অদ্রিজ লাহিড়ী
১
নতুন বছরের প্রথম সকালটা যেন অলিখিত এক দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে এল জলপাইগুড়ির ছোট্ট শহরতলি এলাকায়। চারদিকে কুয়াশার ঘন চাদরে ঢাকা, গাছের পাতা থেকে জলের ফোঁটা টুপটাপ পড়ছে, আর দূরে কোথাও একটি কাঠঠোকরার ডাক শোনা যাচ্ছে। সকাল ছ’টার সময় বাজারে যাওয়ার কথা বলে বেরিয়েছিলেন তুষার দে’র কাকা, সুশোভন দে। কিন্তু তিনি আর ফেরেননি। প্রথমে তুষার ভেবেছিল, হয়তো কাকা পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে চলে গেছেন, কিংবা ফোনের ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উদ্বেগ ঘনিয়ে আসে। কাকার মোবাইল বন্ধ, বাজারের দোকানিরা বলে, তাঁরা তাঁকে দেখেইনি। আশেপাশে খোঁজ করতে গিয়ে মা একসময় বললেন, “আবার কী ১ তারিখের সেই ব্যাপার?” — কথাটা শুনেই তুষারের বুক কেঁপে ওঠে। সে অনেকবার গুজব শুনেছে—প্রতিবছর ১ জানুয়ারি এখানে কেউ না কেউ অদৃশ্য হয়ে যায়। কেউ বলে কুয়াশায় হারিয়ে যায়, কেউ বলে ছায়ামানুষ নিয়ে যায়। কেউ পাত্তা দেয় না এসব গল্পকে, পুলিশও নয়। কিন্তু এবার তুষার সেটা নিজের চোখে দেখছে, নিজের পরিবারের একজন হারিয়ে গেছে, যেন কোনও অদৃশ্য নিয়ম মেনে।
তুষারের মাথায় তখনই একটি চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে—এই ঘটনা কি কেবল কাকতালীয়? তার এক বন্ধুও বলেছিল, তার ঠাকুরদাও একবার এমনই হঠাৎ করে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন বছর দশেক আগে, আর খোঁজ মেলেনি। এবার সে ঠিক করল, এই রহস্য খুঁজবে। স্কুলে গিয়ে সে প্রথমেই বিষয়টা বলে তার প্রিয় শিক্ষক অমিতাভ ঘোষকে। অমিতাভ স্যার ইতিহাস পড়ান, তাঁর কাছে প্রাচীন গল্প, লোককাহিনি, স্থানীয় পুরাণ খুবই আকর্ষণীয়। তুষারের কথা শুনে প্রথমে তিনি হাসেন, বলেন, “এসব কুসংস্কার বড় বেশি বিশ্বাস করলে নিজের মাথাটাই হারাবে।” কিন্তু তুষারের চোখে তখন ভয়, আবেগ আর দৃঢ়তা। “স্যার, আপনি একটা লোককে হারাতে দেখেননি নিজের চোখের সামনে… আপনি জানেন না ওটা কেমন,” এই কথায় অমিতাভ থেমে যান। রাতে বাড়িতে ফিরে তিনি নিজের দাদুর রেখে যাওয়া পুরনো ডায়েরি খুলে বসেন, যেটা বহু বছর ছোঁয়া হয়নি। পাতা উলটে এক জায়গায় তাঁর চোখ আটকে যায়—“১লা জানুয়ারি, ১৯৭৫ – রাখাল মুণ্ডা নামে একজন হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। থানায় জানালেও কিছু হয়নি। ও কি সেই ‘নতুন বলি’? আঁধারের শপথ কি ফিরে এলো?” এই শব্দগুলো দেখে তাঁর বুকের ভেতর ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যায়। তিনি তুষারকে ফোন করেন এবং বলেন, “কাল সকালে দেখা করো, আমাদের কথা বলার আছে।”
পরদিন সকালেই তুষার অমিতাভ স্যারের সঙ্গে দেখা করে। তারা দুজনে সিদ্ধান্ত নেয়—পুলিশ যদি না চায় খুঁজতে, তাহলে তারা নিজেরাই খুঁজবে। স্কুলের পর দুপুরে তারা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যায় পুরনো পঞ্চায়েত ভবনের ধারে, যেখানে নাকি এক সময় গ্রামের প্রাচীন রেকর্ড রাখা হত। স্যারের মাথায় তখনও তাঁর দাদুর লেখাগুলো ঘুরছে। হঠাৎ তুষার বলে ওঠে, “স্যার, আমি জানি এক জনের কথা, যিনি হয়তো এই অভিশাপের কথা বলতে পারবেন—কমলা বুড়ি।” অমিতাভের চোখে কৌতূহল জাগে। কমলা বুড়ির কথা তিনি শুনেছেন—লোকেরা বলে তিনি পাগল, কেউ কেউ বলে তিনি শেষ সাক্ষী। বিকেলের কুয়াশায় ঢাকা গলি ধরে তারা পৌঁছায় কমলা বুড়ির কুঁড়েঘরে, আর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় তুষার বলে, “বুড়ি মা, আপনি কি জানেন ১ তারিখে লোক কোথায় হারায়?” দরজার ফাঁক দিয়ে একটি চোখ উঁকি দেয়, তারপর ধীরে ধীরে কাঁপা গলায় উত্তর আসে—“তোমরা জানতে চাও আঁধারের শপথের কথা? তাহলে এসো, আমার গল্প শেষ হয়নি এখনও…”
২
কমলা বুড়ির ঘরের ভেতরটা ছিল অদ্ভুতভাবে সুনসান, যেন সময় সেখানে অনেক আগেই থেমে গেছে। কাঠের তাকজোড়া ভর্তি পুরনো কাচের বোতল, ছেঁড়া পাটের দড়ি, কয়েকটা শালপাতার পুঁটলি আর এক কোণে গাঁথা শুকনো ধূপকাঠির গন্ধে একটা ধোঁয়াটে বাতাস। বুড়ি লালচে চোখে তাকিয়ে বললেন, “তোমরা যা খুঁজছো, ওটা খুঁজে পাওয়া ভালো না… অনেকেই ফিরেনি, কেউ কেউ শুধু শব্দ হয়ে ফেরে।” অমিতাভ স্যার বললেন, “আপনি কী জানেন রাখাল মুণ্ডা নামে এক লোকের কথা? যিনি উধাও হয়েছিলেন বছর পঞ্চাশ আগে?” কমলা বুড়ি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তখন আমি অনেক ছোট। ওই রাখাল… মেলা থেকে ফেরার পথে শেষবার দেখা গিয়েছিল তাকে। সে কিছু একটা নিয়ে ফিরছিল, চোখে কেমন একটা জ্যোৎস্না লেগেছিল যেন। তারপর আর কেউ দেখেনি। পরদিন সকালে কেউ একজন তার নাম লিখে রেখে যায় পঞ্চায়েত ভবনের সামনে – ‘প্রথম বলি সম্পন্ন’। পুলিশ এলে কিছুই পায়নি, আর সেই থেকেই প্রতি বছর একটি করে নাম হারিয়ে যায় এই ধোঁয়াটে শীতে।” তুষার এক নিশ্বাসে শুনছিল সব কথা, যেন এই শব্দগুলোই তার কাকার ছায়া ধরে ফেলবে। হঠাৎ কমলা বুড়ি বললেন, “তোমাদের খুঁজে পেতে হলে যেতে হবে অন্তরবুনিয়া – এক হারিয়ে যাওয়া গ্রামে, যেটা মানচিত্রেও নেই আর। কিন্তু সাবধান, সে জায়গার মাটি ছায়া ধরে রাখে।” অমিতাভ ধীরে ধীরে খাতায় টুকে নিতে থাকেন প্রতিটি তথ্য, কারণ এখন এই কথাগুলো শুধু কল্পনা নয়, একটা বাস্তব খোঁজের মানচিত্র হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
তুষার সেই রাতে ঘুমাতে পারেনি। তার মাথায় তখন ঘুরপাক খাচ্ছে – ‘অন্তরবুনিয়া’ কি আসলেই কোথাও আছে? স্কুলের পুরনো ম্যাপ ঘাঁটতে গিয়ে সে দেখতে পায়, এক কোণায় ঝাপসা করে লেখা একটা নাম, যা সম্ভবত কোনও গ্রাম ছিল, এখন জঙ্গলে ঢেকে গেছে – ওই এলাকাটা কেউ আর ব্যবহার করে না। পরদিন সে স্যারের সঙ্গে স্কুল শেষে সাইকেল নিয়ে যায় পঞ্চায়েত অফিসের পেছনে, যেখানে রেকর্ডরুমে ধুলো ধরা পুরনো ফাইল ছাড়া কিছু নেই। ঘণ্টাখানেক ঘাঁটার পর হঠাৎ একটি পুরনো নথি পায় তুষার – সেখানে ছেঁড়া পাতার মধ্যে লেখা, “অন্তরবুনিয়া: সেখানকার আদিবাসী সম্প্রদায় প্রতি শীতের শেষে একটি ‘নতুন উৎসব’ করত। সেই উৎসব বন্ধ হয় ১৯৭৫ সালে, এক লোক নিখোঁজ হয়ে গেলে।” অমিতাভ চোখ মেলে তাকিয়ে রইলেন পাতাটার দিকে। “নতুন উৎসব” কথাটা যেন কিছু একটা খুলে দেয় তাঁর মনে। তিনি দাদুর ডায়েরিতে পড়েছিলেন একই লাইন, কিন্তু তখন তা কোনো নির্দোষ সামাজিক আচার বলে ভেবেছিলেন। এখন তাঁরা বুঝতে পারছেন, এই নিরুদ্দেশ হওয়া ঘটনাগুলো শুধু কুয়াশা বা কাকতাল নয়, বরং কোনো একটি ধারাবাহিক প্যাটার্ন – যার সূচনা হয়েছে অনেক আগেই, আর কেউ সেটা থামাতে পারেনি।
দুজনেই সিদ্ধান্ত নেয় এবার অন্তরবুনিয়াকে খুঁজতেই হবে। কিন্তু তার আগে দরকার আরও কিছু তথ্য – যেমন ছায়ার সেই চিহ্ন, যার কথা কমলা বুড়ি বলেছিলেন। অমিতাভ রাতের বেলা নিজের বইয়ের তাক থেকে “লোকবিশ্বাস ও উত্তরবঙ্গের ইতিহাস” নামক একটি পুরনো গবেষণা বই বের করেন, যেখানে একটি অধ্যায়ে তিনি দেখতে পান ঘূর্ণায়মান চোখের প্রতীক – যার নাম দেওয়া হয়েছে “চোখ-দ্রষ্টা”। বলা আছে, কিছু সম্প্রদায় বিশ্বাস করত এই চিহ্ন চোখে দেখার বাইরেও সব কিছু দেখতে পায় – যাকে বলত “অন্তর ছায়ার পাহারা।” এইসব তথ্য অমিতাভ ও তুষারের মধ্যে এক অদ্ভুত টান তৈরি করে – যেন তারা না চাইলেও এই কাহিনির সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে তুষার খেয়াল করে, তার কাকার মোবাইলের লোকেশন লাস্ট পিং হয়েছিল “ঘুটিয়ারডাঙ্গা” নামক এক পরিত্যক্ত গ্রামে – ঠিক অন্তরবুনিয়ার সম্ভাব্য এলাকার পাশে। কুয়াশা আরও গাঢ় হয়, আর তারা ঠিক করে, পরের অভিযান হবে ওখানেই। কিন্তু কে জানত, ওখানে গেলে তারা শুধু একটি ছায়াকে দেখবে না—দেখবে নিজেদের প্রতিধ্বনি, যা ফিরে আসবে না সহজে…
৩
তুষার ও অমিতাভের পরবর্তী গন্তব্য ছিল ঘুটিয়ারডাঙ্গা – সেই নিঃশব্দ জনপদ, যেটি অন্তরবুনিয়ার সম্ভাব্য ধ্বংসাবশেষ হিসেবে উঠে এসেছে তাদের অনুসন্ধানে। সকালে যখন তারা সাইকেল নিয়ে রওনা দেয়, চারদিক তখনও ঘন কুয়াশায় ডুবে, যেন প্রকৃতিও তাদের পথ আটকে রাখতে চায়। পথ যত এগোয়, গাছপালা ঘন হতে থাকে, রাস্তায় কাদার স্তর বাড়ে, আর মোবাইল সিগন্যাল একেবারেই উধাও হয়ে যায়। একসময় তারা পৌঁছে যায় একটি পরিত্যক্ত স্কুলঘরের সামনে – দরজা ভাঙা, জানালা ঠেলে ঢুকেছে লতাপাতা। ভিতরে ঢুকে তারা খুঁজে পায় কিছু পুরনো চকবোর্ড, ছেঁড়া নোটবুক আর এক দেয়ালের কোণায় আঁকা একটি চিহ্ন – ঘূর্ণায়মান চোখ। অমিতাভ সেটা দেখে থমকে যান। “এটা সেই প্রতীক,” তিনি ফিসফিস করে বলেন, “যেটা চোখ-দ্রষ্টার, যা শুধু বাহ্যিক দৃষ্টি নয়, আত্মার ভিতরটাও দেখে।” তুষার হাত দিয়ে দেওয়াল ছুঁয়ে দেখে, যেন কিছু অনুভব করার চেষ্টা করছে। হঠাৎ সে বলে ওঠে, “স্যার, এই স্কুলে কেউ ছিল। আমি জানি।” অমিতাভ প্রথমে ওর কথা উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু জানালার পাশে ছড়ানো মাটি দেখে তাঁর চোখ আটকে যায়—সেখানে স্পষ্ট দুটি তাজা পায়ের ছাপ।
তারা ছাপ অনুসরণ করে স্কুলঘরের পেছনে পৌঁছায়, যেখানে কুয়াশার ভিতর এক ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে ছিল—অপলক। ছায়াটি অনেক দূরে, কিন্তু তার অবস্থান এমন যে সে যেন তাদের দেখছে, না দেখে। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকার পর সেটি হঠাৎ করেই অদৃশ্য হয়ে যায় ঘন কুয়াশার ভিতর। তুষার কাঁপতে থাকে, “ওটাই কি সেই ছায়ামানুষ?” অমিতাভ কিছু বলে না, শুধু তুষারকে নিয়ে ধীরে ধীরে দূরে সরে আসে। তারা জানত না, ওদের পেছনে এখনও কেউ দেখছে, নিঃশব্দে, নিঃসাড়ে। সন্ধ্যায় ফিরে এসে তারা আবার দেখা করে কমলা বুড়ির সঙ্গে। তিনি তাদের দেখে বলেন, “তোমরা ওর চোখে পড়ে গেছো… এখন যা দেখবে, তা শুধু তোমার নয়, ওরও দেখা।” এই অদ্ভুত ভবিষ্যদ্বাণী শুনে তুষার ভীত হলেও, অমিতাভ স্থির থাকে। তিনি বলেন, “আপনি আমাদের বলুন সেই ‘আঁধারের শপথ’-এর কথা। কী ছিল তা?” কমলা বুড়ি এক নিঃশ্বাসে বলেন, “অন্তরবুনিয়ার লোকেরা বিশ্বাস করত, প্রতিটি প্রজন্মে একজনকে ছায়ার দরজায় পাঠাতে হয়। একে তারা বলত ‘আঁধারের শপথ’ – একটি অদৃশ্য অঙ্গীকার, যা ভাঙলে অভিশাপ পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়বে। প্রথম সেই শপথ দিয়েছিলেন রাখাল মুণ্ডা, কিন্ত সে হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে কেউ আর জানে না কে নিয়েছে পরবর্তী শপথ। এখন সেই হিসেব আবার পুরনো হতে চলেছে।”
এই কথা শুনে অমিতাভ ও তুষার বুঝে যায়, ঘটনাগুলো কেবল অতীতের স্মৃতি নয়, বরং একটা সময়বদ্ধ পুনরাবৃত্তি—যেটা এবার তাদের সামনে ঘটছে। তুষার চিন্তা করতে থাকে, যদি অভিশাপ সত্যি হয়, তাহলে তার কাকা কি সেই নতুন বলি? আর যদি সবটাই লোকজ কাহিনির ছায়ায় গড়া এক অপরাধচক্র হয়, তাহলে কে এর মূল কারিগর? উত্তর যাই হোক, তারা বুঝে গেছে – ঘুটিয়ারডাঙ্গার পেছনে কিছু লুকানো আছে, যার সঙ্গে যুক্ত অন্তরবুনিয়া, আঁধারের শপথ এবং সেই নিঃশব্দ ছায়ামানুষ। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, এবার তাদের খুঁজতে হবে সেই হারিয়ে যাওয়া লোকদের নাম, যারা বছরের পর বছর ১ জানুয়ারিতে অদৃশ্য হয়ে গেছে। এই তালিকার শেষে হয়তো তুষারের কাকার নাম লেখা হবে, কিংবা… হয়তো তাদের নিজের। কুয়াশা আবার জমতে থাকে জানালার বাইরে, আর প্রতিটি শ্বাস যেন হয়ে ওঠে একেকটি প্রতিধ্বনি, যার উৎস এখনও অজানা।
৪
পরদিন সকালে, কুয়াশা কিছুটা পাতলা হলেও বাতাসে ছিল চাপা আতঙ্কের গন্ধ, যেন শহরের বুকে জমে থাকা অতীত হঠাৎ করে নড়ে বসেছে। তুষার স্কুলে গিয়ে ক্লাসে মন বসাতে পারে না, তার চোখ বারবার জানালার বাইরে ছায়াময় মেঘের দিকে চলে যায়। মধ্যবেলা ছুটির পর অমিতাভ স্যারের সঙ্গে সে ফের পৌঁছে যায় পুরনো পঞ্চায়েত ভবনে। ইটসুরকি খসে পড়া ভবনটার এক কোনায় ছিল একটি তালাবদ্ধ ঘর, যেটিকে সবাই বলে “পুরনো রেকর্ড ঘর”—যেখানে বহু পুরনো ফাইল, মানচিত্র ও মৃতপ্রায় ফাইল-নথি স্তূপ হয়ে পড়ে আছে। অমিতাভ শহরের শিক্ষকের পরিচয় দেখিয়ে চাবি আদায় করেন বৃদ্ধ কেয়ারটেকারের কাছ থেকে। ঘরে ঢুকতেই ধুলোর ঝাঁঝালো গন্ধে দম আটকে আসে, ছেঁড়া কাগজ, নষ্ট রেজিস্টার আর জংধরা ফাইল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তুষার টর্চ জ্বালিয়ে কোণে কোণে খুঁজে বেড়াতে থাকে, আর অমিতাভ একেকটা আলমারি খুলে পড়ে যান ইতিহাসের গভীরে। হঠাৎ অমিতাভ এক আলমারির নিচ থেকে খুঁজে পান একটি প্রাচীন নীলচে বাঁধাই রেজিস্টার, যার প্রথম পাতায় মোটা অক্ষরে লেখা: “নাম তালিকা – স্থানান্তর ও নিরুদ্দেশ”।
তারা চোখ বুলিয়ে দেখতে থাকে নামগুলোর তালিকা – প্রথমে চোখে পড়ে কয়েকজন বার্ধক্যজনিত মৃত্যুর রেকর্ড, তারপরে হঠাৎ একটা অদ্ভুত মিল ধরা পড়ে। ১৯৭৫, ১লা জানুয়ারি – রাখাল মুণ্ডা (বয়স ২৫)। ১৯৮1, ১লা জানুয়ারি – মানিক সাঁতরা (বয়স ৩০)। ১৯৯৪, ১লা জানুয়ারি – প্রদীপ ঘোষ (বয়স ৪২)। ২০০৬, ১লা জানুয়ারি – ললিতা বিশ্বাস (বয়স ৩৫)। এবং সর্বশেষ এন্ট্রি – ২০২4, ১লা জানুয়ারি – সমীরণ নাথ (বয়স ৫৫)। অমিতাভ ধীরে ধীরে মুখ তুললেন, তাঁর কণ্ঠে একটা চাপা শ্বাস, “প্রতি কয়েক বছরে একজন, ঠিক একই দিনে, বিভিন্ন বয়সে, বিভিন্ন পেশার মানুষ, এবং পুলিশ ফাইলগুলোর কোথাও ফলো-আপ নেই।” তুষার অস্ফুট গলায় বলল, “এগুলো কি সেই আঁধারের শপথের শিকার?” অমিতাভের কপালে ভাঁজ পড়ে, “হয়তো, অথবা কেউ এই কুসংস্কারকে কাজে লাগিয়ে এই হারিয়ে যাওয়ার চক্রকে বাস্তব করে তুলেছে।”
এই তথ্য নিয়ে তারা সোজা যায় শহরের পুরনো লাইব্রেরিতে, যেখানে সংরক্ষিত আছে স্থানীয় সংবাদপত্রের পুরনো ফাইল। ১৯৭৫ সালের পত্রিকায় তারা খুঁজে পায় একটি ছোট খবর – “স্থানীয় যুবক রাখাল মুণ্ডা নিখোঁজ, শেষ দেখা গিয়েছিল নববর্ষের রাতে মেলা থেকে ফেরার সময়। পরিবার দাবি করে, ‘ছায়ামানুষ’ তাকে নিয়ে গেছে।” এর নিচে একজন প্রাচীন ইতিহাস গবেষকের মন্তব্য – “এটি অন্তরবুনিয়ার ‘নতুন উৎসব’ পুনর্জীবিত হওয়ার ইঙ্গিত হতে পারে।” এই লাইনটি পড়ে অমিতাভ থমকে যান – ইতিহাস শুধু অতীত নয়, সে যেন বর্তমানের পথও বানিয়ে দেয়। তিনি তুষারকে বলেন, “আমরা একটি পুরনো সংকেতের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছি, এবং এটি আমাদের সেই হারিয়ে যাওয়া গ্রাম, অন্তরবুনিয়ার দ্বার পর্যন্ত নিয়ে যাবে।” তখনই তুষার একটি মানচিত্র টেনে বের করে, যেখানে জঙ্গলঘেরা এলাকায় একটা বৃত্তাকার চিহ্ন দেখা যায় – কিছুই লেখা নেই, শুধু সেই ঘূর্ণায়মান চোখের প্রতীক, লাল কালি দিয়ে আঁকা। তারা বুঝে যায়, যে কেউ এটি এঁকেছে, সে জানত কী লুকানো আছে সেখানে। আর সেই জায়গায় পৌঁছাতে হলে, তাদের আবার ফিরে যেতে হবে সেই কুয়াশার ধারে – যেখানে কেবল ছায়া দেখা যায়, আলো নয়।
৫
সন্ধ্যার আলো নিঃশেষ হয়ে গেলে তুষার ও অমিতাভ হাতে টর্চ নিয়ে বেরোল অন্তরবুনিয়ার সেই ঘূর্ণায়মান প্রতীকের দিকে, যেখানে মানচিত্রে কেবল এক অচিহ্নিত দাগ ছিল। পথটি ছিল কাঠাল গাছ আর শালপাতার নিচ দিয়ে একটা সরু জঙ্গল পথ, যেখানে পা ফেললেই শুকনো পাতার চেঁচামেচি, পেছনে কোনও শব্দ নেই—তবু যেন কেউ অনুসরণ করছে এমন অনুভব। তুষার বারবার পিছন ফিরে তাকাতে লাগল, চোখের কোনায় কিছু নড়ে ওঠা ছায়া ধরতে চাইল—কিন্তু কিছুই নেই। হঠাৎ দূরে জ্বলজ্বল করতে দেখা গেল তিনটে ছোট্ট আগুনের বিন্দু, যেগুলো আসলে এক অদ্ভুত কাঠের চূড়ায় রাখা তেলজ্বলা বাতি—যেখানে কোনও বসতি নেই, কিন্তু জেগে আছে কারও ছায়া। বাতিগুলোর পাশে ছিল প্রাচীন কালো পাথরের মন্দির, অর্ধেক ধ্বংস, অর্ধেক অদ্ভুত অলঙ্করণে মোড়া, যার গায়ে খোদাই ছিল—এক চোখওয়ালা মুখ, যার জিভ বেরিয়ে, আর চুল উড়ছে বাতাসে। তুষার বলল, “এটা তো একদম সেই চোখের প্রতীকের মতো,” আর অমিতাভ নিঃশব্দে মাথা নাড়লেন, “এই মন্দিরটাই সেই উৎসস্থল।”
মন্দিরের ভেতরে ঢুকে তারা দেখতে পেল এক পুরনো রক্ষিত জায়গা—একটি তাম্রপাত্রে খোদাই করা লেখা, যেটি সম্ভবত পালযুগীয় ব্রাহ্মী লিপি। অমিতাভ মোবাইলের আলো ফেলে পড়তে লাগলেন ধীরে ধীরে—“যে নববর্ষে স্নান না করে অন্তরের সৎকার করে, সে ছায়াকে জাগায়, আর জাগ্রত ছায়া ফিরে চায় রক্ত ও স্মৃতি।” তুষার কাঁপা গলায় বলল, “অর্থাৎ প্রতি নববর্ষে কোনও না কোনও আত্মা এই ছায়ার কাছে উৎসর্গ হয়?” এরই মাঝে বাতাসের দিক বদলায়, হঠাৎ অন্ধকারের মাঝে কানে আসে একটানা বাঁশির সুর—কোনও মেলোডি নেই, কেবল এক নিঃশব্দ হাহাকার। তুষার কাঁপতে কাঁপতে বলে, “এই শব্দ আমি আগে শুনেছি, সমীরণ কাকার নিখোঁজ হওয়ার দিন রাতেও বাজছিল এটা।” তারা দুইজনেই বুঝে যায়, এই সুর শুধু সঙ্গীত নয়, এটা একটা সংকেত—যার মাধ্যমে ‘কেউ’ জানিয়ে দেয় সে উপস্থিত। মন্দিরের বেদিতে তারা দেখতে পায় একটি নীলচে কাপড়ে মোড়া কাঁসার বাক্স, যেটা খুলতেই ঝড়ের মতো বাতাস ঢুকে পড়ে, আর দূরে কোথাও শোনা যায় কারও কান্না, যেন কুয়াশার ভিতর থেকে ডেকে চলেছে অতীত।
তারা তাড়াতাড়ি বাক্সটি নিয়ে মন্দির ছাড়ে এবং পথ ধরে ফিরে আসে শহরের দিকে। কিন্তু পথটা আর আগের মতো সহজ নয়, চারপাশে ঘন কুয়াশা নেমে আসে যেন কেউ ঢেকে দিচ্ছে তাঁদের দৃষ্টিশক্তি। হঠাৎই তুষারের চোখে পড়ে—গাছের ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে আছে একটি দীর্ঘ পুরুষের অবয়ব, সাদা ধুতি আর গায়ে নেই কিছু, চোখজোড়া সম্পূর্ণ শূন্য, আর কপালে সেই ঘূর্ণায়মান চোখ আঁকা। সে একটানা তাকিয়ে থাকে তুষারের দিকে, যেন কিছু মনে করিয়ে দিতে চায়। অমিতাভ তার হাত ধরে টানতে টানতে বলে, “দেখ না, ওইটা আমাদের মনোভ্রম নয়, এটা সত্যি।” তারা দৌড়ে গিয়ে একসময় পৌঁছে যায় শহরের সীমানায়, বাতির আলোয় ছায়া মিলিয়ে যায়। কিন্তু তাদের হাতে এখন সেই কাঁসার বাক্স, যার ভিতরে রাখা এক অজানা ইতিহাস, আর এক অচিন সংকেত—যা হয়তো কেবল ছায়ার মধ্য দিয়েই বোঝা যাবে। সেই রাতে, তারা ঘরে ফিরে বাক্সটা খুলে দেখে ভিতরে রাখা একটা জীর্ণ ডায়েরি—যার প্রথম পাতায় লেখা: “অন্তরবুনিয়া, ১৯৭৪। যাত্রা শুরু করলাম এক অনিশ্চিত উৎসবের খোঁজে। যদি ফিরে না আসি, তবে জেনে রেখো—ছায়া শুধু দেখে না, অপেক্ষাও করে।”
৬
তুষার সেই রাতে ডায়েরি খুলে বসে পড়ে নিজের ঘরে, ঘড়ির কাঁটা তখন দুটো ছুঁই ছুঁই। বাইরের কুয়াশা জানালায় ঠেকে ঠেকে যেন ঢুকে পড়ছে ঘরের মধ্যে, আর ভিতরে মোমবাতির আলোয় ডায়েরির পাতাগুলো কাঁপছে ধীরে ধীরে। অমিতাভ তার পাশে বসে, চশমা পরে ডায়েরির প্রথম কয়েকটি লাইন পড়ে শোনায়—“৩১শে মার্চ, ১৯৭৪। আমরা সাতজন এলাম অন্তরবুনিয়ার মেলায়, উৎসবের কেন্দ্রে যে ঘূর্ণায়মান প্রতীক দেখা যায় তার মানে খুঁজতে। প্রথম রাতে নীলবসনা এক নারী আমাদের দেখালেন পথ, যার চোখ ছিল গাঢ় নীল, মুখ অর্ধেক ঢাকা, আর কণ্ঠ ছিল প্রায় সঙ্গীতের মতো। তিনিই প্রথম বললেন—‘ছায়া শুধু অনুসরণ করে না, একসময় নিয়ন্ত্রণও করে।’” তুষার চুপ করে শোনে, তার মন ভেতরে ভেতরে চিনচিন করে ওঠে, কারণ সেই ‘নীলবসনা নারী’র বর্ণনা হুবহু মিলে যায় তার ঘোরের স্বপ্নে দেখা নারীর সঙ্গে—যে কখনও কথা বলে না, কেবল ডাকে। ডায়েরিতে লেখা আছে সাত বন্ধুর নাম—শিবাজি, নন্দিতা, প্রবাল, রুদ্র, রিতা, সাগর ও দীপ। কিন্তু ডায়েরির শেষে লেখা আছে—“এই সাত থেকে ছয় হলো, তারপর চার, তারপর কেবল আমি। আমি মানে দীপ। আমি যদি না বাঁচি, তবে অন্তরবুনিয়াকে পুড়িয়ে দাও, না হলে ছায়া আরও শরীর চায়।”
তুষার অবাক হয়ে অমিতাভকে জিজ্ঞেস করে, “এই দীপ কি দীপঙ্কর বোস, সেই নিখোঁজ সাংবাদিক?” অমিতাভ মাথা হেঁট করে বলেন, “সম্ভব… কারণ সে-ই তো চার দশক আগে একবার অন্তরবুনিয়ার ছায়া অনুসন্ধানে গিয়েছিল আর আর কখনও ফিরে আসেনি।” হঠাৎ করে মোমবাতির আলো নিভে যায়, কেবল জানালার বাইরে কোথাও কুয়াশার ভিতর থেকে ভেসে আসে সেই বাঁশির সুর, এবার যেন একটু বেশি স্পষ্ট, যেন কাছ থেকে বাজানো হচ্ছে। তুষার এক লাফে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, বাইরে কিছু দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব হয় যেন কেউ নিচে দাঁড়িয়ে আছে আর তাকিয়ে আছে উপরে। ঠিক সেই সময় ডায়েরির ভেতর থেকে একটা ছবি পড়ে যায়—সাতজনের ছবি, সবাই হেসে আছে, তবে ছবির পেছনে লেখা: “কেবল ছায়ার দিকে তাকিও না, ছায়া যেন তোমার মধ্যে না ঢোকে।” অমিতাভ ফিসফিস করে বলে, “এটা কেবল অতীত নয়, এ এক চলমান অভিশাপ।” ডায়েরির মাঝখানে ছিল একটা ভাঁজ করা কাগজ, তাতে আঁকা এক গোলক ধাঁধা, আর তার কেন্দ্রবিন্দুতে খুদে অক্ষরে লেখা—“শূন্যে পৌঁছালেই ছায়া মিলিয়ে যায়।”
পরদিন সকালে তারা দুইজন যায় স্থানীয় গ্রন্থাগারে, পুরনো সংবাদপত্র ঘাঁটতে। একটি ১৯৭۴ সালের রিপোর্টে দেখা যায়—“অন্তরবুনিয়া মেলায় এক অজানা রোগে মৃত ৩ জন, প্রত্যেকের চোখ পাথরের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল, এবং মৃত্যুর আগে তারা সবাই বলেছিল—‘ছায়া ডাকছে।’” আরও কয়েকটা ক্লিপিংসে দেখা যায় একজন চিকিৎসক এই ঘটনাগুলো ‘মাস হিস্টেরিয়া’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তুষার জানে, এটা কোনও কল্পনা নয়। সেই রাতে আবার তুষার ঘুমোতে গেলে দেখে—সে দাঁড়িয়ে আছে এক সরু সিঁড়ির সামনে, আর সেই নারী আবার উপস্থিত, diesmal সে বলে—“তুমি খুঁজছো ভুল পথে। ছায়া চোখের বাইরে নয়, ভেতরে থাকে।” তুষার জেগে ওঠে, ঘামে ভেজা, কাঁপতে কাঁপতে ডায়েরি খুলে দেখে সেই গোলক ধাঁধা এখন যেন একটু একটু করে পাল্টে যাচ্ছে, কেন্দ্র থেকে চারপাশে ছড়াচ্ছে রেখা, ঠিক যেন কোনও জীবন্ত কিছু। অমিতাভ তার পাশে এসে বলে, “তুষার, এই খেলা আর শুধু ইতিহাস নয়, আমাদের বাস্তব এখন ছায়ার হাতে।” তারা ঠিক করে, মেলায় আবার যাবে, খুঁজবে সেই নীলবসনা নারীকে, খুঁজবে সেই বেদি, যেখানে ছায়া প্রথম কথা বলেছিল। কারণ ডায়েরির শেষ লাইনটি ছিল—“যে শেষ পর্যায়ে পৌঁছে, সে কেবল শুনে না, সে বোঝে ছায়ার ভাষা। প্রশ্ন করো, কিন্তু প্রতিধ্বনি শুনলে দৌড়াও।”
৭
মেলায় ফেরার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরদিনই তারা রওনা দেয়, যদিও অন্তরবুনিয়া তখনও সকালের হিমে মোড়া, আর বাতাসে সেই অদ্ভুত ভিজে কাঠের গন্ধ। মেলার মাঠে পৌঁছতেই তুষার অনুভব করে একটা অস্বস্তি—যেন মাঠটা পাল্টে গেছে, আগের চেনা জায়গা নয়, যেন মাটির নিচে কিছু লুকিয়ে আছে, যা প্রতিটি পায়ের শব্দে সাড়া দিচ্ছে। অমিতাভ বলে, “দেখেছো? ঘূর্ণায়মান কাঠের বেদিটা এবার একটু ত্রিভুজাকৃতির দেখাচ্ছে, আগে তো এমন ছিল না।” তুষার কিছু না বলে বেদিটার চারপাশে হেঁটে যায়, আর লক্ষ্য করে—বেদির নিচের কাঠে কেউ বা কিছু নখ দিয়ে আঁচড় কেটেছে, ইংরেজিতে লেখা—”DON’T LOOK BACK.” বেদির চারদিকে মেলা তখন জমে উঠেছে, কিন্তু আশ্চর্যভাবে কেউই যেন কাছাকাছি আসে না, যেন বেদিটাকে সবাই এড়িয়ে চলে। হঠাৎই এক বৃদ্ধা মহিলা, যার চোখ ঝাপসা কাঁচের মতো, এগিয়ে এসে বলে, “ওই বেদির নীচেই প্রথম ছায়া নামল। ওর চোখে আলো পড়লে ছায়া ব্যথা পায়… কিন্তু কেউ তো আলো নিয়ে যায় না, সবাই শুধু ছবি তোলে।”
বৃদ্ধার কথায় চমকে ওঠে তুষার। সে অমিতাভকে বলে, “ডায়েরিতে বলেছিল—ছায়া শূন্যে মিলিয়ে যায়… তবে তা কি আলোয় ঢেকে যায়?” অমিতাভ গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ে, “যদি ছায়া নিজে আলোয় তৈরি হয়, তবে সে নিজের অস্তিত্ব বোঝাতে চাইবে অন্ধকারে।” সন্ধ্যাবেলা হয়, বাতাস ভারি হয়ে ওঠে, বেদির কাছে দাঁড়িয়ে তুষার একবার পিছনে তাকায়—কেউ দাঁড়িয়ে নেই, অথচ তার ছায়া যেন দুটো। সে চোখ মুছে আবার দেখে, এবার শুধু নিজেরটাই, যেন কিছু ভুল দেখছিল। ঠিক সেই সময় বেদির নিচ থেকে উঠে আসে এক ঠান্ডা শব্দ, যেন কাঠ চাপা দেয় কারও দীর্ঘশ্বাস। তুষার নিচু হয়ে দেখে—একটা ছোট আয়না, অর্ধেক ফাটা, তাতে তার প্রতিবিম্ব অস্পষ্ট। আয়নার উল্টো পাশে খোদাই করা—“তুমি যদি দেখতে পাও, তবে ছায়াও তো তোমায় দেখে।”
রাতে ফিরে এসে তুষার ঘুমোতে চায় না। কিন্তু ক্লান্ত শরীর চোখ বুজতেই ডাকে সেই পরিচিত বাঁশির সুর। এবার সে স্বপ্নে নয়, জেগে থাকতে থাকতে শুনতে পায় সুরটা যেন তার ঘরের দরজার বাইরে। ধীরে ধীরে দরজার ছায়া লম্বা হয়, তারপর ছায়ার মধ্যে গড়িয়ে আসে এক জলের ফোঁটার শব্দ—টুপ… টুপ… টুপ। তুষার চিৎকার করে আলো জ্বালায়, কিন্তু তখন কিছুই থাকে না, শুধু মেঝেতে এক ফোঁটা নীলচে জল। সে জানে, ছায়া আর দূরে নয়, তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। পরদিন সকালে ডায়েরিতে নতুন কিছু লেখা দেখতে পায়—তাতে লেখা, “চতুর্থ স্তরে প্রবেশ করেছো। এবার তোমার নিজের ছায়াও তোমার নয়।”
অমিতাভ আর তুষার মিলে খুঁজতে থাকে পুরনো তথ্য—কে প্রথম এই ‘ছায়া’র কথা বলেছিল? তখন এক পুরনো অডিও রেকর্ডিং মেলে এক গবেষকের কণ্ঠে: “আলোক ও ছায়ার দ্বন্দ্বে মানুষ যা হারায়, তা চেতনা। ছায়া নিজে কিছু নয়, সে কেবল শূন্যের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু কেউ যদি দীর্ঘদিন তাকিয়ে থাকে সেই শূন্যের দিকে, একদিন শূন্যও তাকায় তার দিকে।” এই কথা শুনে তুষার উপলব্ধি করে—এই অভিশাপ কোনও দৈব নয়, কোনও পুরনো মনস্তাত্ত্বিক বিকৃতি হতে পারে, যা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে ছড়িয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—নীলবসনা সেই নারী কে? তিনি কি স্বপ্নের মূর্তি, না কি অতীতের কোনও রক্তাক্ত সত্য?
চ্যাপ্টারের শেষে, তুষার হঠাৎ আবিষ্কার করে তার হাতের কব্জিতে এক অদ্ভুত দাগ, যা সে আগে কখনও দেখেনি—চক্রাকারে ছায়ার মতো ঘোরানো। সে স্পষ্ট জানে, এটা তার শরীরের অংশ নয়, এটা চিহ্ন, এবং এর মানে একটাই—ছায়া তাকে বেছে নিয়েছে।
৮
তুষার চিহ্নটা আয়নায় দেখে প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারে না—কব্জির চামড়ার নিচে যেন ঢেউ খেলে যাচ্ছে, সেই চক্রাকৃতি ছায়া কখনও ঘন, কখনও ম্লান, যেন তার রক্তপ্রবাহের সাথে মিশে গেছে কোনো অদৃশ্য বিষ। অমিতাভ বলে, “এই দাগটা… এটা জেনেটিক মার্কিংও হতে পারে, বা কিছুটা শারীরিক রিয়্যাকশন—কিন্তু যদি এটা ছায়ার চিহ্ন হয়, তবে তুই এখন শুধুই দর্শক নয়, অংশ হয়ে গেছিস।” তারা দুজনে সিদ্ধান্ত নেয় আরেকবার মেলার বেদিটার নিচটা খুঁড়ে দেখবে, কারণ রাতের অডিও রেকর্ডিংয়ে শব্দ উঠেছে বেদির নিচ থেকেই, যেন কেউ ধীরে ধীরে হাঁটছিল কাঠের নীচে—নিখুঁত তিনটে ধাপে: চাপা আওয়াজ, শ্বাসের গর্জন, তারপর থেমে যাওয়া। রাত দশটার পর তারা ফের মেলার ভেতর ঢুকে পড়ে, কুয়াশায় মাঠ নিঃশব্দ। বেদির নিচটা একসময় খুলে যায়, কাঠটা সরানো মাত্র একটা গন্ধ উঠে আসে—জল মেশানো মাটি, আর তার ভেতরে প্রায় শুকিয়ে যাওয়া ছোট ছোট খোপে আটকে থাকা পুরনো আয়না, কাচ, এবং একটা চামড়ার খাম, যার গায়ে লেখা — “আলোক-অঞ্চল নিষিদ্ধ, ছায়া প্রবাহিত।”
তুষার খামটা খোলে, ভেতরে একটা পুরনো স্কেচ — একটি নারীমূর্তির, তার চোখে কোনও মণি নেই, কেবল দুটো ফাঁকা গহ্বর, আর পাশে লেখা—“যে চোখে আলো ছিল না, সে ছায়াকে জন্ম দিয়েছিল।” এটা দেখেই অমিতাভ বলে, “এই মেয়েটাই সেই ‘নীলবসনা’ হবে? ছায়ার প্রথম বাহক?” তারা স্কেচটা নিয়ে স্থানীয় জাদুঘরের রেকর্ড ঘাঁটে এবং জানতে পারে ১৯৪৮ সালে এই অঞ্চলে এক রহস্যময়ী নারী থাকতেন—নাম ছিল অদ্বিতী মুখার্জি, যিনি নিজেকে ‘ছায়া-গবেষক’ বলতেন এবং দাবি করতেন, “প্রতিটি মানুষের একটি অদৃশ্য প্রতিবিম্ব থাকে যা জন্ম থেকে মৃত্যুর মাঝে একবার ‘অস্তিত্বের ঘনত্ব’ তৈরি করে, এবং তখনই ছায়া শরীর পায়।”
তুষার বুঝতে পারে, অদ্বিতীই হয়তো সেই নারীর আদি রূপ, এবং তার গবেষণাগুলিই আজকের অভিশাপের বীজ। তারা আবার সেই ডায়েরি ঘাঁটে—তাতে এক জায়গায় লেখা, “যে দিন তুমি তোমার ছায়া ছাড়া থাকো, সে দিন ছায়া নিজের চোখে জেগে ওঠে।” হঠাৎই বৃষ্টি নামে, বিদ্যুৎ চমকে ওঠে, আর ডায়েরির পাতা ভিজে এক অদৃশ্য কালির লেখাকে প্রকাশ করে—“তিনটি স্তর অতিক্রান্ত, চতুর্থে আলো নিভে যাবে।”
রাত বাড়ে, বাতাস ভারী হয়। তুষার অনুভব করে তার ঘরের জানালা নিজে থেকেই খুলে যায়, আর বাইরের অন্ধকার থেকে ভেতরে ঢোকে একটা ঘন ছায়া, যার কোনো আকৃতি নেই, কেবল আবছা এক ঘূর্ণি। সে বুঝতে পারে, এবার আর স্বপ্ন নয়—এটা জেগে থাকা বাস্তব, আর ছায়া ঠিক এখানেই। সে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করে, কিন্তু আলো নিভে যায়। মোমবাতি জ্বালাতে গেলে দেখে, মোম নিজে থেকে গলতে শুরু করেছে—কোনও তাপ ছাড়াই।
এই ভয়াবহতার মাঝে হঠাৎ একটা সুর ভেসে আসে—বাঁশির সেই একই টান, কিন্তু এবার সেটা শুধুই বাদ্য নয়, মনে হয় কারও কণ্ঠস্বর যেন বলছে—“চোখ মেলো না… যাদের আলো থাকে না, তারা ছায়ায় গলে যায়।” তুষার চোখ বন্ধ রাখে, অনুভব করে সেই ছায়া তার গায়ে লেপ্টে আছে, তার চিন্তাগুলো কে যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে একটা গহ্বরের দিকে।
ভোরের আলো উঠতেই সব যেন স্বাভাবিক। কিন্তু এবার তুষার খেয়াল করে—তার ছায়াটা সকালবেলায় রোদ পড়ার দিকেও পড়ছে না, বরং অন্যদিকে ঘুরে গেছে, যেন নিজের পথ নিজে ঠিক করেছে। সে জানে, এই ছায়া আর তার নিজের নয়—এটা এখন অন্য কারো, বা অন্য কিছুর দখলে।
৯
তুষার রাতভর জেগে থাকে, তার ঘরে কোনও আলো জ্বলে না—হাতের টর্চ বারবার ব্যর্থ হয়, মোমবাতিগুলো নিঃশব্দে গলে যায়, আর মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করলেই স্ক্রিনে ফাঁকা চোখের মত দুইটি সাদা দাগ দেখা যায়। সে ঘরের কোনে বসে নিজের ছায়াটার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে—এখন সেটা দেয়ালে পড়ে না, মেঝেতে সরে বেড়ায়, কখনও কখনও ছায়া-ছায়া খেলায় নিজের ছায়া থেকে আরেকটা ছায়া জন্মায়। অমিতাভ এসে জানায় সে রাতে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছে—এক বিশাল থিয়েটারের মঞ্চে অদ্বিতী নামের সেই নারী দাঁড়িয়ে আছে, পেছনে একটা লাল পর্দা, আর তার সামনে সারি সারি ছায়া দর্শক—সবার চোখের জায়গায় গর্ত। সে বলছে, “আমার আলো কেড়ে নেওয়া হয়েছে, এখন আমি ছায়ার জন্মদাত্রী। যারা স্বপ্নে আমাকে দেখে, তারা আমার অঙ্গ হয়ে যায়।” তুষার জানে এবার তাকে সময়ের বাইরে গিয়ে ছায়ার উৎস খুঁজতেই হবে, নইলে এই বাস্তব ও অবাস্তবের ফারাক চিরতরে মিলিয়ে যাবে।
তারা দুজনে চলে যায় মেলাপ্রাঙ্গণের পুরনো খালের দিকে—যেটা এখন শুকিয়ে গেছে, কিন্তু স্থানীয় লোকদের বিশ্বাস, এই খাল দিয়ে এক সময় ছায়ার উৎস নেমে এসেছিল পাহাড় থেকে। অমিতাভ পুরনো মানচিত্র বের করে, যেখানে খালের উৎসস্থলে একটা পরিত্যক্ত গুহার কথা বলা আছে—গুহার নাম আলোকনিষেধ গুহা, যার প্রবেশ নিষিদ্ধ, কারণ ১৯৫০ সালে তিনজন অভিযাত্রী সেখানে ঢুকে আর ফিরে আসেনি। তারা গিয়ে পৌঁছায় সেই গুহার সামনে—অন্ধকার যেন তাদের ঢোকবার আগেই গিলে ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তুষার মৃদু কাঁপা গলায় বলে, “আমরা হয়তো এখনই ইতিহাসের ছায়ায় ঢুকছি।” তারা ভিতরে ঢোকে, কদমে কদমে নেমে যায় নিচের দিকে, মাটির গন্ধ ঘন হতে থাকে, বাতাস ভারী হয়, আর হঠাৎ তারা আবিষ্কার করে দেয়ালে খোদাই করা চক্রের মত একটা প্রতীক—ছায়া-চক্র—যার কেন্দ্রবিন্দুতে খোদাই করা ‘অ’ আর চারদিকে ছড়ানো চারটি চোখ, যাদের রেটিনা নেই, কেবল গর্ত।
তুষার ছুঁয়ে ফেলতেই সেই প্রতীক জ্বলে ওঠে, কিন্তু আলো নয়, যেন ছায়া-আলো—যা দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু যার কোনো উষ্ণতা নেই। তারা বুঝতে পারে—এই চক্রটাই একমাত্র মাধ্যম ছায়াকে ফেরানোর, কারণ এই প্রতীকের নকশা অদ্বিতীর সেই পুরনো স্কেচের সাথেই মিলে যায়। হঠাৎ পেছনে এক আওয়াজ—পাথরের ঘর্ষণ, যেন কেউ বা কিছু তাদের পিছু নিয়েছে। অমিতাভ পেছনে তাকাতেই চোখে পড়ে—একটা ছায়া, মানুষের মত, কিন্তু চলাফেরায় কোনও শব্দ নেই। তুষার বলে, “ওটা আমি নই, কিন্তু আমার মতোই লাগছে।” ছায়াটা এক পা এক পা করে এগিয়ে আসে, এবং দেয়ালে তার নিজের ছায়া পড়ে না। তারা বুঝতে পারে, এটাই সেই চতুর্থ ছায়া, যার কথা ডায়েরির পাতায় লেখা ছিল।
ছায়া এসে তাদের সামনে দাঁড়ায় এবং মুখ না থাকলেও ভেসে আসে একটি কণ্ঠস্বর, যেন সরাসরি তাদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করছে—“তোমরা আলোয় জন্মেছো, কিন্তু ছায়ার ঋণ শোধ করোনি। এখন তোমরা আলোকে বিসর্জন দিয়ে ছায়ার রক্তে স্নান করবে।” সেই মুহূর্তে গুহার মাটি ফেটে উঠে আসে লালচে ধোঁয়া, আর তুষার অনুভব করে সে একটা পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে, চারপাশে তার নিজের পুরনো স্মৃতিগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে—ছোটবেলায় মায়ের মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা, ও সেই সব স্বপ্ন যা কখনো বাস্তব হয়নি। সেই ছায়া বলে, “তোমার আলো সবসময় আমাকে আঘাত করেছে, এখন আমি তোমার আলোই গিলে নেব।”
তুষার বুঝে যায়, এই যাত্রা আর গবেষণার জন্য নয়, এটা আত্মার পরীক্ষা। সে চোখ বন্ধ করে, মনের সমস্ত আলো ছড়িয়ে দেয়, যেটুকু বিশ্বাস, যেটুকু ভালোবাসা, সব জড়িয়ে দেয় নিজের অস্তিত্বে। ছায়া পিছিয়ে যায় কিছুটা, কাঁপতে থাকে, এবং তারপর গুহার পাথরগুলো নিজের থেকেই ভেঙে পড়ে তার ওপরে। অমিতাভ তুষারকে টেনে বের করে আনে, গুহার মুখ বন্ধ হয়ে যায়, আর সেই প্রতীক, সেই ছায়া-চক্র, অদৃশ্য হয়ে যায় ধূলোর ভিতর।
তারা জানে, এই গল্প শেষ নয়। কারণ, তুষার যখন বাইরে এসে আকাশের দিকে তাকায়, দেখে একটা মেঘের ছায়া তার দিকেই তাকিয়ে আছে—চোখ নেই, মুখ নেই, কিন্তু তার অস্তিত্ব ঠিকই অনুভব করা যায়।
১০
কুয়াশার ছায়ায় মোড়া পাথরের গুহার মুখ থেকে যখন রুদ্র আর সোমেন বেরিয়ে এল, তখন তাদের চোখে ছিল এক ধরনের শান্তির আলো। পুরোনো দিনের সেই ভয়াবহ গল্পটা তারা নিজেরা ছুঁয়ে ফেলেছে, তার হাড়গোড়ে সত্যি আর কল্পনার পার্থক্য খুঁজে পেয়েছে। সেই গুহায়, যেখানে একদা বিভূতি নামের সেই ডাকঘরের কর্মচারী আত্মহত্যা করেছিল, তারা খুঁজে পেয়েছিল একটি পুরোনো ট্রাঙ্ক, যার ভেতরে ছিল তাঁর লেখা কিছু চিঠি, যেগুলো কোনোদিন পাঠানো হয়নি। সেই চিঠিগুলিতে ছিল তাঁর হতাশা, সমাজের প্রতি রাগ, এবং বিশ্বাসঘাতকতার বিষণ্ণ ইতিহাস। বিভূতির মৃত্যুর পর পরবর্তী কয়েক বছরে কিছু লোক ওই জায়গায় আত্মহত্যা করেছিল—তবে অভিশাপের মত নয়, বরং এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ছিল, যা স্থানীয় গুজব ও ভয়ের মাধ্যমে এক আত্মঘাতী বৃত্ত তৈরি করেছিল। বিভূতির জীবনের শেষ পর্বটি জেনে রুদ্র যেন অনেকটাই বদলে গেল—তার চোখে শিক্ষক সোমেন এখন শুধু শিক্ষক নন, একজন অনুসন্ধানী, যিনি সত্য খোঁজেন সাহসে ও যুক্তিতে।
এই অভিজ্ঞতার পরে স্কুলে ফিরে রুদ্র আগের চেয়ে অনেকটা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল। সোমেন স্যারের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব আরও গভীর হলো। দুজন মিলে জেলা লাইব্রেরিতে গিয়ে স্থানীয় ইতিহাস, মানসিক স্বাস্থ্য, এবং গণমনস্তত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা শুরু করল। গ্রামে গুজব ছড়ানো বন্ধ করতে তারা একটি ছোট পুস্তিকা বানাল, যেখানে ঐসব “অভিশাপ” ও “নিরুদ্দেশ” হওয়ার পিছনের বাস্তব কারণ ব্যাখ্যা করা ছিল। সোমেন সেই পুস্তিকা স্কুলে, মেলার মাঠে ও গ্রাম পঞ্চায়েতে বিলি করলেন। কেউ কেউ প্রথমে নাক সিঁটকালেও ধীরে ধীরে সত্যিটা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। এবার ১লা জানুয়ারি আসার আগে কেউ কেউ একটু দ্বিধাগ্রস্ত হলেও, গ্রামে সেই ভয় আর ছায়ার প্রভাব আগের মতো ছিল না। বছরের প্রথম সকালটি অন্যান্য দিনের মতোই কেটেছিল, কোনো অদ্ভুত ঘটনা ঘটেনি, কেউ হারিয়ে যায়নি।
বছর পেরিয়ে গেলে রুদ্র একদিন স্যারের কাছে এসে বলল, “স্যার, আমরা কী সত্যিই সবটা বুঝতে পেরেছি?” সোমেন হেসে উত্তর দিলেন, “সবটা নয়, কিন্তু যতটুকু পেরেছি, তা অনেকের বাঁচার পথ খুলে দিয়েছে।” রুদ্র জানত, কিছু প্রতিধ্বনি হয়তো থেকে যাবে—সেই গুহার দেয়ালের মাঝে, পুরোনো ট্রাঙ্কে জমে থাকা অক্ষরগুলির ছায়ায়, কিন্তু এখন সে জানে, সাহস আর যুক্তির আলোয় এগুলোর মুখোমুখি হওয়া যায়। গল্পটা এখানেই শেষ নয়—এই অভিজ্ঞতা তাকে গড়ে তুলেছে এক ভবিষ্যতের সত্য অনুসন্ধানকারী হিসেবে, যে ভয় নয়, প্রশ্ন করে, খোঁজে আর কখনো হেরে না যায়।
____




