেলেটির আগমন, তার চোখের গভীরতা, চেনা অথচ অচেনা মুখের অদ্ভুত চাওয়া—সব মিলিয়ে রিজুতা কেমন যেন ধন্দে পড়ে যায়। ছেলেটির নাম অরুণাভ, সে বলছে এখানে ঘুরতে এসেছে, কিন্তু তার চোখে কেমন যেন প্রশ্ন, বিস্ময়, আর একরকম… স্মৃতি? অথচ এই গ্রামে সে কখনও আসেনি বলেই মনে হয়। রিজুতা যতবার তার দিকে তাকায়, মনে হয় কোথাও আগে যেন দেখেছে। সেই মুখ, সেই দৃষ্টি—সবকিছু এত পরিচিত লাগছে যে, সে নিজেই ভয় পেতে শুরু করে। কিন্তু ভয়টা অস্বস্তির নয়, বরং এক ধরনের টান, যেন পুরনো কোনো সম্পর্ক তার দৃষ্টির আড়ালে ছায়া ফেলে আছে।
সন্ধ্যার দিকে রিজুতা যখন বাড়ি ফিরে, তখন তার মনটা অস্থির। সে বাবার কাঠের আলমারির ভেতর পুরনো ডায়েরিগুলো খুঁজে আনে, যেখানে তার দাদু একটা সময় নানা অদ্ভুত ঘটনা লিখে রাখতেন। সেই ডায়েরিগুলোর একটা পাতায় হঠাৎ করে চোখ আটকে যায়—তারিখ নেই, শুধু লেখা:
“পূর্ণিমার রাতে নদীর পাড়ে তাকে দেখেছিলাম। সাদা-নীল শাড়ি, চোখে দূর কোন অভিমান। সে বলল, ‘আমি বাস্তব না, কিন্তু তোমার মধ্যে আছি’। তার নাম ছিল নীলময়ী।”
এই লাইনগুলো পড়ে রিজুতা যেন কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যায়। কাঁপা হাতে ডায়েরিটা বন্ধ করে আবার খুলে দেখে, লেখাগুলো মুছে যায়নি তো? তার মাথার ভেতর চক্কর দিতে থাকে—নীলময়ী! এই নাম তো সে কখনো শোনেনি, অথচ এত চেনা, যেন বহুবার মুখে উচ্চারণ করেছে। আর অরুণাভ… তার চোখেও তো সেই একই কথা ছিল, “তুমি আমায় আগে দেখেছো।” রিজুতা জানে না কীভাবে, কিন্তু বুঝতে পারে, এই ছেলেটির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক আছে—যেটা কেবল বর্তমানের নয়। সে ঠিক করে পরদিন সকালে আবার নদীর ধারে যাবে, যদি ছেলেটি ফিরে আসে।
এদিকে অরুণাভ সেই রাতটা কাটায় কাছের এক নিরিবিলি গেস্ট হাউসে। সে একটানা ঘুমাতে পারে না—চোখ বন্ধ করলেই দেখা যায় রিজুতার মুখ, আর মিশে যায় নীলময়ীর সেই চিরচেনা হাসি। এবার সে ধন্দে পড়ে যায়—রিজুতা কি সেই মেয়েটিরই প্রতিরূপ? নাকি তারই পূর্বজন্ম? নাকি এই সবটাই কেবল তার মনগড়া? কিন্তু তখনই আবার মনে পড়ে নদীর ধারে মেয়েটির মুখে উচ্চারিত নাম, তার চোখের দিকে তাকানোর ভঙ্গি—যেটা কোনো বাস্তব মেয়ের নয়, বরং কোনো আত্মার মতো গভীর। অরুণাভ জানে, সে পাগল নয়, জানে বাস্তব আর স্বপ্নের মাঝখানে যে রেখাটা থাকে, সেটা কখনো কখনো হঠাৎ মিলিয়ে যায়। সে এবার ঠিক করে, রিজুতার সঙ্গে আর লুকোছাপা নয়—সব বলবে, সব ব্যাখ্যা করবে। তার শুধু একটা ভয়—রিজুতা বিশ্বাস করবে তো? বাস্তব জগতের একজন মানুষ যখন শুনবে যে সে কারও স্বপ্নে প্রতিদিন আসে, বিশ্বাস করবে কি, নাকি পাগল ঠাউরাবে? কিন্তু সে এটাও জানে, যদি আজ সে মুখ না খোলে, তাহলে এই অদ্ভুত প্রেম, এই অস্পষ্ট জন্ম-মৃত্যুর সম্পর্ক চিরতরে হারিয়ে যাবে। রাত গভীর হয়, পূর্ণিমার আলো জানালায় পড়ে, আর অরুণাভর মনে পড়ে মেয়েটির সেই শেষ স্বপ্নের উক্তি: “আমি তোমার ভিতরে আছি। যদি তুমি খুঁজে পাও, আমায় হারাবে না।” এখন সে জানে—এই খোঁজ এবার শেষ করতে হবে। বাস্তবের বুকেই স্বপ্নকে খুঁজে পাওয়ার সময় এসে গেছে।
৫
পরদিন সকালে নদীর পাড়ে হালকা কুয়াশা, বাতাসে নোনাজলের ঘ্রাণ। রিজুতা সেখানে আগে থেকেই বসে, একটি পুরনো নোটবুক হাতে, যা তার দাদুর ডায়েরি। সে জানে না কেন, কিন্তু আজকের দিনটা গুরুত্বপূর্ণ, যেন কোনো উত্তর মিলতে চলেছে বহু পুরনো প্রশ্নের। তার চোখে কালি, কারণ রাতটা কেটেছে অস্থিরতায়। ডায়েরির পাতাগুলো বারবার পড়েছে, কিন্তু সেসব লেখা যেন সম্পূর্ণ নয়, যেন কোথাও মাঝপথে থেমে গেছে। হঠাৎ দূর থেকে পায়ের শব্দ—রিজুতা মুখ তোলে, দেখে অরুণাভ আসছে, হাতে একটা খাতা, চোখে গভীর ক্লান্তি আর আশার মিশ্র ছায়া। তারা মুখোমুখি বসে, কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ। তারপর অরুণাভ প্রথম বলে ওঠে, “আমি আজ তোমাকে একটা পাগলামির গল্প বলতে চাই… বিশ্বাস না করলেও বলব।” রিজুতা একটু হেসে বলে, “পাগলামী না হলে প্রেম জমে না।” এই সহজ বাক্যটুকুই যেন অরুণাভকে সাহস দেয়।
সে বলতে শুরু করে—প্রতিদিন রাতে দেখা সেই স্বপ্ন, সেই মেয়ের কথা, যে তাকে বলে, “আমি বাস্তব নই, কিন্তু তোমার হৃদয়ে আছি।” বলে, কীভাবে সেই মেয়েটির মুখ প্রতিবার সে এঁকে গেছে, আর কীভাবে প্রথমবার রিজুতাকে দেখে সে চমকে উঠেছিল, কারণ রিজুতা একেবারে সেই মেয়েটির মতো। রিজুতা চুপ করে শোনে, চোখে বিস্ময়ের ছায়া, কিন্তু অরুণাভ যে সত্য বলছে, তা যেন তার প্রতিটি শব্দে ফুটে ওঠে। কিছুক্ষণ পর রিজুতা তার ডায়েরির সেই পাতাটা খুলে দেখায়, যেখানে তার দাদু লিখেছিলেন ‘নীলময়ী’র কথা। অরুণাভ স্তব্ধ হয়ে যায়—এই নাম সে কোনোদিন উচ্চারণ করেনি, কিন্তু সে জানে এই নামটাই মেয়েটির, সেই স্বপ্নের আত্মার। দুজনের মুখোমুখি নীরবতা যেন আচমকা গভীর হয়ে ওঠে, আর তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ে এক রহস্যময় অতীত—যার স্মৃতি তারা কেউই পুরোপুরি মনে করতে পারে না, কিন্তু অনুভব করে পুরোমাত্রায়। সময়টা কেমন থেমে যায়, নদীর জল ঠাণ্ডা হয়ে ওঠে, আর দূরে নৌকার বাঁশি ভেসে আসে। রিজুতা ধীরে বলে, “আমিও কখনো কখনো স্বপ্নে এক অদ্ভুত আলো দেখি… যেন কেউ ডাকছে। তবে কখনো মুখটা দেখতে পাইনি।” এবার অরুণাভ বলে, “সেই ডাক… আমারও ছিল। আমরা কি তাহলে কোনওভাবে যুক্ত? কোনো পুরনো জীবনের ছায়ায় বাঁধা?”
তাদের কথোপকথন দীর্ঘ হয়, তাতে প্রশ্নের চেয়ে জবাব কম, কিন্তু অনুভূতির গভীরতা এত বেশি যে ভাষা যেন চাপা পড়ে যায়। অরুণাভ নিজের খাতার পাতাগুলো রিজুতাকে দেখায়—সেই সমস্ত ছবি, যেগুলোতে মেয়েটির মুখ আঁকা, আর প্রতিটিই রিজুতার মতো। রিজুতা তেমন করে তাকিয়ে থাকে ছবিগুলোর দিকে, মুখে কোনো শব্দ নেই, কিন্তু চোখে কাঁপুনি। সে জানে, এমন মিল কেবল কাকতালীয় হতে পারে না। হঠাৎ নদীর ওপার থেকে একটা পাখি ডেকে ওঠে, আর অরুণাভ বলে, “আমার বিশ্বাস, তুমি সেই মেয়েটিরই প্রতিফলন… হয়তো আত্মা, হয়তো স্মৃতি, হয়তো পূর্বজন্মের প্রেম।” রিজুতা হাসে না, বরং বলে, “তবে কি স্বপ্ন বাস্তবকে ডেকে আনে?” এই প্রশ্নের উত্তর জানে না কেউই, কিন্তু তারা বুঝে যায়—দুজনের মাঝে কিছু গড়ে উঠছে, যা এই জীবনের শুরু নয়, বরং বহু জন্ম আগের কোনো অসমাপ্ত কাহিনির ধারাবাহিকতা। তখনই হঠাৎ আকাশে মেঘ জমে, বাতাসে একটা ঠান্ডা শিহরণ ওঠে, আর রিজুতা বলে, “আজ রাতে পূর্ণিমা… আমার মনে হয়, কিছু একটা ঘটতে চলেছে।” অরুণাভ মাথা হেঁট করে বলে, “আমি প্রস্তুত… যদি তুমি থাকো পাশে।” সেই মুহূর্তে বাস্তব ও স্বপ্নের সীমানা এক অদৃশ্য রেখায় মিশে যায়, আর তাদের দুজনের জীবনে ঢুকে পড়ে এক নতুন অধ্যায়ের সম্ভাবনা—যেখানে ভালোবাসা কেবল অনুভূতি নয়, এক অলৌকিক শক্তি, যা সময়, মৃত্যু, এবং যুক্তির সীমা পেরিয়ে ফিরে আসে।
৬
রাতটা ছিল এক নিঃসাড় জ্যোৎস্না-ভরা পূর্ণিমা। আকাশ ছিল মেঘমুক্ত, চাঁদের আলো নদীর জলে রূপালি কালি ঢেলে দিচ্ছিল। কাকদ্বীপের চারপাশে যেন এক অদ্ভুত স্তব্ধতা নেমে এসেছে, যার ভেতরে বাতাসও শব্দ না করে সরে যাচ্ছে। রিজুতা ঘরের জানালায় বসে বাইরের সেই অলৌকিক আলো দেখছিল, আর অরুণাভ পায়ে হেঁটে চলে যাচ্ছিল গ্রামের শেষপ্রান্তের দিকে—যেখানে পুরনো শ্মশানঘাট। মাধব দা’র কথা সে আগেই শুনেছিল এক চা-ওয়ালার মুখে—“পাগল সাধু, শ্মশানের ধারে থাকে, রাতের বেলা আগুনের ধোঁয়ার মধ্যে কীসব বলে নিজেই নিজেকে। তবে লোকটা বুজরুক না, কিছু একটা জানে।” অরুণাভর মনে পড়েছিল, রিজুতা একদিন বলেছিল এই শ্মশান ঘাটে এক বৃদ্ধ লোক আছেন, যিনি লোকচক্ষুর আড়ালে থাকেন, কিন্তু গ্রামের ইতিহাস, মৃত্যু, প্রেম আর পুনর্জন্ম নিয়ে অদ্ভুত কথা বলেন। পূর্ণিমার রাত, নদীর ধার, আর এতকিছুর মধ্যেও যদি সত্যের কোনো ছায়া থাকে, তাহলে তা এই মানুষটার কাছেই লুকানো থাকতে পারে—এই বিশ্বাসেই অরুণাভ পা বাড়ায়।
শ্মশানঘাটে পৌঁছে সে দেখতে পায় মাধব দা মাটি ফুঁড়ে ওঠা ধুপের ধোঁয়ার পাশে বসে আছেন, চোখ বুজে। চুল-দাড়ি সবই একাকার হয়ে গেছে, গায়ে ছেঁড়া কাপড়, হাতে কাঠির মাথায় লাল সুতো বাঁধা। হঠাৎ যেন চোখ না খুলেই বলে ওঠেন, “তোর মন দুলছে… স্বপ্নে দেখা মেয়ে আজও তোর ঘুমের ছায়ায় খেলে বেড়ায়, তাই না?” অরুণাভ চমকে ওঠে, সে কিছুই বলেনি এখনও। ধীরে ধীরে সামনে গিয়ে বসে পড়ে মাধব দার সামনে, কিছু না বলে। মাধব দা এবার চোখ মেলে তাকান—তাঁর দৃষ্টি ঝাপসা, কিন্তু অদ্ভুত ধারালো, যেন সময়ের পেছনে তাকিয়ে দেখেন। “নীলময়ী… তোদের প্রেম তো আগেও ছিল। আগেও তুই এসেছিলি এই নদীর পাড়ে… শুধু তখন নাম ছিল অন্য, শরীর ছিল অন্য, কিন্তু চোখদুটো ছিল এই একই রকম। আর সেই মেয়েটাও… রক্ত-মাংসের মানুষ হয়েও ছিল এক আত্মা। কিছু প্রেমের জন্ম হয় মৃত্যুর মাঝখানে।” অরুণাভ শিহরিত হয়। সে জিজ্ঞেস করে, “রিজুতা… সে কি নীলময়ী? না কি সে নিজের মতো কেউ?” মাধব দা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, “রিজুতা তার ছায়া… তার স্মৃতি… হয়তো তার পুনর্জন্ম, হয়তো কোনো অসমাপ্ত প্রতিশ্রুতির উত্তর। তুই যদি সত্যিকারের ভালোবাসিস, তাহলে সে আপনিই চিনে নেবে নিজেকে। কিন্তু মনে রাখিস, ভালোবাসা মানেই মিলন নয়, কখনো কখনো ভালোবাসা মানে শুধু মনে রাখা।”
এই কথাগুলো যেন ধাক্কা দিয়ে ছুঁয়ে যায় অরুণাভর ভিতর। সে ভাবে, এই প্রেম যদি সত্যিই পূর্বজন্ম থেকে চলে আসে, তবে কি এবারও তারা আলাদা হবে? সে কি এবারও শুধু স্বপ্নেই থাকবে, বাস্তবে নয়? মাধব দা আবার বলে ওঠেন, “পূর্ণিমার রাত যাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে, তাদের পথ সহজ হয় না। কিন্তু প্রেম যদি যথার্থ হয়, তবে সে স্বপ্নকেও বাস্তব করে তোলে। নোনাজলের ধারে তুই যাকে দেখেছিস, সে শুধু রিজুতা নয়, সে তোর ভিতরের ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি।” হঠাৎ পাশের খোলা আগুনের শিখায় এক ঝলক আলো ওঠে, আর সেই আলোয় অরুণাভ যেন দেখতে পায় রিজুতার মুখ—হাসিমুখ, চোখে জল, আর দূরে হারিয়ে যাওয়ার অভিমান। মুহূর্তটা খুব দ্রুত চলে যায়, কিন্তু অরুণাভ বুঝে যায়—সবকিছুর গভীরে একটা সত্য লুকিয়ে আছে, যেটা সে আর অস্বীকার করতে পারে না। সে চুপচাপ উঠে পড়ে, মাধব দার দিকে আরেকবার তাকায়—লোকটা তখন নিজের মতো করে আবার ধুপের ধোঁয়ায় চোখ বুজে বসে আছে। অরুণাভ ফিরে চলে আসে নদীর ধার বরাবর, বুকের ভেতরটা কেমন আলো-আঁধারি। আজ রাতেই সে রিজুতাকে সব বলবে, তার সিদ্ধান্ত, তার অনুভূতি, তার ভালোবাসা। স্বপ্ন যদি বাস্তবকে ডাকে, তবে আজই সে সেই ডাকে সাড়া দেবে। আর যেভাবেই হোক, আজ এই পূর্ণিমা রাতে সে ঠিক করবে—এই প্রেম শুধুই অদ্ভুত নয়, এই প্রেম চিরন্তন।
৭
রিজুতা সেদিন সারাদিন কথা বলেনি কারো সঙ্গে। তার চোখ যেন প্রতিটি শব্দ ছেঁকে দেখছিল, আর মনের ভেতর চলছিল এক অলক্ষ্য আলোড়ন। দাদুর পুরনো নোটবুকটা আবার বের করে সে খোলা জানালার ধারে বসেছিল, যেখানে চাঁদের আলো এখনও কাগজের গায়ে কালি ঢালছে। প্রতিটা পাতা আবার পড়ে যায়, সেই ঘন ঘন ব্যবহারে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া হ্যান্ডরাইটিংয়ের মধ্যে খুঁজতে থাকে কোনো চিহ্ন, কোনো বার্তা—যা তাকে বলবে সে কে, কোথা থেকে এসেছে, কেন তার স্বপ্নে নীল আলো ভেসে বেড়ায়, কেন অরুণাভর মুখ শুনে তার বুকের ভেতর এমন ধকধক করে। পাতা উল্টে এক জায়গায় এসে সে থমকে যায়। পাতাটার এক কোণে হঠাৎ কালি গাঢ়—“যদি সে ফিরে আসে, তাকে বলিস, আমি অপেক্ষা করেছি… শত বছর ধরে। আমার ভুলের ফল এখনো বহন করছে দুজন।” নিচে কোনও নাম নেই, কোনও তারিখ নেই। রিজুতা জানে না এটা দাদুর নিজের লেখা, নাকি অন্য কারোর, কিন্তু এই কথাগুলো যেন একদম তার মনের কথার প্রতিধ্বনি। সে এক আশ্চর্য দোলাচলে ভুগছিল—অরুণাভের সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত যেন তাকে আরও কাছাকাছি টেনে এনেছে, অথচ সেই টানের উৎসে ছিল এক ধরণের ভয়… যদি সবটা সত্যি হয়? যদি সে নীলময়ীর আত্মা হয়, তবে রিজুতা নিজে কে?
বিকেলের দিকে অরুণাভ এসে দাঁড়ায় তার দাওয়ায়। তার মুখে ক্লান্তি, চোখে দৃঢ়তা। রিজুতা প্রথমে চুপ করে থাকে, কিন্তু অরুণাভ সরাসরি বলে ওঠে, “রিজুতা, আজ কিছু লুকাতে চাই না। আমি বিশ্বাস করি তুমি শুধু রিজুতা নও। আমি জানি এটা অদ্ভুত শোনাবে, কিন্তু আমি মনে করি আমরা এক অসমাপ্ত প্রেমের উত্তরাধিকারী। আমি গতকাল মাধব দার কাছে গিয়েছিলাম।” এই নাম শুনে রিজুতা শিউরে ওঠে—ছোটবেলায় দাদু তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই শ্মশানের কাছে একবার, তখন থেকেই মাধব দার নাম তার মনে গেঁথে আছে। অরুণাভ সব খুলে বলে—কীভাবে স্বপ্ন, স্মৃতি, পুরনো ছবি, আর সেই অলৌকিক অনুভূতিগুলো একসাথে মিশে গেছে তার মধ্যে, এবং কীভাবে মাধব দা তাকে বলেছেন যে সত্যিকারের প্রেম শুধু শরীর নয়, আত্মারও মিলন চায়। রিজুতা ধীরে ধীরে বলে, “আমার মাঝেও কিছুটা কিছুদিন ধরে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। স্বপ্নে এক আলো, এক নদীর ধার, এক পুরুষের কণ্ঠ… যাকে দেখা যায় না, কিন্তু তার উপস্থিতি অনুভব করা যায়। এখন আমি বুঝতে পারছি, সেটা কেবল কল্পনা নয়।”
তারা দুজনই চুপ করে পড়ে কিছুক্ষণ, যেন নিজেদের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল গভীর কোনো স্তরে। রিজুতা তখন অরুণাভর দিকে তাকিয়ে বলে, “এই যে সব কিছু—আমরা কি সেটা মেনে নিতে পারি? আমাদের ভালোবাসা যদি পূর্বজন্মের ধারাবাহিকতা হয়, তবে আমরা কি নিজেরা ভালোবাসছি, না কি কেবল তার প্রতিধ্বনি?” প্রশ্নটা কঠিন, উত্তর নেই সহজে। অরুণাভ ধীরে মাথা নাড়ে, “আমি জানি না… কিন্তু আমি জানি, এই ভালোবাসা আমি এখন অনুভব করছি। এটা অতীতের ছায়া হলেও, বর্তমানের আলো তাতে পড়ছে। আমি তোমাকেই ভালোবাসি, যে রিজুতা—সে নীলময়ী হোক বা না হোক।” রিজুতা তখন চুপচাপ একটা পুরনো পাতা ছিঁড়ে অরুণাভর হাতে দেয়। সেখানে দাদু লিখেছিলেন—“ভালোবাসা কখনো মুছে যায় না, সে সময়ের গর্ভে অপেক্ষা করে। একদিন সে আবার ফুল ফোটায়।” অরুণাভ সেই লেখা হাতে নিয়ে অনুভব করে—এই মুহূর্তে তারা কেবল কোনো প্রেমিক-প্রেমিকা নয়, তারা যেন এক দীর্ঘ ইতিহাসের বাহক, যাদের হৃদয়ে বয়ে চলছে শতাব্দীর পুরনো সুর। তারা জানে না আগামীতে কী আছে—মুক্তি, না বন্ধন, মিলন না বিচ্ছেদ—তবে এতটুকু জানে, আজকের এই সন্ধ্যা, এই শ্বাস, এই চোখে চোখ রাখা… এটা তাদের নিজের, একেবারে নিজের। সময় থেমে যায় কিছুক্ষণের জন্য, আর বাতাসে কুয়াশার সঙ্গে এক অদৃশ্য গান বয়ে যায়—যেন সেই অলিখিত দিনলিপির কোনো হারিয়ে যাওয়া লাইন, যা আজ আবার নতুন করে লেখা হচ্ছে।
৮
কাকদ্বীপে হঠাৎ করে বাতাস পাল্টে যেতে থাকে। যেন সবকিছু ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছে এক অদৃশ্য ঘোরে। বৃষ্টি না হলেও আকাশ ভারী, পাখিরা অকারণে চুপ হয়ে গেছে। অরুণাভ আর রিজুতা বুঝতে পারে, তাদের মধ্যেকার সম্পর্কটা এখন আর শুধু অনুভবের স্তরে নেই—এটা পার করছে এক ধরণের পরীক্ষার পর্ব, যেখানে বাস্তব আর অলৌকিক, প্রেম আর পুনর্জন্ম, চেতনা আর অচেতনার সীমারেখা ধুয়ে যাচ্ছে। সেই সন্ধ্যায় তারা হাঁটতে বেরিয়েছিল নদীর ধার বরাবর, কিন্তু আজ জায়গাটা আগের চেনা নদীপাড়ের মতো মনে হয় না। যেন প্রত্যেকটা গাছ, ঘাসের পাতাও তাদের দিকে তাকিয়ে আছে—আচানক এক নিঃশব্দ সাক্ষী হয়ে। এমন সময় রিজুতা হঠাৎ থেমে যায়। অরুণাভ কিছু বলতে যাবার আগেই সে বলে ওঠে, “তুমি কি এই জায়গাটাকে ঠিক আগেও দেখেছ? মনে হয় না, এটা শুধু এই জন্মের জায়গা না।” কথাটা শুনে অরুণাভ গা ছমছম করে ওঠে। জায়গাটা ঠিক সেই পুরনো নদীর বাঁক, যার স্বপ্ন সে এতদিন দেখে এসেছে। এবার স্বপ্ন আর বাস্তব এক হয়ে গেছে, এতটাই নিখুঁতভাবে, যেন পৃথিবী নিজেই ভুলে গেছে—এটা কোনো এক দুঃস্বপ্ন না, কিংবা অতীত না—এটাই এখন।
ওইখানেই একটা পুরনো অশ্বত্থ গাছের গোড়ায় তারা দুজন বসে পড়ে। অরুণাভর হাতে তখনো সেই পুরনো পাতাটা—যেটা রিজুতা দিয়েছিল, দাদুর হাতের লেখা। হঠাৎ করে পাতাটার মাঝখানে কিছু অদ্ভুত দাগ ফুটে ওঠে, যেন জলচিহ্ন নয়, আবার রক্তও নয়। একপ্রকার ধোঁয়া ধোঁয়া লেখা ভেসে ওঠে—”প্রেম শুধু ভালোবাসার নাম নয়, প্রেম মায়া। আর মায়া মানেই পুনরাবৃত্তি। যতবার ভুল করবে, ততবার ফিরে আসবে।” তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে নিঃশব্দে। ঠিক তখন, অশ্বত্থ গাছের ডালে বসে থাকা একটি শালিক হঠাৎ ডেকে ওঠে—কিন্তু সেই ডাকটা পাখির নয়, যেন একজন নারীর দীর্ঘশ্বাস! অরুণাভর মনে পড়ে, স্বপ্নে রিজুতা একবার ঠিক এই আওয়াজের পরেই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। সে ধীরে ধীরে বলে, “এই জায়গাটা আমাদের কোনো স্মৃতির মতো। এখানে কিছু ঘটেছিল—পুরনো কোনো ব্যথা, কোনো বিচ্ছেদ, কোনো অসমাপ্ততা…” রিজুতা হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়, তার চোখ দুটো কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। “আমার মনে পড়ছে,” সে ধীরে বলে, “এই গাছটার নিচেই আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল। আমি সেদিন চেয়েছিলাম তোমায় রুখে দিতে, চলে যেতে বলেছিলাম। কারণ আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল অন্য কারো সঙ্গে। আমি তখনো ভালোবাসতাম তোমাকে, কিন্তু সমাজ, নাম, বাধ্যবাধকতা—সব মিলিয়ে আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম নিজের প্রেম থেকে।”
মুহূর্তটা থমকে যায়। যেন একটা গভীর আত্মা দু’জনের শরীর পেরিয়ে ভিতরে ঢুকে গেছে। অরুণাভ ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে রিজুতার সামনে যায়, তার কাঁধে হাত রাখে। “তবে এবার পালিয়ে যেও না,” সে বলে। “এই জন্মে আমাদের কাছে আছে আরেকটা সুযোগ। আমরা যদি সেই মায়ার রেখা পার করতে পারি, যদি নিজের ভুলগুলো মেনে নিতে পারি, তবে হয়তো মুক্তি সম্ভব।” রিজুতা তখন আবার শালিকের ডাক শোনে, কিন্তু এবার সেটি কেবল দীর্ঘশ্বাস নয়, যেন কোনো প্রাচীন গান—এক নারী গুনগুন করে গাইছে, যার সুরে বয়ে যায় নদী, গাছ, আকাশ আর আগুন। সেই গানের মধ্যে হঠাৎ করে রিজুতা বলে ওঠে, “আমি চাই, তুমি আমায় আবার নতুন করে ভালোবাসো। নীলময়ী নয়, রিজুতা হিসেবে। আমায় আবার খুঁজে নাও, যেভাবে একটা প্রেমিক তার প্রেমিকাকে খোঁজে, একেবারে প্রথমবারের মতো।” অরুণাভ মাথা ঝাঁকায়, তার চোখে জ্যোৎস্নার মতো প্রতিশ্রুতি। তারা দুজন তখন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকে অশ্বত্থ গাছের নিচে, আর চারপাশে ধীরে ধীরে সূর্যের শেষ আলো মিলিয়ে গিয়ে উঠে আসে ছায়া—কিন্তু এই ছায়া আর ভয়ের নয়, এই ছায়া যেন এক অন্তরঙ্গ আলিঙ্গন, যেখানে প্রেম আর পূর্বজন্মের ব্যথা মিশে গেছে, একে অপরকে চেনার নতুন সুযোগের ভেতর।
এই অদ্ভুত বাস্তবতায় তারা জানে না শেষ কোথায়, তবে এটা নিশ্চিত—তারা আবার ভালোবাসতে শুরু করেছে। পুনর্জন্মের গল্প নয়, এটা পুনরাবিষ্কারের গল্প। মায়ার রেখা হয়তো এখনো পেরোনো বাকি, কিন্তু অন্তত এই জন্মে তারা দুজন হাতে হাত রেখে এগোচ্ছে সেই রেখার দিকে, সাহসে, অনুভবে, আর অনন্ত প্রেমে।
৯
সেদিন রাতটা অদ্ভুতভাবে স্তব্ধ ছিল। কোনো কুকুর ডাকেনি, না কোনো শালিক ডেকেছে, এমনকি হাওয়াটাও চলেনি, যেন পুরো কাকদ্বীপ জমে আছে এক অলিখিত মুহূর্তের অপেক্ষায়। রিজুতা আর অরুণাভ বসেছিল ঘরের চৌকাঠে, চোখের সামনে খোলা জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল দূরের কালো নদী। বাতাসে ভেসে আসছিল শিউলি ফুলের গন্ধ, আর তার মাঝেই অরুণাভ ফিসফিস করে বলল, “রিজুতা, তুমি কি কক্ষনো সেই নদীটা দেখেছো?” সে বলছিল স্বপ্নের নদীর কথা, যেখানে এক অলৌকিক আলো ঠিকরে পড়ে এবং সেই নদীর কিনারায় এক নারী তার দিকে ফিরে তাকায় না, শুধু হাঁটে, ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় কুয়াশায়। রিজুতা চমকে ওঠে, “তুমি কি বলছো… সেই স্বপ্নে নীল আলো, আর সেই মেয়েটি যে বারবার ফিরে আসে?” তারা দুজন একে অপরের মুখের দিকে তাকায়, যেন বুঝতে পারে—তাদের স্বপ্নগুলো আলাদা নয়, বরং একটাই—একটি স্মৃতির নদীর ধার, যা দুজনকে বারবার ফিরিয়ে নিয়ে যায় পূর্বজন্মের অন্ধকার স্রোতে।
পরদিন ভোরবেলা তারা রওনা দেয় সেই নদীর দিকে, যেটাকে অরুণাভ আগে কখনো দেখেনি, অথচ আজ মনে হচ্ছিল সেই নদীপাড়ে তার শৈশব, কৈশোর, এমনকি কোনো এক বিস্মৃত জন্ম গেঁথে আছে। পথে যেতে যেতে তারা দেখে ছোট ছোট সংকেত—এক পুরনো ঘাট, যেখানে লতাগুল্মে ঢেকে আছে সিঁড়ি; এক ছেঁড়া কাঁসার কাঁসর, পড়ে আছে জলের ধারে; আর একটা শালবনের মাঝখানে একটা ঘর, যেটা যেন বারবার ডাকছে। তারা চুপচাপ এগিয়ে যায়, কথা নেই, কেবল চোখের ভাষা আর মনের প্রবাহ। ঘাটে পৌঁছে নদীটাকে দেখে অরুণাভ চুপ করে যায়। ঠিক যেমনটা তার স্বপ্নে আসে—নদীটা শান্ত, ধীরে ধীরে বয়ে চলেছে, আর তার জলে পড়ছে এক অদৃশ্য আলো, যা সূর্য নয়, কিন্তু ঠিক স্বপ্নের মতো নীল। সে ভাবে, এই আলোটা কোথা থেকে আসে? আকাশ থেকে নয়, জল থেকে নয়—হয়তো হৃদয় থেকে। রিজুতা তখন ধীরে ধীরে বলে, “আমার মনে পড়ছে এখন। আমি এখানেই বসে কাঁদতাম, যখন তোমার জন্য বুকটা ভেঙে যেত। তুমি বারবার বলতে, ‘চলো, পালিয়ে যাই’, আর আমি বারবার বলতাম, ‘পারব না’। কিন্তু আজ, আমি পালাতে চাই—ভালোবাসার দিকে।”
নদীর পাশে দাঁড়িয়ে তারা হাত ধরাধরি করে, আর হঠাৎ করেই চারপাশটা বদলে যায়। যেন সময় নিজেই গলে গিয়ে ঢুকে পড়ছে অন্য এক স্তরে। ঘাটের সিঁড়িতে হঠাৎ তারা দেখতে পায় এক ছায়ামূর্তি—একজন নারী, শাড়িতে মুখ ঢেকে, ধীরে ধীরে নিচে নামছে। তার পেছনে একজন পুরুষ, মুখ ঝাপসা, কাঁধে একটা থলে। রিজুতা আর অরুণাভ বুঝতে পারে, তারা নিজেরাই দেখছে নিজেদের পুরনো আত্মাকে। সেই আত্মারা হয়তো তখন পালাতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। হয়তো বাধা এসেছিল পরিবার, সমাজ, কিংবা নিজের দ্বিধা থেকে। আর আজ, এই জন্মে, যখন তারা আবার ফিরেছে, এই নদীর সামনে, তখন তারা শুধু দেখে না, তারা অনুভব করে—ভুলটা কোথায় হয়েছিল, কেন সেই প্রেম অসমাপ্ত থেকে গিয়েছিল। হঠাৎ করেই নদীজলটা কেঁপে ওঠে, যেন কোনো প্রাচীন ব্যথা আবার জেগে উঠেছে, আর সেই কাঁপন থেকে জেগে ওঠে এক লুকিয়ে থাকা গলা—“ভালোবাসা কোনো অপরাধ নয়। অপরাধ হল তার অস্বীকার। একবার যদি প্রেম কে স্বীকার করো, তবে সেও তোমার জন্য সময় থামিয়ে দেবে।”
এই অলৌকিক শব্দ শুনেই রিজুতা কেঁপে ওঠে, তার চোখে জল চলে আসে। “তোমার মনে আছে? আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম—যদি এক জন্মে না হতে পারি, পরের জন্মে ঠিক হবো,” সে বলে ওঠে। অরুণাভ ধীরে তার গাল ছুঁয়ে বলে, “আমার আত্মা মনে রেখেছে। তাই তো আমি আজ এখানে।” দুজনের চারপাশে বাতাস ঘুরপাক খায়, আর সেই বাতাসে শিউলি আর ধূপের গন্ধ—যেন কোনো অদৃশ্য পূজা চলছে, যেখানে দেবতা কেবল প্রেম। নদীর বুকে পড়ে আলো আর ছায়া, আর সেই আলোয় তারা বুঝে যায়—এই নদীটা কেবল জলের নয়, এই নদীটা তাদের স্মৃতির, তাদের ভুলের, তাদের ভালোবাসার, তাদের ভাঙাগড়ার।
সেই দিনটা কোনো নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয়নি। সূর্য ওঠে, কিন্তু তাদের জন্য সেটা কেবল আলো নিয়ে আসেনি—আনছে এক নতুন বোঝাপড়া, নতুন সাহস। তারা জানে, মায়ার রেখা তারা পেরিয়ে এসেছে, এখন তারা দাঁড়িয়ে আছে স্মৃতির নদীর কিনারায়, যেখানে জল আর আলো মিশে তৈরি করেছে এক পথ—যেটা ভবিষ্যতের দিকে যায়। প্রেম আর পুনর্জন্ম নয়, এবার তারা খুঁজে পেয়েছে স্বীকারোক্তি। সেই নদীর সামনে তারা দুজন দাঁড়িয়ে থাকে, নিঃশব্দে, হৃদয়ে প্রতিধ্বনি নিয়ে—যা বলে, “তোমরা প্রস্তুত হলে, সময়ও মুক্তি দিতে জানে।”
১০
যেদিনটা শুরু হয়েছিল নরম রোদের আলোয়, সেদিন সকালেই অরুণাভ আর রিজুতা ফিরে এসেছিল সেই নদীর ঘাট থেকে—নিঃশব্দ, কিন্তু সম্পূর্ণ বদলে গিয়ে। তাদের চোখে তখন আর বিভ্রান্তি নেই, কোনো দ্বিধা নেই, নেই ছায়াময় প্রশ্নের মেঘ। তারা যেন ঠিক জেনে গেছে—এই প্রেম, এই পুনর্জন্ম, এই বাস্তব আর অবাস্তবের জটিলতা—সবটাই আসলে এক আত্মিক সত্যের বহিঃপ্রকাশ। সকালটা ছিল শান্ত, অথচ গভীর। কাকদ্বীপের মানুষজন তখনও জানত না—তাদের গ্রামের বুকে এমন একটা প্রেম জন্ম নিয়েছে, যেটা কেবল দেহ নয়, আত্মাকেও ছুঁয়েছে, সময়কেও প্রশ্ন করেছে। অরুণাভের মনে হচ্ছিল, তার সমস্ত জীবন যেন এই কয়েক দিনের মধ্যে নতুন করে বোনা হয়েছে। রিজুতা তার পাশে বসে থেকেও মনে হচ্ছিল দূরের কোনো দ্যুতিময় মূর্তি—যার হাসি কোনো জন্মের নয়, বরং চিরন্তন আলোয় গড়া।
সেই দিন বিকেলে তারা হেঁটে যায় দাদুর পুরনো বাড়ির দিকে। অরুণাভর মনে হয়, যে চিঠিটা তার হাতে এসেছিল, যেটা এই পুরো যাত্রার সূচনা করেছিল—সেটা শুধু দাদুর চিঠি ছিল না, সেটা ছিল এক পরম্পরার ডাক। তারা দোতলার ঘরে ঢুকে দেখে, পুরনো আলমারির মধ্যে আজও রাখা সেই কবিতার খাতা—যেটা দাদু রোজ লিখতেন, যেটার পাতায় পাতায় লেখা ছিল “নীলময়ী”-র নাম। রিজুতা ধীরে বইটা নিয়ে বসে, আর পড়তে শুরু করে। লাইনগুলো যেন কোনো দাদু নয়, অরুণাভই লিখেছিল—এতটাই চেনা, এতটাই সমান্তরাল। “যদি আবার জন্ম নেই, তবে আমি চাই, সেই চোখ দুটো যেন আবার আমার দিকে তাকায়। সেই চোখ যেখানে অনন্ত, যেখানে মায়া, যেখানে প্রেমের মৃত্যু নেই।” তারা বুঝতে পারে, তাদের প্রেম কোনো ব্যক্তিগত গল্প নয়—এটা একটা চক্র, এক চিরন্তন আকর্ষণ, যেটা বারবার জন্ম নেয়, বারবার খুঁজে ফিরে তার সঙ্গীকে, হারিয়ে যাওয়া অনুভবকে। সেই সন্ধ্যায়, যখন গ্রামের আলো একে একে নিভে যায়, তখন তারা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখে চাঁদ উঠছে। চাঁদটা আজ একটু বেশিই উজ্জ্বল, যেন তাকে ছুঁলে মুছে যাবে সমস্ত যন্ত্রণার ছায়া।
রাত গভীর হলে, তারা চুপচাপ নদীর দিকে ফিরে যায়—শেষবারের মতো। নদীর পাশে দাঁড়িয়ে তারা দুজন একে অপরের দিকে তাকায়, আর বুঝতে পারে—এই প্রেম বাস্তবের থেকেও বড়। তারা জানে, এই জীবন হয়তো সবার চোখে খুব সাধারণ, কিন্তু তাদের জন্য এটা অসাধারণ—কারণ তারা এই জীবনে শুধু প্রেম করেনি, তারা প্রেমকে চিনেছে, মান্য করেছে, সম্মান দিয়েছে। ঠিক সেই মুহূর্তে, নদীর মাঝখান থেকে উঠে আসে এক আলো, যেটা রিজুতার শরীর ছুঁয়ে যেন বলে ওঠে—“তুমি পারলে।” অরুণাভর কাঁধে রাখা হাতটা হঠাৎ করে কেঁপে ওঠে, কিন্তু সে কিছু না বলে শুধু তাকিয়ে থাকে রিজুতার চোখে, যেখানে আছে অজস্র জন্মের ছায়া, অগণন ভুলের করুণা, আর এক অদ্ভুত রকম ক্ষমার আলো। তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে, কোনো কথা ছাড়াই, কোনো প্রতিশ্রুতি ছাড়াই। সেই জড়িয়ে ধরা ছিল এক প্রাচীন অঙ্গীকার—যেটা ভাষায় বলা যায় না, শুধু অনুভব করা যায় আত্মার স্তরে।
সকাল হলে, কাকদ্বীপের মানুষজন দেখে, নদীর পাশে বসে আছে দুজন—অরুণাভ আর রিজুতা, নিঃশব্দ, নিস্তব্ধ, কিন্তু মুখে এক অদ্ভুত শান্তি। কেউ জানে না তাদের মধ্যে কী ঘটেছে, বা কীভাবে সেই ছেলেটি যে শহর থেকে এসেছিল, আর সেই মেয়েটি যে এক পুরনো গল্পে বাস করত—তারা কীভাবে এক হয়েছে। কিন্তু লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে—নদীর ঘাটে এক ‘অদ্ভুত প্রেম’-এর গল্প, যেখানে প্রেম বাস্তব ছিল না, অথচ তার প্রমাণ ছিল সর্বত্র। হয়তো এর পরেও কোনো ছেলেটি রাতে স্বপ্নে দেখবে এক মেয়েকে, যে বলবে, “আমি বাস্তব না, কিন্তু তোমার হৃদয়ে আছি।” আর হয়তো সেই ছেলেটিও একদিন নদীর কিনারায় এসে বসবে, এক অদ্ভুত আলোর খোঁজে, এক আত্মিক পুনর্জন্মের অপেক্ষায়। কেননা প্রেমের গল্পের শেষ নেই, সে শুধু রূপান্তরিত হয়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, এক নদী থেকে আরেক নদীর চরে, আর রয়ে যায়—একটা অদ্ভুত প্রেম হিসেবে, যা স্বপ্ন, যা সত্য, আর যা চিরন্তন মায়া।
সমাপ্ত




