সুতপা মল্লিক
কলকাতার উত্তরের এক পুরনো বনেদি বাড়ির ভেতর দুপুরটা যেন হাঁপিয়ে উঠেছিল। ছাদের ওপর চড়া রোদ, নিচের দোতলা বাড়ির অন্দরে নিঃশব্দের এক গহ্বর। ব্রতী সেন জানলার ধারে বসে ছিল, পাশের ঘরে টিকটিকির ডাকে একটানা সময় যেন আটকে পড়েছিল। দুপুরের খাবার, থালা বাসনের শব্দ, শাশুড়ির নিয়মিত বকুনি—সবই সেদিনের মতো সেরে ফেলা হয়েছে। অরিন্দম অফিসে, শাশুড়ি ঘুমোচ্ছেন, আর এই সময়টুকু তার—সে জানে, এই এক-দেড় ঘণ্টা সে তার মতো করে বাঁচতে পারে। কিন্তু কীভাবে বাঁচে, তা সে নিজেই জানে না। তার পছন্দের খাতা, একটা পুরনো পেন আর সেই শাদা পৃষ্ঠা—যেখানে সে শব্দে শব্দে নিজের নিঃশব্দ চিৎকারগুলো গেঁথে রাখে। কেউ জানে না, কেউ পড়ে না, এমনকি সে নিজেও যেন সেই কবিতাগুলোর পাঠিকা নয়। সে যেন শব্দ লিখে ফেলে দেয়, নিজের ভিতরের খাঁচা একটু হালকা করে, আবার শিকল দিয়ে ঢেকে রাখে। তবুও, এইটুকু সময়েই সে বেঁচে থাকে। তার ভিতরে একটা অন্যরকম ব্রতী জেগে ওঠে, যে কথা বলতে পারে, স্বপ্ন দেখতে পারে, কবিতার ছত্রে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পেতে চায়। কিন্তু সেই ব্রতী ঘরের বাইরের জগতে অনুপস্থিত। বাস্তবে, সে এক গৃহবধূ, যার দিন শুরু হয় রান্না ঘর দিয়ে, আর শেষ হয় শোওয়ার ঘরের বাতি নিভিয়ে।
শাশুড়ি সরোজিনী দেবী একজন সময় মেপে চলা মানুষ। তাঁর চোখে গৃহবধূ মানেই নিখুঁত গৃহকর্মী, নিরব, বিনয়ী, অনুগত। ব্রতী ছোটবেলা থেকে শান্ত, ভদ্র ছিল, তাই বিয়ের জন্য তাকে খুব সহজেই “ভালো বউ” হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছিল। অরিন্দম একেবারেই অন্যরকম—প্র্যাকটিকাল, যুক্তিবাদী, ভালো মানুষ হলেও বরং উদাসীন। বিয়ের সাত বছরে একটা দিনও সে ব্রতীর কবিতা নিয়ে কিছু বলেনি, কারণ সে জানেই না যে ব্রতী লেখে। বিয়ের আগে ব্রতী ইংরেজি অনার্স পড়েছিল, কলেজ ম্যাগাজিনে লেখাও ছাপা হয়েছিল, কিন্তু বিয়ের পর লেখালিখি যেন ধীরে ধীরে থেমে গিয়েছিল। সে নিজেই জানে না, কেন লেখে না—সময় নেই, না সাহস নেই? তবে আজ দুপুরবেলা, খাওয়া দাওয়ার পর, সে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেয় যে সে মেজানিন ঘরটা পরিষ্কার করবে। সেই ঘরটা বহুদিন বন্ধ, ধুলোময়লা জমে রয়েছে। বাড়ির কারো তেমন দরকার পড়ে না, কিন্তু সেখানে কিছু পুরনো বই, অজানা জিনিসপত্র রাখা আছে। ব্রতী জানে না ঠিক কী টানছিল তাকে, তবে তার ভিতর যেন কেউ বলছিল, “ও ঘরে যা, দেখবি কিছু একটার অপেক্ষায় তুই।”
ধীরে ধীরে ধুলোবালির ভেতর দিয়ে ঘরে ঢুকে সে জানালার পর্দা সরায়। আলো ঢুকে পড়ে ঘরে, ধুলোর কণাগুলো বাতাসে ভাসে। বাঁদিকের দেয়ালে একটি আয়না ঝুলছে—পুরনো কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো, খানিকটা কালচে হয়ে গেছে। কৌতূহলে এগিয়ে গিয়ে আয়নার ধুলো মুছতে গিয়ে সে এক মুহূর্ত চমকে ওঠে। আয়নার ভেতর নিজের প্রতিফলন দেখতে পেলেও, সেই চোখদুটি যেন তার নয়। সেখানে ছিল না তার চেনা ক্লান্তি, বরং এক ধরণের দৃঢ়তা, আত্মবিশ্বাস—যা ব্রতী নিজের মধ্যে কখনো দেখেনি। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আয়নার দিকে, যেন চোখে চোখ রেখে কারো সঙ্গে কথা বলছে। প্রতিফলনের ঠোঁট নাড়ছে না, কিন্তু চোখের ভাষা যেন প্রশ্ন করছে—“তুই কে?” ব্রতী কাঁপা কাঁপা হাতে আয়নার নিচে রাখা একটি পুরনো কাঠের বাক্স খোলে, সেখানে কিছু পুরনো চিঠি, একটা পেন আর ভাঁজ করা খাতা পড়ে আছে। খাতা খুলে দেখে প্রথম পাতায় লেখা—“সব কিছুর শুরু হয় চুপ করে তাকিয়ে থাকাটা দিয়ে।” ব্রতীর শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। এই বাড়িতে কে লিখেছিল এটা? কেন সে অনুভব করছে, কেউ যেন তার কথা বলছে? কে যেন তাকে ডেকে বলছে, “তুই তো হারিয়ে যাসনি, তুই তো এখানেই আছিস। আয়নার অন্যপাশে।”
–
সেই রাতে ব্রতী ঘুমাতে পারল না। বিছানায় অরিন্দম পাশে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে, কিন্তু ব্রতীর চোখ খোলা, ছাদে চুপচাপ তাকিয়ে। বারান্দার দরজার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকছে ঘরে, দেয়ালে দাগ কাটছে ছায়া, যেন পুরনো কিছু স্মৃতি আবার জেগে উঠছে। মেজানিন ঘরের সেই আয়নার প্রতিফলন, চোখের সেই দৃষ্টি, আর খাতায় লেখা লাইনটা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে বারবার—“সব কিছুর শুরু হয় চুপ করে তাকিয়ে থাকাটা দিয়ে।” কথাটা কেমন যেন তার নিজের ভাষায় লেখা, যেন সে নিজেই বলেছে বহু আগে, বা ভবিষ্যতে বলবে! আয়নার ভেতর সে যেমন চোখের ভাষা দেখেছিল, তেমন অনুভব আগেও কোনোদিন হয়নি। প্রতিবার সে আয়নার সামনে দাঁড়ায় নিজেকে খুব ছোট আর বিবর্ণ মনে করত। কিন্তু আজ, সেই পুরনো আয়নার ভেতর সে যাকে দেখেছিল, সেই নারী যেন তারই মতো, কিন্তু অনেক বেশি জীবন্ত। সেই চোখে ভয় ছিল না, অনুশোচনা ছিল না—ছিল আত্মবিশ্বাস। ব্রতীর মনে হলো, আজ যেন আয়নাটা তাকে ফিরে ডাকছে, যেন দীর্ঘদিন পর নিজের কোনো হারিয়ে যাওয়া অংশ তাকে চিনে ফেলেছে। সে খুব আস্তে উঠে খাট থেকে নামল, স্বামীর ঘুম না ভাঙিয়ে পা টিপে টিপে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। ঠান্ডা বাতাসে তার চুল ওড়াতে থাকল, সে একবার আকাশের দিকে তাকাল—পূর্ণিমার আলোয় তার মুখও যেন একটু অন্যরকম দেখাচ্ছিল।
পরদিন সকালে ব্রতী রোজকার কাজগুলোর ভেতর থেকেও বারবার ছাদঘরের আয়নার কথা ভাবছিল। রান্না, বাসন, বাজারের লিস্ট, শাশুড়ির ওষুধ—সবই ছিল তার প্রতিদিনের ছকে বাঁধা। কিন্তু মনের ভিতর যেন কেউ দরজা খোলার জন্য ধাক্কা দিচ্ছিল। সে অপেক্ষা করছিল কখন সময় পাবে, আবার সেই ঘরে যাবে। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে, শাশুড়ি ঘুমিয়ে পড়লে সে আবার চুপচাপ উঠে গেল মেজানিনে। আজ সে সঙ্গে নিয়ে গেল একটা ছোট টর্চ, নিজের খাতা আর পেন। ঘরের দরজা খুলে সেই পুরনো ধুলোমাখা গন্ধটা আবার পেল, জানালা খুলে আলো ঢুকতেই সে সোজা চলে গেল আয়নার সামনে। এবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখল খুব নিবিড়ভাবে। আজ তার নিজের মুখে চেনা কিছু রঙ ফিরেছে, কিন্তু আয়নার চোখে সে যা দেখল, তা যেন এখনও অতীত আর ভবিষ্যতের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে। প্রতিবারের মতোই প্রতিফলন কোনো শব্দে কথা বলল না, কিন্তু চোখে চোখ রাখা অবস্থায় ব্রতী হঠাৎ বলে ফেলল, “তুই কে?” তার কণ্ঠস্বর খুব আস্তে, কিন্তু তা যেন ঘরের ভেতর গুমরে উঠল। আয়নার মুখ বদলাল না, কিন্তু চোখ দুটো যেন হাসল। হঠাৎ আয়নার পাশে রাখা সেই বাক্সটা থেকে এক পাতলা শব্দ এল—কাগজের। ব্রতী নিচু হয়ে দেখে, বাক্সের তলায় ভাঁজ করা এক পুরনো পত্রিকা, তার ভেতরে লাল কালি দিয়ে আণ্ডারলাইন করা একটি কবিতা। লেখকের নাম নেই, কিন্তু কবিতাটা যেন তারই ভেতরের গোপন কথা। “আমি আয়নার অপরপাশ থেকে তোমাকে দেখি, তুমি চুপ করে থাকো—আর আমার মধ্যে জন্ম হয় এক নতুন সত্তার।” ব্রতী আঁচ করতে পারল না—এটা সে নিজেই লিখেছিল কোনও এক সময়? নাকি এটি তাকে নিয়েই লেখা?
সেদিন সন্ধ্যায় সে আর আগের মতো হাঁসফাঁস করছিল না। তার মুখে এক অদ্ভুত নীরব আত্মবিশ্বাস ছিল। খাওয়ার টেবিলে শাশুড়ি আজও একরকম বকাবকি করছিল—ডালটা পাতলা কেন, থালাটা একটু ছোপ আছে কেন—তবে ব্রতী আর কিছু বলছিল না, মুখে হাসি ধরে রেখেছিল, ভেতরে এক নতুন আলোর জন্ম নিচ্ছিল। খাওয়া শেষ করে সে নিজের ঘরে গিয়ে জানালার ধারে বসল, খাতা খুলল, পেন হাতে নিল। পেন চালানোর আগেই সে আয়নার দিকটা একবার দেখে নিল। দরজা বন্ধ, আয়না নেই—কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, কেউ যেন তার পিঠের দিক থেকে তাকিয়ে আছে। সে লিখল, “আজ প্রথমবার মনে হলো, আমি আসলে কে—তা জানার চেষ্টা করছি। আর সেটা কাউকে না বলেও বলা যায়। আয়নার ভাষা শব্দে নয়, চোখে বোঝা যায়। আমি এখন সেই ভাষা শিখছি।” সেই রাতে, ব্রতী তার খাতার প্রতিটি পৃষ্ঠায় যেন একটু একটু করে নিজের হারিয়ে যাওয়া প্রতিচ্ছবি আঁকতে লাগল। আয়নার ভেতর তার দেখা সেই মেয়েটিকে সে ঠিক কী নামে ডাকবে জানে না, কিন্তু সে জানে—সে হারিয়ে যায়নি, বরং ধীরে ধীরে তার মধ্যেই জেগে উঠছে।
–
ব্রতীর দিন এখন দ্বিখণ্ডিত। বাইরে থেকে সে আগের মতোই—চুপচাপ, বিনয়ী, নিখুঁত গৃহবধূ, যাকে দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না তার ভিতরে এক নতুন জগত গড়ে উঠছে। কিন্তু ভিতরে, প্রতিদিন দুপুরের সেই একটুখানি সময় যেন হয়ে উঠেছে তার আসল জীবন। সে অপেক্ষা করে দুপুর দুটোয় শাশুড়ির ঘুমোনোর, অরিন্দমের ফোনে অফিসের আলাপ চলার, আর রান্নাঘরের কাজ নিঃশেষ হওয়ার। ঠিক সেই সময়ে সে উঠে পড়ে, যেন একটা গোপন অভিসারে যাচ্ছে নিজেরই আরেক সত্তার সঙ্গে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে এখন আর ভয় পায় না—বরং অনুভব করে, সে কোনো এক গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলছে নিজের প্রতিবিম্বের সঙ্গে। আয়না আজও নিঃশব্দ, ঠোঁট নড়ে না, কিন্তু চোখ—সেই চোখ এত স্পষ্ট ভাষায় কথা বলে, যেন প্রতিটি প্রশ্ন ব্রতীর হৃদয়ের ভিতর ঢুকে যায়। “তুই লিখিস কেন না?” “তুই ভয় কীসের?” “তোর যে নাম আছে, তা নিজেই ভুলে গেছিস কেন?” ব্রতী একদিন বলে ফেলে—”কারণ কেউ শুনবে না, কেউ বুঝবে না।” আয়নার চোখ যেন তীব্র আলোয় জ্বলে ওঠে। এক মুহূর্তে মনে হয় আয়নাটা কেঁপে উঠল, তার প্রতিফলন একটুও না নড়ে যেন বলে উঠল, “তুইই তো আগে নিজেকে শোন না, তুই নিজেকে মানিস না—তাহলে অন্যরা কিভাবে শুনবে?” ব্রতী স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, আর আয়নার চোখে দেখে নিজের ভেতরের ভয়ের সমস্ত মুখোমুখি দাঁড়ানো এক সাহসী নারীর চেহারা।
এরপরের দিনগুলোতে ব্রতীর লেখা বদলে যেতে থাকে। তার খাতার ভাষা আর আগের মতো মৃদু নয়—সেখানে এখন ছন্দ আছে, কিন্তু সঙ্গে আছে দ্রোহ। সে লিখে—“যে কণ্ঠ চুপ থেকেছে এতদিন, সে শব্দে নয়, আগুনে কথা বলবে। যে আয়নায় আমি নিজেকে চিনতে পারি না, সেই আয়নাই আজ আমাকে নতুন জন্ম দিচ্ছে।” সে বুঝতে পারে, এই আয়না তার একটা দরজা খুলে দিয়েছে, যার ওপারে অপেক্ষা করে তার নিজের অস্তিত্ব। প্রতিদিন সে যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, তখন যেন একটা অদৃশ্য সংলাপ চলে। আজ সে আবার ফিরে আসে সেই বাক্সে রাখা পুরনো কবিতার কাছে। খাতার পাতা উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ এক পাতায় দেখতে পায় একটি অর্ধেক লেখা কবিতা—যার শেষ লাইন অপূর্ণ: “তুই যদি নিজের মতো হতে চাস, আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকিস…” ব্রতীর গায়ে কাঁটা দেয়। কে লিখেছিল? এই বাক্সে রাখা জিনিসগুলো কার? এ কি তার শাশুড়ির পুরনো স্মৃতি, না অন্য কোনো নারীর চিহ্ন, যে একদিন এই বাড়িতে বাস করত এবং তার মতোই হারিয়ে গিয়েছিল? সে ঠিক করে, সে খোঁজ করবে, জানবে, এবং সেই অর্ধেক লাইনের বাকিটা সে নিজে লিখবে।
সন্ধ্যাবেলা অরিন্দম ঘরে ফিরলে ব্রতী তার চোখে চোখ রেখে বলে, “তুমি জানো, আমি কবিতা লিখতাম?” অরিন্দম একটু থমকে যায়, তারপর হাসে, “ও, ভালো! এখনো লেখো?” ব্রতী বলে না যে, সে এখন প্রতিদিন লেখে, বলে না যে সে লিখতে গিয়ে আয়নার সঙ্গে কথা বলে, শুধু মাথা নাড়ে। অরিন্দম তার মোবাইল খুলে মেসেজ দেখতে থাকে, এবং সেই মুহূর্তেই ব্রতী বোঝে, তার ভেতরের জগত কারো সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার মতো জায়গা এখনো আসেনি। তার যুদ্ধটা এখনো নিঃশব্দ, ব্যক্তিগত। কিন্তু সে জানে, সেই আয়নার কণ্ঠস্বর এখন তাকে ছাড়বে না। সে রাতে ব্রতী নিজের খাতায় লিখে—“তুই তোর মতো করে বাঁচ। হয়তো কেউ দেখবে না, কিন্তু আয়নার দিকে তাকালে প্রতিদিন তোকে চিনতে পারবি। সেটাই সবচেয়ে জরুরি।” আর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে প্রথমবার নিজের মুখে হাসি দেখে—অভ্যন্তরের, নিজেকে আবিষ্কারের, মুক্তির হাসি।
–
বছরের প্রথম বৃষ্টির দিনে, ব্রতীর সকালটা অন্যরকম মনে হলো। জানালার কাঁচে টুপটাপ জল পড়ে চলেছে, আকাশের ধূসরতার ভেতর যেন তার মনে জমে থাকা কুয়াশাগুলোও গলে গলে নামছে। রান্নাঘরের কাজ শেষ করে সে একবার ছাদে গিয়ে দাঁড়ায়, ভেজা বাতাসে শাড়ির আঁচল উড়তে থাকে, আর সে ভাবে—এই মেঘলা আকাশের নিচে, এই শহরে কেউ কি জানে, তার ভেতরে একটা আলাদা জীবন গড়ে উঠছে? সে কি একা এমন অনুভব করে? নাকি আরও অনেক নারী, যারা ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে নিঃশব্দে নিজেদের হারিয়ে ফেলে, তারাও এমনই আয়নার খোঁজে থাকে? তার মনে পড়ে, সেই অর্ধেক লেখা লাইনের কথা—”তুই যদি নিজের মতো হতে চাস, আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকিস…”। সে যেন সেই লাইনটাকে পূর্ণ করতে চায়, শুধু খাতায় নয়, নিজের জীবনেও। তাই আজ সে নিজের খাতা খুলে লিখতে বসে না—সে বের করে রঙ পেন্সিল, পুরনো কাগজ, আর শুরু করে আঁকতে। ছবিটা পরিষ্কার নয়, তবুও সে আঁকে এক নারীর চোখ, যাদের গভীরতায় আছে চুপচাপ জেগে থাকা আগুন। চোখের নিচে জলের রেখা, কিন্তু ভেতরে আছে উজ্জ্বলতা। ব্রতী জানে, সে এই ছবিতে নিজের প্রতিবিম্ব আঁকছে—যে এখনো কথা কম বলে, কিন্তু চোখে জমেছে এক অন্য গল্প।
সেই দিন বিকেলে, শাশুড়ির বান্ধবী রত্নাদেবী আসে। বসার ঘরে গল্প চলছিল—আত্মীয়, পাড়াপড়শি, আর এক স্বনামধন্য পত্রিকার নতুন সংখ্যা নিয়ে। রত্নাদেবী হঠাৎ বলেন, “তোমাদের বউমার চোখে একটা শান্ত ভাব আছে, কিন্তু আমি বলি সরোজিনী, এর মধ্যে কিন্তু অনেক কিছু জমে আছে। লেখার ঝোঁক আছে কিনা কে জানে!” শাশুড়ি হেসে বলেন, “আরে না না, ও খুব শান্ত মেয়ে, এ সব লেখালেখি করার সময় কোথায়! রান্না-ঘর সামলাতেই সময় যায়।” ব্রতী ভিতরে চা তৈরি করছিল, কথাটা শুনে তার বুকের ভেতর হঠাৎ যেন কিছু ছিঁড়ে গেল। সে বুঝে গেল, এই বাড়ির চোখে সে কেবল কাজের মানুষ, শিল্পী নয়, অনুভবী নয়, স্বপ্ন দেখার অধিকার তার নেই। কিন্তু এই রাগ বা দুঃখ তাকে থামায় না, বরং আরও বেশি আঁকড়ে ধরতে শেখায় তার সেই গোপন খাতা। রাতে, সবাই ঘুমিয়ে গেলে সে আবার নিজের লেখা আর ছবিগুলো দেখতে থাকে। তার সেই খাতা এখন শুধু লেখার খাতা নয়—একটা চুপচাপ সংগ্রহ, তার অস্তিত্বের প্রমাণ। সে খাতার এক পৃষ্ঠায় লেখে—“আমি লিখি, কারণ বলার জায়গা নেই। আমি আঁকি, কারণ আমার চোখে যা আছে, তা কারো মুখে নেই। আমি থাকি, আয়নার ঠিক অপর পাশে, যেখান থেকে নিজেকে দেখা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়।”
পরদিন সকালে, অরিন্দম তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছিল অফিসের জন্য। হঠাৎ খাটের তলায় কিছু পড়ে থাকতে দেখে সে টেনে বের করল—ব্রতীর খাতা। কভারটা আঁকা, ভেতরের পাতা ভর্তি কবিতা আর রঙিন চোখের ছবি। ব্রতী তড়িঘড়ি করে ছুটে এল, মুখ শুকিয়ে গেছে। অরিন্দম খাতা খুলে কয়েকটা পাতা দেখে প্রশ্ন করে, “তুমি এগুলো লেখো?” ব্রতী মাথা নিচু করে বলে, “হ্যাঁ, অনেক দিন ধরে।” অরিন্দম কেবল বলে, “তুমি আমাকে কখনো বলোনি।” ব্রতী আস্তে বলে, “কারণ তুমি কখনো জিজ্ঞেস করোনি।” এই কথায় অরিন্দম থেমে যায়, কিছু বলে না, শুধু খাতা বন্ধ করে রাখে টেবিলের ওপর। ব্রতী জানে না সে রাগ করল, অবাক হলো, না ব্যথা পেল। তবে সে এটুকু বোঝে—তাদের মধ্যে এক অদৃশ্য দেওয়াল ছিল, যেটা আজ একটু হলেও ফাঁকা হলো। সেই রাতে ব্রতী ঘুমোতে পারল না। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে দেখে, প্রতিফলনটা আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট। এবার সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “আজ কেউ আমার লেখা দেখেছে। ভয় পেয়েছি, কিন্তু লুকাইনি। হয়তো এটাই শুরু। আমি চাই, একদিন নিজের নামে, নিজের ভাষায় বাঁচতে। আমি আর গোপনে লিখতে চাই না।” আয়নার প্রতিফলন এবার যেন হালকা মাথা নাড়ায়। ব্রতী চোখ বন্ধ করে বলে, “তুই যদি নিজের মতো হতে চাস, আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকিস, আর একদিন আয়নার ভেতরের মেয়েটাকেই নিজের মতো করে বাঁচতে দিস।” শব্দ ছিল না, আলো কমে গিয়েছিল, কিন্তু ব্রতীর মনে হচ্ছিল—সেই আয়নার অন্যপাশের মেয়েটি অবশেষে একটু হেসেছিল।
–
ব্রতীর কলম যেন সেদিন থামতেই চায়নি। রাত বাড়লেও ঘুম আসেনি তার চোখে। সে জানত না কার জন্য লিখছে, কেন লিখছে—শুধু জানত, না লিখলে দম বন্ধ হয়ে যাবে। আয়নার সামনে বসে, চুপিচুপি নিজের হাতের লেখা দেখে সে বুঝল, তার কলমে জমে থাকা কান্না, প্রতিবাদ, ভালোবাসা, অভিমান সব ধীরে ধীরে ছাপা হয়ে যাচ্ছে কাগজে। সেদিন প্রথমবার সে নিজেকে আর “অরিন্দমের বৌ” বা “সেন বাড়ির বউমা” মনে করল না, বরং অনুভব করল—সে একজন মানুষ, যার অনুভব আছে, ভাষা আছে, প্রকাশের অধিকার আছে। অনেকটা সময় নিয়ে সে সাজিয়ে তুলল কবিতাগুলোর একটা পাণ্ডুলিপি। কোনও নাম দিল না, কারণ সে জানে না এই শব্দেরা কাকে ডাকে—কেনই বা ডাকে। এই অনামা সৃষ্টি নিয়েই এক রাতে সে চুপিচুপি অনলাইন সাহিত্য পত্রিকায় পাঠিয়ে দেয়, এক অচেনা ইমেল আইডি থেকে। ইমেলের শেষে কোনো নাম লেখা ছিল না, কেবল লেখা ছিল—“এটি এক আয়নার ভেতর থেকে উঠে আসা শব্দ।”
পরদিন সকালে ব্রতী স্বাভাবিক ভাবে ঘরসংসারের কাজ করতে থাকে, কিন্তু মনে মনে তার বুক ধুকপুক করতে থাকে। কবিতা পড়বে কেউ? গ্রহণ করবে? ছাপা হবে আদৌ? সে জানত এই প্রশ্নগুলোর জবাব আসতে পারে, আবার নাও আসতে পারে। সে জানত, হয়তো অরিন্দম যদি জেনে ফেলে, বা শাশুড়ি সন্দেহ করে, তাহলে বাড়িতে অশান্তি হবেই। কিন্তু আজকাল সে ভয় পায় না। এই যে ভয় ছিল—সম্মানের, কৌলীন্যের, দায়িত্বের—সেই সব ভয় যেন ধীরে ধীরে আয়নার আরেকপাশে জমে যাচ্ছে। তার হাতের নখ রাঙানো নেই, চুল বাঁধা নেই ঠিকভাবে, রান্নাতেও মাঝে মাঝে ভুল হচ্ছে—তবু সে টের পায়, সে আজ একটু বেশিই জীবন্ত। ঠিক পাঁচ দিন পর, এক দুপুরে সে রান্নাঘরে যখন লাল সস দিয়ে চিংড়ির মালাইকারি বানাচ্ছে, তখনই ফোনে একটি মেল আসে। সে কাঁপা হাতে পড়ে—তার কবিতা ছাপা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সম্পাদক তাকে চিঠি লিখেছেন—”এই কবিতার মধ্যে এক নীরব বিদ্রোহ আছে। লেখিকা যদি সামনে আসেন, তবে আমরা বিশেষ সংখ্যায় তাঁকে নিয়ে ফিচার করতে চাই।” ব্রতীর হাত থেকে ফোন পড়ে যায়, একটা মৃদু চিৎকার বেরোয় মুখ থেকে—কিন্তু সে বোঝে না সেটা আনন্দের না আতঙ্কের।
বিকেলে ছেলেকে পড়াতে বসে থাকলেও, তার চোখ চলে যায় বারবার সেই মেলের দিকে। ব্রতী সিদ্ধান্ত নেয়, এই জয় সে কাউকে জানাবে না—কারণ এখনো এই আনন্দে অন্যরা বিষ ঢেলে দিতে পারে। সে জানে না, তার কী পরিচয়ে সেই পত্রিকায় নাম ছাপানো হয়েছে, “অরিন্দম সেনের স্ত্রী” নাকি “আয়নার মেয়ে”—তবে এটুকু বুঝতে পারে, এই নামহীন কবিতাগুলি এবার তার নিজের হয়ে উঠেছে। ওই আয়নাটা এখন আগের মতো কথা বলে না, শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কোণের ঘরে—আর ব্রতী বুঝতে পারে, আসলে আজ সে নিজেই হয়ে উঠেছে আয়না, যার প্রতিফলনে অন্য নারীরাও হয়তো একদিন নিজের মুখ চিনে নেবে। রাতে ঘুমোতে গিয়ে অরিন্দম প্রশ্ন করল, “তুই কি কাগজে দেখলাম সেই কবিতা লিখেছিস? নাম ছিল না, কিন্তু লাইনগুলো তো তোর ডায়রির মতোই মনে হচ্ছিল।” ব্রতী চুপ করে ছিল, কিন্তু তার মুখের হাসি থামেনি। অরিন্দম বলল, “মা জানলে খুব খারাপ লাগবে। লেখালেখি এসব বন্ধ করাই ভালো।” ব্রতী ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে বলল, “তুমি যা বলছ, তা আয়নার ওইপাশের কথা। আমি এখন আয়নার এইপাশে।” অরিন্দম কিছু বলল না। ঘরে নিঃশব্দ জমল, কিন্তু সেই নিঃশব্দ যেন ব্রতীর কাছে এক শুদ্ধ সংগীত হয়ে বাজছিল।
–
অবশেষে সেই দিনটা এল যখন ব্রতী প্রথমবার তার নিজের লেখা কবিতাটি একটি নামী সাহিত্য পত্রিকায় পাঠানোর সাহস করল। সকালটা অন্য সব দিনের মতোই শুরু হয়েছিল—শাশুড়ির বাঁকা কথা, অরিন্দমের অন্যমনস্কতা আর রান্নাঘরের চিরচেনা গন্ধ। কিন্তু ব্রতীর মনে সেদিন একটা অন্যরকম শক্তির সঞ্চার হচ্ছিল। যেন ভেতরের কোনো সুপ্ত আগুন তাকে সাহস দিচ্ছিল। সে এক কাপ চা হাতে নিয়ে তার পুরনো ডায়রিটার পাতা উল্টে কবিতাটি কপি করল কম্পিউটারে। লেখার সময় তার হাত কাঁপছিল, কিন্তু চোখে ছিল এক নিঃশব্দ জেদ। কবিতার শিরোনাম ছিল—”অপরিচিতা”। নামের নিচে সে নিজের নামটা প্রথমবার লিখল সাহসের সঙ্গে—ব্রতী সেন। মনে হচ্ছিল, এই নামটা এতদিন কেবল রান্নাঘরে আর বাজারের ব্যাগে ব্যবহৃত হয়েছে, আজ সেটা পৃষ্ঠার উপর নিজস্ব পরিচয়ে জ্বলজ্বল করছে। সে চুপচাপ ছেলের স্কুল বাস চলে যাওয়ার পর ই-মেইল করে পাঠিয়ে দিল পত্রিকার ঠিকানায়। পাঠানোর পর তার বুক ধকধক করতে লাগল, যেন কোনো অপরাধ করে ফেলেছে। কিন্তু পাশাপাশি তার বুকের ভেতর কোথাও যেন খোলা হাওয়া ঢুকতে লাগল—একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস।
পরবর্তী কয়েকদিন কাটল এক অদ্ভুত উত্তেজনা ও ভয়ে। কেউ জানে না সে কী করেছে, কিন্তু সে জানে তার জীবনের দরজায় এক নতুন সম্ভাবনা কড়া নেড়েছে। সে আর আয়নার সামনে দাঁড়ায় না, কারণ সে এখন নিজেই নিজের মুখ দেখতে শিখেছে—আয়না ছাড়াও। তবুও আয়নাটি তার ঘরে সেই পুরনো জায়গাতেই রয়ে গেছে, যেন এক প্রহরী, তার ভিতরের সত্যি সত্তার পাহারাদার। একদিন দুপুরে, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে আবার লিখতে বসে। তার কলমের নিচে জন্ম নেয় নতুন এক গল্প—এক নারী, যে শহরের ব্যস্ততার মধ্যেও এক পাথরের ঘড়ির নিচে নিজের নিঃশ্বাস খোঁজে। গল্পটা শেষ হলে সে বুঝতে পারে, তার কল্পনা আর বাস্তব মিলে মিশে যাচ্ছে। সে লেখার মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে, ঠিক যেভাবে কোনো আঁকিয়ে রং-তুলির মাধ্যমে নিজের মনভুবন প্রকাশ করে। লেখা এখন তার কাছে হয়ে উঠছে মুক্তির দরজা, আর সেই দরজা খুলে গেছে একবারেই। পত্রিকার উত্তর আসে এক সপ্তাহ পর—তার কবিতা মনোনীত হয়েছে পরবর্তী সংখ্যার জন্য। ব্রতী সে খবরটা দেখে চুপচাপ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে। বাইরে তখন বৃষ্টি পড়ছে, আর সে হঠাৎ করেই অনুভব করে—এই বৃষ্টিতে তার চোখের জলও মিশে গেছে, আনন্দের, বিস্ময়ের, আর একধরনের অদ্ভুত আত্মবিশ্বাসের।
তবে এই নতুন পথ একেবারেই মসৃণ ছিল না। কবিতাটি যখন ছাপা হয় এবং পত্রিকাটি ঘরের ডাইনিং টেবিলে এসে পড়ে, তখন থেকেই শুরু হয় বাড়ির মধ্যে টানাপোড়েন। অরিন্দম প্রথমে দেখে অবাক হয়—তার স্ত্রীর নাম কীভাবে সেখানে গেল? সে তো জানত না যে ব্রতী লেখে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন ছুটে আসে—কেন সে আগেই বলেনি? কেন গোপনে কাজ করছে? ব্রতীর ঠোঁট তখন কাঁপে, কিন্তু চোখে জল আসে না। সে স্থির গলায় বলে, “কারণ তুমি কখনো জানতে চাওনি।” শাশুড়ি বেজায় চটে যান—বউ মেয়ে হয়ে ‘পত্রিকায় ছাপা’ হওয়া তাদের পরিবারের মান ইজ্জতের সঙ্গে খাপ খায় না। কিন্তু এবার ব্রতী আর চুপ করে না। সে বলে, “এটা আমার পরিচয়। আমি কেবল একজন বউ, মা কিংবা বৌমা নই। আমি একজন মানুষ।” সেই প্রথমবার তার কণ্ঠ এত দৃঢ় হয়েছিল যে শাশুড়ির মুখ থমকে যায়। অরিন্দম নিশ্চুপ হয়ে পড়ে। সেদিন রাতে ব্রতী অনেকক্ষণ আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু নিজেকে আর অপরিচিত মনে হয় না। আয়নার মধ্যে সে দেখতে পায় একটি মুখ—যেটা ক্লান্ত, কিন্তু জয়ী। একটা নতুন গল্পের সূচনা হয়ে গেছে, আর এই গল্পের লেখক এখন ব্রতী নিজে।
–
সকালবেলার আলো জানলার ফাঁক গলে পড়েছিল ঘরের মেঝেতে, কিন্তু আজ ব্রতীর চোখে রোদের সেই চেনা উষ্ণতা ছিল না। ঘরটা যেন হঠাৎ করেই অচেনা লাগছিল, আসবাবপত্র একই আছে, দেয়ালে আঁকা ছবিগুলো এক জায়গায় ঝুলছে, তবু যেন কোথাও একটা ফাঁক—একটা অসম্পূর্ণতা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে তাকাল নিজের চোখে, কিন্তু আজ অবাক হয়ে লক্ষ্য করল—সেই রহস্যময় প্রতিবিম্বটা আর নেই। আয়নার গা থেকে যেন একটা জীবন্ত সত্তা হারিয়ে গেছে। প্রতিদিন যার সঙ্গে কথা বলত, যাকে দেখে নিজের সাহস ফিরে পেত, সেই রূপটা আজ অনুপস্থিত। ব্রতী যেন নিজের মধ্যে এক নিঃসঙ্গতা টের পেল, যেটা আগেও ছিল, কিন্তু আজ সেটা অনেক বেশি তীব্র। আয়নার খালি প্রতিবিম্বে সে খুঁজে পেল নিজেকে—কিন্তু কেমন যেন নিঃসাড়, নির্জীব, স্তব্ধ একটা উপস্থিতি। তখনই সে বুঝল, আয়নাটা আর দরকার নেই। কারণ যে প্রতিবিম্ব তার ভেতর সাহস জাগিয়েছে, যে আত্মবিশ্বাস তাকে লেখার পথে ফিরিয়ে এনেছে, সে আর কেবল আয়নার মধ্যে নেই—সে ব্রতীর ভেতরেই বাস করে এখন।
সেদিন দুপুরে অরিন্দম বাড়ি ফিরল একেবারে নীরব মুখে। টেবিলে রাখা ব্রতীর কবিতার পত্রিকা সে চোখের সামনে এনে ফেলল, এবং এক টানেই ছিঁড়ে ফেলে দিল। “তুমি কী ভাবো নিজেকে? নাম ছাপিয়ে দিচ্ছো, নিজে কিছু না জানিয়ে?” — তার কণ্ঠে ছিল রাগ, অপমান, আর ভয়। ব্রতী ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে পড়ল, তার কাঁপা কাঁধে আর কোনো দম বন্ধ হওয়া ভীতি ছিল না। “তুমি জানো, আমি অনেক কিছু জানাইনি তোমায়, বহু বছর ধরে। কিন্তু আজ আমি থামব না। এটাই আমি। তুমি যার সঙ্গে বিয়ে করেছিলে, সে আর নেই। আমি বদলেছি, নিজেকে ফিরে পেয়েছি।” এই কথা শুনে অরিন্দম আর কোনো কথা বলেনি, সে শুধু ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। শাশুড়ি, যিনি রান্নাঘর থেকে সব শুনছিলেন, এগিয়ে এসে বললেন, “সংসারে মেয়েরা যদি নিজের নাম নিয়ে পড়ে, সংসার ভাঙে। তুমি না বুঝলে?” ব্রতী হাসল হালকা করে, বলল, “সংসার যদি আমার সত্যিকে মানতে না পারে, তাহলে সে সংসার ভেঙে যেতেই পারে।” সেই মুহূর্তে ব্রতী অনুভব করল, ভয়ের চেয়ে সত্যি অনেক বড়। এবং ভয়কে পেছনে ফেলে সত্যিকে বেছে নেওয়াটাই হয়তো নারীর আসল জয়।
রাতে ব্রতী লিখল তার নতুন কবিতা, যার নাম দিল “প্রতিবিম্বহীন আয়না”। সেখানে সে লিখল, কীভাবে একজন নারী দিনের পর দিন নিজের পরিচয়কে চাপা দিয়ে চলে, কেবল পরিবারের সুখে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। কিন্তু একদিন সে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের চক্ষুহীন প্রতিবিম্ব দেখে, আর বুঝতে পারে, তার ভেতরের চোখই আসল আলো। তার নিজের স্বর, তার নিজের সত্তা, কোনো আয়নার ওপর নির্ভর করে না। সেই রাতে সে আয়নাটাকে নামিয়ে রেখে দিল কাঠের আলমারিতে। সে জানে, আর দরকার পড়বে না। কারণ এখন সে নিজেকে দেখে চারপাশের জগতের চোখে নয়—নিজের চোখেই। এবং সেই দৃষ্টিতে সে এক সাহসী, সৃষ্টিশীল, আত্মবিশ্বাসী নারী—যার গল্প কেবল আয়নার ভেতর নয়, কাগজের পাতায়, পাঠকের মনে, এবং তার নিজের জীবনের প্রতিটি কোণে জ্বলতে থাকবে। আয়নার অন্যপাশে সে যা দেখেছিল, আজ সেটা তার নিজের ভেতর জন্ম নিয়েছে, স্থায়ী হয়ে গেছে, আর কখনও তাকে একা হতে হবে না।
–
অবশেষে, সেই দিনটা এল যেদিন ব্রতী সিদ্ধান্ত নিল—সে আয়নাটার সামনে দাঁড়াবে না আর। যে আয়নাটা তার আত্মচেতনার জাগরণ ঘটিয়েছিল, সেই আয়না এখন তার প্রয়োজন নেই। কারণ সে নিজেই আয়নার বাইরে সেই মেয়েটি হয়ে উঠেছে—সাহসী, স্বাধীন, নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো আত্মবিশ্বাসী। সকালে উঠে, মাথার খোঁপা আলগা করে ব্রতী বারান্দায় গিয়ে বসল। হাতে তার নিজের লেখা সেই কবিতার ছাপা পত্রিকা। এখন সে নিয়মিত লিখে, বিভিন্ন পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হয়। অরিন্দম আজকাল চুপচাপ, মাঝে মাঝে চোখে একটা অপরিচিত শ্রদ্ধার ছায়া দেখা যায়, আর শাশুড়ি—তিনি আজকাল মুখে কিছু না বললেও ব্রতীর কাজের প্রশংসা করেন অন্যদের কাছে। মেয়ের স্কুলের অনুষ্ঠানে ব্রতী ‘অভিভাবক বক্তা’ হিসেবে ডাক পেয়েছে, আর সেদিন সে যা বলেছিল—নারীর আত্মপরিচয়ের কথা, নিঃশব্দ প্রতিভার কথা—তা দর্শকদের মন ছুঁয়ে গিয়েছিল।
তবে এই জার্নি এতটা মসৃণ ছিল না। কখনও রাতের পর রাত নিঃশব্দ কান্না, কখনও অপমান, কখনও নিজের ওপর সন্দেহ—”আমি কি ঠিক করছি?”—এই প্রশ্নগুলো বারবার জেগেছিল মনে। কিন্তু প্রতিবার সেই আয়নার ভেতরের মেয়েটি তাকে সাহস জুগিয়েছিল। এখন সে জানে, সে একা নয়—তার ভেতরে একটা শক্তি আছে, একটা আলো, যা জ্বলে তখনই, যখন কেউ নিজের অস্তিত্বকে মর্যাদা দেয়। আজ সে সেই আলোকে শুধু নিজের ভেতরে নয়, অন্য নারীদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে চায়। সে একটি ছোট সাহিত্য গোষ্ঠী গড়েছে, যেখানে গৃহবধূ, চাকুরিজীবী, বৃদ্ধা, কলেজ ছাত্রী—সকলেই আসে নিজেদের ভাবনা প্রকাশ করতে। সেখানে ব্রতী শুধু একজন লেখিকা নয়, একজন শ্রোতা, একজন সাহচর্যদাত্রী, একজন পথপ্রদর্শক।
সন্ধ্যায় চা হাতে ব্রতী বারান্দায় দাঁড়ায়। দূর থেকে রাস্তার গা দিয়ে আলো ঝলমলে ট্রাম এগিয়ে আসে—ঠিক যেমন সময় এগোয়, সমাজ এগোয়। বাড়ির কোণে রাখা পুরনো আয়নাটার গায়ে এখন সাদা চাদর ঢাকা। ব্রতী জানে, সে আর আয়নার দরকার নেই। সে এখন আয়নার বাইরের মানুষ—নিজের নামেই পরিচিত, নিজের কণ্ঠেই আত্মবিশ্বাসী। বাতাসে তার খোলা চুল উড়ে যায়, চোখে এক গভীর শান্তি। এই যাত্রা একার ছিল না—এই ছিল প্রতিটি নারীর যাত্রা, যারা একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করেছিল: “আমি কে?” এখন তারা জানে, উত্তরটা আয়নার মধ্যে নয়—নিজের মধ্যেই লুকিয়ে।
____