সঙ্ঘমিত্রা পাল
পর্ব ১: ছায়ার চিঠি
কলকাতা শহর নিঃশব্দে ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু সেই রাতে, মধ্যরাত্রির প্রান্তে দাঁড়িয়ে, অনির্বাণ ঘোষ বুঝে গিয়েছিল—ঘুম কেবল শরীরের হয়, শহরের নয়। তার জানালার নিচে রাখা কাঠের চেয়ারে, বাতাসে হেলে পড়া একটি খাম, যেন কোনো নিঃশব্দ ছায়া রেখে গেছে নিজের সাক্ষর।
খামটা ছিল পুরোনো—হলুদ রঙের, সুতির দাগ লেগে থাকা কাগজে মোড়া, আর মুখ সিল করা রক্তরঙ মোম দিয়ে, যার গায়ে আঁকা ছিল এক অচেনা চিহ্ন—তিনটি পরস্পরসংযুক্ত ত্রিভুজ, যার কেন্দ্র ছিল শূন্য।
সে প্রথমে ভেবেছিল, কেউ হয়তো ভুল করে রেখে গেছে। কিন্তু খামটা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ত্বক ঠান্ডা হয়ে এল—অস্বাভাবিক এক ঠান্ডা, যেন সময় তার ভিতর দিয়ে পেছনে হেঁটে চলেছে।
ভেতরে একটি ছোট্ট কাগজ। অদ্ভুতভাবে পরিষ্কার হস্তাক্ষরে লেখা:
“তুমি বেছে নেওয়া হয়েছো। চক্র সম্পূর্ণ হবে পূর্ণিমার রাতে। প্রস্তুত থেকো।”
তালার মতো ভারী চুপচাপ একটি শব্দ তার বুকে নামল।
নিচে কোনো প্রেরকের নাম নেই। শুধু একটিমাত্র শব্দ বড় অক্ষরে লেখা—
“অর্গাস”।
শব্দটা তার কাছে অচেনা নয়। বহু বছর আগে, যখন দাদু নীলমাধব ঘোষ বেঁচে ছিলেন, তার ঘরের আলমারিতে একটা পুরোনো ডায়েরি ছিল—দাগপড়া পাতায় লেখা হতো অদ্ভুত সব কথা, ইতিহাস, গোপন নাম। অনির্বাণ কিশোর বয়সে একবার সেই ডায়েরির পাতায় এই শব্দটা দেখেছিল—‘অর্গাস’। তখন তা নিছক কল্পনাচার ভেবেছিল সে।
কিন্তু আজ, সেই শব্দ ফিরে এসেছে বাস্তবে।
রাতটা জেগে কাটাল সে। ভোরবেলা, আলো ছোঁয়ার আগে, বেরিয়ে পড়ল। লক্ষ্য একটাই—দাদুর ডায়েরির সূত্র ধরে সত্যটা খুঁজে বের করা।
আজিজ লেনের শেষে যে পুরোনো বইয়ের দোকানটা আছে, ‘সূর্যবংশী বুক কোম্পানি’, দাদু সেখানে কাজ করতেন যৌবনে। বহু পুরোনো, কাঠের তাকভরা সেই দোকানে একসময় শহরের সবচেয়ে রহস্যময় বই আসত বলে কথা ছিল।
দোকানে ঢুকতেই একটা বাজে গন্ধ নাকে এল—আর্দ্রতা, ধুলো আর জমানো সময়ের গন্ধ। ভিতরে এক বয়স্ক লোক বসে, তার চুল ধূসর, গলায় কড়মড়ে কাশি। অনির্বাণ কিছু বলার আগেই লোকটা বলল, “তুমি নীলমাধবের নাতি, না?”
“আপনি জানলেন কী করে?” তার গলা কেঁপে গেল।
লোকটা দাঁড়িয়ে এল, বলল, “এই দোকানের প্রতিটা ধুলোকণা জানে, কারা ফিরে আসে অতীতকে জাগাতে। অর্গাস ডাকলে কেউ ফেরায় না।”
অনির্বাণ ধীরে ধীরে জানতে পারল—‘অর্গাস’ আসলে একটা গুপ্ত সমিতি, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল উনিশ শতকের শেষ দিকে। তখন ব্রিটিশ শাসনের সময়, কলকাতা ছিল দুটি শহরের সমষ্টি—একটা আলোর, আর একটা ছায়ার। আলোর শহরে ছিল কলকাতার বাবু সংস্কৃতি, সাহিত্য, মঞ্চ আর আন্দোলন। ছায়ার শহরে ছিল তন্ত্র, গোপন বিজ্ঞান, নিষিদ্ধ জ্ঞান, আর এক সমিতি—অর্গাস।
অর্গাসের মূল উদ্দেশ্য ছিল “জ্ঞানের চক্র সম্পূর্ণ করা”—এমন জ্ঞান যা সময়কে বাঁকিয়ে দিতে পারে, মানুষকে তার চেতনার অতলে নামিয়ে আনতে পারে। সমিতির সদস্যরা ছিল একসময়কার মহাবিদ্বান, সাধক, কবি, বিপ্লবী—কিন্তু ইতিহাস তাদের নাম ভুলে গেছে, কারণ ওরা নিজেই চেয়েছিল ভুলে যেতে।
আর এখন, নতুন চক্র শুরু হতে চলেছে। তারা অনির্বাণকে বেছে নিয়েছে।
“কিন্তু কেন আমি?” অনির্বাণ ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল।
লোকটা তাকাল গভীর চোখে। “কারণ তোমার রক্তেই সেই স্মৃতি আছে। নীলমাধব ঘোষ একসময় অর্গাসের প্রণেতাদের একজন ছিল। কিন্তু শেষ চক্র ভাঙার সময়, তিনি চলে আসেন বাইরে। কেউ কেউ বলে, তিনি চুক্তি ভেঙেছিলেন। আর অর্গাস সেই বিশ্বাসঘাতকতাকে ক্ষমা করেনি।”
অনির্বাণ অনুভব করল, কিছু একটা ভেতরে নড়ছে—একটা অস্বস্তিকর পরিচয়ের বোধ।
তখনই দোকানের পেছনের একটা তাক নিজের থেকে খুলে গেল। ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটি অদ্ভুত বই—কালো মলাট, সোনালি অক্ষরে লেখা ছিল: “স্মৃতি চক্রের খাতা”।
লোকটা বলল, “নাও। এটা দাদু রেখে গিয়েছিলেন। যখন সময় আসবে, তখন তুমি পাবে বলে।”
অনির্বাণ বইটা হাতে নিল। তার আঙুল ছোঁয়ামাত্র বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠা খুলে গেল নিজে থেকেই। আর সেখানেই সে দেখল নিজের নাম।
অনির্বাণ ঘোষ। জন্ম: ১৯৯৬।
পূর্বনির্ধারিত ভূমিকা: চক্রের চতুর্থ দৃষ্টি।
তখনই বাইরের আকাশে পূর্ণিমার আলো ফুটল। শহরের দূরে কোথাও একটা ঘণ্টা বাজল। অর্গাস জেগে উঠেছে।
আর অনির্বাণ জানে, তার ফেরা নেই।
পর্ব ২: চক্রের প্রথম দরজা
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। কলকাতার আকাশে ছড়ানো সোনালি-ধূসর আলোটা ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছিল ইট-কাঠের ভিতর, আর সেই সময়েই অনির্বাণ বইটা হাতে নিয়ে হাঁটছিল কলেজ স্ট্রিটের ভিড়ের মাঝখানে—তার হাতে যেন কেউ একটা জীবন্ত বস্তু দিয়ে দিয়েছে। স্মৃতি চক্রের খাতা, তার দাদুর রেখে যাওয়া অজানা জিনিস, যার পাতায় সে নিজের নাম দেখেছে—একটা পূর্বনির্ধারিত ভবিষ্যতের মতো।
বইটা সে ব্যাগে রাখতে পারছিল না। কিছু একটা তাকে বারবার বলছিল—খুলে পড়ো, এই মুহূর্তে, এই ভিড়ের মধ্যেই। অবচেতন কোনও ঘর যেন কড়া নাড়ছিল তার মস্তিষ্কের গোপন প্রাচীরে। কিন্তু সে জানত, সেই দরজা একবার খুললে আর আগের মতো ফেরা যাবে না।
সে হাঁটছিল, আর তার চারপাশে সবকিছু বদলে যাচ্ছিল। লোকজনের মুখ ধূসর হয়ে যাচ্ছিল, রিকশার চাকা যেন স্থির, হর্ন থেমে গিয়েছে—সময়ের গতি যেন থেমে পড়েছে।
ঠিক সেই সময়, কলেজ স্ট্রিটের প্রান্তে সে দেখতে পেল একটি কাঠের দরজা—অত্যন্ত পুরনো, প্রায় পঁচে যাওয়া কাঠ, যার গায়ে খোদাই করা একই প্রতীক: তিনটি পরস্পর-জোড়া ত্রিভুজ। এই চিহ্নটা সেই চিঠির খামে ছিল, সেই দোকানের বইয়ের মলাটে ছিল—এটাই অর্গাসের ছাপ।
দরজাটা সাধারণ বাড়ির মতো লাগছিল না। এর চারপাশটা যেন কুয়াশায় ঢাকা, অথচ ভরদুপুরের আলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল সে। আশপাশের কেউ যেন সেটাকে দেখছেও না। মানুষ সেই দরজার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, যেন তা দৃশ্যমানই নয়।
অনির্বাণ ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। তার পায়ের শব্দ বন্ধ হয়ে গেল নিজে থেকেই। সে যখন দরজার হাতলে হাত রাখল, তখন একটা ফিসফাস ভেসে এল ভিতর থেকে—কোনও ভাষাহীন কথাবার্তা, যেন পুরনো পাণ্ডুলিপির বর্ণমালার শ্বাস।
দরজা খুলে গেল নিজে থেকেই।
ভিতরে অন্ধকার। কিন্তু সেই অন্ধকারে ভয়ের বদলে ছিল একটা স্তব্ধতা, এমন এক স্তব্ধতা যা বইয়ের পাতায় থাকে, পাথরের গায়ে খোদাই করা নামের মধ্যে থাকে।
সে ঢুকে পড়ল।
দরজা পিছনে বন্ধ হয়ে গেল, নিঃশব্দে। এখন সে এক দীর্ঘ, সরু করিডোরে দাঁড়িয়ে। চারপাশে পুরনো দেওয়াল, ছাদে জ্বলছিল একটিমাত্র তেলের বাতি। বাতাসে গন্ধ ছিল চন্দন, পুরোনো কালির, আর একটি অচেনা ধূপের—যার ঘ্রাণ অস্থিমজ্জা পর্যন্ত প্রবেশ করছিল।
দেয়ালের গায়ে আঁকা ছিল প্রতীক—ত্রিভুজ, বৃত্ত, রক্তরঙ রেখা। সব এক রহস্যের ইঙ্গিত দিচ্ছিল, অথচ কোনটা কোনটার মানে কেউ জানে না। করিডোরের শেষপ্রান্তে ছিল একটা টেবিল, তার উপর রাখা একটি ধাতব ঘণ্টা।
অনির্বাণ এগিয়ে গিয়ে ঘণ্টাটিতে হাত রাখতেই অদ্ভুত এক কম্পন ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। সে বোঝে, এটা একটা ডাক। ঘন্টা বাজানো মানে সম্মতি। চক্রে প্রবেশের অনুমতি।
কিন্তু সে কি প্রস্তুত?
এই প্রশ্নটা মাথার ভিতর ঘুরছিল ঠিক তখনই, যখন দেয়ালের একপ্রান্ত খুলে গিয়ে বেরিয়ে এল এক ছায়ামূর্তি। মুখ ঢাকা ছিল, পোশাক কালো, আর চোখ—সাদা। একেবারে সাদা, কোনও মণি নেই। অথচ সেই চোখে এক অভ্যর্থনার ছাপ ছিল।
ছায়ামূর্তি বলল না কিছুই। সে শুধু হাতে তুলে ধরল একটা ধাতব প্যাডলক আর একটা চাবি। তারপর শব্দহীন পায়ে ফিরে গেল দেয়ালের ভেতরে।
টেবিলের পাশেই দেখা গেল একটি ছোট লোহার দরজা—তিনটা প্যাডলক লাগানো, কিন্তু তার মধ্যে একটি খোলা যাবে এই চাবি দিয়ে।
অনির্বাণ এগিয়ে গিয়ে প্যাডলক খুলল।
তার ভিতর ছিল একটা আয়না। কিন্তু এই আয়না সাধারণ ছিল না—তাতে নিজের চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। সেখানে অনির্বাণ দেখল—একটি ছেলে, ছেঁড়া জামা পরে, চোখের নিচে কালি, ঠোঁটে রক্তের দাগ, আর পেছনে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধ, যার চোখের চাউনি ভয়ংকরভাবে পরিচিত।
এটা তার নিজেরই প্রতিচ্ছবি—কিন্তু অন্য সময়ের, হয়তো অন্য জীবনের।
তার কাঁপা হাতে আয়নার পেছনে সে পেল একটা নোট:
“প্রথম দরজা পেরোলেই স্মৃতির জাগরণ। আগামী পূর্ণিমার রাতে ‘প্রাঙ্গণ’ তোমায় গ্রহণ করবে। প্রস্তুত থেকো। তোমার পূর্বপুরুষ যা ত্যাগ করেছিলেন, তা এবার সম্পূর্ণ হবে।”
নোটে কোনও স্বাক্ষর ছিল না। কিন্তু পাশে আঁকা ছিল আবার সেই প্রতীক।
ঘণ্টা এবার নিজে থেকেই বেজে উঠল।
অন্ধকারে সে দেখতে পেল দেওয়ালের একপাশে একটা নতুন দরজা—আগের চেয়েও বড়, গায়ে রক্তরঙের তেলতোলা প্যাঁচানো নকশা। উপরে লেখা—
“দ্বিতীয় দৃষ্টি”
অনির্বাণ জানে না, কোন দিক যেতে হবে, কিন্তু তার ভিতরে এক ভয়ানক নিশ্চয়তা জন্ম নিচ্ছে—এখান থেকে ফেরা নেই। সে যে পথে পা বাড়িয়েছে, তা শুধু সামনে যায়। আর অর্গাস—এই গুপ্ত সমিতি—তার রক্তে ছাপ ফেলে দিয়েছে।
হঠাৎ করিডোরের বাতি নিভে গেল।
এক অন্ধকার কণ্ঠস্বর শুধাল—“তুমি কি প্রস্তুত দ্বিতীয় দরজার জন্য, দৃষ্টি বাহক?”
তার ঠোঁট নিঃশব্দে কাঁপল।
“হ্যাঁ।”
পর্ব ৩: দ্বিতীয় দৃষ্টি
অন্ধকার। নিঃশব্দ। অথচ ভেতরে যেন চলছিল এক অদৃশ্য শব্দের উত্তাল প্রবাহ, যা কেবল মনে, রক্তে, না বলা ভয়গুলোর মধ্যে প্রতিধ্বনি তুলছিল।
অনির্বাণ দাঁড়িয়ে ছিল সেই নতুন দরজার সামনে—উঁচু, ধাতব কাঠামোয় গড়া, যার গায়ে আঁকা ছিল ত্রিভুজাকৃতি এক জটিল নকশা, যেন তন্ত্রের গোপন ছক, চোখে না দেখা এক মানচিত্র। উপরে খোদাই করা ছিল তিনটি শব্দ—“দ্বিতীয় দৃষ্টি আরম্ভ”।
দরজার সামনে দাঁড়িয়েই তার শরীর কেঁপে উঠছিল। কোনো ভয় নয়, বরং এক অপরিচিত উত্তেজনা—যা তার ইন্দ্রিয়গুলোকে তীক্ষ্ণ করে তুলছিল, গন্ধ, শব্দ, আলো সবকিছুকে যেন নতুনভাবে অনুভব করতে শেখাচ্ছিল।
সে দরজায় হাত রাখল। মুহূর্তেই ধাতব পৃষ্ঠটা নড়ে উঠল, এক নিঃশব্দ অঙ্গুলিনির্দেশে দরজা সরে গেল।
ভিতরে যা দেখল, তা বাস্তব আর স্বপ্নের মাঝামাঝি এক জায়গা।
এটি ছিল এক ঘূর্ণায়মান ঘর—দেয়ালের গায়ে অসংখ্য আয়না, প্রতিটিতে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, ভিন্ন সময়, ভিন্ন মানুষ। প্রতিটা আয়নায় অনির্বাণ নিজেকে দেখছিল, কিন্তু একেকজন অনির্বাণ যেন একেক ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা।
একটি আয়নায় সে দেখল—সে একজন তরুণ সন্ন্যাসী, গায়ে গেরুয়া, চোখে জ্বলন্ত দৃষ্টি, পিছনে জ্বলছে একটি প্রাচীন বেদি। অন্য আয়নায়—সে ব্রিটিশ কালে এক বিপ্লবী, চোখে গামছা বাঁধা, রক্তাক্ত হাতে রিভলভার। তৃতীয় আয়নায়—এক বৃদ্ধ, কানে শ্রুতিহীন দুল, ট্যাটুতে মোড়া শরীর, গায়ে কালো তিলক। কিন্তু সবার চোখে সেই এক দৃষ্টি—দ্বিতীয় দৃষ্টি, যা দেখছে না দেখা জিনিসগুলোকে।
হঠাৎ করেই ঘরটি থেমে গেল। এক আয়না নিজে থেকেই ঝাঁপিয়ে বেরিয়ে এল সামনে, এবং আয়নার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল সেই ছায়ামূর্তির মতো একজন মানুষ—চেহারায় ধোঁয়াটে, মুখ অস্পষ্ট, কিন্তু গলায় কাঁটা দিয়ে জড়ানো একমুঠো শব্দ।
সে বলল, “তুমি কি জানো, দ্বিতীয় দৃষ্টি কী?”
অনির্বাণ ধীরে মাথা নাড়ল।
লোকটি কাছে এগিয়ে এল। তার চোখ দু’টি পরিষ্কার, ভয়ানক রকম স্থির, আর বলল, “দ্বিতীয় দৃষ্টি হল সেই দৃষ্টি যা আত্মার ভিতর দিয়ে চলে যায়। যা চোখে দেখে না, স্মৃতিতে খোঁজে। তুমি যা ভাবো, তুমি তার চেয়েও বেশি। এই ঘরে প্রতিটি আয়না তোমার ভিন্ন জন্ম, ভিন্ন দায়িত্বের সাক্ষ্য বহন করে। এখন তুমি নির্বাচন করবে—কোন জীবনের বোঝা বহন করবে তুমি এবার।”
এক মুহূর্তের জন্য অনির্বাণের মনে হল, সে পেছনে ফিরে যাবে। হয়তো সব ভুলে যাবে, দাদুর ডায়েরি, অর্গাস, এই রহস্যময় চক্র। কিন্তু ভেতরের কণ্ঠ বলল—এখানে আসা কেবল শুরু, বেছে নেওয়া কেবল নিয়তি নয়, উত্তরাধিকার।
সে বলল, “আমি প্রস্তুত।”
লোকটি একে একে তিনটি আয়নার দিকে ইশারা করল। প্রথমটিতে—আকাশজুড়ে আগুন, মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা গ্রন্থাগার, এক যাজক দাঁড়িয়ে একজন কিশোরের দিকে আঙুল তুলছে—চিহ্নিত করছে। দ্বিতীয়টিতে—এক অন্ধকার কূপ, যার গায়ে গেঁথে আছে শত শত হাতের ছাপ। আর তৃতীয় আয়নায়—রক্তমাখা এক ঘর, মেঝেতে এক শব্দ লেখা—“প্রত্যাবর্তন”।
“বেছে নাও,” লোকটি বলল। “যেকোনো একটি পথ এই চক্রে তোমার প্রবেশ নির্ধারণ করবে। বাকি পথ মুছে যাবে।”
অনির্বাণ প্রথমে দ্বিতীয় আয়নার দিকে তাকাল—কূপ, অজানা গভীরতা, কিন্তু সে জানে, সে ডুববে না, সে কেবল তলদেশ স্পর্শ করবে।
সে বলল, “আমি দ্বিতীয় পথ বেছে নিচ্ছি।”
লোকটি বলল না কিছুই। কেবল পেছনের এক দরজায় ইঙ্গিত করল। আয়নাটা ঘুরে গিয়ে এক গোলক দরজায় পরিণত হল—যা ঘূর্ণায়মান, যেন এক জ্যোতির্বৃত্ত।
সে যখন ভিতরে প্রবেশ করল, তার পায়ের নিচে জমি বদলাতে লাগল। এবার সে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন জায়গায়—দেয়ালের বদলে গুহা, মেঝে পাথরের, আর প্রতিটি কোণে বসে আছে কালো কাপড় জড়ানো চারটি সত্তা।
তারা মুখ তুলল না, কথা বলল না। কিন্তু একসঙ্গে চারটে কণ্ঠস্বর অনির্বাণের মাথার ভিতরে কথা বলল।
“তুমি প্রবেশ করেছো দ্বিতীয় চক্রে। এখন আমরা তোমার মস্তিষ্কের চাবি খুলব।”
একটি ছায়া উঠে এসে তার কপালে হাত রাখল। সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে ফুটে উঠতে লাগল ছবি—মনে পড়ে না এমন স্মৃতি, কখনো না দেখা মুখ, পুরনো মন্দির, নির্জন ঘর, ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বালক, যার নামও মনে নেই, অথচ হৃদয় কেঁপে উঠছে চিনতে গিয়ে।
তার মাথায় প্রবল চাপ—না শারীরিক, না মানসিক—বরং এক মিশ্র জাগরণ, এক প্রবল সত্য উন্মোচনের যন্ত্রণা।
“তুমি এখন জানো, দ্বিতীয় দৃষ্টি কী। এখন শুরু হবে চতুর্থ বৃত্তের সঞ্চালন,” চার কণ্ঠ একসঙ্গে বলল।
তারা একসঙ্গে বলল,
“তোমার শরীর আর তোমার চিন্তা এখন দুটি আলাদা কক্ষ। তুমি তাদের একত্র করবে কিনা, সেটাই নির্ধারণ করবে অর্গাসের ভবিষ্যৎ।”
তার কাঁধে একটি প্রতীক আঁকা হল—লাল কালি দিয়ে, নিঃশব্দে, যেন তা শরীরের চেয়ে আত্মায় গেঁথে যাচ্ছে।
তারপর তাকে দেওয়া হল একটি কাগজের টুকরো। সেখানে লেখা ছিল:
“পরবর্তী পূর্ণিমায় দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের ঘাটে এসো। পেছনের অলিন্দের নিচে থাকবে তৃতীয় চক্রের প্রবেশদ্বার। তুমি এখন দৃষ্টি বাহক, অতীত বাহক, এবং রক্ত সাক্ষী। অর্গাস এখন তোমার ভিতরে।”
ভিতরে হাওয়া স্তব্ধ। শব্দ নেই, কেবল তার হৃদয়ের গর্জন।
সে জানত না, সামনে কী অপেক্ষা করছে। শুধু জানত—সে পেছনে ফিরতে পারবে না।
পর্ব ৪: অলিন্দের নিচে
দক্ষিণেশ্বর ঘাটে পৌঁছানোর আগের দিন, কলকাতা শহর অদ্ভুতভাবে নিস্তব্ধ হয়ে উঠেছিল। সকাল থেকে আকাশে ছিল ধূসর ছায়া, কিন্তু বৃষ্টি হয়নি। মানুষজন ব্যস্ত, অথচ তাদের মুখে এক রকম উদ্বেগ, যেন অচেনা কিছুর আগমন টের পাচ্ছে সবাই, কিন্তু কেউ তা উচ্চারণ করছে না।
অনির্বাণ ততদিনে বদলে গেছে। বাইরের পোশাক, চেহারা—সব এক রকম রয়ে গেছে, কিন্তু ভিতরে সে যেন কোনও সময়চক্রে আটকে গেছে। দ্বিতীয় দৃষ্টির অভিজ্ঞতা তার চিন্তাকে তীক্ষ্ণ করেছে, স্মৃতিকে গলে দিয়েছে। সে জানে, তার মধ্যে এখন আর একজন বসবাস করছে—অর্গাসের কেউ, হয়তো পুরনো জন্ম থেকে টেনে আনা কোনও সত্তা।
সে যে কাগজ পেয়েছিল, তাতে লিখা ছিল:
“পরবর্তী পূর্ণিমায় দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের ঘাটে এসো। পেছনের অলিন্দের নিচে থাকবে তৃতীয় চক্রের প্রবেশদ্বার।”
সেই নির্দেশেই সে পৌঁছেছিল মন্দিরে, এক বিকেলে, যখন গঙ্গার জল সোনা-সাদা হয়ে ঝলমল করছিল, আর পূর্ণিমার আলো ধীরে ধীরে মন্দিরের চূড়ায় হালকা আঙুল ছুঁইয়ে যাচ্ছিল।
সে মন্দির চত্বরের ভেতর ঢুকল না। বরং বামদিক ঘুরে চলে গেল পেছনের অলিন্দের দিকে—যেখানে মানুষজন কম আসে, যেটা প্রায় অবহেলিত, ধুলো আর সময়ের স্তরে ঢাকা। মন্দিরের মূল প্রবেশপথ থেকে অনেক দূরে, সেই অলিন্দ যেন এক অপ্রকাশ্য ইতিহাস লুকিয়ে রেখেছে।
সেখানে দাঁড়িয়ে, সে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকল। একটা শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছিল বারবার, যেন গঙ্গার দিক থেকে নয়, মাটির নিচ থেকে উঠে আসছে। অলিন্দের নিচে একটা ছোট পাথরের দরজা ছিল, চোখ এড়িয়ে যাওয়া যায় সহজেই। সেখানে কেউ সাধারণত যায় না, কারণ সেখানে কোনও পূজা হয় না, আলোও পড়ে না।
অনির্বাণ জানত, এটিই সেই প্রবেশদ্বার।
সে নিচু হয়ে দরজার গায়ে হাত রাখতেই এক মৃদু শব্দ হল—না তালা ভাঙার, না ধাক্কার—বরং যেন কেউ ভিতর থেকে ধীরে খুলে দিল। দরজা খুলতেই বেরিয়ে এল একধরনের ঘন, ধোঁয়াটে বাতাস—যা রক্তে ধীরে ধীরে জমে উঠতে থাকে।
ভিতরে ছিল একটা সরু সিঁড়ি—নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। কোনও আলো নেই, কেবল দেওয়ালের খাঁজে খাঁজে সাদা দাগ, যা দেখতে আয়তকার। সে বুঝতে পারছিল না, তা রক্ত নাকি অন্য কিছু।
পা রাখতেই শোনা গেল নিজের পায়ের শব্দ। প্রতিটি ধাপে ধাপে যেন শহরের শব্দ হারিয়ে যাচ্ছিল। ট্রামের টুংটাং, আরতি ঘন্টার ধ্বনি, জলর ধারা—সব মুছে যেতে লাগল। সে যেন নামছে এক বিকল্প কলকাতায়, শহরের নিচে গড়ে ওঠা এক ছায়া-কলকাতায়, যা সাধারণ চোখে দেখা যায় না।
প্রায় বিশ ধাপ নিচে নামার পর সে পৌঁছল এক ছোট চৌচৌ পাথরের ঘরে।
ঘরটিতে মাত্র একটি তেল-প্রদীপ জ্বলছিল—আলো কম, কিন্তু যথেষ্ট। দেয়ালের গায়ে ছিল সেই চিহ্ন—ত্রিভুজ, বৃত্ত, আর মাঝখানে চোখ। কেন্দ্রচিহ্নটা এবার একটু আলাদা ছিল। এই প্রথম সে দেখল চক্রের ভিতরে একটা খালি জায়গা রাখা—যেখানে কিছুই নেই, কেবল ফাঁকা।
ঘরের মাঝখানে বসে ছিল তিনজন লোক। মুখে মুখোশ—তিন রকমের। একটি সাদা, চোখ ছাড়া কিছুই নেই। একটি লাল, মুখখানা হাঁ করা, যেন চিৎকার থেমে আছে। আর তৃতীয়টি কালো, সম্পূর্ণ বন্ধ, যেন মৃত্যুর প্রতিচ্ছবি।
তারা একসঙ্গে অনির্বাণের দিকে তাকাল।
সাদা মুখোশ বলল, “তুমি এসেছো, আমরা জানতাম।”
লাল মুখোশ ফিসফিস করে বলল, “তুমি এখন প্রস্তুত, কিন্তু আমাদের পরীক্ষা বাকি।”
কালো মুখোশ কিছু বলল না। সে কেবল একটি পাথরের বাক্স সামনে এগিয়ে দিল।
“এটাই তৃতীয় চক্রের গহ্বর,” সাদা মুখোশ বলল।
“তুমি কি জানো, অর্গাসের তৃতীয় স্তর কী?” ফিসফিস করল লাল মুখোশ।
অনির্বাণ মুখ তুলল। “জানি না,” সে বলল। “কিন্তু জানতে চাই।”
সাদা মুখোশ মাথা নাড়ল। “তৃতীয় চক্র হল ‘স্মৃতি-মুকুন্দ’। অর্থাৎ তুমি যা ভুলে গেছো, সেটাই তোমাকে ফিরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু ফিরিয়ে আনলে তুমি বদলে যাবে। একবার সেই স্মৃতির পুকুরে নামলে, আগের তুমি থাকবে না।”
পাথরের বাক্সের ঢাকনা খুলতেই ভিতরে দেখা গেল এক গোলাকার বস্তু—আধা স্বচ্ছ, স্ফটিকের মতো, কিন্তু তার মধ্যে আবছা নড়ে চলছিল দৃশ্যপট—যেন এক টুকরো সময় বন্দী হয়ে আছে।
সাদা মুখোশ বলল, “এই সময়দৃষ্টি তোমাকে নিয়ে যাবে তোমার সেই স্মৃতিতে, যা অর্গাস ভুলিয়ে দিয়েছে। তুমি দেখবে, শোনাবে, এবং আবার ফিরে আসবে… যদি পারো।”
লাল মুখোশ ঝুঁকে বলল, “তবে মনে রেখো, কিছু দেখা যায়, যা আবার না-দেখার মতো নয়।”
অনির্বাণ সেই গোলকটি হাতে তুলল। সঙ্গে সঙ্গে তার ভিতর দিয়ে এক প্রবল শ্বাস যেন ছুটে গেল। চোখ বুঁজতেই সে নিজেকে দেখতে পেল—না কলকাতায়, না এই জীবনে।
সে দাঁড়িয়ে আছে এক পোড়োবাড়িতে। দেয়াল ভেঙে পড়া, মেঝেতে ছাই। আর সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক বালক—চোখে অভিমান, হাতে এক পুরোনো বই, যার গায়ে লেখা—
“অর্গাস: শুরুর দিনলিপি”
অনির্বাণ বুঝল, এই বালক সে নিজে নয়, কিন্তু তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার এক পূর্বজন্ম।
বালক বলল, “তুমি দেরি করেছো। এই বই বহু আগেই তোমার হাতে আসা উচিত ছিল।”
“আমি কে?” অনির্বাণ প্রশ্ন করল।
“তুমি সেই, যে একবার চুক্তি ভেঙেছিলে। আর এখন ফিরে এসেছো সেই চুক্তিকে পূর্ণ করতে।”
এরপর সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেল।
চোখ খুলে সে দেখল, নিজেকে মাটিতে পড়ে আছে। তিন মুখোশের লোক ঘিরে দাঁড়িয়ে।
কালো মুখোশ এবার প্রথম কথা বলল—গভীর, ধীর কণ্ঠে।
“তুমি এখন চতুর্থ দৃষ্টির অধিকারী। কিন্তু সব স্মৃতি ফিরে পেলে, তুমি হয় তোমার শরীর হারাবে, নয় আত্মা।”
তার ডান হাত জ্বলে উঠল। চামড়ার নিচে ফুটে উঠল সেই প্রতীক—এইবার স্পষ্ট, কাটা রক্তরেখায় খোদাই করা।
ঘর নিঃশব্দ।
“পরবর্তী চক্রে তুমি একা যাবে,” সাদা মুখোশ বলল।
“অন্ধকার এখন তোমার ভিতরে প্রবেশ করেছে,” বলল লাল মুখোশ।
তিনজন মিলিয়ে উচ্চারণ করল:
“অর্গাস তোমাকে গ্রহণ করল। তুমি এখন পথ, দৃষ্টি এবং চুক্তি।”
পর্ব ৫: রক্তচুক্তির রাত
কলকাতা তখন গভীর রাতে নিঃশব্দ। পূর্ণিমার আলো ততক্ষণে পুরনো ইমারতগুলোর গায়ে থিতিয়ে পড়েছে, গঙ্গার ঢেউয়ে ঝিলমিল করে উঠেছে অদ্ভুত এক রূপালি আভা। শহর নিঃশব্দ, কিন্তু সেই নিঃশব্দতার ভিতরে অনির্বাণ শুনতে পাচ্ছিল চক্রের স্পন্দন—এক ছায়া-শব্দ, যা তার বুকের মধ্য দিয়ে কেঁপে উঠছিল।
তৃতীয় চক্র পার হয়ে আসার পর থেকে সময় যেন তাকে ধরেই রাখেনি—সব কিছু ভেসে যাচ্ছে, তার স্মৃতির ভেতরকার দেয়ালগুলো খুলে পড়ছে। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ—সবকিছু এক অনির্দিষ্ট রেখায় মিশে যাচ্ছে। আর এই রেখার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে এক রক্তচুক্তি, যা তার জন্য বরাদ্দ।
সে জানে, আজ রাতেই তাকে সেই চুক্তির সামনে দাঁড়াতে হবে—এক চুক্তি, যা বহু পুরোনো, যাকে তার পূর্বপুরুষ ভাঙতে চেয়েছিলেন, কিন্তু যা ভাঙা যায় না, কেবল মুলতুবি থাকে। আজ সেই মুলতুবির মেয়াদ শেষ।
সে ফিরে যায় শহরের এক পুরনো অংশে—নর্থ কলকাতার ভিতরে, যেখানে রাস্তার পাশের বাড়িগুলো সিংহদুয়ারে ভরপুর, জানালার শার্সিতে ঝুলে আছে শতাব্দীর ধুলো। একটা নির্দিষ্ট বাড়ির সামনে এসে থামে সে—বাড়িটার নাম লেখা নেই, কেবল দরজার ওপর একটি চিহ্ন আঁকা: তিনটি ত্রিভুজ, একটি রক্তচক্র, আর এক কণা ফাঁকা শূন্যতা।
সে ঠেলে দরজা খোলে।
বাড়ির ভিতরে এক অদ্ভুত গন্ধ—পুরোনো কাঠ, ধূপ, আর কিছু অচেনা, কাঁচা লৌহের মতো গন্ধ, যা রক্তের সাথেই মিশে থাকে। ভিতরে কেউ নেই, অথচ নিঃসন্দেহে কেউ ছিল বা এখনও আছে, কারণ বাতাসে ছায়া ভাসছে।
দেয়ালের গায়ে আঁকা নানা প্রতীক। একটি দেয়ালে বড় করে লেখা:
“যে চুক্তি রক্তে লেখা, তা কেবল রক্তেই পূর্ণ হয়।”
ভেতরের ঘরে গিয়ে সে দেখে, একটি চতুর্ভুজাকৃতি পাথরের বেদি রাখা, আর তার ওপরে রাখা এক পুরোনো খাতা, খুলে রাখা অবস্থায়। পাশে রাখা একটি ছোট পিতলের পাত্র, যার ভিতর একটি ছুঁচ এবং একটি সিলমোহর।
অনির্বাণ এগিয়ে গিয়ে খাতার উপর ঝুঁকে পড়ে।
তাতে স্পষ্ট লেখা:
“দৃষ্টি বাহক অনির্বাণ ঘোষ, তুমি আজ অর্গাসের চতুর্থ স্তরে প্রবেশ করছো। এই রক্তচুক্তির মাধ্যমে তুমি গ্রহণ করবে তোমার পূর্বপুরুষের ঋণ, এবং দেবে ভবিষ্যতের জন্য প্রতিশ্রুতি। একবার সিলমোহর পড়লে, তুমি অর্গাস হয়ে উঠবে নিজেই।”
তার শরীর কেঁপে ওঠে। সে জানে না, ঠিক কী ঋণ তার দাদু রেখে গিয়েছিলেন। জানে না, এই চুক্তির মানে কতটা গভীর। কিন্তু তার মনে পড়ে—দ্বিতীয় দৃষ্টির আয়নায় সে যাকে দেখেছিল, সেই বৃদ্ধ, যিনি মুখ ফিরিয়ে ছিলেন, তিনি হয়তো ঠিক এই চুক্তির সামনে দাঁড়িয়ে একইভাবে কাঁপছিলেন। এবং ফিরেও গিয়েছিলেন।
কিন্তু সে যাবে না।
সে ছুঁচটা তুলে তার বাঁ হাতের তর্জনীতে ফোঁড়ায় এক ফোঁটা রক্ত। তারপর সেই রক্ত খাতার নির্ধারিত ঘরে ফেলে দেয়—চক্রের প্রতীকের মাঝখানে।
সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। ঘরের ভিতরে যেন এক অদৃশ্য দরজা খুলে যায়।
সিলমোহরটা নিজে থেকেই উঠে এসে রক্তচক্রের ওপর গেঁথে যায়।
তারপরেই, ঘরের ভিতরে আগুন জ্বলে ওঠে—না আগুনের তাপে, বরং এক ধরনের আলোয়। প্রতিটি দেয়াল জ্বলে ওঠে তাম্র-রঙে। আর বেদির চারপাশে উপস্থিত হয় ছয়টি ছায়ামূর্তি—যারা মুখোশ পরা, গলায় ঝুলছে রুদ্রাক্ষ, আর প্রত্যেকের কপালে আঁকা সেই একই প্রতীক।
তারা ঘিরে দাঁড়ায় অনির্বাণকে।
একসঙ্গে বলে ওঠে,
“তুমি এখন রক্তচুক্তিতে প্রবেশ করলে। অর্গাস তোমাকে গ্রহণ করল, কিন্তু তার বিনিময়ে এক স্মৃতি, এক নাম, এক জীবন দিতে হবে।”
একজন মুখোশধারী এগিয়ে এসে তার কপালে আঙুল ছোঁয়ায়। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের সামনে ফুটে ওঠে এক স্মৃতি—সে একটা মাঠে দাঁড়িয়ে, চারপাশে লোকজন পুড়িয়ে দিচ্ছে বই। সামনে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ—গলা চিরে যাচ্ছে, বলছে, “এই জ্ঞান কেউ জানবে না, কেউ বহন করবে না।”
অনির্বাণ সেই মানুষের নাম মনে করতে পারে না, অথচ তার বুকের ভিতর ছটফট করে ওঠে—এক আবেগ, যেন সেটা তার নিজেরই কণ্ঠ।
“এই নামটাই হবে তোমার বলি,” মুখোশধারী বলল।
“তুমি এই স্মৃতিটা দেবে অর্গাসকে, বিনিময়ে পাবে অর্গাসের মুখ, দৃষ্টি, শক্তি।”
অনির্বাণ চোখ বন্ধ করে। সে চায় না এই স্মৃতিটা ভুলে যেতে। কিন্তু সে জানে, যে পথ সে বেছে নিয়েছে, সেখানে স্মৃতি থাকা মানে বাধা। তাকে ছেড়ে দিতেই হবে।
সে মাথা নাড়ল। “আমি সম্মতি দিচ্ছি।”
তার মুখ থেকে নিঃশব্দে একটি নাম বেরিয়ে আসে। সেই নামটা বলার সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিটা ঝাপসা হয়ে যায়। সেই আগুনের দৃশ্য মিলিয়ে যায়। সে ভুলে যায় সেই কণ্ঠস্বর, সেই চোখ।
এক মুহূর্তের মধ্যে এক নিঃস্তব্ধতা নেমে আসে। বেদির তলায় ধ্বনি—এক ফিসফিস, যেন দূরে কোথাও একটা দরজা খুলে গেল।
তার কপালে আঁকা হয় আরেকটি চিহ্ন—এইবার তিনটি রেখা এসে মিলেছে একটি চোখে, যার চারপাশে রক্তের চিহ্ন ঘূর্ণায়মান।
“তুমি এখন সম্পূর্ণ,” এক মুখোশধারী বলে।
“তোমার দৃষ্টির সামনে খুলবে এখন অর্গাসের ইতিহাস, ভবিষ্যৎ, আর একটি সত্য—যা ইতিহাসে নেই, অথচ ইতিহাসকে চালায়।”
“তবে মনে রেখো,” আরেকজন বলে, “এই চুক্তির মূল্য এখনও দেওয়া বাকি।”
অনির্বাণ চুপ। সে জানে, এখন আর সে সাধারণ মানুষ নয়। সে জানে, আজ থেকে তার জীবন নয়, তার ছায়াই বেশি বাস্তব। সে এখন একজন বাহক—রক্ত, স্মৃতি, ও চুক্তির।
দরজা নিজে থেকেই খুলে যায়।
বাইরে পূর্ণিমা হাসছে।
পর্ব ৬: যাদের মুখ নেই
রক্তচুক্তির পরে অনির্বাণ যখন সেই পুরোনো বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়াল, শহর তখন অন্যরকম লাগছিল। যেন কোনও অদৃশ্য স্তর খুলে গিয়ে সে প্রবেশ করেছে এক সমান্তরাল কলকাতায়—এক শহর, যেখানে সবকিছু একটু বেশি নিঃশব্দ, একটু বেশি ধোঁয়াটে, আর একটু বেশি গভীর।
আকাশে তখনও পূর্ণিমার আলো, কিন্তু সেটা আর উজ্জ্বল নয়—ছায়ায় মোড়া। রাস্তায় লোকজন নেই, অথচ বাতাসে ভেসে আছে অসংখ্য পায়ের আওয়াজ। মনে হচ্ছিল, কেউ পিছনে হাঁটছে, কিন্তু ফিরে তাকালে দেখা যায় কিছুই না। গাড়ির হেডলাইটে আলো পড়ছে না, কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে না, ট্রামের তারে ভেসে থাকা মৃদু ঝনঝন ধ্বনিটাও যেন স্থবির হয়ে গেছে।
সে হাঁটছিল এক অজানা নির্দেশনায়, ঠিকানা না জেনে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে জানে—এবার তাকে খুঁজে নিতে হবে সেই গোপন জায়গাটা, যেখানে মুখহীনদের মহড়া হয়। সেই জড়ো হওয়া, যার কথা দাদুর পুরোনো ডায়েরির ছেঁড়া পাতায় একবার পড়েছিল:
“অর্গাসের চতুর্থ রাতের শেষে মুখহীনরা ফিরে আসে। ওরা কথা বলে না, তবু শোনায়, ওরা চোখে দেখে না, তবু তোমাকে গিলে খায়।”
তখন সে বুঝতে পারেনি এটা কেবল অলংকার নাকি সতর্কবার্তা।
কিন্তু এখন সে জানে—এই মুখহীনরা অর্গাসের পুরাতন পরত, যারা একসময় মুখ ছিল, পরিচয় ছিল, কিন্তু চুক্তি পূরণের দায়ে নিজেরাই মুখ হারিয়েছে। ওরা এখন শুধু স্মৃতি বহন করে, শব্দহীন ইতিহাস।
কলকাতার বুকে তাদের মিলনের স্থান একটাই—শোভাবাজারের সেই পুরনো নাটমন্দির, যা আজ আর নাটক করে না, শুধু ছায়াদের জড়ো হতে দেয়।
অনির্বাণ পৌঁছায় সেই জায়গায়। বাইরে থেকে তা একটা ভাঙা প্রাসাদ, গেটের মাথায় লেখা ‘বিজয়নাট্য সংঘ’—অর্ধেক অক্ষর পড়ে গেছে, লতাপাতা ঢেকে দিয়েছে পুরো দেয়াল।
সে গেট ঠেলে ঢোকে।
ভিতরে একটা মঞ্চ, বহু বছর ধরে বন্ধ, কাঠের সিঁড়ি পচে গেছে, গ্যালারির আসনগুলো ধুলোয় চিরকালীন বসবাসে অভ্যস্ত। কিন্তু সেই গন্ধ—পুরনো কাঠ, তেলচিটে পর্দা আর পাণ্ডুলিপির গায়ে লেগে থাকা শব্দ—এখনও বহাল।
আর ঠিক সেই মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে আছে তারা।
মুখহীনেরা।
তাদের মুখ নেই—মানে চোখ, নাক, ঠোঁট কিছুই নেই। এক মসৃণ মোমের মতো মুখ, যেন চামড়া টেনে ধুয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের গলার নিচে জ্বলছে একটি চিহ্ন—ত্রিভুজের মধ্যে চোখ, আর চারপাশে রক্তবিন্দুর রেখা।
তারা দাঁড়িয়ে নেই, তারা নড়ে না, হাঁটে না। কিন্তু তাদের উপস্থিতি ঠেলে আসে বুকের গভীরে—এক ধরনের শব্দহীন চাপ, যা কান দিয়ে নয়, হৃদয়ের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে।
অনির্বাণ এগিয়ে যায় মঞ্চের দিকে।
হঠাৎ করেই ঘরের চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে যায়, কেবল মঞ্চের উপর একটি আলো—আলো না, বরং ফাঁপা উজ্জ্বলতা—জ্বলতে থাকে।
তখনই শোনা যায় তাদের কণ্ঠস্বর—একসঙ্গে, কিন্তু কোনও ঠোঁট নাড়িয়ে নয়।
“তুমি চুক্তি করেছো। এখন তুমি একা নও। এখন তুমি তাদের উত্তরাধিকার, যারা চিরকাল অদৃশ্য হয়ে থেকেছে।”
একজন মুখহীন এগিয়ে আসে, হাতে একটি ধাতব ছায়া নিয়ে—না ছুরি, না চাবি, বরং দুটোর মাঝামাঝি কিছু। সে সেটি অনির্বাণের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
“তুমি এখন ‘অন্তর্দৃষ্টি বাহক’। এই অস্ত্র তোমার স্মৃতির রক্ষাকবচ। এই অস্ত্র দিয়ে তুমি কেটে ফেলতে পারো মিথ্যে স্মৃতি, খুলে ফেলতে পারো ছায়ার গিঁট। কিন্তু খেয়াল রেখো, তুমি যেটা কেটে ফেলবে, তা আর ফিরবে না।”
অস্ত্রটি সে হাতে নিতেই অনুভব করে, যেন তার হাত হালকা হয়ে গেল—অথচ সেই হালকাপনা ভয়ের। কারণ সে জানে না, এর ওজন কতটুকু আত্মায় পড়ে।
তাদের কণ্ঠস্বর আবার শোনা যায়—এইবার একটু নিচু, যেন মাটি ফুঁড়ে উঠছে।
“আগামী অমাবস্যার রাতে, শিয়ালদার নিচে যে পুরনো টানেল আছে, সেখানে তোমার সামনে খুলে যাবে পঞ্চম চক্রের দরজা। সেখানেই তুমি মুখোমুখি হবে তোমার পূর্বসূরির সেই অংশের সঙ্গে, যা তুমি আজও স্বীকার করোনি।”
“যদি ফিরে আসতে পারো, তখনই তুমি হবে অর্গাসের প্রকৃত দৃষ্টি।”
“কিন্তু যদি না পারো…”
তারা চুপ করে যায়।
আলো নিভে যায়।
আরেকবার চারদিক ঝাপসা হয়ে আসে, মঞ্চ ফাঁকা, মুখহীনেরা নেই। কেবল অনির্বাণ দাঁড়িয়ে, এক হাতে ধাতব অস্ত্র, বুকের ভিতর এক নিঃশব্দ তাণ্ডব।
সে বোঝে, এবার সময় হয়েছে মুখোমুখি হওয়ার। অর্গাস তাকে আর শুধু বাহক রাখবে না—তাকে বানাবে প্রবেশদ্বার।
বাইরে বেরিয়ে আসে সে।
শহর এখনও নিঃশব্দ। শুধু দূরের আকাশে এক ঝাঁক পাখি ডানা ঝাপটায়। রাতের বুকে তার হাঁটার শব্দ আরেকটি গল্প তৈরি করে, যে গল্পের শিরোনাম এখনও লেখা হয়নি।
পর্ব ৭: শিয়ালদার নিচে
অমাবস্যার রাত।
শহর নিঃশব্দ, অথচ অস্থির। বাতাস থমকে আছে, কিন্তু তার ভার যেন বেশি, যেন অদৃশ্য শব্দেরা রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছে নিঃশব্দে।
অনির্বাণ দাঁড়িয়ে আছে শিয়ালদার স্টেশনের ঠিক পেছনে, একটা ভাঙা বহুতলের নিচে। সে জানে, এখানে যেসব পথিক আশ্রয় নেয়, যারা নিজেদের নাম ভুলে গিয়ে ট্রেনের শব্দে ঘুমায়, তাদের ভিতরেই কেউ কেউ শুনে ফেলেছে সেই পুরোনো ডাক—অর্গাসের ডাক। সে এবার তাদের পথে হাঁটতে এসেছে।
যেখানে প্ল্যাটফর্ম ফুরোয়, আর রেললাইন হারিয়ে যায় এক সরু গুহার মধ্যে, ঠিক তার পাশেই রয়েছে এক বিস্মৃত টানেল—কোনও রেল মানচিত্রে যার উল্লেখ নেই। কেউ কেউ বলে এটা ব্রিটিশদের সময়কার, কেউ বলে এটা আসলে কলকাতার নিচে গড়ে ওঠা গুপ্ত সমিতির পথ, যারা রাজনীতি বা বিপ্লব নয়, বরং নিয়ন্ত্রণ করত সময়কে, স্মৃতিকে, আর মানবচিত্তের গভীরতম স্তরকে।
আজ সেই পথেই নামছে অনির্বাণ।
তার হাতে সেই ধাতব অস্ত্র—অর্গাসের চতুর্থ চক্রে পাওয়া ‘ছায়া-চাবি’, যা দিয়ে মিথ্যে স্মৃতি কাটা যায়। বুকের মধ্যে তার দৃষ্টির চিহ্ন জ্বলজ্বল করছে, যেন ভিতর থেকে আলো উঠছে, আলো নয়, বরং তপ্ত ছায়া।
টানেলে নামতেই সে বুঝল, নিচের বাতাস অন্যরকম। এখানে শব্দরা বেঁচে থাকে দীর্ঘদিন, দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনি হয়ে থেকে যায় শতাব্দীর পর শতাব্দী। তার পায়ের শব্দ যেন কারও ঘুম ভাঙিয়ে দিচ্ছে, আবার কারও নাম ভুলিয়ে দিচ্ছে।
টানেল আঁকাবাঁকা, পাথরের গায়ে জল জমে আছে, দেয়ালের কাঁধ ঘেঁষে ঝুলে আছে মোটা শেকল, যার কাজ এখন আর কিছুই নয়, তবু তার ভার যেন এখনও থেকে গেছে।
অনির্বাণ পনেরো মিনিট ধরে হাঁটল। তারপরে টানেল হঠাৎ প্রশস্ত হয়ে এক গম্বুজাকৃতি কক্ষে পরিণত হল—যেখানে বাতাস কাঁপছে, আর মাঝখানে রাখা রয়েছে একটি বিশাল আয়না।
এই আয়না আগের আয়নাগুলোর মতো নয়। এটা জ্যান্ত, যেন তাকিয়ে আছে। এর উপরিভাগ স্থির, অথচ নিচে এক অদৃশ্য কম্পন, যেন কাচের ভিতরে সময় ঘুরছে।
দেয়ালের গায়ে লেখা রয়েছে পুরনো বাংলা হরফে:
“যারা নিজের মুখ দেখেনি, তারা অন্যকে কীভাবে চিনবে?”
তখনই আয়নার মধ্যে সে দেখতে পেল—একজন মানুষ, বসে আছে ঘরের এক কোণে, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, পরনে পাঞ্জাবি, কপালে কাটা দাগ। আর তার হাতের ডায়েরির পাতায় স্পষ্ট আঁকা সেই অর্গাস চিহ্ন।
অনির্বাণ চমকে ওঠে।
“দাদু?”
আয়নার ভেতর নীলমাধব ঘোষ মুখ তোলে।
না, সে জীবিত নয়। না, সে মৃত নয়। সে এক অদ্ভুত সীমান্তে আটকে থাকা ছায়া।
তার ঠোঁট নড়ে না, তবু অনির্বাণ শুনতে পায়—
“তুই অবশেষে এলি।”
“তুমি এখানে আছো?” অনির্বাণ বলল। “তুমি তো চুক্তি ভেঙে গিয়েছিলে…”
“তাই তো,” দাদুর চোখ দুটো আলো ছড়ায়। “আমি পালিয়েছিলাম, কারণ আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম—সেই সত্য থেকে, যা আমি নিজেই খুঁড়ে তুলেছিলাম। অর্গাস কাউকে ক্ষমা করে না, কিন্তু কাউকে পুরোপুরি মুছেও না। আমাকে রেখে দিয়েছে এই আয়নার মধ্যে—চুক্তি অসম্পূর্ণ রেখে, অর্ধেক দৃষ্টি নিয়ে।”
“আমি কি পারব?” অনির্বাণ জিজ্ঞেস করল।
“পারবি, যদি নিজের ভয়কে চিনতে পারিস। অর্গাস ভয়কে অস্বীকার করে না, ও সেটাকে বাহক বানায়।”
“তোমার ভয় কী ছিল, দাদু?”
আয়নার মধ্যে থাকা সেই পুরুষ চুপ থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে—
“আমার ভয় ছিল, আমি নিজেকে চিনে ফেলব। আমি যা নই, তাই ভেবে কাটিয়েছি জীবন। কিন্তু আয়না কাউকে মাফ করে না। এখন তুই যদি চুক্তি সম্পূর্ণ করিস, তাহলে এই আয়না ভেঙে যাবে। আমি মুক্ত হব। তুই… অর্গাস হয়ে যাবি।”
“আর যদি না করি?”
“তুইও আয়নার ভিতর আটকে যাবি।”
ঘরের একপাশে তখন খুলে গেল একটা দরজা। ভিতরে অন্ধকার, কিন্তু দরজার মাথায় খোদাই করা ছিল—
“পঞ্চম চক্র: আত্মবিস্মৃতির গুহা”
অনির্বাণ ধীরে পা বাড়াল।
ভিতরে গিয়ে সে যে ঘরে ঢোকে, সেখানে চারদিক আয়নায় ঢাকা। প্রতিটি আয়নায় সে দেখে নিজেকে—কিন্তু সব আয়না এক নয়। একটায় সে চিৎকার করছে, একটায় ঘুমোচ্ছে এক কফিনে, একটায় পেছনে ঘুরে তাকাচ্ছে, অথচ তার মুখ নেই। কোথাও সে দাদুকে হত্যা করছে, কোথাও সে নিজেকেই।
তখনই সে বুঝে যায়—এই চক্র হল আত্ম-ভুলে যাওয়ার। অর্গাসের চূড়ান্ত প্রবেশদ্বার।
ঘরের মাঝখানে রাখা সেই অস্ত্র—ছায়া-চাবি। তাকে নিতে হবে, আয়নার ভিতরের মিথ্যে স্মৃতি কাটতে হবে। কিন্তু কোনটা মিথ্যে, কোনটা সত্য?
সে ভাবে। তারপর একে একে এগিয়ে গিয়ে তিনটি আয়না ভাঙে—যাতে সে নিজেকে অচেনা দেখছিল, ভয় পাচ্ছিল, নিজেকেই শত্রু মনে করছিল।
শেষ আয়নায় সে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সেখানে দেখা যাচ্ছে, সে একজন শিশু, যার কপালে আঁকা অর্গাস চিহ্ন।
সে বুঝে যায়—এটাই তার স্মৃতি। সত্য।
সে মাথা নোয়ায়, এবং তখনই ঘরের উপর থেকে পড়তে থাকে সাদা আলো, আর প্রতিধ্বনি তোলে সেই চেনা কণ্ঠস্বর—
“তুমি দৃষ্টিকে অতিক্রম করেছো। এখন তুমি নিজেই এক চক্র।”
আর ঠিক তখনই আয়না ফেটে যায়। ঘর ভেঙে পড়ে ধুলোয়।
আর সামনে পড়ে থাকে সেই পুরনো ডায়েরি।
কিন্তু এবার তাতে লেখা—“অর্গাস: অনির্বাণের অধ্যায়”
পর্ব ৮: যাকে কেউ লেখেনি
ডায়েরির পাতা খুলে গেল এক নিঃশব্দ ধ্বনিতে। ধুলোমাখা কাগজ, তবুও অক্ষরগুলো তাজা। যেন এইমাত্র লেখা হয়েছে। উপরের দিকে মোটা হরফে লেখা—
“অর্গাস: অনির্বাণের অধ্যায়”
নিচে লেখা একটিমাত্র বাক্য:
“সে লিখবে, যাকে কেউ লেখেনি।”
অনির্বাণ দাঁড়িয়ে ছিল ভাঙা গুহার ভিতর, চারপাশে ধ্বংসস্তূপ। আয়না আর নেই, ছায়াও নেই, শুধু নিস্তব্ধতা আর সেই ডায়েরি। কিন্তু নিস্তব্ধতার ভেতর সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল নিজেকে। যেন তার মস্তিষ্কের গভীর থেকে কেউ কথা বলছে।
“এবার শুরু করো।”
অনির্বাণ ডায়েরির পরবর্তী পাতায় চোখ রাখতেই অক্ষরগুলো নিজে নিজে ফুটে উঠতে লাগল—সে যা ভাবছে, তাই যেন কাগজে রূপ নিচ্ছে।
“আমি অনির্বাণ ঘোষ, অর্গাসের পঞ্চম চক্র পেরিয়ে এসেছি। আমি আমার দাদুর অসম্পূর্ণ চুক্তিকে পূর্ণ করেছি। আমি ভয় দেখেছি, আমি ভুলে গিয়েছি, আমি ফিরে পেয়েছি। এবার আমি লিখছি সেই অংশ, যেটা কেউ লেখেনি।”
এই লেখা যেন আর শুধু স্মৃতি নয়—এটা হয়ে উঠছে ভবিষ্যৎ। সে বুঝে যাচ্ছে, ডায়েরিটা কেবল অতীত নয়, এটা সময়ের মানচিত্র, যেখানে দৃষ্টির বাহক যা লেখে, তাই ঘটে।
সে যখন পৃষ্ঠা উল্টাতে যাচ্ছে, তখনই বাতাস ভারী হয়ে আসে। আবার ফিরে আসে সেই ছায়া-গর্জন। অর্গাস এখন কেবল এক গোপন সমিতি নয়, এটা এখন তার চেতনার অংশ, তার ভেতরে গাঁথা এক স্থায়ী পরিপ্রেক্ষিত।
ঠিক তখনই ডায়েরির পাতার নিচে আরও একটি বাক্য নিজে থেকে লেখা হয়:
“শেষ চক্র খুলবে যাকে কেউ খুঁজে পায় না। সে নিজেই এক রূপরেখাহীন ছায়া—চলন্ত সময়ের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা এক চরিত্র। তাকে লিখতে পারো?”
অনির্বাণ স্থির হয়ে যায়।
এই নামহীন, রূপরেখাহীন চরিত্র—যে অর্গাসের জন্মের আগেই ছিল, যার জন্যই হয়তো এই সমিতি, এই চক্র, এই দৃষ্টির খেলা শুরু হয়েছিল—তাকে পেতে হলে যেতে হবে আরও গভীরে।
ডায়েরির পিছনের পাতায় আঁকা ছিল এক মানচিত্র—কিন্তু সেটি বাস্তব জায়গার নয়। তা সময়ের ভিতরে সময়ের ছায়া। পেঁচানো রেখা, অক্ষরবিহীন সড়ক, এবং মাঝখানে একটি বিন্দু:
“অপরিচিত পুরাণ”।
এই জায়গাটা আসলে কলকাতার কোনও রাস্তা নয়, এটা এমন এক স্তর, যা বাস্তব ও অবচেতনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। এটি একটি মনের স্থান, যা খুঁজে পেতে হলে নিজেকে সম্পূর্ণ ভুলে যেতে হয়।
তবে সেই মানচিত্রের এক কোণে লেখা—“সূচনা হবে সেই বাড়িতে, যেখানে কিচিরমিচির করে না পাখিরা, আর দেয়ালে দেয় ছায়া, শব্দ নয়।”
অনির্বাণ জানত এমন একটা জায়গা—উত্তর কলকাতার এক পুরোনো বাড়ি, একসময় তার ঠাকুরদার মামাবাড়ি ছিল, এখন পরিত্যক্ত। বহু বছর আগে, সেখানে নাকি এক বৃদ্ধ আত্মহত্যা করেছিলেন, যার মৃত্যুর পর থেকে বাড়িটা শব্দহীন হয়ে যায়। পাখি আসে না, কুকুর ডাকে না, বাচ্চারা খেলে না। বাড়ির নাম কেউ জানে না, ঠিকানাও নেই।
সে পৌঁছায় সেই বাড়িতে।
দরজা খোলা। ভিতরে প্রবেশ করতেই টের পায়, বাতাস এখানে ভারী নয়, বরং একরকম শূন্য। শব্দহীন, স্পর্শহীন, গন্ধহীন। যেন বাড়িটা নিজে থেকেই বলে দিচ্ছে—“তুমি চলে এসেছো। কিন্তু তুমি কে?”
ভেতরে ঢুকে অনির্বাণ পায় এক ঘর—দেওয়ালজুড়ে আয়না ছিল একসময়, কিন্তু সব ভেঙে দেওয়া হয়েছে। কেবল একটি দেয়ালে টিকে আছে আধ-ভাঙা আয়না, যার গায়ে লেখা—
“শেষ চক্রের দরজা একটাই—যে নিজেকে লেখে।”
আয়নার নিচে একটা টেবিল। তার ওপর রাখা একটি খালি খাতা, একটি কলম, এবং একটি মুখোশ।
এই মুখোশ সাদা, একেবারে সাদামাটা, মুখাবয়বহীন।
এক কাগজে লেখা নির্দেশ:
“মুখোশ পরো। খাতায় যা দেখো, তাই লেখো। যা লেখো, সেটাই দেখবে। যদি ভুল লেখো, চিরতরে আটকে যাবে।”
অনির্বাণ ধীরে ধীরে মুখোশ পরে। মুহূর্তেই বদলে যায় দৃষ্টির ভেতরকার ছবি।
সে দেখতে পায়—নিজেকে। কিন্তু এই ‘নিজে’ অন্যরকম। সে দাঁড়িয়ে আছে সেই রাতের কলকাতায়, যখন দাদু প্রথম অর্গাসে প্রবেশ করেন। সে সেই পুরনো দোকানে, সেই দোকানের মালিক যার গলায় ক্ষীণ সুরে ঘোরে ইতিহাস।
সে দেখে দাদুর কণ্ঠস্বর—“আমরা যা জানি, তা ইতিহাস নয়। আমরা যা ভুলে যাই, তাতেই লুকিয়ে থাকে উত্তর।”
অনির্বাণ সেই মুহূর্তগুলো দেখতে দেখতে লিখতে থাকে—ডায়েরিতে। প্রতিটি শব্দের সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্য বদলায়।
সে দেখে—একটা সময় ছিল, যখন কলকাতা শহরের নীচে এক জ্ঞানগর্ভ সভা চলত, প্রতিরাতে, যেখানে কবি, বৈজ্ঞানিক, তান্ত্রিক আর বিপ্লবীরা বসে তৈরি করতেন অর্গাসের মূল নীতি—মানবমস্তিষ্ককে খুলে দেওয়ার, কিন্তু নিয়ন্ত্রণেরও।
কিন্তু তারপর সেই সভায় ঢুকে পড়ে এক নামহীন। কেউ জানত না তার পরিচয়, সে লিখত না, সে শুধু শুনত, আর একদিন, সে সব জ্ঞান চুরি করে গায়েব হয়ে যায়। তার মুখ নেই, নাম নেই, কিন্তু তার হাতের লেখা সব চক্রে ছড়িয়ে পড়ে।
তখনই অনির্বাণ বুঝতে পারে—
এই নামহীন লোকটাই অর্গাসের প্রথম চক্রের বাহক। আর তাকে খুঁজে বের করলেই খুলবে শেষ চক্র।
ডায়েরির শেষ পাতায় সে লেখে—
“আমি অনির্বাণ ঘোষ। আমি জানি, তাকে খুঁজে পেতে হলে আমাকে তার মতো হতে হবে—নামহীন, মুখোশধারী, লেখক, কিন্তু লেখা হবে না নিজের নামে। আমি তৈরি।”
মুহূর্তেই ঘরের সব আয়না ফেটে যায়।
দেয়ালে ফুটে ওঠে এক নতুন দরজা—সাদা আলোয় মোড়া। দরজার গায়ে লেখা—
“শেষ চক্র: ছায়ার জনক”
পর্ব ৯: ছায়ার জনক
দরজাটা যেন আলো নয়, বরং একধরনের শূন্যতা ছড়াচ্ছিল। এর মুখে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, এভাবে যদি কেউ তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ, তবে নিজের অস্তিত্বটাই প্রশ্নচিহ্ন হয়ে যাবে। অনির্বাণ জানত—এই শেষ চক্র। এই দরজার ওপারে থাকবে সেই মানুষ, যার নাম কেউ জানে না, যে লিখেছিল সব, কিন্তু নিজের নাম কোনও পাতায় রাখেনি।
সে দরজায় পা রাখল।
সঙ্গে সঙ্গে এক ভারী স্তব্ধতা তার শরীর ঢেকে নিল—যা কানের মধ্য দিয়ে নয়, প্রবেশ করল তার হাড়ের ফাঁকে, মগজের শিরায়। কিছুক্ষণ কিছুই দেখা যাচ্ছিল না, শুধু ধোঁয়াশা, স্তব্ধতা, আর অনির্বচনীয় এক অনুভব। তারপর, ধীরে ধীরে খুলে গেল দৃশ্য।
সে এখন দাঁড়িয়ে আছে একটা গোলাকার কক্ষে। কক্ষ নয়, যেন একটি অনন্ত গ্রন্থাগার। চারদিকে অসংখ্য তাক, তার গায়ে গাঁথা হাজার হাজার খাতা। প্রত্যেকটা খাতার বাইরের মলাটে নেই কোনও শিরোনাম, নেই লেখকের নাম—শুধু নম্বর, কখনো তারিখ, কখনো শুধু একটি চিহ্ন।
এই কক্ষের মাঝখানে বসে আছে এক ব্যক্তি—পেছন ফিরে, সামনে একটি খাতা খোলা। তার পরনে ধবধবে সাদা পোশাক, আর মাথায় সাদা কাপড়ের ঘোমটা। তার মুখ দেখা যায় না, শুধু কাঁধের রেখা, আর কবজির নিচে লেখা একটি চিহ্ন—ত্রিভুজের চারদিকে একটি চোখ, আর চারপাশে সাতটি রেখা, যেন কোনও সূর্য অন্ধকার থেকে উঠে আসছে।
অনির্বাণ কিছু না বলে দাঁড়িয়ে থাকে। সে জানে, এই জায়গায় শব্দের কোনও মূল্য নেই। এখানে কেবল দৃষ্টি কাজ করে—না চোখের, না কল্পনার—বরং সেই অন্তর্দৃষ্টি, যা শরীর ও ভাষার ঊর্ধ্বে।
হঠাৎ করে সেই ব্যক্তি—ছায়ার জনক—খাতাটা বন্ধ করে ফিরে তাকান।
কিন্তু তার মুখ নেই।
অথচ অনির্বাণ বুঝতে পারে, সে তাকাচ্ছে।
তারপর মুখহীন সেই পুরুষ—এক গম্ভীর, শব্দহীন কণ্ঠে—বলে ওঠেন:
“তুমি অবশেষে চলে এসেছো। দেরি করেছো, তবে ভুল করো নি।”
অনির্বাণ মাথা ঝাঁকায়।
“তুমি কি অর্গাসের স্রষ্টা?”
ছায়ার জনক বলেন, “না। আমি অর্গাস নই। আমি সেই প্রথম পাঠক, যাকে পড়তে বলা হয়েছিল, কিন্তু লেখা হয়েছিল না। আমার কাজ ছিল স্মৃতি সংগ্রহ করা, চরিত্র বেছে নেওয়া। যারা ভয় পায়, যারা ভুলে যায়, যারা লড়াই করে—তাদের কথা লিখতাম আমি। তারপর একদিন, আমাকে বলা হয়—নিজেকে লেখো।”
“তুমি লেখোনি?”
“আমি পারিনি। কারণ যে নিজেকে লেখে, সে আর কখনো পাঠক থাকে না। সে হয়ে যায় খাতা নিজেই। অর্গাস আমার ভিতর দিয়ে জন্ম নেয়, আমার না-লিখে ওঠা অধ্যায়ের মধ্য থেকে।”
অনির্বাণ তখন চুপচাপ হাত বাড়ায় সেই খাতার দিকে।
ছায়ার জনক থামে।
“তুমি কি জানো, এই খাতাটা কী?”
“আমার কল্পনা বলে, এটা সেই প্রথম পাণ্ডুলিপি, যেখানে অর্গাসের আদিপর্ব লেখা হয়েছিল। যে লেখায় লেখা হয় দৃষ্টি, কিন্তু লেখা হয় না নাম।”
“ঠিক তাই,” বলেন ছায়ার জনক। “এই খাতায় কেউ নাম লেখে না। কেবল মুখছবি আঁকে। কারণ এখানে লেখা হয় তাদের কথা, যাদের মুখ ইতিহাস চেনে না।”
“আমার কাজ কী?” অনির্বাণ জিজ্ঞাসা করে।
“তুমি শেষ দৃষ্টি। তোমার কাজ, আমাকে লেখা। আমার পরিচয় তুমি দেবে। আমার মুখ তুমি আঁকবে। কিন্তু হুঁশিয়ার—একবার আমায় লিখে ফেললে, তুমি নিজেও হারিয়ে যাবে এ খাতায়। তুমিও এক নামহীন হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে, অর্গাসের চক্র পূর্ণ হবে। কিন্তু অনির্বাণ ঘোষ আর থাকবে না।”
অনির্বাণ থেমে যায়। তার চোখে ভাসে দাদুর মুখ, সেই দোকান, সেই ছেঁড়া ডায়েরি। স্মৃতির পাতায় আসে ছায়া, গন্ধ, মুখহীনদের প্রহরা। এতদূর এসে, এই মুহূর্তে এসে, সে কি নিজের নাম ছেড়ে দেবে?
সে আবার তাকায় ছায়ার জনকের দিকে।
তার মনে হয়—এই মানুষটা আসলে বহু নাম, বহু গল্প, বহু বংশের প্রতিনিধি। সে জানে, কেউ না কেউ, কোনও এক প্রজন্মে, এই দায় নেবে। হয়তো তার পরবর্তী জন্মে। কিন্তু এখন?
সে হাত তোলে, খাতা নেয়, কলম নেয়।
আর লিখতে শুরু করে—
“আমি অনির্বাণ ঘোষ, আমি অর্গাস নই। কিন্তু আমি তাকে লিখছি, যাকে কেউ লেখেনি। সে নামহীন, অথচ ইতিহাসের নিচে তার হাতের ছাপ। সে মুখহীন, কিন্তু সব মুখেই তার ছায়া। আমি তাকে চিনিনি, কিন্তু আমি তাকে বানিয়েছি। আমি তাকে দেখিনি, তবু আমি জানি, সে আমারই মতো কেউ—যে নাম মুছে ফেলেও পথ তৈরি করে যায়।”
লেখা শেষ হতেই, কক্ষ কেঁপে ওঠে। চারপাশের খাতাগুলো ধুলো হয়ে উড়ে যায়। ছায়ার জনক উঠে দাঁড়ান। মুখহীন সেই শরীর থেকে উঠে আসে এক শেষ স্বর—
“তুমি শেষ করেছো। এবার শুরু হবে অন্য এক অধ্যায়। অর্গাস এখন তোমার নয়, তুমিই অর্গাস।”
তারপর সে মিলিয়ে যায় আলোয়।
অনির্বাণ একা দাঁড়িয়ে থাকে। খাতা ফাঁকা। আর তার নাম?
ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা—
“অর্গাসের নবদৃষ্টি: অনির্বাণ ঘোষ (নাম মুছে দেওয়া হয়েছে)”
আর নিচে একটা ফাঁকা বাক্য, যেন অপেক্ষা করছে পরবর্তী পাঠকের জন্য।
পর্ব ১০: যে ফিরে তাকায় না
সবকিছু মিলিয়ে গেলে, অনির্বাণ বুঝতে পারল—নীরবতা যতটা না অনুপস্থিতি, তার চেয়েও বেশি উপস্থিতি।
যা নেই, তার ভিতরেই তো সবচেয়ে গভীর কণ্ঠস্বর লুকিয়ে থাকে।
শূন্য কক্ষে দাঁড়িয়ে, চারপাশে ধুলোর মতো ছড়িয়ে পড়া খাতার ছাই, বাতাসে উড়ছে সেই অদৃশ্য অক্ষর—যেগুলো ইতিহাসে লেখা হয়নি, অথচ রক্তের ভিতর গাঁথা।
আর সামনে, সেই ফাঁকা বাক্য—যা সে শেষ করে আসেনি, শুধু ফেলে এসেছে, পরবর্তী কারও জন্য।
সে জানে, তার কাজ শেষ। অর্গাস এখন আর কোনো একক চক্র নয়, এটা এখন একটি প্রবাহ—যা সময়, চেতনা, এবং স্মৃতির বাইরে জেগে থাকে, মুখহীন বাহকদের মধ্য দিয়ে বাঁচে।
সে নিজে এখন এক অস্তিত্বহীনতা—নাম নেই, পরিচয় নেই, কেবল লেখা আছে তার ভিতরে।
সে বেরিয়ে আসে সেই ঘর থেকে, ধীরে ধীরে, যেন কোনও নদীর ভেতর থেকে হাঁটছে।
দরজাটা এখন আর আলোকিত নয়, বরং একটা গাঢ় নীল ছায়া তাকে ঘিরে ধরে।
তার দেহে আঁকা দৃষ্টিচিহ্নটা একেবারে নিঃশব্দ হয়ে গেছে—না নিভে গেছে, না জ্বলছে, কেবল রয়ে গেছে এক গভীর গর্তের মতো।
কলকাতার ভোর তখন ধূসর।
রাস্তায় প্রথম পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ নেই, কিন্তু কোথাও যেন বাজছে একটা পুরনো ঘড়ির ঘণ্টা। সেই শব্দে শহর ধীরে ধীরে জেগে ওঠে।
ভোর পাঁচটার ট্রাম চলে যায় মেখলালির মোড় ঘেঁষে, কুয়াশা-ভরা জানালায় তখনও দেখা যায় না মুখ, শুধু ছায়া।
অনির্বাণ হাঁটছে—পায়ে ভার নেই, মনে দাগ নেই, হাতে কিছু নেই। তার মাথায় চাপা এক নিঃশব্দ রক্তচুক্তির স্মৃতি, আর বুকের ভেতর এক বাল্যস্মৃতি—যেখানে সে প্রথম দাদুর আলমারি খুলেছিল, আর ভিতরে পেয়েছিল সেই ছেঁড়া ডায়েরির পাতা।
সে বাড়ি ফিরে আসে—পুরনো কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে, ঘরের দরজা খুলে দেখে, টেবিলে সেই পুরনো চিঠিখানা এখনও পড়ে আছে।
হলুদ খাম, রক্তরঙ মোমে সিল, আর একটা শব্দ—
“অর্গাস”
কিন্তু এবার খামটার গায়ে আরও কিছু লেখা—অদৃশ্য অক্ষরে, শুধুমাত্র সেই দেখতে পায়, যে চক্র পেরিয়েছে।
লেখা:
“চক্র সম্পূর্ণ। পাঠ শেষ। পাঠক জন্মাল।”
তার মন ভরে ওঠে এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে।
না, আনন্দ নয়।
না, বেদনা নয়।
একটা শীতল, স্থির উপলব্ধি—যা সময়ের থেকেও পুরনো।
সে জানে, এই শহরে আরও কেউ কেউ আছে, যারা নিঃশব্দে চুক্তির অংশীদার। যারা অজান্তেই সেই সমিতির উত্তরাধিকার বহন করে, যাদের কারও চোখে কোনও এক রাতে ভেসে উঠবে সেই ত্রিভুজ, আর যাদের হাত নিজের থেকেই খুলে নেবে এক ডায়েরির পাতা।
তাদের জন্যই সে লিখে গেছে তার অধ্যায়।
ডায়েরির শেষ পাতায় সে একটি চিরকুট রাখে।
“যদি তুমি একদিন এই পাতায় এসে পৌঁছো,
জানবে, আমি ছিলাম, আমি দেখেছি, আমি লিখেছি।
আর এখন, তুমি—তুমি সেই, যে আবার শুরু করবে।”
তারপর সে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যায়।
নিচে নেমে এসে দাঁড়ায় গলি-ভরা আলো আর ছায়ার ঠিক মাঝখানে।
তার মুখে কোনও উত্তাপ নেই, চোখে কোনও প্রশ্ন নেই। তার পায়ের নিচে রাস্তার ধুলো, মাথার ওপরে অসীম আকাশ।
পেছন থেকে একটা কিশোর গলা দেয়—
“দাদা, আপনি কী লেখক?”
সে কিছু বলে না।
শুধু হেঁটে চলে যায়।
সে ফিরে তাকায় না।
সমাপ্ত