চিরন্তন ঘোষাল
অধ্যায় ১: বীণারম্ভার শেষ স্বর
সকালটা ছিল অদ্ভুতভাবে নিস্তব্ধ, যেন আকাশও গানের কোনো কষ্টসুর বয়ে আনছে। সংগীত বিদ্যালয় ‘শ্রুতি নিকেতন’-এর লালটিপ দেওয়া পুরনো দোতলা ভবনটিকে ঘিরে ভোরের আলো একটু একটু করে পড়ছিল, কিন্তু আজ যেন কিছু একটা ঠিক নেই—হোস্টেল রান্নাঘরের ধোঁয়া উঠছে না, পাখিরা চুপচাপ বসে আছে তুলসিতলায়, আর সবচেয়ে অদ্ভুত, মন্দির ঘর থেকে কোনো রাগ বাজছে না। সকাল সাতটা নাগাদ, ছাত্রীরা একে একে উঠতে শুরু করে। বীণারম্ভা আজও উঠেনি—তাতে কেউ প্রথমে অবাক হয়নি, কারণ সে মাঝেমাঝে গভীর রাত পর্যন্ত রেওয়াজ করত। তবে যখন তিষাণী দরজা ধাক্কায়, কোনো সাড়া না পেয়ে জানালার কাচে উঁকি দেয়, তখন সে চেঁচিয়ে ওঠে। দরজার ভেতরটা অস্পষ্ট, কিন্তু তার চোখ আটকে যায় একটায়—তানপুরার পাশেই, চেয়ারের পাশে পড়ে আছে বীণারম্ভার নিথর দেহ, মাথার চারপাশে ছড়িয়ে আছে সাদাটে গামছায় লেগে থাকা লাল কিছু একটা, সম্ভবত রক্ত।
ঘর ভেঙে ভেতরে ঢোকার পর সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। মেয়েটির চোখ খোলা, তবু শূন্য। এক হাতে এখনো তানপুরার পেটি ধরে আছে, আরেক হাত ঝুলে আছে খাট থেকে। পাশে তার খাতা—‘মনসুর নোটবুক’—যেখানে সে সব সময় তার সুর ও রাগের নোট রাখত, খোলাই পড়ে আছে। খাতার শেষ পাতায় আঁকা ছিল আধা-লেখা এক নতুন রাগের স্কেচ: ‘রাগ মার্গিণী’। অথচ এমন কোনো রাগের নাম কেউ শোনেনি আগে। দেওয়ালে ঝুলে থাকা একটি ছোট্ট ঘড়ির কাঁটা দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক ৩:১০-এ। খাটের চাদরে ছিল রক্তের ছাপ, মাথার পেছনে আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট, আর তার গলায় গলার হারটি ছিল না—যেটা সে সবসময় পরত। আশ্চর্যের বিষয়, ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল, তাই প্রথমে আত্মহত্যার দিকেই সবাই ঝুঁকে পড়ে। তবু, বীণারম্ভার মুখে একটা বিস্ময়ের রেখা ছিল—যা আত্মহত্যার সঙ্গে মেলে না।
স্থানীয় থানায় খবর গেলে, নতুন এসেই পোস্টেড হওয়া ইন্সপেক্টর ভৈরবেশ ঘটনাস্থলে পৌঁছান। তিনি সংগীত বোঝেন না, ক্লাসিকাল সুর তার কাছে আবছা শব্দমাত্র, কিন্তু কেসটি যেন নিজেই তাকে টানতে শুরু করে। পুরো ঘর ঘুরে তিনি লক্ষ্য করেন, জানালার কাচে একটা আঙুলের ছাপ, যা ভেতর থেকে বাইরের দিকে টানা হয়েছে। খাটের পাশের টেবিলটিতে রাখা ছিল একটা ছোট রেকর্ডিং ডিভাইস, যেটা সম্ভবত মেয়েটি রাতের রেওয়াজ রেকর্ড করতে ব্যবহার করত। তিনি সেটি ব্যাগে তুলে নেন, আর খাতাটিও আলাদা করে রেখে দেন প্রমাণ হিসেবে। ভৈরবেশ লক্ষ্য করেন, এক কোণে রাখা রাগমালিকা বইটি ছেঁড়া—তাতে তিনটি পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। একজন সাধারণ পুলিশ অফিসার এসব হয়তো গুরুত্ব দিত না, কিন্তু ভৈরবেশের চোখ তীক্ষ্ণ, আর হৃদয়ে কিছুটা কৌতূহল—এই মেয়েটি কেন মাঝরাতে রেওয়াজ করতে গিয়ে মারা গেল? যদি আত্মহত্যা, তবে রেকর্ড কেন চালু ছিল না? আর যদি খুন হয়—তবে বাইরে থেকে কেউ কীভাবে ঢুকল?
কিছুটা সময় পর, হোস্টেলের অন্যান্য ছাত্রীরা জড়ো হয়। তিষাণী চুপ করে থাকে—তার চোখে কান্না নেই, বরং হতভম্বতা। তার মুখে কিছু প্রশ্ন, যেগুলি উচ্চারণের ভাষা খুঁজে পায় না। মালহারী দেবী, সংগীত বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রাক্তন ধ্রুপদশিল্পী, সেখানে উপস্থিত হয়ে শুধু বলেন, “ওর কণ্ঠে ছিল আগুন, কিন্তু আগুন যারা বুকে রাখে, তারা একদিন পুড়ে যায়।” এই রহস্যময় মন্তব্য যেন আরো বিভ্রান্ত করে সবাইকে। তদন্ত শুরু হলেও বীণারম্ভার মৃত্যুর সুর তখনো অস্পষ্ট। কে জানে—এই সংগীত বিদ্যালয়ের অতলে কোথাও লুকিয়ে আছে এমন এক ভয়ানক সুর, যা শুধু কানের মধ্য দিয়ে নয়, হৃদয়ের গভীরতম গলিঘুপচি দিয়ে চুঁইয়ে পড়ে এবং কাউকে নিঃশব্দে ধ্বংস করে দেয়। এই শুরু, একটি মৃত মেয়ের না-গাওয়া রাগের, যার প্রতিটি সুরে হয়তো লুকিয়ে আছে রক্তমাখা এক হত্যার গল্প।
অধ্যায় ২: রূদ্রভির নীরব ঘর
ইন্সপেক্টর ভৈরবেশ পরদিন সকালেই রূদ্রভির সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেন। ‘শ্রুতি নিকেতন’-এর সবচেয়ে সম্মানিত, তেমনি সবচেয়ে রহস্যজনক মানুষ এই রূদ্রভি—যার গলায় একধরনের অদ্ভুত আবেশ আছে। তার বয়স পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি, মুখে গম্ভীরতা, চোখে সারাক্ষণ একধরনের চিন্তার রেখা। তার সঙ্গে দেখা হলে ভৈরবেশ প্রথমে নিজেকে কিছুটা এলোমেলোই মনে করেন—সংগীতের সঙ্গে তার কোনো সখ্যতা নেই, আর এই মানুষটি যেন কোনো স্বতন্ত্র জগতের বাসিন্দা। রূদ্রভির ঘরে ঢুকতেই কপালে একটা ধাক্কা খান তিনি—ঘরের চারদিক জুড়ে পুরনো পুঁথি, তানপুরা, সরোদ, বীণা—আর এক পাশে একটা কাচঘেরা আলমারিতে সাজানো পুরস্কার, যার মধ্যে একটি জাতীয় পুরস্কারও রয়েছে। কিন্তু ঘরের সবচেয়ে অদ্ভুত জিনিসটি ছিল একটি বাঁধানো পাতলা সাদা খাতা, যার গায়ে লেখা—“রাগ মার্গিণী: অব্যক্ত এক সৃষ্টি।” ইন্সপেক্টর এক ঝলকে চিনে ফেলেন—এই নামটাই ছিল বীণারম্ভার খাতার শেষ পাতায়।
ভৈরবেশ জিজ্ঞেস করেন, “আপনি এই রাগ মার্গিণীর কথা জানেন?” রূদ্রভি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, “এই রাগ আমার তৈরি… বীণারম্ভা চাইছিল ওটা গাইতে শিখতে… কিন্তু ওর কণ্ঠে তখনো পর্যাপ্ত পরিণতি আসেনি।” এই কথা বলার সময় তার গলায় স্পষ্ট একটা বিরক্তি। ভৈরবেশ কৌতূহলী হয়ে জানতে চান, “আপনি কখন শেষবার বীণারম্ভার সঙ্গে একান্তে কথা বলেছিলেন?” রূদ্রভি চোখ সরিয়ে তাকিয়ে বলেন, “তিনদিন আগে… আমি তাকে বলেছিলাম কিছুদিন রেওয়াজ বন্ধ রাখতে, মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছিল।” এই উত্তর শুনে ভৈরবেশের মনে প্রশ্ন ওঠে—এক শিক্ষক কেন একজন প্রতিভাবান ছাত্রীর রেওয়াজ বন্ধ রাখতে বলেন? আর তার মানসিক অবস্থা নিয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার অধিকারই বা কীভাবে আসে?
ঘরের এক কোণায় রাখা ছোট্ট তক্তার পাশে একটা অদ্ভুত কাচের পাত্র দেখা যায়, যার ভেতরে গোলাকার সাদা কাগজে সুরের নিদর্শন আঁকা—আধুনিক কাগজ নয়, অনেকটা হাতে তৈরি প্যাপিরাসের মতো। ভৈরবেশ খেয়াল করেন, কাগজগুলোর একটির মধ্যে একছত্র লেখা—“যদি কণ্ঠ না মানে সুরের আদেশ, তবে তাকে থামিয়ে দাও।” এই লাইন দেখে তার মেরুদণ্ডে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায়। তিনি অনুমান করতে পারেন, এই শিক্ষক হয়তো সংগীতের আড়ালে নিজের এক ধরনের মানসিক দমনব্যবস্থা তৈরি করেছেন, যার শিকার হতে পারে কেউ কেউ। আর সেই কেউ কি বীণারম্ভা ছিল?
রূদ্রভির ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় ভৈরবেশ ভাবেন, এই মানুষটি কিছু লুকাচ্ছে—তার চোখে ছিল এক মুহূর্তের আতঙ্ক, ঠিক সেই সময় যখন তিনি বীণারম্ভার মৃত্যুর সময় জানতে চাইলেন। তার মুখে সংযত ভাষা থাকলেও, চোখ তার কথা মেনে নেয় না। এই সংগীত বিদ্যালয়ে কোনো এক গভীর, ছায়াময় সুর বাজছে—যা শ্রোতা নয়, বন্দি তৈরি করে। বীণারম্ভার খুন যদি সত্যিই হয়, তবে এই ‘রাগ মার্গিণী’ শুধু এক অচেনা সুর নয়—এ এক ভয়াবহ অস্ত্র, যা কেউ ব্যবহার করেছে খুব সুচারুভাবে, যেন খুন নয়, বরং ‘শিক্ষার একটি চূড়ান্ত পরিণতি’। তদন্তের প্রথম সুর ধরা পড়েছে—এবার সেই সুরের গহীনে নেমে দেখা দরকার, কতখানি বিষ লুকিয়ে আছে সেই রাগে।
অধ্যায় ৩: তিষাণীর টক স্বর
তিষাণী আজকাল একেবারেই চুপচাপ। যে মেয়েটি আগে প্রতিটি সকালে রাগ ভৈরবী গাইতে গাইতে গোটা হোস্টেল জাগিয়ে তুলত, সেই মেয়েটি এখন নিজের খাটে চুপ করে বসে থাকে, নখ কামড়ায়, আর মাঝে মাঝে আয়নায় নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে কিছু বলে—যার মানে কেউ বোঝে না। ইন্সপেক্টর ভৈরবেশ তার সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু তিষাণী প্রথমে কিছুই বলতে চায় না। পরে, এক গভীর নিশ্বাস ফেলে সে বলে, “বীণারম্ভা ছিল খুব ভালো… খুবই ভালো… এত ভালো, যে কারো ভেতরের কুৎসিত প্রতিযোগিতা জেগে উঠতে বাধ্য।” তার কণ্ঠে ছিল বিষণ্ণতা, তবুও কোথাও একটা চাপা রাগও যেন লুকিয়ে ছিল। সে আরও বলে, “রাগ তো আমাদের শেখায় সম, অনুসম আর বক্রতা… কিন্তু সংগীতের ভেতরও যদি রাজনীতি ঢুকে পড়ে, তাহলে সে সুর আর সুর থাকে না।” তার কথাগুলোর ভেতরে যেন এক অতৃপ্ততার সুর—যেটা কেবল একজন প্রতিযোগী হৃদয়েই জন্মাতে পারে।
ভৈরবেশ বুঝতে পারেন, তিষাণী শুধু বন্ধু ছিল না—সে ছিল প্রতিদ্বন্দ্বীও। তারা দুজনই বর্ষশেষ প্রতিযোগিতায় একই রাগে গাইবার কথা ভাবছিল, এবং সেই রাগটি ছিল শিক্ষক রূদ্রভির নিজস্ব রচনা—রাগ মার্গিণী। কিন্তু একদিন হঠাৎ রূদ্রভি ঘোষণা করেন, শুধু বীণারম্ভা গাইবে, কারণ তার কণ্ঠেই আছে সেই রাগের উপযুক্ততা। এই ঘোষণার পরে তিষাণী কেমন যেন বদলে যায়—সে একরকম রেওয়াজ বন্ধ করে দেয়, এমনকি কয়েকদিন ক্লাসেও যায়নি। সে নিজেই বলে, “আমি হয়তো হিংসুটে হয়ে উঠেছিলাম… কিন্তু আমি খুন করিনি!” এই কথাটা বলার পর সে চোখ নিচু করে ফেলে। ভৈরবেশ লক্ষ্য করেন, তার নখের কোণায় লাল দাগ—পুরনো রক্তের মতো, কিন্তু সেটি বীণারম্ভার রক্ত নাকি নিজের ক্ষত, তা বলা কঠিন।
ঘরের এক কোণায় তিষাণীর গানের খাতা পাওয়া যায়—যেখানে লেখা ছিল একটি অসমাপ্ত গানের লাইন: “তুমি যদি গাও, তবে আমি থেমে যাব…” তার নিচে আঁকা ছিল একটি ভাঙা তানপুরার ছবি, যার তার ছেঁড়া। ভৈরবেশ খাতাটি নিয়ে নেন, কারণ সেটি কেবল গান নয়, বরং মানসিক যুদ্ধের একটি দলিল। তিনি লক্ষ্য করেন, বীণারম্ভার মৃত্যুর রাতে তিষাণী রেওয়াজঘরে যায়নি, কিন্তু সেই রাতে তার ঘরের আলো অনেকক্ষণ জ্বলছিল। প্রশ্ন উঠছে—তিষাণী কি কিছু জানে, যেটা সে চেপে যাচ্ছে? নাকি শুধু নিজের অপরাধবোধ থেকে এইভাবে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে?
তদন্ত যত এগোয়, ভৈরবেশ বুঝতে পারেন—এই সংগীত বিদ্যালয়ের প্রতিটি রাগ, প্রতিটি খাতা, প্রতিটি মুখ যেন দুটো করে সুর বয়ে আনছে। একটা সুর যেটা সবাই শুনতে পায়, আর একটা গোপন সুর—যেটা শুধু ভেতরের কান শুনতে পারে। তিষাণীর মুখে যেভাবে রাগ ঝরে পড়ছে, তাতে সেই গোপন সুরের গন্ধ স্পষ্ট—সে হয়তো নিজেই নিজেকে দোষী ভাবছে, অথবা কাউকে আড়াল করছে। কিন্তু সত্যটা এখনও ধরা পড়েনি—সে যেন অদৃশ্য সুরের ভেতরে লুকিয়ে, আর তার খোঁজ করতে গেলে শুধু কান নয়, হৃদয় দিয়েও শুনতে জানতে হয়।
অধ্যায় ৪: গোপন রেকর্ডিং
ইন্সপেক্টর ভৈরবেশ অবশেষে সেই ছোট্ট রেকর্ডিং ডিভাইসটি চালু করেন, যা বীণারম্ভার ঘর থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। ভেতরে মোট তিনটি ফাইল ছিল—দুটো ছিল রেওয়াজের, কিন্তু তৃতীয়টি ছিল কিছুটা ভিন্ন, যার নাম দেওয়া ছিল শুধু একটি তারিখ: “১৭-০৩-২৫”. তিনি হেডফোন কানে দিয়ে শুনতে শুরু করেন, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারেন এটি কোনো সাধারণ রেওয়াজ নয়—এটি ছিল রাত্রি তিনটার সময় রেকর্ড করা একটি ধারাবর্ণনা, যেটা অসম্পূর্ণভাবে শেষ হয়েছিল। শুরুতে শোনা যায় তানপুরার ধ্বনি, পরপর তিনটি স্বরধ্বনি, তারপর কিছুক্ষণ নীরবতা। হঠাৎই ভেসে আসে হালকা শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ, যেন কেউ খুব ধীরে ধীরে হাঁটছে রেওয়াজঘরের ভিতর দিয়ে। তারপর এক নারীকণ্ঠ—চেনা কিন্তু শূন্যতায় ভরা—বলছে, “তুমি বলেছিলে আমি পারব… আমি কি তবে ভুল গাইলাম?”
এরপর শোনা যায় আরেকটি শব্দ, যেন কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার ধ্বনি। এরপর নিঃশব্দ। ঠিক এই মুহূর্তেই ডিভাইসটি কিছুটা ঝাঁকুনি দিয়ে শব্দহীন হয়ে পড়ে, যেন কেউ হঠাৎ বন্ধ করে দিয়েছে সেটিকে। ভৈরবেশ বারবার শুনে বোঝার চেষ্টা করেন কে ছিল দ্বিতীয় ব্যক্তি, কিন্তু কণ্ঠ স্পষ্ট নয়। তিনি রেকর্ডিংটি ফরেনসিক বিভাগে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন, তবে একটি বিষয় তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে—তানপুরার সেই সুরটি, যেটি বীণারম্ভা বাজাচ্ছিল, সেটি ছিল রাগ মার্গিণীর সূচনা সুর, যেটা এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বইয়ে লেখা হয়নি। তবে কী বীণারম্ভা নিজেই এই রাগের গঠন জানত? নাকি কেউ তাকে শিখিয়েছিল, গোপনে?
ভৈরবেশ বিদ্যালয়ের আর্কাইভ ঘরে যান, যেখানে রাখা রয়েছে পুরনো শিক্ষকদের ব্যক্তিগত নোটস, কাগজপত্র ও ছাত্র-ছাত্রীদের পারফরম্যান্স রিপোর্ট। সেখানে তিনি খুঁজে পান একটি পুরনো ডায়েরি—রূদ্রভির নিজের হাতে লেখা। ডায়েরির এক জায়গায় লেখা, “সুর যদি বাধা না মানে, তাকে ভেঙে গড়ো… কিছু স্বর হজম হয় না, তাদের গলা বন্ধ করতেই হয়।” সেই কথাগুলো পড়েই তিনি বোঝেন, রূদ্রভি শুধুই শিক্ষক নন—তিনি এক ধরনের নিয়ন্ত্রণকারী, যিনি সংগীতের নামে মানসিক ও নৈতিক শাসন চালাতেন। ভৈরবেশ যতই এগোন, ততই স্পষ্ট হয়—এই মৃত্যু শুধুই একজন ছাত্রীর অপূর্ণতা নয়, বরং এক আদর্শ ভেঙে পড়ার প্রতিধ্বনি।
ডায়েরির শেষ পাতায় আঁকা ছিল রাগ মার্গিণীর চূড়ান্ত ‘সংগীত-চিত্র’—একটি অনুরণনচক্র, যার প্রতিটি ধাপে নোট চিহ্ন দেওয়া ছিল, এবং মাঝখানে লেখা: “এই রাগ শুধু তারাই গাইবে, যাদের আত্মা নিঃশব্দ হয়ে গেছে।” ভৈরবেশ আবার রেকর্ডিংয়ের কথা ভাবেন—বীণারম্ভার গলায় ভীতি, তার স্বরে কান্না, এবং সেই অদৃশ্য উপস্থিতি—সবই একে একে জুড়ে যেতে থাকে। এ যেন এক সংগীত-হত্যা, যেখানে অস্ত্র ছিল না ছুরি বা বিষ, বরং সুর আর দখলের ভয়। তদন্ত একটি জটিল মোড়ে এসে দাঁড়ায়—সত্যকে এখন আর শুধু জেরা করে পাওয়া যাবে না, তাকে শোনার জন্য নিজের ভেতরের কণ্ঠটাকেও জাগাতে হবে। কারণ এই সংগীত বিদ্যালয়ে কিছু শব্দ কখনো মুখে বলা হয় না—তারা কেবল সুরে ঢুকে, আর রক্তে মিশে যায়।
অধ্যায় ৫: গৌরবিন্দের বিষণ্ণ ছন্দ
গৌরবিন্দ, তবলা বিভাগের তরুণ প্রশিক্ষক, বীণারম্ভার মৃত্যুর পর থেকে আর প্রকাশ্যে বাজাচ্ছেন না। যে ছেলেটি আগে প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা তালিমকক্ষে তার আঙুলের খেলায় শিষ পড়ে যেত, সে এখন নিঃশব্দে ঘুরে বেড়ায়, মাথা নিচু করে, কারও চোখের দিকে না তাকিয়ে। ইন্সপেক্টর ভৈরবেশ এক সন্ধ্যেয় তাকে এক কোণায় দাঁড় করান। “তুমি তার খুব কাছের ছিলে, তাই না?” প্রশ্নের উত্তরে গৌরবিন্দ চোখ মেলে তাকায়, তারপর ধীরে মাথা নেড়ে বলে, “সে শুধু গান গাইত না, সে গান হয়ে যেত… আমি কখন যে তাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম, বুঝতেই পারিনি।” ভৈরবেশ ধীরে ধীরে তার কথার গভীরে নামেন, জানতে চান সে বীণারম্ভার মৃত্যুর রাতে কোথায় ছিল। গৌরবিন্দ একটু থেমে বলে, “আমি পাশের তালিমঘরে রেওয়াজ করছিলাম… হঠাৎ থেমে গেলাম, কারণ একটা অদ্ভুত আওয়াজ পেলাম… যেন কেউ তানপুরায় সজোরে আঘাত করছে।”
সে জানায়, সেই আওয়াজের ঠিক পরেই একটি মৃদু কণ্ঠ চিৎকার করে উঠেছিল, যেন বিস্ময় আর ভয় একসঙ্গে মিশে আছে। তারপর সব নিঃশব্দ। গৌরবিন্দ তখন ভয় পেয়ে গিয়েছিল—ভেবেছিল হয়তো কোনো শিক্ষক রাগ হয়ে গেছেন, কিংবা কোনো ছাত্রীর সঙ্গে বিবাদ হয়েছে। সে দরজার কাছে গিয়ে কান পেতে ছিল, কিন্তু বাইরে আসেনি। “আমি ভয় পেয়েছিলাম, স্যার… ভেবেছিলাম যদি কিছু বলি, হয়তো আমাকেই দোষী বানানো হবে… এখানে শিক্ষক মানেই দেবতা।” তার চোখে তখনও তীব্র অপরাধবোধ। ভৈরবেশ বোঝেন, এই ছেলেটি হয়তো খুনি নয়, কিন্তু সে এমন কিছু শুনেছে, যা ঘটনার সময় গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
ভৈরবেশ তার কাছ থেকে রাত্রির রেওয়াজের খাতা চান। গৌরবিন্দ একপাশে রাখা তার পুরনো তবলা ব্যাগ থেকে বের করেন একটি মোটা নোটবুক—ভেতরে লেখা রয়েছে রাগ মার্গিণীর সঙ্গে তাল মিশিয়ে বীণারম্ভার গাওয়ার ধরন। এক জায়গায় লেখা: “১৭ই মার্চ—তানপুরার সুর থেমে গেল, আমি তাল ভুলে ফেললাম… সে যেন আমাকে ডাকছিল চুপিসারে, কিন্তু গলা পায়নি।” এই লেখাটি স্পষ্টভাবে বোঝায়, সে কিছু অনুভব করেছিল সেই রাতেই, কিন্তু প্রকাশ করতে পারেনি। এরপরের পাতায় একটি স্কেচ—বীণারম্ভার মুখ, চোখ বন্ধ, আর তার তানপুরার তার ছেঁড়া। এই ছবিটি যেন সাক্ষ্য দেয় গৌরবিন্দের ভালোবাসা, তার ব্যর্থতা এবং সেই মুহূর্তের ভয়, যখন সে কিছু শুনেও চুপ করে গিয়েছিল।
তদন্তের পঞ্চম ধাপে ভৈরবেশ বুঝে যান—এই মৃত্যু কেবল মানসিক বা সংগীতগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফসল নয়, বরং এক নীরব দর্শকের ভীরুতা, এক শিক্ষকের অহং, এবং এক প্রতিভার অসহ্য যন্ত্রনার সম্মিলিত কাব্য। গৌরবিন্দ যদি তখন সাহস করে দরজা খুলত, যদি একবার শুধু বলত—“তুমি ঠিক আছ তো?”—তবে হয়তো আজ বীণারম্ভার গান থামত না। কিন্তু সংগীত যেখানে দেবত্ব, সেখানে প্রশ্ন করাও পাপ। আর সেই পাপের শাস্তি হয় শুধু নিরবতায়, রক্তে, আর এক অনন্ত অসমাপ্ত রাগে, যেটার কোনো সামপর্ক নেই সুরের সঙ্গে—তবুও সেটাই সবচেয়ে হৃদয়বিদারক সংগীত হয়ে ওঠে।
অধ্যায় ৬: মালহারীর স্মৃতিসুর
মালহারী দেবী, ‘শ্রুতি নিকেতন’–এর প্রতিষ্ঠাতা, এখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন, কিন্তু তার চোখে এখনও আছে সেই স্থিরতা, যেটা একজন আসল গুণী শিল্পীর আত্মবিশ্বাসে জন্মায়। তিনি আগেকার দিনের বিখ্যাত ধ্রুপদশিল্পী, যিনি গুরু-শিষ্যের সম্পর্ককে জীবনের উপাসনা ভাবতেন, আর সংগীতকে ঈশ্বরতুল্য। ইন্সপেক্টর ভৈরবেশ যখন তার ঘরে প্রবেশ করেন, তখন তিনি ছুঁচ হাতে একটি পুরনো বেনারসি শাড়ির আঁচলে কিছু সূচিকর্ম করছিলেন—লাল সুতোর সূক্ষ্ম সুররেখা দিয়ে আঁকা হচ্ছিল একটি তানপুরা। ভৈরবেশ একপ্রকার কৌতূহল নিয়েই প্রশ্ন করেন, “আপনি কি বীণারম্ভার মৃত্যুর বিষয়ে কিছু বলতে চান?” মালহারী কিছুক্ষণ চুপ থাকেন, তারপর মৃদু কণ্ঠে বলেন, “সুর কখনো মরে না, মরে কণ্ঠ, মরে আত্মা, মরে দেহ। কিন্তু সুর থাকে, আর সে সুর যখন অভিশপ্ত হয়, তখন সে একেকটা মৃত্যু ঘটায় নিঃশব্দে।”
ভৈরবেশ অবাক হয়ে জানতে চান, “আপনি কি বলতে চাইছেন, এরকম ঘটনা আগে কখনো ঘটেছে?” মালহারী চোখ বুজে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন, তারপর বলেন, “বিশ বছর আগে এক ছাত্রীর আত্মহত্যা… নাম ছিল মীনাক্ষী। রূদ্রভির প্রথম ব্যাচের ছাত্রী। সেও একদিন তার খাতায় লিখে গিয়েছিল—‘এই রাগ আমাকে গিলে ফেলছে।’ আমরা তখন ব্যাপারটা চাপা দিয়েছিলাম—ভেবেছিলাম আবেগে ভুল করেছে, পড়াশোনার চাপ নিতে পারেনি। কিন্তু পরে বুঝি—সংগীতের ভেতরে কেউ কেউ ক্ষমতার সুর ঢুকিয়ে দিয়েছিল।” ভৈরবেশ বিস্ময়ে জানতে চান, “তাহলে আপনি কিছু করেননি?” মালহারী মাথা নিচু করে বলেন, “তখন আমি ভেবেছিলাম, সংগীতের পবিত্রতা এতটা দুর্বল নয়… কিন্তু ভুল ভেবেছিলাম।”
তিনি আরও জানান, রূদ্রভির সংগীতশিক্ষা পদ্ধতিতে এমন একধরনের গভীর মানসিক দখল ছিল, যা কিছু শিক্ষার্থীদের উপর অদৃশ্য চাপ তৈরি করত। “সে বিশ্বাস করত, কোনো ছাত্রীর ভেতরের ভয়কে জাগিয়ে তুলতে না পারলে, তার সুর নির্জীব থাকে। আর সেই ভয় জাগানোর উপায় সে নিজেই ঠিক করত। রাগ মার্গিণী এই ভাবনার চূড়ান্ত প্রতিফলন।” এই তথ্য শুনে ভৈরবেশ স্তব্ধ হয়ে যান—একজন শিক্ষক যদি নিজের রচনাকে ব্যবহার করেন মানসিক খেলার অস্ত্র হিসেবে, তবে তার শিকারের সংখ্যা কত হতে পারে? আর কতজন নিঃশব্দে বয়ে বেড়ায় সেই ক্ষত, যেটা চোখে দেখা যায় না, কেবল সুরে লুকিয়ে থাকে?
মালহারী তার শেষ কথায় বলেন, “বীণারম্ভা একদিন আমার কাছে এসেছিল… খুব চুপচাপ, কণ্ঠে ব্যথার রেশ। সে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘রাগ কি সবসময় সুখ দেয়?’ আমি তখন বলেছিলাম, ‘না মেয়ে, কিছু রাগ শোনার নয়, শুধু বোঝার জন্য।’ সে হাসেনি… চোখ দুটো মেঘে ভরে উঠেছিল।” ইন্সপেক্টর ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন, কিন্তু তার মনে তখন গুঞ্জন করছে মালহারীর বলা সেই শেষ লাইন—“কিছু রাগ শোনার নয়।” হয়তো রাগ মার্গিণী ছিল তেমনই এক সৃষ্টি—যেটা গাওয়া মানেই আত্মা হারানোর প্রতিশ্রুতি। আর বীণারম্ভা সেই ভুল সুর ধরেছিলেন, যে সুর হয়তো কখনওই মুক্তি দিতে জানে না, কেবল টেনে নেয় গভীর, রক্তমাখা নিস্তব্ধতার দিকে।
অধ্যায় ৭: রক্তে রচিত সংজ্ঞা
ইন্সপেক্টর ভৈরবেশের সামনে এখন ক্রমশ স্পষ্ট হতে শুরু করেছে যে বীণারম্ভার মৃত্যু ছিল নিছক আত্মহত্যা নয়, বরং বহুস্তর জড়ানো এক গভীর ষড়যন্ত্রের ফল। কিন্তু সবচেয়ে রহস্যজনক বিষয় হলো বীণারম্ভার সংগীত খাতা, যেখানে সে রাগ মার্গিণী শেখার সময় প্রতি পাতায় লিখে রেখেছিল নিজের অনুভব—কিন্তু তার শেষ পৃষ্ঠাটি ছিঁড়ে গিয়েছিল। forensic বিভাগ জানিয়েছে সেই পৃষ্ঠার নিচে ছিল রক্তের দাগ, এমনকি পাতায় পাতায় অদ্ভুতভাবে ভাঁজ করা নখের দাগ, যা বলছে শেষ মুহূর্তে বীণারম্ভা প্রবল আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন। ভৈরবেশ সেই খাতাটি হাতে নিয়ে দেখে পাতাগুলোর মধ্যে কোথাও কোথাও জলের দাগ মিশে আছে—চোখের জল না কি জলরঙ, তা বোঝা মুশকিল। তবে একটি পাতায় স্পষ্ট লেখা—“যদি আমি না ফিরি, মার্গিণীকে জিজ্ঞাসা কোরো।”
এই লাইনটি যেন এক বিস্ফোরণ ঘটায় তদন্তে। ইন্সপেক্টর এখন বুঝতে পারেন, বীণারম্ভা নিজেই হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি এমন এক চক্রে পা রেখেছেন, যেখান থেকে ফিরে আসার পথ নেই। তিনি যোগাযোগ করেন তানিয়া ব্যানার্জির সঙ্গে—যিনি ছিলেন রাগ মার্গিণী রচনার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করা একজন পিএইচডি ছাত্রী, এবং যিনি কিছুদিন আগে শ্রুতি নিকেতনে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তানিয়া বলেন, “রাগ মার্গিণী কোনো প্রচলিত রাগ নয়, এটা ছিল রূদ্রভির নিজস্ব রচনা। তবে তিনি দাবি করতেন, এটি প্রাচীন দ্রাবিড় ঘরানার একটি হারানো রাগ, যেটা তিনি পুনরুদ্ধার করেছেন। কিন্তু তার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। বরং এই রাগ গাওয়ার সময় অনেক ছাত্রীর উপর মানসিক চাপ তৈরি হত।” ভৈরবেশ জিজ্ঞেস করেন, “তবে কি আপনি বলছেন এই রাগটাই বিপদের মূল?” তানিয়া বলেন, “রাগ নিজে বিপজ্জনক নয়, কিন্তু কেউ যদি সেটাকে অস্ত্র করে তোলে, তখন সংগীত হয়ে যায় একধরনের মানসিক নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র।”
এই তথ্য মিলতেই ভৈরবেশ ফিরে যান শ্রুতি নিকেতনের আর্কাইভ কক্ষে, যেখানে পুরনো রেকর্ডিং আর পাণ্ডুলিপি রাখা আছে। সেখানে তিনি আবিষ্কার করেন একটি পুরনো ক্যাসেট—যেখানে লেখা ‘মার্গিণী—প্রথম রেকর্ড’। সেই রেকর্ডিং চালিয়ে তিনি শুনতে পান রূদ্রভির কণ্ঠস্বর, যেটা এক অদ্ভুত সুরে শুরু হয়—প্রথমে কোমল রেশাব, তারপর হঠাৎ করেই তীব্র গান্ধার—একটি ভারসাম্যহীন, ভাঙা সুরের বিন্যাস। এই সুরে একটা চোরা বিষ আছে, একটা অস্বস্তিকর কম্পন যা স্বাভাবিক শ্রোতার কানেই খটকা লাগে। এর মাঝে রূদ্রভির কণ্ঠে উচ্চারণ—“শুদ্ধ সুরই শুদ্ধ আত্মা সৃষ্টি করে। ভ্রান্ত হলে আত্মা নিঃশেষ।” সেই মুহূর্তে ক্যাসেটের শেষ দিক থেকে এক মেয়েলি কণ্ঠ শোনা যায়—“আমি পারছি না, স্যার… এটা গলায় কাঁটা হয়ে বসছে।” তারপর একটা ধ্বনি, যেন কিছু একটা ভেঙে পড়ছে।
ভৈরবেশ অবাক হয়ে দেখেন ক্যাসেটের গায়ে লেখা তারিখটি—১৫ বছর আগের। এবং মেয়েটির কণ্ঠ ছিল মীনাক্ষীর। তাহলে কি তখনই প্রথম এই রাগ দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের উপর মানসিক পরীক্ষা চালানো হয়েছিল? প্রশ্নটা এখন আরও গভীর হয়। বীণারম্ভা কি সেই পুরনো ভয়ঙ্কর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়েছিল? আর রূদ্রভি কি সত্যিই একজন শিক্ষক, নাকি একজন সংগীত-সাধক সেজে তৈরি করেছিলেন এক নিষ্ঠুর মানসিক খেলার মঞ্চ, যেখানে সুর ছিল কেবল আড়ালের চাবিকাঠি?
সন্ধ্যা গড়াতে গড়াতে শ্রুতি নিকেতন যেন নিঃশব্দ এক চিৎকারে ভরে ওঠে। ভৈরবেশ জানেন, তারা এখন দাঁড়িয়ে আছে এক রহস্যের কিনারায়—যেখানে সংগীত আর মৃত্যু পরস্পরের পরিপূরক হয়ে গেছে। আর সেই জট খুলতে হলে তাকে নামতে হবে আরও গভীরে, আরও পুরনো রক্তে লেখা সংজ্ঞার দিকে, যেটা একদিন রাগ মার্গিণীর গর্ভে লুকিয়ে ছিল।
অধ্যায় ৮: সুরের ফাঁস
রাত গভীর হলে ইন্সপেক্টর ভৈরবেশ শ্রুতি নিকেতনের পুরনো অডিটোরিয়ামের সামনে এসে দাঁড়ান। চাঁদের আলো ছুঁয়ে পড়ে ছাদের কারুকার্যে, যেন এক লুকিয়ে থাকা ছায়া গোপন কিছু প্রকাশ করতে চায়। তিনি জানেন, এই অডিটোরিয়ামে আগামীকাল সকালেই বসবে বার্ষিক সংগীত উৎসব, যেখানে রূদ্রভির শেষ ছাত্রীরা পরিবেশন করবে রাগ মার্গিণী। কিন্তু তার আগেই ভৈরবেশের হাতে এসেছে এক অদ্ভুত তথ্য—অন্য আরেক ছাত্রী, অঞ্জনা ঘোষ, হঠাৎ করেই নিজেকে উৎসব থেকে সরিয়ে নিয়েছে। অঞ্জনা এখন আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে, আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। কিন্তু ভৈরবেশ হাসপাতালে গিয়ে তার হাতে আবিষ্কার করেন সেই একই রক্তমাখা খাতা, যেটির কপি বীণারম্ভার ঘর থেকেও পাওয়া গিয়েছিল—মার্গিণী রাগের সেই নিঃসঙ্গ অনুশীলনের প্রতিচ্ছবি।
ভৈরবেশ খাতা ও ক্যাসেট নিয়ে দেখা করেন তানিয়া ব্যানার্জির সঙ্গে। তানিয়া বলেন, “এই রাগে এক বিশেষ বাঁধুনি আছে, যেটা স্নায়ুর ওপর প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে যদি কারও আত্মবিশ্বাস কম হয়, যদি কেউ পরিপক্ব না হয়, তাহলে এই রাগ মানসিকভাবে আক্রমণ করতে পারে।” তিনি যোগ করেন, “রূদ্রভি এই বিষয়টা জানতেন, তবু বারবার অপ্রস্তুত ছাত্রীদের দিয়ে এই রাগ গাওয়াতেন, যেন কেউ মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে—তখনই তিনি বলতেন, ‘তুমি সুরের যোগ্য নও।’ এটা নিছক শিক্ষা ছিল না, এটা ছিল একধরনের মানসিক শাসন।” ভৈরবেশ বুঝতে পারেন, রাগ মার্গিণী একটি সংগীত নয়, এটি ছিল এক নিষ্ঠুর পরীক্ষার নাম, যার ভিতরে রূদ্রভি তৈরি করেছিলেন এক মনস্তাত্ত্বিক ফাঁদ। যে ছাত্রীরা পারত, তারা কৃতী। আর যারা পারত না, তারা ধীরে ধীরে হারিয়ে যেত—কেউ সরে যেত, কেউ হারিয়ে যেত চিরতরে।
এই সত্যের মুখোমুখি হয়ে ভৈরবেশ সিদ্ধান্ত নেন, উৎসবের দিনেই রূদ্রভিকে জনসমক্ষে প্রশ্ন করবেন। উৎসবের দিন আসে, অডিটোরিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ। মঞ্চের আলো নিভে গিয়ে ভেসে ওঠে বীণারম্ভার এক রেকর্ডেড কণ্ঠ—“যদি আমি না থাকি, জানবে যে সুরও খুন করতে পারে।” শ্রোতারা স্তব্ধ। এর পরেই রূদ্রভি মঞ্চে উঠে এসে বলেন, “সুর যদি সত্য হয়, তবে সে শুদ্ধ হবে। যদি কেউ না পারে, দোষ সুরের নয়, দোষ শিল্পীর।” তখনই ভৈরবেশ সামনে এসে বলেন, “কিন্তু আপনি কি জানেন, এই রাগই কতজনের মৃত্যু ডেকে এনেছে? আপনি কি জানেন, বীণারম্ভা, অঞ্জনা, এমনকি মীনাক্ষী—all were victims of your psychological game?” রূদ্রভি মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যান, তারপর বলেন, “আমি কাউকে মারিনি, আমি কেবল সুরের পথ দেখিয়েছি। যারা হাঁটতে পারেনি, তারা নিজের বোঝা নিজেই বহন করেছে।”
এই বাক্যেই যেন প্রকাশ পায় এক নির্মম অহংকার। ঠিক তখনই অডিটোরিয়ামের ছাদ থেকে ঝুলে পড়ে এক পাতলা কাপড়ের ঝোলা ব্যানার—যেখানে লেখা, “রক্তে লেখা রাগ, সংগীতে ছদ্মবেশী মৃত্যু।” মুহূর্তে চারদিকে হইচই পড়ে যায়। ভৈরবেশ পুলিশি হেফাজতে নেন রূদ্রভিকে, যদিও তার বিরুদ্ধে এখনো কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। কিন্তু যে সামাজিক বিচারের সূচনা হলো সেই উৎসবে, তা রূদ্রভিকে শ্রুতি নিকেতনের গুরুপদের আসন থেকে নামিয়ে দেয়। সংগীত বিদ্যালয় ছেড়ে দেয় তার ছায়া, শিক্ষকরা প্রশ্ন তোলে তাদের পদ্ধতি নিয়ে, আর ছাত্রছাত্রীরা শুরু করে নতুনভাবে সংগীতের সংজ্ঞা খোঁজা।
রাত্রি নামার সময় ভৈরবেশ একা ফিরে যান বীণারম্ভার সেই ঘরে, যেখান থেকে সবটা শুরু হয়েছিল। জানালার ধারে বসে থাকা বীণারম্ভার সেই পুরনো ছবি তাকিয়ে আছে চুপচাপ, যেন সেও চায় কিছু বলার। ভৈরবেশ জানেন, অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনো বাকি। কিন্তু তিনি এইটুকু নিশ্চিত—রাগ মার্গিণী আর কখনো গাওয়া হবে না সেই আগের মতো করে। কারণ সে এখন কেবল এক সংগীত নয়, সে এক স্মৃতিতে ছেয়ে থাকা ফাঁদ—যে ফাঁদে কেউ হারিয়ে গেছে চিরতরে।
অধ্যায় ৯: ছায়া ও স্বরলিপি
ভৈরবেশের মাথার মধ্যে যেন একটি অস্পষ্ট ধ্বনি ঘুরপাক খাচ্ছিল—বীণারম্ভার সেই শেষ বাক্য, “সুরও খুন করতে পারে।” তিনি জানতেন, এটি কেবল রূপকথার বাক্য নয়; এটি ছিল এক সতর্কতা, এক পাথর চাপা সত্য যা রূদ্রভির ব্যক্তিত্বের আড়ালে চাপা পড়েছিল এতদিন। এখন তিনি আরও গভীরে যাচ্ছেন। শ্রুতি নিকেতনের পুরনো রেকর্ডরুমে, যেখানে কয়েক দশকের সংগীতচর্চার অডিও ও হস্তলিখিত স্বরলিপি সংরক্ষিত আছে, সেখানেই খুঁজে পাওয়া গেল একটি রহস্যময় নোটবুক—তাতে লেখা ছিল “প্রণবেশ চক্রবর্তীর শিক্ষা পদ্ধতি ও ছাত্রীর মানসিক প্রতিক্রিয়া”—এই প্রণবেশ চক্রবর্তী ছিল রূদ্রভির গুরু, যার বিরুদ্ধে একসময় মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছিল কিন্তু প্রমাণ না মেলায় তা চাপা পড়ে যায়। নোটবুকটি পড়ে ভৈরবেশ বুঝলেন, রূদ্রভি শুধু এই পদ্ধতি অনুসরণ করেননি, বরং তাকে আরও নিখুঁত, আরও হিংস্র করেছেন। ছাত্রীর মনের সূক্ষ্মতা, আত্মবিশ্বাসের সীমা—সবকিছু নোট করে রাখতেন তিনি, আর ঠিক যে রাগ বা সুরে তাদের ভেঙে ফেলা সম্ভব তা প্রয়োগ করতেন ধাপে ধাপে।
একটি পুরনো ক্যাসেট টেপে রেকর্ড ছিল এক ছাত্রীর চিৎকার—“আমি আর গাইতে পারছি না, দয়া করে থামান…” তারপর রূদ্রভির ঠাণ্ডা কণ্ঠ—“তুমি রাগের যোগ্য নও। তুমি নিজেকে নিজেই শেষ করো।” সেই কণ্ঠের নিচে চাপা কান্না, রেকর্ডিং হঠাৎই থেমে যায়। এই প্রমাণ ভৈরবেশ আদালতে তোলার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু ঠিক তখনই ঘটে আরেক রহস্য—রূদ্রভি হঠাৎ নিখোঁজ। তাঁর ঘর খালি, ফোন সুইচড অফ, গাড়ি ফেলে রেখে গেছেন শ্রুতি নিকেতনের পেছনের গ্যারেজে। পুলিশ পুরো শহর জুড়ে তল্লাশি শুরু করে, কিন্তু রূদ্রভির খোঁজ মেলে না। ভৈরবেশ ফিরে আসেন বীণারম্ভার মা কল্পনাদেবীর কাছে। তিনিও জানেন না কিছু, শুধু বলেন, “ওর চোখে আমি এক সময় স্নেহ দেখেছিলাম, কিন্তু ধীরে ধীরে সেটা ভয় হয়ে উঠেছিল। ও যখন বলেছিল, ‘গুরু আমাকে শুদ্ধ করবেন,’ তখনই আমি বুঝেছিলাম ওর মন ভাঙছে…।”
এদিকে, সংগীত বিদ্যালয়ে গুঞ্জন শুরু হয়—কেউ কেউ বলছে রূদ্রভি আত্মহত্যা করেছেন, কেউ বা বলছে তিনি নিজের কোনো আশ্রমে গিয়ে লুকিয়ে পড়েছেন। কিন্তু ভৈরবেশ বিশ্বাস করেন না। তিনি আবারও ফিরে যান রেকর্ডরুমে, এবার খুঁজে পান একটি পাণ্ডুলিপি—একটি অপূর্ণ অপেরা, যেখানে একজন গুরু তার ছাত্রীর প্রতিভা দেখে ভয় পায় এবং ধীরে ধীরে তাকে মানসিকভাবে ভেঙে নিজেকে সেরা প্রমাণ করতে চায়। পাণ্ডুলিপির শেষ লাইন ছিল—“শিষ্য গাওয়া থামায়, গুরু চুপ থাকে, আর তখনই গর্জে ওঠে রক্তমাখা রাগ।” ভৈরবেশ বোঝেন, এটা ছিল রূদ্রভির নিজস্ব স্বীকারোক্তি, হয়তো অনিচ্ছাকৃত, অথবা নিজের অহংকার থেকে লেখা, কিন্তু এটি প্রমাণ করে দেয় তার অপরাধমূলক মানসিক কাঠামো। শহরের সাহিত্য ও সংগীতমহল এখন দুইভাগে বিভক্ত—একদল এখনো রূদ্রভিকে শ্রদ্ধা করে, অন্যদল তাকে ‘সাংগীতিক নির্যাতক’ বলে অভিহিত করে।
শেষের দিকে, বীণারম্ভার একটি পুরনো ভিডিও ফুটেজ সামনে আসে—যেখানে সে বলে, “আমি যদি না থাকি, আমার সুর যেন হারিয়ে না যায়। আমার মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই হয়তো নতুন কোনও সংগীত জন্ম নেবে, যা ভয় নয়, ভালোবাসা শেখাবে।” ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে যায়। সংগীত বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, রাগ মার্গিণীকে পুনরায় শিখবে, তবে এবার নতুনভাবে, ভালোবাসার ব্যাখ্যায়—not fear, not judgment, not cruelty. ভৈরবেশ সেই সংগীতচর্চা দেখতে দেখতে বলেন, “একটি সুরের ভিতরে যদি মৃত্যু লুকিয়ে থাকতে পারে, তবে সেখানে জীবনেরও জন্ম সম্ভব।” কিন্তু তিনি জানেন, রূদ্রভি এখনো কোথাও আছে—হয় আত্মগোপনে, নয়তো কারও নতুন মানসিক দাসত্ব তৈরিতে ব্যস্ত।
রাত গভীর হয়। শ্রুতি নিকেতন এখন ঘুমিয়ে আছে, কিন্তু কোনো এক অন্ধকার কোণ থেকে কেউ বাঁশির হালকা সুর তুলছে—একটি পুরনো রাগ, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে চেনা কান্নার ছায়া। ভৈরবেশ জানেন, যাত্রা শেষ হয়নি—এ কেবল বিরাম, সমাপ্তি নয়।
অধ্যায় ১০: শেষ আলাপ
ভৈরবেশ বসে আছেন শ্রুতি নিকেতনের ছাদের ধারে, চোখের সামনে ঢুকে পড়ছে সন্ধ্যার রঙ। গাছের পাতায় বাতাসের ছোঁয়া যেন কোনো অদৃশ্য যন্ত্রণা নিয়ে ভেসে আসছে। আজ স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠান, কিন্তু গানের পরিবেশনা বদলে গেছে। প্রথাগত গুরুপ্রণামের বদলে আজকের সন্ধ্যা উৎসর্গ করা হয়েছে বীণারম্ভা চক্রবর্তীর স্মৃতির উদ্দেশে। সেই মঞ্চে বসেছে ছাত্রছাত্রীরা, যারা গাইছে নতুনভাবে শেখা রাগ মার্গিণী—ভয় নয়, ভালোবাসা নিয়ে। এই পরিবর্তনের পিছনে যে রক্ত আছে, যন্ত্রণার গাথা আছে, তা জানে শুধু ভৈরবেশ এবং কয়েকজন। অথচ এই সন্ধ্যার আলোতে সবকিছুই যেন নতুন করে গঠিত হচ্ছে। গানের প্রতিটি স্পন্দনে ছড়িয়ে পড়ছে বীণারম্ভার কণ্ঠের স্মৃতি, তার অস্ফুট ব্যথা আর নিষ্পাপ স্বপ্ন। ঠিক সেই মুহূর্তে, ভৈরবেশের ফোন বেজে ওঠে—অপরিচিত নম্বর, কিন্তু কণ্ঠটি একেবারে চেনা। “ভৈরবেশদা, তুমি সত্যিই আমার শেষ সুরটা শুনেছিলে,” বলে হালকা কণ্ঠে হাসে রূদ্রভি।
সেই হাসি ছিল শীতল, খালি এবং বিভ্রান্তিকর। “তুমি কোথায়?” ভৈরবেশ জিজ্ঞাসা করেন, গলায় কঠোরতা টেনে। “সেইখানেই, যেখানে সুর আর শব্দ মিশে যায়,” বলে সে, “আমি এখন এক অন্য বিদ্যালয়ে পড়াই, যেখানে সুরের মধ্যেই শুদ্ধি। বীণারম্ভা ব্যর্থ হয়েছে, কারণ সে প্রশ্ন তুলেছিল। আর তুমি? তুমি শুধু খুঁজে বেড়াও ছায়া। তুমি কখনো গাইলে না, ভৈরবেশ, তাই তুমি বোঝো না সুরের অভিশাপ।” ভৈরবেশ চুপ করে যান। এই কথোপকথনের মধ্যে এক প্যাথলজিকাল আত্মবিশ্বাস মিশে আছে, যার উৎস রূদ্রভির অসুস্থ অহংবোধ। ভৈরবেশ জানেন, যতক্ষণ না সে নিজের ভুল বুঝবে, ততক্ষণ সে প্রতিনিয়ত নতুন বীণারম্ভা তৈরি করতে থাকবে। কিন্তু তিনি আর থামবেন না। সেই পুরনো ক্যাসেট, রেকর্ড, স্বীকারোক্তি, ছাত্রীর ভিডিও—সবকিছু নিয়ে এক সাংবাদিক দলের সহায়তায় তিনি তৈরি করছেন একটি প্রামাণ্যচিত্র, যার নাম “রক্তমাখা রাগ: এক সুরের মৃত্যু ও জন্ম।”
প্রদর্শনের দিন আসে। প্রেক্ষাগৃহে ভরে যায় শ্রুতি নিকেতনের ছাত্রছাত্রী, প্রাক্তনরা, শহরের সংগীতপ্রেমী মানুষ এবং সাংবাদিকেরা। প্রামাণ্যচিত্র শুরু হয় বীণারম্ভার সেই বিখ্যাত ভিডিও দিয়ে, যেখানে সে বলে, “আমার কণ্ঠ থেমে গেলেও, আমার সুর যেন বেঁচে থাকে।” এরপর একে একে উঠে আসে রূদ্রভির মানসিক নির্যাতনের প্রমাণ, তার লেখা অপেরা, ক্যাসেটের ভয়াবহ রেকর্ডিং, এমনকি তার ছাত্রছাত্রীদের গোপন সাক্ষাৎকার। প্রদর্শনী শেষে কিছুক্ষণ স্তব্ধতা, তারপর করতালির ঝড়। কিন্তু ভৈরবেশ জানেন, এ কেবল শুরু। ঠিক সেই মুহূর্তে পুলিশ একটি খবর নিয়ে আসে—দক্ষিণ ভারতে এক পাহাড়ি অঞ্চলে ‘অর্জবর্ণা’ নামে একটি নতুন গুরুকুল খোলা হয়েছে, যার কর্ণধার একজন ‘রাগসিদ্ধ পুরুষ’, যিনি কেবল মানসিকভাবে দুর্বল ছাত্রছাত্রীদের নির্বাচন করেন। নাম নেই, ছবি নেই, কিন্তু পদ্ধতি সেই পুরনো। ভৈরবেশের হাত মুঠো করে ওঠে—তিনি জানেন, রূদ্রভি বেঁচে আছে। এবং সে আবার শুরু করেছে।
শেষ দৃশ্যে আমরা দেখি, ভৈরবেশ শ্রুতি নিকেতনের নতুন ব্যাচের সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন, “গান শুধু দক্ষতা নয়, এটা অনুভবের ভাষা। যদি সেই ভাষা ভয়ের ভেতর দিয়ে শেখানো হয়, তবে তা সংগীত নয়—তা এক রক্তমাখা অভিশাপ।” ছাত্রছাত্রীরা চুপ করে শুনছে। তারা জানে না, এই গল্পের শুরু কোথায়, শেষ কোথায়, কিন্তু তারা জানে—তাদের কণ্ঠের দায়িত্ব এখন নিজেদের হাতে। সেই সন্ধ্যায় একটি নতুন সুর জন্ম নেয়—রাগ মাধবী, যেটি বীণারম্ভা একসময় স্বপ্নে গেয়েছিলেন। সে সুর ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় সন্ধ্যার অন্ধকারে, কিন্তু তার অনুরণন রয়ে যায় শ্রুতি নিকেতনের বাতাসে।
এবং তখনই দূরের কোনো এক পাহাড়ি আশ্রমে, একটি নতুন কণ্ঠ গান গাইছে। গুরু বসে শুনছেন, চোখ বুজে। কণ্ঠে সেই পুরনো ভয়, সেই পুরনো ভাঙন। রূদ্রভির ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি খেলে যায়। “আরও এক বীণারম্ভা,” তিনি ফিসফিস করে বলেন। কিন্তু এবার হয়তো তার গল্প অন্যভাবে শেষ হবে। কারণ ভৈরবেশ থেমে যাননি, কারণ সুর এবার রক্ত নয়, প্রতিবাদ লিখছে। রক্তমাখা রাগ হয়তো এবার নিজের রঙ বদলাবে—ভয়ে নয়, সাহসে।
[সমাপ্ত]