Bangla - প্রেমের গল্প

ভেজা জানলার ধারে

Spread the love

শ্রুতি পোদ্দার


এক

কলকাতার আকাশ সেইদিন সকাল থেকেই ভারী হয়ে ছিল, যেন অনেক পুরনো স্মৃতির মতন চেপে বসেছিল শহরের বুকে। কলেজ স্ট্রিটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে অর্ক চট্টোপাধ্যায় নিজের ছায়ার দিকেই তাকিয়ে ছিল, কিন্তু আসলে সে তাকিয়ে ছিল না কিছুতেই—সে যেন হাঁটছিল কোনো অভ্যন্তরীণ টানেই। প্রেসিডেন্সির লাল ইটের বিল্ডিংটা ভিজে গন্ধ ছড়াচ্ছিল, যেটা অর্কর অদ্ভুতভাবে ভালো লাগে। এ শহরের বৃষ্টির মধ্যে একটা নির্জনতা আছে, একটা নিরব অথচ উপস্থিতি-ময় শব্দ—যা ভীড়ের মধ্যেও নিজেকে একা করে তোলে। কলেজ গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে সে খানিকক্ষণ মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল—বৃষ্টির জল তখন টুপটাপ পড়ে চলেছে সিগনেট গেটের ওপর। তার পকেটে রাখা ছাতা সে খুলল না—কারণ অর্কর বৃষ্টি ছোঁয়ায় চলার অভ্যেস পুরনো। সে জানে, একটু ভিজলে, জামার কাঁধে বৃষ্টির জল জমলে, কিছু অনুভবগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গেট পেরিয়ে সে হাঁটল কলেজের দিকটায়, মাথায় ছাতা না থাকায় তার কাঁচের চশমায় জমে উঠেছে সাদা বিন্দু। সিঁড়ি বেয়ে উঠে লাইব্রেরির দিকে যেতে যেতে তার মনে পড়ল আজ ক্লাস খুব একটা নেই, কিন্তু তবুও সে এসেছে—কারণ সে জানে, নীলা আসবে।

নীলা সেন, ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী, অর্কর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাদের বন্ধুত্ব কলেজ জীবনের শুরু থেকেই—ক্লাসরুম, ক্যানটিন, নাটকের মহড়া, রবীন্দ্র সদনের পেছনের ক্যাফে—সব জায়গায় একসঙ্গে হেঁটে আসা দুটো মানুষ। কিন্তু আজকের দিনে সেই বন্ধুত্বের ছায়ায় জমে থাকা অন্য কোনো অনুভূতি অর্ককে অস্থির করে তুলেছে। অর্ক জানে, সে নীলাকে ভালোবাসে—কিন্তু এই ভালোবাসা উচ্চারিত নয়, শব্দে বাঁধা নয়। তা যেন কোনো পুরনো কবিতার মতো, যার কোনো নাম নেই, কিন্তু অনুভব আছে। লাইব্রেরির করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে দূর থেকে দেখল, নীলা কলেজ চত্বরে ঢুকছে, খোলা চুল ভিজে যাচ্ছে বৃষ্টিতে, আর হাতে ধরা আছে একটা ছোট্ট নীল ছাতা, যেটা কখনোই ঠিক করে খোলা থাকে না। নীলা হাসছে কাউকে দেখে, কার সঙ্গে হেসে কথা বলছে—তা অর্কর জানার প্রয়োজন নেই, সে শুধু ওই হাসিটার তলায় জমে থাকা বিষণ্ণতাকে চেনে। একসঙ্গে হেঁটে লাইব্রেরির বারান্দায় এসে দাঁড়াল দুজনে—বৃষ্টির জল ছুঁয়ে যাচ্ছে তাদের পায়ের নিচের সিঁড়ি, চারপাশটা নীরব অথচ কুয়াশাময়। আজ ক্লাস ক্যানসেল হয়েছে—তাই কলেজে লোকজন কম, শব্দ নেই তেমন। তারা দুজনে বসল লাইব্রেরির বাঁদিকের জানলার ধারে কাঠের বেঞ্চিতে, যেখান থেকে দেখা যায় বাইরের রোডটা—ঝরঝরে জলধারায় যেন ভেসে যাচ্ছে সময়।

“আজ একটু ঠান্ডা লাগছে না?”—নীলা বলল, ভেজা চুল কাঁধ থেকে সরিয়ে।
অর্ক মাথা নাড়ল, হেসে বলল, “এই ঠান্ডাটা তো ভালো… একটু কবিতার মতো।”
নীলা তাকিয়ে রইল অর্কর দিকে, সেই পুরনো দৃষ্টিতে—যেটা অনেক কথার মধ্যে থেকেও অনেক কিছু না বলার দৃষ্টি। তারা কথা বলল কিছুক্ষণ—বই নিয়ে, থিয়েটার নিয়ে, একটা পুরনো রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে, যেখানে প্রেমের অর্থ নিরবতা। কিন্তু এই কথাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে অন্য কিছু জমে উঠছিল—যেটা neither friend-zone nor confessional—বরং এমন কিছু যা শুধু এক নির্দিষ্ট মুহূর্তে, নির্দিষ্ট সুরে, নির্দিষ্ট বৃষ্টিতে ধরা দেয়। অর্ক নীলার দিকে তাকিয়ে ভাবল—এই মেয়েটা জানে না, সে কতটা প্রভাব ফেলেছে তার জীবনে। জানে না, বৃষ্টির দিনে জানলার পাশে বসে থাকা নীলাকে দেখেই কবিতার ভাষা পাল্টে যায়। জানে না, তার হেসে ওঠার শব্দটাই এই শহরের শিরায় রক্তের মতো বয়ে চলে। কিন্তু অর্ক কিছুই বলল না—সে শুধু জানালার দিকে তাকিয়ে রইল, বাইরের রাস্তায় জল জমে যাচ্ছে, আর জানলার কাঁচে জমছে একরাশ অপ্রকাশিত ভাবনার ছাপ। নীলা তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আজ যদি বৃষ্টি থেমে যেত, তাহলে তুই কি কিছু বলতিস?”
অর্ক একটু থমকে গেল—তারপর ধীরে মাথা নাড়িয়ে বলল, “বৃষ্টি তো বলার ভাষা দেয়। থেমে গেলে তো সব চুপ হয়ে যাবে।”
আর তারপরে কিছু না বলেই তারা দুজনে বসে রইল, জানলার ধারে—ভেজা কাঁচের ওপারে ছায়া হয়ে রইল তাদের অনির্বচনীয় সম্পর্কের প্রথম আলতো স্পর্শ।

দুই

ক্যানটিনে বসে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে নীলা চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল, জানালার ওপারে ছায়া পড়া কাগজের মতো আবছা বৃষ্টির রেখা, মাঝে মাঝে ঘনিয়ে আসা দমকা হাওয়া। ঘরটা অর্ধেক খালি—মাত্র কয়েকজন বসে আছে টেবিলের চারপাশে, কিছু চায়ের গ্লাসের পাশে শুকনো বিস্কুট, কিছু হেসে ওঠার শব্দ আর কিছু অন্ধকারে ঢাকা চিন্তা। অর্ক এসে বসে পড়ল নীলার ঠিক সামনে, তার হাতে চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আজ কী ভাবছিস এত চুপ করে?” নীলা হেসে মাথা নাড়ল, “তেমন কিছু না। শুধু… এই শহরের বৃষ্টির শব্দ শুনছি। মনে হয়, এই শব্দগুলো একটা গান গায়, যেটা বাইরে কেউ শোনে না।” অর্ক কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। সে জানে, এইরকম কথার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে নীলার আসল সত্তা। সে জানে, বাইরে থেকে যতই সে হালকা হেসে থাকুক, ভেতরে কোথাও যেন নীলা নিজেই নিজের একটা জানলা খুলে বসে থাকে, আর অপেক্ষা করে কেউ এসে বুঝুক তাকে।

“তুই জানিস?” অর্ক বলল চুপচাপ, “তোর এই চুপ করে থেকে কথার মাঝখানে একটা ছন্দ আছে, যেটা বইয়ের ভাষায় পাওয়া যায় না।”
নীলা হেসে বলল, “ছন্দ থাকলেও তা সবসময় কবিতা হয় না, অর্ক। কিছু কিছু ছন্দ শুধুই থেকে যায়… একার।”
এই একার শব্দটাই যেন হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যানটিনের ভেতরে গা ছমছমে এক নিঃশব্দতা ছড়িয়ে দিল। অর্কের হাতের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছিল, কিন্তু তার চোখটা যেন নীলার চোখের গভীরে ডুবে গিয়েছিল। তারা কথা বলতে লাগল, ইংরেজি সাহিত্যের মেয়েলি চরিত্রগুলো নিয়ে, যেখানে প্রেম আসে কিন্তু থেকে যায় না। অর্ক বলল, “জেন আয়ারের কথা ভাব। সে তো ভালোবাসে, কিন্তু নিজের সম্মানেও বিশ্বাস রাখে।”
নীলা জিজ্ঞেস করল, “আর তুই? তুই যদি কাউকে ভালোবাসিস, তাহলে কি তাকে বলতে পারবি?”
অর্ক থেমে গেল, একটুখানি হাসল। বলল, “আমি চাই, সে বুঝুক। আমার বলা শব্দের আগেই।”
এই কথাটা নীলা শুনে কিছু বলল না। তার চশমার কাচে জমে উঠেছিল হালকা ফোঁটা। হয়তো বৃষ্টির ছিল, হয়তো তার চোখের। তারা বুঝছিল—শব্দের ভেতর দিয়ে একে অপরকে তারা ছুঁয়ে যাচ্ছে, এমনভাবে যা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। সেই ছোঁয়া ধরা দেয় এক মুহূর্তে, যখন পাশে বসা মানুষটার নিঃশ্বাসে নিজের নাম শোনা যায়, অথবা একটি সাধারণ বাক্যে অসাধারণ অভিপ্রায় লুকিয়ে থাকে।

চা শেষ হয়ে গেলে তারা বেরিয়ে এল ক্যানটিন থেকে, বাইরের ঝিরঝিরে বৃষ্টি তখনো থামেনি, বরং হালকা ঠান্ডা আর ধোঁয়াটে আলোয় শহরটাকে যেন ছবির মতো লাগছিল। কলেজের সামনের পুকুরটার ধারে এসে তারা দাঁড়াল, সেই জায়গাটা যেখানে বসে বসে বিকেলে তারা অনেক গল্প করেছে—নাটকের স্ক্রিপ্ট, নতুন সিনেমা, বেকার দুঃখ, অথবা কোনো কবির লাইন নিয়ে তর্ক। কিন্তু আজকের এই বিকেল অন্যরকম। পুকুরে জল জমেছে, তার ওপর ছায়া পড়েছে গাছের—আর গাছের পাতাগুলো হালকা বাতাসে ভিজে কেঁপে উঠছে। নীলা বলল, “তুই জানিস অর্ক, আমি প্রায়ই ভাবি—এই কলেজটা শেষ হয়ে গেলে আমাদের কথাগুলো কোথায় থাকবে? এই আড্ডা, এই চায়ের কাপ, এই জানলা?”
অর্ক মাথা নাড়ল, “স্মৃতির জানলার কাঁচে… যেমন আজকের এই বিকেল থাকবে, একদিন।”
নীলা হঠাৎ করেই থেমে গেল, বলল, “কিন্তু যদি তুই তোর কথা বলার আগেই কেউ হারিয়ে যায়?”
এই প্রশ্নে অর্কর মুখ থেমে গেল, যেন কোনো পুরনো ব্যথার ওপর হঠাৎ কেউ হাত দিয়ে ফেলেছে। তার গলার স্বর বদলে গেল, “আমরা কেউ হারাই না, নীলা। শুধু নিজেদের কিছু কিছু কথা না বলেই ফেলে রাখি… সেই ফেলে রাখা কথাগুলোই একদিন আমাদের আড়াল করে দেয়।”
নীলা তার দিকে তাকিয়ে রইল, অনেকক্ষণ। তার চোখে ছিল এমন এক চাহনি, যা কোনো সাহিত্যে পাওয়া যায় না, যা শুধু অনুভব করা যায়। সেই মুহূর্তে, বাইরের বৃষ্টির মতোই, ভেতরের অনুভূতিগুলো ঝরে পড়ছিল, চুপচাপ—একটা সুরে, যার নাম নেই, ভাষা নেই, শুধু আছে—একটি আলতো আকর্ষণ, একটি অনুচ্চারিত প্রেমের প্রথম রাগ।

তিন

কলেজ বিল্ডিংয়ের পেছনের ছাদটা বর্ষার দিনে একটা আশ্রয়ের মতো হয়ে দাঁড়ায় — যে আশ্রয়ে শব্দ কম, ছায়া বেশি, আর জানলায় জমে থাকা জলের রেখাগুলোতে মিশে থাকে ফেলে-আসা বিকেলের গন্ধ। সেইদিন, দুপুরবেলা বৃষ্টি একটু কমেছিল বটে, কিন্তু বাতাসে ছিল জলের ধোঁয়া, মেঘের ওজন আর শহরের অদৃশ্য বিষণ্ণতা। অর্ক ছাদের কার্নিশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল, গায়ে হালকা নীল শার্ট, চুলের ভেতর ভিজে জলের রেখা, আর চোখে ছিল একরাশ চুপচাপ চিন্তা। তার সামনে ছড়িয়ে থাকা শহরটাকে দেখে মনে হচ্ছিল, যেন সবকিছুই আজ একটু ধুয়ে-মুছে গেছে—গলি, গাছ, রেলিংয়ের পুরনো রং, এমনকি কলেজের সিঁড়ির ধুলোও। অর্ক জানত না, ঠিক কী ভাবছে, কিন্তু তার ভেতরে একটা ভার জমছিল—একটা না-বলা কথা, যা দিন দিন বেড়ে উঠছে।

নীলা কিছুদূরে দাঁড়িয়ে ছিল, ছাতাটা হাতে, কিন্তু খোলা নয়। তার মুখে কোনো কথা ছিল না, শুধু দু’চোখে জলের মত একটা অভিব্যক্তি—নিশ্চিন্ত নয়, অথচ শান্ত। তারা কিছু বলেনি একে অপরকে। নীলা মাঝেমাঝে তাকাচ্ছিল আকাশের দিকে, যেন মেঘের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা কিছু বোঝার চেষ্টা করছে। অর্ক তার দিকে তাকিয়েই ছিল, চুপচাপ। তার মনে হচ্ছিল, আজ যেন একটা কিছু ভেঙে পড়বে ভেতরে—হয়তো নীরবতা, হয়তো বন্ধুত্বের দেয়াল, কিংবা সেই বহুদিনের জমে থাকা অস্বীকার। হঠাৎ নীলা বলল, “তুই আজ সকাল থেকে খুব চুপচাপ… তোর চোখে কেমন যেন ক্লান্তি। ঠিক আছিস তো?”
অর্ক একটা হালকা হাসি দিল, “চোখের নিচে ঘুম নেই, আর মনের ভেতর কথা বেশি—এই ক্লান্তি খুব আপন হয়ে গেছে।”
নীলা চুপ করে রইল। কিছুক্ষণের নীরবতায় কেবল ছাদের রেলিংয়ে জল পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছিল।

অর্ক ধীরে ধীরে এগিয়ে এল নীলার পাশে, তাদের মাঝে ছিল একহাত ফাঁকা জায়গা, কিন্তু সেই ফাঁকা জায়গাটা যেন একটা অলঙ্ঘ্য দূরত্ব। “তুই জানিস?”—অর্ক বলল, “আমি তোকে প্রথমবার দেখে বুঝিনি যে তুই এমন হয়ে যাবি। এমন, যে তোর কথা মনে পড়লে মন কেমন করে।”
নীলা একবার তাকাল, তারপর চোখ নামিয়ে ফেলল, বলল, “আমি কি বদলে গেছি?”
“না, তুই তুই-ই আছিস… কিন্তু আমার দেখাটা বদলে গেছে।”
এই কথাগুলো এত হালকা করে বলা হয়েছিল যে মনে হচ্ছিল, যেন বাতাসে ওড়ানো কোনো পাতার মতন—ছুঁলে উড়ে যাবে, না ছুঁলে থেকে যাবে বুকের ভেতর। তাদের নিঃশ্বাস একসঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছিল ছাদের বাতাসে, আর এই মুহূর্তটায় শহরটা যেন থেমে গিয়েছিল—শুধু একটা নরম, অথচ অদম্য আকর্ষণ ছড়িয়ে পড়ছিল চারপাশে। অর্ক একটু এগিয়ে এল, নীলার ছাতার ভাঁজ ছুঁয়ে বলল, “এই ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে থাকলে সব কিছু থেকে বাঁচা যায়… কিন্তু আমি তো সেই ছাতার বাইরেই থেকে গেছি, নীলা।”
নীলা কাঁপা গলায় বলল, “তুই জানিস, আমি তোকে দেখে অনেক কথাই বুঝতে পারি… কিন্তু একটাই ভয় পাই—যদি কোনো একদিন এই বন্ধুত্বটাই আর না থাকে।”
অর্ক কিছু বলল না, শুধু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। নীলার চোখে তখন জল ছিল না, কিন্তু তার কণ্ঠে ছিল সেই ভার—যেটা ভালোবাসা না বলে শুধু অনুভবের নাম নেয়। বৃষ্টির গন্ধ আবার একটু ভারী হয়ে উঠছিল, আকাশ ঝিমঝিম করছিল। তাদের দুজনের হাত একটুখানি ছুঁয়ে গিয়েছিল, আর সেই ছোঁয়াতেই যেন বুকের ভেতর কিছু নড়ে উঠল—যেটা শরীর ছুঁয়ে নয়, আত্মা ছুঁয়ে যায়। এ মুহূর্তে তারা জানত, কিছু একটা বদলে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে, ভিজে ছাদ আর আকাশের সাক্ষী রেখে। বন্ধুত্বের নাম রেখে ভালোবাসা ধরা দেয়নি, কিন্তু ভালোবাসার মৌনতা শব্দকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এবং এই ছাদের নিচে, এই ছায়ার মতো বিকেলে, অর্ক ও নীলা জেনে গেল—কিছু অনুভবকে আর বন্ধু বলা যায় না।

চার

কলেজ লাইব্রেরির সেই পুরনো ঘরটা ছিল নিঃশব্দতার জন্য বিখ্যাত—মাথার উপর ফ্যানের ঘূর্ণি, পুরনো বাঁধানো বইয়ের গন্ধ আর জানলা দিয়ে আসা হালকা আলোয় একটা ঘোরের পরিবেশ তৈরি হয়। সেইদিন দুপুরে অর্ক একা বসেছিল লাইব্রেরির দ্বিতীয় সারির টেবিলে, চোখের সামনে একটা পুরনো খোলা বই, পাশে ছড়িয়ে রাখা তার নোটবুক, আর এক কোণে শুয়ে থাকা একটা হলুদ চিঠি—যেটা তার দাদুর পুরনো ট্রাঙ্ক থেকে পাওয়া। চিঠিটা ১৯৭১ সালের, একজন কবি তার প্রেমিকাকে লিখেছিলেন, “তুমি না থাকলে বৃষ্টি নিঃশব্দ হয়ে যায়”—এই এক লাইন বারবার পড়ে যাচ্ছিল অর্ক, যেন সেই লাইনটার মধ্যেই সে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিল। বাইরের বৃষ্টি একটু থেমেছে, কিন্তু জানলার কাঁচে জমে থাকা জলের দাগগুলো যেন থেকে গেছে, কিছু মুছে যায়নি। অর্ক ভেতর থেকে বেদনাহত, কারণ তার অনুভব আজও শব্দের চিঠিতে পরিণত হয়নি। নীলার প্রতি তার ভালোবাসা রয়ে গেছে চোখের গভীরে, কবিতার পাতায়, আর এই চিঠির হলুদ অক্ষরের মধ্যে।

নীলা হঠাৎ করেই লাইব্রেরির দরজায় এসে দাঁড়াল। তার ভিজে পায়ের আওয়াজ আর বইয়ের শেলফে ছায়া পড়া শরীর অর্ক প্রথমে টের পায়নি। তারপর যখন নীলা আস্তে করে বলল, “তুই আজ এখানে?”—তখন অর্ক চমকে উঠে তাকাল। নীলার হাতে একটা বই, চোখে হালকা ক্লান্তি, আর মুখে সেই চেনা নির্লিপ্ত অভিব্যক্তি, যেটা একা সময় কাটিয়ে ফেরা মানুষের হয়ে থাকে। অর্ক একটু হেসে বলল, “চিঠি পড়ছিলাম… একজন লিখেছিল—‘তুমি না থাকলে বৃষ্টি নিঃশব্দ হয়ে যায়।’ জানিস, আমি ভাবছিলাম—এই লাইনটা ঠিক কার জন্য লেখা হয়েছিল?”
নীলা চুপ করে রইল, তারপর বলল, “তুই কার জন্য ভাবছিস সেটা আমি জানি না, কিন্তু এই বৃষ্টির মধ্যে যাকে মনে পড়ে, তারই জন্য লেখা হয়েছিল হয়তো।”
এই কথাটার মধ্যে এমন একটা নিঃশব্দ স্পর্শ ছিল যে অর্ক যেন স্থির হয়ে গেল। নীলার কণ্ঠস্বর ছিল শান্ত, কিন্তু গভীর—তাকে বুঝতে হলে শব্দের গায়ে হাত না দিয়ে ভেতরের অনুভবে ঢুকতে হয়।

তারা দু’জনে পাশাপাশি বসে চুপচাপ বইয়ের পাতায় চোখ রাখল, যদিও মন অন্য কোথাও ছিল। নীলা বলল, “তুই কি কখনো কাউকে চিঠি লিখেছিস?”
অর্ক বলল, “হ্যাঁ… লিখেছি। কিন্তু কখনো পাঠাইনি। কারণ ভয় পাই—যদি সেই চিঠি পড়ে সে পালিয়ে যায়?”
নীলা একটু থেমে বলল, “যদি না পাঠাস, তাহলে সে জানবেই না… যে কেউ তার জন্য অপেক্ষা করছে।”
এই কথাগুলো কাগজে লেখা থাকলে হয়তো এমন তীব্র হত না, কিন্তু নীলার চোখের দিকে তাকিয়ে অর্ক বুঝল—সে এসব শুধু ‘বলছে’ না, বরং কিছু একটা বোঝাতে চাইছে। নীলার দৃষ্টি একপলক বইয়ের পাতায়, পরমুহূর্তে অর্কের চোখে। তারা কেউ কিছু বলে না, কিন্তু জানে—এই মৌনতা, এই লাইব্রেরির নিঃশব্দতা, আসলে তাদের মধ্যে জমে থাকা না-বলা কথাগুলোর প্রতিবিম্ব। অর্ক আস্তে করে চিঠিটা নীলার দিকে এগিয়ে দিল।
নীলা সেটা না নিয়ে বলল, “তুই এটা আমাকে দিতে চাস?”
অর্ক একটু ভেবে বলল, “না… শুধু চাই, তুই পড়ে দেখিস, তোর নিজের মতো করে।”
নীলা চিঠিটা হাতে নিল, ভাঁজ খুলে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, “শব্দগুলো খুব আলতো… কিন্তু বুঝি—এগুলো আসলে ভালোবাসা ছুঁয়ে লেখা।”

সেই মুহূর্তে, বাইরের জানলা দিয়ে আবার বৃষ্টি শুরু হল, কিন্তু এবার শব্দটা যেন বেশি ভারী নয়, বরং একটা তালের মতো—যেন কারও হৃদস্পন্দনের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। লাইব্রেরির পুরনো ঘরে বসে, বই আর চিঠির ভেতর দিয়ে, দুটো মানুষ ধীরে ধীরে কাছে আসছে—কোনো হাত ধরা নেই, কোনো চুম্বন নেই, শুধু অনুভূতির সাঁকোতে দু’জন হেঁটে যাচ্ছে শব্দ ছাড়াই। অর্ক জানত না, নীলা কখন পড়বে এই চিঠিটা, কিংবা আদৌ কোনো উত্তর দেবে কি না। কিন্তু তার ভেতরে একটা ভার নেমে গিয়েছিল—কারণ সে জানে, নীলা এখন জানে। আর কোনো কোনো ভালোবাসা থাকে, যা শুধু জানলেই যথেষ্ট—প্রতিউত্তর চায় না, কারণ তারা চিরকাল চিঠির মতো হয়ে থাকতে জানে—পাঠানো হয়নি, তবুও মুছে যায় না।

পাঁচ

কলেজের সেই পরের সপ্তাহটা যেন অর্ক আর নীলার জন্য এক অদ্ভুত আবেশের মধ্যে কেটেছিল। তারা প্রতিদিন দেখা করত, যেমনটা আগেও করত, কিন্তু এখন যেন সেই দেখার মধ্যে এক নীরব লুকোচুরি খেলা চলত—দৃষ্টি এড়ানোর চেষ্টা, আবার তাকিয়ে পড়া, কথার ভিড়ে হঠাৎ থেমে যাওয়া, আর অকারণে হেসে ওঠা। বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো, ক্লাসে একসাথে বসা, ল্যাব পার্টনার হিসেবে কাজ করাও নতুন মাত্রা পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কেউ বুঝতে পারত না—ওদের মধ্যে কী যেন বদলে যাচ্ছে। অর্ক আগের মতোই সহজ, কিন্তু মাঝে মাঝে চোখে এক ধরনের অন্যমনস্কতা দেখা যেত। সে যেন নিজের মধ্যে নতুন কিছু আবিষ্কার করছে, যার স্পষ্ট ব্যাখ্যা তার নিজের কাছেও নেই। নীলা ছিল একটু বেশি গম্ভীর, কম কথা বলত, কিন্তু চোখে ও মুখে ছিল এক কোমল টান—যেন সে কিছু লুকিয়ে রাখছে আবার তা-ই বলতেও চাইছে। তাদের আড্ডা চলত ক্যান্টিনের পিছনের বেঞ্চে, রোদের গায়ে বসে বা বৃষ্টির ফোঁটার শব্দের মাঝে। একদিন, কলেজ শেষে দুজন হেঁটে চলেছিল হেস্টিংস-এর দিকের ফুটপাথ ধরে। রাস্তার দুপাশে ঝরঝরে বাতাস, গাছের পাতায় বৃষ্টির ছিটে, আর নীলা তার খোলা চুলে একবার হাত বুলিয়ে বলল, “তুই কি কখনও অনুভব করিস, কারো পাশে চুপচাপ হাঁটলেও একটা আলাদা শান্তি আসে?” অর্ক একটু থেমে হেসে বলল, “হ্যাঁ… কিছু মানুষ থাকে, যাদের পাশে শব্দের দরকার হয় না।” সেই মুহূর্তেই যেন কোথাও ভেতরে গাঢ় কিছু জমা হতে থাকে—না বলা কথাগুলোর নিচে।

পরের দিন, ক্লাসের শেষে কলেজ প্রায় ফাঁকা। বৃষ্টি থেমেছে, কিন্তু জানলার কাঁচে রয়ে গেছে জলের দাগ। অর্ক আর নীলা, প্রতিদিনের মতোই সিঁড়ির মাথায় দেখা করল। “চল একবার ওপরে যাই?” অর্ক বলল। ছাদে ওঠা গেল না, তালা দেওয়া, তাই তারা উঠে গেল তৃতীয় তলার এক ফাঁকা ঘরে—একটা পুরোনো ফিজিক্স ল্যাব, যেটা এখন ব্যবহার হয় না। ঘরে ঢুকে জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়াল নীলা, বাইরের দিকে তাকিয়ে। অর্ক চুপচাপ তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। জানলা দিয়ে ভেজা গাছের পাতা, মেঘলা আকাশ, আর দূরের ট্রামের হালকা শব্দ ভেসে আসছে। তারা দুজনে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইল, কোনো কথা বলল না। যেন সেই নীরবতার মধ্যেই কথা ছিল বেশি। হঠাৎ, অর্ক নিচু গলায় বলল, “নীলা, তুই জানিস তো… আমার তোকে না, একটা সময় থেকেই অন্যরকম লাগছে।” নীলা মুখ ঘুরিয়ে তাকাল অর্কের দিকে—চোখে বিস্ময়, সংকোচ, আর কোথাও যেন এক ধরনের প্রতীক্ষা। অর্ক আর কিছু বলল না, শুধু নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে তার কাঁধ ছুঁয়ে দিল—একটা আলতো স্পর্শ, যা কোনো যৌনতা নয়, বরং গভীর অনুভবের মৃদু বার্তা। নীলার চোখের পাতায় জল জমে উঠল, কিন্তু সে হাসল—একটা ধীর, শান্ত হাসি, যা উত্তর না দিয়ে উত্তর দিয়ে দেয়। বাইরে বৃষ্টি শুরু হল আবার, জানলার গায়ে টিপ টিপ শব্দ পড়ছে, আর ঘরের নিস্তব্ধতায় সেই শব্দ দুজনের নিঃশ্বাসের সাথে মিশে গেল।

তারা জানত, এই সম্পর্ক এখন আর কেবল বন্ধুত্বে আটকে নেই। কিন্তু তারা তাড়াহুড়ো করল না, বরং সেই আকর্ষণের গভীরতাকে উপলব্ধি করতে লাগল ধীরে ধীরে। কলেজের মধ্যে প্রতিদিনের দেখা, লাইব্রেরির সিঁড়িতে বই হাতে বসা, কখনও বা মেট্রো স্টেশনের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা—সবই যেন একটা নতুন ভাষায় রচিত হচ্ছিল। তাদের শারীরিক ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও মানসিক সংযোগে এক অদ্ভুত টান তৈরি হচ্ছিল, যা কোনো নির্দিষ্ট নাম চায় না। এক সন্ধ্যায়, কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তারা আবার দেখা করল, সাউথ কলকাতার এক পুরোনো ক্যাফেতে। চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠছে, জানলার বাইরেও বৃষ্টি পড়ছে, আর নীলা হঠাৎ বলল, “তুই কি আমার পাশে অনেকদিন থাকবি?” অর্ক এক গাল হেসে বলল, “যতদিন তুই চাইবি।” কথাটার মধ্যে ছিল না কোনো নাটকীয়তা, কোনো প্রতিশ্রুতি নয়—শুধু উপস্থিতির আশ্বাস। সেই দিনটাও, সেই বিকেলটাও কেটে গেল, কিন্তু নীলা মনে মনে জানল—সে ধীরে ধীরে নিজেকে এই সম্পর্কের মধ্যে ছেড়ে দিচ্ছে। শুধু আকর্ষণ নয়, শুধু আবেগ নয়, বরং এমন এক ভরসা যেখানে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলতেও ভয় পায় না।

ছয়

কলেজ ক্যাম্পাসের পুরনো লাইব্রেরি বিল্ডিংটার চারপাশে আজ এক ধরনের অদ্ভুত নীরবতা। ছুটির দিনের দুপুর, ছাত্রছাত্রী নেই বললেই চলে, আর বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি চলছে দিনের শুরু থেকে। নীলা আজ লাইব্রেরির শেষ সারির জানলার ধারে বসে, হালকা হাওয়ার ছোঁয়ায় চুলের গোছা চোখে এসে পড়ছে, সে পাতার ফাঁকে আঙুল চালিয়ে কী যেন খুঁজছে। একটু আগে অর্ক এসে ঢুকেছে লাইব্রেরিতে, কিন্তু কথা বলেনি—শুধু এক পলক তাকিয়েই চলে গেছে পাশের র‌্যাকের দিকে। এই কয়েকদিনের মাঝে, বিশেষ করে যেদিন কলেজের ক্লাসরুমে তারা একে অপরের দিকে চেয়ে রয়ে গিয়েছিল কিছু না বলে, সেদিন থেকে কিছু যেন পাল্টে গেছে। কথাগুলো এখন মুখে নয়, চাহনিতে হয়, চলাফেরার ধীর ছন্দে বাজে। তারা কথা না বলেও যেন অনেক কিছু বলে ফেলছে, আর আজকের এই বর্ষামুখর দিনে, সেই না-বলা কথাগুলো আরও ঘনীভূত হয়ে উঠছে।

নীলার হাতে ধরা বইটা পড়ার ভান, চোখ তার বাইরে, জানলার কাঁচে জমা জলের রেখায়। হঠাৎ পাশের টেবিলে অর্ক এসে বসে, তার হাতে একটা পুরনো কবিতার বই, ‘উত্তরাধিকার’। তারা পাশাপাশি বসে, অথচ কিছু বলছে না, কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যায়—এই নীরবতাও এক ধরনের সংলাপ। অর্ক বই খুলে পড়ে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বইয়ের পৃষ্ঠায় চোখ থাকলেও মন তার ভিন্ন জগতে। সে চুপিচুপি বলে ওঠে, “কবিতার শব্দগুলো আজকাল আর কাগজে আটকে থাকে না, যেন পাশের কেউ ছুঁয়ে দেয় শব্দগুলোর শরীর।” নীলা চমকে তাকায়, তারপর হালকা হাসে, বলে, “আমিও তেমনটাই ভাবছিলাম।” তারপর দু’জনের মধ্যে আবার মৌনতা নেমে আসে, এবার যেন আরও গভীর, আরও টানটান। তাদের মাঝখানে পড়ে থাকা একটা পাতাহীন শূন্যতা, যার মধ্যে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে অদৃশ্য অনুভূতির নদী। জানলার বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে, ভিতরে দু’জনের মাঝে এক তপ্ত ধোঁয়া—যা না ছুঁয়ে, না বলেই ছুঁয়ে যায়।

লাইব্রেরির আলো হালকা হলুদ, আর সেই আলোয় নীলার চুলের মধ্যে পড়ে থাকা কিছু বৃষ্টির ছাঁট ঝলকে ওঠে। অর্ক আস্তে করে তার দিকে ফিরে বলে, “তুই জানিস, তোর পাশে থাকলে আমার শব্দ খুঁজে পেতে সময় লাগে।” নীলা তাকায়, চোখে জল নয়, তবে এক ধরনের অদৃশ্য কম্পন—যা ভিজিয়ে দেয় ঘরের বাতাস। “তাহলে চুপ থাক,” সে বলে, “কারণ এই নীরবতাও অনেক কিছু বলে।” বাইরে যখন বিদ্যুৎ চমকে ওঠে, ভিতরে তখন দুই হৃদয়ের মধ্যে তৈরি হয় এক অচিহ্নিত গলিপথ, যেখান দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে তারা আবিষ্কার করে—একজন আরেকজনকে কতটা ভেতরে ধারণ করে আছে। তারা কোনো স্পর্শ করে না, কিন্তু চোখের ভাষায়, নিঃশ্বাসের ঢেউয়ে, অচেতন আঙুলের কাঁপুনিতে, এবং অতীত স্মৃতির উষ্ণতায় তৈরি হয় এক অলিখিত বন্ধন—যা আর শুধুই বন্ধুত্ব নয়, আর প্রেম বললেও যেন পর্যাপ্ত নয়। লাইব্রেরির ঘড়িতে ধীরে ধীরে তিনটে বাজে, আর সেই টিক টিক শব্দে যেন কেউ লিখে যায়—তাদের গল্পের এক অনুচ্চারিত অধ্যায়।

সাত

সেদিন ছিল এক গুমোট বিকেল। সকাল থেকেই হালকা বৃষ্টি পড়ছে, ছাতার নিচে ঢাকা মুখগুলো কলেজে ঢুকছে আর বেরোচ্ছে, কিন্তু অর্ক আর নীলা আজ ক্লাসে মন বসাতে পারেনি। তাদের মনের ভেতরে যেন অন্য কোনো পাঠ চলছে—অন্তর্দ্বন্দ্বের, অনুভবের, আর কিছু অপ্রকাশ্য আকাঙ্ক্ষার। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই কলেজের করিডোরগুলো আরও ফাঁকা হয়ে গেল। তারা দু’জনেই জানত—এই ফাঁকা ঘর, এই ভেজা জানলা, এই স্যাঁতসেঁতে দেয়ালের গন্ধ—সব যেন চুপিচুপি ডাকছে। অর্ক আর নীলা আবার সেই পুরনো ক্লাসরুমে এসে বসল, যেখানে তারা প্রথমদিন একসঙ্গে পড়েছিল, প্রথম একসঙ্গে হাসতে শিখেছিল। বৃষ্টির ধারারা জানলার কাঁচে ফোঁটা ফোঁটা আঁকছে, যেন কারও স্মৃতির জলছবি।

নীলা আজ একটু বেশি চুপ। চোখে একটা অদ্ভুত মাদকতা, ঠোঁটে সংযত এক প্রশান্তি। অর্ক লক্ষ্য করল তার আঙুলগুলো কাঁপছে সামান্য, অথচ মুখে কোনো সঙ্কোচ নেই। অর্ক আস্তে করে বলল, “তুই জানিস তো, আজকাল তোর পাশে বসলে একটা কেমন অনুভব হয়?” নীলা মাথা নাড়ল না, শুধু তাকাল, স্থির, গভীর চোখে। উত্তর না দিয়ে প্রশ্নটা শুষে নিল। মুহূর্তগুলো গাঢ় হচ্ছিল, নিঃশব্দে, নিঃশ্বাসের ওঠানামায়। অর্ক বুঝে গেল—শব্দ দরকার নেই আজ, শুধুই উপস্থিতির ভাষা যথেষ্ট। সে হাত বাড়িয়ে ধীরে ধীরে নীলার হাত ধরল। একটুও প্রতিবাদ এল না। বরং নীলার নরম আঙুলে যেন এক অনুচ্চারিত সম্মতি ছিল, এক অভিমন্ত্রিত শান্তি। তারা পাশাপাশি বসে থাকল—একটা অদ্ভুত বন্ধন, যা বন্ধুত্ব নয় শুধু, প্রেম নয় শুধুই, বরং দুটো সত্তার নিঃশব্দ সংযোগ।

বাইরে তখনও বৃষ্টি ঝরছে, আর ভেতরে অর্ক-নীলার মাঝে বুনে চলেছে এক অদৃশ্য সূতো। তারা কোনও প্রতিশ্রুতি দেয় না, কোনো চুম্বন নেই, কোনো আবেগঘন আলিঙ্গনও না—তবুও এক অপূর্ব পূর্ণতা যেন ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে গড়ে উঠছে। নীলা বলল হঠাৎ, “আমরা কি ভুল করছি?” অর্ক বলল না কিছুই, শুধু তার চোখে চোখ রেখে বলল, “তাই যদি হয়, এই ভুলটা সারাজীবনের জন্য চাই।” জানলার কাচের ওপারে তখন রোদের ছায়া ফুটে উঠছে, মেঘ কেটে গিয়ে রোদ নামছে ধীরে ধীরে। আর ভিতরে, এই নীরব সন্ধ্যাবেলায়, একটা অচিহ্নিত ভালোবাসা তাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে, নামহীন এক অনুভূতি হয়ে। তারা জানে না, আগামীকাল কী হবে—কিন্তু আজকের বিকেলটা, এই ভেজা জানলার ধারে, শুধু তাদের জন্যই লেখা হয়েছে।

আট

কলেজের শেষ দিন।

আজ যেন চারপাশে এক অদ্ভুত শূন্যতা, অথচ সেই শূন্যতাই শব্দে শব্দে ভরে উঠছে। লাস্ট ক্লাস, লাস্ট বেঞ্চ, লাস্ট একসঙ্গে বসা—সবকিছুতে যেন একটা বিদায়ের রঙ মাখা। বন্ধুরা হইচই করছে, সেলফি তুলছে, ক্লাসের বেঞ্চে স্যারের অজান্তে নাম খোদাই করে যাচ্ছে, কেউ চিঠি দিচ্ছে, কেউ চিঠি ছিঁড়ে ফেলছে—কিন্তু অর্ক আর নীলা, তারা কেবল চুপচাপ জানলার ধারে বসে আছে।

কয়েকটা দিন আগের সেই নীরব সন্ধ্যার পরেও, তারা প্রায়ই একসঙ্গে সময় কাটিয়েছে—বই পড়া, পুকুরপাড়ে বসে থাকা, কলেজের ক্যানটিনে নিঃশব্দ চা খাওয়া। কেউ কাউকে কিছু বলেনি, তবুও সবই বলা হয়ে গেছে—শুধু ভাষাহীন ভালোবাসায়। আজ যেন সেই চুপচাপ ভালোবাসার পরিসমাপ্তির দিন, আবার এক নতুন শুরুও বটে।

নীলা বলল, “কাল তো আমি চলে যাচ্ছি। বাবা বলেছে, পুজোর আগেই হোস্টেলে উঠতে হবে।”
অর্ক মাথা নিচু করে বলল, “জানি।”
সেটুকুই।
কোনো অনুযোগ নেই, কোনো প্রশ্ন নেই—শুধু চোখের পাতার ভেতর জমা থাকা এক সমুদ্র অভিমান, যা ভেসে ওঠে না।

নীলা ব্যাগ থেকে একটা ছোট খাম বের করে অর্কের হাতে দিল। “পুজোর সময় খুলিস। এখন না।”
অর্ক জিজ্ঞেস করল না কী আছে ভিতরে। শুধু খামের ওপর আঙুল বুলিয়ে বলল, “তুই থাকবি তো?”
নীলার চোখে জল, ঠোঁটে একটুকরো হাসি। সে বলল, “রোজকার মতোই। তোকে দেখব না, কিন্তু তোকে ছাড়বও না।”

কলেজ চত্বর তখন ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে আসছে। কেউ কেউ কাঁদছে, কেউ কেউ হাসতে হাসতে বিদায় নিচ্ছে। আকাশে আবার মেঘ জমেছে। প্রথম ফোঁটা টিপটিপ করে গড়িয়ে এল জানলার ধারে।

অর্ক আর নীলা বাইরে বেরিয়ে এল। ক্যাম্পাসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে দুজন। মাথার ওপরে ছাতা নেই, জলে ভিজে যাচ্ছে চুল, জামাকাপড়, চোখ—সব।
অর্ক বলল, “আজ আর কিছু বলবি না?”
নীলা চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে এক পা এগিয়ে এসে অর্কের কাঁধে মাথা রাখল। বৃষ্টির ফোঁটার ভেতর দিয়ে গলে গেল তাদের সমস্ত ভাষাহীনতা।

সেই মুহূর্তে কোনও চুম্বন নেই, কোনও গলায় আলিঙ্গন নয়—তবুও পৃথিবীর সব ভালোবাসা যেন এসে জমেছে এই ভেজা পর্দার নিচে।

নীলা কানে কানে বলল, “তোর মতো করে আর কেউ ভালোবাসতে পারবে না। আমিও না।”

তারপর দুজন দুই দিকে হাঁটতে শুরু করল—কোনো কনফেশন ছাড়াই, কোনো সংজ্ঞাহীন প্রতিশ্রুতি ছাড়াই, কিন্তু এক অদৃশ্য সুতোর বাঁধনে চিরদিনের জন্য জড়িয়ে।

বৃষ্টি তখনও পড়ছে—শেষ বৃষ্টির মতো।
তাদের শেষ কলেজদিনের মতো।
তাদের না-বলা ভালোবাসার মতো।

শুধু জানলার কাঁচে লেখা নাম দুটো—
“অর্ক – নীলা”
বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে,
তবুও থেকে যাচ্ছে কোথাও, গোপনে, গভীরে।

নয়

রাতটা যেন অস্বাভাবিক দীর্ঘ হয়ে উঠেছিল। কলকাতার আকাশে আজও মেঘ জমেছে, তবে সেই প্রথম দিনের মত নয়—এবার যেন সেই মেঘ অর্ক আর নীলার মনের ভিতরেও ছায়া ফেলেছে। দিনের আলো মুছে যাওয়ার পরেও দুজনের ফোনে কথা হচ্ছিল, তবে শব্দের চেয়ে দীর্ঘ ছিল নীরবতা। “তুই কিরকম আছিস?”—নীলা জিজ্ঞেস করেছিল হঠাৎ, গলার স্বর ছিল শান্ত, কিন্তু ভিতরে অদ্ভুত এক আবেগ লুকানো ছিল। অর্ক প্রথমে কিছু না বলে শুধু জানলার বাইরে তাকিয়ে থেকেছিল, তারপর বলেছিল—“ভাল না। কিছু একটা থমকে আছে।” সেই ‘কিছু’ যে কী, সেটা কেউ সরাসরি বলেনি। কিন্তু কথার ফাঁকে ফাঁকে, নিঃশব্দে, যেন দুজনেই বুঝতে পারছিল—একটা স্বীকারোক্তি আসন্ন। কলেজে যেসব মুহূর্ত তারা একসঙ্গে কাটিয়েছে, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ল্যাবের পেছনে বসে থাকা, লাল গেটের ধারের চায়ের দোকানে চা খাওয়ার অজুহাতে একে অপরকে দেখার মুহূর্তগুলো যেন মনে পড়ছিল। নীলা বলেছিল—“আমরা কি বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু?” প্রশ্নটা এতটাই সরাসরি ছিল যে অর্ক কাঁপা গলায় ‘হ্যাঁ’ বলার আগে কিছু সময় চুপ করে ছিল।

পরদিন কলেজে দেখা হয়েছিল। বৃষ্টি হচ্ছিল না, কিন্তু ভিজে পাতার গন্ধে বাতাসে ছড়িয়ে ছিল একটা চেনা অনুভূতি। লাইব্রেরির সিঁড়িতে বসে থাকা নীলাকে দেখে অর্কর বুক ধকধক করছিল। আজ প্রথমবার, তাদের চোখে কোনো রাখঢাক ছিল না। অর্ক কাছে গিয়ে বসেছিল, বলেছিল—“কাল রাতে আমি ঘুমোতে পারিনি। মনে হচ্ছিল কিছু একটা বলা দরকার, যা অনেকদিন ধরে জমে আছে।” নীলা চোখ তুলে তাকিয়েছিল, বলেছিল—“তাহলে বল।” এই সহজ কথাটার ভিতর যে কী গভীর আহ্বান ছিল, অর্ক অনুভব করেছিল। “তুই আমার প্রতিদিনের ভাবনার অংশ হয়ে গেছিস, জানিস তো? বন্ধু হিসেবেই শুরু হয়েছিল, কিন্তু এখন সেটা আলাদা। তোর না থাকাটা কষ্ট দেয়।” বলার পর যেন অর্কর বুক থেকে অনেকটা বোঝা নামল। নীলা কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল, তারপর তার হাতটা অর্কর হাতে রাখল, ধীরে বলে উঠল—“আমিও অনেকদিন ধরে এই একই কথা বলতে চেয়েছিলাম।” কোনও নাটকীয়তা ছিল না, ছিল না চোখের জলও, শুধু দুটো হাতের মাঝখানে আটকে ছিল এক অলিখিত স্বীকারোক্তি—যা একদিন বৃষ্টির ফোঁটার মত করেই নেমে এসেছিল তাদের দুজনের মনে।

সন্ধ্যাটা তারা কাটিয়েছিল কলেজের পেছনের পুকুরপাড়ে বসে। চারপাশে পাখির ডাক, কিছু ছাত্রছাত্রী দূরে গল্প করছে, কিন্তু তাদের জন্য যেন সময় থেমে গিয়েছিল। অর্ক বলেছিল—“তুই জানিস, আমি তোকে ছুঁতে চাই, কিন্তু ভয় পাই—ভাঙবো না তোকে?” নীলা হেসে বলেছিল—“ভাঙা আমি বহুদিন আগেই ছিলাম। তুই শুধু জোড়া লাগাতে চাস, আমি সেটা বুঝি।” সেই মুহূর্তে, অর্কর মনে হয়েছিল এই কথাটাই প্রেম—যেখানে শরীরের আকর্ষণের বাইরেও এমন এক যোগাযোগ গড়ে ওঠে, যা আত্মাকে ছুঁয়ে যায়। তারা চুপচাপ বসে ছিল অনেকক্ষণ, একে অপরের দিকে তাকিয়ে, সময়ের হিসেব না রেখে। নীলা বলেছিল—“যা শুরু হয়েছে, তার কোনও নাম দরকার নেই। নাম দিলে হয়ত সীমাবদ্ধতা চলে আসে।” অর্ক মাথা নেড়েছিল, তারপর বলেছিল—“তবে আমরা জানি, আমরা একসাথে। এইটুকুই যথেষ্ট।” আর সেই সন্ধ্যাবেলা, জানলার ধারের প্রথম বৃষ্টির দিনের মতই, তাদের জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছিল—নিঃশব্দে, আন্তরিকতায় ভরপুর, এবং এমন এক স্বীকারোক্তিতে যা কথায় নয়, স্পর্শে, চাহনিতে আর নীরবতায় প্রকাশ পায়।

দশ

কয়েক মাস কেটে গেছে। বর্ষা শেষ হয়েছে, রোদ উঠে গেছে শহরে, অথচ অর্কর মনে এখনও যেন একটানা জল জমে আছে। কলেজ প্রায় শেষের পথে, সামনে জোর প্রস্তুতি চলছে মাস্টার্সের জন্য, কেউ কেউ বাইরে চলে যাচ্ছে, কেউ চাকরির পেছনে ছুটছে। আর নীলা? সে যেন হয়ে উঠেছে এক রহস্য, এক ফিকে হয়ে যাওয়া চিঠির মতো, যা বারবার পড়েও কিছু লাইন স্পষ্ট হয় না। সেই দিন জানলার ধারে তাদের মধ্যেকার অদৃশ্য যোগাযোগ যেভাবে আত্মার গভীরে গিয়ে জড়িয়ে পড়েছিল, তার পরেও বাস্তবতা আবার নিজস্ব নিয়মে চলতে শুরু করেছে। নীলা একটু দূরে সরে গেছে, অর্ক টের পায়—সে আর আগের মতো ফোন করে না, ছোট্ট কোনো ছবি পাঠায় না, দুপুরবেলা কলেজ ক্যাম্পাসে তাকে অপেক্ষা করতে দেখা যায় না। অথচ অর্ক জানে, সেই জানলার পাশে তারা একে অপরের মধ্যে এমন কিছু রেখে গেছে, যা কথায় বা আলাপে পূর্ণ ব্যাখ্যা যায় না।

একদিন হঠাৎ নীলা ফোন করল, অনেকদিন পর। গলায় একটু কাঁপন ছিল, একটু দ্বিধা। সে বলল, “কলেজে যাবি কাল? শেষ ক্লাসটা তো।” অর্ক যেন শব্দ শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল, হঠাৎ শরীর গরম হয়ে উঠল, অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরতে লাগল, কিন্তু সে শুধু বলল, “হ্যাঁ, যাব।” পরদিন কলেজের সেই পুরনো ঘর, সেই জানলা, আর জানলার বাইরে ছড়ানো অগোছালো গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ, সবকিছু একসাথে যেন কিছু অপেক্ষা করছিল। নীলা এসে দাঁড়াল সেই জানলার ধারে। চোখে ঠান্ডা চোখাচোখি, কিন্তু ভিতরে ঢেউ উঠছে দুজনেরই। নীলা চুপচাপ বলল, “তুই জানিস তো, আমি দিল্লি চলে যাচ্ছি স্কলারশিপ পেয়ে। খুব ইচ্ছে ছিল তোকে জানাই আগে, কিন্তু নিজেকেই বুঝতে পারছিলাম না।” অর্ক কিছু বলল না, মাথা নিচু করে তাকিয়ে থাকল বেঞ্চের ওপর তার রাখা আঙুলগুলোয়। নীলা আবার বলল, “তুই হয়তো ভাবছিস, আমি তোকে ফেলে যাচ্ছি। কিন্তু জানিস, সেই দিন জানলার ধারে যা হয়েছিল—সেটা আমি কোনোদিন ভুলব না। আমি তোকে ভালোবাসি, অর্ক। ঠিক যেমন আকাশ তার বৃষ্টিকে ভালোবাসে, কিন্তু ধরে রাখতে পারে না।”

অর্ক ধীরে ধীরে তার চোখ তুলল। নীলার চোখ ভিজে ছিল, এবার সত্যি। দুজনেই বুঝে গেল, ভালোবাসা মানেই পাশে থাকা নয় সবসময়, ভালোবাসা মানে কখনও কখনও এমন মুহূর্ত ভাগ করে নেওয়া, যা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বুকের ভেতর গোপনে বাজতে থাকে। অর্ক নীলার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, “তুই যা করছিস, ঠিক করছিস। আমি জানি তুই অনেক দূর যাবি। আর জানিস, জানলার সেই ভেজা কাঁচে আমরা যে মুহূর্তটা রেখে গেছি, সেটা আমার সারা জীবনের তাবিজ হয়ে থাকবে।” নীলা হেসে ফেলল, অর্কর হাত ধরল শেষবারের মতো, খুব আলতো করে। আর তারপর, এক নিঃশব্দ বিদায়। জানলার পাশে তখন আর কোনো শব্দ নেই, শুধু হাওয়ায় মিশে থাকা এক পুরনো স্মৃতির গন্ধ, আর হৃদয়ের গোপন কোনায় জমে থাকা এক অসমাপ্ত প্রেমের নীরবতা। সেই জানলাটার পাশে আজও কেউ বসে না, কিন্তু অর্ক জানে—সেখানে একদিন ভালোবাসা বৃষ্টি হয়ে নেমেছিল।

____

1000046260.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *