Bangla - প্রেমের গল্প

চিঠির শহর

Spread the love

ঈশিতা ঘোষ


পর্ব ১

একটা অদেখা শহরের নাম

কলেজ স্ট্রিটের শেষ মাথায় একটা ছোট কফির দোকান ছিল, যার নাম মনে নেই অর্ণবের। এমনকি তার বাইরের নামফলকটাও আজ মনে করার চেষ্টা করলে, চোখের সামনে শুধু ফ্যাকাশে হলদে রঙটা ভেসে ওঠে। তবু, সেই কফির গন্ধ, টেবিলের কাঠের দাগ, আর এককোণে বসে থাকা মেঘলার চোখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকার মুহূর্তগুলো অর্ণবের স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল।

মেঘলা তখন সদ্য রেডিওতে কাজ পাওয়া এক স্বপ্নবিলাসিনী, আর অর্ণব তখন কবিতা লেখার ভান করে। তারা কেউই তখন জানত না, চিঠির যুগটা শেষ হতে চলেছে।

সে সময় ফোন ছিল, ঠিকই, কিন্তু মেঘলা বলত — “কল করে বললে কথাটা থাকেনা, হারিয়ে যায়। লিখলে জমে থাকে, কাগজ জানে ধরে রাখতে।”
অর্ণব হাসত। সে বিশ্বাস করত, মেঘলা এমন সব কথা বলে শুধু মেঘলা হওয়ার জন্যেই।

তারা চিঠি লিখত। সত্যিকারের কাগজে, হাতের লেখায়। শহরের ভেতর একে অপরের ঠিকানা থাকলেও, তারা মেইল করে না, পোস্ট করত। সময় নিয়ে, শব্দ বেছে, ছেঁড়া খামে পুঁথির মতো অনুভূতি ভরে রাখত তারা।

একবার এক চিঠিতে মেঘলা লিখেছিল —
“তুই জানিস, শহর আসলে কেবল রাস্তা আর বাড়ি দিয়ে তৈরি হয় না। শহর তৈরি হয় অপেক্ষায়, সেই মুহূর্তগুলোর ভেতর দিয়ে, যা আর কখনও ফিরে আসে না। তুই যদি কোনোদিন চলে যাস, আমি একটা শহর বানিয়ে রাখব, শুধুই তোর নামে।”

অর্ণব সেই চিঠিটার উত্তর দিতে পারেনি। সময়ের কোনো অলস মুহূর্তে হয়তো সে ভেবেছিল — “এই কথার উত্তর দরকার নেই।”

তারপর হঠাৎ একদিন মেঘলা উধাও হয়ে গেল।

একটি চিঠি এল, কলকাতার বাইরে কোথাও থেকে — নামহীন, জায়গাহীন। খামে ছিল শুধু একটি লাইন —
“এবার আমি হারিয়ে যেতে চাই, অর্ণব। ফিরে এসো যদি কখনো, আমি থাকব ওই চিঠির শহরে।”

তারপর কেটে গেছে কুড়ি বছর।

অর্ণব এখন মফস্বলের কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক। ছাত্রদের চোখে একরকম উদাসীন, কবিতায় বিশ্বাসী, ব্যতিক্রমী মাস্টারমশাই। কিন্তু তার ডেস্কের নিচে, একটা পুরনো টিনের বাক্সে, আজও যত্নে রাখা আছে সেই সব চিঠি — ধুলো ধরা, হলদেটে কাগজে মেঘলার হাতের লেখা।

আজ সকালে, তার অফিসে এসে হাজির এক বৃদ্ধ ডাকঘরের কর্মচারী।

“আপনার নামে একটা চিঠি ছিল। বহুদিন আগের। পোস্ট অফিস বন্ধ হচ্ছে তো, সব ফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে পেলাম। আপনার নাম লেখা, ঠিকানাও মিলল।”

অর্ণব প্রথমে ভেবেছিল হয়তো ভুল। কিন্তু খামটা হাতে নিয়ে কাঁপে উঠেছিল তার আঙুল।

লেখা ছিল —
To: Arnab Ray
C/o: Department of English
Ballyganj College, Kolkata – 700019

তারপর শুধু একটা লাইন —
“যদি কখনও খুব দেরি হয়ে যায়, তাও জানবে আমি অপেক্ষা করি।”

খামের মধ্যে ছিল একটা ছোট চিরকুট, আর একচিলতে কাগজ।

চিরকুটে লেখা —
“তুই যদি আবার কখনও কফির গন্ধে ফিরে আসিস, আমি জানব তুই হারাস নি।”

কাগজে ছিল একটা পুরনো ঠিকানা —
সাউথ কলকাতার এক গলির নাম।

অর্ণব এখন জানে — সময় অনেক পেরিয়ে গেছে, হয়তো সেই মানুষটাও আর নেই। কিন্তু সে যেভাবে একদিন মেঘলার কথা না বলে রেখে দিয়েছিল, সেই ঋণ শোধ না করা পর্যন্ত তার শহরও সম্পূর্ণ নয়।

আজ সন্ধ্যায় সে কলকাতায় ফিরে যাবে।
একটা পুরনো শহরের ভেতরে, এক অদেখা ঠিকানায়, সে খুঁজে পাবে — হয়তো কেবল উত্তরহীন প্রশ্ন।

তবু, সে জানে, কিছু কিছু শহর শুধু চিঠির জন্যই বানানো হয়।
আর কিছু কিছু চিঠি — শুধু একবার দেখা হওয়ার অপেক্ষায়।

পর্ব ২

তোমার লেখা কাগজপত্র

কলকাতার হাওয়া কি সত্যিই আলাদা ছিল, না কি শুধু স্মৃতির মধ্যে মিশে যাওয়া পুরনো গন্ধই তাকে এমন করে রেখেছে, অর্ণব বুঝতে পারে না। ট্রেন থেকে নেমে সে যখন গড়িয়াহাটের মোড় পেরিয়ে সেই পুরনো রাস্তাগুলোর দিকে হাঁটা শুরু করে, তখন তার মনে হয় শহরটা তাকে চেনে না আর।

বহু কিছু পাল্টে গেছে — দোকানের সাইনবোর্ড, রিকশাওয়ালাদের মুখ, চা-ওয়ালার কাপের আকৃতি। তবু অর্ণব জানে, কোথাও এক চিলতে ছায়া আছে, যেটা মুছে যায়নি।

চিঠিটা তার কোটের ভাঁজে রাখা। ছোট্ট এক টুকরো কাগজ, যার ভাঁজে ভাঁজে মেঘলার হাতের ছাপ লেগে আছে, আর অর্ণবের হৃৎস্পন্দনের গতি। সে জানে না, ঠিকানাটা এখনো আছে কিনা, কিন্তু এ যাত্রা কোনো গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য নয় — বরং একবার অন্তত ফিরে তাকানোর জন্য।

রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে সে বহু পুরনো এক পানের দোকান দেখে। দোকানটা বন্ধ, তবে কাঠের শাটারে এখনো সেই ধূসর রং — ঠিক যেমনটা ছিল, যখন তারা একসাথে এই দোকানের পাশের গলিতে দাঁড়িয়ে চিঠি পড়ত।

সেই গলিটাই ঠিকানা —
“৩০/বি, অমৃতালয়, পূর্ব গড়িয়াহাট।”

একটা চারতলা বাড়ি। বাইরের রং ফিকে হয়ে গেছে, জানালায় কাপড় ঝুলছে, বারান্দায় লোহার গ্রিল। অর্ণব একটু দ্বিধায় পড়ে। এই তো তার ঠিকানার খোঁজ — তবু সে জানে না, এখানে কে থাকে, কেউ অপেক্ষা করছে কিনা, কিংবা এই ঠিকানা আসলেই মেঘলার কিনা।

ডোরবেল বাজে না। দরজার পাশে একটা ঘণ্টা বাঁধা, পুরনো স্কুলঘরের মত। টোকা দিয়ে সে ডাকে —

“কেউ আছেন?”

ভেতর থেকে ধীরপায়ে এগিয়ে আসে এক বয়স্কা মহিলা। তার শাড়ির ভাঁজে অদ্ভুত পরিচ্ছন্নতা, চোখে বিরক্তি নয়, কেবল বিস্ময়।

“আপনি কী চান?”

অর্ণব কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে —
“মেঘলা সেনগুপ্ত এখানে থাকত কি একসময়?”

মহিলার চোখ কুঁচকে যায়, কণ্ঠস্বর একটু কোমল হয় —
“তুমি কি অর্ণব?”

প্রশ্নটা তাকে থমকে দেয়। সে শুধু মাথা নাড়ে।

“তোমাকে মেঘলা বহুবার চিঠি লিখেছিল, কিন্তু পোস্ট হয়নি। শেষ চিঠিটা অনেক কষ্টে সে পাঠিয়েছিল, জানত না পৌঁছবে কিনা।”

অর্ণব কিছু বলতে পারে না। বুড়ো ঠোঁটের কাঁপুনি, আর তার বুকের ভিতর জমে থাকা হাওয়ার স্রোত, দুটো একসাথে ধাক্কা দেয়।

“সে এখন এই বাড়িতে নেই। দেশ ছেড়েছে বহুদিন। সুইডেন থাকে, ছেলেমেয়েও হয়েছে।”

সেই মুহূর্তে অর্ণব বুঝে যায়, তার অপেক্ষা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে — শুধু সে নিজেই তা জানত না।

মহিলা একটা খাটের নিচ থেকে একটা টিনের ট্রাংক টেনে বের করেন। খোলেন না, শুধু বলেন —
“এই খোলায় কিছু কাগজ আর চিঠি আছে, সব তোর নামে লেখা। ও বলে গেছে, যদি কোনোদিন তুই ফিরে আসিস, এগুলো যেন তোকে দিই।”

অর্ণব বাক্সটা হাতে নিয়ে কিছু বলতে পারে না। তার চোখে তখন কেবল ফিকে অক্ষরের ঢেউ — অনেক অজানা কথার উত্তরের সম্ভাবনা।

রাস্তায় নামার সময় বাতাসে হালকা বৃষ্টি পড়ছিল। অর্ণব মাথা না ঢেকে হাঁটতে থাকে। সে জানে, এই শহরটা আর আগের মতো নেই। কিন্তু এই কাগজপত্র, এই চিঠিগুলো — এগুলোর ভেতরেই মেঘলা আছে।

তারা একে অপরকে ছেড়েছিল, ঠিকই। কিন্তু চিঠিগুলো লিখে গিয়ে, তারা দুজনেই নিজেদের এক টুকরো করে রেখে গেছে একে অপরের ভেতর।

সেই শহর, সেই অচেনা বাড়ি, সেই কাগজপত্র — আজ সব একসাথে এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে।

আর অর্ণব জানে, এই চিঠির শহর সে আর ছেড়ে যাবে না — যতদিন না শেষ চিঠিটার শেষ লাইনে পৌঁছায়।

পর্ব ৩

পোস্ট অফিস যেখানে বন্ধ

অর্ণব ট্রাংকটা নিয়ে বসে আছে গেস্টহাউসের সেই ছোট্ট ঘরে, যেখানে বিছানার চাদরে হালকা ডিটারজেন্টের গন্ধ, আর জানলার ওপাশে একটা নিমগাছ পাতা ঝরাচ্ছে নিরবধি। এক কাপ চা টেবিলে ঠান্ডা হয়ে গেছে, কিন্তু তার চোখ ঠেকেছে অন্য এক গরম বিষয়ে — কাগজ, খাম, সাদা পাতা আর চেনা হাতের লেখা।

টিনের ট্রাংকের ঢাকনা খোলার সময় ধুলোর এক পরত উঠে এসে গাল ঘেঁষে হালকা জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সে তো জানে — কিছু ব্যথা থেকে যাওয়ার জন্যই হয়।

সবচেয়ে ওপরে রাখা চিঠিটা ছিল নীল রঙের খামে, লাল কালিতে লেখা তার নাম — অর্ণব রায়। খামের ভাঁজে হালকা ভেজা দাগ — যেন অনেক আগেই কেউ কেঁদে ফেলেছিল পত্রের ওপরে।

চিঠিটা খুলতেই ভেতর থেকে বেরোল কাঁচাপাকা গন্ধ। যেন বহুদিন ধরে লুকোনো অনুভূতির ধ্বংসাবশেষ। অর্ণব পড়ে

“অর্ণব,

আজ যখন এই চিঠি লিখছি, তখন আমার কণ্ঠে রেডিওর শব্দ নেই, গলায় গান নেই, শুধু ভেতরে একধরনের শূন্যতা। জানি, তুই লেখার উত্তর দিস না সবসময়। কিন্তু এই চিঠিটা আমি পাঠাব, কারণ তোর না জানলেই আমার বেঁচে থাকা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

তুই কি জানিস, আমি পোস্ট অফিসে গিয়ে চিঠি জমা দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গেছি? অনেকগুলো চিঠি জমে আছে আমার ছোট্ট ট্রাংকে, যা তোকে পাঠানো হয়নি কখনো। কারণ তোকে খুঁজে পাইনি।

তুই হারিয়ে গেলি, কবিতার মতনই। খাতার ভাঁজে লেখা থেকে যাস, কিন্তু চোখের সামনে এসে দাঁড়াস না। আমি অপেক্ষা করি, প্রতিবার যখন পোস্ট অফিসের সেই বুড়ো কাকু বলে — ‘চিঠি ফেরত এসেছে।’

তোর এই না থাকার মধ্যেও একটা তীব্র উপস্থিতি আছে। আমি কল্পনা করে নিই, তুই এখনও চা খাস কলেজ স্ট্রিটে, এখনও বইয়ের পাতায় আমার নাম লিখিস, এখনও সেই চিঠিগুলো পড়িস যেগুলো আসলে কখনো পৌঁছয়নি।

আমি জানি না, তুই কেমন আছিস। শুধু জানি, আমি তোকে এক শহরের নাম দিয়েছি — ‘অর্ণবপুর’। যেখানে শুধু তোর চিঠি পৌঁছয়, আর আমি অপেক্ষা করি উত্তর আসবে বলে।

ভালো থাকিস। যদি কোনোদিন তোর শহরে আমার নাম লেখা একটা চিঠি পৌঁছয়, জানিস আমি তোরই জন্য লিখেছি।

— মেঘলা”

চিঠিটা পড়ে অর্ণব অনেকক্ষণ কিছু ভাবতে পারে না। তার ভেতরে কোথাও যেন গলে যায় বরফ। বাইরে যেন বর্ষা নামে না, কিন্তু তার চোখের ভিতর দিয়ে একটা জলোচ্ছ্বাস বয়ে যায়।

সে উঠে দাঁড়ায়, বাইরের আলো তখন নরম। রাস্তায় বেরিয়ে সে পায় পুরনো পোস্ট অফিসটা — গড়িয়াহাটের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা লালচে ছাপার দালান, দরজায় তালা, জানালার ভিতরে স্তূপ করা ফাইল, কাগজ, আর পুরনো রেজিস্টার।

তার মনে পড়ে, সে ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে এই পোস্ট অফিসেই এসেছিল মানি অর্ডার দিতে। এখন এই জায়গাটাই যেন কোনো পরিত্যক্ত মন্দির — পত্রের দেবতা নির্জন হয়ে শুয়ে আছেন।

দরজার পাশের খোলা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে সে দেখে — একটা টেবিলের ওপরে পড়ে আছে কিছু ফেরত আসা চিঠি, যাদের প্রাপকেরা হয় হারিয়ে গেছে, নয়তো নতুন ঠিকানায় চলে গেছে, কিংবা আর বেঁচেই নেই।

অর্ণব হঠাৎ উপলব্ধি করে — চিঠিগুলো হারিয়ে যায় না, তারা শুধু অপেক্ষা করে।

যে কাগজে একদিন ভালোবাসা লেখা হয়, তা কখনো অকেজো হয় না। শুধু ঠিকানা পাল্টে যায়।

পকেট থেকে নিজের ডায়েরি বের করে সে একটা পাতায় লিখে —

“আজ চিঠির শহর আমাকে খুঁজে পেল। আমি সেই চিঠিগুলোর উত্তর লিখব, যেগুলো পড়তে এতদিন দেরি হয়েছে। সময় থেমে থাকেনি — কিন্তু ভালোবাসা অপেক্ষা করেছে।

— অর্ণব”

সে জানে, এই শহরের ভেতরে এখনো কোথাও একটা মেঘলা রয়ে গেছে — তারই কোনো অবচেতন কোণে, কোনো অর্ধেক ঘুম ভাঙা স্বপ্নে।

আর সে নিজেই — আজ একজন প্রাপক, একজন পাঠক, একজন লেখক।

তাদের চিঠির

শহর বন্ধ হয়নি।

শুধু পোস্ট অফিসটা একটু পুরনো হয়ে গেছে।

পর্ব ৪

রেডিওর আওয়াজ, ভেতরের একাকীত্ব

কলেজ জীবনের শেষ বছরে, মেঘলার হাতে একটা প্রস্তাব এসেছিল — একটি নতুন এফএম স্টেশনে রাতের শিফটে আরজে হওয়ার। সময়টা ছিল ঠিক রাত ন’টা থেকে বারোটা। শহর যখন ধীরে ঘুমিয়ে পড়ছে, তখন সে শুরু করত নিজের অনুষ্ঠান — “রাতচিঠি”।

প্রথম দিন, মেঘলা জানত না ঠিক কী বলবে। তার গলায় তখনও অনিশ্চয়তা, তবু কণ্ঠে ছিল গভীরতা — এমন এক টান, যা রেডিওর পর্দা ভেঙে পৌঁছে যেত কারও নিঃশব্দ ঘরে।

“আজ রাতে, যদি কেউ একা থাকেন, যদি ঘুম আসে না, যদি কানে বাজে কোনো পুরনো স্মৃতির গান — তবে এই সময়টা কেবল আপনার জন্য। আমি, মেঘলা, আপনার জন্য পড়ে শোনাব কিছু লেখা, কিছু না-পাওয়া চিঠি, কিছু কথা যেগুলো বলা হয়নি।”

এই প্রথমদিনের পরেই শহরের তরুণ 청听করা নতুন কণ্ঠে প্রেম খুঁজে পেল। অর্ণব অবশ্য সেই প্রথম রাতেই শুনেছিল মেঘলার অনুষ্ঠান — এবং চমকে গিয়েছিল। মেঘলার কণ্ঠ যেন কাগজ ছুঁয়ে পাঠানো চিঠির মতো শোনাল তার কানে।

সেই রাতেই সে একটি ছোট্ট চিঠি লিখে ফেলল —
“তুই কাগজে লেখ না, এখন রেডিওর হাওয়ায় ভাসিস। কিন্তু আমি শুনি, প্রতিটি বাক্যে আমার জন্য রেখে যাওয়া শ্বাসের শব্দ।”

চিঠিটা পাঠানো হয়নি। তবে তার পরদিন দেখা হলে, অর্ণব শুধু বলেছিল —
“তোর কণ্ঠটা রেডিওতে শুনে মনে হচ্ছিল, তুই চিঠির পাতায় হাঁটিস।”

মেঘলা হাসে। তার সেই হাসি ছিল ধোঁয়ার মতো — ধরা যায় না, কিন্তু ঘরের গায়ে গায়ে ছড়িয়ে পড়ে।

সে বলেছিল, “আমি তো চিঠিই পড়ি। তুই বুঝিসনি?”

“কার চিঠি?”

“আমার নিজের। যেগুলো কাউকে পাঠানো হয় না। শুধু রাতের হাওয়ায় পাঠিয়ে দিই। কে জানে, কোনো অর্ণব শুনছে কিনা!”

সেই মুহূর্তে, অর্ণব জানত, এটাই মেঘলার ভালোবাসার ভাষা। সে কখনও বলবে না সরাসরি — “ভালোবাসি।” সে বলবে, “আজ রাতটা শুধু তোকে ভেবে সাজিয়েছি।”

কিছুদিন পর এক রাতে, অর্ণব স্টেশনে গিয়ে অপেক্ষা করছিল। শো শেষ হলে মেঘলা তাকে বলেছিল —
“আজ একটা ছেলে ফোন করেছিল লাইভ শোতে, বলল তার প্রেমিকার নামে সে প্রতিদিন চিঠি লিখে কিন্তু কখনও পোস্ট করে না।”

“তুই কী বললি?”

“বললাম — কিছু চিঠি কখনও পোস্ট হয় না, তারা শুধু সময়ের একেকটা খামে নিজেই ঢুকে পড়ে। কেউ পড়বে কিনা তার ঠিক নেই, তবু লেখা হয়।”

অর্ণব সে রাতে কিছু বলেনি। শুধু মনে মনে নিজের প্রতিদিন লেখা অসমাপ্ত চিঠিগুলোর কথা ভেবেছিল।

এক রাতে, হঠাৎ করেই মেঘলা চুপ করে গেল রেডিওতে। কোন ঘোষণা ছাড়াই অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিল। কেউ জানত না কেন। শহরের যারা রেডিও শোনার অভ্যস্ত ছিল, তারা বুঝতেই পারল না, কোথায় গেল সেই মেয়েটি যে প্রতিদিন রাতে কারও না-পাওয়া চিঠি পড়ে শোনাত।

অর্ণবও জানত না।

পরদিন মেঘলা আসে না কলেজে। এক সপ্তাহ পর, তার মেসের ঘর তালাবদ্ধ — বিছানার পাশে পড়ে আছে একটা নীল খাতা, যার ভেতরে একটাই লাইন:
“একটা সময় আসে, যখন কণ্ঠস্বরের চেয়ে নীরবতাই বেশি স্পষ্ট শোনায়।”

অর্ণব সেই খাতা যত্ন করে রেখে দেয়। প্রথমবার তার বুকের মধ্যে বেজে ওঠে ভেতরের একাকীত্ব — যে একাকীত্ব শুধুই শব্দহীন নয়, বরং শব্দে ভরা এক অভাবের চিৎকার।

বহুদিন পর আজ, চিঠির বাক্স খুলে বসে, অর্ণব সেই খাতার কাগজের গন্ধ খোঁজে।

রেডিওর আওয়াজ এখনো বাজে কি না জানে না সে। কিন্তু একেকটা চিঠি খুললেই, তার মনে হয় মেঘলা তখনো কথা বলছে —
নাম না বলে, শহরের আকাশে ভাসিয়ে দিচ্ছে কোনো পুরনো ভালোবাসার আভাস।

আর সে শুনছে — ঠিক আগের মতো।

পর্ব ৫

চা, ট্রামলাইন, আর নিরুত্তর বিকেল

কলেজ স্ট্রিটের সেই শেষ বিকেলটা আজও অর্ণবের চোখে অমলিন। যেন একটা পেইন্টিং যার রঙ কেউ ধুয়ে ফেলেনি কখনো — শুধু কাচের ওপর জমেছে সময়ের ধুলো।

সেদিন ছিল ফেব্রুয়ারির শেষ রবিবার। বাতাসে গরম-ঠান্ডার এক অদ্ভুত টানাপোড়েন। অর্ণব একটা পুরনো খাতায় লিখছিল কবিতা, আর মেঘলা সামনের চায়ের কাপে চামচ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শব্দ করছিল — এমনভাবে, যেন সে কোনো উত্তর তৈরি করছে না, বরং কিছু না-বলা প্রশ্নের স্বাক্ষর রেখে দিচ্ছে।

“তুই এখন আর লিখিস না কেন?” অর্ণব জিজ্ঞেস করেছিল।

“লিখি তো, শুধু কাগজে না। মনেও তো লেখা যায়,” মেঘলার জবাব তখনো তার মনে গেঁথে আছে।

অর্ণব সেই মুহূর্তে বোঝেনি, এটাই ছিল তার শেষ দেখা। তারা একসাথে হেঁটেছিল কলেজ স্কোয়ারের ধারে, একটা ট্রাম লাইন বরাবর, যেখানে শহরের কোলাহল আর নিরবতা পাশাপাশি হাঁটে।

মেঘলা হঠাৎ থেমে গিয়ে বলেছিল —
“তুই জানিস, কলকাতার সব রাস্তা কোথাও না কোথাও গিয়ে থেমে যায়। কিন্তু আমাদের পথটা ঠিক কোথায় থামবে জানি না।”

“তোর প্ল্যান কী?”

“একটা জার্নালিস্টিক ওয়ার্কশপ পেয়েছি, মুম্বাইয়ে। তারপর হয়ত দূরে আরও কিছু।”

“তুই যাচ্ছিস?”

“হ্যাঁ।”

সেই ‘হ্যাঁ’ ছিল কোনও যুদ্ধ জেতার মতো না, বরং এক অনিবার্য নীরবতার ঘোষণা — অর্ণব ঠিক তখনই বুঝেছিল, মেঘলা চলে যাবে।

সে কিছু বলেনি। শুধু তাকিয়ে ছিল — মেঘলার চোখে, যেন ওই চোখে তার নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পাবে।

চায়ের দোকানের পেছনে একটা পোস্ট বক্স ছিল। মেঘলা তাতে একটা খাম ফেলে দিল — খামের উপর লেখা ছিল অর্ণবের নাম, কিন্তু ঠিকানা নেই।

“তুই কি লিখেছিস আমার জন্য?”

“হয়ত। তুই যদি বুঝিস, তবেই সেটা তোর জন্য।”

ট্রাম আসছিল ধীরে ধীরে। ট্রামপাশে ছায়া চলছিল, আর তার সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছিল এক অসমাপ্ত সম্পর্কের কঙ্কাল।

মেঘলা বলল —
“তুই যদি কোনোদিন কিছু বলতে চাস, চিঠি লিখিস। বলার চেয়ে লেখা ভালো — কারণ লেখা চুপ করে থাকতে জানে। আর চুপ থাকা কখনো কখনো অনেক কিছু বলে দেয়।”

ট্রাম চলে গেল। মেঘলা চলে গেল।
অর্ণব সেই মুহূর্তে বলার জন্য অনেক কিছু খুঁজছিল — কিছুই বলতে পারেনি।

তারপর সে আর মেঘলাকে দেখেনি।

আজ, এত বছর পর, সেই দিনটার সব শব্দ তার ভেতর ফিরে ফিরে আসছে — ট্রামের শব্দ, চায়ের কাপে চামচের ধাক্কা, আর সেই একটাই প্রশ্ন —
“তুই কী বলতে চাসনি, অর্ণব?”

সে জানে, চিঠির শহরটা আসলে সেই দিনেই তৈরি হয়েছিল —
যেদিন দুইজন মানুষ, বলা আর না-বলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থেকেও কিছুই বলেনি।

পর্ব ৬

চিঠি যা আসেনি কোনোদিন

অর্ণব জানালার পাশে বসে আছে। বাইরের আকাশে সন্ধ্যার রঙ ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে, কিন্তু তার মন যেন সেই আলো-অন্ধকারের মধ্যবর্তী এক ধূসর স্তরে আটকে গেছে। হাতের কাছে রাখা ট্রাংক, আর ট্রাংকের ভেতরে অসংখ্য চিঠি। কিন্তু আজ সে খুলবে শুধু একটা — যেটার উপরে লেখা আছে:
“না-পৌঁছানো চিঠি। না-পাঠানো অনুভব।”

খামটা ছিল পাতলা কাগজে মোড়া, ভেতরে একটি ভাঁজ করা সাদা পৃষ্ঠা। তার ওপরে ছিল একরকম এলোমেলো লেখা, যেন তাড়াহুড়ো করে লেখা, আবার ইচ্ছা করেই অগোছালো।

“অর্ণব, এই চিঠিটা আমি পাঠাব না — কারণ তুই পাবি না জানি। আবার তাইও জানি, যদি তুই কোনোদিন এই চিঠিটা খুলিস, তাহলে আমি নিশ্চিত হব, আমাদের ভালোবাসার পেছনে কোনো দৈব ছিল।

তুই তো জানিস, আমি একদিন চলে যাব — অনেক দূরে, তোর নাগালের বাইরে। কিন্তু যাওয়ার আগে আমি তোর জন্য একটা জিনিস রেখে যেতে চাই। না, কোনও বস্তু নয়। কোনও চাবি, ছবি, উপহার না। আমি রেখে যেতে চাই — প্রশ্ন।

তুই কি সত্যিই আমায় ভালোবাসিস?

আমি বহুদিন ধরে ভাবি, তোর সেই না-বলা, না-লিখা ভালোবাসাটা কেমন ছিল। তোর চুপ করে থাকাটা কি অভিমান ছিল, না ভয়? তুই কি ভেবেছিলি, আমি তোর থেকে কিছু চাই?

আমি চাইনি কিছুই, অর্ণব। শুধু চেয়েছিলাম, একদিন যখন রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকব, তখন তুই আমাকে ডাকবি। বলবি, ‘থাম মেঘলা, আমিও আসছি।’

তুই বলিসনি। আমি চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু আজও জানি, আমার পিঠের পেছনে তুই দাঁড়িয়ে ছিলি। ডাকিসনি — সেটাই তোর সবচেয়ে চুপচাপ ভালোবাসা।

আজ যদি তুই এই চিঠিটা পড়িস, জানিস, তুই একবার হলেও সত্যিই ভালোবেসেছিলি।

— মেঘলা”

অর্ণব চিঠিটা পড়ে চুপ করে বসে থাকে। জানালার বাইরে রোদ আর অন্ধকারের ভেতর দিয়ে হাওয়ার এক ঝলক এসে খামের ভাঁজ উলটে দেয়। সেই মুহূর্তে সে অনুভব করে — সময় কখনও ভালোবাসাকে থামায় না, শুধু অন্য রাস্তায় নিয়ে যায়।

তার মনে পড়ে যায় সেই সব দিন, যেদিন সে মেঘলাকে নিয়ে কবিতা লিখত, কিন্তু কখনও মেঘলার সামনে পড়ে শোনাত না। যে ভালোবাসার ভাষা সে খুঁজে পেয়েছিল শব্দে, কিন্তু গলায় তুলে বলতে পারেনি।

চিঠিটা কাঁপা হাতে আবার ভাঁজ করে সে। মনে হয়, এই চিঠি আসলে তার ভেতরের একটুকরো আয়না, যেখানে সে নিজের মুখ দেখে — প্রেমিক, অথচ নির্বাক; প্রত্যাশাহীন, অথচ বৃষ্টিতে ভেজা।

সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। ট্রাংকের সব চিঠি না খুললেও, সে জানে — প্রতিটি চিঠির একেকটি পাতা, একেকটি অভিমানের স্তব্ধতা ভেঙে তৈরি।

এ শহর শুধু পাথর আর পিচের নয়। এ শহর চিঠির। শব্দহীন স্বীকারোক্তির। সেই সব শব্দের, যা একদিন হারিয়ে গিয়েছিল সময়ের গলিতে।

আজ সে বুঝে গিয়েছে — কিছু চিঠি কখনও আসে না, তবুও তারা লেখা হয়, ঠিক সেইজন্য —
যাতে কোনো একদিন, কারও মন ভেঙে গিয়ে সেগুলো নিজে থেকেই খুঁজে পায়।

পর্ব ৭

এক পুরনো ঠিকানার গল্প

সকালে ঘুম ভাঙতেই অর্ণব অনুভব করল, চিঠির বাক্সটা যেন কোনো জাদুর দরজা — যত খুলে সে ততই ডুবে যাচ্ছে এমন এক পৃথিবীতে, যার মানচিত্র শুধু তারই হৃদয়ে আঁকা।

সে আজ ঠিক করল, শুধু চিঠি নয়, এবার খুঁজে দেখবে সেই মানুষটাকেও, যে শব্দের আড়ালে এতদিন থেকেছে। কিন্তু মেঘলা যে আজ সুইডেনে, দুই সন্তানের মা — তার কাছে গিয়ে “ফিরে এসো” বলা এক ধরনের নির্মমতা।

তবু, অর্ণব জানে, কিছু খোঁজা হারানোর জন্য নয় — বরং বোঝার জন্য। সে চায় মেঘলার অতীত জানতে, তার ফেলে আসা দিন, তার ভেতরের গল্পগুলো।

পুরনো ঠিকানাটা ছিল মেঘলার ছেলেবেলার বাড়ি — “১৩/সি, বেলেঘাটা রোড, উত্তমনগর।”
চিঠিগুলোর একটা পেছনের পাতায় একবার লেখা ছিল —
“আমার প্রথম চিঠি তোকে আমি এখান থেকেই লিখেছিলাম। তখন আমার বয়স ছিল সতেরো, তুই ছিলি আমার পাঠের সহযাত্রী — আমি ভাবতাম, তোর কবিতাগুলো একদিন আমার জন্য লেখা হবে।”

অর্ণব রিকশা ধরে পৌঁছল সেই ঠিকানায়।

বাড়িটা এখন আধা-বহুতল, নিচতলায় একটি বিউটি পার্লার, দোতলায় এক অ্যাকাউন্ট্যান্টের অফিস, আর এককোণে শুকনো পাতায় ভরা উঠোন।

পাশের চায়ের দোকানে বসে থাকা এক বৃদ্ধকে সে জিজ্ঞেস করল —
“এই বাড়িতে আগে কি সেনগুপ্ত পরিবার থাকত?”

বৃদ্ধ একটু চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বললেন —
“হ্যাঁ রে বাবা, থাকত। মেঘলা ছিল মেয়েটার নাম, খুব শান্ত। তার বাবা ছিলেন স্কুল মাস্টার — মৃদু স্বভাবের মানুষ। উনি মারা গেলেন বেশ আগেই। মেয়ে চলে যায় বিদেশে। কেউ আর ফিরে আসেনি।”

অর্ণব আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। শুধু একটা ধাতব অনুভূতি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল উঠোনের সামনের কদম গাছটার নিচে। একসময় এই গাছের নিচে বসেই হয়ত মেঘলা প্রথম তার চিঠি লিখেছিল, হয়ত হাতের লেখা বারবার কেটে আবার লিখেছিল — “অর্ণব”, “প্রিয় অর্ণব”, “শ্রদ্ধেয়”, “বন্ধু” — কিছুই স্থায়ী হয়নি, শুধু ভালোবাসাটুকু ছাড়া।

একটা মেয়ে যার শৈশব কেটেছে এই বাড়িতে, যার বাবা চুপচাপ বই পড়ে থাকতেন, আর যে রাতভর কাগজে নিজের অনুভব লিখে রাখত — সেই মেয়ের ভেতরে গড়ে উঠেছিল এক অলিখিত শহর।

অর্ণব একবার গিয়েছিল মেঘলার বাবার সঙ্গে দেখা করতে — কলেজের কোনও পুরনো নাটকের রিহার্সালের ছবি নিয়ে। তিনি তখন বলেছিলেন —
“তুমি মেঘলার বন্ধু তো? ও তো এখন লেখালিখি করছে খুব। একটা চিঠি লিখেছিল আমার নামে, যেখানে আমাকে বাবার বদলে ‘বুঝতে চাওয়া মানুষ’ বলে সম্বোধন করেছিল। আমি ওকে কিছু বলিনি, শুধু জানতাম, এই মেয়ে বুঝি একদিন চলে যাবে অনেক দূরে।”

সেই স্মৃতি এখন ঠোঁট ভিজিয়ে দেয় অর্ণবের।

বাড়িটার ভাঙা বারান্দায় সে শেষবার চোখ রাখে। জানে না আর কবে ফিরবে এখানে। তবু মনের ভেতরে গেঁথে নিল ঠিকানাটা — যেন এটাই সেই চিঠির শহরের জন্মস্থান।

রাস্তায় ফিরে এসে সে ভাবতে থাকে — যদি কোনোদিন মেঘলা ফিরে আসে, এই শহরে, এই বাড়িতে, এই উঠোনে — তবে সে কি তার ছায়ার ভেতর অর্ণবকে খুঁজবে?

সে জানে না।
কিন্তু আজ থেকে এই ঠিকানাটাও চিঠির শহরের এক অলিগলি হয়ে গেল।

পর্ব ৮

যদি ফিরে আসতে চাও

বিকেলের আলো ধীরে ধীরে পাতলা হতে হতে অর্ণবের ঘরের জানালা দিয়ে গলে পড়ে মেঝেতে। সেই আলোয় সে ট্রাংকের ভেতর হাত চালায় আর চিঠির পাতাগুলো একে একে সরিয়ে রাখে। যেন শব্দের বনজঙ্গল পেরিয়ে খুঁজছে এমন কিছু, যা অতীতকে ছুঁয়ে বর্তমানকে জাগিয়ে তুলবে।

এমন সময় খুঁজে পেল ছোট এক খাম — অন্যরকম, একটু বেশি যত্নে মোড়া, আর তার ওপরে লেখা শুধু তিনটি শব্দ:
“যদি ফিরে আসতে চাও”

খামের মধ্যে ছিল একটি দীর্ঘ চিঠি, সাদা পাতায় লেখা, কিনারায় নীল কালির হালকা দাগ, আর একেবারে নিচে লেখা —
“লিখেছি যাওয়ার আগের রাতে, কলকাতা ছাড়ার কিছু ঘন্টা আগে।”

অর্ণব পড়ে —

“অর্ণব, আজ রাতটা কেমন যেন — নিঃশব্দ, অথচ ভারী। জানালার বাইরে কুকুর ঘেউঘেউ করছে, ট্রামের ঘণ্টা নেই, এমনকি রেডিওটাও নীরব হয়ে গেছে। শুধু ঘরের কোণে আমার ছেলেবেলার ট্রাঙ্কটা খোলা — ভেতরে তোকে লেখা চিঠিগুলোর স্তূপ। আমি সব নিয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু নিচ্ছি না। রেখে যাচ্ছি, তোর শহরে, তোর নামে।

জানিস, আমরা আসলে কেউই কাউকে পুরো চিনি না। আমি তোকে চিনিনি — তোর ভয়, তোর নিরবতা, তোর অভিমান। তুইও আমায় চেনিসনি — আমার অপেক্ষা, আমার পালিয়ে যাওয়ার ভান, আর ভেতরের কান্না। কিন্তু তারপরও, এই অচেনার ভেতরেই আমরা একে অপরকে লিখে ফেলেছি বারবার।

আমি যাচ্ছি। এই যাওয়ার মানে তুই বুঝবি না এখন — বুঝবি কেবল যদি কোনোদিন তুইও একা হয়ে পড়িস, আর তোকে কেউ না ডাকে। তুই যদি কোনোদিন ফিরতে চাস, এই শহরে — তবে এই চিঠিটা তোর জন্য।

ফিরে এসো, যদি ভাঙা জানালায় আলো ফোটে, যদি পুরনো দোকানে একই চায়ের স্বাদ থাকে, যদি কোনো রাস্তার মোড়ে হঠাৎ আমার নাম উচ্চারিত হয় মনে মনে — জানবি, আমি তোকে ফিরতে বলেছি অনেক আগেই।

তুই যদি চিঠিগুলো খুলে দেখতে চাস, আমি তোকে দোষ দেব না। কারণ ওরা কেবল আমার একলা রাতের দলিল নয়, তোকে ভালোবেসে কিছু না পেয়ে নিজের কাছে জমিয়ে রাখা শব্দ।

শেষে শুধু বলি, আমার ভালোবাসা কখনও তোর সামনে হাঁটেনি, পিছনে থেকেছে। তোকে না বলে ভালোবেসেছি, যেন তুই বোঝিস। তুই যদি না বুঝিস, তাও কিছু না। কারণ, ভালোবাসা বোঝাতে হয় না, থেকে যেতে হয়।

— মেঘলা”

চিঠির শেষে চোখ চলে যায় নিচে, যেখানে লেখা —
“পুনশ্চ: তুই যদি এই চিঠি পড়িস, জানব তুই একদিন এসেছিলি।”

অর্ণব জানে না কখন চোখে জল এসেছিল। তবে সে বুঝেছে, কিছু চিঠি যেমন পথ খোঁজে না, কিছু ভালোবাসাও ফিরে আসার অপেক্ষা করে না।

সে জানে, এই চিঠির শহরের রাস্তাগুলো পাথরের নয়, শব্দ দিয়ে তৈরি। এবং তার প্রতিটি গলিতে এখন একটা করে জ্বলন্ত বাতি — প্রতিটি চিঠির মতোই, যেগুলো অন্ধকারে আলোর মতো পথ দেখায়।

এই শহর এখন তার নয় শুধু। এ শহর তাদের দুজনের।

একজন লিখেছে, একজন পড়েছে।
তবু, তারা একসাথে ছিল — মাঝখানে ছিল কেবল সময়, আর একরাশ না-পাওয়া।

পর্ব ৯

শেষ ট্রেনের অপেক্ষায়

রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা। গড়িয়াহাটের পুরনো স্টেশন রোড একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে। বাতাসে হালকা ধুলো, কিছু ছেঁড়া কাগজ উড়ছে রিকশার চাকার স্পর্শে। অর্ণব হাঁটছে ধীরে ধীরে — হাতে ধরা একটা খাম, আর পকেটে ভাঁজ করে রাখা কিছু শব্দ, যা সে বছরের পর বছর জমিয়ে রেখেছে, কিন্তু কখনও মেঘলার কাছে পাঠায়নি।

এখন সময় এসেছে — নিজেকে লেখার।

একটা চায়ের দোকানে থেমে, সে শেষবারের মতো চা নেয়। দোকানদার চেনা, কিন্তু চিনে না। এটাই তো কলকাতার নিয়ম — যে শহর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, সে-ই ভুলে যেতে জানে দ্রুত।

অর্ণব ডায়রির শেষ পাতায় লিখতে শুরু করে:

মেঘলা,তুই বলেছিলি — লিখে ফেলতে। কথা না বলে শব্দের মধ্যে রেখে যেতে যা বলার। আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে, আমি জানি। তুই এখন আর সেই মেয়েটি নোস, যে রেডিওতে গভীর রাতে শোনাত আমার নাম না-নেওয়া কবিতা। আমি নিজেও সেই ছেলেটা নই, যে চুপ করে চিঠির খামে ঘামের গন্ধ জমাত।

তবু লিখছি, কারণ আজ শেষ ট্রেনের আগে যদি কিছু বলার থাকে — সেটা তোকে বলা ছাড়া আর কোনো মানে হয় না।

আমি তোকে ভালোবেসেছিলাম। এমন এক ভালোবাসা, যা প্রকাশ করার ভাষা খুঁজে পায়নি কোনোদিন। হয়তো ভয় ছিল, হয়তো বিশ্বাস করতাম, ভালোবাসা বলা মানেই হারিয়ে ফেলা। তোর চলে যাওয়ার দিন, আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম রাস্তার উল্টো দিকে — বলতে পারিনি, ‘থেমে যা।’ সেটাই আমার একমাত্র অপরাধ, অথবা আমার সবচেয়ে সত্য ভালোবাসা।

তুই যদি আজ থাকতিস, আমি হয়তো আবার চুপ করেই থাকতাম। কিন্তু এই চিঠির শহরের দেয়াল ভেঙে ফেলতে হলে, একটা জানলা খুলতেই হয়। এই চিঠিটা সেই জানলা। আমি জানি তুই কখনো পড়বি না — তোর হাতে এটা পৌঁছবে না। তবু রেখে যাচ্ছি এটা এই শহরের পুরনো পোস্ট অফিসে — যেন শহর নিজেই একদিন তোকে জানিয়ে দেয়, আমি এসেছিলাম।

শেষ ট্রেনের আগে যে কথা না বলা রয়ে যায়, তাকে চিঠি বলে না কেউ — কিন্তু আমি বলি, সেই কথাই আসলে প্রেমের সবচেয়ে খাঁটি রূপ।

— অর্ণব চিঠিটা ভাঁজ করে, অর্ণব পুরনো পোস্ট অফিসের দিকে যায়। এখন আর তা অফিস নয় — ধুলোমাখা এক ঠান্ডা স্মৃতি। কিন্তু দরজার ফাঁক এখনও একটা খাম ফেলার মতো ফাঁদ রেখে দিয়েছে।

সে খামটা ঢুকিয়ে দেয় সেই ফাঁকে। কোনো ঠিকানা লেখে না, শুধু বড় করে লেখে —
“চিঠির শহর”

তারপর ধীরে ধীরে চলে আসে গড়িয়া স্টেশনের দিকে। ট্রেন ধরার নয় — কেবল শেষ ট্রেনের শব্দ শুনে বুঝে নেওয়ার জন্য যে কিছু জিনিস পার হয়ে গেছে, আর কিছু রয়ে গেছে ঠিক মাঝখানে।

অর্ণব জানে, সে মেঘলার জীবনে আর ফিরবে না। তবু আজ, এতগুলো বছর পর, সে যেন নিজেকেই মাফ করে দিল — সেই না-বলা কথার দায় থেকে, সেই মুখ ফিরিয়ে থাকা ট্রামের দিন থেকে, সেই ‘তুই চলে যাচ্ছিস’ না বলা অভিমানের ভেতর থেকে।

শেষ ট্রেনের শব্দ দূরে কোথাও বাজে। আর অর্ণব দাঁড়িয়ে থাকে।
কোনো স্টেশনে নয়, কোনো প্ল্যাটফর্মে নয় — দাঁড়িয়ে থাকে ঠিক সেই জায়গায়, যেখানে একদিন ভালোবাসা চলে গিয়েছিল চুপিচুপি।

পর্ব ১০

চিঠির শহর আজও দাঁড়িয়ে

কলকাতা বিমানবন্দরের জানালায় তাকিয়ে মেঘলা দেখল, ঝকঝকে নীল আকাশের নিচে ভেসে যাচ্ছে ছোট ছোট মেঘদলা। প্রায় আঠারো বছর পর সে ফিরছে এই শহরে — যে শহর একসময় তার নাম জানত, মুখ চিনত, তার কণ্ঠের রেডিওর ভোর-রাত্রির ছায়া ছুঁয়ে থাকত।

এবার সে এসেছে আরজে হিসেবে নয়, বা প্রেমিকার পুরনো শূন্যতায় ফিরে আসতে নয় — এসেছে তার ছেলেকে নিজের শৈশবের শহর দেখাতে।

“এটাই তোমার মায়ের শহর,” সে বলল দশ বছরের রুদ্রকে, যে বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে হলদেটে ট্যাক্সির জানালার বাইরে।

গড়িয়াহাটের সেই পুরনো গলিতে এসে তারা দাঁড়াল। বাড়িটার চেহারা অনেকটাই বদলে গেছে — রং বদলেছে, বারান্দায় এখন রডের গ্রিল, নিচতলায় ফাস্টফুডের দোকান। কিন্তু উঠোনের কদমগাছটা এখনও আছে — তার পাতায় ধুলোর আস্তরণ, কিন্তু গোড়ায় যেন সময় জমে আছে।

মেঘলা দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, চোখ বুজে ফেলে — যেন শুনতে পায় পুরনো পায়ের শব্দ, চায়ের কাপের ধাক্কা, আর সেই চুপচাপ ছেলেটির নিঃশব্দ প্রশ্ন:
“তুই ঠিক চলে যাচ্ছিস?”

মেঘলার মা নেই অনেক বছর। ঘরবাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে। তবু পরিচিত একজন বৃদ্ধ, যিনি তখন বাড়ির কেয়ারটেকার ছিলেন, হঠাৎ এগিয়ে এসে বলেন,
“আপনি সেনগুপ্ত মেমসাবের মেয়ে তো? আপনার নামে একটা চিঠি ছিল, অনেক বছর আগে এসেছিল। আমি রাখতে বলেছিলাম পোস্ট অফিস থেকে। লিখে রাখা ছিল — ‘যদি কোনওদিন ফিরে আসেন।’”

মেঘলা চমকে ওঠে।
“আমার নামে?”

“হ্যাঁ, কিন্তু খামে ঠিকানা ছিল না। শুধু লেখা ছিল — ‘চিঠির শহর’। আর প্রেরকের নাম — অর্ণব রায়।”

চিঠিটা খোলা নয়, ধুলোমাখা, কিন্ত ভাঁজে কোনো ভেজা দাগ নেই। যেন শব্দগুলো এতদিন শুকনো থেকেও ভিজে ছিল ভিতরে ভিতরে।

মেঘলা চিঠিটা খোলে রুদ্রের সামনে। সে পড়ে —

মেঘলা, তুই যদি কোনোদিন ফিরে আসিস, আমি চাই তুই জানিস — আমি অপেক্ষা করিনি, কারণ জানতাম, তুই ফেরার জন্য বাঁচিস না। তুই চলে গিয়েছিলি নিজেকে বাঁচাতে, নতুন জীবন খুঁজতে — এবং তাতে কোনো দোষ নেই।

আমি শুধু চেয়েছিলাম তোর ফেলে যাওয়া শব্দগুলোকে ধরে রাখতে। সেই চিঠিগুলো, যেগুলো কখনও পৌঁছায়নি, তাদের শহর বানিয়েছি আমি। তুই যদি আজ তোর ছেলে নিয়ে ফিরে আসিস, জানিস, এই শহর এখন তারও — কারণ তার মা একদিন ভালোবেসেছিল এই শহরের একজন মানুষকে, যে কিছুই বলেনি, তবু সব বুঝেছিল।

ভালো থেকো। আমাকে না চিনলেও ক্ষতি নেই। শুধু জানি, এই চিঠিটা পৌঁছলে বুঝব — তুই ফিরেছিস।

— অর্ণব”

চিঠি পড়ে রুদ্র তাকিয়ে বলে, “মা, এ লোকটা কে?”

মেঘলা হেসে মাথায় হাত রাখে ছেলের। “একটা চিঠির লেখক। একদিন আমার জন্য লিখেছিল। আমি শুধু পৌঁছাতে পারিনি। কিন্তু তুই যদি কখনও কাউকে খুব মন থেকে ভালোবাসিস, লিখে ফেলিস — কারণ চিঠি কখনও মরে না। তারা অপেক্ষা করে।”

আকাশে মেঘ জমছে ধীরে ধীরে। ছায়ায় মিশে যায় কদম গাছের নিচের স্মৃতি।

মেঘলা জানে না, অর্ণব এখন কোথায়। হয়ত অন্য শহরে, হয়ত জীবনের অন্য ছকে বন্দি।

কিন্তু এই শহর, এই বাড়ি, এই চিঠি — প্রমাণ রেখে গেছে, ভালোবাসা চলে যায় না, বরং রয়ে যায় একেকটা শব্দে, ভাঁজে ভাঁজে, একেকটা অলিগলির মধ্যে যেখান দিয়ে একদিন হেঁটে গিয়েছিল দুইজন মানুষের না-বলা অনুভব।

চিঠির শহর আজও দাঁড়িয়ে।
কেবল ঠিকানাটা বদলে গেছে।

সমাপ্ত

Lipighor_1753968538871.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *