Bangla - তন্ত্র

চতুষ্পথের ব্রহ্মদত্ত

Spread the love

জয়ন্ত পাল


কলকাতার আকাশে সেদিন অদ্ভুত এক মেঘ ছিল, যেন কেউ কালির কুয়াশা ছড়িয়ে দিয়েছে শহরের উপর। দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়া মোড়ের চতুষ্পথে বিকেলবেলার ব্যস্ত ট্রাফিক হঠাৎ যেন স্তব্ধ হয়ে গেল, যখন এক ভবঘুরে মানুষ মাঝ রাস্তায় এসে দাঁড়াল। তার গায়ে ছিল মলিন গেরুয়া পোশাক, মাথাভর্তি উসকো চুল, আর গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। কেউ কেউ বলেছিল, সে হয়ত ভবঘুরে কোনও পাগল সাধু; আবার কেউ চোখ কপালে তুলে দেখছিল, তার চোখে যেন আগুনের ঝলকানি। লোকটা দুই হাত তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা জপতে লাগল, ভাষা বোঝা যাচ্ছিল না—কিন্তু আশেপাশে এক অদ্ভুত গুঞ্জন সৃষ্টি হচ্ছিল, যেন শব্দ নয়, ধ্বনি নয়, বরং সময় নিজে কাঁপছে তার শব্দে। কয়েকজন অটোচালক প্রথমে গালাগাল দিয়ে উঠেছিল, ট্র্যাফিক পুলিশ এগিয়ে এসে বলল, “কাকু, চলুন, রাস্তা ছাড়ুন।” কিন্তু লোকটা তখন মাটিতে বসে পড়ে আঁকতে লাগল আঙুল দিয়ে চতুষ্পথের মাঝখানে এক গোল চিহ্ন, যার প্রতিটি দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছিল চারটি রেখা, যেন কোনও মণ্ডল আঁকা হচ্ছে রাস্তায়, যেন রাস্তাটাই তার পাটায় পরিণত হয়েছে। পুলিশ যখন তাকে টানতে যায়, তখন হঠাৎ তার গলায় এক ভয়ানক মন্ত্র ছুটে আসে—“কালসময়ের অঙ্গচ্যুতি যেথায়, সেখানেই চক্রের পুনর্জন্ম”—এই কথা বলে সে অচেতন হয়ে পড়ে যায়।

তাকে পাঠানো হয় নিকটবর্তী মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্র, যেখানে তার নাম পাওয়া যায় না, কোনও ঠিকানা নেই, শুধু তার গায়ে এক পুরনো লোহার টালির লকেটে খোদাই করা—“ব্রহ্মদত্ত”। চিকিৎসকরা তাকে স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রোগী ভেবে পর্যবেক্ষণে রাখে। ঠিক সেই সময়ই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও গবেষক ড. নীলাঞ্জনা ঘোষ ঐ হাসপাতালটিতে একটি গবেষণা প্রকল্প নিয়ে কাজ করছিলেন—বিষয় ছিল “অবচেতন মস্তিষ্কে ধর্মীয় বিভ্রমের প্রতিফলন”। তাঁর আগ্রহ হয় এই মানুষটিকে নিয়ে, কারণ হাসপাতালের রেকর্ডে এমন বিস্ময়কর অঙ্গভঙ্গি, সংস্কৃতমিশ্রিত অদ্ভুত মন্ত্রোচ্চারণ, এবং একই ধরণের চিহ্নিত আঙুলের রেখা আগে কখনও দেখা যায়নি। নীলাঞ্জনা প্রথম দিন তার সঙ্গে বসে কথাবার্তা বলেন—লোকটা চুপ করে থাকে, শুধু একসময় বলে, “তুমি অন্তঃদর্শী, আমি চক্রের মাঝখানে আটকে পড়েছি। আমাকে শেষ করতে হবে এই মণ্ডল, নাহলে আমি এখানেই থেকে যাব, সময়ের বাইরে, দেহের ভিতরে, চেতনার কুণ্ডলীতে।” নীলাঞ্জনা প্রথমে এটিকে ক্লাসিক প্যারানয়াল হ্যালুসিনেশনের উদাহরণ মনে করলেন, কিন্তু কিছুক্ষণ পর তাঁর নিজের মনেই কেমন যেন ধোঁয়াশা জমতে লাগল। রাতে তিনি যে স্বপ্ন দেখলেন, তাতে তিনি নিজেকে দেখতে পেলেন ঠিক সেই চতুষ্পথের মাঝে, পা থেকে মাথা পর্যন্ত আলোয় ঘেরা, আর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই ভবঘুরে লোকটা—তার চোখে কোনও পাগলামি নেই, বরং ভয়ানক শান্তি।

পরদিন সকালবেলা হাসপাতালে এসে নীলাঞ্জনা দেখেন, ব্রহ্মদত্ত মাটিতে বসে একমনে কিছু আঁকছে—হাসপাতালের মেঝেতেও সেই একই চক্রের চিহ্ন। সে চোখ তুলে বলে, “একটা চতুষ্পথ শুধুই রাস্তাঘাটের বিন্দু নয়—ওটা একটা প্রবেশদ্বার। যারা দেখতে পায়, তাদের ওপর দায় পড়ে। তুমি সেই দায় এড়িয়ে যেতে পারবে না।” এইসব কথায় অন্যরা আতঙ্কিত হয়ে উঠলেও নীলাঞ্জনার মনে হল যেন কথাগুলোর মধ্যে কোথাও একটা অতীতের সুর বাজছে। নিজের অজান্তেই সে ব্রহ্মদত্তের কথার মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেতে লাগল। সেই রাতে সে আবার এক স্বপ্ন দেখে—চতুষ্পথ, আগুনের রেখা, বাতাসে উড়তে থাকা পুরনো কাগজের পাতায় অদ্ভুত মন্ত্র লেখা—আর সবশেষে তার নিজের মুখের সামনে এক পুরনো ফটোগ্রাফ, যেখানে তার দাদুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে ব্রহ্মদত্ত নামের সেই একই লোক। তখনই প্রথমবার সে অনুভব করল, হয়তো সে এই ভবঘুরের সঙ্গে কোথাও না কোথাও সত্যিই বাঁধা, হয়তো এটা নিছক মানসিক রোগীর প্রলাপ নয়, বরং অতীত আর বর্তমানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক চতুষ্পথ—যার ঠিক মাঝখানে সে নিজেই দাঁড়িয়ে আছে।

হাসপাতালের করিডোরের প্রতিটি ধাপ যেন নীলাঞ্জনার কাছে ভারী হয়ে উঠছিল, যেন মেঝে থেকে উঠে আসছে কোনও অদৃশ্য টান, যা তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে সেই ঘরের দিকে, যেখানে ব্রহ্মদত্ত বসে রয়েছে মেঝেতে। সে ঘুমিয়ে নেই, চোখ দু’টো বন্ধ, অথচ ঠোঁটের ফাঁকে জপ চলছে অবিরাম—একধরণের ছন্দময় উচ্চারণ যা চেতনার প্রান্ত ছুঁয়ে যায় কিন্তু পুরোপুরি বোঝা যায় না। নীলাঞ্জনা তার সামনে বসে বললেন, “তুমি কী বোঝাতে চাও? কীসের চতুষ্পথ?” ব্রহ্মদত্ত ধীরে চোখ খুলল, তাতে যেন এক ধরনের ধূসর আলো ছিল—আলো নয়, যেন পুরনো কোনও সময় থেকে ফেলে আসা দৃষ্টি। সে বলল, “চারদিকের রাস্তা শুধু দিক নয়, প্রতিটি রাস্তাই একেকটা শক্তি। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম—চারটি দিক, চারটি বীজমন্ত্র, চারটি অভিপ্রায়। মাঝখানে থাকে আত্মা, আটকে পড়া এক চেতনা। আমি সেখানে আটকে আছি… আর তুমি সেই মাঝের দরজা।” কথাগুলো শুনে নীলাঞ্জনার গায়ে কাঁটা দেয়, যদিও তিনি নিজেকে যুক্তিবাদী এবং বাস্তববাদী বলে মানতেন। কিন্তু অদ্ভুতভাবে গত রাতের স্বপ্নে এই কথাগুলোর প্রতিধ্বনি ছিল—চারটে রাস্তা, আগুনের রেখা, আর মাঝখানে একটা বৃত্ত যার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে সে নিজেই, তাকিয়ে আছে উপরের আকাশে ঝুলে থাকা এক চোখের দিকে, যা দেখছে সব।

সেই দিন বিকেলেই সে আবার খুঁজে পায় তার ঠাকুরদার পুরনো একটি নোটবুক—এক জীর্ণ, বাদামি চামড়ার খামে মোড়া খাতা, যেখানে কিছু তান্ত্রিক লিপি, মণ্ডলের ছক, এবং খসড়া মন্ত্র লেখা ছিল। আশ্চর্যের বিষয়, সেই নোটবুকে হুবহু একই চিহ্ন আঁকা ছিল, যেটা ব্রহ্মদত্ত হাসপাতালের মেঝেতে আঁকছিল। পাতার নিচে হাত দিয়ে ছুঁতেই যেন ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল তার শরীরজুড়ে। পৃষ্ঠার এক কোনায় লেখা ছিল—“চতুষ্পথ চক্র—তিনজনে খুলবে, একজনে ভাঙবে, আর একজনে মুক্ত হবে।” সেই মুহূর্তে তার মনে হল, এই খাতাটি শুধু একটি পারিবারিক ইতিহাস নয়, বরং এক অসমাপ্ত সাধনার দলিল, যেখানে কোনও এক ব্রত শেষ হয়নি। নীলাঞ্জনা ভাবতে লাগল—এই সমস্ত কিছুর পেছনে কি কেবল কাকতালীয় মিলে যাওয়া? নাকি তার জীবনই ছিল সেই চক্রের অপেক্ষায়—যেটা একবার খুললে আর আগের মতো থাকবে না কিছুই? স্বপ্নে আবার আসতে লাগল আগুনে ঘেরা মণ্ডল, মাঝে দাঁড়িয়ে এক কণ্ঠহীন ছায়া, যে তাকে বারবার ইশারা করে ডাকে, আর তার পেছনে দাঁড়িয়ে সেই ভবঘুরে লোকটা, যে দেখে কিন্তু কিছু বলে না।

পরদিন ব্রহ্মদত্ত আবার বলল, “একটা চক্র খুলতে গেলে তিনজন দরকার—জাগ্রত, বিভ্রান্ত, আর অন্তঃদর্শী। আমি জানি আমি কে। আমি চক্রের রক্ষক, কিন্তু মুক্তির জন্য দরকার অন্তঃদর্শী। তুমি এখনও চোখ খোলোনি, কারণ তুমি এখনো ভয় পাও। তুমি মন দিয়ে সব বোঝো, কিন্তু চেতনা দিয়ে কিছুই ছোঁয় না।” কথাগুলো শুনে নীলাঞ্জনা সেদিন আর কিছু বলে উঠতে পারেনি। রাতে সে বাড়ি ফিরেও অস্বস্তি বোধ করছিল, যেন ঘরের দেয়ালগুলোও এখন তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘুম ভেঙে ওঠে এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতায়—সে দেখে, চতুষ্পথের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সে, কিন্তু চারপাশের সমস্ত দিকেই সময় স্থির, গাড়িগুলো চলতে চলতে থেমে গেছে, বাতাস স্থির, কেবল একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে—তার নিজের হৃদস্পন্দন। হঠাৎ করে সেই মধ্যবিন্দু থেকে ফেটে বেরিয়ে আসে আলো—আলোর মধ্যে একটা চিত্র ভেসে ওঠে, তার ঠাকুরদার মুখ, যিনি বলে উঠছেন, “তুই দেরি করেছিস, কিন্তু এখনও সময় আছে। ওর কথা শুন—ব্রহ্মদত্তকে মুক্ত করতে পারলে তোর নিজের বন্ধনও কাটবে।” নীলাঞ্জনা চিৎকার করে জেগে ওঠে, আর বুঝতে পারে—এই চতুষ্পথ কেবল একটা স্থান নয়, এটা এক মহাজাগতিক প্রতীক, এক আত্মিক ল্যাবিরিন্থ, যার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা ভবঘুরে ব্রহ্মদত্ত সময়ের বাইরের একজন—আর সে নিজে এখন তাতে টেনে পড়তে শুরু করেছে, এক অজানা ছায়ার দিকে।

হাসপাতালের সাদা আলোয় ঘেরা ঘরটির দেয়ালে বসে থাকা ব্রহ্মদত্তকে দেখে নীলাঞ্জনার মনে হচ্ছিল, এই মানুষটি যেন কোনও পাথরে খোদাই করা পুরনো সময়ের গল্প। তার চোখে ছিল এক স্থিরতা—যেটা কেবল সেই মানুষরা বহন করে, যারা বহু যুগ ধরে কোনো প্রতীক্ষার ভারে নুয়ে পড়ে গেছে। সে বলল না কিছুই, কিন্তু তার আঙুল তখনো একইভাবে হাসপাতালের মেঝেতে অদৃশ্য রেখা টানছিল, যেন সেই চক্র আঁকাই তার অস্তিত্বের প্রমাণ। নীলাঞ্জনা ধীরে ধীরে বসে পড়ল তার পাশে। সে ভাবল, এই কথাগুলো কেবল বিভ্রান্তির ফল, কিন্তু তার ভিতরে এক অদ্ভুত টান তৈরি হচ্ছিল। সে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কবে থেকে এই অবস্থায় আছো?” ব্রহ্মদত্ত ধীরে মুখ তুলে বলল, “কালের বাইরে সময়ের ধারে বসে আছি আমি। ঠিক বলতে পারব না, কত বছর। সময় আমার চারদিকে সরে গেছে, আমি থেকে গেছি মাঝখানে। এই পৃথিবী ঘুরেছে, লোক বদলেছে, কিন্তু আমার চক্র অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। আমার সময় থেমে আছে সেই মুহূর্তে, যেদিন আমি চক্রের তৃতীয় বিন্দু খুঁজে পাইনি।” নীলাঞ্জনা চুপ করে শুনছিল, মনে মনে ভাবছিল, কেউ কি এমনভাবে সময়ের ফাঁকে আটকে যেতে পারে? কিন্তু তার স্বপ্নে যেভাবে বারবার সেই চতুষ্পথের মণ্ডল, আগুনের রেখা, আর পুরনো মুখের ইঙ্গিত এসেছে—তাতে তার যুক্তিবোধ কেঁপে উঠছিল।

নীলাঞ্জনা ব্রহ্মদত্তের মুখে ‘চক্র’ শব্দটা বারবার শুনছিল এবং বুঝতে পারছিল, সে কেবল জ্যামিতিক কোন ধারা বা ধর্মীয় কল্পনা বলছে না—বরং মানসিক, অস্তিত্বগত চক্রের কথা বলছে, যেটা কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বা বর্ণের নয়। সে তার ঠাকুরদার খাতার আরও কিছু পাতা পড়ে বুঝতে পারল, “চতুষ্পথ চক্র” হচ্ছে এমন একটি তান্ত্রিক সাধনা, যা নির্দিষ্ট স্থানের সঙ্গে জড়িত—বিশেষ করে এমন সব স্থান, যেখানে চারদিক এক বিন্দুতে মিলেছে, অর্থাৎ চৌরঙ্গী, বা মোড়। সেই জায়গাগুলোতে চারদিক থেকে বয়ে আসে চেতনাশক্তি, আর সেই মাঝখানে অবস্থান করলে সাধক সময় ও অস্তিত্বের সীমা অতিক্রম করতে পারে। কিন্তু যদি সাধনার চক্র অসম্পূর্ণ থাকে, তবে সাধক সময়চক্রে আটকে পড়ে—চেতনা হয় চিরস্থায়ী, কিন্তু মুক্ত নয়। এই তথ্য পড়েই যেন হিমশীতল স্রোত বয়ে যায় তার মেরুদণ্ড বেয়ে। সে বুঝতে পারে, ব্রহ্মদত্ত সত্যি কথা বলছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও, তার অভিজ্ঞতা ও কথা বহু পুরনো তন্ত্রশাস্ত্রের সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে।

এক রাত গভীর ঘুমে, নীলাঞ্জনা দেখতে পায় নিজেকে গড়িয়া মোড়ের সেই চতুষ্পথে—চারদিকে নীরবতা, বাতাস স্থির, মানুষ-গাড়ি সব থেমে আছে, যেন কেউ সময়কে বন্ধ করে দিয়েছে। হঠাৎ সেই চতুর্দিক থেকে বেরিয়ে আসে চারটি ছায়া—উত্তর থেকে এক শিশু, দক্ষিণ থেকে এক বৃদ্ধ, পূর্ব থেকে এক নারী, পশ্চিম থেকে এক অন্ধ লোক। তারা চারজন মিলে এসে দাঁড়ায় তার চারপাশে, আর তার মাঝখানে উঠে আসে সেই মণ্ডল। তার চোখের সামনে অদৃশ্য হাতে লেখা হয়—“তৃতীয় চক্রের দ্বার এখন তোমার উপর নির্ভর করে।” ঠিক সেই মুহূর্তে সে দেখতে পায় ব্রহ্মদত্ত তার দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু এবার তার চোখে কেবল আকুতি নয়, ভয়ও। ঘুম ভেঙে সে বুঝতে পারে, এ কেবল তার অবচেতন মস্তিষ্ক নয়, কিছু একটা বাস্তবতা তার ভিতর জায়গা নিচ্ছে—এক ফাঁদ, যেখান থেকে হয়তো সে ফিরে আসতে পারবে না। ব্রহ্মদত্ত তাকে পরদিন সকালে চুপচাপ বলে, “তুমি একা নও। তোমার মতোই একজন বিভ্রান্ত ছিল, যে ভুল পথে গেছিল। তাকে এখন খুঁজে বের করতে হবে, নাহলে চক্র অপূর্ণ থাকবে। চক্র কখনো অসম্পূর্ণ থাকলে, তার ধ্বংস ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।” নীলাঞ্জনা এবার অনুভব করল, সে শুধু একজন মনোচিকিৎসক নয়—সে এক চক্রের অংশ, যার সূচনা বহু প্রজন্ম আগে, আর সমাপ্তির জন্য তার ভেতরেই জন্ম নিচ্ছে নতুন কোনো সত্য, যা সময়, যুক্তি ও বাস্তবতার ঊর্ধ্বে।

নীলাঞ্জনার চারপাশের পৃথিবী যেন এক স্তর খসে গিয়ে অন্য স্তরে রূপ নিচ্ছিল—যেখানে দিনের আলোও সন্দেহজনক মনে হয়, আর রাতের অন্ধকার এক রহস্যময় শব্দে ফুঁপিয়ে কাঁদে। ব্রহ্মদত্তের কথাগুলো এখন আর তাকে রোগীর প্রলাপ মনে হয় না, বরং প্রতিটি বাক্য যেন তার ভিতরের কোনো ঘুমন্ত কক্ষের দরজা খুলে দিচ্ছে। অফিসে সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলার সময়ও সে বারবার চমকে উঠছিল, যেন তারা বলার মাঝে হঠাৎ থেমে যাচ্ছেন, আর শব্দগুলো প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে, “তুমি সেই অন্তঃদর্শী… তুমি মাঝের দরজা…”। এক রাতে, শহরের ব্যস্ততা পেরিয়ে, সে গিয়েছিল তার ঠাকুরদার পুরনো বাড়িতে—যেটা এখন বহুদিন বন্ধ, ধুলোয় ঢেকে যাওয়া সময়ের নিঃসঙ্গ স্মৃতি। সেখানে পুরনো আলমারির মধ্যে সে খুঁজে পায় একটি কপার-পট্টির কেসে মোড়া একটি তালপাতার পুঁথি—যেখানে আঁকা ছিল এক বিশাল চক্র, যার কেন্দ্রে বসে রয়েছে তিনটি অবয়ব—এক ভবঘুরে, এক নারী, আর এক কাঁধে রুদ্র চিহ্নধারী অস্ত্রধারী পুরুষ। নিচে লেখা ছিল প্রাচীন বঙ্গীয় সংস্কৃত মিশ্রণ: “চক্র হইল দেহরূপ—তিনে পূর্ণ, একে জাগ্রত, একে বিভ্রান্ত, একে অন্তঃদর্শী।” আরেকটি শব্দ সেখানে বারবার ফিরে আসে—“মুক্তি।” সেই মুহূর্তে, ধুলোর মাঝখানে বসে থাকা অবস্থাতেই, তার মনে হয়, সে নিজেকে আর অস্বীকার করতে পারছে না। যতদিন সে এই পথকে রোগ আর বিভ্রম বলে এড়িয়ে গিয়েছে, ততদিন সে নিজেই সময়চক্রে আটকে ছিল—কিন্তু এখন, যখন সত্যের রেখাগুলো চোখে স্পষ্ট, সে আর অস্বীকার করতে পারছে না—সে-ই সেই তৃতীয় বিন্দু, যে চক্র সম্পূর্ণ করবে।

পরদিন সকালে সে আবার ব্রহ্মদত্তের ঘরে যায়। এবার তার চোখে ছিল দ্বিধাহীন স্পষ্টতা। ব্রহ্মদত্ত তাকে দেখেই মৃদু হেসে বলে, “এতদিনে চোখ খুলেছে। এখন তুই দেখবি যে দুনিয়া কেবল রাস্তা আর বাড়ি নয়—এ এক চেতনার নক্সা, যার প্রতিটি মোড়েই বসে আছে সময়ের প্রতিচ্ছবি।” সে জানায়, আগামী পূর্ণিমা রাতেই হবে চক্রচর্চার প্রথম ধাপ—চারটি চতুষ্পথে চারটি চিহ্ন স্থাপন করতে হবে, প্রতিটি চিহ্ন নির্দিষ্ট ঘন্টার মধ্যে, নির্দিষ্ট অবস্থানে। আর এই চারটি চতুষ্পথেই নাকি তৈরি হয়েছে ভারসাম্যহীনতা—শহরে ঘটছে দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা, আকস্মিক অজ্ঞান, অকারণ ট্র্যাফিক জ্যাম, সব যেন অজানা অশান্তির প্রতিচ্ছবি। নীলাঞ্জনা এবার নিজের অতীতের দিকে তাকাতে শুরু করে। সে মনে করতে পারে, যখন ছোট ছিল, তার একবার জ্বরের ঘোরে সে দেখেছিল নিজের ঘরের ঠিক জানালার পাশে মাটিতে আঁকা এক গোল রেখা—যার চারপাশে ছিল প্রদীপের মতো আলো। সেই স্মৃতিটা এতদিন ধূলোমলিন ছিল, কিন্তু এখন যেন নিজেই উঠে এসে বলছে, “তুই তখন থেকেই ডাক শুনছিলি।” ব্রহ্মদত্ত তাকে হাতে দেয় এক পুরনো তামার চক্র—বলে, “এটা তোর চিহ্ন। এখন থেকে শহরের চার কোণে তুই নিজেই দেখবি, কে কোথায় দাঁড়িয়ে, আর কোথায় দরজা খুলছে।”

রাতে ঘরে ফিরে, সে প্রথমবার নিজের চোখে দেখে দরজার নিচে এক রেখা—জ্যোৎস্নার মতো নরম আলোয়। সে দরজা খুলে দেখে, বাইরে কেউ নেই, কিন্তু বাতাসে গন্ধ ভাসছে—পুরনো চন্দনের, ভিজে মাটি আর ধূপের গন্ধ। সে নিচে গিয়ে দেখে, রাস্তায় চারটি কুকুর এক সারিতে বসে আছে, যেন পাহারাদার, আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি লোক—গায়ে ছেঁড়া কাপড়, কিন্তু চোখে আগুন। সে কিছু বলে না, শুধু চোখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে চলে যায়, আর তার পেছনে ছায়ার মতো মিলিয়ে যায় কুয়াশায়। সে আবার ঘরে ফিরে এসে আয়নার দিকে তাকায়, আর দেখে—তার কপালে স্পষ্ট আঁকা হয়ে আছে একটি চিহ্ন, যেটা খালি চোখে আগেই দেখা যায়নি, কিন্তু এখন যেন নিজের আলোয় জ্বলছে। চমকে গিয়ে আয়নাতে হাত ছোঁয়ায়, চিহ্নটা মিলিয়ে যায়, কিন্তু তার হৃদয়জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এক রক্তমাখা সত্য—সে এখন কেবল একজন চিকিৎসক নয়, সে এক চক্রের ধারক, যার মধ্য দিয়ে সময় নিজেকে মুক্ত করতে চাইছে।

স্টেথোস্কোপ আর গবেষণাপত্রের শহুরে জগৎ পেরিয়ে নীলাঞ্জনা যেদিন সেই অরণ্যের দিকে বেরোল, ভোরটা ছিল স্যাঁতসেঁতে, আকাশে জলের গন্ধ, যেন মেঘ থেকে ঝরে পড়ার আগেই বৃষ্টি তাকে পথ দেখিয়ে দিচ্ছে। ঠাকুরদার খাতার ভাঁজে রাখা ছেঁড়া মানচিত্রের কোণায় হাতের লেখায় যে নামটা ছিল—“শালতাল”—সেটা ধরেই লোকাল ট্রেন, তারপর ধুলোমাখা বাস, তারপর আরও কিছুটা হেঁটে সে পৌঁছাল এক অনুচ্চ পাহাড়ঘেঁষা শালবনের ধারে, যেখানে বাতাসে ধূপের ধোঁয়া নয়, বরং কাঁচা মাটির ঘ্রাণে এক ধরনের বয়ন চলছে। বনপথটা অদ্ভুত, দুই পাশে গাছগুলো যেন মাথা নুইয়ে তাকে দেখে নিচ্ছে, আর পথের বুকে পড়ে থাকা শুকনো পাতার শব্দ ছন্দে ছন্দে এক অচেনা মন্ত্র গেয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, সে একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে; বাঁকের পরে একই কাণ্ড, একই কস্ফুটে ফাঙ্গাস, একই ভাঙা মাটির চেরা—কিন্তু হাতঘড়ির কাঁটা বলে দিচ্ছিল সময় এগিয়ে যাচ্ছে। শেষমেশ যখন সামনে একটা কুঁড়ে-আশ্রম দেখা দিল—চৌকাঠে কাঁসার ঘণ্টা ঝুলছে, ছাদের নীচে শুকোতে দেওয়া কুশ, আলপনায় বাঁধা চতুষ্কোণ মণ্ডল—তখনই দরজার ফাঁক দিয়ে, শালের ছায়ায় বসা এক দীর্ঘদেহী অনামা সন্ন্যাসীর চোখ পড়ে তার চোখে। সেই দৃষ্টি এমন, যেন বহু দূর থেকে সে এই আগমনকে দেখেছে; তিনি বললেন, “তুই আসবি এ কথা জানতাম। অন্তঃদর্শী হলে বনের পথ নিজে খুলে যায়। আমি দিগন্ত।” শব্দটা মাটিতে পড়তেই যেন চারদিকের শালপাতা কেঁপে উঠল। নীলাঞ্জনা এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গেল সে একজন যুক্তিবাদী চিকিৎসক; ব্রহ্মদত্তের কথার প্রতিধ্বনি তার কানের ভেতরে ঘুরে ঘুরে বলল, “দিগন্ত বাবাজি—প্রাক্তন সহ-শিষ্য।” সন্ন্যাসী ইশারায় ভেতরে ডাকলেন। আশ্রমে ঢুকেই সে দেখল দেয়ালে ঝোলানো কিছু পুরনো তাম্রফলক—ত্রিভুজের ভেতরে বদ্ধ একটি বৃত্ত, বৃত্তের ভেতরে ক্ষুদ্রতম বিন্দুতে আঁকা কোন এক নামবিহীন মুদ্রা। দিগন্ত ধীরে বললেন, “বৃত্ত মুক্তির, ত্রিভুজ বন্ধনের। আমাদের গুরু কৌশলাচার্য শিখিয়েছিলেন, ‘চক্র’ যেমন খুলে দেয়, তেমনি ‘বন্ধ’ করে। ব্রহ্মদত্ত খুলেছিল, কিন্তু শেষ বিন্দুতে গিয়ে—ত্রাতা আর ভোক্তার পার্থক্য ভুলে—নিজেকেই মাঝখানে ফেলে দিয়েছে। তখন থেকে কালচক্রে তার শরীর পড়ে আছে, চেতনা টিঁকে আছে, কিন্তু সে নয়, বরং শহর ভুগছে।” নীলাঞ্জনা শুকনো গলায় বলল, “তাহলে আমি—” দিগন্ত থামিয়ে বললেন, “তুই তৃতীয় বিন্দু, অন্তঃদর্শী। তবে খেয়াল রাখ—চক্র খুললেই মুক্তি আসে না, ভুল পাত্রে খোলা চক্র শহরের মোড়ে মোড়ে সময় ফাঁসিয়ে দেয়। যে সব চতুষ্পথে উন্মাদের মতো দুর্ঘটনা, ঘড়ির কাঁটা থেমে যাওয়া, লোকের হঠাৎ ঝাঁপ দেওয়া, এসব—ওগুলো সবই চক্রের অসাম্য। ব্রহ্মদত্ত তোর সাহায্য চাইবে, কারণ সে মুক্তি চায়। আমি তোর সাহায্য চাই, কারণ শহরকে বাঁচাতে চাই। তোর সিদ্ধান্তই নির্ণয় করবে, বৃত্ত থাকবে না ত্রিভুজ।” কথা বলতে বলতে তিনি নীলাঞ্জনার দিকে তাকিয়ে থেমে গেলেন; তারপর মৃদু হাসি হেসে বললেন, “তোর কপালে যার জ্যোতিটা দেখা যায়—ওটা কিন্তু তোর দেখা নয়, বনের দেখা। তুই এসেছিস বলেই বন দেখছে।”

দিগন্ত তাকে আশ্রমচৌধুরির পেছনের খোলা অঙ্গনে নিয়ে গেলেন, যেখানে মাটিতে দাগ কেটে আছে চার বাহুযুক্ত এক প্রতিচক্র—বৃত্ত নয়, বরং চারপাশে বর্গের রেখা, কোণাগুলোতে রুদ্রাক্ষ আর মধ্যখানে ছাইয়ের ছোট ঢিবি। “এটা প্রতিচক্র,” দিগন্ত বললেন, “চক্রের প্রতিস্পন্দন। এই দিয়ে আমরা শহরের অসাম্যকে আটকে রাখি। কিন্তু চিরকালের জন্য কিছুই আটকে রাখা যায় না। পূর্ণিমায় যখন তুই ব্রহ্মদত্তের সঙ্গে চৌরাস্তার মাঝখানে দাঁড়াবি, তখন মনে রাখবি—‘বিভ্রান্ত’ কে, আর ‘জাগ্রত’ কে। তিনজন ছাড়া চক্র খোলে না। বৃত্তের ভেতরের এক বিন্দু—তুই; বাহিরের এক প্রহরী—সে; আর মাঝখানে যে সন্দেহে ঝাঁপায়, যে ভুল করে, যে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে অন্যকে ঠেলে দেয়—সেই ‘বিভ্রান্ত’ ছাড়া চক্রের আগুন জ্বলে না। কিন্তু বিভ্রান্তটি যদি ভুল শরীরে থাকে, আগুন শহরকে খেয়ে নেয়।” নীলাঞ্জনা প্রশ্ন করল, “আপনি জানেন বিভ্রান্ত কে?” দিগন্ত শালের কাণ্ডে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। “অনেক বছর আগে, একটা ছেলে, শহরের এক মোড়ে, একবার চক্র-মুদ্রা ধরেছিল—দু’মুহূর্তের জন্য। তার চোখে যে ভয়ের ছায়া দেখেছিলাম, সেটা মানুষের ভয় নয়, সময়ের ভয়। কালচক্র তাকে ছুঁয়েছিল। সে বড় হয়ে যুক্তিতে পাথর হল, কিন্তু অবচেতনে চতুষ্পথ দেখলেই তার চোখ কাঁপে। তুই চিনবি তাকে। হয়তো চিনেছিসও।” নীলাঞ্জনার মনে ঝটকা লাগল—রুদ্রপ্রতাপ? হাসপাতালে দেখা করার সময় তার দৃঢ়, অনড় যুক্তির ভেতরে যে মৃদু কাঁপন অনুভব করেছিল, সে কি তবে এই? দিগন্ত যেন তার ভাবনা পড়ে ফেলে বললেন, “নামের দরকার নেই। দরকার সত্যের। আমাদের গুরু কৌশলাচার্য শেষ রাতে বলেছিলেন—‘চক্র ভাঙিস না, বাঁধিসও না; সত্যকে ঠিক পাত্রে রাখ।’ ব্রহ্মদত্ত তখন অহংকারে বলেছিল—‘আমি কেন্দ্রে দাঁড়ালেই চক্র খুলবে।’ ফল যা হয়েছে, তুই দেখছিস।” আশ্রমের ছায়ায় বসে থাকা কিছু কাক এক সাথে ডাকা শুরু করল—কর্কশ ডাক, তবু তাতে কোনো অশনি নয়, বরং সতর্কতা। নীলাঞ্জনা কপালের ঘাম মুছতে গিয়ে অনুভব করল, ব্রহ্মদত্তের দেওয়া তামার চক্রটা গরম হয়ে উঠেছে, যেন আরেকটি হৃদপিণ্ড তার হাতে ধুপধুপ করছে। দিগন্ত বললেন, “ওটা আগুনে সিদ্ধ। তোর শরীর এখন থেকে সেতু; যে-দিক দিয়ে সময় যাবে, তার দায় তোর। তুই চাইলে আমি তোর কপালের জ্যোতিটা বাঁধতে পারি—তুই চাইলেই।” সে চমকে বলল, “বাঁধা মানে?” “বুঝতে শেখা। অন্ধ লাভ-ক্ষতির হিসাব নয়, দেখার প্রশিক্ষণ।”

সেই সন্ধ্যায়, আলো আঁধারের ভিতর দিগন্ত নীলাঞ্জনাকে এক অদ্ভুত পরীক্ষায় নিলেন—চোখ বাঁধা, পা খালি, শালপাতার পথে দড়ির মতো একটা রেখা ধরে হাঁটা। প্রতিটি দশ পা অন্তর, বাতাসে একটা ঘণ্টার আওয়াজ, যার উৎস নেই। “শুন,” তিনি পেছন থেকে বললেন, “ঘণ্টা কেবল শব্দ নয়, সময়ের তরঙ্গ। ভুলে গেলে পা যাবে গর্তে, মনে রাখলে পা উঠবে সঠিক স্থানে।” নীলাঞ্জনা বুঝল না, কিন্তু তার পায়ের তলা দিয়ে ঠান্ডা মাটি কখনো নরম, কখনো কাঁকর—আর কানে ভেসে এল ফিসফিস করা কয়েকটি কণ্ঠ: একটি শিশুর নরম হাসি, এক বৃদ্ধের গাঢ় কাশি, এক নারীর ধীর শ্বাস, এক অন্ধ লোকের লাঠির ঠুকঠুক। সে হকচকিয়ে গেল—এগুলো তো তার স্বপ্নের চার দিকপুরুষ! দিগন্ত বললেন, “দিগ্‌শক্তিরা নজর রাখে। তারা তোর শত্রু নয়; তারা দুশ্চিন্তার অবয়ব, যাদের পার হতে হয়। তুই যদি ভয়কে নাম ধরে ডাকতে পারিস, ভয় তোর পাশে হাঁটে, সামনে নয়।” তারা আশ্রমের পেছনদিকের শ্মশানঘাটের দিকে এগোল—সেখানে পুরনো, শ্যাওলা ধরা এক মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, ভাঙা সিঁড়ি; সিঁড়ির ধাপে মলিন আলতা-রেখা, যেন কারও পা ছিল, ছিল না। দিগন্ত একখানা ক্ষুদ্র রৌপ্যঘণ্টা নড়ে বললেন, “এইখানে কৌশলাচার্য শেষ রাত কাটিয়েছিলেন। এখানে আমরা প্রথম প্রতিচক্র এঁকেছিলাম, যখন শহরে ঘড়ির কাঁটা চারবার একসাথে থেমে গেছিল। ব্রহ্মদত্ত তখনও নম্র ছিল, কিন্তু মুক্তি’ শব্দটাই মানুষকে মাতাল করে। ‘মুক্তি’ মানে কী, জানিস? দায় থেকে মুক্ত হওয়া নয়; দায়ের কেন্দ্রকে দেখার শক্তি। যাকে তুই ‘ছায়াময়ী’ দেখিস, সে নারী নয়; সে তোর নিজের অদেখা সত্তা। সে যদি তোর আগে চক্রে পা রাখে, তুই কেবল বাহক হবি, দৃষ্টি নয়। কাজেই সাবধানে।” নীলাঞ্জনার বুকের ভেতর একটা ভার খসে পড়ল—সে ভাবছিল ‘ছায়াময়ী’ হয়তো কোনও দুষ্প্রাপ্য, প্রাচীন শক্তির আহ্বান; অথচ দিগন্ত বলছে সে নিজেরই প্রতিচ্ছবি। “তুমি তাহলে ব্রহ্মদত্তকে আটকাবেন?”—তার প্রশ্নে দিগন্ত দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “আটকানো আমার কাজ নয়। সতর্ক করা আমার কাজ। ওপাশে দাঁড়িয়ে যদি দেখিস কেউ অন্ধকারে হাঁটছে, তাকে টর্চ দেখানো দোষ নয়। কিন্তু টর্চ হাতে তুলে নিতে বাধ্য করা—সেটা হিংসা। আমি তোর হাতে একটা প্রতিচিহ্ন দেব। তুই চাইলে ব্যবহার করবি; না চাইলে কেবল রাখবি।” তিনি অগ্নিকুণ্ডের পাশে বসে ছাই, গোশত্পত্র আর তামার ধুলো মিশিয়ে ছোট্ট এক বর্গাকার তাবিজ গড়লেন—মাঝখানে খুঁচিয়ে দিলেন ক্ষুদ্র ত্রিকোণ, চার কোণায় আঁকলেন বিন্দু। “এটা ‘রক্ষাচক্র’। যখন চতুষ্পথে দাঁড়াবি, বৃত্ত তোর চারদিকে উঠবে, কিন্তু কোণগুলো বাইরে থাকবে—সে তোর দেখাকে তীক্ষ্ণ রাখবে, অহংকারকে নয়।” তাবিজ ধরতেই নীলাঞ্জনার তালুতে হালকা কাঁপুনি লাগল, যেন দূরে কোথাও ট্রাফিক সিগন্যাল হঠাৎ সবুজ থেকে লাল হয়ে যাচ্ছে, আর গাড়ির ভেতরের মানুষেরা একসাথে নিঃশ্বাস টানছে। দিগন্ত তাকিয়ে থেকে মৃদু বললেন, “শহর শোনে, তুই শুনিস। পূর্ণিমা পর্যন্ত সময় আছে। তুই ব্রহ্মদত্তের কাছে ফিরে যা, কিন্তু তাকে বল—গড়িয়া মোড় নয়; প্রথম ধাপ হবে যাদবপুর সিগন্যালের উত্তর-মুখে। দক্ষিণে নয়, উত্তরেই দাওয়াত। দক্ষিণের দিক আজ অসাম্য, সেখানে আগুন বেশি।” নীলাঞ্জনা চমকে উঠল—দক্ষিণমুখী সেই রাস্তা তো তার স্বপ্নে বারবার জ্বলেছিল। দিগন্ত যেন উত্তর দিলেন, “স্বপ্ন নির্দেশ দেয়, কিন্তু ফাঁদও পাতে। দিক বদলে দাও; সময় দেখবি নিজের মুখ।”

রাতটা সে আশ্রমে থাকল, কিন্তু ঘুম এলো না। বনের কালো নিঃশব্দতা মাঝে মাঝে এমন বেগে নড়ে উঠছিল, যেন দূরে অদৃশ্য এক গাড়ির কাচে বৃষ্টি ঝাপটা মারছে, হেডলাইট নিবে জ্বলে; আর সেই আলো এসে শালগাছের গায়ে লম্বা এক ছায়া তুলে দিচ্ছে—একজন মানুষের, যে মাঝরাতে চৌরাস্তার ঠিক কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে। নীলাঞ্জনা আধো ঘুমে, আধো জাগরণে দেখল—দুই শক্ত মুখোমুখি, এক জন ব্রহ্মদত্ত, অন্য জন দিগন্ত; দু’জনের চোখেই একই আগুন, কিন্তু আগুনের ভাষা আলাদা। ব্রহ্মদত্ত বলছে, “আমি মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি, কারণ আমাকেই যেতে হবে,” আর দিগন্ত বলছে, “মাঝখানে দাঁড়াতে হবে তাকে, যে দেখে; যে চায়, তাকে নয়।” দু’শব্দ মিশে গিয়ে তার কানে আছড়ে পড়ছিল, আর সে অনুভব করছিল—তার কপালের আলো এখন দুলতে দুলতে স্থির হচ্ছে, যেন কে একটা বাইরে থেকে বাতাস আটকাচ্ছে। এক সময় সে উঠে বাইরে এল—অঙ্গনের মাঝখানে দিগন্ত বসে, প্রতিচক্রের উপর হাত রেখে নিঃশব্দে জপ করছেন। তিনি চোখ না তুলেই বললেন, “ফিরে যা। শহর তোর অপেক্ষায়। তুই গেলে হয়ত সে স্থির হবে।” নীলাঞ্জনা বুঝল, প্রশ্নের থেকে উত্তর ভারী হয়নি—উল্টে আরও ভার বেড়েছে; কিন্তু সেই ভারই হয়তো তাকে সমতল রাখবে। ভোরের ছায়া যখন শালের ফাঁকপথ ভেদ করে আসছে, দিগন্ত তাকে একটা ছোট সুতোর আংটি পরিয়ে দিলেন—তামা মেশানো, কাঁচা, রুক্ষ। “এটা পর,” তিনি বললেন, “চক্রের আগুনে তোর হাত যেন আগে না পুড়ে যায়। আর মনে রাখ—যে যত জোরে বাঁচতে চায়, সে তত সহজে ভুল করে। তুই জোরে নয়, গভীরে হাঁটিস।” সে মাথা নেড়ে বেরোল। আশ্রমের দরজা পেরোতেই দেখল, বনের পথ চারদিকে চাররকম—একটা পথ পাতায় ঢাকা, আরেকটা পাথরে, তৃতীয়টায় কাদা, চতুর্থটা ধোঁয়াটে; চারপথই যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। কোথা দিয়ে বেরোবে ঠিক করতে গিয়েও সে থেমে গেল—তার ডান হাতের তামার চক্রটা হালকা টান দিচ্ছে উত্তরের দিকে। সে উত্তরমুখী হল। কয়েক পা যেতে না যেতেই বাঁ পাশের ঝোপে জলের শব্দ—খেয়াঘাটের মতো ছলাৎ ছলাৎ; মাথা ঘুরিয়ে দেখল, বনের মধ্যে কী আশ্চর্য, ছোট্ট জলাশয়ের পাড়ে এক নারী দাঁড়িয়ে—আলোর ভেতর তার মুখ নেই, কেবল চোখ, জলের ওপরে নরম ছায়া। “ছায়াময়ী”—শব্দটা তার জিভে আসতে না আসতেই ছায়া জল হয়ে গেল। সে আবার হাঁটা দিল। বন ফুরোল, কাঁচা রাস্তা এল, দূরে শহরের ধোঁয়ার রেখা; আর তার ভিতরে দুটো শক্তির ধুকপুক—ব্রহ্মদত্তের দেওয়া তামার বৃত্ত ও দিগন্তের দেওয়া বর্গাকার তাবিজ। সে জানে, এখন থেকে প্রতিটি মোড়ে তার সিদ্ধান্তই মণ্ডলের আকৃতি বদলাবে; আর ঠিক সেই মুহূর্তে তার ফোন কেঁপে উঠল—স্ক্রিনে রুদ্রপ্রতাপের নাম। কলটা ধরতে ধরতেই নীলাঞ্জনার মনে হল, হয়তো সে-ই সেই ‘বিভ্রান্ত’ যার চোখে সময়ের ভয় লেগে আছে; কিংবা—হয়তো সে-ই শহরের প্রহরী। উত্তর না দক্ষিণ, বৃত্ত না ত্রিভুজ—সবকিছু অপেক্ষা করছে পূর্ণিমার রাতে, শহরের এক চতুষ্পথে, যেখানে সময় আবার নিজের শরীর ছুঁতে চাইবে।

শহরের শেষ প্রান্তে, যেখানে পুরনো কবরস্থান এক সময় ছিল আর এখন কেবল শাল-সেগুনের ঝোপঝাড়ে ঢাকা বিস্মৃত ভূমি, সেখানে পৌঁছাল ব্রহ্মদত্ত। এই জায়গাটি তার চক্রসাধনার এক অবশিষ্ট কেন্দ্র, যেখানে একসময় তার সহচররা তপস্যা করত, মৃত্যুর পরে যাদের অস্থির স্তূপ আজও মাটির নিচে গুমরে কাঁদে। ভগ্নপ্রায় শিবমূর্তির নিচে বসে সে এক ছায়ামন্ত্র জপ করতে থাকে—একটি গুপ্ত শব্দচক্র, যা বাস্তব ও অপার্থিবের মাঝে একটি ক্ষীণ সেতু তৈরি করে। বাতাসে এক অদ্ভুত গন্ধ ভেসে আসে—না পচা, না চন্দনের মতো; বরং কিছু একটার অন্তিম সত্তার গন্ধ, যেন সময় নিজেই সেখানে নিঃশেষ হয়ে গেছে। হঠাৎ, এক সাদা পোশাক পরা ছায়ামূর্তি গাছের আড়াল থেকে এগিয়ে এল। তার চোখে ছিল না চাহনি, মুখে ছিল না ভাষা—তবুও তার উপস্থিতিতে কেঁপে উঠল ব্রহ্মদত্তের অস্থি-মজ্জা। সে জানত, এ তার পুরনো চক্রভ্রাতাদের মধ্যে কেউ, যার আত্মা এখনো পরিত্রাণ পায়নি, যাকে সে ছেড়ে গিয়েছিল তন্ত্রচক্র অসম্পূর্ণ রেখে।

ছায়ামূর্তি তাকে দেখিয়ে দিল এক গোপন গুহার পথ, যা বর্তমানে শুকিয়ে যাওয়া নদীর তলদেশে অবস্থান করছে। ব্রহ্মদত্ত সেই পথ ধরে এগোতে থাকে, তার মনের ভিতর স্মৃতির কুয়াশা ঘনিয়ে আসে। সেই গুহায় একসময় তারা করত ‘ভৈরব কিঙ্কর’ সাধনা—এক ভয়ানক এবং নিষিদ্ধ তন্ত্রচক্র, যেখানে প্রত্যেক সাধককে মৃত্যুর প্রতীক হয়ে উঠতে হত। গুহায় প্রবেশের পর ব্রহ্মদত্ত অনুভব করল সময় যেন সেখানে থমকে আছে। দেয়ালে খোদাই করা মণ্ডল, মাটিতে ছড়িয়ে থাকা অস্থি, আর বাতাসে ছড়ানো পুরনো ঘিয়ের ধূপের গন্ধ—সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল যেন সে ফিরে এসেছে এক অন্ধকার অতীতে। গুহার কেন্দ্রস্থলে সে দেখতে পেল এক কঙ্কালসজ্জিত সিংহাসন—তারই পুরনো আসন। সেই সিংহাসনে বসার আগে সে মাটিতে শুয়ে থাকা কঙ্কালের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, “আমি ফিরে এসেছি, ভাই। এবার আমি চক্র সম্পূর্ণ করব।” কঙ্কাল যেন এক মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠল—হয়ত বাতাসে, হয়ত স্মৃতিতে।

গভীর ধ্যানে ডুবে গেল ব্রহ্মদত্ত। তার সামনে ভেসে উঠল আটটি মুখ—প্রত্যেকটি তার অতীত সাধনার সাথী, যাদের আত্মা এখনো বাঁধা পড়েছে এই অসম্পূর্ণ চক্রের ফাঁদে। একের পর এক সে তাদের নাম ধরে ডাকতে লাগল—আকুতি, অর্ঘ্য, বেণীমাধব, করবী, নিধি, দার্শনিক, ঈশ্বরপতি, আর সর্বশেষে—তাঁর আত্মশিষ্য অমৃত। হঠাৎ, সে অনুভব করল, এক অদ্ভুত শীতলতা ঘিরে ধরছে তার শরীরকে। গুহার দেয়াল যেন ফিসফিস করে উঠেছে, ছায়ারা নড়ছে আলো ছাড়া, এবং এক বীভৎস ঘন নিঃশ্বাস তার গলা চেপে ধরছে। ব্রহ্মদত্ত জানত—এটি পরীক্ষা। চক্র সম্পূর্ণ করতে হলে তাকে কেবল ছায়াদের মুখোমুখি নয়, নিজের অতীত অপরাধ, ভয়, এবং ছেড়ে আসা সম্পর্কের মুখোমুখি হতে হবে। তার মনের মধ্যে ভেসে উঠল সেই মুহূর্ত, যখন সে চক্রভঙ্গ করে পালিয়েছিল—ভয়ে নয়, অহংকারে। আজ তাকে সেই অহংকারের মূল্য দিতে হবে। সে চোখ বন্ধ করে মন্ত্রের অগ্নিশিখা জ্বালিয়ে রাখল, আর তাতে এক এক করে ছায়ারা গলে গিয়ে নিঃশব্দ অশ্রুর মতো তার মাথার চূড়ায় ছড়িয়ে পড়ল। একটি চক্র সম্পন্ন হল। কিন্তু এখনো পথ অনেক।

রাত গভীর হলেও বালিগঞ্জ ফাঁকা ছিল না, নিঃশব্দে কেবল বাতাসে ঝুলে থাকা শব্দের মত, ছায়ার মত কিছু হেঁটে বেড়াচ্ছিল। ব্রহ্মদত্ত হাঁটছিল একঘেয়ে গলির ভিতর দিয়ে, মাথার উপর ছেঁড়া আকাশ, পায়ের নীচে ভাঙা পিচ আর পুরনো চিহ্নের মত এক টুকরো লাল রঙের দাগ, যা কিছুতেই মুছে যায় না। তার চোখে তখন আর জ্বলছিল না আগুনের মত দীপ্তি, বরং এক অদ্ভুত ঠাণ্ডা জমে উঠেছিল সেখানে—যেন তার ভিতরেই একটি আস্ত শ্মশান। কাঁধে পুঁটলি, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, আর সেই কপালের ত্রিকোণ লালচে চিন্হ—সব মিলিয়ে ব্রহ্মদত্ত এক চলমান প্রতিমা যেন, অথচ তার পায়ে ছিল না কোনো গন্তব্য। হঠাৎ তার চোখ পড়ে এক রিকশাওয়ালার দিকে, যার চোখ যেন কিছু বলতে চাইছিল। ব্রহ্মদত্ত স্থির হয়ে দাঁড়াল। “তুমি আমার খোঁজে এসেছ?” – এই এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল সে। রিকশাওয়ালার মুখের রেখা কেঁপে উঠল, তারপর সে মাথা নিচু করে বলল—”আমি দেখেছি, সেই সাদা পোশাক পরা মেয়েটিকে… শূন্যে ভেসে গিয়েছিল ঠিক যেমন আপনি বলেছিলেন।” ব্রহ্মদত্ত তার দিকে এগিয়ে গেল, চোখে আগুন জ্বলে উঠল। রিকশাওয়ালার স্মৃতিতে সে মেয়েটির প্রতিচ্ছবি—যা ব্রহ্মদত্তের তন্ত্রচক্রের ষষ্ঠ স্তরের মুখপাত্র হতে পারে—সে সরে গিয়েছিল গত তিন রাত আগে, চৌরাস্তায়।

চৌরাস্তাকে ঘিরেই শুরু হয়েছিল এই স্তরের চক্রসাধনা। এই নির্দিষ্ট চৌরাস্তাটিকে ব্রহ্মদত্ত মানচিত্রে খুঁজে বার করতে পারেনি, কারণ এই পথ চারটি ভিন্ন সময়ের পথে খুলে যায়। সেখানে দাঁড়ালেই অনুভব হয় যেন চৈত্র, ভাদ্র, পৌষ আর শ্রাবণ—সব ঋতু একসাথে দুলছে বাতাসে। রিকশাওয়ালার দেখানো পথে পৌঁছে ব্রহ্মদত্ত দেখে—একটি পুরনো ঘড়ির দোকানের সামনে এখন ঝুলে আছে সময়হীনতার ঘ্রাণ। এক বৃদ্ধ দোকানি তাকে বলে, “তুমি অনেক দেরি করে ফেলেছ, সাধক। সে চলে গেছে শূন্যপথে।” ব্রহ্মদত্ত তখন নিজের তন্ত্রমুদ্রা আঁকতে শুরু করে চারপাশে, এবং সেই তাবিজ থেকে একে একে বেরিয়ে আসে তার পুরনো ভুলগুলি, ছায়া রূপে। তার অতীতের প্রতিটি ভ্রান্তি, যেসব কারণে সে আটকে গেছে এই চক্রে—তারা ঘিরে ধরে ব্রহ্মদত্তকে। একটি ছায়া বলে ওঠে—”তুই তো আসলে পালাতে চেয়েছিলি, মুক্তি খুঁজছিস না, শুধু নিজেকে রক্ষা করতে চাস।” কিন্তু ব্রহ্মদত্ত এবার চুপ করে না, সে ত্রিকোণ অগ্নিচক্রের মাঝে বসে তন্ত্রোচ্চারণ শুরু করে—’অয়ি শূন্যরূপে নমঃ’। সেই ধ্বনি বাতাসকে কাঁপিয়ে দেয়, এবং ছায়াগুলো একে একে ঝরে পড়ে সময়ের ভিতরে। সেই মুহূর্তে ঘড়ির দোকানটা যেন এক সেকেন্ডের জন্য উল্টে যায়—সময় ফিরে আসে এক অন্য রূপে, যেন ব্রহ্মদত্ত এখন দাঁড়িয়ে আছে নিজেই নিজের অতীতের সামনে।

তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে সেই মেয়েটি, যার নাম নন্দিনী। সেই মুখটা যেন আগে দেখেছে, হয়তো সত্তর বছর আগে, কিংবা হয়তো আগত ভবিষ্যতের কোন ছায়া। নন্দিনী বলে—”তুমি আমাকে খুঁজছো, কিন্তু আমি তো সেই শূন্য, যাকে তুমি পূর্ণ করতে পারো না।” ব্রহ্মদত্ত তখন বুঝতে পারে, ষষ্ঠ স্তরের মুখপাত্র কেউ ব্যক্তি নয়, এক দর্শন, এক বোধ। এই বোধের সামনে দাঁড়িয়ে তার সমস্ত তন্ত্রব্যবস্থা অর্থহীন। তবু সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, মাথা নিচু করে, যেন শূন্যের সামনে একটা সমর্পণের নীরবতা। নন্দিনী তখন বলে—”তুমি যদি সত্যিই মুক্তি চাও, তবে চক্রকে পূর্ণ করতে হবে তোমার ভিতরে, বাইরে নয়।” সে বলে যায়—”এই চৌরাস্তা আসলে তোমার নিজের হৃদয়ের, প্রত্যেক পথ একেকটা স্মৃতি, একেকটা আবেগ। যতক্ষণ না তুমি নিজেকে চিনবে, ততক্ষণ মুক্তি নয়—চক্র ঘুরতেই থাকবে।” এই বাক্যগুলি শুনে ব্রহ্মদত্ত স্থির হয়ে যায়, তার কপালের ত্রিকোণ জ্বলতে থাকে আবার, এইবার আর অগ্নিতে নয়, শূন্যের ঠান্ডা আলোয়। সে আবার হাঁটতে শুরু করে, এবার চারপথ নয়, সোজা সামনে, নিজেকেই খুঁজতে।

অরণ্যের গহীন ছায়ায় ব্রহ্মদত্ত ধ্যানস্থ ছিল, চারপাশে কেবল পাখিদের শব্দ আর ঝিঁঝিঁর ডাক। অশ্বথ গাছের নিচে, কাঁসার কুণ্ডের ভেতর তেল ভরে রাখা দীপের আলোয় তাঁর মুখ স্পষ্ট হচ্ছিল না—কিন্তু তাঁর মন জেগে উঠছিল অতীত ও বর্তমানের সন্ধিক্ষণে। সেই অশরীরি কণ্ঠস্বর, যেটি কয়েক রাত আগেও তাঁর ধ্যান ভেঙে দিয়েছিল, আবার ফিরে এসেছিল—”ব্রহ্মদত্ত, সময় ফুরিয়ে আসছে। চতুর্থ দিকের রক্ষক জাগ্রত, পঞ্চম দ্বার খোলার পূর্বে তোমার মনের অন্ধকার দেখতে চায়।” এইবার আর ব্রহ্মদত্ত চমকে উঠলেন না। তিনি জানতেন, এখনকার সময় আর তন্ত্রের সময় এক নয়। এই বাস্তবের কলকাতা, যেখানে ডালহাউসি থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত মেট্রো ছুটে চলে, তার নিচেই লুকিয়ে রয়েছে এক পুরনো চক্র, যেটি গত শতাব্দীর অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেই চক্র আবার ধীরে ধীরে সক্রিয় হচ্ছে। তিনি নিজেই ছিল সেই চক্রের শেষ চালক, যাকে সময় আটকে রেখেছে নিজের ফাঁদে। কিন্তু তাঁর পথ এবার তাঁর মতো একজনকে খুঁজে পেয়েছে—আর্য।

আর্য তখন কলেজ স্ট্রিটে পুরনো বইয়ের দোকানে এক অদ্ভুত বইয়ের খোঁজে—একখানা হাতে লেখা তন্ত্র-সঙ্কলন, যার নাম ‘সপ্তচক্র দণ্ড’। দোকানদার দুলালদা হাসতে হাসতে বলেছিল, “এই বই কেউ খুঁজে পায় না, বই তোমাকে খুঁজে নেয়।” আর্যর সামনে সেই মুহূর্তেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ব্রহ্মদত্ত, আধময়লা সাদা ধুতি, গেরুয়া চাদর, মুখে অস্পষ্ট দাড়ি, চোখে এমন এক দৃষ্টি, যা সোজা বুকের ভিতরে পৌঁছে যায়। “তুমি খুঁজছো সপ্তচক্র দণ্ড?”—সে প্রশ্ন করেছিল এমনভাবে, যেন উত্তরটা আগে থেকেই জানা ছিল। সেই রাতেই আর্যর জীবনে প্রথমবার ঘুমের ভেতর এক ধাঁধায় ঘেরা চক্র ঘুরতে শুরু করে। স্বপ্নে সে দেখে সাতটি দরজা, প্রতিটি দরজার পেছনে এক-একটি মুখ, যারা তার দিকে তাকিয়ে বলছে, “তোমার ভিতরেই লুকিয়ে আছে চাবি, তুমি নিজেই জানো না।” ঘাম ভেজা গায়ে জেগে উঠে সে দেখে, জানালার পাশে বসে থাকা ব্রহ্মদত্ত চুপচাপ তাকিয়ে আছে।

ব্রহ্মদত্ত এবার আর্যকে সঙ্গে নিয়ে চলে যায় গড়িয়াহাটের এক পুরনো খ্রিস্টান কবরস্থানে। সেখানে মাটির নিচে লুকিয়ে আছে এক রহস্যময় স্তম্ভ, যেখানে চতুর্থ চক্রের রক্ষকের চিহ্ন খোদাই করা। আর্যর শরীর তখন এক অজানা শক্তির দ্বারা কাঁপছে, ব্রহ্মদত্ত বলে, “তুমি যত না আমার উত্তর, তার চেয়ে বেশি আমার আয়না। তোমার ভিতরেই আমি আটকে পড়েছি।” চতুর্থ চক্রের রক্ষক—এক অন্ধ সন্ন্যাসী, যার শরীর আগুনে জ্বলে ওঠে যখন কেউ মিথ্যা বলে, সেই আত্মা ধীরে ধীরে আর্যর সামনে রূপ পেতে থাকে। কিন্তু সেই মুহূর্তে, আর্যর অতীতের এক স্মৃতি তার সামনে ছায়ার মতো উঠে আসে—তার ছোটবেলার বন্ধু নীহারিকা, যার মৃত্যু হয়েছিল রহস্যজনকভাবে স্কুলের বারান্দা থেকে পড়ে গিয়ে। ব্রহ্মদত্ত বলে, “তোমার তন্ত্রচক্র তখনই সম্পূর্ণ হবে, যখন তুমি নিজের ছায়াকে গ্রহণ করবে। নীহারিকা এখনো রয়ে গেছে সেই সময়ের ফাটলে।” সেদিনের রাত শেষে আর্য আর আগের মতো থাকে না, আর ব্রহ্মদত্ত বুঝতে পারে—চক্র এগোচ্ছে, কিন্তু তার মূক্তির পথে নতুন বিপদ ঘনিয়ে আসছে।

অচেনা শহরের গা-ছমছমে এক অলিগলিতে, সময় থমকে আছে বলে মনে হয়। ব্রহ্মদত্ত সেই গলির পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটে, কাঁধে তার পুরনো বস্ত্র আর চোখে নিস্পৃহতা। এই শহরে এসে এক সপ্তাহ হয়েছে, কিন্তু সে বুঝতে পারছে—এই জায়গায় কিছু একটা অপেক্ষা করছে তার জন্য। গলির শেষে একটি ভগ্নপ্রায় অট্টালিকা, যার দরজা দীর্ঘদিন খোলা হয় না। ব্রহ্মদত্ত বারবার এই বাড়িটার পাশ দিয়ে হেঁটে যায়, প্রতিবারই তার বুকের ভিতর কেমন যেন টান পড়ে। আজ, এক অদ্ভুত রাতে, চাঁদের আলো ছায়া ফেলে দেয় দেয়ালের গায়ে। সে থেমে দাঁড়ায়। হঠাৎ করেই তার মনে পড়ে যায় চক্রশাস্ত্রের সেই অষ্টম ধাপ—’স্মৃতি-ভেদ’। এই ধাপে সাধককে নিজের অতীত এবং ভুল সিদ্ধান্তের সম্মুখীন হতে হয়। ব্রহ্মদত্ত জানে, এই বাড়ির ভেতরে কিছু আছে যা তার সেই স্মৃতিকে নাড়া দেবে, যা তাকে চক্রের পথে এক ধাপ এগিয়ে দেবে, অথবা স্থায়ীভাবে আটকে দেবে।

বাড়ির ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে সে অনুভব করে যেন সময় এখানে গলে গিয়েছে—ঘড়ির কাঁটা থেমে গেছে, বাতাস দাঁড়িয়ে আছে, আর প্রত্যেকটি আসবাব যেন দেখছে তাকে। দেয়ালের ছোপ ছোপ ছায়ার মাঝে হঠাৎ করে এক ঝলক চেনা মুখ—এক নারী, যার চোখে ছিল বিষণ্ণতা আর অভিমান। ব্রহ্মদত্ত থমকে যায়। সে মুখ যে বহু বছর আগে তার সাধনায় উৎসর্গ করা এক শিষ্যা—মাধবীলতা। মনে পড়ে যায়, কিভাবে সে তন্ত্রজগতের অন্ধকারে হারিয়ে যেতে যেতে মাধবীলতার হাত ছেড়ে দিয়েছিল। সেই ত্যাগ ছিল তার সাধনার এক অংশ, কিন্তু তার হৃদয়ের এক অন্ধকারও। আজ, সেই অন্ধকার ফের এসেছে। মাধবীলতার প্রেতাত্মা যেন ঘুরে বেড়ায় এই অট্টালিকায়। দেয়ালের গায়ে আঁকা এক চক্রচিহ্ন হঠাৎ করে আলোকিত হয়ে ওঠে, আর তার থেকে বেরিয়ে আসে এক ঘূর্ণিপাক, যা ব্রহ্মদত্তকে টেনে নেয় অতীতের গভীরে। সে দেখে, সে আবার সেই রাতে ফিরে গিয়েছে—যেদিন মাধবীলতা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “তুমি কি নিজেকে খুঁজছ, নাকি পালাচ্ছ?” এবং তখন সে কিছু বলেনি, শুধু চলে গিয়েছিল।

ঘূর্ণিপাক কেটে গেলে, ব্রহ্মদত্ত ফিরে আসে বর্তমান সময়ে, কিন্তু সে জানে এখন সে আর সেই ভবঘুরে ব্রহ্মদত্ত নয়। এই বাড়ি, এই স্মৃতি, এই দুঃখ—সবকিছু মিলিয়ে সে পৌঁছেছে নবম চক্রে। এখন তার ভিতরে জন্ম নিচ্ছে এক নতুন উপলব্ধি। সে বুঝতে পারে, চক্র সম্পূর্ণ করতে গেলে তাকে শুধু সাধনার গূঢ়মন্ত্র নয়, নিজের হৃদয়ের গোপন ক্ষতগুলোকেও স্পর্শ করতে হবে। ঘরের এক কোণে পড়ে থাকা পুরনো আয়নায় সে দেখে নিজের প্রতিবিম্ব, কিন্তু সেই প্রতিবিম্বে তার মুখ নয়, বরং মাধবীলতার চোখ ফুটে উঠেছে—চোখ যেগুলো প্রশ্ন করে, ক্ষমা চায়, আবার আশীর্বাদও করে। ব্রহ্মদত্ত ধীরে ধীরে পেছনে ফিরে তাকায়, জানালা দিয়ে দূরে শহরের আলো ঝলমল করছে, কিন্তু তার চোখে এখন অন্য আলো—এক অদ্ভুত শান্তি, এক অদ্ভুত প্রস্তুতি। নবম চক্র শেষ হলে, সামনে অপেক্ষা করছে শেষ ও সর্বশেষ চক্র—‘মুক্তি’র দ্বার।

১০

চন্দ্রমল্লিকা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে ব্রহ্মদত্তের দিকে, তার পায়ে কোনও শব্দ নেই, যেন বাতাসে ভেসে আসছে সে। তার চোখদুটি আজ আর চিরচেনা জ্যোৎস্নার মতো নয়, যেন কোনও অন্ধকার নদী থেকে উঠে আসা জলরঙা দৃষ্টি। ব্রহ্মদত্ত বোঝে, সময় এসে গেছে—শেষ বৃত্তটি সম্পূর্ণ করার। সে উঠে দাঁড়ায়, শরীরে এক অদ্ভুত শূন্যতা, কিন্তু মন শান্ত, নিশ্চিত। চারপাশে চক্রের শেষ রেখাগুলি জ্বলে ওঠে একে একে, যেন তার শরীরের ছায়াগুলিই উঠে এসে জ্যোতিতে মিশে যাচ্ছে। চন্দ্রমল্লিকার কপালে কপাল স্পর্শ করে ব্রহ্মদত্ত, তাদের দুই হাত মিলিত হয় বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুতে, এবং চক্রচালনার সেই পুরাতন মন্ত্র উচ্চারিত হয় তার ঠোঁট থেকে। তখন সময় থেমে যায়, বাতাস থেমে যায়, এমনকি শহরের সমস্ত শব্দ যেন এক মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ায়।

চক্র সম্পূর্ণ হওয়ার মুহূর্তে চন্দ্রমল্লিকার শরীর দিয়ে তীব্র আলো ফেটে পড়ে। সেই আলো ব্রহ্মদত্তকে গ্রাস করে, তার চেতনা ছিন্ন হতে হতে যেন সে দেখতে পায় অতীতের নিজেকে—পিতার মৃত্যুর রাত, প্রথম গুহা-প্রবেশ, রক্ত দিয়ে আঁকা বৃত্ত, অদৃশ্য গুরুর নির্দেশ, একের পর এক চক্র পূরণ, এবং অবশেষে সেই অভিশপ্ত মুহূর্ত, যেখানে সে চক্র ভাঙতে গিয়ে আটকে পড়ে কালের এক উপকোলে। আলোয়ের মাঝে সে নিজের সমস্ত অপরাধ, ব্যর্থতা, ভয়—সবকিছু দেখতে পায়, এবং তারপর ধীরে ধীরে সেই সবকিছু থেকে নিজেকে মুক্ত করে। একটি নিঃশব্দ বিস্ফোরণের মতো ব্রহ্মদত্তের অস্তিত্ব মিলিয়ে যেতে থাকে—কোনও রক্ত নেই, কান্না নেই, শুধু চক্রের কেন্দ্রবিন্দুতে একটি আগুনরঙা বালুকণা ঘুরতে থাকে, যেন তার আত্মা এখন এক নতুন পথে, নতুন চক্রে প্রবাহিত হচ্ছে।

শহরটি আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে আসে—চারপাশে মানুষ চলে, গাড়ি চলে, আলো জ্বলে। কিন্তু চৌরঙ্গীর সেই নির্জন চতুষ্পথে একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা থেকে যায়। চন্দ্রমল্লিকা, এখন আর সেই মেয়ে নয়, যে ফ্ল্যাটে গান গাইত, তার চোখে এখন সেই প্রাচীন আলো, যেটা একমাত্র যাঁরা চক্র স্পর্শ করেছে, তারাই জানে। সে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে, অজানা উদ্দেশ্যে, এক নতুন চক্রের পথে। কেউ আর ব্রহ্মদত্তের নাম করে না, কেউ জানেও না তার অস্তিত্ব। কিন্তু কোনও এক সন্ধ্যায়, কোনও এক পুরনো রাস্তার কোণে, কেউ যদি দেখেন এক ভবঘুরে বসে আছে নীরবে, চেয়ে আছে আকাশের দিকে—তবে বুঝে নিতে হবে, চক্র শেষ হয় না, শুধু স্থানান্তর হয়। আর চতুষ্পথে, যেখান থেকে সবকিছু শুরু হয়েছিল, সেখানে এখনও অদৃশ্য রেখায় আঁকা রয়েছে একটি অপূর্ণ বৃত্ত।

চতুষ্পথ এখন শান্ত। দিনের আলোয় ধুলোর ওপর দিয়ে হাঁটে সাধারণ মানুষ, কারো চোখে আর ধরা পড়ে না সেই ভবঘুরে তান্ত্রিক ব্রহ্মদত্ত। কিন্তু তার যাত্রা কি সত্যিই শেষ? এক অদ্ভুত নির্জন দুপুরে, জংশনের পাশের পরিত্যক্ত বাসস্ট্যান্ডের পেছনে, এক শিশুর চোখে ঝলক দেয় এক ছায়ামূর্তি—বৃদ্ধ, কিন্তু স্থির, চোখ দুটো গাঢ় নীল—যেন সে সব কিছু দেখেও কিছুই বলে না। শিশুটি ভয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়, আবার তাকায়—কেউ নেই। সেই সময়েই চতুষ্পথের বাতাসে যেন কিছু অদৃশ্য শব্দ ভেসে আসে, “চক্র সম্পূর্ণ, কিন্তু পথ অনন্ত…”

কবি অনির্বাণ এখন তার কবিতায় আর মুখোশের কথা লেখেন না; তিনি লেখেন আলো আর ছায়ার যুগলতা নিয়ে—কখনো সুখ, কখনো ভয়, কখনো মুক্তি। প্রতিভা নামের সেই তরুণী, যার শরীর একদা শূন্য ছিল আত্মার, আজ শান্ত, স্বাভাবিক, আর পূর্ণতায় পরিপূর্ণ। সে মাঝে মাঝে বসে চৌরঙ্গীর ফুটপাথে, রাস্তার শব্দে কান পেতে, যেন কোনও পুরনো কণ্ঠস্বর আবার ডাকে তাকে। প্যারানরমাল গবেষক ডঃ ইমরান হাসান তার ডায়েরির শেষ পাতায় লেখেন—“এই ছিল এক ভবঘুরের শেষ, অথবা এক তান্ত্রিকের চক্র সমাপ্তি। কিন্তু ব্রহ্মদত্ত হয়তো ফুরায় না, সে রয়ে যায়…সেই চিরচেনা চতুষ্পথে, অন্য রূপে, অন্য সময়ে।”

আর শহর? সে তো চলতেই থাকে। গাঢ় আলো আর গাঢ় ছায়ার মাঝে, কখনো অদ্ভুত গন্ধে, কখনো হঠাৎ সিঁথিতে ঠান্ডা বাতাসে, আবার ফিরে আসে চিহ্নহীন পায়ের ছাপ। ব্রহ্মদত্তের মতো চরিত্র হয়তো হারিয়ে যায় চোখের সামনে থেকে, কিন্তু সে গেঁথে যায় সময়ের স্তরে স্তরে—যেখানে বাস্তব আর অলৌকিকের রেখাগুলো ধোঁয়াশায় মিলে যায়। গল্প শেষ হয় না। সে শুধু রূপান্তরিত হয়—আর এক নতুন চতুষ্পথে, আর এক নতুন ব্রহ্মদত্তের খোঁজে…

– সমাপ্ত –

1000047394.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *