Bangla - রহস্য গল্প

বিটকয়েন বিলিওনিয়ার: এক নিঃশব্দ যুদ্ধ

Spread the love

রুদ্রনীল মুখার্জি


পর্ব ১: ফ্ল্যাশ অফ কোড

কলকাতা, রাত একটা। জানালার কাঁচে বাইরের আলোটা অনেকক্ষণ ধরেই ঝাপসা। স্কাইলাইনের ভেতর টিমটিম করে জ্বলছে কোনো অচেনা সিগন্যাল লাইট। অর্ঘ্যর চোখ তখনও ল্যাপটপ স্ক্রিনে আটকে। ছ’ঘণ্টা হলো সে এই একটাই জিনিসের দিকে তাকিয়ে আছে—একটা ব্লকচেইন এক্সপোর্ট ফাইলের শেষ লাইনে এলোমেলোভাবে আসা এক “.dat” স্নিপেট। এটা সাধারণ হ্যাকারের কাজ না, এটা সিগন্যাল। কেউ কথা বলতে চাইছে—কোডের ভেতরে।

বিছানার পাশে প্যাক করা একটা ডুফেল ব্যাগ। তার ওপর একটা পাসপোর্ট পড়ে আছে—শেষ পৃষ্ঠায় লাল কালিতে ঘষা, “VOID” লেখা। নিচে একটুকরো কাগজে হাতের লেখা:
“UAE ইমিগ্রেশন ফ্ল্যাগ করবে, সাবধানে…”

অর্ঘ্যর আঙুল থমকে যায়। কীবোর্ডে টাইপ করছিল—

$dechain –trace –auth 44x…97ff

সার্ভারে ঢোকার আগেই স্ক্রিন ঝলকে ওঠে।
ACCESS BLOCKED: Suspicious pattern identified.
তারপর—পিং!

একটা মেসেজ ভেসে ওঠে স্ক্রিনে। ইনক্রিপ্টেড।
Sender: AL MIRZA | Message: তুই কি ভাবছিস আমি ভুলে গেছি? 🙂

অর্ঘ্য থেমে যায়। ল্যাপটপের ঢাকনাটা ধীরে বন্ধ করে দেয়। ঠোঁটে এক ধরনের ক্লান্ত, বিষণ্ন হাসি। পুরনো ডেটা সব খুলে গেছে, মনে হয় তার স্মৃতির মতো।

চার বছর আগেও সে ছিল অজস্র স্বপ্নের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক কোডার—একটা ছোট কোম্পানিতে ডেভেলপার, ফ্ল্যাটমেটদের হোস্টেলে চা বানাত। তারপর, হঠাৎ এক বিটকয়েন ওয়ালেট তার দিক পাল্টে দেয়।

সে আর আলী মিলে তৈরি করেছিল ‘DeChain’, একটা ডিসেন্ট্রালাইজড ট্রানজাকশন ম্যাপিং টুল, যেটা আজও অনেক গ্লোবাল ক্রিপ্টো কোম্পানি ব্যাকএন্ডে ব্যবহার করে। কিন্তু ডিচেইনের কোড একদিন ঢুকে পড়ে পাকিস্তানের ডার্কওয়েবে—আলীর হাত ধরে। আর সেদিন থেকে অর্ঘ্য সবকিছু ফেলে পালিয়ে বেড়াচ্ছে—নিজের টাকাসহ।

সে উঠে পড়ে। জানালার কাঁচে জল জমেছে। নিচে রাস্তায় একটা কালো SUV এসে থেমেছে। ফোনে লোকেশন ট্র্যাক অন নেই, তাও কীভাবে খুঁজে পেল?

অর্ঘ্য সাইড টেবিল থেকে পিস্তলটা তুলে নেয়। হ্যাঁ, সে জানে এই মুহূর্তটা আসবেই। সে তিনটে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, চারটা ক্রিপ্টো ওয়ালেট, দুটো ক্লোন আইডি আর একটা ফেক পাসপোর্ট চালায়—এই পৃথিবীর থেকে পালানোর জন্য।

সে যখন দরজা খোলার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে, পেছনে হঠাৎ নরম গলায় একটা কণ্ঠস্বর—
“এইভাবেই পালিয়ে যাবি সবসময়?”

সে থমকে দাঁড়ায়।

“মেঘলা?”

কোণার ছায়া থেকে বেরিয়ে আসে মেয়েটি—চোখে অন্ধকার রাত, হাতে একটা ছোট রেকর্ডার, কাঁধে সাদা ব্যাগ। তার পোশাক সাংবাদিকদের মতো, কিন্তু মুখে এক অদ্ভুত অশ্রুস্নাত ক্লান্তি।

“তুই এখন একটা খবর অর্ঘ্য। তুই জানিস?”
মেঘলার ঠোঁট ফাঁটা, চোখে জেদ।
“বাংলাদেশ সাইবার ডিভিশন বলছে, তোর তৈরি একটা ব্লকচেইন API দিয়ে ট্রাফিক করানো হচ্ছে আফগানিস্তানে। তোকে ধরার জন্য ভারত, UAE আর EU ত্রিমুখী ওয়ারেন্ট ইস্যু করছে।”

অর্ঘ্যর গলায় সামান্য ঝাঁঝ, “তুই এখন পুলিশ নাকি সাংবাদিক?”

মেঘলা চুপ। তারপর বলে, “আমি তোর জন্য এসেছি, রিপোর্টের জন্য না। আমি জানি, তুই সব করিস নিজের মতো। কিন্তু এটা তোর মতো নয়। এটা… ভয়ানক।”

অর্ঘ্য জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। দূরে সেই SUV-এর দরজা খুলেছে। কেউ নামছে না। ওরা শুধু চায়, সে বেরিয়ে আসুক।

“তুই বুঝতে পারছিস না মেঘলা,” অর্ঘ্য ধীরে বলে, “এই শহরের আলোগুলো যত উজ্জ্বল দেখায়, তার পেছনে তত অন্ধকার কোড লুকিয়ে থাকে।”

“তুই তো সেই কোড লেখিস!”

“আমি লেখতাম। এখন আমি শুধু পালাই।”

এক মুহূর্তের নীরবতা।

“আমার একটা ল্যাপটপে,” অর্ঘ্য বলল, “একটা এনক্রিপ্টেড ফোল্ডার আছে। নাম ‘CoinDrop’। তাতে সব আছে—আলীর মেসেজ, চুক্তির প্রমাণ, সবকিছু। যদি আমি না ফিরি—তুই সেটা ডিসক্লোজ করবি মিডিয়ায়। কপিটা তোকে দিচ্ছি এখনই।”

মেঘলা কিছু বলার আগেই অর্ঘ্য ল্যাপটপে কোড টাইপ করে এক পেনড্রাইভে ফাইল ট্রান্সফার করতে শুরু করে। স্ক্রিনে লেখা আসে:

Decrypting Layer-3: 23% complete…

ঠিক তখন, জানালার বাইরে আলো জ্বলে ওঠে। কেউ স্ক্যান করছে রুমের হিট সিগন্যাল। অর্ঘ্য পেনড্রাইভ ছুঁড়ে দেয় মেঘলার দিকে।

“দৌড়! ওরা চলে আসছে।”

“তুই?”

“আমার পালাতে হবে। আবার।”

মেঘলা আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না। দরজা খুলে ছুটে বেরিয়ে যায়।

অর্ঘ্য আবার ল্যাপটপের দিকে তাকায়। স্ক্রিনে শেষ বার্তা:
AL MIRZA: Let’s finish what we started.

অর্ঘ্যর মুখে সামান্য হাসি। সে জানে—এই খেলাটা এবার শেষ করতে হবে। শুধু টাকার নয়, জীবনের।

পর্ব ২: প্রিয় মুখ, অচেনা ছায়া

বেঙ্গালুরু, ইন্ডিয়া ব্লকচেইন সামিট। চারপাশে চকচকে হেডসেট, অ্যাগরেসিভ পিচিং, ইনস্টাগ্রাম-ফ্রেন্ডলি স্টল আর ধাতব ব্যাজ। মেঘলা ঘোষ এক কোণে দাঁড়িয়ে দেখছিল—এই শহরের নতুন স্বপ্নদ্রষ্টারা আজ কারা। কেউ চোখের সামনে কোডের পর্দা টানছে, কেউ স্যুট পরা ধনকুবের হয়ে উঠতে চাইছে, কেউ কেউ শুধু ভিডিও কন্টেন্টের লাইভ লুপে আটকে যাচ্ছে।

মেঘলা এসেছিল মূলত একটি গোপন রিপোর্টের সূত্রে। দুবাইয়ের একটি হ্যাকার গ্রুপ ভারতীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে একাধিক ফেক ট্রান্সফার মডেল চালাচ্ছে—এই তথ্য তার কাছে এসেছিল এক অজানা ইমেল অ্যাকাউন্ট থেকে। সেই অ্যাকাউন্টের নাম ছিল: CoinDropArchives।

“ম্যাম, কফি?” এক স্বেচ্ছাসেবক ছাত্রী এগিয়ে এসে বলে।
মেঘলা মাথা নেড়ে ‘না’ বলল। তার চোখ স্ক্যান করছে পুরো কনফারেন্স হল।

সেই সময় মঞ্চে উঠে আসে একজন, যার মুখ ক্যামেরা থেকে কিছুটা আড়ালে। উচ্চারণে অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস। পেছনে তার স্টার্টআপের নাম—“SilentKey Technologies”।

মেঘলা প্রথমে চেনেনি। কিন্তু গলার টোন, পেছনের চালচলন, ছায়ার নিচে দাঁড়ানো চোখজোড়া—অর্ঘ্য।

তার পেটটা খালি হয়ে আসে। সে নিশ্চিত।
চার বছর পর, একই শহরে, এক নতুন পরিচয়ে, সেই মানুষ—যে একদিন তার হাত ধরে বলেছিল, “তোর চোখের ভেতরেও একটা এনক্রিপশন আছে।”

সে বসে পড়ে কনফারেন্স রুমের শেষ সারিতে। তার রেকর্ডার চালু।
অর্ঘ্য বলছে—“এখনকার ট্রান্সাকশন ভেরিফিকেশন সিস্টেমগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা তৈরি করছি এমন এক অ্যাপ্লিকেশন, যেটা মানুষের ফেসিয়াল রেসপন্স থেকে ট্রাস্ট ফ্যাক্টর বের করে আনবে—ডিপ কোডিং, নো ওয়ালেট লিন্ক, জাস্ট সেন্সর-ভিত্তিক ওথেন্টিকেশন।”

একটা করতালির গুঞ্জন। কিন্তু মেঘলার চোখ তখনও স্থির অর্ঘ্যের ঠোঁটের রেখায়।
এই লোকটা এখন পিচ করছে ভবিষ্যতের নাম করে। অথচ তার অতীত আজও ছায়ার মতো পেছনে ঘুরে বেড়ায়।

সে বেরিয়ে আসে রুম থেকে। একটা করিডরে গিয়ে দাঁড়ায়—হাঁটুতে কাঁপুনি, চোখে জ্বালা। একটা সময় ছিল, যখন অর্ঘ্যর হাতে হাত রেখে সে পাড়ি দিতে চেয়েছিল এই পথগুলো। তখন সে জানত না—ছায়ারাও খুন করতে জানে।

হঠাৎ পেছনে পায়ের শব্দ। মেঘলা ফিরে দেখে—অর্ঘ্য।

“তুই…”
সে হাসে, খুব হালকা, ক্লান্ত একটা হাসি।
“তুই রিপোর্ট করতে এসেছিস? না কি আমাকে বাঁচাতে?”

“তুই এখানে কেন?” মেঘলা সরাসরি জিজ্ঞেস করে।

অর্ঘ্য জানালার দিকে তাকিয়ে বলে, “বেঙ্গালুরু নিরাপদ। অন্তত এখনো। আর SilentKey আমাকে একটা নতুন নাম দিয়েছে। নতুন মুখও। শুধু চেনা মানুষের চোখে নিজেকে লুকাতে পারি না।”

“আমি তোকে চিনে ফেলেছি।”

“তাই তো… এখনও চোখের ভাষা বদলায়নি তোর।”

মেঘলা এক ধাক্কায় দেয়, “তুই জানিস, তোর নামে ওয়ারেন্ট বেরিয়েছে? ইউরোপিয়ান সাইবার সেল তোকে ট্র্যাক করছে। আমি রিপোর্ট করলে, তুই আজকেই ধরা পড়বি।”

“তা করবি?”
অর্ঘ্যের গলায় না অনুনয়, না ভয়—শুধু স্পষ্টতা।

“আমি এখন জানি না,” মেঘলা ধীরে বলে। “তবে একটা কথা জানি—তুই পালাচ্ছিস। আর প্রতিবার একটু একটু করে নিজের থেকেই পালাচ্ছিস।”

একটা মুহূর্তের জন্য দুজন চুপ। করিডরের বাতি ঝাপসা হয়ে আসে।

“আলী ফিরেছে,” অর্ঘ্য বলে। “এই শহরে নয়—দুবাইয়ে। ও আমাকে খুঁজে বের করে ফেলেছে। CoinDrop-এর সব ফাইল ওর হাতে গেলে শুধু আমি না—তুই, তোর ভাই, সবাই ঝুঁকিতে পড়বি। এই খেলা আর কেবল টাকা বা হ্যাকিংয়ের না—এটা এখন জিম্মাদারির।”

মেঘলার ফোনে একটা নোটিফিকেশন আসে—একটি অজানা নাম্বার থেকে, মেসেজ:
You’ve been followed since Delhi. Nice earrings.

সে চমকে উঠে। জানালার বাইরে একটা বাইক অদ্ভুতভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে—রাইডার হেলমেট খুলছে না। পেছনে অটোতে বসা কেউ হ্যাঁ করে ইশারা দেয়।

অর্ঘ্য বলে, “তুই এখন তোর মতো না। তুই আমার মতো হয়ে যাচ্ছিস। চুপচাপ একটা কোডে আটকে যাচ্ছিস।”

মেঘলা ঠোঁট কামড়ে ধরে। “CoinDrop ফাইল আমার কাছে আছে। আমি জানি ওটা খোলার পাসওয়ার্ড—তোর জন্মতারিখ না, তোর মার জন্মতারিখ।”

অর্ঘ্যের মুখ সাদা হয়ে যায়।

“তুই সব জানিস?”
“না। কিন্তু জানব। তোকে আমি বাঁচাতে এসেছিলাম। কিন্তু এখন বুঝছি, নিজেকেও বাঁচাতে হবে।”

সেই মুহূর্তে বাইরে একটা বিস্ফোরণ হয়—ছোট, কিন্তু স্পষ্ট। অর্ঘ্য ছুটে গিয়ে দেখে—তার গাড়ি পুরোপুরি ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

“ওরা এসে গেছে,” সে বলে।

মেঘলা পিছন থেকে বলে, “চলো, আমার হোটেলে চল। এখন তুই কোথাও একা যেতে পারবি না।”

অর্ঘ্য একবার আকাশের দিকে তাকায়। তারপর ধীরে মেঘলার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
“ঠিক আছে। শেষ খেলাটা একসাথেই খেলি।”

পর্ব ৩: ব্লকচেইনের পিছনে রক্ত

তখন ২০১৯ সালের আগস্ট। মেঘালার ডায়েরির পুরনো পৃষ্ঠায় লাল কালি দিয়ে লেখা:
“DeChain—দিনটা বদলেছে, কিন্তু রাতটা অন্ধকারেই রয়ে গেছে।”

অর্ঘ্যর সেদিনকার চেহারাটা মেঘলা আজও ভুলতে পারেনি। চোখে জ্বর, ঠোঁটে কোডের ছায়া, আর ব্যাগে একটা অচেনা সার্ভার ড্রাইভ। তারা তখন বেঙ্গালুরু থেকে কাশ্মীরের দিকে পালাচ্ছিল। আলী মির্জা তখনও তাদের “বন্ধু” ছিল। অথচ, সেই রাতেই প্রথম রক্ত ঝরেছিল ব্লকচেইনের মাটিতে।

ড্রাইভে তখন নতুন কিছু অ্যাসেট তৈরি হচ্ছিল—“ChainGhost” নামে একটা পাইলট প্রজেক্ট। এর কাজ ছিল লোকাল এনক্রিপশন দিয়ে গ্লোবাল ওয়ারলেস ট্রান্সফার করা, যাতে কোনো সরকারি নেটওয়ার্ক ফিল্টার করতে না পারে। এটা ছিল আলীর আইডিয়া, কিন্তু কোড লিখেছিল অর্ঘ্য। মেঘলা তখন সাইড থেকে শুধু ছবি তুলত, ডকুমেন্ট বানাত, আর স্বপ্ন আঁকত—একদিন তারা তিনজন মিলেই একটা কোম্পানি খুলবে।

কিন্তু সেই স্বপ্নটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল শ্রীনগরের এক পাহাড়ি গেস্ট হাউসে।

সেই রাতে, কোড কম্পাইল চলছিল। আলী তার বিটকয়েন ওয়ালেট দিয়ে লাইভ টেস্ট শুরু করেছিল। হঠাৎ অর্ঘ্য লক্ষ্য করে—ডেটা ডাম্পে এক অচেনা সার্ভার রিকোয়েস্ট ঢুকছে। আইপি ট্রেস করে দেখা যায়—লাহোর।

“আলী, এটা কী?”
“কিছু না, একটা ক্লোন সার্ভার দিয়ে টেস্ট করছি,” বলে হেসে ফেলে আলী। “ট্রাফিক ম্যানেজ করতে হবে তো।”

কিন্তু অর্ঘ্য কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। সে যখন টার্মিনালে ডিটেইলস ঘেঁটে যাচ্ছিল, তখনই সে খুঁজে পায়—চেইনঘোস্টের একটা এনক্রিপ্টেড রুট ডিরেক্টলি পাকিস্তানি একটি হ্যাকার গ্রুপের সাথে সংযুক্ত। তারা সেই রুট দিয়ে কালো টাকার হদিস পাচার করছে, এমনকি অস্ত্র কেনাবেচার টোকেনও চালাচ্ছে।

“তুই এটা করেছিস?”
“ভাই, আমি শুধু অপশন রেখেছি। দুনিয়া বদলানোর জন্য পয়সা দরকার, আর পয়সার উৎস সবসময় সাদা হয় না,” বলে আলী ঠান্ডা গলায়।

সেই রাতে অর্ঘ্য জানত—এই কোড আর তার হাতে নেই। এটা রক্তাক্ত হয়ে গেছে।

সে চুপচাপ মেঘলাকে নিয়ে পালিয়ে আসে। কিছু ডেটা সে ব্যাকআপ নেয়, বাকিটা নষ্ট করে দেয়—অন্তত তাই ভাবত। কিন্তু ChainGhost মরেনি, বরং একটা ছায়া হয়ে বেঁচে ছিল।

বর্তমান, কলকাতা।

ডি.সি. প্রিয়ঙ্কা ধর তার ডেস্কে বসে আছে। চারটা স্ক্রিনে চারটে আলাদা ট্র্যাকিং ম্যাপ। একটায় ইউএই, একটায় মুম্বাই, আরেকটায় বেঙ্গালুরু, আর চতুর্থটায় শুধুই একটা কোড:
ChainGhost-ID-4723X

“স্যার, আমরা নিশ্চিত, এই ওয়ালেট থেকে বিটকয়েন লন্ডারিং হয়েছে গত তিনমাস ধরে। শেল কোম্পানির লোগো ব্যবহার হয়েছে—SilentKey।”
প্রিয়ঙ্কা মাথা নাড়ে। “তোদের বলেছিলাম, এই অর্ঘ্য সেনকে ধরো। ওর ফেসিয়াল ম্যাপ মেলাচ্ছে না, কিন্তু টেকনো-সিগনেচার একই রকম। ছেলেটা শ্যাডো ট্রানজাকশনের হিমশৈল।”

সে তার ডেস্কে পড়ে থাকা একটা মেইল প্রিন্টআউট তুলে নেয়—অজ্ঞাত প্রেরক, শুধু লেখা:
“If he disappears again, more than money will burn.”

বেঙ্গালুরু, গভীর রাত।

অর্ঘ্য মেঘলার হোটেলরুমে এক কোণায় বসে ছিল। জানালার বাইরে আজও কেউ দাঁড়িয়ে আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। হালকা বৃষ্টিতে রাস্তার বাতি জলছবি হয়ে গেছে।

“আলী এখনও এই প্রজেক্ট চালাচ্ছে। তুই নিশ্চিত?” মেঘলা জিজ্ঞেস করল।

“ওর একটা সিস্টেম আছে—‘GhostFork’। সেটা ChainGhost-এর কপি। ওরা এখন লোকাল এনক্রিপ্টেড অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে ট্র্যাক-লেস পেমেন্ট করছে—ডার্কনেটের নতুন মুদ্রা। আমি আর থাকতে পারব না এই খেলার ভেতরে।”

“তুই কি তাহলে মিডিয়ায় আসতে চাস? সত্যিটা ফাঁস করতে চাস?”

“না,” অর্ঘ্য চুপচাপ বলল। “আমি সব শেষ করতে চাই। পুরো সিস্টেমটা ধ্বংস করতে হবে। ওদের ডেটা সার্ভার, ওদের কন্ট্রোল, ওদের এনক্রিপশন—সব।”

“তুই একা পারবি?”

“তাই তো তোকে ডেকেছি।”

মেঘলা চমকে তাকাল।
“তুই কী বলছিস?”

অর্ঘ্য ধীরে তার ল্যাপটপের স্ক্রিনে একটি ম্যাপ খুলে দেখাল—দুবাইয়ের বাইরের একটি পুরনো ডেটা সেন্টার, যেটা এখন GhostFork-এর কোর সার্ভার হিসেবে কাজ করছে।

“এই জায়গাটা ধ্বংস হলে, ওদের পুরো নেটওয়ার্ক ভেঙে পড়বে। কিন্তু আমি একা পৌঁছাতে পারব না। তোকে লাগবে—তোর রিপোর্টিং স্কিল, তোর পরিচয়, তোর সাহস।”

মেঘলার গলা শুকিয়ে আসে।
“আমি তোর ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে পারিনি অর্ঘ্য। কিন্তু যদি এটাই সত্য হয়, তাহলে আমি তোকে শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাব।”

দূরে মেঘ গর্জে ওঠে।

আর শহরের আরেক প্রান্তে আলী মির্জা তার ডেস্কে বসে হেসে বলে, “তোর এক্স-গার্লফ্রেন্ড আর তোকে ফাঁসাবে অর্ঘ্য। কিন্তু দোষ যদি থেকেই যায়, মুখ পাল্টে কী হবে?”

পর্ব ৪: সাদা জামা, কালো লেনদেন

সকাল ছয়টা, কলকাতা। বাগুইআটি থানার সাইবার ইউনিট অফিসে আলো জ্বলছে কেবল একটিই ঘরে। ডি.সি. প্রিয়ঙ্কা ধর নিজের ডেস্কে চায়ের কাপে ঠোঁট ছুঁইয়ে বসে আছে, আর টেবিল জুড়ে ছড়িয়ে আছে একগুচ্ছ মোবাইল স্ক্রিনশট, সার্ভার ট্রেস রেকর্ড আর ব্লকচেইন ওয়ালেটের লগ ফাইল।

ওর চোখ আটকে আছে একটা সাদা জামার ভেতরে লুকানো অন্ধকারে।

“তুমি জানো তো, অর্ঘ্য সেন একটা সাদা ছেলের মতো থাকতে শিখেছে,” প্রিয়ঙ্কা বলল সহকারী অফিসারকে, “কিন্তু যে লেনদেনটা করছে, সেটা পাপের চেয়েও গভীর।”

অফিসার কৌশিক জিজ্ঞেস করে, “স্যার, ও তো এখন বেঙ্গালুরুতে। ট্রেস হবে?”

“ওর লাইভ লোকেশন পাওয়া যাচ্ছে না। ওর ডিভাইস একটা হোস্টড সার্ভার থেকে ক্লোন পিং পাঠাচ্ছে। কিন্তু গতকাল রাতে ‘GhostFork’ থেকে একটা অদ্ভুত এক্সচেঞ্জ লগ ধরা পড়েছে। কেউ যেন ৭২টা বিটকয়েন তিন মিনিটের মধ্যে আলাদা আলাদা অ্যাকাউন্টে পাঠিয়েছে—এমনভাবে, যেন ট্র্যাক করা না যায়।”

“রেসিপিয়েন্ট?”

“তন্ময় সেন। অর্ঘ্যর ভাই।”

কৌশিক থমকে যায়।

“ভাই? সে তো স্কুল শিক্ষক, কলেজের অ্যাসিস্টেন্ট টিচার!”

“ঠিক তাই,” প্রিয়ঙ্কা চোখ সরু করে তাকায়, “আর ওর অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে এক কোটি ছাপ্পান্ন লাখ টাকা, এক রাতের মধ্যে। তার মানে, অর্ঘ্য টাকা পাচার করছে নিজের পরিবারের মাধ্যমে।”

অন্যদিকে, মুম্বাইয়ের মালাডের এক পুরনো কোয়ার্টারে, তন্ময় সেন চা খাচ্ছে মাকে নিয়ে। খবরের কাগজ খুলতেই চোখ আটকে যায় এক হেডলাইনে:

“ডার্কওয়েবের নেপথ্যে এক ভারতীয়? DeChain-এর ছায়ায় জড়িয়ে আছে কলকাতার এক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।”

মা বলে, “এই অর্ঘ্যর মতো নাম না?”

তন্ময় হাসে, “হাজারো অর্ঘ্য থাকে মা। তুই আবার কী সব ভাবিস।”

কিন্তু তার হাত কাপছে।

সে জানে, রাতের বেলা হঠাৎ এক অচেনা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছিল:
“CoinDrop ডেটা আসছে। এটা শুধু টাকা নয়। এটা সত্য। Use wisely.”

সাথে ছিল একটা ওয়ালেট অ্যাড্রেস আর একটি ইনক্রিপ্টেড পাসকোড:
de_sen_1987@blacknode

তন্ময় বুঝতে পারছে না কী করছে। কিন্তু সে জানে, তার দাদা এখন কোথায় আছে, কী করছে, সেই প্রশ্নের উত্তর এটাই। সে চুপচাপ একটি ড্রাইভে ফাইলগুলো কপি করে। স্ক্রিনে হঠাৎ ছোট্ট এক নোটিফিকেশন ভেসে ওঠে:
“You are now being watched.”

সে জানে, এটা খেলা নয়। এটা একটা চক্র।

বেঙ্গালুরু, সকাল সাড়ে আটটা।

অর্ঘ্য আর মেঘলা এখন একটি ক্লিনিক্যাল ইনফরমেটিক্স অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে। এখানে ওদের একমাত্র আশ্রয়—ডাঃ সূর্যভান, এক প্রাক্তন হ্যাকার যিনি এখন সিস্টেম অ্যানালিস্ট।

“সূর্য তোকে কেন সাহায্য করবে?” মেঘলা জিজ্ঞেস করে।

“কারণ ও নিজেও একসময় GhostFork-এর সদস্য ছিল। কিন্তু পরে বেরিয়ে আসে, যখন বুঝেছিল ওরা শুধু টেকনোলজি নয়, মানুষ পাচার, চাইল্ড এক্সপ্লয়টেশন—সব কিছু চালায় এই এনক্রিপশন ছাঁদের ভেতর দিয়ে।”

অর্ঘ্য দরজায় নক করে। কিছুক্ষণ পর একজন চোখে ধোঁয়াটে গ্লাস পরা মানুষ দরজা খোলে।

“তুই ফিরলি, অর্ঘ্য?” সূর্যভান হাসে না, গলায় একধরনের ক্লান্তি।
“আমার বাড়িতে পুলিশ আসতে পারে, জানিস তো?”
“জানি। কিন্তু এবার ফেলে আসা কিছু শেষ করতে এসেছি।”

ওরা ভিতরে ঢোকে।

“GhostFork-এর কোর সার্ভারে ঢুকতে হলে, তোকে নতুন ধরনের এনক্রিপশন টানেল তৈরি করতে হবে। এখন ওরা ১২-লেয়ারড ব্লাইন্ড ফোল্ড এনক্রিপশন চালায়—যেটা শুধুমাত্র ডিপ ওয়ার স্ক্যানিং দিয়ে ভাঙা সম্ভব,” সূর্য বলে।

“আমি সেটার জন্যই এসেছি। আমার হাতে ChainGhost-এর প্রোটোটাইপ আছে।”

মেঘলা চমকে যায়।

“তুই বলেছিলি ফাইলটা ডিলিট করেছিলি?”

“ডিলিট করিনি। এনক্রিপ্ট করে রেখেছিলাম… নিজের মতো করে।”

অর্ঘ্য ল্যাপটপ চালু করে। টাইপ করে একটি কমান্ড:

/usr/ghost –init –path ~/legacy/prototype/

স্ক্রিনে ভেসে ওঠে:

“Unlock Key Required.”

অর্ঘ্য ধীরে পকেট থেকে একটা লাল কাগজ বের করে, তাতে লেখা কিছু সংখ্যা:

18-12-1961 | 02-04-1987 | 07-11-2019

“এগুলো কী?” মেঘলা প্রশ্ন করে।

“আমার মা’র জন্মদিন, আমার জন্মদিন, আর যেদিন আমি ChainGhost থেকে আলাদা হয়েছিলাম।”

কোড ইনপুট হলে স্ক্রিন ফ্ল্যাশ করে ওঠে, তারপর খুলে যায় একসাথে ১৭টা ফাইল। ফাইলগুলোর নাম:

bloodtrail_001.json

users_harvest.log

ghostroot_RSA.key

“ওরা শুধু টাকা পাচার করে না,” অর্ঘ্য বলে, “ওরা মানুষ কিনে নেয়।”

মেঘলার গলায় কাঁপুনি।

সূর্য হঠাৎ বলে, “তোর হাতে এবার যা আছে, সেটা আইন, মিডিয়া, এমনকি আন্তর্জাতিক আদালত পর্যন্ত যেতে পারে। কিন্তু তোকে টিকে থাকতে হবে। GhostFork এবার তোকে মুছে ফেলবে।”

“আমিও তো তাদেরই একটা ছায়া ছিলাম,” অর্ঘ্য বলে, “এবার নিজেকেই মুছে ফেলতে চাই।”

কলকাতায়, ডি.সি. প্রিয়ঙ্কার কম্পিউটারে তখন চলে আসছে রিয়েল টাইম অ্যালার্ট:

“GhostFork server breach attempt from India node.”

সে চেয়ারে হেলে পড়ে বলে, “অবশেষে, সে আবার কোড লিখছে।”

পর্ব ৫: ভাইয়ের ঘর

কলকাতা, রাত দশটা। বাগুইআটির পুরনো দুইতলা বাড়িটা আজও অন্ধকারে ডুবে থাকে যতবার অর্ঘ্যর নাম কেউ নেয়। পাঁচ বছর ধরে সে বাড়ি ফেরেনি। তবু জানালার ধুলো জমা গ্রিল, কাঠের তাকের ওপর রাখা তার স্কুল জীবনের ট্রফি আর পুরনো টিনের সুটকেস যেন চুপ করে অপেক্ষা করে থাকে—যেন কেউ আসবেই।

তন্ময় দরজা খুলে নিজের রুমে ঢোকে। বিছানার পাশে টেবিলে রাখা USB পেনড্রাইভটা এখনও সেভাবেই পড়ে আছে। তাতে CoinDrop ডেটা লুকিয়ে আছে—অর্জিত নয়, যেন রেখে যাওয়া এক রহস্য।

সে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালায়। পেনড্রাইভটা ল্যাপটপে ঢুকিয়ে ওপেন করে। একে একে খোলে তিনটা ফাইল:

transaction_loop.mp4

ledgerkey.csv

Message_for_Tanmay.txt

শেষের ফাইলটা ওপেন করতেই স্ক্রিনে ফুটে ওঠে অর্ঘ্যর লেখা এক চিঠি:

“তন্ময়,
আমি জানি, তোকে বলার মতো মুখ আমার নেই। কিন্তু এই পেনড্রাইভে যা আছে, সেটা শুধুই টাকা নয়—এটা আমার পাপ, আমার স্বপ্ন আর শেষপর্যন্ত আমার দায়। আমি চেয়েছিলাম স্বাধীনতা—নিজের, দেশের, প্রযুক্তির। কিন্তু টাকার দুনিয়া সব বদলে দিল।

এখন তোকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে—এই টাকা দিয়ে তুই কি জীবন সাজাবি, না কি এই আগুন নেভাবি? জানিস, ভাই, আমি আর ফিরতে পারব না। কিন্তু তুই যদি ঠিক করিস, তবে আমি মরেও শান্তি পাবো।

— অর্ঘ্য”

তন্ময় দীর্ঘক্ষণ বসে থাকে, স্থির চোখে। তারপর ক্লিক করে transaction_loop.mp4।

ভিডিওটা রাতের। একটি কন্টেইনার গোডাউন। কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে হুড তোলা অবস্থায়, চোখ ঢাকা সানগ্লাসে। সে ইশারা করছে এক ট্রাকের চালককে। তারপর কন্টেইনার খুলতেই দেখা যায়—ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাঝে লুকোনো মানুষ। শিশু, নারী—অচেতন, বোবা, কাঁপতে থাকা। এদের শরীরে ছোট এনক্রিপশন ট্যাগ বসানো—ওই চিপের মাধ্যমেই ট্র্যাকিং হচ্ছে ট্রান্সফারের।

তন্ময়ের বুকের ভেতরটা জমে যায়। সে জানত না দাদার ছায়া এতটা গভীর, এতটা অন্ধকার।

ঠিক তখনই দরজায় টোকা।

“তন্ময়, খোল দরজা। পুলিশ।”
একটা কাঁপা মুহূর্ত। সে জানালার দিকে তাকায়, আর তারপর পেনড্রাইভটা ব্যাগে ঢুকিয়ে দরজা খুলে দেয়।

সামনে দাঁড়িয়ে ডি.সি. প্রিয়ঙ্কা ধর।

“তুমি তন্ময় সেন?”
“হ্যাঁ।”

“তোমার নামে এখনো কোনো ওয়ারেন্ট নেই। কিন্তু তোমার অ্যাকাউন্টে যে বিটকয়েন ট্রান্সফার হয়েছে, সেটা একটা সক্রিয় তদন্তের অংশ। তোমার ভাই অর্ঘ্য সেন একজন আন্তর্জাতিক অপরাধী। তাকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার।”

তন্ময় ধীরে মাথা নাড়ে।

“আমি কিছু জানি না।”

প্রিয়ঙ্কা চোখ সরু করে তাকায়।
“তুমি একজন শিক্ষক। কিন্তু তোমার কম্পিউটার এখন আন্তর্জাতিক হ্যাকার সার্ভারের সাথে লিংক করছে। তুমি নিজেই বুঝতে পারছ, এটা কী অর্থ দাঁড় করায়।”

তন্ময় চুপ। তারপর বলে, “আপনি যদি চান, আমার কম্পিউটার নিতে পারেন। কিন্তু একটা অনুরোধ—আপনার দল যেন শুধু দাদার খারাপ দিকটা না দেখে।”

প্রিয়ঙ্কা একটু থেমে জিজ্ঞেস করে, “আর কী দিক আছে?”

তন্ময় উত্তর দেয় না। তার চোখে অদ্ভুত এক নরম অভিমান।

একই সময়, বেঙ্গালুরু।

অর্ঘ্য আর মেঘলা দাঁড়িয়ে আছে রেলস্টেশনের ভিড়ের মাঝে। একটা সস্তা ব্যাগে তারা বহন করছে GhostFork-এর মূল ফাইলের একটি ক্লোন। এই ডেটা যদি সঠিক হাতে পৌঁছায়, তাহলে আন্তর্জাতিক ট্রান্সফার চেইনের ছিদ্র ধরা সম্ভব হবে।

“তুই এখন যাবি কোথায়?” মেঘলা জিজ্ঞেস করে।

“দিল্লি। UNO-র মানব পাচার শাখায় এক চেনা মুখ আছে—ডাঃ মালিক। ওকে এই ফাইলটা পৌঁছাতে হবে।”

“আর আমি?”

অর্ঘ্য বলে, “তুই তন্ময়ের কাছে যা। ওকে রক্ষা কর। কারণ ওরা এবার তাকেই টার্গেট করবে।”

মেঘলা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “তুই তো বুঝিস, আমি শুধু রিপোর্টার না। আমি তোর কথাও রাখি, এমনকি তোর ছায়াকেও।”

অর্ঘ্য তাকায় মেঘলার দিকে—চোখে ক্লান্তি, কিন্তু কৃতজ্ঞতাও।
“তুই আমার সাদা জামা। যেটার ভেতর সব কালো লেনদেন ঢেকে রাখা যায়।”

মেঘলা হাসে। “আর তুই আমার পুরনো কোট, যে যতবারই পরি, পকেট থেকে একটা রহস্য বের হয়।”

ট্রেনের হুইসেল বেজে ওঠে। অর্ঘ্য উঠে পড়ে।
মেঘলা ফিরে যায়, তার কাঁধে এখন একটা দায়—দাদা আর ভাইয়ের মাঝখানে দাঁড়ানো একটা লড়াই।

পর্ব ৬: লেটার অফ নো রিটার্ন

দিল্লি, রাত ১১টা। পাহাড়গঞ্জের গলির এক ফ্ল্যাটে মৃদু আলো জ্বলছে। কাঁচের জানালায় ফুটে ওঠা ছায়ার মতো, অর্ঘ্য সেনের মুখটাও আর সেই আগের মতো নেই। ক্লান্ত, শুকিয়ে আসা গালে কেবল কোডের ভাষা লুকোনো। তার ল্যাপটপে চলে ChainGhost-এর শেষ রাউন্ড ডিক্রিপশন। স্ক্রিনে টাইমার চলতে থাকে—

“Decrypting GhostFork—Progress: 89%”

তবু, সময় যেন দাঁড়িয়ে।

অর্ঘ্য জানে, এই কাজ শেষ হলে, তার আর ফিরে যাওয়ার রাস্তা থাকবে না। মেঘলার মুখ মনে পড়ে। তন্ময়ের চোখ—ভয় আর বিশ্বাসের সংমিশ্রণ। মা’র কণ্ঠস্বর—“তুই আবার কবে আসবি রে?”

এই সব স্মৃতি আজ যেন এক নির্দয় ডেটা ফাইলের মতো, যা ডিলিট হয় না, শুধু এক্সপায়ার হয়।

ঠিক তখন দরজায় নক।
অর্ঘ্য সতর্ক, হাতে পিস্তল ছুঁয়ে দেখে। ধীরে দরজা খোলে।

সামনে দাঁড়িয়ে এক উচ্চবর্ণ পাঞ্জাবি পরা মধ্যবয়স্ক মানুষ। গলায় ID কার্ড—UNO Emblem।

“ডাঃ মালিক?”
“তুইই অর্ঘ্য? দেরি করলি।”

অর্ঘ্য ভিতরে ডাকে। তারা দুজনে বসে।

“এই ফাইলগুলো যদি তুমি ইন্টারন্যাশনাল ট্রাফিকিং ট্রাইব্যুনালে পৌঁছে দিতে পারো, তবে GhostFork ধ্বংস হতে বাধ্য। আমি শুধু চাই, আমার নাম না আসুক।”

মালিক ফাইল স্ক্যান করেন। ধীরে বলেন, “তুই জানিস তো, এগুলোর একেকটার পেছনে একজন করে মরেছে? শিশুরা নিখোঁজ হয়েছে, নারীরা বিক্রি হয়েছে। তোর লেখা কোড এদের সিস্টেম চালিয়েছে।”

অর্ঘ্য মাথা নিচু করে।

“আমি শুধু প্ল্যাটফর্ম বানিয়েছিলাম। কখনও ভাবিনি, এই কোড মানুষ গিলে ফেলবে।”

“কোড তো নিষ্পাপ। কিন্তু কোডারের বিবেক যদি ঘুমিয়ে পড়ে, তখন এই কোড ড্রোন হয়ে যায়, বুলেট হয়ে যায়।”

অর্ঘ্য ধীরে চিঠির একটা খাম এগিয়ে দেয়।

“এটা CoinDrop-এর আসল চাবিকাঠি। এই খামের ভিতরে থাকা কাগজে লেখা পাসফ্রেজ খুললে, GhostFork-এর কর ফান্ড, ভেনম ওয়ালেট, সব কিছু উন্মুক্ত হয়ে যাবে।”

“তুই জানিস, এটা ফেরার চিঠি না—এটা একপাশার খেলা।”

“আমি তো বহু আগেই হেরে গেছি,” অর্ঘ্য চোখ সরিয়ে নেয়।

ডাঃ মালিক চিঠি হাতে নেয়, কিন্তু কিছু না বলে চলে যায়।

অর্ঘ্য জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ভাবে, তার তৈরি টাকার পাহাড় একদিন তাকে গিলে ফেলবে। কিন্তু আজ, সে যদি এই পাহাড়টা ধ্বংস করে দেয়, তাহলে তার কবরের উপর হয়তো একটা ছোট্ট ফুল থাকবে ।

কলকাতা, পরদিন সকাল।

তন্ময় সেন জেগে উঠে দেখে ঘরে রাখা ডেস্ক কম্পিউটারটা রিবুট হচ্ছে। স্ক্রিনে বার্তা ভেসে ওঠে:

“Message: Mallick UN VERIFIED — Uploading to Interpol Chain.”

সাথে সাথেই চিঠির সফ্টকপি আপলোড হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো GhostFork নেটওয়ার্ক অস্থির হয়ে ওঠে। টোকেন ভ্যালু ড্রপ করে, ইউজার রেজিস্ট্রি ডাউন, এবং একাধিক ব্লকচেইন ট্রান্সফার ঠেকে যায়।

ডি.সি. প্রিয়ঙ্কা ধর কলকাতার হেড অফিসে খবর পান:

“GhostFork data exposed. Source traced—India node. Possible leak by A.Sen or related ID.”

প্রিয়ঙ্কা অবাক হয়ে বলে, “সে নিজেই ছায়া ছিঁড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে?”

দুবাই, ভোর চারটা।

GhostFork-এর মূল হেডকোয়ার্টারে হইচই পড়ে যায়। সার্ভারগুলো তীব্রভাবে হিট হয়ে যাচ্ছে। আলী মির্জা—চেয়ারে বসে ফোনে চেঁচিয়ে বলে, “তাকে খুঁজে বের কর। ডিক্রিপশন ফাইল কারা দিল, সেটা জানতেই হবে। এখনই।”

হঠাৎ তার টেবিলের ওপর রাখা ল্যাপটপে একটা ভিডিও চলে আসে।

স্ক্রিনে অর্ঘ্য সেন—ক্লান্ত, চোখে ক্ষত।

“আলী, আমি তোকে খুঁজে পাব না জানি। কিন্তু আমার কোড আজ তোর সাম্রাজ্য গুঁড়িয়ে দেবে। আমি ফিরে যাব না, কিন্তু আমি আর পালাবোও না। এবার আমি শুধু হারাতে এসেছি—তাকে যার কাছে আমি কিছু রেখে যেতে চাই।”

ভিডিও থেমে যায়।

আলী দাঁড়িয়ে পড়ে, পেছনে হাওয়ার ঝাপটায় পর্দা উড়ে ওঠে। এই প্রথম তার চোখে ভয়।

কলকাতা, মেঘলার ফ্ল্যাট।

সে স্ক্রিনে তাকিয়ে চুপ করে বসে। UNO ডাটাবেসে অর্ঘ্যর পাঠানো লেটার আপলোড হয়ে গেছে। নাম নেই, শুধু লেখা—
“A Developer Who Burned His Own Blockchain.”

মেঘলার চোখের কোণে জল জমে।

অর্ঘ্য হয়তো আর ফিরবে না, কিন্তু সে তার শব্দে ফিরে এসেছে। এক নিঃশব্দ যুদ্ধের সৈনিক হয়ে।

পর্ব ৭: সৌদি চিঠি

দুবাই, এক গোপন ক্যাফে, মদিনাত জুমেইরার উপকণ্ঠে। দেয়ালে ঝোলানো আছে সূর্যাস্তের পেইন্টিং, কিন্তু জানালার বাইরে সূর্য তখনও উঁকি দিচ্ছে কাঁচের শহরে। টেবিলের কোণে বসে আছে আলী মির্জা, হাতে পুরনো চিঠি, কফির কাপ ঠাণ্ডা।

চিঠিটা এসেছে সৌদি আরব থেকে—জেদ্দাহর এক বেসরকারি হসপিটাল অ্যাড্রেস লেখা খামে। ভেতরে ছোট্ট এক ভিডিও পেনড্রাইভ, সঙ্গে হাতের লেখা একটা চিঠি—

“আলী ভাই,
তুমি আমাকে ভুলে গেছো। কিন্তু আমি তোমায় ভুলি নাই। আমি হাসান। তোমার ‘GhostFork’ টিমের লাস্ট লেভেল অপারেটর। আমি তখন ১৬ বছর বয়সে ঢুকেছিলাম। কোড জানতাম না, মানুষ চিনতাম না। শুধু জানতাম, ডেটা কারচুপি করলে টাকা পাওয়া যায়।

আমার কাজ ছিল মোবাইল অ্যাপের মধ্যে লুকানো এনক্রিপশন পুশ করা। তার মধ্যে অনেকবার এমন ভিডিও গিয়েছিল যা একজন মানুষ চোখে দেখতে পারে না। কিন্তু একদিন আমি ভুল করে এক ফোল্ডারে ঢুকে যাই, যেখানে ছিল… ওদের… ছবি। শিশুদের। মার খাওয়া, চোখ বেঁধে রাখা।

আমি আজও ঘুমাতে পারি না।

ভাই, আমি জানি আপনি বড়। আপনি সব জানতেন। কিন্তু আপনি যদি আজও মানুষ হয়ে থাকেন, তাহলে দয়া করে—এই ব্যবসা বন্ধ করুন। আমি এখন হাসপাতালে। আমার শরীরে টিউমার। শেষ স্টেজ। এই ভিডিওটা আমি রেকর্ড করে পাঠালাম UNO-তে। তারা শুনবে কিনা জানি না, কিন্তু আপনি যদি একটু কাঁদেন, তবে বুঝব, আপনি মানুষ ছিলেন।”

আলী মির্জার চোখে পড়ে ভিডিওর থাম্বনেইল—এক যুবক, মুখে অক্সিজেন মাস্ক, কণ্ঠে কষ্ট।

আলী চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ায়, এক ঝলকে তার সামনে ভেসে ওঠে অর্ঘ্য সেনের মুখ—চোখে আগুন, পকেটে পাপ।

সে চিঠিটা পকেটে রাখে না। কফির সঙ্গে জলে মিশিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দেয়। মুখে ফিসফিসিয়ে বলে, “ভুলে গেছিস হাসান, আমার কোডে আবেগ লেখা নেই।”

কলকাতা, রাজারহাট।

তন্ময় সেন বাইরের দিক থেকে তালা খুলে নিজের নতুন ফ্ল্যাটে ঢোকে। সে এখন মেঘলার তত্ত্বাবধানে। UNO-র সাবপ্রোটেকশন লিস্টে থাকা ব্যক্তি হিসেবে, তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে—কিন্তু এখনও সে স্বাধীন।

ভেতরে ঢুকে দেখে টেবিলের ওপর একটা খাম রাখা। কে দিয়েছে জানে না। খামে শুধু একটা লাইন—

“Don’t trust the data you didn’t create.”

তন্ময় চমকে ওঠে। খাম খুলে ভিতরে পায় একটা ছোট USB। কম্পিউটারে লাগিয়ে দেখে—একটা এনক্রিপ্টেড কনসোল ফাইল। খোলা যায় না।

মিনিট পাঁচেক পরেই মেসেজ আসে অজানা নাম্বার থেকে:
Try this decryption key: 12.11.02.89.ghostfork.blacknode

ডিক্রিপ্ট করার পর খুলে যায় ভিডিও ফাইল—একটি রুম, যেখানে একজন লোক বেঁধে রাখা এক মেয়েকে কিছু দেখাচ্ছে। তারপর তার চিৎকার।

তন্ময়ের গলা শুকিয়ে আসে। সেই মেয়ে মেঘলা না তো?

না। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু গলার স্বর, কাঁধের ঝাঁকুনি, চুলের দৈর্ঘ্য—সবই প্রায় মিলছে।

ফাইলের শেষে লেখা—

“He gave us this footage to trade. We’ll give it back when we get the key.”

তন্ময় বুঝে যায়—GhostFork আবার উঠেছে। এবার তাদের টার্গেট অর্ঘ্য নয়, মেঘলা।

দিল্লি, একটি সরকারি গেস্ট হাউস।

অর্ঘ্য ল্যাপটপে চোখ রেখে শেষ কোড টাইপ করছে—

/exit.protocol –ghost-fork-mainnet –disablekey

এই কমান্ড চালালে GhostFork-এর মূল নেটওয়ার্ক থেকেই তার ডেভেলপার চাবিকাঠি মুছে যাবে। এরপর সে আর কিছু করতে পারবে না, এমনকি নিজের সিস্টেমেও ঢুকতে পারবে না।

একটা নোট খুলে সে লিখে ফেলে—

“এই চাবি আমি দিচ্ছি না। আমি হারিয়ে ফেলছি, ইচ্ছাকৃত। কারণ আমি জানি, আমার কোড দিয়ে যদি আরও একজন মানুষ কাঁদে, তবে আমি আর মানুষ থাকবো না।”

ঠিক তখনই ফোন বেজে ওঠে।

অর্জ্য দেখে নাম্বার নেই। সে রিসিভ করে।

ওপাশে ঠান্ডা গলায় আলী মির্জা:
“তোর প্রাক্তন সাংবাদিক বান্ধবী এখন আমাদের দখলে। ফাইলটা ফেরত দে। নয়তো আমরা ফাইলের বদলে শুধু ছায়া ফেরত পাঠাবো।”

অর্ঘ্যর ঠোঁট শুকিয়ে আসে।

“তুই যদি ছায়া ছুঁয়ে দেখতে পারিস, তোর ছায়াও পুড়ে যাবে,” অর্ঘ্য শান্ত গলায় বলে।

“তুই ভুলে গেছিস, আমি একা না। GhostFork এখন টিম না, একটা কনফিডেন্স।”

“আর আমি এখন কোডার না। আমি একজন চিঠি লেখক, যার প্রতিটি চিঠি কোনো কিছু শেষ করে দেয়।”

আলী বলে, “তোর হাতে সময় ২৪ ঘণ্টা।”

কল কেটে যায়।

অর্ঘ্য এবার বুঝে নেয়—এটা শুধু প্রযুক্তির যুদ্ধ নয়। এটা মানুষকে ফেরানোর যুদ্ধ। আর সে জানে, এই যুদ্ধে আর ফিরতি রাস্তা নেই।

পর্ব ৮: মুখোশ

লেখক: রুদ্রনীল মুখার্জি

ভোর চারটা, দিল্লির পুরনো ফাঁকা রাস্তায় গাড়ির আলো ছায়া কাটতে কাটতে অর্ঘ্য সেন পৌঁছে যায় এক নির্জন গ্যারেজে। গ্যারেজের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে সূর্যভান—চোখেমুখে অঘুম ক্লান্তি, হাতে একটি প্লাস্টিক বক্স।

“তুই সত্যিই ফিরে এলি?” সূর্য জিজ্ঞেস করে।

“আমি পালাতে এসেছিলাম,” অর্ঘ্য বলে, “এবার ফিরেছি মুখোমুখি হতে।”

সেই বক্সে একটি ছোট সার্ভার—GhostFork-এর ক্লোন ও অ্যাক্সেস ট্রেসার। সূর্য সেটি খুলে অর্ঘ্যকে দেখায়।

“এইখানে তাদের লোকেশন পিং আসছে। মেঘলাকে কোথায় রাখা হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু ডেটা গেছে লাহোরের একটা সাব-নেটওয়ার্কে। VPN দিয়ে ঢাকা, কিন্তু ফাইলগুলো একবার পেরিয়ে গেছে জর্ডানের সার্ভারে।”

অর্ঘ্য ধীরে চোখ বন্ধ করে।

“ওরা শুধু চায় CoinDrop-এর ডিলিট না হওয়া কোড। এখন আমি যদি ওদের কোড ফেরত দিই, ওরা মেঘলাকে ফিরিয়ে দেবে। না হলে ওর খোঁজও মিলবে না।”

সূর্য বলেন, “তুই বিশ্বাস করিস যে ওরা ফিরিয়ে দেবে?”

“না,” অর্ঘ্য ফিসফিস করে, “তবে আমি চাই ওরা ভাবুক আমি বিশ্বাস করি।”

কলকাতা, UNO অফিসে মেঘলা চোখ বেঁধে বসে আছে। মাথায় চোটের দাগ, গলায় জলের গ্লাসের অভাব। একজন মহিলা গার্ড তার হাতে কিছু খাবার এগিয়ে দেয়—নরম কণ্ঠে বলে, “আমরা শত্রু না। আমাদেরও আদেশ মানতে হয়।”

মেঘলা কিছু খায় না। তার মনে পড়ে সেই সময় যখন সে রিপোর্টার ছিল, তার গলায় ছিল মাইক্রোফোন, চোখে ছিল ক্যামেরার আলো। আজ শুধু অন্ধকার। অথচ তার বিশ্বাস, অর্ঘ্য আসবে।

তন্ময় সেন এখন মুখোমুখি প্রিয়ঙ্কা ধরের। হাতে তার CoinDrop-এর ব্যাকআপ কপি, যেটা সে এখন সরকারের হাতে তুলে দিতে প্রস্তুত। কিন্তু সে শর্ত রাখে।

“আমি এই ফাইল দিচ্ছি, তবে আমার দাদা যেন এই ইনফর্মেশন ব্যবহারের ফলে ট্রায়ালের আগেই মেরে না পড়ে। তাকে যেন একটা শেষ সুযোগ দেওয়া হয়।”

প্রিয়ঙ্কা তাকে কিছুক্ষণ দেখে বলেন, “তোমার দাদা কি সুযোগ পেতে চায়?”

তন্ময়ের চোখে জ্বলজ্বল করে ওঠে—

“ও পাপ করেছে, কিন্তু মরণচিন্তায় না গিয়ে redemption খুঁজছে। ও এখন কোডার না, মানুষ।”

দুবাই, GhostFork-এর হেডকোয়ার্টারে, আলী মির্জা মুখোশ পরা দশজন মেম্বারের সামনে দাঁড়িয়ে। সবাই তাদের মুখ ঢেকেছে। কাউকে কেউ চেনে না—এটাই তাদের নিয়ম।

আলী বলে, “অর্ঘ্য সেন আমাদের দেওয়া কোড নিজেই কাস্টমাইজ করে আমাদের হাতছাড়া করেছে। আজ রাতেই ওকে থামাতে হবে। আমি চাই তার মুখে গুলি নয়—তার মুখেই যেন মুখোশ চাপিয়ে দেওয়া হয়। তার সত্যিকে যেন সে নিজেই অস্বীকার করতে বাধ্য হয়।”

একজন জবাব দেয়, “আমরা মুখোশ পরে আছি, কারণ আমরা সবাই ভুল করেছি। কিন্তু তুমি তো আলী—তুমি তো পুরোটাই বিশ্বাস করো। তুমি কি মুখোশ পরো, না পরাও?”

আলী হাসে, “আমি মুখোশ পরাই, কারণ আমি জানি, মুখোশ মানুষকে মুক্তি দেয়।”

রাত ১১টা, দিল্লি।

অর্ঘ্য একটি মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠায়—
“CoinDrop Access Granted. File Encrypted @ OneTimeLink.”
লিংকটি শুধুমাত্র একবার ব্যবহারযোগ্য।

সাথে সাথেই মেসেজ আসে আলীর পক্ষ থেকে—

“She’ll be released near Jamia Metro. You’ve done the right thing.”

অর্ঘ্য জানে, এটা ফাঁদ।

সে পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট লোকেশনে। একটা কেবিনের কাছে এসে দেখে, মেঘলা নিস্তেজভাবে বসে, চোখে জল, মুখে অবিশ্বাস। পাশে দাঁড়িয়ে দুজন সশস্ত্র লোক।

“তোকে কি মেরে ফেলতে বলেছে?” অর্ঘ্য জিজ্ঞেস করে।

তারা কিছু বলে না।

ঠিক সেই সময় পেছন থেকে আসে সূর্যভান, হাতে মোবাইল ট্রিগার। একটা স্ক্রিপ্ট চালায়—GhostFork সার্ভার ডাউন করার জন্য তৈরি।

“তুই লিংক দিসনি, অর্ঘ্য। তুই শুধু ওদের ফাঁদে ফেলেছিস।”

অর্ঘ্য হাসে। “মুখোশ ভাঙতে গেলে, একবার নিজেকেও ভুলে যেতে হয়।”

মুহূর্তেই পুলিশি বাহিনী ঢুকে পড়ে, UNO, CBI, ইন্টারপোল একসাথে অ্যাসিস্ট করে। দুজন সশস্ত্র লোক বন্দি হয়।

মেঘলাকে উদ্ধার করা হয়।

অর্ঘ্য তখন তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। তার মুখে কোনো হাসি নেই, চোখে শুধু ক্লান্তি।

পরদিন খবরের কাগজে হেডলাইন

“GhostFork Crackdown: Indian whistleblower traps dark web syndicate.”
“বিটকয়েন বিলিয়নিয়ারের মুখোশ খুলে গেল।”

পর্ব ৯: ব্লকড চেইন

কলকাতা, রাত ১টা। তন্ময় সেনের ঘরের আলো জ্বলছে এখনও। সে সামনে বসে আছে তার ল্যাপটপের পর্দার দিকে, চোখ তার যেন সোজা তাকিয়ে আছে এক এমন দিকের দিকে যেখানে ফেরার পথ নেই। CoinDrop ফাইল এখন সরকারি হেফাজতে, তবু একটা ব্যাকআপ সে রেখে দিয়েছে নিজের কাছে। কেউ জানে না—এমনকি মেঘলাও না।

ল্যাপটপে একটি নতুন মেইল এসেছে:

From: admin@chainroot.to
Subject: One Last Transaction

ভেতরে লেখা:
“তোমার দাদা অনেক কিছু করেছিল, আবার অনেক কিছু করেনি। কিন্তু যে চাবিকাঠি সে আমাদের দেয়নি, সেটা তুমি দিতে পারো। বিনিময়ে—তোমার জীবন যেমন ছিল, তেমনই থাকবে। না দিলে, আমরা তোমার সব কিছু ব্লক করে দেব—একটা একটা করে। ভাবো, তোমার চেনাগুলো কেমন করে চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।”

তন্ময়ের গলা শুকিয়ে আসে। এই লোকগুলো শুধু প্রযুক্তিতে পটু নয়, এরা সম্পর্ক বোঝে, ভয় বোঝে—মানুষের দুর্বলতার কোড লেখে।

সে হাত বাড়ায় Delete বাটনের দিকে, কিন্তু ক্লিক করে না। কারণ সে জানে, ওদের ব্লকচেইন শুধু টোকেন ট্রান্সফার করে না—মানুষের মধ্যে ভয়ও ট্রান্সফার করে।

UNO হেফাজতে এখন অর্ঘ্য সেন। দিল্লির মেইন অফিসের ছোট্ট একটি কনফারেন্স রুমে তাকে রাখা হয়েছে, পেছনে গার্ড, সামনে দুজন আন্তর্জাতিক তদন্তকারী।

তারা বলে, “তুমি যদি আরেকবার GhostFork-এর সিস্টেমে ঢুকতে পারো, তাহলে আমরা চূড়ান্তভাবে ওদের সব ওয়ালেট ফ্রিজ করে দিতে পারব। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে—তুমি নিজের অ্যাক্সেস শেষ করে ফেলেছ।”

অর্ঘ্য মৃদু হেসে বলে, “আমি আমার কোডার পরিচয় মুছে ফেলেছি। এখন আমি শুধু সেই মানুষ, যে একদিন কোড লিখত।”

“তাহলে আমাদের কি কেউ দরকার আছে, যে এখনও কোড জানে?”

অর্ঘ্য চুপচাপ একটি নাম বলে—“তন্ময়।”

তদন্তকারী চোখ সরু করে বলে, “তোমার ভাই? সে তো শিক্ষক।”

“হ্যাঁ। কিন্তু ও এখন সেই একমাত্র মানুষ, যার কাছে আছে আমার শেষ চাবি। আমি শুধু শুরু করেছিলাম, কিন্তু শেষটা ওর হাতেই লেখা।”

মেঘলা এখন রাজারহাটের রেস্টহাউজে। তার চোখের নিচে কালি, মুখে ক্লান্তি, আর বুকের ভেতর হাহাকার। খবরের শিরোনামে অর্ঘ্যর নাম, কিন্তু কোথাও তার চোখের ভাষা নেই।

সে রাতের আকাশের দিকে তাকায়—জানে, ওকে আবার দেখা যাবে না। অর্ঘ্যর জীবনের চূড়ান্ত ব্লকটা দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়—সে নিজেকে মুছে দিয়েছে, শুধু অন্যদের নিরাপদ রাখতে।

ফোন বেজে ওঠে। অপরিচিত নম্বর।

ওপাশে তন্ময়। “মেঘলা, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিতে চলেছি। যদি আমি না ফিরি, জানবে, আমি চুপ থাকিনি।”

মেঘলা বসে পড়ে। “তুই আমাকে ভয় পাইয়ে দিস না। বল, কী হয়েছে?”

“GhostFork এখনও শেষ হয়নি। ওরা আমার কাছ থেকে চায় শেষ চাবিকাঠি। আর আমি দিতে চাই না।”

“তাহলে দে না পুলিশকে।”

“তাহলে তারা বুঝবে আমার কাছে আছে। আর তখন শুধু আমি না, তুই, মা, অর্ঘ্য—সবারই তালিকা বানিয়ে ফেলবে ওরা। ওরা শুধু ব্লক করে না, চেইন বানিয়ে ফেলে। তারপর এক এক করে ফাটায়।”

তন্ময় পরদিন সকালে হাজির হয় UNO অফিসে। তার হাতে পেনড্রাইভ।

প্রিয়ঙ্কা ধর সামনে বসে।

“এটা CoinDrop-এর লাস্ট টোকেন ডিরেক্টরি। এটা দিলে ওদের ওয়ালেট ফ্রিজ হবে, কিন্তু সাথেসাথেই একটা অটো-স্ক্রিপ্ট চালাবে ওদের সার্ভারে—যেটা যে কোনো নতুন ডিভাইস থেকে টোকেন রিকভারি করার চেষ্টায় ফায়ারওয়াল বাইপাস করে।”

“মানে?”

“মানে এটা দিলে GhostFork মরে যাবে, কিন্তু অন্তত দশটা ফিশিং নোড আবার তৈরি হবে। আমি চাই, আপনি শুধু ওদের না, ওদের ছায়াগুলোও ধ্বংস করুন।”

প্রিয়ঙ্কা একটু থেমে বলেন, “তুমি তোমার দাদার মতো কথা বলছ।”

তন্ময় চুপ করে বলে, “আমি তো ওর ভাই। ”

তদন্তের শেষে UNO-Interpol-এর যৌথ মিশনে GhostFork-এর ৯৭টি সার্ভার ব্লক করা হয়, ১৪টি দেশীয় ওয়ালেট বাজেয়াপ্ত, আর ৩৭ জন হ্যাকার গ্রেপ্তার।

কিন্তু অর্ঘ্য সেন মুক্ত হয় না। তাকে রাখা হয় আন্তর্জাতিক ট্রায়াল পর্যন্ত হেফাজতে—সাক্ষী হিসেবে, অপরাধী হিসেবে নয়।

এক রাতে, প্রিয়ঙ্কা ধর তাকে বলে, “তুমি চাইলে এই মুহূর্তেই বেরিয়ে যেতে পারো। কিন্তু ফিরবে কোথায়?”

অর্ঘ্য বলে, “আমি তো ফিরতেই আসিনি।”

গল্পের গতি ধীরে থেমে আসে একটা ব্লকচেইনের মতো—শেষ লেনদেন, শেষ চাবি, শেষ বিশ্বাস।

সবই থেকে যায়, শুধু একটাই ভেঙে যায়—মুখোশ।

পর্ব ১০: কেবল একটা অ্যাকাউন্ট

ছয় মাস পর, উত্তরাখণ্ড। হিমালয়ের কোল ঘেঁষে এক ছোট্ট আশ্রম। চারদিকে ঝিঁঝিঁর ডাক, বুনো পাতার গন্ধ, আর পাহাড়ে ঠাণ্ডা হাওয়া। এখানে ইন্টারনেট নেই, মোবাইল টাওয়ার নেই, নেই কোনো শব্দের অহংকার। আছে শুধু নিঃশব্দ।

আশ্রমের এক কোণে বসে আছে একদম অন্য মানুষ। মুখে দাড়ি, গায়ে হালকা ধুতি, চোখে স্থিরতা। কেউ তাকে এখন আর “অর্ঘ্য সেন” নামে ডাকে না। তিনি এখন আশ্রমবাসী “অর্ঘ্য দাস”—একজন প্রাক্তন।

কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে জানে, একদিন সে যা লিখেছিল, যা বানিয়েছিল, যা ধ্বংস করেছিল—সবই থেকে গেছে।

হঠাৎই আশ্রমের কেয়ারটেকার এসে বলে, “একটা চিঠি এসেছে, দাদা। আপনার নামে।”

অর্ঘ্য চমকে ওঠে। কেউ জানে না সে এখানে। চিঠিটা সাদা খামে, নামহীন। সে খুলে দেখে—

“তুই যেখানেই থাকিস, আমি জানি, তুই ঠিক আছিস। CoinDrop-এর শেষ ভার্সন আমি ডিলিট করে দিয়েছি। কিন্তু একটা ব্যাকআপ রেখে দিয়েছি একটা একাউন্টে। শুধু একটাই।

তুই যদি কোনোদিন ফিরতে চাস, মানুষদের জন্য কিছু করতে চাস—এই অ্যাকাউন্টটা খুলিস।

পাসফ্রেজটা তোর জীবনের একমাত্র সত্যি জিনিস—আমাদের মা’র নাম।

– তন্ময়”

অর্ঘ্যর চোখে জল এসে যায়। সে জানে, ওই একাউন্টে হয়তো লক্ষ কোটি টাকা নেই। কিন্তু আছে একটাই জিনিস—ক্ষমা। দ্বিতীয় সুযোগ।

সে উঠেই আশ্রমের পুরনো পিসি চালু করে। কোনোমতে চালু হয় একটি ওয়েব টার্মিনাল।
সে টাইপ করে—

login: coindrop.redemption.node

Enter passphrase:
সে ধীরে টাইপ করে তার মা’র নাম: “মালতীসেন”

স্ক্রিনে একটি একাউন্ট খুলে যায়—ওয়ালেট আইডি:
only1.acc.redeem

ব্যালান্স:
₹ 0.01 BTC
Last Activity: Never
Note: Use me only when you’re not running away.

অর্ঘ্যর ঠোঁটে দীর্ঘদিন পর হাসি আসে।

অন্যদিকে, কলকাতার বইমেলায় মেঘলা ঘোষ তার নতুন বইয়ের স্টলে দাঁড়িয়ে। বইয়ের নাম—“The Ghost Key”
ভিতরে প্রথম পাতায় উৎসর্গ—
“To the one who chose silence over power. You were always more human than hero.”

তন্ময় তখনই পৌঁছায়, একটা কফি হাতে। বলে, “তুই জানিস, সে আবার কোডিং শুরু করেছে। আশ্রম থেকে আঙুল নেড়ে কী সব লিখছে!”

মেঘলা বলে, “সে এখন কোড না লিখুক, গল্প লিখুক।”

তন্ময় হাসে, “হ্যাঁ, কারণ এবার তার চেনা সব ব্লক ভাঙা। শুধু একটা অ্যাকাউন্ট রেখে গেছে—ভবিষ্যতের জন্য।”

ডি.সি. প্রিয়ঙ্কা ধর এখন নতুন পদে নিযুক্ত—Interpol Southeast Asia Cyber Division হেড। তাকে কেউ একবার জিজ্ঞেস করেছিল—

“আপনি কি অর্ঘ্য সেনকে দোষী মনে করেন?”

তিনি বলেছিলেন—

“আমি তাকে দোষী বলি না। আমি বলি, সে একটা অ্যাকাউন্ট ছিল—ভুলের, দায়ের, সাহসের। এখন সেটা লগআউট হয়েছে। কিন্তু তার পাসওয়ার্ড আমরা কেউ ভুলতে পারি না।”

শেষ দৃশ্য, হিমালয়ে আবার রাত নেমেছে।

অর্ঘ্য তার জার্নাল খুলে লিখে—

“তুমি যদি কখনো ভেবো, পাপ থেকে মুক্তি নেই, মনে রেখো—প্রত্যেক ব্লকচেইনেই একটা ‘genesis block’ থাকে। আর সেটাই সব কিছুর শুরু। আমি এখন শুধু শুরু চাই।”

শেষ

1000025810.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *