Bangla - প্রেমের গল্প - ভ্রমণ

মেঘের গায়ে হেলান দিয়ে

Spread the love

সায়ন্তনী ঘোষ


পর্ব ১: ট্রেন যখন ছাড়ে, মন তখন কোথাও আটকে থাকে

কলকাতা স্টেশনটা যেমন সব সময় গমগম করে, সেদিনও ঠিক তেমনই ব্যস্ত আর পাঁপড়ের মতো শব্দে ভরা ছিল। তবে আমাদের ভেতরে যেন কোনও শব্দ ছিল না। আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম দু’জন দু’দিকে মুখ করে — কেউ কিছু বলছে না, কেউ কিছু বলার চেষ্টাও করছে না। ট্রেন ছাড়ার দশ মিনিট আগে, আমার হাতের বোর্ডিং পাসটা খানিকটা ভিজে গিয়েছিল, জানি না মেঘের জল ছিল না চোখের জল।

রুদ্র আমার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, পিঠে রুকস্যাক, আর একটা নীল চেক শার্ট গায়ে। এই মানুষটার সঙ্গে আট বছর কেটে গেছে, অথচ আজও মাঝে মাঝে ওকে চিনতে পারি না। যেন প্রতিবার ট্রিপে বেরিয়ে আমি একটা নতুন রুদ্রকে খুঁজে পাই। আর প্রতিবারই মনে হয়, এই যে ট্র্যাভেলগ লিখছি, সেটা কি আসলে আমাদের সম্পর্কের ম্যাপ?

এই ট্রিপটা ঠিক কীভাবে প্ল্যান করা হয়েছিল, মনে পড়ে না। মনে শুধু পড়ে, একদিন হঠাৎ রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, “দার্জিলিং যাবে?”
রুদ্র তখন ল্যাপটপে ঝুঁকে কিছু টাইপ করছিল, মাথা না তুলে বলেছিল, “ঠিক আছে, শীত পড়লে যাই।”

তারপর অনেক দিন কেটে গেছে। বৃষ্টির মতো ঝগড়া, ঠান্ডা রাতের মতো নিরবতা, হালকা মেঘের মতো ছুঁয়ে থাকা কিছু ভালোবাসা — সব মিলিয়ে একরকম জমাট অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল আমাদের সম্পর্ক।
এবার যাওয়ার আগে শুধু এটুকুই ঠিক হয়েছিল — কোনও পরিকল্পনা থাকবে না। যেখানে ইচ্ছে হবে, সেখানে থামব। যেদিকে মন চাইবে, হেঁটে যাব। আর যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ — এই সফরে ফোন নিষিদ্ধ।

ট্রেন যখন বাঁশদ্রোণীর কাছে ঢুকছিল, বাইরে তখন একটা অদ্ভুত নীলচে আলো ছড়িয়ে পড়েছিল। আমি জানলার ধারে বসেছিলাম, রুদ্র বিপরীত দিকে। মুখোমুখি হলেও চোখাচোখি হচ্ছিল না। আমি কানের ফোন খুলে দিয়েছিলাম আগেই। রুদ্র তার পকেট থেকে একটা ছোট নোটবুক বের করে কি যেন লিখছিল।

এই মানুষটা কথা কম বলে, কিন্তু ভেতরে অনেক কিছু জমিয়ে রাখে। জানি না সেগুলো লেখা হয় কি না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় ওর লেখা ডায়েরিগুলো চুরি করে পড়ি। আবার ভয়ও হয় — যদি এমন কিছু পড়ি যা আমি জানতাম না, বা জানলে আরও বেশি ভেঙে পড়তাম?

হঠাৎ রুদ্র বলল, “তোর মনে আছে, আমরা প্রথমবার দার্জিলিং গিয়েছিলাম যখন, তুই গরুবাথান স্টপে নেমে এক বৌদ্ধ ভিক্ষুকে জড়িয়ে ধরেছিলি?”
আমি অবাক হয়ে তাকালাম, “তুই এই কথা মনে রেখেছিস?”
সে হাসল, “আমার মনে তো তুই ছাড়া কিছু নেই।”

এইসব কথাগুলো একেকটা স্নিগ্ধ ঝরনার মতো। শান্ত করে, কিন্তু কাঁপিয়ে তোলে ভেতরটা।
ট্রেন তখন নিউ জলপাইগুড়ির কাছাকাছি। খড়খড় শব্দে জানলার বাইরে ছুটে চলেছে মাঠ, গাছ, আর দূরের পাহাড়। আমাদের মধ্যে থাকা চুপচাপ শব্দহীনতার ভেতরেও যেন একটা নতুন সুর খেলা করছে।

আমি একটু হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। একটা পুরোনো দিনের গন্ধ ভেসে এল — প্রথমবার রুদ্রর সঙ্গে ট্রেনে চড়ার সেই উত্তেজনা, সেই বালিশে মাথা রেখে পাহাড় দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়া দিনগুলো। সময় হয়তো বদলে যায়, কিন্তু কিছু অনুভব সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে।

সকালে যখন আমরা NJP তে নেমে পড়লাম, চারপাশে তখন হালকা ঠান্ডা। রুদ্র পকেট থেকে বের করে একটা টফি আমার হাতে দিল। বলল, “এখন থেকেই শুরু করিস ট্র্যাভেলগটা লিখে দেওয়া। আজ রাতে তো লাভায় থাকব।”
আমি হাসলাম। আমাদের মাঝে আবার কোনও সেতু গড়ে উঠছিল বোধহয় — চেনা পুরোনো ইট দিয়ে তৈরি, কিন্তু নতুন করে।

হোটেলটা ছিল একটা পাহাড়ঘেঁষা গেস্টহাউস। খুব জাঁকজমক ছিল না, কিন্তু জানালার বাইরে যেন এক চিলতে মেঘ দাঁড়িয়ে ছিল আমাদের জন্য।
চায়ের কাপ হাতে, আমরা জানালায় বসে রইলাম কিছুক্ষণ। কেউ কিছু বলছে না, শুধু চুপচাপ সেই মেঘের দিকে তাকিয়ে আছি। এক সময় রুদ্র বলল, “মেঘ কি কখনও ফিরে আসে?”
আমি বললাম, “মেঘ তো ফিরে আসেই। আবার চলে যায়। আবার আসে। ঠিক যেমন আমরা।”

তখনই বুঝেছিলাম, এই ভ্রমণটা শুধু পাহাড় দেখা নয়। এটা ফিরে আসার গল্প। খুঁজে পাওয়ার গল্প। আর হয়তো একটা নরম, ভেজা অনুভবের গল্প — যেখানে কেউ মেঘের গায়ে হেলান দিয়ে বলে, “তুই ছিলি, তো আমি ছিলাম।”

পর্ব ২: কফির কাপ, কবিতার পাতা

লাভার রাস্তা ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছিল পাহাড়ের বুক ধরে। আমাদের গাড়ি যেন থেমে থেমে হাঁটছিল। পাশে পাহাড়, নীচে গা-ছমছমে ঘন সবুজ। গাছের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছিল রোদ, আবার হঠাৎই মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছিল দিগন্ত।

কিন্তু আমাদের মধ্যে সেই নিস্তব্ধ আলোছায়া অনেক আগে থেকেই ছিল। এই সফরের সবচেয়ে বড় চুক্তিটা ছিল — না বলা কথাগুলোর পাশে বসে থাকা।” অনেক সময় সম্পর্ক বাঁচে না কথায়, বাঁচে একসাথে চুপ করে থাকার ভেতরে।

গাড়ি থামল লাভার পুরোনো বাজারের কাছে। রাস্তার পাশে ছোট্ট কাঠের দোকান, সামনে টং-এর মতো বসে এক বৃদ্ধা শালপাতায় মোমো পরিবেশন করছিলেন। রুদ্রের চোখ এক মুহূর্তে আটকে গেল সামনের এক দোতলা কাফের দিকে।

— “ওইখানে চল না,” সে বলল।
আমি তাকালাম। কাফেটার নাম ছিল Café Monsoon Verse — কাঠের ওপর কালো রঙে আঁকা, নিচে লেখা: Where poems taste like coffee.

এক অদ্ভুত টান অনুভব করলাম। আমরা দুজনই একসঙ্গে দরজাটা ঠেলে ঢুকে গেলাম ভিতরে।

কাফেটা যেন একটা নিঃশব্দ সময়ের আলমারি। পুরোনো কাঠের মেঝে, দেয়ালে টাইপরাইটারে লেখা কবিতার পাতা টাঙানো, আর একটা কাঠের তাকে রাখা পুরোনো বইয়ের গন্ধ। এক কোনে বসে ছিল এক বৌদ্ধ ভিক্ষু, চোখ বন্ধ করে গুনগুন করছিলেন — হয়তো কোনও মন্ত্র, অথবা নিজের ভেতরের গল্প।

আমরা জানালার ধারে একটা ছোট্ট টেবিলে বসলাম। বাইরে মেঘ যেন কাচে ঠোকরাচ্ছে। আমার মুখে তখনও কথা নেই, কিন্তু চোখের মধ্যে একটা ছায়া ভেসে উঠছিল — এই জায়গাটায় আমরা একবার এসেছিলাম, বহুদিন আগে, যখন সব কিছু এক রকম উজ্জ্বল ছিল, ঝকঝকে, খুশিতে ডোবা।

রুদ্র বলল, “তোর মনে আছে, সেই সন্ধ্যায় এই টেবিলেই তুই আমাকে একটা কবিতা শুনিয়েছিলি? বলেছিলি, একদিন যদি আমি হারিয়ে যাই, ওই কবিতাটা পড়ে আমায় খুঁজে পাওয়া যাবে।”
আমি মাথা নিচু করলাম। মনে পড়ে না কবিতার লাইনগুলো, কিন্তু মনে আছে রুদ্রর মুখে সেই বিস্ময়, সেই মৃদু কমলা আলোয় তার চোখের জল।

ওয়েটার এসে দুটো কফির অর্ডার নিয়ে গেল — একটা ডার্ক ব্ল্যাক, একটা মিল্ক কফি, আমার পছন্দমতো হালকা দারচিনির গন্ধে।

রুদ্র ব্যাগ থেকে একটা ছোট নোটবুক বের করল। নীল কাভার, একটা রুক্ষ রাবারের ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা। ও বলল, “এই নোটবুকে তোকে নিয়ে লেখা কিছু জিনিস আছে, পড়বি?”
আমি চুপ করে রইলাম। তার মানে, এতদিন ও লিখে গেছে — সেইসব না বলা শব্দগুলো, যা আমি কখনও শুনতে পাইনি।

আমি হাত বাড়িয়ে নিলাম খাতাটা। খুলতেই প্রথম পাতায় লেখা:

তোর চুলে মেঘের গন্ধ থাকে,
আর আমি বুঝতে পারি —
পাহাড় নেমে এসেছে আমার জানালার পাশে।”

সেই মুহূর্তে আমার চোখের সামনে যেন সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেল। জানালা ভিজে উঠল বাইরের বৃষ্টিতে, আমার চোখ ভিজে উঠল ভেতরের।

কফি এসে গেল। আমি কাঁপা হাতে কাপ তুললাম। চারপাশে যেন সব কিছু স্তব্ধ, শুধু কাপ থেকে ওঠা ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে আমার আর রুদ্রর দূরত্বটুকু ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে।

আমি বললাম, “তুই কেন বলিস না যে আমায় ভালোবাসিস?”
রুদ্র হাসল, সেই পুরোনো শান্ত, নরম হাসি।
— “কারণ আমি জানি, তুই তো সব জেনেই থাকিস।”

এই কথাটা যেন এক অজানা আশ্বাসের মতো বুকের মধ্যে ঢুকে গেল। কোনও মোবাইল ছিল না আমাদের হাতে, তোলা হয়নি একটাও ছবি। কিন্তু এই মুহূর্তটা — কফির কাপ, কবিতার পাতা, আর আমাদের দুজনের মেঘমাখা চোখ — এটাই ছিল ভ্রমণের সবচেয়ে সত্য স্মৃতি।

হোটেলে ফেরার পথে আমি বললাম, “আজ রাতে একটু হাঁটবি আমার সঙ্গে?”
রুদ্র বলল, “আজ না হাঁটলেই তো আর এই সফর লেখা যাবে না।”

আর আমি জানতাম, আজ রাতটা মেঘেদের নয়, আজ রাতটা আমাদের।

পর্ব ৩: হারিয়ে যাওয়ার ভিতরেই তো ফিরে আসা আছে

রাত তখন নামতে শুরু করেছে লাভার পাহাড়ি বুক বেয়ে। গেস্টহাউসের জানালায় মেঘ এসে কড়া নাড়ছে ধীরে ধীরে — যেন কারও পুরোনো অভিমান ফেরার অনুমতি চাইছে।
রুদ্র চুপচাপ পেছনের পাথুরে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। দূরে পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট আলো জ্বলছে – মনে হচ্ছিল যেন আকাশের তারা মাটিতে নেমে এসেছে।
আমি বললাম, “চল, বেরিয়ে পড়ি। আজ রাতে একটু ট্রেক করি, অচেনা রাস্তায়। কোনো গন্তব্য ছাড়াই।”

রুদ্র আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল।
— “তুই তো জানিস, আমি দিক হারাতে ভয় পাই।”
আমি বললাম, “আর আমি জানি, দিক হারালেই কখনো কখনো নিজেকে পাওয়া যায়।”

তখন আমাদের দু’জনের পায়ে পরা ছিল শুধু হালকা কেডস, হাতে একটা ছোট টর্চ আর হৃদয়ের ভেতরে জমে থাকা হাজারটা কথা।
রাস্তাটা শুরুতেই বেশ খানিকটা নামছিল, কুয়াশার চাদরে ঢাকা ছিল দুই পাশে ঘন পাইনের গাছ। একেকটা গাছ যেন রাতের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা স্মৃতির মতো — চুপচাপ, ছায়াময়, কিন্তু সজাগ।

আমরা হাঁটছিলাম ধীরে ধীরে, কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছিল না, শুধু শব্দ শুনছিলাম — শুকনো পাতা চেপে যাওয়ার আওয়াজ, দূরে কোনও পাখির ডানা ঝাপটার মতো শব্দ, আর মাঝেমধ্যে নিজের নিঃশ্বাস।

আচমকা রুদ্র বলল, “তুই কি কখনও কাউকে ছেড়ে যেতে ভয় পেয়েছিস?”
আমি থমকে গেলাম।
বললাম, “ভয় তো পাই। কিন্তু তুই যদি খেয়াল করিস, ছেড়ে যাওয়া আর দূরে থাকা এক জিনিস নয়। অনেক সময় একই ছাদের নিচে থেকেও মানুষ দূরে থাকে।”

রুদ্র উত্তর দিল না। শুধু পাশে এসে দাঁড়াল। আমাদের কাঁধ ছুঁয়ে গেল অদ্ভুতভাবে — খুব নরম, অজান্তে।

একটা মোড় ঘুরতেই সামনে একটা ছোট ব্রিজ দেখা গেল — বাঁশ দিয়ে তৈরি, নিচে পাহাড়ি ঝরনা বয়ে চলেছে ক্ষীণ শব্দে। সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলাম।

আমি ঝরনার শব্দ শুনতে শুনতে বললাম, “তুই যখন লেখ, তখন কি আমার কথা ভাবিস?”
রুদ্র একটুও না ভেবে বলল, “তুই তো আমার প্রতিটা শব্দে আছিস। এমনকি যেগুলো আমি লেখার সাহস পাই না, সেগুলোতেও।”

বুকের মধ্যে একটা কষ্ট নেমে এল, কিন্তু তা যেন তৃপ্তির মতো কষ্ট — যেমন কারও জন্য অনেকদিন পর চোখ ভিজে আসে, আর তাতে একটুকরো সত্যি মিশে থাকে।

রুদ্র পকেট থেকে আবার সেই নীল নোটবুকটা বার করল। তার প্রথম পাতাগুলোয় যা পড়েছিলাম, তার পরে আরও অনেক কথা লেখা ছিল।

সেই ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে আমি শুনলাম ওর মুখ থেকে কিছু লাইন —
হৃদয়ের দিকচিহ্ন যে শুধু মানচিত্রে থাকে না,
তুই যখন চোখ নামাস, আমি তখন দিগভ্রান্ত হয়ে পড়ি।”

কবিতা আর ভালোবাসার মাঝে কোনও সীমারেখা থাকে না। সেই রাতে আমরা আর পাহাড়ি পথে এগোলাম না। শুধু সেই ব্রিজেই বসে রইলাম অনেকক্ষণ।

রাত্রি তখন গভীর। পাহাড় নিস্তব্ধ, কুয়াশা ঘন হয়ে আসছে। কিন্তু আমাদের মাঝে একটা নিরব সেতু তৈরি হচ্ছিল — ঠিক যেমন এই বাঁশের ব্রিজ, সময় আর অনুভবের মাঝে ঝুলে থাকা।

হোটেলে ফেরার পথে রুদ্র হঠাৎ করে আমার হাত ধরল।
না, কোনও নাটকীয়তা নয়। সে ঠিক সেইভাবে ধরল, যেমন কেউ নিজের পুরোনো জিনিসটা আবার ছুঁয়ে দেখে — জানে, এটিই সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে নিরাপদ।

সেই রাতে, জানালার পাশে শুয়ে, আমি বুঝলাম — হারিয়ে যাওয়ার ভিতরেই তো ফিরে আসা থাকে।
আর সেই ফিরে আসাটাই হয়তো সবচেয়ে গভীর প্রেমের জায়গা।

পর্ব ৪: একসঙ্গে, না শুধু একসাথে?

কালিম্পংয়ের রাস্তাগুলো যেন দিগভ্রান্ত আত্মার মতো — উঠে যাচ্ছে, আবার নামছে, বাঁক ঘুরছে, আবার হঠাৎ উধাও। শহরটা নিজের ভিতরে এক অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা বহন করে — সবুজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক গভীর বিষণ্নতা, যেটা আমি প্রথমবারেই বুঝেছিলাম। আর সেই বিষণ্নতার মধ্যেই একবার প্রেম খুঁজে পেয়েছিলাম — সেই রুদ্র, সেই আমি।

এই শহরেই একসময় আমরা প্রথম একসঙ্গে বেড়াতে এসেছিলাম — কুয়াশার ভিতর দিয়ে হাত ধরে হাঁটা, মোবাইল বন্ধ রেখে নীরবে হেসে ফেলা, আর এক ছোট্ট কফিশপে বসে লেখালেখি করা।

এইবারও আমরা সেখানে ফিরে এলাম, কিন্তু এই ফেরা যেন পুরোনো ছবিতে নতুন রং লাগানোর মতো — একটু ধুলো, একটু খসে পড়া রং, একটু চেনা অচেনা।

আমরা উঠেছিলাম হিমালয়ের একধারে ছোট্ট একটা হোমস্টেতে — কাঠের ছাদের নিচে, ছিমছাম একটা ঘর, জানালার পাশে কাঠের টেবিল, আর দূরে দেখা যায় ধোঁয়ায় ঢাকা তিস্তা।

রুদ্র চুপচাপ ব্যাগ থেকে একটা শাল বার করল।
আমি বললাম, “তুই এখনো এই শালটা রাখিস?”
সে হাসল, “তুই দিয়েছিলি, ভুলে গেছিস?”
আমি বললাম, “আমরা কি একসঙ্গে ছিলাম তখন?”
সে বলল, “একসঙ্গে ছিলাম না ঠিকই, কিন্তু তোর গন্ধ তখনও আমার গায়ে লেগে ছিল।”

সেদিন দুপুরে আমরা বের হলাম হাঁটতে। কালিম্পং-এর সেই পুরোনো গির্জার পথে, যেখানে মেঘগুলো ঠিক গায়ে এসে জড়িয়ে ধরে। হাঁটতে হাঁটতে রুদ্র বলল, “আজ এক বন্ধু দেখা করতে চাইছে, কলেজে পড়তাম একসাথে। একসময় খুব কাছের ছিল।”

আমি মাথা নাড়লাম, “চল, দেখা করি।”

সেই বন্ধুর নাম ছিল অন্বেষা। সাদামাটা পোশাকে, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, আর ঠোঁটজোড়ায় এমন একটা স্থিরতা, যেন বহুদিনের না-বলা কথা জমে আছে ওখানে।

আমরা তিনজনে বসলাম হিমালয় ভিউ ক্যাফেতে। চায়ের কাপের ধোঁয়ার ভেতরে প্রথমদিকে খানিকটা অস্বস্তি, খানিকটা কৌতূহল।

অন্বেষা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি লেখো?”
আমি হাসলাম, “না ঠিক লেখক নই। মাঝে মাঝে ভ্রমণের স্মৃতি রাখি।”
সে বলল, “তোমাদের দেখলে একটা প্রশ্ন মাথায় আসে — তোমরা কি একসঙ্গে, না শুধু একসাথে?”

ঘরটা হঠাৎ থেমে গেল। চায়ের কাপের ধোঁয়াও যেন হালকা কেঁপে উঠল। রুদ্র কিছু বলল না, আমি তাকিয়ে রইলাম জানালার বাইরের দিকটা ধরে।

অন্বেষা খুব ধীরে বলল, “অনেক সময় মানুষ একসাথে থাকে অভ্যেসে, আর অনেক সময় আলাদা থেকেও একসঙ্গে থাকে অনুভবে। তোমরা কোনটা?”

আমি কিছু বললাম না। শুধু একটা হাসি চাপা দিলাম ঠোঁটে। সেই হাসিতে ছিল একটা ক্লান্তি, আর একটা সত্যি।

রুদ্র বলল, “এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আমরা পাহাড়ে এসেছি।”
অন্বেষা একটু মুচকি হেসে চা খেতে লাগল। তারপর বলল, “কাউকে পাশে পাওয়া আর কাউকে কাছে পাওয়া এক নয়। যে পাশে থাকে, সে ছায়া হয়। আর যে কাছে থাকে, সে আত্মা হয়।”

বাইরে মেঘ আস্তে আস্তে শহরটাকে ঢেকে দিচ্ছিল। আর আমাদের তিনজনের মধ্যে যেন তৈরি হচ্ছিল এক অদৃশ্য নীরবতা। সম্পর্কের এই মুহূর্তগুলোতে কোনও সিদ্ধান্ত হয় না, শুধু উপলব্ধি জন্ম নেয়।

ফেরার পথে আমি বললাম, “রুদ্র, আমরা কি একসঙ্গে আছি?”
সে বলল, “আমি জানি না, কিন্তু আমি আজও তোর পাশে হাঁটতে চাই।”

সেই মুহূর্তে বুঝেছিলাম — অনেক সময় উত্তরের চেয়ে হাতের চাপ, চোখের নিরবতা, আর হাঁটার ছন্দ অনেক বেশি সৎ।

রাতে আমি ডায়েরি খুলে লিখেছিলাম:
আজ যদি তুই পাশে থাকিস, তবে একদিন বুঝে নেব — একসাথে থাকার মানে ঠিক কী। হয়তো একদিন লিখতে পারব, হেঁটেছিলাম, হারিয়েছিলাম, খুঁজে পেয়েছিলাম।”

পর্ব ৫: মনাস্টেরির নীল দরজার ওপারে

কালিম্পং-এর পাহাড়ি দুপুরটা হঠাৎ কেমন যেন পালটে গেল। দুপুরে যখন ছোট্ট দোকান থেকে পাইন মধু আর লেমন ক্যান্ডি কিনছিলাম, তখনও আকাশ ছিল একদম স্বচ্ছ। কেউ বলতেই পারত না যে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আকাশ ফেটে পড়বে।
আমরা তখন পাহাড়ি রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম – রুদ্র কিছুই বলছিল না, আমি ডায়েরির জন্য নতুন কিছু মুহূর্ত ধরছিলাম চোখে।

হঠাৎ আকাশের পেট থেকে নামে হুড়মুড় করে মেঘ আর বৃষ্টি। পাহাড়ি ঝড়ের শব্দটা যে এত গভীর, এত ভেতর কাঁপিয়ে দেয়, আগে জানতাম না। পাইন গাছগুলো থরথর করে কাঁপছিল, রাস্তায় একপাশ দিয়ে নেমে আসছিল গড়িয়ে পড়া কাদামাটি।

রুদ্র বলল, “চল, ওদিকে একটা মনাস্টেরি দেখলাম। খুলে থাকলে ঢুকি। রাস্তা এখন একেবারে বন্ধ।”

মনাস্টেরিটা ছিল একটু পুরোনো — চারপাশে সাদা দেয়াল, লাল ফ্রেমে ঘেরা জানালা, আর একটা নীল দরজা, যা বৃষ্টিতে ধীরে ধীরে ভিজে উঠছিল। আমরা কড়া নাড়তেই এক বৃদ্ধ ভিক্ষু দরজা খুলে দিলেন, মুখে শান্ত এক দৃষ্টির রেখা।

তিনি মাথা নেড়ে ভেতরে আসতে বললেন। ভিতরটা ছিল গরম, কাঠের গন্ধে ভরা। মেঝেতে মোটা কার্পেট, এক কোণে কিছু ধূপধুনো, আর দেওয়ালে প্রার্থনার মন্ত্র।
আমরা ভিজে কাপড় খুলে গায়ে একটা কম্বল জড়ালাম। রুদ্র জানালার পাশে বসে পড়ল। আমি একটু দূরে। ঝড় এখনও থামেনি, কিন্তু ঘরের ভিতরটায় যেন এক আশ্রয় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।

অনেকক্ষণ কেউ কিছু বলল না। বাইরে কেবল ঝড়, ভিতরে কেবল নিঃশব্দতা।
রুদ্র হঠাৎ বলল, “জানিস, আমি এই ঝড়টা চেয়েছিলাম।”
আমি চমকে তাকালাম, “মানে?”
— “চেয়েছিলাম একটা কিছু হোক, যাতে আমরা আটকে পড়ি। একসাথে। বাইরের সব বাধা থাকুক, কিন্তু তুই আমার থেকে দূরে যেতে পারবি না এমন একটা মুহূর্ত হোক।”

কথাগুলো ভেতরে কেঁপে উঠল। আমি তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে — একটা অচেনা সাহস, একটা অদ্ভুত কোমলতা।
আমি বললাম, “তুই তো কখনও এমন করে বলতে পারিস না। কী হলো আজ?”
সে বলল, “এই পাহাড়ে না আসলে হয়তো বলতে পারতাম না। হয়তো তুই থাকতিস না পাশে। তুই আছিস বলেই আজ বললাম।”

আমি আস্তে আস্তে পাশে গিয়ে বসলাম। বাইরে মেঘ, ভিতরে অনুভব। আর আমাদের দুজনের মাঝে কোনও শব্দ নেই, কেবল নিঃশ্বাস।

বৃদ্ধ ভিক্ষু এসে আমাদের জন্য গরম থুকপা আর লাল চা রেখে গেলেন। হাসলেন, “পাহাড় যখন ডাক দেয়, তখন কিছু না কিছু বদলায়। ভিতরেও, বাহিরেও।”
আমি তখন ভেতরে অনুভব করছিলাম — ঠিক সেটাই তো হচ্ছে আমাদের সঙ্গে।

রুদ্র আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই কি আমাকে আবার ভালোবাসিস?”
আমি চোখ নামিয়ে বললাম, “তুই যদি জিজ্ঞেস করিস, তবে বুঝতে পারবি — আমি তো কখনো ভালোবাসা থামাইনি, শুধু ভুলে গেছিলাম কেমন করে বলতে হয়।”

সে তখন আমার হাত ধরল — ধীরে, স্থিরভাবে, একটুও নাটক না করে। বাইরে তখনও ঝড়, কিন্তু জানালার কাঁচে যেন একটা শান্ত আলোর রেখা পড়ে যাচ্ছিল।

মনাস্টেরির সেই নীল দরজা, যেটা ভিজেছিল বৃষ্টিতে, এখন যেন আমাদের সম্পর্কের একটা দরজাও খুলে দিচ্ছিল — ভিজে যাওয়া সময়ের দিকে, আরেকবার ফিরে যাওয়ার সুযোগ।

রাতটা আমরা সেখানেই কাটালাম। কাঁথা মুড়ি দিয়ে, পাশাপাশি শুয়ে, কেউ কিছু বললাম না। কিন্তু ভেতরে মনে হচ্ছিল — এই রাত, এই পাহাড়, এই নীল দরজা — আমরা আবার শুরু করছি। শব্দহীন, ধীর, অথচ গভীর একভাবে।

পর্ব ৬: “তুই থাকিস, শুধু এমনটাই করে থাকিস”

পাহাড়ি ঝড়ের পরদিন সকালটা ছিল অবাক করা রকম শান্ত।
মনাস্টেরির বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেঘে ভেজা কাঠের রেলিংয়ে হাত রেখে আমরা চুপ করে তাকিয়ে ছিলাম দূরের দিকে — পাইন গাছের মাথায় জমে থাকা শিশির, পাহাড়ের গায়ে ছড়িয়ে পড়া কুয়াশা, আর নিচে একটা সরু নদীর রেখা।
জানালার ধারে একটা প্রার্থনার ঘণ্টা টুং টাং করে বেজে চলছিল — ধীরে, গভীরে।

বৃদ্ধ ভিক্ষুটি এসে বললেন, “আজ এখানে ‘লোসার’ উৎসব শুরু হচ্ছে — নতুন বছরের প্রথম দিন। চাইলে থাকতে পারো কিছুক্ষণ।”
রুদ্র ওর দিকে তাকিয়ে হাসল। আমিও মাথা নাড়লাম।
শহরের মধ্যে তো এমন নির্জন, অথচ স্পন্দিত কিছু পাওয়া যায় না।

আমরা যখন মূল মন্দিরের উঠোনে পৌঁছালাম, তখন ছোট ছোট শিশু ভিক্ষুদের লাল জামা, ঢোলের শব্দ আর রঙিন প্রার্থনা পতাকার মেলবন্ধনে চারদিক রঙিন হয়ে উঠছিল।
পাহাড়ি উৎসব মানেই একটা আশ্চর্য আন্তরিকতা — এখানে কেউ আপনার নাম জিজ্ঞেস করে না, কেউ আপনাকে যাচাই করে না।
শুধু আপনাকে মিশে যেতে দেয় — যেন আপনি একদিনের জন্য হলেও এই পাহাড়েরই কেউ।

রুদ্র আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই তো উৎসব খুব ভালোবাসিস।”
আমি মুচকি হাসলাম, “উৎসব মানেই তো একসাথে থাকা। কিছু ভুলে যাওয়া। আবার কিছু নতুন করে শুরু করা।”
ও একটু থেমে বলল, “তাহলে আমরা এখন কি করব?”
আমি ধীরে বললাম, “আমরা শুধু থাকব। কোনও প্রশ্ন না করে। একে অপরের পাশে থাকব। যদি তুই তা পারিস।”

উঠোনের একপাশে তখন ধূপজ্বলা শুরু হয়েছে। বৌদ্ধ প্রার্থনার মন্ত্র ধীরে ধীরে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে, মেঘের ভিতরে ছড়িয়ে পড়ছে ঘন ধোঁয়া।

আমি হঠাৎ ওর হাত ধরলাম — জনসমক্ষে আমরা কখনও হাত ধরি না। কিন্তু আজ আমার ইচ্ছা করল — সমস্ত না বলা কথার বদলে এই চুপ করে হাত ধরা হোক।

রুদ্র আমার দিকে তাকাল, তার চোখে তখন ছিল একটা কৃতজ্ঞতা, আর একরকম নিশ্চয়তা।
বলল, “তুই জানিস, এই হাতটা যদি আমি হারিয়ে ফেলতাম, আমি আর নতুন করে কাউকে খুঁজতাম না।”
আমি বললাম, “তুই হারিয়ে যাস, কিন্তু হাতটা যেন আমার মুঠোয় ফেলে যাস। তবেই আবার খুঁজে পাব।”

এক ভিক্ষু তখন আমাদের সামনে এসে এক টুকরো রঙিন কাপড় দিল। বলল, “এটা আশীর্বাদের প্রতীক। ভেতরে যা থাকুক না কেন, বাইরে যেন ভালোবাসা থাকে।”

আমরা দু’জনেই কাপড়টা হাতে নিয়ে একে অপরের চোখে তাকালাম।
কিছু কিছু মুহূর্ত শব্দ চায় না। শুধু চোখ চায়। শুধু ওই একফোঁটা অমোঘ চাহনি।

আমরা তখন ঠিক করলাম — এবার শহরে ফিরবো।
সমস্ত উঁচু-নিচু পথ, কুয়াশা, ঝড়, উৎসব — সবকিছু নিয়ে ফিরে যাব।
কিন্তু এই সফরটা কোনও ট্র্যাভেলগ নয় আর — এটা একটা সম্পর্কের সিগনেচার হয়ে থাকবে।

হোটেলে ফেরার পথে আমি বললাম, “তুই থাকিস। শুধু এমনটাই করে থাকিস — চুপ করে, পাশে, নিঃশব্দে। কারণ আমার সবটুকু তোকে দরকার নেই, শুধু তুই আছিস এইটুকু জানলেই আমার হয়ে যায়।”
রুদ্র তখন আমার হাতটা নিজের দুই হাতে ধরে বলল, “আমি তো কখনো যাবো না। শুধু হয়তো বলি না সবসময়।”

আর আমি বুঝলাম, এটাই আসল আশীর্বাদ — সব বলার দরকার নেই, কেবল থেকে যাওয়াটাই সব কিছু বলে দেয়।

পর্ব ৭: “তুই যদি চুপ করিস, আমি লিখব তোর হয়ে”

ট্রেনটা যখন শিয়ালদহ স্টেশনে ঢুকল, তখন ঘড়িতে সকাল ছটা।
তবুও প্ল্যাটফর্ম ছিল ভিড়ে ভরা — কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ছুটতে থাকা মানুষ, হাতে চা নিয়ে হাঁটতে থাকা বিক্রেতা, কাঁচের মতো স্লিপার কেটে রাখা আলোয় ব্যস্ত শহরের প্রথম নিঃশ্বাস।

আমরা দুজন যেন অনেক দূর থেকে ফিরলাম — শহরের মধ্যে ঠিক ছিলাম, কিন্তু মনের ভিতরে এখনো একটা পাহাড় টিকে আছে।
নেমে আসা আলোয় রুদ্রর চোখে ক্লান্তি ছিল, কিন্তু সেই ক্লান্তি ছিল একরকম শান্তির মতো।

ট্যাক্সিতে চড়তেই চারপাশের শব্দগুলো ফিরে এলো — বাসের হর্ণ, রিকশার ঘণ্টা, মোবাইলে কথা বলার বিরামহীন গলা।
আমি জানলার পাশে বসে রইলাম। এক মুহূর্তে মনে হলো, আমরা কি সত্যিই ফিরলাম? নাকি একটা ছায়া মাত্র ফিরেছে?

ফ্ল্যাটে ঢোকার পর স্যুটকেস খুলতেই পাহাড়ি গন্ধ ভেসে উঠল।
লাভার সেই কাঠের ঘরের সুগন্ধ, কালিম্পংয়ের লোসার উৎসবের ধূপ, মনাস্টেরির ভেজা দরজা — সব কিছু যেন স্যুটকেসের ভাঁজে জমে ছিল।

রুদ্র কিচেনে ঢুকে চা বানাতে গেল। আমি জানালার ধারে বসে ডায়েরি খুললাম। লিখতে গিয়ে বুঝলাম, কী যেন আটকে আছে ভেতরে — পাহাড়ে তো কেমন সহজে শব্দ এসেছিল, আর এখানে যেন শব্দগুলো শহরের কোলাহলে হারিয়ে যাচ্ছে।

চা নিয়ে এসে রুদ্র বলল, “লিখতে পারছিস না?”
আমি মাথা নাড়লাম। বললাম, “সব মনে আছে, কিন্তু ভাষা পাচ্ছি না।”
ও আমার পাশে বসে বলল, “তুই যদি চুপ করিস, আমি লিখব তোর হয়ে।”

আমি অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে।
— “তুই?”
— “হ্যাঁ। আমি তো পাহাড়ে তোর লেখা দেখেছি। এবার তুই দেখ, আমার লেখা।”

সে নিজের নোটবুকটা খুলে কিছু পাতা টানাটানি করল। তারপর এক পাতা এগিয়ে দিল আমার দিকে।

লেখা ছিল:

তুই ফিরে এসে আবার প্রশ্ন করিস — কেমন ছিল পাহাড়?
আমি উত্তর দিই না। কারণ আমি জানি, তুই নিজেই তো পাহাড় হয়ে উঠেছিস আমার ভিতরে।
তোর চুপ থাকা, তোর হাঁটার শব্দ, তোর মুখ ঘোরানো অভিমান —
এই শহরের প্রত্যেকটা ভোরে আমি সেই পাহাড় দেখি।
তুই না বললেও, আমি তো লিখি তোর হয়ে।”

পড়তে পড়তে আমার চোখে জল এসে গেল। রুদ্র হালকা হেসে বলল, “ভয় পাস না। এটা আমি নিজের জন্য লিখেছি। কিন্তু আজ তোর হাতে দিলাম।”
আমি ওর হাত ধরে বললাম, “তুই থাকিস, আমি না পারলেও তুই লিখে নিস আমার হয়ে।”

বাইরে তখন শহরের সূর্য উঠছে — হলুদ আলো জানালার কাচে গায়ে এসে পড়ছে।
আমাদের ঘরটা অল্প আলোকিত। কিন্তু সেই আলোয় কিছু জিনিস স্পষ্ট হয়ে উঠছে — কিছু অনুভব, কিছু প্রতিজ্ঞা।

এই শহরে আমরা অনেকবার ফিরেছি।
কিন্তু এইবার মনে হচ্ছে, আমরা একসঙ্গে ফিরেছি।

আগে ছিলাম শুধু একসাথে — অভ্যেসে, দিনপঞ্জিতে, প্রয়োজনের তালিকায়।
এবার আমরা হয়তো সত্যিই একসঙ্গে — চুপ করে, হাতে হাত রেখে, আর একজন আরেকজনের ভাষা হয়ে ওঠার প্রচেষ্টায়।

পর্ব ৮: “এইবার তুই শুধু যাত্রী না — তুই আমার গল্পের পথচলা”

কাল সকাল থেকে আকাশটা অদ্ভুত মেঘে ঢাকা ছিল — যেন পাহাড় তার ছায়া নামিয়ে এনেছে শহরের ওপর।
আমার ব্যালকনিতে তখন কফির কাপ আর হাতে ধরা সেই পুরোনো ডায়েরি — যেখানে এখনও শেষ পৃষ্ঠাটা ফাঁকা পড়ে আছে।
বহুদিন হল পাহাড় থেকে ফিরেছি, আবার অফিস, ট্র্যাফিক, মেট্রো — সেই পুরোনো চেনা তাল।

তবুও কোথাও যেন কিছু বদলেছে।
শব্দগুলো যেন ভেতর থেকে আসছে — আর চুপ করে বসে থাকা মুহূর্তগুলোর ভেতরেও যেন একটা কথা হয়ে উঠছে, “তুই আছিস তো?”

ঠিক তখনই রুদ্র আমার সামনে এসে দাঁড়াল। পরনে সাদা শার্ট, হাতে একটা ছোট খাম।
— “এইটা তোর জন্য,” সে বলল।

খাম খুলে দেখি, একটা ট্রেন টিকিট।
গন্তব্য: অনির্দিষ্ট। নাম: সায়ন্তী ঘোষ।
তার পাশে পেন্সিলে লেখা:
এইবার তুই শুধু যাত্রী না — তুই আমার গল্পের পথচলা।”

আমি থমকে গেলাম।
রুদ্র তখন আমার চোখে তাকিয়ে বলল,
— “তুই তো এতদিন লিখেছিস। এবার আমি একটা গল্প শুরু করতে চাই — যেখানে আমরা দু’জনেই লিখব, দু’জনেই হারাব, আর আবার দু’জনেই খুঁজে পাব।”
আমি হাসলাম। একটা নিঃশব্দ, তৃপ্ত, ক্লান্ত কিন্তু সম্পূর্ণ হাসি।
— “তাহলে তো আবার একটা পাহাড় ডাকছে,” বললাম আমি।

রুদ্র বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু এবার পাহাড় গন্তব্য না। পাহাড় তো তুই। আমি শুধু তোর পাশের পথটা হাঁটতে চাই।”

সেদিন বিকেলে, আমরা হাওড়া স্টেশনে গিয়েছিলাম — কোনো প্ল্যান ছাড়া, কোনো হোটেল বুকিং ছাড়া।
রুদ্র বলেছিল, “এইবার ঠিক করিস না তুই — শুধু দেখিস, আমি তোর প্রতিটা চুপ করে থাকা মুহূর্তে সাথ দেব।”

ট্রেন ছাড়ল সন্ধে সাতটায়। জানালার বাইরে তখন আলো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।
আমরা দুজন পাশাপাশি, হাতের মধ্যে হাত।
আমি জানি না কোথায় যাচ্ছি। কিন্তু জানি, এবার আমি একা নই।
আমার পাশে একজন আছে, যে বলেছে, “তুই যদি চুপ করিস, আমি লিখব তোর হয়ে।”

ডায়েরির শেষ পাতায় তখন আমি লিখে ফেলি:

প্রেম সবসময় চিৎকার করে আসে না।
সে আসে মেঘের মতো, চুপ করে বসে থাকে জানালার পাশে,
আর একদিন হঠাৎ বলে ওঠে —
তুই থাকিস, শুধু এমনটাই করে থাকিস।”

আর আমি বুঝে যাই —
আমার গল্পটা শেষ হচ্ছে না।
শুধু একটা পাতার শেষে লেখা থাকছে…
চলছে…”

সমাপ্ত
(
কিন্তু কোথাও যেন শুরু হচ্ছে নতুন করে)

 

WhatsApp-Image-2025-08-05-at-5.24.47-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *