Bangla

শিল্প যখন জীবন

Spread the love

মধুমিতা নন্দী


পর্ব ১: মাটির ঘ্রাণে আঁকা স্বপ্ন

কলকাতার দক্ষিণ শহরতলির এক নিরিবিলি গলির মধ্যে অবস্থিত ‘রঙপট’—অনিন্দ্য ঘোষের ছোট্ট কিন্তু সুবিখ্যাত চিত্রশিল্প স্টুডিও। স্টুডিওর ভেতরটা যেন এক বিচিত্র জগৎ। দেয়ালে ক্যানভাসে আঁকা আধুনিক বিমূর্ত শিল্প, মেঝের কোণে রাখা ভারতীয় লোকশিল্পের নিদর্শন, আর চারপাশে বইয়ে ঠাসা তাক। প্রতি সকালে, একটি বড় কাপে কালো কফি হাতে নিয়ে অনিন্দ্য সেখানে কিছু সময় কাটান। সেই সময়টাই যেন তাঁর ভ্রমণপথের সূচনা।

অনিন্দ্য ঘোষ—পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়স, গায়ের রঙে রোদে পোড়া দাগ, চুলে পাক ধরেছে বেশ কিছুটা, কিন্তু চোখদুটোতে এখনও শিল্পের দীপ্তি। একজন একাডেমিক শিল্পী হলেও লোকশিল্পের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল অনন্য। তিনি মনে করেন, শহরের আধুনিক শিল্প যতই মোহময় হোক না কেন, ভারতবর্ষের মাটি, গ্রাম, আর তার শিল্পের মধ্যে যে প্রাচীন ধারা প্রবাহিত হচ্ছে, সেটাই ভারতীয় চেতনার শিকড়।

এই দর্শন থেকেই জন্ম নিয়েছিল তার নতুন পরিকল্পনা—ভারতের বিভিন্ন লোকশিল্প ও তার শিল্পীদের জীবনভিত্তিক একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ। তার প্রথম গন্তব্য—ওড়িশার রঘুরাজপুর হেরিটেজ ভিলেজ। কারণ তিনি জানতেন, সেখানে রয়েছেন একজন কিংবদন্তি শিল্পী, যিনি পটচিত্রকে কেবল শিল্পে নয়, জীবনে রূপান্তরিত করেছেন—শিল্পিগুরু দিনবন্ধু মহাপাত্র।

অনিন্দ্যর রঘুরাজপুর যাত্রা শুরু হয় এক বসন্তসন্ধ্যায়। হাওড়া স্টেশন থেকে পুরী যাওয়ার ট্রেনে ওঠেন তিনি। হাতে একটি ছোট নোটবুক, যেখানে লেখা আছে তার গবেষণার নোট, ক্যামেরার ব্যাগ, আর কিছু অল্প জিনিসপত্র। গ্রীষ্মের ভ্যাপসা গরমে যাত্রা সোজা নয়, কিন্তু অনিন্দ্যর মনে এক অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করছে। যেন তিনি শুধু কোনো শিল্পগ্রাম নয়, কোনো পুরাকালের মন্দিরে প্রবেশ করতে চলেছেন, যেখানে প্রতিটি রেখা, প্রতিটি বর্ণ, প্রতিটি নিঃশ্বাস শিল্পময়।

পুরী স্টেশনে পৌঁছে, সেখান থেকে অটো করে সাকিনে পৌঁছাতে হয়—রঘুরাজপুর। পথটা সরু, আঁকাবাঁকা, দুই পাশে বিস্তীর্ণ ক্ষেত, মাঝে মাঝে তাল গাছ, নারকেল গাছের সারি, এবং দূর থেকে দেখা যায় কাদা মাটির ঘর। রাস্তার ধারে শিশুদের খেলা, মহিলারা হাঁড়ি ধুচ্ছেন, কোথাও বাজছে ওড়িয়া লোকসঙ্গীত। অনিন্দ্যর মনে হলো, সময় যেন এখানে থেমে গেছে—যেন এক অন্য ভূগোল।

গ্রামের প্রবেশপথে বড় করে আঁকা একটি বোর্ড—“Welcome to Raghurajpur Heritage Village – Land of Pattachitra & Performing Arts”।

অনিন্দ্য থেমে দাঁড়ালেন। সেই বোর্ডের নিচেই কিছু তালপাতার পাতায় আঁকা পটচিত্র, স্থানীয় বাচ্চারা বিক্রি করছে পর্যটকদের। তাদের চোখে লাজুক কিন্তু কৌতূহলী দৃষ্টি।গ্রামের ভেতর ঢুকতেই অন্য এক অনুভূতি। প্রতিটি বাড়ির গায়ে আঁকা রয়েছে নানা রকম চিত্র—রাধাকৃষ্ণ, জগন্নাথ, দশাবতার, পাখি, ফুল, ময়ূর। ঘরের দেয়াল যেন ক্যানভাস। মাটির গন্ধে মিশে আছে রঙের গন্ধ। কিছু ঘরের সামনে পর্যটকদের জটলা, কেউ ছবি তুলছে, কেউ কিছুর ব্যাখ্যা শুনছে স্থানীয় গাইডের মুখে। অনিন্দ্যর আগমনের খবর জানিয়ে রাখা হয়েছিল। তাই তিনি যখন প্রধান পটচিত্রশিল্পীর বাড়ির সামনে পৌঁছান, তখন গেট খুলেই দাঁড়িয়ে আছেন এক বৃদ্ধ—শুধু তার মুখ দেখলেই বোঝা যায়, এই মানুষটি শিল্পের সাধক।

“আপনি অনিন্দ্য ঘোষ? আমি দিনবন্ধু মহাপাত্র।”

সাদামাটা কণ্ঠ, কিন্তু চোখে উজ্জ্বলতা। গায়ে সাদা ধুতি, গেরুয়া রঙের কুর্তা, কপালে চন্দনের ফোঁটা। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে ছোট্ট একটি ছেলে—বয়স বারো কি তেরো, হাতে রঙতুলি, মুখে মৃদু হাসি।

“আপনাকে স্বাগতম আমাদের ছোট্ট গ্রামে,” দিনবন্ধু বললেন।

অনিন্দ্য কিছুটা ভিজে চোখে বললেন—“আপনার কাজ দেখেছি, পড়েছি। আজ আপনাকে সামনে দেখে মনে হচ্ছে, যেন কোনো জীবন্ত কাহিনির সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”

“চলুন, ভেতরে চলুন। আমাদের উঠোনেই আপনার জন্য জায়গা করা হয়েছে।”

বাড়ির ভেতরটা যেন শিল্পের রাজপ্রাসাদ। উঠোন জুড়ে কাঠের পুতুল, তালপাতার পটচিত্র, নারকেল খোলের মূর্তি, এবং একদিকে জঙ্গলের মতো সাজানো বাগান। ঘরের দেওয়ালে ঝুলছে পুরস্কারের সারি—রাষ্ট্রপতি পদক, ইউনেস্কোর স্বীকৃতি, ওড়িশা সরকারের সম্মানপত্র।

দিনবন্ধু বললেন, “এই ঘরটা আমার বাবার, তিন পুরুষ ধরে আমরা এখানে ছবি আঁকি। আগে জীবিকা ছিল, এখন এটা আমাদের সাধনা।”

শুভদীপ, তার নাতি, তখন বসে একটি বড় পটচিত্রে রাধাকৃষ্ণ আঁকছে। অনিন্দ্য দেখলেন, ছেলেটির হাতে যে নিপুণতা, তা বিস্ময়কর।

“এখনকার ছেলেমেয়েরা কি আগ্রহী এ শিল্পে?” প্রশ্ন করলেন অনিন্দ্য।

দিনবন্ধু মৃদু হাসলেন—“আগে ছিল না। এখন আবার ফিরছে। আমরা চেষ্টা করেছি শিল্পকে জীবনের অংশ করে তুলতে।”

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। অনিন্দ্যর প্রথমদিন শেষ হয় দিনবন্ধুর উঠোনে বসে, এক কাপ চা হাতে। চারদিকে সন্ধ্যার নিস্তব্ধতা, দূর থেকে শোনা যাচ্ছে কোন এক মন্দিরে ঘণ্টাধ্বনি। আকাশে জ্বলে উঠেছে প্রথম তারা।

দিনবন্ধু বললেন—“এই মাটি শুধু চাষের জন্য নয়, রঙের জন্যও উর্বর। আমরা শুধু সেই রং তুলে আনি। আপনি আগামী কয়েকদিন থাকুন, আমাদের সঙ্গে খান, ঘুরুন, দেখুন। তারপর আপনার তথ্যচিত্র নিজেই কথা বলবে।”

অনিন্দ্য মাথা নোয়ালেন। তিনি বুঝলেন, এই যাত্রা কেবল শিল্প বা তথ্যের সংগ্রহ নয়, এটি এক আত্মিক ভ্রমণ। যেখানে একটি শিল্প, একটি গ্রাম, একটি প্রজন্ম—সব মিলিয়ে তৈরি হবে তার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

পর্ব ২: শিল্প গুরুর উঠোনে

রঘুরাজপুরে অনিন্দ্য ঘোষের প্রথম রাতটা কেটেছিল আশ্চর্য এক নিস্তব্ধতায়। শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে, যেখানে রাতের শব্দ বলতে শোনা যায় জোনাকির ডানার ঝিরঝির শব্দ, কিংবা মাঝেমধ্যে কোনো পেঁচা ডেকে ওঠে গাছের ডালে। কাঁচা মাটির ঘরে হাতপাখার বাতাস আর বাইরে বয়ে যাওয়া সাই নদীর শব্দ—সেই শব্দে অনিন্দ্য যেন নতুন করে শোনে মাটির গান। পরদিন সকালে, ঘুম ভাঙে মুরগির ডাক আর নারকেল পাতায় হাওয়ার খেলা শুনে। ঘরের দরজা খুলতেই দেখতে পেলেন দিনবন্ধু মহাপাত্র একটি খুপরি চেয়ারে বসে, হাতে তুলির ডাঁটি ধরে কাগজে আলতো করে রঙ মিশিয়ে দিচ্ছেন। শুভদীপ ইতিমধ্যে এক কোণায় রাধাকৃষ্ণের একটি খুদে পটচিত্র আঁকছে।

“ভোরে উঠে পড়েন আপনি?” অনিন্দ্য অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন। দিনবন্ধু মৃদু হাসলেন, “শিল্প তো শুধু কাজ নয়, তা সাধনা। ভোরের আলোতেই তুলির কাজ সবচেয়ে নিখুঁত হয়।”

সকালের জলখাবারে ছিল চিড়ে, নারকেল, আর হাতে বানানো গুড়ের মিঠা। অনিন্দ্য জানলেন, দিনবন্ধুর পরিবারে মোট পাঁচজন সদস্য—তিনি, তাঁর স্ত্রী সৌমিত্রী দেবী, পুত্র সুরেশ মহাপাত্র, বউমা গীতাঞ্জলি, আর নাতি শুভদীপ। সুরেশ নিজেও একজন পটচিত্রশিল্পী, সরকারি আর্ট ফেয়ার ও কর্মশালায় তিনি নিয়মিত যোগ দেন। গীতাঞ্জলি ঘরের ভিতর থেকেও রঙের কাজ করেন—তাঁর বিশেষত্ব তালপাতার পটচিত্র। সূক্ষ্ম খোদাই আর পুঙ্খানুপুঙ্খ লাইন আঁকার যে দক্ষতা, তা দেখে অনিন্দ্য বিস্মিত হন।

“আপনি নিজেও তো শিল্পী, গীতাঞ্জলি?”

গীতাঞ্জলি মৃদু হেসে বলেন, “আমরা তো সবাই, মশাই। এখানে ঘরে ঘরে বাচ্চারা আঁকতে শেখে দুধের সঙ্গে রঙ মিশিয়ে। এটা শুধু পেশা নয়, আমাদের জীবনযাত্রা।”

বেলা গড়াতেই দিনবন্ধু অনিন্দ্যকে নিয়ে গেলেন তাঁদের পুরনো স্টুডিও ঘরে। একটা বড় খোলা ঘর, চারদিকে রাখা পুঁথি, রঙের পাত্র, তুলি, পটচিত্র, তালপাতা, আর কাঠের পুতুল। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা কাঠের টেবিল, তার ওপর আঁকা হচ্ছে বিশাল একটি দশাবতার চিত্র।

“এই যে,” দিনবন্ধু ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন, “আমরা পটচিত্রে প্রধানত ধর্মীয় বিষয় আঁকি—বিশেষ করে জগন্নাথদেব, রাধাকৃষ্ণ, রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনি। তবে এখন অনেক আধুনিক গল্পও তুলে আনি—পরিবেশ, সামাজিক বার্তা, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি।”

অনিন্দ্য রঙের উৎস নিয়ে জানতে চাইলে, দিনবন্ধু দেখালেন তাঁদের নিজস্ব কাঁচামাল সংগ্রহের পদ্ধতি।

“এই যে গেরুয়া রঙ—এটা হেমতাল গাছের ছাল থেকে। নীল রঙ আসে ইন্দিগো পাতা থেকে। কালচে রঙ আসে সোনা মাটি পুড়িয়ে। এই সব রঙ তৈরি হয় দিনের পর দিন ধরে।”

এই রঙ তৈরি করার প্রক্রিয়া দেখে অনিন্দ্য মুগ্ধ। তিনি ছবি তুলতে শুরু করেন, ভিডিও করেন, প্রতিটি ধাপ লিখে রাখেন নিজের খাতায়। দুপুরে খাওয়ার পর, অনিন্দ্য দিনবন্ধুর সঙ্গে গিয়ে বসলেন উঠোনে, যেখানে শুভদীপ তার পটচিত্র নিয়ে ব্যস্ত। সে যখন ময়ূরের পালক আঁকছিল, তার হাতে তুলি এত নিখুঁতভাবে চলছিল যে মনে হচ্ছিল, তার বয়স অন্তত তিরিশ।

“তুই কত বয়স থেকে আঁকা শিখেছিস, শুভ?”

ছেলেটা মাথা চুলকে বলে, “বুঝে আঁকি হয়তো পাঁচ বছর বয়স থেকে। কিন্তু ঠাকুর্দা বলতেন, চোখ দিয়ে ছবি দেখাই শিখতে হয় আগে।”

দিনবন্ধু গর্বভরে বলেন, “ওদের মধ্যে নতুন কিছু করার ইচ্ছা আছে, এটা ভালো। আমি শুধু চাই, এই শিল্প যেন শুধু আমার প্রজন্মে থেমে না থাকে।”

অনিন্দ্যর প্রশ্ন আসে, “আপনারা সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতা পান?”

দিনবন্ধুর মুখে হালকা ছায়া পড়ে—“পাই কিছুটা, হস্তশিল্প মেলা, প্রদর্শনী হয়। কিন্তু অনেক সময়ই মানুষ আমাদের শিল্পকে হালকা করে দেখে। ভাবে, এ তো শুধু পুরনো কাহিনি আঁকার কাজ। অথচ এই শিল্পই তো আমাদের ইতিহাস, আমাদের সত্তা।”

বিকেলে তাঁরা গ্রামের আরও কিছু ঘর ঘুরে দেখেন। প্রতিটি বাড়িই যেন একেকটা গ্যালারি। কেউ তালপাতার পুঁথি লিখছে, কেউ নারকেল খোলের ওপর রং করছে, কেউ নাচের মুখোশ তৈরি করছে। অনিন্দ্যর মনে হচ্ছিল, যেন কোনো জীবন্ত মিউজিয়ামের মধ্যে হাঁটছেন তিনি। এমন সময় এক বৃদ্ধ শিল্পী মিললেন—বিনোদ বিহারী নায়ক। তিনি দিনবন্ধুর সমসাময়িক, অবসরপ্রাপ্ত পটচিত্রশিল্পী। তাঁর কথায় উঠে এলো শিল্পের গৌরব ও লড়াইয়ের ইতিহাস।

“বাবু, একটা সময় ছিল যখন বাজারে কেউ পটচিত্র কিনতে চাইত না। হোটেলেও রাখত না। তখন আমরা বেঁচে থাকার জন্য দেবতার ছবি আঁকতাম মেলা-মণ্ডপে। এখন কিছু বিদেশি পর্যটক আসেন, তবু সমস্যা থাকে। আমরা চাই, এই শিল্পের একটা সম্মানজনক স্থান হোক।”

অনিন্দ্য এসব শুনে আরও একনিষ্ঠ হয়ে পড়েন তাঁর তথ্যচিত্র প্রকল্পে। তিনি বুঝতে পারেন, এই কাহিনিগুলি তুলে ধরা শুধু গবেষণা নয়, এক প্রকার দায়িত্ব।

রাত্রি নামলে, দিনবন্ধু আমন্ত্রণ জানান তাঁদের ঘরের বারান্দায় বসা এক বিশেষ গল্পের আসরে। চায়ের কাপ হাতে সবাই বসে—দিনবন্ধু, সুরেশ, গীতাঞ্জলি, শুভদীপ, অনিন্দ্য, এমনকি প্রতিবেশী কয়েকজন শিল্পীও। আলো জ্বলে কুপির, হালকা ওড়িয়া লোকসঙ্গীত বাজে ব্যাকগ্রাউন্ডে।

দিনবন্ধু বলতে শুরু করেন তাঁর জীবনের কথা—কীভাবে ছোটবেলায় তাঁর বাবা কালীচরণ মহাপাত্র তাঁকে পটচিত্র শিখিয়েছিলেন, কেমন করে ১৯৮০ সালে তিনি প্রথমবার দিল্লি হস্তশিল্প মেলায় গিয়ে জাতীয় স্তরে পরিচিত হন, কেমন করে একসময় ইউরোপীয় সংগ্রাহকেরা এসে তাঁর কাজ কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন।

“কিন্তু বাবু, যত পুরস্কারই আসুক, আমি সবচেয়ে খুশি হই, যখন দেখি শুভদীপের হাতে তুলি চলেছে। কারণ আমি জানি, আমার শিল্প মরেনি।”

অনিন্দ্য সেই রাতে লেখেন তাঁর ডায়েরিতে—

“এই উঠোনটা যেন আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাঠশালা। এখানে রঙ শুধু রঙ নয়, তা অনুভব, তা আত্মিক সংযোগ। দিনবন্ধু মহাপাত্র কেবল একজন শিল্পী নন, তিনি এক চলমান ইতিহাস। আমি আজ বুঝেছি, যে মাটি শিল্প ধারণ করতে পারে, সেই মাটিই প্রকৃতভাবে জীবন্ত।”

রাত গভীর হলে চারদিকে নিস্তব্ধতা নেমে আসে, কিন্তু অনিন্দ্যর মনে তখন চলছিল এক উত্তাল ঢেউ। তিনি বুঝতে পারছিলেন, এই কাহিনি শুধু ছবি নয়, এক প্রজন্মের লড়াই, স্বপ্ন, উত্তরাধিকার আর আত্মপরিচয়ের গল্প। আর সেই গল্প তিনিই বিশ্বকে শুনাবেন।

পর্ব ৩: তালপাতার পাতায় জীবনরেখা

ভোর হতেই রঘুরাজপুর যেন জেগে ওঠে এক শিল্পের লয়ে। ছোট ছোট উঠোনে, কুয়ার পাশে, কিংবা গাছের ছায়ায়—প্রতিটি কোণেই কেউ না কেউ রঙ, ছাঁচ বা কাঠের পুতুল নিয়ে বসে। সেইদিন সকালে অনিন্দ্যর ঘুম ভাঙল দূর থেকে ভেসে আসা এক তালমাদলের সুরে।

নেমেই দেখতে পেলেন গীতাঞ্জলি বাইরের উঠোনে তালপাতার পাতার উপরে এক সূক্ষ্ম রেখায় খোদাই করছেন। তাঁর পাশেই বসে রয়েছেন গ্রামের আরও দু’জন নারী—গোপী আর সুমিত্রা। তাঁরা তিনজনই একত্রে কাজ করছেন। অনিন্দ্য কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে গেলেন।

“এই পাতাটা কী? আপনি আঁকছেন না, মনে হচ্ছে কাটছেন?”

গীতাঞ্জলি হেসে বললেন, “এগুলো তালপাতার পুঁথি। অনেক পুরনো ওড়িশি শিল্প। আগে রাজা-নবাবদের ইতিহাস, পুরাণ, রামায়ণ-মহাভারত সব লেখা হতো এই পাতায়। আমরা এখন তা আঁকি ও খোদাই করি—রাখার মতো স্মৃতি হয়ে যায়।”

তালপাতার পুঁথি তৈরি একটি জটিল প্রক্রিয়া। প্রথমেই শুকনো তালপাতা সংগ্রহ করতে হয়। তারপর সেগুলোকে কয়েক ঘণ্টা জলে ভিজিয়ে রেখে শুকাতে হয় ছায়ায়, যাতে পাতাগুলো নরম হয় এবং ভাঙে না। এরপর পাতাগুলোকে পরিস্কার করে সারিবদ্ধভাবে কেটে নেওয়া হয় নির্দিষ্ট মাপে।

“এই পাতায় যে দাগ দেখি, সেগুলো কীভাবে আসে?”

গোপী বলে উঠলেন, “ওটা খোদাই করে তুলি দিয়ে কালি ভরলে এমন হয়। আমরা সূঁচ দিয়ে আল্পনা আঁকার মতো কাঁটা লাইন দিই, তারপর পুঁথির মধ্যে কালি ভরে দিই। শুকিয়ে গেলে পরিষ্কার করি।”

অনিন্দ্য এবার তাঁদের পাশে বসে খাতা খুলে লিখতে শুরু করলেন—‘তালপাতার পুঁথি: স্মৃতির রেখায় জীবনবোধ’।

কাজ করতে করতে তাঁরা গান গাইছিলেন। পুরনো লোকগান, শাক্ত পদাবলি, কখনো বা কোনও শিশুতোষ ছড়া।

“এই গান গাও কেন?”

সুমিত্রা হেসে বললেন, “রঙ করতে করতে মনও রঙিন করতে হয় বাবু। না হলে হাতে কম্পন আসে। গান হল আমাদের তাল। গানেই তালপাতা সজীব হয়।”

অনিন্দ্য বুঝলেন—এই শিল্প কেবল চোখে দেখা যায় না, শোনা যায়, অনুভব করা যায়। তিনি গীতাঞ্জলিকে প্রশ্ন করলেন, “আপনি এই কাজ কাদের শেখান?”

গীতাঞ্জলি বললেন, “প্রতিমাসে আশপাশের গ্রামের মেয়েরা আসে শিখতে। অনেকে আবার মোবাইলে ভিডিও নিয়ে যায়। এখন তো ইউটিউবেও শেখাই। তবে হাতের ছোঁয়া শেখানো যায় না, ওটা হৃদয় দিয়ে আসে।”

এইসময় দিনবন্ধু এসে হাজির। তাঁর হাতে একটি পুরনো বাক্স।

“এই বাক্সে আছে আমার বাবার তৈরি তালপাতার পুঁথি। প্রায় ৭০ বছর আগে তৈরি। আজ আপনাকে এটা দেখাব। দেখলে আপনি বুঝবেন এই পুঁথি কেবল শিল্প নয়, ইতিহাস।”

বাক্স খুলতেই অনিন্দ্যর চোখে পড়ল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রামায়ণের দৃশ্য, কৃষ্ণলীলা, শিবের তাণ্ডব। এত সূক্ষ্ম খোদাই তিনি কখনও দেখেননি। পাতাগুলো কাঠের দুটি পাতার মাঝে সংরক্ষিত, মাঝে কাঁথা সেলাইয়ের মতো সুতো দিয়ে বাঁধা। প্রতিটি পাতায় অক্ষর, রেখা, এবং অলঙ্করণ।

“এগুলো পড়া যায়?”

দিনবন্ধু বললেন, “হ্যাঁ, ওড়িয়া ও সংস্কৃত ভাষায় লেখা। আগে গ্রামের পুরোহিতেরা এগুলো থেকেই পাঠ করতেন। এখন কেউ পড়ে না, কিন্তু আমরা ছবি আঁকি, স্মৃতি ধরে রাখি।”

এরপর তাঁরা গিয়েছিলেন গ্রামের তালপাতা তৈরির ছোট্ট কর্মশালায়। সেখানকার প্রধান শিল্পী ছিলেন লক্ষ্মীনারায়ণ সাহু। তিনি জানালেন কিভাবে এখনকার তরুণ প্রজন্ম পুঁথির ডিজিটাল সংস্করণ তৈরি করছে।

“আমরা মোবাইল কভার, জার্নাল কভার, পেনস্ট্যান্ড—সবকিছুতেই এই শিল্পকে আনছি। তাহলে মানুষ ব্যবহার করবে, দেখবে। নইলে শুধু প্রদর্শনী হলে আমাদের কাজ বাঁচবে না।”

এই কথাগুলো অনিন্দ্যর মনে গভীর রেখা টেনে দিল। এ যেন আত্মপরিচয়কে সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার লড়াই। দুপুরে খাওয়া শেষে অনিন্দ্য গিয়ে বসেন দিনবন্ধুর পাশে। গ্রীষ্মের দুপুরে ছায়াঘেরা বটগাছের নিচে বয়ে চলেছে এক অদ্ভুত শীতলতা। দিনবন্ধু বলেন, “জানেন বাবু, একটা পট বা পুঁথি তৈরি করতে কেবল হাত নয়, আত্মা লাগে। অনেক সময় এক পুঁথি আঁকতে লাগে মাসখানেক। আর তার দাম আমরা পাই মাত্র দু’হাজার বা তিন হাজার টাকা।”

অনিন্দ্য চিন্তিত হয়ে পড়েন, “তবে আপনারা কীভাবে চালান সংসার?”

“আমরা তো অভ্যাসে বাঁচি। টাকা আসুক বা না আসুক, তুলির সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়তে পারি না। এ আমাদের ধম্ম, পেশা নয়।”

সন্ধ্যায় আবার বসে এক কথার আসর। আজ আলোচনার বিষয়—শিল্পের ভবিষ্যৎ। সুরেশ বলেন, “আমরা এখন ছোট ছোট ভিডিও তৈরি করি। এক তরুণ ছেলে আছে, সে পটচিত্রের অ্যানিমেশন বানাচ্ছে। তাতে গল্প জীবন্ত হয়।”

গীতাঞ্জলি বলেন, “আমি এক ফ্যাশন ডিজাইনারের সঙ্গে কাজ করছি। সে আমাদের রং দিয়ে শাড়িতে পটচিত্রের ডিজাইন নিচ্ছে। খুব চলেছে দিল্লিতে।”

অনিন্দ্য ভাবেন—এই গ্রাম এখন আর কেবল অতীত নয়, ভবিষ্যতের পথে হাঁটছে। তালপাতার রেখায় শুধু পুরাণ নয়, আজকের সময়ও লেখা হচ্ছে।

রাত্রে, অনিন্দ্য তাঁর ডায়েরিতে লেখেন: “তালপাতার পাতায় আমি দেখলাম সময়ের চলমানতা। এই পাতাগুলো শুধু পুরনো নয়, তাতে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা গাঁথা। গীতাঞ্জলি, দিনবন্ধু, সুরেশ—এঁরা সবাই যেন জীবনরেখা এঁকে চলেছেন এক অদৃশ্য পটচিত্রে। আমি ধন্য যে আজ তাঁদের সাহচর্যে আছি।”

 পর্ব ৪: মুখোশের আড়ালে উৎসব

ভোরবেলা অনিন্দ্যর ঘুম ভাঙল কাঁসর-ঘন্টার আওয়াজে। আজ রঘুরাজপুরে মহোৎসব। গ্রামের সবচেয়ে পুরনো মন্দির—রত্নেশ্বরী কালীমন্দিরে আজ দেবীর বার্ষিক পূজা। শুধু পূজা নয়, সেই উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয় মাসব্যাপী উৎসব—পটচিত্র প্রদর্শনী, নৃত্য-সন্ধ্যা, মুখোশ-নাট্য, ও চিত্রপ্রদর্শনী। এ যেন রঘুরাজপুরের প্রাণের উৎসব। দিনবন্ধু মহাপাত্র নিজেই এসে ডাকলেন অনিন্দ্যকে। “আজ আপনাকে কিছু বিশেষ দেখাব বাবু। চলুন, চলুন মণ্ডপের দিকে।”

রাস্তার ধারে গাঁয়ের ছেলেমেয়েরা তুলির কাজ করছে মুখোশে। বাঁশ আর কাগজের তৈরি মুখোশগুলোর গায়ে রঙের খেলা। কখনো রাক্ষসের মুখ, কখনো নারায়ণের রূপ, কখনো বা আদিবাসী দেবতা।

“এই মুখোশগুলো কি নাটকের জন্য?” অনিন্দ্য জিজ্ঞেস করলেন।

দিনবন্ধু হেসে বললেন, “হ্যাঁ, নাটকের জন্য তো বটেই। তবে এগুলো আমাদের উৎসবেরও অঙ্গ। আগে আগে মহারাজারা মুখোশধারী পটনাট্য করতেন। এখন তা আমরা নিজেরাই করি। শোনাবেন, মুখোশের আড়ালে কী রহস্য লুকিয়ে আছে?”

ওঁরা পৌঁছলেন একটি প্রাচীন গুদামে—এটা ছিল এককালের নাট্যশালা। ভিতরে ঠায় রাখা আছে শতাধিক মুখোশ, কাঠের পুতুল, পুরনো তামার ঝাঁপি, এবং বহু শতাব্দী পুরনো পোশাক।অনিন্দ্য ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন এক বড় মুখোশের দিকে—মুখোশটি মহিষাসুরের, বিশাল রক্তচক্ষু, বাঁকানো শিং, আর ছুঁড়ির মতো জিভ বেরোনো। তার পাশে রাখা এক নারীর মুখোশ—দুর্গা, হাতে ত্রিশূলের প্রতীক আঁকা।

“এই দুটো মুখোশ গত শতাব্দীর। আমার ঠাকুরদা অভিনয় করতেন। তখন পুরো নাটক মুখোশ পরে করা হতো—নাচ, গান, সংলাপ—সব মুখোশের আড়ালে।”

সন্ধ্যাবেলায় শুরু হলো নাট্য-উৎসব। মঞ্চ বাঁধা হয়েছে খোলা মাঠে, পটচিত্রের ব্যাকড্রপ, সামনের সারিতে বসেছেন বৃদ্ধ শিল্পীগণ, পেছনে স্কুলপড়ুয়া ও পর্যটকেরা। আজ পরিবেশিত হবে ‘চণ্ডীমঙ্গল কাব্য’ অবলম্বনে একটি মুখোশনাট্য—‘দেবীর অভ্যুদয়’।

প্রথমে প্রবেশ করলেন গ্রাম্য সন্ন্যাসীর চরিত্রে এক বালক—তাঁর মুখোশ এক অর্ধেক চণ্ডাল আর অর্ধেক সাধুর। সুরে সুরে তিনি গাইতে লাগলেন:

“তালপাতার পাতায় লেখা কাহিনী,

মুখোশের ছায়ায় দেবীর গাথা…।”

এরপর একে একে প্রবেশ করলেন দেবী দুর্গা, মহিষাসুর, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর। প্রতিটি চরিত্রের মুখোশে এমন নিখুঁত কারুকার্য যে দেখে বোঝা মুশকিল এরা শিশু, কিশোর বা গ্রাম্য তরুণ।অনিন্দ্য বিমোহিত হয়ে দেখলেন—এই মুখোশ কেবল একটি চরিত্র নয়, এটি এক জীবনদর্শন। মুখোশ পরলে মানুষ নিজেকে ভুলে যায়, চরিত্র হয়ে ওঠে। নাট্যশেষে দিনবন্ধু অনিন্দ্যকে নিয়ে এলেন মঞ্চের পেছনে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন গীতাঞ্জলি, তাঁর হাতে এক বিশালাকার রাক্ষসের মুখোশ।

“এই মুখোশ আমি বানিয়েছি তিনদিন ধরে,” গীতাঞ্জলি বললেন। “এই নাটকে আমি ছিলাম মহিষাসুর। আপনি দেখেননি, কারণ মুখোশে আমায় চেনেননি।”

অনিন্দ্য থমকে গেলেন। তিনি তো ভেবেছিলেন মহিষাসুরের চরিত্রে কোনও যুবক অভিনয় করছেন! গীতাঞ্জলি হেসে বলেন, “এটাই মুখোশের মায়া, বাবু।”

এরপর তাঁরা সবাই মিলে গিয়ে বসলেন পটচিত্র প্রদর্শনী মণ্ডপে। সেখানে একটি নতুন পটচিত্র অনিন্দ্যর চোখে পড়ল—চিত্রটির নাম ‘আধুনিক মুখোশ’। তাতে আঁকা হয়েছে ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা নানা মুখ—কেউ মোবাইলে মুখ গুঁজে, কেউ কর্পোরেট কোটে, কেউ রাজনীতির ভাষণ দিচ্ছে। প্রত্যেকের মুখে একটি কালো মুখোশ।

“এটা কাদের তৈরি?”

দিনবন্ধু বললেন, “আমার ছেলের। এবার কলেজে পড়ে। ওর মতে, এখন মানুষও মুখোশ পরে। তাই সে আধুনিক মুখোশ দেখাতে চেয়েছে।”

অনিন্দ্য চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন সেই ছবির সামনে। মনে মনে ভাবলেন—এই মুখোশ কেবল নাটকের নয়, জীবনেরও।রাত্রিবেলা দিনবন্ধুর উঠোনে বসে চলল জলখাবার ও গান। সবাই মিলে গাইল পটগান, বাজল ঢোল-মাদল, আর সেই মধ্যরাতে দিনবন্ধু একটি ছোট পুতুল উপহার দিলেন অনিন্দ্যকে।

“এই পুতুলটি মুখোশধারী চিত্রকারের প্রতিকৃতি। আপনি নিয়ে যান শহরে, যেন রঘুরাজপুরের মুখোশ আপনার সঙ্গে থাকে।”

অনিন্দ্য পুতুলটি হাতে নিয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন—এই মুখোশের গল্প তিনি লিখবেন, ছড়িয়ে দেবেন পৃথিবীজুড়ে।

 পর্ব ৫: পটগানের পথচলা

রাত পেরিয়ে সকাল হতেই অনিন্দ্য আবার হাজির হলেন দিনবন্ধু মহাপাত্রের উঠোনে। আজ তাঁর আগ্রহ পটগান ঘিরে। যে গান যুগের পর যুগ ধরে তালপাতার চিত্র ও পটচিত্রকে কণ্ঠে ধারণ করেছে, সে গান কীভাবে তৈরি হয়, কেমন তার আবেগ—এসব জানার সাধ জেগেছে তাঁর মনে।

দিনবন্ধু বললেন, “চলুন, আজ আপনাকে নিয়ে যাব আমার কাকার কাছে—গুণীন পটগায়ক। এই গাঁয়ের সবচেয়ে প্রবীণ পটগায়ক, এখন আর চোখে দেখেন না, কিন্তু গানের লয় আজও তাঁর কণ্ঠে বেঁধে আছে।”

বেলা দশটার সময় তাঁরা পৌঁছলেন গ্রামের অন্য প্রান্তে, গাছপালা ঘেরা এক ছিমছাম কুঁড়েঘরে। দরজার সামনে বসে আছেন এক বয়স্ক মানুষ, কাঁধে উড়ে পড়েছে একটি টুনটুনি পাখি, পাশে একটি পুরনো সরঞ্জাম—পটচিত্র বাঁধার কাঠি।

“কাকু, বাবু এসেছে কলকাতা থেকে,” দিনবন্ধু পরিচয় করিয়ে দিলেন।

“ওহ, শহরের বাবু! পটের গান শোনতে চান?” বৃদ্ধ কণ্ঠে মৃদু হাসি।

তিনি ধীরে ধীরে বোল তুলতে লাগলেন, ঠিক যেমন নদীর স্রোত গড়িয়ে যায়:

 “পটে আঁকা যুদ্ধে রামের মুখ,

গানে বাজে বিজয়ের সুখ…

সীতার আঁচলে প্রেমের ছায়া,

লক্ষণ দিচ্ছে প্রিয় ভাইয়া…”

অনিন্দ্য মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকলেন। যেন এক চলমান চিত্র, যেখানে রঙ কথা বলে, আর কথা রঙের মতো ছড়িয়ে পড়ে।পটগান শুধু গান নয়, এক ধরনের বর্ণনামূলক কাহিনি। প্রতিটি দৃশ্যের সঙ্গে গায়কের কণ্ঠ মিলে তৈরি করে সজীব এক জগত। গুণীন কাকা পটটির প্রতিটি খণ্ড উল্টে উল্টে বলছিলেন কাহিনি—যেন এক জীবন্ত ক্যানভাস।

“এই যে দেখুন,” বললেন তিনি, “এখানে রাম বন্দুক হাতে, আর পাশেই আধুনিক রাবণ—মনে হচ্ছে যেন সে রাজনীতির নেতা। আমি এটিকে বলি ‘রামায়ণ ২০২০’। আগের কাহিনিকে নতুন মোড় দিয়েছি।”

অনিন্দ্য অবাক হলেন। পটচিত্র ও পটগান যে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে, তা এভাবে না দেখলে বিশ্বাস করা যেত না। গৃহে ফিরে এসে গীতাঞ্জলি অনিন্দ্যকে নিয়ে গেল তার নিজের আঁকার ঘরে। সেখানে একটি আধ-সমাপ্ত পটচিত্র পড়ে ছিল—আধুনিক নারীর জীবন নিয়ে। প্রথম চিত্রে কিশোরী মেয়েটি স্কুলে যাচ্ছে, দ্বিতীয়টিতে সে একটি কারখানায়, তৃতীয়টিতে তার বিয়ে হচ্ছে, আর চতুর্থটিতে সে সশস্ত্র হয়ে প্রতিবাদ করছে এক রাক্ষস-সদৃশ অফিসারের বিরুদ্ধে।

“তুমি কি এর পটগান লিখেছ?” অনিন্দ্য জানতে চাইল।

গীতাঞ্জলি হেসে বলল, “না, এখনো লেখা হয়নি। তবে ভাবছি, যদি আপনি সাহায্য করেন…”

অনিন্দ্য প্রথমে চমকে গেলেও, পরে মাথা নাড়ল। “চেষ্টা করতে পারি।”

সেদিন রাতেই উঠোনে বসে তাঁরা তৈরি করলেন পটগানের খসড়া:

“নারী হেঁটে চলে আলোর পথে,

 হাতের তুলিতে আঁকে স্বপ্নরেখে।

শহরের ভিড়ে চিৎকার ওঠে,

সাহসে গড়ে সে প্রতিবাদের কথা…”

দিনবন্ধু এসে বললেন, “এই গান আমাদের আগামী প্রদর্শনীতে গাওয়া হবে। আপনার নামও থাকবে।”

অনিন্দ্য চুপ করে বসে থাকলেন। এ যেন কেবল পটচিত্র নয়, এক শিল্প-সংগ্রাম—যেখানে রঙ, কথা আর কণ্ঠ মিলিয়ে তৈরি হয় জীবনের নতুন অর্থ। পরদিন গ্রামে একটি ছোটখাটো মেলা বসেছে। শিশুদের জন্য পটগান কর্মশালা, পর্যটকদের জন্য চিত্রপ্রদর্শনী, আর একটি ছোট স্টলে অনিন্দ্যর লেখা গানের পাণ্ডুলিপি বিক্রি হচ্ছে কপি করে।

তিনি দেখে অবাক হলেন—একদল বিদেশি তরুণও কিনছে সেই পাণ্ডুলিপি, কেউ কেউ গুনগুন করে গাইছে তার ভাষায়। আর গীতাঞ্জলি মোবাইলে সেটি তুলে রাখছে ভবিষ্যতের জন্য।দিনবন্ধু এসে কানে কানে বললেন, “দেখলেন, পটগান এখন ভাষা ছাড়িয়ে যায়। সুরের ডানায় উড়ে বেড়ায়।”

সন্ধ্যাবেলা একদল শিশু গাইছে পটগান:

“চিত্রে দেখি ইতিহাসের ছায়া,

গানে পাই স্বাধীনতার প্রায়া…

 গ্রামে, শহরে, পথে, মেলায়,

পটগানে বাজে জীবনের মায়া…”

অনিন্দ্য বসে বসে ভাবলেন—এই গান কি তাঁকে ফিরিয়ে দেবে শহরে, না সে থেকেই যাবে এই গাঁয়ের এক প্রান্তে, দিনরাত্রি পটচিত্র আর পটগানের মাঝে?

তাঁর মনে হতে লাগল—তাঁর লেখকসত্তা যেন এখন এক নতুন জন্ম পেয়েছে। শব্দের মতো করে সে দেখতে শিখেছে রংকে, শুনতে শিখেছে আঁচড়ের আওয়াজ।

 পর্ব ৬: রঙের বিপণি ও বিদেশের ডাক

রঘুরাজপুরের সকাল যেন প্রতিটি দিনেই একটু ভিন্ন। আজকের সকালটা বিশেষ। গ্রীষ্মের শেষ ভাগে চারদিক ঝকঝকে, আকাশ ধবধবে নীল, বাতাসে কাঁচা আমের গন্ধ। অনিন্দ্য ঘুম থেকে উঠে চৌকাঠে বসেই দেখতে লাগলেন—গ্রামের ছেলেমেয়েরা কেউ পটচিত্রের কাজ করছে, কেউ সানাই নিয়ে অনুশীলন করছে। এ যেন এক জীবন্ত শিল্পগ্রাম, যেখানে প্রতিটি নিঃশ্বাসেই রং ও সুর জড়িয়ে আছে। দিনবন্ধু এসে বললেন, “আজ আপনাকে নিয়ে যাব আমাদের ‘রঙের বিপণি’তে—একটি ছোট শিল্পসংগ্রহশালা ও বিক্রয়কেন্দ্র। সেখানে দেশের নানা প্রান্ত থেকে পর্যটক আসে। কেউ পটচিত্র কিনে নিয়ে যায়, কেউ চায় এই শিল্পকে আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে যেতে।”

‘রঙের বিপণি’ গ্রামের শেষ প্রান্তে একটি দু’তলা পুরনো বাড়ি। নিচে মাটির ঘরে সাজানো শত শত পটচিত্র—কোনোটা রামায়ণ, কোনোটা পুরাণ, আবার কোনোটা সম্পূর্ণ আধুনিক ভাবনার প্রতিফলন। ছবির পাশে থাকে QR কোড, দাম, ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বিবরণ।

“এগুলো সব দিনবন্ধুবাবুদের হাতেই আঁকা?” অবাক হয়ে অনিন্দ্য প্রশ্ন করলেন।

“হ্যাঁ,” গীতাঞ্জলি এসে বলল, “আর এই বিপণি তৈরি হয়েছিল দশ বছর আগে। লক্ষ্য ছিল—রঘুরাজপুরের শিল্পকে শুধু জাদুঘরের ভেতরে নয়, ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া।”

বিপণির দ্বিতীয় তলায় একটি গ্যালারি। সেখানে বিদেশি ক্রেতাদের জন্য আলাদা স্টল। ছবি বিক্রি হয় ইউরো, ডলার, ইয়েনে। একপাশে রাখা আছে দিনবন্ধুর একটি মাস্টারপিস—‘কলিঘাট ও রঘুরাজপুর’, যেখানে কলকাতা ও রঘুরাজপুর এক ফ্রেমে মিশে গেছে। দুপুরে এক বিদেশি দম্পতি এলেন—ডেনমার্ক থেকে। তাঁদের চোখে মুখে শিল্পের আগ্রহ। পটচিত্র ও পটগান শোনার জন্য এসেছেন রঘুরাজপুরে।

“আমরা শুনেছি, আপনি একটি নতুন ধারার পটগান লিখেছেন?” মহিলাটি অনিন্দ্যর দিকে তাকিয়ে বললেন।

অনিন্দ্য একটু লজ্জায় পড়লেও গীতাঞ্জলি বলল, “হ্যাঁ, তিন দিন আগেই আমরা রচনা করেছি—‘নারীর কথা’।”

দম্পতি অনুরোধ করলেন গানটি শোনাতে। সন্ধ্যায় উঠোনে আসর বসল। কেরোসিন বাতির আলোয়, চারদিকে শিশু আর পর্যটক, মাঝে গীতাঞ্জলির কণ্ঠে অনিন্দ্যর লেখা গান:

“জীবনের পটে নারীর গল্প,

কালি আর রঙে আঁকে শক্তি অচল…

রক্তের রেখায় ইতিহাস বয়,

প্রতিটি চিত্রে সে নায়িকা হয়…”

বিদেশি দম্পতির চোখে জল। তারা বলল, “এই গান শুধু ভারতের নয়, পৃথিবীর সকল নারীর গল্প।”

পরদিন বিপণির ভিতরে একটি চিঠি আসে—‘ইউনেস্কো কালচারাল অ্যাসেম্বলি’-র পক্ষ থেকে।

চিঠিতে লেখা: “আমরা জানতে পেরেছি, রঘুরাজপুরে তৈরি হয়েছে আধুনিক পটচিত্র ও পটগান নিয়ে এক নতুন ধারা। আমরা চাই এই শিল্পকে আমন্ত্রণ জানাতে প্যারিসে আন্তর্জাতিক লোকশিল্প উৎসবে। আমাদের প্রতিনিধি আগামী মাসে রঘুরাজপুর পরিদর্শনে আসবেন।”

দিনবন্ধুর মুখে আনন্দের ছায়া। “দেখলেন বাবু, আমাদের এই ছোট গাঁর রঙ এখন পেরিয়ে যাচ্ছে সাত সমুদ্র তেরো নদী।” গীতাঞ্জলি বলল, “এই চিঠির কৃতিত্ব আপনারও, অনিন্দ্যদা। আপনার লেখায় আমরা যেন নতুন ভাষা পেয়েছি। এ পথটা একা আমরা হাঁটতে পারতাম না।”

অনিন্দ্য চুপ করে বসে রইলেন। শহরের সাহিত্যসভা আর পুরস্কার নিয়ে দৌড়াদৌড়ির জীবন যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। এখানে, রঘুরাজপুরে তিনি পেয়েছেন নিজের লেখার প্রকৃত মূল্য—মানুষের চোখের জল, শোনার আগ্রহ, অনুভবের কম্পন। তিন দিন পর, একটি বিশেষ দল আসে কলকাতা থেকে—একটি বিখ্যাত প্রকাশনী সংস্থা ও এক চিত্রপ্রেমিক সাংবাদিক। তাঁরা চান অনিন্দ্য ও গীতাঞ্জলির লেখা ও চিত্রের উপর একটি বই বের করতে, যার নাম হবে— “পটের আঁচলে জীবনের গান”।

তাঁরা বলেন, “আমরা চাই বইটা বাংলায়, ইংরেজিতে, ওড়িয়ায় বের হোক, এবং সেই সঙ্গে QR কোডে সংযুক্ত হোক গীতাঞ্জলির গাওয়া পটগান।”

দিনবন্ধু বললেন, “এটাই তো ছিল আমাদের স্বপ্ন, রঙ শুধু কাগজে নয়, ছড়িয়ে পড়ুক কণ্ঠে কণ্ঠে, ঘরে ঘরে…”

বিকেলে গাছতলায় বসে দিনবন্ধু, অনিন্দ্য, ও গীতাঞ্জলি খাতায় লিখে চলেন নতুন পটগানের খসড়া। সুরের ধারা, চিত্রের রেখা, ভাষার মাধুর্য একসঙ্গে গড়ে তোলে নতুন অধ্যায়।

“পটের রং ছড়ায় সময়ের গায়ে,

 আঁচলে বাঁধা জীবনের রায়ে…

গ্রাম ছাড়িয়ে শহর ছুঁয়েছে,

ইতিহাস আজ পটগানে বয়ে গেছে…”

অনিন্দ্যর মনে হয়, এ তো শুধু গল্প নয়, একটি আন্দোলন। যেখানে শিল্প হারিয়ে যায় না, বরং প্রতিনিয়ত নিজেকে খুঁজে পায় নতুন আকারে। রঘুরাজপুর যেন তার প্রমাণ—একটি গ্রাম, যেখানে প্রতিটি ঘরই জাদুঘর, প্রতিটি মানুষই শিল্পী।

 পর্ব ৭: ফিরে দেখা, ফিরে চেনা

রঘুরাজপুরে আজ অন্যরকম এক সকাল। বাড়ির সামনের উঠোনে বসে দিনবন্ধু মোহাপাত্র এক হাতে পুরনো একটি পটচিত্র ধরে আছেন, অন্য হাতে চায়ের কাপ। পাশে দাঁড়িয়ে গীতাঞ্জলি, আর একটু দূরে বসে অনিন্দ্য। তাঁদের চোখে মুখে যেন সময়ের স্তব্ধতা। এতদিনের সৃষ্টির, সংগ্রামের, স্বপ্নের, গৌরবের এবং কিছু না বলা অভিমান জমে জমে তৈরি হয়েছে আজকের এই নিরালায় সকাল।

গীতাঞ্জলি হঠাৎ বলে উঠল, “আপনাদের প্রথম ছবি কোনটা ছিল, দিনবন্ধুবাবু?”

দিনবন্ধু চুপচাপ হাতে ধরা পটচিত্রটি অনিন্দ্যর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ছবি দেখতে দেখতে মনে হল, এক শতাব্দীর ইতিহাস এক পটচিত্রে ফুটে উঠেছে—মধ্যিখানে কৃষ্ণ, পাশে যশোদা, দূরে বৃন্দাবনের গোপ-গোপিনীরা; কিন্তু পাশে শহরের ট্রাফিক সিগনাল, মাথার উপর হেলিকপ্টার, দূরে হাইরাইজ বিল্ডিং!

“এটা আমরা একুশ বছর আগে এঁকেছিলাম,” বললেন দিনবন্ধু। “আধুনিক ও পুরাতনের মেলবন্ধনের প্রথম প্রচেষ্টা। তখন সবাই বলেছিল, এ পটচিত্র বিক্রি হবে না। কিন্তু আজ সেটা টেটমডার্ন আর্ট মিউজিয়ামে আছে। বুঝলে অনিন্দ্য, তখন থেকেই আমাদের এই যাত্রা।”

গ্রীষ্মের এক দুপুরে অনিন্দ্য একা হাঁটছেন গ্রামের পথে। কাঁধে ঝোলা, হাতে নোটবই। তাঁর চোখে লেগে আছে সারা গ্রামের প্রতিচ্ছবি—রঙে ভরা ঘর, উঠোনে বসে শিল্পী পরিবার, শিশুরা পট আঁকছে, আর বাড়ির বয়স্করাও সেই শিল্পে হাত লাগাচ্ছে। এটা যেন একটি চলমান কর্মশালা, একটা নিরন্তর উৎসব। হঠাৎ পাশের এক প্রাচীন বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা এক বৃদ্ধার দিকে নজর পড়ল। মুখে গভীর রেখা, চোখে মায়া। তিনি মৃদু হেসে বললেন, “আপনি কি সেই লেখক, যিনি পটগান লিখছেন এখন?”

অনিন্দ্য সম্মতিসূচক মাথা নাড়তেই বৃদ্ধা বললেন, “আমি দিনবন্ধুর মা, প্রতিমা মোহাপাত্র। আমার স্বামীও পটশিল্পী ছিলেন। ছেলের শৈশব কেটেছে পটের মধ্যেই। আপনি যেটা করছেন, তা শুধু শিল্প নয়—এ এক রক্ষাকবচ। এই গাঁয়ের সত্তাকে আপনি ভাষা দিচ্ছেন।”

সন্ধ্যায় অনিন্দ্য ও গীতাঞ্জলি আবার বসেন দিনবন্ধুর বাড়িতে। চারিদিকে কেরোসিন বাতির আলো। গীতাঞ্জলি বলল, “আমরা একটা গ্রন্থ প্রকাশের প্রস্তুতি নিচ্ছি। বইটির নাম ঠিক হয়েছে: *‘পটের আঁচলে জীবনের গান’*। আপনি কি মুখবন্ধ লিখবেন, দিনবন্ধুবাবু?”

দিনবন্ধু হাসলেন। “আমি মুখবন্ধ নয়, একটি কবিতা লিখে দেব—আমাদের শিল্পের প্রতি প্রণামস্বরূপ।”

তিনি হাত তুলে মুখস্থ বলতে লাগলেন:

“রঙে আঁকা প্রতিচ্ছবি,

গানে বাঁধা ইতিহাস,

পটের পাতায় বাঁধা জীবন,

এ যেন এক নিরন্তর উল্লাস।

তুমি লেখো, সে গায়,

আমি দেখি প্রতিচ্ছবিতে মায়া,

আমাদের গ্রাম তাই শুধু স্থান নয়—

সে এক জীবন্ত কাব্যছায়া।”

পরের দিন সকালের ট্রেনে ফিরবেন অনিন্দ্য। গীতাঞ্জলি তাঁকে দিয়ে আসতে এলেন পট্টবিষ্ণু স্টেশনে। পথে দু’জনেই চুপচাপ। গাড়ির জানালা দিয়ে রঘুরাজপুর পেছনে সরে যাচ্ছে, অথচ অনিন্দ্যর মনে হচ্ছে, এই গ্রাম কখনোই তাঁকে ছাড়বে না। স্টেশনের ছোট চায়ের দোকানে বসে অনিন্দ্য বললেন, “গীতাঞ্জলি, তুমি তো বলেছিলে পটশিল্পের পাশাপাশিও কিছু নতুন গান লেখার ইচ্ছে আছে?”

সে বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু তোমার ছাড়া তা সম্ভব নয়।”

অনিন্দ্য বললেন, “তাহলে লিখি আমরা—একসঙ্গে। আগামী বছর যখন ইউরোপের উৎসবে যাব, তখন আমাদের গান হবে সেখানে পঠিত।”

ট্রেন ছেড়ে দিল। জানালার পাশে বসে অনিন্দ্য দেখছেন কেমন করে গ্রাম মুছে যাচ্ছে শহরের ধোঁয়ায়। কিন্তু মুছে যাচ্ছে না মনের ভিতর আঁকা সেই রঙিন গ্রাম—দিনবন্ধুর দৃষ্টিতে, গীতাঞ্জলির গানে, প্রতিমা মায়ের স্পর্শে। কিছু দূরে দূরে ছোট ছোট গ্রামগুলো পেছনে পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু মনে হচ্ছে সবটাই সংযুক্ত এক অদৃশ্য সুতোয়। রঘুরাজপুর এখন কেবল একটি স্থান নয়, এক অনুভব, এক চেতনা।

তার খাতার শেষ পাতায় অনিন্দ্য লিখে রাখলেন:

“ফিরে দেখা মানে ফিরে চেনা,

রঙে আঁকা আমার সেরা বেদনা।

শহরের ভিড়ে, আলোর নীচে,

গ্রামই যেন আমাকে শিখিয়েছে বাঁচতে।”

সেই দিন থেকেই শুরু হয় একটি নতুন অধ্যায়—রঘুরাজপুর এখন শুধু শিল্পগ্রাম নয়, আন্তর্জাতিক লোকসংস্কৃতির এক কেন্দ্র। এবং সেই কেন্দ্রের ইতিহাসে অনিন্দ্য, গীতাঞ্জলি ও দিনবন্ধু মোহাপাত্রের নাম লেখা থাকবে একসঙ্গে।

 

সমাপ্ত 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

1000022626.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *