Bangla - প্রেমের গল্প

রাত্রির নীল পত্র

Spread the love

তিথি রায়


রাত্রি নেমেছিল ধীরে ধীরে, যেন শহরের গায়ে গায়ে নরম নীল পর্দা টেনে দিচ্ছিল কেউ। নয়না বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, হাতে একটা কাপে শেষ চুমুকের চা। চারতলার উপর থেকে নীচে তাকিয়ে দেখে—পথে আলো জ্বলছে, কিন্তু কারো চেহারা স্পষ্ট নয়। কলকাতার এই অংশটা এতদিনে তার চেনা হয়ে গেছে, তবু এই নির্জনতা যেন তাকে আলাদা করে একটা দুঃখ দেয়। অরিন্দম আজও বাড়ি ফেরেনি—সাংহাতিক কাজের চাপ। নয়না জানে না, সে কি এই নিঃসঙ্গতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, না এর মধ্যেই কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত আরামের ছায়া আছে। আজ বিকেলে যখন সে ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরেছিল, তখনই ফ্ল্যাটের পোস্টবক্সে একটা অচেনা চিঠি খুঁজে পায়—নীল খামে মোড়ানো, হাতে লেখা ঠিকানায় কালি ছড়িয়ে গেছে একটু। প্রথমে ভেবেছিল কোনো ভুল ঠিকানায় এসেছে, কিন্তু নিজের নাম দেখে বুকের মাঝে কোথাও যেন কেঁপে উঠেছিল—নয়না সেন। সে চিঠিটা ব্যাগে রেখে দিয়েছিল, পড়েনি তখনই।

এখন, বারান্দা থেকে ফিরে ঘরে ঢুকে সে ধীরে ধীরে চিঠিটা খোলে। নীল কাগজে মোটা হরফে লেখা, যেন কবিতার মতন। “তুমি কি এখনও রাত জাগো, নয়না?” এই একটা বাক্য পড়তেই নয়নার ভেতরের সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। কাকে বলে চেনা গন্ধ? চিঠির কাগজটায় যেন সেই পুরনো বইয়ের পাতার গন্ধ, সেই যে কলেজ লাইব্রেরির কোনায় বসে একসাথে নীরব সময় কাটানো হতো। অনির্বাণ। এক মুহূর্তে নামটা বুকের ভেতর বাজে। একুশ বছর বয়সে যাকে ভেবেছিল জীবনের পরিণয় হবে, তাকেই হঠাৎ এত বছর পরে ফিরে পায় একটি চিঠির আকারে? কত বছর পর সেই নাম, সেই গলা, সেই কবিতা যেন হাওয়ায় ভেসে ওঠে। চিঠিটা পড়ে শেষ না করেই সে একটানে আলমারির পুরনো কাগজঘরে ঢুকে পড়ে, খুঁজে বার করে পুরনো চিঠিগুলো—পান্ডুলিপির পাতায় লেখা সেইসব লাল কালির কবিতা, যা একসময় অনির্বাণ তার জন্য লিখত। একটা চিঠির কোণায় লেখা ছিল: “যদি কখনো হারিয়ে ফেল, এই শব্দগুলো তোমায় খুঁজে নেবে।” আজ কি সেই শব্দরাই তাকে খুঁজে বের করেছে?

রাত বাড়তে থাকে, বাতি নিভে যায় এক এক করে, কিন্তু নয়নার চোখে ঘুম নেই। বিছানার পাশে রাখা চিঠিটা বারবার তার নজর কেড়ে নিচ্ছে। অরিন্দমের ফ্লাইট ডিলে হয়েছে—ফোনে হালকা ভঙ্গিতে জানিয়েছে সে, “খুব দেরি হবে, রাত্তিরে অপেক্ষা কোরো না।” নয়না নিজের শরীরটা অনুভব করে—শীতল, নিঃসাড়, তবু কোথাও যেন এক চাপা উত্তাপ জেগে উঠছে। তার মাথায় বারবার ঘুরছে সেই প্রশ্নটা—এই চিঠিটা কি হঠাৎ করে এসে পড়েছে? না কি অনেকদিন ধরে আসার কথা ছিল? অনেকদিন পরে সে অনুভব করে, তার ভিতরে এখনও একটা মেয়ের মতো উত্তেজনা জেগে উঠছে, যে প্রথম চিঠি পেয়েছে প্রেমিকের কাছ থেকে। কিন্তু এ তো সেই প্রেমিক, যে তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, কোনো বিদায়বাণী ছাড়া, কোনো কৈফিয়ত না দিয়ে। তাহলে কেন সে এখন ফিরে আসে? নয়নার প্রশ্নের উত্তর নেই, কিন্তু জানলার পাশে বসে, শহরের আলো আর অন্ধকারের মাঝখানে সে টের পায়—এ শুধু একটা চিঠি নয়, এ এক ঘুম ভাঙানোর ঘণ্টাধ্বনি, যা হয়তো তাকে সেই আত্মা ছুঁতে দেবে, যেটা অনেক আগেই তার শরীর থেকে সরে গিয়েছিল।

নয়নার মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই দিনের কথা—কোলকাতার দক্ষিণের একটি সরকারি কলেজ, মাঝেমধ্যেই বিদ্যুৎ যেত, তখন ক্লাস চলত জানলার আলোয়। অনির্বাণের সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের ক্লাসে—হোমার থেকে শুরু করে জীবনানন্দ পর্যন্ত সবকিছুতেই তার চোখে ঝলক ছিল। অনির্বাণ ছিল অদ্ভুতরকম আত্মবিশ্বাসী, কিন্তু অহংকারী নয়; কথা বলত ধীরে, গভীর দৃষ্টিতে তাকাত—যেন প্রশ্ন করত, “তোমার ভিতরে কে লুকিয়ে আছে?” একদিন লাইব্রেরির পিছনের কর্নারে বসে নয়না আবিষ্কার করেছিল, অনির্বাণ একটা কবিতা লিখছে—তাকে উদ্দেশ্য করে, অথচ তাকে না জানিয়েই। সে কবিতার নাম ছিল ‘ঘুমহীন দুপুর’—তখনি নয়না বুঝেছিল, এই ছেলেটির মধ্যে কিছু আছে যা বাইরের সবার থেকে আলাদা। এরপর সেই সম্পর্ক গড়ে উঠতে দেরি হয়নি—প্রথমে কবিতা, তারপর চিঠি, তারপর ছুটির দিনের চুপচাপ হেঁটে বেড়ানো… শরীর তখনো কাছে আসেনি, কিন্তু প্রতিটা চোখাচোখি যেন স্পর্শের চেয়েও তীব্র ছিল।

কিন্তু সেই মাধুর্যের ভিতরে ছিল একটা অদৃশ্য টানাপোড়েন, যা তখন নয়না বুঝে উঠতে পারেনি। অনির্বাণ মাঝে মাঝেই হঠাৎ হারিয়ে যেত, ফোন ধরত না, চিঠির উত্তর দিত না। নয়না তখন ভেবেছিল হয়তো তারই কোনো দোষ, হয়তো সে খুব বেশি কিছু চায়। একবার, শেষ বর্ষের ঠিক আগের সপ্তাহে, অনির্বাণ হঠাৎ কলেজেই আসা বন্ধ করে দেয়। সে তখন কেবল বলে গিয়েছিল, “আমি এখন নিজের কিছু যুদ্ধের ভেতরে আছি।” এরপর নয়না বহুদিন অপেক্ষা করেছিল—চিঠি, ফোন, বন্ধুদের মাধ্যমে খোঁজ…কিন্তু সব ব্যর্থ হয়েছিল। সেই হারানোর পরে নয়না নিজেকে কেমন যেন গুটিয়ে নিয়েছিল, ধীরে ধীরে পড়াশোনায় ডুবে গিয়ে সেই আবেগকে চাপা দিয়েছিল। পরবর্তীতে অরিন্দমের সঙ্গে বিয়ে—এক নিরাপদ, স্থিত জীবন—তার ভেতরের সেই উন্মাদ প্রেমিকাকে সে যেন জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।

এতদিন পর, সেই ঘুম ভাঙানোর ডাক শুনে তার ভিতরটা কাঁপছে। সেই সমস্ত পুরনো মুহূর্তগুলো—যা সে ভেবেছিল ধুলোয় চাপা পড়ে গেছে—এখন যেন চিঠির শব্দের মধ্যে উঠে আসছে। অনির্বাণ কি আজও সেই আগুন বহন করে ফিরেছে? না কি শুধু খেলছে তার আবেগ নিয়ে? নয়না চায়না আবার সেই ভাঙা বিশ্বাসের পথে হাঁটতে, তবু কিছু অনুভূতি আছে যা ইচ্ছের অধীন নয়। স্মৃতির ভিতরে ফিরে যেতে যেতে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে—সে দেখে, কলেজের ছাদে বসে অনির্বাণ বলছে, “তুই জানিস, তোর চুলের গন্ধে আমার ঘুম আসে না।” সেই পুরনো কথাগুলো হাওয়ায় ভেসে আসে, আর নয়না বুঝতে পারে—চিঠির মধ্যেই সে ডুবে যাচ্ছে, যেন সেই নীল কাগজ তার অস্তিত্বের জলের মতো গা ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে।

কলকাতা শহরের ধুলো ধরা বাতাসে অদ্ভুত একটা নরম বিষণ্ণতা ছড়িয়ে থাকে সন্ধ্যাবেলায়, বিশেষ করে যখন জানলার ধারে বসে থাকা কেউ নির্জনতা চায় কিন্তু পায় না। নয়নার প্রতিদিনের রুটিনে কোনও নাটক নেই—সকালবেলা কলেজ, নির্ধারিত ক্লাস, মেয়েদের মুখে একঘেয়ে প্রশ্ন, স্টাফরুমে সোহিনীর সাথে দু-চারটি কথা, তারপর বিকেলে ফিরে এক কাপ চা আর নিরব ঘর। অরিন্দমের সাথে তার সম্পর্ক ঠিক ঘড়ির কাঁটার মতো—ঠিক সময়ে কথা, ঠিক সময়ে নীরবতা, ঠিক সময়ে আলাদা ঘুম। তারা কোনওদিন ঝগড়া করে না, কারণ কোনও উত্তাপই নেই, আর উত্তাপ ছাড়া সংঘর্ষও নিষ্প্রাণ। নয়নার শরীরটা যেন ভুলে গিয়েছে কামনার সংজ্ঞা, শুধু মাঝে মাঝে শরীর জেগে উঠে মনকে প্রশ্ন করে—“আমি কি এখনও জীবিত?” সেই মুহূর্তগুলোতেই সে ফিরে ফিরে ভাবতে বাধ্য হয়, কেন চিঠিটা এল, কেন আবার সেই পুরনো মুখ মনে পড়ছে, কেন হৃদয়ের যে অংশটাকে মৃত ভেবে সে এতোদিন চালিয়ে নিয়েছে, এখন সেইখানে হঠাৎ হালকা নাড়া লাগছে।

দুদিন কেটে গিয়েছে, কিন্তু চিঠিটার গন্ধ এখনো তার মাথার পাশের টেবিলে। আজ কলেজ থেকে ফেরার পথে, লিফটে ওঠার সময় নয়না বুকের ভেতর কেমন এক অস্থিরতা টের পেল—ঠিক যেন কেউ তার ওপর নজর রাখছে। সে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, কিন্তু কেউ ছিল না। বাড়িতে ঢুকে কাপড় বদলে, মুখে জল দিয়ে সে বিছানায় এসে বসে পড়ল, আর ঠিক তখনই দরজার নিচ দিয়ে একটা খাম ঠেলে ঢুকল। ভেতরে আবার সেই নীল খাম, তার নাম লেখা হয়েছে সেই চেনা হাতে—অনির্বাণের হাত! এবার খোলার পর সে দেখে, ভিতরে একটা কবিতা নেই, বরং আছে একটা ছোট্ট কাগজে লেখা কিছু শব্দ—“সবকিছু কি সত্যিই পেরিয়ে যায়, না আমরা ভান করি ভুলে যাওয়ার?” নয়নার হাত কাঁপে, বুকের ভিতরে যেন ছাই চাপা আগুন আবার তাপ ছড়াতে থাকে। সে জানে, এখনই ফোন করতে পারে, খোঁজ নিতে পারে, প্রশ্ন করতে পারে—কিন্তু তার ভিতরের সেই বছর কুড়ির মেয়েটি যেন তাকে থামিয়ে দেয়।

রাতে সে খোলা জানলার পাশে বসে থাকে, বাইরে একটা ঠাণ্ডা বাতাস এসে গায়ে লাগে। অরিন্দম অফিস থেকে এখনো ফেরেনি। নয়না একা বিছানায় বসে আবার সেই পুরনো ডায়েরি বের করে, যেখানে এখনো অনেক পুরনো কবিতা জমা আছে। সে পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে একটি পাতায় থামে—সেখানে লেখা, “একদিন যদি ভয় না থাকত, আমি কেবল তোর কাছে আসতাম, এক চুমুতে সব প্রশ্নের উত্তর দিতাম।” নয়নার চোখে জল আসে না, কিন্তু ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে ওঠে—অনির্বাণ ছিল বড্ড স্পষ্ট, অথচ সবকিছুই অসম্পূর্ণ। আজ এত বছর পরে, যখন নয়নার ভিতরে সমস্ত প্রশ্ন ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন সেই অসম্পূর্ণতাই আবার কড়া নাড়ছে। শহর জেগে থাকে আলোয়, আর নয়নার ভিতরে সেই আলো-আঁধারির খেলা চলতেই থাকে, যেখানে প্রেম নেই, নেই ঘৃণাও—শুধু আছে টুকরো টুকরো কামনা আর প্রশ্নে মোড়া এক অস্থির স্মৃতি।

আজও রাত যখন গভীর হয়ে আসে, নয়না চোখে ঘুম এনে নিতে পারে না। তার মাথার ভেতরে একটা অন্যমনস্ক গতি, একটি প্রশ্ন, একটি খোঁজ—শরীরের গন্ধের মতো। সে জানে না, সে কি ফের ফিরে যেতে চায় সেইসব স্মৃতির ভেতরে, যেখানে অনির্বাণ তাকে একবার বলেছিল, “তোর চোখের মধ্যে এক ধরনের রহস্য আছে, যা আমি কখনোই সমাধান করতে পারব না।” সেই সময়ে এসব কথা হয়তো কল্পনাই মনে হয়েছে, কিন্তু এখন তা অদ্ভুতভাবে বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। চিঠির প্রতিটি শব্দ তার গায়ে একটা ছোঁয়া রেখে যাচ্ছে, যেন কেউ বারবার তাকে স্পর্শ করছে। কয়েক বছর আগের সেই অনুভূতিগুলো—যেগুলো সে নিজের মনে চাপা রেখেছিল, ফিরে আসছে, প্রত্যেক কোণায় নতুন করে শ্বাস নিচ্ছে। আসলে, সময় কি সত্যিই সব কিছু মুছে দেয়? না কি সময় নিজেই পুরনো স্মৃতিকে আরও গভীর করে রাখে?

নয়না কখনো ভাবেনি যে তার জীবন এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়াবে। বিয়ে, কাজ, পরিবারের দায়িত্ব—এই সব কিছুই তাকে এক ঘরবন্দি জীবনের মধ্যে ঢেলে দিয়েছে। অরিন্দমের সঙ্গেও সে কখনো সেই আগের মতো সম্পর্ক খুঁজে পায়নি। অরিন্দম ভালো মানুষ, সংসারের প্রতি একনিষ্ঠ, কিন্তু তাদের সম্পর্ক কখনোই এক ঘরবন্দি প্রেমের বেশি কিছু হতে পারেনি। সেটাও ছিল নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য, কিন্তু কোথাও যেন ভালোবাসার খরা ছিল। একদিন নয়না তার চোখে প্রশ্ন রেখেছিল—“তুমি কি মনে করো, আমরা ভালোবাসি?” অরিন্দম হেসে বলেছিল, “আমরা একে অন্যকে যতটা জানি, ঠিক ততটাই ভালোবাসি।” কিন্তু যখন সে জানাল, সে আর কিছু পেতে চায় না, তার জন্য সেটাই যথেষ্ট—তখন নয়না নিজের ভেতর ফাঁকা অনুভব করেছিল, একটা গভীর অভাব।

আর আজ, রাতের অন্ধকারে, সেই অনির্বাণের কথা মনে পড়ে। সেই সব কথা, সেই পুরনো দিনগুলো, যেখানে তারা একে অপরকে ছুঁতে, একে অপরকে বুঝতে চেয়েছিল। এখন, সেই ছোঁয়া, সেই গন্ধ যেন ফিসফিস করে তার চারপাশে। যদিও চিঠি কখনো পুরোপুরি প্রকাশ পায়নি, তবুও তার প্রতিটি শব্দ যেন তীক্ষ্ণ শাসন করতে থাকে। সে কখনোই ভাবেনি যে তার শরীর এতদিন পরে তেমনি সেই স্পর্শকে মনে রাখতে পারবে। এই স্পর্শ, এই আবেগ, এই উত্তাপ—যে শরীরটাই জীবনের একটি অংশ ছিল, সেটাই যেন এখন নতুন করে তার সামনে উপস্থিত হচ্ছে। চিঠির মাধ্যমে অনির্বাণ তাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে সেই পৃথিবীতে, যেখানে তারা একে অপরকে জানত, একে অপরকে স্পর্শ করত, এবং একে অপরের দেহে নিজেদের খোঁজ পেত।

রাতে, যখন তার শরীরের ভিতর সব অনুভূতিগুলো ঘুরে ফিরে আসে, সে উপলব্ধি করে—এটা শুধু শরীরের আকাঙ্ক্ষা নয়, এটা আত্মার একটা গভীর আকাঙ্ক্ষা। তার মনের মধ্যে এক অপূরণীয় ফাঁকা জায়গা ছিল, যা কখনো পূর্ণ হয়নি, যা কেউ কখনো পূর্ণ করতে পারেনি। আজ, যখন সেই পুরনো আগুন আবার তাকে ছুঁতে চাচ্ছে, সে নিজেও জানে না—এই শরীরের স্মৃতিগুলো কি তাকে আবার সেই পথের দিকে নিয়ে যাবে, যে পথে সে একদিন হারিয়ে গিয়েছিল।

রাত তখন গভীর, শহরের কোলাহল অনেক আগেই স্তব্ধ হয়ে গেছে। নয়নার ঘরের জানলা খোলা, পর্দা ধীরে ধীরে দুলছে মধ্যরাতের হালকা বাতাসে। বিছানায় সে আধশোয়া, চোখ মেলে তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে, আর মনের ভিতরে অনবরত ঘুরছে একটি অনুভূতি—চেপে রাখা কিছু, যা আর ঠেকিয়ে রাখা যায় না। হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে—একটা অচেনা নাম্বার, অন্ধকার ঘরের একমাত্র শব্দ। প্রথমে সে থমকে যায়, তারপর হাত কাঁপতে কাঁপতে ফোনটা কানে তোলে। ওপাশ থেকে একটা নিঃশব্দ ভেসে আসে, তারপর ধীরে ধীরে খুব পরিচিত এক কণ্ঠস্বর, যেন দীর্ঘ ঘুম থেকে জেগে ওঠে—“নয়না, আমি।” গলা শুনেই তার শরীরটা কেঁপে ওঠে। এত বছর পর, এতদিনের নিঃশব্দতার পর, এই কণ্ঠস্বর যেন হঠাৎ অতীতের সমস্ত জানলা একসাথে খুলে দেয়।

প্রথম কয়েক মুহূর্তে দুজনেই কিছু বলে না, শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে আসে। তারপর অনির্বাণ বলে, “তোর চিঠির উত্তর আমি বহুবার লিখতে গিয়েছিলাম, কিন্তু কখনো শেষ করতে পারিনি। জানি না, তোকে এইভাবে আবার বিরক্ত করা উচিত কিনা।” নয়না কিছু বলে না, তার গলায় যেন আটকে আছে হাজারটা প্রশ্ন, হাজারটা অব্যক্ত অভিমান। সে শুধু জিজ্ঞাসা করে, “তুমি কেন ফিরে এলে?” অনির্বাণ নিঃশব্দ থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, “কারণ মনে পড়ছিল। কারণ ভোলা যায়নি। কারণ তুই ছিলি সেই একমাত্র, যার চোখে আমি নিজেকে দেখতে পেতাম।” সেই কথার ভারে নয়নার বুকটা ভরে যায়, আবার ফাঁকা হয়ে যায় একসাথে। সে জানে না এই মুহূর্তে কী বেশি কাজ করছে—রাগ, আনন্দ, নাকি পুরনো প্রেমের কোনো অসমাপ্ত বুদবুদ। অনির্বাণ আবার বলে, “কলকাতায় ফিরেছি কিছুদিনের জন্য। ইচ্ছে হয়েছিল তোকে দেখি। পারবি?” নয়না চোখ বন্ধ করে রাখে কিছুক্ষণ, যেন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে—নিজেকে সামলাবে, না হারিয়ে যাবে সেই স্বর-ভরা রাতে।

তারপর সে বলে না কিছু, শুধু কাঁধে চাদর জড়িয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়, আর ফোনটা নিঃশব্দে বন্ধ করে দেয়। ওপাশে এখনও অনির্বাণ অপেক্ষা করছিল কিনা, সে জানে না। কিন্তু জানে, এই মধ্যরাতের ফোন তার ভিতরের সমস্ত অভিমান, সমস্ত প্রহরী, সমস্ত লুকোনো কামনা একসাথে ভেঙে দিয়েছে। সে নিজের ছায়ায় নিজের হাত ছুঁয়ে দেখে, যেন যাচাই করে—এই আমি এখনো সেই পুরনো নয়না তো? ফোনটা তার শরীরে আগুনের মতো ছড়িয়ে গেছে, ঠান্ডা বাতাসেও সে তাপ অনুভব করে। সে জানে, অনির্বাণ ফিরে এসেছে। আর এবার কেবল চিঠিতে নয়, কণ্ঠস্বরে, স্পর্শে, আত্মার অন্তর্গত এক ধ্বনিতে। সেই রাতে সে আর ঘুমাতে পারে না। তার মাথার নিচে বালিশে জমে থাকা চুলে পুরনো গন্ধ মিশে যায়, আর চোখের কোণে মিশে থাকে এক অনামা কামনা—যেটা অনেক আগে হারিয়ে গিয়েছিল, আবার এখন ডাক দিচ্ছে, এক ফোনকলের মতো।

সেদিন রাতে বৃষ্টি হয়নি, কিন্তু জানালার বাইরে বাতাসে পেঁচিয়ে থাকা গাছের পাতাগুলো যেন কিছু বলছিল, ফিসফিস করে, অজানা কোনও ভাষায়। রূপসা বিছানার কিনারায় বসে ছিল, হাতে থাকা সেই চিঠিটার শেষ লাইনটা পড়ে আবার উপরের দিকে চোখ দিচ্ছিল, যেন এক আশ্বাস খুঁজছিল কোথাও। অরিন্দম লিখেছিল— “তোমার শরীরের গন্ধ এখনো আমার নিশ্বাসে আটকে আছে, জানো?” এই কথাটা কাঁপিয়ে দিচ্ছিল তার ভেতরের সবকিছু। তার পাশেই আলতোভাবে রাখা ছিল অরিন্দমের কলেজের সেই পুরনো ছবি, যেখানে তারা দুজন একসাথে, হেসে উঠেছে ভিজে দুপুরে। কিন্তু এই হাসির নিচে লুকোনো ছিল অজস্র অসমাপ্ততা—একটা কফিশপের দরজার সামনে শেষ দেখা, অরিন্দমের সিগারেট ধরা আঙুল, আর রূপসার চোখে জমে থাকা অব্যক্ত কিছু। বিয়ের পর এগুলো ভুলে যেতে চেয়েছিল, চেয়েছিল নিপুনের সংগে নতুন একটা পথ গড়ে তুলতে, কিন্তু স্মৃতি এমনই এক চোরাবালি, যেখানে একবার পা পড়লে আর ওঠা যায় না। রূপসা জানত, সে ভালো স্ত্রী, ভালো মা, কিন্তু তার মধ্যে এক অনাহুত শূন্যতা আছে—যা নিপুনের নিয়মিততা, তার নিয়ন্ত্রিত ভালোবাসায় পূর্ণ হয় না। সেই ফাঁকটাই যেন অরিন্দমের চিঠি এসে ভরিয়ে তুলছিল, শরীরের গভীর কোনও চেনা অনুভব জেগে উঠছিল ধীরে ধীরে।

রাতের মধ্যভাগে, যখন নিপুন পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছিল, রূপসা হঠাৎ করেই একটা সাহসী সিদ্ধান্ত নিল। সে জানত, এই সিদ্ধান্তে লুকিয়ে আছে পাপবোধ, কিন্তু তার ভিতরের আগুন নিভে যাওয়ার আগে একবার স্পর্শ করতে চেয়েছিল সেই আগুনকে। সে ফোনটা তুলে অরিন্দমকে একটা বার্তা পাঠাল—“আগামী শুক্রবার, আমরা দেখা করব। কথা না, চোখে চোখ রেখে।” বার্তাটি পাঠিয়েই সে বিছানায় শুয়ে পড়ল, তবে ঘুম তার চোখে এল না। ভেতরে ভেতরে কাঁপছিল সে, কিন্তু সেই কাঁপুনি ছিল না ভয়ের, ছিল উত্তেজনার, জাগরণের, কামনার এক চাপা দহন। সে চোখ বন্ধ করতেই মনে পড়ল, কলেজে একবার সন্ধ্যায় অরিন্দম তাকে বলেছিল, “তোমার চুলের গন্ধে আমি হারিয়ে যাই, রূপসা। যদি কোনওদিন ফিরে আসি, বিশ্বাস করো, শুধু সেই গন্ধটাই খুঁজে ফিরব।” সেই গন্ধ, সেই দৃষ্টি, সেই উষ্ণতা—সবকিছু যেন রক্তে ঢেউ তুলে দিচ্ছিল। সেই রাতে সে নিপুনকে ছুঁয়ে দেখেনি, কোনো আলিঙ্গন করেনি, কারণ তার শরীর এখন বিভক্ত, মন ভাগ হয়ে গেছে। সে জানত না, এই পথে হাঁটতে গিয়ে সে কোথায় পৌঁছাবে, কিন্তু তার পায়ের নিচে জমে থাকা নিস্তরঙ্গ জীবনের বরফে আজ ফাটল ধরেছে—এটাই ছিল একমাত্র সত্য।

শুক্রবারের সেই দিনটা যেন হাজার বছরের প্রতীক্ষার মতো এল। রূপসা জানত, অরিন্দম আর সেই আগের ছেলেটা নেই, তার চোখে জীবনের ভার আছে, কাঁধে অভিমান, আর হৃদয়ে সেই পুরনো কবিতাগুলোর তাপ—যা তারা একসাথে পড়ত কলেজের চৌকাঠে বসে। দেখা হওয়ার সময় ওরা কোনও রেস্তোরাঁ নয়, বরং পুরনো সেই গ্রন্থাগারের পাশে সেই ছোট্ট পার্কে দাঁড়িয়ে রইল। কেউ কিছু বলল না, শুধু চোখে চোখ রাখা হল, আর সেই চোখে ছিল একগুচ্ছ প্রশ্ন, একরাশ অপরাধবোধ, এবং… একটুকরো আশ্রয়। অরিন্দম হাত বাড়িয়ে বলল, “চলো, হাঁটি,” আর রূপসা চুপচাপ তার হাত ধরল। ওই প্রথম স্পর্শেই যেন তার শরীর জেগে উঠল নতুন করে। নিপুনের চেনা ভালোবাসার বাইরে এই টানটা অচেনা হলেও এতখানি সত্যি হবে, সেটা সে জানত না। তাদের হাঁটা ছিল ধীর, কথা ছিল কম, কিন্তু বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল সেই নীল রাতের ছায়া, যা তাদের ঘিরে রেখেছিল অনুচ্চারে, অবদমনে, কামনায়। রূপসা জানত, সে বাড়ি ফিরলে হয়তো নিপুনের চোখে কিছু লুকিয়ে রাখতে পারবে না, কিন্তু আজকের এই মুহূর্তে, এই স্পর্শে সে নিজের সবচেয়ে সত্যিকারের রূপটা খুঁজে পাচ্ছিল—যেখানে সে নারী, প্রেমিকা, পাপবোধহীন এক কামনার শরীর, যা শুধু অনুভব করতে চায়, প্রশ্ন নয়।

কলকাতার আকাশে তখন বৃষ্টির ঘ্রাণ, জানলার কাঁচে থেমে থেমে বৃষ্টির শব্দ। তিথি একটা হালকা নীল শিফনের শাড়ি পরে বসে ছিল বেডরুমের সোফায়, কাঁধ ছুঁয়ে নেমে আসা চুলের ঢেউ যেন নিজস্ব ভাষায় কিছু বলতে চাইছে। ড্রয়িংরুম থেকে শাশ্বত উঠে এল একটা কফির কাপ হাতে, মুখে অস্বস্তির ছায়া। “এই সময়ে তুমি একা থাকো, ভালো লাগছে?”—প্রশ্ন করল। তিথি মাথা ঘোরালো না, জানালার দিকে তাকিয়েই বলল, “তুমি এলে, তাতেই তো আর একা নেই।” শাশ্বতের চোখে পড়ল, পাশের টেবিলে রাখা পুরনো এক খামে ভাঁজ করা চিঠিটা, এক কোণে একটা অক্ষরের রেখা দেখা যাচ্ছে—”S”। তার বুক কেঁপে উঠল। সে জানে এই চিঠি তার নয়, এবং এই মুহূর্তে ঘরের নিঃশব্দতা কোনওভাবে তীব্র হয়ে উঠছে। “চিঠিটা কে দিল?” প্রশ্নটা যেন হাওয়ায় ভেসে থাকল। তিথি এবার তাকাল, একরাশ নির্লিপ্ততা নিয়ে বলল, “শব্দের শরীর থাকে না কি? এই চিঠিটা শুধু শব্দ নয়, একটা শরীর—যেটা ছুঁলে আমার ভেতরে কোথাও আগুন লাগে।”

শাশ্বত জানে, সে আজ নতুন এক তিথিকে দেখছে—যে তিথি তাকে বিয়ে করেছিল, সেই তিথি নয়। সে চুপচাপ উঠে চিঠিটা নিতে চাইলে তিথি বাধা দিল না, শুধু বলল, “পড়লে তুমি হয়তো বুঝবে, আমি ঠিক কী হারিয়েছি।” শাশ্বত চিঠির কাগজ খুলল, এক নিঃশ্বাসে পড়ে নিল সব। সেখানে লেখা ছিল, “তিথি, যখন তোমার ঘাড়ে চুল পড়ে আর তুমি নিচু গলায় হাসো, আমি জানি, সেই হাসির নিচে আমার নামে একটা নৈঃশব্দ্য থাকে। আমি আজও রাতে চোখ বন্ধ করলে শুনি, তুমি বলছ—আরো একবার, শুধু আরেকটা বার… আমি আসতে পারি না, কিন্তু আমার শব্দেরা আসে। এই চিঠিটা তোমার বালিশের নিচে রাখো, যেন আমি প্রতিরাতে তোমার ঘ্রাণ নিই। — সৌম্য।” শাশ্বতের মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। যে কামনার ভাষা সে তিথির চোখে কোনওদিন পড়তে পারেনি, তা এই চিঠির শব্দে ফুটে উঠেছে। তার ঠোঁট শুকিয়ে এল, কফির কাপ নামিয়ে রাখল। তিথি এবার উঠে এসে তার মুখোমুখি দাঁড়াল, বলল, “তুমি যদি চাও, আমি পুড়িয়ে ফেলতে পারি ওকে।” কিন্তু শাশ্বত জানে, পুড়লে শব্দ পোড়ে না, পোড়ে না শরীরও। কেবল থেকে যায় এক নিঃশব্দ কামনার ছায়া।

রাতের খাওয়া শেষ করে তিথি একা ছাদে যায়। আকাশ কালো মেঘে ঢাকা, হঠাৎ এক বিদ্যুতের ঝলকে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে—এ যেন স্মৃতির কোনও আলোকচিত্র। শাশ্বত জানে, সে আজও তিথিকে ভালোবাসে, কিন্তু তার ভালোবাসা কখনও শব্দে রূপ পায়নি। আর সৌম্য? সে তো শব্দের শরীরে তিথিকে ছুঁয়েছে বহুবার, হয়তো বাস্তবে নয়, তবু এমনভাবে যা শাশ্বত পারেনি। এই ঘরের মধ্যে একটা ত্রিভুজ তৈরি হয়েছে—তিথি, সৌম্য, আর সে নিজে—তিনটি শরীর নয়, তিনটি ভাষা, তিনটি অপরাধবোধ, তিনটি অসমাপ্ত কামনা। রাত বাড়ে, কিন্তু ঘরের আলো নিভে না। তিথি ফিরে এসে একবার তাকায় শাশ্বতের দিকে—চোখে প্রশ্ন, না কি আহ্বান? শাশ্বত চুপচাপ তার দিকে হাত বাড়ায়। এই স্পর্শে কি শব্দেরা হার মানবে? নাকি আবার কোনও চিঠির শরীর জেগে উঠবে তিথির মনস্তলে? চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে তারা, একসাথে, কিন্তু ভেতরে আলাদা, নিজেদেরই ভাষায় গুঁজে থাকা।

বৃষ্টি থেমে গিয়েছে অনেকক্ষণ, জানালার কাঁচে জলের রেখাগুলো শুকিয়ে গিয়েছে, কিন্তু নীহারিকার ভেতরে এক ধরণের ঝড় বয়ে চলেছে। রাতের খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে, সে ধীরে ধীরে ছাদের প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ায়। চারপাশে নিঃস্তব্ধতা, শহরের কোলাহল বহু নিচে। সে ভাবছিল—এই সম্পর্কের শেষ কোথায়? কবে থেকে ভালোবাসা এতটা দহনময় হয়ে উঠল যে শরীর, মন, সংসার, সামাজিক বন্ধন—সব কিছু ছাই হয়ে যেতে বসেছে? শোভন এখনো তার জীবনে আছে, কিন্তু তবুও নেই। তন্ময়, বারবার ফিরে এসে তার ভিতরের সেই স্তব্ধ অভ্যন্তরটাকে জাগিয়ে তোলে। কিন্তু কী সেই টান? স্রেফ যৌনতা? নাকি এমন এক অপরাধী আকাঙ্ক্ষা যা তাকে তার জীবনের স্বাভাবিক পথ থেকে বিচ্যুত করে? সে বোঝে, এই গভীর সম্পর্কের মধ্যে শুধু কাম নয়, লুকিয়ে আছে অপরাধবোধ, লুকিয়ে আছে একধরনের মুক্তির আর্তি।

তন্ময়ের গলায় যে টান, তার কথায় যে মায়া—নীহারিকা বারবার নিজেকে বোঝাতে চায় সেটা শুধুই অতীতের রোমান্টিসিজম। কিন্তু তবুও, তন্ময় যখন বলে, “তুই যা চাস, আমি সেটাই হতে রাজি,” তখন যেন সেই পুরোনো ঘর, পুরোনো ছাদ, কোলাজ করা প্রেমপত্রেরা সব আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে। সেই রাতে, তারা আবার দেখা করেছিল, এক হোটেল রুমে। খোলা জানালা দিয়ে বাতাস ঢুকছিল, বাতাসে লবণের মতো গন্ধ—সম্ভবত সেই অনিশ্চয়তার, সেই নিষিদ্ধতার। চুমুর ভেতরে, স্পর্শের ভেতরে, ছিল না কেবল শরীরের ক্ষুধা—ছিলো এক গভীর দহন। তন্ময় বলেছিল, “এই শরীর তোর, সেই কলেজ থেকে আজ পর্যন্ত,” আর নীহারিকা যেন সেদিন প্রথমবার অনুভব করল নিজের নারীসত্তার এক বিস্ময়কর পরিপূর্ণতা। কিন্তু যখন সে বাড়ি ফিরে এল, তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে সে ভয় পায়। তন্ময় তাকে উজ্জ্বল করে তোলে, আবার সেই আলোতেই তার নিজস্ব অন্ধকারও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

দিনের পর দিন পেরিয়ে যায়, নীহারিকার জীবনে এক ধরণের দ্বৈত বাস্তবতা জন্ম নেয়। দিনের আলোয় সে শোভনের স্ত্রী, সমাজে প্রতিষ্ঠিত এক বৌদি, একজন আদর্শ কন্যা, অফিসের সহকর্মী। আর রাতে সে এক রহস্যময়ী, যাকে শুধু তন্ময় জানে, শুধুই সে ছুঁতে পারে। এই দুই সত্তার সংঘাতে তার ঘুম উড়ে যায়, বুকের মধ্যে এক অজানা আগুন যেন জ্বলতে থাকে। সে বুঝতে পারে, এই সম্পর্ক কোনো ক্লাসিক প্রেম নয়, কোনো কাব্যিক পুনর্মিলন নয়—এ এক বিষাক্ত কিন্তু লোভনীয় আকর্ষণ, যা তাকে ধ্বংস করবে কিন্তু তবুও সে তা ছাড়তে পারবে না। শেষ রাতে, আবার একটি চিঠি পায় সে। তন্ময় লিখেছে, “তুই যদি চাস, আমি চিরকাল এই অন্ধকারেই থাকতে রাজি।” নীহারিকা চিঠিটা ছুঁয়ে চোখ বন্ধ করে। তার শরীরের ভেতর, তার মনের ভেতর, এক অদ্ভুত দহন চলতে থাকে—যার কোনো নাম নেই, কোনো পরিণতি নেই, শুধু জ্বলতে থাকা এক বিষাক্ত প্রেম আছে।

অপর্ণার শরীর জুড়ে তখন গ্রীষ্মের বাতাসে ভেজা ঘামের মতো এক অস্থির অনুভূতি। সেই রাতে সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, যখন আকাশে জমে থাকা মেঘগুলো বিদ্যুৎহীন অন্ধকারে বিস্তার করছিল। তার ভেতরের আলো জ্বেলে উঠেছিলো না-জানা এক চিঠির শব্দে, যা সুদীপ পাঠিয়েছিলো – এক লাইন: “তুই জানিস, এখনও তোকে ছুঁতে চাওয়া আমার অপরাধ নয়।” অপর্ণা বুঝে উঠতে পারছিল না, সুদীপ এই কথা কেন লিখল, কী চায় সে এখন? সংসারের নিয়মমাফিক ছাঁচে ফেলা নিজের পরিচিত জগৎ থেকে বেরিয়ে গিয়ে, শুধুমাত্র অতীতের এক গভীর রাতের স্মৃতিকে আঁকড়ে কেউ কতদূর যেতে পারে? তার স্বামী অরিন্দম তখন ঘরে ঘুমাচ্ছে, নিশ্চিন্তে, নিঃশব্দে। আর অপর্ণার শরীর জেগে উঠছে, শব্দের উত্তাপে। সে জানে না, কী করবে। একটা আগুন মনে পুড়তে শুরু করেছে, তবু সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, যেন বারান্দার কাঁঠাল গাছের পাতার শব্দে কোনো উত্তর খুঁজছিল।

সুদীপ তখন তার নিজস্ব ছায়ার মধ্যে বসে আছে – তার একাকীত্বে, তার লিখে যাওয়া কবিতার পাতাগুলোর মধ্যে। অপর্ণাকে লেখা চিঠির পর তার নিজেরই শরীর কাঁপছে; ভয়, লজ্জা, কামনা আর অপরাধবোধ একসঙ্গে এসে আঘাত করছে তাকে। সে জানে, এই সম্পর্ক এখন কেবল একটি স্মৃতি নয় – এটি আবারও জীবন্ত হয়ে উঠছে, প্রতিটি চিঠির প্রতিটি শব্দে। সে অপর্ণার প্রতিক্রিয়া কল্পনা করে – কী বলবে, কী লিখবে, আদৌ লিখবে কিনা। একদিকে সে নিজেকে দোষী ভাবছে – একটা সংসারী নারীর মানসিক স্থিতি নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য – আবার তার গভীর বিশ্বাসও রয়েছে যে, যা ছিল, তা এখনো আছে, বদলায়নি। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে অপর্ণার সেই হাসি – সেই কলেজ জীবনের দুপুরের আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা মুখ, যার দিকে তাকিয়ে সে একদিন বলেছিল, “তোর চোখের ভিতর আমি আমার কবিতা হারিয়ে ফেলি।”

পরদিন সকালে অপর্ণা সুদীপের চিঠির উত্তর লেখে। লেখার সময় তার হাত কাঁপছিল, অথচ সে থামেনি। সে লিখল, “তুই ঠিক বলেছিস, কোনো স্পর্শই যদি ভালোবাসা থেকে আসে, তা অপরাধ নয়। কিন্তু আমার বুকের ভিতরে একটা দেয়াল এখন। তুই যদি তা ভেঙে ঢুকতে চাস, জানি না, আমি বাধা দেবো কিনা।” চিঠি শেষ করে সে জানালায় গিয়ে দাঁড়ায় – সূর্য উঠেছে, ছাদে কাপড় শুকোতে দিয়েছে পাশের বউটি, রাস্তায় স্কুল বাস থেমেছে। এই বাস্তবতা আর চিঠির ভিতরের সেই গোপন আগুন, এই দুই অস্তিত্বে অপর্ণা নিজেকে বিভক্ত দেখে। এবং ঠিক তখনই সে বুঝতে পারে – তারা দুজন, সুদীপ আর সে, এক নিষিদ্ধ বাস্তবতায় পা রেখেছে, যেখানে কামনা আর স্মৃতি, দুটোই সত্য, কিন্তু স্বীকৃত নয়।

তারাপুকুর রোডের ওপার থেকে সেই সন্ধ্যায় ভেসে আসছিল বাউল সঙ্গীতের অস্পষ্ট ধ্বনি, যেন কেউ মাটির খুব গভীর থেকে গেয়ে উঠছে এক প্রাচীন গান—যার ভাষা শুধু হৃদয় বোঝে, যুক্তি নয়। অপর্ণা তখন ছাদের এক কোণে বসে ছিল, হাতে সুদীপের দ্বিতীয় চিঠি, খুলেও পড়েনি, শুধু চিঠিটার ওজন টের পাচ্ছিল হাতের পাতায়। বাতাসে গন্ধ ছিল জ্বলা কয়লার, পাকা জামরুলের, আর এক অপার্থিব উত্তরের, যেটা সে এখনও খুঁজে পায়নি। তার শরীর নিঃশব্দে জেগে উঠছিল, অথচ সে নিজেকে বলছিল—এটা ভুল নয়, এটুকু ভালোবাসা তো মানুষের স্বাভাবিক চাওয়া। সে জানে, তার জীবনে যে শূন্যতা জমেছে, তা অরিন্দম পূরণ করতে পারেনি—সে প্রতিদিন খবরের কাগজ পড়ে, নির্দিষ্ট সময়ে অফিস যায়, নির্দিষ্ট সময়ে খায়, ঘুমায়—কিন্তু অপর্ণার ভিতরে যে শব্দেরা ঘুরে বেড়ায়, তার জন্য সে কোনো দরজা খুলে দেয়নি। আর সুদীপ? সুদীপ তাকে সেই নামহীন ভাষায় ডেকেছিল, যা কেবল দুটি আত্মার মধ্যেই উচ্চারিত হয়।

সুদীপ তখন লাল কাগজে একটা কবিতা লিখে চলেছে—তার শব্দগুলো কাঁপছে, যেমন শরীর কাঁপে প্রলয়ের ঠিক আগে। সে লিখছে, “তোর কাঁধে যদি মাথা রাখতাম, আজও, জানিস তুই, আমার ছায়ার রঙ বদলে যেত।” তারপর হঠাৎ থেমে যায়। সে জানে না, অপর্ণা কী পড়ছে, কী ভাবছে। চিঠির পরে চিঠি লেখা যেন তাকে আরও গভীরে ডুবিয়ে দিচ্ছে—সেই জলের নিচে, যেখানে আলো নেই, কিন্তু শব্দের তীব্রতা আছে। তার বন্ধু অনিমেষ বলে—”তুই কেন আবার যাচ্ছিস সেই পেছনের দিকে?” সুদীপ উত্তর দিতে পারে না। শুধু ভাবে, এই প্রেম তার কাছে কোনো ছেলেমানুষী নয়—এ এক ভাষাহীন আর্তি, যা শরীর ছুঁয়ে যায়, অথচ শরীরেই থেমে থাকে না।

রাত দশটার পরে অপর্ণা সুদীপের চিঠিটা খুলে পড়ে। সেখানে লেখা—“আজ তোর গায়ের গন্ধ মনে পড়ছে। জানিস তুই, তোর শরীর মানেই শুধু শরীর নয়, তুই একটা ভাষা।” অপর্ণা জানে, এই লাইনগুলো একদিন তার দেহে আগুন লাগাবে। কিন্তু তার মধ্যে যে নারী—যে শুধু এক স্ত্রী, এক মা, এক পরিচিত ছায়া হয়ে থেকেছে এতদিন—সে আজ অচেনা হতে চাইছে। অরিন্দম পাশেই ঘুমোচ্ছে তখন, তার নিঃশ্বাসের ভারি শব্দে। অপর্ণা উঠে দাঁড়ায়, আয়নার সামনে যায়। নিজের মুখের দিকে তাকায়। তিরিশের কোঠায় এসে শরীর যেমন হয়, তেমনি তার—কিন্তু চোখ? চোখে এখন সেই আগুন, যে আগুন একদিন সুদীপের চোখে দেখেছিল। অপর্ণা জানে, এই আগুনকে আর দমন করা যাবে না। এই প্রেম, এই কামনা, এই অপরাধ—সবকিছু মিলিয়ে সে এখন সত্যি হয়ে উঠছে। চিঠির কাগজে লেখা প্রতিটি শব্দ যেন এখন তার শরীরের ভিতরে পুড়ে যাচ্ছে, নিঃশব্দে, গভীরভাবে।

****

1000045630.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *