Bangla - হাস্যকৌতুক

ঠাকুমার টিকটক

Spread the love

ঋজু সেন


ঠাকুমা ও ‘ShortyShorts’-এর প্রথম সাক্ষাৎ

কলকাতার বালিগঞ্জে পুরনো বনেদি দোতলা বাড়ি, ছাদের কোণে একটা নারকেল গাছ, দেওয়ালে ফাটল, আর উঠোনে ঝাঁপিয়ে পড়া হিবিসকাস ফুল। বাড়িটার বয়স প্রায় একশো। আর তার একজন স্থায়ী বাসিন্দা—শৈলজা বসু, ওরফে ‘ঠাকুমা’। বয়স ৮২, চোখে চশমা, মুখে হাঁ করা চমকানো অভিব্যক্তি প্রায় সর্বক্ষণ। কিন্তু তিনি হাঁটেন সোজা, শাড়ি পরেন রঙিন—তুলসী পাতার মতো সবুজ, চেরি ফুলের মতো গোলাপি।

ঠাকুমা সারাদিন খবরের কাগজ পড়েন, টিভি দেখে রান্নার শো, আর মাঝে মাঝে শঙ্খ বাজিয়ে জানান দেন তিনি এখন “যোগা” করছেন। কিন্তু এই পরিপাটি নিয়মমাফিক জীবনে হঠাৎ একদিন হট্টগোল লাগে।

নাতি অভ্র, ক্লাস টুয়েলভে পড়ে, তার ঘরে বসে গানের আওয়াজ, হাসির হা-হা, আর ক্যামেরার ঝিকিমিকি দেখে ঠাকুমা বললেন,
— “কি রে? আবার পিকচার তুলছিস?”
অভ্র বিরক্ত হয়ে বলল,
— “না ঠাকুমা, এটা রিল… মানে শর্টি-শর্টস, ইনস্ট্যান্ট ফেম… ভাইরাল ভিডিও।”
— “তোর ভাই জ্বালায় তোকে, আর তুই সেটার ভিডিও তুলিস?”

অভ্র মাথা চুলকে হাসল, ঠাকুমা কিছুই বুঝলেন না।
কিন্তু রাতে ঘুম আসছিল না। তিনি ভাবলেন, এই ‘শর্টি শর্টস’ কি আবার কোনো বিশেষ ধরনের হাফপ্যান্ট? না কি এটা আবার ঠাকুরঘরের কোনো জিনিস!
পরের দিন সকালের কাগজ পড়ার বদলে তিনি অভ্রর মোবাইলটা চুপচাপ নিয়ে ঘাঁটতে লাগলেন।

আবিষ্কার করলেন—একটা অ্যাপে লোকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে, নাচছে, কেউ পেঁয়াজ কাটতে কাটতে গান গাইছে!
ঠাকুমা তো চোখ কপালে তুলে বললেন,
— “এই সব কি, রে? এরাই এখনকার শিল্পী?”

কিন্তু তিনিও একটু হেসে ফেললেন—একজন বৃদ্ধ দাদু নিজের কাঁধে বিড়াল নিয়ে ‘লুংগি ডান্স’ করছে!
ঠিক তখনই এক টিপে বুম—অ্যাকাউন্ট খুলে ফেললেন তিনি। নাম দিলেন @BongoQueen82।

পরের কয়েকদিনে ঠাকুমার মধ্যেই যেন অন্য এক মানুষ জন্ম নিল।
ভোরবেলা উঠে তিনি ভিডিও করেন—
“আজ আমি শিখবো কীভাবে নারকেল কোড়া ছাড়া নারকেল চাটনি বানানো যায়… কিন্তু তার আগে একটুখানি ডায়ালগ—‘আয় রে ছেলেপুলেরা, ঠাকুমা একাই ধুম’!”

চায়ের টেবিলে অভ্র দেখে তার ফোনে কেউ ‘লাইক’ দিচ্ছে দেদার। এক ঝলক দেখে বুঝতে পারল—তার ফোন থেকেই কেউ ভিডিও পোস্ট করেছে।
— “Who posted this??”
ঠাকুমা মুচকি হেসে বললেন,
— “আরে আমি… তোকে তো কেউ দেখে না, আমারেই সবাই চায়!”

অভ্র রীতিমতো চমকে উঠল—তার ঠাকুমা, যিনি ফোনে নাম সেভ করতে পারেন না, তিনি এখন ‘Hashtag’ লিখে ক্যাপশন দিচ্ছেন?

শুরু হল এক নতুন যুদ্ধ—নাতি বনাম ঠাকুমা।
অভ্র যেখানে হাল ছেড়ে বসে থাকে, ঠাকুমা তখন ডায়লগ বলেন:
— “সিঙ্গেল ঠাকুমা, রেডি টু মিংগল! ❤️ #OldIsTheNewBold”

চতুর্থ দিনে ঠাকুমার একটা ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেল।
বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে তিনি বলছেন—
“সকালে হাঁটতে বেরোলে যদি কেউ বলে ‘কি সুন্দর’, বুঝে নেবেন আপনার মুখ নয়, আপনার মাস্কটা নতুন।”

ভিডিওটা দেখা মাত্রই ১০ হাজার ‘ভিউ’।
গ্রুপ চ্যাটে নিকুন্জ কাকিমা, রূপার মা, সবাই বলছেন,
“শৈলজা দি, আপনি তো এখন সেলিব্রিটি!”

অভ্র হাঁ করে তাকিয়ে। সে কত দিন ধরে চেষ্টা করছে ইনফ্লুয়েন্সার হতে! আর এই বৃদ্ধা ঠাকুমা… তিন দিনে বাজিমাত।

পর্ব শেষে অভ্র ঠাকুমার ঘরে ঢুকে বলে,
— “তুমি জানোই না তোমার এই ভিডিওর মানে কী!”
ঠাকুমা শান্ত গলায় বলেন,
— “আমি জানি, একাকীত্বের মানে কী। এটাও জানি, একটু হেসে নিলে সকালটা বাঁচে।”
তারপর হঠাৎই বললেন,
— “কাল একটা রিল তোর সাথেও করব। হ্যান্ডস্ট্যান্ড শিখবি?”
অভ্র অবাক!
— “হ্যান্ডস্ট্যান্ড? তুমি?”
— “বয়স নয় রে, সাহসই সব। এইটাই হবে ক্যাপশন।”

ফলোয়ার ফাইট

সকালের আলো ফোটার আগেই ঠাকুমা আজকে উঠে পড়েছেন। পেটিকোট গুঁজে ফুলতোলা শাড়ি পরা, চুল আঁচড়ানো শেষ, লিপস্টিকের জায়গায় একটা টুকটুকে পানের দাগ, আর হাতে একটা ঠোঙা—ভরা আমসত্ত্ব আর কাঁচা লঙ্কা। আজকের ভিডিওর থিম: “ঠাকুমার স্ট্রিট ফুড রিভিউ”।

অভ্র তখনও ঘুমের ভেতর। চোখ খুলেই ফোনটা টিপে দেখে তার ইনস্টাগ্রাম—ফলোয়ার ৫১৮।

আচ্ছা, এত কষ্ট করে সে ভিডিও এডিট করে, মিউজিক লাগায়, কভার ডিজাইন করে—আর ফলোয়ার মাত্র ৫০০!

ঠাকুমার দিকে তাকিয়ে সে দেখে—তিনি আঙুলে তুলো মুড়িয়ে বলছেন,
— “আজ আমি খাব রামধনু ঝালমুড়ি! আর বলব, কোন দোকানটার ঝাল সবচেয়ে ঝাল!”

একপাশে লেখা:
📍 “North Kolkata’s Hidden Gem”
🎶 ব্যাকগ্রাউন্ডে গান: “কাঁচা লঙ্কার ঘ্রাণে পুড়ে গেল মন…”

অভ্র ফোন খুলে দেখল—ঠাকুমার নতুন ভিডিও ৩ ঘণ্টায় ২০,০০০ ভিউ ছাড়িয়েছে।
আর কমেন্টস?
“Such vibe!”
“Reminds me of my grandma 😭”
“Need a collab with @BongoQueen82 RIGHT NOW!”

সে গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করে বলল,
— “এই বয়সে কেউ ইনফ্লুয়েন্সার হয়? এটা অন্যায়! এটা ঠকাই!”
ঠাকুমা নাক সিটকোলেন,
— “আমার বয়সে বিয়ে করেছি, এখন যদি লাইক-কমেন্টে প্রেম আসে, দোষ কোথায়?”
একটু থেমে আবার যোগ করলেন,
— “তুই যদি ভালো কনটেন্ট বানাতিস, তোকে কেউ তো আটকাত না।”

এইটুকু শুনে অভ্র আর চুপ করে থাকতে পারল না। ঘোষণা করল:
— “এক সপ্তাহ। আমি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি ঠাকুমা—কে বেশি ফলোয়ার বাড়াতে পারে!”

ঠাকুমা হেসে গালে আলতো চাপ দিলেন,
— “তাহলে শুরু হোক ‘ফলোয়ার ফাইট’। পুরস্কার কী?”
— “হারলে নিজের অ্যাকাউন্ট ডিলিট করতে হবে।”
— “ডিলিট মানে কী?”
— “মানে সব শেষ। BongoQueen82 মুছে যাবে!”
— “তাহলে তুই প্রস্তুত হ?”

ঠাকুমা চোখ টিপে বললেন,
— “বয়স্ক বাঘ দাঁত দেখালে লোকে ভাবে গল্প, আর আমি দাঁত দেখাইলে হয় ট্রেন্ড। দেখা যাক, কে জেতে।”

পরের সাত দিন পুরো বাড়ি রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে।

Day 1:
অভ্র বানায় ড্রোন দিয়ে কলেজের ছাদে এক সিনেম্যাটিক ভিডিও—ব্যাকগ্রাউন্ডে হিন্দি র‍্যাপ।
ঠাকুমা Meanwhile দাঁড়িয়ে বলেন,
— “আজ বলব কীভাবে হাঁটুর ব্যথা নিয়েও নাগিন ডান্স শেখা যায়।”
সিনেম্যাটিক রিল তো দূরের কথা, ঠাকুমা টিকটক স্টাইলেই হাসি-ঠাট্টায় সব গুছিয়ে ফেলেন।

Day 3:
অভ্র ফলোয়ার: ৮৯০
ঠাকুমা ফলোয়ার: ২৬,০০০
ঠাকুমার ভিডিও: “How to flirt in proper Bangla”
ক্যাপশন: “শুধু বং ছেলেরা বুঝবে!”

অভ্র ফোন ছুঁড়ে ফেলে দিতে গিয়ে থামে—কিছু একটা করতেই হবে!

Day 5:
অভ্র বানায় কুকুর-বিড়ালের ভিডিও, ভাইরাল ফর্মুলা।
কিন্তু ঠাকুমা সেদিন বানালেন—“Bongo Beauty Secrets from 1960s”
ভাঙা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলেন:
— “আমার সময় আমরা লিপস্টিক বানাতাম বেদানা বাটা দিয়ে… আর প্রেমিক ধরতাম চোখের ইশারায়!”

ভিডিওটা একদিনে ৫০,০০০ ভিউ পায়।
Abc.in নামক একটি অনলাইন ম্যাগাজিন ঠাকুমার ওপর ফিচার চায়।

অভ্র মুখ চেপে বসে থাকে। শেষদিন এগিয়ে আসছে। হেরে গেলে? ঠাকুমার অ্যাকাউন্ট না, বরং তার আত্মসম্মানটাই ডিলিট হয়ে যাবে।

Day 7:
ফাইনাল দিন। ঠাকুমার ফলোয়ার: ৫৪,০০০
অভ্রর ফলোয়ার: ২,৩০০

রাতে চুপচাপ অভ্র নিজের ঘরে বসে থাকে। হঠাৎ ঠাকুমা এসে বলেন,
— “হার মানছিস?”
— “না… কিন্তু বুঝতে পারছি, তুই কেন জিতলি।”

ঠাকুমা হাঁসেন, গলায় কাঁপা কাঁপা হাসি।
— “জিতিনি রে। তোকে জিতিয়ে দিলেই বরং বেশি ভালো লাগত। কিন্তু জানিস, এই ভিডিওগুলো আমার একঘেয়েমি ভেঙে দিয়েছে। আমি আবার ‘আল্লাদে’ হাসি পেতে শিখেছি।”

অভ্র ধীরে ধীরে উঠে আসে… বলে,
— “তাহলে চল, দু’জনে মিলে একটা ভিডিও বানাই?”
ঠাকুমা বললেন,
— “তোর কি মনে আছে, একদিন বলেছিলাম হ্যান্ডস্ট্যান্ড শিখতে?”
— “না না ঠাকুমা, আজকে না! একটা রিল কর, যাতে কমপক্ষে একটুও হেলান না লাগে…”

দু’জন মিলে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ায়।

ক্যাপশন পড়ে:
“Two Generations. One Bond. #BongoBonding begins!”

ব্র্যান্ড ফেস ঠাকুমা!

ঠাকুমার ইনস্টাগ্রাম ফলোয়ার ৬৫,০০০ ছাড়িয়েছে। “#BongoQueen82” এখন রীতিমতো ট্রেন্ডিং। কাঁচা লঙ্কা খেতে খেতে ডায়ালগ বলা, রান্না করতে করতে কবিতা আবৃত্তি, ঠাকুমার হাসি আর কাঁধের সেই পুরনো গামছা—এই মিলিয়ে এক অনন্যা জুটি তৈরি হয়েছে।

হঠাৎ এক সকালে ডোরবেল বাজল। দরজা খুলে অভ্র দেখে তিনজন কড়া-কাঠের মতো পোশাকে লোক দাঁড়িয়ে। একজনের হাতে ফোল্ডার, অন্যজনের কাঁধে ক্যামেরা।
— “আমরা A1 Creatives থেকে এসেছি। আমরা চাই আপনার ঠাকুমা আমাদের ব্র্যান্ড ফেস হোন।”

অভ্র তো হতভম্ব! ঠাকুমা তখন বসে রয়েছেন রোদে পিঠ দিয়ে, দুধ চা খাচ্ছেন কাঁসার বাটিতে।
— “কে রে?”
— “বিজ্ঞাপন সংস্থার লোক ঠাকুমা!”
— “আমি আবার এখন বিজ্ঞাপন দেব?”
— “না না, আপনি থাকবেন বিজ্ঞাপনে।”

ঠাকুমা চশমা খুলে রাখলেন, সোজা হয়ে বসে পড়লেন যেন ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছেন।

প্রথম লোকটি সামনে ফোল্ডার খুলে দেখাল—
— “দেখুন, আমরা আপনাকে নিয়ে একটা ক্যাম্পেইন করতে চাই—‘মা-ঠাকুমার পাকা রাঁধুনি কৌটো’। আপনি হবেন আমাদের শুভেচ্ছা দূত। মাইনে মাসে পঁচিশ হাজার। আর তিন মাসের চুক্তি।”

ঠাকুমা একটু চুপ করে বললেন,
— “আমাকে টিভিতে দেখা যাবে?”
— “জি। আপনার ভিডিও থাকবে ইনস্টাগ্রামে, ইউটিউবে, এমনকি হোর্ডিং-এও।”
— “ভালো কথা। কিন্তু আমার কিছু শর্ত আছে।”
— “শর্ত?”—তিনজন একসঙ্গে চোখ বড় বড় করে তাকাল।

ঠাকুমা শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে গম্ভীর গলায় বললেন,
— “প্রথমত, আমার গামছাটা থাকতেই হবে। ওটা আমার স্টাইল স্টেটমেন্ট।
দ্বিতীয়ত, আমি কোনও রাসায়নিক মশলার বিজ্ঞাপন করব না।
তৃতীয়ত, স্ক্রিপ্ট আমি নিজে লেখার অধিকার চাই।
চতুর্থত, ক্যামেরাম্যানকে চা-সিঙ্গারা খাইয়ে তবেই শুটিং শুরু হবে।
আর পঞ্চমত… আমার নাতি অভ্র থাকবে ভিডিও এডিটর।”

তিনজন নির্বাক।

তাদের টিমের প্রোডিউসার চোখ গোল করে বলল,
— “অ্যামেজিং! এত কনফিডেন্স! এত ক্যারিশমা! আপনি তো রীতিমতো কমিউনিকেশন স্ট্র্যাটেজি নিজেই তৈরি করে ফেললেন!”

অভ্র চুপচাপ দাঁড়িয়ে হাসছিল। একদিকে গর্ব, অন্যদিকে অবাক—এই মানুষটা তার ঠাকুমা?

সেদিন দুপুরে বাড়িতে মিনি শুটিং সেট বানানো হল। ঠাকুমার মেকআপ করতে এল একজন, কিন্তু ঠাকুমা চুলে একটু নারকেল তেল লাগিয়ে বললেন,
— “আমি যেমন আছি, তেমনই থাকব। কাচা আমি, পাকা নয়।”

চিত্রনাট্য শুরু হয়—
“এই বয়সে আর কী চাই জানেন? দু’চামচ আদা-মরিচ বাটা, আর একটা মানুষ যে কিচেনের গন্ধে ভালোবাসে।”

ক্যামেরার পিছনে অভ্র, হাতে গিম্বাল ধরে হাঁপাচ্ছে, আবার হেসেও ফেলছে।
একটা শটে ঠাকুমা লাইন ভুলে বললেন,
— “এই মশলা খাবেন না—এইটা খেলে আপনিও মোর মতো গম্ভীর হয়ে পড়বেন!”

টেক কাট। কিন্তু পুরো টিম হেসে গড়াগড়ি খায়।
বলা চলে, ঠাকুমা নিজেই একটা ‘আনফিল্টারড’ রত্ন।

ভিডিও পোস্ট হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে:

✅ ইউটিউবে ২.৫ লাখ ভিউ
✅ ইনস্টাগ্রামে “#BongoQueen82” ট্রেন্ডিং নম্বর ৫
✅ “ঠাকুমার কিচেন টিপস” নিয়ে নতুন রিল সিরিজের চুক্তি

বাড়িতে ঢুকে অভ্র বলল,
— “তুমি এখন আমাদের পরিবারের ব্র্যান্ড হয়ে গেলে।”
ঠাকুমা হাসলেন,
— “আমি তো শুধু বলছিলাম কিভাবে পেঁয়াজ ছাড়া তরকারি বানাই। ওটাই যদি ব্র্যান্ড হয়, তাহলে বলিস না!”

হঠাৎ ফোনে টিং করে নোটিফিকেশন আসে। ঠাকুমার চোখ বড় বড় হয়ে যায়।

— “রে অভ্র, কেউ আমায় আমেরিকান চ্যানেল থেকে মেসেজ করেছে! বলে, একটা কুকিং শো করতে চায়!”

অভ্র তাকিয়ে থাকে। ঠাকুমার সেই ছাদের কোণের গামছা—এবার কি আমেরিকার রান্নাঘরে উড়বে?

হলিউড কলিং!

সন্ধ্যার আলো মিশে গিয়েছে কলকাতার মেঘলা আকাশে। ছাদের কোণে বসে ঠাকুমা তখন হালকা গরম চায়ের সঙ্গে মুড়ি-আলুভাজা চিবোচ্ছেন। আর হাতে ধরা ফোনটা একদৃষ্টে তাকিয়ে বলছেন,
— “অভ্র, দেখে তো কে মেসেজ পাঠিয়েছে—একটা বিদেশি নাম: Barry Thompson, LA Cookhouse Productions!”

অভ্র ফোনটা হাতে নিয়ে চোখ গোল করে বলল,
— “LA মানে লস অ্যাঞ্জেলেস? আমেরিকা?”

— “তা-ই তো লিখেছে। বলে, আমি নাকি খুব ইনফ্লুয়েন্সিয়াল ‘ক্রিয়েটর’। চায় আমাকে নিয়ে একটা কুকিং রিয়েলিটি শো বানাতে।”

ঠাকুমার মুখে লাজুক হাসি। কিন্তু অভ্রর মুখে সন্দেহের রেখা।
— “তুমি কি কোনও ডকুমেন্ট বা লিংক খুলেছ?”
— “একটা ফর্ম খুলেছিলাম, তাতে জিজ্ঞেস করেছিল আমার আধার নম্বর আর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট…”
— “কি!! আধার আর অ্যাকাউন্ট! ঠাকুমা!! এটা তো স্প্যাম! স্ক্যাম! ফ্রড!”
— “ওরে বাবা… আমি তো ভাবলাম বিদেশিরাও বুঝেছে গরম মশলার গুণ!”

অভ্র ফোনটা হাতে নিয়ে ল্যাপটপ খুলে বসে গেল। Barry Thompson নামে সার্চ করল—
না, এমন কোনও প্রোডাকশন হাউস নেই।

তারপর যা হল, তা যেন গোয়েন্দা কাহিনির মতন—
Barry’র প্রোফাইল ফেক, ফলোয়ার মাত্র ৩
ডিপিতে একটা স্টক ফটো
আর মেসেজ পাঠানো হচ্ছে একাধিক প্রবীণ ইনফ্লুয়েন্সারকে

অভ্র বলল,
— “এটা একেবারে পুরোদস্তুর স্ক্যাম। যদি তুমি লিঙ্কে ক্লিক করতে, অ্যাকাউন্ট ফাঁকা হয়ে যেত।”

ঠাকুমা চুপ করে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে বললেন,
— “মানে হলিউডে আর যাওয়া হল না?”
— “না, এখনই না। তবে তুমি চাইলে আমরা বানাতে পারি ‘Ballygunge Cookhouse Presents: Bongo Queen’।”

ঠাকুমা একটু চুপ থেকে হঠাৎ বললেন,
— “তাহলে এখন থেকেই শুরু করা যাক শো-এর রিহার্সাল!”

পরদিন সকাল:
ঠাকুমা চেয়ারে বসে, সামনের টেবিলে দেশি মশলা, পাটার থালা, একটা ক্যামেরা আর অভ্র।

সিনেম্যাটিক ভয়েসে ঠাকুমা বললেন,
— “Welcome to Ballygunge Cookhouse! আজ আমি শেখাব কীভাবে দুটো পুরোনো আলু, একটা ঝাল লঙ্কা আর একটা শোনালী মন নিয়ে তৈরি হয় প্রেমের ঝালঝাল তরকারি!”

অভ্র পেছন থেকে বলে উঠল,
— “Cut! ঠাকুমা, তুমি তো পেঁয়াজটা কাটাইনি!”
— “ওটা কাটলে চোখে জল আসে, আর প্রেমে চোখে জল মানেই সুপারহিট!”

সেদিন সন্ধ্যায় ভিডিও পোস্ট হলো। ক্যাপশন:
“Hollywood didn’t happen. But Ballygunge did.”
#BongoQueen82 #BallygungeCookhouse #SpiceAndSoul

কমেন্ট বক্সে ভরে গেল:
— “Hollywood doesn’t deserve you!”
— “East or West, our Bong Queen is best!”
— “Please do a full cooking series!!”

রাতে অভ্র হেসে বলল,
— “তুমি জানো, এখন সবাই ভাবছে তুমি খুব চালাক ঠাকুমা। অথচ তুমি আধার নম্বরই দিয়ে দিচ্ছিলে।”
— “আরে বাবা, আমি ভাবছিলাম যদি তারা আমাকে পুরস্কার দেয়, টাকা তো জমাতেই হবে!”
— “তোমাকে একদিন ইন্টারনেট ব্যবহার না করতে বললে কী হবে?”
— “তখন আমি ঘুমিয়ে পড়ব, আর স্বপ্নে ভিডিও বানাব!”

অভ্র মাথা চুলকে বলল,
— “কিন্তু ঠাকুমা, একটা জিনিস বুঝলাম না… এত বয়সে তুমি এত আগ্রহ পাও কোথা থেকে?”
ঠাকুমা চশমা খুলে বললেন,
— “যখন বাড়ির সবাই ব্যস্ত থাকে ফোনে, তখন বুড়ো মানুষটাও ফোনেই গল্প খোঁজে। আমার শুধু গল্প বলার জায়গাটা বদলে গেছে। এখন শুধু ক্যামেরা ছাড়া কেউ শোনে না।”

অভ্র ধীরে ধীরে মাথা নোয়াল।
এই মানুষটার গল্পটা যত না মজার, তার চেয়েও অনেক বেশি জীবন্ত।

ঠাকুমার ফ্যান মিট!

বাড়ির সামনে আচমকা তিনটে সাইকেল এসে দাঁড়ায়। স্কুল ব্যাগ কাঁধে, হাতে ফোন, চোখে অদ্ভুত উজ্জ্বলতা। তিনজন স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে, দরজায় কড়া নাড়ে।

অভ্র দরজা খুলতেই বলে,
— “আমরা কি এখানে ‘BongoQueen82’-এর বাড়িতে এসেছি?”
অভ্র চোখ কুঁচকে বলল,
— “হ্যাঁ, বলুন… কেমন সাহায্য করতে পারি?”
— “ওনার ফ্যান। আমরা প্রতিদিন ওনার ভিডিও দেখে খেতে বসি!”

এই কথা শুনে অভ্র খানিকটা হেসে বলল,
— “ঠাকুমা! তোমার ফ্যান এসেছে!”

ঠাকুমা এসে দাঁড়াতেই ছেলেমেয়েগুলো উত্তেজনায় বলে উঠল,
— “হি ইজ শি! I mean… শি ইজ শি!”
— “আপনি আমাদের আইডল! মা বলে ফোন ছুঁয়ো না, কিন্তু বলেও আপনি যা করেন—মা নিজেই আজকাল আপনাকে দেখে রাঁধে!”

ঠাকুমা একটু থতমত খেয়ে গেলেন, তারপর বললেন,
— “তোমরা খালি ফোন দেখো না তো, আমায় দেখে কেউ পড়ে না বলো? পরীক্ষা কবে?”

তিনজন হেসে ফেলল।

তাদের সঙ্গে গল্প জমে উঠল—কার জীবনে কত হোমওয়ার্ক, কার টিফিনে কী থাকে, কে সবচেয়ে ভাল GIF বানাতে পারে।
ঠাকুমা বললেন,
— “তোমাদের বাড়িতে তো কেউ শুনতে চায় না তোমাদের ছোট ছোট হাসির গল্প। তাই তো আমার মতো বুড়োদের কথাই ভালো লাগে।”

একজন বলল,
— “তবে একটা অনুরোধ… একটা ভিডিও বানাবেন আমাদের নিয়ে?”
— “তোমরা যদি কাল সকালে স্কুলের আগে চলে আসো, আমি বানিয়ে দিই!”

পরদিন সকাল ৬টা:
ঠাকুমা দাঁড়িয়ে রান্নাঘরে, পরনে হালকা রঙের তাঁতের শাড়ি, হাতে ঝাঁটা। তিনজন দাঁড়িয়ে পাশে, ইউনিফর্ম পরে, পিঠে ব্যাগ।

ক্যামেরা অন।

— “আজ আমি শিখাব কিভাবে পড়াশোনা করতে করতে মনের ভেতর টিকটক চালু রাখা যায়!
টিপস ১: বইয়ের ফাঁকে এক চামচ ঘুগনি।
টিপস ২: গণিত করতে করতে মুখে কবিতা আওড়াও।
আর টিপস ৩: ক্লাসে ঘুমিয়ে গেলে স্বপ্নে আমি এসে বলব, ‘উঠ ছেলে, ফলোয়ার কমে যাচ্ছে!’”

রিলটা পোস্ট হতেই ছড়িয়ে পড়ল গোটা সোশ্যাল মিডিয়ায়।

স্কুলের বাচ্চারা কমেন্ট করছে—
— “This is the content we want!”
— “Our generation has hope again!”
— “BongoQueen82 for Principal!”
একজন লিখল—
— “আমার ঠাকুমা তো এখন ঠাকুমার ফ্যান!”

সন্ধ্যায় ঠাকুমা একটা চিঠি পান—একটা ছোট্ট হাতে লেখা পোস্টকার্ড।

“প্রিয় ঠাকুমা,
আপনার ভিডিও দেখে মনে হয় আপনি আমার নিজের মানুষ। আপনি থাকলে একা লাগে না।
– রূপ, ক্লাস সিক্স”

ঠাকুমা চিঠিটা হাতে নিয়ে চুপ করে বসে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর অভ্রকে ডেকে বলেন,
— “তোর কি মনে হয়, আমি শুধু নাচি-গাই বলেই সবাই দেখে?”
অভ্র মাথা নাড়ে।
— “তুই জানিস, আমি যখন তোর ঠাকুরদার সঙ্গে প্রথম আলাপ করি, তখনো আমি রেডিওতে কবিতা পাঠাতাম। তখন শুনতাম হাজার জন। এখন দেখি হাজার ছেলেমেয়ে দেখে… তারা শুনতে চায় আমি কে। ওটাই তো আনন্দ।”

অভ্র বলে,
— “তোমার আসল ম্যাজিকটাই ওখানে। তুমি শুধু হাসাও না—তুমি ছুঁয়ে যাও।”

ঠাকুমা হেসে বললেন,
— “এখন থেকে আমার ভিডিও শুরু হবে এই লাইন দিয়ে—
‘যাদের মনে একটুও হাসি নেই, তাদের জন্যই আমি আছি।’”

বালিগঞ্জ কনটেন্ট কুইন!

বাড়ির ঘড়িতে তখন সকাল ১০টা। ঠাকুমা ততক্ষণে এক কাপ দুধ চা শেষ করে বসে আছেন ছাদের কোণে। আচমকা নিচে কলিং বেল বেজে উঠল।

অভ্র দরজা খুলতেই ঢুকলেন—সাবিত্রী দেবী মুখার্জি, যিনি পাড়ায় পরিচিত “মডার্ন দিদিমা” নামে।
পরনে নীল-হলুদ জিন্স-কুর্তি ফিউশন, চোখে হালকা ছায়া, আর হাতে স্মার্টফোন!

— “শৈলজা, তোমার ইনস্টাগ্রাম তো আজকাল আগুন হয়ে উঠেছে দেখছি!”
ঠাকুমা চমকে উঠে বললেন,
— “আরে সাবিত্রী, এতদিন পর? তুমি এখন ফোনে রিল দেখো?”
— “রিল? আমি এখন নিজেই বানাই! @ModernDida48—৫০০০ ফলোয়ার তো হয়ে গিয়েছে। এখন চাইলে প্রোমোশনও পেতে পারি।”

ঠাকুমা একটু অবাক।
— “ও তো বেশ! তাহলে তো আমরা এখন একই জগতে।”

— “একই নয় কিন্তু, আমার কনটেন্ট trendy lifestyle নিয়ে—তোমার তো ওল্ড স্কুল! এখন আমি বানাতে চলেছি ‘Yoga with Modern Dida’ সিরিজ।”

অভ্র ওদের কথা শুনে নিজের ফোন বের করে বলল,
— “দু’জনকেই রেকর্ড করি নাকি? একটা চ্যালেঞ্জ কন্টেন্ট হয়ে যাক—‘বালিগঞ্জ কনটেন্ট কুইন’ কে হবেন?”

ঠাকুমা একটু হেসে বললেন,
— “তোর ভালোই কৌতূহল! ঠিক আছে, দেখা যাক কে জেতে।”

চ্যালেঞ্জের নিয়ম ঠিক হয়:
১. দু’জনকেই দিতে হবে তিনটি রিল
২. একদিনে সর্বোচ্চ লাইক ও কমেন্ট যার হবে, তিনিই জয়ী
৩. থিম—‘বয়স শুধু সংখ্যা’

Day 1:

📱 Modern Dida:
ফুটপাথ ধরে হেঁটে কফি হাতে ‘রিল ডায়ালগ’:
— “সাসুমা বলে বুড়ো হচ্ছি, আমি বলি—বুড়ো কিন্তু হট!”
ফলোয়ার বাড়ছে… কিন্তু কমেন্টস মিশ্র। কেউ বলছে “গর্জিয়াস!”, কেউ আবার “অত অভিনয় ক্যানো?”

📱 BongoQueen82:
ঠাকুমা চেয়ারে বসে, হাতে একটা জং ধরা হারমোনিয়াম—
— “বয়স হলে গান ভুলে যায় না, বরং আরও গভীর হয়। আজ একটা নজরুল গাই।”
গান শেষ, ক্যাপশন:
“I may be old, but I’m still in tune.”
কমেন্টে এক কলেজ স্টুডেন্ট লিখেছে—
“এই গান শুনে আমার দাদুর কথা মনে পড়ল।”

Day 2:
📱 Modern Dida:
জুম্বা ডান্স, ট্রেন্ডিং সাউন্ডে, ক্যাপশন:
“No Botox, only Biceps!”
লাইকস ১০০০+, কিছু কটাক্ষও আসছে—“এই বয়সে এতটা দরকার?”

📱 BongoQueen82:
ঠাকুমা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে বলছেন—
— “এক হাতে লুচি ফুলিয়ে, আরেক হাতে ভাইরাল হওয়া, সেটা শুধু ঠাকুমারাই পারে।”
কমেন্টে এক নেটিজেন লিখেছে—
“দিদা, তুমি আমার টেস্টবুকের থেকেও বেশি রিফ্রেশিং!”

Day 3: ফাইনাল শোডাউন।
দু’জনে একসাথে লাইভে আসেন ইনস্টাগ্রামে।

সাবিত্রী বললেন,
— “আমি এখানে এসেছি জেতার জন্য।”
ঠাকুমা হাসলেন,
— “আর আমি এসেছি হাসানোর জন্য। যদি দু’টো এক হয়, তাহলে বুঝবে ভালোবাসা আসলেই ভাইরাল হয়।”

শেষমেশ ভোট গণনা শুরু হয়।
ফলাফল:
Modern Dida: ৯,৫৪৩ লাইক
BongoQueen82: ২৭,৮৭২ লাইক

পাড়া কেঁপে ওঠে! লোকাল ইনফ্লুয়েন্সার চ্যাম্পিয়ন—BongoQueen82!

সাবিত্রী মুখার্জি হালকা হাসি দিয়ে বললেন,
— “ঠিক আছে শৈলজা, তুই জিতেছিস। কিন্তু চল, দু’জনে মিলে একটা কন্টেন্ট বানাই?”
ঠাকুমা বললেন,
— “তাতে বেশি ফলোয়ার হবে। কারণ ঠাকুমা আর দিদিমা মিললে প্রেম আর ঝাল দুটোই পাবে!”

ভিডিওর ক্যাপশন:
“Two Queens. One Bond. Bongo Bonding Extended!”
#ModernDidaXQueen82 #SeniorSwag #BallygungeBattle

 

দিদিমণির গার্জেন

বালিগঞ্জ গার্লস হাই স্কুল থেকে অভ্রর মায়ের ফোনে এল একটা চিঠি—
“আমাদের স্কুলের বাৎসরিক অভিভাবক সভায় আমরা এক বিশেষ অতিথিকে নিমন্ত্রণ করতে চাই—জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শৈলজা বসু ওরফে ‘BongoQueen82’।”

অভ্র তো শুনে তাজ্জব!
— “স্কুলে ঠাকুমা? মোটিভেশনাল টক?”
ঠাকুমা বললেন,
— “আমি তো মোটিভেট করিই, শুধু ভাষাটা আজকাল একটু ট্রেন্ডি।”

 

দিনটি: শুক্রবার
স্থান: স্কুল অডিটোরিয়াম
সময়: সকাল ১০টা

ঠাকুমা পরেছেন রেশমি ধুতি-শাড়ি, কপালে ছোট লাল টিপ, আর হাতে সেই বিখ্যাত গামছা।
মঞ্চে উঠে মাইক হাতে তুলে বললেন—
— “আমার নাম শৈলজা বসু। আমার একখানা আইডি আছে—@BongoQueen82। শুনলে হাসবেন না, আমি হ্যাশট্যাগ দিই, রিল বানাই। কিন্তু আজ হ্যাশট্যাগ নয়, হূদয় দিয়ে কথা বলব।”

ছোট ছোট কিশোরী মুখগুলো কৌতূহলে তাকিয়ে, আর পেছনে অভিভাবকদের ভিড়।

— “আমি দেখেছি, এখনকার ছেলেমেয়েরা মন খুলে কাঁদে না, মন খুলে হাসেও না। ওরা মোবাইলে ভালোবাসে, আবার মোবাইলে কাঁদে।
আমি শুধু এটুকু বলি—একটা লুচি যদি ফুলে না ওঠে, তাও খাওয়া যায়। কিন্তু একটা মন যদি দমচাপা থাকে, সেটা কষ্ট দেয়।”

সবার চোখে ছায়া পড়ে। কেউ হাসে, কেউ চুপ করে।

ঠাকুমা থামেন না—
— “আমি রিলে বলি, ঝাল লঙ্কা খাও। কিন্তু জীবনটা ঝাল হলে, পাশে কে আছে সেটা বেশি জরুরি।
আপনার সন্তানের পাশে থাকুন, তিরস্কারের নয়, সাহসের পাশে। আর একটা কথা—যতই ব্যস্ত থাকুন, তাদের গল্পগুলো শুনুন। কারণ একদিন ওরা আপনাদের গল্প হয়ে যাবে।”

সারাটা হল তখন নিঃশব্দ।

হঠাৎ এক অভিভাবক উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
— “আমি আমার মেয়ের সাথে অনেকদিন কথাই বলি না। সে শুধু ফোনে থাকে। এখন বুঝলাম, তার মনেও আমি নেই… এ ভুল আমার।”

তারপর ধীরে ধীরে করতালি শুরু হয়।
শুরুটা শিশিরের মতো নরম, শেষে ঝড়ের মতো তীব্র।

 

অভ্র ব্যাকস্টেজে দাঁড়িয়ে চুপ করে দেখছিল।
সেই মহিলা, যিনি একদিন আধার নম্বর দিয়ে স্ক্যামে পড়ছিলেন, আজ স্কুলে সবাইকে শেখাচ্ছেন সম্পর্কের সত্যিকারের অঙ্ক।

ঠাকুমা মঞ্চ থেকে নেমে এসে বললেন,
— “তোকে একটা কথা বলি অভ্র—
আগে দিদিমণি বললে ক্লাসের সবাই ভয় পেত। এখন আমার নাম শুনলে বাচ্চারা ছবি তুলতে চায়। এটা জীবনের প্রাপ্তি, রে।”

অভ্র ঠাকুমার হাত ধরল।

সেদিন ইনস্টাগ্রামে নতুন রিল এল—
📹 ঠাকুমা বলছেন:
“আজকের রেসিপি—এক কাপ ভরসা, এক চামচ শোনার ইচ্ছে, আর একটু কম ফোন। রান্না করো সম্পর্ক। খারাপ হবে না।”
#BongoQueen82 #ParentingWithLove #OldIsTheNewCool

কন্টেন্ট চুরির কাণ্ড!

এক ভোরবেলা অভ্র ফোন হাতে চুপচাপ বসে আছে। ঠাকুমা এসে চা দিতে গিয়ে বললেন,
— “কি রে? সকালবেলায় মুখ কালো করে বসে আছিস কেন?”
অভ্র ফোন দেখিয়ে বলল,
— “এই দেখো, তোমার রিল—‘লুচি ফুললে সম্পর্কও ফুলে’—হুবহু কপি করেছে এক ইনফ্লুয়েন্সার! ক্যাপশনও এক, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও!”
— “মানে চুরি?”
— “না, ভাইরাল চুরি। এখন সবাই বলছে ওটাই আসল, তুমি নাকি কপি করেছো!”

ঠাকুমা চুপ করে বসে চা খেলেন। তারপর বললেন,
— “একটা কাজ কর, ওই ইনফ্লুয়েন্সারের প্রোফাইলটা খুল।”

প্রোফাইল খুলতেই দেখা গেল—নাম @MasalaMashi, বয়স আনুমানিক ৪৫, ভিডিওতে ডায়ালগ, হাসি, থিয়েট্রিকাল এক্সপ্রেশন। ফলোয়ার ২ লাখ।

ঠাকুমা মুচকি হেসে বললেন,
— “এইবার একটা নতুন রিল তোইরি কর। ক্যামেরা, লাইট, কিছুই লাগবে না। আমি রান্নাঘরে বসে বলব।”

 

📹 ভিডিও শুরু:
BongoQueen82:
— “অনেকে বলে, পুরনো কনটেন্ট আবার নতুন করে বানালে, সেটাকে বলে ‘ট্রেন্ড’। আমি বলি, মশলার প্যাকেট বদলালেই রান্না ভালো হয় না। আসল স্বাদ আসে মাটির হাঁড়ি থেকে।
যারা আসল কথা চুরি করে, তাদের কণ্ঠে থাকে শুধু আওয়াজ, হৃদয়ে থাকে না গল্প।”

📸 ক্যাপশন:
“লুচি ফুলিয়ে কি প্রেমের অনুভূতি চুরি করা যায়? উত্তর রইল এখানে। #OriginalAlways”

 

রিলটা পোস্ট হতেই কমেন্ট বক্সে আগুন!

🔥 “স্যালুট দিদা! ক্লাসি জবাব!”
🔥 “@MasalaMashi should take notes!”
🔥 “When grace meets guts. Queen is back!”
🔥 “শুধু রিল নয়, আপনি শিক্ষা!”

দু’ঘন্টার মধ্যে রিল ছাড়িয়ে গেল ৫০,০০০ লাইক।
আর তখনই ঘটল আশ্চর্য ঘটনা—@MasalaMashi নিজে ইনবক্সে মেসেজ পাঠাল:

“দিদি, আপনি ঠিক বলেছেন। রেগে নয়, মজা করে বললেন। আমি সত্যিই দুঃখিত।”

ঠাকুমা ফোন দেখিয়ে বললেন,
— “দেখলি, তেতো কথা না বলে যদি একটু জিরে ফোড়ন দিই, অনেক কিছুই বদলে যায়।”
অভ্র হেসে ফেলল।
— “তোমার রিল এখন অনলাইন এথিক্সের উদাহরণ হয়ে গেছে!”

সেদিন রাতে ‘BongoQueen82’ এক নতুন রিল পোস্ট করলেন—

📹 “চুরি করে কেউ বড় হয় না। আসল রান্না হয় মায়া মিশিয়ে, হিং নয়। তাই বলি—ভালোবাসা দিয়ে ফলোয়ার বাড়াও, কপি করে নয়।”
#CopyNoMore #RespectTheRecipe #BongoQueen82

 

পরদিন এক বিখ্যাত ডিজিটাল পোর্টাল ঠাকুমার সাক্ষাৎকার চাইল।
শিরোনাম:
“Meet the Influencer Grandma Who Fights Plagiarism with Poetry.”

ঠাকুমা বললেন,
— “আমি লড়াই করি না, আমি গল্প বলি। তাতে যদি কারও চুরি ধরা পড়ে—দোষ তার, শিক্ষা আমার।”

 

লাইভ শো কাণ্ড!

A1 Creatives-এর অনুরোধে ঠাকুমা রাজি হয়েছেন প্রথমবার Live Cooking Session করতে। অনুষ্ঠানটির নাম:
“Bongo Queen Live: Sunday Tiffin Tales”
তাঁদের আশা—হাজার খানেক দর্শক দেখবে, ফলোয়ার কিছু বাড়বে। ঠাকুমার ধারণা ছিল—“আরে লাইভ মানে তো কেবল রেডিওর মতো হবে, কেউ দেখবে না তো!”

অভ্র অবশ্য সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে—রিং লাইট, ট্রাইপড, ফোনে ভালো মাইক্রোফোন, স্ক্রিপ্টও টুকে দিয়েছে।
শুধু একটা জিনিস ভুল করেছিল—ঠাকুমার মুখ ধোয়ার আগে লাইভ অন করে রেখেছিল!

রবিবার সকাল ৯টা ৫৮
ঠাকুমা বললেন,
— “রেকর্ডিং কবে শুরু হবে?”
অভ্র বলল,
— “২ মিনিট পর… ক্যামেরা রেডি।”
কিন্তু ভুল করে সে বাটনে টিপ দিয়ে Live অন করে বসে।

স্ক্রিনে লাইভ শুরু:
📲 ঠাকুমা বাথরুমে হাঁটছেন—হাতে একটা গামছা, মুখে টুথপেস্টের ফেনা!
— “এই অভ্র! আমার ব্রাশটা কই? আর কি বলেছিলি—লাইভ মানেই নাকি অজ্ঞান থাকলেও মানুষ দেখে না!”

হাজারের বেশি দর্শক স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে তখন।

একজন কমেন্ট করল:
“OMG! This is THE REAL BONGO QUEEN!”
আরেকজন:
“She’s brushing on live! ICONIC.”

হাসির ঢেউ শুরু হলো। লোকেরা স্ক্রিনশট নিয়ে পোস্ট করতে লাগল:
“When your day starts with grandma brushing and roasting life.”
“She’s the GOAT—Granny of All Time!”

ঠাকুমা বুঝতেই পারেননি লাইভ চলছে। ফিরে এসে রান্নাঘরে বসে শুরু করলেন—
— “আজ আমি করব দুধ-সুজির টিকিয়া। এইটা আমি খাইতাম যখন তোমার ঠাকুরদা চিঠি লিখত—‘আজ তুমি কি পরেছো’?”

অভ্র ফিসফিস করে বলল,
— “ঠাকুমা… আমরা ৪ হাজার লোক লাইভ দেখছে।”
— “কি?? মুখ ধোয়া দেখেছে?”
— “হ্যাঁ… এবং সেটাই ভাইরাল হচ্ছে।”

ঠাকুমা একটু থেমে বললেন,
— “তাহলে এখন থেকে রোজ ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়েই লাইভে যাব!”
— “তুমি কি সিরিয়াস?”
— “আরে হ্যাঁ! এখন থেকে হবে নতুন সিরিজ—‘Brush & Bash’।”

সেদিন দুপুরে, ইন্টারনেটজুড়ে একটা ভিডিও ঘুরতে লাগল—
📹 “BongoQueen82 Brushing While Talking Existential Philosophy”

সেই ভিডিওতে ঠাকুমা বলছেন—
— “জীবনটা যেমন—মুখ ধুলেও সব দাগ যায় না, মনটা ধোয়া দরকার। কিন্তু মন কে ধোয়? এক কাপ চা আর একটু নিজের সঙ্গে কথা বললেই অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যায়।”
কমেন্টে লেখা—
“She just redefined morning routine!”
“This is better than therapy.”

সন্ধ্যায় টিভিতে চলে এল একটি খবরে রিপোর্ট:
“BongoQueen82 Accidentally Goes Live While Brushing. India Can’t Stop Laughing (or Loving Her).”

A1 Creatives ফোন করে বলল,
— “ম্যাম, আমরা এর ওপর ভিত্তি করে একটা ব্রাশ ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন বানাতে চাই!”
ঠাকুমা বললেন,
— “ঠিক আছে, কিন্তু আমি চা খেতে খেতে কথা বলব। আমি মুখ ধোয়াই নায়িকা, অভিনয়ে নয়!”

সেই রাতেই ঠাকুমার নতুন রিল:
📹 “মুখ ধুতে গিয়ে ভাইরাল হলাম। এখন থেকে বালতিটাই আমার রিং লাইট।”
#BrushAndBash #LiveWithLove #BongoQueen82

বিদায় BongoQueen?

সকালের রোদে আজ একটু কম উষ্ণতা।
ঠাকুমা চুপচাপ বসে আছেন বারান্দার চেয়ারে। চোখে চশমা, পাশে চা আর পেপার খোলা।
অভ্র এসে বলে,
— “আজ কিছু পোস্ট করবে না? কাল রাতের লাইভে পাঁচ লাখ ভিউ গেছে, ঠাকুমা!”

ঠাকুমা হালকা হাসলেন।
— “আজ একটা পোস্ট করব ঠিকই, কিন্তু অন্যরকম।”

 

দুপুর ১২টা। ইনস্টাগ্রামে ‘BongoQueen82’ নতুন রিল আপলোড করলেন।

📹 ঠাকুমা শান্ত গলায় বলছেন—
— “আমি শৈলজা বসু। অনেকেই আমাকে চেনেন BongoQueen82 নামে।
এই কয়েক মাসে আমি হেসেছি, কেঁদেছি, রান্না করেছি, ভুল করেছি, ভাইরাল হয়েছি।
কিন্তু আজ একটা কথা বলতে চাই—এটাই আমার শেষ রিল।”

দৃশ্যপট: পেছনে পেঁজা রোদ, ঠাকুমার ছাদের কোণে শুকতে থাকা গামছা।

— “আমি শুরু করেছিলাম নিছক মজার জন্য, এখন দেখছি ভালোবাসা যেন পাহাড়ের মতো।
কিন্তু আমি একটা কথা বিশ্বাস করি—গল্প থামা উচিত তখনই, যখন শ্রোতা আরেকটু চায়।
এই বয়সে প্রতিদিন ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো, ভিউ-কমেন্ট-স্ট্যাটস নিয়ে ভাবা, আমার শরীর আর মন দুটোই ক্লান্ত।
তাই আজ আমি নিজেকে একটু ছুটি দিলাম।
তবে আমি আছি—তোমাদের পাশে। কখনও যদি মনে হয়, ‘আজ হাসতে পারছি না’, তখন পুরোনো কোনও রিল চালিয়ে নিও। আমি তখনও থাকব।”

রিলের শেষ ফ্রেমে ঠাকুমা ক্যামেরার দিকে হাত নাড়েন—
“ভালো থেকো।
হ্যাশট্যাগ নয়, হৃদয় দিয়েই বলছি—বিদায়।”

ইনস্টাগ্রামে ঝড় বয়ে যায়।
কমেন্টে লেখা—
💔 “Please don’t go, দিদা!”
💬 “You were my therapy!”
🌸 “Your videos made my ma smile again after baba passed away.”
🥲 “The internet just got lonelier.”
🔥 “LEGEND. Nothing less.”

সন্ধ্যায়, বাড়িতে নীরবতা।
অভ্র এসে পাশে বসে বলে,
— “তুমি জানো, তোমার ইনবক্সে এক হাজারেরও বেশি চিঠি এসেছে। কেউ কবিতা লিখেছে, কেউ চিঠি, কেউ নিজের মায়ের ছবি পাঠিয়েছে।”

ঠাকুমা হালকা চোখ মুছে বললেন,
— “আমি জানতাম না, এতোটা ছড়িয়ে পড়েছি। আমি তো শুধু বলতে চেয়েছিলাম—‘এক কাপ চা, আর একটু গল্প’।”
একটু থেমে আবার বললেন,
— “তোর কি মনে হয়, আমি আবার একদিন ফিরে আসতে পারি?”
অভ্র হাসল।
— “তুমি কি চুপ থাকতে পারো?”
— “না।”
— “তাহলে একদিন না একদিন, তুমি আবার ফিরবে। হয়তো নতুন নাম নিয়ে, হয়তো নতুন গল্প নিয়ে।”

 

এক সপ্তাহ পর।
হঠাৎ ইনস্টাগ্রামে একটা নতুন একাউন্ট খোলা হয়—
@GacherNicheGolpo
প্রথম পোস্টে লেখা—
📸 একটা পেঁজা রোদে রোদ পোহানো ঠাকুমার ছবি
📖 ক্যাপশন:
“আমি এখন শুধু গল্প বলি। লাইক, কমেন্ট নয়—তোমার চায়ের কাপের পাশে বসে। হ্যাশট্যাগ নয়, হৃদয়ে থাকি।”
– শৈলজা বসু

 

এভাবেই শেষ হয় “ঠাকুমার টিকটক”।
একজন ঠাকুমা যিনি ভুল করে ইনস্টাগ্রাম খুলেছিলেন, কিন্তু ঠিক করে লক্ষ লক্ষ মনের দরজা খুলে দিয়েছিলেন।

 

শেষমেশ, শিরোনাম একটাই:
“BongoQueen82 didn’t just make reels. She made us feel.”


সমাপ্ত —

WhatsApp-Image-2025-08-05-at-7.36.48-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *