Bangla - ভূতের গল্প

রক্তচোখা

Spread the love

সুদীপ নাগ


অধ্যায় ১

অতিথি নয়, আপনজন হিসেবেই ফিরেছিল বিনয় হালদার সুন্দরবনের সেই ঘরটিতে—যেখানে তার শৈশব কেটেছিল, বাপ-ঠাকুর্দার স্মৃতি মিশে আছে গাছের পাতায়, মাটির গন্ধে। শহুরে জীবনের ধকল, চাকরির অনিশ্চয়তা আর মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে স্থায়ীভাবে ফিরে এসেছিল পৈত্রিক ভিটেয়, সেই নদীঘেরা গ্রামে যেখান থেকে তার পূর্বপুরুষেরা একদিন নৌকা নিয়ে মধু সংগ্রহ করতে যেত, কাঁকড়া ধরত, গরান কাঠ চেনে ফিরত সন্ধ্যাবেলায়। সঙ্গে এসেছে স্ত্রী নন্দিনী ও সাত বছরের মেয়ে তিতলি। তিনটি মানুষ, তিন রকম মনোভাব নিয়ে ফিরেছে এই ঘরে। বিনয় যেন আশ্বাস খুঁজছিল, জীবনের ক্লান্ত ছন্দে ছুটি চাইছিল; নন্দিনী ফিরছিল সংশয়ে ভরা চোখে, বুকের গভীরে অজানা আতঙ্ক নিয়ে; আর তিতলি এসেছিল নিরীহ কৌতূহল নিয়ে—যা কোনো শিশু ধারণ করে অজানা এক ভূখণ্ডে পা রাখার সময়। গ্রামের মাটির রাস্তা, বাঁশঝাড়ের পাশে ছায়াঘেরা পথ, পুকুরঘাটের নীরবতা—সবকিছুই যেন এক অদ্ভুত ছন্দে ফিরে এসেছিল তাদের সামনে, অথচ তার নিচে চাপা ছিল কিছু অনুচ্চারিত অভিজ্ঞতা, যেগুলোর কথা কেউ খোলসা করে বলে না, কিন্তু চোখে মুখে একটা চাপা ভয় রেখে দেয়। মাধবী হালদার, বিনয়ের মা, ছেলের ফিরে আসায় খুশি হলেও চট করে হাসলেন না; বরং বারবার বললেন, “এই সময়টা ভালো না রে… তুই তো জানিস পূর্ণিমার আগের দিনগুলোতে খালি বাতাস ভারী লাগে।”

ঘরটিতে ঢুকেই যেন এক প্রাচীন গন্ধে ভরে গেল নন্দিনীর শ্বাস। কাঠের আলমারি, কাঁসার বাসন, দেয়ালে ঝুলে থাকা হলদে হয়ে যাওয়া ছবি, আর সিলিং ফ্যানের ঘুরন্ত শব্দ—সবকিছুই যেন এক অন্য জগতের অংশ ছিল। ঘরের চারপাশে সিঁদুর মাখা তুলসী গাছ, লতাপাতা দিয়ে ঘেরা জানালাগুলো যেন দিনের আলো ঢোকালেও রাতের অন্ধকার ঠেকাতে অক্ষম। প্রথম রাতেই নন্দিনী শুনতে পেল বাইরে কোথাও হঠাৎ করেই কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুরু হয়েছে—তা যেন থামতেই চায় না, আবার হঠাৎ থেমেও যায় একসাথে। ঘরের মধ্যে পাখির পালক পাওয়া গেল সকালে, অথচ কোথাও জানালা খোলা ছিল না। তিতলি বারবার মাকে জিজ্ঞেস করছিল, “মা, তুমি জানো? কাল রাতে আমি জানালার কাছে এক আপুকে দেখেছিলাম। সে আমার সঙ্গে কথা বলছিল। তার চোখ লাল হয়ে জ্বলছিল।” নন্দিনী প্রথমে শিশুসুলভ কল্পনা ভেবে উড়িয়ে দিলেও মাধবী চমকে উঠলেন। তিনি আর এক মুহূর্ত দেরি না করে নিমপাতা আর হলুদ ছাই দিয়ে বাড়ির চারপাশে রেখা কেটে দিলেন, দরজার পাশে বাঁশের তালার নিচে ছোট্ট এক তাবিজ বেঁধে রাখলেন। বিনয় বিরক্ত হলেও চুপ করে রইল—গ্রামের বাতাসে এমন কিছু ছিল, যা যুক্তির কাছে ধরা দেয় না, কিন্তু অস্তিত্বের গভীরে স্পর্শ করে। প্রতিবেশীরা বিনয়ের ফেরার খবর পেয়েও কেউ আসেনি অভ্যর্থনা জানাতে। বরং বিকেল নামতেই কেমন যেন সবাই দরজা বন্ধ করে ফেলছিল, আর সন্ধ্যার পর রাস্তা যেন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল।

দিন তিনেকের মধ্যে তিতলি ক্রমেই গম্ভীর হয়ে উঠতে থাকল। সে আর আগের মতো দৌড়ে বেড়ায় না, খেলনা নিয়ে খেলে না। শুধু বারান্দায় বসে দূরে নদীর দিকে চেয়ে থাকে। একদিন সকালে সে বলল, “মা, দিদি বলেছে আজ রাতে সে আবার আসবে। তার নাম রক্তচোখা।” নন্দিনী আঁতকে উঠেছিল। সে নাম সে শুনেছে তার শাশুড়ির মুখে, খোকা নামের গ্রামের এক মাতাল পাগলের মুখেও, যাকে কেউ গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু শিশুর মুখে সেই নাম শোনার পর যেন শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। সেই রাতের আকাশ ছিল অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। চাঁদ উঠেছিল অকাল পূর্ণিমার মতো, অথচ পঞ্জিকায় তারিখ মিলছিল না। দূরের গরান গাছগুলোর ছায়া যেন ঘন হয়ে ঘনিয়ে ঘরের জানালায় এসে থেমেছিল। বাতাস নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল এমনভাবে, যেন জঙ্গলের সব প্রাণী তাদের নিঃশ্বাস বন্ধ করে রেখেছে। জানালার কাঁচে এক সময় যেন হালকা কুয়াশা জমে উঠেছিল, আর সেই কুয়াশার মধ্যেই দুটি চোখ জ্বলে উঠেছিল কয়েক সেকেন্ডের জন্য—লাল, হিংস্র, অথচ গভীরভাবে দুঃখে ভরা। বিনয় টেরই পায়নি কখন যেন গ্রামের এই নির্জন ঘরটা রাত নামলেই একটা অপেক্ষার স্থানে রূপান্তরিত হয়েছে। পূর্ণিমা এগিয়ে আসছে—আর সেই সঙ্গে কিছু একটাও যেন এগিয়ে আসছে—ধীরে ধীরে, নীরবে, প্রতিশোধের পায়ের শব্দ ফেলে।

অধ্যায় ২

রাতের নিস্তব্ধতা যেন সুন্দরবনের গভীর নিঃশ্বাস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বিনয়দের কাঁচা বাড়ির চারপাশে। দিনের বেলায় গ্রামের ছেলেপুলেরা নদীতে ঝাঁপ দেয়, মহিলারা ঘাটে বসে গসিপ করে, আর পুরুষেরা জঙ্গলের ধার ঘেঁষে জীবিকার সন্ধানে ব্যস্ত থাকে—কিন্তু সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গেই যেন এই গ্রামের রক্তপ্রবাহ থেমে যায়। তিতলি সেই নীরবতার মধ্যেই একদিন হঠাৎ বলল, “মা, ওই দিদি জানালার পাশে দাঁড়ায়, আমার সঙ্গে খেলা করে না… শুধু তাকায়।” সে কথাটা বলে নিরীহ ভঙ্গিতে ঘরের কোণায় বসে আঁকতে লাগল—একটি নারীছায়া, চোখ দুটি লাল, শরীর কুয়াশায় ঢাকা। প্রথম দিন নন্দিনী সেটাকে শিশুসুলভ কল্পনা ভেবেই উড়িয়ে দিয়েছিল। শহরের বাসিন্দা সে, যুক্তিবাদী, কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না। তবু তিতলির ছবিগুলো দিনে দিনে আরও গা ছমছমে হয়ে উঠতে থাকল, আর তার চোখে মুখে ভয়ের ছায়া ঘনীভূত হতে লাগল। মাধবীও এবার সতর্ক হয়ে উঠলেন। তিনি সিঁদুরে ভিজানো তুলসীপাতা দিয়ে ঘরের দরজার সামনে রেখা আঁকলেন, নিমপাতা পুড়িয়ে ঘরে ধোঁয়া দিলেন, আর জানালার চারকোণ বাঁশের গাছের ডাল দিয়ে বেঁধে দিলেন—বলে উঠলেন, “ও যদি আসে, যেন ঢুকতে না পারে। জানালার পথ বন্ধ করতেই হবে।”

নন্দিনী তা দেখে বিরক্ত হয়েছিল। “এসব বাঁশের ডাল, ছাইপোড়া ধোঁয়া দিয়ে কী হবে, মা?”—সে জিজ্ঞাসা করেছিল। মাধবী কেবল বলেছিলেন, “সব কিছু চোখে দেখা যায় না বউমা, রক্তচোখা তো চোখে পড়ে না, সে তো অনুভবে আসে।” কথাগুলো তখন নিছক গ্রামীণ আতঙ্ক মনে হয়েছিল নন্দিনীর কাছে, যতক্ষণ না পর্যন্ত সেই রাতের ঘটনা ঘটে। চাঁদ ছিল ঝকঝকে, যেন ঝলসানো রুপোর থালা, আকাশে একটাও মেঘ নেই অথচ বাতাস ভারী, স্থবির, একটা অজানা চঞ্চলতা যেন প্রবাহিত হচ্ছিল পরিবেশে। তিতলি সেদিন হঠাৎ জ্বর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল আর বারবার ঘুমের ঘোরে কেঁপে উঠছিল। রাতে হঠাৎ তিতলির গলা শুনে ঘুম ভাঙে নন্দিনীর—সে ফিসফিস করে বলছিল, “দিদি আবার এসেছে মা… এবার সে বলে, তোর চোখে চোখ রাখব।” নন্দিনী কাঁথা ঠিক করে মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে আবার শুয়ে পড়েছিল, কিন্তু খানিক বাদে জানালার কাছে হালকা একটা শব্দ শুনে তার গা ছমছম করে ওঠে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে, কাঁচের বাইরে যেন এক ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। একটানা তাকিয়ে থাকে সে কুয়াশার মতো আবছা মুখের দিকে—তখনই সেই চোখ দুটো জ্বলে ওঠে। ধাঁধা লাগানো, নিস্তব্ধ লাল আলো। যেন চোখ নয়—দুটি পোড়া কুয়াশার গর্ত যা থেকে নিঃশব্দে বেরোয় তাপ ও ভয়ের ঢেউ। নন্দিনী হিম হয়ে যায়—চিৎকার করতে পারে না, গলা শুকিয়ে যায়।

পরদিন সকালে সে কিছু না বলেই সোজা গিয়ে বসে পড়ে মাধবীর সামনে। “আপনি ঠিক বলেছিলেন… আমি দেখেছি…”—এইটুকু বলেই থেমে যায়। মাধবী শুধু মাথা নেড়ে বলেন, “তুমি চোখে দেখেছো, আমি অনুভবে পাই… রক্তচোখা ফিরে এসেছে।” ঘরের সবাই তখন কেমন এক ঘোরে দিন কাটাতে থাকে। বিনয় অবশ্য এসব মানতে চায় না, তার যুক্তিবাদী মন তা মেনে নিতে পারে না। সে বলে, “এই কুয়াশা, এই আলো, এসব অপটিকাল ইলিউশন—মা, এসব গ্রামে থাকলে মাথায় চাপ দেয়।” কিন্তু তার নিজের মধ্যেও একরকম অস্বস্তি জন্ম নিচ্ছে—সে যেন ঘরের চারপাশে অদৃশ্য কিছু অনুভব করে, নদীর দিকে তাকিয়ে বুকের মধ্যে খালি ভয় জমে ওঠে। আর তিতলি এখনো মাঝে মাঝে বলে, “দিদি জানে আমি ওকে দেখতে পাই… তাই ও আর আমাকে ভয় দেখায় না, কিন্তু তোমাকে করবে মা।” এইসব কথার মধ্যে যে সরলতা ছিল, তার নিচে লুকিয়ে ছিল ভয়ের কাঁপুনি। একদিন দুপুরবেলায়, খোকা হঠাৎ ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। সেদিন সে মাতাল ছিল না। চোখ লাল, মুখ থমথমে। সে বলল, “জানালার চোখ যেদিন আলোয় জ্বলে ওঠে, সেদিন কাউকে নিয়ে যায় রে বৌমা… সাবধান থাকিস। ও প্রতিশোধ নিতে এসেছে।” নন্দিনী মাথা নিচু করে বসে রইল—তার মনে হলো, এই জানালা, এই চোখ, এই গন্ধহীন ভয় কিছুতেই আর দূরে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।

অধ্যায় ৩

পূর্বাহ্নের রোদ নেমে আসছিল ধীরে ধীরে, সুন্দরবনের গহীন ছায়ার মতই গা ছমছমে এক নিস্তব্ধতা ঢেকে ফেলছিল চারপাশ। পাখিরা থেমে গেছে অনেকক্ষণ আগেই, কেবল দূরের নদী থেকে আসা হালকা হাওয়ায় কখনো কখনো বাঁশঝাড় কেঁপে ওঠে ফিসফিস শব্দে, যেন গাছেরা নিজেদের মধ্যেই কিছু গোপন কথা চালাচ্ছে। সেই সময়েই হঠাৎ করেই বাড়ির সামনের উঠোনে দেখা গেল খোকাকে—গ্রামের বিখ্যাত মাতাল, অদ্ভুত পাগলাটে স্বভাবের জন্য যাকে সবাই এড়িয়ে চলে। আজ অবশ্য তার মুখে কোনো মদের গন্ধ ছিল না, বরং চোখে ছিল অদ্ভুত এক উত্তেজনার ঝিলিক—যেটা মধুর বা মাতালের নয়, বরং যেন সেই মানুষটির, যে কিছু এমন দেখে ফেলেছে যা দেখা উচিত ছিল না। সে হঠাৎ করে চিৎকার করে বলল, “ও ফিরছে… ওর প্রতিশোধ এখনও বাকি!” তার কণ্ঠে ছিল আতঙ্কে চাপা পড়া ক্রোধ, আর হাতদুটো আকাশের দিকে তুলে সে যেন কাউকে সতর্ক করছে। “ও আসে পূর্ণিমার রাতে… আর যার চোখে চোখ পড়ে, সে আর সকালে ওঠে না… এবার তোর ঘরে এসেছে বিনয়, রক্তচোখা তোকে খুঁজছে।”

নন্দিনী চমকে উঠেছিল, আর মাধবী উঠে দাঁড়িয়ে দরজার চৌকাঠে এসে দাঁড়ালেন—চোখে কুয়াশা মেশানো ভয়। বিনয় অবশ্য বিরক্ত মুখে দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “খোকা কাকু, আজ একটু বেশিই খেয়েছেন মনে হয়।” কিন্তু খোকা এবার সরাসরি তার চোখে চোখ রেখে বলল, “তুই বুঝিস না… রক্তচোখা শুধু তাকায় না, সে স্মৃতি খোঁজে, অভিশাপ খোঁজে। তোদের পরিবারের কারও কিছু নেওয়া বাকি ছিল… এখন সে এসেছে শেষ করতে।” খোকা থেমে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল বিষ্ণুপদের দিকে, যিনি পেছনে বসে ছিলেন নিঃশব্দে। তারপর সে ধীরে ধীরে বলে উঠল, “আপনিও জানেন, কাকাবাবু… সেই মধু সংগ্রাহকের কাহিনি… নববধূ বলি… গরান গাছের নিচে রক্ত…” তার কণ্ঠস্বর ক্রমে জড়ানো হয়ে আসছিল। বিষ্ণুপদ ততক্ষণে আর তাকাতে পারছিলেন না খোকার চোখে—একটানা মাটির দিকে চেয়ে ছিলেন। তার মুখের রেখা শক্ত হয়ে উঠেছিল, গলার শিরা স্পষ্ট, যেন বহু পুরনো কোনো কথা তার বুকের নিচে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল বছরের পর বছর। নন্দিনী তা লক্ষ্য করল—বাবার মুখে থাকা সেই কুন্ঠিত নীরবতা তাকে আরও বেশি অস্থির করে তুলল।

খোকা কথা শেষ করে হঠাৎ থেমে গেল, তারপর এক অদ্ভুত হাসি দিয়ে বলল, “তিতলি তো এখন ওর সঙ্গে খেলে, তাই না?” কথাটা শুনে যেন সব বাতাস থেমে গেল। নন্দিনী ছুটে গিয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নেয়, আর খোকা ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বলে, “রক্তচোখা কেবল জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে না… সে ডাক দেয়, একবার যার কানে সেই ডাক পড়ে, তার ঘুম আর সাড়ে তিনদিনের বেশি টেকে না।” তারপর সে হঠাৎ নাচতে নাচতে চলে যেতে থাকে গ্রামের পথে—কোনো নির্দিষ্ট দিকে নয়, যেন বাতাসের নির্দেশে। বিনয় রেগে গিয়ে পেছন থেকে চিৎকার করে উঠেছিল, “পুরো পাগল! এসব বলে মানুষকে ভয় দেখাচ্ছ!” কিন্তু তার গলার সুরে নিজেকেই বোঝানোর চেষ্টা ছিল বেশি, অন্য কাউকে নয়। মাধবী বললেন ধীরে, “ও পাগল বটে, কিন্তু ওর চোখ ভুল বলে না। খোকা এমন কিছু দেখেছে যেটা তাকে ভেঙে দিয়েছে।” বিষ্ণুপদ তখনো নীরব। কেবল একবার দৃষ্টি তুলে বলেছিলেন, “রক্তচোখা আসলে লোককথা, আর লোককথার রক্ত থাকে না।” কিন্তু তার চোখে যেই মৃদু কাঁপন ছিল, সেটি নন্দিনীর চোখ এড়ায়নি। সে বুঝতে পারল, কিছু একটা আছে—একটা চুপ করে থাকা সত্য, যা বাড়ির সবচেয়ে পুরনো মানুষটি হয়তো জানেন, কিন্তু বলেন না। ঘরের এক কোণে তখন তিতলি বসে নিজের আঁকার খাতায় আবার একটা রক্তচোখা দিদির ছবি আঁকছিল—এইবার মুখে এক ফালি হাসি, আর পেছনে গরান গাছ। নন্দিনীর হাত কেঁপে উঠল, আর পূর্ণিমার আগের রাত আরও কাছাকাছি চলে এলো।

অধ্যায় ৪

বিনয় সেদিন সন্ধ্যেবেলায় একা নৌকায় চড়ে নদীর দিকে গিয়েছিল, কেবল কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস নিতে। জঙ্গলঘেরা এই অদ্ভুত গ্রামে ফেরার পর থেকে একটা অজানা অস্বস্তি তাকে পেয়ে বসেছে, যেন কেউ তাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করছে, যেন বাতাসে এক অচেনা গন্ধ—শুকনো রক্ত আর পচা পাতার মতো। নৌকা আস্তে আস্তে সরু খাঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, চারপাশে নিস্তব্ধতা। জলের ওপর পড়ে থাকা গাছের ডালপালা, পেছন থেকে ভেসে আসা নিশাচর পাখির ডাক আর মাঝেমধ্যে কাদায় চ্যাপলা মাছের ঝাঁপ—সব মিলিয়ে এক ঘোরলাগা পরিবেশ। বিনয় ভাবছিল, হয়তো এই পরিবেশেই তার দাদুরা একসময় মাছ ধরত, মশার ধোঁয়ার মাঝে গল্প করত। অথচ আজ এই অঞ্চলটা অচেনা, অস্পষ্ট, ভয়ংকর। হঠাৎই, একফালি বাতাস বইল, ঠাণ্ডা আর কাঁপিয়ে দেওয়া। বিনয়ের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। সে অনুভব করল—নৌকার নিচে কিছু একটা ঘষা দিচ্ছে, যেন কিছু একটাকে সে স্পর্শ করে ফেলেছে, কিংবা কিছু একটার ছায়া তার পাশ কাটিয়ে চলে গেছে।

সেই মুহূর্তেই কানের কাছে একটা কান্নার শব্দ। প্রথমে সে ভাবল, হয়তো কোনো পাখি, কিংবা হাওয়ার খেলা। কিন্তু কান্নাটা যেন স্পষ্ট হচ্ছে, যেন কারও বুকচেরা বিলাপ—মেয়েলি কণ্ঠ, কষ্টে ধরা, দীর্ঘশ্বাসে মোড়া। বিনয় থমকে দাঁড়াল, টর্চ বের করল, কিন্তু বাতির আলো শুধু ঝিঁঝিরা ভরা পাতার ঝোপে হারিয়ে গেল। সে ধীরে ধীরে পিছনে ঘুরল, আর তখনই তার চোখে পড়ল নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থাকা সেই নারীমূর্তি—সাদা শাড়িতে মোড়া, চুল এলোমেলো, চোখ দুটি যেন আগুনের মত জ্বলছে লাল আলোয়। কুয়াশার মত একটা কিছু তার শরীর ঘিরে আছে, যেন ধোঁয়ার আবরণ। বিনয়ের গলা শুকিয়ে এল, হাত কাঁপতে লাগল, আর সে অনুভব করল তার শরীর যেন হিম হয়ে গেছে। সেই নারীমূর্তি এক পা করে এগিয়ে আসছিল, অথচ পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছিল না, শুধু বাতাস ভারি হয়ে উঠছিল তার অস্তিত্বে। চোখের সেই জ্বলুনি যেন বুকের মধ্যে ঢুকে পড়ছিল, দৃষ্টির মাঝে খেলা করছিল ভয় আর অদ্ভুত আকর্ষণ। হঠাৎই নৌকাটা কেঁপে উঠল, আর বিনয়ের পা পিছলে সে সোজা জলে পড়ে গেল।

জল ঠাণ্ডা, কাদা ভরা। সে কাঁপতে কাঁপতে মাথা তোলে, চোখে জল ঢুকে যায়, কিন্তু তার মাঝেও সে দেখে—ওই নারীমূর্তি এখন নদীর ওপারে দাঁড়িয়ে, তার দৃষ্টি বিনয়ের চোখে স্থির। “কে তুমি?” বিনয় চেঁচিয়ে ওঠে, কিন্তু কণ্ঠস্বর যেন গিলে নেয় জল আর জঙ্গল। এক মুহূর্তে চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে ওঠে, আর মুহূর্তের মধ্যে নারীমূর্তি মিলিয়ে যায় ধোঁয়ার মত। বিনয় কোনোমতে কাদার ভিতর থেকে উঠে পড়ে নৌকায় চড়ে বসে। বুক ধড়ফড় করছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে বুঝে যায়, এটা স্বপ্ন নয়, মানসিক ভ্রম নয়—কিছু একটা সত্যিই আছে এই জঙ্গলে, কিছু এমন, যা মানুষ নয়, অথচ মানুষের আকার নেয়, কষ্ট নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বাড়ি ফিরে আসার পর তার শরীর জ্বর জ্বর করে, আর মাধবী তাকে দেখে বলে, “তুমি তার চোখে তাকিয়েছো? সে যাকে দেখে, তাকে সে ভোলে না। এখন তুই শুধুই সময়ের অপেক্ষা।” ঘরে সেই রাতে আর কেউ ঘুমাতে পারে না, কারণ রাতের বাতাসে ফের ভেসে আসে সেই কান্না, ধীরে ধীরে, তারপর স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যেন জঙ্গল নিজেই কাঁদছে।

অধ্যায় ৫

রাত গভীর হতেই গ্রামের শ্মশান ঘাটের পেছনে পুরনো শিবমন্দিরের চাতালে বসে মনোরঞ্জন পুরুত ধূম্রপান করছিলেন, বাতাসে তখন নিমপাতা আর পোড়া ধুপের গন্ধ। বিষ্ণুপদ তাকে ডেকে নিয়েছিল একান্তে কিছু জানার আশায়। রাতের আঁধারে, দীপ্ত শিখার মতো পুরুতের চোখে তখন এক গা ছমছমে দীপ্তি। বিষ্ণুপদের কাঁধে হাত রেখে তিনি বললেন, “শুনো, তোমরা যারা শহর থেকে আসো, তারা ভাবো সব গল্প, সব কাহিনি হলো গাঁজাখুরি। কিন্তু রক্তচোখার গল্প, ওটা শুধু গল্প নয়—ও একটা জীবন্ত অভিশাপ, যা এখনো থেমে যায়নি।” বিষ্ণুপদ যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। সে বিশ্বাস করতে চাইছিল না, কিন্তু বিনয়ের মুখে নদীর ধারের সেই নারীমূর্তির কথা, আর নন্দিনীর বর্ণনায় জানালার পাশে লাল চোখ—সব যেন এক সুতোয় গাঁথা হয়ে যাচ্ছিল।

মনোরঞ্জন চুপ করে থেকে এক সময় বললেন, “এই গ্রামে শত বছর আগে এক ভীষণ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। মাঠে শস্য ছিল না, নদীতে জল শুকিয়ে গিয়েছিল। মানুষ যখন আর কিছু খুঁজে পায় না, তখন তারা শুরু করে ভয়ংকর এক রীতি—মানব বলি। গ্রামের জমিদার তখন সিদ্ধান্ত নেন, যদি কোনো নববধূকে বলি দেওয়া হয়, তাহলে হয়তো দেবতারা সন্তুষ্ট হবেন। সেই সময় এক কৃষকের কন্যা, গিরিজা, সদ্য বিবাহিত, তাকে তুলে আনা হয় বলির জন্য। মেয়েটি কাঁদছিল, আর কাঁদতে কাঁদতে চোখের রক্ত ছড়িয়ে যাচ্ছিল। অনেকেই বলে, সে তখন শিবমূর্তির পায়ের কাছে বসে শপথ নিয়েছিল—‘আমি আবার ফিরবো, পূর্ণিমা রাতেই ফিরবো, প্রতিশোধ নিতে।’ সেই দিন থেকে প্রতি পূর্ণিমার রাতে কেউ না কেউ নিখোঁজ হয়ে যেত, আর সবাই জানে—রক্তচোখা এসে তার প্রতিশোধ নিচ্ছে।”

বিষ্ণুপদ চুপচাপ শুনছিল, কিন্তু তার চোখে ধীরে ধীরে আতঙ্ক জমে উঠছিল। পুরুত আবার বললেন, “ওর চোখ, ওর চোখই তোমাদের সবচেয়ে বড় সংকেত। জানো, রক্তচোখার অভিশাপ হলো—যার চোখে সে চোখ রাখে, তার মনেই জন্ম নেয় বিভ্রান্তি, ভয়, আর শেষে মৃত্যু। আর সে শুধু ফিরতে পারে পূর্ণিমার রাতে। আজ থেকে তিন রাত পর আবার পূর্ণিমা, আর যেহেতু এবার তার অভিশাপ ফের নতুন চোখে জেগে উঠেছে, সে এবার একে একে সবাইকে টেনে নেবে। তিতলি দেখেছে তাকে, নন্দিনীও চোখ রেখেছে তার দিকে, বিনয়ের কথা শুনেছ—এবার ওর লক্ষ্য তোমাদের সবাই।” বিষ্ণুপদ উঠে দাঁড়ায়, মাথা নিচু করে ভাবে, “আমি তো বিশ্বাস করতাম না এসব… তবে যদি সত্যিই এটা ঘটে থাকে, তবে আমাদের কিছু করতে হবে। পুরুত মশাই, ওকে থামানোর কোনো উপায় নেই?” মনোরঞ্জন পুরুত মাথা নাড়িয়ে বলেন, “অভিশাপ থামে না, ওকে ফিরিয়ে দিতে হয়। যে স্থান থেকে বলি হয়েছিল, ঠিক সেই জায়গায়, সেই রাতে, কেউ যদি নিজের ইচ্ছায় দাঁড়ায়, তবে হয়তো অভিশাপের বলয় ভাঙা যায়। কিন্তু তার জন্য চাই আত্মত্যাগ। কেউ কি সে সাহস দেখাবে?” বিষ্ণুপদের নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসে, আর রাতের বাতাসে কেমন একটা কান্নার শব্দ ভেসে আসে দূর নদীর দিক থেকে, যেন রক্তচোখা সেই নববধূ আবার জেগে উঠছে পূর্ণিমার প্রতীক্ষায়।

অধ্যায় ৬

সন্ধ্যা নামার আগেই তিতলির শরীর খারাপ হতে শুরু করে। অকারণে কাঁপুনি, গায়ে জ্বর, চোখে একধরনের অদ্ভুত নিস্পৃহতা। অদ্ভুত ব্যাপার হল, সে ঠিকঠাক খাচ্ছে, কথা বলছে, কিন্তু মাঝেমধ্যে একধরনের ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে, যেন কারও সঙ্গে কথা বলছে যাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। পরদিন সকালে রুমার চিৎকারে বাড়ি হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়—তিতলি ঘুমঘোরে বসে বসে বিড়বিড় করে বলছে, “রক্তচোখা দিদি বলে, মা বাবাকে নিয়ে যাবে…” বিষ্ণুপদ চমকে ওঠে, মাথায় হাত রাখে মেয়ের—জ্বর বেড়ে গেছে, গা আগুনের মতো গরম। ডাক্তার ডাকা হয়, ওষুধও দেওয়া হয়, কিন্তু তিতলি যেন কিছুতেই সাড়া দিচ্ছে না, যেন কারও হাত ধরে অদেখা এক দুনিয়ায় হাঁটছে। ঘরে বসে থাকা তিতলি হঠাৎ বলে—“আজ জানালার পাশে দাঁড়িয়েছিল, মা বলল না কেন? সে তো এসেছিল, আমায় দেখে গেল…” সেই মুহূর্তে জানালার পর্দা এলোমেলোভাবে উড়তে থাকে, অথচ কোনো হাওয়া নেই। বিষ্ণুপদ কিছুটা শঙ্কিত হলেও মুখে কিছু বলে না, শুধু বিছানার পাশে বসে মেয়ের হাত ধরে রাখে, যেন একটা অদৃশ্য দেওয়াল হয়ে ওঠে রক্তচোখার সামনে।

সেদিন বিকেলে তিতলি হঠাৎই তার খাতার পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে আঁকতে শুরু করে। ছোট্ট মেয়েটি যেভাবে রঙ দিয়ে ছবি আঁকে, তা সব সময়েই খুব প্রাণবন্ত হয়, কিন্তু আজকের আঁকাগুলো অস্বাভাবিক। একটার পর একটা পাতায় দেখা যায়—একটা ঘর, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক নারী, যার চোখ লাল, শরীর কুয়াশায় ঢাকা। ছবির রংগুলি যেন অন্ধকার থেকে উঠে এসেছে, কাঠকয়লার মতো কালো ছায়া ঘিরে আছে চরিত্রগুলোকে। খাতার শেষে একটি পাতায় শুধু একটি চোখ আঁকা—লাল রঙের, যার চারপাশ কুয়াশায় আচ্ছন্ন। রুমা আঁচ করতে পারে যে কিছু একটা গভীর ভাবে তিতলিকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে, কিন্তু মেয়েকে সরাসরি কিছু বলতেও পারে না। বিষ্ণুপদ ছবিগুলো পুড়িয়ে ফেলতে চায়, কিন্তু তিতলি তখন চিৎকার করে ওঠে, “না! দিদি বলেছে কেউ যদি ওর ছবি পোড়ায়, সে ফিরে এসে তার চোখ দিয়ে আগুন নামাবে!” এমন কথা ছোট্ট মেয়ের মুখে শুনে ঘরজুড়ে নিঃশব্দ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সেদিন রাতে তিতলি বারবার কাঁদতে কাঁদতে ঘুম ভাঙায়—সে বলে, “দিদি বলেছে মা আর বাবাকে নিয়ে যাবে, আর আমি থাকব একা ঘরের মধ্যে, জানালার পাশে বসে থাকব আমি।” সেই রাতে বিষ্ণুপদ রুমার ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়, কিন্তু সে নিজে জানালার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ, জানালা দিয়ে কুয়াশার ভেতর কিছু খোঁজার চেষ্টা করে।

পরদিন সকালে, ঘরের দেওয়ালে এক অদ্ভুত দৃশ্য ধরা পড়ে। তিতলির ঘরের ঠিক জানালার পাশে, যেখানে সে বলেছিল “দিদি দাঁড়ায়,” সেখানে দেখা যায় একটা লাল রঙের হাতের ছাপ—পাঁচ আঙুল স্পষ্ট, যেন কেউ কুয়াশার মধ্য থেকে এসে দেয়ালে হাত রেখেছে। ছাপটা টাটকা, লালচে রঙ ঠিক যেন রক্ত নয়, কিন্তু রংটা অদ্ভুতভাবে প্রাণবন্ত। বিষ্ণুপদ আঙুল দিয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করতেই হাতটা যেন ঠান্ডায় জমে যায়, বরফের মতো। সেই মুহূর্তে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, দরজার কাঠ যেন কাঁপে, আর তিতলি অন্য ঘর থেকে চিৎকার করে ওঠে—“সে আবার এসেছে, বলছে বাবা এবার যাবে…” রুমা আর বিষ্ণুপদ দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে, কিন্তু তিতলি চোখ বন্ধ করে শুধু বলে—“আমি কিছু দেখিনি… আমি কিছু শুনিনি… আমি শুধু চেয়েছিলাম ওর সঙ্গে খেলতে…” বিষ্ণুপদ জানে—এখন আর এসব অস্বীকার করার সময় নয়। রক্তচোখার ছায়া শুধু কুয়াশা নয়, এখন ঘরের দেয়ালেও তার উপস্থিতি রেখে যাচ্ছে। মৃতের অভিশাপ, হারানো রক্তের প্রতিশোধ—তিতলির মধ্যে দিয়ে এবার পূর্ণ হতে চলেছে সেই শতবর্ষ পুরনো অশান্ত ইতিহাস।

অধ্যায় ৭

অন্ধকার রাতের আগমনে গ্রাম যেন নিঃশব্দ আতঙ্কে জমে উঠল। পশ্চিম আকাশে একফালি চাঁদ উঠলেও তার আলো যেন থমকে আছে, যেন ভয় পেয়েছে সে-ও। বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে ধূপগন্ধে আর ভয়ের প্রাচীন ঘ্রাণে। প্রতিটি ঘরেই দরজা-জানালা শক্ত করে বন্ধ, জানালার ফাঁকে লাল কাপড় ঝোলানো—পুরোনো বিশ্বাস, লাল রঙ নাকি অপদেবতা তাড়ায়। ঘরের ভিতরে চলছে হোমযজ্ঞ, ধুপ-ধুনোর ধোঁয়ায় ঘর ধোঁয়াশায় ভরে গেছে, যেন প্রতিটি পরিবার নিজের মতো করে লড়ছে এক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে। মাধবীও তার ছোট্ট মেয়ে তিতলিকে কোলে নিয়ে বসে আছে, চোখে ভয় আর নির্ঘুমতা। কিন্তু সে জানে, ভয় লুকিয়ে থাকলেই দূর হয় না। তবুও চুপচাপ বসে আছে, অপেক্ষায়—কিসের, তা জানে না। ঠিক সেই সময়েই পাড়া থেকে কান্নার একটা মৃদু শব্দ ভেসে আসে, যেন কে যেন ফিসফিস করে কাঁদছে। মাধবী উঠে গিয়ে জানালায় চোখ রাখে, কিন্তু কিছুই দেখা যায় না ধোঁয়াটে কুয়াশার ভিতর।

এদিকে খোকার কুঁড়েঘরটা তালা দেওয়া ছিল, অথচ সন্ধ্যা নামতেই দেখা যায় দরজাটা আধা খোলা। কেউ না কেউ নিশ্চয়ই ঢুকেছে বা বেরিয়েছে। গ্রামের লোকজন কেউই সাহস করে কাছে যায় না। কিন্তু নন্দিনীর মনে একটা খচখচে কৌতূহল জন্মায়। সে নিঃশব্দে পায়ের শব্দ না করে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দেখে ভিতরে শুধু একটা মাটির খাটিয়া আর সেই খোকা আঁকা কিছু ছবি। ঠিক কোণার দিকে রাখা একটা কৌটো থেকে একটা চিরকুট বেরিয়ে পড়ে, যাতে লেখা—”ওর চোখে তাকিয়ো না, ও নিজেই মৃত্যু।” নন্দিনী স্তব্ধ হয়ে যায়। সে জানে, ‘ও’ মানে রক্তচোখা। সে জানে খোকা এই অশুভ শক্তির কিছু গভীর গোপন কথা জানে। কিন্তু খোকা কোথায়? তখনই মাধবীর হাহাকার ভেসে আসে। তিতলি ঘরে নেই! কোলের উপর ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটা যেন হঠাৎ করেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। জানালার পাশের পর্দা একটু সরে আছে, সেই ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখা যায়—দূরে নদীর দিকে যাচ্ছে ছোট একটা ছায়া, এবং তার পিছনে হেঁটে আসছে লম্বা কুয়াশাঘেরা এক নারীমূর্তি।

গ্রামের বাকি লোক তখন ঘরের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে, কেউ জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাতে সাহস করছে না। কিন্তু নন্দিনী আর মাধবী ছুটে পড়ে। তারা জানে, আজকের রাতটাই শেষ। পূর্ণিমা আসতে এখনো কয়েক ঘণ্টা বাকি, কিন্তু রক্তচোখা এবার তার সময়ের আগেই জেগে উঠেছে। নদীর দিকে ছুটে যেতে যেতে তারা দেখতে পায়—তিতলি হাঁটছে, যেন কারও ডাকে সাড়া দিচ্ছে। তার চোখ ফাঁকা, তার পা মাটিতে নয়, যেন ভেসে চলেছে। আর ঠিক পিছনে, সাদা শাড়ি পরা সেই নারীমূর্তি—চোখ জ্বলছে আগুনের মতো, যেন সময় থেমে গেছে তার চারপাশে। তারা চিৎকার করে তিতলিকে ডাকলেও সে থামে না। নদীর ধারে পৌঁছে, হঠাৎ একটা ঝাপটা হাওয়া বয়ে যায়। গাছের পাতা থরথর করে কাঁপে। তিতলি হঠাৎ থেমে যায়, ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে—”রক্তচোখা দিদি বলেছে, আমি মাকে এনে দিচ্ছি। এখন আমাদের সময় শেষ…” সেই ভয়াল কণ্ঠস্বর শুনে নন্দিনী আর মাধবীর পা যেন জমে যায়। তারপর এক ঝলক ঝোড়ো হাওয়ায় সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়। পূর্ণিমার আগের রাত, যেখানে অন্ধকারই একমাত্র আলো।

অধ্যায় ৮

অরণ্যের নিঃসীম কুয়াশায় জঙ্গলের গা ঘেঁষে হেঁটে চলেছে বিনয় ও নন্দিনী। চারপাশের গাছপালা যেন স্তব্ধ, নিস্তব্ধতাকে ভেঙে কেবল শোনা যাচ্ছে পায়ের তলায় শুকনো পাতার চিড়মিড় শব্দ। পূর্ণিমার আগের রাত হলেও চাঁদের আলো আজ ঘন কুয়াশায় হারিয়ে গেছে। নন্দিনীর চোখে আতঙ্ক আর উদ্বেগ, সে অনবরত তিতলির নাম ধরে ডাকছে, কিন্তু কোনো সাড়া নেই। হঠাৎ এক জায়গায় এসে তারা দেখতে পায়—এক জীর্ণ পুকুরপাড়, যার পেছনে বহু পুরনো বটগাছের ছায়া। সেই ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে আছে একটি অবয়ব—এক নারী, শাড়ির আঁচল মাটি পর্যন্ত লম্বা, আর কোলে নিঃশব্দে শুয়ে আছে তিতলি। নারীর চোখ দুটো যেন আগুনের মতো জ্বলছে—রক্তচোখা! নন্দিনী দৌড়ে যেতে চাইলে বিনয় হাত ধরে থামায়। রক্তচোখা নারীর ঠোঁটে এক হালকা হাসি—তবে তাতে ছিল না কোনো শান্তি, ছিল এক অপার বেদনা।

“এই মেয়েটা আমার ছিল… অনেক আগে, বহু জন্ম আগে,” কুয়াশার ভিতর থেকে ধ্বনি ভেসে আসে, যেন বাতাসে কান্না মেশানো। “ওর মুখে আমার মুখ দেখি… ওর কান্নায় আমার কান্না শুনি। তোমরা ওকে বড় করছ, তাই আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু ওকে ফিরিয়ে দাও, আমার কোল ফিরিয়ে দাও…” তার কণ্ঠে ছিল না হুমকি, ছিল এক নিঃশেষ যন্ত্রণার আভাস। বিনয় সাহস করে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কে? কেন তিতলিকে চাও?” রক্তচোখা ধীরে ধীরে জানায়, সে সেই নববধূ যাকে এক সময় বলি দেওয়া হয়েছিল দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে। তার কোলের সদ্যোজাত শিশুকে ছিনিয়ে নিয়ে যজ্ঞে উৎসর্গ করা হয়েছিল। সেই অভিশপ্ত রাতের পর থেকে তার আত্মা পূর্ণিমার সময় জেগে ওঠে, এবং সে খুঁজে ফেরে তার মেয়েকে—যে এখন তিতলি নামে জন্মেছে নতুন করে। নন্দিনী অঝোরে কাঁদছে, সে বলছে, “ও আমার মেয়ে… আমি ওকে হারাতে পারব না।” কিন্তু রক্তচোখা ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বলল, “আমি কেবল তাকে দেখতে এসেছি… তার গন্ধ নিতে এসেছি… তাকে হারাতে চাই না… এবার আমি ঘুমাবো।”

বাতাস কাঁপে, পাতার মর্মর শব্দে কুয়াশা আরও ঘন হয়ে ওঠে। রক্তচোখা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় সেই বটগাছের গাঢ় ছায়ায়। তিতলি তখন নিস্তেজ, যেন নিদ্রিত। বিনয় তাকে কোলে তোলে, তার গা গরম, নিঃশ্বাস ধীরে চলেছে। তারা তাড়াতাড়ি ফিরে আসে গ্রামের দিকে। কিন্তু পেছনে তাকালে দেখা যায়, সেই জায়গায় একজোড়া লাল চোখ ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। গ্রামে ফিরে তিতলি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়, কিন্তু তার আঁকা ছবিগুলোতে সেই নারী, সেই চোখ, সেই বটগাছ এখনও ফিরে আসে বারবার। রক্তচোখা কোনোদিন কি সত্যিই ঘুমাবে? না কি সে আবার আসবে পূর্ণিমার কোনো রাতে, তার অপূর্ণ মাতৃত্বের দাবি নিয়ে? নন্দিনী জানে না, শুধু জানে—ভালোবাসার সম্পর্ক রক্তের থেকেও গভীর, জন্মের সীমা ছাড়িয়ে সেই টান রয়ে যায় আত্মার ভিতর। তিতলি তার কোলেই ফিরে এসেছে, কিন্তু সেই রক্তচোখা মাতৃসত্তার শেষ আহ্বান বাতাসে রয়ে গেছে, এক নিঃশব্দ প্রার্থনার মতো।

অধ্যায় ৯

বাড়ির বাতাস যেন থমকে ছিল সেই দিন। তিতলি নিস্তেজ হয়ে ফিরে আসার পর নন্দিনী যেন এক দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল। বিনয় চুপচাপ, চোখে ঘুম নেই। তিতলি বিছানায় পড়ে আছে—জ্ঞান ফেরেনি পুরোপুরি, কিন্তু শ্বাস চলছে ধীরে ধীরে। সেই সন্ধ্যায় মনোরঞ্জন পুরুত আসেন গ্রাম থেকে, তাঁর সঙ্গে বেশ কিছু পুরোহিত। তিনি সরাসরি বলেন, “এ বাড়িতে আত্মা আছে, কিন্তু এটা কোনও সাধারণ আত্মা নয়। এ আত্মা ‘মুক্তি’ চায়—কিন্তু তার জন্য চাই সত্যের স্বীকারোক্তি, চাই আত্মিক পরিশোধ।” তার কথায় ছায়া নামে ঘরে, আর সেই মুহূর্তে বিষ্ণুপদ দাদু যেন কেঁপে ওঠেন। সকলের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি ধীরে ধীরে বলে ওঠেন, “তোমরা যেটাকে শয়তানি ভেবেছ, সেটা আসলে আমাদের পুরুষদেরই পাপের ছায়া। আমার ঠাকুরদা, আর তার দাদা—তারা এই পাহাড়ি নারীদের বলি দিত। জমি দখল, শক্তি অর্জন আর কুপ্রথার নামে এক কন্যাকে তারা পূর্ণিমার রাতে পাথরের বেদীতে বলি দিয়েছিল। সেই মেয়েটাই হয়তো রক্তচোখা। ওর আত্মা মুক্তি পায়নি।” বিষ্ণুপদের স্বীকারোক্তি শুনে সবাই স্তব্ধ। নন্দিনীর গা দিয়ে ঠাণ্ডা ঘাম বইতে থাকে। মনোরঞ্জন মাথা নোয়ান, বলেন—“এখন সময় এসেছে সত্যকে মেনে নেওয়ার। আয়োজিত হবে যজ্ঞ—যে যজ্ঞ হবে আত্মা শান্তির জন্য, নতুন করে কোনও বলি ছাড়া।”

সেই রাতেই শুরু হয় প্রস্তুতি। বাড়ির পিছনের পুরনো বলিদানের স্থানে তৈরি হয় যজ্ঞ মঞ্চ। চারপাশে বসানো হয় প্রদীপ, ঢাক বাজে ধ্বনিময় ভাবে। পুরোহিতরা মন্ত্র জপ শুরু করেন, সঙ্গে নন্দিনী, বিনয়, বিষ্ণুপদ—সবাই হাজির। পূর্ণিমার রাত আসছে আবার, সময়ের ঘূর্ণি যেন ঘন ঘন উলটে যাচ্ছে। যজ্ঞে উৎসর্গ করা হয় ঘি, কাঠ, তুলসীপাতা আর শেষবারের মতো ফুলের মালা। তখনই এক ঝটকায় আগুনের শিখায় দেখা যায়—একজোড়া লাল চোখ, যেন অন্ধকারের মাঝেও জ্বলছে নিঃশব্দ প্রতিহিংসায়। সেই চোখ এক মুহূর্তে আগুনের মধ্যে উঁকি দিয়ে আবার হারিয়ে যায়। সকলে থমকে যায়। মনোরঞ্জন পুরুত বলেন—“এ স্বীকৃতির মুহূর্ত। সে এসেছে, সে শুনছে। সে এবার চলে যাবে।” চারপাশে হাওয়া থেমে যায় যেন। তিতলি তখনই চোখ মেলে ধীরে ধীরে বলে—“দিদি চলে গেছে, সে কাঁদছিল না, সে হাসছিল।” ঘরের বাতাস যেন হালকা হয়ে আসে, গাছের পাতায় হাওয়া লাগে, ধীরে ধীরে আগুন নিভে আসে।

সকালবেলা যজ্ঞস্থল নিঃশব্দ, যেন কিছুই ঘটেনি। আগুনের ছাইয়ে শুধু দেখা যায় এক জোড়া পদচিহ্ন, যেন কোনও শিশু সেখানে হেঁটে গিয়েছে। বিষ্ণুপদ চোখ মুছতে মুছতে বলেন—“ও কন্যা ছিল, কোলের মেয়ে। আমরা শুধু সেই কোলের আকুতি ভুলে গিয়েছিলাম। আজ সে শান্তি পেল।” নন্দিনী চেয়ে থাকে আকাশের দিকে। কুয়াশা নেই, ধোঁয়াও নেই। তিতলি তখনো বিছানায়, কিন্তু মুখে এক প্রশান্ত হাসি। বিনয় এসে জানলায় দাঁড়িয়ে বলে, “সবাই বলে ভূত আছে, কেউ বলে নেই। কিন্তু আমি আজ জানি—আছে আত্মা, যাদের দুঃখ মুক্তি পায় না যতক্ষণ না আমরা আমাদের পাপ স্বীকার করি।” শেষবারের মতো ঢাক পড়ে ওঠে দূরে, হিমঝরা বাতাসে কাঁপে কয়েকটি পাতা, আর বাড়ির দেওয়ালে যেটা আগে ছিল রক্তলাল ছোপ—তা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। পূর্ণিমার আলোর নিচে, অন্ধকার আর ভয়কে বিদায় জানায় পুরনো সেই বলির বেদি। আত্মা যেন সত্যের আলোয় শান্তি পায়—অবশেষে।

অধ্যায় ১০

পূর্ণিমার রাত পেরিয়ে যাওয়ার পর গ্রামে যেন এক অপার্থিব নিস্তব্ধতা নেমে আসে। আগের সেই অদৃশ্য ভয়ের ছায়া কোথাও নেই, অথচ কেমন এক চাপা উত্তেজনা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। গ্রামের লোকজন ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে, একে একে সবাই মন্দিরের প্রাঙ্গণে জড়ো হয়—যেখানে আগুনের যজ্ঞ হয়েছিল গতরাতে। কেউ কিছু বলে না, শুধু তাকিয়ে থাকে সেই ভস্মীভূত বেদির দিকে, যেখানে আগুনের শেষ শিখা নিভে যাওয়ার আগে ঝলসে উঠেছিল একজোড়া লাল চোখ। সেই দৃষ্টির স্মৃতি অনেকেরই মনে গেঁথে গেছে, কিন্তু কেউ মুখে আনে না। বিনয়, নন্দিনী, তিতলি ও মাধবী—সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, যেন কোনো এক অজানা অভিজ্ঞতার ভার একসঙ্গে বহন করছে। তিতলি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে, তবে মাঝে মাঝে হঠাৎ চমকে ওঠে, অথবা কান পেতে কিছু শুনতে চায়—যা কেউ শোনে না। ডাক্তার বলেছে, সবটাই মানসিক চাপের ফল, কিন্তু নন্দিনী জানে, এই মেয়েটি কিছু এমন দেখে এসেছে, যা চোখে দেখা যায় না—কেবল অনুভব করা যায়।

গ্রামের প্রাচীন গাছগুলোর পাতায় অদ্ভুত এক আলো ঝলকে ওঠে আজকাল, বিশেষ করে সন্ধের পরে। কেউ কেউ বলে, ওটা চাঁদের আলো, কেউ আবার ফিসফিস করে বলে—ওটা কোনো চিহ্ন, কোনো শেষ না হওয়া গল্পের দাগ। তিতলি জানালার পাশে বসে বই পড়ে, কিন্তু মাঝে মাঝে জানালার বাইরের গাছে চোখ পড়ে যায়—সেই গাছটিতে, যার ডাল এখন আর আগের মতো সবুজ নয়। গাছের একটি বিশেষ শাখা যেন পোড়া, শুকনো, তবু তার দুটো পাতায় মাঝে মাঝে লাল ঝলক দেখা যায়, যেন আগুনে পোড়া কোনও প্রতিচ্ছবি সেখানে লেগে আছে। নন্দিনী ও মাধবী শুরুতে গাছ কেটে ফেলার কথা ভাবলেও পরে আর সাহস করে না। বিষ্ণুপদ একদিন গাছের দিকে তাকিয়ে শুধু বলেছিল—”সব কিছু মুছে ফেলা যায় না… কিছু স্মৃতি রয়ে যায় বৃক্ষের পাতায়, বাতাসের শব্দে।” তারপর সে আর কিছু বলেনি, কেবল মাথা নিচু করে ভেতরে চলে গিয়েছিল। আর সেই রাতেই নাকি মাধবী দেখেছিল—একজন লালপাড় শাড়ি পরা রমণী জানালার ছায়ায় দাঁড়িয়ে তিতলির দিকে তাকিয়ে আছে—শুধু তাকিয়ে, কিছু বলছে না। পরদিন মাধবী মুখে কিছু না বললেও, জানালার পর্দা পুরোপুরি টেনে দিল, আর সেই থেকে পূর্ণিমার রাতে জানালা খোলে না আর।

সময় এগিয়ে চলে। তিতলি আবার স্কুলে যেতে শুরু করে, গ্রামের জীবনে ধীরে ধীরে স্বাভাবিকতা ফিরে আসে। তবে মানুষ বদলে যায়। কেউ আর রাতে একা বেরোয় না, কেউ আর হেসে বলে না—ভূত বলে কিছু নেই। বরং লোকজন এখন আগুনকে আবার শ্রদ্ধা করতে শিখেছে, চাঁদকে নতুন করে ভয় পায়। যারা জানে, তারা বোঝে—’রক্তচোখা’ কি ছিল, কিংবা কে ছিল, সেই উত্তর হয়তো একদিন ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাবে, কিন্তু কিছু সত্য থেকে যাবে বাতাসে ভেসে। আর সেই গাছ, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিরীহ এক গাছ, তার পাতায় মাঝে মাঝে এখনো ঝলসে ওঠে লাল আলো। যেন এক অদৃশ্য উপস্থিতি জানিয়ে দেয়—”আমি একদম হারাইনি, শুধু শান্ত হয়েছি।” গ্রামের লোকেরা তাই চাঁদের আলোয় চোখ মেলে না, কেউ আর জানালার দিকে তাকায় না পূর্ণিমার রাতে—কারণ নিস্তব্ধতার মাঝেও যে গল্পেরা কথা বলে, তাদের ভাষা বোঝে না সবাই।

সমাপ্ত

 

1000049715.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *