মেঘলা রায়
পর্ব ১: সেই চিঠি
পূর্ব ক্যালকাটা কর্পোরেশনের ঘিঞ্জি কোয়ার্টার, হরিদেবপুরের বাসা। সেইখানেই প্রতিদিন ঠিক আটটায় ঘুম ভাঙে সৌম্য মিত্রর। ঘুম থেকে উঠেই বাম দিকের দেয়াল ঘেঁষে থাকা পুরনো লোহার আলমারিটা খোলে—চাবি নেই, সরাসরি তালা ভেঙে রাখা। সেই তালার ভেতরেই পুরোনো চিঠিগুলো থাকে, মায়ের লেখা, ভাইয়ের পাঠানো, কয়েকটা সরকারি চিঠি, দু-তিনটে কাটা টিকিট। কিন্তু আজ সকালটা যেন কেমন অন্যরকম। জানলা গলে ঢুকছে একরাশ ঝিরঝিরে ঠান্ডা আলো, যেটা কলকাতার চেনা আষাঢ়ে মেলে না। আর তার ফাঁক দিয়ে, ছেলেবেলায় শোনা মাধবীলতার ঘ্রাণ এসে পড়ছে বিছানার বালিশে।
হাতের প্রথম চিঠিটা হলুদ হয়ে যাওয়া খামে মোড়া। উপরে কালো কালিতে বড় বড় হরফে লেখা—সৌম্য মিত্র, কল্যাণ চক্রবর্তী রোড, হরিদেবপুর, কলকাতা—৭০০০৮২। খামের কোণে ডানদিকের পাশে কোনো ডাক তারিখ নেই, কোনো স্ট্যাম্প নেই। খামটা খোলার সময় চিঠির কাগজটা একটু চটে গেল। হাতে নিতেই সৌম্যের বুকের ভেতর এক অদ্ভুত ভারি ঠান্ডা জমাট বেঁধে উঠল।
“চতুষ্পথে অপেক্ষা করছি, ফিরে এসো। — বাবা”
তার বাবা, গগন মিত্র, নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে। পথরডাঙা নামে এক অজ পাড়াগাঁয়ে এক জমিদারবাড়ির সংস্কারের কাজে গিয়ে আর ফেরেননি। খোঁজ চালিয়েছিল পুলিশ, তার সহকর্মীরা, এমনকি স্থানীয় পত্রিকাতেও একটি অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল—“এক স্থপতির অন্তর্ধান।” কিন্তু কোনো হদিস মেলেনি। সৌম্য তখন মাত্র ছয় বছরের। মা বারবার বলে উঠতেন, “তোর বাবা পালিয়ে গেছে, বোধ হয় অন্য কারো কাছে।” অথচ সৌম্য কখনো বিশ্বাস করেনি—বাবা পালাতে পারে না, বাবা নকশা আঁকতেন, কিন্তু সম্পর্কের রেখাগুলো আঁকতেন হৃদয়ের কম্পাসে।
চিঠিটার ভাঁজে ছিল একটা ছোট্ট নীলচে কাগজের ছেঁড়া টুকরো—পুরোনো নক্সার অংশবিশেষ। এক কোণে লেখা ‘দক্ষিণ গলি’, আর এক পাশে লাল কালিতে গোল করে চিহ্নিত, একটা ছোট চতুর্মুখী মোড়। সেই গোলচিহ্নের পাশে লেখা—“চতুষ্পথে রহস্য শুরু হয় না, শেষ হয়।”
সৌম্য এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল। ভেতরের কণ্ঠ বলল, ‘এটা ঠাট্টা নয়।’ বাবা মারা গেছেন ধরে নিয়ে জীবনের এতগুলো বছর কাটিয়ে দিল সে, অথচ এখন এসে তাঁর লেখা এই অস্বাভাবিক বার্তা? কে পাঠালো? কিভাবে এল?
আলমারির নিচে রাখা স্যুটকেসটা বার করে, তিনটে জামা, একটা নোটবই, ছাঁটা পেন্সিল আর বাবার ছবি ভরে ফেলল সে। বাইরের আলো তখন আরও ঘন হয়ে উঠেছে, যেন পুরোনো কোনো প্রজেক্টরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে, পেছনে চলছে বাবা-ছেলের শেষ দেখা হওয়ার স্মৃতি।
যাত্রা শুরু হল দুপুরে। হাওড়া থেকে বাঁকুড়া লোকাল, তারপর পঞ্চমেলির কাছে এক নোনাধরা চা-স্টলে বাস বদল। রাস্তাঘাট এখনো আগের মতোই এবড়োখেবড়ো। রাস্তার ধারে জংলা বন, মাঝে মাঝে ঝোপের ফাঁকে দেখা যাচ্ছে ভাঙাচোরা মন্দির, খসে পড়া নামফলক, ঝুলন্ত দেবীর মুখ। গন্তব্য সেই পথরডাঙা, যে জায়গাটার নাম এখনও কেউ উচ্চারণ করতে চায় না।
বিকেলের আলো পড়ে আসছে যখন সে গ্রামের সীমানায় পৌঁছাল। পাকা রাস্তা ছেড়ে মাটির পথ শুরু হয়েছে, ধানক্ষেতের ফাঁকে দাঁড়িয়ে একটানা বাঁশঝাড়। সেখানে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধ, যার চোখে লাল ফ্রেমের চশমা আর মুখে কাঁপা গলা—“তোমার বাবা বলেছিলেন, একদিন তুই আসবি… তোরই মতো দেখতে ছিল।”
সৌম্য কোনো কথা না বলে বৃদ্ধের পেছনে হাঁটা লাগাল। বাঁশবনের গা ঘেঁষে গিয়ে উঠল একটা তিনমেঝে বিশাল বাড়ির সামনে—জমিদারবাড়ি। দালান ভেঙে পড়েছে, তবে কিছুর কিছুর শৃঙ্খল এখনও টিকে আছে। সামনের উঠোনে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা গাছের শিকড়ের মতো সময় ছড়িয়ে আছে।
ভেতরে ঢুকতেই কেমন একটা গন্ধ—পুরোনো পচা কাঠ, ধূপের ছাই আর, কেমন যেন পোড়া মোমবাতির। আর এক কোণে, পরিত্যক্ত ঘরের ভেতর, দেওয়ালে ঝুলছে বাবার আঁকা সেই নক্সার টুকরো—যেখানে লেখা “পথ না হারালে, পথরডাঙায় পৌঁছানো যায় না।”
সেই মুহূর্তে সৌম্য বুঝল, এই অভিযান শুধু এক নিখোঁজ বাবাকে খোঁজার নয়—এ এক বৃত্ত রচনা, যেখানে সে নিজেই এক নতুন পথিক, যাকে চারপথের ভেতর দাঁড়াতে হবে।
পর্ব ২: চার দিকের খোঁজ
ভোরবেলা ঘুম ভাঙে বাঁশপাতার ফাঁক দিয়ে ফোঁটা-ফোঁটা আলোয়। জমিদারবাড়ির মেঝেতে বিছানো ধুলোপড়া মাদুরে রাতটা কেটেছে সৌম্যর। দরজার পাশে রাখা জলপাত্রে এখনও অর্ধেক জল। পাখিদের ডাকে ভেসে আসছে নদীর শব্দ। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্য উঠছে ধীরে ধীরে—যেন এই ভাঙা দালানের ছায়ায়ও সে পৌঁছে দিতে চায় নতুন কোনো ইঙ্গিত।
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কাল সন্ধ্যার সেই বৃদ্ধ। কাঁধে একটা বস্তা ঝোলানো, চোখে অদ্ভুত এক প্রকার করুণা আর জানার আনন্দ। তার নাম চরণ পাল। গ্রামবাসীরা তাঁকে ডাকে ‘চারপথ চরণ’ বলে। কারণ শোনা যায়, গ্রামের চারটি দিক চরণ একমাত্র জানেন ভালো করে। তিনি নাকি একদিন জমিদারবাড়ির রক্ষক ছিলেন। এখন ভূতের পাহারাদার।
চরণ বলল, “এই বাড়িটা চারপথের মাঝখানে দাঁড়ানো। কিন্তু এই চারদিকের রাস্তা চাররকম — চার উপাসনার পথ, চার মৃত্যুর ইতিহাস।”
সৌম্য চুপচাপ পেন্সিল আর খাতা বের করে নোট নিতে লাগল। বাবা যেমন করতেন।
প্রথমেই তারা গেল উত্তরদিকে।
উত্তর: শ্মশানের পথ
পথটা সরু, কাঁকর বিছানো, দুইপাশে কণ্টক আর শুকনো শালপাতা। দশ মিনিট হাঁটার পর পৌঁছে গেল এক পরিত্যক্ত শ্মশানে। চরণ বলল, “এখানে এক সময় রাজা রণজিৎচন্দ্র রায় সপরিবারে দাহ হয়েছিলেন—মধ্যরাতে, হঠাৎ আগুন ধরে গিয়েছিল জমিদারবাড়িতে। তারপর থেকে এই শ্মশান আর কারো দাহস্থল নয়, শুধু শোনা যায়—জ্বলন্ত কণ্ঠস্বর।”
সৌম্যর মনে পড়ে গেল সেই শিশুকালে শোনা কাহিনি—যে আগুন পুড়িয়ে দেয় আত্মাকে, কিন্তু ছায়া বাঁচিয়ে রাখে।
দক্ষিণ: নদীর ঘাট
পরদিন সকালে তারা গেল দক্ষিণে—পথটা একটু বেশি খোলা, বেশ কিছুটা ধানখেত পেরিয়ে একটা ধু-ধু বালির প্রান্তর। সেইখানে একটা প্রাচীন ঘাট—ভাঙা সিঁড়ি, মাটির কুয়োর মতো নদীর এক খাঁজ।
চরণ বলল, “এই ঘাটে পুজো হতো নদীদেবীর। তবে একবার একজন বধূ জলে ডুবে যায়—পরে দেখা যায়, তার মুখে হাসি ছিল, চোখে ছিল আতঙ্ক। নদী তখন গায়ে জড়িয়ে নিয়েছিল ওকে।”
সৌম্য জলের দিকে তাকিয়ে দেখল, অদ্ভুতভাবে শান্ত। অথচ যেন জলের নিচে কেউ বসে আছে, তাকিয়ে আছে ফিরে আসার আশায়। তার বাবার আঁকা নকশায় এই নদীঘাটের জায়গাটা চিহ্নিত ছিল ‘বিন্দু বিন্যাসের মধ্যগগন’—এই নদীই হয়তো ছিল অতলসন্ধির চিহ্ন।
পূর্ব: মন্দিরের পথ
তৃতীয় দিনে সৌম্য গেল পূর্বদিকে। একটা দীর্ঘ, পিচঢালা রাস্তা, শেষে জঙ্গলের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে এক পোড়া মন্দির। মন্দিরের দরজার উপর শিবলিঙ্গ আঁকা, কিন্তু মূর্তি নেই। চরণ বলল, “এই মন্দিরেই প্রথম আত্মারা কথা বলেছিল গগনবাবুর সঙ্গে। তিনি এখানে একা বসতেন, রাতে ধূপ জ্বালাতেন।”
মন্দিরের ভিতর ফাঁকা। কিন্তু দেয়ালে আঁকা আছে চারটি পথের চিহ্ন—চারদিকে চারটা চক্র। প্রতিটা চক্র একেকটি রঙে আঁকা—লাল, সাদা, নীল আর কালো। চরণ কাঁপা গলায় বলে, “এই চক্র যদি একজায়গায় মেলে, তবে খোলা হয় চতুষ্পথের দরজা।”
সৌম্য মনে করল সেই পুরনো চিঠির কথা—‘পথে থেকো না, পথ দেখাও।’ বাবার শব্দ যেন প্রতিধ্বনিত হল শূন্য মন্দিরের গায়ে।
পশ্চিম: ভাটার গল্প
সন্ধে নামার আগে তারা গেল পশ্চিমের দিকে। সেখানে এক পুরোনো চুন-ভাটা। কারখানার ধাঁচের সেই জায়গাটায় এখন শুধু ধুলো, ছাই আর পোড়া ইটের স্তূপ। কিন্তু চরণ বলল, “এইখানেই সবচেয়ে বেশি লোক উধাও হয়েছে। শোনা যায়, চুনের স্তূপে গিয়ে কেউ দাঁড়ালে, তার ছায়া আর তার সঙ্গে থাকে না। সে নিজের ছায়াকে ফেলে রেখে হাঁটে।”
সৌম্য দাঁড়িয়ে দেখল নিজের ছায়া মাটিতে লম্বা হয়ে পড়েছে। সে ইচ্ছে করে একপা পেছনে সরলো—ছায়াটাও নড়ল। কিন্তু মুহূর্তের জন্য তাকে মনে হল, ছায়া নড়ার আগেই সে হাঁটছে।
চার দিক দেখা শেষ। এখন চার পথ এসে মিশে সেই মধ্যস্থলে, চতুষ্পথে। চরণ বলল, “এই চারপথ আসলে চার রকম আকাঙ্ক্ষা—ভয়, মোহ, প্রেত, অভিশাপ। তোর বাবা সেইসব আঁকতেন, কিন্তু একদিন এক আঁকা নিজেই তার উপর চেপে বসে।”
সৌম্য রাতে ঘুমোতে পারল না। বসে বসে বাবার নকশা দেখে সে বুঝল—এই চার পথের মধ্যে ভারসাম্য আছে। সে ঠিক করল—আগামীকাল সে ঠিক মাঝখানে দাঁড়াবে। চতুষ্পথে।
আর তখনই, দোতলার ঘর থেকে ভেসে এল হালকা গলার আওয়াজ—“নকশাটা উল্টো করে দেখ, সৌম্য।”
সে চমকে তাকাল। কেউ নেই। কিন্তু সেই গলা যে বাবার, তা সে জানে।
পর্ব ৩: চতুষ্পথে দাঁড়ানো
বাড়ির পিছনের ছোট্ট উঠোনে দাঁড়িয়ে সৌম্য আকাশ দেখছিল। ভোর হয়নি এখনও, তবে পূব আকাশে এক টুকরো সোনালি রেখা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। চারপাশ নিস্তব্ধ, কেবল দিগন্তরেখায় বসে থাকা পাখিদের গলা থেকে টুপটাপ শব্দ। জমিদারবাড়ির ছাদের ওপর রুক্ষ শালগাছের ডালে বসে একটা পেঁচা তার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে। এই বাড়ির ছাদ থেকে চারপথ দেখা যায়—উত্তরের শ্মশান, দক্ষিণের ঘাট, পূর্বের পোড়া মন্দির আর পশ্চিমের ভাটা। যেন পৃথিবীর চার দিক ঘিরে রেখেছে এই জায়গাকে। যেন এখানেই পৃথিবীর এক ছেদবিন্দু।
সৌম্য আজকের দিনের জন্য তৈরি। পকেটে বাবার সেই চিঠি, হাতে খাতা আর পেন্সিল। পায়ে শক্ত বুটজুতো। চরণ পাল আগেই বলে দিয়েছেন, “আজ দাঁড়াতে হবে কেন্দ্রে, একেবারে সেই জায়গায়, যেখানে চারদিকের ছায়া এসে মিশে যায়। সকালে দাঁড়ালে কিছু শোনা যায় না, দুপুরে দাঁড়ালে দৃষ্টি ঝাপসা হয়। দাঁড়াতে হবে দুপুর বারোটায়। ঠিক সেই মুহূর্তে আলো আর ছায়া সমান হয়, ঠিক তখনই খুলে যায় পথ।”
সৌম্যর মন অস্থির, কিন্তু স্পষ্ট। সে বাবাকে খুঁজতে এসেছে, কিন্তু এখন সে বুঝতে পারছে—এই খোঁজ শুধুই এক ব্যক্তির নয়, এই খোঁজ এক পরম্পরার, এক বন্ধ দরজার, যা হয়তো শুধুমাত্র একজন স্থপতির দৃষ্টিতেই খোলে।
দুপুর নাগাদ চরণ তাকে নিয়ে গেল সেই কেন্দ্রে—চারদিকে চারটি পথ এসে মিলেছে এক জায়গায়। মাঝখানে একটা পাথরের বৃত্তাকার স্তম্ভ, ঘষা-পরা, খানিকটা কালচে। মনে হয় অনেক বছর আগে কেউ একে নকশায় বসিয়ে রেখে গেছে, কিন্তু পরে কেউ তা মুছে দিতে চেয়েছে।
চরণ বলল, “এইখানে দাঁড়ালে সময় অন্যরকম চলে। যেটা তোরা ‘অতীত’ বলিস, সেটা এখানে ঢেউয়ের মতো ফিরে আসে। কান খোলা রাখবি, চোখ বন্ধ করিস না। মনে রাখিস—ছায়া যদি পালিয়ে যায়, পেছন ফিরিস না।”
সৌম্য স্তম্ভের ঠিক মাঝে দাঁড়াল। চারদিকে সূর্যরশ্মি ঢুকে পড়ছে চার কোণ থেকে, তার শরীরের চারদিকে চারটি ছায়া। মুহূর্তে মনে হল, তার চারটি মুখ—চারটি সৌম্য চারদিক থেকে তাকিয়ে আছে নিজের দিকে। পৃথিবী যেন হঠাৎ করেই নিঃশব্দ। পাখির ডাক নেই, বাতাস নেই, এমনকি নিজের নিঃশ্বাসের শব্দও যেন থেমে গেছে।
তার মাথার ভেতর ভেসে উঠল একটা শব্দ—“সৌম্য…”
সে চমকে উঠল। চারপাশে কেউ নেই। চরণ দূরে দাঁড়িয়ে, কিন্তু মুখ নিচু। আবার সেই গলা, এবার একটু স্পষ্ট—“নকশা উল্টো কর।”
সে পকেট থেকে বাবার নকশার টুকরোটা বের করল। চরণ বলেছিল উল্টো করে দেখতে। উল্টো করতেই সে যা দেখল, তাতে পায়ের নিচে জমি কেঁপে উঠল।
চারটি পথ আর তাদের সংযোগস্থলে যে বৃত্ত আঁকা ছিল, সেটা উল্টে দিলে ঠিক মানুষের মুখের ছাঁচের মতো লাগে—দুটি চোখ, একটি মুখের রেখা, এবং চারপাশে ঘূর্ণায়মান রেখা যেন চুলের মতো। এই চেহারা এক অলৌকিক মুখ, যেটা স্থাপত্য নয়, বরং এক চেতনার আকৃতি। এই নকশা কোনো জমিদারবাড়ির ডিজাইন নয়—এটা ছিল এক আত্মার চিহ্ন, এক ধরনের মানচিত্র, যা কেউ আঁকতে চেয়েছিল ভূতের মুখ।
সৌম্য আবার শুনল সেই গলা, এবার ঘাড়ের ডান দিক থেকে—“আমি অপেক্ষা করছিলাম তোর জন্য। আমি এখনও আটকে আছি।”
সে ঘুরে দাঁড়াতে চাইল, কিন্তু মনে পড়ল—পেছন ফিরলে ছায়া ফেলে যায়। সে দাঁড়িয়ে রইল। চোখের পাতা বন্ধ করল না, কিন্তু দৃষ্টি স্থির রাখল সামনের পাথরে।
এবার তার সামনে স্পষ্ট হল বাবার মুখ—আলোর ছায়ায় গঠিত এক কুয়াশাচ্ছন্ন অবয়ব। গগন মিত্র। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, কাঁধে খাতা, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। কিন্তু মুখে এক অদ্ভুত শূন্যতা। চোখের ভেতর আলো নেই, শুধুই গহ্বর।
গগন বলল, “আমি আঁকতে গিয়ে ফেঁসে গেছি। এই জায়গাটা আর শুধু স্থান নয়, এটা এক ধরণের বন্দিত্ব। আমার নকশার প্রতিটা রেখায় আমি বন্দী। যে যত গভীরে দেখে, সে তত আমার কাছে আসে। কিন্তু মুক্তি পায় না।”
সৌম্য বলল, “আপনি ফিরে যেতে চান?”
গগন বলল, “ফিরে যেতে চাই না। মুক্তি চাই। আমার শরীর নেই, কিন্তু আমার নকশা এখনো টিকে আছে। ওটাকে শেষ করতে হবে।”
সৌম্য জিজ্ঞেস করল, “কিভাবে?”
গগনের ছায়া অদৃশ্য হল। তার জায়গায় পড়ে রইল কেবল একটা শব্দ—“চতুর্থ রেখা কেটে দাও। জিনিসগুলো সরিয়ে ফেলো চারপথ থেকে। একটাও থাকলে মুক্তি হবে না। তারা খুঁজে পাবে আমাকে বারবার।”
আলো ফিকে হয়ে এল। সৌম্য ধীরে ধীরে পাথরের ওপর হাত রাখল। যেন কিছু একটা জ্বলন্ত অনুভব করল ত্বকে। চারটি পথ থেকে যেন চারধরণের ছায়া তার শরীরের দিকে এগিয়ে এল—একটা ধূপের গন্ধ, একটা পোড়া কাঠের ছাই, একটা পচা জলের নোনা গন্ধ, আর একটা সাদা ফুলের ঘ্রাণ।
চরণ ছুটে এসে বলল, “এসো এবার, সময় শেষ। ওরা ঘুমোচ্ছে না আজ। আজ ওরা জেগে উঠবে।”
সৌম্য পেছন ফিরল না। সে জানে এখন আর এই চতুষ্পথ তাকে ছাড়বে না।
পর্ব ৪: চার দিকের চার বস্তু
বিকেল ঢলে পড়েছে ধীরে ধীরে। হালকা মেঘলা আকাশ, মাঝে মাঝে একফোঁটা বৃষ্টি ঝরে পড়ে পুরনো জমিদারবাড়ির কর্দমাক্ত উঠোনে। সৌম্য একাকী বসে আছে পাথরের বেদির পাশে, হাতে খাতা আর পেন্সিল। গগন মিত্রের ছায়া যেভাবে মিলিয়ে গেল, তার মুখে যে কথাগুলি থেকে গেল, সেই বাক্যগুলো সে পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছে, নিজের কণ্ঠে, আবার নিজের কানে।
“চতুর্থ রেখা কেটে দাও… জিনিসগুলো সরিয়ে ফেলো চারপথ থেকে… একটাও থাকলে মুক্তি হবে না।”
চরণ পাল একটা পুরনো কাঠের টুল টেনে এনে বলল, “ও গুলি আসলে বস্তু নয়… স্মৃতি। আটকে থাকা ঘ্রাণ, রঙ, ছায়া—সব কিছু। যারা আটকে আছে, তাদের স্মৃতি ধরে রাখে এই চারটি বস্তু।”
সৌম্য তার বাবার আত্মার ছায়া দেখে এসেছে। সে বিশ্বাস করে। বিশ্বাস করতে শেখা মানে ভূতের গল্পে মজা পাওয়া নয়, বরং সেই মজা আর ভয় একসঙ্গে বুকের ভেতরে ঝাঁপিয়ে পড়ে যতবার নিজের ছায়াকে জিজ্ঞেস করতে হয়, “তুই আমার সঙ্গে আছিস তো?”
প্রথম বস্তু: নদীর ঘাটের নীল ফুল
পরদিন সকালে সৌম্য দক্ষিণে রওনা দিল। নদীর ঘাট, সেই বালির ধারে দাঁড়িয়ে থাকা শীতলতা। এই ঘাটের নিচে নাকি আত্মারা নামে, এমনটাই বলেছিল চরণ। সৌম্য এবার সিঁড়ি ধরে নেমে গেল একেবারে জলে। তলদেশে হাত দিল। কাদা, শেওলা আর ঠান্ডা পাথর।
তখনই আঙুলে ঠেকে গেল এক টুকরো কচি কান্ড। জলের তলায় আধা-ঢেকে থাকা একটা ছোট্ট নীল ফুল। চোখে পড়ে না, কেবল স্পর্শে ধরা পড়ে। সে ফুলটা তুলে আনল। অদ্ভুতভাবে, সেটি এখনও টাটকা। সৌম্যর মনে হল, এই ফুল একসময় তার মা তার বাবাকে দিতেন, অথবা কে জানে, বাবাই হয়তো ছেঁড়া নকশার ভাঁজে রেখে দিতেন—চিহ্ন রেখে যাওয়ার আশায়।
পানির ওপর সূর্য পড়ছে। ফুলটা তার পকেটে। নদীর তরঙ্গ কিছুটা শান্ত।
দ্বিতীয় বস্তু: ভাটার ছায়াপড়া ইট
সন্ধ্যাবেলা, সৌম্য গেল পশ্চিমে, সেই ভাটার পথ ধরে। চরণ আগে থেকে সাবধান করে দিয়েছিল—“ছায়া সঙ্গে রাখবি। যদি পেছনে পড়ে যায়, এক মুহূর্তের জন্যও থামিস না।”
ভাটার গায়ে সূর্যরশ্মি পড়েছে কৌণিক ভাবে। সৌম্য দেখল, একটা ইট, বাকিদের থেকে আলাদা। তার গায়ে দাগ পড়েছে আগুনে পোড়ার, কিন্তু সেই পোড়ার রেখাটা যেন এক নকশা। কাছে গিয়ে সে বুঝল, সেটা আসলে একটা মুখাবয়বের ছাপ—ছায়ার মতোই অস্পষ্ট, কিন্তু অনস্বীকার্য।
ইটটা তুলতে গিয়ে সে অনুভব করল, গায়ে হালকা ঝাঁকুনি। যেন কারও স্পর্শ এসে ছুঁয়ে গেল হাত। সে পেছন ফিরল না। ইটটা ব্যাগে ভরে সোজা ফিরে এল।
চরণ দেখে বলল, “তুই ওকে না দেখে ফিরে এসেছিস, এই হলো বাঁচার প্রমাণ।”
তৃতীয় বস্তু: মন্দিরের পোড়া ধূপ
পরদিন সকালে পূর্বের দিকে যাত্রা। সেই পোড়া মন্দির, গম্বুজহীন, ভিতরে শূন্যতা। সৌম্য এবার ঢুকেই দেখল—একটি কালো ধূপদানি পড়ে আছে ভাঙা মেঝের কোণে। সেখানে ধূসর ধূম্ররেখা এখনও জড়িয়ে আছে। যেন কেউ আগেই বুঝেছিল সে আসবে। যেন সেই ধূপ আগুন ছাড়াই পুড়েছে স্মৃতির আঁচে।
সৌম্য ধূপের ছাই ভরে নিল কাঁচের ছোট এক শিশিতে। তার মনে পড়ে যায়—বাবা প্রতিদিন সন্ধ্যায় ধূপ জ্বালাতেন নকশা আঁকার আগে। মা বলতেন, “এই ধোঁয়াটাই তোমার বাবার পৃথিবী। নকশার সাথে ওর সম্পর্ক এমনই।”
মন্দিরের দেয়ালজুড়ে চক্রচিহ্নগুলো অদ্ভুতভাবে গা ঝাড়া দিয়ে উঠল যেন। সৌম্য দ্রুত বেরিয়ে এল।
চতুর্থ বস্তু: শ্মশানের ছাই
এই যাত্রার শেষ ও সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পর্ব—উত্তরের শ্মশান। চরণ বলেছিল, “ছাই তুলবি, কিন্তু শব্দ শুনলে পালাস না। কেবল তুলবি, আর ফিরে আসবি। মনে রাখবি—ওরা ডাকবে, কিন্তু ওরা তুই না।”
সৌম্য পা দিল সেই শুকনো পথের ওপর। পায়ের নিচে শুকনো পাতার মচমচ শব্দ। একসময় পৌঁছাল সেই ভাঙা চিতার পাশে। ছাইয়ের স্তূপে হাত দিতেই মনে হল, গায়ে ঠান্ডা বালির স্পর্শ। অথচ গন্ধে এখনো পোড়া কাঠ, পোড়া শরীর, পোড়া সম্পর্ক।
সে ছাই ভরে ফেলল এক টিনের বাক্সে। তখনই বাতাসে এল এক ডাক—“সৌম্য…” গলার স্বর মা’র মতো, কিন্তু আরও পুরনো, আরও দূরবর্তী।
সে থামল না। সেই ছাই নিয়েই সোজা ফিরে এল।
চারটি বস্তু এখন তার কাছে—একটি নদীর নীল ফুল, একটি পোড়া ইট, একটি ধূপের ছাই, একটি শ্মশানের স্তব্ধতা। চরণ বলল, “এই জিনিসগুলোই গগনবাবুকে আটকে রেখেছে। এই বস্তুগুলো এখন চতুষ্পথের কেন্দ্রে রেখে, সেই রেখা কাটতে হবে—যেটা নকশায় আঁকা ছিল কিন্তু বাস্তবে রয়ে গেছে অদৃশ্য হয়ে।”
সৌম্য জানে—পরের দিন তার জন্য অপেক্ষা করছে সবকিছুর কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে, একটি রেখা কাটার নিষ্ঠুর সাহস নিয়ে।
পর্ব ৫: রেখা কাটার দিন
বাতাসে আজ এক অদ্ভুত ভার। সকাল থেকে আকাশ মেঘে ঢাকা। অথচ বৃষ্টি পড়ছে না। মাটির গন্ধে চাপা পড়ে আছে কিছু অজানা আগুনের ছাই। জমিদারবাড়ির চারপাশে ঘুরছে নিঃশব্দ পাখিরা, ডানা ঝাপটাচ্ছে না, ডাকছে না—শুধু উড়ছে, যেন কোনো অদৃশ্য পথ দেখিয়ে চলেছে।
সৌম্য পাথরের খোলা উঠোনে দাঁড়িয়ে চারটি বস্তু সাজাচ্ছে। দক্ষিণ থেকে আনা নীল ফুল, পশ্চিমের পোড়া ইট, পূর্বের ধূপের ছাই, আর উত্তরের শ্মশানের ধূসর স্তবক। প্রত্যেকটি সে রাখছে ঠিক সেইভাবে, যেমনটি বাবার শেষ নকশার উল্টোপিঠে নির্দেশ ছিল—চক্রাকার বিন্যাস, কেন্দ্রের চারদিকে, সমদূরত্বে। প্রতিটি বস্তুর ঠিক মাঝখানে সে বসাচ্ছে সেই পুরনো নকশাটির ক্ষতবিক্ষত টুকরো।
চরণ তার পাশে এসে দাঁড়াল। তার চোখ লাল, যেন অনেকরাত না ঘুমানো মানুষ। কিন্তু গলায় রয়েছে এক অনমনীয় বিশ্বাস—“রেখা কাটতে পারলেই তোর বাবাকে ছেড়ে দেবে এই চতুষ্পথ। তুই শেষ কর কাজটা। আমি আর কাছে যাব না।”
সৌম্য পেন্সিল বের করল। মাটি রুক্ষ, কিন্তু এই পাথরের স্তরে আগেও আঁকা হয়েছে এমন কিছু যা চোখে পড়ে না। সে সেই পুরনো রেখার চারদিকে হাত বুলিয়ে অনুভব করল অদৃশ্য এক গহ্বর, যেন ধুলোর নিচে লুকিয়ে থাকা এক সূক্ষ্ম আঁচড়, অপেক্ষায় রয়েছে আবার জাগবার।
তখনই—এক ঝলক হাওয়া। সেই হাওয়ার সঙ্গে ভেসে এল এক গলা—“থেমে যা।”
সৌম্য চমকে উঠল। চারদিকে তাকাল। কেউ নেই। কিন্তু কানে এসেছে স্পষ্ট শব্দ। সে ভাবল, এটা তার ভ্রম। এমনই সময়, সে অনুভব করল একটা ঠান্ডা হাত তার বাঁ পায়ের গোড়ালিতে ছুঁয়ে গেল। নিচে তাকিয়ে দেখল—একটি অর্ধেক ছায়া, যার মুখ নেই, কেবল দুটো হাত মাটির উপর ঘষছে, যেন কাঁপতে থাকা দাগ।
সে পেছনে তাকাল না। বাবার গলা বলেছিল—“ছায়া যদি পালিয়ে যায়, পেছন ফিরিস না।”
সৌম্য চোখ বন্ধ করে মাটিতে প্রথম রেখা কাটল—দক্ষিণের নীল ফুল থেকে শুরু করে পশ্চিমের ইটের দিকে।
আর তখনই পৃথিবী খানিক দুলে উঠল।
চারপাশ থেকে বাতাস জড়ো হতে থাকল কেন্দ্রে, আর সেই বাতাসে ভেসে উঠতে লাগল চেনা মুখ—তার ছোটবেলার ছবি, মায়ের চিৎকার, বাবার নকশা আঁকার মুহূর্ত, পুরনো চিঠি, সন্ধ্যার ধূপের ঘ্রাণ, বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া পেন্সিলের দাগ।
সে দ্বিতীয় রেখা কাটল—পশ্চিম থেকে পূর্বে। এবার একটা ছায়া দৌড়ে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। অন্ধকারে গড়া, পা নেই, চোখ নেই, কিন্তু মুখে এক অদ্ভুত আকৃতি, যেন হাসি আর কান্না মিশে গেছে।
ছায়াটি বলল, “ও আমাদের রেখে গেছে। ও নিজেই জানত না আমরা তার আঁকা আঁকিতে জন্ম নিয়েছি। তুমি আমাদের মুছে দিচ্ছ?”
সৌম্য কিছু বলল না। হাতে শক্ত করে পেন্সিলটা ধরে রেখেছে। সে জানে—এই ছায়াগুলি বাবার সৃষ্টি, কিন্তু তারা আর এখন শুধু রেখা নয়, তারা নিজের অস্তিত্ব দাবি করে।
সে বলল, “আমি কেউকেই মুছে দিচ্ছি না। আমি তোমাদের থামিয়ে দিচ্ছি।”
তৃতীয় রেখা কাটার সময় আকাশ গর্জে উঠল। প্রথমবারের মতো বৃষ্টি শুরু হল। কিন্তু সেই বৃষ্টি গায়ে এসে লাগল না—যেন একরকম গন্ধের মতো পড়ল মাটির ওপর, আর তার গায়ে এসে বয়ে গেল ঠান্ডা রক্তের মতো।
শেষ রেখা—উত্তর থেকে দক্ষিণ। সেই রেখাটা কাটার আগে সৌম্য থেমে গেল। কারণ ঠিক ওই দিকে, দাঁড়িয়ে আছে গগন মিত্র। ছায়া নয়। এবার তার মুখে আলো পড়ছে। চোখে চশমা নেই। মুখে এক বিষণ্ন প্রশান্তি।
সে বলল, “এই রেখা কাটলে আমি আর তোদের ছায়ায় ফিরতে পারব না, সৌম্য। আমি সত্যিই হারিয়ে যাব। তুই তৈরি তো?”
সৌম্যর চোখ ভিজে গেল। সে ধীরে মাথা নাড়ল। বলল, “আপনি অনেক আগেই হারিয়ে গেছেন, বাবা। এবার মুক্ত হন।”
সে শেষ রেখাটি কাটল।
চারটি রেখা এক মুহূর্তে মিলল কেন্দ্রে, আর ঠিক সেই সময় চারটি বস্তু থেকে আলাদা আলাদা আলো উঠে এল—নীল, ধূসর, কালচে আর হালকা হলুদ। আলোগুলো জড়ো হয়ে ঘূর্ণির মতো ঘুরতে ঘুরতে পাথরের ওপর জমাট বাঁধল।
তারপর হঠাৎ একঝলক হাওয়ায়, সমস্ত আলো মিলিয়ে গেল। ফুল শুকিয়ে গেল, ইট ধুলো হয়ে গেল, ধূপের ছাই উড়ে গেল আকাশে, শ্মশানের ছাই মিশে গেল মাটিতে।
গগন মিত্র আর নেই। নেই তার নকশা, নেই তার ছায়া। চতুষ্পথ এখন নিস্তব্ধ।
চরণ এসে বলল, “শেষ হল?”
সৌম্য মাথা নাড়ল। কিন্তু কিছু বলল না। তার খাতা খোলা, তাতে লেখা আছে চারটি রেখা, আর কেন্দ্রে একটা শূন্যতা। যেন একটা পৃথিবী কেটে ফেলা হল, আর তাতে এক নতুন নকশা তৈরি হয়েছে—একটা মুক্তির নকশা।
পর্ব ৬: আবার সেই চিঠি
কলকাতার আকাশেও এখন ছায়া পড়ে আছে। আগস্টের শেষ সপ্তাহ, কিন্তু বাতাসে আশ্বিনের আগমনী ধ্বনি নেই—বরং এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, এক রকম ঠাণ্ডা যেন শহরের মাঝখানেও জমে আছে। সৌম্য মিত্র ফিরে এসেছে হরিদেবপুরের বাড়িতে। ভাঙা কাঠের চেয়ারে বসে জানালার পাশে তার নকশার খাতা খোলা। সেখানে এখনও আঁকা সেই চারটি রেখা, চার দিক থেকে কেন্দ্রে এসে মিশে যাওয়া, ঠিক যেমনটা সে কাটেছিল পথরডাঙার পাথরে।
তবে একটা কষ্ট লেগে আছে ভিতরে—বাবা নেই, এখন আর কোনো ছায়াও নেই। গগন মিত্র নেই, কিন্তু তার তৈরি ছায়ার পৃথিবীটা রয়ে গেছে মনে। মাঝে মাঝে সৌম্য এখনও শুনতে পায় সেই কণ্ঠস্বর—“নকশা উল্টো কর…”
রাত ন’টা বাজে। দরজায় টোকা পড়ল। কুরিয়ারের মত নয়, বরং ঘরের ভিতর থেকে কেউ যেন ধীরে ধীরে চাপা শব্দে আঙুল ঠুকছে কাঠে। সৌম্য দরজা খুলল। কেউ নেই।
তবে মেঝেতে পড়ে আছে একটা খাম।
হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজে লেখা:
“এবার তুই দাঁড়া, চতুষ্পথে। – গগন”
তার হাত কেঁপে উঠল। কিন্তু কৌতূহল তাকে ঠেলে নিয়ে গেল খামের ভিতরে। একটি ছোট্ট কাগজ, অর্ধেক ছেঁড়া, পুরনো আঁকিবুঁকি। এবং একটি অদ্ভুত নকশা—এই নকশায় কোনও চক্র নেই, কোনও রেখা নেই। কেবল একটি দরজা। চৌকো, কালো, স্পষ্ট। দরজার ঠিক নিচে লেখা—“পথরডাঙা নয়। এ বাড়ির মধ্যেই চতুষ্পথ তৈরি হয়েছে।”
সৌম্য জানত না, এটি ঘোর, নাকি সত্যি। কিন্তু তার হৃদয়ের গভীরে ছায়ার মতই অস্থির এক প্রশ্ন উঠে এল—“তাহলে আমি ফিরেছি কোথায়?”
সে সেই রাতে ঘরজোড়া আলো জ্বালিয়ে রাখল। কিন্তু আলোও অদ্ভুতভাবে নিস্তেজ লাগছিল। দেয়ালের ধূসর ছোপে যেন কেউ বসে তাকিয়ে ছিল। মেঝেতে পা দিলেই টিকটিকির মতো শব্দ—ফোঁসফোঁস, কিছুর চলাফেরা, আবার থেমে যাওয়া।
ঘুম এল না। চোখ বন্ধ করলেই মনে হল সে এখনও চতুষ্পথের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে।
পরদিন সকালে সে তার আলমারির নিচে রাখা পুরনো ট্রাঙ্ক খুলল। বাবার রেখে যাওয়া পুরনো চিঠি, নকশা, ছবির ভাঁজ খুলে দেখল—প্রায় এক দশক আগের একটি নকশা, যেটা সে কখনও গুরুত্ব দেয়নি। সেটি ছিল তাদের এই হরিদেবপুরের বাড়ির প্ল্যান। কিন্তু এবার উল্টো করে তাকাতেই বুঝল—নিচতলা, দোতলা, সিঁড়ি, উঠোন, বারান্দা—সব মিলিয়ে গঠিত হয়েছে এক ছায়াপথ, এক ঘূর্ণায়মান প্যাটার্ন। ঠিক যেন পথরডাঙার চার পথ এখানে নিজেই জন্ম নিয়েছে। যেন চতুষ্পথ এবার এসেছে কলকাতায়।
তার খেয়াল হল—এই বাড়িটা আসলে গগন মিত্র নিজেই তৈরি করেছিলেন তার নিজের হাতে। পুরনো দালান ভেঙে এই নতুন কাঠামোটা বানিয়ে ছিলেন নিজের সময়ে, বলেছিলেন, “এটা হবে আমাদের নিরাপদ ঘর।”
কিন্তু হয়তো, সেটাই ছিল তার শেষ নকশা।
সৌম্য সিদ্ধান্ত নিল—সে আবার শুরু করবে। এবার নিজের চোখে নিজের তৈরি খাঁচা খুঁজে বের করতে হবে। চারদিকে চারটি ঘর—দোতলার চার কোণে। সে প্রথম ঘরে গেল—পূর্ব কোণে, যেখানে মায়ের বিছানাটা এখনও পড়ে থাকে। দরজা খুলতেই ধূপের গন্ধ ভেসে এল। অথচ সেখানে কোনও ধূপ ছিল না।
দ্বিতীয় ঘর—উত্তর কোণে, পুরনো স্টোররুম। দরজা ঠেলে ঢুকতেই একরাশ ছাই মেঝের কোণায়। কবে কোথা থেকে এল, জানা নেই।
তৃতীয় ঘর—পশ্চিম কোণে, তার নিজের কাজের ঘর। সেখানে টেবিলের নিচে পড়ে থাকা একটা ইটের টুকরো, যেটা সে অনেক বছর আগে এনেছিল, ভুলেই গিয়েছিল—ভাটার পাশে খুঁজে পেয়েছিল বাবা।
চতুর্থ ঘর—দক্ষিণ কোণে, যেখানে ছিল ছোট্ট বাগানঘর। তার দেয়ালে এখনো একটা শুকনো নীল ফুল গাঁথা আছে গামলার গায়ে।
সৌম্য বসে পড়ল মেঝেতে। চারটি ঘর, চারটি দিক, চারটি বস্তু—ফুল, ইট, ধূপ, ছাই।
বাবা তাকে চতুষ্পথ থেকে মুক্ত করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু সেই মুক্তি বাবার মৃত্যুর মতোই ছিল—অন্তিম, একমুখী। আর সেই মুক্তির ছায়া ফিরে এসেছে, সৌম্যর ভেতর দিয়ে তৈরি করে নিচ্ছে আরেকটি চক্র, আরেকটি কেন্দ্র।
তাহলে কি সে-ই পরবর্তী চিহ্নধারী? পরবর্তী রক্ষক?
চরণ পাল বলেছিলেন, “একজন নকশাকার যদি চতুষ্পথের মানচিত্র আঁকে, তবে সে-ই একদিন কেন্দ্রস্থলে পৌঁছায়।”
সৌম্য এবার নিজের তৈরি ঘরের নকশা নতুন করে আঁকতে শুরু করল।
আর সেই আঁকার মধ্যেই শুনতে পেল কণ্ঠস্বর—নিজের, কিন্তু যেন কারো ছায়া-মাখা কণ্ঠ—“তুই নিজেই এখন গগন মিত্র।”
পর্ব ৭: নকশার ভিতর
রাতের অন্ধকার ঘনীভূত হয়েছে এ শহরে। শহরের আলোগুলো রুগ্ণ, যেন বাতিগুলো দেরি করে নিভতে চায়, কিন্তু নিভে যাওয়া ছাড়া আর কোনও পথও খোলা নেই। সৌম্য জানালার পাশে বসে নিজের আঁকা ঘরের নকশা দেখছে—চারটি ঘর, চারটি দিক, আর তাদের কেন্দ্রস্থলে ফাঁকা রাখা একটি ছোট চৌকো অংশ। আগেও সে সেখানে কিছু আঁকেনি। আজ যেন সেই ফাঁকা জায়গাটা তাকে গিলে খেতে চায়।
সে খেয়াল করল, তার নিজের আঁকা রেখাগুলোর ভেতরেই ছড়িয়ে আছে বাবার আঁকার ছায়া। রেখার মোচড়ে, কোণের ব্যাসার্ধে, দেয়ালের গঠনগত রেখায় গগন মিত্রের চিহ্ন জেগে আছে। এ যেন কেবল বাড়ির প্ল্যান নয়, বরং এক জ্যামিতিক অভিশাপ, যা প্রজন্ম পেরিয়ে হাত বদল হয়।
সে মেঝেতে ধুপ করে বসে পড়ল। এক পাটি হাওয়াই চটি খুলে ছুঁড়ে দিল দূরে, যেন পায়ের তলা থেকে সরিয়ে দিল শহরের ধুলো। হাতের পেন্সিল তুলে কেন্দ্রে টানল এক টানা রেখা—চারটি ঘরের মধ্যবর্তী জায়গায়। এক নিমিষে মনে পড়ে গেল পথরডাঙার সেই চার রেখা, যে রেখাগুলোর ঠিক কেন্দ্রে দাঁড়ালে সময় পিছিয়ে যেত, বাতাস ঘুরে যেত বিপরীত দিকে, ছায়া থাকত শরীরের চেয়ে দ্রুতগামী।
এই বাড়ির কেন্দ্রটা ঠিক কোথায়? খাতায় আঁকা রেখার চৌকাঠ মেপে সে মেঝেতে দাঁড়াল। বারান্দা থেকে সোজা প্যাসেজে ঢুকে ঠিক মাঝখানে, যেখানে চারটে ঘরের দরজার মুখ এসে এক জায়গায় মেলে, ঠিক সেইখানে সে দাঁড়িয়ে পড়ল।
চারদিকে নিঃশব্দ। অদ্ভুতভাবে ঠান্ডা। অথচ কোনও জানালাও খোলা নেই। বাতাস ঢুকছে না, কেবল যেন শরীর থেকে কিছু বেরিয়ে যাচ্ছে চুপচাপ।
চোখ বন্ধ করতেই তার মাথার ভিতর ভেসে উঠল বাবার কণ্ঠস্বর—“ছায়া রেখ না পেছনে, ওটাই তোমার সবচেয়ে বড় নকশা।”
সে চোখ খুলে দেখল—নিজের ছায়া নেই।
মেঝের ওপর, বাতির আলো পড়ছে তার চারদিকে, কিন্তু কেবল সে একা দাঁড়িয়ে—আর কোথাও কোনও ছায়া নেই। সে একপা পেছনে এল, তারপর সামনে, বাঁদিকে ঘুরল, কিছুই নয়। ছায়া নেই।
তারপর হঠাৎ সে অনুভব করল, কারো শ্বাস তার ঘাড় ছুঁয়ে যাচ্ছে। পেছনে ঘোরার আগেই এক কণ্ঠস্বর—একেবারে তার নিজের গলার মতো—বলল, “তুই একা নোস। আমি আছি।”
সৌম্য মাথা ঘোরাল না। সে শুধু বলল, “তুমি কে?”
স্বরটা উত্তর দিল, “আমি সেই তুমি, যে সবকিছু দেখে। যে প্রতিটি নকশার রেখা ধরে সময় মেপে দেখে, কে কবে হারিয়ে গেল, কে কবে ফিরতে চাইল, কে কবে ফিরে গিয়ে নিজেকেই চিনতে পারল না।”
সৌম্য এবার বুঝতে পারল—এটা তারই প্রতিফলন, তার ভেতরের চতুষ্পথ। যে যত গভীরে যায়, সে তত নিজের কাছাকাছি আসে, এবং ঠিক সেই মুহূর্তে, নিজেকেই চিনতে পারে না।
সে বলল, “আমি এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কী করব?”
সেই কণ্ঠস্বর বলল, “তুই যদি সত্যি কেন্দ্রে পৌঁছাস, তাহলে তোকে তৈরি থাকতে হবে দায়িত্বের জন্য। এই নকশা শুধু ঘর নয়, এটা একটা দরজা। এবার তুই পাহারা দিবি। তুই হবে নতুন গগন মিত্র।”
সৌম্য কাঁপছিল। কিন্তু তার পা নড়ছিল না। সেই কণ্ঠস্বর আবার বলল, “তুই জানিস, সব নকশা আসলে এক ধরনের বন্দিত্ব। কেউ একজন সবসময় কেন্দ্র পাহারা দেয়। তোর বাবা যেমন ছিল, এবার তুই।”
তখনই ঘরের চারটি দরজা একসঙ্গে কড় কড় করে খুলে গেল। কোনও বাতাস নেই, কোনও মানুষ নেই, তবুও চার দিক থেকে শব্দ এসে পড়ল কেন্দ্রে। পূর্ব ঘর থেকে ধূপের গন্ধ, পশ্চিম থেকে পোড়া মাটি, দক্ষিণ থেকে নীল ফুলের ঘ্রাণ, উত্তর থেকে ছাইয়ের ধোঁয়া। সবকিছু মিলেমিশে এক কুয়াশার মতো চারপাশ ঢেকে ফেলল।
সৌম্য জানত, এবার তার পেছনে কিছু দাঁড়িয়ে আছে। সে ধীরে পেছনে তাকাল।
গগন মিত্র নন।
বরং, সেই তার নিজের মুখ, কিন্তু অন্ধকারে ডুবে থাকা চোখ, কাঁধে নকশার খাতা, কণ্ঠে নীরবতা।
সৌম্য তাকিয়ে বলল, “তুমি কি আমি?”
উত্তর এল, “আমি সেই তুমি, যে কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে গেছে। যে আর ফিরবে না।”
তখনই দরজাগুলো আবার বন্ধ হয়ে গেল, একসঙ্গে।
আর মেঝেতে, কেন্দ্রে যেখানে সৌম্য দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে তার ছায়া আবার ফিরে এল—কিন্তু ঠিক মাঝখান থেকে দু’ভাগ হয়ে গেছে। এক ভাগ এগিয়ে গেল পূর্বে, আরেক ভাগ পশ্চিমে।
সৌম্য বুঝতে পারল—সে আর সম্পূর্ণ নয়।
পর্ব ৮: ছায়ার খোঁজে
সৌম্য জানত না ঠিক কতক্ষণ সে কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে ছিল। দরজাগুলো আবার ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছিল—পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ—চারটি মুখ যেন একে একে নিঃশ্বাস ফেলছে। ঘরের প্রতিটি কোণ থেকে আসছিল বিভিন্ন গন্ধের মিশ্রণ—ধূপ, পোড়া ইট, নদীর কাদা, শ্মশানের ছাই। এই গন্ধগুলো সে চেনে। কিন্তু এইবার গন্ধের ভেতর লুকিয়ে আছে অন্য কিছু—এক ধরনের শূন্যতা, যে শূন্যতা অনুভব করা যায়, কিন্তু বলা যায় না।
সে এখন দাঁড়িয়ে আছে নিজের আঁকা নকশার কেন্দ্রে, কিন্তু আর নিজেকে চেনে না। কারণ তার ছায়া নেই। নেই মানে একেবারে নিঃশেষ নয়—তার ছায়া দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। একটি অর্ধেক গিয়েছে পূর্বদিকে, অন্যটি পশ্চিমে।
চরণ পাল বলেছিল, “যে কেন্দ্রে দাঁড়ায়, সে নিজের ছায়াকে দুটি রাস্তায় পাঠায়। যদি ফিরিয়ে আনতে পারে, তবে সে নিজেকে ফিরে পায়। না হলে, ছায়াহীন মানুষ কেবল চলতে থাকে, চতুষ্পথের পর চতুষ্পথ ধরে।”
সৌম্য ঠিক করল—সে এবার সেই ছায়ার খোঁজে বেরোবে।
প্রথম ছায়া: পূর্বঘরে, ধূপের জ্যামিতি
পূর্বদিকের ঘর, যেখানে আগে মা থাকতেন। সেই ঘরে একসময় সন্ধ্যাবেলা ধূপ জ্বালানো হতো। আজও সেখানে সেই ধূপের গন্ধ লেগে থাকে, অথচ কেউ এখন আর কিছু জ্বালায় না।
ঘরের মধ্যে ঢুকতেই সৌম্য দেখে—ছায়া পড়ে আছে মেঝের ওপর, কিন্তু নিজের মতো করে। সেই ছায়া মেঝের ধারে বসে নকশা আঁকছে, তারই কাঁধের ভঙ্গিতে, মাথা একটু কাত করা, ঠোঁট কামড়ানো।
সৌম্য ফিসফিসিয়ে বলল, “তুই আমি?”
ছায়াটা মাথা তোলে না। বলে, “আমি সেই তুমি, যে সবকিছু গুছিয়ে রাখতে চায়। রেখা কেটে মুছে দিতে চায় অতীত। আমি সেই আমি, যে কখনও ভুলে যেতে চায়নি—শুধু তোমার মা’র শেষ রাতটা, শেষ কথাগুলো, শেষ চুম্বন।”
সৌম্য চুপ করে। তারপর ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে যায়। বলে, “তুই ফিরবি?”
ছায়াটা বলল, “তুই কি ভুলতে পারবি?”
সৌম্য কিছু বলে না। শুধু হাঁটু গেড়ে বসে ছায়ার পাশে নিজের হাত রাখে। তারপর চোখ বন্ধ করে ভাবে সেই শেষ সন্ধ্যেটা, মায়ের মুখ, তার শ্বাসকষ্টের ধড়ফড়, গগনের অনুপস্থিতি।
মুহূর্তেই ছায়াটা গলে যায়, এসে পড়ে তার পায়ের নিচে। অর্ধেক ফিরে আসে।
দ্বিতীয় ছায়া: পশ্চিমঘরে, ভাটার ছোপে
পশ্চিমদিকের ঘরে সে ঢোকে পরের দিন সকালে। ঘরটা হল তার নিজের স্টুডিও—ক্যানভাস, স্কেল, নকশা টাঙানো দেওয়াল, বালতি ভর্তি পুরোনো পেন্সিল, অনেকগুলো ড্রাফট বাতিল করা।
সেই ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে থাকে আরেক ছায়া—একটু লম্বা, একটু বেঁকে থাকা, চোখে যেন কোনও আগুন জ্বলছে। এই ছায়া তাকে দেখে বলে, “তুই আবার এলি?”
সৌম্য বলল, “তুই আমি, না?”
ছায়াটা হেসে বলে, “না রে, আমি সেই আমি, যাকে তুই লুকিয়ে রাখিস খাতার পাতায়। আমি সেই অঙ্ক, যা ঠিক হয় না, আমি সেই রেখা যা কখনও সোজা যায় না। আমি ব্যর্থতা, আমি ভয়, আমি সব ফেলে রেখে চলে যেতে চেয়েছি।”
সৌম্য চুপ করে। তারপর বলে, “তুই তবু আমিই। ফিরবি?”
ছায়াটা বলে, “তুই কি স্বীকার করবি, যে তুই ব্যর্থ? যে তোর আঁকা সব নকশা আসলে একেকটা ধাঁধা?”
সৌম্য চোখ মেলে দেয়ালের দিকে তাকায়। সে জানে তার আঁকা নকশাগুলোর কোনোটাই পরিপূর্ণ নয়। প্রতিটিতেই কোনও না কোনও খুঁত আছে, অসমাপ্ত রেখা, ভুল পরিমাপ, কাটা অংশ।
সে এবার নিজেই বলে, “হ্যাঁ, আমি ব্যর্থ। কিন্তু এই ব্যর্থতা নিয়েই আমি চলি। এটাই আমার ছায়া।”
ছায়াটা এবার এগিয়ে আসে। ধীরে ধীরে গলে গিয়ে মিশে যায় তার শরীরের ছায়ায়।
দুটি অর্ধেক মিলে যায়।
ফিরে দেখা
রাত গভীর। বাড়ির চারটি দরজা আবার বন্ধ হয়েছে। কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে সৌম্য, সম্পূর্ণ ছায়া নিয়ে। কিন্তু সেই ছায়া আর আগের মতো নয়—ওটা এখন স্মৃতি, ব্যর্থতা, অস্বীকৃত সত্য ও কবুলের সমষ্টি। এখন সে জানে—একটি ছায়া মানে কেবল আলো-আঁধারি নয়, বরং একটি চিহ্ন, যে চিহ্ন মানুষকে বলে দেয়—সে এখনও নিজের সঙ্গে আছে।
তখনই আবার সেই কণ্ঠস্বর—
“এবার তৈরি হও শেষ রেখা কাটার জন্য, সৌম্য। সব কিছু মুছে ফেললে তবে আসল চতুষ্পথ খুলবে।”
পর্ব ৯: শেষ নকশার আগে
কলকাতার সেই পুরনো বাড়িটা আর আগের মতো লাগে না। একই দেয়াল, একই দরজা, একই কাঠের সিঁড়ি—তবু কোথাও যেন বদলে গেছে তার দিকনির্দেশ, সময়ের প্রবাহ, কিংবা বাস্তবতা। সৌম্য এখন জানে এই বাড়ি কেবল চার দেয়ালের স্থাপত্য নয়, এ এক চলমান নকশা—একটা জীবন্ত ছায়ার খাঁচা, যা গগন মিত্র একদিন নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন, আর রেখে গিয়েছিলেন এমন একটি কেন্দ্রে, যেখানে দাঁড়ালে আলো আর ছায়া একে অপরকে প্রতারিত করে।
দুটি ছায়া নিজের ভেতর ফিরিয়ে এনে সৌম্য এখন সম্পূর্ণ। কিন্তু সেই সম্পূর্ণতা তাকে শান্তি দেয় না। বরং এক অদ্ভুত উদ্বেগে ভরিয়ে তোলে। কারণ সে জানে, শেষ কাজ এখনো বাকি—শেষ রেখা কাটতে হবে। এবং সেই রেখার ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসতে হবে এমন এক দরজা, যা একবার খুললে ফিরতে হয় না।
চরণ পাল একবার বলেছিলেন, “চতুষ্পথ কেবল চারদিকে মিলে যাওয়া নয়, একরকম উত্তরণ। যার চার দিক পূর্ণ, তার জন্য মধ্যস্থলে দরজা খুলে যায়। কিন্তু সেই দরজা বন্ধও হয়ে যায় একবারেই।”
সৌম্য জানে, আজই শেষ দিন। আজ রাত বারোটার আগে তাকে আঁকতে হবে সেই নকশা—তার নিজের জীবনের পূর্ণরেখা।
প্রস্তুতি
সে তার স্টুডিও ঘরে ঢোকে, টেবিলের ওপর খাতা খুলে বসে। হাতে প্রিয় পেন্সিল, একধরনের ড্রাফ্টিং চার্ট, আর মাথায় প্রবল ঘূর্ণায়মান দৃশ্য—নদীর ঘাট, পোড়া মন্দির, ভাটা, শ্মশান, চতুষ্পথের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা বাবার ছায়া, তারপর নিজের ছায়াহীন শরীর, শেষমেশ সেই দ্বিখণ্ডিত প্রতিফলনের সম্মিলন।
সে প্রথমে আঁকে একটা বৃত্ত—তার ছোটবেলাকার ছবির মতো মুখাবয়ব, চারটি পথ বেরিয়ে যাচ্ছে চারদিকে। তারপর সে সেই পথগুলিকে রূপ দেয়—একটি ঘর, একটি নদী, একটি মন্দির, একটি শ্মশান। প্রতিটির মাঝখানে সে বসায় একটি নির্দিষ্ট বস্তু—ফুল, ধূপ, ছাই, ইট। এরপর সে কেন্দ্রে রাখে নিজের মুখের আদল, অর্ধেক আলোয়, অর্ধেক ছায়ায়।
নকশা সম্পূর্ণ। কিন্তু কিছু যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
ঠিক তখনই বাতাস ঘরের ভিতর ঘূর্ণি তোলে। জানালার কাচ কাঁপে। সৌম্য টের পায়—কেউ বা কিছু উপস্থিত হয়েছে। এবার আর কোনও কণ্ঠস্বর নয়, এবার সরাসরি সামনে দাঁড়ায় সেই পরিচিত মুখ—গগন মিত্র।
কিন্তু সে আর ছায়া নয়। এবার তার চোখে স্পষ্টতা আছে, ঠোঁটে ভাষা আছে।
সে বলল, “তুই আমার শেষ রেখা। আমি শুরু করেছিলাম, কিন্তু শেষ করতে পারিনি। তুই শেষ কর।”
সৌম্য বলল, “আমি কী আঁকছি জানি না। এটা কী? একটা ফাঁদ, নাকি মুক্তির দরজা?”
গগন মিত্র চুপ করে। তারপর মাথা নিচু করে বলল, “দুই-ই। এই নকশা সেই ছায়াদের বিদায় দেবে, কিন্তু তোকেও ছেড়ে দেবে না।”
সৌম্য এবার বোঝে—শেষ রেখা কাটার অর্থ কেবল এক আত্মার মুক্তি নয়, বরং নিজেকেও বিলিয়ে দেওয়া এই নকশার ভিতরে। যেন প্রতিটি স্থপতির শেষ নকশা নিজেরই প্রতিচ্ছবি।
সে এবার ছুরি হাতে তুলে রাখে খাতার উপরে। বৃত্তের কেন্দ্রে কাটে একটি হালকা আঁচড়, একবারে উপরের থেকে নিচে, মুখের মাঝ বরাবর। যেন নিজেরই মুখ কাটল। সেই মুহূর্তেই নকশার কাগজে ছড়িয়ে পড়ে একরকম অদ্ভুত রেখা, যেটা সে আঁকেনি। সেই রেখা কাগজ থেকে মেঝেতে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে—পাথরের ফাঁক, দেওয়ালের গায়ে, জানালার ফ্রেম ধরে সে চলে যায় বাড়ির মাঝখানে।
ঘর হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে যায়। বাতি নিভে যায় একে একে। কেবল কেন্দ্রে জ্বলতে থাকে মোমের মতো এক রেখা।
দরজার সন্ধান
সৌম্য ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বেরোয়। সেই রেখা অনুসরণ করে চলে যায় বাড়ির কেন্দ্রে, যেখানে চারটি ঘরের দরজা এসে মেলে। সেখানেই মেঝেতে দেখা যায় ছোট্ট একটা দরজা, যেন আঁকা নয়, কাটা—ছ’ইঞ্চির মতো লম্বা, অথচ তাতে আলো পড়ে যেন অন্তহীন।
গগন মিত্র আবার বলে ওঠে, “এই দরজা একবারই খোলে। যেদিন কেউ তার সমস্ত রেখা চিনে ফেলে, সেদিন সেই কেন্দ্র খুলে যায়। তুই যেতে পারিস, চাইলে। কিংবা, পাহারা দিতে পারিস।”
সৌম্য দাঁড়িয়ে থাকে। ভেতরে হাহাকার, পেছনে ছায়ার ভিড়। সামনে দরজা, আর তার ওপারে অজানা।
সে ভাবতে পারে না, শুধু বলে, “আপনি কি গেছেন?”
গগন মিত্র মাথা নাড়ে। “আমি আটকে ছিলাম। তুই মুক্ত করেছিস। এখন আমার জায়গায় তুই।”
সৌম্য হাঁটু গেড়ে বসে। মেঝেতে হাত রাখে। দরজার গা ঘেঁষে শ্বাস নেয়। এরপর চোখ বন্ধ করে, ধীরে বলে—
“এই নকশা এবার আমার নয়। এর মালিক আমি হব না। এর রক্ষক হব।”
দরজাটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। গগন মিত্র মিশে যায় দেওয়ালের ছায়ায়। নকশা নিঃশেষ হয়ে যায় আলোয়।
পর্ব ১০: পথরেখার শেষে
এক বছর পেরিয়ে গেছে।
হরিদেবপুরের সেই পুরনো বাড়িটার রঙ এখন আরও ফিকে, আরও ধুলো ধরা, যেন এক ঝাপসা ফ্রেমে রাখা প্রাচীন ছবি। জানালার গ্রিলে লতা উঠেছে, ছাদে ফাটল ধরেছে, সিঁড়ির ধাপে ক苛ু হেলান দিয়ে পড়ে আছে ধুলো জমা পেন্সিল — এক সময়ের স্থপতির প্রিয় অস্ত্র।
লোকেরা বলে, বাড়িটা ফাঁকা। মাঝে মাঝে নিচতলার বারান্দায় আলো জ্বলে ওঠে রাত একটার সময়, অথচ ভেতরে কাউকে দেখা যায় না। এক-একটা দরজা খুলে যায় নিজে থেকেই, আবার বন্ধ হয়ে যায় বিনা বাতাসে। যারা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়, তারা বলে, “ওখানে কেউ আছে, একজন… একা থাকে, কথা বলে না, শুধু ঘোরে। মাঝে মাঝে তাকে দেখি, জানালার পেছনে দাঁড়িয়ে।”
কিন্তু কেউ জানে না—সেই কেউ আর কোনও শরীর নয়।
সৌম্য মিত্র এখন আর একটি মানুষ নয়, বরং একটি ছায়ার রক্ষক, একটি নকশার কেন্দ্রে আটকে থাকা পাহারাদার।
বাড়ির ভেতর
ভেতরে চারটি ঘর আগের মতোই আছে—পূর্বের ধূপের গন্ধ, পশ্চিমের পোড়া ইটের ছোপ, দক্ষিণে শুকিয়ে যাওয়া নীল ফুলের ছায়া, আর উত্তরে জমাট ধুলোর স্তূপে ছাইয়ের রেখা। মাঝখানে সেই ছোট্ট দরজা, যেটা আর খোলে না, কেবল আলো ফেলে রাখে নিরবতার মতো।
সৌম্য দিনের বেলা দেখা যায় না। কিন্তু রাত হলেই সে ঘরে ঘরে হেঁটে বেড়ায়। দেয়ালের গায়ে হাত রাখে। পুরনো নকশার রেখাগুলোতে আঙুল ছুঁইয়ে দেখে, কোন রেখাটা ভুল ছিল, কোনটা অসমাপ্ত।
সে আর কোনও নতুন নকশা আঁকে না। তার সামনে রাখা পুরনো খাতাগুলোর পাতা উল্টে যায় বাতাসে, কিন্তু তাতে আর কোনও রেখা যোগ হয় না। কারণ এই বাড়ির সব রেখা পূর্ণ হয়েছে।
একদিন দরজার বাইরে
একদিন দুপুরে দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। তিনটে টোকা। সৌম্যর মতোই নিঃশব্দ, ধৈর্যশীল। বাড়ির ছায়াগুলো মুহূর্তে স্থির হয়ে গেল। যেন এক নতুন রেখা ফুটে উঠল পুরনো দেওয়ালে। দরজার গায়ে তখন পড়ে এক দীর্ঘ ছায়া, যেটা ভেতরের আলোকে চাপে না, বরং চুম্বকের মতো টেনে আনে।
সৌম্য বারান্দার কোণে দাঁড়িয়ে দেখল—একটা বাচ্চা মেয়ে, হাতে আঁকার খাতা, কাঁধে কাপড়ে মোড়া কাঠি আর স্কেল। তার চোখে সেই একই দৃষ্টি—যে দৃষ্টিতে গগন মিত্র একদিন বাড়ি বানিয়েছিল, আর যেভাবে সৌম্য নিজের ছায়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল।
মেয়েটি বারবার চিঠির খামটা দেখছে। ওপরে লেখা:
“সৌম্য মিত্র, ৩/১ কল্যাণ চক্রবর্তী রোড, হরিদেবপুর, কলকাতা—৭০০০৮২”
প্রেরক: অজানা
পেছনে ছোট হরফে: ‘চতুষ্পথে দাঁড়াও।’
সে চিঠিটা রেখে যায় দরজার ফাঁকে। তারপর একটু দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ পেছন ফিরে চলে যায়। কিন্তু মেঝেতে পড়ে থাকে তার পায়ের ছাপ—চারটি রেখা তৈরি করেছে। চারটি দিক থেকে এগিয়ে গেছে কেন্দ্রে।
সৌম্য নিচু হয়ে চিঠিটা তোলে। খুলে দেখে, ভেতরে একটি কাগজ। শুধু একটি বাক্য:
“নতুন নকশার জন্য অপেক্ষা করছি।”
শেষ প্রতিফলন
রাত বারোটায় সৌম্য আবার সেই কেন্দ্রে দাঁড়ায়। দরজার ওপরে হালকা আলোর রেখা। হাতে নিজের খাতা, যদিও জানে, নতুন নকশা সে নয় আঁকবে। এখন সে কেবল পাহারা দেবে—নতুন আঁকাকে, নতুন ছায়াকে, যাকে পথ দেখিয়ে দিতে হবে।
সে দেয়ালের গায়ে লিখে ফেলে নতুন একটি বাক্য:
“এখানে দাঁড়াও, যদি নিজেকে খুঁজে পাও।”
এরপর আলো নিভে যায়।
শেষ লাইন
চতুষ্পথে আজও দাঁড়িয়ে কেউ।
তাকে দেখা যায় না। কিন্তু সে দেখছে সবাইকে।
একজন গেল, আর একজন অপেক্ষা করছে।
এই গল্পটা হয়তো আজ শেষ,
কিন্তু এই কেন্দ্র—
চিরকাল খোলা।
শেষ