Bangla - রহস্য গল্প

কৃষ্ণনগরের পুতুলবাড়ির গুপ্তধন

Spread the love

ঋতব্রত সেন


[১]

জুলাইয়ের এক মেঘলা দুপুরে মিহির তার ঠাকুরদার পুরনো কাঠের আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, যেখান থেকে ধুলোমাখা বই আর ভাঙা পুতুলের গন্ধ ভেসে আসছিল। ঠাকুরদা, বিশ্বেশ্বর পাল, এককালে ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন—তার চোখে এখনও সেই অতীতের আলো জ্বলে। মিহির ছুটির দিনে তার কাছ থেকে নানা কাহিনি শুনতে ভালোবাসত, বিশেষ করে কৃষ্ণনগরের পুতুলশিল্প ও রাজাদের গোপন ইতিহাস। সেই দিন, যখন বৃষ্টি বাইরের দিগন্ত ঘিরে রেখেছিল, ঠাকুরদা হঠাৎ এক গল্প শুরু করলেন—একটা পরিত্যক্ত বাড়ির, যেটি সবাই ‘পুতুলবাড়ি’ বলে চিনত। সেই বাড়ি নাকি এক কালে ছিল রামানন্দ পাল নামের এক পুতুলশিল্পীর, যিনি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের দরবারে কাজ করতেন। কথিত আছে, রাজপরিবারের গুপ্তধন রক্ষা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাকে, আর তিনি সেই ধন লুকিয়ে রেখেছিলেন নিজের তৈরি পুতুলগুলোর ভিতরে। ঠাকুরদা বললেন, “সে পুতুলগুলো ছিল যন্ত্রচালিত, গোপন সংকেতে খোলার মতো, একেকটা যেন ধাঁধার কক্ষ।” মিহির চোখ বড় হয়ে উঠল। সে জানত পুতুলশিল্প ছিল কৃষ্ণনগরের গর্ব, কিন্তু এই ধরনের গুপ্তধনের কথা সে কখনও শোনেনি। ঠাকুরদার কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠল, “আমি একবার সেই বাড়িতে ঢুকেছিলাম, বহু বছর আগে। কিন্তু… কিছু অদ্ভুত ঘটনার পর আর সাহস পাইনি।”

রাতে ঘুম আসছিল না মিহিরের। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে সে ভাবছিল—কী সেই অদ্ভুত ঘটনা? কেন সবাই বলে ওই বাড়ি ভৌতিক? সকালে সে পুরনো একটি বাক্সে খুঁজে পেল রামানন্দ পালের বানানো এক পুতুল, যার চোখে ছিল লাল কাচের দানা আর শরীর ছিল কাঠের খোদাই করা সুক্ষ্ম কারুকাজে ভরা। পুতুলটা নড়ছিল না, কিন্তু তার মুখের ভঙ্গিমায় কিছু একটা লুকিয়ে ছিল—এক নিঃশব্দ সতর্কবার্তা যেন। সে পুতুলটা ঠাকুরদাকে দেখাতে গেলে তিনি কাঁপা গলায় বললেন, “এটা সেই পুতুল। এক সময় আমি খুঁজে পেয়েছিলাম। কিন্তু এর ভিতরে যা ছিল, তা আমি বুঝিনি তখন। আজ এত বছর পর আবার ওটা ফিরে এল কেন?” মিহির বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। রাতের বেলায় সেই পুতুলটার দৃষ্টিতে যেন কিছু একটা বেঁচে ছিল, ঘরের নিস্তব্ধতা চিরে তার চোখ মিহিরের দিকে তাকিয়ে ছিল নিঃশব্দে। সকালে রাধার সঙ্গে দেখা হলে মিহির প্রথমবার বলল, “চল না, পুতুলবাড়িটা খুঁজে দেখি। হয়তো ওখানে এখনও কিছু আছে।”

রাধা প্রথমে ভয় পেয়ে গেল, কিন্তু মিহিরের উত্তেজনা ছুঁয়ে গেল তাকে। তাদের দুজনের মাথায় ছিল শুধু একটা কল্পনা—একটা গুপ্তধনের, একটা রহস্যের, আর একটা সত্যি অথবা মিথ্যের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা ইতিহাসের। তারা সাইকেল চেপে পৌঁছাল কৃষ্ণনগরের শহরতলির কাছে সেই পুরনো গলিপথে, যেখানে আগাছায় ঢাকা এক বিশাল খাম্বা দেখা যায়—ওটাই ছিল সেই পুতুলবাড়ির প্রবেশদ্বার। বাড়িটার জানালাগুলো বন্ধ, দেয়াল ভাঙা, আর গেটের সামনে কাঁটা তার লাগানো। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ছিল বাড়িটার চারপাশের নীরবতা—কুকুরের ডাক নেই, পাখির শব্দ নেই, এমনকি হাওয়ার সোঁ সোঁ শব্দও যেন সেখানে থেমে যায়। মিহির ফিসফিস করে বলল, “এই বাড়িটা বেঁচে আছে।” রাধা কাঁধ ছোঁয়াল, “আমরা কি ঠিক করছি?” মিহির হাসল, কিন্তু সে নিজেও জানত না কী অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। পুতুলবাড়ি তখন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে, যেন পুরনো দিনের ছায়া হয়ে—যেখানে ইতিহাস, অলৌকিকতা আর লুকিয়ে রাখা ধনের গল্প একসাথে ঘুরপাক খাচ্ছে।

[২]

সপ্তাহান্তের সকালে, সূর্যটা গাঢ় হয়ে ওঠার আগেই, মিহির আর রাধা তাদের সাইকেল নিয়ে চুপিচুপি বেরিয়ে পড়েছিল। শহরের ব্যস্ত রাস্তা পেরিয়ে তারা পৌঁছায় কৃষ্ণনগরের পুরনো উত্তরপাড়া অঞ্চলে, যেখানে মাটির রাস্তা আর পোড়ো বাড়ির সারি স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধে ভরা। রাধার চোখে একটা মিশ্র অনুভূতি—উৎসাহ আর ভয়—দুটি একসাথে নাচছিল। বাড়িটা দেখতে যেমন ভাঙাচোরা, তেমনি ছিল একরকম মর্যাদার ছাপ, যেন এককালে তা গর্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। তারা সাইকেল গেটের পাশে রেখে ভাঙা লোহার খাম্বার ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকল। চারদিকে আগাছা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যেন প্রকৃতি নিজেই এই বাড়িকে গিলে ফেলতে চেয়েছে। বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াতেই তারা বুঝতে পারল, যত গল্প শুনেছে, বাস্তবতা তার চেয়েও বেশি গা ছমছমে। পেছনের জানালা থেকে একটা সাদা কাপড় নড়ছিল, অথচ বাড়িতে তো কেউ থাকে না! পায়ে চেপে শুকনো পাতার শব্দ তুলতে তুলতে তারা সামনে এগোল, আর ঠিক তখনই একটা পুতুলের মতো মুখ ঝলকে উঠল ওপরে, পুরনো ব্যালকনির ভাঙা কাঠের আড়ালে। মুহূর্তের মধ্যেই তা অদৃশ্য হয়ে গেল। মিহির থমকে দাঁড়াল, “তুই দেখলি?” রাধা চোখ গোল করে তাকাল, “হ্যাঁ, পুতুল না কি মানুষ?”

তাদের বুক ধড়ফড় করছিল, তবুও ফিরে যাওয়ার কথা মাথায় এলো না। রাধা পকেট থেকে একটা ছোট টর্চ বার করল—বাড়ির ভিতরটা অন্ধকার, এমনকি দুপুরবেলা হলেও জানালাগুলো বোঝাই যায় যে অনেক বছর ধরে খোলা হয়নি। প্রধান দরজার ধারে এসে তারা দেখল, দরজায় একটা খোদাই করা কাঠের প্যানেল, যেখানে এক রাজপুরুষকে ঘিরে নৃত্যরত পুতুলদের ছবি খোদাই করা আছে। দরজার বাঁদিকে মাটির খুব কাছে একটা বস্তুর উপর রাধার চোখ পড়ল—একটা পুরনো ব্রোঞ্জের বোতাম, যেটা মনে হচ্ছিল কেউ ছিঁড়ে ফেলেছে। মিহির এক হাঁটু গেঁড়ে সেটা তুলল, আর বোতামের নিচে একটা অদ্ভুত চিহ্ন খোদাই করা ছিল—তিনটি ঘূর্ণাবর্ত, একে অপরকে ছেদ করে গেছে, যেন কোনো রহস্যময় সংকেত। “এটা সাধারণ কিছু না,” রাধা ফিসফিস করে বলল। হঠাৎ করে সামনের দরজা খানিকটা খুলে গেল নিজে থেকেই—কোনো বাতাস ছিল না, কেউ ছিল না, তবুও সেই শব্দটা যেন তাদের হাড়ে হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। মিহির টর্চ জ্বালিয়ে বলল, “চল ভেতরে যাই।”

বাড়ির ভেতরে এক অদ্ভুত ঠান্ডা, ঘামের রেখা পিঠ বেয়ে নেমে এল। দেয়ালজুড়ে কালচে ফোঁটাগুলো যেন ছড়িয়ে পড়েছে বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা আর্দ্রতার মতো। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিল ভাঙা পুতুলের মাথা, হাত, চোখের গুটি। একটা ঘরে তারা ঢুকল, যেখানে একপাশে পড়ে থাকা একটা বড় পুতুল-র‍্যাক থেকে হঠাৎ একটা পুতুল নিজে নিজেই উল্টে পড়ল—কোনো শব্দ না করে, শুধু নড়েচড়ে উঠল। রাধা চিৎকার করে উঠতে গিয়েও নিজেকে সামলাল। “এইসব কি বাতাসে হচ্ছে?” মিহির ঘাড় নাড়িয়ে কিছু বলল না, সে শুধু জানে—এই বাড়ির ভিতর কেউ আছে, অথবা কিছু একটা আছে। দেয়ালের একটি ফ্রেমে ঝুলছিল রামানন্দ পালের ছবি—মর্যাদাপূর্ণ চেহারা, চোখে গভীর চাহনি, কিন্তু হাসিমুখে এক গা ছমছমে ছায়া। তার পেছনে পুতুলের সারি—যেগুলোর চোখ খোলা। মিহির ছবির দিকে তাকিয়ে বলল, “এই মানুষটাই লুকিয়ে রেখেছিলেন ধন। আর মনে হয়, এখনও পাহারা দিচ্ছেন।” আর তখনই তারা পেছনে একটা ধাতব আওয়াজ শুনতে পেল—কারা যেন লোহার জিনিস ঠুকছে… বাড়িটা যেন বেঁচে উঠছে, তারা জানত—এটা কেবল শুরু।

[৩]

সেই রাতে মিহির নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে ছিল, কিন্তু ঘুম তার চোখে আসছিল না। পুতুলবাড়ির দৃশ্যগুলো বারবার তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল—রামানন্দ পালের ছবির চোখ, নিজের থেকে পড়ে যাওয়া পুতুল, আর সেই রহস্যময় ধাতব আওয়াজ। জানালার পাশে বসে চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া কৃষ্ণনগরের ছাদগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ সে লক্ষ করল—পর্দার ফাঁকে রাখা সেই পুরনো কাঠের পুতুলটি তার আলমারির ওপর বসানো ছিল, কিন্তু এখন সেটা কোথাও নেই। বুক ধুকপুকিয়ে উঠল। সে টর্চ জ্বালিয়ে আলমারির আশপাশ খুঁজতে লাগল, কিন্তু পুতুলের কোনো চিহ্ন নেই। ঘরের মেঝেতে চোখ পড়তেই গায়ে কাঁটা দিল—চোখের পুতুলদুটো যেন তাকিয়ে আছে তার দিকে, খোলা দৃষ্টি নিয়ে, ম্লান আলোয় চকচক করছে। মিহির ধীরে ধীরে নিচু হয়ে পুতুলটা তুলতে গেল, তখনই কানের কাছে ফিসফিস করে ওঠে এক শব্দ, যেন কেউ কানে কানে বলছে—”তুমি কি খুঁজে পেয়েছো?”—এক মুহূর্তের মধ্যেই শব্দটা মিলিয়ে যায়। মিহির গলা শুকিয়ে আসে, চোখ বন্ধ করে ফিসফিস করে বলে ওঠে, “এটা কোনো পুতুল না, এটা একটা সংকেত… একটা ডাক…”

পরদিন সকালে রাধাকে নিয়ে সে ঠাকুরদার কাছে যায়। বিশ্বেশ্বর পাল চুপচাপ পুতুলটা হাতে নেন, আর অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। তারপর খুব নিচু গলায় বলেন, “এই পুতুলটা আমি অনেক বছর আগে পেয়েছিলাম। তখন এক বন্ধুর সঙ্গে গিয়েছিলাম পুতুলবাড়িতে। আমরা ধন খুঁজতে যাইনি, শুধু রহস্য জানার জন্য গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার বন্ধু… সে একটা দরজা খোলার পর নিখোঁজ হয়ে যায়। পুলিশ খুঁজে পেল না, কেউ বিশ্বাসও করল না। আমি শুধু ওই পুতুলটা নিয়ে চলে এসেছিলাম, আর আর কোনোদিন ওদিকে পা রাখিনি।” রাধা জিজ্ঞেস করল, “আপনি বলছেন কেউ হারিয়ে গেল? সেটা কি বাড়ির কোনো ফাঁদ, না কি…” ঠাকুরদা থামিয়ে দিয়ে বললেন, “না, ওটা মানুষ ছিল না… ওটা যেন এক আত্মা… এক রক্ষক… যে পুতুলের আড়ালে থেকে পাহারা দেয়।” এরপর তিনি একটা পুরনো ডায়েরি বের করলেন, যেখানে আঁকা ছিল কিছু চিহ্ন—ঘূর্ণাবর্ত, ত্রিভুজ, চোখের প্রতীক। “এই চিহ্নগুলো আমি ওই বাড়ির দেওয়ালে দেখেছিলাম… আর পুতুলটার গায়ের নিচে লুকিয়ে ছিল এ রকমই এক চিহ্ন। এইসব কিছুই যুক্ত হয়ে আছে এক ধাঁধার সঙ্গে। হয়তো পুতুলগুলোর মধ্যেই আছে সেই ধন, কিংবা তারা নিজেই ধনকে রক্ষা করছে।”

সন্ধেবেলা রাধা ও মিহির সিদ্ধান্ত নেয়, এবার বাড়ির দ্বিতীয় তলায় ওঠার চেষ্টা করবে, যেখানে রামানন্দ পালের ওয়ার্কশপ ছিল বলে কথিত। তারা সাথে নেয় টর্চ, রশি, আর ক্যামেরা—রাধা বলে, “আমরা যা দেখব, তা নথিভুক্ত করব। সবাই বলে গল্প, আমরা দেখাব সত্যি।” তারা আবার সেই পাথর-পড়া রাস্তা ধরে পুতুলবাড়ির সামনে পৌঁছায়, এবার সূর্যাস্তের আলোয় বাড়িটা যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে। দ্বিতীয় তলায় ওঠার কাঠের সিঁড়ি প্রায় ভেঙে পড়েছে, তবুও একে একে উঠে যায় তারা। ওপরের ঘরে ঢুকেই একটা অদ্ভুত গন্ধ তাদের নাকে লাগে—পুরনো কাঠ, ধুলোর সঙ্গে মিশে থাকা রঙ আর স্নানের সাবানের গন্ধ, যেন কেউ আজকেই ছিল সেখানে। ঘরজুড়ে পুতুলের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, ধাতব যন্ত্রাংশ, আর দেয়ালের ওপর খোদাই করা কিছু চিহ্ন—যার মানে এখনও তারা বুঝে উঠতে পারে না। হঠাৎ একটা দেয়ালের অংশে চাপ পড়তেই নিচ থেকে উঠে আসে এক গোপন তাক, আর তাতে পাওয়া যায় এক ভাঁজ করা কাগজ—যেখানে লেখা আছে, “যদি সত্যিই জানার সাহস থাকে, তবে পুতুলদের চোখের পেছনে তাকাও। তারা যা দেখে, তা কেউ বোঝে না।” দুই বন্ধু মুখ চেয়ে থাকে—আরও গভীরে ঢুকতে হবে, আরও বেশি জানতে হবে। কিন্তু তারা জানত না, এই পথের শেষে শুধু ধন নয়, অপেক্ষা করছে এক ভয়, এক প্রতিশোধ, আর এক অতীত, যাকে দীর্ঘদিন ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল।

[৪]

পরদিন স্কুল শেষে মিহির আর রাধা সোজা চলে গেল রাধাদের বাড়ির ছাদের ঘরে, যেখানে রাধা তার কাকিমার পুরনো স্ক্যানার, ম্যাগনিফায়িং লেন্স, আর কিছু পুরাতন বই জমিয়ে রেখেছিল। তারা পুতুলবাড়ির দ্বিতীয় তলা থেকে উদ্ধার করা সেই অদ্ভুত নোটটিকে আলতো করে খুলে দেখল। কাগজটি ছিল খুব পাতলা, কৌটোয় থাকা ঘুঁটে দেওয়া পাতার মতো, আর অক্ষরগুলো হালকা লালচে কালি দিয়ে লেখা—যেন রক্তে ডুবানো কলম দিয়ে আঁকা। লেখাটিতে কোথাও কোথাও স্পষ্ট নির্দেশ ছিল না, বরং কবিতার মতো অস্পষ্ট বাক্য: “যেখানে পুতুলের চোখে বসে দিন, সেখানে রাত দেখায় পথ।” রাধা বোঝার চেষ্টা করল, “এখানে ‘পুতুলের চোখ’ মানে কী? সেটা কি কোনো নির্দিষ্ট পুতুল, নাকি প্রতীক?” মিহির তখন পুতুলটার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “এর চোখটা লাল কাঁচ দিয়ে তৈরি। আমরা আলো ফেললে সেটা একটা ছায়া তৈরি করেছিল জানিস? সেই ছায়া যদি কোনো দিক নির্দেশ করে?” রাধা সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাতি নিভিয়ে, পুতুলের চোখে টর্চের আলো ফেলল। চোখের ভিতর দিয়ে লাল আলো দেয়ালে গিয়ে পড়তেই এক গোলাকার চিহ্ন দেখা গেল—তা যেন একটা মানচিত্রের খণ্ডাংশ, যার মধ্যভাগে তিনটি বিন্দু ছিল, এবং চারপাশে কিছু সংকেত। তারা বুঝল, এই পুতুল শুধু একটা পুতুল নয়—এ যেন এক চালাক যন্ত্র, যার ভিতর লুকিয়ে আছে দিক নির্দেশনার ছক।

রাধা তার ট্যাবলেট খুলে সংকেতগুলো তুলনা করতে লাগল। সে বলল, “এই তিনটি বিন্দু সম্ভবত তিনটি ঘর নির্দেশ করছে—পুতুলবাড়ির ভিতরের ঘর। এই চিহ্নটা অনেকটা বৈদিক যুগের যন্ত্রচক্রের মতো, যেখানে শক্তি প্রবাহের রেখা আঁকা থাকত।” মিহির হতবাক হয়ে বলল, “তাহলে রামানন্দ পাল শুধু শিল্পী ছিলেন না, উনি হয়তো প্রাচীন জ্ঞান ও তন্ত্রবিদ্যাও জানতেন। তাই এই বাড়ির প্রতিটা ঘর একটা যন্ত্রের মতো কাজ করে, পুতুলের চোখ থেকে নির্দেশ পাওয়া যায়।” তখনই রাধা দৃষ্টি আকর্ষণ করল এক অদ্ভুত প্রতীকের দিকে—একটি ত্রিভুজ, যার কেন্দ্রস্থলে আঁকা একটি চোখ, আর নিচে লেখা: “অন্তর্দৃষ্টি যার আছে, সে প্রবেশ করতে পারে। বাকিদের জন্য দরজা বন্ধ।” তারা বুঝল, শুধু চোখে দেখা নয়, বুদ্ধি, অন্তর্জ্ঞান আর যুক্তিকে কাজে লাগাতে হবে এই রহস্য ভেদ করতে। রাধা পুরাতন মানচিত্র বের করে বাড়ির কাঠামো তুলনা করতে লাগল। তিনটি চিহ্ন যেভাবে বসানো আছে, সেভাবে বাড়ির তিনটি ঘর নির্দিষ্ট করা গেল—একটি নিচতলার বাম কোণার ছোট ঘর, একটি রান্নাঘরের পাশে থাকা গুদাম, আর একটি দ্বিতীয় তলার মাঝের বড় ঘর—যেটা একসময় পুতুলশিল্পীর ওয়ার্কশপ ছিল।

পরদিন ঠিক সকাল ছ’টায় তারা আবার হাজির হল পুতুলবাড়ির সামনে—এবার তাদের হাতে ছিল মানচিত্র, পুতুল, আর সংকেতের ব্যাখ্যা। নিচতলার বাম কোণার ঘরে ঢুকতেই তারা দেখতে পেল পাটের ধুলোমাখা পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিরাট পুতুল—মানব আকৃতির, মাথায় মুকুট, গায়ে ধাতব আবরণ। পুতুলটির চোখ ছিল বন্ধ, কিন্তু বুকের মাঝখানে ছিল একটি ছোট স্ক্রোল ঢোকানোর ফাঁক। রাধা তার ব্যাগ থেকে বের করল সেই সংকেতপত্র, আর ভাঁজ করে স্ক্রোলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। মুহূর্তে পুতুলটির চোখ খুলে গেল, আর তার বুক থেকে বেরিয়ে এল একটি যান্ত্রিক শব্দ—টিক টিক করে চলতে লাগল ঘড়ির কাঁটার মতো। তারা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। পুতুলটি ধীরে ধীরে তার হাত বাড়িয়ে একটি ধাতব চাবি দিল। সেই চাবিতে ছিল একটি অদ্ভুত ছিদ্রযুক্ত কাঠামো, যা অনেকটা পুতুলের চোখের মধ্যে বসানোর মতো দেখাচ্ছিল। তখনই ঘরের এক পাশে থাকা কাঠের তাক নিজে থেকেই খুলে গেল, এবং তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল আরও একটি সংকেত—এবার একটি কবিতা, যার শেষ চরণে লেখা: “চোখ যেখানে বলে থামো, হৃদয় সেখানে খুলে দাও—তোমার পথ সেখানে।” তারা জানত, রহস্য আরও গভীর হচ্ছে। ধন শুধু সোনা বা মণিমুক্তো নয়, এটা এক ইতিহাস, এক উত্তরাধিকার… আর সেই সত্যের মুখোমুখি হতে এখন তাদের সামনে আরও দরজা খুলতে হবে।

[৫]

রাত গভীর হতে হতে কৃষ্ণনগরের আকাশে এক অদ্ভুত থমথমে নীরবতা নেমে আসে, যেন পুরো শহরটা নিঃশব্দে শ্বাস রোধ করে শুনছে পুতুলবাড়ির ভেতরে কি ঘটছে। মিহির ও রাধা সেই রাতে সিদ্ধান্ত নেয় তারা ঘুমাবে না—তারা পুতুলবাড়ির পেছনের জানালা দিয়ে আবার ঢোকার পরিকল্পনা করে। হাতে টর্চ, ব্যাগে রাখে সেই পুতুল আর মানচিত্র, এবং ঠাকুরদার দেওয়া কাঠের রুলেটি যা কোনো একসময় রামানন্দ পালের কাজে ব্যবহৃত হত। তারা জানে, এই রাতে বাড়িটা অন্যরকম; অতীত আর বর্তমানের সীমা মুছে গিয়ে কিছু অদৃশ্য শক্তি চোখে পড়বে। জানালা দিয়ে ঢুকে তারা পৌঁছায় সেই ঘরটিতে, যেখানে আগেও পুতুলের মধ্যে থেকে কাগজ পাওয়া গিয়েছিল। ঘরের দেয়ালে হঠাৎই অদ্ভুত প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে—একটি ছায়ামূর্তি, যেটি যেন পুতুলের মতোই অবয়ববিশিষ্ট কিন্তু মুখে কোনো ভাব নেই, কেবল শূন্যতা। সে যেন জানিয়ে দেয়, তারা ঢুকেছে এমন এক গোপন স্তরে, যেখানে শুধু সাহস নয়, সত্যিকারের শ্রদ্ধা ও সম্মান লাগে প্রবেশ করতে।

রাধা কাঁপতে কাঁপতে মিহিরের হাত চেপে ধরে, কিন্তু মিহির বলে, “ভয় পাস না। ওদের রক্ষা করার কেউ চাইছে—আমরা যদি সত্যিই শিল্প আর ইতিহাসকে ভালোবাসি, তাহলে ভয় না পেয়ে এগোতে হবে।” হঠাৎ সেই ছায়ামূর্তির হাত থেকে আলো ছিটকে পড়ে ঠিক সেই পুতুলটির দিকে, যেটি তারা নিয়ে এসেছিল। পুতুলটি যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে; চোখ জ্বলে ওঠে সাদা আলোর মত, আর তার বুকে একটি ছোট্ট দরজা খুলে যায়। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একটি খোদাই করা তামার কুঞ্জি—অত্যন্ত পুরনো কিন্তু অক্ষত। পেছনে থাকা দেওয়ালে রাধা টর্চ ফেলতেই দেখে এক টানা চিত্ররেখা—পুতুলে ভরা একটি রাজসভা, যার মাঝখানে বসে আছেন এক মহিলা, চোখে পাটুল ফুলের কাজ করা চশমা, আর তার সামনে পাতা একটি পিতলের সিন্দুক। “এটা নিশ্চয়ই রানি হেমাঙ্গিনী,” মিহির বলে, যার কথা ঠাকুরদা একবার বলেছিলেন—যিনি নাকি শিল্পকে গুপ্তধনের রক্ষাকবচ করেছিলেন। রাধা বলে, “আমরা সঠিক পথে আছি। এবার আমাদের খুঁজতে হবে সেই পিতলের সিন্দুক।” ঠিক সেই সময় ছায়ামূর্তি এক ঝটকায় ঘরের আরেকটি দেওয়ালে হাত রাখে—একটি দরজা খুলে যায়, যার ওপারে এক সরু ঘুপচি সিঁড়ি নিচে নেমে যাচ্ছে অন্ধকারের গভীরে।

তারা সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে অনুভব করে ঠাণ্ডা হাওয়া, পাথরের গন্ধ আর কেমন একটা সুরের ধ্বনি—যেন পুতুল নাচের তান। নিচে পৌঁছে দেখে একটি গোল ঘর, চারপাশে মাটির পুতুল সারিবদ্ধভাবে বসে আছে, চোখ বন্ধ। মাঝখানে রাখা একটি পাথরের বেদি, যার ওপর বসানো সেই পিতলের সিন্দুক। কিন্তু তার চারপাশে আঁকা রয়েছে এক রহস্যময় তান্ত্রিক চক্র—লাল আর সাদা পাউডারে। মিহির তামার কুঞ্জি তুলে সিন্দুকের দিকে এগিয়ে যায়, কিন্তু ছায়া আবার আবির্ভূত হয়। এবার সে কথা বলে—স্বরে ধ্বনি নেই, কেবল মস্তিষ্কে ধাক্কা দেওয়া এক অন্তর্দৃষ্টি: “এই ধন কারো ব্যক্তিগত সম্পদ নয়। যিনি একে ছুঁতে চান, তাকে দিতে হবে আত্মার নিখাদ সত্য। যারা এসেছ, তারা কি প্রস্তুত নিজেদের প্রমাণ দিতে?” রাধা আর মিহির একে অপরের দিকে চায়। তারা জানে, কেবল বুদ্ধি বা সাহস নয়, সত্যিকার ভালবাসা আর ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধাই পারে তাদের পথ দেখাতে। মিহির সিন্দুকের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমরা ধন নিতে আসিনি। আমরা এসেছি জানার জন্য, আর ইতিহাসকে সংরক্ষণের জন্য।” ছায়া ধীরে ধীরে সরে যায়। পুতুলগুলো যেন চোখ মেলে তাকায়, তারপর আবার চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ে। সিন্দুক খুলে যায়—ভেতরে আছে স্বর্ণের নয়, বরং রামানন্দ পালের নিজের হাতে বানানো সবশেষ পুতুলটি—রানির মূর্তি, যার বুকে লেখা: “শিল্পই ধন।” একটি পুরনো দলিলও পড়ে থাকে পাশে—বাড়ির দানপত্র, যেখানে লেখা, এই বাড়ি ভবিষ্যতের শিল্পীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। মিহির ও রাধা বোঝে, তারা ইতিহাসের ভার নিয়েছে—আর পুতুলবাড়ি যেন সেই রাতে তাদের সত্যিকারের অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে নেয়।

[৬]

চাঁদের আলো ক্রমশ মেঘের চাদরে ঢেকে যাচ্ছিল। পুতুলবাড়ির ভেতরে তখন নিস্তব্ধতা যেন জমাট বাঁধা দুঃস্বপ্ন হয়ে নেমে এসেছে। মিহির ও রাধা সেই সিঁড়ি বেয়ে নিচের গোপন কক্ষে পৌঁছানোর আগেই দেয়ালে খোদাই করা অলৌকিক প্রতীক আর পুতুলের চোখে বসানো লাল পাথরের ঝিলিক তাদের থমকে দিল। মনে হচ্ছিল যেন সেগুলো শুধুই মৃত বস্তু নয়—তারা যেন তাকিয়ে আছে, সতর্ক করছে। রাধা ধীরে ধীরে আগালো, তার হাতে সেই ধাঁধার শেষ অংশ—যেটি বলে একটি বিশেষ পুতুলের চোখ সরালেই খোলে চূড়ান্ত দরজা। হঠাৎ করেই চারদিক কেঁপে উঠল, যেন ভূকম্প হচ্ছে। দেয়াল থেকে এক বৃদ্ধার ছায়া বেরিয়ে এলো—বিবর্ণ চোখ, দীর্ঘ চুল, পুতুলের মতো কাঠের শরীর। সে কোনো মানুষ নয়, রামানন্দ পালের তৈরি সেই চূড়ান্ত আত্মার পুতুল, যাকে বলা হয় ‘পুতুলতান্ত্রী’। তার কণ্ঠ ছিল ভারী, অথচ কাঠের ঘষাঘষির মতো। “যারা সত্য জানে না, তারা এই পথ পাড়ি দিতে পারে না,” সে বলল। “এই ধন বিশ্বাসের, এই ধন শিল্পের, এই ধন আত্মত্যাগের—তোমরা কী সেই মূল্য দেবে?”

মিহির সাহস করে সামনে এগিয়ে এসে বলল, “আমরা কোনো লোভে আসিনি। আমরা শুধু জানতে চাই সত্যি কী লুকিয়ে আছে এখানে, আর কেন এই পুতুলবাড়ি এত বছর ধরে অভিশপ্ত?” পুতুলতান্ত্রী কিছুক্ষণ চুপ থেকে যেন অতীতের ঘরে ফিরে গেল। হঠাৎ দেয়ালের এক পাশ উন্মুক্ত হল, আর বেরিয়ে এলো এক অদ্ভুত কাচঘেরা পুতুল, যার পেটে সোনালি রোলে লেখা ইতিহাস। সেটা ছিল এক রাজপুত্রের চিঠি—যেখানে লেখা ছিল, কীভাবে বিপ্লবের সময় রামানন্দ পাল রাজপরিবারের ধনসম্পদ নিজের পুতুলে লুকিয়ে বিদেশি শাসকদের হাত থেকে বাঁচান, এবং কীভাবে তাঁর শিল্পকর্মেই মিশে থাকে দেশের স্বাধীনতার বীজ। কিন্তু সেই বিশ্বাসভঙ্গ করেছিল এক চেলারা, যারা ধন আত্মসাৎ করতে চেয়েছিল। তাদের পাপেই অভিশপ্ত হয় পুতুলবাড়ি। রাধা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “তাহলে এই বাড়ির রক্ষক তুমি?” পুতুলতান্ত্রী বলল, “না, আমি শুধু এক শিল্পীর সৃষ্টি—যার মধ্যে সত্যের রক্ষাকবচ আছে। তবে যাদের হৃদয় সৎ, তাদের পথ আমি খুলে দিই।”

আলো বদলে গেল ঘরের ভেতর। পুতুলদের চোখ যেন নরম হয়ে এল, কাঠের মুখগুলো হাসল। একটা লুকানো দরজা খুলে গেল, আর ভিতরে দেখা গেল ছোট্ট একটা কক্ষ, যেখানে রাখা ছিল বহু পুরনো কাগজপত্র, স্বর্ণমুদ্রা আর নিখুঁতভাবে সাজানো কিছু পুতুল, যাদের পেটের ভেতরেই গুপ্তধনের চিহ্ন। কিন্তু সবচেয়ে মূল্যবান ছিল একটি ছাপানো চিঠি—রামানন্দ পালের নিজহস্তে লেখা, যেখানে তিনি লিখেছেন, “এই ধন কেবলমাত্র সেই সন্তানেরাই পাবে, যারা কৃষ্ণনগরের পুতুলশিল্পকে ভালোবাসে, লোভ নয়, ভালবাসার চোখে দেখে।” পুতুলতান্ত্রী মিলিয়ে গেল দেয়ালের ছায়ায়। রাধা ও মিহির বুঝতে পারল, এই গুপ্তধন শুধু সোনা-দানা নয়, এটা এক ঐতিহ্যের, এক আত্মত্যাগের, এক ইতিহাসের উত্তরাধিকার—যার মানে তারা এখন বুঝতে শুরু করেছে। এবং এই উত্তরাধিকার এখন তাদের হাতে।

[৭]

পুতুলবাড়ির গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে নেমে আসার পর মিহির ও রাধা যেন এক অন্য জগতে প্রবেশ করেছিল। নিচে একটা বিশাল ফাঁকা জায়গা, যার চারপাশে ছড়ানো অসংখ্য পুতুল, দেয়ালের গায়ে গায়ে টাঙানো রহস্যময় ছবি, কিছু পুরনো রাজবংশীয় প্রতীকচিহ্ন আর একটি উঁচু বেদি, যেখানে বসানো ছিল একটি পিতলের পুতুল—দু’চোখে যেন অন্ধকারে জ্বলছিল আলো। হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে, সেই পুতুলের মুখ থেকে এক গম্ভীর শব্দ বেরিয়ে এলো, যেন বহু যুগ ধরে জমে থাকা আত্মার কান্না—“প্রবেশ করেছে কে? উত্তর দাও…” মিহির আতঙ্কে গলা শুকিয়ে এলেও রাধা শক্তভাবে বলল, “আমরা উত্তরাধিকার খুঁজতে এসেছি, আমরা কোনো লোভে আসিনি।” সেই মুহূর্তে পুতুলের চোখ থেকে এক রশ্মি বেরিয়ে পড়ে, আর চারপাশ আলোকিত হয়ে যায়—একটি জীবন্ত চিত্রের মতো দৃশ্য ভেসে ওঠে বাতাসে, যেখানে দেখা যায় রামানন্দ পাল রাজবংশীয়দের কাছ থেকে ধন গ্রহণ করছেন, আর প্রতিজ্ঞা করছেন, “এই ধন থাকবে পুতুলের আশ্রয়ে, যতদিন না প্রকৃত উত্তরাধিকারী আসে।” রাধা ও মিহির সেই দৃশ্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে যেন সময়ের গর্ভে হারিয়ে যায়, অতীত আর বর্তমানের সীমারেখা ঘুলিয়ে যেতে থাকে।

তারা বুঝতে পারে, এই ধন কেবলমাত্র টাকার পরিমাণ নয়, এটি এক শিল্পের, এক সংস্কৃতির, এক অদৃশ্য দায়বদ্ধতার বহিঃপ্রকাশ। হঠাৎ সেই পুতুলগুলোর মধ্যে থেকে একটার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাসের মতো আওয়াজ, আর তারপর এক ছায়ামূর্তি দৃশ্যমান হল। সেই ছায়া রামানন্দ পালের রূপে আবির্ভূত হয়ে বলল, “আমি বহুদিন ধরে অপেক্ষায় ছিলাম—কে আসবে, কার হৃদয়ে থাকবে লোভের বাইরে কিছু… তোমরা যদি সত্যি বুঝতে পারো শিল্পের মূল্য, তবে ধন তোমাদের কাছে ধরা দেবে।” সেই সময় সুড়ঙ্গের ভিতর আরেকটা শব্দ—এবার প্রবেশ করেছে অজয় মুখার্জি, তার লোকজন নিয়ে। সে সোজা এগিয়ে আসে সেই বেদির দিকে, আর চিৎকার করে বলে, “এই সব ভাঁওতা আমি মানি না—চাবি দাও, ধন দাও, নয়তো এই ঘর আমি ধ্বংস করে দেব!” তার হাতে এক যন্ত্র, যা দিয়ে সে দেয়াল ফাটাতে চাইছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে ছায়ামূর্তি তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে, এবং এক গর্জনের সঙ্গে পুরো কক্ষে এক ঝড়ের মতো বাতাস বইতে শুরু করে। অজয়ের লোকজন ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়, অজয় নিজে মাটিতে পড়ে কাঁপতে থাকে। ছায়া বলে, “যে লোভ করে, সে কিছু পায় না… যে রক্ষা করে, তাকেই পাওয়া যায় উত্তরাধিকার।”

শেষমেশ মিহির আর রাধা একসাথে এগিয়ে আসে বেদির দিকে। পিতলের সেই পুতুল একবার নড়ে ওঠে, আর তারপর তার বুকের ভিতরে খুলে যায় এক ছোট্ট গোপন দরজা। তার ভিতরে রাখা ছিল এক পুরনো তালার চাবি, যার সাথে জড়ানো ছিল রাজবংশীয় সোনার সিলমোহর। রামানন্দের আত্মা তখন শান্ত কণ্ঠে বলে, “এটি এখন তোমাদের হাতে, কিন্তু মনে রেখো, এই ধন এক দায়িত্ব—এক শহরের, এক শিল্পের, এক অতীতের সম্মান রক্ষার দায়িত্ব।” সেই মুহূর্তে আলো নিভে আসে, ছায়া মিলিয়ে যায় ধীরে ধীরে, আর চারপাশ আবার নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। পুতুলবাড়ির নিচে, মাটির তলায় দাঁড়িয়ে দুই কিশোর যেন বুঝে যায়—তারা কেবল এক গুপ্তধনের সন্ধান পায়নি, তারা পায় এক উত্তরাধিকারের দায়িত্ব, যা কালের ধুলো মুছে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করবে কৃষ্ণনগরের গৌরবময় অতীতকে।

[৮]

ভেতরের ঘরটি ধীরে ধীরে আলোকিত হচ্ছিল এক অদ্ভুত নীলাভ আলোয়, যেন সময় থমকে গেছে। মিহির আর রাধা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল—তাদের সামনে বিশাল এক কাচের কেসে সারি সারি পুতুল রাখা, প্রত্যেকটির মুখে যেন জীবন্ত অভিব্যক্তি। হঠাৎ, ঘরের এক কোণ থেকে ভেসে এল এক ঘন গম্ভীর কণ্ঠস্বর—”তোমরা কেন এসেছো এখানে?” মিহির কাঁপা গলায় জবাব দিল, “আমরা সত্য জানতে চাই। পুতুলবাড়ির রহস্যটা কী? রামানন্দ পাল কী সত্যিই গুপ্তধন লুকিয়েছিলেন?” আলোটা আরও স্পষ্ট হতে শুরু করল, আর এক অবয়ব সামনে এসে দাঁড়াল—এক বয়স্ক মানুষ, মুখজুড়ে দাড়ি, চোখদুটি যেন হাজার বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে ঝলসে উঠছে। তিনি বললেন, “আমি রামানন্দ নই। আমি তার রক্ষক—পুতুলতান্ত্রী। আমার অভিশাপ রক্ষা করছে এই ধন, কারণ এক বিশ্বাসঘাতকতার মূল্য এখনও পরিশোধ হয়নি।” রাধা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। সেই আত্মা জানাল, এক সময় এক রাজপুত্র তাকে গুপ্তধন রক্ষার দায়িত্ব দিয়েছিল, কিন্তু শিল্পীর এক শিষ্য লোভে পড়ে বিশ্বাসঘাতকতা করে ধনের খোঁজ দিয়েছিল ব্রিটিশদের। তখনই শিল্পী পুতুলের ভিতরে ধন লুকিয়ে, নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে এক অভিশাপ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন—যে-ই ধন নিজের স্বার্থে নিতে চাইবে, ধ্বংস অনিবার্য।

মিহির ধীরে ধীরে বলে উঠল, “আমরা শুধু জানতে চাই এই ইতিহাস—ধন আমাদের চাই না। এটা কৃষ্ণনগরের, মানুষের শিল্পের স্মারক।” পুতুলতান্ত্রীর চোখে এক মৃদু প্রশান্তি দেখা দিল। তিনি বললেন, “তোমরা যদি সত্যিই সত্য চাও, তাহলে আমাকে বিশ্বাস করতে হবে। ধন যেখানে লুকানো, সেখানে যেতে হলে তোমাদের তিনটি পরীক্ষা দিতে হবে—সাহস, মায়া এবং আত্মত্যাগের।” প্রথম পরীক্ষা শুরু হল—এক অন্ধকার ঘরে, যেখানে অসংখ্য পুতুলের মধ্যে থেকে সত্যিকারের ‘কান্নার পুতুল’ খুঁজে বের করতে হবে। তাদের ঘিরে এক বিভ্রম সৃষ্টি হতে লাগল—মৃত শিশুদের কান্না, ছায়ার নাচ, ঘড়ির উল্টোপথে ঘোরা—রাধা ভয় পেলেও মিহির পুতুলগুলোর চোখ লক্ষ্য করে বুঝল কোন পুতুল কাঁদছে সত্যিই। দ্বিতীয় পরীক্ষায়, তাদের দেখা গেল ভবিষ্যতের এক বিভীষিকাময় কৃষ্ণনগর—সব কিছু বিক্রি হয়ে গেছে, শিল্প নেই, ইতিহাস নেই। পুতুল শুধু ডিজিটাল ফর্মে বেঁচে আছে। রাধা কান্নায় ভেঙে পড়ে, কিন্তু মিহির তার হাত ধরে বলে—”এই ভবিষ্যৎ বদলানো আমাদের হাতে।” তারা এই বিভ্রম ভেঙে বেরিয়ে আসে।

শেষ পরীক্ষায়, তাদের একটাই প্রশ্ন করা হয়—”তোমরা কি জীবন দিয়ে হলেও এই শিল্প রক্ষা করবে?” মিহির নিঃসংকোচে বলে, “হ্যাঁ।” তখনই পুতুলতান্ত্রী সামনে এগিয়ে এসে বলে, “তবে আমি তোমাদের উত্তরাধিকার হস্তান্তর করছি। ধন, যা কেবল সোনা নয়—রয়েছে প্রাচীন পুতুল, হাতে লেখা চিত্রপট, রাজপুত্রের চিঠি—সবই তোমাদের হাতে তুলে দিলাম। এটিই কৃষ্ণনগরের ভবিষ্যৎ। কিন্তু সাবধান—এই ধনের রক্ষাকর্তা তোমরা, মালিক নও।” আলো নিভে যেতে যেতে পুতুলতান্ত্রীর অবয়ব মিলিয়ে যায়, আর তাদের হাতে আসে এক কাঠের ছোট পুতুল—যার ভিতরে রয়েছে সেই মানচিত্র, সত্য, ইতিহাস আর এক নতুন যাত্রার দরজা।

[৯]

রাত গভীর। কৃষ্ণনগরের পুতুলবাড়ি তখন নিঃশব্দ অন্ধকারে নিমজ্জিত। মিহির ও রাধা সেই অন্ধকারেই ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে পেছনের গোপন সিঁড়ি ধরে নিচে, মাটির তলা ঘরে যেখানে শেষ সংকেত নিয়ে অপেক্ষা করছে বহু পুরনো এক সত্য। সিঁড়ির শেষ প্রান্তে এসে তারা দেখে একটি গোল ঘর, যার মেঝেতে ছড়ানো অসংখ্য পুতুল—কেউ মাথা ঘুরিয়ে বসে আছে, কেউ ঠোঁটে হাসি নিয়ে তাকিয়ে, আবার কেউ বা অদ্ভুত ভাবে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। ঘরের কেন্দ্রে একটি পুতুল চৌকি, তার ওপর বসে আছে একটি বড়ো পুতুল—এক রাজার আদলে তৈরি, যার চোখ যেন জীবন্ত। হঠাৎই ঘরজুড়ে একটা শীতল বাতাস বইতে শুরু করল, আর সব পুতুল একে একে নিজেদের জায়গা ছেড়ে নড়তে শুরু করল—কোনোটা মাথা ঘুরিয়ে, কোনোটা হাত তোলে, আর কোনোটা পায়ে নাচে। মিহির প্রথমে ভেবেছিল এটা হয়তো যান্ত্রিক, কিন্তু না—পুতুলগুলো চলেছে এমন এক ছন্দে, যা কল্পনাতীত। ঘরের এক কোণ থেকে ভেসে এল বাঁশির সুর, নিঃশব্দের ভেতর ছড়িয়ে পড়ল ছায়ার নাচ—প্রতিটি পুতুল যেন কারও আদেশে চলছে। রাধা মিহিরের হাত চেপে ধরে বলল, “এরা তো… বেঁচে আছে!” মিহির চোখ বড়ো করে দেখল—একটি পুতুল তাদের দিকে এগিয়ে এল, আর তার ঠোঁট নড়ে উঠল—“তোমরা কি উত্তর এনেছো?” সেই স্বর ছিল এক বৃদ্ধ নারীর, যেন বহু বছর আগের নিঃশেষিত কণ্ঠ।

রাধা তার ব্যাগ থেকে বের করল সেই কাঠের পুতুলটি, যার পেটে ছিল সেই ধাতব চাবি ও শেষ সংকেতটি। মুহূর্তেই, ঘরের আলো বদলে গেল—প্রতিটি পুতুল মাথা নত করল, যেন সম্মান জানাচ্ছে এক সত্তাকে। হঠাৎ রাজপুতুলটির বুকে খুলে গেল একটি ছোট দরজা, আর তার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটি নীল রঙের দৃষ্টি-রশ্মি। সেই রশ্মি ঘরের এক দেওয়ালে গিয়ে পড়তেই সেখানে ফুটে উঠল এক দৃশ্য—রামানন্দ পাল এক ছোট শিশুকে শেখাচ্ছেন পুতুল তৈরির আদব-কায়দা, একথা বলতে বলতে, “এই পুতুলেরা শুধু কাঠ নয়, এরা ইতিহাস, অনুভব, রক্ষা এবং বিচার।” এরপর দৃশ্য মিলিয়ে যায়, আর পুতুলরাজ বললেন, “তোমরাই উত্তরাধিকারী। কিন্তু এখনও এক পরীক্ষা বাকি।” হঠাৎ ঘর কাঁপতে শুরু করল, দেয়ালের ওপাশ থেকে চিৎকার করে উঠল এক পুরুষ কণ্ঠ—“তাদের থামাও! গুপ্তধন আমার হবে!” সেই কণ্ঠ ছিল অজয় মুখার্জির, যে পেছনের আরেকটি সুড়ঙ্গ দিয়ে নিচে নেমে এসেছে তার কিছু লোক নিয়ে। পুতুলরাজ বললেন, “আমাদের রাজ্য রক্ষা করো। সত্য ও লোভের লড়াই শুরু হল।”

মিহির আর রাধা তখন প্রস্তুত, তারা জানত পুতুলবাড়ির রহস্য শুধু ইতিহাসের নয়, ভবিষ্যতেরও রক্ষাকবচ। পুতুলরা একে একে জীবন্ত রূপে যুদ্ধ শুরু করল—কেউ লাঠি নাড়াচ্ছে, কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ছে লোভী মানুষদের দিকে। অজয় মুখার্জি ও তার লোকেরা ভয় পেয়ে পালাতে চাইলেও সেখান থেকে বেরনোর পথ বন্ধ হয়ে গেল পুতুলদের দ্বারা। রাধা বলল, “এই ধন শুধু কৃষ্ণনগরের, এক শিল্পের আত্মার প্রতীক। একে গিলে ফেললে আমরা নিজেদের হারাব।” মিহির সে কথায় সায় দিয়ে এগিয়ে যায় রাজপুতুলের দিকে, তার হাত ছুঁয়ে দেয় বুকে। আর সেই মুহূর্তেই চৌকির নিচে খুলে যায় এক সিন্দুক—তাতে রাজকীয় অলংকার, স্বর্ণমুদ্রা, প্রাচীন নথি আর একটি ছোট কাঁচের ঘড়ির মধ্যে বন্দি একটি অদ্ভুত আলো। পুতুলরাজ বললেন, “এই আলোই ‘আত্মা’, পুতুলশিল্পের প্রাণ। একে রক্ষা করাই তোমাদের শেষ দায়িত্ব।” ঘরের আলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। পুতুলরা আবার স্থির হয়ে দাঁড়ায়। বাইরে তখন ভোরের আলো উঠেছে—নতুন সূর্য কৃষ্ণনগরের আকাশে। মিহির ও রাধা জানত, শেষ পদক্ষেপটা এখনও বাকি, কিন্তু পুতুলবাড়ির ছায়ার নাচ আজ তাদের নতুন করে শিখিয়ে দিল সাহস, বিশ্বাস আর উত্তরাধিকারের মূল্য।

[১০]

অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে পুতুলবাড়ির চারপাশ যেন আরেকবার জীবন্ত হয়ে উঠল। মিহির ও রাধা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সেই মাটির তলদেশে, যেখানে একসময় রাজপরিবারের গুপ্তধন লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। বিশ্বেশ্বর পাল ও প্রদীপবাবু আগেই জানিয়েছিলেন, শেষ ধাঁধাটি শুধু বুদ্ধির নয়, মনুষ্যত্বের পরীক্ষাও। তাদের সামনে উপস্থিত হয়েছিল একটি বৃহৎ কাচঘেরা ঘর, ভেতরে শোভিত শতাধিক পুরনো পুতুল—সব পুতুল যেন কোনো এক অদৃশ্য নির্দেশে তাকিয়ে রয়েছে সামনে রাখা একটি কাঠের কফিনের দিকে। সেই কফিন খুলতেই ভেসে উঠল একটি আলোকময় চক্র, যার ভিতরে বসে ছিল একটি পুতুলতুল্য মানবাকৃতি—রামানন্দ পালের আত্মার প্রতিচ্ছবি, যিনি শান্ত কণ্ঠে বললেন, “যদি তোমরা এই ধন পাওয়ার যোগ্য হও, তবে তোমাদের শেষ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে—‘ঐতিহ্য রক্ষা করে কাদের জন্য?’” মিহির এক মুহূর্ত দেরি না করে উত্তর দিল, “জনগণের জন্য। কৃষ্ণনগরের শিল্প ও তার ভবিষ্যতের জন্য।” মুহূর্তেই কাচ ভেঙে পড়ল না, ধনভাণ্ডারের দরজা খুলে গেল। অথচ কোনো সোনা বা রত্ন নয়, ভেতরে ছিল শত শত অপূর্ব শিল্পকর্ম, পুতুল, কাঠের ভাস্কর্য, ও পুরাতন রাজপত্র—যা এক বিশাল ঐতিহাসিক সম্ভার হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। সেই মুহূর্তে রাধা বুঝতে পারল, এ শুধু ধন নয়, এ কৃষ্ণনগরের গর্ব, যার উত্তরাধিকার এখন মিহিরদের হাতে।

সেই খবর ছড়িয়ে পড়ল কৃষ্ণনগরের কোণে কোণে। সংবাদপত্রে বেরোল, “পুতুলবাড়ির ইতিহাস জাগিয়ে তুলল দুই কিশোর!” অজয় মুখার্জির মুখ পুড়ে গেল জনসমক্ষে, কারণ তার ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। সরকার সিদ্ধান্ত নিল, পুতুলবাড়িকে ঐতিহ্যবাহী জাদুঘরে রূপান্তর করবে, যেখানে রামানন্দ পালের কাজ সংরক্ষিত থাকবে, আর সেই ভবনের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হবে বিশ্বেশ্বর পাল ও প্রদীপবাবুকে। কিন্তু সবচেয়ে বড় চমক ছিল, সেই জাদুঘরের ‘কিউরেটর’ হিসেবে নিযুক্ত হলো মাত্র ষোল বছরের মিহির পাল। তার প্রথম কাজ ছিল, রাধাকে সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করা এবং পুতুল শিল্পের ইতিহাস নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা। মিহির ও রাধা জানত, আজ তারা যে গর্বের অংশ হতে পেরেছে, তার পেছনে আছে অতীতের রক্ত, শ্রম, বিশ্বাসঘাতকতা ও আত্মত্যাগের গল্প। রাত্রে মিহির যখন একা পুতুলবাড়িতে বসে লেখালিখি করে, তখন কখনো কখনো পায় সেই পুরনো সুরেলা হাসি, যেটা বোধহয় রামানন্দ পালের।

শেষে, এক বছর পরে কৃষ্ণনগরে হয় এক বিশাল পুতুলমেলা, যেখানে দেশ-বিদেশ থেকে আগত শিল্পীরা মিহির ও রাধার হাতে পুরস্কার গ্রহণ করেন। সেইদিন রাতে মেলা শেষ হওয়ার পর, মিহির একবার ফিরে যায় সেই মাটির ঘরে, পুতুলতান্ত্রীর কক্ষে। সেখানে একটি নতুন পুতুল দেখা যায়—ছোট, হাসিমুখের, হাতে কলম ধরা। পুতুলটির নিচে লেখা, “নব উত্তরাধিকারী।” মিহির হাসে, চোখ ভিজে আসে। পেছন থেকে রাধা বলে, “এই তো শুরু, গল্প তো এখনও শেষ হয়নি।” তখন মিহির জানে, ইতিহাস কখনো একা পড়ে থাকে না, যাদের হৃদয়ে সাহস, তাদের হাত ধরেই সে এগিয়ে চলে। পুতুলবাড়ির রহস্য সমাধান হলেও, কৃষ্ণনগরের শিল্প, তার ঐতিহ্য, আর তার গর্বের গল্প এখন শুধু অতীতে নয়—ভবিষ্যতেও বাঁচবে।

সমাপ্ত

1000045657.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *