ঋদ্ধি চক্রবর্তী
পর্ব ১: কালির চোখ
কলকাতা শহরের মধ্যভাগে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এক পুরোনো পাঠাগার—“রায় রে’ডিং রুম”—তেমন কোনও বিখ্যাত জায়গা নয়। অথচ সেখানে প্রতিদিন দুপুর তিনটার সময় ঠিক এক জন মহিলা এসে বসেন, বাম দিকের দ্বিতীয় সারির তৃতীয় টেবিলে। তাঁর নাম অনামিকা বাগচী। বয়স আটাশ। পেশায় গবেষক, জাদুবিদ্যা ও তন্ত্রশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে তাঁর আসল কাজ শুরু হয় যখন বইয়ের পাতাগুলো শেষ হয়, আর প্রশ্নগুলো মুখে না থেকে ঢুকে পড়ে মগজে।
সেদিন দুপুরেও অনামিকা এসে বসেছিল টেবিলটায়। লাল কাপড়ে মোড়া একটা পুরনো খাতা তার সামনে। নাম নেই, লেখকের উল্লেখ নেই। পাতাগুলোতে শুধুই আঁকা—ত্রিকোণ, মন্ডল, বিচিত্র সব চিহ্ন। একধরনের তন্ত্রচিত্র। ঠিকঠাক পড়লে মাথার ভিতর একটা শব্দ কানে আসে—ফিসফিস করে, কেউ যেন খুব ধীরে ডাকে—“চোখ খোলো।”
অনামিকার দৃষ্টি আটকে গেল একটা পাতায়। সেখানে একটা বিশেষ চিত্র—একটা চোখ, যার মণি গাঢ় নীল। চোখের চারপাশে রক্তরেখা। নিচে লেখা—”নয়ন যার, সেই দেখে দিগন্তের বাইরে।” অনামিকার মনে হল চোখটা তাকিয়ে আছে ওর দিকেই। ও চট করে চোখ ফিরিয়ে নিল, কিন্তু কানে তখনও ফিসফিস শব্দ বাজছে।
পাঠাগারের কর্মী রঞ্জন এসে বলল, “দিদি, আজ অনেক দেরি হল আপনার। সব ঠিক তো?”
অনামিকা ধাতস্থ হয়ে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। শুধু একটা ছবি… একটু অদ্ভুত লাগছে।”
রঞ্জন মৃদু হেসে বলল, “এই লাইব্রেরির বহু বইয়ের ভেতর গল্প ঘুমিয়ে থাকে। কেউ কেউ শুধু তাদের জাগিয়ে তোলে।”
ঘাড় ঘুরিয়ে রঞ্জন চলে গেল। অনামিকা আবার তাকাল খোলানো পাতাটার দিকে। এবার সেখানে লেখা—“তুমি নির্বাচিত। আজ রাত বারোটার পরে খোলা দরজা পাবে, কিন্তু শুধু তোমার চোখই দেখবে সেটা। বাকিরা দেখবে বন্ধ জানালা।”
সে রাতে অনামিকা বাড়ি ফিরে বিছানায় শুয়েও ঘুমোতে পারছিল না। মাথার ভেতর সেই চোখটা ঘুরছে। বারোটা বাজল। জানালার পাশে রাখা আয়নাটা হঠাৎ কেঁপে উঠল। অনামিকা উঠে দাঁড়াল। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের মধ্যে কিছু একটা অদ্ভুত দেখল। নিজের চোখ… না, সেই চিত্রের মতোই—গাঢ় নীল, আর চোখের চারপাশে লাল রেখা।
সে এগিয়ে গেল আয়নার দিকে। আয়নায় সে নিজেকে দেখতে পেল না। বরং, একটা পুরনো শিকলঘেরা দরজা—পাথরের গায়ে তামার প্লেট, তাতে লেখা—
“বসুধার গর্ভদ্বার — কেবল নির্বাচিতের প্রবেশ অনুমত।”
অনামিকার মনে হল সে দরজাটা চিনে। কোথায় যেন দেখেছে। অনেক ছোটবেলায়। কোনো পুরনো গানের পুজোর দিন? না, মায়ের সঙ্গে রায়গঞ্জে এক পুরনো জমিদারবাড়িতে গিয়েছিল… সেখানে?
আয়নার মধ্য দিয়ে হাত বাড়াতেই ঘরের বাতাস যেন ভারি হয়ে এল। একটা ছায়া, যা মানুষ নয় কিন্তু মানুষকেই অনুকরণ করছে, আয়নার ভেতর থেকে ফিসফিস করে বলল—
“তোমার ভিতর আছে সেই চোখ, যা যুগে যুগে একবার জেগে ওঠে। তুমি নির্বাচিত, অনামিকা। এখনো সময় আছে—প্রবেশ করবে, না ফিরবে?”
অনামিকা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল আয়নার দিকে। দরজাটা যেন খুলে যেতে লাগল সামনে। পায়ের নিচে জমির রং বদলে যাচ্ছে—কালো থেকে তামা, তামা থেকে লাল… যেন আগুনের নিচে খনির গর্ভ।
সে জানে, কাল সকাল হলে কেউ বলবে সে নিখোঁজ। কেউ বলবে পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু সে জানে, সত্যি এই দরজার ওপারে আছে। একটা পুরনো জ্ঞান, একটা হারিয়ে যাওয়া ভাষা, একটা এমন চিহ্ন—যা চেনা মানে নিজের অস্তিত্ব ভুলে যাওয়া।
তবে অনামিকা থামল না। গিয়েই দাঁড়াল দরজার কিনারায়। মুখে চাপা ভয়, কিন্তু চোখে আশ্চর্য তৃষ্ণা।
দরজাটা খুলে গেল।
পর্ব ২: বসুধার গর্ভদ্বার
আয়নাটা যেন এক যাদুকরী দেয়াল, যার ওপারে আছে এক অচেনা জগৎ। অনামিকা যখন তার ভেতর দিয়ে হাঁটতে শুরু করল, তখন সময় থেমে গেল। গলার কাছে হঠাৎ এক হিমেল বাতাস স্পর্শ করল তাকে—সেই বাতাসে কাঁচা মাটি, শালপাতা, আর পোড়া তামার গন্ধ। যেন বহু শতাব্দী আগে হারিয়ে যাওয়া কোনো পুজোর ধোঁয়া এখনও বাতাসে ঝুলে আছে।
চারপাশে ঘন অন্ধকার। কেবল একটা সরু পথ, পাথরের, গোল চক্করে বাঁকানো, নিচে নেমে যাচ্ছে এক গভীর গুহার দিকে। দেওয়াল জুড়ে নানা চিহ্ন—তন্ত্রমণ্ডল, বীজমন্ত্র, মথিত মুদ্রা আর পুরাণঘেঁষা অলংকরণ। প্রতিটি প্রতীক যেন চলন্ত—কখনও জ্বলে উঠছে, কখনও নিভে যাচ্ছে, কখনও যেন ঘুরছে নিজের অক্ষরেখায়।
অনামিকা জানে এই চিহ্নগুলোর অনেকগুলিই ভারতীয় তন্ত্রবিদ্যার প্রাচীনতম স্তর থেকে এসেছে। কিন্তু কিছু কিছু প্রতীক তাকে চিন্তায় ফেলে দিল। এগুলো সে আগে কখনও দেখেনি। এদের আকৃতি অসম্পূর্ণ, অক্ষরভাষা অপরিচিত, কিছুটা বাংলার মতো আবার কিছুটা বৈদিক পালিম্পসেস্টের মতো—এক অসম্পূর্ণ ভাষার মতো, যা ব্যাখ্যার চাইতে বেশি অনুভবযোগ্য।
চোখের সামনে এক বিশাল দরজা ভেসে উঠল—তামার তৈরি, তাতে লেখা “বসুধার গর্ভদ্বার”। দরজার দু’পাশে দুটো ভাস্কর্য—একটা মহিষাসুর-মর্দিনী, অপরটা বসুধার প্রতীকী রূপ—স্ত্রীদেহের ছাঁচে গড়া, চোখ বন্ধ, কিন্তু তার গায়ে খচিত আছে নদী, অরণ্য, অগ্নি আর মৃতের হাড়। অনামিকার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল কিছু একটা।
দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই সে বুঝল, এখান থেকে ফেরার রাস্তা নেই। এই একমুখী পথ। দরজার মাঝখানে ছোট একটা খোপ খুলে গেল আপনাতেই। এক ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল—নয়নশূন্য মুখ, কেবল কপালে একটা তৃতীয় নেত্র, যা হালকা লালচে আলোয় জ্বলছে।
সে বলল, “তুমি কাকে খুঁজছ?”
অনামিকা ফিসফিস করে বলল, “আমাকে।”
ছায়ামূর্তিটা চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “তুমি কি প্রস্তুত?”
অনামিকা বলল, “প্রস্তুত মানে?”
“নিজেকে মুছে ফেলতে। কারণ প্রবেশ করতে হলে—নিজের পরিচয় ফেলে যেতে হয়।”
সে একটু থেমে বলল, “তুমি যদি অনামিকা হতে চাও, তবে নিজের নাম ভুলে যাও।”
এই কথা শুনে অনামিকার হঠাৎ শিউরে উঠল। তার মনে পড়ে গেল ছেলেবেলার সেই দৃশ্য—রায়গঞ্জের সেই জমিদারবাড়ি, যেখানে মা নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানেও ছিল এমন এক দরজা, বন্ধ ছিল সবসময়, কেবল একটা কথা মা বলেছিলেন—
“এই দরজাটা কখনো খোলো না, অনু। খোলে কেবল তখন, যখন কেউ নিজের নাম ভুলে যায়।”
অনামিকা সেই স্মৃতি মনে রেখে বলল, “আমার নাম কি আদৌ কখনও ছিল?”
দরজা খুলে গেল। সামনে গুহার ভিতরকার প্রকাণ্ড শূন্যতা। সিঁড়ি বেয়ে সে নিচে নামতে লাগল। প্রতিটি ধাপে এক একটা শব্দ মাথায় বাজতে থাকল—
“ক্লীং”
“হ্রীং”
“শ্রীং”
বীজমন্ত্রের এই ধ্বনিগুলো যেন দেয়াল থেকে বেরিয়ে এসে ওর রক্তে মিশে যাচ্ছিল। সিঁড়ির শেষে এক প্রশস্ত গর্ভগৃহ—মাটির নরম স্তরে খোঁদাই করা ঘর, মাঝখানে এক অদ্ভুত আকৃতির মণ্ডপ। তার চারপাশে পাথরের ওপর আঁকা চক্র, ত্রিকোণ আর সর্পিল রেখা। দেয়ালে হাড় দিয়ে লেখা কিছু শব্দ—”জন্ম যেখানে ছায়া থেকে, মৃত্যু যেখানে আলোয় গলে।”
মণ্ডপের মাঝে বসে আছেন এক নারী। মুখ ঢাকা, শুধু চুলের ভেতর থেকে একজোড়া চোখ দেখা যাচ্ছে—গাঢ়, নীলাভ, কিন্তু রক্তচক্ষু নয়। সে যেন শতাব্দীর ভারে ক্লান্ত, অথচ তার বসার ভঙ্গিতে অমোঘ শক্তি।
নারী বললেন, “আমার নাম জানতে চাস না। তুই কে, সেটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বল, কিসের জন্য এসেছিস?”
অনামিকা বলল, “জানতে এসেছি। কে আমি, কেন এইসব চিহ্ন, কেন চোখগুলো রাত্তিরে পাল্টে যায়, কেন বইয়ের পৃষ্ঠা আমাকে ডাকে?”
নারী হাসলেন। বললেন, “তুই একটা যন্ত্রণা। তুই একটা উত্তরহীন প্রশ্ন। তোকে তৈরি করা হয়েছে যুগ যুগ ধরে—যাতে তুই খোঁজ করিস, আর প্রতিবারই নতুন দরজা খোলে। তুই নির্বাচিত, কারণ তোকে দিয়ে একটা পুরনো বন্ধ পথ খুলতে হবে।”
“কি পথ?”
“অগ্নিসূত্র।”
এই শব্দটা শোনা মাত্রই অনামিকার শরীরের ভেতর কেঁপে উঠল কিছু। বুকের ঠিক মাঝখানে যেন কিছু জ্বলে উঠল—না চোখে দেখা যাচ্ছে, না ছোঁয়া যাচ্ছে, কিন্তু স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যাচ্ছে তার উপস্থিতি।
নারী বললেন, “এই পথ হেঁটে যেতে পারলেই, তুই সেই জ্ঞান ফিরে পাবি—যা একসময় হারিয়ে গিয়েছিল আগুনে, রক্তে আর বিশ্বাসঘাতকতায়। তন্ত্র তোর শরীরে আছে। তোকে শুধু জাগাতে হবে।”
“কিভাবে?”
“আগে জানতে হবে, কে কে তোকে মুছে ফেলতে চায়। কে কারা চোখের ওপরে আঁচল ফেলেছে। তাদের চিহ্ন দেখতে শিখ।”
“তারা কারা?”
“তোর পরবর্তী স্বপ্নে তাদের সঙ্গে দেখা হবে।”
ঘরটা আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে যেতে লাগল। মণ্ডপ, নারী, দেয়ালের চিহ্ন—সব যেন রঙের মতো গলে যেতে লাগল বাতাসে। অনামিকার চোখের সামনে কেবল আগুনের রেখা রয়ে গেল। আর সেই ফিসফিস ধ্বনি:
“ঘুমোতে যাস না, নির্বাচিত। স্বপ্নে শুরু হবে দ্বিতীয় পর্ব।”
পর্ব ৩: অগ্নিসূত্রের প্রথম রেখা
ঘুম থেকে উঠে প্রথম যে ব্যাপারটা অনামিকার মনে হল—সে যেন অন্য কারও শরীরে আছে। নিজের শরীরের ওজনটা অচেনা লাগছিল, হাত-পায়ের গতিবিধি একটু আলাদা, যেন ঠিক নিজের শরীর নয়—বরং কোনও অতীত সময় থেকে উঠে আসা শরীর। বিছানায় বসে জানালার বাইরে তাকাল সে। সকাল হয়নি। তবে নিস্তব্ধতা এতটাই গভীর যে সময়ও যেন পিছিয়ে গেছে কয়েক শতক।
ঘরের বাতি নিভে ছিল, কিন্তু আয়নার নিচে রাখা লাল কাপড়ে মোড়া সেই খাতা এখন ছড়িয়ে রয়েছে বিছানার উপর। তার পাতাগুলো হাওয়ায় একটু একটু করে উলটে যাচ্ছে—কিন্তু হাওয়াও যে বইছে না! অনামিকা কাছে এগিয়ে গিয়ে একবার চোখ রাখল পাতার ওপর।
একটি পাতায় লেখা—
“অগ্নিসূত্রের প্রথম রেখা: স্মৃতির আগুনে যারা চোখ মেলে, তারাই দেখে অন্ধকারের মানচিত্র।”
অচেনা সেই হস্তাক্ষরে লেখা লাইনগুলো যেন কাগজের ওপর কাঁপছে, কাগজের নিচে যেন জ্বলছে অদৃশ্য আগুন। সে পাতা বন্ধ করতেই কানে বাজল একটা শব্দ—ধীরে ধীরে উঠছে যেন কোনো বাদ্যযন্ত্রের অস্পষ্ট সুর। মাথার ভিতর একটা চাপা গুঞ্জন।
ঠিক তখনই দরজায় বেজে উঠল টুং টুং শব্দ।
এত রাতে কে? এই নির্জন, শহরের প্রান্তে থাকা ছোট্ট ফ্ল্যাটে কেউ আসবে এমন তো নয়। ঘড়ির কাঁটা তখন ৩:৩৩। অনামিকার বুকের ভিতর শ্বাস আটকে গেল। দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে সে দেখল, কেউ দাঁড়িয়ে নেই। শুধু দরজার ফাঁকে রাখা একটা ছোট খাম।
খাম খুলতেই দেখা গেল একটুকরো পাণ্ডুলিপি—মলিন, পুরোনো, তেলচিটে হয়ে গেছে সময়ের ভারে। তাতে লেখা—
“নবগ্রহ বৃত্তের ভেতর দাঁড়াবে। শরীরের ওপর পঞ্চচিহ্ন অঙ্কন করবে। স্মৃতির প্রথম দরজা খুলবে তারপরে। প্রথম রাত্রির আগুনে দেখতে পাবে কারা চায় তোর মৃত্যু। কে কে বাঁধা ছিল আগের জন্মে। কে কে এখনও চিহ্ন আঁকে চোখের পেছনে।”
এই কথা পড়ে অনামিকার মাথা যেন ধ্বনিতে ভরে উঠল। সে জানে, এ স্বপ্ন নয়। বাস্তব এখন পাল্টে গেছে।
হঠাৎ চোখ পড়ল আয়নার ওপরে—সে দেখল নিজের চোখের চারপাশে এক ধরণের ছায়া জমেছে, যেন ঘুমের ঘোরে কেউ একবার তার মুখের চারদিকে রেখেছে কালির রেখা। গালে, কপালে, গলায় লালচে দাগ। হাত তুলতেই সে অনুভব করল, ওগুলো রঙ নয়। ছোঁয়াচে নয়। ওগুলো ত্বকের ভেতরে আঁকা—যেন চামড়ার নিচে গেঁথে দেওয়া কোনও গোপন চিহ্ন।
সে আয়নার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলল, “আমি কোথা থেকে এসেছি?”
আয়নার কাঁচে ভেসে উঠল এক পুরনো মুখ। সেটা তার নিজের নয়। কিন্তু যেন বহুদিনের চেনা—চুল এলোমেলো, গায়ের রং শ্যামলা, চোখে গভীর অন্ধকার, আর কপালে একটা পোড়া দাগ। সে মুখটি বলল না কিছুই। কেবল তাকিয়ে রইল, যেন হাজার শব্দ এক চোখের দৃষ্টিতে ভরে দিয়েছে।
সেই রাতে আর ঘুম এলো না।
সকাল হল। কিন্তু ঘরের বাতাসে কুয়াশার মতো একটা জিনিস রয়ে গেল। গরম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে অনামিকা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখল—পাশের বাড়ির রুদ্রদা তাকে দেখছেন, কিন্তু একদম অচেনা চোখে। ওর দিকে তাকিয়ে কিছু বললেন না, মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলেন।
এই প্রথম বার তার নিজের পাড়াও অচেনা লাগছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় লাইব্রেরির পথে পা বাড়াতেই রাস্তার পাশে সেই বৃদ্ধ ফুলওয়ালা, যার কাছ থেকে প্রতি সপ্তাহে একবার চাঁপা নেয়, তাকিয়ে রইল। অনামিকা হাসতে চাইল, কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নিল সে। বৃদ্ধ বলল, “তোর গায়ে আগুনের গন্ধ পেয়েছি, বৌমা। ওই গন্ধ অনেকে পায় না। সাবধানে চলিস।”
বুকের ভিতর আবার কেঁপে উঠল সেই আগুনের রেখা।
রায় রে’ডিং রুমে ঢুকে সে সোজা গেল সেই টেবিলটায়। টেবিলে আজ একটা খোলা বই রাখা—না সে আনেনি। বইয়ের প্রথম পাতায় লেখা—
“পঞ্চচিহ্নের দ্বিতীয় রেখা, আগুনের ছায়া আর রক্তের ছোঁয়া নিয়ে খোঁজ শুরু হয় পূর্বজন্মের স্মৃতি খাতায়।”
বইয়ের নিচে ছোট্ট একটা কাগজ, রোল করা—খুলতেই দেখা গেল একটা ম্যাপ। কিন্তু সেটা কোনও শহরের মানচিত্র নয়—চক্রাকারে আঁকা, মাঝখানে একটা শব্দ—“মৃগনয়নী”।
এই শব্দটা দেখে সে চমকে উঠল।
মৃগনয়নী… এটা তো তার ঠাকুমার নাম ছিল! একটা দুষ্প্রাপ্য নাম, এখনকার সময় কেউ রাখেও না।
সে হঠাৎ স্পষ্টভাবে মনে করতে পারল—ছোটবেলায় ঠাকুমা একবার বলেছিলেন, “অনু, কারও দিকে তাকাবার আগে জানতে হবে, চোখটা আসলে কার। চোখ শুধু দৃষ্টি দেয় না, খেয়ে নেয় স্মৃতিও।”
তখন এসব কথা সে বুঝত না। আজ বুঝতে পারছে।
এইসব ভাবতে ভাবতেই লাইব্রেরির নিচতলার পুরনো আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়াল অনামিকা। এই আলমারি কাউকে খুলতে দেওয়া হয় না, তবু আজ দরজা খোলা। ভিতরে কয়েকটা পুরনো বই, আর একটা কাঁচের ফ্রেমে ছবি—এক নারী, দাঁড়িয়ে আছেন এক তান্ত্রিক মণ্ডপে। ছবি সাদা-কালো। নারীটির গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, মাথায় কাপড় ঢাকা, কিন্তু কপালে সেই একই পোড়া দাগ।
মৃগনয়নী বসু — লেখা আছে নিচে। জন্ম: ১৯১৯, মৃত্যু: অজানা।
অনামিকার পা হঠাৎ কেঁপে গেল।
সে আয়নার সেই মুখটাকে এখন চিনতে পারল।
ছবির নিচে ছোট্ট একটা খামে রাখা ছিল আরও এক পাণ্ডুলিপি—তার ওপর লেখা:
“তৃতীয় রেখা শুরু হবে যেখানে আগুন গলে জল হয়ে যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে ফিরে দেখিস—কারা তোকে আগুনে ঠেলে দিয়েছিল।”
পর্ব ৪: আগুনের ভিতর জন্ম
ঘড়ির কাঁটা বিকেল পাঁচটা ছুঁতেই বাতাসের গায়ে যেন একটা চাপা ধোঁয়া মিশে গেল। হঠাৎই শহরের শব্দ গুলি স্তব্ধ হয়ে গেল। ট্রাফিকের আওয়াজ দূরে মিলিয়ে গিয়ে অনামিকার চারপাশে শুধু নিঃশব্দতা—যেন কেউ কানে তুলো ঢুকিয়ে দিয়েছে, কিংবা সময় নিজের নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে আছে। রায় রে’ডিং রুমের নিচতলার পুরনো ঘরে সে দাঁড়িয়ে আছে—মৃগনয়নী বসুর ছবি আর সেই অদ্ভুত পাণ্ডুলিপিটা হাতে নিয়ে।
ছবির নারীটার দিকে তাকিয়ে সে ফিসফিস করে বলল, “তুমি কে? আমার কী?”
ছবির চোখ দুটি যেন কিছু বলতে চাইছে—কিন্তু ভাষা নেই, কেবল দৃষ্টি। সেই দৃষ্টি যেন চেনা, কিন্তু রক্তমাখা। আর ঠিক তখনই আবার কানের ভিতর বাজতে শুরু করল সেই গুঞ্জন—
“আগুন ছুঁয়ে যা। জল পাবে।”
পাণ্ডুলিপিটা হাতে নিয়ে যখন সে বেরোল, বাইরের বাতাস বদলে গেছে। আকাশটা গাঢ় কমলা—এমন যেন সূর্যাস্তের পরও সূর্য থেমে আছে, শুধু পুড়ছে, নিঃশব্দে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে তার মনে হচ্ছিল, শহরটা যেন এক প্রাচীন স্বপ্ন—যেখানে বিল্ডিং, মানুষ, ট্রাম, সবই কোনও এক কল্পনার খোলস মাত্র। আজকের কলকাতা নয়, বরং কোনও হারিয়ে যাওয়া তান্ত্রিক রাজ্যের অলীক প্রতিচ্ছবি।
বাড়ি ফিরে দরজা খুলেই অনামিকা বুঝল কিছু একটা বদলে গেছে।
ঘরটা তার নিজের হলেও ঠিক আগের মতো নয়। দেয়ালে সে যে সব বইয়ের পোস্টার টাঙিয়েছিল—তার বদলে আজ সেখানে ঝুলছে কয়েকটা মণ্ডলচিত্র, তান্ত্রিক রেখা, ত্রিকোণ আর ত্রিনয়নের মুখ। তার ডেস্কের ওপর রাখা ল্যাপটপ নেই, তার বদলে রাখা এক পুরনো শঙ্খ, এক রৌপ্যপাত্র আর একটা প্রদীপ—যার ভিতরে অলক্ষ্যে জ্বলছে হলুদাভ শিখা।
সে দরজা বন্ধ করল, আলো নিভিয়ে ফেলল, আর পাণ্ডুলিপিটা বিছানায় রেখে একবার গা ঝাড়া দিল। শরীরটা ভারী লাগছিল, চোখের পাতায় টান। কিন্তু ঘুম নয়—এ যেন ঘোর।
সে পড়ল পাণ্ডুলিপির দ্বিতীয় পৃষ্ঠায়—
“চতুর্থ রেখা তখনই জাগে, যখন পূর্বজন্ম আর বর্তমান এক হয়ে যায়। যেখানে সাপ আর স্রোত একই দিকে যায়, সেইখানে শুরু হয় অগ্নিস্মৃতি।”
ঠিক তখনই ঘরের আয়নাটা আবার কেঁপে উঠল। এই আয়নাটা অনেকদিন ধরে ওর ঘরে আছে, কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে সেটার আচরণ… যেন প্রাণ আছে তাতে। এবার আর প্রতিচ্ছবি এল না। আয়নায় ভেসে উঠল এক সিঁড়ি—মাটির, সর্পিল পথ, যা নামছে নিচের দিকে। সেই সিঁড়ি যেন আয়নার ভিতর থেকেও টেনে নিচ্ছে অনামিকাকে।
সে চোখ বন্ধ করল। পরমুহূর্তেই অনুভব করল, পায়ের নিচে জমি নেই।
সে পড়ছে। ধীরে, গভীরে।
চোখ খুলে দেখে সে এখন এক অন্য জগতে।
চারপাশে অন্ধকার, শুধু মাঝখানে এক যজ্ঞকুণ্ড—পোড়ানো চন্দনের গন্ধ, ধোঁয়া আর আগুনের তেজে কাঁপছে বাতাস। যজ্ঞমণ্ডপের চারপাশে কিছু লোক বসে আছে—তাদের মুখ ঢাকা, কপালে ত্রিনয়ন, চোখে তামার চশমা। কারও মুখে কালীমা, কারও চোখে গাঢ় চন্দনের টান। মাঝখানে বসে আছেন একজন নারী—সে আর কেউ নয়, মৃগনয়নী বসু।
কিন্তু এই নারী বৃদ্ধা নন, বরং তিরিশ বছরের এক দীপ্ত নারী—চোখে ভয়ংকর শান্তি, গলায় রুদ্রাক্ষ, কপালে আগুনের পোড়া দাগ। তিনি অনামিকার দিকে তাকিয়ে বললেন—
“তুই চলে এলি? এত তাড়াতাড়ি?”
অনামিকা যেন বোঝে না কিছুই। সে বলল, “এটা কোথায়?”
নারী বললেন, “১৯৪২ সালের অমাবস্যা। এই রাতেই তোকে প্রথমবার আগুনে নামানো হয়েছিল, অনু। এই সেই রাত—যখন তোর শরীরকে প্রমাণ করতে হয়েছিল যে তুই জন্মেছিলি আগুন থেকেই।”
“আমি?” অনামিকা প্রশ্ন করল।
নারী বললেন, “তুই তখনও ‘তুই’ ছিলিস না। তোর নাম ছিল চণ্ডী। আর তোর আত্মা ছিল অগ্নিপথে বাঁধা। একবার পা দিলেই ফেরার পথ থাকত না। তোর শরীরে খোদাই হয়েছিল সেই পাঁচটি চিহ্ন—যার ভেতর দিয়েই তন্ত্রজগত প্রবেশ করে। মনে পড়ে?”
অনামিকা মাথা নাড়ল। কিছুই মনে নেই। অথচ তার শরীরের ভেতর যেন হঠাৎ করে কোনও পুরনো সংবেদনা জেগে উঠল। বুকের মাঝখানে যেন আগুন জ্বলে উঠল—এক সুতার মতো—যা জিহ্বা, হৃদয়, জঠর, যোনি আর মস্তিষ্ককে একসঙ্গে বাঁধে।
নারী বললেন, “এটাই অগ্নিসূত্র। পাঁচ চক্র জুড়ে জেগে ওঠা একমাত্র রেখা, যা মৃত্যু দিয়েই শুরু হয়।”
তখনই যজ্ঞকুণ্ডের আগুন যেন রক্তে রূপ নিল। মাঝখানে ভেসে উঠল এক মুখ—পুড়ে যাওয়া, কিন্তু চোখ দুটি জীবন্ত। সেই মুখ অনামিকার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল—
“আমাকে কেন পুড়িয়ে দিলে?”
অনামিকা চিৎকার করে উঠল—“আমি কিছু করিনি!”
চারপাশের মুখগুলো আবার বলল একসাথে, “পুনর্জন্ম মানে দায়িত্ব। আর তুই তা ফেলে পালাতে পারিস না।”
বাতাসে জ্বলন্ত ছাইয়ের মতো ভেসে উঠল সেই পাঁচ চিহ্ন—ত্রিকোণ, সর্পচক্র, ত্রিনয়ন, অগ্নিপদ্ম, আর বসুধার মুখ। অনামিকার গায়ে আবার একবার আঁকা হল সেই চিহ্নগুলি। এবার জ্বালা অনুভব করল সে। শরীরের ভেতর, যেন আগুনের আঁচরে লেখা হচ্ছে তার অতীত।
অবশেষে মৃগনয়নী বললেন, “আজ শুধু প্রথম রেখাটা খুলল। তুই এখন ফিরে যা। কিন্তু মনে রাখিস—আগুন যখন একবার চোখে পড়ে, তখন অন্ধকার আর চিরকাল থাকে না।”
চোখে একটা ঝলকানি।
আবার বিছানায়, আবার নিজের ঘর। ভোর হয়েছে। কিন্তু জানালার বাইরে একঝাঁক কাক বসে আছে, অদ্ভুত নিঃশব্দে। তারা যেন তাকিয়ে আছে শুধু অনামিকার দিকে।
পর্ব ৫: যে আগুন কথা বলে না
ভোরের প্রথম আলো জানালার কাঁচে পড়ে যেন ভিতর-বাইরের মাঝখানে এক পাতলা আবরণ গড়ে তোলে। সেই কাঁচে অনামিকার মুখ পড়ছে, কিন্তু প্রতিচ্ছবি যেন চুপচাপ তাকিয়ে আছে অন্য কোথাও—তার চাহনিতে সেই আগুনের প্রতিধ্বনি, যেটা আগের রাতে অনামিকার শরীরের গায়ে গেঁথে গেছে।
সে আয়নার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আমি ফিরে এসেছি, কিন্তু আমি কি আদৌ ফিরে এসেছি?”
তার কথার জবাবে কিচ্ছু এল না। ঘর নিঃশব্দ, কেবল হৃদয়ের ভিতরে একটা তাপ, এক গভীর গর্জন জমে আছে। যেন কেউ দাহ করেছে, অথচ শরীরটা ছাই হয়নি।
সেই মুহূর্তে দরজায় কড়া নড়ে।
এবার সে ভয় পেল না। ধীরে গিয়ে দরজা খুলে দিল। দাঁড়িয়ে আছে একটা পিচকে চেহারার কিশোর, হাতে ধরা একটা সাদা খাম। চোখ দুটো গভীর, তার বয়সের তুলনায় অনেক বেশি বোঝা বইছে।
“আপনার নাম অনামিকা বাগচী?”
“হ্যাঁ।”
“এই চিঠিটা আপনার জন্য।”
“কে দিয়েছে?”
“আমাদের বলা আছে, নাম বলতে নেই। শুধু বলেছে, আপনি চেনেন তাকে।”
ছেলেটা এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল, তারপর চলে গেল। গলির মোড় ঘুরেই মিলিয়ে গেল অন্ধকারের মধ্যে।
চিঠিটা খুলে অনামিকা প্রথমেই দেখতে পেল—হাতের লেখা সে চেনে। খুব ভালো চেনে। ছোটবেলার ডায়েরিতে প্রতিদিন যে লেখা সে নিজেই লিখত, সেই একরকম হস্তাক্ষর, একই টান, একই বাঁক।
কিন্তু এই কাগজ সে লেখেনি।
“অনু,
তুই ভুলে যাস না—একজন তোর অপেক্ষায় আছে।
তুই যখন আগুন ছুঁয়েছিলি, তখন সে ছিল পেছনে।
কিন্তু তারও শরীরে আঁকা হয়েছিল একই চিহ্ন।
তুই এখন শুধু নিজের অগ্নিসূত্রের খোঁজ করছিস,
কিন্তু তারটা কোথায় গেল—তা কি জানিস?”
চিঠির নিচে কোনও নাম নেই। কিন্তু মনে পড়ল একটা মুখ। সেই মুখ, যেটা আগুনের মধ্যে ভেসে উঠেছিল—পুড়ে যাওয়া, কিন্তু চোখ দুটি জীবন্ত। চোখে এক অপমান, এক ব্যথা, আর এমন এক প্রশ্ন যা উত্তর দাবি করে।
অনামিকা জানে না সে কে, কিন্তু জানে তাদের সম্পর্ক ছিল। পূর্বজন্মে। আগুনের ভিতরে।
সে চিঠিটা বালিশের নিচে রাখল। ব্যাগে পুরে নিল পাণ্ডুলিপি আর সেই মানচিত্রটা—যার কেন্দ্রে লেখা “মৃগনয়নী”।
আজ তার গন্তব্য নিশ্চিত—পুরনো কলকাতার সেই বাড়ি, যেখানে তার ঠাকুমা ছোটবেলায় তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন, রায়গঞ্জের বেহালা সংলগ্ন রামতনু ঘোষ স্ট্রিটে। সেখানেই ছিল মৃগনয়নী বসুর আদি বাড়ি। বহু বছর আগেই পরিত্যক্ত, ধ্বংসপ্রায়।
ট্যাক্সি পেতে দেরি হল না। শহরের রাস্তাগুলো আজ যেন তাকে ডাকছে। ছায়া ঘনিয়ে আছে, কিন্তু কোথাও অস্বস্তি নেই। যেন পথগুলো জানে, আজ একজন নির্বাচিতের আগমন হবে সেই বাড়িতে।
বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে অনামিকা একবার চোখ বন্ধ করল।
ঘরের দেওয়ালে তখনও পোড়া চুন, জানালার কাঁচ ভাঙা, ভেতরে গাছপালা উঠে এসেছে। কিন্তু তার মন বলল—ভেতরে এখনও কেউ আছে। কেউ তাকিয়ে আছে।
দরজাটা বন্ধ, তবে তালা নেই। সে ধীরে ধাক্কা দিল।
আড়মোড়া ভাঙার মতো একটা শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল।
ভেতরে ঢুকেই সে যেন একসাথে দুই কালে প্রবেশ করল। আধুনিকতা এখানে নেই, কেবল ধ্বংস, স্মৃতি, আর গন্ধ। ঘরে ছড়িয়ে আছে রক্তের মতো শুকনো লাল দাগ—যেন বহু আগের কোনও যজ্ঞের স্মৃতি মাটিতে গেঁথে গেছে।
ঘরের একপাশে একটা পুরনো কাঠের সিন্দুক ছিল। সে জানে না কীভাবে জানে, কিন্তু হাত এগিয়েই খুলে ফেলল। ভিতরে রাখা কিছু পুস্তক, পুরোনো কাগজ, আর একটা পোড়ানো ছবি—যেখানে দুটো শিশু দাঁড়িয়ে আছে। একটির মুখ মুছে গেছে আগুনে। অন্যটি তাকিয়ে আছে সোজা ক্যামেরার দিকে।
চোখ দুটি একেবারে সেই আগুনের মধ্যেকার ছেলেটির মতো।
অনামিকা ছবি বুকে চেপে ধরল।
তারপর হঠাৎ পেছন থেকে এক গলা—
“অনু, মনে পড়ছে?”
সে চমকে ঘুরে তাকাল।
একটি ছায়ামূর্তি, হালকা রক্তাক্ত মুখ, কিন্তু দৃষ্টিতে কোনও ভয় নেই। সে যেন ঠিক স্বপ্নের মাঝখানে থেকে এসেছে, কিন্তু বাস্তবের ছায়া মেখে দাঁড়িয়ে আছে।
“তুই চণ্ডী ছিলি। আর আমি ছিলাম অগ্নি।
তোর জন্য আমি সেই যজ্ঞে ঢুকেছিলাম।
তুই বাঁচলি। আমি পুড়লাম।
কিন্তু তোর শরীরে চিহ্ন থেকে গেল।
আর আমার আত্মা… আটকে রইল এই বাড়িতে।”
অনামিকা ফিসফিস করে বলল, “তুই কে?”
ছায়ামূর্তি বলল, “তুই ভুলে গেছিস।
কিন্তু আমরা ছিলাম এক শরীর, এক আত্মা—
দুই দিক, এক অগ্নিপথ।
তোর অগ্নিসূত্র শুরু হয়েছিল আমার মৃত্যু দিয়ে।”
তারপর সে এগিয়ে এল।
“আমারও মুক্তি চাই, অনু।
তুই জেনে গেছিস নিজের আগুন।
এবার আমায় ছুঁয়ে দে,
আমারটাও জাগিয়ে দে।”
অনামিকা তার দিকে হাত বাড়াল।
ছোঁয়া মাত্র, কেঁপে উঠল ঘরটা। বাতাস গর্জন করল। সিন্দুকের ভিতরকার কাগজগুলো ঘূর্ণি হয়ে উড়তে লাগল। দেওয়ালের ফাটল থেকে বেরিয়ে এল গাঢ় তামার আলো। মেঝেতে আগুনে আঁকা হল সেই পাঁচ চিহ্ন—ত্রিকোণ, অগ্নিপদ্ম, ত্রিনয়ন, সর্পচক্র, বসুধার মুখ।
আর দুই জন একসাথে দাঁড়িয়ে থাকল চিহ্নের মধ্যে।
একসময় ছায়ামূর্তির মুখ থেকে একটা হাসি ছড়িয়ে পড়ল।
“তুই মনে রেখেছিস। এখন আমি মুক্ত।”
তারপর সে মিলিয়ে গেল আলোয়।
অনামিকা একা দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু এই একাকীত্ব অন্যরকম—এমন এক অনুভব, যা আত্মার প্রাচীন ভার হালকা করে।
সে জানে, শুধু নিজের পথ নয়, কারও পথ সে খুলে দিয়েছে।
পর্ব ৬: যাদের শরীরেই লেখা থাকে মন্ত্র
রামতনু ঘোষ স্ট্রিটের সেই পরিত্যক্ত বাড়িটা এখন নিঃশব্দ, ধ্বংসপ্রায়, কিন্তু অনামিকার চোখে তা জীবন্ত। দেওয়ালের গায়ে জেগে থাকা চিহ্নগুলো, মেঝেতে পুড়ে আঁকা ত্রিকোণ ও সর্পরেখা, সিন্দুকের ভিতরে পুড়ে যাওয়া পুরনো কাগজগুলো—সব যেন একে একে ভাষা হয়ে উঠছে, একটা লিপি যার নাম তন্ত্র নয়, বরং স্মৃতি।
সে জানে, ছেলেটি—অগ্নি—একটা আত্মা নয় শুধু। তার অস্তিত্ব ছড়িয়ে আছে অনামিকার দেহে, মনে, জীবনের অতীত অলিগলিতে। তারা একসঙ্গে জন্মেছিল আগুনে, এবং সেই জন্ম আজও জ্বলে চলেছে অন্য কোনও স্তরে।
অনামিকা জানে, তাকে এবার যেতে হবে আরও গভীরে। খুঁজে বের করতে হবে সেই সংগঠনটিকে, যাদের মূলে বসুধার গর্ভদ্বার। যারা ইতিহাসের বইয়ে নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স সিলেবাসে নেই, কিন্তু যারা কলকাতার মাটির নিচে, পুরনো মন্দিরের গায়ে, বস্তির দেয়ালে, শ্মশানের ছাইয়ের মধ্যে নিজেদের চিহ্ন রেখে গেছে।
তাদের নাম ভূসম্প্রসার—এক প্রাচীন তান্ত্রিক সম্প্রদায়, যারা বিশ্বাস করে, প্রত্যেক নির্বাচিত মানুষের শরীরেই লেখা থাকে পাঁচটি অদৃশ্য চিহ্ন, যা একমাত্র অগ্নিসূত্র জাগ্রত করলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই চিহ্নগুলোই তন্ত্রের ভাষা। তারা বিশ্বাস করে, মন্ত্র মুখে বলা হয় না, শরীরে বহন করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গিয়ে সে লাইব্রেরির পুরোনো আর্কাইভে খোঁজ নিল। দশকের পর দশক ধরে কেউ খোলেনি এমন এক তাক থেকে সে বের করল একটি কাচঢাকা জার্নাল—”পূর্ববঙ্গের অপার মুদ্রা ও তান্ত্রিক লিপি”। ভিতরে আঁকা কিছু চিত্র দেখে তার কাঁধের পেছনে কাঁপুনি উঠল। তার গায়ে আঁকা পাঁচ চিহ্নের হুবহু মিল—এমনকি সেই আগুনের ত্রিকোণ পর্যন্ত।
তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ছিল একটি পৃষ্ঠায় লেখা একটি শব্দ: “পঞ্চলোক”।
এই শব্দটি সে আগে শোনেনি। নিচে একটা ব্যাখ্যা লেখা ছিল—
“পঞ্চলোক সেই পাঁচজন, যাদের শরীরে পাঁচ চিহ্ন অঙ্কিত। একসাথে তারা খুলতে পারে বসুধার শেষ দ্বার। তাদের মধ্যে একজন নির্বাচন করে, একজন আগুন নেয়, একজন পেছন থেকে পথ দেখায়, একজন বিশ্বাসঘাতক হয়, আর একজন হারিয়ে যায়…”
এই বাক্যটুকু পড়ে অনামিকার শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেল।
পাঁচজন? সে তো একা ছিল না?
তাহলে বাকিরা কোথায়? কে ছিল বিশ্বাসঘাতক?
সেই রাতে তার ঘুম ভাঙে হঠাৎ এক স্বপ্নে—সে দাঁড়িয়ে আছে এক ঘন কুয়াশার ভিতরে। পাশে চারজন। তাদের মুখ স্পষ্ট না, কিন্তু সবাই দাঁড়িয়ে আছে আগুনের পাঁচ কোণ ঘিরে। একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে হাতে রুদ্রাক্ষ মালা নিয়ে, একজনের চোখে বাঁধা কাপড়, একজন ঝুঁকে আগুনে কিছু একটা বলছে, আর চতুর্থজন পেছন ঘুরে আছে। সেই পেছন ফিরে থাকা মানুষটির চোখ দেখা যায় না, কিন্তু তার শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে ঠান্ডা বাতাস।
স্বপ্নে আগুন বলল, “তাদের খুঁজে পেলে অগ্নিসূত্র পূর্ণ হবে। একেকজন একেক দিক। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম, আর কেন্দ্র।”
অনামিকা চমকে ঘুম ভাঙল। ঘরের ভেতরে তখন নিস্তব্ধ, কিন্তু জানালার কাঁচে লেখা এক শব্দ—পঞ্চলোক।
সে জানে, এবার তাকে খুঁজে বের করতে হবে সেই বাকি চারজনকে—যাদের শরীরেও চিহ্ন আছে, কিন্তু হয়ত তারাও জানে না তারা নির্বাচিত।
প্রথম সূত্র পেল সে রঞ্জনের কাছ থেকে—রায় রে’ডিং রুমের সেই যুবক, যে প্রতিদিন তাকে সেই নির্দিষ্ট টেবিলে বসতে দেখেছে, আর অদ্ভুতভাবে সবকিছু জানে যেন।
সেই বিকেলে, সে যখন লাইব্রেরি থেকে বেরোচ্ছে, রঞ্জন হঠাৎ তাকে থামাল। বলল, “দিদি, একটা কথা বলি?”
“হ্যাঁ?”
“আপনার কাঁধে লাল ত্রিকোণটা প্রথম যেদিন জেগেছিল, আমি দেখেছিলাম। সেইরাতেও আমি ছিলাম এখানে। জানতাম আপনি একদিন পাবেন সেই বইটা।”
“তুমি কী জানো?” অনামিকার কণ্ঠে বিস্ময়।
রঞ্জন হাসল। “আমি জানি আপনার মতো আরও চারজন আছে। একজন আছে দক্ষিণ কলকাতায়—যিনি বৌদ্ধ তন্ত্র গবেষণা করেন, নাম ডঃ অয়ন রায়। একজন আছেন নদিয়ায়—যিনি মৃতদেহের মুখ দেখে পূর্বজন্মের চিহ্ন পড়ে ফেলতে পারেন, নাম চাঁদমণি দেবী। আর একজন… খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তিনি নিজের নামও ভুলে গেছেন। শুধু কালীঘাটের পেছনে ছায়ার মতো বসে থাকেন।”
“আর পঞ্চম?”
রঞ্জন তাকাল অনামিকার চোখে। ধীরে বলল, “পঞ্চম হচ্ছেন আপনি।”
অনামিকার বুকের ভিতর শিউরে উঠল কিছু। এই ছেলেটা এত কিছু জানে কীভাবে?
রঞ্জন বলল, “আমার শরীরে কোনও চিহ্ন নেই। কিন্তু আমার কাজ ছিল আপনাদের খোঁজ করে একত্র করা। আমি বসুধার দ্বারের কণ্ঠস্বর মাত্র।”
“তোমার নাম কী?”
“নাম দিয়ে কী হবে দিদি। আপনি ডাকলেই আমি শুনব। এই শহরটাই আমার শরীর, আর আপনাদের পথ দেখানোই আমার কর্ম।”
সেদিন রাতে অনামিকা জানে, তার আগের অধ্যায় শেষ। এবার শুরু হবে সেই পথচলা—যেখানে এক একজন নির্বাচিত মুখোমুখি হবে নিজেদের ভয়, বিশ্বাস, বিশ্বাসঘাতকতা আর নিয়তির সঙ্গে।
একটা পুরোনো পাণ্ডুলিপির শেষ পাতায় লেখা—
“অগ্নিসূত্র কখনও শেষ হয় না। যারা একবার চিহ্ন বহন করে, তারা যুগ যুগ ধরে সেই আগুনে ফিরে আসে। একসময় না একসময়, বসুধা সবাইকে ডাকবেই।”
পর্ব ৭: পঞ্চলোকের ছায়া
সকাল ছয়টা। কলকাতা তখনো ঘুমঘুম। ফুটপাথে চা-ওয়ালারা দোকান খুলছে, পল্টুর মোড়ে কাগজের গাদায় ভোরের আলো পড়ছে। কিন্তু এই শহরের ওপর আজও একটা অদৃশ্য চাদর টানানো—যার নিচে হাঁটছে এক তরুণী, যাকে আর ‘সাধারণ’ বলা যায় না।
অনামিকার শরীর এখন অনেকটা বোঝা হয়ে উঠেছে তার নিজের কাছে—ভিতরে আগুনের মতো কিছু জেগে আছে, হালকা জ্বলুনি, কিছু না বলা শব্দ, আর স্বপ্নের পেছনে গড়া দিকনির্দেশ। সে জানে, এবার সময় হয়েছে। পাঁচজনকে খুঁজে বের করতে হবে, সময়ের আগেই। কেননা প্রতিটি চিহ্নের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক একটা পথ—আর পথের শেষে বসুধার দ্বার।
প্রথম গন্তব্য—বৌদ্ধ তন্ত্র গবেষক ডঃ অয়ন রায়।
দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুর সংলগ্ন গলিতে তাঁর বাড়ি। সাধারণ দোতলা বাড়ি, কিন্তু তার বারান্দায় পুঁথিপত্রে ঢাকা পড়ার টেবিল, আর দেয়ালে আঁকা একটি ধ্যানরত বোধিসত্ত্বর চিত্র জানান দেয়, এই মানুষটি কেবল অধ্যাপক নন, এক অনুসন্ধানী আত্মাও।
অনামিকা যখন পৌঁছোল, তখন অয়নবাবু উঠেইছেন। জানালার পাশে বসে ধূপ জ্বালাচ্ছেন।
“আপনি ডঃ অয়ন?”
“আপনি নিশ্চয় অনামিকা। আমি আপনাকে স্বপ্নে দেখেছি। তিন রাত আগে।”
“স্বপ্নে?”
“হ্যাঁ। এক আগুনের ঘরে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম পাঁচজন। আপনি মাঝখানে। আমি দক্ষিণে। মনে নেই?”
অনামিকার মুখে স্তব্ধতা। সে জানে, এই মানুষটি মিথ্যে বলছেন না।
অয়ন তাকে বললেন, “আমার ঘাড়ে এক তিলের মতো দাগ আছে, ত্রিকোণাকার। ছোটবেলা থেকে সেটি ব্যথা করে যখন চন্দ্রগ্রহণ হয়। আগে ভয় পেতাম। এখন বুঝি, এটা শরীরের বাইরে থেকে আসা নয়—এটা বহন করছি আমি জন্মজন্মান্তর ধরে।”
“আপনি জানেন আমরা কারা?”
“একটা গোষ্ঠীর কথা জানতাম—ভূসম্প্রসার। তারা বিশ্বাস করত, পৃথিবীর গভীরে এক শক্তিকেন্দ্র আছে—বসুধার গর্ভদ্বার। শুধু নির্বাচিতরাই সেই দরজা খুঁজে পেতে পারে। আর সেই নির্বাচিতরা পাঁচজন—যাদের শরীরেই পাঁচটি চিহ্ন ফুটে ওঠে।”
অনামিকা জানাল, সে ইতিমধ্যেই সেই দ্বারের মুখে গিয়েছিল। মৃগনয়নী, অগ্নি, আগুনের চক্র—সব কিছু খুলে বলল।
অয়ন গভীরভাবে শুনলেন। তারপর বললেন, “আমরা পাঁচজন যদি একত্রিত হই, তবে সেই দরজা খুলবে—যেখানে আমাদের পূর্বজন্ম আর ভবিষ্যৎ মিলেমিশে একটি ভাষা তৈরি করবে। সেই ভাষায় লেখা আছে তন্ত্রের শেষ সূত্র।”
অনামিকা জানতে চাইল, “তৃতীয়জন কে?”
অয়ন বললেন, “নদিয়ার এক গ্রামে থাকে চাঁদমণি দেবী। তিনি মৃতদেহের মুখে পূর্বজন্মের ছায়া পড়তে পারেন। এক ধরণের শ্মশান-তন্ত্রচর্চা করেন। তাঁকে সাধারণ মানুষ ভয় পায়, পাগল ভাবে। কিন্তু তিনিই ‘পূর্বদৃষ্টি’।”
সে দিনেই তারা রওনা দিল নদিয়ার দিকে।
পথে ট্রেনের জানালায় বসে অনামিকা মনে করতে লাগল, তার নিজের ভেতরে কোথায় কোথায় চিহ্নগুলো আছে। বাম কাঁধে লাল ত্রিকোণ, বুকের মাঝখানে সর্পরেখা, কপালের শিরার নিচে অস্পষ্ট মুদ্রা, পায়ের পাতা জুড়ে আগুনের মতো ছোপ… আর চোখে বসুধার ছায়া।
চাঁদমণি দেবীর গ্রামটা শহরের বাইরে, গাছপালা ঘেরা, নদীর ধারে ছোট্ট একটা ঘর। বাইরে এক কুয়ো, পাশে পাথরের ঘাট।
ঘরে প্রবেশ করতেই এক ঘোর লাগা গন্ধ—ধূপ, পোড়া তুলসীপাতা আর মাটি।
চাঁদমণি দেবী অপেক্ষা করছিলেন। তিনি চুলে সিঁদুর লাগান না, চোখে কাজল দেন না, কিন্তু মুখে এমন আলো আছে, যেন হাজার মৃত আত্মা তাঁর আশেপাশে ঘোরে, আর তাঁর ভাষা শোনে।
তিনি অনামিকার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুই পেরেছিস আগুনে ঢুকতে, এখন আমার গলায় স্পষ্ট দেখছি তোর মুখ। আগের জন্মে আমরা কালীঘাটে একসঙ্গে পুজো দিয়েছিলাম, মনে পড়ে?”
অনামিকা মাথা নাড়ল। “স্মৃতি নেই।”
“থাকবেই না। তন্ত্রের সবচেয়ে বড় শাস্তি—জন্মান্তরের স্মৃতি লোপ। তবে চিহ্ন ফেরে।”
চাঁদমণি উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর ঘাড়ে উলম্ব রক্তলেখার মতো দাগ—একটি পদ্মরেখা।
অয়ন দেখলেন, তাঁর বুকেও আগুনের মতো একটা ছোপ—যেটা আগে ছিল না।
তিনজনের শরীরেই এখন এক এক করে স্পষ্ট হচ্ছে সেই পাঁচ চিহ্ন।
চাঁদমণি বললেন, “তোমরা যদি চতুর্থজনকে খুঁজতে চাও, তবে কালীঘাটে যাও। পুরোনো মন্দিরের পেছনে এক লোক বসে থাকে। নাম বলে না। চোখে কাপড় বাঁধা। গলায় শঙ্খ ঝুলে আছে। সে শুধু শোনে। কিছু বলে না। কিন্তু তার শরীরেই ত্রিনয়ন ফুটে উঠেছে। সে ‘শ্রোতা’।”
“আর পঞ্চম?” অনামিকা প্রশ্ন করল।
চাঁদমণি দেবী হেসে উঠলেন। বললেন, “পঞ্চম সবসময় জানে সে কে। তাই খোঁজার দরকার হয় না। সে নিজেই ফিরে আসে।”
তিনজন যখন কালীঘাট পৌঁছল, তখন সন্ধে। পুরোনো ঘাটের পেছনে শালপাতা ছাওয়া এক ছায়ামূর্তি বসে ছিল—চোখে কাপড় বাঁধা, গলায় শঙ্খ, নিঃশব্দে বসে।
তারা কাছে যেতেই সে বলল, “আমি জানি। চারজনে এসেছ। পঞ্চম তোমাদের নিয়েই এসেছিল।”
“কে?” অয়ন প্রশ্ন করল।
“তোমরা যে মেয়েটির সঙ্গে এসেছ—সে নিজেই পঞ্চম। সে নির্বাচিত, কিন্তু সে-ই পথের দিশারি।”
অনামিকার বুকের ভিতর হঠাৎ কেঁপে উঠল সেই আগুন। এবার সে জানে, পাঁচজন একত্রিত। এবার সময় এসেছে। বসুধার গর্ভদ্বার জেগে উঠবে।
পর্ব ৮: বসুধার গর্ভদ্বার
পাঁচজন দাঁড়িয়ে আছে এক বৃত্তে—এক একটি শরীর, এক একটি চিহ্ন, এক একটি প্রাচীন অনুরণন। তাদের কারও চোখে ভয় নেই, কিন্তু প্রত্যেকের শরীর জ্বলছে নিঃশব্দ আগুনে। এ আগুন ধ্বংস করে না—এ জাগায়, খুলে দেয় শরীরের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা মানচিত্র।
অয়ন দাঁড়িয়ে আছে দক্ষিণ দিকে, বুকের মাঝখানে তার চিহ্ন জ্বলজ্বল করছে। চাঁদমণি দেবী দাঁড়িয়ে আছেন পূর্বে, কপালে বসুধার পদ্ম, যেন চোখের জায়গা নিয়েছে তৃতীয় নক্ষত্র। কালীঘাটের ছায়ামূর্তি, ‘শ্রোতা’, দাঁড়িয়ে আছেন পশ্চিমে—চোখে এখনও কাপড় বাঁধা, তবু সে সব দেখতে পাচ্ছে। আর অনামিকা দাঁড়িয়ে কেন্দ্রবিন্দুতে—সে জানে, তার মধ্য দিয়েই খুলবে গর্ভদ্বার।
নির্বাচিত পঞ্চম, ‘লিপি’—যার শরীরে আগুন লিখেছে সেই প্রাচীন ভাষা, যা কেবল জেগে ওঠে চিহ্নগুলো একত্র হলে।
স্থান—এক পুরনো কালীমন্দিরের নিচের কুঠুরি, যা কেবল গোপনে খোলা হয় এক রাতে, বছরে মাত্র একবার, কার্তিকী অমাবস্যায়। সেখানে এখন জেগে উঠছে বসুধার শেষ দ্বার। চারপাশের পাথর গায়ে লেখা লিপি গুলিয়ে যাচ্ছে—ত্রিকোণ, সর্পচক্র, ত্রিনয়ন, অগ্নিপদ্ম, বসুধার মুখ। প্রতিটি চিহ্ন এক এক করে জেগে উঠছে পাথরের গায়ে, আলো ফেটে পড়ছে প্রতিটি রেখা থেকে।
অনামিকার চোখের সামনে দরজাটা ঘুরতে থাকল। শব্দ নেই, কেবল শ্বাসরুদ্ধ সময়। তারপর এক মুহূর্তে দরজাটা খোলা গেল—না, হাত দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে। সেই পাঁচজন যখন চোখ বন্ধ করল, তখনই দরজার গায়ে আলো জ্বলে উঠল।
দরজার ওপাশে অন্ধকার নয়—শূন্যতা।
কিন্তু সে শূন্যতার গভীরে তন্ত্রের পায়ে বাঁধা আত্মারা কেঁপে উঠছে। সেইসব আত্মা, যারা একদিন এই দ্বারে এসেছিল, কিন্তু নিজের ভয় পেরোতে পারেনি।
পাঁচজন একসঙ্গে প্রবেশ করল।
ভিতরে ঢুকতেই তারা বুঝতে পারল, এটি কোনও ঘর নয়, কোনও গুহা নয়, বরং একটি চেতনা। বসুধার চেতনা। সময় এখানে নেই। শব্দ নেই। কেবল স্মৃতি।
তাদের সামনে ভেসে উঠল একেকটা চিত্র—যেন একেকজনের আত্মার ডায়েরি খুলে গেল।
অয়ন দেখল, সে আসলে একজন রাজবংশীয় তান্ত্রিক ছিল, যে নিজের ভাইকে উৎসর্গ করেছিল আগুনে।
চাঁদমণি দেখলেন, তিনি এক সময়ে বসুধার প্রধান রক্ষাকর্তা ছিলেন, কিন্তু ভুল করেছিলেন—ভুল মানুষকে বিশ্বাস করায় গর্ভদ্বার রুদ্ধ হয়েছিল।
‘শ্রোতা’ দেখল, সে সেই যজ্ঞের পুরোহিত, যে শেষ যজ্ঞে মন্ত্র উচ্চারণ করেনি—ভয় পেয়েছিল।
আর অনামিকা?
সে দেখল আগুনের কুণ্ডে অগ্নিকে ঠেলে দিচ্ছে, নিজে বাঁচতে। সে চিৎকার করে বলেছিল, “আমি পারব না! আমি পারব না!”
বসুধার গলা শোনা গেল, না শব্দে, না ভাষায়—মন দিয়ে।
“তোমরা সবাই ভুল করেছিলে। তাই ফিরেছ।
তোমরা সবাই ভয়ে পালিয়েছিলে। তাই নির্বাচিত হয়েছ।
কারণ যারা ভয় পায়, তাদেরই স্মৃতি থাকে সবচেয়ে বেশি।
ভুল দিয়ে শুরু হয় সত্যের দরজা।”
পাঁচজন হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। এই আত্ম-স্মৃতির সামনে দাঁড়ানো মানে নিজেকে ছিন্ন করা। অতীত নিজের হাতে নিয়ে তার পুড়ে যাওয়া পৃষ্ঠা খুলে দেখা।
তখনই বসুধা বলল—
“এবার বলো—তোমরা কী চাও?”
অনামিকা বলল, “ভুল নয়, এবার আমরা স্মৃতি চাই। আগুনের ভাষা চাই, যাতে আমাদের শরীরে লেখা তন্ত্রকে আমরা বুঝতে পারি। আর যে সত্য চাপা পড়ে আছে, তাকে তুলে আনার শক্তি চাই।”
“তবে জেনে রাখো,” বসুধা বলল, “এই পথ সহজ নয়। তুমি চিহ্ন পাবে, কিন্তু তা বোঝার জন্য তোমাকে মরতে হবে—এই জীবনে নয়, আত্মায়।”
পাঁচজন একত্রে বলল, “আমরা প্রস্তুত।”
হঠাৎ প্রতিটি চিহ্ন তাদের গায়ে জ্বলে উঠল। সেই আগুন তাদের পোড়াল না, কিন্তু গায়ে লেখা সব মিথ্যে ছেঁড়ে ফেলল—লিঙ্গ, জন্ম, নাম, পরিচয়—সব ছাই হয়ে গেল।
শরীর নিঃশব্দে দুলল। তারপর গলে গেল, রূপ পেল আলোয়।
অনামিকা দেখল—সে আর আগের মতো নয়। তার মুখে অন্য ভাষা, চোখে অন্য দৃষ্টি। তার শরীর হয়ে উঠেছে এক লিপি—প্রত্যেক অঙ্গ যেন একেকটি মন্ত্র।
আর বাকি চারজন? তারাও এখন আলাদা, কিন্তু সংহত।
বসুধা বলল—
“তোমরা এখন পাঁচ চিহ্নের পঞ্জি। তন্ত্র তোমাদের মধ্য দিয়ে বাঁচবে। কিন্তু কেউ জানবে না। কেউ দেখবে না। কারণ সত্য কেবল নির্বাচিতদের মধ্যেই কথা বলে।”
বাইরে তখন ভোর।
পাঁচজন আবার ফিরে এল দুনিয়ায়।
কিন্তু এখন তাদের কেউ চিনতে পারবে না। তারা হারিয়ে যাবে শহরের ভিড়ে—একজন পাণ্ডুলিপি লিখবে, একজন নদীর ধার ঘেঁষে গা ঢাকা দেবে, একজন ফের পুরোহিত হয়ে উঠবে, একজন ঘোরের মধ্যে পাথর দিয়ে মণ্ডল আঁকবে।
আর অনামিকা?
সে চুপচাপ চলে যাবে সেই লাইব্রেরির টেবিলে। লাল কাপড়ে মোড়া খাতাটা এবার সে খুলবে অন্যভাবে। এবার সে জানবে, কাকে ডাকছে পৃষ্ঠাগুলো। কাকে বেছে নিচ্ছে চিহ্নেরা।
পঞ্চলোক আবার ভেঙে যাবে। আবার একদিন জন্মাবে।
কারণ বসুধার গর্ভদ্বার কখনো বন্ধ হয় না। কেবল ঘুমিয়ে থাকে।
নতুন নির্বাচিত আসবে। নতুন আগুন জ্বলবে।
আর সেই আগুনের ভিতর থেকে কোনও একদিন, আবার ভেসে উঠবে সেই ফিসফিসানি—
“চোখ খোলো। চিহ্ন বুঝে ফেলো। তোমার নাম লেখা আছে আগুনের ভিতরে।”
শেষ