Bangla - ভূতের গল্প

ঝর্ণার জ্বালানি

Spread the love

সঞ্জয় দে


এক

ঝর্ণাটির সামনে দাঁড়িয়ে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে যুবকটি, যেন এই নির্জন জলপ্রপাত এক গভীর নিঃশব্দ ডাক ছুঁড়ে দিচ্ছে তার বুকের ভেতর। গ্রামের একপ্রান্তে ঘন জঙ্গলের পেছনে লুকিয়ে থাকা সেই বিশাল ঝর্ণা, দিনের আলোয় যেন স্বচ্ছ অথচ রহস্যে মোড়া। জনশ্রুতি বলে, এই ঝর্ণায় কেউ একবার ঢুকলে আর ফিরে আসে না—আর এমন নিখোঁজের ঘটনা কেবল একজন নয়, বহুজনের। মানুষজন বলত, তারা নিজের চোখে দেখেছে—কে যেন একদিন হেঁটে হেঁটে ঝর্ণার ধার ঘেঁষে জলের ভেতরে ঢুকে গেল, কিন্তু জল কোনো গতি ছাড়াই স্থির থেকে গেল, আর সেই মানুষ আর ফিরে এল না। পঁচিশ বছর আগে এমনই একদিন যুবকের বাবা, একজন সাহসী গবেষক, এই ঝর্ণার রহস্যভেদ করতে এসে নিখোঁজ হয়েছিলেন। তখন যুবকটি খুব ছোট, কিন্তু সেই দিনের বিভ্রান্ত মুখগুলি, মাতৃহীন আর্তনাদ, আর চিরকাল ভেতরে গেঁথে যাওয়া একটি নিরুত্তর প্রশ্ন—কোথায় গেলেন বাবা?—তা আজও তার ভিতরে থমথম করে জেগে থাকে।

তার মা আজও বাবার একটি ফটোগ্রাফ আঁচলে গুঁজে রাখেন, আর প্রতিদিন সন্ধ্যেয় প্রদীপ জ্বালিয়ে সেই ছবির দিকে তাকিয়ে কিছু প্রার্থনা করেন—যা হয়তো মাফ, নয়তো অপেক্ষার ক্লান্তি। এমন পরিবারগুলোকে গ্রামে লোকে করুণা করে, কেউ কেউ ভয় পায়, কেউ কেউ অবজ্ঞাও করে বলে, “ওরা অভিশপ্ত।” যুবক এসব শুনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে, কিন্তু তার ভেতরে এক চাপা আগ্রহ সবসময় তোলপাড় করে—বাবার ডায়েরির শেষ পাতার সেই লাইনটা: “জল কখনও নিঃশেষ হয় না, তবে কিছু জল স্মৃতি বয়ে নিয়ে যায়।” বাবার পুরনো ঘরটায় একদিন সে এক ছোট লোহার সিন্দুক খুঁজে পায়, যার মধ্যে রয়েছে কিছু ছবি, ভেজা নোটবুক, আর একটি কাঠের মানচিত্র যার পিছনে আঁকা অচেনা প্রতীকের রেখাচিত্র। প্রতীকের চারপাশে গায়ে গায়ে লেখা কিছু শব্দ—“সময় যেখানে স্তব্ধ, সেখানে ঘুমায় সত্য”—যা দেখে যুবকের ভিতর কেমন যেন শীতলতা বয়ে যায়। সেই রাতেই তার ঘুম ভাঙে অদ্ভুত এক শব্দে—একধরনের সুরেলা ঝর্ণার আওয়াজ, যেন জলের মধ্যেই কেউ কিছু বলছে, ডাকছে।

সকালের আলোয় সেই শব্দ স্বাভাবিক মনে হয়, কিন্তু ভিতরের কাঁপন কিছুতেই থামে না। যুবক সিদ্ধান্ত নেয় সে যাবে, একবার অন্তত দেখবে, কী এমন আছে যে সবাই হারিয়ে যায় আর ফিরে আসে না। সে তার বন্ধুবান্ধব কাউকে বলে না, মাকে শুধু জানায় সে জঙ্গলের পথে কিছু ছবি তুলতে যাচ্ছে—যা সে মাঝেমধ্যে করেই থাকে। দুপুরের রোদ কাঁধে নিয়ে সে হেঁটে হেঁটে পৌঁছায় ঝর্ণার পাশে। সেখানে গিয়েই প্রথম সে অনুভব করে চারপাশে সময় কেমন ধীরে চলতে লাগল, গাছপালার শব্দ বন্ধ, পাখির ডাক থেমে গেল, কেবল ঝর্ণার জল পড়ছে গভীর গর্জনে। কিন্তু সে গর্জন যেন এক টান, এক আহ্বান। সে পাথরের উপরে বসে, বাবার ডায়েরি থেকে একটি পাতায় লেখা শব্দ মিলিয়ে দেখে আশেপাশে কোনো প্রতীক আছে কিনা। হঠাৎ চোখে পড়ে—ঝর্ণার বাঁ পাশে খোদাই করা এক অদ্ভুত প্রতীক, যা সেই মানচিত্রের ছবির সাথে মিলে যায়। সে জলের কাছে এগিয়ে যায়, হালকা হাত দিয়ে ছোঁয়। মুহূর্তেই জল যেন নীলচে হয়ে ওঠে, এবং তার বুকের মধ্যে ভেসে ওঠে একটি অস্পষ্ট মুখ—আধো চোখ বন্ধ এক মহিলার মুখ, যার চুল জলে মিশে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

তাকে মনে হয় যেন জলেই কেউ লুকিয়ে আছে—নয়তো জলই কোনো প্রাণী। সে দ্রুত পেছনে সরে আসে, কিন্তু সেই মুখ মনে গেঁথে থাকে। বাড়ি ফিরে তার মা তাকে দেখে চমকে ওঠেন, বলেন তার মুখ এত ফ্যাকাসে কেন, সে কিছু খেয়েছে কিনা। যুবক কেবল মাথা নাড়ে। রাতে সে খেতে বসে, কিন্তু খেতে পারছে না। ঘরের জানালার বাইরে আবার সেই সুরেলা শব্দ, যেন ঝর্ণার জল গুনগুন করে তার নাম নিচ্ছে। সে মনে মনে ভাবে, “আমি কী খুঁজছি—বাবাকে? না কি নিজেকেই?” ঘুম আসে না। রাত গভীর হলে সে আবার সেই মানচিত্র আর ডায়েরি খুলে বসে, খুঁটিয়ে দেখে প্রতিটি লাইন। এক জায়গায় লেখা আছে: “ভিতরে যাবার পথ, বাইরে ফিরবার নয়। তাই নিজেকে রেখে যেতে হবে সেই শেষ ঢেউয়ের কাছে।” তার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। নিজের অজান্তেই সে জানে—এই ঝর্ণা শুধু জল নয়, এ এক আয়না, এক দরজা, যেখানে হারিয়ে যায় সময়, আর থেকে যায় অভিশপ্ত কিছু সত্য।

দুই

পরদিন সকালে যুবকের ঘুম ভাঙে চমকে উঠে। তার দেহ ভারী, চোখের নিচে কালো ছাপ। রাতটা যেন ঘুমিয়ে নয়, বেঁচে থাকার লড়াইয়ে কেটেছে। তবে অদ্ভুতভাবে, তার ভিতরে ভয় নেই, বরং এক রকম আকর্ষণ, যেন কিছু তাকে জড়িয়ে ধরেছে। সে উঠে সোজা চলে যায় পুরনো আলমারির কাছে, যেখানে বাবার পুরনো বইপত্র রাখা। সেখানেই একদিন আগে দেখা লোহার সিন্দুকটা আবার খুলে দেখে সে—ভেতরে বাবার সেই পুরনো খাতা। খাতার মলাটে বড় করে লেখা: “জলরেখার অন্তঃপট”। খাতার ভেতরের লেখা খুব অস্পষ্ট—জলের ছোপে ঝাপসা হয়ে গিয়েছে, কিছু পৃষ্ঠা তো পুরোপুরি মুছে গেছে। কিন্তু কয়েকটি পৃষ্ঠা এখনও পড়ার উপযোগী। একটি পাতায় বাবার হাতে লেখা একটি বাক্য—“যে জল কথা বলে, সে তোমাকে পথ দেখায়। শুধু শুনতে শিখতে হবে।” পাতার পাশে আঁকা এক গোল চক্রী চিহ্ন—যা দেখতে অনেকটা ঝর্ণার স্রোতের কেন্দ্রবিন্দুর মত।

তবে সবচেয়ে ভয়ানক অংশ আসে পরের পাতায়। সেখানে বাবার লেখা: “আজ আমি জলরেখার ধারে বসে তার শ্বাস শুনলাম। সে আমার নাম নিচ্ছে। তার ভিতরে কেউ আছে—কিন্তু সে মানুষ নয়। আমি দেখলাম ছায়া, তার চোখে জল, অথচ সে কাঁদছে না। সে আমায় চায়।” যুবকের রক্ত যেন জমে যায়, কারণ এই একই অনুভব সে গতরাতে করেছে, সেই জলছোঁয়ার মুহূর্তে। সে বুঝে যায়, এই খাতা কেবল লেখা নয়, এটি এক মানসিক রেকর্ড—এক সময়ের গভীর অভিজ্ঞতা, যা জল দিয়ে লেখা, আর জল দিয়েই ব্যাখ্যা করতে হবে। আরেকটি পাতায় তার চোখ আটকে যায়—এক গোলকধাঁধার মত নকশা, যার মাঝখানে লেখা: “ঝর্ণার কক্ষ”। সেই শব্দটার দিকে তাকিয়ে থাকতেই তার মাথার ভেতরে যেন কিসের আওয়াজ আসে—ঝর্ণার গর্জনের মত, কিন্তু তার ভেতরে অনেক ক্ষীণ আওয়াজ মিশে আছে, ঠিক যেন কেউ বলে, “ফিরে এসো।”

সে ঠিক করে, খাতার প্রতিটি চিহ্ন বোঝার চেষ্টা করবে। ডায়েরির একদম পেছনের দিকে বাবার হাতের লেখা কিছু সংখ্যার বিন্যাস দেখা যায়, যেগুলো এক ধরনের ক্যালেন্ডারের মত দেখতে—কিন্তু দিন-তারিখ নয়, বরং সময়চক্রের মতো। সে এই সংখ্যা ও চক্র মিলিয়ে খুঁজে পায় যে, এই ঝর্ণার পানি নাকি এক বিশেষ চন্দ্ররাত্রিতে আলাদা হয়ে ওঠে। সেই বিশেষ রাতে, যখন পূর্ণিমার আলো ঝর্ণার জলে পড়ে, তখন এই ঝর্ণা কেবল জল নয়—তা এক দরজা হয়ে ওঠে, যেটি খোলা থাকে মাত্র এক ঘণ্টা। সেই সময়ই যুবকের বাবা ঢুকেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “আমি ফিরবো, যদি সময় আমায় ফিরতে দেয়।” এই বাক্য পড়ে যুবকের চোখে জল চলে আসে। তার বাবার কণ্ঠ যেন অনুভব করে সে—এক রকম আশ্বাস, আবার এক গভীর শূন্যতাও।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে আসে। মা বাইরে উঠানে পাতা কুড়িয়ে আগুন জ্বালাচ্ছেন। যুবক ধীরে ধীরে গিয়ে মায়ের পাশে বসে। মা বলে, “বাবার স্বপ্ন দেখলাম কালরাতে। কিছু বলছিল, কিন্তু কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না, শুধু ঝর্ণার শব্দ।” যুবক চমকে উঠে তাকায় মায়ের দিকে। সে এবার মাকে ডায়েরির কথা বলে না, কিন্তু অনুভব করে—ঝর্ণা যেন কেবল তাকে নয়, মাকেও ছুঁয়ে ফেলেছে। সেই রাতেই, পুকুরঘাটের ধারে বসে যুবক আকাশের দিকে তাকায়। পূর্ণিমার আলো জলে পড়ে ঝিকমিক করছে। সে ভাবে—আর মাত্র চার রাত বাকি। যদি এই খাতা সত্যি হয়, তাহলে চার রাত পরে সেই দরজা আবার খুলবে। আর এবার সে একা যাবে না, সে প্রস্তুত হয়ে যাবে। তার সামনে রয়েছে এক চিহ্নিত দিন, এক সুযোগ—সবকিছুর উত্তর জানার, তার বাবাকে খুঁজে পাওয়ার, কিংবা নিজের ভেতরে এক অনন্ত অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার।

তিন

বিকেলটা ছায়াময় হয়ে ওঠে। কুয়াশার মত হালকা ধুলো বাতাসে ভাসে, আর দূরের ঝর্ণার গর্জন যেন দিনের আলোর সাথেও প্রতিধ্বনি তুলছে। যুবক গ্রামের এক প্রান্তে থাকা সেই বৃদ্ধ শিক্ষকের বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে—যার কথা সে ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছে। ওই বৃদ্ধ একসময় তার বাবার সঙ্গী ছিলেন, স্থানীয় ইতিহাস, লোককথা ও সংস্কৃতি বিষয়ে গভীর জ্ঞান রাখতেন। লোকেরা বলে, তিনি নাকি একসময় ঝর্ণার রহস্য নিয়ে গবেষণা করেছিলেন, তারপর হঠাৎ সব ছেড়ে নিঃসঙ্গ জীবন বেছে নেন। যুবকের মনে হয়, যদি কেউ জানে সত্যিকারের ইতিহাস, তবে সেই মানুষটিই। সে ধীরে ধীরে মাটির রাস্তা দিয়ে হেঁটে পৌঁছায় ঝাউবন ঘেরা ছোট কুঁড়ে ঘরের সামনে—ঝুলে থাকা একাকী কাঁঠালপাতা দরজার ওপারে যেন সময় নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে।

ভিতর থেকে একটি কাশি ও হাঁপানির শব্দ আসে। দরজায় টোকা দিতেই একটি ধুসর গলার ডাক—“কে?” যুবক বলে, “আমি…নাম জানেন না, কিন্তু আমার বাবা আপনার বন্ধু ছিলেন। আমি তাঁর ছেলেই। আপনি কি একটু সময় দেবেন?” কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা, তারপর ধীরে ধীরে দরজাটা খোলে। চোখে মোটা চশমা, কাঁধে চাদর জড়ানো, কুঁকড়ে যাওয়া এক বৃদ্ধ তাকিয়ে থাকে যুবকের দিকে। তার মুখে বিস্ময় নয়, যেন একটা পূর্বজানা অপেক্ষার স্বস্তি। তিনি বলেন, “তুই এসেছিস? আমি জানতাম, একদিন ঠিক আসবি।” ভিতরে বসার জন্য ইশারা করেন। ঘরের ভেতর ধুলোপড়া বই, পুরনো নকশা, শুকনো লতা দিয়ে গাঁথা এক ধ্বংসপ্রায় মানচিত্র দেয়ালে ঝোলানো। বাতাসে একধরনের বুনো গন্ধ, যা বইয়ের পাতার সাথেও যেন মিশে আছে। বৃদ্ধ ধীরে ধীরে বলে উঠলেন, “তোর বাবা খুব সাহসী ছিল… কিন্তু তার চেয়েও বেশি ছিল অস্থির।”

যুবক তার কাছে বাবার খাতার কথা বলে, মানচিত্রের প্রতীক দেখায়, ঝর্ণার নীল জল ও সেই মুখের কথা বলে। বৃদ্ধ গভীরভাবে শোনেন। তারপর উঠে গিয়ে একটি কাঠের বাক্স থেকে বের করেন এক পুরনো স্ক্রল—চামড়ায় মোড়া, যার গায়ে আঁকা সেই একই গোল চক্রী প্রতীক। তিনি বলেন, “এইটা বহু বছর আগে পাওয়া… ওই ঝর্ণার পাড়ে কাদা মাটির নিচে চাপা ছিল। কেউ জানে না, কবে তৈরি। এই প্রতীকটা আসলে একটা দিক নির্দেশ করে—কোথাও এক জায়গায় সময় আটকে আছে।” যুবক বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে, “সময় আটকে আছে মানে?” বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করে বলে, “এই ঝর্ণা কোনো সাধারণ জলপ্রপাত নয়। এটা একটা সীমান্ত, যেখানে বাস্তব আর স্মৃতি একে অপরকে ছায়ার মত অনুসরণ করে। তোর বাবা সেই সীমান্ত পার হয়েছিল, কিন্তু সে ফিরতে পারেনি, কারণ সে সময়ের ভিতরে ঢুকে পড়েছিল।”

যুবকের কণ্ঠ ভারী হয়ে ওঠে। “তাহলে কি আমার বাবার আর ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই?”—এই প্রশ্ন তার কণ্ঠে যেন আর্তনাদ হয়ে ওঠে। বৃদ্ধ বলে, “সম্ভাবনা সবসময় থাকে, কিন্তু মূল্যও দিতে হয়। তুমি যদি প্রবেশ করতে চাও, তবে প্রস্তুত থাকতে হবে নিজের আত্মা নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে। ওই জলের নিচে যা আছে, তা কেবল বাহ্যিক নয়—তা তোমার ভিতরের ভয়, গ্লানি, স্বপ্ন—সবকিছুর প্রতিফলন।” তিনি তার সামনে একটি ছোট কাঁসার পাত্রে জল দেন। জলটা স্পর্শ করতেই যুবকের মনে হয়, সে আবার সেই মুখ দেখল—আধো চোখে জল মাখা, যেন কেউ তাকে তার নাম ধরে ডাকছে। ঘরের আলো হালকা কেঁপে ওঠে। বৃদ্ধ চোখ মেলে শুধু বলেন, “ঝর্ণার সময় এবার ফিরছে। তোমার রক্তে তার ডাক আছে। তবে মনে রেখো—ভিতরে যাওয়ার আগে দরজা বন্ধ হয়ে গেলে, কেউ আর নাম ধরে ডাকে না। শুধু ছায়া থেকে যায়।”

চার

চতুর্থ রাত, পূর্ণিমার আগের দিন। আকাশে চাঁদের আলো এখনো পূর্ণ হয়নি, তবে ঝর্ণার উপর পড়ে এক অনির্বচনীয় ঝিলিক। যুবক সারাদিন খাতা, মানচিত্র আর বৃদ্ধ শিক্ষকের বলা প্রতিটি কথা মনে করে প্রস্তুতি নেয়। পিঠে একটি পুরনো ব্যাগ, যার ভেতরে রয়েছে তার বাবার খাতা, একটি ছোট টর্চ, একটি লাল সুতোয় বাঁধা মায়ের দেওয়া কাঁথার টুকরো, আর মাটির এক ঠোঙায় রাখা কিছু শুকনো তুলসীপাতা। সন্ধ্যা নামতেই সে নিরবে বেরিয়ে পড়ে, কাউকে কিছু না জানিয়ে। বাতাস ভারী, নিস্তব্ধ, যেন গাছপালাও তার গমনপথে নিঃশব্দ শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। ঝর্ণার দিকে যেতে যেতে তার কানে আবার ভেসে আসে সেই সুরেলা জলঘট, যা শুধুমাত্র তার বুকের গভীরে বেজে ওঠে।

ঝর্ণার ধারে পৌঁছেই সে দেখে, জল যেন আগের চেয়ে বেশি নীল, আর সেই নীলের ভিতর আলো ঝিকমিক করছে, যেন নিচে কোথাও আগুন জ্বলছে। কিন্তু জল গরম নয়, বরং ঠান্ডা, গভীর। ঝর্ণার বাঁ পাশে, সেই প্রতীকের নিচে হালকা কুয়াশার মত ধোঁয়া উঠছে—যা সে আগে দেখেনি। সে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যায়, বাবার ডায়েরির সেই লাইনটি মনে পড়ে, “দরজা শুধু তখনই খোলে, যখন তুমি ভয়কে পেছনে ফেলো।” যুবক তার দুই পা জলে রাখে। মুহূর্তেই তার গায়ে এক শীতলতা নেমে আসে, যেন শত শত বছর পুরোনো জল তাকে ছুঁয়ে গেল। সে ধীরে ধীরে হাঁটু পর্যন্ত জলে ডুবে যায়, আর হঠাৎ তার নিচের মাটি নড়ে ওঠে—না, নড়ে ওঠে না, বরং মিলিয়ে যায়। সে পড়ে যায় এক নিমগ্ন অন্ধকারে, কিন্তু কোনো ঝাঁকুনি নেই, ব্যথা নেই—শুধু একরকম ভাসমানতা।

চোখ খুলতেই সে দেখতে পায় এক আলোর রেখা তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। কোথাও জল নেই, কোথাও মাটি নেই—সে যেন একটি অনন্ত নীল স্তরে ঝুলে আছে। সামনে দেখতে পায় একটি ঘূর্ণায়মান গোল আলো, তার চারপাশে ভাসছে ছায়ার মত কিছু অবয়ব, যাদের চেহারা স্পষ্ট নয়, তবে মানবাকৃতি। একটি ছায়া তার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে—তার চোখে নয়, কণ্ঠে নয়, বরং মনে এক স্বর—“তুমি এসেছো। সময় আমাদের অপেক্ষা করছিল।” সেই ছায়া ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে, এবং যুবক দেখতে পায়, সেটি তার বাবার মুখ! কিন্তু মুখে নেই কোনো চিন্তার রেখা, নেই কোনো স্মৃতি—শুধু এক স্থিরতা। সে বাবার নাম ধরে ডাক দেয়, “বাবা!” কিন্তু কোনো সাড়া নেই। বাবার চোখ যেন তাকিয়ে আছে তার দিকে, অথচ কিছু দেখছে না। তার চারপাশে আরও কিছু ছায়া ভেসে উঠে—কেউ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, কেউ হাত ছুঁড়ে যেন কিছু ধরতে চাইছে, কেউ আবার কাঁধে মুখ গুঁজে কাঁদছে।

এই দৃশ্য যুবকের শিরায় শিরায় কাঁপন তুললেও, সে পিছিয়ে যায় না। সে সামনে এগিয়ে বাবার হাত ছুঁতে চেষ্টা করে, কিন্তু তার আঙুল বাবার হাত ছুঁয়ে যায় না—একটি স্বচ্ছ পর্দার মত বাধা দেয়। হঠাৎ সে দেখে, সেই গোল আলো এক মুহূর্তের জন্য ফেটে গিয়ে তৈরি হয় একটি পথ—একটি সিঁড়ির মত আলো, যা ঝর্ণার নিচের অন্ধকার থেকে উঠে গেছে উপরের দিকে। তার মনের ভেতর একটি মৃদু কণ্ঠ বলে, “এই সিঁড়ি যদি পার হতে পারো, তুমি ফিরে যেতে পারো, তবে কিছু নিয়ে নয়—ফেলতে হবে স্মৃতি, ফেলতে হবে ভয়, ফেলতে হবে চাওয়া।” যুবক বুঝে যায়, এটি শুধুমাত্র পিতাকে খুঁজে পাওয়ার অভিযান নয়—এটি নিজের ভেতরের সত্যকে মেনে নেওয়ার যাত্রা। সে দাঁড়িয়ে থাকে—একদিকে বাবার হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি, অন্যদিকে তার নিজের অস্তিত্বের সিদ্ধান্ত। সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রাখতেই আলোর সিঁড়ি ঝলসে ওঠে, আর পেছনে ছায়ারা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে সেই একই কণ্ঠে একটি বাক্য বলে—“স্মৃতি যদি সত্য হয়, তবে জলও তার জ্বালানি।”

পাঁচ

যুবক যখন আলোর সেই সিঁড়ির পথ ধরে উঠে আসছে, তখন মনে হয় তার চারপাশে সময় আর বাস্তবতা এক অদৃশ্য সুতায় জড়িয়ে গেছে। প্রতিটি ধাপেই তার মনে হয় যেন সে কোনো না কোনো স্মৃতিকে পেছনে ফেলে আসছে, যেমন মায়ের মুখ, শৈশবের সেই বাঁশবাগান, বাবার হাসি—সব ধীরে ধীরে আবছা হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ আলো থেমে যায়, আর সে নিজেকে খুঁজে পায় এক অদ্ভুত জায়গায়—এক শহরের মত দেখতে, কিন্তু সেখানে কোনো মানুষ নেই, কোনো শব্দ নেই, কেবল ধোঁয়া আর ছায়া। প্রতিটি গলি, প্রতিটি বাড়ি যেন একেকটি নিঃশ্বাসে গড়া, যার দেয়াল স্পষ্ট নয়, কেবল দোল খাচ্ছে নীরব কুয়াশায়। এই শহরের আকাশ কালো নয়, সাদা নয়—বরং ধূসর, যেন দিনরাত্রির মাঝামাঝি সময় চিরতরে আটকে গেছে এখানে।

হেঁটে হেঁটে সে দেখতে পায়, ছায়ার মত কিছু অবয়ব এগিয়ে চলছে, কিছু বসে আছে কোনো বেঞ্চে, কিছু তাকিয়ে আছে দূরের কোনো শূন্যতায়। তাদের চোখ আছে, মুখ আছে, কিন্তু জীবন্ত নয়—যেন তারা কেবল অস্তিত্বের স্মৃতি মাত্র। তাদের মধ্যে কেউ কেউ চেনা লাগে, আবার কেউ সম্পূর্ণ অজানা, অথচ মনে হয় কখনো কোথাও দেখেছে। এক মোড়ে সে দেখতে পায় একটি ছোট দোকান, তার সামনে বসে আছে এক বৃদ্ধ, যার চোখের দৃষ্টি সম্পূর্ণ ফাঁকা। যুবক ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কী জানেন, আমি কোথায়?” বৃদ্ধ উত্তর দেয় না, কেবল তার সামনে রাখা একটি কাঁচের পাত্র দেখায়, যার ভিতরে একটি ভাসমান মুখ—একটি শিশুর মুখ—আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে জলের নিচে। যুবকের গলা শুকিয়ে আসে।

একটি দীর্ঘ গলিপথ ধরে হেঁটে গেলে সে দেখতে পায়, একখানি বাড়ি, যার দরজার সামনে বসে আছে একজন মহিলা—চোখ বন্ধ, কিন্তু চোখের কোনা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, অথচ মুখে কোনো ব্যথার চিহ্ন নেই। সে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কাঁদছেন কেন?” মহিলা চোখ না খুলেই বলে, “কারণ আমার কান্না কেউ শুনতে পারে না। আমি সেই স্তব্ধতার বন্দি, যেখানে কেউ ফেরা মানে হারানো।” যুবক বুঝে ওঠে, এই শহর সেই সমস্ত আত্মাদের আশ্রয়—যারা হারিয়েছে নিজের পরিচয়, নিজের সময়, নিজের কথা বলার অধিকার। এরা কারা? তার বাবাও কি এই শহরের কোনো এক প্রান্তে আটকে আছে?

হঠাৎ তার সামনে ভেসে ওঠে একটি পরিচিত ছায়া—উঁচু লম্বা গড়ন, কাঁধে খয়েরি রঙের জ্যাকেট। যুবক চিৎকার করে ওঠে, “বাবা!” কিন্তু সেই ছায়া কোনো সাড়া না দিয়ে ধীরে ধীরে গলিপথের অন্য দিকে হেঁটে চলে যায়। যুবক দৌড়ে তার পিছু নেয়, সেই ছায়া ঘুরে যায় একটি সরু পথ ধরে, শেষ পর্যন্ত একটি দরজার সামনে থেমে দাঁড়ায়। দরজার উপর লেখা—“স্মৃতি থেকে বেরোলে, সত্য আর পুরোনো থাকে না।” সে যখন ছায়াটির কাছে পৌঁছয়, তখন ছায়াটি ধীরে ধীরে পেছনে ঘোরে, আর যুবক দেখে—এটি তার বাবার মুখ, কিন্তু তাতে কোনো চিন্তার রেখা নেই, কেবল শূন্যতা। বাবা তাকে দেখে না, কেবল বলে, “তুমি এলে…তবে ফিরবে না, জানো তো?”

এই বাক্য শুনে যুবক কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। তার মন বলে, “না, আমি ফিরব, তবে কিছু সঙ্গে করে—not just memory, but truth.” সে বাবার চোখে চোখ রাখে, ধীরে ধীরে বলে, “আমি তোমাকে নিতে এসেছি। তুমি ভুলে গেছ, আমায়, মাকে, নিজের নামকেও। কিন্তু তোমার রক্ত আমার শরীরে, আর সেই রক্তই তোমার পথ হয়ে উঠবে।” সেই মুহূর্তে বাতাসে একটা ভাঙা ঘণ্টার আওয়াজ শোনা যায়, যেন সময়ের দরজা আবার খুলছে। বাবার চোখে একটুখানি আলো জ্বলে ওঠে, আর ছায়া ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে যেতে বলে, “জল মনে রাখে। তাকে জাগিয়ে তুলো।” শহরের ছায়া যেন এক ঝড়ের মাঝে কেঁপে ওঠে, আর যুবক বুঝে যায়—এই ছায়ার শহর শুধু তার বাবার নয়, এটি এক অভিশপ্ত দৃষ্টিকোণ, যেখানে হারিয়ে যাওয়া আত্মারা নিজেরই প্রতিবিম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে বেরোতে হবে। এখনই।

ছয়

রুদ্রর শরীর ঠান্ডায় কাঁপছিল, অথচ আশেপাশে বাতাস ছিল নিঃশব্দ আর নিস্তব্ধ। ঝর্ণার জলরেখা বেয়ে সে যে অদ্ভুত গুহার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে, তা যেন সময়ের বাইরের কোনও জায়গা। দেওয়ালে জমে থাকা শ্যাওলা, মাটির নিচে গর্জন করে বয়ে চলা কোন অজানা নদী, আর দূরে ক্ষীণ আলোয় নাচতে থাকা ছায়াগুলো—সব মিলিয়ে জায়গাটিকে যেন জীবন্ত করে তুলেছিল। তার পায়ের নিচে একটি পাথরের সিঁড়ি নেমে গেছে অন্ধকারে, যার শেষ দেখা যায় না। রুদ্র একবার পিছনে ফিরে তাকাল—কিন্তু সেই পথ আর খোলা ছিল না, যেন ঝর্ণা তাকে গিলে ফেলেছে। কোনও উপায় ছিল না, সে পা বাড়াল নিচের দিকে।

সিঁড়ি নামার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের শব্দ বদলে যাচ্ছিল। শুরুতে ঝর্ণার গর্জন, তারপর ধীরে ধীরে সেই শব্দ রূপ নিল কান্নার মতো একধরনের হাহাকারি সুরে। রুদ্রর মাথার ভিতরে কেউ যেন ফিসফিস করে বলছে, “চোখ বন্ধ করো না… অন্ধকারের মাঝেও আলোর কণাগুলো লুকিয়ে থাকে…” গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল, কিন্তু সে জানত থামা যাবে না। হঠাৎ করেই সে দেখতে পেল সিঁড়ির ধারে একটি ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে, যাকে ঘিরে ছিল নীলাভ এক আলোর বলয়। রুদ্র থমকে দাঁড়াল, হৃদপিন্ডের স্পন্দন যেন কানে ধ্বনিত হতে লাগল। ছায়ামূর্তিটি ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এল—কিন্তু বিস্ময়ের বিষয়, সে ভয়ের নয়, বরং একধরনের শান্তির আবেশ নিয়ে উপস্থিত হল। তার কণ্ঠে নিঃসৃত হল এক করুণ স্বর, “তুমি কি তার ছেলে? সেই অর্ণবের?”

রুদ্রর বুক ধক করে উঠল। এই নামটা এখানে কিভাবে এল? অর্ণব, তার বাবা, সেই মানুষ যিনি বছর দশেক আগে এই ঝর্ণার রহস্য খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন। সে কাঁপা গলায় বলল, “হ্যাঁ… আপনি তাকে চিনতেন?” ছায়ামূর্তিটি সামান্য মাথা নোয়াল, আর বলল, “অর্ণব আমাদের বাঁচাতে চেয়েছিল, কিন্তু সময় শেষ হয়ে গিয়েছিল। এই ঝর্ণা শুধু জল দেয় না, এই ঝর্ণা শোষণ করে আত্মা, যাদের হৃদয়ে প্রশ্ন থেকে যায়, যাদের মৃত্যু হয়নি মনের গভীর থেকে…” কথাগুলো শেষ না হতেই রুদ্রর চারপাশে যেন আরও অসংখ্য ছায়া জড়ো হতে লাগল—তাদের চোখে ছিল নীরব আহ্বান, অস্ফুট আর্তনাদ। রুদ্র বুঝল, এই অন্ধকারের নিচে কেবল রহস্য নয়, একটি অভিশাপ জমে আছে—যা তার বাবাকেও গিলে ফেলেছিল।

সে সাহস করে জিজ্ঞেস করল, “আপনারা এখানে কেন? কেন মুক্তি পাননি?” ছায়াটি উত্তর দিল, “কারণ আমাদের মৃত্যুর মুহূর্তগুলো অপূর্ণ, অসম্পূর্ণ… কেউ কেউ আত্মাহীনভাবে এসেছিল, কেউ এসেছে অপরাধবোধে, কেউ এসেছে কোনও এক অস্পষ্ট টান অনুভব করে। আর এই সিঁড়ি—এই সিঁড়ি নামা মানেই সেই ছায়ার জগতে প্রবেশ করা, যেখানে কোনও সত্য চাপা পড়ে থাকে না, যেখানে নিজেকেই মুখোমুখি হতে হয় নিজের অতীতের।” রুদ্রর গলায় যেন এক চাবি গেঁথে গেল। নিজের বাবার মৃত্যুর শেষ সত্য জানার জন্য আজ সে এখানে, কিন্তু তার নিজের আত্মাও কি ধীরে ধীরে ছায়ায় পরিণত হচ্ছে না? অজানা এক ছায়া হঠাৎ তার কাঁধে হাত রাখল, আর বলল, “শেষ পর্যন্ত যাবা, রুদ্র? যেখান থেকে আর ফেরা নেই?” অন্ধকারের গভীরে তখনও সেই সিঁড়ি নেমেই চলেছে, নেমেই চলেছে—এক অনন্ত ছায়ার অতল গহ্বরে।

সাত

ঝর্ণার গর্জন যেন আরও গভীর হয়েছে, যেন তার বুক থেকে বেরিয়ে আসছে শতাব্দীর জমে থাকা হাহাকার। নীলয় যখন ধীরে ধীরে অন্ধকার গুহার মধ্যে এগিয়ে যাচ্ছিল, তার মনে হচ্ছিল অদৃশ্য কেউ তার পেছনে পা ফেলে চলেছে। বাতাসের মধ্যে ভেসে আসছিল মৃদু কান্নার শব্দ—যেন কোনো শিশু হারিয়ে গেছে। এই গুহার দেওয়ালগুলো ঘামে ভেজা, ছোঁয়া মাত্রই ঠান্ডা আর কাঁপুনি লাগানো। তার হাতের টর্চ আলোর শলাকা হয়ে যেটুকু পথ আলোকিত করছিল, তাও যেন অন্ধকারের ভেতর গিলে নিচ্ছিল।

এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ সে এক বিশাল গম্বুজাকৃতি কক্ষে পৌঁছায়, যেখানে পাথরের মূর্তি জড়িয়ে রয়েছে এক বিশাল ঝর্ণার জলধারার নিচে। মূর্তির মুখ অদ্ভুত রকম বিকৃত—এক চোখ কোটরে নেই, আরেক চোখ কাঁদছে রক্তের মত দেখতে লাল জল। ঝর্ণার ঠিক নিচে বসে ছিল একজন বৃদ্ধ—তার চোখদুটি খোলা, কিন্তু দৃষ্টি যেন শূন্যে। নীলয় চুপচাপ কাছে যায়। বৃদ্ধ ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে বলে, “তুইও এলি, ওর মতো… তোর বাবার মতো।” তার গলা কেঁপে উঠছিল, চোখ ভরে উঠছিল কোনো না বলা ভয়ের আবেশে। নীলয় চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করে, “আপনি কে? আমার বাবা কোথায়?” বৃদ্ধ চাপা গলায় বলে, “তোদের রক্তেই আছে আলো দেখার ক্ষমতা, কিন্তু আলো দেখলেই অন্ধকার জেগে ওঠে।”

এই বলে বৃদ্ধ এক পাথরের দরজার দিকে ইশারা করে, যেখানে খোদাই করে লেখা ছিল প্রাচীন ভাষায় কিছু শব্দ—যা নীলয় শিখেছিল তার বাবার রেখে যাওয়া নোটবুক থেকে। সেগুলোর মানে দাঁড়ায়: “আত্মারা শান্তি পায় যদি কেউ সত্য স্বীকার করে।” দরজার ওপাশে ছিল এক গুহা—একটা কুয়োর মতো গভীর খাদ, যার নিচ থেকে উঠছিল ফিসফিসানি, এক সঙ্গে অনেক কণ্ঠস্বরের। নীলয় সেই দরজার গা ছুঁয়ে যখন প্রবেশ করল, তার টর্চ হঠাৎ নিভে গেল। অন্ধকারে সে শুনতে পেল একটি পরিচিত কণ্ঠ—একদম তার বাবার গলার মতো—যা বলছে, “সত্যিটা এখন তোর ওপর নির্ভর করছে।” গলার স্বর কেঁপে উঠল তার সারা শরীর জুড়ে, চোখের সামনে ভেসে উঠল একটি দৃশ্য—তার বাবা, কাঁধে ব্যাগ, চোখে দৃঢ়তা, গুহার এইখানে দাঁড়িয়ে, অনেক বছর আগে।

আচমকা চারপাশ থেকে বেরিয়ে এল ছায়ামূর্তি, তাদের চোখ নেই, মুখ নেই, শুধু ছায়া আর থাবা। নীলয় বুঝতে পারল, ওরা আত্মারা, যারা সত্য না জেনে এই গুহায় ঢুকেছিল। সে বুক শক্ত করে বাবার লেখা নোটবই খুলে এক লাইন পড়ে ফেলল: “আমি জানি, তোমরা সত্যের প্রহরী, আমি এসেছি জানাতে—আমার বাবা কাউকে হত্যা করেননি, তিনি সত্য জানার জন্য আত্মাহুতি দিয়েছিলেন।” মুহূর্তে চারপাশের ছায়ারা থেমে গেল, ঝর্ণার জল গম্ভীর হয়ে উঠল, আর সেই বৃদ্ধ এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তার কণ্ঠস্বর একবার ফিসফিস করে উঠল, “সত্য বললে আত্মারা শান্তি পায়।”

আট

ঝর্ণার গুহা থেকে বেরিয়ে আসার পথটা যেন সহজ ছিল না। সূর্য তখন ঢলে পড়ছে পশ্চিম আকাশে, কিন্তু ভিতরের সময় যেন অন্য নিয়মে চলে। রাজন ও পিতার আত্মা একসাথে সেই তমসা পেরিয়ে যখন বাইরে পা রাখল, তাদের সামনে ছিল এক স্তব্ধ প্রকৃতি—কোনো পাখির ডাক নেই, শুধু বাতাসে ভেসে আসা ঝর্ণার একটানা গম্ভীর শব্দ। রাজনের শরীর ক্লান্ত, কিন্তু মন ছিল উত্তাল—সে জানত, সে এমন কিছু দেখে এসেছে যা কেউ বিশ্বাস করবে না। পিতার চাহনি ছিল এখন শান্ত, মুখে এক আলোর রেখা, যেন শতাব্দী ধরে আটকে থাকা কোনো বোঝা আজ নামিয়ে দিয়েছে। রাজন তাঁর দিকে তাকিয়ে বলল, “চলুন, এবার মা’র কাছে চলুন, আপনাকে ফিরে পেতে উনি প্রতিদিন ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে ছিলেন।” পিতার মুখে যেন এক অনুচ্চ উচ্চারণ—“তোমাদের ভালোবাসাই ছিল আমার মুক্তির একমাত্র পথ।”

পথে ফিরতে ফিরতে রাজনের কানে যেন বারবার সেই ভূতের ফিসফিসানি ফিরে আসছিল—“ভুলে যেও না, প্রতিটি আত্মা মুক্তি চায়, কিন্তু তা পেতে হলে কাউকে না কাউকে আত্মত্যাগ করতেই হয়।” পেছনে তাকিয়ে ঝর্ণাটাকে তখন আর আগের মতো রহস্যময় লাগছিল না—বরং সেখানে ছিল এক পরিস্কার নদীর মতো ধারা, যেন সমস্ত অভিশাপ ধুয়ে গেছে। কিন্তু রাজন জানত, এই অভিশপ্ত সত্যকে শুধু সে নয়, এই গ্রামের প্রতিটি মানুষকে জানাতে হবে, যাতে আর কোনো সন্তান, আর কোনো বাবা- মা এই জায়গার কাছে হারিয়ে না যায়। সে সিদ্ধান্ত নিল, সে গ্রামে ফিরে সব বলবে, গুহার ভেতরের স্মৃতিগুলি লিপিবদ্ধ করবে, যেন কালক্রমে সে হয়ে ওঠে একটি জীবন্ত কাহিনির ধারক। আর তার পিতাকে নিয়ে যাবে সেই ছাদে, যেখানে তার মা এখনো প্রতিদিন সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে থাকে।

গ্রামে ফিরে রাজনের আগমন যেন এক অলৌকিক দৃশ্যের মতন। বহুদিন পরে হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে ফিরে পেয়ে মা ছুটে এলেন, পিতাকে দেখে তাঁর মুখের ভিতর এক দীর্ঘ নীরবতা; চোখের জলে তিনি বলে উঠলেন, “তুমি ফিরে এসেছো?” রাজন কিছু বলল না, শুধু বাবার হাত ধরে তাঁকে সামনে আনল। গ্রামের মানুষরা প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারল না, তবে যখন রাজন গুহার কথা, ভূতের কাহিনি, আর পিতার মুক্তির যাত্রা বলল, তখন অনেকে অবাক, কেউ বা সংশয়প্রবণ, কেউ ভয়ে স্তব্ধ। কিন্তু পিতার মুখের সেই প্রশান্তি ও চোখের সত্যতা সকল সংশয় কাটিয়ে দিল। সে রাতেই রাজন সেই গুহার পথ বন্ধ করে দিল, আগুন দিয়ে সবগুলো প্রবেশ পথ সিল করে দিল, যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর সেই অন্ধকার অতীতে আটকে না পড়ে।

কিন্তু শেষ রাতে, রাজন যখন নদীর ধারে দাঁড়িয়ে পাথরের ওপর বসেছিল, সে আবার শুনতে পেল সেই চেনা সুর—ভূতের কণ্ঠ, এবার আর ভয়ের নয়, বরং যেন ধন্যবাদ জানানো এক আত্মার গান। ঝর্ণার জলের শব্দে মিশে ছিল এক মৃদু সুর, যেটা কেবল সে শুনতে পারছিল, তার হৃদয় শুনতে পারছিল। সে জানত, গল্পের শেষ হয়েছে, কিন্তু কাহিনির নয়। কারণ সত্য কখনো নিঃশেষ হয় না—সে শুধুই রূপ বদলায়। আর রাজন, সেই রূপান্তরের সাক্ষী হয়ে থেকে গেল, এক নতুন সূর্যের অপেক্ষায়, যেন প্রতিটি রাতের মতো এ গল্পেরও ভোর আছে।

সমাপ্ত

1000045622.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *